হাদীস গ্রন্থ সংকলন

হাদীস গ্রন্হ সংকলন

পূর্বের আলোচনা হইতে প্রমাণিত হইয়াছে, প্রথম পর্যায়েই রাসূলে করীম (ﷺ)-এর হাদীসসমূহ গ্রন্হাকারে সংকলিত হইতে পারে নাই। আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

নবী করীম (ﷺ)-এর হাদীস তাঁহার সাহাবী ও শ্রেষ্ঠ তাবেয়ীদের যুগে গ্রন্হকারে সংকলিত ও সুসংবদ্ধ ছিল না।

[********************]

ইসলামের প্রথম পর্যায়েই হাদীস গ্রন্হসমূহ সংকলিত না হওয়ার মূলে কয়েকটি যুক্তিসংগত কারণ রহিয়াছে। প্রথমত, পূর্বে যেমন বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হইয়াছে, সাহাবায়ে কিরাম তীব্র স্মরণশক্তিসম্পন্ন ছিলেন, রাসূলের নিকট হইতে যাহা কিছু শ্রবণ করিতেন, তাহাই তাঁহাদের মুখস্থ হইয়া যাইত, উহা লিখিয়া লওয়ার কোন প্রয়োজন সাধারণভাবে ও স্বভাবতই তারা মনে করিতেন না।

দ্বিতীয়ত, লিখিবার শক্তি তাঁহাদের অনেকেরই ছিল না। তখন লিখন শিল্পের প্রচলনও পরবর্তীকালের ন্যায় ব্যাপক ছিল না, উহা সাধারণ জনপ্রিয়তাও তখন লাভ করিতে পারে নাই।

তৃতীয়ত, নবী করীম (ﷺ) নিজেই প্রথম পর্যায়ে হাদীস লিখিতে নিষেধ করিয়াছেলেন বলিয়া হাদীস গ্রন্হ সংকলনের প্রতি সকল সাহাবীর দৃষ্টি আকৃষ্ট হইতে পারে নাই।

আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী এই সম্পর্কে যাহা লিখিয়াছেন, তাহা এখানে প্রণিধানযোগ্যঃ

******************************************************

নবী করীম (ﷺ)-এর জীবদ্দশায়ই হাদীসসমূহ সংগৃহীত ও সংকলিত হওয়া বাহ্য দৃষ্টিতে যদিও উত্তম ছিল, কিন্তু কুরআনের অনুরূপ হাদীসেরও সংকলিত হওয়া এবং ঠিক কুরআনের মতই হাদীসেরও সংরক্ষিত হওয়া বোধ হয় আল্লাহরই মর্জি ছিল না।

[ফায়জুলবারী শরহে বুখারী, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২০৮।]

এইসব কথাই হইল হাদীস গ্রন্হ সংকলনের উদ্দেশ্যে বিশেষ ব্যবস্থা ও যত্ন গ্রহণ সম্পর্কে। অন্যথায় হাদীসের হিফাযত ও উহাকে বিলীন হইয়া যাওয়ার হাত হইতে রক্ষা করার ব্যাপারে রাসূলে করীমরে যুগ হইতে সাহাবাও তাবেয়ীনের যুগ পর্যন্ত উহার প্রতি কখনই এবং কিছু মাত্র কম গুরুত্ব দেওয়া হয় নাই।

সেই কারণেই আমরা দেখিতে পাই যে, কুরআনের সঙ্গে হাদীস মিশিয়া যাওয়ার আশংকা দূরীভূত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যেমন সাহাবায়ে কিরাম হাদীস লিপিবদ্ধ করিয়া রাখার দিকে লক্ষ্য দিয়াছেন, অনুরূপভাবে সাহাবায়ে কিরামের সময় হইতেই হাদীস সংকলন ও গ্রন্হাকারে উহাকে সুসংবদ্ধকরণের কাজও পূর্ণ মাত্রায়ই সম্পন্ন করা হইয়াছে।

তবে সাহাবীদের যুগে হাদীসকে গ্রন্হাকারে সংকলিত করিয়া লওয়ার ব্যবহারিক প্রয়োজনীয়তা সাধারণভাবে অনুভূত ছিল না। কেননা তখন সাহাবিগণ নিজেরাই রাসূলের হাদীসের ধারক ছিলেন। যে কোন ব্যাপারে প্রয়োজন দেখা দিলেই জনগণ সাহাবীদের নিকট উপস্থিত হইতেন, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জানিয়া লইয়া সকল ব্যাপারের মীমাংসা করিয়া লইতেন এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে রাসূলে করীমের ফরমান কি, তাহাও নিঃসন্দেহভাবে সাহাবাদের নিকট হইতে জানিতে পারা যাইত। কিন্তু সাহাবাগণ যখন এক এক করিয়া দুনিয়া হইতে চলিয়া যাএত লাগিলেন তখন সাধারণ মুসলমানও যেমন হাদীস গ্রন্হ সংকলনের প্রয়োজন বোধ করেন, তেমনি হাদীসের অবশিষ্ট ধারক সাহাবীগণও উহাকে সংকলিত করিয়া চিরদিনের তরে সুরক্ষিত করিয়া রাখিয়া যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভব করিতে থাকেন।

তাবেয়ী যুগে সাহাবায়ে কিরামের বিদ্যমানতা যে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ ছিল তাহা হযতর আনাস (রা)-এর ইন্তেকালের পর মুরেক নামক জনৈক তাবেয়ীর নিম্নোক্ত উক্তি হইতে স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায়। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আজ অর্ধেক ইলম – হাদীস – দুনিয়া হইতে চলিয়া গেল।

এই কথার তাৎপর্য জিজ্ঞাসা করা হইলে তিনি বলিলেনঃ

******************************************************

সাহাবীদের যুগে কোন অসদুদ্দেশ্যসম্পন্ন ব্যক্তি হাদীস সম্পর্কে আমাদের বিরোধিতা কিংবা মতবিরোধ করিলে আমরা বলিতামঃ যে লোক এই হাদীস স্বয়ং রাসূলের নিকট শ্রবণ করিয়াছেন তাঁহার নিকট চল ( ও ইহার সত্যতা যাঁচাই করিয়া লও)।

[********************]

এই কারণেই সাহাবাদের কাফেলার শেষ অন্তর্ধান শুরু হওয়ার পূর্বেই হাদীসি সংকলনের ও হাদীসকে গ্রন্হবন্ধ করিয়া উহাকে চির দিনের তরে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করার প্রয়োজনীয়তা সাধারণভাবে ও তীব্রতা সহকারে অনুভূত হইতে শুরু করে। নবুয়্যাত- উত্তর যুগে এই পর্যায়ে একসঙ্গে পেশ করা আবশ্যক। এখানে প্রথমে খুলাফায়ে রাশেদীনের আমলের সংক্ষিপ্ত আলোচনা পেশ করা হইব। অতঃপর পরবর্তীকালের বিস্তারিত ইতিহাস লিপিবদ্ধ করা হইবে।

খুলাফায়ে রাশেদুন ও হাদীস গ্রন্হ সংকলন

নবী করীম (ﷺ)-এর ইন্তেকালের পর খুলাফায়ে রাশেদীন ইসলামী জীবন ব্যবস্থা ও ইসলামী রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা পরিচালনা ও যাবতীয় দ্বীনি কার্যাবলীর দায়িত্বগ্রহণ করেন। এই সময় ইসলামের অপরিহার্য দ্বিতীয় স্তর- ইলমে হাদীস- সম্পর্কে তাঁহাদের চেষ্টা- যত্নের কোনই ক্রটি ছিল না। এখানে স্বতন্ত্রভাবে প্রত্যেক খলীফার হাদীস সংক্রান্ত খিদমত সম্পর্কে আলোচনা পেশ করা যাইতেছে।

হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা)

প্রথম খলীফা হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) নিজে পাঁচশত হাদীসের এক সংকলন তৈয়ার করিয়াছিলেন। কিন্তু জীবনের শেষভাগে তিনি নিজেই তাহা বিনষ্ট করিয়া ফেলেন। ইহার কারণস্বরূপ মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করিয়াছেন যে, হাদীসসময়হ সংকলন করার পর তিনি মোটেই স্বস্তি লাভ করিতে পারেন নাই। তাঁহার মনে কয়েক প্রকার ভয়ের সঞ্চার হয়। তিনি এজন্য বিশেষ ভাবিত হইয়া পড়েন যে, তাঁহার সংকলিত হাদীসসমূহের মধ্যে একটি কথা- একটি শব্দও যদি রাসূলে করীমের মূল বাণীর বিন্দুমাত্রও বিপরীত হইয়া পড়ে, তাহা হইলে রাসূলের কঠোর সতর্কবাণী অনুযায়ী তাঁহাকে জাহান্নামের ইন্ধন হইতে হইবে।

দ্বিতীয়ত, তাঁহার মনে এই ভয়ও জাগ্রত হইল যে, তাঁহার সংকলিত হাদীস গ্রন্হকে মুসলিম জনগণ যদি কুরআনের সমতুল্য মর্যাদা দিয়া বসে কিংবা অন্যান্য সাহাবীদের বর্ণিত ও সংকলিত হাদীস অপেক্ষা অধিক মর্যাদা দিতে শুরু করে, তাহা হইলেও মুসলমানদের পক্ষে বিশেষ ক্ষতির কারণ হইবে। তাহার ফলে হাদীস সংকলনের ক্ষেত্রে ব্যাপক কাজ ও অগ্রগতি ব্যাহত হইতে পারে। এই সব চিন্তার ফলেই তিনি তাহা নষ্ট করিয়া ফেলেন।

[কিন্তু আল্লামা যাহবী হযরত আবূ বকর কর্তৃক তাঁহার নিজেরই সংকলিত হাদীস গ্রন্হ বিনষ্ট করিয়া দেওয়ার বর্ণনাকে সত্য বলিয়া স্বীকার করেন নাই।]

ব্যাপারটিকে আমরা যতই গভীর ও সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে বিচার করিয়া দেখি না কেন, ইহাতে একটি বিশেষ মনস্তাত্ত্বিক ও মানসিক অবস্থার পরিণাম বলা ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় না।

কিন্তু এতদসত্ত্বেও হযরত আবূ বকর (রা) হাদীস সংকলন করিতে নিষেধ করেন নাই। বরং তিনি নিজেও কিছু সংখ্যক হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। তাঁহার বর্ণিত হাদীস হইতেছে ইমাম সয়ূতীর মতে ১৪২টি । এই হাদীসসমূহ হাদীসের কোন কোন গ্রন্হে উল্লিখিত হইয়াছে তাহাও তিনি উল্লেখ করিয়াছেন। তাঁহার এত কম সংখ্যক হাদীস বর্ণনার মূলেও যথেষ্ট কারণ রহিয়াছে। ইমাম সয়ূতী এ বিষয়ে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তাহার কম সংখ্যক হাদীস বর্ণনার কারণ এই যে, হাদীসে প্রচার ও তাবেয়ীন কর্তৃক উহা শ্রবণ করা শিক্ষা ও সংরক্ষণ করার কাজ শুরু করার পূর্বেই তাঁহার ইন্তেকাল হইয়া যায়।

[********************]

হযরত আবূ বকর (রা) হইতে কম সংখ্যক হাদীস বর্ণিত হওয়ার কারণ বিশ্লেষণ প্রসংগে ইমাম সয়ূতী উপরিউক্ত গ্রন্হের অন্যত্র লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

হযরত আবূ বকর (রা) হইতে সনদ সম্পন্ন হাদীস খুব কম সংখ্যক বর্ণিত হইয়াছে। কেননা হযরতের ইন্তেকালের পর তাঁহার আয়ুষ্কাল খুবই অল্প ছিল ও তাঁহার মৃত্যু খুব তাড়াতাড়িই সংঘটিত হইয়াছিল। অন্যথায় তিনি যদি দীর্ঘদিন বাঁচিয়া থাকিতেন তাহা হইলে তাঁহার নিকট হইতে বহু সংখ্যক হাদীসই বর্ণিত করিতেন। তিনি যতদিন বাঁচিয়াছিলেন, ততদিন সাহাবাদের কেহই তাঁহার নিকট হইতে হাদীস বর্ণনার প্রয়োজন বোধ করেন নাই। কেননা সমস্ত ব্যাপারে তারা সমানভাবেই শরীক ছিলেন। যাহা তাঁহাদের অজ্ঞতা ছিল কেবল তাহাই তারা নিকট হইত বর্ণনা করিতেন।

[********************]

শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলবীও এই কথাই লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

সাহাবাগণ হযরত আবূ বকরের সূত্রে খুব বেশী হাদীস বর্ণনা কার জন্য প্রয়োজনশীল ছিলেন না। কেননা অধিক সংখ্যক হাদীস তারা নিজেরাই রাসূলের মুখে শুনিয়াছিলেন।

[********************]

এতদ্ব্যতীত হযতর আবূ বকর (রা) হযরতের অন্তর্ধানের পর মাত্র আড়াই বৎসরকাল জীবিত ছিলেন। এই আড়াইটি বৎসর তাঁহার খিলাফাতের কঠিন দায়িত্ব পালন ও ভীষণ প্রতিকূল ঝড়-ঝাপটার মধ্যে অতিবাহিত হয়। ফলে এই সময়ে অন্যন্য দীর্ঘায়ূসম্পন্ন সাহাবায়ে কিরামের মত হাদীস বর্ণনার নিরবচ্ছিন্ন অবসর ও অনুকুল পরিবেশও তিনি পান পান নাই।

উপরন্তু মুসলমাদের সহিত পরামর্শ করিয়া যাবতীয় দায়িত্ব পালন করাই ছিল তাঁহার এই সময়কার বড় কাজ। ইসলামী খিলাফতের প্রকৃত গণতন্ত্রিক ও পরামর্শভিত্তিক হওয়ার কারণে প্রত্যেকটি সামাজিক, রাষ্ট্রিয় ও সামগ্রিক ব্যাপারে বিশিষ্ট সাহাবীদের সহিত পরামর্শ করিয়া এবং কুরআন হাদীসের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মীমাংসা বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াই কাজ করা হইত।

হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) খিলাফতের যাবতীয় কার্য সম্পাদনের ব্যাপারে কুরআন মজীদের পরে-পরেই হাদীসের প্রতি গুরুত্ব দিতেন। খলীফা নির্বাচিত হইয়াই তিনি যে ভাষণ দিয়াছিলেন, তাহাতেই তিনি কুরআনের পরে পরেই হাদীসের গুরুত্ব ঘোষণা করিয়াছিলেন। বলিয়াছেনঃ

******************************************************

হে লোকগণ! আমাকে তোমাদের রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল বানানো হইয়াছে। অথচ আমি তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি নই। কিন্তু কুরআন নাযিল হইয়াছে এবং নবী করীম (ﷺ) তাঁহার সুন্নাত ও আদর্শ প্রতিষ্ঠিত করিয়া গিয়াছেন। তিনি আমাদিগকে এই উভয় জিনিসের শিক্ষা দান করিয়াছেন, আর আমরা তাহা শিখিয়া লইয়াছি।

[********************]

খিলাফতের কাজের ক্ষেত্রেও বাস্তবভাবেই তিনি কুরআনের পরেই হাদীসের উৎস হইতে নির্দেশ ও বিধান লাভ করিতেন। প্রমাণ্য গ্রন্হাবলীতে তাঁহার এই নীতির কথা স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখিত হইয়াছে। বলা হইয়াছেঃ

******************************************************

হযরত আবূ বকরের নিকট যখন মীমাংসা যোগ্য কোন ব্যাপার উপস্থিত হইত তখন তিনি প্রথমত আল্লাহর কিতাবে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিতেন। তাহাতে যদি ফায়সালা করার ভিত্তি খুঁজিয়া পাইতেন, তবে উহার ভিত্তিতে লোকদের মধ্যে ফয়সালা করিয়া দিতেন। আর কুরআনে কিছু নাই পাইলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে রাসূলের সুন্নাত যদি কিছু জানা যাইত, তবে উহার ভিত্তিতে মীমাংসা করিয়া দিতেন।

[সুনানে দারেমী, ২৩ পৃঃ ********************]

হযরতের ইন্তেকালের পর যতগুলি সামগ্রিক ব্যাপারেই মতভেদ দেখা দিয়াছে হযরত আবূ বকর (রা) তাহার প্রায় প্রত্যেকটি ব্যাপারেই মীমাংসা করিয়াছেন রাসূলে করীমের হাদীস পেশ করিয়া এবং তাঁহার উপস্থাপিত হাদীস সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সকল মতভেদ খতম করিয়া দিয়াছে। হযরতের ইন্তেকালের পর সকীফায়ে বণী সায়েদায় সাহাবীদের মধ্যে প্রথম জটিল প্রশ্ন দেখা দেয়- খলীফা কে হইবে। অবস্থা এমন দাঁড়াইয়াছিল যে, এই বিষয়ে কোন মীমাংসা করাই তখন অসম্ভব হইয়া পড়িয়াছিল। তখন হযরত আবূ বকর (রা) দাড়াইয়া রাসূলে করীম (ﷺ)-এর একটি হাদীস পেশ করিলেন এবং বলিলেনঃ

******************************************************

ইমাম ও খলীফা কুরায়েশদের মধ্য হইতে হইবে।

সেই সঙ্গে রাসূলের এই কুরায়শ বংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকিবে।

[********************]

এই হাদীস শ্রবণের সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত সকল সাহাবী ইহার সত্যতা স্বীকার করিয়া লইলেন। অতঃপর খলীফা নির্বাচনের কাজ নির্বিাবাদে সম্পন্ন হয়।

নবী করীম (ﷺ)-কে কোথায় দাফন করা হইবে, তাহা লইয়া যখন মতবিরোধ দেখা দিল, তখন হযরত আবূ বকর (র) সিদ্দীক (রা) হাদীস পেশ করিলেনঃ

******************************************************

আমি রাসূলের নিকট একটি কথা শুনিয়াছিলাম, যাহা আমি ভুলিয়া যাই নাই। তিনি বলিয়াছিলেনঃ আল্লাহ তাঁহার নবীর জান কবজ করেন সেই স্থানে, যেখানে তাঁহাকে দাফন করা কর্তব্য হয়।

অতঃপর বলিলেনঃ******************************************************

অতএব তোমরাও রাসূলে করীম (ﷺ)- কে তাঁহার মৃত্যুশয্যার স্থানেই দাফন কর।

[শামায়েলে তিরমিযী, পৃষ্ঠা ৩০ ******************** মুয়াত্তা মালিক, পৃষ্ঠা ৮০।]

হযরত আয়েশা (রা) প্রথম খলীফা হযরত আবূ বকরের নিকট নবী করীমের সম্পত্তি হইতে অংশ লাভের দাবি করিলেন। তখন হযরত আবূ বকর (রা) নিম্নোক্ত হাদীসটি বর্ণনা করেন। তিনি বলেনঃ

******************************************************

আমি রাসূলে করীম (ﷺ)-কে বলিতে শুনিয়াছি যে, আমরা কাহাকেও সম্পত্তির উত্তরাধিকারী বানাই না। যাহা কিছু রাখিয়া যাই, তাহা সবই আল্লাহর পথে দান। কাজেই মুহাম্মদের বংশধর বায়তুলমাল হইতে জীবিকা গ্রহণ করিবে।

অতঃপর হযরত আবূ বকর (রা) বলিলেনঃ

******************************************************

আল্লাহর শপথ, রাসূলকে আমি যে যে কাজ করিতে দেখিয়াছি আমি তাহা প্রত্যেকটিই কার্যে পরিণত করিব, একটিও ছাড়িয়া দিব না।

এই হাদীস বর্ণনার উপস্থিত ফল এত ত্বরান্বিত দেখা দেয় যে, হাদীসের বর্ণনাকারী শেষ ভাগে বলেনঃ

******************************************************

অতঃপর হযরত ফাতিমা মীরাসের দাবি পরিত্যাগ করেন এবং মৃত্যু পর্যন্ত তিনি আর এই বিষয়ে কোন কথা বলেন নাই।

[বুখারী শরীফ, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠ ৯৯৫-৯৬।]

পক্ষান্তরে তিনি যখন রাসূলের হাদীসের ভিত্তিতে জানিতে পরিলেন যে, দাদীর মীরাস রহিয়াছে, তখন হাদীস অনুযায়ী তাঁহার জন্য মিরাসের ফয়সালা করিয়া দিতে এতটুকুও বিলম্ব করিলেন না। প্রথমত দাদী যখন মিরাসের দাবি করেন, তখন তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

তোমার জন্য আল্লাহর কিতাবে মীরাসের কোন অংশ নির্দিষ্ট হয় নাই। রাসূলের আদর্শে (হাদীস)-ও তোমার জন্য কোন অংশ নির্দিষ্ট হইয়াছে বলিয়া আমার জানা নাই। অতএব, তুমি চলিয়া যাও। আমি লোকদের নিকট এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করিয়া পরে তোমাকে জানাইব।

অতঃপর তিনি একদিন সাহাবীদের নিকট এই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করিলেন। তখন হযরত মুগীরা ইবনে শু’বা দাড়াঁইয়া বলিলেনঃ

******************************************************

আমি রাসূলের নিকট উপস্থিত ছিলাম, তিনি দাদীর জন্য ছয় ভাগের এক ভাগ নির্দিষ্ট করিয়া দিয়াছেন। আমি নিজ চক্ষে দেখিয়াছে।

হযরত আবূ বকর (রা)-এর আমল সম্পর্কে বর্ণিত এই হাদীস সম্পন্ধে নিঃসন্দেহে হইবার জন্য ও ইহার প্রামাণ্যতাকে বলিষ্ঠ করার উদ্দেশ্যে জিজ্ঞাসা করিলেনঃ

******************************************************

তোমার সঙ্গে এই কথার সাক্ষী আর কেহ আছে?

তখন হযরত মুহাম্মদ ইবনে মুসলিম (রা) দাঁড়াইয়া সাক্ষ্য দান করিলেন ও হযরত মুগীরার কথার সমর্থন করিলেন।

[********************] অতঃপর হযরত আবূ বকর (রা) ইহা মানিয়া লইতে একটু দ্বিদা করিলেন না।

তবে একথা সত্য যে, হাদীস বর্ণনার ব্যাপারে হযরত আবূ বকর (রা) বিশেষ কড়াকড়ি করিতেন। বিশেষভাবে ও অকাট্য প্রমাণের ভিত্তিতে যখন রাসূলের কোন হাদীস প্রমাণিত হইত, তখন তিনি উহার সম্মুখে মাথা নত করিয়া দিতেন। দাদীর মীরাস সংক্রান্ত এইমাত্র উল্লেখিত ঘটনা হইতেই ইহা সুস্পষ্ট হইয়া উঠে। পরন্তু কোন হাদীসের সত্যতা সম্পর্কে তিনি যতক্ষণ পর্যন্ত নিঃসন্দেহ ও নিশ্চিত না হইতেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি তাহা গ্রহণ করিতে প্রস্তুত হইতেন না।

[********************]

হাফেজ যাহবী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

হাদীস গ্রহণে হযরত আবূ বকরই সর্ব প্রথম বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করেন।

[********************]

হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) হযরত আনাস (রা)-কে যখন বাহরাইনের শাসনকর্তা নিযুক্ত করিয়া পাঠাইয়াছিলেন, তখন তিনি যাকাতের হুকুম-আহকাম সংক্রান্ত এক বিস্তারিত দস্তাবেজ লিখিয়া তাঁহার সঙ্গে পাঠাইয়া দেন। এই বিস্তারিত দস্তাবেজের শুরুতে লিখিত ছিলঃ

******************************************************

দয়াবান করুণাময় আল্লাহর নামে।– ইহা যাকাতের ফরয হওয়া সংক্রান্ত দস্তাবেজ। রাসূলে করীম (ﷺ) মুসলমানদের জন্য ইহা ফরয করিয়াছেন এবং আল্লাহ তাঁহার রাসূলকে এই নির্দেশ দিয়াছেন।

[********************]

হযরত উমর ফারূক (রা)

দ্বিতীয় খলীফা হযতর উমর ফারূক (রা) নিজে হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। তাঁহার দৃষ্টিতে দ্বীন-ইসলামের ভিত্তি হিসাবে কুরআন মজীদের পরই ছিল সুন্নাহ বা হাদীসের রাসূলের স্থানে। তিনি বিপুল সংখ্যক হাদীস সংগ্রহ ও লিপিবদ্ধ করিয়া ইসলামী রাজ্যের বিভিন্ন প্রদেশের উচ্চ ও নিম্ন পর্যায়ের শাসকদের নিকট প্রেরণ করিয়াছিলেন এবং সর্বসাধারণ্যে উহার ব্যাপক প্রচার করার নির্দেশ দিয়াছিলেন।

ইলমে হাদীসের শিক্ষা ব্যাপবতর করিয়া তোলার জন্য তিনি বিভিন্ন অঞ্চলে বহু সংখ্যক মাদ্রাসা কায়েম করেন। প্রখ্যাত সাহাবিগণকে তিনি বিভিন্ন অঞ্চলে হাদীস শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে পাঠাইয়াছিলেন। এই পর্যায়ে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মুগাফফাল,হযরত ইমরান ইবনে হুসাইন (রা) ও হযরত মা’কাল ইবনে ইয়াসার (রা)-কে বসরা প্রদেশে এবং হযরত উবাদা ইবনে সামিত ও হযরত আবুদ দারদা (রা) কে সিরিয়ায় প্রেরণ করিয়াছিলেন।

[********************] আরজান ইবনে আবূ হালাকে এই উদ্দেশ্যেই মিসর পাঠাইয়াছিলেন।

[********************]

হযরত আবূ মূসা আশ’আরী (রা) কুফার শাসনকর্তা নিযুক্ত হইয়া তখায় গমন করেন ও সেখানকার মুসলমানগণকে সম্বোধন করিয়া বলেনঃ

******************************************************

আমাকে হযরত উমর (রা) তোমাদের নিকট এই উদ্দেশ্যে প্রেরণ করিয়াছেন যে, আমি তোমাদিগকে আল্লাহর কিতাব ও তোমাদের নবীর সুন্নাত-হাদীস শিক্ষা দিব।

[********************]

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা)-কেও তিনি কূফায় হাদীস ও কুরআনের শিক্ষাদাতা করিয়া পাঠাইয়াছিলেন এবং তাঁহার নিকট হইতে হাদীস শিক্ষা করার জন কূফাবাসীদিগকে আদেশ করিয়াছিলেন।

[********************]

আল্লামা খাজরী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ কূফায় অবস্থান করিলেন। সেখানকার লোকেরা তাঁহার নিকট রাসূল (ﷺ)-এর হাদীস শিক্ষা করিতেন। তিনি ছিলেন তাঁহাদের শিক্ষক ও বিচারপতি।

[********************]

হযরত উমর (রা) হাদীস গ্রহণের ব্যাপারে প্রথম খলীফার মত খুবই কঠোর নীতি অবলম্বন করিতেন। হযরত আবূ মুসা আশ’আরী (রা) বর্ণিত একটি হাদীসের সত্যতা প্রমাণের জন্য তিনি তাঁহাকে (আবূ মুসাকে) কঠোর ভাষায় নির্দেশ দিয়াছিলেন। বলিয়াছিলেনঃ

******************************************************

দলীল পেশ কর, নতুবা আমি তোমাকে কঠোর শাস্তি দিব।

পরে তাঁহার কথার সমর্থনে অপর এক সাহাবীকে যখন সাক্ষী হিসাবে পেশ করা হইল, তখন তিনি আশ্বস্ত হইলেন।

[********************]

আল্লামা যাহবী তাঁহার সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

হাদীস বর্ণনা করার ব্যাপারে তিনি মুহাদ্দিসদের জন্য দৃঢ় ও মজবুত নীতি অবলম্বনের নিয়ম প্রতিষ্ঠিত করিয়া দিয়াছেন।

[********************]

হযরত আবূ মুসা তাঁহার বর্ণিত হাদীসের সপক্ষে আর একজন সাহাবীকে সাক্ষী হিসাবে পেশ করিলেন। তাহার পরই হযরত উমর (রা) তাহা কবুল করিলেন। ইহিা হইতে প্রমাণিত হয়ঃ

******************************************************

কোন হাদীসস যখন অন্তত দুইজন বিশ্বস্ত বর্ণনাকারী বর্ণনা করেন, তখন তাহা একজনের বর্ণিত হাদীস অপেক্ষা অধিক প্রামাণ্য, শক্তিশালী ও অগ্রাধিকার লাভের যোগ্য হয়। এই হাদীস বর্ণনার বহু সংখ্যক সূত্র লাভ করার জন্যও ইহা যথেষ্ট উৎসাহব্যঞ্জক। ইহার ফলে হাদীস ‘সাধারণ ধারণার’ (********************) পর্যায় হইতে নিঃসন্দেহ ইলমের (নির্ভূল ও নির্ভরযোগ্য জ্ঞান) পর্যায়ে উন্নীত হইতে পারে।

[********************]

হযরত উবায় ইবনে কা’ব একটি হাদীস বর্ণনা করিলে হযরত উমর (রা) বলিলেনঃ

******************************************************

আপনি যে হাদীস বর্ণনা করিলেন, তাহার সত্যতা সম্পর্কে আপনাকে অবশ্যই প্রমাণ পেশ করিতে হইবে।

[********************]

হযরত উবায় আনসারদের মধ্য হইতে কয়েকজন সাহাবীকে সাক্ষী হিসাবে পেশ করিলে খলীফা বলিলেনঃ

******************************************************

আমি আপনার প্রতি কোন সন্দেহ করি নাই, হাদীসকে অকাট্য প্রমাণের ভিত্তিতে সুদৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যেই আমি আপনার নিকট প্রমাণের দাবি করিয়াছিলাম।

[********************]

হযরত উমর ফারূকের সময়ই সরকারী পর্যায়ে বিচ্ছিন্ন হাদীস সম্পদ সংকলন ও লিপিবদ্ধ করা হয় এবং উহাকে সুসংবদ্ধ করিয়া লওয়ার প্রশ্ন সর্বপ্রথম উত্থাপিত হয়। হযতর উমর (রা) নিজেই এই বিরাট কাজ সম্পন্ন করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিয়াছিলেন এবং এ সম্পর্কে অন্যান্য সাহাবীর সহিত পরামর্শও করিয়াছিলেন। মুসলমানরা তাঁহাকে ইহার অনুকূলেই পরামর্শ দিয়াছিলেন। কিন্তু পরে তাঁহার নিজের মনেই এই সম্পর্কে দ্বিধা ও সন্দেহের উদ্রেক হয় যে, ইহা করা সমীচীন হইবে কিনা? তিনি প্রায় একমাস কাল পর্যন্ত অনেক চিন্তা-ভাবনা ও ইস্তেখারা করিতে থাকেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি নিজেই একদিন বলিলেনঃ

******************************************************

আমি তোমাদের নিকট হাদীস লিপিবদ্ধ ও সংকলিত করার কথা বলিয়াছিলাম, একথা তোমরা জান। কিন্তু পরে মনে হইল, তোমাদের পূর্বের আহলে কিতাব লোকেরাও এমনিভাবে নবীর কথা সংকলিত করিয়াছিল, ফলে তাহারা তাহাই আঁকড়িয়া ধরিল এবং আল্লাহর কিতাব পরিত্যাগ করিল। আল্লাহর শপথ, আমি আল্লাহর কিতাবের সাথে কোন কিছুই মিশ্রিত করিব না। অতঃপর তিনি হাদীস সংকলিত করার সংকল্প ত্যাগ করেন।

বস্তুত সুসংবদ্ধ ও সংকলিত হাদীস-গ্রন্হ পাইয়া লোকেরা হয়ত উহাতে এতখানি মনোনিবেশ করিয়া বসিবে যে, কুরআন শরীফকেও তাহারা ভুলিয়া যাইবে, লোকদের নিকট উহার গুরুত্ব নগণ্য হইয়া পড়িবে ও কেবলমাত্র হাদীসকে ভিত্তি করিয়াই তাহারা চলিতে চাহিবে, কেবলমাত্র এই আশংকায়ই হযরত উমর ফারূক (রা) নিজে হাদীস লিপিবদ্ধ ও সংকলিত করার কাজ করেন নাই। অন্যথায় ইহাকে তিনি কোন নাজায়েয কাজ নিশ্চয়ই মনে করিতেন না। তাঁহার এই আশংকা কতখানি যুক্তিসংগত ছিল, তাহা পরবর্তীকালের অবস্থার দৃষ্টিতে বিচার করিলেই বুঝিতে পারা যায়।

[********************] এই ধরণের সতর্কতাবম্বনের ফলেই আজ মুসলিম মিল্লাত কুরআন মজীদকে প্রথম এবং হাদীসকে উহার পরেই দ্বিতীয় গুরুত্ব দিতে শিখিয়াছে। এইরূপ সতর্কতা অবলম্বিত না হইলে মুসলমানদের নিকটই হযরত কুরআন মজীদের স্থান প্রথম ও মুখ্য না হইয়া গৌণ হইয়া পড়িত, যেমন হইয়াছে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের নিকট তাহাদের ধর্মগ্রন্হ।

হযরত উসমান (রা)

হযরত উসমান (রা) নিজে হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন; কিন্তু খুব অল্প সংখ্যক হাদীসই তাঁহার নিকট হইতে বর্ণিত হইয়াছে। ইহার কারণ প্রদর্শন সম্পর্কে তিনি নিজেই বলিয়াছেনঃ

******************************************************

রাসূলের সাহাবীদের মধ্যে রাসূলের অধিক হাদীস সংরক্ষণকারী আমি নহি, এই কারণটি আমাকে রাসূলের হাদীস বর্ণনা করা হইতে বিরত রাখে নাই। বরং হাদীস বর্ণনা হইতে বিরত থাকার কারণ এই যে, আমি নিজেই রাসূল করীম (ﷺ)-কে এই কথা বলিতে শুনিয়াছি বলিয়া সাক্ষ্য দিয়েছি যে, রাসূল যাহা বলেন নাই তাহা যদি কেহ তাঁহার উপর আরোপ করে তবে সে যেন জাহান্নামে তাহার আশ্রয় খুঁজিয়া লয়।

[********************]

হযরত আলী (রা)

যে কয়জন সাহাবী নিজেদের হাতে রাসূলের নিকট শ্রুত হাদীস লিপিবদ্ধ করিয়া লইয়াছিলেন, হযরত আলী (রা) তাঁহাদের অন্যতম।তিনি কুরআনের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ সম্পর্কে কয়েকটি হাদীস রাসূলের নিকট হইতে শ্রবণ করিয়া লিখিয়াছিলেন। এই হাদীস সমষ্টির তিনি নাম দিয়াছিলেন ‘সহীফা’। ইহাকে ভাঁজ করিয়া তিনি তাঁহার তলোয়ারের খাপের মধ্যে সযত্নে রাখিয়া দিয়াছিলেন। ইহাতে ব্যবহারিক ও কাজকর্ম সংক্রান্ত হুকুম আহকামের কয়েকটি হাদীস লিখিত ছিল।

[সহীহ বুখারী শরীফ, কিতাবুল ইলম ও কিতাবূল ই’তেসাম, মুসনাদে আহমদ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৭০৯।]

পরবর্তীকালে এই সহীফাখানিকে তিনি হযরত উসমানের নিকট পাঠাইয়া দেন হাদীসের একখানি লিখিত দস্তাবেজ হিসাবে। তাঁহার পুত্র মুহাম্মদ ইবনুল হানাফীয়া বলেনঃ

******************************************************

আমাকে আমার পিতা এই বলিয়া পাঠাইয়া দিলেন যে, এই কিতাবখানি লইয়া খলীফা উসমান (রা)- এর নিকট যাও। ইহাতে সদকা ও যাকাত সম্পর্কে রাসূলে করীমের ফরমান লিখিত রহিয়াছে।

[********************]

উপরিউক্ত আলোচনা হইত প্রমাণিত হয় যে, খুলাফায়ে রাশেদীনের আমলে হাদীস প্রচারিত হইয়াছে, উহা শিক্ষাদানের কাজ পূর্ণ মাত্রায় চলিয়াছে এবং রাষ্ট্র পরিচালনা ও বিচার-আচারে উহা আইনের অন্যতম ভিত্তি হওয়ার মর্যাদা লাভ করিয়াছে। খণ্ডভাবে বিভিন্ন লোকদের দ্বারা উহা লিখিত এবং সংগৃহীতও হইয়াছে। কিন্তু হাদীস যথাযথভাবে গ্রন্হকারে সংকলিত হয় নাই। তখন পর্যন্ত তাহা বহু তাবেয়ী তাহাদের নিকট হইতে উহা শিক্ষা ও সংগ্রহ করিয়া বহু লোকের মাঝে ব্যাপকভাবে প্রচার করিয়া দিয়াছেন। কিন্তু হাদীস যথারীতি গ্রন্হকারে সংকলনের কাজ এই পর্যায়ে কেহ করিয়াছেন- ইতিহাসে ইহার কোন নজীর পাওয়া যায় না। এইভাবেই ইসলামী ইতিহাসের প্রায় একটি শতাব্দীকাল অতিক্রম হয়। হিজরী প্রথম শতকের শেষভাগে ইহার ব্যতিক্রম ঘটে এবং হাদীস সংকলনের ব্যাপারে এক বিপ্লবী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।

হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীয (র) ও হাদীস সংকলন

হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীয (র) ৯৯ হিজরী সনে খলীফা নির্বাচিত হন। তিনি খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করিয়াই হাদীসের বিরাট বিক্ষিপ্ত সম্পদ সংকলনের প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভব করেন। তিনি স্পষ্ট বুঝিতে পারিলেন, ইসলামী জীবন যাপন ও খিলাফত পরিচালনার জন্য হাদীস এক অপরিহার্য সম্পদ। অনতিবিলম্বে ইহার সংকলন ও পূর্ণ সংরক্ষিত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করিলে এই সম্পদ হইতে গোটা উম্মতের বঞ্চিত হওয়ার আশংকা। সাহাবায়ে কিরামের প্রায় সকলেই দুনিয়া হইতে বিদায় লইয়াছেন। তাঁহাদের নিকট শিক্ষাপ্রাপ্ত তাবেয়ীদেরও অধিক সংখ্যক লোক তাহাদেরই অনুগামী হইয়াছেন। এখনও যাহারা জীবিত আছেন, তারা আরও দীর্ঘদিন বাঁচিয়া থাকিবেন- তাহার নিশ্চয়তা কিছু নাই। অতএব অনতিবিলম্বে এই মহান সম্পদ সংগ্রহ ও সংকলন এবং উহাকে সুবিন্যাস্তকরণ একন্তই আবশ্যক।

অতঃপর তিনি ইসলামী রাজ্যের কেন্দ্রে নিম্নোক্ত ভাষায় ফরমান লিখিয়া পাঠাইলেনঃ

******************************************************

রাসূলে করীমের হাদীসের প্রতি অনতিবিলম্বে দৃষ্টি দাও এবং তাহা সংগ্রহ ও সংকলন করিতে শুরু কর।

[]

মদীনার শাসনকর্তা ও বিচারপতি আবূ বকর ইবনে মুহাম্মদ ইবনে হাযমকেও নিম্নোক্ত মর্মে এক ফরমান লিখিয়া পাঠানঃ

******************************************************

রাসূলের হাদীস, তাঁহার সুন্নাত কিংবা হযরত উমরের বাণী অথবা অনুরূপ যাহা কিছু পাওয়া যায়, তাহার প্রতি দৃষ্টি দাও এবং আমার জন্য লিখিয়া লও। কেননা আমি ইলমে হাদীসের ধারকদের অন্তর্ধান ও হাদীস সম্পদের বিলুপ্তির আশংকা বোধ করিতেছি।

[********************]

******************************************************

আর হাদীসে- রাসূল ছাড়া আর কিছুই যেন গ্রহণ করা না হয়। লোকেনা যে এই ইলমে হাদীসকে ব্যাপকভাবে প্রচার করে। হাদীস শিক্ষাদানের জন্য যেন মজলিস অনুষ্ঠিত হয়, যাহারা জানে না, তাহারা যেন শিখিয়া লইতে পারে। কেননা ইলম গোপন করা হইলেই তাহা বিনাশপ্রাপ্ত হয়।

[******************** বুখারী শরীফ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠাঃ ২০।]

ইমাম দারেমী আবদুল্লাহ ইবনে দীনার-এর জাবানীতে এই কথাটি নিম্নোক্ত ভাষায় উদ্ধৃত করিয়াছেনঃ

******************************************************

রাসূলের যেসব হাদীস তোমার নিকট প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত, তাহা এবং হযরত উমরের হাদীসসমূহ আমার নিকট লিখিয়া পাঠাও। কেননা আমি ইলমে হাদীস বিনষ্ট ও হাদীসবিদদের বিলীন হইয়া যাওয়ার আশংকা বোধ করিতেছি।

[********************]

ঐতিহাসিক ইবনে সায়াদ উমর ইবনে আবদুল আযীযের ফরমানের আর একটি অংশেরও উল্লেখ করিয়াছেন। তাঁহার উদ্ধৃত অংশটুকু এইরূপঃ

******************************************************

উমর ইবনে আবদুল আযীয আবূ বকর ইবেন হাযমকে উমরা বর্ণিত হাদীসসমূহও লিখিয়া তাহার নিকট পাঠাইয়া দিবার জন্য ফরমান পাঠাইয়াছিলেন।

[********************]

ইবনে সায়াদের বর্ণনা হইতে ইহাও জানা যায় যে, উমর ইবনে আবদুল আযীয হযরত আয়েশা (রা)-এর বর্ণিত হাদীসসমূহও লিখিয়া পাঠাইতে বলিয়াছেন। আর উমরা বিনতে আবদুর রহমানের বর্ণিত হাদীস সংগ্রহ ও লিপিবদ্ধ করিয়া পাঠাইবার জন্য এই কারণেই তাকিদ করিয়াছিলেন। কেননা মুসলমানের আকাইদ ও ব্যবহরিক জীবনের জন্য জরুরী হুকুম-আহকাম হযরত আয়েশা (রা) বর্ণিত হাদীসসমূহেই বিশেষভাবে উল্লেখিত হইয়াছে।

[********************] আর এই উমরা হযরত আয়েশা (রা)-এর ক্রোড়েই লালিত পালিত হইয়াছিলেন এবং তাঁহার নিকট হাদীসের শিক্ষা পূর্ণমাত্রায় লাভ করিয়াছিলেন। উমর ইবনে আবদুল আজীজ নিজেই তাঁহার সম্পর্কে বলিয়াছেনঃ

******************************************************

হযরত আয়েশার বর্ণিত হাদীস সম্পর্কে উমরা অপেক্ষা বড় আলিম আর কেহ অবশিষ্ট নাই।

[********************]

ইমাম জুহরীও তাঁহার সম্পর্কে বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি তাহাকে হাদীস জ্ঞানের এক অফুরন্ত সমুদ্রের মত পাইয়াছি।

[********************]

ইমাম মালিক বলিয়াছেন, উমর ইবনে আবদুল আযীয আবু বকর ইবনে হাজমকে উমরা বিনতে আবদুর রহমানের সঙ্গে সঙ্গে কাসেম ইবনে মুহাম্মদ বর্ণিত হাদীসও লিখিয়া পাঠাইতে আদেশ করিয়াছিলেন।

[********************]

এই কাসেম কে ছিলেন? ইমাম বুখারী তাঁহার সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তাঁহার পিতা নিহত হইলে তিনি তাঁহার ফুফু-আম্মা হযরত আয়েশার ক্রোড়ে লালিত-পালিত হন এবং তাঁহার নিকট দ্বীন সম্পর্কে গভীর জ্ঞান লাভ করেন।

[********************]

ইবনে হাব্বান এই কাসেম সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

কাসিম তাবেয়ী এবং তাঁহার যামানার লোকদের মধ্যে হাদীস ও দ্বীনের জ্ঞানের দিক দিয়া সর্বোত্তম ও সর্দার ব্যক্তি ছিলেন।

[********************]

আবূ বকর ইবনে হযম সম্পর্কে পূর্বে বলা হইয়াছে যে, তিনি মদীনার শাসনকর্তা ছিলেন। সেই সঙ্গে বিচারপতির দায়িত্বও তাঁহাকেই পালন করিতে হইত। তিনি তদানীন্তন মদীনার একজন প্রধান ফকীহ ছিলেন। ইসলামী আইন-কানুনে তাঁহার অতুলনীয় পারদর্শিতা ছিল। পূর্বোক্ত উমরা বিনতে আবদুর রহমানের নিকট হযরত আয়েশা বর্ণিত যাবতীয় হাদীস পূর্বেই লিপিবদ্ধ করিয়া নিজের নিকট রাখিয়া দিয়াছিলেন। উমরা তাহার আপন খালা হইতেন।

[********************]

কাযী আবূ বকর খলীফা উমর ইবনে আবদুল আযীযের আদেশানুক্রমে বিপুল সংখ্যক হাদীস সংগ্রহ ও হাদীসের কয়েকখানী খণ্ড গ্রন্হ সংকলন করিয়া লইয়াছিলেন। কিন্তু খলীফার ইন্তেকালের পূর্বে তাহা ‘দারুল খিলাফতে’ পৌঁছানো সম্ভবপর হইয়া উঠে নাই। এ সম্পর্কে আল্লামা সুয়ূতী ইবনে আবদুল বার লিখিত ‘আত-তামহীদ’ গ্রন্হের সূত্রে উল্লেখ করিয়াছেনঃ

******************************************************

ইবনে হাযম কয়েক খণ্ড হাদীস- গ্রন্হ সংকলন করেন; কিন্তু তাহা খলীফা উমর ইবনে আবদুল আযীযের নিকট পাঠাইয়া দেওয়ার পূর্বেই ইন্তেকাল করেন।

[********************]

কিন্তু অতঃপর এই হাদীস- সংকলনসমূহের পরিণাম কি হইল? এই সম্পর্কে ইমাম মালিক বলিয়াছেনঃ আমি এই হাদীস গ্রন্হসমূহ সম্পর্কে কাযী আবূ বকরের পুত্র আবদুল্লাহর নিকট জিজ্ঞাসা করিলে তিনি বলিলেনঃ ******************** তাহা সব বিনষ্ট হইয়া গিয়াছে।

[********************] কিন্তু ইহা বিশ্বাসযোগ্য নয়। কেননা খলীফা ইন্তেকাল করিয়া গিয়াছেন বলিয়াই সরকারী ব্যবস্থাপনায় তৈয়ার করা হাদীস সংকলনসমূহ বিনষ্ট হইয়া যাইবে, তাহার রক্ষণাবেক্ষণের কোন ব্যবস্থাই হইবে না- এমন কথা হইতে পারে না। নিশ্চয়ই উহা জনগণের নিকট রক্ষিত ছিল এবং পরবর্তীকালে উহার ভিত্তিতে জনগণের মধ্যে হাদীসের প্রচার করা হইয়াছে।

কোন কোন বর্ণনা হইতে এ কথা জানা যায় যে, খলীফা উমর ইবনে আবদুল আযীয মদীনায় আবু বকর ইবনে হাযম ছাড়া সালেম ইবনে আবদুল্লাহকেও হাদীস সংগ্রহ করিয়া পাঠাইতে আদেশ করিয়াছিলেন। আল্লামা সুয়ূতী ইমাম জুহুরীর সূত্রে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

উমর ইবনে আবদুল আযীয সালেম ইবনে আবদুল্লাহকে হযরত উমরের যাকাত ও সদকা সম্পর্কে রীতিনীতি লিখিয়া পাঠাইবার জন্য আদেশ করিয়াছিলেন।

[********************]

ইমাম সুয়ুতী সালেম সম্পর্কে অতঃপর লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

সালেম যে বিষয়ে আদিষ্ট হইয়াছিলেন, তাহা তিনি পুরাপুরি লিখিয়া পাঠাইয়া দিয়াছিলেন। সেই সঙ্গে তিনি (সালেম) তাঁহাকে ইহাও লিখিয়া পাঠাইয়াছিলেন যে, হযরত উমর (রা) তাঁহার আমলেও তদানীন্তন লোকদের মধ্যে অনুরূপ কাজ করেন তবে আপনি আল্লাহর নিকট উমর ফারূক হইতেও উত্তম ব্যক্তি বলিয়া বিবেচিত ও পরিগণিত হইবেন।

[********************]

এই সম্পর্কে মুহাম্মদ ইবনে আবদুর রহমান আনসারী বলেনঃ

******************************************************

উমর ইবনে আবদুল আযীয যখন খলীফা নির্বাচিত হইলেন, তখন তিনি মদীনায় রাসূলে করীমের ও হযরত উমরের যাকাত ইত্যাদি সংক্রান্ত লিখিত দস্তাবেজ সংগ্রহের জন্য তাকীদ কারিয়া পাঠাইলেন। পরে আমর ইবনে হাযমের বংশধরদের নিকট রাসূলে করীমের লিখিত বস্তাবেজ এবং হযরত উমরের বংশধরদের নিকট রাসূলে করীমের অনুরূপ লিখিত দস্তাবেজ পাওয়া গেল।

[********************]

উমর ইবনে আবদুল আযীয ইমাম জুহরীকে বিশেষভাবে হাদীস সংকলনের কাজে নিযুক্ত করিয়াছিলেন।

[********************]

ইমাম জুহরী সম্পর্কে উমর ইবনে আবদুল আযীয নিজেই বলিয়াছেনঃ

******************************************************

সুন্নাত ও হাদীস সম্পর্কে যুহরী অপেক্ষা বড় আলিম বিগত কালের আর একজনও বাঁচিয়া নাই।

[********************]

এ সম্পর্কে ইমাম ইবনে শিহাব যুহরী (র) নিজেই বলেনঃ

******************************************************

উমর ইবনে আবদুল আযীয আমাদিগকে হাদীস সংগ্রহ ও সংকলন করার জন্য আদেশ করিলেন। এই আদেশ পাইয়া আমরা হাদীসের বিরাট গ্রন্হ লিখিয়া তাঁহার নিকট পাঠাইয়া দিলাম। অতঃপর তিনি নিজেই তাঁহার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি প্রদেশে এক-একখানি গ্রন্হ পাঠাইয়া দিলেন।

[********************]

সংগৃহীত হাদীস সম্পদ যে কিছুমাত্র বিনষ্ট হয় নাই, এই কথা হইতে তাহা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়।

ইমাম মালিক (রা) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

সর্বপ্রথম যিনি হাদীস সংকলন করেন, তিনি হইলেন ইবনে শিহাব যুহরী।

[********************]

ইমাম আবদুল আযীয দারাওয়ার্দী নামক অপর এক মনীষীও এই কথারই সমর্থন করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

হাদীস সংকলনও উহা লিপিবদ্ধকরণের কাজ সর্বপ্রথম করিয়াছেন ইবনে শিহাব যুহরী।

[********************]

ইমাম যুহরী এই গৌরবের দাবি করিয়া নিজেই বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমার পূর্বে ইলমে হাদীস আর কেহ সংকলিত করেন নাই।

[********************]

উমর ইবনে আবদুল আযীয কেবল হাদীস সংগ্রহ ও লিপিবদ্ধ করণেরই নির্দেশ দেন নাই, বরং সর্বত্র উহার ব্যাপক শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করার জন্যও তিনি সুস্পষ্ট ফরমান পাঠাইয়াছিলেন।

অপর একজন শাসনকর্তার নামে নিম্নোক্ত ভাষায় এক ফরমান প্রেরিত হইয়াছিলঃ

******************************************************

হাদীসবিদ ও বিদ্বান লোকদিগকে আদেশ করুন, তারা যেন মসজিদে মসজিদে হাদীসের শিক্ষাদান ও উহার ব্যাপক প্রচার করেন। কেননা হাদীসের জ্ঞান প্রায় বিলীন হইয়া যাইবার উপক্রম হইতেছে।

[********************]

উপরিউক্ত উদ্ধৃতি ও ঐতিহাসিক দলীল- প্রমাণের ভিত্তিতে এই কথায় কোনই সন্দেহ থাকে না যে, উমর ইবনে আবদুল আযীযের হাদীস-সংগ্রহ সম্পর্কিত ফরমান বিশেষ একটি মাত্র স্থানে প্রেরিত হয় নাই, বরং ইসলামী রাজ্যের সর্বত্রই এই ফরমান পাঠানো হইয়াছিল এবং উহার ফলে সর্বত্রই হাদীস সংগ্রহ ও সংকলনের অভিযান সুষ্ঠুভাবে শুরু হইয়া গিয়াছিল। এই অভিযানের অনিবার্য ফলস্বরূপ সর্বত্রই হাদীস সংকলিত হয়। সেই সময় জীবিত প্রায় সকল হাদীসবিদই হাদীস সংকলনের মহৎ কাজে আত্মনিয়োগ করিয়াছিলেন এবং তাঁহাদের সংকলিত বিরাট বিপুল সম্পদ মুসলিম সমাজের নিকট চিরকালের অমূল্য ধনরূপে গণ্য ও সংরক্ষিত হইয়া রহিয়াছে।

উমর ইবনে আবদুল আযীয (র) অন্য লোকদিগকে আদেশ করিয়াই ক্ষান্ত হন নাই, তিনি নিজেও হাদীস লিখিয়া লইবার কাজ শুরু করিয়াছিলেন, এইরূপ উল্লেখ পাওয়া যায়।

প্রসিদ্ধ তাবেয়ী ও হযরত আনাস হইতে হাদীস বর্ণনাকারী আবূ কালাবা

[********************] বলিয়াছেনঃ

******************************************************

উমর ইবনে আবদুল আযীয একদা জুহরের নামাযের জন্য মসজিদে আসিলে আমরা তাঁহার হাতে কিছু কাগজ দেখিতে পাইলাম। পরে আসরের নামাযের জন্য বাহির হইয়া আসিলেও তাঁহার সহিত সেই কাগজই দেখিলাম। আমি জিজ্ঞাসা করিলামঃ হে আমীরুল মুমিনীন! এই লিখিত জিনিসটি কি? জওয়াবে তিনি বলিলেনঃ আওন ইবনে আবদুল্লাহ আমার নিকট হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন, উহা আমার খুব পছন্দ হইয়াছে, আমি তাহা লিখিয়া লইয়াছি। তাহার মধ্যে এই হাদীসটিও রহিয়াছে।

[********************]

ইমাম যুহরীর পরবর্তী সময়ে যাঁহারা ইসলামী রাষ্ট্রের বিভিন্ন কেন্দ্রে হাদীস সংকলন ও গ্রন্হ প্রণয়নের কাজ করিয়াছেন, তাঁহাদের মধ্যে নিম্নোক্ত মনীষিগণ উল্লেখযোগ্যঃ

মক্কা শরীফে ইবনে জুরইজ (১৫০ হিঃ); মদীনায় ইবনে ইসহাক (১৫১ হিঃ) ও ইমাম মালিক (১৭৯ হিঃ); বসরায় রুবাই ইবনে সুবাইহ (১৬০ হিঃ), সায়ীদ ইবনে আবূ আরুবা (১৫৬ হিঃ) ও হাম্মাদ ইবনে সালমা (১৭৬ হিঃ); কূফায় সুফিয়ান আস-সওরী (১৬১ হিঃ); সিরিয়ায় ইমাম আওযায়ী (১৫৬ হিঃ); ওয়াসত-এ হুশাইম (১৮৮ হিঃ); ইয়েমেন মা’মার (১৫৩ হিঃ); এবং খোরাসানে জরীর ইবনে আবদুল হামীদ (১৮৮ হিঃ); আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক (রা) (১৮১ হিঃ)।

[********************]

উপরে প্রত্যেক নামের সঙ্গে উল্লিখিত সন তারিখ হইতে স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায় যে, তারা সকলেই সমসাময়িক ও প্রায় একই যুগের লোক ছিলেন এবং একই সময়ের বিভিন্ন স্থানে থাকিয়া রাসূলে করীম (ﷺ)-এর হাদীস সম্পদ সংগ্রহ ও হাদীস গ্রন্হ সংকলন করিয়াছেন। কাজেই এই ব্যাপারে তাঁহাদের মধ্যে সর্বপ্রথম কে এই কাজ করিয়াছেন, তাহা নিশ্চিত করিয়া বলার উপায় নাই। কিন্তু আল্লামা ইবনে হাজর আসকালানী তাঁহাদের মধ্যে অগ্র-পরের একটি বিন্যাস কায়েম করিয়া দিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

সর্বপ্রথম হাদীস সংগ্রহ ও সংকলনের কাজ করেন রুবাই ইবনে সুবাইহ ও সাদ ইবনে আবূ আরূবা এবং তাঁহাদের ছাড়া আরো কেহ কেহ। তারা হাদীসের প্রত্যেকটি অধ্যায়কে স্বতন্ত্রভাবে গ্রন্হাবদ্ধ করিতেন।

[********************]

এই পর্যায়ে ইমাম মকহুলের নামও উল্লেখযোগ্য। কেননা তিনি গ্রন্হ প্রণয়নের কাজ ব্যাপকভাবে শুরু হওয়ার পূর্বেই ‘কিতাবুস সুনান’ নামে হাদীসের একখানি গ্রন্হ প্রণয়ন করেন।

[********************]

কূফা নগরে ইমাম শা’বী একই বিষয় সম্পর্কিত হাদীসসমূহ একই স্থানে সন্নিবদ্ধ করার কাজে সর্বপ্রথম হাত দেন।

[********************] প্রথমত তিনি হাদীস লিখন ও হাদীস গ্রন্হ প্রণয়নের পক্ষপাতী ছিলেন না, কিন্তু কেবলমাত্র খলীফাতুল মুসলিমীন উমর ইবনে আবদুল আযীযের নির্দেশ পাইয়াই হাদীস গ্রন্হ প্রণয়ন শুরু করেন। কেননা তিনি কূফা প্রদেশে উমর ইবনে আবদুল আযীযের নিযুক্ত বিচারপতি ছিলেন।

[********************]

আল্লামা সুয়ূতী ইবনে হাজর আসকালানী হইতে উদ্ধৃত করিয়াছেনঃ

******************************************************

একই বিষয় সম্পর্কিত হাদীসসমূহ একত্র সংকলন করার কাজ সর্বপ্রথম করেন ইমাম শা’বী। কেননা তাঁহার সম্পর্কে বর্ণিত হইয়াছে যে, তিনি ‘ইহা তালাক সম্পর্কে এক বিরাট অধ্যায়’ বলিয়া উহাতে বহু সংখ্যক হাদীস একত্রে লিখিয়াদিয়াছেন।

[********************]

ইমাম শা’বী ২২ হিজরী সনে হযরত উমর ইবনুল খাত্তাবের খিলাফত আমলে জন্মগ্রহণ করেন, আর ইন্তেকাল করেন ১০৪ হিজরীতে। ইমাম মকহুলের ইন্তেকাল হয় ১৩৪ সনে। আর ইমাম যুহরীও এই ১২৩, ১২৪ কিংবা ১২৫ হিজরী সনে ইন্তেকাল করেন। এই হিসাবের ভিত্তিতে বলা যায়, হাদীস-গ্রন্হ প্রণয়নের ক্ষেত্রে ইমাম মকহুল প্রথম ব্যক্তি।

কিন্তু বিশেষভাবে বিচার করিলে এই সিদ্ধান্তই গ্রহণ করিতে হয় যে, হাদীস সংগ্রহ ও সংকলনের কাজ সর্বপ্রথম করিয়াছেন মদীনার হাদীসবিদগণ- আবূ বকর ইবনে হাজম, সালেম ও ইমাম যুহরী প্রমুখ। আর অধ্যায় ভিত্তিতে হাদীসের গ্রন্হ প্রণয়নের কাজ করিয়াছেন কূফার মুহাদ্দিসগণ- ইমাম শা’বী ও অন্যান্য।

[********************]

উমাইয়া বংশের ‘খলীফায়ে রাশেদা’ উমর ইবনে আবদুল আযীয হাদীস সংগ্রহ ও সংকলনের ফরমান জারি করার পর বেশিী দিন জীবিত ছিলেন না। কিন্তু তাঁহার এই ফরমানের ফলে হাদীস সংগ্রহ ও সংকলনের যে প্রবাহ তরংগায়িত হইয়িা উঠিয়াছিল, তাহা অতঃপর কয়েক শতাব্দীকাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। ইমাম যুহরীরর পরবর্তী মনীষী ও হাদীসবিদগণ হাদীস সংগ্রহ ও সংকলনের কাজে পূর্ণমাত্রায় আত্মনিয়োগ করিয়াছিলেন। অতঃপর এই কাজ পূর্ণোদ্যমে চলিতে থাকে।

হিজরী দ্বিতীয় শতকে হাদীস সংকলন

উমর ইবনে আবদুল আযীয ১০১ হিজরীর ২৫শে রজব ইন্তেকাল করেন। তাঁহার খিলাফতের মেয়াদ ছিল দুই বৎসর পাঁচ মাস। ইমাম শা’বী ইমাম যুহরী, ইমাম মকহুল দেমাশকী ও কাযী আবূ বকর ইবনে হাযমের সংকলিত হাদীস গ্রন্হাবলী তাঁহারই খিলাফতকালের অমর অবদান। প্রথম হিজরী শতকের মধ্যেই এই গ্রন্হাবলীর সংকলন কার্য সম্পূর্ণতা লাভ করিয়াছিল।

প্রথম হিজরী শতকে এই পর্যায়ে যতটুকু কাজ সম্পন্ন হইয়াছিল, পরিমাণে ও আকারে তাহা বিরাট কিছু না হইলেও উহার ফলে যে হাদীস গ্রন্হ-সংকলনের দ্বার উন্মুক্ত হইয়াছিল, তাহা অনস্বীকার্য। ফলে দ্বিতীয় হিজরী শতকের প্রথম হইতেই এই কাজ যথোপযুক্ত গুরুত্ব সহকারে সম্পন্ন হইতে শুরু করে। এই পর্যায়ে কেবলমাত্র রাসূল (ﷺ)- এর কথা ও কাজ সম্পর্কিত হাদীসই নহে, সাহাবায়ে কিরামের কথা, ফতোয়া, তাবেয়ীদের কুরআন-হাদীসভিত্তিক বিভিন্ন ফতোয়া এবং দ্বীনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে তাঁহাদের কথাবার্তা ও নসীহতের বাণী পর্যন্ত এই যুগের হাদীস গ্রন্হাবলীতে সন্নিবেশিত হইবার সুযোগ লাভ করে।

কিতাবুল আ’সর

তাবেয়ী যুগের মুহাদ্দিসদের সংকলিত হাদীস গ্রন্হাবলী স্বীয় স্বতন্ত্র অস্তিত্ব লইয়া পরবর্তীকালের হাদীসানুধ্যায়ীদের নিকট পৌঁছায় নাই। এই দিক দিয়া আমাদের নিকট বিরাজমান কেবলমাত্র একখানি গ্রন্হেরই নাম করা যাইতে পারে এবং তাহা হইতেছে ‘কিতাবুল আ’সার। ইমাম আবূ হানীফা (র) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা)-এর সময়ে প্রতিষ্ঠিত

[********************] কূফার জামে মসজিদের প্রসিদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্রের প্রধান শিক্ষাগুরু নিযুক্ত হইয়া একদিকে যেমন ‘ইলমে ফিকাহ’র ভিত্তি স্থাপন করেন, অপরদিকে সেই সঙ্গেই তিনি রাসূল (ﷺ)-এর আদেশ-নিষেধমূলক হাদীসসমূহের ও একটি সংকলন নির্ভরযোগ্য সূত্রে সংকলিত হাদীস সমূহের সমন্বয়ে রচনা করেন। এই গ্রন্হেরই নাম হইতেছে ‘কিতাবুল আ’সার’। দুনিয়ার মুসলিম জাতির নিকট ইহা অপেক্ষা প্রাচীনতম হাদীস গ্রন্হ সম্ভবত আর একখানিও বর্তমান নাই। অথবা বলা যায়, মুসলিম উম্মতের নিকট মওজুদ হাদীস গ্রন্হাবলীর মধ্যে ইহাই সর্বাধিক প্রাচীন হাদীস-গ্রন্হ। ইমাম আবূ হানীফার পূর্বে হাদীস সংগ্রহকারিগণ কর্তৃক যেন-তেনভাবে হাদীসসমূহ সংগ্রহ ও সংকলন করার কাজই হইয়াছিল। ঠিক গ্রন্হ প্রণয়নের ধারায় হাদীসের কোন গ্রন্হই বিরচিত হয় নাই। ইমাম শা’বী একই বিষয়ের হাদীস একস্থানে একত্র করিয়া একখানি গ্রন্হের রূপ দিয়াছিলেন বটে; কিন্তু তাহা মাত্র কয়েকটি অধ্যায় পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল, ইহার বেশী কিছু করা তাঁহার পক্ষে সম্ভব হয় নাই। এই কাজ অতঃপর আর অগ্রসরও হইতে পারে নাই। এই কারণে হাদীসসমূহকে পরিচ্ছেদ (কিতাব) ও অধ্যায় (বাব) হিসাবে, গ্রন্হ প্রণয়নের ধারা ও পদ্ধতি অনুসারে সুসংকলিত করার কাজ তখন পর্যন্তও অসম্পন্নই রহিয়া গিয়াছিল। ইমাম আবূ হানীফা (র) ‘কিতাবুল আ’সার’ প্রণয়ন করিয়া এই দায়িত্ব বিশেষ যোগ্যতা ও বিজ্ঞতা সহকারেই পালন করিয়াছিলেন। হাফেজ সুয়ূতী ইমাম আবূ হানীফা (র) সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম আবূ হানীফা (র) বিশেষ একটি কীর্তি-যাহাতে তিনি একক, তাহা এই যে, তিনিই সর্বপ্রথম ইলমে শরীয়াতকে সুসংবদ্ধ করিয়াছেন এবং উহাকে অধ্যায় হিসাবে সংকলিত করিয়াছেন। ইমাম মলিক (র) ‘মুয়াত্তা’ প্রণয়নে তাহারই অনুসরণ করিয়াছেন। কিন্তু এইরূপ গ্রন্হ প্রণয়নের ব্যাপারে ইমাম আবূ হানীফা (র)-কে সময়ের দিক দিয়া কেহই অতিক্রম করিয়া যাইতে পারেন নাই।

[********************]

ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর সংকলিত ‘কিতাবুল আ’সার’ সম্পর্কে হাফেজ ইবনে হাজার আল-আসকালানী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম আবূ হানীফা (র) বর্ণিত স্বতন্ত্র হাদীস-গ্রন্হ বর্তমান। আর তাহা হইতেছে ‘কিতাবুল আ’সার’; ইহা তাঁদের নিকট হইতে মুহাম্মদ ইবনে হাসান বর্ণনা করিয়াছেন।

[********************]

ইমাম আলাউদ্দিন ‘কাশানী’ এই কিতাবের উল্লেখ করিয়াছেন ******************** ইমাম আবূ হানীফা (র) সংকলিত ‘কিতাবুল আ’সার’ বলিয়া।

[********************]

‘কিতাবুল আ’সার’ নামক হাদীসগ্রন্হখানি প্রণয়নের ব্যাপারে ইমাম আবূ হানীফা (র) ব্যাপকভাবে হাদীস সংগ্রহ ও ছাঁটাই-বাছাই করিয়াছেন। সদরুল আয়িম্মা মুয়াফফিক ইবনে আহমদ মক্কী তাঁহার গ্রন্হে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম আবূ হানীফা (র) চল্লিশ সহস্র হাদীস হইতে ছাঁটাই-বাছাই করিয়া ‘কিতাবুল আ’সার’-এর এই গ্রন্হখানি প্রণয়ন করেন।

[******************** এখানে হাদীসের যে সংখ্যা বলা হইয়াছে, তাহা হাদীসের আলাদা আলাদা সংখ্যা নহে; বরং হাদীসের সূত্র মাও এবং এক-একটি হাদীসের বহু সংখ্যক সূত্র হইতে পারে।]

হাদীস চয়ন ও হাদীস গ্রহণের ব্যাপারে তাঁহার এই অসামান্য সতর্কতার কথা সকল হাদীস-পারদর্শী ব্যক্তিই স্বীকার করিয়াছেন। ইমাম ওকী (র) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

হাদীস গ্রহণের ব্যাপারে ইমাম আবূ হানীফা (র) কর্তৃক যেরূপ সতর্কতা অবলম্বিত হইয়াছে, তদ্রুপ আর কাহারও দ্বারা অবলম্বিত হয় নাই।

[ঐ, এখানে উল্লেখ্য, হাদীসের ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে সায়ীদুল কাতান হাদীস যাচাই, পরখ ও বাছাই-ছাঁটাই শাস্ত্রে পারদর্শী ছিলেন। তিনি বলিয়াছেনঃ

****************************************************** আল্লাহর নামের শপথ, মুসলিম উম্মত বা জাতির নিকট আল্লাহ ও রাসূলের নিকট হইতে পাওয়া সমস্ত ইলম-এর ক্ষেত্রে অধিক বড় আলিমরূপে স্বীকৃত।]

ঠিক এই কারণেই মনে হয় মুহাদ্দিমগণ ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর সমালোচনা করিতে গিয়া তাঁহাকে ******************** ‘হাদীস বর্ণনায় অত্যন্ত কঠোর ও কড়া লোক’ বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন এবং এই কারণেই তাঁহার বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা খুব বেশী হইতে পারে নাই। ঐতিহাসিক আল্লামা ইবনে খালদুন ইহার কারণ বর্ণনা প্রসংগে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম আবূ হানীফা (র)- এর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম হওয়ার কারণ এই যে, তিনি হাদীস গ্রহণ ও বর্ণনার ব্যাপারে কঠোর নৈতিক শর্ত আরোপ করিতেন।

[********************]

ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর সংগ্রহীত হাদীসের বিপুলতা ও উহা সামান্য পরিমাণ বর্ণনা করা সম্পর্কে স্বয়ং ইমাম আবূ হানীফা (র)- এর হইতে একটি উক্তি এখানে উল্লেখযোগ্য। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমার নিকট কয়েক সিন্দুক ভর্তি লিখিত হাদীস-সম্পদ মজুদ রহিয়াছে। কিন্তু আমি তাহা হইতে অতি অর্প সংখ্যকই প্রকাশ ও বর্ণনা করিয়াছি, যাহা লোকদের ব্যবহারিক জীবনের উপকার দিবে।

[********************]

অন্যান্য হাদীস গ্রন্হের ন্যায় ‘কিতাবুল আ’সার’-এর ‘নুসখা’ (অনুলিপি) রহিয়াছে। এই কারণে তাহা এক-একজন ছাত্রের নামেই প্রখ্যাত হইয়াছে। অন্যথায় মূল গ্রন্হ ইমাম আবূ হানীফারই সংকলিত একখানি মাত্র হাদীসগ্রন্হ। এই ‘নুসখা’ প্রকাশকারীদের মধ্যে নিম্নলিখিত ব্যক্তিদের নাম উল্লেখযোগ্যঃ

১. ইমাম যুফার ইবনুল হুযাইলঃ এই সম্পর্কে প্রামাণ্য গ্রন্হাবলীতে উদ্ধৃত হইয়াছেঃ

******************************************************

আহমদ ইবনে বকর যুফার ইবনুল হুযাইলের ছাত্র আবূ ওহাবের নিকট হইতে আবূ হানীফা (র)- এর সংকলিত ‘কিতাবুল আ’সার’ বর্ণনা করিয়াছেন।

[********************]

২. ইমাম আবূ ইউসুফ ইবনে আবূ ইউসুফঃ তাঁহার সম্পর্কে উদ্ধৃত হইয়াছেঃ

******************************************************

ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর নিকট হইতে তাঁহার সংকলিত ‘কিতাবুল আ’সার’ তাঁহার পিতার সূত্রে বর্ণনা করিয়াছেন। উহা একখানি বিরাট আকারের গ্রন্হ।

[কাজী আতহার মূবারকপুরী (বো’ই হইতে প্রকাশিত ‘আল বালাগ’ পত্রিাকর সম্পাদক) লিখিয়াছেনঃ ইমাম আবূ হানীফার ‘কিতাবুল আ’সার’ তাঁহার নিকট হইতে তাঁহার ছাত্ররা অন্য লোকদের নিকট বর্ণনা করিয়াছেন এবং বর্ণনা করার সময় তারা নিজেরাও ইহাতে অনেক হাদীস সংযোজিত করিয়াছেন। এই কারণে মূল গ্রন্হখানি বিভিন্ন ছাত্রের নামে জনগণের মধ্যে পরিচিত হইয়াছে। অন্যথায় মুলগ্রন্হ ইমাম আবূ হানিফা (র)-এর সংকলিত হাদীস গ্রন্হ।********************]

৩. ইমাম মুহাম্মদ ইবনে হাসান শায়বানীঃ তাঁহার তৈরী করা সংকলনটিই প্রসিদ্ধ এবং ইহাই বর্তমান ভূলক্রমে ইমাম মুহাম্মদ (র)-এর সংকলিত ‘কিতাবুল আ’সার’ বলিয়া পরিচিত।

৪. ইমাম হাসান ইবনে যিয়াদ লু’লুয়ীঃ ইবনে হাজার আসাকালানী (র) ইহার সম্পর্কে মুহাম্মদ ইবেন ইবরাহীমের আলোচনা প্রসঙ্গে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

মুহাম্মদ ইবন ইবরাহীম ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর ‘কিতাবুল আ’সার’ মুহাম্মদ ইবনে শুজা তাহার ওস্তাদ হাসান ইবনে যিয়াদের সূত্রে বর্ণনা করিয়াছেন।

[********************]

মুয়াত্তা ইমাম মালিক

ইমাম আবূ হানীফা (র)- এর সংকলিত ‘কিতাবুল আ’সার’-এর পরে পরেই সংকলিত হাদীস গ্রন্হ হিসাবে আমরা দেখিতে পাই ইমাম মালিক (র)-এর সংকলিত ‘মুয়াত্তা’।

কিতাবুল আ’সার ও মুয়াত্তা ইমাম মালিক (র)-এর মধ্যে একটি প্রধান পার্থক্য এই যে, প্রথমোক্ত গ্রন্হে হিজায, ইরাক, সিরিয়াও মুসলিম জাহানের অন্যান্য হাদীস-বর্ণনাকারী লোকদের বর্ণিত হাদীসসমূহ সন্নিবেশিত হইয়াছে; কিন্তু ‘মুয়াত্তা ইমাম মালিক’-এ রহিয়াছে কেবলমাত্র মদীনায় অবস্থানকারী মুহাদ্দিসদের বর্ণিত হাদীস। কেননা ইমাম মালিক (র) সম্পর্কে পূর্ববর্তী আলোচনা হইতে আমরা দেখিয়াছি যে, তিনি হাদীস সংগ্রহের জন্য মদীনার বাহিরে কখনো সফরে গমন করেন নাই।

‘মুয়াত্তা’ গ্রন্হের ধারা এইভাবে সাজানো হইয়াছে যে, প্রথমে রাসূলে করীম (ﷺ)-এর হাদীস- কথা বা কাজের বিবরণ উল্লেখ করা হইয়াছে। তাহার পর উহাতে সাহাবায়ে কিরামের কথা এবং তাবেয়ীদের কুরআন-হাদীস ভিত্তিক ফতোয়াসমূহ সন্নিবেশিত হইয়াছে।

[********************]

ইমাম মালিক (র) হাদীসের এই গ্রন্হখানি সংকলন করেন আব্বাসী খলীফা আল- মনসুর –এর আদেশক্রমে। মুহাম্মদ আবূ যাহু নামক এ যুগের একজন মিসরীয় গ্রন্হ-প্রণেতা লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

আব্বাসী খলীফা আবূ জাফর আল-মনসূর ইমাম মালিক (র)- কে ডাকিয়া বলিলেনঃ তিনি যেন তাঁহার নিজের নিকট প্রমাণিত ও সহীহরূপে সাব্যস্ত হাদীসসমূহ সংকলন ও একখানি গ্রন্হাকারে তাহা প্রণয়ন করেন এবং উহাকে যেন তিনি লোকদের ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োগ করার জন্য নির্দিষ্ট করেন। অতঃপর তিনি তাঁহার এই গ্রন্হ প্রণয়ন করেন এবং উহার নাম নির্দিষ্ট করেন- ‘আল-মুয়াত্তা’।

[********************]

ইমমা মালিক (র) এই গ্রন্হখানি প্রণয়নের অপরিসীম শ্রম-মেহনত ও অমলিন ধৈর্য ও অধ্যবসায় নিয়োগ করিয়াছিলেন। ইমাম সুয়ূতী ইবনুল হুবাব-এর সূত্রে উল্লেখ করিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম মালিক (র) প্রথমে একলক্ষ বর্ণনা করেন। তাহা হইতে দশ হাজার হাদীসের সমন্বয়ে ‘মুয়াত্তা’ গ্রন্হ সংকলন করেন। অতঃপর তিনি উহাকে কুরআন ও সুন্নাহর দৃষ্টিতে যাঁচাই করিতে থাকেন। সাহাবীদের আ’সার ও অন্যান্য খবর-এর ভিত্তিতেও উহার পরীক্ষা করেন। শেষ পর্যন্ত উহাতে মাত্র পাঁচশত হাদীস সন্নিবেশিত করেন।

[********************]

ইমাম সুয়ূতী আতীক ইবনে ইয়াকুবের সুত্রে নিম্নোক্ত বর্ণনাও উদ্ধৃত করিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম মালিক প্রায় দশ সহস্র হাদীসের সমন্বয়ে ‘মুয়াত্তা’ রচনা করেন। অতঃপর তিনি উহার প্রত্যেক বৎসর দৃষ্টি দিতে ও যাঁচাই করিতে এবং উহা হইতে হাদীস প্রত্যাহার করিতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত বর্তমান আকারে উহা পূর্ণ পরিণীত লাভ করে।

[********************]

এই গ্রন্হ প্রণয়ন চূড়ান্তভাবে সম্পূর্ণ করিতে ইমাম মালিকের পূর্ণ চল্লিশটি বৎসর সময় লাগিয়াছে। এ সম্পর্কে বলা হইয়াছেঃ

******************************************************

মুহাদ্দিসগণ বলিয়াছেন, ইমাম মালিক এই গ্রন্হখানি প্রণয়নে পূর্ণ চল্লিশটি বৎসর অতিবাহিত করিয়াছেন। এই দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তিনি উহাকে যাঁচাই ও ছাঁটাই করিতেছিলেন এবং উহাকে সুসংবদ্ধরূপে সজ্জিত, নির্ভূল ও শৃংখলিত করিতে ব্যস্ত ছিলেন।

[********************]

এই গ্রন্হের নামকরণ সম্পর্কে ইমাম মালিক নিজেই বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমার এই কিতাবখানা আমি মদীনায় বসবাসকারী সত্তর জন ফিকাহবিদ-এর সম্মুখে পেশ করিয়াছি। তারা প্রত্যেকেই উহার জন্য আমাকে উপদেশ দিয়াছেন। এই কারণে আমি উহার নাম রাখিয়াছি ‘মুয়াত্তা’।

[********************]

উপরে ইবনুল হুবাবের সূত্রে উল্লেখিত ইমাম সুয়ূতীর উদ্ধতি হইতে জানা গিয়াছে যে, ইমাম মালিক দশ হাজার হাদীস হইতে ছাঁটাই-বাছাই করিয়া মাত্র পাঁচশত হাদীস তাঁহার গ্রন্হে রাখিয়াছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ‘মুয়াত্তা’ গ্রন্হে মোট কতটি হাদীস সন্নিবেশিত হইয়াছে, তাহা এই উদ্ধৃতি হইতে জানা যায় না। এই সম্পর্কে ইমাম সয়ূতীর নিম্নোক্ত উদ্ধৃতি হইয়াছে, তাহা এই উদ্ধৃতি হইতে জানা নির্দিষ্ট সংখ্যা জানা যায়। তিনি আবূ বকর আল- আবরাহীর সূত্রে উল্লেখ করিয়াছেনঃ

******************************************************

মুয়াত্তা গ্রন্হে রাসূলে করীম (ﷺ), সাহাবায়ে কিরাম ও তাবেয়ীন হইতে বর্ণিত হাদীসের মোট সংখ্যা হইতেছে এক হাজার সাতশত বিশটি।

[********************]

ইহার মধ্যে সঠিকরূপে সনদযুক্ত হাদীস হইতেছে মাত্র তিনশত, ‘মুরসাল’ হাদীস হইতেছে ২২২টি, ‘মওকুফ’ হইতেছে ৬১৬টি এবং তাবেয়ীদের উক্তি হইতেছে ২৮৫টি।

[********************] ইমাম হাযম (র) বলেনঃ

******************************************************

আমি ‘মুয়াত্তা’ গ্রন্হের হাদীসসমূহ গণনা করিয়াছি। ফলে উহাতে আমি পাইয়াছি ‘মুসনাদ’ হাদীস পাঁচশতের কিছু বেশী প্রায় তিনশত হাদীস ‘মরসাল’। এতদ্ব্যতীত উহাতে প্রায় সত্তরটি হাদীস এমনও আছে, যাহার অনুসরণ করা ইমাম মালিক (র) পরিহার করিয়াছিলেন।

[********************]

‘মুয়াত্তা’ গ্রন্হের নোসখা অসংখ্য। তন্মধ্যে তিনশত ‘নোসখা’ অত্যন্ত প্রসিদ্ধ। এই নোসখাসমূহে সন্নিবেশিত হাদীসের সংখ্যায় যথেষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান- কোনটিতে অপেক্ষাকৃত বেশী, আর কোনটিতে কম হাদীস রহিয়াছে। ইমাম সুয়ুতী ইহার তিনটি নোসখার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করিয়াছেন। নোসখা তিনটি এইঃ

১. ইয়াহইয়া ইবনে ইয়াহইয়া লাইসী আন্দালুসীকৃত নোসখাঃ তিনি ইমাম মালিক (র)-এর নিকট হইতে সরাসরিভাবে শেষ তিনটি অধ্যায় বাদে সম্পূর্ণ ‘মুয়াত্তা’ গ্রন্হ শবণ করিয়াছিলেন।

২. আবূ মুসয়িব আহমদ ইবনে আবূ বকর আল কাসিম কৃতঃ তিনি মদীনার বিচারপতি ছিলেন এবং তাঁহার তৈরী করা নোসখাই ইমাম মালিক (র)-কে সর্বশেষে শুনানো হয়। ইহাতে অপর নোসখার তুলনায় প্রায় একশতটি হাদীস বেশী রহিয়াছে।

৩. ইমাম মুহাম্মদ ইবনুল হাসান শায়বানী কৃতঃ তিনি যেমন ইমাম আবু হানীফা (র)-এর নিকট ইলমে ফিকাহ শিক্ষা করিয়াছেন, অনুরুপভাবে ইমাম মালিক (র)-এর নিকট হাইতে তিনি হাদীস শিক্ষা ও গ্রহণ করিয়াছেন।

[********************]

ইমাম মালিক (র)-এর নিকট হইতে ‘মুয়াত্তা’ গ্রন্হ শ্রবণ করিয়া প্রায় এক হাজার ব্যক্তি উহার বর্ণনা করিয়াছেন।

[********************] ইহা হইতে প্রমাণিত হয় যে, তদানীন্তন ইসলামী সমাজে ‘মুয়াত্তা’ গ্রন্হ যথাযথ মর্যাদা লাভ করিয়াছিল। জনগণ উহাকে সাদরে গ্রহন করিয়াছিল এবং মদীনার অধিবাসী ইমাম মালিক (র)-এর নিকট সরাসরিভাবে উহা আদ্যোপান্ত শ্রবণ করার উদ্দেশ্যে গোটা মুসলিম জাহানের জনতা ভীড় জমাইয়াছিল। বহু সংখ্যক মুহাদ্দিস এই কারণেই মনে করেন যে, তিরমিযী শরীফে উদ্ধৃত নবী করীম (ﷺ)-এর নিম্নোক্ত ভবিষ্যদ্বাণী ইমাম মালিক (র) সম্পর্কেই সত্য প্রমাণিত হইয়াছে। হাদীসটি এই- নবী করীম (ﷺ) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

সেই সময় খুব দূরে নয়, যখন জনগণ ইলম হাসিল করার উদ্দেশ্যে উষ্ট্রপৃষ্ঠে সাওয়ার হইয়া দূর দূর দেশ সফর করিবে; কিন্তু তাহারা মদীনায় অবস্থানকারী ‘আলেম’ অপেক্ষা অধিক বিজ্ঞ অন্য কাহাকেও কোথাও পাইবে না।

[********************]

ইবনে উয়াইনা ও আবদুর রাযযাক প্রমুখ বিখ্যাত মুহাদ্দিসগণ একবাক্যে বলিয়াছেন যে, এই হাদীসে উক্ত ‘আলেম’ হইতেছেন ইমাম মালিক (র)।

[তিরমিযী, হযরত আবূ হুরায়রা বর্ণিত।]

‘মুয়াত্তা’ ইমাম মালিক (র) সম্পর্কে ইমাম শাফেয়ী (র) অত্যন্ত উচ্চ ধারণা পোষণ করিতেন ও ইহাকে এক অনন্য সাধারণ গ্রন্হ মনে করিতেন। তাঁহার এই সম্পর্কিত নিম্নোদ্ধৃত উক্তি সর্বজনবিদিত। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আল্লাহর কিতাবের পর ইমাম মালিক (র) সংকলিত হাদীসের কিতাব অপেক্ষা অধিক বিশুদ্ধ গ্রন্হ দুনিয়ার বুকে আর একখানিও নাই।

[********************]

তাঁহার এই কথাটি নিম্নোক্ত ভাষায়ও বর্ণিত হইয়াছেঃ

******************************************************

কুরআনের অধিকতর নিকটবর্তী কিতাব ইমাম মালিক (র)-এর কিতাব অপেক্ষা আর একখানিও পৃথিবীর বুকে রচিত হয় নাই।

[********************]

পরবর্তীকালের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আবূ জারয়া মুয়াত্তা মালিক (র) সম্পর্কে বলিয়াছেনঃ

******************************************************

এতখানি আস্থা ও নির্ভরতা অপর কোন কিতাবের উপর স্থাপিত হয় নাই।

[********************]

ইমাম মালিক সংকলিত এই হাদীস গ্রন্হ এতই জনপ্রিয়তা লাভ করিয়াছিল যে, তদানীন্তন আব্বাসীয় বাদশাহ আল-মনসুর হ্জ্জ উপলক্ষে মদীনায় গমন করিলে তিনি ইমাম মালিক (র)-কে লক্ষ্য করিয়া বলিলেনঃ

******************************************************

আমি সংকল্প করিয়াছি যে, আপনার সংকলিত হাদীস গ্রন্হখনির অসংখ্য অনুলিপি তৈয়ার করাইয়া প্রত্যেক মুসলিম শহরেও নগরে এক-একখানি করিয়া পাঠাইয়া দিব ও সেই অনুযায়ী আমল করার জন্য সকলকে আদেশ করিব। এবং উহাকে ছাড়িয়া অপর কোন গ্রন্হের দিকে মনোযোগ না দিতে বলিব।

এই কথা শ্রবণের পর ইমাম মালিক (র)-এর মনে আনন্দ ও স্ফূর্তির বন্যা প্রবাহিত হওয়াই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু ইমাম মালিক (র)-ইহা মোটেই পছন্দ করিতে ও মানিয়া লইতে পারিলেন না। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলিলেনঃ

******************************************************

আপনি এইরূপ কাজ করিবেন না। কেননা লোকরেদ নিকট পূর্বেই শরীয়াতের বহু কথা পৌঁছিয়া গিয়াছে। তাহারা বহু হাদীস শ্রবণ করিয়াছে, বহু হাদীস তাহারা বর্ণনা ও করিয়াছে এবং লোকেরা প্রথমেই যাহা কিছু পাইয়াছে, তাহাই তাহারা গ্রহণ করিয়া লইয়াছে, তদানুযায়ী তাহারা আমল শুরু করিয়া দিয়াছে। অতএব প্রত্যেক শহর ও অঞ্চলের লোকেরা নিজেদের জন্য যাহাই গ্রহণ করিয়াছে তদানুযায়ীই তাহাদিগকে আমল করিতে দিন।

[********************]

অতঃপর বাদশাহ হারুন-অর-রশীদও ‘মুয়াত্তা’ মালিক (র) সম্পর্কে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে চাহিয়াছিলেন। তিনি উহাকে কা’বা ঘরের সঙ্গে ঝুলাইয়া রাখার ও তদানুযায়ী আমল করার জন্য জনগণকে নির্দেশ দেওয়ার সংকল্প করিয়াছিলেন। কিন্তু ইমাম মালিক (র)-এর নিকট ইহার ইচ্ছা প্রকাশ করিলে তিনি বলিলেনঃ

******************************************************

না, আপনি এইরূপ করিবেন না। কেননা রাসূলের সাহাবীদের মধ্যে খুঁটিনাটি ব্যাপারে মত-পার্থক্য রহিয়াছে, তারা বিভিন্ন শহরে ও অঞ্চলে ছড়াইয়া পড়িয়াছেন। আর তাহারা সকলেই সঠিক পথে পরিচালিত।

[********************]

ইসলামের বিরাট ও ব্যাপক জীবন-ব্যবস্থার খুঁটিনাটি ব্যাপারে মতভেদ হওয়া অতি স্বাভাবিক। ইহার পথ বন্ধ করিয়া দিয়া সকল মানুষকে বিশেষ ও নির্দিষ্ট একটি মতের অনুসারী করিতে চেষ্টা করা ও সেজন্য রাজ-ক্ষমতার ব্যবহার করা কিছুতেই সমীচীন হইতে পারে না। বরং ইসলামী বিধানভিত্তিক সকল (খুঁটিনাটি) মতকেই- তাহা বাহ্যত যতই পরস্পর-বিরোধী মনে হউক না কেন, সত্য ও সঠিক বলিয়া স্বীকার করাই হইতেছে ইসলামের নীতি। ইমাম মালিক (র)-এর উপরোক্ত উক্তি হইতেও এই কথা প্রমাণিত হয়। ইমাম মালিক (র)-এর এই নীতি যে অত্যন্ত যুক্তিসংগত ও ইনসাফপূর্ণ ছিল, তাহাতে সন্দেহ নাই। ইমাম ইবনে আবদুল বার (র) এই নীতির প্রতি লক্ষ্য করিয়া বলিয়াছেনঃ

******************************************************

সমঝদার লোকদের জন্য ইহা এক অতি ইনসাফপূর্ণ নীতি, সন্দেহ নাই।

[********************]

ফিকাহর খুঁটিনাটি মাসলা লইয়া যাঁহারা সীমালংঘনকারী গোঁড়ামীতে লিপ্ত রহিয়াছেন ও খুঁটিনাটি ব্যাপারে নিজস্ব একটি বিশেষ মতকে জোরপূর্বক অন্যান্য মানুষের মাথায় চাপাইয়া দিবার জন্য অনমনীয়, ইমাম মালিক (র)- এর উপরোক্ত ভূমিকায় তাঁহাদের জন্য বিশেষ শিক্ষা নিহিত রহিয়াছে।

জামে সুফিয়ান সওরী (র)

ঠিক এই সময়ই ইমাম সুফিয়ান সওরী (র) তাঁহার সংকলিত হাদীস গ্রন্হ ‘আল-জামে’ নামে প্রণয়ন করেন। সুফিয়ান সওরী (র) ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর অনুষ্ঠিত দারসের মজলিসে রীতিমত হাযির থাকিতেন এবং তাঁহার সূত্রে হাদীস বর্ণনা করিতেন। কিন্তু ফিকাহ তিনি গ্রহণ করিয়াছেন ইমাম আবূ হানীফার বিশিষ্ট ছাত্র আলী ইবনে মসহর-এর নিকট হইতে। আলী ইবনে মসহর ছিলেন ফিকাহ ও হাদীস উভয়েরই বিশিষ্ট সুদক্ষ আলিম। তাঁহার সম্পর্কে বিশেষজ্ঞগণ লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তিনি হাদীস ও ফিকাহ- উভয়েরই পরদর্শী ছিলেন।

[********************]

ইমাম সাওরী তাঁহারই সাহায্য ও সহযোগীতা লইয়া তাঁহার জামে গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন। ইমাম ইয়াযীদ ইবনে হারূন বলিয়াছেনঃ

******************************************************

সুফিয়ান সওরী ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর ফিকাহ গ্রহণ করিতেন আলী ইবনে মসহর-এর নিকট হইতে এবং তাঁহারই সাহায্য এবং তাঁহার সহিত আলাপ-আলোচনা করিয়াই তিনি তাঁহার ‘জামে’ নামক হাদীস গ্রন্হ প্রণয়ন করেন।

[********************]

এককালে সুফিয়ান সওরীর এই ‘আল-জামে’ কিতাখানি হাদীসবিদদের নিকট বড়ই প্রিয় ও বহুল পঠিত হওয়ার মর্যাদা লাভ করিয়াছিল। ইমাম বুখারী (র) সর্বপ্রথম যেসব হাদীস-গ্রন্হ অধ্যয়ন করিয়াছেন, তন্মধ্যে এই ‘আল-জামে’ গ্রন্হ অন্যতম।

ইমাম ইসহাক ইবনে রাহওয়ায় (র)-এর নিকট প্রশ্ন করা হইয়াছিলঃ

******************************************************

গ্রন্হদ্বয়ের মদ্যে কোনখানি অধিকতর উত্তম, ইমাম মালিকের ‘মুয়াত্তা’ না সুফিয়ান সওরীর ‘আল-জামে’?

তিনি অবশ্য জওয়াবে ‘মুয়াত্তা ইমাম মালিক’কে উত্তম কিতাব বলিয়াছিলেন।

[********************] কিন্তু ইমাম আবূ দাউদ সিজিস্তানী (সুনান প্রণেতা) ইহা হইতে ভিন্ন মত পোষণ করেন। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

এই পর্যায়ে লোকেরা যত গ্রন্হই প্রণয়ন করিয়াছেন, সুফিয়ান সওরীর ‘আল-জামে’ তন্মধ্যে সবচেয়ে উত্তম গ্রন্হ।

[********************]

উপরে এই সময় পর্যন্ত সংকলিত হাদীস গ্রন্হসমূহের মধ্যে কেবলমাত্র উল্লেখযোগ্য কয়েকখানির সংক্ষিপ্ত পরিচয় পেশ কর হইয়াছে, কিন্তু এই শতকের বিস্তারিত ইতিহাস প্রমাণ যে, এই সময়ে কেবলমাত্র এই কয়েকখানি গ্রন্হই সংকলিত হয় নাই। বরং এতদ্ব্যতীত আরো কয়েকখানি হাদীস-গ্রন্হ সংকলিত হইয়াছে। কিন্তু সেই গ্রন্হসমূহ উপরোল্লিখিত গ্রন্হ কয়খানি হইতে সরাসরি ও বিশেষ সাহায্য গ্রহণের মারফতেই সংকলিত হইয়াছে বলিয়া উহাদের সবিশেষ উল্লেখ করা হয় না।

এই সময় দুইজন গভীর পাণ্ডিত্যপূর্ণ মুহাদ্দিসের আবির্ভব ঘটে। উল্লেখযোগ্য যে, তাঁহাদের দুইজনেরই নাম আবূ হাফস এবং তারা হইতেছেন পিতা ও পুত্র। পিতা-পুত্রের একই নাম হওয়ার কারণে তাঁহাদের পরস্পরের মধ্যে পার্থক্য করার উদ্দেশ্যে পিতাকে আবূ হাফস কবীর (বড়) এবং পুত্রকে আবূ হাফস সগীর (ছোট) বলিয়া সম্ভোধন করা হয়। এইযুগে ইলমে হাদীসের প্রচার ও প্রসারকার্যে এই দুইজনের অবদান অবিস্মরণীয়। তারা বুখারার প্রদান মুহাদ্দিসদের মধ্যে গন্য এবং তাঁহাদের প্রচেষ্টায়ই বুখারার সমস্ত এলাকায় ইলমে হাদীস ব্যাপক প্রচার লাভ করে, ঘরে ঘরে উহার চর্চা, শিক্ষা ও আলোচনা শুরু হয়। হাফেজ সাময়নী আূ হাফস কবীর সম্পর্কে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

তাঁহার নিকট হইতে এত লোক হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন যে, তাহার সংখ্যা নিরূপণ সম্ভব নয়।

[********************]

বস্তুত বুখারার প্রতিটি গ্রামে তাঁহার ছাত্রগণ ছড়াইয়াছিল। খাইজাখীজ নামক গ্রামেও তাঁহার অসংখ্য ছাত্র ইলমে হাদীসের চর্চায় নিযুক্ত ছিল।

[********************]

ইমাম আবূ হাফস ইমাম আবূ ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মদের নিকট হইতে ইলমে হাদীস ও ফিকাহ শিক্ষা করেন। হাফেজ যাহবী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম আবূ হাফস কবীর ইমাম মুহাম্মদের প্রধান ছাত্রদের মধ্যে গণ্য ছিলেন এবং বুখারার হানাফী আলিমদের নের্তৃত্বের তিনিই ছিলেন শেষ স্তম্ভ।

[********************]

ইসলামের ইতিহাসে ইহা এমন এক পর্যায়ে, যখন তাফসীর, হাদীস, ফিকাহ ও ইতিহাস-ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের এই বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ব্যাপকভাবে গ্রন্হ-প্রণয়নের কাজ সম্পাদিত হয়। ঐতিহাসিক সুয়ূতী লিখিয়াছেনঃ এই সময় ইমাম আবূ হানীফা ও ইমাম মালিকের নিকট শিক্ষাপ্রাপ্ত ও দীক্ষিত অসংখ্য লোক ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিপুল সম্ভার বক্ষে ধারণ করিয়া মুসলিম জাহানের বিভিন্ন স্থানে কেন্দ্র স্থাপন করিয়া উহার ব্যাপাক শিক্ষাদান ও প্রচারকার্যে আত্মনিয়োগ করেন। ইমাম আবূ হানীফার ছাত্রদের প্রকৃত সংখ্যা কত হাফেয আবদুল কাদের কুরায়শীর নিম্নোদ্ধৃত বর্ণনা হইতে এই সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। তিনি লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর নিকট হইতে প্রায় চার সহস্র ব্যক্তি হাদীস ও ফিকাহ সম্পর্কীয় তাঁহার মত বর্ণনা ওপ্রচার করিয়াছেন।

[********************]

ইমাম হাজেজুদ্দীন ইবনুল বাযযায কুরদারী ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর বিপুল সংখ্যক ও মুসলিম জাহানের সর্বত্র বিক্ষিপ্ত ছাত্রদের এক দীর্ঘ তালিকা পেশ করিয়াছেন। উহার শিরোনামায় নিম্নোদ্ধৃত কথা লিখিত হইয়াছেঃ

******************************************************

পূর্ব ও পশ্চিম এলাকার শহরে-শহরে বিক্ষিপ্ত ঐসব লোক, যাঁহারা ইমাম আবূ হানীফার নিকট হইতে হাদীস ও ফিকাহ বর্ণনা করিয়াছেন।

অতঃপর তিনি তদানীন্তন মুসলিম জাহানের প্রায় সব কয়টি উল্লেখযোগ্য প্রদেশ, শহর, নগর, ও গ্রামের নাম লিখিয়া তথায় ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর কোন কোন ছাত্র হাদীস ও ফিকাহ প্রচারে নিযুক্ত ছিলেন, তাহার বিস্তারিত বিবরণ পেশ করিয়াছেন।

[********************]

ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর নিকট হইতে হাদীস ও ফিকাহর শিক্ষা লাভের পর যেসব মনীষী স্বাধীন ও নিজস্বভাবে গ্রন্হ প্রণয়ন করিয়াছেন, তাঁহদের সম্পর্কে ইমাম তাহাভী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর যেসব ছাত্র গ্রন্হ প্রণয়নের কাজ করিয়াছেন, তারা হইতেছেন, চল্লিশজন। তাঁহাদের প্রথম পর্যায়ের দশজনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেনঃ ইমাম আবূ ইউসুফ, ইযুফার, ইমাম দাউদ-আত্তায়ী, ইমাম আসাদ ইবনে আমর, ইমাম ইউসুফ ইবন খালিদ সিমতী, ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে যাকারিয়া ইবেন আবূ যায়েদা। আর এই শেষোক্ত ব্যক্তি তো ত্রিশ বৎসর পর্যন্ত প্রথমোক্ত ব্যক্তিদের লেখক হইয়া কাজ করিয়াছেন।

[********************]

তারা সকলেই খ্যাতনামা মুহাদ্দিস ছিলেন। ইমাম হাসান ইবেন যিয়াদও এই পর্যায়েরই একজন শ্রেষ্ঠ হাদীসবিদ। তিনি ইবনে জুরাইজ-এর নিকট হইতে হাদীস সংগ্রহ করিয়াছেন। তিনি নিজেই বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি ইবনে জুরইজের নিকট হইতে বারো হাজার হাদীস লিখিয়া লইয়াছিলাম। এই হাদীসসমূহ ফিকাহবিদদের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

[********************]

মোটকথা, ইমাম যুহরীর অব্যবহিত পর হইতেই হাদীস সংকলন ও হাদীস গ্রন্হ প্রণয়নের এক দুই কূলপ্লাবী সয়লাব প্রবাহিত হয়। মুসলিম জাহানের প্রায় প্রত্যেকটি শহরেই এই কাজ আরম্ভ হইয়া যায়। এই সময়কার অন্যান্য গ্রন্হ প্রণেতা হইতেছেনঃ

মক্কায় এবনে জুরইজ (১৫০ হিঃ); ইবনে ইসহাক (১৫২ হিঃ); মদীনায় সায়ীদ ইবনে আবূ আরুজা (১৫৬ হিঃ); রুবাই ইবনে দুবাই (১৬০ হিঃ) ও মালিক ইবনে আনাস (‌১৭৯ হিঃ) বসরায় হাম্মাদ ইবনে সালামাহ (১৭৬ হিঃ) ও ইবনে আরূবা; কুফায় সুফিয়ান সওরী (১৬১ হিঃ) সিরিয়ায় আবূ আমর আওযায়ী (১৫৬ হিঃ) ওয়াসতে হুশাইম (১৮৮ হিঃ); লাইস ও ইবনে লাহইয়া’ খুরাসানে আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক (১৮১ হিঃ) ইয়ামেনে মা’মর (১৫৩ হিঃ) রায় শহরে জরীর ইবনে আবদুল হামিদ (১৮৮ হিঃ) তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ স্থানে হাদীস সংগ্রহ ও সংকলনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন।

[********************]

তারা সকলেই প্রায় একই যুগের লোক এবং সমমাময়িক; দ্বিতীয় হিজরী শতকের তারা শ্রেষ্ঠ হাদীসবিদ।

[********************] আর তাঁহাদেরই অবিশ্রান্ত সাধনা ও আন্তরিক গভীর নিষ্ঠাপূর্ণ গবেষণা ও যাচাই পরীক্ষা চালনার ফলেই হানাফী মাযহাবের দৃষ্টিতে ইলমে ফিকাহদের বিরাট প্রাসাদ রচিত হয়।

অনুরূপভাবে ইমাম মালিক (র)-এর ছাত্রগণও মুসলিত জাহানের প্রাচ্য ও প্রতীচ্যে ছড়াইয়া পড়েন। তাঁহার নিকট হাদীস শিক্ষা লাভ করিয়াছেন ও উহার প্রচার এবং শিক্ষাদানে নিযুক্ত হইয়াছেন এমন লোকের সংখ্যা কত? খতীব বাগদাদী বর্ণনাকারীদের সংখ্যা বলিয়াছেন ৯৩; কিন্তু হাফেয কাযী ইয়ায লিখিয়াছেনঃ এক হাজার তিন শতেরও অধিক।

[********************]

ইমাম মালিক (র)-এর ছাত্রদের মধ্যে আবদুল্লাহ ইবনে ওহাব (মৃঃ ১৯৫ হিঃ); আবদুর রহমান ইবনুল কাসেম (মৃঃ ১৯১ হিঃ) ও আশহুব (মৃঃ ২০৪ হিঃ) সুদক্ষ ওউচ্চমানের গ্রন্হ রচয়িতা ছিলেন। হাফেজ যাহবী বলিয়াছেন, ইবনে ওহাব এক লক্ষ হাদীস মুখস্থ বর্ণনা করিতেন। আর তাঁহার সংকলিত গ্রন্হাবলীতে এক লক্ষ বিশ হাজার হাদীস উদ্ধৃত হইয়াছে।

[********************] ইবনুল কাসেমও হাদীসের হাফেজ ছিলেন এবং ইমাম মালিক (র)-এর ‘ফিকহ’ যাঁহারা বর্ণনা ও প্রচার করিয়াছেন, তাঁহাদের মধ্যে তিনি প্রধান ব্যক্তিরূপে গণ্য হইতেন।

[********************]

উপরের এই দীর্ঘ আলোচনা হইতে একথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দী সম্পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই হাদীসের অসংখ্য সংকলন তৈয়ার হইয়া সর্বত্র প্রচারিত হইয়াছিল। সেই সঙ্গে ইমাম আবূ হানীফা (র) ও ইমাম মালিক (র)-এর ছাত্রগণ হাদীসের বিপুল জ্ঞান-সম্ভার বক্ষে ধারণ করিয়া গোটা মুসলিম জাহানের কেন্দ্রে কেন্দ্রে ছড়াইয়া পড়িয়াছিলেন। উহার প্রচার ও শিক্ষাদানের ব্রতে আত্মনিয়েঅগ করিয়াছিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *