হাদীসের উৎস

হাদীসের উৎস

পূর্বের আলোচনা হইতে একথা প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ তা’আলা বিশ্বনবীল প্রতি যে ওহী নাযিল করিয়াছেন, তাহাই হইতেছে হাদীসের মূল উৎস। আল্লাহর প্রেরিত ওহী প্রধানত দুই প্রকারেরঃ প্রথম প্রকারের ওহীকে বলা হয় ‘ওহী’য়ে মতলু’- সাধারণ পঠিতব্য ওহী’ ইহাকে ওহীয়ে জ্বলীও বলা হয়। আর দ্বিতীয় প্রকারের ওহী ‘ওহীয়ে গায়র মতলূ; নামে পরিচিত। ইহা সাধারণত তিলাওয়াত করা হয় না। ইহার অপর এক নাম ‘ওহীয়ে খফী’–প্রচ্ছন্ন ওহী। ইহা হইতে জ্ঞান লাভ করার সূত্রে এবং এই সূত্রলব্ধ জ্ঞান উভয়ই বোঝানো হয়।

শরীয়াতের মূল ভিত্তি হিসাবে কুরআনের পরেই হাদীসের স্থান। আল্লাহর হেদায়েত ও নির্ভূল নির্ভরযোগ্য সত্য জ্ঞানের যে উৎস হইতে কুরআন মজীদ অবতীর্ণ, হাদীসেও ঠিক সেই উৎস হইতেই নিঃসৃত। কুরআন মজীদের ঘোষণা হইতেই এই কথার সত্যতা প্রমাণিত হয়। আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করিয়াছেনঃ
 

******************************************************

হে নবী! আল্লাহ তোমার প্রতি কিতাব ও হিকমাত নাযিল করিয়াছেন এবং তুমি যাহা জানিতেন না, তাহা তোমাকে শিক্ষা দিয়াছেন।

[সূরা আন-নিসা, ১১৩ আয়াত।]

এই আয়াতের তাফসীরে আল্লামা ইবনে কাসীর লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

আয়াতে উল্লিখিত আল-কিতাব অর্থ কুরআন মজীদ এবং হিকমত অর্থ সুন্নত বা হাদীসে রাসূল (এবং এই উভয় জিনিসই আল্লাহর নিকট হইতে আল্লাহ কর্তৃক অবতীর্ণ।)

[তাফসীরে ইবনে কাসীর।]

নবী করীম (ﷺ)- এর নিম্নোক্ত বাণীও প্রমাণ করে যে, কুরআন এবং হাদীস উভয়ই একই স্থান ও একই সূত্র হইতে প্রাপ্ত। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমাকে কুরআন দেওয়া হইয়াছে এবং সেই সঙ্গে উহারই মত আর একটি জিনিস।

[কাঞ্জুল উম্মাল, -শায়ক আলাউদ্দীন; আবূ দাউদ, কিতাবুস সুন্নাহ।]

‘উহার মত আর একটি জিনিস’ কথাটির অর্থ হাদীস ছাড়া আরি কিছু হইতে পারে না। কেননা দুনিয়ার মানুষ রাসূলে করীম (ﷺ)-এর হইতে এই দুইটি জিনিসই লাভ করিয়াছেন।

হযরত হাসসান ইবনে সাবিত (রা) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

জিব্রাঈল (আ) হযরতের নিকট সুন্নাত বা হাদীস লইয়া নাযিল হইতেন, যেমন নাযিল হইতেন কুরআন লইয়া এবং তাঁহাকে সুন্নাতও শিক্ষা দিতেন, যেমন শিক্ষা দিতেন কুরআন।

[৮৬**********]

হাসন ইবনে আতীয়াতা বলিয়াছেনঃ

******************************************************

রাসূলে করীম (ﷺ) –এর প্রতি ‘ওহী’ নাযিল হইত এবং হযরত জিব্রাঈল তাঁহা নিকট সুন্নাত লইয়া হাযির হইতেন, যাহা প্রথম প্রকার ওহী কুরআনের-ব্যাখ্যা দান করে।

[৮৭***********]

কুরআনের আয়াত ছাড়া শুধু হাদীস লইয়াও হযরত জিব্রাঈল নবী করীমের নিকট উপস্থিত হইতেন, একথা মুসলিম শরীফের একটি হাদীস হইতে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়। কিতাবুল জিহাদ- এ উল্লেখিত—

******************************************************

হাদীসে আত্মোনিবেদিত নিষ্ঠাবান মুজাহিদের গুনাহ মাফ হওয়া সম্পর্কে এক লম্বা কথা বর্ণনা করার পর রাসূলে করীম (ﷺ) বলিলেনঃ

জিব্রাঈল (আ) নিজেই আমাকে এই কথা বলিয়া গেলেন।

এই কথাটি এই পর্যায়ে খুবই স্পষ্ট ও অকাট্য।

বস্তুত নবী করীম (ﷺ) দ্বীন সম্পর্কিত যাবতীয় ব্যাপারে আল্লাহর নিকট হইতে নির্ভূল জ্ঞান লাভ করার পরই কথা বলিতেন। দ্বীন সম্পর্কিত কোন কথাই িতনি নিজস্ব আন্দাজ অনুমানের ভিত্তিতে বলিতেন না। ইহা র বাস্তব প্রমাণ এই যে, তাঁহার নিকট দ্বীন-ইসলাম সংক্রান্ত বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হইলে এবং সে বিষয়ে তাঁহার পূর্ব জ্ঞান না থাকিলে তিনি সঙ্গে সঙ্গেই উহার কোন জওয়াব দিতেন না। বরং জিব্রাঈলের মারফতে আল্লাহর নিকট হইতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সঠিক জ্ঞান লাভের অপেক্ষায় থাকিতেন। তিনি এই উপায়ে যখন জানিতে পারিতেন, তখনই সেই জিজ্ঞাসার জওয়াব দান করিতেন। উহার দুইটি দৃষ্টান্ত পেশ করা যাইতেছেঃ

১। এক ইয়াহুদী পণ্ডিত নবী করীমের নিকট জিজ্ঞাসা করিলঃ পৃথিবীতে উত্তম স্থান কোনটি? ইহার সঠিক জওয়াব উপস্থিতভাবে নবী করীমের জানা ছিল না, সেই কারণে তিনি এই প্রশ্নের জওযাব সঙ্গে সঙ্গেই দিলেন না। পরে জিব্রাঈলেরে আগমন হইলে তিনি তাঁহার নিকট এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন। জিব্রাঈল প্রথশত বলিলেনঃ ‘এই বিষয়ে প্রশ্নকারী ও যাহার নিকট প্রশ্ন করা হইয়াছে উভয়ই অজ্ঞ। এই বিষয়ে আল্লাহর নিকট হইতে জানিয়া জওয়াব দেওয়া যাইবে’। দ্বিতীয়বারে জিব্রাঈল আসিয়াবলিলেনঃ হে নবী, আমি এইবার আল্লাহর এতিই নিকটবর্তী হইয়াছি, যতটা আর কখনো হই নাই। আল্লাহ তা’আলা জিজ্ঞাসিত বিষয় সম্পর্কে ইরশাদ করিয়াছেনঃ

******************************************************

সর্বোপক্ষো নিকৃষ্ট হইতেছে হাট-বাজারের স্থান এবং সর্বাপেক্ষা উত্তম ও কল্যাণময় স্থান হইতেছে মসজিদসমূহ।

[৮৯**************]

হযরত আবূ ইয়ালা একটন সাহাবী ‘ওহী’ কিভাবে নাযিল হয় এবং ‘ওহী’ নাযিল হওয়ার সময় রাসূলে করীমের অবস্থাটা কিরূপ হয় তাহা প্রত্যক্ষভাবে দেখিবার আগ্রহ প্রকাশ করেন। বিদায় হজ্জের সফরে তাহা প্রত্যক্ষ করা অপূর্ব সুযোগ ঘটে। নবী করীম (ﷺ) এই সময় ‘জেয়ের রেনা’ নামক স্থানে অবস্থান করিতেছিলেন। তখন একজন সাহাবী রাসূলে করীমের নিকট জিজ্ঞাসা করেনঃ ‘সুগন্ধি মাখিয়া উমরা পালনের জন্য ইহরাম বাঁধা জায়েয কিনা?

[আল্লামা শারকাভী লিখিয়াছেনঃ প্রশ্নকারীর ছিলেন- আতা ইবনে মুনিয়া, হযরত ইয়ালার ভাই।]নবী করীম (ﷺ) সঙ্গে সঙ্গেই ইহার জওয়াব প্রদান করেন নি। তিনি অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকেন। অতঃপর রাসূল (ﷺ)-এর প্রতি ওহী নাযিল হয়। বুখারী শরীফে এই প্রসঙ্গে বলা হইয়াছেঃ

******************************************************

তখন নবী করীম (ﷺ) নবী কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন। পরে তাঁহার প্রতি নাযিল হইল……………..।

এই সময় নবী করীম (ﷺ)- এর উপর কাপড় দ্বারা ছায়া করিয়া দেওয়া হইয়াছিল। তখনই ইয়ালা উহার মধ্যে মাথা প্রবেশ করাইয়া দেখিলঃ

******************************************************

রাসূলের সমস্ত মুখমণ্ডল রক্তিম বর্ণ ধারণ করিয়াছে এবং তিনি বিকট শব্দে শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করিতেছেন।

[বুখারী শরীফ, ১ম খন্ড, কিতাবুল মানাসিক, ২০৮ পৃষ্ঠা এবং ঐ ২য় খন্ড, কিতাব ফাযায়েলুল কুরআন, ৭৪৫ পৃষ্ঠা।]

মুহাদ্দিসীনের মতে ওহী অবতরণের দুর্বহ ভারে এই সময় নবী করীমের ভীষণ শ্বাসকষ্ট হইতেছিল। আল্লামা শারাকাভী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

হাদীসে উল্লিখিত ‘গাতীত’ এমন এক প্রকারের বিকট শব্দ, যাহা ওহী নাযিল হওয়ার সময়ে উহার দুর্বহ ভারে অতি কষ্টে শ্বাস লওয়ার কারণে ধ্বনিত হইত।

[ফতহুল মুবদী, ২য় খন্ড, ৮৯ পৃষ্ঠা।]

রাসূলে করীমের প্রতি ওহী নাযিল হওয়ার সময় এইরূপ কষ্ট অনুভূত হইত এবং সেইজন্য তাঁহার ভীষণ শ্বাস-কষ্ট হইত। পক্ষান্তরে এইরূপ শব্দ হইতে শুনিলে সকল সাহাবীই বুঝিতে পারিতেন যে, এখন রাসূলের প্রতি ওহী নাযিল হইতেছে।

বস্তুত কুরআন মজীদ জিব্রাঈলের মাধ্যমে ওহীর সূত্রে প্রাপ্ত পূর্ণাঙ্গ সত্য বিধান। কিন্তু এই ওহীর মাধ্যমে যত সত্য ও নির্ভুল তত্ত্বই লাভ হইয়াছে, তাহা সবই কুরআন মজীদে সন্নিবেশিত নহে। দ্বীন-ইসলামে এই ধরণের সত্য জ্ঞানের গুরুত্ব কুরআনের অব্যাবহতি পরেই, এই কারণে উহা কুরআনে সন্নিবেশিত না হইয়া ‘হাদীসে রাসূল’ হিসাবে সংরক্ষিত হইয়াছে। নবী-জীবনের ইতিহাসে এমন অসংখ্য ওহী নাযিল হওয়ার সন্ধান পাওয়া যায়, যাহা ত্রিশপারা কুরআন মজীদের কোথাও পরিদৃষ্ট হয় না। তবে উহা কি বিনষ্ট ও বিস্মৃতির অতল তলে নিমজ্জিত হইয়া গিয়াছে? উহা কি অপ্রয়োজনীয় ছিল? তাহা হইতে পারে না। বাস্তবিকই উহা বিনষ্ট হয় নাই। মানব জীবনের জন্য উহা একান্ত প্রয়োজনীয় ছিল বলিয়াচিরদিনের জন্য স্বতন্ত্রভাবে সংরক্ষিত হইয়াছে। মুসলিম জাতির জন্য ইহা এক চিরন্তন সম্পদ।

পরন্তু নবী করীম (ﷺ) গঠিত সমাজের লোকদের আল্লাহর কালাম কুরআন মজীদের প্রতি যেমন ঈমান ও গুরুত্ব বোধ ছিল, ওহীর কুরআন-বহির্ভূত অংশ-হাদীসের প্রতিও ছিল অনুরূপ আগ্রহ ও লক্ষ্য। বরং রাসূলে ইন্তেকালের পর সাহাবায়ে করিামের নিকট কুরআন মজীদ সম্পূর্ণ লিপিবদ্ধ ও সংকলিত অব্স্থায় বর্তমান ছিল বলিয়া উহার কোন অনুসন্ধান-তৎপরতা অবল’নের প্রয়োজন দেখা দেয় নাই। কিন্তু রাসূলের হাদীসের ব্যাপারে এই প্রয়োজন দেখা দিয়াছিল। আর এইজন্য তাঁহাদের চেষ্টা ও সাধনার কোন অন্ত ছিল না। তারা রাসূলের অধিক নিকটবর্তী লোকদের নিকট এই পর্যায়ে জিজ্ঞাসাবাদও করিয়াছেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ দুইটি ঘটনার উল্লেখ করা যাইতে পারেঃ

******************************************************

কুরআনে সংকলিত ওহী ছাড়া ওহীর অপর কোন অংশ আপনার নিকট রক্ষিত আছে কি?

[বুখারী শরীফ, প্রথম খন্ড, কিতাবুল জিহাদ, ৪২৮ পৃষ্ঠা।]

ইহার জাওয়াবে হযরত আলী কয়েকটি হাদীস পেশ করেন। ইহা হইতে প্রমাণিত হয়ঃ (ক) কুরআন ছাড়াও ওহী সুত্রে পাওয়া জ্ঞানের আরো অস্তিত্ব আছে। (খ) সব ওহীই কুরআন মজীদে সংকলিত বা উহার মধ্যে সামিল নয়। ওহীর আরো এমন অংশ রহিয়াছে, যাহা কুরআনের বাহিরে রহিয়াছে। তাহা আল্লাহর ‘কালাম’ না হইলেও আল্লাহর নিকট হইতেই জানিয়া লওযা জ্ঞান। (গ) কুরআন-বহির্ভূত ওহী রাসূলে করীমের মৌখিক কথা বাস্তবে করা কাজের বিবরণ হইতে জানা যায় এবং তাহাও ‘ওহী’– ওহীলব্ধ জ্ঞান, ইহা নিঃসন্দেহ। হযরত আবূ হুযায়ফা উহাকেও ‘ওহী’র মধ্যে গণ্য করিলেন, কিন্তু হযরত আলী (র) তাহাতে কোন রূপ আপত্তি করে নাই। তিনি বলেন নাই যে, সব ওহী- ওহীর মাধ্যমে পাওয়া সব জ্ঞানই- কুরআন মজীদে সংকলিত; উহার বাহিরে ওহীর কোন অংশ নাই।

কুরআন ও হাদীস বাহ্যত দুই জিনিস হইলেও মুলত উভয়ই ওহীর উৎস হইতে উৎসারিত। এই কারণে মৌলিকতা, যুক্তিভত্তিকতা, প্রামাণিকতা এবং অবশ্য অনুসরণীয় হওয়ার দিক দিয়া উভয়ের মধ্যে কোন পার্থক্য নাই। কাজেই হাদীসের প্রতি কোন প্রকার উপেক্ষা প্রদর্শন করা এবং উহা রাসূলের কথা- আল্লাহর কথা নহে, অতএবং তাহা না মানিলেও চলিবে’ বলিয়া উহার গুরুত্ব হ্রাস করা কোন মুসলমানেরই নীতি হইতে পারেন না।

এই পর্যায়ে একটি কথা বিশেষভাবে মনে রাখিতে হইবে। তাহা এই যে, নবী করীম (ﷺ) তাঁহার প্রতি অবতীর্ণ কুরআনের ভিত্তিতে অনেক সময় ইজতিহাদও করিয়াছেন। কুরআনের মৌলিক ও ইজমালী নীতির দৃষ্টিাতে দ্বীনে বিস্তারিত রূপ সম্পকেৃ স্বীয় চিন্তা ও বিবেচনার ভিত্তিকে জনগণকে দিয়াছেন অনেক আদেশ- উপদেশ। শরীয়াতের দৃষ্টিতে তাহাও হাদীস- ‘রাসূলের সুন্নাত পর্যায়ে গণ্য। এই সম্পর্কে ইমাম শাফেয়ী (র) বলিয়াছেনঃ******************************************************

রাসূলে করীম (ﷺ) যাহা কিছু হুকুম দিয়াছেন তাহা সবই তাহাই, যাহা তিনি কুরআন হইতে বুঝিতে পারিয়াছেন। পরে কুরআন হইতে উহার সমর্থন বাহির করিয়াছেন।

মুল্লা আলী আলকারী লিখিয়াছেন, হাদীসকে নবী করীমের কথারূপে পরিচয় দেওয়া হয় এইজন্য যে,তিনিই উহা কুরআন হইতে বুঝিয়া লইয়াছেন।

******************************************************

এইজন্য যে, তিনি তাহা কুরআন হইতেই বুঝিয়া পাইয়াছেন এবং কুরআনের ভাবধারা হইতেই উহা বাহির করিয়াছেন।

কুরআন ও হাদীসের পার্থক্য

কুরআন ও হাদীস উভয়ই ওহীর উৎস হইতে উৎসারিত হইলেও এতদুভয়ের মধ্যে নানা দিক দিয়া পার্থক্য বিদ্যমান। পূর্ববর্তী আলোচনায় এই সম্পর্কে ইঙ্গিত করা হইয়াছে; কিন্তু বর্তমান পর্যায়ে উহার বিস্তারিত আলোচনা পেশ করা আবশ্যক।

কুরআন মজীদ এক অপূর্ব মু’জিযা। ইহা কেবল শব্দ, ভাষা ও সাহিত্যের দিক দিয়াই মু’জিযা নহে; ইহার বিষয়বস্তু, আলোচন্য বিষয়ের ব্যাপকতা, প্রসারতা, গভীরতা ও সূক্ষ্মতা এবং উহার উপস্থাপিত মানব কল্যাণকর পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থাও এক অপূর্ব ও চরম বিস্ময়কর মু’জিযা।

প্রথম গুরুত্বপূর্ণ ও সর্বোত্তম কালাম হইতেছে কুরআন মজীদ, উহার অলৌকিক বৈশিষ্ট্যের কারণে উহা কালজয়ী, সর্বপ্রকার পরিবর্তণ, পরিবর্ধন ও সংশোধন-সংযোজন হইতে চিরসুরক্ষিত, বিনা অযুত উহা স্পর্শ ও পাঠ করা হারাম। নামাযে উহা সুনির্দিষ্টভাবে পাঠ করা অবশ্য কর্তব্য।

কিন্তু হাদীসসমূহ কুরআনের ন্যায় কোন মু’জিযা নহে। হাদীসৈর মূল কথাটিই শুধ ওহীর মাধ্যমে হযরতের স্বচ্ছ ও পবিত্র হৃদয়পটে প্রতিফলিত হইয়াছে, তিনি নিজ ভাষায় তাহা জনসমক্ষে পেশ করিয়াছেন। এজন্য উহার ভাষা’ মতলু’ নহে; উহার ভাষা ও শব্দের তিলাওয়ারত করা বাধ্যতামূল নহে, উহার মূল বক্তব্য ও ভাবধারা অনুসরণ করার জন্যই শরীয়াতে নির্দেশ দান করা্ হইয়াছে। এই কারণেই উহাকে ‘ওহীয়ে গায়ের মতলু’ নামে অভিহিত করা হয়। কিন্তু কুরআন মজীদের ভাব-শব্দ সব কিছুই আল্লাহর, আল্লাহর নিকট হইতে অবতীর্ণ।

আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

ওহীয়ে ‘মতলূ’ হইতেছে কুরআন মজীদ। অপর প্রকার ওহী রাসূলে করীম (ﷺ) হইতে (বর্ণনাকারীদের সূত্রে) বর্ণিত।

[৯৬**************]

আল্লামা মুহাম্মদুরল মাদানী লিখিয়াছেনঃ কুরআন হাদীসের পারস্পরিক কার্থক্য ছয়টি দিক দিয়া বিবেচ্য। প্রথম, কুরআন অলৌকি বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন মু’জিযা’ হাদীস তাহা নহে। দ্বিতীয়, কুরআন পাঠ না হইলে নামায বিশুদ্ধ হয় না, হাদীস সেরূপ নহে। তৃতীয়, কুরআন ও উহার সামান্য অংশও কেহ অস্বীকার করিলে সে নিশ্চিত কায়ির হইয়া যায়, কিন্তু বিশেষ কারণের ভিত্তিতে বিশেষ কোন হাদীস মানিয়া লইতে অস্বিকৃত হইলে কাফির হইতে হয় না। চুতর্থ, কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার জন্য আল্লাহ ও রাসূলের মাঝখানে জিব্রাঈরের মধ্যস্থতা, অপরিহার্য।; হাদীসের জন্য ইহা জরুরী নয়। পঞ্চম, কুরআনের প্রতিটি শব্দ ও কথা আল্লাহর নিজস্ব, হাদীসের শব্দ ও ভায়া রাসূলের নিজের এবং ষষ্ঠ, কুরআন অযু ও পবিত্রতার সহিত স্পর্শ করা কর্তব্য, বিনা অযুতে স্পর্শ করা যায় না। হাদীস সম্পর্কে এরূপ কোন নির্দেশ নাই।

[৯৭************]

অন্য কথায় চিঠি ও মৌখিক পয়গামের মধ্যে যে পার্থক্য, কুরআন ও হাদীসের মধ্যেও অনুরূপ পার্থক্য বলা যায়। লোক মারফত মৌখিক পয়গম প্রেরণের ক্ষেত্রে মূল কথাটিই মুখ্য, ভাষা বা শব্দের তারতম্যে কিছুই আসে যায় না। কিন্তু চিঠির ব্যাপারটি এরূপ নহে। প্রথমত উহা চিঠি প্রেরকের নিজস্ব মর্জি অনুযায়ী রচিত হয় এবং দ্বিতীয়ত উহাতে নিজ মত ও উদ্দেশ্য অনুযায়ী পূর্ণ ভাব প্রকাশক ভাষা ও শব্দ প্রয়োগ হইয়া থাকে। কিন্তু মৌখিক কথা প্রেরণ শব্দ ও ভাষার সেই বাধ্যবাধকতা থাকে না।

কুরআন ও হাদীরেস স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে যদিও এইরূপ পার্থক্য রহিয়াছে- কুরআনকে মনে করা যায় আল্লাহর নিজ লিখিত চিঠি আর হাদীস হইতেছে আল্লাহর মৌখিক পয়গাম; কিন্তু সেই সেঙ্গ এই কথাও মনে রাখা আবশ্যক যে, আল্লাহরর এই ‘চিঠি’ ও ‘মৌখিক পয়গাম’ উভয়েরই মুখপাত্র হইতেছেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (ﷺ)। এই কারণে তাঁহার নিকট হইতে আল্লাহর লিখিত চিঠি (কুরআন) গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার মৌখিক পয়গাম (হাদীস)- ও জানিয়া লওয়া একান্ত আবশ্যক। আল্লাহর প্রেরিত এই দুইটি জিনিসই পরস্পর ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একটিকে বাদ দিয়া অপরটি গ্রহণ করিলে মূল উদ্দেশ্যই বিনষ্ট হইতে বাধ্য।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি যখন কোন হাদীস বর্ণনা করি, তখন তোমাদের নিকট উহার কুরআন সমর্থিত হওয়ারই সংবাদ প্রকাশ করি।

[৯৮***********]

ইবনে যুবায়র বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমার নিকট যে হাদীসই পৌছিঁয়াছে আমি আল্লাহর কিতাবে উহার সমর্থন ও উহার সত্যতার প্রমাণ পাইয়াছি।

[৯৯**********]

শরীয়াতের ইমামগণের সর্বসম্মত মত হইলঃ

******************************************************

সমগ্র সুন্নাত ও হাদীস কুরআনেরই ব্যাখ্যা।

ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় হাদীসের গুরুত্ব

হাদীস ইসলামী মিল্লাতের এক অমুল্য সম্পদ, ইসলামী শরীয়াতের অন্যতম অপরিহার্য উৎস। ইহাকে বাদ দিয়াইসলামী জীবন-ধারা ধারণাতীত। হাদীসের গুরুত্ব নির্ধারণের পূর্বে স্বয়ং রাসূলে করীম (ﷺ)- এর গুরুত্ব এবং মর্যাদা (Position) নির্ধারণ একান্ত প্রয়োজন।

ইসলামের দৃষ্টিতে রাসূলের আদেশ –নিষেধ, তাঁহার যাবতীয় কাজ-কর্ম, কথাবার্তা- এক কথায় তাঁহার মূখ- নিঃসৃত বাণী ও গোটা কর্মময় জীবনই ইসলামী মিল্লাতের জ ন্য একান্ত অনুসরণীয় এক মহান আদর্শ। রাসূল প্রেরণের মূলে আল্লাহর উদ্দেশ্যেই এই ছিল যে, উম্মত তাঁহাকে পূর্ণ মাত্রায় অনুসলণ করিয়াচলিবে, তাঁহার হুকুম আহকাম পুরাপুরি পালন করার সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার বাস্তব জীবন ধারাকেও অনুসরণ করিয়া চলিবে। কুরআন মজীদ স্পষ্ট ভাষায় রাসূল প্রেরণের উদ্দেশ্য ঘোষণা করিয়া বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আমি রাসূল পাঠাইয়াঠি একমাত্র ইএ উদ্দেশ্যে যে, আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাঁহাকে অনুসরণ করা হইবে- তাঁহাকে মানিয়া চলা হইবে।

[সূরা আন-নিসা, ৬৪ আয়াত।]

অপর এক আয়াতে রাসূলকে আনুগত্য ও অনুসরণ করিয়াচলার জন্য আল্লাহ তা’য়ালা স্পষ্ট ভাষায় নির্দেশ দিয়াছেন, বলিয়াছেনঃ

******************************************************

হে ঈমানদার লোকগণ, আল্লহ এবং তাঁহার রাসূলের আনুগত্য কর, তাঁহাদের আদেশ শ্রবণের পর তাহা অমান্য করিয়া পৃষ্ঠ-প্রদর্শন করিও না। তাহাদের মত হইও না, যাহারা বলে- আমরা শুনিয়াছি, কিন্তু কার্যত তাহারা শোনে না।

[সূরা আল-আনফাল, আয়াত ২০ ও ২১।]

এখানে ঈমানদার লোকদের প্রতি প্রথমে আল্লাহর আনুগত্য করার আদেশ দান করা হইয়াছে, সেই সঙ্গে রাসূলেরও অনুসরণ বা আনুগত্য করিতে আদেশ করা হইয়াছে। আল্লাহর এবং রাসূলের আনুগত্য করিতে বলা হইয়াছে একই ******** ‘আনুগত্য কর’আদেশমূলক শব্দ দ্বারা। আল্লাহ এবং রাসূল উভয়কেই মানিয়া চলা মুসলমানের কতৃব্য ঘোষিত হইয়াছে এবং এই কর্তব্যের ব্যাপারে উভয়ের মধ্যে কোন পার্থক্য করা হয় নাই। তবে বাহ্যত শুধু এতটুকুই পার্থক্য করা যাইতে পারে যে, আল্লাহর নাম প্রথমে উল্লিখিত হইয়াছে- অতএব তাহার আনুগত্য করিতে হইবে মূলত এবং প্রথমত, আর তাঁহার পরই আনুগত্য করিতে হইবে রাসূলের।

দ্বিতীয়ত আল্লাহর আনুগত্য করা যায় আল্লাহর কিতাব-কুরআন মজীদের আদেশ-নিষেধ মান্য করিয়া। আর রাসূলের আনুগত্য করিতে হয় রাসূলের আদেশ-নিষেধ ও অনুসৃত রীতি-নীতি পালন করিয়া। আল্লাহর আদেশ-নিষেধ ত্রিশ পারা কুরআন মজীদে বর্তমান; কিন্তু রাসূলের আদেশ-নিষেধ কোথায় পাওয়া যাইবে? তাহা পাওয়া যাইবে রাসূলের কথা, কাজ, সমর্থন সম্বলিত মহান সম্পদ-হাদীসের মাধ্যমে।

আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করিয়াছেনঃ

******************************************************

বল হে নবী, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালবাস, তবে আমাকে অনুসরণ করিয়াচল। তাহা হইলে আল্লাহও তোমাদের ভালবাসিবেন; তোমাদের গুনাহ মাফ করিয়া দিবেন। নিশ্চয় আল্লাহ গুনাহ মার্জনাকারী, দয়াশীল।

[সূরা আল-ইমরান, ৩১ আয়াত।]

অর্থাৎ আল্লাহকে ভালবাসার অনিবার্য দাবি ও বাস্তব শর্ত হইতেছে রাসূলকে কার্যত অনুসরণ করিয়া চলা; আল্লাহর ভালবাসা ও তাঁহার নিকট হইতে গুনাহের মাজনা লাভের একমাত্র পথ ও উপায় হইতেছে রাসূল (ﷺ)- কে অনুসরণ করা। রাসূলকে অনুসরণ না করিলে আল্লাহর ভালবাসা ও তাহার নিকট গুনাহ মার্জনা লাভ স্ভব নহে। কেবল ইহাই নয়, রাসূলকে অনুসরণ করিয়া না চলিলে মানুষ ঈমানদারই হইতে পারে না, মুসলিম থাকিতে পারে না, বরং কাফির হইয়া যায়।

আল্লাহ তা’আলা বলিয়াছেনঃ

******************************************************

বল হে নবী, আল্লাহ ও রাসূলকৈ মানিয়া চল; যদি তাহা না করা তবে জানিয়া রাখ, আল্লাহ কাফিরদের ভালবাসেন না।

[সূরা আল-ইমরান, ৩২ আয়াত।]

এই আয়াতেও আনুগত্যের ক্ষেত্রে আল্লাহর পরে ও সঙ্গে সঙ্গেই রাসূলকে স্বতন্ত্র মর্যাদা দেওা হইয়াছে। ফলে কেবল আল্লাহর আনুগত্য করিলেই চলিবে না, রাসূলেরও আনুগত্য করিতে হইবে। আল্লাহর আনুগত্য না করিলে মানুষ যেমন কাফির হইয়া যায়, রাসূলের আনুগত্য না করিলেও মানুষ অনুরূপভাবেই কাফির হইয়া যাইবে। আয়াতের শেষাংশ এই কথা স্পষ্ট ভাষায়ই ব্যক্ত করিয়াছেন। সেই সঙ্গে এই কথাও বলা হইয়াছে যে, এই কাফিরদিগকে আল্লাহ কিছুমাত্র ভালবাসেন না- পছন্দ করেন না।

মুসলিম হওয়ার জন্য আল্লাহর সঙ্গে সঙ্গে রাসূলের আনুগত্য করা এইরূপ তাকীদ হওয়ার বিশেষ কারণ রহিয়াছে। প্রকৃতপক্ষে কেবলমাত্র আল্লাহর কালাম পৌঁছাইয়া দেওয়াই রাসূলের একমাত্র কাজ নহে। আল্লাহর কালাম ব্যাপক প্রচার করা, লোকদিগকে উহা বিশদভাবে বুঝাইয়া দেওয়া, উহার ভিত্তিতে লোকদের মন-মগজ চরিত্র ও জীবন গঠন করা এবং তদনুযায়ী এক আদর্শ সমাজ গঠন করাও রাসূলের কাজ, সন্দেহ নাই।

কুরআন মজীদে এই সম্পর্কে বলা হইয়াছেঃ

******************************************************

সেই মাহন আল্লাহ-ই উম্মী লোকদের প্রতি তাহাদের মধ্যে হইতেই একজন রাসূল পাঠাইয়াছেন। রাসূল আল্লাহর আয়াতসমূহ তাহাদের সম্মুখে তিলাওয়াত করে, তাহাদিগকে পবিত্র-পরিশুদ্ধ ও সুসংগঠিত করে, তাহাদিগকে কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেয়- যদিও তাহারা ইহার পূর্বে সুস্পষ্ট গোমরাহীতে নিমজ্জিত ছিল।

[সূরা জুময়া, আয়াত ২।]

আয়াতে নবী করীমের তিনটি সুস্পষ্ট দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা ঘোষণা করা হইয়াছেঃ

প্রথম, কুরআনের আয়াতসমূহ পাঠ করা, পাঠ করিয়া লোকদিগকে শোনানো। দ্বিতীয়, জন-মনকে পবিত্র-পরিচ্চন্ন ও বিশুদ্ধকরণ, বিশেষ ও সুনির্দিষ্ট আদর্শের মানদণ্ডে তাহাদের লালন-পালন ও গঠন করা। শিরক ও চরিত্রহীনতার পংকিলতা হইতে তাহাদিগকে পরিশুদ্ধকরণ।

তৃতীয়, আল্লাহর কিতাব ও জরুরী জ্ঞান শিক্ষা দান, ইসলামী জ ীবনাদর্শ বাস্তাবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় বুদ্ধি ও প্রতিভার বিকাশ সাধন, ‘সুন্নাত’ শিক্ষা দান।

আলোচন্য আয়াতে প্রথম ও তৃতীয় পর্যায়ে যে কাজের নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে-আয়াত তিলাওয়াত করা ও কিতাবের তালীম দেওয়া- এই্ দুইটি কি একই ধরনের কাজ? একই ধরনের কাজ হইলে ইহা নিঃসন্দেহে পুনরুক্তি দোষে দুষ্ট। আর তাহা হইলে উভয় ক্ষেত্রে একই ধরনের শব্দ প্রয়োগ হওয়া উচিত ছিল। অথচ উভয় ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র শব্দের ব্যবহার হইয়াছে। ফলে অর্থের তারতম্যের কারণে ইহা দুইটি স্বাতন্ত্র কাজরূপেই প্রতিফলিত হইয়াছে। বস্তুত ‘আয়াত তিলাওয়াত’ ও ‘কিতাবের তালীম’ দুইটি আলাদা আলাদা কাজ, স্বতন্ত্র দায়িত্ব বিশেষ।

অতএব কুরআন তিলাওয়াত করা সঙ্গে সঙ্গে উহার কঠিন ও অভিনব পারিভাষিক শব্দসমূহের ব্যাখ্যা, নির্দেশিত বিষয়সমূহের বিশ্লেষণ, সংক্ষিপ্ত বিষয়গুলির বিস্তৃ রূপদান এবং স্বীয় কথা ও কাজের মাধ্যমে উহার বাস্তব রূপায়ণ ও প্রতিষ্ঠা- এ সবই রাসূলৈ করীমের দায়িত্ব ও কর্তব্যরূপে নির্দিষ্ট হইয়াছে।

আয়াতের শেষাংশে ‘কিতাব’ ও ‘হিকমাত’ শিক্ষাদানের কথা বলা হইয়াছে। ‘আল কিতাব’ অর্থঃ কুরআন মজীদ, কিন্তু ‘হিকমাত’ অর্থ কি?

কুরআন মজীদের বহুস্থানে ‘হিকমাত’ শব্দটি ‘আল-কিতাবের’ সঙ্গে উল্লিখিত হইয়াছে এবং সকল রাসূলকে যেমন কিতাব দেওয়া হইয়াছে, তেমনি হিকমাতও দান করা হইয়াছি বলিয়া স্পষ্ঠ ভাষায় ঘোষণঅ করা হইয়াছে। সূরা আল-আমরানে বলা হইয়াছেঃ

******************************************************

স্মরণ কর, আল্লাহ নবীদের নিকট হএত প্রতিশ্রুতি লইয়াছেন যে, (আজ) তোমাদিগকে কিতাব ও হিকমাত দান করিয়াছি।

[সূরা আল-ইমরান, ৮১ আয়াত।]

আয়াতে উল্লিখিত ‘কিতাব’ অর্থ যে আল্লাহর কালাম সম্বলিত আসমানী গ্রন্হ, তাহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু ‘হিকমাত’ শব্দের তাৎপর্য কি? ইহা দ্বারা আল্লাহ তা’য়ালা কি বুঝাইতে চাহেন? কিতাবের সাথে আল্লাহ রাসূলগণের প্রতি এমন আর কি জিনিস নাযিল করিয়াছেন, যাহাকে তিনি ‘হিকমাত’ নামে অভিহিত করিয়াছেন। এ সম্পর্কে বিস্তারিত গবেষণা ও অনুসন্ধান আবশ্যক।

অভিধানের দৃষ্টিতে ‘হিকমত’ শব্দের মূল হইতেছে *******, ইহার অর্থ ****************** ‘সংশোধন উদ্দেশ্যে কোন জিনিস বা কাজ হইতে নিষেধকরণ’। লাগামকে এই দৃষ্টিতেই ‘হাকামাতুন’ ****** বলা হয়; কেননা, উহা দ্বারা ঘোড়াকে বিদ্রোহ ও যথেচ্ছা গমন হইতে বিরত রাখা হয়। এই অর্থগত সামঞ্জস্যের কারণেই ‘হিকমাতে’র অর্থ করা হয়- *************** জিনিসগুলিকে যথোপযুক্ত স্থানে স্থাপন করা-রাখা এবং অনুপযুক্ত স্থানে রাখা, বন্দ করা।

‘তাজুল-উরুস’ অভিধানে ইহার অধিকতর বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে বলা হইয়াছেঃ

******************************************************

বিচার-মীমাংসার ক্ষেত্রে সুবিচার-ইনসাফ ও ন্যায়পরতাকে বলা হয় ‘হিকমাত’।

‘জিনিসসমূহের প্রকৃত নিগূঢ় তত্ত্ব ও হাকীকত (Reality) জানিয়া লওয়া এবং এই বিশুদ্ধ ও নির্ভুল জ্ঞানের দৃষ্টিতে আমল করা। এই কারণে ‘হিকমাত’ দুই ভাগে বিভক্ত। এক ভাগ জ্ঞানগত, আর অপর ভাগ বাস্তবমূলক বা কাজ সম্পর্কিত।

[তাজুল ‘উরুস’‘হিকমাত’ শব্দের আলোচনা।]

ইমাম রাগেব ইসফাহানী লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

হিকমাত হইতেছে জ্ঞান ও বুদ্ধির সাহায্যে প্রকৃত সত্য লাভ, সত্য লাভের যোগ্যতা ও প্রতিভা। অতএব আল্লাহর ‘হিকমাত’ হইতেছে সমস্ত জিনিস ভাল করিয়া জানা-চেনা এবং চূড়ান্ত বিধানের ভিত্তিতে নূতন জিনিস সৃষ্টি ও উদ্ভাবন। আর মানুষের ‘হিকমাত’ হইতেছে বস্তুজগতের বিষয়াদি সম্পর্কে পরিচিতি ও জ্ঞানলাভ এবং ভাল ভাল কাজ সম্পাদন।

[১০৭]

লিসানুল আরব গ্রন্হে বলা হইয়াছেঃ

******************************************************

কার্যত সর্বোত্তম ও উৎকৃষ্ট জিনিসসমূহ সম্পর্কে সূক্ষ্ম গভীর জ্ঞান লাভই হইতেছে হিকমাত।

[১০৮]

ইমাম ইবনে জরীর তাবারী বিভিন্ন লোকের কথা উল্লেখ করার পর লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

হিকমাত সম্পর্কে আমার দৃষ্টিতে সঠিক কথা এই যে, হিকমাত হইতেছে আল্লাহর আদেশ-নিষেধ সম্পর্কেত ইলম, যাহা রাসূলের বর্ণনা ছাড়া কিছুতেই লাভ করা সম্ভব নয় এবং উহার সম্পর্কে গভীর সূক্ষ্ম পরিচিতি লাভ করাও হিকমাত। উহার সহিত সামঞ্জস্যশীল আর যেসব জিনিস দ্বারা উহা লাভ করা যায়, তাহাও উহার অন্তুর্ভক্ত। আমার মতে ‘হিকমাত’ শব্দটি ‘হাকাম’ হইতে নির্গত হইয়াছে। উহার অর্থ হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্যকরণ।

[১০৯**************]

ইমাম শাফেয়ী (র) লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

কুরআন সম্পর্কিত জ্ঞানে সর্বাধিক পারদর্শী আস্থাভাজন বিশিষ্ট লোকদের নিকট আমি শুনিয়াছি, তারা বলিয়াছেনঃ হিকমাত হইতেছে রাসূলে করীম (ﷺ)-এর সুন্নাত।

[কিতাবুর রিসালা; ২৮ পৃষ্ঠা।]

অতঃপর তিনি লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

রাসূলের সুন্নাত হইতেছে সেই হিকমাত, যহা হযরতের দিল মুবারকে আল্লাহর নিকট হইতে উদ্রেক করা হইয়াছে।

[কিতাবুর রিসালা; ২৮ পৃষ্ঠা।]

কুরআন মজীদের যেসব স্থানে ‘আল-কিতাবের’ সঙ্গে ‘আল-হিকমাতে’র উল্লেখ হইয়াছে, সেসব স্থানেই কিতাব অর্থ আল্লাহর নিজস্ব কালাম, যাহা রাসূলের প্রতি নাযিল হইয়াছে এবং যাহাতে আল্লাহর আদেশ-নিষেধ ও উপদেশ নসীহত বর্ণিত হইয়াছে। আর ‘আল-হিকমাত’ অর্থ সে সবের নিগূঢ় তত্ত্ব সম্পর্কে বিশুদ্ধ ও সঠিক জ্ঞান এবং সে নির্ভূল জ্ঞান অনুযায়ী সঠিক কাজ। বস্তুত এই নির্ভূল জ্ঞান ও তদনুযায়ী সঠিক কাজ করার যথেষ্ট বুদ্ধি প্রত্যেক রাসূলকেই দেওয়া হইয়াছে। নবী-রাসূলগণের ক্ষেত্রে ইহা আল্লাহর স্থায়ী ও নির্বিশেষ নিয়ম।

এই নিয়ম অনুযায়ী সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (ﷺ) কেও আল-কিতাব কুরআনের সঙ্গে সঙ্গে ‘আল হিকমাত’ ও দেওয়া হইয়াছে। কুরআন মজীদের বহু সংখ্যক আয়াতে ইহা স্পষ্টভাষায় উল্লেখ করা হইয়াছে। এখানে একটি আয়াত উল্লেখ করা যাইতেছে। আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করিয়াছেনঃ

******************************************************

হে নবী, আল্লাহ তোমার প্রতি ‘আল-কিতাব’ ও ‘আল-হিকমাত’ নাযিল করিয়াছেন এবং তুমি যেসব কথা জানিতে না, তাহার শিক্ষা তোমাকে দান করিয়াছেন। আর ইহা তোমার প্রতি আল্লাহর এক বিরাট অনুগ্রহ।

[সূরা আন-নিসা, ১১৩ আয়াত।]

কুরআনের সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর দেওয়া এই ‘আল-হিকমাত’ নিশ্চিতরূপে কুরআন হইতে এক স্বতন্ত্র জিনিস। ইহার সুন্নাত এবং ইহার বিস্তৃত বিবরণ হাদীস সম্পদেই পুঞ্জীভূত রহিয়াছে।

[হাদীসকে হিকমাত বলার তাৎপর্য কি, তাহা অনুধাবনীয়। আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী লিখিয়াছেনঃ ********************** সুন্নাত বা হাদীসকে হিকামত বলার তাৎপর্য এই যে, উহা দ্বারাই হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্য করা হইয়াছে ***************** এবং কুরআনের মোটামুটি কথার উহার দ্বারা ব্যাখ্যা করা হইয়াছে।]

‘আল-হিকমাত বা সুন্নাতও যে আল্লাহর নিকট হইতেই অবতীর্ণ, তাহা পূর্বোক্ত আয়াত স্পষ্ট ভাষায় প্রমাণ করে। বস্তুত আল্লাহ তা’আলা বিশ্বমানবতার পথ-নির্দেশের জন্য এবং হিদায়আয়াতের পথে পরিচালনার উদ্দেশ্য কেবলমাত্র আল-কিতাব নাযিল করাই যথেষ্ট মনে করেন নাই; সেই সঙ্গে রাসূল ও রাসূলের সুন্নাতকেও আল্লাহর তরফ হইতে প্রেরণের প্রয়োজন মনে করিয়াছেন। অন্যথায় শুধুমাত্র ‘আল-কিতাব’ মানুষের প্রকৃত কোন কল্যাণ সাধন করিতে পারিত না।

কুরআন মজীদের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করাও রাসূলেরই অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। নিম্নোক্ত আয়াত এই দৃষ্টিতে সুন্নাত বা হাদীসের গুরুত্ব ঘোষণা করে। আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করিয়াছেনঃ

******************************************************

হে নবী, তোমার প্রতি এই কিতাব এই উদ্দেশ্যে নাযিল করিয়াছি যে, তুমি লোকদের জন্য অবতীর্ণ এই কিতাব তাহাদের সম্মুখে বয়ান ও ব্যাখ্যা করিবে এবং এই উদ্দেশ্যে যে, তাহারা ইহা চিন্তা ও গবেষণা করিবে’।

[সূরা আন-নাহাল, আয়াত ৪৪; বয়ান’ করার তাৎপর্য ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে হাফেজ ইবনে আবুল বার বলিয়াছেনঃ নবী করীমের কুরআন ‘বয়ান’ করা দুই প্রকারের হইয়াছেঃ প্রথম, কুরআনের মোটামুটি কথার ব্যাখ্যা, যেমন পাঁচবারের নামায ও সময়, উহার সিজদা, রুকু ও অন্যান্য হুকুম আহকাম হইবে তাহা বলা এবং হজ্জের নিয়ম প্রণালী বর্ণনা করা। নবী করীম (ﷺ) যখন হজ্জ করিয়াছিলেন, তখন বলিয়াছিলেনঃ ************ ‘আমার নিকট হইতে তোমরা হজ্জের নিয়ম-কানুন গ্রহণ কর’। ইহার প্রয়োজন এই যে, কুরআনে তোম কেবল নামায, যাকাত ও হজ্জের মোটামুটি আদেশ দেওয়া হইয়াছে, এ সবের কোন ব্যাখ্যা করা হয় নাই-কোন বিস্তৃত রূপ দেওয়া হয় নাই। হাদীসই ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ পেশ করে।(******************)]

আলোচ্য আয়াতের মূল প্রতিপাদ্য কথা এই যে, জনগণের সম্মযখে কুরআনের বিস্তারিত ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করাই রাসূলের প্রতি কুরআন নাযিল করা আসল উদ্দেশ্য। বস্তুত কোন বিষয়কে সঠিক রূপ ও পূর্ণাঙ্গভাবে বুঝাইয়া দেওয়ার জন্য তিনটি কাজ একান্তই অপরিহার্যঃ

প্রথম, মুখের কথা দ্বারা উহার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করা, আলোচনার মাধ্যমে প্রতিটি বিষয়ের তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক রূপ উদঘাটিত করা।

দ্বিতীয়, নিজ জীবনের কাজ-কর্ম ও বাস্তব জীবনধারার সাহায্যে উহার ব্যবহারিক মূল্য ও গুরুত্ব উজ্জ্বল করিয়াতোলা।

তৃতীয়, লোকদের দ্বারা উহাকে কার্যকর ও বাস্তবায়িত করার জন্য চেষ্টা করা, সঠিকরূপে তাহারা উহার মর্মার্থ অনুধাবন ও অনুসরণ করিতেছে কিনা, সেদিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখা; যাচাই ও পরীক্ষা কার্যে আত্মনিয়োাগ করা এবং সিঠকরূপে কার্যকর হইতে দেখিলে তাহাকে সমর্থন ও অনুমোদন দান, আর কোনরূপ ভূল-ক্রন্তি বা ক্রটি বিচ্যুতি পরিলক্ষিত হইলে তাহার সংশোধন করা।

নবী করীম (ﷺ)- এর প্রতি কুরআন নাযিল হওয়ার এই উদ্দেশ্যে ঘোষিত হইয়াছে যে, তিনি কুরআনকে এই তিন-তিনটি দিক দিয়া সুস্পষ্ট ও উজ্জ্বল করিয়া জনসমক্ষে তুলিয়া ধরিবেন। রাসূলে করীম (ﷺ) তাঁহার তেইশ বছরের নবুয়তী জীবনে এই দায়িত্ব পূর্ণ মাত্রায় ও যথাযথরূপরে পালন করিয়াছেন। এই দায়িত্ব পালন করিতে গিয়া তিনি যাহা কিছু বলিয়াছেন বা করিয়াছেন, তাহার নির্ভরযেগ্য রেকর্ডই হইতেছে হাদীস। অতএব হাদীস যে কুরআন সমর্থিত এবং কুরআন সমর্তন করে না এমন কোন জিনিস যে হাদীসে পাওয়া যায় না, তাহাতে তো সন্দেহ থাকিতে পারে না। ইমাম শাতেবী এ এ জন্যই লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

সুন্নাতে বা হাদীসে এমন জিনিসই পাওয়া যাইবে, কুরআন যাহার পূর্ণ সমর্থন করে। কুরআন সমর্থন করে না এমন কোন জিনিসই হাদীসে পাইবে না।

[১১৫*********]

রাসূলে করীম (ﷺ) যে কুরআন মজীদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আয়াতের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করিয়াছেন, তাহার বাস্তব প্রমাণ হইতেছে হাদীস গ্রন্হসমূহের তাফসীর অধ্যায়সমূহ। যেসব আয়াতের সঠিক অর্থ সাহাবায়ে কিরাম (রা) বুঝিতে পারেন নাই এবং তাহার কারণে তাহারা কাতর হইয়া পড়িয়াছেন, রাসূলে করীম (ﷺ) সে সবের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করিয়া সাহাবাদের উদ্বেগ দূরীভূত করিয়াছেন। দৃষ্টান্ত-স্বরূপ কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতটির উল্লেখ করা যাইতে পারে। আল্লাহ তা’য়ালার ইরশাদঃ

******************************************************

যাহারা ঈমান আনিয়াছে এবং তাহাদের ঈমানকে কোন প্রকার জুলুমের সহিত মিশ্রিত করে নাই………….

যখন নাযিল হয়, তখন ইহা সাহাবাদের পক্ষে বড়ই উদ্বেগের কারণ হইয়া পড়ে। তায়হারা ইহার সঠিক তাৎপর্য জানিবার জন্য রাসূলের নিকট জিজ্ঞাসা করিলেনঃ

******************************************************

আমাদের মধ্যে এমন কে আছে, যে তাহার ঈমানকে জুলুমের সহিত মিশ্রিত করে নাই?

এই প্রশ্ন শুনিয়া নবী করীম (ﷺ) বুঝিতে পারিলেন যে, সাহাবায়ে কিরামের নিকট এই আয়াতটি অত্যন্ত দুর্বোধ্য অনুভূত হইয়াছে। তখন নবী করীম (ﷺ) বলিলেনঃ

******************************************************

তোমরা যেরূপ ধারণা করিয়াছে, আয়াতের অর্থ তাহা নহে। এখানে জুলুম অর্থ শিরক ছাড়া আর কিছু নয়। তোমারা কি শোন নাই, লোকমান তাহার পুত্রকে বলিয়াছেনঃ ‘হে প্রিয় পুত্র, আল্লাহর সাথে শিরক করিও না, নিশ্চয়ই শিরক এক বিরাট জুলুম সন্দেহ নাই।

[সহীহ বুখারী শরীফ, ২য় খণ্ড, কিতাবুত তাফসীর, ৭০৮ পৃষ্ঠা।]

রাসূলের নিকট উক্ত আয়াতের প্রকৃত ব্যাখ্যা জানিতে পারিয়াই সাহাবায়ে কিরাম সান্তনা লাভ করেন। এই কারণে কুরআন মজীরে তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা জানিবার জন্যও বিশ্ব মুসলিম রাসূলের হাদীসের মুখাপেক্ষী। রাসূলের ব্যাখ্যা ব্যাতীত কুরআনের সঠিক তাৎপর্য জানিবার জন্য নির্ভরযোগ্য অপর কোন উপায়ই থাকিতে পারে না।

অপর এক আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলিয়াছেনঃ

******************************************************

হে নবী, তোমার প্রতি এই কিতাব সত্যতা সহকারে নাযিল করিয়াছে এই উদ্দেশ্যে যে, আল্লাহর প্রদর্শিত নিয়ম পদ্ধতি অনুযায়ী তুমি লোকদের মধ্যে বিচার ফয়সালা করিবে।

[সূরা আন-নিসা, ১০৫ আয়াত।]

আল্লাহ তা’আলা কিতাব নাযিল করিয়াছেন এই উদ্দেশ্যে যে, রাসূলে করীম (ﷺ) লোকদের মধ্যে বিচার ফয়সালা করিবেন, কিন্তু কোন পদ্ধতিতে তাহা করিবেন? ইহার উত্তরে বলা হইয়াছে-************ ‘যে পদ্ধতি আল্লাহ তোমাকে দেখাইয়াছেন’। তাহা হইলে মূল কিতাবও যেমন আল্লাহ নাযিল করিয়াছেন, তদনুযায়ী বিচার-ইনসাফ কায়েম করার নিয়ম পদ্ধতিও ওহীর মাধ্যমেই প্রাপ্ত।

[তাফসীরে রুহুল মাআনী, ৫ম খণ্ড, ১৪০ পৃষ্ঠা। তাফসীরে বায়যাবী, ১ম খণ্ড, ২০৫ পৃষ্ঠা। উভয়ই ************* -এর তাফসীর করিয়াছেন ********* রূ ‘যাহা তোমাকে বুঝাইয়া দিয়াছেন এবং যে বিষয়ে তেমার নিকট ওহী পাঠাইয়াছেন’ বলিয়া।] এব ইহার বিবরণ হাদীসের মারফতেই লাভ করা যাইতে পারে।কুরআন মজীদি সম্পর্কে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজের ভার আল্লাহ তা’আলা নিজেই গ্রহণ করিয়াছেন। এই সম্পর্কে আল্লাহ নিজেই বলিয়াছেনঃ

******************************************************

নিশ্চয়ই আমার উপর ন্যস্ত রহিয়াছে উহার সংগ্রহ এবং উহার পাঠ অধ্যয়ন। অতএব আমি যখন াঠ করি, তখন তুমি উহার পাঠ অনুসরণ কর। এতদ্ব্যতীত উহার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দানও আমারই কাজ।

[সূরা আল-কিয়ামাহ, ১৭, ১৮, ১৯ আয়াত।]

এই আয়াত অনুযায়ী তিনটি কাজের দায়িত্ব আল্লাহ নিজেই গ্রহণ করিয়াছেনঃ কাজ তিনটি নিম্নরূপঃ

ক) কুরআন মজীন সঞ্চয়ন, সংগ্রহ ও সন্নিবদ্ধকরণ।

খ) কুরআন মজীদের পাঠ শিক্ষা দান।

গ) কুরআনের অর্থ, ভাব ও তাৎপর্য বুঝাইয়া দেওয়া।

কিন্তু এই তিনটি কাজ আল্লাহ তা’আলা কিভাবে সম্পন্ন করিলেন, তাহা বিচার্য। এই কথা সর্বজনবিদিত যে, আল্লাহ তা’আলা জিব্রাঈলের মারফতে কুরআন মজীদ রাসূলকে পড়াইয়া দিয়াছেন, জিব্রাঈলের পাঠ করার সঙ্গে সঙ্গে রাসূলকেও সেই পাঠের অনুসরণ করিতে বলিয়া রাসূলকে উহার অধ্যয়ন শিক্ষা দিয়াছেন এবং এইভাবে রাসূলের হৃদয়পটে পূর্ণাঙ্গ কুরআনকে সঞ্চিত ও সুসংবদ্ধ করিয়া দিয়াছেন। আল্লাহর তিনটি কাজের মধ্যে প্রথম দুইটি কাজ এইভাবেই সুসম্পন্ন হইয়াছে। কিন্তু তৃতীয় কাজটি কিভাবে সম্পন্ন করা হইল? আল্লাহ নিশ্চয়ই রাসূলকে কুরআনের অর্থ, ভাব, তাৎপর্য ও কঠিন অংশের ব্যাখ্যা শিক্ষা দিয়াছেন এবং তাহা কুরআন হইতে স্বতন্ত্রভাবে করা হইয়াছে। বস্তুত এ প্রসঙ্গে আল্লাহর শিক্ষা দেওয়া যাবতীয় বিষয় হাদীসের মধ্যে সঞ্চিত হইয়া আছে।

ইসলামী জীবনাদর্শের প্রতি বিশ্বাসীদের জন্য হালাল-হারাম নির্ধারণের দায়িত্ব রাসূলের উপর অর্পিত হইয়াছে।রাসূল এই কাজ আল্লাহর প্রতিনিধি হিসাবেই আনজাম দিয়াছেন। কুরআনে স্পষ্ট ভাষায় বলা হইয়াছেঃ

******************************************************

রাসূল ভাল কাজের আদেশ করেন; খারাপ কাজ হইতে লোকদিগকে বিরত রাখেন; লোকদের জন্য ভাল ও উৎকৃষ্ট জিনিস হালাল করিয়া দেন এবং খারাপ ও নিকৃষ্ট জিনিস হারাম ঘোষণা করেন।

[সূরা আল-আরাফ, ১৫৭।]

অতএব রাসূলের যাতবীয় আদেশ-নিষেধ উপদেশ এবং তাঁহার ঘোষিথ হালাল ও হারাম বিশ্বাস করা ও মানিয়া চলা মুসলিম মাত্রেরই কর্তব্য। তাঁহার এই সমস্ত কাজের বিস্তারিত ‘রেকর্ড’ হাদীসের মধ্যে সঞ্চিত হইয়া আছে।রাসূলকে আল্লাহ তা’আলা মুসলিমদের পারস্পরিক ঝগড়া-বিবাদের চূড়ান্ত মীমাংসাকারী করিয়া পাঠাইয়াছেন। এই সম্পর্কে অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভাষায় ঘোষণা দেওয়া হইয়াছে কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতেঃ

******************************************************

তোমার আল্লাহর শপথ, লোকেরা কিছুতেই ঈমানদার হইতে পারিবে না, যদি না তাহারা –হে নবী- তোমাকে তাহাদের পারস্পরিক যাবতীয় ব্যাপারে বিচারক ও সিদ্ধান্তকারীরূপরে মানিয়া লয়, তোমার ফয়সালা সম্পর্কে মনে কুন্ঠাহীনতা বোধ করে এবং তাহা সর্বান্তকরণে মানিয়া লয়।

[সূরা আন-নিসা, ৬৫ আয়াত।]

জীবনে সমগ্র ক্ষেত্রে রাসূলের আনুগত্য করাও প্রতিটি মুসলিমের কর্তব্য। এই সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলিয়াছেনঃ

******************************************************

হে ঈমানদারগণ, আল্লাহর আনুগত্য কর, রাসূলের অনুগত হও এবং তোমাদের মধ্য হইতে দায়িত্বশীল লোকদেরও,,,,,,,,,,,,,,। কোন বিষয়ে তোমরা পরস্পর মতবিরোধ করিলে উহাকে আল্লাহ ও রাসূলের দিকে ফিরাও।

[সূরা আন-নিসা ৫৯ আয়াত।]

এই আয়াতে তিনটি বিভিন্ন সত্তার আনুগত্য করার স্পষ্ট ভাষায় নির্দেশ করা হইয়াছে। প্রথমে আল্লাহর আনুগত্য, দ্বিতীয় রাসূলের আনুগত্য এবং তৃতীয় মুসলিম দায়িত্বশীল লোকদের আনুগত্য। আল্লাহ ও রাসূলের প্রসঙ্গ স্পষ্ট ভাষায় দুই-দুইবার ******* ‘আনুগত্য’ বলার কারণে উভয় আনগত্যই মৌলিক ও স্বতন্ত্র মর্যাদা সম্পন্নরূপে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। এই নির্দেশ অনুসারে কুরআন মজীদ মানিয়া চলিলেই আল্লাহর আনুগত্য কার্যকর হইতে পারে। কিন্তু ‘রাসূলের আনগত্য কর’ এই আদেশ কার্যকর করার কি পথ?…………… এই জন্য হাদীসকে মানিয়ালওয়া ছাড়া দ্বিতীয় কোন উপায় হইতে পারে না। পক্ষান্তরে পারস্পরিক বিরোধী বিষয়ের চুড়ান্ত মীমাংসার জন্য আল্লাহর ও রাসূলের দিকে প্রত্যাবর্তন করিতে বলা হইয়াছে। আল্লাহ দিকে প্রত্যাবর্তন করা যায় আল্লাহর কিতাবের সাহায্য গ্রহণ করিলে, কিন্তু রাসূলের অবর্তমানে রাসূলের দিকে প্রত্যাবর্তন করার কি উপায় হইতে পারে? তাহার উপায় হইতেছে রাসূলের সুন্নাত বা হাদীসকে গ্রহণ করা। তাহা করা হইলেই আল্লাহর এই আদেশ পালন করা সম্ভব হইতে পারে। ইহা ছাড়া অন্য কোন উপায় নাই। এই জন্যই উপরিউক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে মায়মুন ইবনে মাহরান বলিয়াছেনঃ

******************************************************

আল্লাহর প্রতি ফিরানোর অর্থ আল্লাহর কিতাবের প্রতি ফিরানো এবং রাসূলের প্রতি ফিরানোর অর্থ রাসূলে করীমের জীবদ্দশায় তাঁহার নিজের নিকট পেশ করা। আর আল্লাহ যখন তায়হার জান কবজ করিয়া লইলেন তখন ইহার বাস্তব অর্থ তাঁহার সুন্নাতের দিকে ফিরানো।

[১২৩*********]

আল্লামা ইবনে হাজার আল-আসকালানী এই আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

যদিও প্রকৃতপক্ষে আনুগত্য পাইবার যোগ্য অধিকারী হইতেছেন একমাত্র আল্লাহ তা’আলা। কিন্তু তাহা সত্বেত্বও রাসূলেরও আনুগত্য করার আদেশ নূতন করিয়া দেওয়া হইয়াছে। কিন্তু পরবর্তী ‘উলীল আমর’ ******** এর পূর্বে ‘আনুগত্য কর’ নূতন করিয়াবলা হয় নাই। ইহার কারণ এই যে, মানুষ মানিয়া চলিতে বাধ্য শুধু দুইটি জিনিস, তাহা হইল ‘কুরআন ও সুন্নাহ’। কাজেই এখানে অর্থ হইবে এই, যেসব বিষয়ে কুরআনে স্পষ্ট ফয়সালা করিয়া দেওয়া হইয়াছে, তাহাতে আল্লাহর আনুগত্য কর, আর যাহা কুরআন হইতে জানিতে পারিয়া তোমাদিগকে বলিয়া দেওয়া হইয়াছে এবং যাহা সুন্নাতের দলিল দিয়া তোমাদের সামনে প্রমাণ করা হইয়াছে, তাহাতে রাসূলের আনুগত্য কর। ফলে আয়াতের মোট অর্থ দাঁড়াইল এইরূপঃ তিলাওয়াত করা হয় যে ওহী, তাহা হইতে তোমাদিগকে যে হুকুম দেওয়া হইবে, তাহা পালন করিয়া আল্লাহর আনুগত্য কর। আর যে ওহী কুরআন নয়, তাহা হইতে তোমাদিগকে যে হুকুম করা হইবে তাহা পালন করিয়া তোমরা রাসূলের আনুগত্য কর।

[*****************************]

আল্লামা তাইয়্যেবী এই আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

আল্লাহর হুকুম ‘রাসূলের আনুগত্য কর’ কথায় আনুগত্যের আদেশের পুনরাবৃত্তি করার কারণে বুঝা গেল যে, রাসূলে করীম (ﷺ) স্বতন্ত্র স্বাধীন এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ আনুগত্য পাওয়ার অধিকারী। আর ‘উলীল আমর’- এর ক্ষেত্রে এই শব্দটির পুনরুল্লেখ না হওয়ায় বুঝা গেল যে, ‘উলীল আ্মর’ এমনও হইতে পারে যাহার আনুগত্য করা ওয়াজিব নহে।

[১২৫**************]

রাসূলে করীম (ﷺ) কে অমান্য করা হইরে তাহাতে কতখানি অপরাধ হইতে পারে? এই সম্পর্কে নিম্নোদ্ধৃত আয়াত হইতে অনেক তত্ত্বই জানিতে পারি। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করিয়াছেনঃ

******************************************************

হে ঈমানদার লোকেরা, তোমরা যখন পরস্পর পরামর্শে মিলিত হও তখন গুনাহের কাজ, সীমালংঘনমূলক কাজ ও রাসূলের নাফরমানী করার বিষয়ে পরামর্শ করিও না। বরং পরামর্শ কর নেক কাজ ও আল্লাহ ভীতিমূলক কাজ সম্পর্কে। আর আল্লাহকে ভয় করিয়া চল, যাঁহার নিকট তোমাদের সকলকেই একত্রিত করা হইবে।

[সূরা মুযাদালাহ, আয়াত নং ৯]

এই আয়াতে রাসূলকে অমান্য করিতে স্বতন্ত্রভাবে নিষেধ করা হইয়াছে। একদিকে পাপ, সীমালংঘন ও রাসূলের অনানুগত্য বা নাফরমানীর কথা উল্লেখ করা হইয়াছে, অপরদিকে উল্লেখ করা হইয়াছে নেকী ও আল্লাহ ভীতিমূলক কাজের। ইহার অর্থ এই যে, রাসূলের অবাধ্যতা ও অনানুগত্য করিলে যেমন গোনাহ ও সীমালংঘন করা হয়, অনুরূপভাবে সকল কল্যাণ নেকী ও আল্লাহভীতি হইতেও বঞ্চিত ইতে হয়। আয়াতের শেষাংশে পরকালের কথা উল্লেখ করিয়াবলা হইয়াছে যে, রাসূলকে অমান্য ও অনানুগত্য করিলে কিয়ামতের দিন কঠিন শাস্তি ভোগ করিতে হইবে।

রাসূলের আনুগত্য ও অনুসরণ মুসলিম জীবনের এক চিরন্তন কর্তব্য। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করিয়াছেনঃ

******************************************************

অতএব তোমরা আল্লাহ এবং তাঁহার ‘উম্মী’ নবীর প্রতি ঈমান আন; যে নবী নিজে আল্লাহ এবং তাঁহার বাণীর প্রতি ঈমানদার এবং তোমরা তাহার অনুসরণ করিয়া চল।

[সূরা আল-আরাফ, আয়াত ১৫৯]

অপর এক আয়াতে ইরশাদ হইয়াছেঃ

******************************************************

রাসূল তোমাদিগকে যাহা কিছু দান করে তাহা পূর্ণরূপে তোমরা গ্রহণ ও ধারণ কর; আর যাহা হইতে নিষেধ করে, তোমরা তাহা হইতে বিরত থাক। (রাসূলের আদেশ-নিষেধ মানিয়া চলার ব্যাপারে) আল্লাহকে ভয় কর; নিশ্চয়ই আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা।

[সূরা আল-হাশর, আয়াত-৭]

রাসূলের আদেশ-নিষেধ অমান্য বা তাঁহার বিরোধিতা করিলে আল্লাত তা’আলা কঠোর শাস্তি দান করিবেন। তিনি বলিয়াছেনঃ

******************************************************

রাসূলের আদেশের যাহারা বিরোধিতা করে, তাহাদের ভয় করা উচিত যে, তাহাদের উপর কোন বিপদ মুসীবত আসিতে পারে অথবা কোন পীড়াদায়ক আযাবে তাহারা নিক্ষিপ্ত হইতে পারে।

[সূরা আন-নূর, আয়াত-৬৩]

রাসূলের ‘ইতায়াত’ বা আনুগত্য স্বীকার করা এবং বাস্তব জীবন তাঁহাকে অনুসরণের ভিত্তিতে যাপন করার উপরই মানুষের হিদায়াত ও কল্যাণ লাভ একান্তভাবে নির্ভরশীল।

আল্লাহ তা’আলা বলিয়াছেনঃ

******************************************************

তোমরা রাসূলের আনুগত্য ও অনুসরণ করিলেই হিদায়াত প্রাপ্ত হইবে।

[সূরা আন-নূর, আয়াত- ৫৪]

আবার আল্লাহর আনুগত্যও নির্ভর করে রাসূলের আনুগত্যের উপর। অন্য কথায়, রাসূলের আনুগত্য না করিলে আল্লাহর আনুগত্য করা সম্ভব হইতে পারে না। এই কথাই স্পষ্ট ভাষায় বলা হইয়াছে নিম্নোক্ত আয়াতেঃ

******************************************************

যে লোক রাসূলের আনুগত্য করিবে, সে-ই ঠিক আল্লাহর আনুগত্য করিল।

[সূরা আন-নিসা, আয়াত-৮০]

‘ইত্তিবা’ ও ‘ইতয়াতে’ রাসূল

উপরোল্লিখিত আয়াতসমূহে আল্লাহর আনুগত্য স্বীকার করার সঙ্গে সঙ্গে রাসূলেরও আনুগত্য ও অনুসরণ করার জন্য স্পষ্ট ভাষায় আদেশ করা হইয়াছে। আল্লাহর এই আদেশকে সঠিকরূপে অনুধাবন করার জন্য কুরআনে ব্যবহৃত ‘ইত্তিবা’ ও ‘ইতায়াত’ শব্দদ্বয়ের বিস্তারিত ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ আবশ্যক। এখানে আমরা এই শব্দ দুইিট সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করিব।

আরবী ভাষায় ‘ইত্তিবা’ (*******) বলা হয় কোন ব্যক্তির পিছনে পিছনে চলাকে। ইবনে মনজুর তাঁহার বিখ্যাত অভিধান গ্রন্হ ‘লিসানুল আরব’-এ বলিয়াছেনঃ

******************************************************

অভিধান ও ব্যাকরণ শাস্ত্রের ইমাম ফরা বলেনঃ ইত্তিবা বলিতে বুঝায়ঃ কোন ব্যক্তি অগ্রে অগ্রে চলে এবং তুমি তাহার পিছনে পিছনে চল। এখন তুমি যদি বল, আমি তাহার ‘ইত্তিবা’ করি, তবে বুঝাইবে যে, তুমি তাহার পদাংক অনুসরণ করিয়া পিছনে পিছনে চলিতেছ।

[*****************]

‘তাজুল উরুস’ গ্রন্হে বলা হইয়াছেঃ

******************************************************

‘তুব্বু’ বা ‘তুব্বু’ যেমন সুক্কারু, অর্থ ছায়া। উহাকে ছায়া বলা হয় এই জন্য যে, উহা সব সময়ই সূর্যের অনুসরণ করিয়া চলে। এই সম্পর্কের দৃষ্টিতে মধুমক্ষিকাদের মধ্যে সর্বোচ্চ ও সর্বোক্তম (পুরুষ) মক্ষিকাকেও ‘তুব্বা’ বলা হয়। কেননা সমস্ত সাধারণ মক্ষিকা উহাকে অন্ধভাবে অনুসরণ করিয়া চলে।

[*******************]

ইমাম আবুল আল-আ-মদী উহার পারিভাষিক অর্থ বর্ণনা প্রসংগে বলিয়াছেনঃ

******************************************************

‘মুতাবিয়াত-অনুসরণ- কখনো কথার ব্যাপারে হয়, কখনো কোন কাজ করা বা না করার ব্যাপারে হয়। কথার ব্যাপারে ‘ইত্তিবা’ হইতেছে কথার দাবি ও প্রকৃতি অনুযায়ী কাজ করা। আর কাজের ক্ষেত্রে ‘ইত্তিবা’ হইতেছে কাহারো কাজ দেখিয়া তাহা এমনভাবে করা ঠিক যেভাবে সে করিতেছে। এবং সে করিতেছে বলিয়াই সেই কাজ করা হইবে।

[***************]

এই ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যাইতে পারে যে, আল্লাহ তা’আলার নির্দেম অনুযায়ী রাসূলের ‘ইত্তিবা’ করার জন্য রাসূলের প্রত্যেকটি কথা এমনভাবে পালন করিতে হইবে, যেমনভাবে পালন করা তাঁহার কথার লক্ষ্য ও দাবি এবং রাসূলের কাজগুলিকে যেভাবে তিনি সম্পন্ন করিয়াছেন ঠিক সেইভাবেই সম্পন্ন করিতে হইবে। অন্যথায় রাসূলকে ‘ইত্তিবা’ করার আল্লাহর আদেশ পালন হইতে পারে না।

‘ইতায়াত’ (**********) শব্দটিও অনুরূপভাবে ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। আরবী ভাষায় ‘ইতায়াত’ বলা হয় কাহারো সম্মখে আনুগত্যের মস্তক অবনমিত করাকে, কাহারো হুকুম আহকামযথাযথরূপে পালন করাকে।

‘লিসানুল আরব’ গ্রন্হে উল্লেখ করা হইয়াছেঃ

******************************************************

‘তাহযীব’ নামক প্রামাণ্য অভিধান গ্রন্হে বলা হইয়াছে ************* কথাটির অর্থ কাহারো সম্মুখে আনুগত্যের মস্তক নত করিয়া দেওয়া। কেহ যদি অপর কাহারো আদেশ পালন করে, তখন বলা হয় ********** সে তাহার আনুগত্য করিল।

[*****************]

ইমাম আবুল হাসান আল-আ-মদী ‘ইতায়াত’ শব্দর পারিভাষিক অর্থ বর্ণনা প্রসঙ্গে বলিয়াছেনঃ

******************************************************

কাহাকেও বড় জানিয়া বা বড় করার উদ্দেশ্যে যদি কেহ তাহার মত কাজ করে, তবে সে তাহার ‘অনুগত হইল’ বলা হয়।

[******************]

‘ইত্তিবা’ ও ‘ইতায়াত’ শব্দদ্বয়ের আভিধানিক ও পারিভাষিক অর্থের এই আলোচনা হইতে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হইল যে, রাসূলের কথাও কাজকে পুরাপুরি মানিয়া লওয়া এবং যথাযথরূপে পালন করা এক কথায় তাহার পূর্ণাঙ্গ আনুগত্য ও অনুসরণ করা মুসলিম মাত্রেরই কর্তব্য। আর রাসূলের যাবতীয় কথা ও কাজের বিবরণ যেহেতু হাদীসের মাধ্যমেই জানা যাইতে পারে, এজন্যই দ্বীন-ইসলামে হাদীসের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

এই প্রসঙ্গে কুরআন মজীদের আর একটি আয়াতের উল্লেখ করা আবশ্যক বোধ হইতেছে। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করিয়াছেনঃ

******************************************************

কোন বিষয়ে আল্লাহ ও রাসূলের ফযসালা এবং ফরমান আছার পর তাহা মানা-না- মানার ব্যাপারে মু’মিন পুরুষ ও স্ত্রীলোকের কোন ইখতিয়ারই থাকিতে পারে না। সে লোক আল্লাহ ও তাঁহার রাসূলের নাফরমানী করে, সে পথভ্রষ্ট হইয়া ইসলাম হইতে বহুদূরে চলিয়া যায়।

[সূরা আল-আহযাব, ৩৬ আয়াত।]
 

এই আয়াত হইতে একসঙ্গে তিনটি কথা জানা যায়। প্রথশ এই যে, কোন বিষয়ে আল্লাহর যেমন স্বাধীনভাবে কোন ফয়সালা করার বা ফরমান দেওয়ার অধিকার আছে, আল্লাহর রাসূলেরও ঠিক সেইরূপ অধিকার আছে। দ্বিতীয় এই যে, মু’মিন স্ত্রী-পুরুষ যেমন আল্লাহর ফরমান ও ফয়সালা মানিয়া লইতে বাধ্য, রাসূলের ফয়সালা ও ফরমানও অনুরুপভাবে মানিয়া লইতে বাধ্য। তৃতীয় এই যে, আল্লাহর ফরমান ও ফয়সালা না মানিলে যেমন মানুষ গোমরাহ ও কাফির হয়, রাসূলের ফয়সালা ও ফরমান না মানিলেও সেইভাবেই গোমরাহ ও কাফির হইতে হয়।

অতএব কুরআন মজীদের মত রাসূলের ফরমান ও ফয়সালা নির্ভরযোগ্য রেকর্ড-হাদীস- মানিয়া লওয়াও প্রত্যেক মুসলিমের ঈমানদার হওয়া এবং ঈমানদার হইয়া জীবন যাপন করার জন্য একান্তই অপরিহার্য।

হাদীসের অপরিহার্যতা

হাদীস কুরআন মজীদের ব্যাখ্যাদাতা ও বিশ্লেষণকারী। হাদীসের সাহায্য গ্রহণ ব্যতীত কুরআন মজীদের যথাযথ ব্যাখ্যা ও অর্থ করা, উহার সঠিক উদ্দেশ্য ও ভাবধারা নিরূপণ করা সুকঠিন। নবী করীম (ﷺ) এই জন্যই নিজ ইচ্চামত কুরআন ব্যাখ্যা সস্পর্কে কঠোর সাবধান বাণী উচ্চারণ করিয়া বলিয়াছেনঃ

******************************************************

যে ব্যক্তি নিজ ইচ্ছামত কুরআন মজীদের ব্যাখ্যা করে সে যেন জাহান্নামে নিজের আসন তালাশ করিয়া লয়।

[তিরমিযী, আরওয়াবুত্তাফাসীর, ইবনে আক্কাস বর্ণিত।]

হাদীসে বর্ণিত আছেঃ

******************************************************

যে লোক নিজের ইচ্ছামত কুরআন মজীদের অর্থ করে, তাহার ব্যাখ্যা নির্ভূল হইলেও সে ভূল করে।

[তিরমিযী, আবওয়াবুত্তাফাসীর, জুনদুব হইতে বর্ণিত।]

বস্তুত মানুষের বুদ্ধি যতই প্রখর, তীক্ষ্ণ ও সুদূরপ্রসারী হউক না কেন, তাহা অবশ্যই সীমাবদ্ধ। একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত পৌছিঁয়া উহা ব্যর্থ হইতে ও স্বীয় অক্ষমতা প্রকাল এবং প্রমাণ করিতে বাধ্য কিন্তু বুদ্ধবাদ বা বুদ্ধির পূজা কোন সীমা মানিয়ালইতে প্রস্তুত নয়। বুদ্ধি ও বিবেক-শক্তি যদি রাসূলের সুন্নাত দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না হয়, তাবে তাহা বুদ্ধিবাদ ও বিবেক-পূজার নামান্তর। এই বুদ্ধিবাদ ও বিবেক-পূজা মানুষকে আল্লাহর আনগত্যের সীমা লংঘন করিতে বাধ্য করে। উপরন্তু তাহাতে একদিকে যেমন কুরআনের অপব্যাখ্যা, ভূল ও বিপরীত ব্যাখ্যা হয় বলিয়া উহার উপর জুলুম করা হয় এবং মানুষ এই কারণেই কুরআন মানিয়া চলার সৌভাগ্য হইতে বঞ্চিত হইয়া যায়; অপরদিকে তেমনি কুরআন বিশ্বাসীদের মধ্যে কঠিন মতবৈষম্য সৃষ্টি ও বিভিন্ সাংঘর্ষিক মতাদর্শ বা দৃষ্টিভঙ্গির উদ্ভব হওয়ার ফলে মুসলিম সমাজ বহুধা বিভক্ত হইয়া পড়ে। অনেক লোক আবার এই সুযোগে কুরআন লইয়া স্বেচ্ছাচারিতা শুরু করে, কুরআনের ছত্রে ছত্রে নিজেদের মনগড়া ব া পরকীয় চিন্তার পাঠ গ্রহণ করিতে শুরু করে। রাসূলের হাদীস এই পথে প্রবল প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। ইহাই মানুষের সম্মুখে কুরআনী হিদায়াতের প্রশস্ত পথ উপস্থাপিত করে; গোমরাহী বিভ্রান্তি হইতে মানুষকে রক্ষা করে ও সঠিক সরল ঋজুপথে পরিচালিত করে।

নবী করীম (ﷺ) কুরআনের বাহক, কুরআন তাঁহারই উপর অবতীর্ণ হইয়াছে; কিন্তু তিনি কেবল কুরআনই মানুষের সম্মুখে পেশ করেন নাই, কুরআনকে ভিত্তি ও কেন্দ্র করিয়া তিনি ইসলামের এক পূর্ণাঙ্গ বিধান উপস্থাপিত করিয়াছেন। এই কারণে তিনি নিজে কুরআনের সঙ্গে সঙ্গে সুন্নাত ও হাদীসের গুরুত্বের কথা নানাভাবে ঘোষণা করিয়াছেন। এখানে আমরা এই প্রৃসংগে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ হাদীস উল্লেখ করা জরুরূ মনে করিতেছি।

হযরত মিকদাম ইবনে মা’দি কারাব (রা) বলিয়াছেন, নবী করীম (ﷺ) ইরশাদ করিয়াছেনঃ

******************************************************

সাবধান, আমাকে কুরআন দেওয়া হইয়াছে এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে উহারই মত আর একটি জিনিস। সাবধান, সম্ভবত কোন সুখী ব্যক্তি তাহার বড় মানুষির আসনে উপবিষ্ট হইয়া বলিতে শুরু করিবে যে, তোমরা কেবল এই কুরআনকেই গ্রহণ কর, ইহাতে যাহা হালাল দেখিবে তাহাকেই হালাল এবং যাহাকে হারাম দেখিবে তাহাকেই হারাম মনে করিবে। অথচ প্রকৃত ব্যাপার এই যে, রাসূল যাহা হারাম করিয়াছেন, তাহা আল্লাহর ঘোষিত হারামের মতই মাননীয়।

[ইবনে মাজা, পৃষ্ঠা ৩, আবূ দাউদ, কিতাবুস সুন্নাহঃ *********************]

এই হাদীসটিই ‘সুনানে দারেমী’ গ্রন্হ নিম্নলিখিত ভাষায় উল্লেখ করা হইয়াছেঃ

******************************************************

সম্ভবত এক ব্যক্তি তাহার আসনে হেলান দিয়া বসিয়া আমার বলা কথার উল্লেখ করিবে এবং বলিবেঃ তোমাদের ও আমাদের মাঝে একমাত্র আল্লাহর কিতাব রহিয়াছে। উহাতে যাহাই হালাল পাইব, তাহাকেই হালাল মনে করিব, আর যাহা হারাম পাইব, তাহাকেই হারামরূপে গ্রহণ করিব। (অতঃপর রাসূল বলেন) সাবধান, আল্লাহর রাসূল যাহা হারাম করিয়াছেন, তাহা আল্লাহর নির্দিষ্ট করা হারামের মতই।

[সুনানে দারেমী, পৃষ্ঠা ৭০।]

রাসূলের এই কথাটি অধিক সুস্পষ্ট হইয়া ফুটিঁয়া উঠিয়াছে নিম্নোক্ত হাদীসে। হযরত ইবরাজ ইবনে সারীয়া বলেনঃ

******************************************************

নবী করীম (ﷺ) বলিয়াছেনঃ তোমাদের একজন তাহার আসনে বসিয়া কি এই ধারণ করে যে, কুরআনে যাহার উল্লেখ আছে তাহা ব্যতীত আল্লাহ তা’আলা আর কিছুই হারাম করেন নাই? সাবধান, আল্লাহর কসম, আমিও কিন্তু অনেক আদেশ করিয়াছে, উপদেশ দিয়াছি এবং অনেক বিষয়ে নিষেধ করিয়াছি; আর তাহাও কুরআনের মতই মাননীয় কিংবা তাহারও অধিক কিছু।

[আবূ দাউদ কিতাবুসসুন্নাহ ইহার সনদে আশয়াস ইবনে শু’বা একজন বর্ণনাকারী; কিন্তু তাঁহার বর্ণিত হাদীস গ্রহণ সম্পর্কে আপত্তি করা হইয়াছে।]

কুরআনের সঙ্গে সঙ্গে হাদীসও গ্রহণ করিতে হইবে এবং কোন বিশুদ্ধ হাদীসই যে কুরআনের খেলাফ হইতে পারে না, তাহা নিম্নোক্ত হাদীস হইতে প্রমাণিত হয়। হযরত সায়ীদ ইবনে যুবায়র (রা) একদা নবী করীম (ﷺ)- এর একটি হাদীস বর্ণনা করিলেন। উপস্থিত এক ব্যক্তি বলিলঃ

******************************************************

এই সম্পর্কে কুরআনে এমন কথা আছে যাহা এই হাদীসের বিপরীত।

তখন হযরর সায়ীদ বলিলেনঃ

******************************************************

আমি তোমার নিকট রাসূলের হাদীস বর্ণনা করিতেছি, আর তুমি আল্লাহর কিতাবের সহিত উহার বিরোধিতার কথা বল। অথচ রাসূলে করীম আল্লাহর কিতাব সম্পর্কে তোমার অপেক্ষা অধিক ওয়াকিফহাল ছিলেন।

[সুনানে দারেমী, পৃষ্ঠা ৭৭।]

হিদায়াতের পথে চলা ও গোমরাহী হইতে বাঁচিয়া থাকা কুরআন ও হাদীস উভয়ই মানিয়া ও পালন করিয়া চলার উপর নির্ভর করে। এই প্রসঙ্গে এখানে রাসূলে করীম (ﷺ) হইতে বর্ণিত দইটি হাদীসের উল্লেখ করা যাইতেছে। হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বলেন, নবী করীম (ﷺ) ইরশাদ করিয়াছেন।

******************************************************

আমি তোমাদের মাঝে দুইটি জিনিস রাখিয়া যাইতেছে। এই দুইটি অনুসরণ করিতে থাকিলে অতঃপর তোমরা কখনও পথভ্রষ্ট হইবে না। তাহা হইতেছে আল্লাহর কিতাব ও আমার সুন্নাত (হাদীস) এবং কিয়ামতের দিন ‘হাওযে কাওসার’- এ উপস্থিত হওয়া পর্যন্ত এই দুইটি জিনিস কখনই পরস্পর হইতে বিচ্ছিন্ন হইবে না।

[মুস্তাদরাক হাকেম, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৩।]

বিদায় হজ্জের ভাষণে রাসূলে করীম (ﷺ) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

দুইটি জিনিস, যাহা আমি তোমাদের মাঝে রাখিয়া যাইতেছি, তোমরা যতক্ষণ এই দুইটি জিনিস দৃঢ়ভাবে ধারণ করিয়া থাকিবে তোমরা কখনো গোমরাহ হইবে না। তাহা হইল, আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাত।

[ঐ, মালেক ইবনে আনাস বর্ণিত।]

ইবনে ইসহাকের বর্ণনায় এই ভাষণের ভাষা এইরূপঃ

******************************************************

আমি তোমাদের মাঝে এমন জিনিস রাখিয়া গেলাম যাহা তোমরা শক্তভাবে ধারণ করিয়া থাকিলে কস্মিনকালেও পথভ্রষ্ট হইবে না। তাহা হইল আল্লাহর কিতাব এবং তাঁহার নবী (ﷺ) –এর সুন্নাত।

[তাফসীরে রুহুল মায়ানী, ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৯৮।]

সীরাতে ইবনে হিশাম-এ বিদায় হজ্জের ভাষণের এই অংশ নিম্নোক্তরূপ ভাষায় বর্ণিত হইয়াছেঃ

******************************************************

হে মানব সমাজ, আমি তোমাদের নিকট এমন এক সম্পদ রাখিয়া গেলাম, তোমরা যদি তাহা খুব দৃঢ়তা সহকারে ধারণ কর, তবে কখনই গোমরাহ হইবে না। তাহা হইল, আল্লাহর কিতাব এবং তাঁহার নবীর সুন্নাত।

হযরত ইমরান ইবনে হুসায়ন (রা)-এর মজলিসে একজন লোক বলিলঃ

******************************************************

আপনি আমাদের নিকট কুরআন ব্যতীত অন্য কিছু বর্ণনা করিবেন না।

তখন হযরত ইমরান সে ব্যক্তিকে ডাকিয়া বলিলেনঃ

******************************************************

তুমি কি চিন্তা করিয়াদেখিয়াছ, তোমাকে ও তোমার সঙ্গী-সাথীদেরকে যদি কেবলমাত্র কুরআনের উপরই নির্ভরশীল করিয়াদেওয়া হয়, তাহা হইলে কি তুমি কুরআনে যেহরের চার রাকআত, আছরের চার রাকআত ও মাগরিবের তিন রাকআত নামাযের উল্লেখ পাইবে?

হজ্জের প্রসঙ্গ তুলিয়া বলিলেনঃ

******************************************************

কেবল কুরআন মজীদেই কি তুমি সাতবার বায়তুল্লাহার তওয়াফ, সাফা-মারওয়ার তওয়াফ, আরাফার ময়দানে অবস্থান করা এবং পাথর টুকরা নিক্ষেপ করার বিধান দেখিতে পাও?

তিনি আরো বলিলেনঃ কুরআনে চোরের হাত কাটার নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে, কিন্তু-

******************************************************

চোরের হাত কোন স্থান হইতে কাটিতে হইবে?…………… এইখান হইতে না এইখান হইতে, তাহা কি কুরআনে লেখা আছে?

[****************]

সুন্নাত ও হাদীসের গুরুত্ব এবং অপরিহার্যতা এইসব যুক্তি হইতে স্পষ্টভাবে ফুটিয়া উঠে। প্রাথমিক যুগের মনীষিগণ ইহার গুরুত্ব পূর্ণ মাত্রায় স্বীকার করিতেন। সাহাবায়ে কিরাম, তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ীন সকলেই কুরআনের সঙ্গে সঙ্গে হাদীসকেও অবশ্য পালনীয় বিষয় হিসাবে গ্রহণ করিতেন। এই সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা যথাস্থানে পেশ করা হইবে। এখানে প্রসংগত আমরা পূর্ববর্তী মনীষীদের এমন কিছু উক্তির উল্লেখ করিব, যাহা হইতে হাদীস ও সুন্নাত মানিয়া লওয়ার গুরুত্ব সুস্পষ্ট হইয়া উঠিবে।

এই পর্যায়ে প্রথমত সাহাবী যুগের একটি ঘটনা উল্লেখ করা আবশ্যক। এক ব্যক্তি হযরত ইমরান ইবনে হুসায়ন (রা) কে বলিলেনঃ

******************************************************

আপনারা আমাদের নিকট এমন সব হাদীস বর্ণনা করেন, যাহার কোন মূল ভিত্তি আমরা কুরআনে খুজিঁয়া পাই না।

ইহাতে হযরত ইমরান অত্যন্ত রাগান্বিত হন এবং প্রশ্নকারী ব্যক্তিকে সম্বোধন করিয়াবলিলেনঃ

******************************************************

প্রত্যেক চল্লিশ দিরহামে এক দিরহাম যাকাত দিতে হইবে, এত এত (প্রত্যেক চল্লিশটি) বকরীতে একটি বকরী দিতে হইবে ও এত এত (প্রত্যেক পচিঁশটি) উষ্ট্রে একটি উষ্ট্র দিতে হইবে- যাকাতের নিসাব কি তোমরা কুরআন মজীদে দেখিতে পাও?

অর্থাৎ যাকাত দানের স্পষ্ট আদেশ তো কুরআন মজীদে স্পষ্ট ভাষায় উদ্ধৃত হইয়াছে; কিন্তু উহার বিস্তারিত বিধান ও ব্যবস্থা কি কুরআনে উল্লিখিত হইয়াছে?

সেই ব্যক্তি বলিলেনঃ ‘না, তাহা কুরআনে পাওয়া যায় না’। তখন হযরত ইমরান বলিলেনঃ

******************************************************

তাহা হইলে যাকাতের এই বিস্তারিত বিধি-বিধান তোমরা কাহার নিকট হইতে জানিতে পারিলে? ইহা সবই তোমরা আমাদের (সাহাবীদের) নিকট হইতে পা্ইয়াছ, আর আমরা ইহা আল্লাহর নবীর নিকট হইতে (হাদীসের মাধ্যমে) লাভ করিয়াছি।

[***************]

এই হাদীসের ভিত্তিতে মুহাদ্দিসগণ একবাক্যে যে মূলনীতি ও ফর্মূলা প্রমাণ করিয়াছেন, তাহা এইঃ

******************************************************

সমগ্র বিষয়েরই মূল বিধান কুরআনে উল্লিখিত; কিন্তু উহাদের শাখা-প্রশাখা খুটিঁনাটি (ও ব্যবহারিক নিয়মনীতি) সবই রাসূলের বর্ণনা হইতে জানা গিয়াছে।

[******************]

মকহুল দেমাশকী বলিয়াছেনঃ

******************************************************

কুরআন হাদীস বা সুন্নাতের প্রতি অধিকতর মুখাপেক্ষী, সুন্নাত কুরআনের প্রতি ততটা নয়।

[**********************]

ইমাম আওযায়ীও এই কথা বলিয়াছেন নিম্নোক্ত ভাষায়ঃ

******************************************************

আল্লাহর কিতাব ব্যাখ্যার জন্য সুন্নাত অধিক দরকারী কিন্তু সুন্নাত ব্যাখ্যার জন্য কুরআনের প্রয়োজন ততটা নয়।

[***********]

ইয়াহইয়া ইবনে আবী কাসীর বলিয়াছেনঃ

******************************************************

সুন্নাত বা হাদীস কুরআনের তুলনায় অধিক ফয়সালাকারী, কুরআন সুন্নাতের বিপরীত ফয়সালা দিতে পারে না।

[**************]

ইমাম আহমদ ইবনে হা’ল এই দুইটি কথার ব্যাখ্যাদান করিতে গিয়া বলিয়াছেনঃ

******************************************************

সুন্নাত বা হাদীস কুরআনের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণকারী এবং সুন্নাত উহার অর্থ প্রাঞ্জল ভাষায় বর্ণনা করে।

[********]

শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী হাদীসের গুরুত্ব ও অপরিহার্যতা নিম্নোক্ত ভাষায় ঘোষণা করিয়াছেনঃ

******************************************************

******************************************************

ইলমে হাদীস সকল প্রকার জ্ঞান-বিজ্ঞানের তুলনায় অধিক উন্নত, উত্তম এবং দ্বীন-ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের ভিত্তি। হাদীসের সর্বশ্রেষ্ঠ নবী এবং তাহার সাহাবীদের হইতে নিঃসৃত কথা, কাজ ও সমর্থন বর্ণিত হইয়াছে। বস্তুত ইহা অন্ধকারের মধ্যে আলোকস্তম্ভ, ইহা যেন এক সর্বদিক উজ্জ্বলকারী পূর্ণ চন্দ্র। যে ইহার অনুসারী হইবে ও ইহকে আয়ত্ত করিয়া লইবে, সে সৎপথ প্রাপ্ত হইবে। সে লাভ করিবে বিপুল কল্যাণ। আর যে উহাকে অগ্রাহ্য করিবে, উহা হইতে বিমুখ হইবে সে পথভ্রষ্ট হইবে, লালসার অনুসারী হইবে, পরিণামে সে অধিক মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হইবে। কেননা নবী করীম (ﷺ) অনেক কাজ করিতে নিষেধ করিয়াছেন, অনেক কাজের আদেশ করিয়াছেন। পাপের পরিণাম সম্পর্কে ভীতি প্রদর্শন করিয়াছেন, নেক কাজের সুফল পাওয়ার সুসংবাদ দিয়াছেন। তিনি অনেক দৃষ্টান্ত দিয়া লোকদের নসীহত দান করিয়াছেন। অতএব তাহা নিশ্চয়ই কুরআনের মত কিংবা ততোধিক গুরুত্বপূর্ণ।

[হুজ্জতুল্লাহিল বালিগা, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১।]

শাহ দেহলভী আরো বলিয়াছেনঃ

******************************************************

সুন্নাত বা হাদীস কুরআনেরই ব্যাখ্যাদাতা এবং তাহা উহার কিছুমাত্র বিরোধিতা করে না।

[***********************]

ইমাম আবূ হানীফার নিম্নোক্ত বাক্যটিও এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়ঃ

******************************************************

সুন্নাত বা হাদীসের অস্তিত্ব না হইলে আমাদের মধ্যে কেহই কুরআন বুঝিতে পারিত না।

[**************]

এই প্রসঙ্গে নিম্নোক্ত কথাটিও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্যঃ

******************************************************

রাবিয়া (রা) হইতে বর্ণিত হইয়াছে, তিনি বলিয়াছেনঃ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা (হে নবী) তোমার প্রতি কুরআন নাযিল করিয়াছেন অতিশয় বিস্তারিতভাবে; কিন্তু উহাতে হাদীস ও সুন্নাতের জন্য একটি অবকাশ রাখিয়া দিয়াছেন। নবী করীম (ﷺ) সেই সুন্নাত ও হাদীস স্থাপন করিয়াছেন, যদিও তাহাতে ইজতিহাদ করা বা নিজের মত প্রয়োগের সুযোগও রাখিয়া দেওয়া হইয়াছে।

[তাফসীরে দুররে মনসুর, তারিখুত্তাফসীর, পৃষ্ঠা ৪।]

ইমাম উবায়াদ লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

আল্লাহ ও রাসূলের হালাল-হারাম সম্পর্কিত হুকুমের মধ্যে পার্থক্য নাই। রাসূল এমন কোন হুকুম দিতেন না, যাহার বিপরীত কথা কুরআন হইতে প্রমাণিত হইত। বরং সুন্নাত (হাদীস) হইতেছে আল্লাহর নাযিল করা কিতাবের ব্যাখ্যাদাতা এবং কুরআনের আইন-বিধান ও শরীয়াতের বিশ্লেষণকারী।

[কিতাবুল আমওয়াল-আবূ উবায়দ, পৃষ্ঠা ৫৪৪।]

হাদীস অমান্যকারী কাফির

ইসলামী ফিকাহর ইমামগণ সম্পূর্ণ একমত হইয়া ঘোষণা করিয়াছেন যে, হাদীস অমান্যকারী গুমরাহ, ইসলাম হইতে বাহির হইয়া যাওয়া লোক। ইসহাক ইবনে রাহওয়াই বলিয়াছেনঃ

******************************************************

যে লোকের নিকট রাসূল করীম (ﷺ) হইতে কোন হাদীস পৌছিঁল, সে উহার সত্যতা যথার্ততা স্বীকার করে তাহা সত্ত্বেও সে যদি কোনরূপ কারণ ব্যতীত উহা প্রত্যাখান করে। তাহা হইলে তাহাকে কাফির মনে করিতে হইবে।

ইমাম ইবনে হাজম তাঁহার ‘আল-আহাকাম’ গ্রন্হে লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

কোন ব্যক্তি যদি বলে যে, আমরা শুধু তাহাই গ্রহণ করিব যাহা কুরআনে পাওয়া যায়-উহা ছাড়া আর কিছুই গ্রহণ করিব না, তাহা হইলে সে গোটা মুসলিম উম্মতের ঐকমত্যের ভিত্তিতে কাফির।

হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) বলিয়াছেনঃ

******************************************************

খুব শীঘ্র এমন সব লোক আসিবে যাহারা কুরআনের প্রতি সন্দেহ লইয়া তোমাদের সহিত বিবাদ করিবে, তোমরা তাহাদিগকে সুন্নাত বা হাদীসের সাহায্যে পাকড়াও কর। কেননা সুন্নাতের ধারক বা হাদীস বিশারদ মহান আল্লাহর কিতাব সম্পর্কে অধিক জ্ঞানের অধিকারী।*********************************

হাদীস ও রাসূলের ইজতিহাদ

নবী করীম (ﷺ) হইতে বিশ্বমানব দুইটি জিনিস লাভ করিয়াছে। একটি হইতেছে কুরআন মজীদ আর দ্বিতীয়টি সুন্নাত। কুরআন সরাসরি আল্লাহর কালাম, আল্লাহর নিকট হইতেই ওহীর মারফতে নাযিল হইয়াছে। আর সুন্নাতেরও মূল উৎস হইতেছে ওহী। রাসূলে করীম (ﷺ) অনেক ক্ষেত্রে নিজেই ইজতিহাদ করিয়াছেন একথা সত্য; কিন্তু তাহাও ওহীবিহীন নহে। হয় উহার সহিত ওহীর সরাসরি সম্পর্ক রহিয়াছে, নয় উহা ওহী কর্তৃক সমর্থিত এবং অনুমতিপ্রাপ্ত। কাজেই রাসূলের ইজতিহাদকেও ইসলামের উৎস হিসাবে স্বীকার করিতে হইবে।

এই পর্যায়ে শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভীর আলোচনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি এই বিষয়টির প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ দান প্রসঙ্গে লিখিয়াছেনঃ

হাদীসের কিতাবসমূহে রাসূল (ﷺ) হইতে যেসব হাদীস বর্ণিত ও উদ্ধৃত হইয়াছে, তাহা দুই প্রকারের। প্রথম প্রকারের হাদীস হইতেছে তাহা. যাহা রিসালাতের দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যে বলা হইয়াছে। কুরআনের আয়াতঃ

******************************************************

‘রাসূল তোমাদিগকে যাহা কিছু দিয়াছেন তাহা গ্রহণ কর, আর যাহা হইতে নিষেধ করিয়াছেন তাহা হইতে বিরত থাক’- এই বিশাল পর্যায়ে এই ধরনের হাদীস গণ্য। এই ধরনের হাদীসের এক ভাগ তাহা, যাহাতে পরকালের অবস্থা ও মালাকুতী জগতের বিস্ময়কর বিষয় সম্পর্কে বলা হইয়াছে। এইসব বিষয়ের ভিত্তি হইতেছে ওহী। হাদীসসমূহে যে ভাবে শরীয়াতের হুকুম-আহকাম বর্ণিত হইয়াছে, ইবাদাতের আরকান ও নিয়মাবলীর বিশ্লেষণ রহিয়াছে, জীবন প্রণালীর বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা সম্পর্কিত ব্যাখ্যা ও উপদেশ রহিয়াছে, তাহা এই প্রথম পর্যায়ের প্রথম ভাগের হাদীস। প্রথম পর্যায়ের এই হাদীসসমূহের এব দ্বিতীয় ভাগের কিছু হাদীস ওহীবদ্ধ; আর কিছু রাসূলে করীমের নিজের ইজতিহাদ-ভিত্তিক। কিন্তু স্মরণ রাখিতে হইবে যে, রাসূলে করীমের ইজতিহাদও ওহীর সমপর্যায়ভুক্ত। কেননা আল্লাহ তা’আলা তাঁহাকে ভূল ইজতিহাদ করিতে দেন নাই। তাঁহার ইজতিহাদ কখনো ভূল হইয়া গেলে সেই ভূলের উপর তাঁহাকে কায়েম থাকিতে দেন নাই। কোন প্রকার ভূল হইলে অনতিবিলম্বে আল্লাহর তরফ হইতে উহার সংশোধন ও বিশুদ্ধ হইয়া যাওয়া অপরিহার্য।

[****************]

শাহ ওয়ালীউল্লাহ এই শেষ কথা কয়টি এই ভাষায় লিখিয়াছেনঃ

******************************************************

এই প্রকারের হাদীসের কিছু অংশ ওহীমূলক, আর কিছু ইজতিহাদমূলক। তবে রাসূলে করীম (ﷺ)-এর ইজতিহাদও ওহীরই সমতুল্য। কেননা রাসূলের রায়কে ভূলের উপর স্থায়ী হইয়া থাকা হইতে আল্লাত তা’আল্অ তাঁহাকে রক্ষা করিয়াছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *