হাত উঠায়া যব – বিশ্বপতি চৌধুরী
ভারতের অদ্বিতীয় গায়ক তানসেনের নাম তোমরা সকলেই বোধ হয় শুনেছ৷ আজও আমাদের দেশের বড়ো বড়ো গায়কেরা মিয়া তানসেনের নামে কপালে হাত ঠেকিয়ে বার বার সেলাম ঠুকে থাকেন৷ জবরদস্ত কালোয়াতের দল আজও আসরে গান শুরু করবার পূর্বে বীণাপাণির এই বরপুত্রটিকে স্মরণ করে ডান হাত দিয়ে নাসিকা ও কর্ণমূল তিনবার স্পর্শ করে থাকেন৷ এতবড়ো জবরদস্ত গায়ক ছিলেন এই মিয়া তানসেন৷
প্রবাদ আছে, ইনি এতবড়ো গুণী ছিলেন যে, মেঘ রাগ ভেঁজে খর গ্রীষ্মের রৌদ্রদগ্ধ নীলাকাশকে নিমেষে মেঘাচ্ছন্ন করে তুলতে পারতেন৷ আবার দিল্লির দারুণ শীতে মানুষ যখন হি-হি করে কাঁপছে, সেই সময় তাঁর কন্ঠনিঃসৃত দীপক রাগ দেখতে দেখতে দারুণ রৌদ্রতাপে সকলকে অতিষ্ঠ করে তুলত৷
এইসব আজগুবি গল্প তোমাদের বিশ্বাস করতে বলি না; কিন্তু এ থেকে বুঝতে পারছ, এদেশের লোকেরা তানসেনকে কী চক্ষে দেখত৷
এহেন তানসেনেরও একজন ওস্তাদ ছিলেন৷ এই ওস্তাদজিটির নাম হরিদাস স্বামী৷
সাকরেদের গুণপনার কথা তো শুনলে, এখন ওস্তাদজির গুণপনার কথাটা একবার কল্পনায় ভেবে দেখো!
হরিদাস ছিলেন সাধু প্রকৃতির লোক৷ বৃন্দাবনের এক নির্জন বনে, লোকালয় থেকে বহুদূরে একটি কুটির রচনা করে সেইখানেই তিনি বাস করতেন, আর সকাল-সন্ধ্যায় তানপুরাটি তুলে নিয়ে আপন মনে ভগবানের গুণকীর্তন করতেন৷ সে গান পৃথিবীর নয়৷ সে গান সুদূর কোন স্বপ্নরাজ্যের কথা মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয়৷
২
সম্রাট আকবর শিকারে বেরিয়েছেন৷ বৃন্দাবনের একটি নিবিড় জঙ্গলে সম্রাটের ছাউনি পড়েছে৷ সেদিন অনেক তোড়জোড় করা হয়েছিল; কিন্তু কিছুতেই শিকার মিলল না৷ সারাদিন বনবাদাড় ভেঙে বৈকালের দিকে অবসন্ন দেহ আর তারও চেয়ে অবসন্ন মন নিয়ে নিতান্তই নিরাশ হয়ে বাদশা যখন শিবিরে ফেরবার ব্যবস্থা করছেন, সেই সময় সহসা একটা প্রকাণ্ড বন্য হরিণ তাঁর নজরে পড়ে গেল৷ আর যায় কোথা! আকবর শিকারের পশ্চাতে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন৷ হরিণও ছোটে যত, ঘোড়াও ছোটে তত৷ বাদশা ছুটছেন তো ছুটছেন৷ কিন্তু হরিণকে কিছুতেই বাগে পাওয়া যাচ্ছে না৷ কাছাকাছি না পেলে বর্শা ছুড়বেনই বা কেমন করে?
তাঁর অশ্ব ক্রমেই হাঁপিয়ে পড়ছে ফলে শিকারের সঙ্গে তাঁর দূরত্বের ব্যবধান ক্রমে বেড়েই চলেছে৷ এদিকে ক্ষুধা-তৃষ্ণা ও ক্লান্তিতে দেহ ভেঙে পড়বার মতো হয়েছে৷ কিন্তু শিকারের ঝোঁক বড়ো ঝোঁক৷
বাদশা একবার পশ্চাতের পানে তাকালেন৷ তাঁর সঙ্গীদের কোনো চিহ্ন নেই৷ তারা অনেকখানি পেছিয়ে পড়েছে৷ হয়তো বা তারা তাঁকে অনুসরণ করতে না পেরে ভুল করে ভিন্ন পথে চলে গেছে৷ গেছে যাক-তাতে ক্ষতি নেই-একাই তিনি শিকারের পশ্চাতে ছুটবেন৷ কিন্তু এইভাবে ছুটলে হরিণ আর একটু পরেই দৃষ্টিসীমার বাইরে গিয়ে পড়বে৷ তখন ঘন জঙ্গলের মধ্যে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না৷
এমনি ধারা যখন অবস্থা, সেই সময় হঠাৎ আকবর দেখেন, দূরে-বহূদূরে তাঁর শিকারটি সহসা পাথরের মতো নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে৷ সম্রাট অবাক হয়ে গেলেন;-এ কী ব্যাপার?-হরিণটা হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল কেন? মুহূর্ত পূর্বেও সে যেরকম দ্রুত ছুটছিল-তা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, সে এতটুকুও হাঁপিয়ে পড়েনি৷ অবাক হয়ে সম্রাট শিকারের পানে অশ্ব ছোটালেন৷ ব্যবধান ক্রমেই কমে আসছে; কিন্তু হরিণ তো নড়বার নামটি পর্যন্ত করে না৷ সম্রাট আরও নিকটে গেলেন-তবুও সেই একই ভাব৷
আর একটু অগ্রসর হতেই হঠাৎ দূর থেকে অস্পষ্ট একটি সংগীতের রেশ তাঁর কানে ভেসে এল, কী অপূর্ব সে সংগীত!-সে যেন মানুষের সমস্ত চেতনাকে অভিভূত করে ফেলে; সে যেন মানুষের মনকে কোন এক স্বপ্নলোকে উধাও করে নিয়ে যায়৷
ঘোড়াটি কখন একসময় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল-বাদশা তা জানতেও পারেননি৷ হরিণের কথাও তিনি ভুলে গেছেন৷ সমস্ত চেতনা যেন দূরাগত সেই সংগীতের মোহঘোরে আচ্ছন্ন৷
সহসা গান থেমে গেল৷ বাদশা যেন স্বপ্ন দেখতে দেখতে হঠাৎ জেগে উঠলেন৷-চেয়ে দেখেন, হরিণটিও হঠাৎ সজাগ হয়ে উঠে প্রাণভয়ে আবার ছুটতে শুরু করে দিয়েছে৷
আকবর কিন্তু আর তাকে অনুসরণ করলেন না-সে প্রবৃত্তিও এখন তাঁর নেই৷ এতক্ষণে তিনি বুঝতে পারলেন-হরিণটি হঠাৎ অমন করে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়েছিল কেন৷
কিন্তু কে সেই অপরিচিত গায়ক, যার গান মৃত্যুভয়ে ভীত বনের পশুকেও এমন করে মুগ্ধ করতে পারে? আকবর অশ্বপৃষ্ঠ থেকে অবতরণ করলেন৷ তারপর যেদিক থেকে গানের সুর ভেসে আসছিল সেই দিক লক্ষ করে অগ্রসর হতে লাগলেন৷
সরু আঁকাবাঁকা বন্যপথ৷ দু-ধারে নিবিড় ঘন জঙ্গল৷ বাদশা উন্মুখ হয়ে চলেছেন৷ গাছপালার আড়ালে ওই না কার কুটিরের চালা দেখা যায়?-হ্যাঁ, কুটিরই তো বটে!
৩
ছোটো একরত্তি ঘর৷-যেমন জীর্ণ, তেমনি অপরিসর৷ তারই মধ্যে ছেঁড়া মাদুরে একটা হাতের উপর মাথা রেখে শুয়ে আছেন একটি দীর্ঘকায় পুরুষ৷ ঘরখানি এত ছোটো, তাঁর পা দুটির কতক অংশ দরজার বাইরে পড়েছে৷
কুটিরের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়াতেই একজোড়া পা বাদশার চোখের সুমুখে জেগে উঠল৷ এ দৃশ্য দেখতে সম্রাটের চোখ কোনোদিন অভ্যস্ত নয়৷ আকবর শার চিত্ত ভিতরে ভিতরে অত্যন্ত অপ্রসন্ন হয়ে উঠল৷
এই সময় কুটিরের ভিতর থেকে প্রশ্ন এল-‘কে ওখানে?’
উত্তর হল-‘আমি দিল্লির সম্রাট আকবর শা, তোমার গানে মুগ্ধ হয়ে এখানে এসেছি৷’
আকবর মনে ভেবেছিলেন, একথা শোনবামাত্র কুটিরবাসী লোকটি নিশচয় তাঁর পা দু-টি শশব্যস্তে গুটিয়ে নেবেন৷ কিন্তু সেরকম কোনো লক্ষণই দেখা গেল না৷
আকবর শার বাদশাহি মেজাজ এইবার উদারা, মুদারা থেকে একেবারে তারায় ঠেলে উঠল৷ জলদগম্ভীর স্বরে তিনি বলে উঠলেন ‘পা উঠায়া কব?’
সঙ্গেসঙ্গেই উত্তর এল ‘হাত’ ‘উঠায়া যব৷’
আকবর স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন৷ এতবড়ো উত্তর আজ পর্যন্ত তিনি কারুর মুখ থেকে শোনেননি৷ সত্যই তো, সংসারের সমস্ত বাসনা-কামনা থেকে যে ব্যক্তি হাত উঠিয়ে নিয়েছে, জগতের সবার সামনে পা তোলবার অধিকার তো একমাত্র তারই৷ তার কাছে সম্রাট আর পথের ভিখারিতে প্রভেদ কোথায়?
গুণগ্রাহী সম্রাট কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে রইলেন; তারপর সহসা একসময় সেই অপরিচিত মহাপুরুষকে ভক্তিভরে প্রণিপাত করলেন৷
ইনিই হচ্ছেন তানসেনের গুরু হরিদাস স্বামী৷ এরপর বাদশার আগ্রহাতিশয্যে হরিদাস স্বামী তাঁর প্রিয় শিষ্যটিকে আকবর শার হাতে সঁপে দিয়েছিলেন এবং পরে তাঁর এই হিন্দু শিষ্যটি মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করে বাদশার কাছ থেকে তানসেন উপাধি লাভ করেছিলেন৷