হাতে কমণ্ডলু, মাথায় তুর্কি টুপি

হাতে কমণ্ডলু, মাথায় তুর্কি টুপি

প্রভাঁসের লোক বড়ই অনাড়ম্বর। তাই স্যুটের বড়ফাট্টাই নিয়ে সেখানে মশকরা জমে ভালো।

স্যুট বাবদে একদা মহামুশকিলে পড়েছিলেন লর্ড কার্জন।

আমি জানি আমার নগণ্যতম অর্থাৎ আমার প্রিয়তম পাঠকও প্রত্যয় যাবেন না যে, লর্ড কার্জনের মতো বিলেতের খানদানি পরিবারের নিকষ্যি কুলীন স্যুটের মতো ডালভাত– সরি, আই মিন বেকন-আন্ডা নিয়ে গর্দিশে পড়তে পারেন। টাকাকড়ির অভাব এমনিতেই ছিল না, তদুপরি বিয়ে করেছিলেন মার্কিন কোটিপতির দুহিতা নিশ্চয়ই শ্বশুরবাড়িতে আসার সময় (আবার ভুল করলুম, মার্কিনিংরেজ মেয়ে শাদি করে শ্বশুরবাড়ি যায় না, স্বামীকে সেখান থেকে ছোঁ মেরে শিকার করে ঘরে বাঁধে অন্য মোকামে) পিতাকে উত্তমরূপে দোহন করেই এসেছিলেন। তাই স্বীকার করে নিচ্ছি গল্পটি অন্য কারও বাবদে হতে পারে এবং ডিটেলে ভুল থাকবে এন্তের। কিন্তু আমার নিপীড়িত কর্মক্লান্ত স্মৃতিশক্তি তবু যেন ক্ষীণ কণ্ঠে বার বার অভিমানভরে বলছে, এটা লর্ড কার্জন অব্‌ কিডলস্টনেরই কাহিনী কার্জনের মুসলমানপ্রীতি দেখে অনেকেই বলতেন লর্ড কার্জন অব্‌ খিদিলস্তান।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তুর্কিকে কচুকাটা করা হল সে-এর সন্ধিচুক্তিতে (তখনই এদেশে খেলাফত আন্দোলনের দানা বাঁধে), কিন্তু ওই সময় উদয় হল মুস্তফা কামাল পাশার, (পরে আতা ত্যুরক) এবং তিনি সে সন্ধিকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে খেদিয়ে বার করে দিলেন গ্রিকদের তুর্কি থেকে। তখন আবার নয়া করে সন্ধিপত্র তৈরি করতে হবে। ইউরোপময় হাহাকার রব উঠেছে, বর্বর মুসলমান তুর্ক সুসভ্য খ্রিস্টান গ্রিকদের তাড়িয়ে দিয়েছে তার হকের (বে-) দখলি জমি থেকে নতুন সন্ধিতে এটা মানা চলবে না। (ফ্যাতাপ্লি নয়)। তাই নয়, সন্ধিটা যাতে চোস্ত-দুরস্ত হয় সেজন্য লজান বৈঠকে পাঠানো হল তামাম ইউরোপের কুটিলস্য কৌটিল্য মহামান্য কার্জনকে।

গণ্ডা দশেক সটকেশ ট্রাঙ্ক নিয়ে নামলেন পরমপ্রতাপান্বিত কার্জন লজান শহরে। দুনিয়ার রিপোর্টার জড় হয়েছে তাঁর অবতরণভূমিতে।

মালপত্র যখন নামছে তখন দেখা গেল, সেই বাষট্টি ভাজা লগেজের সঙ্গে আলাদা করে অতি সন্তর্পণে নামানো হল একখানি ছোট্ট ফুট-স্টুল- লর্ড কার্জন মিটিং-মাটিং সর্বত্রই এই জিনিসটির উপর পা না রেখে দু-দণ্ড বসতে পারেন না। ওইটে দেখামাত্রই এক ঠোঁট-কাটা ফরাসি সাংবাদিক টিপ্পনী কাটলে– ভোয়ালা ল্য ত্রোন দ্য দামা! (Voila le trone de Danas!)–এই হেরো, দামাস্কাসের সিংহাসন–অর্থাৎ নয়া মাহমুদ কার্জনের চলচৌকি পৃথিবীর সর্বপ্রাচীন নগর (স্থান পরিবর্তন না করে একটানা এক জায়গায় আছে) দমস্কের সমতুল্য।…তা সে যাক গে, এটা ঈষৎ অবান্তর।

তুর্কির পক্ষ থেকে এসেছেন জেনারেল ইসমে পাশা (পরে প্রেসিডেন্ট ইনে)।

জোর কনফারেন্স, জোরালো উপ-কনফারেন্স, সাবকমিটি আরও কত কী। কার্জন বজ্রনির্ঘোষে থানডারিং– লেকচার ঝাড়লেন টেবিল থাবড়ে। ইসমে দিব্য ইংরেজি বোঝেন– ভান করলেন বোঝেন না, তদুপরি তিনি কানে খাটো। থানডারিং লেকচারের প্রতিটি তার কানের কাছে অনুবাদ করে দিতে হয়– থান্ডার ততক্ষণে ঠাণ্ডা। গরমাগরম উত্তর দিতে হল। সেপাই ইসমে পারবেন কেন অরেটর কার্জনের সঙ্গে? তবু চলল লড়াই।(১)

সন্ধেবেলা এরা সবাই একটুখানি আমোদ-আহ্লাদ করে নিতেন। আজ এখানে ডিনার, কাল সেখানে ডান্স, পরশু জিনিভা হ্রদে নৈশভ্রমণ।

এক সন্ধ্যায় কার্জনের ভ্যালে তাঁকে যথারীতি অত্যুত্তম ডিনার স্যুট পরিয়ে দিয়ে, সাদা বো-টি নিখুঁত বেঁধে দিলে পর সদাশয় লর্ড বললেন, আজ আর তুমি আমার জন্য জেগে থেক না; ফিরতে অনেক রাত হবে। আমি কোনওরকমে ম্যানেজ করে নেবোখন। এ যে কত বিরাট সদাশয়তা সেটা সাধারণ পাঠক বুঝতে পারবেন না। এসব লর্ডরা ভ্যালের সাহায্য বিনা জামা-কাপড় পরতে তো পারেনই না– আর বো বাধার বেলা তো ৯৯% স্রেফ ঘায়েল ছাড়তে পর্যন্ত পারেন না।

ভ্যালেটি ছিল কার্জনের চেয়েও খানদানি অবশ্য তার আপন ভ্যালে সম্প্রদায়ে। বো বাঁধাতে তার ছিল বিশ্বরেকর্ড। ১১ সেকেন্ডে সে যা বো বাঁধত, মনে হত, একদম মেশিনে তৈরি, রেডিমেড বো। অন্য লোক এস্থলে সে সন্দেহ এড়াবার জন্য বো-টি একটু ট্যারা করে নেয়। খানদানি কার্জনের বেলা অবশ্য এ সন্দেহ করতে যাবে কে?– বহু বছর পরে হিটলারের ভ্যালে লিঙে এর কাছাকাছি অর্থাৎ ১২ সেকেন্ডে আসতে পেরেছিলেন। লিঙে তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, হিটলার প্রতিবার চোখ বন্ধ করে এক, দুই গুনতেন এবং লিঙের বো বাঁধা হলে সোল্লাসে বলতেন, লিঙে, এবারও কেল্লা ফতে করেছ মাত্র বারো সেকেন্ড!… উপস্থিত এ বো অনুচ্ছেদ থাক।

কার্জন তো গেলেন ব্যানকুয়েটে wined and dined হতে– সঙ্গে ত্রোন দ্য দামা বা দিমিশকের ময়ূর সিংহাসন বগলে করে নিয়ে গিয়েছিলেন কি না সে সম্বন্ধে ইংরেজি এসাইপিডিয়া, ফরাসি লিত্রে, জর্মন ব্রকহাউস– চরম পরিতাপের বিষয়– সবাই নীরব। বিবেচনা করি নিমন্ত্রণ-কর্তাই সেটি সাপ্লাই করেছিলেন। কিন্তু সে রাত্রে কিসে যেন কী হয়ে গেল, কার্জন অসুস্থ বোধ করতে লাগলেন এবং রাত দশটা-এগারোটার মধ্যে হোটেলে ফিরে এলেন।

হোটেলে ঢুকতেই দেখেন বিরাট হল জুড়ে লেগেছে ধুন্ধুমার নৃত্য– সে রাত্রে সে হোটেলে ছিল গ্যালা ড্যান্স। তারই একপাশ দিয়ে পেরিয়ে গিয়ে তাকে উঠতে হবে লিফুটে। যেতে যেতে হঠাৎ তিনি থমকে দাঁড়ালেন– কে ওই লোকটি? বড্ডই যেন চেনা-চেনা মনে হচ্ছে। উৎকৃষ্টতম স্টাইলের নিখুঁত ফুল ডিনার-ড্রেস পরে সাতিশয় সুরুচিসম্মত পদ্ধতিতে নাচছে একটি সম্ভ্রান্তবংশীয়া যুবতীর সঙ্গে।

সর্বনাশ! ও গড!! এ যে তারই ভ্যালে!! নাচছে তারই ইভনিং ড্রেস পরে।

আহা, সদয় সহৃদয় পাঠক, তুমিও আমার সঙ্গে সবেদন কণ্ঠ যোগ দিয়ে বলবে, আহা, বেচারি ভেবেছিল কত্তার ফিরতে যখন দেরি হবে তখন সে-ই বা দু চক্কর নেচে নেয় না কেন?

কিন্তু এ যে ডবল মহাপাপ– খাস বিলেতে নিশ্চয়ই, এস্থলে ডবল ফাঁসির চেয়েও কড়া আইন আছে।

তুলনা দিয়ে কী প্রকারে বোঝাই? কোনও নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ যদি হঠাৎ কোনও এক পরিচিতের বাড়িতে গিয়ে দেখেন তারই এক চেনা চাড়াল তারই গরদ পরে বামুন সেজে পুজোর ঘরে ঘন্টা বাজিয়ে ধুমধাম লাগিয়েছে আর বউঝিরা তাকে টিপটিপ করে পেন্নাম করছে তা হলে তার মনের অবস্থাটা কোন রস দিয়ে বর্ণাতে হয়?

***

 কার্জন হুকুম জারি করলেন, ব্যাটাকে যেন অতি ভোরের ট্রেনে চাপিয়ে দেওয়া হয় নাক বরাবর লন্ডন। একটা ঠিকে ভ্যালে যেন তদ্দণ্ডেই জোগাড় করা হয়।

এখানেই শেষ? আদৌ না। এ তো সবে শুরু।

পরদিন সকালে কার্জন খাটে শুয়ে শুয়ে দেখেন, ঠিকে ভ্যালে ওয়ার্ডরোবের দরজা খুলে তার সামনে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে ঘাড় চুলকোচ্ছে। অচেনা, নয়া ঠিকে কার্জনও দরদী দিল আদমি, শুধোলেন, কী হল?

কাঁচুমাচু হয়ে বলল, হুজুর, সঠিক ঠাহর হচ্ছে না। পাতলুনগুলো গেল কোথায়!

লক্ষ মেরে কার্জন গিয়ে দেখেন, সত্যিই তো পাতলুনগুলো গেল কোথায়? আছে বটে অনেকগুলো, কিন্তু স্ট্রাইপট অর্থাৎ ডোরাকাটা পাতলুনগুলো কোথায়? সেগুলোর যে এক জোড়াও নেই। আর সেই পরেই তো তিনি যাবেন দুপুরের কনফারেন্সে। খাঁটি ফুল মর্নিং ড্রেস। সামনের দিকে ট্যারা করে কাটা হাঁটুবুল কোট, সেই কাপড়েরই তৈরি ম্যাচ করা কিংবা ফেনসি ওয়াকিট– এই ওয়াসকিটেই সাদা পাইপিং লাগাবেন কি না তাই নিয়ে জীবনমরণ সমস্যায় পড়েছিলেন আমার সুবন্ধু স্যার সিরিল হবজন-জবসন ফর্স-রবার্টসন লন্ডনে এবং তাঁর সঙ্গে সাদায় কালোয়, কিংবা ঈষৎ ধূসর রঙের ডোরাকাটা স্ট্রাইপট ট্রাউজারজ– তার তো কোনও চিহ্নই নেই।

সর্বনাশ! এখন উপায়?

গাঁইয়া পাঠক যতই ধানাইপানাই করি না কেন, আন্মো এখনও তাই তুমি বলবে, কেন অন্য পাতলুন পরে গেলে হয় না? নিশ্চয়ই হয়। যান না আপনি নিচে কপ্পিন, উপরে দুশালা-শাল, মাথায় তুর্কি টুপি, হাতে কমণ্ডলু নিয়ে আধুনিকদের ব্যুফে লান পার্টিতে টালিউডে কে বারণ করছে? সেকথা থাক।

কিন্তু ব্যাটা ভ্যালের চুরি করারই যদি মতলব ছিল কোট-ওয়েসকিট ম্যাচিং-টাই-কলার পেটেন্ট-লেদার জুতো মায় স্প্যাটস এগুলো ফেলে গেল কেন? এস্তেক ডাইমন্ড পিনও যথাস্থানে রয়েছে। উঁহু, তা নয়। নিশ্চয়ই সুদ্ধমাত্র তাদের রাম-ইডিয়েট বানাবার জন্য।

ঝাড়ো টেলিগ্রাফ। পকড়ো রাসকেলকো কঁহি ভি হোয় টেরেন মে–চাহে প্যারিস, চাহে লনদন!

সে না-হয় হল। কার্জনের রোআবে বাঘের দুধের অর্ডার আকছারই যায় টেলিগ্রামে।

 কিন্তু স্ট্রাইপট ট্রাউজারজ তো আর বাঘের দুধ নয়, বাঘিনীর দুধও নয়। আপাতক সে বস্তু মেলে কোথা? ওদিকে প্লেনারি কনফারেন্সের সময় যে ঘনিয়ে আসছে। হে ভগবান! প্রতি মুহূর্তের এ কী গব্বযন্ত্রণা!

***

এমন সময় করিডরে শতকণ্ঠে বাইশটে ভাষায় চিৎকার হই-হুল্লোড়।

 পাওয়া গেছে! পাওয়া গেছে! কোথায়? কোথায়?

যে মেয়েটি ভ্যালে, চাকরবাকরদের কুটুরিগুলোতে তাদের বিছানাপত্র ঝেড়ে-কুড়ে দেয়, সে কার্জনের ভ্যালের তোশক ঝাড়তে গিয়ে দেখে তার নিচে পরিপাটিরূপে টান-টান করে সাজানো চার জোড়া স্ট্রাইপট পাতলুন। আমরা, গরিব দুঃখীরা যাদের বাধ্য হয়ে মাঝেমধ্যে স্যুট পরতে হয়, তারা জানি, পাতলুনের ক্রিজ দুরস্ত করার জন্য এর চেয়ে মহত্তর মুষ্টিযোগ নেই।

কিন্তু সর্বজ্ঞ কার্জনের সেদিন নবীন জ্ঞানসঞ্চয় হল ॥(২)

———–

১. কার্জন-ইসমেতের দ্বন্দ্বযুদ্ধে ইসমেতের শেষ পর্যন্ত নিরঙ্কুশ জয় হলে পর সাংবাদিকরা তাকে অভিনন্দন জানাতে আসেন। অতিশয় সবিনয়ে তিনি নিবেদন করেন, না, না, আমার আর কী কীর্তি! আমি কালা– আল্লাকে অসংখ্য শোকরিয়া ধন্যবাদ।

২. কাহিনীটি যিনি আমাকে সর্বপ্রথম বলেন তার মতে লিটন স্ট্রেচিই নাকি ইটি সকলের পয়লা লিপিবদ্ধ করেন। আমি ভিন্ন ভিন্ন কীর্তন শুনেছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *