2 of 2

হাতের রেখায় খুন – কবিতা সিংহ

হাতের রেখায় খুন – কবিতা সিংহ

দার্জিলিঙে তখন সিজন চলছে।

অনুপম হঠাৎ বলে বসল, চল অসিত, দার্জিলিং যাওয়া যাক।

আমি বললাম, হোটেলে জায়গা পাবি?

অনুপম আমার হাতটা ধরে বলল, দেখি হাতটা। —তারপর খুব নিরীক্ষণ করে দেখছে এইভাবে খানিকক্ষণ ভ্রূ কুঞ্চিত করে দেখে বলল, যা হোক একটা জুটে যাবে, দেখিস!

অতএব বাক্স-বিছানা বেঁধে দার্জিলিং।

বলতে ভুলেছি, অনুপম ভাগ্য-গণনা করে। আর ভাগ্য-গণনার সূত্রে বহুরকম মানুষের সঙ্গে তার চেনা-জানা, আলাপ-পরিচয়। দুর্বল মুহূর্তে বহু মানুষ তাদের মনের কথা অকপটে বলে ফেলে অনুপমকে, গোপন বাসনা জানিয়ে ফেলে।

আর সত্যি কথা বলতে কী, যদিও জ্যোতিষ-শাস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই, কিন্তু অনুপমকে আমি দারুণ বিশ্বাস করি। যারা তাকে হাত দেখায় তাদের মতে, অনুপম নাকি দারুণ ভবিষ্যৎ-গণনা করতে পারে।

দার্জিলিং গিয়ে যখন কোনও হোটেলে জায়গা পাওয়া গেল না, তখন অনুপমকে ক্লান্ত, শ্রান্ত গলায় কথা শোনাতে ছাড়লাম না। বললাম, কী, খুব যে হাত দেখে বলেছিলি, একটা কিছু জুটে যাবে!

যাঃ, সে তো ঠাট্টা করেছিলাম।

কিন্তু সত্যি বলতে, এখন কোথায় যাই? যেমনি খিদে পেয়েছে, তেমনি ঘুম!

হোটেলের গেটের বাইরে সুটকেস আর বেডিং রেখে আমরা দুজন ক্লান্ত হয়ে বসে পড়েছিলাম। একজন সুট-পরা ভদ্রলোক অনুপমকে দেখে হঠাৎ থেমে দাঁড়িয়ে বললেন, আরে! অনুপম না?

অনুপম লাফিয়ে উঠে বলল, অনিল না? অনিল চৌধুরী!

হোটেলে জায়গা পাসনি তো, বেশ হয়েছে। থাক ঠান্ডায় বসে। সারারাত বাইরে বসে জমে শক্ত হয়ে যা।

অনুপম এবার নিজের মেজাজ ফিরে পেয়েছে। হেসে বলল, তুই এখানে আছিস? তা হলে আর হোটেল খুঁজবই বা কেন? নে চল, তোর আস্তানায় উঠি।

পথে যেতে-যেতে অনিল চৌধুরীর সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিল অনুপম। পদস্থ সরকারি কর্মচারী, দার্জিলিঙে পোস্টেড।

অনুপমের কলেজ-জীবনের বন্ধু। মনে হল, এককালে খুব দহরম-মহরম ছিল দুজনের। অনুপমকে দেখে দারুণ খুশি হয়ে গেছেন ভদ্রলোক।

ফাউ আমাকে দেখেও অখুশি হননি।

আমার দিকে ফিরে অনুপম গর্বভরে বলল, দেখলি, হাত দেখতে জানি, কি জানি না? জায়গা জুটে গেল কি না বল?

আমি বাধ্য হয়ে বললাম, জানিস বাবা, জানিস। হল!

আমাদের কথোপকথন শুনছিলেন অনিল চৌধুরী। এবার সরব হয়ে বললেন, ধ্যেৎ, ও কিছু জানে না। কলেজ-লাইফে আমরা ছিলাম ওর জ্যোতিষবিদ্যাচর্চার গিনিপিগ। আমাদের হাত দেখে যত সব হাবিজাবি বলত। আমার সম্বন্ধেও অনেক বাজে কথা বলেছে, একটাও মেলেনি।

অনুপম উত্তেজিত হয়ে বলল, এই, মেলেনি? বল, আমি বলিনি তুই রাজকার্য করবি?

হ্যাঁ।

তোর অনেক টাকা হবে, পিতৃকুলের বিষয় পাবি অনেক!

তা অবশ্য পেয়েছি!

বলিনি, তোর বিদেশযাত্রা হবে?

হ্যাঁ, তাও হয়েছে অবশ্য!

তবে?

অনিল চৌধুরী এবার সলজ্জভাবে বললেন, যাঃ, সেসব কি আর বলা যায়, আরও যেসব বলেছিলি! অসিতবাবুর সামনে…প্রথম আলাপেই বলতে কীরকম যেন সঙ্কোচ হচ্ছে!

সঙ্কোচের কিছু নেই, ও আমার প্রাণের বন্ধু, তুই যেমন ছিলি কলেজ-লাইফে। ওর কাছে আমি কিছুই গোপন করি না।

অনিল চৌধুরী এবার একটু অপ্রস্তুতের মতো হাসলেন। ভদ্রলোক অত্যন্ত সুপুরুষ। সুন্দর সাজানো দাঁত। এমন সাজানো, হাসলে ভারী সুন্দর দেখায়।

না, মানে, আমার লাভ-লাইফ, ম্যারেড-লাইফ সম্বন্ধে তুই যা বলেছিলি!

কেন? মেলেনি বলতে চাও? —অনুপম কটমট করে অনিল চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে ছদ্মরাগে ফেটে পড়ে বলল, নাঃ, ধোওয়া তুলসী পাতা তুমি! বুকে হাত দিয়ে বলো, স্ত্রীঘটিত কোনও প্যাঁচে পড়োনি তুমি? বিলেতে, কলকাতায় চাকরির জায়গায়?

সে অমন অনেকেই পড়ে, কিন্তু আমার স্ত্রী!

হ্যাঁ, তোমার স্ত্রী! বলো! বলো!

বলতে আর হল না। সামনেই চমৎকার গেট। বাগান, মরশুমি ফুলে সাজানো মস্ত বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি। একেবারে গেটের কাছে উৎকণ্ঠিত মুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন যিনি, তিনিই অনিল চৌধুরীর স্ত্রী।

স্ত্রীকে দেখে মুহূর্তেই মুখের চেহারা বদলে গেল অনিল চৌধুরীর। মুখের রেখাগুলো কেমন ভালোবাসায়, শান্তিতে, নির্ভরতায় নরম হয়ে গেল।

মিনতি, অনুপম রায় আর অসিত মিত্র, আমার বন্ধু, হোটেলে জায়গা পাননি। খুব শিক্ষা হয়েছে, তাই তোমার কাছে নিয়ে এলাম।

গেট খুলে হেসে মিনতি বললেন, বেশ করেছ। আসুন, ভিতরে আসুন!

তাঁর মুখখানিতে লাবণ্যের আলো মাখানো। ভারী কোমল চেহারা। হাতির দাঁতের মতো ফরসা গায়ের রং। দাঁতগুলি ঝকঝকে, সাজানো। পাতলা দুটি ঠোঁটে হালকা গোলাপির ছোঁয়া। দেখলে প্রথমটা মনে হয়, ঠোঁটে রং দিয়েছেন। পরে সদ্যস্নাতা মিনতিকেও দেখেছি। অমনি পাতলা রঙিন ঠোঁট, গোলাপি গাল। ঠোঁটের গালের স্বাভাবিক রং অম্লান রয়েছে।

চাপা গলায় অনিল চৌধুরী অনুপমকে বললেন, ইউ আর রং, মাই ডিয়ার ফ্রেন্ড। শি ইজ নট এ ফেয়ারি, বাট অ্যান অ্যাঞ্জেল!

অ্যাঞ্জেল তো বটেই। পরনে হালকা হলুদ রঙের শালের শাড়ি। শাড়ির ওপর গরম কোট। কোটের ওপর পশমের চাদর। লম্বা বিনুনি, কোমর ছাড়িয়ে আরও নীচে নেমেছে। পায়ে গোলাপি নাইলনের মোজা আর মখমলের নেপালি চটি।

বাড়ির মধ্যে ঢুকে আমাদের আরও ভালো লাগল। চমৎকার সাজানো ড্রয়িংরুম, ডাইনিংরুম, এমনকী গেস্টরুম দুটিও সুন্দর সাজানো। যেন মিনতি চৌধুরী জানতেন, আজ সন্ধ্যায়, অবেলায় আমরা এসে পড়ব।

আমরা মিনতির প্রশংসায় সরব না হয়ে পারলাম না। দুজনে মিলে একটি গেস্টরুমেই আশ্রয় নিলাম। আর-একটি খোলা হলেও সেটিতে গেলাম না।

রাতে মিনতির রান্না করা পোলাও আর মুরগির মাংস খেয়ে উদগার তুলতে-তুলতে আমরা তিনজন পুরুষ ড্রয়িংরুমে বসলাম। মিনতি আর এলেন না। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বললেন, এবার আপনাদের স্ট্যাগ পা. চলুক, আমি শুতে যাচ্ছি।

মিনতি চলে যেতেই অনিল চৌধুরী বললেন, ব্রান্ডি চলবে?

খাওয়ার পর সত্যিই বেশ শীত করছিল। অনুপম বলল, হোক না একটু মেডিকেটেড ডোজ।

অনিল চৌধুরী উঠে বেয়ারাকে ব্রান্ডি দিতে বলতে গেলেন। সেই ফাঁকে নিচু গলায় আমি অনুপমকে প্রশ্ন করলাম, ওর বউ সম্বন্ধে ওকে কী ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলি?

কী আবার বলব? বলেছিলাম, তোমার বউ হবে মার্ডারেস, খুনি!

আমি চমকে উঠে বললাম, কী বলছিস তুই!

ঠিকই বলছি, অনিলের হাতে ভীষণ স্ট্রং সাইন আছে। কোষ্ঠীতেও। ও-চিহ্ন বদলাবার নয়।

কিন্তু তুই মিনতি চৌধুরীর হাত দেখেছিস?

দেখেছি।

কখন?

যখন খাবার পরিবেশন করছিলেন। হাত পেতে হাতে চিনি ঢালছিলেন, দেখেছি।

কী দেখেছিস?

শি ইজ এ মার্ডারেস, খুনি!

যাঃ! আমি বিশ্বাস করি না।

আমি করি। তবে চিহ্নটা ম্লান হয়ে এসেছে। হয়তো ও খুন করেছে অলরেডি!

আমি আরও প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলাম, অনিল চৌধুরী ঢুকলেন, সঙ্গে বেয়ারা। আর ট্রেতে তিন গ্লাস সত্যিই মেডিকেটেড ডোজে ব্রান্ডি।

ব্রান্ডিতে চুমুক দিতে-দিতে সোফায় ডুবে গিয়ে অনিল চৌধুরী বললেন, মন খারাপ করিস না, অনুপম। সব গণনা তো আর মেলে না। বল, এতক্ষণ দেখলি তো মিনতিকে, বল কত ভালো বউ পেয়েছি আমি! তোর গণনা-টননা মিলল না আর। বুঝলি!

অনুপম চুপচাপ ব্রান্ডিতে চুমুক দিতে-দিতে মৃদু-মৃদু হাসতে লাগল।

অনিল চৌধুরী চাপা গলায় বলল, জানিস, এই একটি মেয়ে, মিনতি, আমার সমস্ত জীবনটাকে কীভাবে বদলে দিয়েছে?

ক্লান্ত গলায় অনুপম বলল, বউয়ের প্রশস্তি করার আর সময় পেলি না, অনিল! তার চেয়ে বরং এখন জমিয়ে একটা ভূতের গল্প কর।

আরে তাই-ই করছি। সত্যি, ভূত-টুত আমি বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু আজকাল করি। জানিস, মিনতির জীবনের সঙ্গে একটা অদ্ভুত অলৌকিক রহস্য জড়িয়ে আছে। সেই রহস্যের ঘটনাটাই শাপে বর হয়ে আমাদের দুজনের জীবন বদলে দিয়েছে, জানিস! ঘটনাটা শুনলে বুঝবি মিনতি কত ভালো। যেসব অতীন্দ্রিয় লোকের খবর আমরা জানি না, সেখান থেকেও মিনতির জন্যে সাহায্য আসে।

অনুপম এবার সোজা হয়ে বসে একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, ঠিক আছে। নাউ আই অ্যাম ইন্টারেস্টেড, বল।

সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে অনিল চৌধুরী বললেন, মিনতি ছিল বাপ-মা হারা গরিব একটি মেয়ে। মামারবাড়ি মানুষ। আমি তখন রৌরকেলায় পোস্টেড। সোল গভর্নমেন্টে একটা মোটামুটি চাকরি করি। আমি যে-ফ্ল্যাটে থাকতাম, তার পাশের ফ্ল্যাটের একটি মেয়ের সঙ্গে তখন আমার পুরোদমে প্রেম চলছে। আমার প্রথম স্ত্রী রুচি ঘটনাটা স্বচক্ষে দ্যাখে। মানে, আমার আর অতসীর প্রেম। মাঝরাতে নিজের বিছানা থেকে উঠে আমি পড়াশোনার ছুতো করে পাশের ঘরে যেতাম, অতসী দুটো ফ্ল্যাটের মাঝের দরজা খুলে আমার কাছে চলে আসত।

ব্যাপারটা ধরা পড়ার পর রুচির কাছে আমি ক্ষমা প্রার্থনা করি। শপথ করি, আর অমনটা হবে না। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কী, আমার প্রতিজ্ঞা আমি রাখতে পারিনি। আবার একদিন, অতসীর সঙ্গে…সেইদিন রাতেই রুচি শাড়িতে কেরোসিন ঢেলে আত্মহত্যা করে। তবে সে মরার সময় আমাকে জড়ায়নি।

ব্রান্ডিতে চুমুক দিয়ে অনিল চৌধুরী বললেন, অসিতবাবু, আপনি হয়তো আমাকে খুব ঘেন্না করছেন। তা করুন, ভাবতে আমার নিজেরই অবাক লাগছে যে, সেই লোকটি কি সত্যিই আমি? এই আমি? একদিন যে-নোংরা কাজ আমি করেছি, আজ সেই কথাগুলো কেবল মুখে আনতেই আমার নিজেকে এত অশুচি মনে হচ্ছে, কী বলব! জানবেন, এ সবই ওই মিনতির জন্যে, ও সত্যিই দেবী!

অনুপম বলল, তারপর?

যে-অতসীর জন্যে এত কাণ্ড, সেই অতসী কিন্তু কিছুতেই আমায় বিয়ে করতে রাজি হল না। আমি যখন স্ত্রী-বিয়োগ-যন্ত্রণা আর অতসীর জন্যে তীব্র পরকীয়া আকর্ষণ অনুভব করছি, তখন অতসী আর-এক আমেরিকা ফেরত ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে ঘুরতে আরম্ভ করেছে। আমাকে আর পাত্তা দিচ্ছে না।

মাস-ছয়েকের মধ্যে মা-বাবা-বউদিরা আবার পেড়াপেড়ি শুরু করলেন বিয়ে করতে হবে। আমারও অনিচ্ছা ছিল না। তা ছাড়া, অতসীকেও তো দেখিয়ে দেওয়া হবে যে, দাগী আর খুঁতো হওয়া সত্ত্বেও আমারও বিয়ে হচ্ছে।

এবার কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হল, কেবল পাত্রীই বিবেচ্য। কোনও দাবিদাওয়া নেই। প্রকৃত সুন্দরী কন্যা চাই।

একরাশ ফটো থেকে তিন-চারটে ফটো বাছলেন মা। খোঁজখবর নেওয়া হতে লাগল। শেষ পর্যন্ত যাকে সবচেয়ে পছন্দ হল মায়ের, আরও খবর নিতে-নিতে জানা গেল, সে—অর্থাৎ মিনতি—রুচিরই মামাতো বোন। গরিব মামার গলগ্রহ, শরীর-ভরা রূপ ছাড়া বেচারির আর কিছুই নেই। মামা আবার পয়সা রোজগারের জন্যে মিনতিকে অফিসপাড়ার থিয়েটারে নামাত। ভালো অভিনেত্রী বলে সুনাম হয়েছিল খুব। কিন্তু ওর গাম্ভীর্যের রক্ষাকবচ ভেদ করে কেউ ওর দিকে এগোতে সাহস করত না।

আমি তো মিনতিকে দেখেই মুগ্ধ। বিয়ের কথা যখন চলছে, হাতে মাত্র মাসখানেক সময়, তখন রৌরকেলায় ফিরে বিয়ের জন্যে ছুটি আর টাকা-পয়সার ব্যবস্থা করতে গেলাম। সেখানে গিয়ে শুনলাম অতসী সেই ইঞ্জিনিয়ার ছোকরার কাছে ঘা খেয়েছে। আবার মধ্যরাত্রে আমাদের সেই পুরোনো অভিসার শুরু হল। অতসী আবদার করল, বিয়ে ভেঙে দিতে হবে। আমি অতসীর আকর্ষণে তখন এমন মুগ্ধ যে, কলকাতায় ফিরে এলাম মাকে-বাবাকে সমস্ত ব্যাপারটা খুলে বলবার জন্যে।

ফিরে এসে শুনলাম, কনের বাড়িতে নাকি আমার নামে যা-তা বদনাম দিয়ে চিঠি এসেছে। আমার নাকি চরিত্র খারাপ। অতসী বলে একটি মেয়ের সঙ্গে আমার প্রেম আছে। এইসব চিঠি পড়ে কনের দরিদ্র মামা পর্যন্ত বিয়ে ভেঙে দিতে চান। কিন্তু বিয়ে ভাঙতে চায় না স্বয়ং মেয়ে।

আরও শুনলাম, মেয়েটি নাকি বলেছে, আমিই তার জন্ম-জন্মান্তরের স্বামী। আমার সঙ্গে নাকি তার গাঁটছড়া বাঁধাই আছে। তা ছাড়া, সে আমার সঙ্গে দেখা করতে চায়।

আমি তার সঙ্গে সত্যিই একদিন দেখা করলাম। মনে আছে, ভিক্টোরিয়ায়। দুপুরবেলা।

অনিল চৌধুরী পাশের বোতল থেকে আর-একটু মেডিকেটেড ডোজ নিজের গ্লাসে ঢেলে নিলেন। বেয়ারা করিডোরের আলো নিভিয়ে দিল। অনিল চৌধুরীর পাশে শুধু একটি শেড দেওয়া দাঁড়ানো আলো জ্বলছে, আর বিদ্যুতের রুম-হিটারের লাল কয়েলের আগুন ছাড়া ঘরে আবছা অন্ধকার। অনিল চৌধুরী দেখতে পাচ্ছিলেন না, তাঁর পেছনের দরজার পরদা ঈষৎ তুলে দাঁড়ালেন একজন বয়স্কা মহিলা। মাথার চুল কাঁচা-পাকা। চওড়া শতরঞ্জ-পাড় ধনেখালি শাড়ি ঘরোয়া করে পরা। চিবুকে আঁচিল। মাথায় ঘোমটা টানা। খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে-থেকে আস্তে পেছনে সরে গেলেন মহিলা। এঁকে খাবার টেবিলে তো দেখিনি! কে ইনি? বোধহয় ছোঁয়াছুঁয়ি করেন না। তাই টেবিলে খাননি। অনিলের মা-ই হবেন হয়তো। আমরা আবার অনিলের কথায় মনোযোগ দিলাম।

অনিল বলছিলেন, মিনতির মামা বিয়ে ভেঙে দিতে চাচ্ছেন। কিন্তু মিনতি চলে তার মায়ের কথায়। আমি অবাক হয়ে জিগ্যেস করেছিলাম, শুনেছি আপনার মা নেই?

মিনতি অদ্ভুত হেসে বলেছিল, তার মা না থেকেও আছেন। তার বিপদে-আপদে নাকি তার মা ঠিক আসেন। তার সমস্যার সমাধান করে দেন তিনি। সেই মা নাকি তাকে বলেছেন, আমি নাকি তার জন্ম-জন্মান্তরের স্বামী।

আমাকে রৌরকেলার পোস্টাল ছাপ লাগানো উড়োচিঠিটাও দেখাল মিনতি। বলাই বাহুল্য, হাতের লেখাটা অতসীর। তার মধ্যে ঘৃণিত অভিযোগ করা হয়েছে। শুধু পরকীয়াই নয়, আমি নাকি আমার স্ত্রী রুচিকেও হত্যা করেছি। এই কথাটাই অতসীকে চিনিয়ে দিল। বুঝলাম, অতসী আমার কতদূর ক্ষতি করতে পারে। মিনতি হেসে বলেছিল, মামা বলছিলেন, চিঠিটা পুলিশের হাতে তুলে দিতে। আমি মামাকে বারণ করলাম। বললাম, ভদ্রলোক বিপদে পড়ে যাবেন শুধু-শুধু। আমি বিশ্বাস করি না যে, রুচিকে উনি খুন করেছেন। আমি এত সব শোনার পর মিনতিকে বিয়ে না করে আর পারলাম না।

বিয়ের পর মিনতিকে নিয়ে রৌরকেলায় ফিরে গেলাম। শুনলাম, অতসী রাগে দুঃখে তার মাসির বাড়ি জব্বলপুরে চলে গেছে। আসলে সেখানেও সে শিকার ধরতেই গিয়েছিল। মাসির এক কচি পাইলট দেওরকে। এবং যথানিয়মে আবার সেখান থেকেও আনসাকসেসফুল হয়ে ফিরে এল।

এবারও মাঝের দরজা খুলে রাতে চলে আসতে আরম্ভ করল অতসী।

আমি দু-চারদিন নিজেকে সামলালেও, আর পারলাম না শেষের দিকে।

অতসী সম্বন্ধে যে কী ভয়ানক দুর্বলতা ছিল আমার!

মিনতির ঘুম ছিল খুব গভীর। ভাগ্যিস গভীর ঘুম ছিল। না হলে পাশের ঘরে আলো নিভিয়ে অন্ধকারে আমাদের কথোপকথন, নড়াচড়া, সে ঠিক রুচির মতোই টের পেয়ে যেত।

একদিন মিনতি বলল, অতসীর সঙ্গে তার খুব ভাব হয়ে গেছে। ভারী ভালো মেয়ে অতসী। উড়োচিঠি নিয়েও খুব আলোচনা হয়েছে দুজনের। মিনতির দৃঢ় বিশ্বাস, আমাদের কোনও শত্রুই এইসব মিথ্যে বদনাম রটিয়েছে। এমন মিষ্টি মেয়ে অতসী, সে কি এসব খারাপ কাজ করতে পারে? অতসীর সঙ্গে ওর এত ভাব হয়েছে যে, ওর মায়ের ছবি, বাপের বাড়ির অ্যালবাম, সব দেখিয়ে দিয়েছে অতসীকে। সেদিন রাতেই আমি আর অতসী প্রথম মিনতির মাকে দেখি। আমরা কথা বলছি, বাইরের ঘরে অন্ধকারে। মহিলার আবছায়া মূর্তিটা ঘরে এসে দাঁড়াল। চোখ দুটো, বিশ্বাস কর অনুপম, ধকধক করে জ্বলছে।

আমি আর্তস্বরে ‘কে? কে?’ বলে চিৎকার করে উঠলাম। অতসী ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাল। মহিলাও অদৃশ্য হলেন। আমি ঘরে এসে দেখলাম, মিনতি বিছানায় মুড়িসুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছে। তাকে আর বিরক্ত না করে বাথরুম, রান্নাঘর, বক্সরুম চারিদিক খুঁজলাম। নাঃ, সেরকম চেহারার কেন, কোনওরকম মহিলাই সারা ফ্ল্যাটের কোথাও নেই। আমার গা-ছমছম করে উঠল। ফিরে গিয়ে মিনতিকে ডাকলাম।

ধড়মড় করে ঘুম-চোখে উঠে বসল মিনতি। ওর পবিত্র মুখখানি দেখে আমি যেন মরমে মরে গেলাম।

লজ্জায় অপমানে নিজেই নিজের মধ্যে গুটিয়ে গিয়ে বললাম, মিনতি, তোমার মা কেমন দেখতে ছিলেন?

মিনতি উঠে ওদের ফ্যামিলি অ্যালবামটা পেড়ে নিয়ে এসে ওর মায়ের ছবি দেখাল।

আমি চমকে উঠলাম। অবিকল ওই মহিলাকে দেখেছি আমরা। আমি আর অতসী।

মিনতি বিহ্বল স্বরে আমাকে বলল, জানো, আজ রাতে মা স্বপ্নে এসেছিলেন। বললেন, রুচিকে যে মেরেছে, আমি তাকে ছাড়ব না। আমিও তাকে মারব। মা বললেন, রুচির অতৃপ্ত আত্মা নাকি আমাদের এই বাড়িতে ঘুরে-ঘুরে বেড়াচ্ছে।

বিশ্বাস কর, অনুপম, আমি আত্মা অলৌকিক এসব কিছুতেই বিশ্বাস করতাম না। ভয়ে আমার শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল।

পরদিন রাতে অতসীর চিৎকারে আমাদের দু-বাড়ির সকলের ঘুম ভেঙে যায়। অতসীকে পাওয়া গেল দু-বাড়ির মাঝের দরজার কাছে।

বোধহয় সে রাতের অভিসারে আসছিল। তার ঘাড় ভাঙা। দু-চোখে বিস্ফারিত ভয়।

হাসপাতালে খুব অল্প সময়ের জন্যে অতসীর জ্ঞান হয়। তখন সে শুধু মিনতির দিকে তাকিয়ে বলেছিল, বউদি, তোমার মা। তোমার মা।

মিনতির এত নরম মন যে, ওই অতসীর জন্যেও কেঁদে-কেঁদে চোখ ফুলিয়েছে কতদিন।

তারপর আমরা বদলি হলাম কলকাতায়। কলকাতায় এসে চাকরি বদল করে এই দার্জিলিঙে। এই যে দেখছিস বড় চাকরি, এই পরিবর্তিত জীবন, এসবই ভাই, ওই বউ-ভাগ্যে!

অনুপম বলল, আচ্ছা অনিল, বউদির মায়ের চেহারা ঠিক কেমন ছিল বল তো?

কাঁচা-পাকা চুল, চিবুকে আঁচিল, অনেকটা মিনতির মুখের ছায়া আছে। যখন দেখা যায়, তখন পরনে থাকে শতরঞ্জ-পাড় শাড়ি সাধারণভাবে পরা। অতসীর মৃত্যুর পর একবছর চলে গেছে, এখনও ক্বচিৎ-কখনও তাঁকে দেখা যায়। আমাদের এই দার্জিলিঙের বাড়িতেও দেখেছি।

অনুপম লাফিয়ে উঠে বলল, মিনতির মায়ের কোনও ছবি দেখাতে পারিস আমায়?

কেন পারব না, এই তো।

কফি-টেবিলের তলার তাকে গোছকরা অ্যালবাম থেকে একটা পুরোনো অ্যালবাম বেছে নিয়ে তার একটা পাতা খুলে ধরলেন অনিল চৌধুরী।

এই তো!

আমি আর অনুপম ঝুঁকে পড়ে দেখে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম।

বোঝা গেল, একটু আগেই আমরা দুজনে এঁকে দেখেছি।

হঠাৎ অনুপম অনিল চৌধুরীকে বলল, বউদির কোষ্ঠী আছে?

না!

এক্ষুনি হাত দেখতে পারি?

দেখিস, তাড়া কীসের?

না, দেখলে এখুনি দেখতে চাই, আর একটি শর্তে। বউদির হাত আমি একা দেখব। তুমি বা অসিত কেউ থাকতে পারবে না সে-ঘরে!

অনিল চৌধুরী খুব কৌতূহলী হয়ে উঠে দাঁড়ালেন।

আমি বাধা দিয়ে বললাম, আজ থাক না!

না।

অনুপমের শরীরে যেন কীসের ভর হয়েছে। সে বলল, ব্যাপারটা জরুরি, তোকে পরে বলব অনিল। বুঝছিস না, ভালো হোক খারাপ হোক, মেয়ের মায়ায় বদ্ধ হয়ে একটি আত্মার এভাবে বারবার দেখা দেওয়াও তো ঠিক নয়। তোদের ক্ষতি হতে পারে।

অনিল চৌধুরী উঠে দাঁড়ালেন।

বললেন, বেশ, তোর শর্ত মেনে নিচ্ছি, আমি ওপরে যাচ্ছি। মিনতিকে পাঠিয়ে দিচ্ছি, কিন্তু তুমি আমার সব কৌতূহল মেটাবে কাল সকালে।

আমিও উঠে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম। অনুপম আমাকে জোর করে বসাল।

থাক না, যাচ্ছিস কোথায়? অনিল ওপরে উঠে গেছে। ও তো আর দেখতে আসছে না, তুই আছিস কি নেই?

অল্পক্ষণ পরে মিনতি চৌধুরী এলেন। সাদা শাড়ির ওপর সাদা শাল জড়ানো। চুল এলো করা। মুখে ঘন করে ক্রিম মেখেছেন। চোখে ঘুমের ছোঁয়া।

আপনি হাত দেখতে পারেন, অনুপমবাবু! —চোখ-দুটি হেসে উঠল মিনতির।

অনুপম বলল, পারি, কিন্তু এখন আপনার হাত দেখব না, আপনার মায়ের ছবি দেখব।

অবাক হয়ে মিনতি চৌধুরী সামনের অ্যালবামটা খুলে ওঁর মায়ের ছবি দেখালেন।

অনুপম ভালো করে ছবিটা দেখে বলল, এটা আপনার মায়ের ছবি নয়।

মিনতি এবার চমকে সাদা হয়ে গেলেন।

মানে?

আপনার সঙ্গে আপনার মায়ের মুখের সাদৃশ্য থাকতে পারে, কিন্তু আপনার হাতের যেখানে কাটা দাগ, আপনার মায়ের ঠিক সেখানে কাটা দাগ থাকে কী করে?

আমি এবার চোখ নামিয়ে দেখলাম, আশ্চর্য! মিনতি চৌধুরীর কনুই-এর কাছে যে-দাগটা জ্বলজ্বল করছে, সেটা ওঁর মায়ের ছবির কনুইতেও আছে।

আঠা দিয়ে সাঁটা ছবিটা চড়চড় করে ছিঁড়ে ফেলল অনুপম।

এই অ্যালবামের সব ছবি কর্নার লাগিয়ে বসানো। শুধু এই একটি ছবি আঠা দিয়ে সাঁটা কেন, মিসেস চৌধুরী? এইজন্যে কী? আপনার ভাগ্য খুব ভালো যে, অনিল এটা খেয়াল করেনি। এ-ছবি আর এই অ্যালবামে রাখা উচিত নয়। ছবির উলটো পিঠে আবছা অক্ষরের যেটুকু ছেঁড়া-ছেঁড়া কাগজের আঁশ থেকে উদ্ধার করা গেল, তাতে লেখা, স্নেহময়ীর রূপসজ্জায় মিনতি রায়।

অনুপম বলল, আপনি যে এককালে অ্যামেচার থিয়েটারে অভিনয় করতেন, মিসেস চৌধুরী, সে আমি শুনেছি অনিলের কাছে। যে জন্যে মায়ের রূপসজ্জা সে-কাজ তো হয়ে গেছে, এখন আর কেন? তা ছাড়া, আপনার মা মারা গেছেন আপনার অল্পবয়েসে। তখন কি তাঁর পাকা চুল আর বয়স্ক চেহারা হয়েছিল?

মিনতি চৌধুরী মুখ নামিয়ে নিলেন।

না, শুধু ছবিটা নয়—ওই শাড়ি, পরচুলা, আঁচিলটা পর্যন্ত নষ্ট করে ফেলতে হবে। আর রিস্ক নেওয়া উচিত নয়। কবে অনিল দেখে ফেলবে, সব বুঝতে পারবে, তার ঠিক আছে?

অনুপম আর আমি দেখলাম, মিনতি চৌধুরীর চোখ ছেপে জল পড়ছে।

অনুপম বলল, আপনাকে দেখবার আগেই আমি জানি, আপনি কাউকে হত্যা করেছেন। সে অতসী, তাই না?

মিনতি মাথা নোয়াল।

মায়ের গল্পটা বানালেন কেন?

চাপা গলায় মিনতি বললেন, উপায় ছিল না। মামা আমাকে ক্রমাগত কুপথে ঠেলছিলেন। আমার তখন একটা বিয়ে করে সরে যাওয়া জরুরি ছিল।

আপনি রৌরকেলায় গিয়ে সব বুঝতে পেরেছিলেন?

পারব না? —মিনতি চৌধুরী অদ্ভুত হাসলেন আমার ঘুম ছিল পাতলা, অবশ্য অভিনয় করতাম যেন গাঢ় ঘুমে অজ্ঞান হয়ে আছি। আমি সব দেখেছি। সব শুনেছি। আর রাগে, ঘৃণায় শুধু জ্বলেছি আর জ্বলেছি।

অতসীকে মারলেন কী করে?

ওকে মায়ের ওই ছবি দেখিয়েছিলাম। মাঝে-মাঝে মায়ের দেখা দেওয়ার কথা গল্প করেছিলাম। একদিন দেখাও দিয়েছিলাম ওই বেশে। আর শেষদিন, চুলের মুঠি ধরে ওকে আছড়ে ফেলে দিই।

কথাটা শুনে অনুপমের কোনওরকম ভাব-বৈকল্য দেখলাম না। কিন্তু আমার সারাটা শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল।

অনুপম এবার মিনতি চৌধুরীর হাতখানি হাতে তুলে নিয়ে ভালো করে দেখে বলল, সত্যি বলছি, আপনি সাক্ষাৎ লক্ষ্মী, সাধ্বী, কল্যাণী। কৃতী সন্তানের জননী হবেন আপনি। পুরোনো সব কথা ভুলে যান—সব প্রেত আর ছায়ামূর্তির কথা। অনিল জিগ্যেস করলে বলবেন, আপনার মায়ের ছবি অ্যালবাম থেকে আমি ছিঁড়ে ফেলেছি। ছদ্মবেশ আর পরচুলার প্যাকেটটা আজ রাতেই আমাকে দিয়ে দেবেন। আমি কলকাতায় নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে ফেলব। যান, শুতে যান এবার। আমি আর আপনাকে মিসেস চৌধুরী বলব না। বউদি বলব।

এতক্ষণে মিষ্টি একটি হাসি ফুটল মিনতি চৌধুরীর মুখে। রাহুমুক্ত কণ্ঠে তিনি বললেন, প্যাকেটটা গেস্টরুমের দেরাজের নীচের তলায় রাখা আছে। আজকের রূপসজ্জার পর তাড়াহুড়োয় বেশি দূরে সরিয়ে রাখতে পারিনি।

তারপর আমাদের নমস্কার করে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

ক্রাইম

পুজো সংখ্যা, ১৯৭৩

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *