হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবীদের শ্রেণীবিভাগ
[সংখ্যাভিত্তিক]
নবী করীম (ﷺ)- এর নিকট হইতে যাঁহারা সরাসরিভাবে হাদীস শ্রবণ করিয়াছেন এবং তাঁহার তরফ হইতে কিছু না কিছু হাদীসও বর্ণনা করিয়াছেন, তাঁহাদের সংখ্যা কিছুমাত্র কম নহে। এ সম্পর্কে হাদীস বর্ণনাকারীদের জীবন চরিত-বিশেষজ্ঞ মুহাদ্দিস ইমাম আলী ইবনে আবু জুরয়া এক প্রশ্নের জওয়াবে বলিয়াছেনঃ
******************************************************
নবী করীম (ﷺ)-এর ইন্তেকালের পূর্বে যাঁহারা তাঁহাকে নিজেদের চক্ষে দেখিতে পাইয়াছেন এবং তাঁহার বানী নিজেদের কর্ণে শ্রবণ করিয়াছেন, তাঁহাদের সংখ্যা স্ত্রী-পুরুষ মিলাইয়া লক্ষাধিক হইবে। তারা প্রত্যেকেই সরাসরি হযরতের নিকট হাদীস শুনিয়া কিংবা অপরের নিকট বর্ণনা পাইয়া হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন।
বর্তমান যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ হাদীস বিজ্ঞানবিদ মিসরস্থ জামে আযহারের শিক্ষক মুহাম্মদ আবূ জাহু লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
নবী করীম (ﷺ) প্রায় এক লক্ষ্য চৌদ্দ হাজার সাহাবী রাখিয়া দুনিয়া ত্যাগ করে। তারা নবী করীম (ﷺ)-এর নিকট হাদীস শুনিয়া পাইয়া তাহা বর্ণনা করিয়াছেন। বলা হয়, তারা কোথায় থাকিতেন এবং কোথায় কেমন করিয়া তারা হাদীস শুনিতে পাইলেন? উহার জওয়াব এই যে তারা ছিলেন মক্কা ও মদীনার অধিবাসী, এই শহরদ্বয়ের মধ্যবর্তী এলকার লোক, সাধারণ আরব জনগণ আর যাঁহারা তাঁহার সহিত বিদায় হজ্জে উপস্থিত হইয়াছিলেন তারা। তারা সকলেই রাসূলে করীম (ﷺ)-কে নিজেদের চক্ষে দেখিতে পাইয়াছেন এবং তাঁহার জীবদ্দশায়ই তাঁহার নিকট হইতে হাদীস শুনিতে পাইয়াছেন।
[*************]
মুহাদ্দিস আবূ জুরয়া প্রদত্ত এক বিবরণ অনুযায়ী সাহাবীদের
[এবং নবী করীম (ﷺ)- হইতে কিছু না কিছু বর্ণনা করিয়াছেন, এমন লোকদের] সংখ্যা যদিও লক্ষাধিক ছিল কিন্তু যেসব সাহাব রীতিমত ও গণনাযোগ্য সংখ্যক হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন, আল্লামা যাহবীর মতে তাঁহাদের সংখ্যা ছিল মাত্র এক শত পাঁচজন।
[************] অবশ্য অনুসন্ধান করিলে এই সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাইতে পারে। মুসনাদে আবূ দাউদ তায়ালিসী দ্বিতীয় হিজরী শতকের শেষ ভাগে সংকলিত একখানি হাদিস গ্রন্হ, ইহাতেই প্রায় আড়াই শত সাহাবী হইতে বর্ণিত হইয়াছে।
[****************] ‘উসুদল গাবাহ’ গ্রন্হে হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবীদের সংখ্যা ৭৫৫৪ উল্লেখ করা হইয়াছে। তারা সকলেই রাসূলের নিকট হইতে সরাসরি হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন বলিয়া এই গ্রন্হে দাবি করা হইয়াছে। কিন্তু আল্লামা ইবনে হাজার ইহাতে আপত্তি জানাইয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন যে, সাহাবী নয়-এমন লোকেই ইহাকে গণ্য করা হইয়াছে।
[****************]
আল্লামা যাহবীর মতে এই একশত পাঁচজন সাহাবীর মধ্যে আটাশজন সাহাবী হইতে বিপুল সংখ্যক হাদীস বর্ণিত হইয়াছে। অধিকাংশ মুহাদ্দিসের মতে এই আটাশজন সাহাবীই হইতেছেন সর্বাধিক সংখ্যক হাদীস বর্ণনাকারী। সত্য কথা বলিতে কি, বিরাট হাদীস সম্পদের প্রায় অর্ধেক পরিমাণ এই আটাশজন সাহাবী হইতে বর্ণিত হইয়াছে। মুহাদ্দিসদের সিদ্ধান্ত এই যে, যাঁহারা চল্লিশটির কম হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন, তারা হইতেছেন, ‘কম হাদীস বর্ণনাকারী’। এই ভিত্তিতে অধিক সংখ্যক হাদীস বর্ণনাকারী ও কম সংখ্যক হাদীস বর্ণনাকারী হিসাবে সাহাবাদের চারটি ভাগে বিভক্ত করা যায়ঃ
ক) প্রথম ভাগের সাহাবীঃ যাঁহারা এক হাজার কিংবা ততোধিক হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন।
খ) দ্বিতীয় ভাগের সাহাবীঃ যাঁহাদের নিকট হইতে পাঁচশত কিংবা তদুর্ধ্ব সংখ্যক হাদীস বর্ণিত হইয়াছে।
গ) তৃতীয় ভাগের সাহাবীঃ যাঁহাদের হাদীসের সংখ্যা চল্লিশ কিংবা চল্লিশের অধিক।
ঘ) চতুর্থ ভাগের সাহাবীঃ যাঁহাদের বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা চল্লিশের ক।
[***************]
কিন্তু ঊর্ধ্ব পাঁচশত হইতে নিম্ন সংখ্যা চল্লিশ পর্যন্ত হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবীদের সংখ্যা সমধিক। সেই কারণে তাহাদিগকে আমরা আবার দুই পর্যায়ে বিভক্ত করিতে পারি। একশত হইতে পাঁচশত পর্যন্ত হাদীস বর্ণনাকারী প্রথম পর্যায়ের এবং চল্লিশ হইতে একশত হাদীস পর্যন্ত বর্ণনাকারীরা দ্বিতীয় পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত।
এই ল্ডসীর অনুযায়ী হাদীস বর্ণনাকারী সমস্ত সাহাবীকে মোট পাঁচটি শ্রেণতে বিভক্ত করা চলেঃ
১। যাঁহাদের বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা হাজার কিংবা হাজারের অধিক।
২। যাঁহাদের বর্ণিত হাদীস পাঁচশত কিংবা পাঁচশতের অধিক, কিন্তু হাজার হইতে কম।
৩। যাঁহাদের বর্ণিত হাদীস একশত কিংবা একশতের অধিক, কিন্তু পাঁচশতের কম।
৪। যাঁহাদের বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা চল্লিশ কিংবা চল্লিশ কিংবা চল্লিশের বেশী কিন্তু একশতের কম।
৫। যাঁহাদের বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা চল্লিশ কিংবা চল্লিশের কম।
প্রথম ভাগ
অধিক সংখ্যক হাদীস বিজ্ঞানীর মতে প্রথম শ্রেণতে মাত্র ছয়জন সাহাবী গণ্য হইতে পারেন। তারা হইতেছেনঃ
(১) হযরত আবূ হুরায়রা (রা)
(২) হযরত আয়েশা (রা),
(৩) হযরত আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা),
(৪) হযরত আবদুল্লাহ ইবন উমর (রা),
(৫) হযরত জাবির ইবন আবদুল্লাহ (রা) এবং
(৬) হযরত আনাস ইবন মালিক (রা)।
তাঁহাদের বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা সহস্রাধিক। কিন্তু শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী (র) এই পর্যায়ে মোট আটজন সাহাবীকে গণ্য করিয়াছেন। তিনি ইহাদের সঙ্গে শামিল করিয়াছেন হযরত আবদুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আ’স (রা) ও হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা)-কে।
[**************]
শাহ দেহলভীর এই মত হাদীস বিজ্ঞানের প্রথম শ্রেণীর মনীষীদের মতের বিপরীত। ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল (রা)- ও প্রথমোক্ত ছয়জন সাহাবীকেই সর্বাধিক সংখ্যক হাদীস বর্ণনাকারী বলিয়া উল্লেক করিয়াছেন।
[************]
বস্তুত মুহাদ্দিসরা সাধারণত হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা)-কে এই পর্যায়ে গণ্য করেন নাই’ যদিও তাঁহার বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা সহস্রাধিক।
আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী তাঁহার সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
তিনি এক হাজার একশত সত্তরটি হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। তন্মধ্যে বুখারী ও মুসলিম- উভয় কিতাবে ৪৬ টি এবং স্বতন্ত্রভাবে বুখারী শরীফে ১৬ টি ও মুসলিমে অপর ৫২ টি হাদীস উল্লিখিত হইয়াছে।
[**********]
শাহ ওয়ালীউল্লাহ (র) হযরত আবদুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আ’স (রা)-কে কেন এই পর্যায়ভুক্ত করিতে চাহেন, তাহা বুঝা গেল না। কেননা নির্ভরযোগ্য হিসাব মুতাবিক তাঁহার বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা মাত্র সাতশত।
[**********] এই পরিপ্রেক্ষিতে বলা যাইতে পারে যে, সহস্র কিংবা সহস্রাধিক হাদীসের বর্ণনাকারী সাহাবীর সংখ্যা মাত্র সাতজন এবং তাঁহাদের বর্ণিত মোট হাদীসের সংখ্যা চৌদ্দ হাজার আটশত সত্তরটি।
[***********]
এই ছয়-জন সাহাবী সম্পকের্ক এখানে খানিকটা বিস্তারিত আলোচনা পেশ করা আবশ্যক বোধ হইতেছে। কেননা হাদীস সম্পর্কে দৃঢ় বিশ্বাস ও স্পষ্ট ধারণা সৃষ্টির জন্য এই আলোচনা অপরিহার্য।
হযরত আবূ হুরায়রা (রা)
হযরত আবূ হুরায়রা (রা) সপ্তম হিজরী সনের মুহররম মাসে খায়বার যুদ্ধের সময় ইসলাম কবুল করেন এবং স্থানীয়ভাবে নবী করীম (ﷺ)-এর সঙ্গে ধারণা করেন। সেই সময় হইতেই নবী করীম (ﷺ)- এর ইন্তেকাল পর্যন্ত তিনি কখনো রাসূলের দরবার ও সঙ্গ ত্যাগ করিয়া যান নাই।
[***********] ইহার মূলে তাঁহার উদ্দেশ্যে ছিল ইসলাম সম্পর্কে সঠিক ও বিস্তারিত জ্ঞানার্জন।
ইবনে আবদুল বার লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
আবূ হুরায়রা খায়বরের যুদ্ধের বছর ইসলাম কবুল করেন। তিনি রাসূলে করীম (ﷺ)- এর সঙ্গেই এই যুদ্ধে শরীক হন। অতঃপর তিনি রাসূলের সঙ্গ ধারণ করেন। সব সময়ই তাঁহার সঙ্গে থাকিতেন। তাঁহার উদ্দেশ্য ছিল ইলম হাসিল করা। ইহাতেই তিনি সন্তুষ্ট থাকিতেন ও তাঁহার ক্ষুধা নিবৃত্ত হইত। তাহার হাতে রাসূলের হাত বাঁধা থাকিত। তিনি যেখানে যাইতেন, আবূ হুরায়রা (রা)-ও সেখানে যাইতেন।
[***************]
রাসূলে করীম (ﷺ) সাধারণত যেসব কথাবার্তা বলিতেন, অপর লোকের সওয়ালের জওয়াবে তিনি যাহা কিছু ইরশাদ করিতেন, ইসলাম ও কুরআনের বিভিন্ন বিষয়ে যাহা কিছু শিক্ষাদান করিতেন, কুরআনের আয়াতের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করিতেন, বিভিন্ন বিষয়ে ভাষণ ও বক্তৃতা দিতেন, রাসূলের দরবারে সর্বক্ষণ উপস্থিত থাকিয়া তাহা সবই তিনি গভীরভাবে শ্রবণ করিতেন ও মুখস্থ করিয়া রাখিতেন। সেই সঙ্গে তিনি নিজেও রাখিতেন। অন্য সাহাবিগণের অনেকেই পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাষাবাদের বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকিতেন বলিয়া তারা খুব বেশী সময় রাসূলের দরবারে অতিবাহিত করিত পারিতেন না। কিন্তু হযরত আবূ হুরায়রার এই ধরনের কোন ব্যস্ততাই ছিল না। এই কারণে অন্যান্যদের তুলনায় তিনি অধিক হাদীস শ্রবণের সুযোগ লাভ করিয়াছেলেন। বিপুল সংখ্যক হাদীস বর্ণনা করা তাঁহার পক্ষে বিচিত্র কিছুই নয়। এমতাবস্থায় হযরত আবূ হুরায়রা (রা) নিজেই বলিয়াছেনঃ
******************************************************
আমার মুহাজির ভাইগণ অধিকাংশ সময়ে বাজারে ব্যবসায়ের কাজে ব্যস্ত থাকিতেন, আর আমি রাসূলের সঙ্গে লাগিয়া থাকিতাম। বাহিরে আমার কোন ব্যস্ততাই ছিল না। ফলে তারা যখন রাসূলের দরবারে অনুপস্থিত থাকিতেন আমি তখন সেখানে হাযিল থাকিতাম। তারা ভুলিয়া গেলে আমি তাহা স্মরণ রাখিতাম।
অপরদিকে আমার আনসার ভাইগণ তাঁহাদের ধন-সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা লইয়া ব্যস্ত থাকিতেন। কিন্তু আমি ছিলাম সুফফার একজন মিসকীন ও গরীব ব্যক্তি। ফলে তারা কোন বিষয় ভূলিয়া গেলেও আমি তাহা স্মরণ করিয়া রাখিতাম।
[***************]
হযরত আবূ হুরায়রা (রা)- এর বর্ণিত হাদীসের মোট সংখ্যা ৫৩৪৭ টি। তন্মধ্যে বুখারী ও মুসলিম উভয় গ্রন্হে উল্লেখ করা হইয়াছে ৩২৫টি হাদীস, আর স্ববন্ত্রভাবে ৭৯ টি হাদীস কেবল বুখারী শরীফে এবং ৯৩টি হাদীস কেবল মুসলিম শরীফে উদ্ধৃত হইয়াছে।
[*****************]
ইমাম বুখারী ও বদরুদ্দীন আইনী লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
আটশতেরও অধিক সাহাবী ও তাবেয়ী তাঁহার নিকট হইতে হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন।
[************]
হযরত আবূ হুরায়রা (রা) অন্য সাহাবীদের অপেক্ষা এত অধিক হাদীস কেমন করিয়া বর্ণনা করিতে পারিলেন, উপরিউক্ত তাঁহার নিজস্ব বিশ্লেষণ হইতে তাহা বিশদভাবেই জানিতে পারা যায়। এতদ্ব্যতীত তাঁহার নিম্নোক্ত বানী হইতেও এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা জন্মে। তিনি নিজেই বলিয়াছেনঃ
******************************************************
এই আয়াত দুইটি যদি আল্লাহ তা’আলা তাঁহার কিতাবে নাযিল না করিতেন, তাহা হইলে আমি কখনই কোন হাদীস বর্ণনা করিতাম না। উহাতে আল্লাহ বলিয়াছেনঃ আমি যেসব সুস্পষ্ট যুক্তিপূর্ণ ও হিদায়অতের কথা নাযিল করিয়াছে, তাহাকে যাহারা গোপন করিয়া রাখে- তাহাদের উপর আল্লাহর ও অন্যান্য অভিসম্পাতকারীদের অভিশাপ।
[মুসলিম শরীফ, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩০২; বুখারী শরীফ, ১ম খণ্ড, ২২ পৃষ্ঠা।]
হযরত আবূ হুরায়রা (রা) কমবেশী প্রায় তিন বৎসরকাল ক্রমাগতভাবে রাসূলের সঙ্গে থাকিয়া হাদীস শ্রবণ করিয়াছেন এবং তাহা স্মরণ করিয়া রাখিয়াছেন। তাহার ফলেই তাঁহার পক্ষে অন্য সাহাবীদের তুলনায় এত অধিক সংখ্যক হাদীস বর্ণনা করা সম্ভব হইয়াছে। বিশেষত তাঁহাকে আল্লাহ তা’আলা এত প্রখর স্মরণশক্তি দান করিয়াছিলেন যে, তিনি যাহা কিছু শুনিতেন, তাহা কখনই ভুলিয়া যাইতেন না। যদিও তাঁহার এই অতুলনীয় স্মৃতিশক্তি রাসূলে করীমের দো’আ ও এক বিশেষ তদবীরের ফলেই অর্জিত হইয়াছিল।
[************] তাঁহার সর্বাধিক হাদীস অর্জন ও অতুলনীয় স্মৃতিশক্তির কথা তদানীন্দন সমাজে সর্বজনবিদিত ও স্বকৃত ছিল। নিম্বোদ্ধৃত উক্তিসমূহ হইতে তাহা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়।
হযরত উবায় ইবন কা’ব (রা) বলেনঃ
******************************************************
আবূ হুরায়রা রাসূলের নিকট প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসা করার ব্যাপারে বড় সাহসী ছিলেন। তিনি এমন সব বিষয়ে তাঁহাকে জিজ্ঞাসাবাদ করিতেন, যে বিষয়ে অপর কোন সাহাবী জিজ্ঞাসা করিতেন না।
[***********]
আবূ আমের বলেনঃ আমি হযরত তালহার নিকট উপস্থি ছিলাম। এক ব্যক্তি আসিয়া তাঁহাকে বলিলঃ ‘হে আবূ মুহাম্মদ!’ আবূ হুরায়রা রাসূলের হাদীসের বড় হাফেয, না তোমরা, তাহা আজ পর্যন্ত আমরা বুঝিতে পারিলাম না’। তখন হযরত তালহা (রা) বলিলেনঃ ‘তিনি
[আবূ হুরায়রা (রা)] এমন অনেক কথাই জানেন, যাহা আমাদের জ্ঞান বহির্ভূত। ইহার কারণ এই যে, আমরা বিত্ত-সম্পত্তিশালী লোক ছিলাম, আমাদের ঘর-বাড়ি ও স্ত্রী-পরিজন ছিল, আমরা তাহাতেই অধিক সময় মশগুল থাকিতাম। কেবল সকাল ও সন্ধ্যার সময় রাসূল (ﷺ)-এর খিদমতে হাযির থাকিয়া নিজের নিজের কাজে চলিয়া যাইতাম। আর আবূ হুরায়রা (রা) মিসকীন ছিলেন, তাঁহার কোন জায়গা-জমি ও পরিবার –পরিজন ছিল না। এই কারণে তিনি রাসূলের হাতে হাত দয়িা তাঁহার সঙ্গে লাগিয়া থাকিতেন। আমাদের সকলেরই বিশ্বাস, তিনি আমাদের সকলের অপেক্ষা অধিক সংখ্যক হাদীস শুনিতে পাইয়াছেন। তিনি রাসূলের নিকট না শুনিয়াই কোন হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন, আমাদের কেহই তাঁহার উপর এই দোষারোপ করে নাই।
[**************]
হযরত আয়েশা (রা) একবার তাঁহাকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেনঃ “কি রকমের হাদীস বর্ণনা করিতেছ? অথচ আমি রাসূল (ﷺ)- এর যেসব কাজ দেখিয়াছি ও যেসব কথা শুনিয়াছি, তুমিও তাহাই শুনিয়াছ? ‘ইহার জওয়াবে হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বলিলেনঃ “আম্মা! আপনি তো রাসূল (ﷺ)-এর জন্য সজ-সজ্জার কাজেই ব্যস্ত থাকিতেন আর আল্লাহর শপথ, রাসূলের দিক হইতে কোন জিনিসই আমার দৃষ্টিকে অন্যদিকে ফিরাইতে পারিত না”।
[******************]
উমাইয়া শাসক মারওয়ানের নিকট হযরত আবূ হুরায়রা (রা) কোন ব্যাপার অসহ্য হওয়ায় তিনি রাগান্বিত হইয়া একবার বলিয়াছিলেনঃ ‘লোকেরা বলে, আবূ হুরায়রা (রা) বহু হাদীস বর্ণনা করেন; অথচ নবী করীম (ﷺ)- এর ইন্তেকালের কায়েকদিন মাত্র পূর্বেই তিনি মদীনায় আসেন।
জওয়াবে হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বলিলেনঃ ‘আমি যখন মদীনায় আসি তখন আমার বয়স ছিল ত্রিশ বৎসরের কিছু বেশী। অতঃপর রাসূল (ﷺ)-এর ইন্তেকাল পর্যন্ত আমি তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে রহিয়াছি। তাঁহার সাথে বেগমদের মহল পর্যন্ত যাইতাম তাঁহার খিদমত করিতাম, তাঁহার সঙ্গে লড়াই-জিহাদে শরীক হইতাম, তাঁহার সঙ্গে হজ্জে গমন করিতাম। এই কারণে আমি অপরের তুলনায় অধিক হাদীস জানিতে পারিয়াছি। আল্লাহর শপথ, আমার পূর্বে যেসব লোক রাসূল (ﷺ)-এর সাহচর্যে আসিয়াছিলেন, তারাও রাসূল (ﷺ)-এর দরবারে আামার সব সময় উপস্থিত থাকার কথা স্বীকার করিতেন এবং আমার নিকট তারা হাদীস জিজ্ঞাসা করিতেন। হযরত উমর (রা) হযরত উসমান (রা), হযরত তালহা (রা) ও হযরত যুবায়র (রা) তাঁহাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
[************] তালহা ইবন উবায়দুল্লাহ বলেনঃ
******************************************************
আবূ হুরায়রা রাসূল (ﷺ)-এর নিকট হইতে এতসব হাদীস শুনিয়াছেন তাহা আমরা শুনিতে পরি নাই; ইহাতে কোনই সন্দেহ থাকিতে পারে না।
[*************]
হযরত ইবন উমর (রা) হযরত আবূ হুরায়রা (রা)-কে লক্ষ্য করিয়া একদিন বলিয়াছিলেনঃ
******************************************************
তুমি আমাদের অপেক্ষা রাসূল (ﷺ)-এর সাহচর্যে বেশ লাগিয়া থাকিতে এবং এই কারণে তাঁহার হাদীস তুমি আমাদের অপেক্ষা অধিক জানিতে ও মুখস্থ করিতে পারিয়াছ।
[***********]
ইমাম যাহবী লিখিয়াছেন, হযরত উমর ফারুক (রা)- ও হযরত আবূ হুরায়রা (রা)-কে একদিন এই কথাই বলিয়াছিলেন।
[***********]
তাবয়িদের মধ্যে বহুসংখ্যক মনীষী হযরত আবূ হুরায়রা (রা)-এর তীক্ষ্ম স্মরণশক্তি সম্পর্কে সাক্ষ্য দিয়াছেন। এখানে কয়েকজনের উক্তি উদ্ধৃত করা যাইতেছেঃ
আবূ সালেহ বলেনঃ
******************************************************
নবী করীম (ﷺ)-এর সাহাবীদের মধ্যে হযরত আবূ হুরায়রা (রা) সর্বাধিক স্মরণশক্তিসম্পন্ন ও হাদীসের অতি বড় হাফেয ছিলেন।
[*************]
সায়ীদ ইবনে আবুল হাসান বলিয়াছেনঃ
******************************************************
সাহাবীদের মধ্যে হযরত আবূ হুরায়রা (রা) অপেক্ষা অধিক হাদীস বর্ণনাকারী আর একজনও ছিলেন না।
[*******]
ইমাম বুখারী (রা) হযরত আবূ হুরায়রা (রা) সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
তাঁহার নিকট হইতে প্রায় আটশত মনীষী হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। তাঁহার যুগের হাদীস বর্ণনাকারীদের মধ্যে তিনি ছিলেন হাদীসের সবচেয়ে বড় হাফেয।
[****************]
বদরুদ্দীন আইনী লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
হযরত আবু হুরায়রা (রা) সাহাবীদের মধ্যে সর্বাধিক হাদীস বর্ণনাকারী-ইহাতে সকল হাদীসবিজ্ঞানীই একমত।
[***************]
ইমাম শাফেয়ী (র) বলিয়াছেনঃ
******************************************************
আবূ হুরায়রা (রা) তাঁহার যুগের সমস্ত হাদীস বর্ণনাকারীর মধ্যে সর্বাধিক স্মরণশক্তিসম্পন্ন ও হাদীসের বড় হাফেয।
[*************]
মুহাদ্দিস হাকেম বলিয়াছেনঃ
******************************************************
হযরত আবূ হুরায়রা (রা) রাসূল (ﷺ)- এর সাহাবীদের মধ্যে অধিক স্মরণশক্তিসম্পন্ন ও হাদীসের অতি বড় হাফেয ছিলেন। তিনি রাসূল (ﷺ)-এর সঙ্গে অন্যান্যদের তুলনায় অনেক বেশী সময় অবস্থান করিয়াছেন। কেননা তিনি প্রয়োজনের দিক দিয়া পরিতৃপ্ত ছিলেন। তাঁহার হাত রাসূল (ﷺ)-এর হাতের মধ্যে থাকিত, রাসূল (ﷺ) যখন যেখানে যাইতেন তিনিও তখন সেখানে যাইতেন। রাসূলের ইন্তেকাল পর্যন্তই এই অবস্থা থাকে। আর এই কারণেই অন্যান্যের তুলনায় হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা অনেক বেশী হইয়াছে।
[***************]
ইমাম আল-হাফিয বাকী ইবন মাখলাদ আন্দালুসী তাঁহার মুসনাদ গ্রন্হে লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
আবূ হুরায়রার বর্ণিত পাঁচ হাজার তিন শত চুয়াত্তরটি হাদীস রহিয়াছে। সাহাবাদের মধ্যে অন্য কেহই এই পরিমাণ কিংবা ইহার কাছাকাছি পরিমাণ হাদীসও বর্ণনা করেন নাই।
[********************]
মোটকথা তাঁহার বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা অধিক হওয়ার চারটি প্রধান কারণ রহিয়াছে। কারণ চারটি এইঃ
১। ইসলাম কবুল করার পর সব সময়ের জন্য রাসূল (ﷺ)-এর সঙ্গ ধারণ।
২। হাদীস শিক্ষা ও উহা মুখস্থ করিয়া রাখার জন্য আকুল আগ্রহ এবং শ্রুত কোন কথাই ভুলিয়া না যাওয়া।
৩। বড় বড় সাহাবীর সাহচর্য ও তাঁহাদের নিকট হাদীস শিক্ষার সুযোগ লাভ ইহাতে তাঁহার হাদীস জ্ঞান পূর্ণতা লাভ করে ও পূর্বাপর সর্বকালের হাদীসই তিনি সংগ্রহ করিতে সমর্থ হন।
৪। নবী করীম (ﷺ)-এর ইন্তেকালের পর দীর্ঘ দিন পর্যন্ত বাঁচিয়া থাকা, প্রায় ৭৪ বৎসর পর্যন্ত হাদীস প্রচারের সুযোগ লাভ এবং কোন প্রকার গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় পদের ব্যস্ততা কবুল না করা।
এই সব কারণে হযরত আবূ হুরায়রা (রা) হাদীসের বড় হাফেয ও সাহাবীদের মধ্য অধিক হাদীসজ্ঞ এবং অধিক হাদীস বর্ণনাকারী ছিলেন। সাহাবিগণ বিচ্ছিন্নভাবে যাহা বর্ণনা করিতেন, সেই সব হাদীস হযরত আবূ হুরায়রার নিকট একত্রে পাওয়া যাইত। ফলে সকলেই তাঁহার নিকট জিজ্ঞাসা করিতেন ও তাহার উপর নির্ভর করিতেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর বলিয়াছেনঃ
******************************************************
আবূ হুরায়রা (রা) মুসলমানদের জন্য রাসূল (ﷺ)-এর হাদীস হিফয করিয়া রাখিতেন।
[***************]
হযরত আবূ হুরায়রা (রা) যে হাদীসের অতি বড় আলিম ছিলেন, তাঁহার বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা যে অন্যান্যের তুলনায় স্বাভাবিকভাবেই বেশী হইবে এবং তাঁহার বর্ণিত হাদীস যে সর্বতোভাবে বিশ্বাষ্য ও নির্ভরযোগ্য, তাহা পূর্বোক্ত দীর্ঘ আলোচনা হইতে অকাট্যভাবেই প্রমাণিত হইতেছে। এতদসত্ত্বেও যাহারা হযরত আবূ হুরায়রার অধিক হাদীস বর্ণনার প্রতি কটাক্ষ করিয়াছেন, তাহাদের ধৃষ্টতা দেখিয়া আশ্চর্যান্বিত হইতে হয়।
হযরত আয়েশা (রা)
উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রা) বিশ্বনবনী জীবন সংঙ্গিনী হিসাবে একাধারে দীর্ঘ নয়টি বৎসর অতিবাহিত করেন। আর রাসূল জীবনের এই বৎসর কয়টিই সর্বাধিক কর্মবহুল ও ইসলামী জীবন ব্যস্থার পূর্ণ প্রতিষ্ঠার সময়। হযরত আয়েশার আঠারো বৎসর বয়সকালে নবী করীম (ﷺ)-এর ইন্তেকাল হয়। অতঃপর প্রায় ঊনচল্লিশ বৎসর তিনি জীবিত থাকেন। এই কারণে একদিকে তিনি যেমন নবী করীম (ﷺ)-এর নিকট হইতে বিপুল সংখ্যক হাদীস সংগ্রহ করিতে পারিয়াছিলেন, অপরদিকে ঠিক তেমনি পারিয়াছিলেন উহার সুষ্ঠু প্রচার করিতে। নবী করীম (ﷺ)-এর বহু সংখ্যক সাহাবী এবং তৎপরবর্তী কালের বহু সংখ্যক তাবেয়ী তাহার নিকট হাদীস শ্রবণ করিতে পারিয়াছেন, পারিয়াছেন তাহার মুসনাদসূত্রে উহার বর্ণনা করিতে।
[********]
আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
হযরত আয়েশা (রা) একজন বড় ফিকাহবিদ সাহাবী ছিলেন এবং রাসূল (ﷺ)-এর নিকট হইতে যে ছয়জন সাহাবী সর্বাধিক সংখ্যক হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন, তিনি তাঁহাদের একজন। তাঁহার সনদে দুই হাজার দুইশত দশটি হাদীস বর্ণিত হইয়াছে। তন্মধ্যে বুখারী ও মুসলিম গ্রন্হদ্বয়ে সমানভাবে একশত চুয়াত্তরটি হাদীস উল্লেখ করা হইয়াছে। এতদ্ব্যতীত আলাদাভাবে চুয়ান্নটি হাদীস বুখালী শরীফে এবং অপর আটান্নটি মুসলিম শরীফে উল্লিখিত হইয়াছে।
[**********]
হযরত আনাস (রা)
পূর্বেই বলা হইয়াছে, হযরত আনাস (রা) দীর্ঘ দশ বৎসর কাল পর্যন্ত নবী করীম (ﷺ)-এর খিদমতে নিযুক্ত ছিলেন।
[ঐ] রাসূলে করীম (ﷺ)-এর সান্নিধ্যে থাকিয়া তাঁহার অনেক কথা শুনিবার এবং অনেক কাজ লক্ষ্য করিয়া দেখিবার তিনি সুযোগ পাইয়াছিলেন। হাদীস বর্ণনার ব্যাপারে যে কয়জন সাহাবী বিশেষ নীতি অবলম্বন করিতেন, তিনি তাহাদের অন্যতম। তিনি ইলমে হাদীসের বিশেষ খিদমত আঞ্জাম দিয়াছেন। বলিতে গেলে সমগ্র জীবনই তিনি হাদীস প্রচারের কাজে নিয়োজিত রহিয়াছেন । রাসূল (ﷺ)-এর ইন্তেকালের পর অন্যান্য সাহাবা যখন যুদ্ধ ও সংঘাতে নিমজ্জিত ঠিক সেই সময়ও তিনি হাদীস প্রচারে অক্লান্তভাবে মশগুল ছিলেন। শেষ জীবনে বসরার জামে মসজিদই ছিল তাঁহার হাদীস প্রচারের কেন্দ্র।
তাঁহারদ হাদীস প্রচারের মজলিসে মক্কা, মদীনা, বসরা, কুফা ও সিরিয়ার হাদীস শিক্ষাভিলাষী ছাত্রগণ আকুল আগ্রহ লইয়া শরীক হইতেন।
তাঁহার বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা কয়েক সহস্র। আল্লামা বদরুদ্দীন আইনীর কথায়ঃ
******************************************************
তিনি নবী করীম (ﷺ) হইতে দুই হাজার দুইশত ছিয়াশিটি হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন।
[********************]
তন্ম্যে বুখারী শরীফে ৮৩টি মুসলিম শরীফে অপর ৯১টি হাদীস উল্লেখ করা হইয়াছে। আর ১৬৮ টি হাদীস বুখারী ও মুসলিম উভয় গ্রন্হেই উদ্ধৃত হইয়াছে। বসরা নগরে ইন্তেকালকারী সাহাবীদের মধ্যে তিনিই সর্বশেষ। তিনি প্রায় এক শতাব্দীকাল বাঁচিয়াছিলেন।
[*****************]
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) রাসূল (ﷺ)-এর দরবারে খুবই ছোট বয়সেই সাহাবী ছিলেন। এই অল্প বয়স্কতার কারণে তিনি বদর যুদ্ধে যোগদান করিবার সুযোগ ইইতে বঞ্চিত হইয়াছিলেন।
[*************] কিন্তু উহার পরবর্তী সকল ব্যাপারেই তিনি প্রত্যক্ষভাবে শরীক হইয়াছেন। ফলে তিনি নবী করীম (ﷺ)-এর সঙ্গে থাকার এবং তাঁহার হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবীদের মধ্যে তিনি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মর্যাদার অধিকারী। তাঁহার বর্ণিত হাদীসের মোট সংখ্যা ১৬৩০। তন্মধ্যে ১৭৩টি বুখারী ও মুসলিম উভয় গ্রন্হেই উদ্ধৃত। এতদ্ব্যতীত বুখারী শরীফে ৮১টি ও মুসলিম শরীফে ৩১ হাদীস উল্লেখ করা হইয়াছে।
[****************] আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
আবূ হুরায়রার পরে সাহাবীদের মধ্যে তিনিই সর্বাধিক হাদীস বর্ণনাকারী।
[*****************]
হযরত আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা)
হযরত আবদুল্লাহ ইবন আব্বাসের খালা ছিলেন উম্মুল মু’মিনীন হযরত মায়মুনা (রা)। হযরত আবদুল্লাহ সাধারণত খালা আম্মার ঘরেই অবস্থান করিতেন। করিতেন এই কারণে যে, তিনি নবী করীম (ﷺ)-এর রাত্রিকালীন ইবাদত-বান্দেগী নিজ চক্ষে দেখিবার জন্য বিশেষ আগ্রহান্বিত ছিলেন।
[**********] নবী করীম (ﷺ) তাঁহার জন্য দোয়া করিয়াছিলেন এই বলিয়াঃ
******************************************************
হে আল্লাম তুমি ইবন আব্বাসকে দ্বীন-ইসলাম সম্পর্কে বিশেষ সমঝদার বানাও এবং তাহাকে সে ব্যাপারের নিগূঢ় তত্ত্ব জানাইয়া দাও।
[************]
ইহার ফলে তিনি যে বিপূল সংখ্যক হাদীস সংগ্রহ করিতে সমর্থ হইবেন, তাহা আর বিচিত্র কি! আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
ইবন আব্বাস (রা) নবী করীম (ﷺ) হইতে এক হাজার ছয়শত ষাটটি হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। তন্মধ্যে ৯৫ টি বুখারী ও মুসলিম উভয় গ্রন্হে্ উল্লিখিত হইয়াছে। আর কেবলমাত্র বুখারীতে একশত কুড়িটি এবং কেবল মুসলিমে ৪৯ টি হাদীস রহিয়াছে।
[*******] সাহাবী তাবেয়ীনের মধ্যে। বিপুল সংখ্যক লোক তাঁহার নিকট হইতে হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। সকলে তাঁহাকে হাদীসের বিশেষ পারদর্শী বলিয়া জানিতেন।
[**************]
হযরত জাবির ইবন আবদুল্লাহ (রা)
হযরত জাবির ইবন আবদুল্লাহ (রা) ইলমে হাদীসে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। হাদীসের জন্য তিনি আজীবন সাধনা করিয়াছেন। হাদীস শিক্ষা, চর্চা ও প্রচারই ছিল তাঁহার জীবনের লক্ষ্য। এই উদ্দেশ্যে তিনি বহু দূরবর্তী অঞ্চলের দুর্গমতম পথে বহু বৎসর পর্যন্ত সফর করিয়াছেন। তাঁহার সম্পর্কে মিশকাত-গ্রন্হ সংকলনক বলিয়াছেনঃ
******************************************************
তিনি প্রখ্যাত সাহাবীদের অন্যতম। যে কয়জন সাহাবী বেশী সংখ্যক হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন, তিনি তাঁহাদের একজন।
[****************]
তিনি সরাসরি নবী করীম (ﷺ) হইতে যেমন হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন, তেমনি করিয়াছেন সাহাবাদের মধ্যমে। ওহুদের যুদ্ধে হযরত আবদুল্লাহ শহীদ হইলে হযরত জাবির রাসূল (ﷺ)-এর স্থায়ী সঙ্গ অবলম্বন করেন। তিনি দীর্ঘদিন জীবিত থাকেন। মুসলিম জাহানের বড় বড় শহর নগর সফর ব্যাপদেশে তিনি হাদীস বর্ণনাকারী বহু সাহাবীর সহিত সাক্ষাত লাভের সুযোগ পান । মসজিদে নববীতে তিনি দীর্ঘদিন হাদীস শিক্ষাদানের জন্য একটি ‘হলকা’ (চক্র) গঠন করেন। রাসূল (ﷺ)-এর পর তিনি ৬৪ বৎসর বাঁচিয়া থাকেন। এই দীর্ঘ জীবন তিনি হাদীস প্রচারেই অতিবাহিত করেন। তাঁহার বর্ণিত হাদীসের মোট সংখ্যা হইতেছে ১৫৪০। তন্মধ্যে বুখারী ও মুসলিম ষাটটি হাদীস মিলিতভাবে উল্লেখ করিয়াছেন। বুখারী আলাদাভাবে ২৬ টি এবং মুসলিম স্বতন্ত্রভাবে অপর ২৬ টি হাদীস উল্লেখ করিয়াছেন।
[*******************]
দ্বিতীয় ভাগ
দ্বিতীয় ভাগে গণ্য পাঁচশত কিংবা পাঁচশতের অধিক হাদীস বর্ণনাকারী হিসাবে যে সাহাবীদের নাম উল্লেখ করা যাইতে পারে, তারা হইতেছে মাত্র চার জন্য। তাঁহাদের নাম ও সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া গেল
১. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা):তিনি মক্কা শরীফে ইসলামী দাওয়তের প্রথম সময়েই ইসলাম কবুল করেন এবং রাসূল (ﷺ)-এর সঙ্গে প্রায় প্রতিটি যুদ্ধেই যোগদান করেন। তিনি রাসূল (ﷺ)-এর জুতারক্ষক ছিলেন। রাসূল (ﷺ) কে তিনি কাপড় পরাইয়া দিতেন।
আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী তাঁহার সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
রাসূল (ﷺ) হইতে তিনি ৮৪৮টি হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। তন্মধ্যে বুখারী ও মুসলিমের উভয় কিতাবে ৬৪ টি হাদীস বর্ণিত হইয়াছে। এতদ্ব্যতীত অপর ২১ টি বুখারী শরীফৈ এবং আরো ৩৫টি মুসলিম শরীফে উল্লিখিত হইয়াছে।
[******************]
২. হযরত আবদুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আস (রা):আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী তাঁহার সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
তিনি অত্যন্ত বড় আলিম ও ইবাদতের কাজে বড় পরিশ্রমী ছিলেন। তিনি হযরত আবূ হুরায়রা (রা) অপেক্ষা অধিক হাদীসের ধারক ছিলেন। কেননা তিনি হাদীস লিখিয়া লইতেন আর হযরত আবূ হুরায়রা (রা) (প্রথমে) লিখিতেন না। এতদসত্ত্বেও তাহার সনদে বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা হযরত আবূ হুরায়রার সনদে বর্ণিত হাদীস অপেক্ষা অনেক কম।
[****************]
তিনি হাদীস লিখিয়া রাখিতেন। মুজাহিদ বলেনঃ আবদুল্লাহর নিকট একখানি হাদীস সংকলন দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিরাম ইহা কি? তিনি বলিলেনঃ
******************************************************
ইহার নাম সাদেকা। রাসূল (ﷺ)-এর নিকট হইতে আমার শ্রুত হাদীসসমূহ ইহাতে লিখিত আছে। এই হাদীস শ্রবণে আমার ও রাসূল (ﷺ)-এর মাঝখানে অন্য কোন ব্যক্তি নাই।
[***************]
৩. হযরত আলী (রা):খুলাফায়ে রাশেদীনের চতুর্থ খলীফা। পুরুষদের মধ্যে সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণকারী ও স সময়ে রাসূলের সহচর হিসাবে অবস্থানকারী। রাসূলে করীম (ﷺ)-এর চাচাতো ভাই এবং জামাতা। বনি হাশিম বংশের প্রথম খলীফা ও তিনি।
[*****************]
আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী তাঁহার সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
তাঁহার সনদে রাসূল (ﷺ) হইতে মোট ৫৮৬টি হাদীস বর্ণিত হইয়াছে। তন্মধ্যে বুখারী-মুসলিম উভয়ই নিজ নিজ গ্রন্হে বিশটি হাদীস উল্লেখ করিয়াছেন। এতদ্ব্যতীত বুখারী ৯টি এবং মুসলিম অপর পনেরোটি হাদীস উল্লেখ করিয়াছেন।
[************]
৪. হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা): খুলাফায়ে রাশেদীনের দ্বিতীয় খলীফা। নবুয়্যাতের ষষ্ঠ বৎসরেই তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তাহার ইসলাম গ্রহণের ফলে মক্কা শরীফে ইসলাম প্রবল শক্তি লাভ করে। ইসলামের জন্য তিনি সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেন।
[*************] এক হিসাব মুতাবিক তাঁহার বর্ণিত হাদীসের মোট সংখ্যা হইতেছে ৫৩৯।
[************]
তৃতীয় ভাগ
তৃতীয় পর্যায়ে মোট ২৬ জন সাহাবী গণ্য হইয়া থাকেন। তাঁহাদের নাম ও সংক্ষিপ্ত পরিচয় নিম্নে প্রদত্ত হইতেছেঃ
১. উম্মুল মু’মিনীন হযরত উম্মে সালমা (রা):তাঁহার বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ১৫৭টি । তন্মধ্যে দুইটি বুখারী ও মুসলিম উভয় গ্রন্হেই উল্লিখত আছে। মিশকাত গ্রন্হকার তাঁহার সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
তাহার নিকট হইতে হযরত ইবন আব্বাস (রা), আয়েশা (রা) এবং তাঁহার নিজের কন্যা যয়নব, তাহার পুত্র উমর ও ইবনুল মুসাইয়্যিব হাদীস রিওয়ায়েত করিয়াছেন।
এতদ্ব্যতীত বহু সংখ্যক সাহাবী এবং তাবেয়ীও তাঁহার নিকট হইতে হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন।
[******************]
২। হযরত আবূ মূসা আশ’আরী (রা): আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী তাঁহার সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
তাঁহার বর্ণিত হাদীস তিনশ ষাটটি। তন্মধ্যে বুখারী ও মুসলিম উভয় গ্রন্হেই পঞ্চশটি হাদীস উদ্ধৃত হইয়াছে। এতেদ্ব্যতীত বুখারী শরীফে স্বতন্ত্রভাবে চারটি হাদীস ও মুসলিম শরীফে অপর পনরটি হাদীস উল্লেখ করা হইয়াছে। তাঁহার নিকট হইতে আনাস ইবন মালিক (র) ও তারেক ইবন শিহাব এবং আরো বহু সংখ্যক তাবেয়ী হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। তিনি সাহাবাদরে মধ্যে একজন বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরূপে গণ্য হইতেন।
[**********]
৩। হযরত বরা’ ইবন আজেব (রা): বদরদ্দীন আইনী লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
রাসূলের নিকট হইতে তাঁহার সনদে তিনশত ও আরো পাঁচটি হাদীস বর্ণিত হইয়াছে। তান্মধ্যে বুখারী ও মুসলিম- উভয় কিতাবে ২২টি হাদীস, কেবল বুখারী শরীফে পনেরোটিএবং কেবল মুসলিম শরীফে ছয়টি হাদীস উদ্ধৃত হইয়াছে।
[*****************]
৪। হযরত আবূ যর গিফারী (রা): তিনি নিজেই বলিয়াছেনঃ
******************************************************
প্রথম চারজন ইসলাম গ্রহণকারীর মধ্যে আমি চতুর্থ।
[ঐ]
আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী উল্লেখ করিয়াছেনঃ
******************************************************
তাঁহার সনদে রাসূলের নিকট হইতে ২৮১ টি হাদীস বর্ণিত হইয়াছে। তন্মধ্যে বারোটি হাদীস বুখারী ও মুসলিম উভয় গ্রন্হে এবং এককভাবে বুখারী শরীফে ২টি ও মুসলিম শরীফে ১৭টি হাদীস উদ্ধৃত হইয়াছে। বহু সংখ্যক সাহাবীও তাঁহার নিকট হইতে হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন।
[***********] তাবেয়ী ও তাঁহার নিকট হইতে হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন।
[**********]
হযরত সায়াদ বিন ইবনে আবূ ওয়াক্কাস (রা):দুনিয়ায় জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশজন সাহাবীর মধ্যে তিনি একজন। ১৪ কি ১৭ বৎসর বয়সে তিনি ইসলাম কবুল করেন। তিনিই সর্বপ্রথম আল্লাহর দ্বীনের জন্য জিহাদে তীর নিক্ষেপ করেন। তাঁহার সম্পর্কে আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
রাসূলের নিকট হইতে তাঁহার বর্ণিত মোট হাদীস হইতেছে দু্ইশত সত্তরটি। তন্মধ্যে বুখারী ও মুসলিম উভয়ই পনেরোটি হাদীস উ্ল্লেখ করিয়াছেন। আর আলাদাভাবে বুখারীতে পাঁচটি ও মুসলিম-এ আঠারোটি হাদীস উল্লেখিত হইয়াছে।
[***********]
৬। হযরত সহল ইবনে সায়াদ আনসারী (রা): তাঁহার পনেরো বৎসর বয়সের সময় রাসূলে করীম (ﷺ) ইন্তেকাল করেন এবং সাহাবীদের মধ্যে তিনিই সকলের শেষে মদীনায় ইন্তেকাল করেন।
[**********] সকল সাহাবীর ইন্তেকালের পর একমাত্র তিনিই জীবিত ছিলেন বলিয়া ইলমে হাদীসের জন্য সকলে তাঁহার দিকেই প্রত্যাবর্তন করিত। তাঁহার বর্ণিত হাদীসের মোট সংখ্যা হইতেছে ১৮৮ টি। তন্মধ্যে ২৮ টি হাদীস বুখারী ও মুসলিম-উভয় গ্রন্হেই উল্লিখিত হইয়াছে।
[*************]
৭। হযরত উবাদা ইবনে সাবিত (রা):মক্কা হইতে ইসলামের আওয়াজ মদীনারর যেসব লোকের কর্ণে প্রবেশ করে ও পরপর তিন বারের হজ্জের সময় অনুষ্ঠিত আকাবার বায়’আতে শরীক হন, তিনি তাঁহাদের একজন।
[************]
আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
রাসূলের নিকট হইতে তাঁহার বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ১৮১। তন্মধ্যে বুখারী ও মুসলিম-উভয় গ্রন্হে ছয়টি হাদীস উল্লেক করা হইয়াছে। এতদ্ব্যতীত বুখারী অপর দুইটি হাদীস এবং মুসলিম অপর দুইটি হাদীস উল্লেখ করিয়াছেন।
[*************]
৮। হযরত আবূদ্দরদা (রা):তিনি একজন বড় সম্মানিত সাহাবী। তাঁহার জ্ঞান, বুদ্ধি, মনীষা ও ইলমে হাদীসের উপর পূর্ণ পারদর্শিতা সুপ্রসিদ্ধ। হযরত আবূযর গিফারী (রা) তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া একদিন বলিলেনঃ
******************************************************
জমিনের উপর ও আসমানের নীচে তোমার অপেক্ষা বড় আলিম এখন আর কেহ নাই হে আবূদ্দরদা।
[************]
৯। হযরত আবূ কাতাদাহ আনসারী (রা):তিনি হাদীসবর্ণনার ব্যাপারে অত্যাধিক মাত্রায় সতর্কতা অবলম্বন করিতেন। রাসূলের প্রতি মিথ্যা কথা আরোপ করা সম্পর্কিত তীব্র বাণী শ্রবণের পরই তিনি এই নীতি অবলম্বন করিতে শুরু করেন।
[ঐ, ৮ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৯২।] এতদসত্ত্বেও তাঁহার বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ১০০।
১০। হযরত উবাই ইবন কায়াব (রা):তাঁহার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ইলমে হাদীসের খিদমতে অতিবাহিত হইয়াছে। খতীবুল উমরী লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
তিনি নবী করীম (ﷺ)-এর জন্য ওহী লেখক ছিলেন। রাসূলের যুগে যাঁহারা সম্পূর্ণ কুরআন মজীদ মুখস্থ করেন তিনি তাঁহাদের একজন্য। তাঁহার সূত্রে বহু সংখ্যক লোক হাদীস বর্ণনাকরিয়াছেন।
[************]
১১। হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল (রা):দ্বিতীয়বারে অনুষ্ঠিত আকাবার বায়’আতে উপস্থিত সাতজনের মধ্যে তিনি ছিলেন একজন। বদর ও অন্যান্য সকল যুদ্ধেই তিনি শরীক ছিলেন। নবী করীম (ﷺ) তাঁহাকে বিচারপতি ও ইসলামের শিক্ষাদাতা হিসাবে ইয়েমেন প্রদেশে প্রেরণ করিয়াছিলেন।
[************]
হযরত ইবন মাসউদ বলিয়াছেনঃ
******************************************************
মুয়ায সব কল্যাণের শিক্ষাগুরু এবং আল্লাহ ও রাসূলের অনুগত ছিলেন।
[ঐ ৩৪১ পৃষ্ঠা।]
তাঁহার সম্পর্কে স্বয়ং নবী করীম (ﷺ) বলিয়াছেনঃ
******************************************************
হালাল হারাম সম্পর্কে মুয়ায সকলের অপেক্ষা বেশী জানে।
[**************]
তিনি আরো বলিয়াছেনঃ
******************************************************
কিয়ামতের দিন মুয়ায আলিম সমাজের ইমাম হিসাবে উপস্থিত হইবেন।
[***************]
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর, ইবনে আব্বাস, ইবনে আবূ আওফা, আনাস ইবনে মালিক, আবূ ইমামাতা, আবূ কাতাদাহ, আবূ সালাবাতা, আবদুর রহমান ইবনে সামুরাতা, জাবির ইবনে সামুরাতা প্রমুখ সাহাবী তাঁহার নিকট হইতে হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন।
[*********************]
১২। হযরত নুমান ইবনে বশীর (রা): তিনি হিজরতের পরে আনসার বংশের প্রথম সন্তান। আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
তাঁহার সনদে একশত চৌদ্দটি হাদীস বর্ণিত হইয়াছে।
[************]
১৩। হযরত আবূ বাকরাতা (রা):তিনি তায়েফ বিজয়ের পর রাসূলের সহিত আসিয়া যোগদান করেন। তাঁহার সম্পর্কে বদরুদ্দীন আইনী লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
তিনি সাহাবাদের মধ্যে ইলমের দিক দিয়া অধিক পারদর্শী ছিলেন। ছিলেন সর্বাধিক নেক লোকদের অন্যতম। তিনি সব সময় ইবাদতের কাজে প্রাণপণ চেষ্টা করিতে থাকিতেন।
[*************]
আইনী ইহাও লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
তাঁহার সনদে নবী করীম (ﷺ) হইতে মোট ১৩৩ টি হাদীস বর্ণিত হইয়াছে। তন্মধ্যে ৮টি হাদীস বুখারী ও মুসলিম- উভয় গ্রন্হে এবং অপর পাঁচটি বুখারী শরীফে ও অপর একটি মুসলিম শরীফে উল্লিখিত হইয়াছে।
[*******]
১৪। হযরত জরীর ইবনে আবদুল্লাহ (রা):তিনি রাসূলে করীম (ﷺ)-এর ইন্তেকালের বৎসরই ইসলাম কবুল করেন। তিনি নিজেই বলিয়াছেনঃ
******************************************************
আমি রাসূলের ইন্তেকালের চল্লিশ দিন পূর্বে ইসলাম কবুল করিয়াছি।
[*********]
আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
তাঁহার বর্ণিত হাদীস একশতটি। তন্মধ্যে বুখারী ও মুসলিম উভয়ই আটটি হাদীস উল্লেখ করিয়াছেন এবং বুখারী ও মুসলিম ছয়টি আলাদা হাদীস উল্লেখ করিয়াছেন। মুসলিম শরীফের শরাহ নববী কিতাবে উল্লেখ করা হইয়াছে, তাঁহার বর্ণিত হাদীস দুইশত। তন্মধ্যে বুখারী এককভাবে উল্লেখ করিয়াছেন মাত্র একটি। কেহ বলিয়াছেন, ছয়টি।
[************]
১৫। হযরত আবূ আইয়ুব আনসারী (রা):তিনি একজন অতি সম্মানিত সাহাবী। দ্বিতীয়বারের আকাবার বায়’আতে এবং বদর যুদ্ধে তিনি শরীক হইয়াছিলেন। মদীনায় উপস্থিত হইয়া রাসূলে করীম (ﷺ) প্রথমে তাঁহারই ঘরে অবস্থান করিয়াছিলেন। আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
তাঁহার বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা একশত পঞ্চাশটি। তন্মধ্যে সাতটি হাদীস বুখারী ও মুসলিম উভয় গ্রন্হেই উল্লিখিত হইয়াছে। বুখারীতে ইহা ব্যতীত অন্য একটি হাদীসও রহিয়াছে।
[**********]
১৬। হযরত উসমান ইবনে আফফান (রা):তিনি খুলাফায়ে রাশেদীনের তৃতীয় খলীফা, আমীরুল মু’মিনীন। রাসূলের দুই কন্যারই পরপর তাঁহার সঙ্গে বিবাহ হইয়াছিল। বদরুদ্দীন আইনী তাঁহার সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
তিনি রাসূলের নিকট হইতে ১৪৬টি হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। বুখারী তন্মধ্যে এগারটি নিজ কিতাবে উল্লেখ করিয়াছেন।
[***********]
১৭। হযরত মুগীরা ইবনে শু’বা (রা):সাহাবীদের মধ্যে ইলম-এর দিক দিয়া বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী। হাদীসের কিতাবসমূহে তাঁহার বর্ণিত ১৩৩টি হাদীসের উল্লেখ রহিয়াছে। এতদ্ব্যতীত আরো একটি হাদীস বুখারী শরীফে এবং অপর দুইিট মুসলিম শরীফে উল্লেখ করা হইয়াছে।
[***********]
১৮। হযরত ইমরান ইবনে হুসাইন (রা):খতীবুল উমরী লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
তিনি সাহাবীদের মধ্যে বিশিষ্ট মনীষী এবং ফিকাহবিদদের অন্যতম।
[***********]
১৯। হযরত উসামা ইবনে যায়দ (রা):তিনি নবী করীম(ﷺ)- এর পালিত পুত্র। ইসলামী জ্ঞানে তিনি বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী। রাসূলের ইন্তেকালের সময় তাঁহার বয়স ছিল আঠার কিংবা বিশ বৎসর মাত্র। তবুও রাসূলে করীম (ﷺ)-এর বিপুল সংখ্যক বানী তাঁহার স্মৃতিশক্তিতে সুরক্ষিত ছিল। তাঁহার আমল ও চরিত্রও ছিল সকলের জন্য আদর্শ এবং অনুসরণীয়।
[*************]
তাঁহার দ্বারা বিপুল সংখ্যক হাদীস বর্ণিত ও প্রচারিত হইয়াছে। তাঁহার বর্ণিত হাদীসের মোট সংখ্যা হইতেছে ১২৮টি । তন্মধ্যে ১৫টি বুখারী ও মুসলিম শরীফে উদ্ধৃত হইয়াছে। এতদ্ব্যতীত অপর দুইট হাদীস বুখারী শরীফে এবং অপর দুইটি মুসলিম শরীফে উল্লিখিত হইয়াছে।
[*************]
২০। হযরত সওবান (রা):তিনি রাসূলে করীম (ﷺ)-এর ক্রীদাস ও তাঁহার পরিবারের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তিনি সব সময়ই রাসুলে করীম (ﷺ)-এর সঙ্গে থাকিতেন। তিনি একদিকে যেমন হাদীস মুখস্থ করিতেন, স্মরণ রাখিতেন, তেমনি হাদীস প্রচারের দায়িত্বও তিনি পূর্ণ মাত্রায় পালন করিতেন।
[************]
২১। হযরত বুরায়দা ইবনে হাসীব (রা):সাহাবীদের মধ্যে তিনি বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন ছিলেন। রাসূলের বিপূল সংখ্যক হাদীস তাঁহার কণ্ঠস্থ ছিল। তাঁহার বর্ণিত হাদীসের মোট সংখ্যা ১৬৪। তন্মধ্যে একটি মাত্র হাদীস বুখারী ও মুসলিম-উভয় গ্রন্হে উল্লিখিত হইয়াছে। এতদ্ব্যতীত আরো ২টি হাদীস কেবলমাত্র বুখারী শরীফে ও ১১ টি কেবলমাত্র মুসলিম শরীফে উদ্ধৃত হইয়াছে।
[**********] তাঁহার বর্ণিত সব কয়টি হাদীসই সরাসরি রাসূলের নিকট হইতে শ্রুত।
[***********]
২২। হযরত আবূ মাসউদ আকাবা ইবনে উমর (রা):আকাবার দ্বিতীয় বায়’আতের সময় তিনি ইসলাম কবুল করেন।দ্বীন-ইসলামের একজন উদ্যমশীল প্রচারক ছিলেন তিনি। সব কয়টি যুদ্ধেই তিনি শরীক ইয়াছিলেন। হাদীস প্রচারেও তিনি যথেষ্ট মনোযোগী ছিলেন। হাদীসের কিতাবসমূহে তাঁহার বর্ণিত ১০২টি হাদীসের উল্লেখ পাওয়া যায়।
[***********]
২৩। হযরত জরীর ইবনে আবদুল্লাহ (রা):তিনি রাসূলের ইন্তেকালের প্রায় চল্লিশ দিন পূর্বে ইসলাম কবুল করেন। তাঁহার বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা একশত। তন্মধ্যে আটটি হাদীস বুখারী ও মুসলিম-উভয় গ্রন্হেই উল্লিখিত হইয়াচে। এতদ্ব্যতীত বুখারী শরীফে একটি হাদীস স্বতন্ত্রভাবে উল্লিখিত হইয়াছে, আর মুসলিম শরীফে উল্লিখিত হইয়াছে ছয়টি হাদীস। অবশ্য নববীর শরহে মুসলিম গ্রন্হে বলা হইয়াছে যে, হযরত জরীর হইতে দুইশত হাদীস বর্ণিত হইয়াছে। তন্মধ্যে বুখারী শরীফে একটি এবং মসলিম শরীফে নয়টি হাদীস উল্লিখিত হইয়াছে।
[************]
২৪। হযরত সামুরা ইবনে জুনদুব ফরাজী (রা):তাঁহার সম্পর্কে মিশকাত সংকলক বলিয়াছেনঃ
******************************************************
তিনি হাফেজে হাদীস ছিলেন এবং রাসূলে নিকট হইতে অধিক সংখ্যক হাদীস বর্ণনাকারীদের মদ্যে তিনি অন্যতম। তাঁহার নিকট হইতেও বহু সংখ্যক লোক হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন।
[************]
আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
তাঁহার নিকট হইতে মোট একশত তেইশটি হাদীস বর্ণিত হইয়াছে। তাহার মধ্য হইতে মাত্র চারিটি হাদীস বুখারী শরীফে উদ্ধৃত হইয়াছে।
[**************]
২৫। হযরত জাবির ইবনে সামুরা (রা):তিনি হযরত সায়াদ ইবনে আবূ অক্কাসের ভাগ্নেয়। কুফা নগরে তিনি অবস্থান করিতেন এবং সেখানেই ৭৪ হিজরীতে তাঁহার ইন্তেকাল হয়। তাঁহার নিকট হইতেও বিপুল সংখ্যক লোক হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন।
[*****************]
২৬। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা):তিনি খুলাফায়ে রাশেদীনের প্রথম খলীফা। নবী করীম (ﷺ)-এর আজীবনের বন্ধু ও সহচর। জাহিলিয়াতের যুগ হইতে ইসলামী সমাজ কায়েম হওয়া পর্যন্ত কোথাও কোন অবস্থায়ই তিন বেশিী সময়ের জন্য রাসূলে করীম (ﷺ) হইতে বিচ্ছিন্ন হন নাই। তাঁহার সম্পর্কে তাঁহার সম্পর্কে মিশকাত সংকলক লিখিয়াছেনঃ
******************************************************
বহু সংখ্যক সাহাবী ও তাবেয়ীন তাঁহার নিকট হইতে হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। তবে রাসূলের ইন্তেকালের পর অল্পকাল মাত্র জীবিত থাকার কারণে তাঁহার নিকট হইতে খুব কম সংখ্যক হাদীসই বর্ণিত হইয়াছে।
[**************
হযরত আবূ বকরের হাদীস বর্ণনা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার জন্য এই গ্রন্হের ‘খুলাফায়ে রাশেদীন ও হাদীস গ্রন্হ সংকলন’ আালোচনা দ্রষ্টব্য।]
উপরিউল্লিখিত সাহাবীদের প্রত্যেকের বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা একশত কিংবা ততোধিক এবং ইহাদের সকলের বর্ণিত সর্বমোট হাদীস হইতেছে ৪৫৫৬টি।
চতুর্থ ভাগ
চতুর্থ ভাগের হাদীস বর্ণকারী সাহাবী হইতেছে ৩৩ জন। তাঁহাদের প্রত্যেকেরই নিকট হইতে চল্লিশ হইতে একশতটি হাদীস বর্ণিত হইয়াছে। তাঁহাদের নামের পূর্ণ তালিকা এখানে পেশ করা হইতেছেঃ
(১) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আবী আওফা (২) হযরত যায়দ ইবনে সাবিত (৩) হযরত যায়দ ইবনে আরকাম (৪) হযরতকায়াব ইবনে আসলামী (৫) হযরতযায়দ ইবনে খালেদুল জুহানী (৬) হযরতহযরত আবূ তালহা যায়দ ইবনে সহল (৭) হযরতহযতর রাফে’ ইবনে খাদীজ (৮) হযরতসালমা ইবনে আকাওয়া (৯) হযরতআবূ রাফে কিবতী (১০) হযরত আওফ ইবনে মালিকুল আশজায়ী (১১) হযরতআদী ইবনে হাতিম (১২) হযরতআবদুর রহমান ইবনে আওফ (১৩) উম্মল মুমিনীন হযরত উম্মে হাবীবা (১৪) হযরতআম্মার ইবনে ইয়াসার (১৫) হযরত সালমান ফারসী (১৬) উম্মুল মুমিনীন হযরত হাবসা (১৭) হযরতহযরত বুরাইরা ইবনে মুতরিম কুবশী (১৮) হযরতআসমা বিনতে আবু বকর (১৯) হযরতওয়াসিলা ইবনে আসকা কানানী (২০) হযরত আকবা ইবনে আমের জুহানি (২১) হযরত ফুযালা ইবনে উবায়দা আনসারী (২২) হযরত উমর ইবনে উতবা (২৩) হযরত কায়াব ইবনে আমর আনসারী (২৪) হযরত ফুযালা ইবনে উবাইদ আসলামী (২৫) উম্মুল মুমিনীন হযরত মায়মুনা (২৬) হযরত উম্মে হানী (২৭) হযরত আবূ হুযায়ফা ইবনে মুগাফফাল (২৮) হযরত বিলাল ইবনে রিয়াহ তামীমী (২৯) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মুগাফফাল (৩০)হযরত মিকদান ইবনে আসাদ কুফী (৩১) হযরত উম্মে আতীয়া আনসারীয়া (৩২) হযরত হাকীম ইবনে হাজার আসাদী এবং (৩৩) হযরত সালমা ইবনে হানীফ আনসারী (রা)।
পঞ্চম ভাগ
পঞ্চম ভাগের সাহাবীদের সংখ্যা পঞ্চান্ন। তাঁহাদের প্রত্যেকের নিকট হইতে চল্লিশ কিংবা চল্লিশ হইতেও কম সংখ্যক হাদীস বর্ণিত হইয়াছে। এখানে এই পর্যায়ের অপেক্ষাকৃত বেশী হাদীস বর্ণনাকারী ৪০ জনের নাম উল্লেখ করা যাইতেছে। তারা হইতেছেনঃ
(১) হযরত জুবাইর ইবনে আওয়াম (২) হযর ফাতিমা বিনতে কায়স (৩) হযতর খাব্বাব ইবনুল ইবত (৪) হযরত আয়াজ ইবনে হাম্মাদ তামীমী (৫) হযরত মালিক ইবনে রবীয়া সয়েদ (৬) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (৭) হযরত উম্মে কায়স বিনতে মহয (৮) হযরত ফজল ইবনে আব্বাস (৯) হযরত আমের ইবনে রবীয়া (১০) হযরত রবী বিনতে ময়ূদ (১১) হযরত উসাইদ ইবনে হুযাইর আশহালী (১২) হযরত খালিদ ইবনে অলীদ (১৩) হযরত উমর ইবন হারীস (১৪) হযরত খাওলা বিনতে হাকীম (১৫) হযরত সাবিত ইবনে জহাক (১৬) হযরত ওরওয়াহ ইবনে আবী জায়দুল আসাদী (১৭) হযরত মুয়াবিয়া ইবনে হাকীম সালামী (১৮) হযরত ইয়ামরা বিনতে সফওয়ান (১৯) হযরত ওরওয়াহ ইবনে মজরাস (২০) হযরত মজমা ইবনে ইয়াজীদ (২১) হযরত সালম ইবনে কায়স (২২) হযরত কাতাদা ইবনে লুকমান (২৩) হযরত কুবাইসা ইবনে মুখরিক আমেরী (২৪) হযরত আসেম ইবনে আদী (২৫) হযরত সালমা ইবনে নয়ীম আশজায়ী (২৬) হযরম মালিক ইবনে স’সায়া (২৭) হযতর মহজন ইবনে আদরা (২৮) হযরত সায়েব ইবনে ফালাহ (২৯) হযরত খাফাফ গিফারী (৩০)হযতর যু’ফজর হাবশী (৩১) হযরত মালিক ইবনে হুবাইর (৩২) হযরত যায়দ ইবনে হারিস (৩৩) হযরত সাবিত ইবনে আদীয়া (৩৪) হযরত কায়াব ইবনে আয়াজ আশ’আরী (৩৫) হযরত কুলসুম ইবনে হুসাইন গিফারী (৩৬) হযরত দাহইয়া কলবী (৩৭) হযরত জুদানা বিনতে ওহাব (৩৮) হযরত মালিক ইবনে ইয়াসার (৩৯) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে জামরা এবং (৪০) হযরত কুলসুম ইবনে আলকামাহ (রা)।
অবশিষ্ট ১৫ জন অল্পবয়স্ক সাহাবী। তাঁহাদের বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা খুবই অল্প ও অনুল্লেখযোগ্য।
উপরে বিভিন্ন পর্যায়ে যে সাহাবীদের নাম উল্লেখ করা হইল, তাঁহাদের মোট সংখ্যা একশত পাঁচ। মুসলিম মিল্লাতের নিকট হাদীসের যে বিরাট মহান সম্পদ অক্ষয় ও অনির্বাণ আলোক-স্তম্ভ রহিয়াছে, ইহা তাঁহাদের বর্ণিত- তাঁহারদেরই অপরিসীম নিষ্ঠাপূর্ণ ও নিরবিচ্ছিন্ন চেষ্টা, সাধনা, অক্লান্ত শ্রম, অবিচল আল্লাহ-বিশ্বাষী ও চিরন্তন মানব কল্যাণ কামানার ফল, তাহাতে সন্দেহ নাই।
[*******************]
হাদীস বর্ণনায় সংখ্যা পার্থক্যের কারণ
পূর্বের আলোচনায় দেখা গিয়াছে যে, হাদীস বর্ণনায় সাহাবীদের মধ্যে সংখ্যার দিক দিয়া বিরাট পার্থক্য রহিয়াছে। একই নবীর সাহাবী সত্ত্বেও কেহ বিপুল সংখ্যক হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন, আবার কেহ করিয়াছেন অতি নগণ্য সংখ্যক হাদীস। হাদীস বর্ণনায় এই বিরাট পার্থক্য সৃষ্টির কারণ কি, তাহা আমাদের বিশেষভাবে জানিয়া লওযা আবশ্যক।
নবী করীম (ﷺ) যতদিন পর্যন্ত সাহাবীদের মধ্যে জীবিত ছিলেন, ততদিন পর্যন্ত তিনি সাধারণভাবে তাঁহাদের সকলকেই দ্বীন-ইসলাম, আল্লাহর কিতাব হিকমতের শিক্ষা দানে ব্যাপৃত ছিলেন। তখন যেমন রাসূলের নামে কোন মিথ্যা কথা প্রচার করার অবকাশ ছিল না, তেমনি ছিল না রাসূলের কোন কথাকে ‘রাসূলের কথা নয়’ বলিয়া উড়াইয়া দেওয়ার বা প্রত্যাখ্যান করার এক বিন্দু সুযোগ। তখন মুনাফিকগণও রাসূলের কোন কথার অপব্যাখ্যা করিয়া ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার তেমন কোন সুযোগ পাইত না। কেননা তেমন কিছু ঘটিলেই সাহাবীয়ে কিরাম রাসূলের নিকট জিজ্ঞাসা করিয়া সমস্ত ব্যাপারে পরিস্কার ও সুস্পষ্ট করিয়া লইতে পারিতেন। ইতিহাসে বিশেষত হাদীস শরীফে ইহার অসংখ্য নিদর্শন বিদ্যমান রহিয়াছে। হযতর উমর ফারূক (রা) একবার হযরত হিশাম ইবনে হাকীমকে সূরা আল-ফুরকান নূতন পদ্ধতিতে পড়িতে দেখিয়া অত্যন্ত আশ্চর্যোবোধ করেন এবং তাঁহাকে পাকড়াও করিয়া রাসূলের দরবারে লইয়া আসেন। অতঃপর নবী করীম (ﷺ) হযরত হিশামের পাঠ শ্রবণ করিয়া বলিয়াছেন যে, এইভাবেও উহা পাঠ করা বিধিসম্মত। ফলৈ হযরত উমরের মনের সন্দেহ দূরীভূত হয়। এ কারণে এই কথা বলা যায় যে, রাসূলে করীম (ﷺ) তাঁহার জীবদ্দশায় সাহাবায়ে কিরামের পারস্পরিত সমস্ত মতবিষম্যের মীমাংসা দানকারী ছিলেন। কোন বিষয়ে একবিন্দু সন্দেহ বা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হইলেই রাসূলের দ্বারা সাক্ষাতভাবে উহার অপনোদন করিয়া লওয়া হইত।
কিন্তু নবী করীম (ﷺ)-এর ইন্তেকালের পর এই অবস্থায় বিরাট পরিবর্তন ঘটে। একদিকে যেমন ওহীর জ্ঞান লাভের সূত্র ছিন্ন হইয়া যায়, তেমনি অপরদিকে অসংখ্য নও-মুসলিম মুর্তাদ হইয়া দ্বীন-ইসলাম পরিত্যাগ করিতে উদ্যত হয়। এইরূপ অবস্থায় ঘোলা পানিতে স্বার্থ শিকারের উদ্দেশ্যে কিছু সংখ্যা মুনাফিকও মাথাচাড়া দিয়া উঠে। তখন তাহারা যদি রাসূলের নামে কোন মিথ্যা রটাইতে চেষ্টা করিয়া থাকে, তবে তাহা কিছুমাত্র বৈচিত্র বা বিস্ময়ের কিছু নয়।
কিন্তু প্রথম খলীফা হযরত আবূ বকর (রা) ইহার সম্মুখে প্রবল প্রতিরোধের ব্যবস্থা করেন। তিনি একদিকে যেমন পূর্ণ শক্তি প্রয়োগ করিয়া মুর্তাদ ও যাকাত অস্বীকারকারীদের মস্তক চূর্ণ করিয়া দেন, অপরদিকে ঠিক তেমনি প্রবলভাবে মিথ্যাবাদীদের মিথ্যা কথা প্রচারের মুখে দুর্জয় বাধার প্রাচীর রচনা করিয়া দেন। তাঁহার পর হযরত উমর ফারুক (রা)-ও ইহার জন্য যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তিন হাদীস বর্ণনার ব্যাপারে অত্যন্ত কড়াকড়ি অবলম্বন করেন। হাদীসের বিরাট সম্পদ বক্ষে ধারণ করিয়া বিপুল সংখ্যক সাহাবী অতন্দ্র প্রহরীর মত সজাগ হইয়া বসিয়া থাকেন। কোন হাদীস বর্ণনা করিলে তাহা মুনাফিকদের হাতে ক্রীড়ানক হইয়া পড়িতে পারে ও বিকৃত রূপ ধারণ করিতে পারে- এই আশংকায় তারা সাধারণভাবে হাদীস বর্ণনা করা প্রায় বন্ধ করিয়া দেন। কাহারো মনে এই ভয় এতদূর প্রবল হইয়া দেখা দেয় যে, বেশী করিয়া হাদীস বর্ণনার ব্যাপারে ভূল হইয়া যাইতে পারে কিংবা সাধারণ মুসলমান হাদীস চর্চায় একান্তভাবে মশগুল হইয়া পড়িলে তাহারা আল্লাহর নিজস্ব কালাম কুরআন মজীদের প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করিতে পারে। এইসব কারণেও সাধারণভাবে সাহাবায়ে কিরাম হাদীস প্রচার ও বর্ণনা সাময়িকভাবে প্রায় বন্ধ করিয়া রাখেন। শরীয়াতের মাসলা-মাসায়েলের মীমাংসা কিংবা রাষ্ট্র শাসন ও বিচার-আচার প্রভৃতি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে যখন হাদীসের আশ্রয় গ্রহণ অপরিহার্য হইয়া পড়িত কেবলমাত্র তখন তারা পরস্পরের নিকট হাদীস বর্ণনা করিতেন।
এই পর্যায়ে আমরা বিশেষভাবে কয়েকজন সাহাবীর কথা উল্লেখ করিতে পারি এবং বিপুল সংখ্যক হাদীস জানা থাকা সত্ত্বেও তাঁহাদের অপেক্ষাকৃত কম সংখ্যক হাদীস বর্ণনা করিবার কারণও তাহা হইতে অনুধাবন করিতে পারি।
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) নবী করম (ﷺ)-এর আজীবনের সঙ্গী, হযরত আবূ উবায়দা, হযরত আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব, হযতর ইমরান ইবনে হুসাইন প্রমুখ মহাসম্মানিত সাহাবী বিপুল সংখ্যক হাদীস জানা থাকা সত্ত্বেও তাঁহাদের নিকট হইতে খুবই কম সংখ্যক হাদীস বর্ণিত হইয়াছে। হযরত সায়ীদ ইবনে যায়দ বেহেশতবাসী হওয়ার সুসংবাদ প্রাপ্ত দশজন সাহাবীর মধ্যে অন্যতম; কিন্তু তাহা সত্ত্বেও তিনি মাত্র দুইটি কিংবা তিনটি হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। হযরত উবাই ইবনে উম্মারাতা কেবলমাত্র একটি হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন।
কোন কোন সাহাবী রাসূলের ইন্তেকালের পর খিলাফতের দায়িত্ব পালনে এতই মশগুল হইয়া পড়িয়াছিলেন যে, তাঁহার পক্ষে হাদীস বর্ণনার মত সুযোগ বা অবসর লাভ করা সম্ভব হয় নাই । খুলাফায়ে রাশেদীনের চারজন সম্মানিত সাহাবী এবং হযরত তালহা ও হযরত জুবাইর (রা) এই কারণের বাস্তব দৃষ্টান্ত।
বহু সংখ্যক সাহাবীর অবস্থা ছিল ইহার ঠিক বিপরীত। তাঁহাদের ছিল বিপুল অবসর। হাদীস বর্ণনার প্রতিবন্ধক হইতে পারে এমন কোন ব্যস্ততাই তাঁহাদের ছিল না। ফলে তারা বিপুল সংখ্যক হাদীস বর্ণনা করিতে সমর্থ হন। যেমন হযরত আবূ হুরায়রা (রা), হযরত আয়েশা (রা) এবং হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা)।
কোন কোন সাহাবী নবী করীম (ﷺ)- এর সংস্পর্শে ও সঙ্গে থাকার অপেক্ষাকৃত বেশী সুযোগ পাইয়াছিলেন। দেশে-বিদেশে, ঘরে ও সফরে সর্বত্র তাঁহার সঙ্গে থাকার কারণে একদিকে যেমন অধিক সংখ্যক হাদীস সংগ্রহ করা তাঁহাদের পক্ষে সহজ হইয়াছিল, তেমনি তাঁহার ইন্তেকালের পর উহাকে অপরের নিকট পূর্ণ মাত্রায় বর্ণনা করার সুযোগও তাঁহাদের ঘটিয়াছিল। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা), হযরত আবূ হুরায়রা (রা), হযতর যাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা), হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) প্রমুখ সাহাবীর নাম এই পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য। কিছু সংখ্যক সাহাবী রাসূলে করীম (ﷺ)-এর জীবদ্দশায়ই কিংবা তাঁহার ইন্তেকালের অব্যবহিত পরেই ইন্তেকাল করিয়াছিলেন বলিয়া তাঁহাদের জীবনে অপরের নিকট হাদীস বর্ণনা করার কোন সুযোগই ঘটে নাই। রাসূলের সঙ্গলাভ কিংবা তাঁহার সঙ্গে লাগিয়া থাকার সুযোগ যাঁহাদের বেশী ঘটে নাই, তাঁহাদের নিকট হইতেও খুব কম সংখ্যক হাদীসই বর্ণিত হইয়াছে।
রাসূলে করীম (সা)-এর অন্তর্ধানের পর ইসলামী সমাজে নিত্য নূতন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। তখন মুসলিম জনসাধারণের পক্ষে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে রাসূলের কথা জানা আবশ্যকীয় হইয়া পড়ে। ফলে এই সময়ে জীবিত সাহাবীগণ বেশী সংখ্যক হাদীস বর্ণনা করিতে বাধ্য হইয়াছেন। পরবর্তীকালে মুসলিমদের মধ্যে ইলম হাদীস অর্জন করার প্রবল আগ্রহ জন্মে। তারা সাহাবীদের নিকট নানাভাবে রাসূলের হাদীস শ্রবণের আবদার পেশ করিতেন। এই কারণেও সাহাবিগণ তাঁহাদের নিকট সুরক্ষিত ইলমে হাদীস তাঁহাদের সামনে প্রকাশ করিতে ও তাঁহাদিগকে উহার শিক্ষাদান করিতে প্রস্তুত হন। এই কারণও অনেক সাহাবীর নিকট হইতে বিপুল সংখ্যক হাদীস বর্ণিত হইতে পারিয়াছে।
খিলাফতে রাশেদার শেষ পর্যায়ে মুসলিম সমাজে নানাবিধ ফিতনার সৃষ্টি হয়। শিয়া এবং খাওয়ারিজ দুইটি বাতিল ফিরকা স্থায়ীভাবে মাথাচড়া দিয়া উঠে। এই সময় তাহারা কিছু কিছু কথা রাসূলের হাদীস হিসাবে চালাইয়া দিতেও চেষ্টা করে। এই কারণে রাসূলের কোন কোন সাহাবী প্রকৃত হাদীস কম বর্ণনা করিতেও হাদীস বর্ণনায় অধিক কড়াকড়ি করিতে বাধ্য হন। ঠিক এই কারণেই চতুর্থ খলীফা হযতর আলী (রা)-এর নিকট হইতে খুবই কম সংখ্যক হাদীস বর্ণিত হইতে পারিয়াছে।
স্মরণশক্তির পার্থক্য ও হাদীস লিখিয়া রাখা বা না রাখাও হাদীস বর্ণনায় এই সংখ্যা পার্থক্য সৃষ্টির অন্যতম কারণ। যাঁহারা হাদীস বেশী মুখস্থ করিয়া কিংবা লিপিবদ্ধ করিয়া রাখিতে পারিয়াছিলেন- যেমন হযরত আবূ হুরায়রা (রা) ও হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা)- তারা অপর সাহাবীদের অপেক্ষা অধিক হাদীস বর্ণনা করিতেত সমর্থ হইয়াছিলেন। একই রাসূলের অসংখ্য সাহাবীদের বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা পার্থক্য সৃষ্টির মূলে এইসব বিবিধ কারণ নিহিত রহিয়াছে। কাজেই ব্যাপারটি যতই বিস্ময়কর হউক না কেন, অস্বাভাবিক কিছুই নয়, তাহা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
[মুহাম্মদ আবু জহু লিখিত ***************গ্রন্হের ৬৬,৬৭, এবং ১৪৭ ও ১৪৮ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।]