ব্যাঙ্কে টাকা আছে, কিন্তু হাতে টাকা নেই। কারণ লম্বা লাইন পেরিয়ে এটিএমে যখন পৌঁছই তখন মেশিনের টাকা ফুরিয়ে যায়। ব্যাঙ্কের দীর্ঘ লাইনে সকালে দাঁড়িয়ে সন্ধ্যেবেলায় সপ্তাহের বরাদ্দ টাকা তুলতে শুধু মনের জোর থাকলে চলে না, পায়েও জোর থাকা চাই। চারদিকে সব আছে, শুধু টাকা নেই। কার্ডে জিনিসপত্রের দাম দিচ্ছি, চেকে দিচ্ছি। কিন্তু খুচরোর তো দরকার আছে। মাছওয়ালার কাছ থেকে বাকিতে বেশ ক’দিন মাছ কিনেছি। মাছওয়ালা ক্যাশ ছাড়া কিছু নেয় না। কিন্তু সেদিন তার হাতে অনেকটা জোর করেই ব্যাঙ্কের চেক ধরিয়ে দিলাম। এ ছাড়া আমার উপায় কী!
প্রতিদিন সকাল থেকে মানুষ ব্যাঙ্কের সামনে দাঁড়াচ্ছে। লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে প্রতিদিন। অনেকে হতাশায়-আশঙ্কায় আত্মহত্যা করছে, কারো কারো হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তারপরও মানুষ কিন্তু অখুশি নয়। খুব বেশি কেউ বলছে না হঠাৎ করে পাঁচশ আর এক হাজার টাকার নোট বাতিল করার কাজটা মোদিজি ভালো করেননি, বা এভাবে দুর্নীতি দমন করা যায় না। ভারতের মানুষ দুর্নীতি দমন করার জন্য কোনো সরকারকে এমন কোনো পদক্ষেপ নিতে, যে পদক্ষেপ দেশকে আমূল নাড়িয়ে দেয়, দেখেনি আগে। তাই সকলেই ভেবে নিচ্ছে চমৎকার দমন হচ্ছে দুর্নীতি। মাঝে মাঝেই খবর পাচ্ছে কোথাও রাস্তার ধারে বস্তা ভরা বাতিল টাকা পাওয়া যাচ্ছে, কোনও খালে বা নদীতে বাতিল হয়ে যাওয়া বিস্তর টাকা ডুবিয়ে দেওয়া হচ্ছে, টাকা পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। সকলেই ধরে নিচ্ছে ধরা পড়ে গেছে দুর্নীতিবাজরা। সাধারণ মানুষ এই ভেবে খুশি হচ্ছে যে কালো টাকা যাদের কাছে ছিল, তাদের ভীষণ বিপদে ফেলে দিয়েছেন মোদি, তারা এখন কালো টাকা ফেলে দিচ্ছে, পুড়িয়ে দিচ্ছে, ডুবিয়ে দিচ্ছে। মানুষ ভেবে নিচ্ছে ভারতবর্ষ থেকে জন্মের মতো বিদেয় নিতে যাচ্ছে দুর্নীতি। নিজেদের দুর্ভোগ নিয়ে তাই তারা মোটেও দুঃখিত নয়। সপ্তাহে ২৪ হাজারের বেশি টাকা ব্যাঙ্ক থেকে তোলা যাবে না। এটিএম থেকে আড়াই হাজারের বেশি নয়। পুরনো নোট চার হাজারের বেশি বদলানো যাবে না। একশ’ পঁচিশ কোটি লোকের দেশ। বিয়ের মরশুম এখন। মানুষের হাতে টাকা নেই। অন্য কোনো দেশ হলে এমন সরকারকে বিদেয় নিতে হতো বা প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করতে বাধ্য হতেন। ভারতবর্ষই বোধহয় একমাত্র দেশ যেখানে মানুষের দুর্ভোগের কারণ হয়েও একই রকম জনপ্রিয় থাকা যায়।
ভারতবর্ষের ভাববাদী আদর্শে আত্মত্যাগ থাকতেই হয়। মানুষ শুনতে শুনতে বড় হয়েছে, কষ্ট করলে কেষ্ট মেলে। দীর্ঘ দুর্গম পথ হেঁটে তারা তীর্থস্থানে যায়। দুর্ভোগ যত হবে, তত নাকি পুণ্য হবে। ধর্মে আর কুসংস্কারে আচ্ছন্ন মানুষ দেশ থেকে দুর্নীতি বিদেয় করতে নিজেদের অশান্তি হাসিমুখেই মেনে নিচ্ছে। তবে দুর্মুখ যে নেই তা নয়, বলছে, ‘যে জনগোষ্ঠী টাকাকে আক্ষরিক অর্থে পুজো করে তারা টাকা ওভাবে পোড়াবে না, ডোবাবে না, রাস্তায় ফেলবেও না। কালো টাকাকে সাদা করার যেসব পদ্ধতি আছে, সবগুলোই চেষ্টা করবে। বাতিল টাকা রাস্তায় ফেলেছে সরকারি দলের লোকেরা। নিউজ এজেন্সির লোকদের দাওয়াত দিয়ে নিয়ে নিয়ে তারাই দেখাচ্ছে এই দেখ কালো টাকা রাতের অন্ধকারে ডুবিয়ে দিচ্ছে ওরা, পুড়িয়ে দিচ্ছে ওরা। ওরা কারা? ওরা কালোবাজারি, কালো ধনের মালিক। ’
মানুষ কালো ধনের মালিকদের শাস্তি দিতে এক পায়ে খাড়া। ভারতের রাজনীতিতে এর চেয়ে জনপ্রিয় আর কোনো বিষয় নেই যে, ভারতীয়দের কালো টাকা তুমি তাদের সুইস ব্যাঙ্ক থেকে উঠিয়ে দেশে ফেরত নিয়ে আসবে। ওই টাকায় দেশের অর্থনীতির উন্নতি ঘটবে, সব মানুষের সচ্ছলতা আসবে। এই কাজটি করার প্রতিশ্রুতি দিলে এ দেশে ভোটে জিতে মুখ্যমন্ত্রী হওয়া যায়, এমনকি প্রধানমন্ত্রীও হওয়া যায়।
অরভিন্দ কেজরিওয়াল ঠিকই ধরতে পেরেছিলেন রাজনীতির লোক না হয়েও লোককে কী কথা শোনালে তিনি রাতারাতি জনপ্রিয় রাজনীতিক হয়ে যেতে পারেন। হয়েছেনও তাই। কংগ্রেসের নেতারা দুর্নীতি করে কালো টাকা জমিয়েছেন, লক্ষ কোটি টাকার স্ক্যাম হয়েছে কংগ্রেসের আমলে। এই প্রচারই যথেষ্ট ছিল কংগ্রেসকে গত নির্বাচনে ধুলোর মতো উড়িয়ে দিতে। বিজেপি এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে গেল যে তারা দেশকে দুর্নীতির হাত থেকে মুক্ত করবে। সুইস ব্যাঙ্কে জমানো ভারতীয়দের সব কালো টাকা সরকার গঠন করার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নিয়ে আসবে। কয়েক বছর হয়ে গেল, বিদেশে জমানো কালো টাকা এখনও দেশে ফেরত আনার কোনো লক্ষণই নেই। মানুষ কিন্তু অপেক্ষা করছে। এমন সময় আচমকা এলো টাকা বাতিলের ঘোষণা। মানুষ ভেবে নিচ্ছে, প্রথম পদক্ষেপে কালোবাজারিরা অর্ধেক মৃত, এর পর এদের বিদেশের টাকা ঘরে নিয়ে এলে, অর্থাৎ দ্বিতীয় পদক্ষেপে এরা হবে পুরোটাই মৃত।
সাধারণ মানুষ হয়তো তলিয়ে দেখে না, ধরা যদি কেউ পড়েও থাকে, ক্ষতি যদি কারো হয়েই থাকে এই টাকা বাতিল করার সিদ্ধান্তের কারণে, সে রাঘব-বোয়ালদের নয়, চুনোপুঁটিদের, যারা সামান্য কালো টাকা জমিয়ে ঘরে লুকিয়ে রেখেছিল বিপদে আপদে বাঁচার জন্য, ছেলে মেয়ের প্রাইভেট ইস্কুলে পড়াশোনা, বা তাদের বিয়েটিয়ের জন্য। যারা রাঘব-বোয়াল, যাদের ধন দৌলতের কোনো কূল কিনার নেই, তারা নোট রাখে না কোথাও, তারা রিয়েল এস্টেটে ঢেলে দেয়, সোনা কিনে রাখে, অথবা সুইস ব্যাঙ্কে রেখে দেয়। তাদের সঙ্গে সব রাজনীতিকদের, বিশেষ করে যারা ক্ষমতায়, সম্পর্ক অত্যন্ত মধুর। তারা নির্বাচনের সময় দু’হাতে কালো টাকা ঢেলে পছন্দের দলকে জেতানোর ব্যবস্থা করে, শত শত কোটি টাকা দলের দানবাক্সে ঢুকিয়ে দেয়। তারপর তারা যখন সরকারি ব্যাঙ্ক থেকে বাণিজ্য উদ্দেশ্যে লক্ষ কোটি টাকা লোন নেয়, বছরের পর বছর পার হলেও সেই লোনের টাকা পরিশোধ করার কোনো তাগিদ তাদের মধ্যে লক্ষ করা যায় না। এই রাঘব-বোয়ালরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকে।
হাজার বা লক্ষ কোটি কালো টাকা বিদেশের ব্যাঙ্কে যারা লুকিয়ে রেখেছে, তাদের লিস্ট আগের সরকারের কাছেও আছে, এই সরকারের কাছেও আছে। কিন্তু কেউ সেই কাজটি করছেন না, যে কাজটির জন্য জনগণ দীর্ঘদিন অপেক্ষা করে আছে। কোনো সরকারই কথা দিয়েও সেই টাকা ফেরত আনছেন না। অপ্রিয় সত্য কথাটি হলো, সেই লিস্টে অনেক রাজনীতিক আছেন। সব দলেরই রাজনীতিক। এক দল ফেঁসে গেলে আরেক দলও ফেঁসে যাবে। তাই দুর্মুখরা বলে, ‘এ অনেকটা দলে দলে ‘পলিটিক্যাল ডীল’, তুমিও যাবে না, আমিও যাবো না, বুঝলে নটবর?’
এ দেশের পাবলিককে বোকা বানানো খুব সহজ। তারা হিসেব চাইছে না টাকা বাতিল করে দেশজুড়ে যে টাকার অভাব তৈরি করা হলো, জনগণকে যে ভোগানো হলো, এখনো হচ্ছে, আখেরে কতটা লাভবান হলো দেশ! বাণিজ্যে যে মন্দা দেখা দিচ্ছে, কতদিনে তা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারবে, তা জানতেও চাইছে না সরকারের কাছে। পাবলিক যে কোনো উপায়ে দুর্নীতি রোধের পক্ষে। তোমার পদ্ধতিটি কার্যকরী নাও হতে পারে, কিন্তু কিছু করার জন্য তুমি যে চেষ্টা করেছ, এতেই তারা খুশি।
এত খুশি যে দুর্নীতি দমনের সরকারি এই সিদ্ধান্তে ভুল ধরাটাও কারো সহ্য হচ্ছে না। যদি ভরা মাঠে কেউ টাকা বাতিলের সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বলে, তবে সে মার খেয়ে মরবে। দেশদ্রোহী বলে তো গালি দেওয়াই হবে। আজকাল কেউ যদি ভারতের সিনেমায় পাকিস্তানি অভিনেতাদের অধিকারের পক্ষে কথা বলে, বা পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের বন্ধুত্ব চায়, বা কাশ্মীরে ভারতীয় সেনাদের খুন খারাবির কোনোরকম সমালোচনা করে, তাহলেই দেশদ্রোহী আখ্যা পেয়ে যায়। অনেক ভিন্ন মতের মানুষ দেশদ্রোহী আখ্যা পাওয়া নিয়ে এতই ভীতসন্ত্রস্ত যে মনের কথা কোথাও তারা প্রকাশ করছে না। দেয়ালেরও কান আছে, তারাও জানে।
দুর্নীতি রোধের কোনো পদক্ষেপের সমালোচনা তো দূরের কথা, এ নিয়ে প্রশ্ন করাও চলবে না। মানুষ সত্যিই অন্তর থেকে চাইছে দেশ থেকে দুর্নীতি সরাতে। এ সময় সৎ রাজনীতিকদের চেষ্টা করা উচিত দুর্নীতি রোধের টোপটা পাবলিকের নাকের ডগায় ঝুলিয়ে না রেখে সত্যিকার কিছু একটা করা, জনগণের দুর্ভোগ পোহাতে না হয়, কিন্তু দুর্নীতি রোধ হয়, এমন কিছু। এমন কিছু পদ্ধতির অস্তিত্ব যে নেই, তা তো নয়।
কে সৎ আর কে সৎ নয়, এ ব্যাপারে সাধারণ মানুষের মধ্যে সেদিন কথোপকথন শুনলাম। তারা বলছে, প্রেসিডেন্ট আব্দুল কালাম আজাদ সৎ লোক ছিলেন, কারণ তাঁর পরিবার ছিল না, সন্তানাদি ছিল না, তিনি একা মানুষ ছিলেন, কারো জন্য তাঁর চুরি ডাকাতি করার দরকার পড়েনি। মোদি সৎ, কারণ তিনিও একা মানুষ। সৎ আর অসতের এই ব্যাখ্যা যারা দেয়, তাদের বোকা বানানো সহজ বলেই চতুর রাজনীতিকরা বোকা বানায়। আমি একবার ভেবেছিলাম বলবো, পরিবার আর বাচ্চাকাচ্চা না থাকলেই কেউ সৎ হয়, আর না থাকলেই অসৎ হয়, তা ঠিক নয়। শেষ পর্যন্ত বলিনি, বললে হয়তো মার খেতে হবে, অথবা ভারতের ভাল চাই না আমি, আমাকে এ দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া উচিত— এমন কথা শুনতে হতে পারে।
বাক স্বাধীনতায় বিশ্বাস করা মানুষকেও সময় সময় মুখ বুজে থাকতে হয়।
সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৪ নভেম্বর, ২০১৬