হাতের প্যাঁচ
ছোটো, মাঝারি, বড়ো, কী গল্প আপনি চান বলুন, পেশাদার কলম ঠিক নামিয়ে দেবে। কত স্লিপ? আজকাল তো আর সাহিত্য নেই, আছে স্লিপ। সম্পাদক মহাশয়রা আজকাল আর লেখা চান না। লেখা আজকাল আবার একসঙ্গে আসে না। বড়ো বড়ো লেখকরা স্লিপ দিতে থাকে। সম্পাদক মহাশয়রা প্রশ্ন করেন, ‘কাল ক’ স্লিপ দিচ্ছেন! অন্তত পাঁচ স্লিপ দিন।’ সাহিত্যের জগতে আর ফল-পাকড়ের জগতে বিপ্লব ঘটে গেছে। আগে আম বিক্রি হত টাকায় পাঁচটা হিসেবে। এখন পনেরো টাকা কিলো। লিচু বিক্রি হত শ’ দরে। লিচুরও এখন কিলো। যুগ পালটে গেছে।
আমি একটা বড়ো গল্প লেখার বায়না পেয়েছি। চল্লিশ স্লিপ। তার কম বা বেশি নয়। সেদিন সরকারি অফিসে লিফটে উঠেছিলুম। দেখি লেখা রয়েছে সিকস্টিন পার্সনস। প্রশ্ন জাগল, হাতির মতো চেহারার ষোলোজন উঠলে কী হবে! নির্দেশ অনুসারে তো ষোলোজনই হল। চল্লিশ স্লিপে যদি চল্লিশ হাজার শব্দ হয়ে যায়! সে তো তাহলে উপন্যাসই হয়ে গেল।
বড়ো গল্প কাকে বলে আমি জানি না। ছোটো গল্পকে টেনে বাড়ালেই মনে হয় বড়ো গল্প হয়। আউর থোড়া হেঁইয়ো, বড়ো গল্প হয়। উপন্যাস-উপন্যাস একটা ভাব থাকবে। যেমন শীত-শীত ভাব। ছুঁচো আর হাতি। ছুঁচো দেখে এক পন্ডিত বলেছিলেন, এ হল রাজার হাতি, না খেয়ে খেয়ে এইরকম হয়ে গেছে। আর হাতি দেখে বলেছিলেন, এ ব্যাটা রাজার ছুঁচো, খেয়ে খেয়ে অমন হয়েছে। ছোটো গল্প আর বড়ো গল্প একই ব্যাপার।
কী গল্প লেখা হবে? প্রেমের গল্প! বিছিন্নতার গল্প। হতাশার গল্প! রাজনৈতিক গল্প! নাকি ভূতের গল্প! প্রেমের গল্পই চেষ্টা করা যাক। গল্প আর রান্না একেবারে একজিনিস। নানা উপাদান। নানা মশলা। তারপর আগুনে চাপিয়ে নাড়াচাড়া। যাকে বলে হেলুনি মারা। বা কষা। মাংস যত কষবে ততই তার প্রাণমাতানো গন্ধ বেরোবে। এক এক রান্নার এক এক উপাদান। প্রেমের গল্পের প্রধান উপাদান হল, একজন প্রেমিক আর একজন প্রেমিকা। যেমন ডিমের কারির প্রধান উপাদান হল, ডিম আর পেঁয়াজ। মাংসের কালিয়ার প্রধান উপাদান হল, মাংস আর আলু।
একজন প্রেমিক আর একজন প্রেমিকা। যেন আলু আর পটল ভাসছে জলে। জল হল সমাজ। এরপর মশলা চাই। তেল চাই, নুন চাই। তা না হলে, তরকারি না হয়ে, হয়ে যাবে আলু সেদ্ধ, পটল সেদ্ধ। শুধু প্রেমিক-প্রেমিকাকে নিয়ে কত দূর যাওয়া যায়। কত কথাই বা বলানো যায়। মিতালি, আমি তোমাকে ভালোবাসি। সোমেন, আমি তোমাকে ভালোবাসি। এ ভাবে বেশিক্ষণ চালানো যায় না। তা ছাড়া একালের প্রেমে ভালোবাসা শব্দটাই উচ্চারিত হয় না। ন্যাকা ন্যাকা শোনায়। অ্যাকশানের যুগ। ধর তক্তা, মার পেরেকের যুগ। মধ্যযুগের প্রেমে অনেক হিলি হিলি, বিলি বিলি কান্ড হত। পাতার পর পাতা কবিতা। ফুল। কোকিলের ডাক। চাঁদ। সরোবর। বাতাস। দীর্ঘশ্বাস। মধ্যযুগের প্রেমে বিরহের ভাগ ছিল বেশি। কারণ তখন ফ্রি মিকসিং ছিল না। প্রেমিক আর প্রেমিকায় মুখোমুখি দেখা হওয়ার উপায় ছিল না। বারান্দায় প্রেমিকা, ল্যাম্পপোস্টের তলায় প্রেমিক। যমুনায় জল ভরতে চলেছেন প্রেমিকা, গাছের ডালে পা ঝুলিয়ে বাঁশি বাজাচ্ছেন প্রেমিক। নিশি জাগছেন রাই, কবি গাইছেন, তুমি যার আসার আশায় আছো, তার আসার আশা নাই। নট-ঘট শ্যামরায় চলিল আজ মথুরায়। প্রেমের এই ফোঁসফোঁসানি একালে অচল। দেহাতীত প্রেম কেউ বিশ্বাস করবে না। সমালোচকরা তুলো ধুনে দেবেন। প্রেমের সঙ্গে সেক্স চাই-ই চাই। রূপ বর্ণনায় এখন কবিতাও হয় না। গদ্য-সাহিত্য তো দূরের কথা। ‘চুল তার কবেকার’—একটা সময় পর্যন্ত বেশ ছিল। এখন খোলাখুলির যুগ। একালের সিনেমায় জোড়া ঠোঁটের মাঝখানে আর যোজন তিনেকের ব্যবধান থাকে না। চুম্বক আর লোহা-সম কাছাকাছি হওয়ামাত্রই টানাটানি, জোড়াজুড়ি।
আমার উপাদান আমি গুছিয়ে ফেলি। বেকার প্রেমিক, বেকার প্রেমিকা। প্রেমিকের পিতার কারখানায় চলছে লাগাতার ধর্মঘট। মা বাতের রুগি। যত না কাজ করেন, কোঁত পাড়েন তার চেয়ে বেশি। আর সূর্য ওঠা থেকে, মশারিতে ঢোকা পর্যন্ত ঝগড়া করেন প্রাণ খুলে। প্রেমিকের একজন অবিবাহিতা বোন থাকবে। যুবতী। ম্যাগনাম স্বাস্থ্যের অধিকারী। পথে বেরোনোমাত্রই দশ-বিশটা নানা চেহারার, নানা পোশাকের ছেলে পেছন পেছন চলতে থাকে। লেজের বদলে রুমাল নাড়ে। প্রেমিক ভাড়া থাকবে দু কামরার একটি বাড়িতে। একটি ঘর বড়ো। একটি ঘর ছোটো। বাথরুম কমন। সব লেখকই আশা করেন, তাঁর গল্প নিয়ে সিনেমা হোক। কোন ভালো পরিচালকের হাতে পড়ুক। কাহিনীটিকে প্রথম থেকেই সেই কারণে ক্যামেরার চোখে দেখতে হবে। সিনেরিয়ো করতে করতে এগোতে হবে। সামান্য বাম-বাম ভাব থাকা চাই। ক্যাপিট্যালিস্ট প্রেম নিয়ে হিন্দি বাণিজ্যেক ছায়াছবি হতে পারে। তাতে পয়সা আছে, সম্মান নেই।
আমার এই কাহিনি যখন মুভি-ক্যামেরা ধরবে, তখন শুরুর শটটা হবে এইরকম :
ধোঁয়া। ভলকে ভলকে ধোঁয়া। আকাশে উঠে এলো চুলের মতো খুলে খুলে যাচ্ছে! নরম ধোঁয়া। মধ্যবিত্ত ধোঁয়া। মারোয়াড়ির বেআইনি গুদামে আগুন-লাগা ধোঁয়া নয়। কয়েক জোড়া উনুনের ধোঁয়া একসঙ্গে আকাশে উঠছে! সেই আকাশে উড়ছে বাবু-কলকাতার পায়রা। পায়রা ছাড়া ভালো ছবি হয় না। পায়রা হল প্রতীক। ভালোভাবে লাগদাই করে লাগাতে পারলে একটা কেলেঙ্কারি কান্ড হয়ে যায়। পায়রা দিয়ে মৃত্যু খুব সুন্দর বোঝানো যায়। সিনেমার মৃত্যু বড়ো হাস্যকর। না মরলে মরা কেমন করে মরার মতো হবে? সব কিছুর অভিনয় সম্ভব, মৃত্যুর অভিনয় অসম্ভব। অভিনেতাদের কাছে মৃত্যু একটা কঠিন সাবজেক্ট। মরছি না, অথচ মরতে হচ্ছে। ক্যামেরা সরে গেলেই উঠে বসে, কই রে সিগারেট নিয়ে আয়, নিয়ে আর জোড়া ওমলেট, ডবল হাফ চা। যে মৃত্যুর পর মানুষকে শ্মশানে গিয়ে চিতায় শুতে হয়, এ মৃত্যু নয়। এ হল গিয়ে পরিচালকের নির্দেশিত মৃত্যু। ক-জন আর মৃত্যুকে সেভাবে দেখার সুযোগ পান। মৃত্যু ঘটে নিভৃতে একান্তে। মৃত্যু মানুষের বড়ো ব্যক্তিগত ব্যাপার। একান্ত আপনজন শিয়রে বসে থেকেও বুঝতে পারে না, মানুষটা কখন কিভাবে হঠাৎ চলে গেল, তার দেহ-জামাজোড়া ছেড়ে। সেই শ্বাসকষ্ট, সামান্য এক চিলতে বাতাসের জন্যে ভেতরের আকুলি-বিকুলি। দুটো চোখের ঠেলে বেরিয়ে আসা। চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে ঊর্ধ্বনেত্র হলেই কী আর মৃত্যু হল। সেই কারণে সিনেমার মৃত্যু সব একই ধরনের। মাথাটা বালিশ থেকে উঠতে উঠতে ধপাস করে পড়ে গেল। সঙ্গেসঙ্গে আবহ সংগীত। বেহালায় প্যাথসের টান। ক্যামেরা ক্লোজ-আপে অভিনেতার মুখ ধরছে। অভিনেতার তখন অগ্নিপরীক্ষা। তারস্বরে চিৎকার—‘চোখের পাতা পিটপিট করে না যেন, ড্যাবাড্যাবা ঊর্ধ্বনেত্র।’ এই একটা শটই যে কতবার রি-টেক করতে হয়। কখনো পাতা পড়ে যায়, কখনো ড্যাবা কমে আসে, কখনো মৃতের চোখে জল এসে পড়ে। সেই কারণে মৃত্যুর আজকাল একটা পেটেন্ট চেহারা হয়েছে সিনেমার পর্দায়। সেকেণ্ড-গ্রেড পরিচালকরা তার বাইরে আসতে পারছেন না। প্রথম সারির পরিচালকরা মৃত্যুকে নিয়ে গেছেন আর্টের পর্যায়ে। তাঁরা করেন কী, ক্যামেরাকে ক্লোজ-আপে এনে মৃত্যু-পথ-যাত্রীর মুখটা ধরেন। ছটফট ছটফট, বালিশে মাথা চালাচালি। দু-হাত কোনোরকমে ওপরে তুলে কারোকে ধরার বা খোঁজার চেষ্টা। অস্ফুটে কারোর নাম ধরে ডাকা, ‘সুধা! সুধা!’ তারপর একপাশে ঘাড় কাত করে এলিয়ে পড়া। কাট। পরের শট ফড়ফড়, ফড়ফড়, এক ঝাঁক পায়রা যেন কারোর তাড়া খেয়ে আকাশে উড়ে গিয়ে, বিশাল বৃত্ত রচনা করে উড়তে লাগল। এরপর এক রাউণ্ড আন্তরিক কান্না। কান্নার দৃশ্যে আমাদের অভিনেত্রীদের কোনো জুড়ি নেই। একেবারে ফাটিয়ে দিতে পারেন। যাকে বলে কেঁদে মাত করা। অনেক পরিচালক আবার রেলগাড়ির সাহায্য নেন। সিটি বজিয়ে হু-হু করে ট্রেন চলে গেল দূর থেকে দূরে। বুক কাঁপিয়ে। লোহার রেলে চাকার শব্দ। মন হু-হু করানো সিটি। সব মিলিয়ে এমন একটা এফেক্ট। আত্মা রেলে চেপে পরবাস থেকে চলেছে স্ববাসে। পায়রা দিয়ে জমিদারের লাম্পট্য বোঝানো যায়। চকমেলানো বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে পায়রাদের দানা খাওয়াতে খাওয়াতে বয়স্যকে বলছে, ওই অমুকের স্ত্রীকে তাহলে আজ রাতেই তোলার ব্যবস্থা করো। আবার জোতদারের অত্যাচার বোঝবার জন্যে বেড়াল আর পায়রা একসঙ্গে ব্যবহার করা হয়। বাড়ির চালে লাউ ফলে আছে। তার আড়াল থেকে গুটি গুটি বেরিয়ে আসছে পাঁশুটে রঙের একটা বেড়াল ইয়া এক হুলো। আর অদূরে নিশ্চিন্ত মনে ঠোঁট দিয়ে ডানা পরিষ্কার করছে নিরীহ এক পায়রা। দর্শকের আসনে বসে আতঙ্কে আমাদের শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। মানুষের সামগ্রিক নিপীড়ন বোঝাতে ক্রুশবিদ্ধ যিশু তো হামেশাই পর্দায় আসেন।
এখন হল প্রতীকের যুগ। লোগোর যুগ। অলিম্পিক, এশিয়ান গেমস, এক একবার এক একরকম লোগো। কোনোবার হাতি। কোনোবার ভাল্লুক। কোনোবার গোল গোল চাকা। তা আমার কাহিনির চিত্ররূপে প্রথমেই থাকবে পর্দাজোড়া নরম, মিষ্টি ধোঁয়া। তার উপর দুলতে থাকবে টাইটেল। আবহ হিসেবে ব্যবহৃত হবে দমকা কাশির শব্দ, কাকের কর্কশ চিৎকার। ব্যাটারি ডাউন গাড়ির বারে বারে স্টার্ট নেবার চেষ্টায় সেলফ মারার শব্দ। দুপক্ষের কদর্য ঝগড়ার অস্পষ্ট আওয়াজ। বেতারে প্রভাতী সংগীত। কলতলায় বাসন ফেলার আচমকা শব্দ। কোনো যন্ত্র ব্যবহার করা হবে না। স্রেফ শব্দ। বাজারের কোলাহল। কলের বাঁশি। সব মিলিয়ে তৈরি হবে টাইটেল মিউজিক। আজকাল বিদেশি বইতে এই কায়দাই চলেছে।
এইবার ক্যামেরা ছাদের ভাঙা আলসে বেয়ে, বারান্দার ভাঙা রেলিং বেয়ে নেমে আসবে, শ্যাওলা ধরা চৌকো উঠোনে। ক্লোজ আপে তিনটে তোলা উনুন। এই ভাঙা সাবেক বাড়িতে তিনটি পরিবার বাস করে। এখন সমস্যা হল বাড়ি তৈরির মতো গল্পটাকে আমি কীভাবে খাড়া করব। কুস্তির মতো গল্প লেখারও দুটো ধরন আছে—একটা হল ফ্রি স্টাইল। অর্থাৎ শুরু করে দাও, তারপরে যেখানে যায় যাক। লিখতে লিখতে ভাব, ভাবতে ভাবতে লেখো। শেষ পর্যন্ত গল্পের চরিত্ররাই লেখকের গলায় দড়ি বেঁধে হিড় হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে যায়। দিল্লিতে এক বিখ্যাত নামি লেখক বসবাস করতেন। খুব সাহেবি ভাবাপন্ন। তাঁর একটা বিশাল বড়ো অ্যালসেশিয়ান কুকুর ছিল। রোজ সকালে সেই দুর্বল বুদ্ধিজীবী তাঁর সবল কুকুরটিকে নিয়ে প্রাতঃভ্রমণে বেরোতেন। প্রায়ই দেখা যেত, ব্যাপারটা উলটে গেছে। কুকুরই বাবুকে নিয়ে বেড়াচ্ছে। টানতে টানতে যেদিকে নিয়ে যাচ্ছে, সেই দিকেই যেতে হচ্ছে। চরিত্র নিয়ে লেখক বেড়াতে বেরিয়েছে, শেষে চরিত্ররাই লেখককে টানতে থাকে।
আর একটা হল কুস্তি। নিয়ম মেনে। প্রথা মেনে। কম্পোজ করে। স্টাইল রেস্টলিং। প্ল্যান করে লেখা। কার সঙ্গে কী হবে। গল্পর কাঠামোটা পুরো ভেবে নিয়ে খড় বেঁধে মাটি চড়িয়ে যাও। সাহিত্যে আমরা যাকে গল্প বলি সিনেমায় সেইটাকেই বলে স্টোরি। আমার এই স্টোরি ফ্রি-স্টাইলেই চলুক। আঁতেল গল্প সেইভাবেই এগোয়। আমার যখন যা মনে হবে, তাই নামিয়ে যাব, তারপর ফিনিশ করে, মেজে-ঘষে ছেড়ে দোবো। যেমন এখন আমার মনে হচ্ছে, গল্পের প্রেমিক, প্রেমিকা এই একই বাড়িতে বসবাস করবে। একটা তোলা উনুন প্রেমিক-পরিবারের, আর একটা তোলা উনুন প্রেমিকা-পরিবারের। এই দুটো উনুনই জীবনের প্রতীক। জীবন জ্বলছে গুমরে গুমরে। যত না পুড়ছে তার চেয়ে বেশি ধোঁয়া ছাড়ছে। এইবার তৃতীয় উনুনটি কার! তৃতীয় উনুনটা অবশ্যই আর একটি পরিবারের, কিন্তু এই কাহিনিতে সেই পরিবারটির কী ভূমিকা হবে?
এই পরিবারটিকেই আগে প্রতিষ্ঠিত করা যাক। বড়ো বড়ো সাহিত্যিক আর বাঘা বাঘা সমালোচক ও সমালোচিকাদের সঙ্গে সামান্য মেলামেশা করে একটা কথা শিখেছি চরিত্রকে, ঘটনাকে ‘এশট্যাবলিস’ করা। আধ্যাত্মিক জগতের ভাষায় বলে প্রাণ প্রতিষ্ঠা। মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা। প্রথমত, চরিত্রকে এমনভাবে আঁকতে হবে, যেন বইয়ের পাতা থেকে তার শ্বাসপ্রশ্বাস আমাদের গায়ে এসে লাগে। যেন চিমটি কাটলে উঃ করে ওঠে। জনৈক প্রখ্যাত প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিককে প্রশ্ন করেছিলুম, আপনার একটি চরিত্র আর একটি চরিত্রকে বলবে, ‘সুধা, আমার ভীষণ মাথা ধরেছে।’ তা সেই কথাটা বলে ফেললেই হয়; তা না, সুধাময় আসছে রাস্তার একপাশ দিয়ে। কেন একপাশ দিয়ে আসছে, প্রায় এক প্যারা জুড়ে তার ব্যাখ্যা। সুধাময় সাবধানী। তার পিতাও খুব সাবধানী ছিলেন। সুধাময়ের এক বন্ধু, বড়োদিনে পার্ক স্ট্রিটে কথা বলতে বলতে হাঁটতে হাঁটতে অন্যমনস্ক হয়ে পাশে সরে যাওয়ার সঙ্গেসঙ্গেই রানওভার হয়ে গিয়েছিল। সে-দৃশ্য সুধাময় আজও ভুলতে পারেনি। রক্তাক্ত, থ্যাঁতলানো একটা দেহ। সুধাময়ের একটা প্রশ্নের পুরো জবাব সমাপ্ত করে যেতে পারেনি। সে হাসছিল। হাসতে হাসতে নিমেষে মারা গেল। ওই একটা ঘটনায় সুধাময়ের পাকাপাকিভাবে নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়ে গেছে। পেছন থেকে গাড়ির শব্দ এলেই সে লাফিয়ে পাশে সরে যায়। এত পাশে যে একবার নর্দমায় পড়ে পা ভেঙে তিন মাস বিছানায় পড়েছিল। এই ব্যাখ্যার সঙ্গেসঙ্গে সুধাময় চলতে চলতে বাড়ির দোরগোড়ায় পৌঁছে গেল। দেখলে দূর থেকে একটা হলদে ট্যাক্সি আসছে। পেছনের আসনে প্রশান্তর বোন বসে আছে। এয়ার হোস্টেস। ভীষণ অহঙ্কারী। এক সময় সুধাময়ের ছাত্রী ছিল। মেয়েটির খোঁপার দিকে সুধাময়ের দৃষ্টি চলে গেল। সে নিজেকে তিরস্কার করল। মেয়েদের খোঁপা, তাও আবার ছাত্রী, সেই খোঁপার দিকে এই বয়সে নজর চলে যাওয়া খুবই অন্যায়। ট্যাক্সিটা চলে যাবার পর সুধাময় রাস্তার দিকে তাকাল। একটা শালপাতার ঠোঙা উপুড় হয়ে পড়ে আছে। এই প্লাস্টিক আর কাগজের যুগে এই বস্তু এখনও আছে। সুধাময় নিজের সঙ্গে তুলনা করল। তার মতো মিসফিট মানুষের তুল্য এই ঠোঙা এখনও দু’একটা উপুড় হয়ে পড়ে থাকে। ঠোঙাটাকে একটা লাথি মেরে সুধাময় বেশ তৃপ্তি পেল। এইরকম একটা লাথি নিজের নিতম্বে মারতে পারলে সুধাময় খুব খুশি হত। নিজেকে নিজে লাথি মারা যায় না। এইটাই এক দুঃখ। সেই বেড়ালছানাটা একইভাবে বসে আছে দরজার বাইরে, একপাশে। বাড়ি থেকে ভোরবেলা বেরোবার সময় যে অবস্থা দেখে গিয়েছিল, ঠিক সেই একই অবস্থায় বসে আছে জড়োসড়ো হয়ে। দাঁতাল শূকরের মতো ভয়ঙ্কর এই পৃথিবীতে হঠাৎ এসে পড়ে ক্ষুদ্র এই প্রাণীটি যেন স্তম্ভিত হয়ে গেছে। সুধাময়ের খুব ইচ্ছে করছিল অসহায়, ভীত প্রাণীটিকে তুলে ভেতরে নিয়ে যায়। ভয়ে পারল না। পৃথিবীর ভয়ে নয়। ভয় সুধাকে। যেকোনো রোমশ প্রাণীর কাছাকাছি এলেই সুধার অ্যালার্জি হয়। রাতে হাঁপানির মতো হয়। নি:সঙ্গ, ভীত বেড়ালটার কথা চিন্তা করতে করতে সুধাময় দোতলায় উঠতে লাগল। সিঁড়ির প্রতিটি ধাপের আগা ভেঙে ভেঙে গেছে। মেরামত অবশ্যই করা উচিত। একটু অন্যমনস্ক হলেই পতন অবধারিত। বহুবার পড়ে যেতে যেতে বেঁচে গেছে। সারাবার সঙ্গতি নেই। সুধাময় সিঁড়িটার নাম রেখেছে সচেতনতা। সুধাময় যৌবনে কবিতা লিখত। অভ্যাসটা ধরে রাখতে পারলে কবি হিসেবে এতদিনে তার খুব নাম হত। সংসার তার এই প্রতিভাকে জাগাবার বদলে জল ঢেলে দিলে। সুধাময় বারান্দা পেরিয়ে ঘরে এল। বারান্দায় শেষ বেলায় ছায়া নেমে এসেছে। সুধা শুয়েছিল খাটে। কপালে হাত রেখে। সুধাময় সেইদিকে তাকিয়ে বললে, ‘তোমার আজও কি জ্বর আসবে?’
‘ওই একই প্রশ্ন নিয়ে, আসার আগেই, জ্বরকে বিছানার দান করব বলে, শুয়ে পড়েছি।’
‘আমি তোমাকে আগেও বলেছি, এখনও বলছি, মন থেকে জোর করে অসুখটাকে তাড়াও। তোমার একটা ম্যানিয়া এসে গেছে।’ কপাল থেকে হাত সরিয়ে সুধা করুণ চোখে সুধাময়ের দিকে তাকাল। এই ম্যানিয়া শব্দটা শুনলে তার ভেতরে একটা চাপা ক্রোধ ধিকিয়ে ওঠে। ক্ষতবিক্ষত সুধাময়ের দিকে তাকালে সেই ক্রোধ পরিণত হয় চাপা অভিমানে। দু-চোখের পাশ দিয়ে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে আসেমাত্র। তার ভেতরের জলও শুকিয়ে আসছে ক্রমশ। সুধা আধবোজা চোখে দেখতে লাগল, সুধাময় পাঞ্জাবিটা খুলে হ্যাঙারে রেখে বারান্দার চেয়ারে গিয়ে বসল। সুধাময় ঠোঁটে একটা সিগারেট লাগাল। সিগারেটের কাগজটা জড়িয়ে গেল ঠোঁটের সঙ্গে। বেশ বুঝতে পারল শরীর শুকিয়ে আসছে। সিগারেট খুলে নিতে গিয়ে অল্প একটু কাগজ ছিঁড়ে ঠোঁটেই লেগে রইল। সুধাময় দু’তিনবার থু-থু করেও কাগজটা ছাড়াতে পারল না। তখন আঙুল দিয়ে ঠোঁট পরিষ্কার করে, জিভ বুলিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে সিগারেট লাগাল। ছেঁড়া অংশ দিয়ে কয়েক কুচি তামাক জিভে এসে গেল। সিগারেট খুলে সুধাময় আবার থু থু করল।
সুধা ঘাট থেকে ক্ষীণ কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার কি আবার গা গুলোচ্ছে! আমি কিন্তু তোমাকে বারে বারে বলছি, খালি পেটে থেকো না। তোমার পুরোনো আলসার। এই সময় তুমি দয়া করে বিছানায় পড়ে যেও না। একটু কিছু মুখে দাও। কিছু না পার তো একটা বাতাসা, এক গেলাস জল।’
পর পর তিনটে দেশলাই কাঠি জ্বলল না। একটার বারুদ ঘষতে ঘষতে ক্ষয়ে গেল। একটা ভেঙে দু-টুকরো হয়ে গেল। আর একটার বারুদ খুলে জ্বলতে জ্বলতে বারান্দার বাইরে ছিটকে চলে গেল। সুধাময় অবাক হয়ে দেশলাইটার দিকে তাকাল। এইরকম তো হয় না কখনো। সুধাময় সিগারেটটা ছুড়ে ফেলে দিল বারান্দার বাইরে। ঘরে এসে ঘাটের পাশের চেয়ারে বসে পড়ল। ভুরুর মাঝখানের কপালটা দু-আঙুলে টিপে ধরে বললে, ‘সুধা, মাথাটা আজ ভীষণ ধরেছে। কপালের কাছটা একেবারে ছিঁড়ে যাচ্ছে।’
সেই প্রখ্যাত সাহিত্যিককে প্রশ্ন করেছিলুম, ‘এই একটা কথা বলাতে আপনি কত কান্ড করলেন, তাই না?’
‘তুমি একটা আকাট মুর্খ! এইটুকু বোধ তোমার এল না, একে বলে বিল্ডআপ করা। ওয়ার্মিং আপও বলা যায়। একই সঙ্গে কত কী বোঝানো হল। এইটাই হল ক্ল্যাসিক্যাল স্টাইল। টমাস মান, আঁদ্রে জিদ এই কায়দায় লিখতেন। গল্পের চরিত্রকে যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। তার ম্যানারস, ম্যানারিজম। চেহারার কোনো বর্ণনা নেই; কিন্তু যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, একহারা, সাধারণ উচ্চতার একটি লোক। এক সময় রং ফর্সা ছিল, এখন তামাটে। সামনের চুল পাতলা হয়ে এসেছে। হাতের শিরা জেগে আছে। চোখ দুটো কোটরে ঢুকে গেছে। লোকটি সামান্য পরিশ্রমেই ঘেমে যায়। চোখ দুটো কোটরগত হলেও অস্বাভাবিক উজ্জল। চেহারায় একটা আভিজাত্যের ভাব এখনও ফুটে আছে। এই সমাজে লোকটি মিসফিট হলেও, অলস নয়, সংগ্রামী।’
কত কী শেখার আছে, তাই না! আমি তৃতীয় উনুনটিকে আগে এশট্যাবলিস করি। ক্ল্যাসিক্যাল জার্মান-সাহিত্যিকদের কায়দায়। উনুন দিয়ে যেন মানুষ চেনা যায়। যেমন ছড়ি দিয়ে বাবু। দরজার পাল্লায় একটা ছড়ি ঝুলছে। লোকটির আর ঘরে ঢোকা হল না। বেরিয়ে গেল। অনেকটা পরে ফিরে এল একটা কুড়ুল নিয়ে। বউয়ের বিছানায় মহাজনের মুন্ডু খুলে পড়ে গেল। সেই রকম অ্যাশট্রেতে পোড়া সিগারেট। স্ত্রীর প্রেমিকার সিগারেট অবৈধ ধোঁয়া ছাড়ে। শ্বশুর মহাশয়ের সিগারেট ছাড়ে তিরিক্ষি ধোঁয়া। বন্ধুর সিগারেটের মজলিশি ধোঁয়া। দারোগার সিগারেটের ধোঁয়ায় রুলের গুঁতো। ছেলের বন্ধুর সিগারেটের ধোঁয়া কেয়ার ফ্রি। পিতার সিগারেটের ধোঁয়ায় চাপা আতঙ্ক, এরপর জীবনমঞ্চে কোন দৃশ্য আসছে।
তৃতীয় উনুনটা ঢালাই লোহার। মাটির উনুন ধরে মায়ের বুকের স্নেহের আগুন। এই লোহার উনুনে যেন বউ পোড়ানো আগুন। উনুনটার চেহারা যেন গেস্টাপোর মতো। সলিড লোহা। গা-টা খসখসে। ভেতরের চাপা নিষ্ঠুরতা যেন ফুস্কুড়ির মতো ফুটে উঠেছে। অন্য দুটো উনুনের চেয়ে এই উনুনের আগুন যেন বেশি লাল। প্রথম উনুনটি তুলে নিয়ে গেল সুন্দর স্বাস্থ্যের অধিকারী এক যুবক। প্রখ্যাত সাহিত্যিকের জার্মান কায়দায় যুবকটিকে একটু এশট্যাবলিস করা যাক।
ছোটো একটি ঘর। সেই ঘরে ইটের পর ইট দিয়ে উঁচু করা একটি চৌপায়া। আধময়লা একটি মশারি। সেই মশারির ভেতর যুবকটি শুয়ে ছিল। সাদা পাজামা আর কাঁধকাটা গেঞ্জি পরে। ছোটো একটা মাথার বালিশ। গামছা জড়ানো। গামছা জড়াবার কারণ, বালিশের খোলে দুটো ফুটো তৈরি হয়েছে। ফুটো হবার কারণ, এই পরিবারে একটা আদুরে বেড়াল আছে। সাদার ওপর হলদে। মুখটা ভারি মিষ্টি। পোখরাজের মতো জ্বলজ্বলে দুটো চোখ। লেজটা চামরের মতো মোটা। লোমে ভর্তি থুপথুপে একটা বেড়াল। বেড়ালটার পেট কোনো সময়ে ঢুকে থাকে না। সব সময় ভরভর্তি। সব সময় হাসিখুশি। হয় খাচ্ছে, না হয় ঘুমোচ্ছে না হয় দুর্দান্ত খেলায় মেতে আছে আপনমনে। নানারকম খেলা আবিষ্কার করার অসাধারণ প্রতিভা আছে বেড়ালটার, চাদরের ঝোলা অংশে ঝুলে ঝুলে খেলে। দেশলাইয়ের খালি প্যাকেট দু-পায়ে পাকা ফুটবলারের মতো ড্রিবল করে। হাওয়াই চটি চারপায়ে আঁকড়ে ধরে চিৎ হয়ে উলটে পড়ে। কামড়াতে থাকে। কখনো লেজটাকে ধনুকের মতো বাঁকিয়ে অকারণে ঘরময় ছোটাছুটি করে। হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে ঘাড় বাঁকিয়ে পিছনে তাকায়। তারপর আবার দৌড়োয়। তড়াং করে বিছানায় লাফিয়ে উঠে খচমচ, খচমচ এপাশে-ওপাশে দৌড়ে চাদরের ঝোলা অংশ বেয়ে ধুপ করে মাটিতে পড়ে। এই বেড়ালটাই বালিশটা ছিঁড়েছে। তার এই অপরাধের জন্যে কেউ অসন্তুষ্ট হয়নি, বরং বেশ গর্বিত। ফুটো দিয়ে তুলো বেরিয়ে আসছিল, তাই যুবকটির মা নতুন একটা গামছা দিয়ে বালিশটা বেঁধে দিয়েছেন। মেয়েকে বলেছেন বালিশে দুটো তাপ্পি মেরে দিস। তার আর সময় হচ্ছে না। এটা তার অবহেলা নয়; সত্যিই সময়ের বড়ো অভাব। সৃষ্টি সংসারের কাজ, তিন বাড়িতে টিউশানি, রবীন্দ্রসংগীত শিখতে যাওয়া আর ছোট্ট একটা প্রেম। আর দোষ নেই। সত্যিই সময়ের অভাব।
সমস্ত কিছু ব্যাখ্যা করা উচিত। বেড়ালের অংশটাকে এত বড়ো করার কারণ, বেড়াল আর বিছানা একটা সংসারকে প্রকাশ করে। উচ্চবিত্ত, ভোগী, স্বার্থপরের সংসারে বিছানা খুব টিপটপ থাকে। বালিশের খুব বাহার। প্রত্যেকের আলাদা আলাদা ঘর। কলেজের কমন রুমের মতো একটা লিভিং রুম। আলাদা খাবার ঘর। সেই সব বাড়িতে বিছানার ওপর চাঁদের হাটবাজার বসে না। সেইসব বাড়িতে বেড়াল ঢোকার উপায় নেই। ঢুকলেই দেখমার। রাতের বেলায় টানটান বিছানায় শয্যাগ্রহণকারী আলতো করে শরীরটা ছেড়ে দেন। চাদর কুঁচকে শয্যার সৌন্দর্য নষ্ট হবার ভয়ে সাবধানে শরীর তুলে পাশ ফেরেন। এই ধরনের অধিকাংশ পরিবারে স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক তেমন ভালো থাকে না। বিয়ের তিন বছরের মধ্যে ডিভোর্স না হলে ‘সোস্যাল প্রেস্টিজ’ বাড়ে না। যে মহিলা যতবার ডিভোর্স করতে পারবেন ততই তাঁর সম্মান আর ব্যক্তিত্ব বেড়ে যাবে। সোসাইটির ওপর তাঁর একটা গ্রিপ এসে যাবে। তাঁর চুল তত ছোটো হবে। জীবনে আর কুলিয়ে উঠতে পারেন না তাই নেড়ার আগের স্তরে এসে থেমে যান। যে পুরুষ যতবার ডিভোর্স করতে পারবেন, ডিভোর্সি মহলে তাঁর আকর্ষণ তত বেড়ে যাবে। মুখে একটা উদাসীনতা। কঠিন একটা পাকা পাকা ভাব। অর্থাৎ স্টিল থেকে টেম্পারড স্টিল। সোনা থেকে পাকা সোনা। আনাড়ি স্বামী আর কী! মেয়েরা নেড়েচেড়ে একটু ফ্রাই করে ছেড়ে দেয়। ফ্রায়েড হতে হতে ডিপ ফ্রাই হয়ে ঈশ্বরের কাটলেট। ডিভোর্সিদের একটা বৃত্ত থাকে। বৃত্তাকারে নৃত্য।
এ ছাড়ছে সে ধরছে। সে আবার ছাড়ছে তো এ ধরছে। এই ধরাধরি আর ছাড়াছাড়ি হতে হতে দেখা গেল, সাত আট বছর পরে প্রথমটি আবার প্রথমের কাছে ফিরে এসেছেন। তখন দু-জনেই বলছেন, ‘কী আশ্চর্য মাইরি, শুধু ওয়ালর্ড ইজ রাউণ্ড নয়, ম্যারেজ ইজ অলসো রাউণ্ড। চলো দাঁত বাঁধিয়ে আসি।’
আর বেড়াল! এরই মধ্যে এই কাহিনিতে দুটো বেড়াল এসে গেছে। প্রথম বেড়ালটি এসেছে উদাহরণে। সেই প্রখ্যাত সাহিত্যিক, সুধাময়কে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে অসহায় একটি বেড়ালছানা এনেছেন। পৃথিবী হল গেস্টাপোর পায়ের বুটজুতো আর বেড়াল হল অসহায় জীবন। এ কাহিনির বেড়াল এই পরিবারের জীবনদর্শন। অভাবের কুমির পরিবারটিকে চিউইংগামের মতো চিবোলেও, মানুষগুলো ফ্যান-ফোন-ফ্রিজ-মারুতিঅলা পরিবারের সদস্যদের মতো নীচ আর সঙ্কীর্ণ হয়ে যায়নি। ঐশ্বর্যশালীর নাস্তিকতা অথবা ভীত-আস্তিকতা নয়, মেঠো মানুষের সহজ সরল ঈশ্বর-বিশ্বাসে পরিবারটি চালিত। গৃহকর্ত্রীর চিৎকার-চেঁচামেচি তাঁর বাইরের দিকে, ভিতরে তুলতুলে সাদা ভাল্লুকের মতো, স্নেহ-ভালোবাসা-মমতা-উদারতা ঘাপটি মেরে বসে আছে।
পাজামা আর গেঞ্জি-পরা যুবকটি যদি আমাদের এই কাহিনির নায়ক হয় তাহলে তার কিছু গুণ থাকা চাই। ছেলেটি সম্প্রতি বাংলায় এম. এ. করেছে। ভীষণ সরল। জগৎ ও জীবন সম্পর্কে সন্দেহবাদী নয়। বাঁচতে ভালোবাসে। মানুষের সঙ্গে মিশতে ভালোবাসে। অতীতের গল্প তাকে টানে। তার ভবিষ্যৎ হতাশায় ভরা নয়। বয়সের তুলনায় বুদ্ধি পাকেনি। সকলের সব কথাই সে বিশ্বাস করে। ঠকলেও তার জ্ঞান হয় না। ক্ষমাশীল। ‘যাক-গে, একটা দুটো লোক ওরকম করতেই পারে’—বলে হেসে উড়িয়ে দেয়। বাবা, মা, বোন, তিনজনকেই সে খুব ভালোবাসে। তিনজনের জন্যেই সে জীবন দিতে পারে। তার মৃত্যুভয় নেই। নিজে অসম্ভব কষ্ট করতে পারে। সাজ-পোশাকের কাপ্তেনি তার অসহ্য লাগে, কিন্তু অতিমাত্রায় পরিচ্ছন্ন। সে অলস নয়, কিন্তু ঠেলে না তুললে ভোরবেলা সে কিছুতেই বিছানা ছেড়ে উঠতে পারে না। ঘুম থেকে ওঠার পরও নিজেকে ক্লান্ত মনে হয়। মনে হয়, সারা রাত সে যেন লড়াই করে উঠল। সে নিজেই বলে ‘ডিংডং-ব্যাটল’।
এইবার ছেলেটির একটা সুন্দর নাম রাখা যাক। এমন একটি ছেলের নাম শঙ্কর ছাড়া আর কিছুই ভাবা যায় না। ‘নিউমারোলজি’ বলে একটা শাস্ত্র আছে। বিজ্ঞানের বাইরে। সেই শাস্ত্র অনুসারে শঙ্কর নামের ছেলেরা ভালো হতে বাধ্য। এই যে শঙ্করের চরিত্রটা এইরকম হয়ে গেল, এরপর আর প্রেমের গল্প হয় না। এই ছেলে কখনো প্রেম করতে পারে না। কারণ শঙ্কর নিজের জামার বুকপকেটে উদ্বোধন থেকে কেনা স্বামী বিবেকানন্দের ছোট্ট একটি ছবি রাখে। সত্যি রাখে। এটা গল্প নয়। মুভি ক্যামেরার বদলে এবার আমি নিজে আসরে নেমে পড়লুম। সেই ঘটনাটির মতো। শঙ্কর আমার গলায় চেন দিয়ে টানছে।
শঙ্করকে জিজ্ঞেস করেছিলুম, ‘তুমি স্বামীজির ছবি সব সময় বুকপকেটে রাখ কেন? ভন্ডামি! গলায় গুরুদেবের লকেট ঝুলিয়ে অনেক পরমার্থী দেহার্থী হয়ে বেশ্যালয়ে যায়।’
‘সে কে, কী করে আমি জানি না। আমার জানার দরকার নেই। আমি একটা শক্তির স্পর্শ পাই বলে রাখি। একটা আদর্শ আমার হাত ধরে রাখে সব সময়। আমার হতাশা কেটে যায়। স্বামী বিবেকানন্দ হতে পারব না কোনো দিন; কিন্তু তাঁর ত্যাগ, বিবেক বৈরাগ্য যদি সামান্য স্পর্শ দিতে পারে আমাকে, এ জীবনে আমার কোনো দুঃখ থাকবে না, হতাশা থাকবে না।’
‘কেন, তুমি তো ফোর্ড অথবা গেটি কি ওনাসিসের ছবি রাখতে পার। তুমি একটা ইণ্ডাস্ট্রিয়াল কিংডম গড়ে তুলতে পার। ত্যাগ তো নেগেটিভ অ্যাপ্রোচ। তুমি জীবনের পজিটিভ সাইডটা নিচ্ছ না কেন, তার কারণ তোমার অক্ষমতা। ভাবে যা করা যায়, কাজে তা করা যায় না। ধরতে গেলে শক্তি চাই, ছাড়তে গেলে শক্তির প্রয়োজন হয় না। দুর্বলের আলগা হাত থেকে তো সবই খুলে পড়ে যায়। সেইটাকেই ত্যাগ বলা হোক। উড়ো খই গোবিন্দায় নমঃ।’
‘ভোগের একটা ব্যাকরণ আছে। সিঁড়ি আছে। ধাপ আছে। ত্যাগের কোনো ব্যাকরণ নেই। ত্যাগ করতে গেলে কি ভীষণ শক্তির প্রয়োজন, আপনার ধারণা নেই। ছেঁড়া, তালি মারা একটা জামা গা থেকে খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিতে হলেও মন টেনে ধরে। ভোগ বসে আছে মনের ভিতরে, কাঠকয়লার আগুন জ্বেলে। অহরহ ফুঁ মেরে চলেছে বিষয়ের ব্লোয়ার। আরো চাই, আরো চাই, সদাসর্বদা এই সংকীর্তন চলেছে। এই যা পেলুম, পরমুহূর্তেই তাতে আর মন ভরে না, অন্য কিছু চাই। চাওয়া, পাওয়া না পাওয়া, পুড়ে যাওয়া ছাই। এ. এস. এইচ.। এ. এস…এস.।’
‘আমার কী মনে হয় জান, ধর্ম, ধার্মিকতা, আধ্যাত্মিকতা, আদর্শ, সংযম, ত্যাগ, বৈরাগ্য, সবই হল দুর্বলের বলিষ্ঠতা। এক ধরনের আত্মতৃপ্তি! তুমি বাংলার এম. এ. তোমার দ্বারা তো আর কিছু করা সম্ভব নয়। স্কুল মাস্টারি জোটানোও শক্ত। তুমি এখন সন্ন্যাসীও হয়ে যেতে পার। আবার কেউ যদি তোমাকে বলে আমার অসুন্দরী মেয়েটিকে বিয়ে করো, তোমাকে আমি আমার কোম্পানির বিরাট একজন একজিকিউটিভ করে দেবো, তাহলেই তোমার মতিগতি বদলে যাবে। ব্যাঙ্গালোরে সাজানো অফিসে গিয়ে বসবে। সাজানো কোয়ার্টার। লাল গাড়ি। স্যুট, টাই, পার্টি, ড্রিঙ্কস। সোসাইটি। কল-গার্লস।
শঙ্কর বললে, ‘ঠিক হচ্ছে না। গতানুগতিক হয়ে যাচ্ছে। দার্শনিক তর্ক-বিতর্কে না গিয়ে, একপাশে বসে নিরাসক্ত হয়ে দেখুন, আমি কী করি। কীভাবে আমি ফুটে উঠি। ভালো, ক্ষমতাশালী লেখকরা পাকামো না করে জীবনকে অনুসরণ করেন। জীবন সৃষ্টি করেন স্বয়ং ঈশ্বর। এক এক জীবন এক এক রকম। জন্মানোমাত্রই জীবন-ঘড়ির টিকটিক শুরু হয়ে গেল। সব মানুষেরই ভিতরে একটা ঘড়ি আছে। সেই ঘড়ি ঠিক করে একজন মানুষ মুহূর্তে মুহূর্তে কেমন থাকবে, তার শরীর, তার মানসিক অবস্থা, তার অনুভূতি, তার কর্মতৎপরতা। রোজ সূর্য উঠছে, সূর্য অস্ত যাচ্ছে। জোয়ার আসছে নদীতে ভাটা পড়ছে। বিভিন্ন গতিতে গ্রহ ঘুরছে সূর্যের চারপাশে। কোনো ব্যতিক্রম নেই। সূর্যের গতি, সমুদ্রের জোয়ার ভাটার সঙ্গে জীবনের অনেক কিছুর প্রত্যক্ষ যোগাযোগ। ভূমিকম্পের সাইকল আছে, ঋতুচক্র আছে, আবহাওয়ার পরিবর্তনের একটা সাইকল আছে। মানুষের মন, মগজ, ভালো লাগা-না-লাগা, কাজ করার ইচ্ছা-অনিচ্ছা সবই এই ঘড়ির নিয়ন্ত্রণে। যদি পারেন ডক্টর হেরম্যান সোবোদার দি পিরিয়াডস অফ হিউম্যান লাইফ বইটা পড়ে নেবেন। মানুষ যা ভাবে তাই করে, যা ভাবে না, তা করে না, করলেও জোর করে করে। আর এই ভাবনাটা নিয়ন্ত্রণ করে তার জন্মকালীন ঘড়ি।’
আমার চরিত্রের হাতে মার খেয়ে আমি থেবড়ে বসে পড়লুম।
শঙ্কর যে জায়গাটায় শোয়, তার মাথার কাছে একটা কুলুঙ্গি। সেইখানে একটা টেবিল ঘড়ি। মরচে ধরা। তবে অ্যালার্মের শব্দটা ভারি সাঙ্ঘাতিক। সেই শব্দে পুরো বাড়ি জেগে ওঠে। শঙ্করের একটা হিসেব আছে। অ্যালার্মটা যখন বাজে তখন উনুনটা ধরে আসে। শঙ্কর চৌকি থেকে নেমে, ঘুমচোখে সোজা এগিয়ে যায় বাইরে, যেখানে উনুনটা অল্প অল্প ধোঁয়া ছাড়ছে। উনুনটাকে সোজা তুলে এনে রান্নাঘরে বসিয়ে দেয়। একটু দেরি করলেই তার অধৈর্য মা তুলে আনবেন। মা বাতে ক্রমশ বেঁকে আসছেন। কোমরে স্পণ্ডিলাইসিস। শঙ্কর মাকে দেবীর মতো শ্রদ্ধা করে, আর বোনকে ভালোবাসে ফুলের মতো। সমস্ত কায়িক পরিশ্রম থেকে দূরে রাখতে চায়। শঙ্করের মানসিকতা হল সংসারের সমস্ত ঝড়ঝাপ্টা তার ওপর দিয়েই যাক। অনাহার, অসুখ, অপমান, যা কিছু অশুভ সব বয়ে যাক তার উপর দিয়ে, বাকি সকলে ওরই মধ্যে একটু আড়ালে, একটু সুখে থাকুক। দুঃখটাকে শঙ্কর ভীষণ ভালোবাসে। কষ্টে মানুষ পবিত্র হয়, চরিত্রবান হয়। প্রাচুর্যে মানুষ চরিত্রহীন হয়। জীবন একঘেয়ে হয়ে যায়। শঙ্কর নিজের কাজ নিজেই করে নিতে ভালোবাসে। গরম জ্বলন্ত উনুনটাকে রান্নাঘরে পাচার করে দিয়ে, শঙ্কর বিছানা তুলবে। বোন শ্যামলী তাকে সাহায্য করতে চাইলেও শঙ্কর সাহায্য নেবে না। ছেলেবেলায় তার আদর্শবাদী শিক্ষক তার মনে একটি মন্ত্র লিখে দিয়ে গেছেন চিরতরে, সেলফ হেলপ ইজ বেস্ট হেলপ। বিছানা তোলার পর শঙ্কর মুখ ধোবে।
উঠোন। কল। জল পড়ছে সরু সুতোর মতো। উঠোনটা শ্যাওলা ধরাই হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু পরিষ্কার। ঝকঝকে পরিষ্কার। এর জন্যে সমস্ত কৃতিত্বই শঙ্করের পাওনা। শঙ্করের মা একবার পা হড়কে পড়ে গিয়েছিলেন টিনের বালতির ওপর। ঈশ্বরের অসীম কৃপা, কোমরটা ভাঙেনি। সামনের একটা দাঁত খুলে পড়ে গিয়েছিল। দাঁতটা একটু নড়বড়েই ছিল। সেই দিন থেকে শঙ্করের কাজ হয়েছে, পাথর মেরে উঠান পরিষ্কার। বাঙালির মজা হল, নিজেরা ভালো কিছু করবে না, অন্যে কেউ কিছু করলে হাসাহাসি হবে। এই উঠোন পরিষ্কার নিয়ে নানা কথা শঙ্করের কানে আসে। বেকার ছেলে অফুরন্ত সময়, কী আর করবে! একটা কিছু তো করতে হবে! এ কথাও কানে এসেছে। শরীরটা পুরুষের হলেও মন আর স্বভাবটা মেয়েমানুষের। উনুনে কয়লা দিচ্ছে, দুপুরে গুল দিচ্ছে, কলতলায় চাল ধুচ্ছে। শঙ্কর মনে মনে ভাবে—মুখ দিয়েছেন যিনি, বাত দিয়েছেন তিনি।
কলতলায় যাবার সময় শঙ্কর খড়ম পরে। চিৎপুর থেকে খুঁজে খুঁজে এক জোড়া খড়ম কিনে এনেছে। পায়ের তলাটা নোঙরা হয়ে গেলে তার বিশ্রী লাগে। খড়মের খটাস খটাস শব্দে সকলকে সচকিত করে শঙ্কর কলতলায় গিয়ে দাঁড়াল। শঙ্কর গামছার বদলে ব্যবহার করে একটুকরো সাদা কাপড়। গামছা জিনিসটাকে সে অপছন্দ করে। তোয়ালে বড়োলোকের এবং অস্বাস্থ্যকর। শঙ্কর এক মিটার মার্কিন কিনে এনে নিজেই মেশিন চালিয়ে ধার দুটো সেলাই করে নেয়। তার সেই শিক্ষাগুরু বলতেন, লিভ ইন স্টাইল। বাঁচাটা যেন রুচিসম্মত হয়। অঢেল খরচ না করেও রুচিসম্মত বাঁচা যায়।
বাঙালির জীবন হল, জল আর কল। কলতলা খালি যাবার উপায় নেই। কেউ-না-কেউ থাকবেই। শঙ্কর খড়ম পায়ে কলতলায় গিয়ে দাঁতে বুরুশ ঘষতে লাগল। আর সেই সময় দ্বিতীয় উনুনটি তুলতে এল আরতি। তীব্র চেহারা। যেমন রং, তেমনি ধারালো চোখমুখ। চোখ দুটো যেন ছুরি ছোলা। খুব নামকরা ভাস্কর কেটেছেন। পটলচেরা। মণি দুটো জ্বল জ্বল করছে। শঙ্করের কলতলায় আসা আর আরতির উনুন তুলতে আসা রোজই এক সময় হয়। এই নিয়ে তৃতীয় পরিবারটিতে নানা আলাপ আলোচনা। আরতিদের উনুনটা আকারে বেশ বড়ো। এক একবারে সের পাঁচেক কয়লা ধরে। আগুনও হয় তেমনি গনগনে। আরতি একহারা, লম্বা। শঙ্কর রোজই দেখে, আরতি নানাভাবে চেষ্টা করছে উনুনটাকে কায়দা করার। পারছে না। তখন শঙ্কর এগিয়ে গিয়ে বলে, দেখি সরুন। তারপর উনুনটাকে অক্লেশে তুলে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দেয় তাদের রান্নাঘরে। এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে ফিরে আসে কলতলায়। রোজই আরতি কিছু বলতে চায়। বলা আর হয় না, কারণ শঙ্কর এক মুহূর্ত দাঁড়ায় না। কোনো দিকে তাকায় না। তার মুখে ব্রাশ। গায়ের ওপর সাদা মার্কিনের টুকরো। আরতির জীবনের ঘোরালো একটা ইতিহাস আছে। কে বলেছে বাঙালি ইতিহাস-বিমুখ। পারিবারিক ইতিহাস কারোর অজানা থাকে না। কোনো ভাবেই চেপে রাখার উপায় নেই। কোথা দিয়ে ঠিক বেরোবেই বেরোবে। আরতির বাবার আর্থিক অবস্থা একসময় খুবই ভালো ছিল। মধ্য কলকাতায় সুন্দর একটা বাড়ি ছিল। বাড়ির পিছনে লন ছিল, ফুলগাছ ছিল, দোলনা ছিল। একটা গোমড়ামুখো ভকসহল গাড়ি ছিল। আরতিকে দেখলেই বোঝা যায়, আরতির মা খুব সুন্দরী ছিলেন। বিদুষী মহিলা; একটু বিলিতি ভাবাপন্ন। আরতির বাবার বিশাল এক ব্যবসা ছিল। দুই পুরুষের ব্যবসা। পিতামহ ফেঁদেছিলেন, পিতা বাড়িয়েছিলেন। আরতির বাবা আধুনিক করেছিলেন। কারবারটা ছিল এনামেলিং-এর। এনামেলের হাজাররকম জিনিসপত্র তৈরি হত। রপ্তানি হত বিদেশে। বিশাল কারখানা ছিল ওপারে। গঙ্গার ওই কূলে। রপ্তানির সূত্রে আরতির বাবা বহুবার বিদেশে গেছেন। বিবাহ করেছিলেন এক অতি সম্পন্ন স্টিভেডারের সুন্দরী মেয়েকে। মেয়েটি ইংলিশ মিডিয়ামে লেখাপড়া করে গ্র্যাজুয়েট হয়েছিল। শিক্ষিতা, সুন্দরী মেয়ে অনেকটা মৌচাকের মতো। সবসময়ই সেই চাকে মৌমাছি বিড়বিড় করে। আরতির রাসায়নিক পিতা জীবন আর জগৎকে কর্মযোগীর দৃষ্টিতে নিয়েছিলেন। খাটবেন, খুটবেন, অর্থ উপার্জন করবেন, কিছু মানুষের কর্মসংস্থান করবেন। দিনের শেষে ফিরে আসবেন সুখী গৃহকোণে। সেই গৃহকোণ অবাঞ্ছিত উপদ্রবে আর সুখী রইল না। তিনি ভেবেছিলেন বাঙালি মেয়ে এক স্বামীতেই সন্তুষ্ট থাকবে। তা আর হল কই! বাড়ি, গাড়ি, বিত্ত, আদর্শবাদী স্বামী, স্বাভাবিক এইসব পাওনার ঊর্ধ্বে একটু হিং-এর গন্ধ। একটু পাপ। একটু বিশ্বাসঘাতকতা। একটু লুকোচুরির আকর্ষণ কারো কারো কাছে অনেক বেশি। থ্রম্বোসিস শুধু মানুষের হয় না, ভাগ্যেরও হয়। আরতির যখন তিন-চার বছর বয়েস, আরতির মা গৃহত্যাগ করলেন এক তরুণ পাঞ্জাবী শিল্পপতির সঙ্গে। দিল্লিতে তাঁর বিশাল এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের ব্যবসা। কে জানে ভদ্রমহিলা এখন কেমন আছেন। যৌবন কী ধরা আছে দেহে! থ্রম্বোসিসের প্রথম আক্রমণ। আরতির বাবা করুণাকেতন প্রথম ধাক্কাটা কাটালেন। এলো দ্বিতীয় আঘাত। কারখানায় শুরু হল ধর্মঘট। ভাঙচুর খুনোখুনি। হল লকআউট। কারখানার ভিতরে জঙ্গল তৈরি হয়ে গেল। যন্ত্রে মরচে ধরে গেল। করোগেটের চাল খুলে খুলে পড়ে গেল। ঝড়ে চিমনি দুমড়ে গেল। পিছনের পাঁচিল ভেঙে মালপত্র চুরি হয়ে গেল। করুণাকেতন বেধড়ক ধোলাই খেয়ে হাসপাতালে পড়ে রইলেন তিন মাস। এদিকে এনামেলের জায়গায় এসে গেল স্টেনলেস স্টিল, প্লাস্টিক, হিট রেজিসটেন্ট গ্লাস। পুরো ব্যবসা চৌপাট হয়ে গেল প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর মতো। বাড়ি গেল, লন গেল, দোলনা গেল, টেনিস কোর্ট গেল। এইবার তিন নম্বর স্ট্রোক। ভাগ্য আর দেহ দুটোই সেই আঘাতে টাইসনের ঘুষি খাওয়া বক্সারের মতো লুটিয়ে পড়ল রিং-এ। এক থেকে দশ গুণে গেলেন রেফারি। করুণাকেতন উঠতে পারলেন না। মায়ের দেনা শোধ করছে আরতি। মাসের রোজগার সাত-শো টাকা। ব্যাঙ্কে ফিক্সড ডিপোজিটের ইন্টারেস্ট। আরতির দিকে অনেকেরই নজর আছে। সেই সর্বনাশ আর পৌষ মাসের গল্প। মা যার চরিত্রহীনা, সেই মেয়ে কদিন আর ঠিক থাকতে পারে! তিমির বাচ্চা তিমিই হবে। অনেকেই দাঁতে দাঁত মিশমিশ করে বলে, আঃ একবার বাগে পেলে হয়! পৃথিবীতে বেশ কিছু মানুষ আছে, যাদের দিবারাত্র এক চিন্তা, কখন একটা মেয়েকে ক্যাঁক করে ধরব। সামনে দিয়ে কোনো মেয়ে চলে গেলে ভাবে এই যা: চলে গেল। চোখে শিকারী বেড়ালের ঘুটঘুটে দৃষ্টি। এদিকে তাকাচ্ছে, ওদিকে তাকাচ্ছে। বন্ধুর বাড়িতে গেছে, বন্ধুর স্ত্রী চা দিতে এসেছে। সেন্টার টেবিলে চা রাখার জন্যে নীচু হয়েছে, অমনি বাপ করে উঠল। বন্ধু জিজ্ঞেস করল, কি হল ভাই সন্তু, চা পড়ল গায়ে? বন্ধুর স্ত্রী জানে কী হয়েছে। তাড়াতাড়ি সোজা হয়ে বুকে আঁচল টেনে দিল। আর মুহূর্তমাত্র দাঁড়াল না। চলে গেল ভিতরে। চলে যাবার পর স্বামীকে জিজ্ঞেস করল, ‘জিনিসটা তোমার কোথাকার আমদানি! চোখে আবার খাব দৃষ্টি! অসভ্য।’
না, এইবার তৃতীয় উনুনটাকে এশট্যাবলিস করা যাক। রোগা, পাতলা, অ্যানিমিক এক মহিলা, চেহারা দেখে বয়েস বোঝার উপায় নেই। কুড়িও হতে পারে চল্লিশও হতে পারে। ঢালাই উনুন, কয়লাটয়লা পড়ে বিশ, ত্রিশ কেজি ওজন হয়েছে। অতি কষ্টে হাঁপাতে হাঁপাতে উনুনটাকে ভিতরে নিয়ে গেল। পরক্ষণেই বাইরের রকে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে একপাশে বসে পড়ল। আর সঙ্গেসঙ্গে ঘরের ভিতর থেকে দামড়াপানা একটা লোক বেরিয়ে এসে আকাটের মতো বললে, ‘কি, আজ চা-টা হবে? চাঁটা না খেলে তোমার দেখি গতর আর নড়েই না। যে পুজোর যা নৈবেদ্য। বাবু এখানে বসে হাওয়া খাচ্ছেন, ওদিকে আমার দোকান লাটে উঠুক।’
শঙ্কর এই দৃশ্য রোজই দেখে। দেখে একটা পেটমোটা যমদূতের মতো লোক অসুস্থ ক্ষীণজীবী এক মহিলাকে ক্রীতদাসীর মতো ব্যবহার করছে। কে বলেছে দেশ স্বাধীন হয়েছে, মানুষ স্বাধীন হয়েছে, শিক্ষা, সংস্কৃতির প্রসার হিন্দুসভ্যতা এক সুপ্রাচীন সভ্যতা। বিশ্বের গৌরব। দামড়া লোকটা কাটা কাপড়ের ব্যবসা করে। হাতিবাগানে স্টল আছে। অনেক রাতে বাড়ি ফেরে নেশা করে। রোজই বউটাকে ঘরে খিল দিয়ে পেটায়। অন্যেরা প্রতিবাদ করেছিল, ভদ্রলোকের পাড়ায় এ কী ছোটোলোকমি! রোজ রাতে চিৎকার, চেঁচামেচি! দামড়া এখন পলিসি পাল্টেছে। বউয়ের মুখে গামছা পুরে পেটায়। আবার রোজ সকালে টেরিকটনের পাঞ্জাবি, চুস্ত পাজামা পরে, মশলা চিবোতে চিবোতে ব্যবসায় যায়। তখন বোঝাই দায়, লোকটা ইতর না লোকটা ভদ্রলোক। তখন সে রতনবাবু। দুটো পয়সার মুখ দেখেছে। রতনবাবু আবার পার্টি করেন। বলা যায় না, দেশের যা অবস্থা হচ্ছে, এই মালই হয়তো মন্ত্রী হয়ে বসবেন। হয়তো শিক্ষামন্ত্রী হবেন।
শঙ্কর ব্রহ্মদৈত্যর মতো খড়ম খটখটিয়ে ঘরে গিয়ে ঢোকে। তার সেই ছোটো ঘরে চারখানা থান ইট আছে। সেই ইট চারটে সরিয়ে প্রাণভরে ডন মারে। পঞ্চাশটার কম নয়। শ’খানেক বৈঠক। জানালার গরাদ ধরে ঝুলে থাকে বেশ কিছুক্ষণ। ব্যায়াম হয়ে যাবার পর, পুরো দু-মুঠো ছোলা খায় চারটে বাতাসা দিয়ে। তারপর এক লোটা জল। এরপর সে একটা ব্যাগ বগলে বাজারে যায়। শঙ্কর বেশ গুছিয়ে বাজার করতে পারে। সাত টাকা হল তার বাজেট। মাসে দু-শো দশ টাকা। মাছ মাংস ডিম খাওয়ার পয়সা নেই। এক প্যাকেট দুধ আসে। দু-বার চা হয়। সকালে একবার, বিকেলে একবার। একটু বেড়াল খায়। যেটুকু বাঁচে, সেইটুকু সে জোর করে মাকে খাইয়ে দেয়। শঙ্করের বাবার প্যাকেটের দুধ খাওয়ায় ভীষণ আপত্তি। সংসারের খরচ শঙ্করই কন্ট্রোল করে। মাসে সাত-শো টাকার এক পয়সা বেশি খরচ করলে চলবে না। বরং কিছু বাঁচলে ভালো হয়। তিন-শো টাকার মতো বাড়িভাড়া। শঙ্করদের অবস্থাও এক সময় বেশ ভালো ছিল। বাবা হঠাৎ বসে যাওয়ায় সংসারটা দমে গেছে। শঙ্কর ভাবে, তা যাকগে। চিরকাল মানুষের সমান যায় না। জন্মেছি, জলে পড়েছি, সাঁতার কাটতেই হবে। স্রোতের অনুকূলে, স্রোতের বিপরীতে। যখন যেমন। হাত পা সর্বক্ষণ ছুঁড়তেই হবে। তা না হলেই ভুস। অতল তলে। শঙ্কর যেভাবে বেঁচে আছে, সেই বাঁচাটাই তার ভীষণ ভালো লাগে। সকালে ছোলার বদলে ডিম আর টোস্ট হলে তার খুব খারাপ লাগবে। ডাল, ভাত আর যেকোনো একটা তরকারির বেশি অন্য কিছু হলে সে খেতেই পারবে না।
শঙ্কর যেমন শঙ্করদের সংসার চালায়, আরতি সেইরকম চালায় আরতিদের সংসার। শঙ্কর ছেলে, আরতি মেয়ে। শঙ্কর আর আরতি প্রায় একই সময় রাস্তায় নামল। দু-জনেরই হাতে ব্যাগ। আরতির বাগটা সুন্দর, শঙ্করের ব্যাগটা সাদামাটা। আরতির রুচিটা একটু অন্যরকম। তাদের ঘরদোর ওরই মধ্যে বেশ সাজানো গোছানো। প্রতি মাসে কোনো একটা জায়গা থেকে বেশ কিছু টাকা আসে। আমি জানি, কোথা থেকে আসে। আরতির বাবার কিছু টাকা ব্যাঙ্কে ফিক্সড করা আছে। সেই সুদে কোনোরকমে চলে যায়। দু-জনের সংসার। ঝামেলা তেমন নেই। আরতি জীবনের সুদিন দেখেছে; তাই এই দুর্দিনে সে একটু বিষণ্ণ। রাস্তায় বেরোলে তার বিষণ্ণতা বেশি বোঝা যায়। উদাস দৃষ্টিতে চারপাশে তাকাতে তাকাতে চলে। যেন সে হেঁটে চলেছে জগৎ সংসারের বাইরে দিয়ে।
শঙ্কর রাস্তায় বেরোলেই পাড়ার কয়েকটা বাচ্চা তাকে ঘিরে ধরে। ওরা সব শঙ্করের বন্ধু। বাচ্চাগুলোকে শঙ্কর ভীষণ ভালোবাসে। তাদের সঙ্গে এমনভাবে কথা বলে যেন সমবয়সী। খেলার কথা, পড়ার কথা, খাওয়ার কথা। বাড়িতে কিছু তৈরি হলে শঙ্করের জন্যে নিয়ে আসে পকেটে করে, ঠোঙায় করে। এই বাচ্চাদের সঙ্গে শঙ্কর মাঝে মাঝে চড়ুইভাতি করে। সে বেশ মজা। কেউ নিয়ে এল আলু। কেউ নিয়ে এল ময়দা। কেউ তেল। বনস্পতি। শঙ্করের সমান ভাগ থাকে। একটা কেরোসিন কুকার আছে। অপুদের বাড়ির ছাদে জমে গেল বনভোজন। শঙ্কর রাঁধে, বাচ্চারা যোগাড়ে। কখনো কখনো শ্যামলী এসে যোগ দেয়, সেদিন রান্নাটা বেশ খোলতাই হয়। শালপাতা লুচি আলুর দম, শুকনো শুকনো। শঙ্কর সন্ধ্যেবেলা বাচ্চাগুলোকে এক জায়গায় করে পড়তে বসায়। তখন তার ভূমিকা শিক্ষকের। এদের কারোরই অবস্থা তেমন ভালো নয়। শঙ্করের একটাই ভয়, পৃথিবীর প্রতিযোগিতায় ওরা যেন বড়লোকদের কাছে হেরে না যায়! যত সুযোগ ওরাই তো গ্রাস করে নিচ্ছে। ভালো বাড়ি, ভালো স্কুল, ভালো খাওয়া, ভালো পরা। রাস্তা দিয়ে যখন গাড়ি হাঁকিয়ে যায়, তখন ধরাকে সরা জ্ঞান করে। এদের সঙ্গে ট্রেনের এক কামরায় ভ্রমণ করা যায় না। সিনেমা, থিয়েটারে বসা যায় না। রেস্তোরাঁয় ঢোকা যায় না। এদের অর্থের উৎস হল ব্যবসার দুনম্বরী পয়সা। চাকরি হলে বাঁ-হাতের কামাই। পয়সার জোরে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যারিস্টার, বিলেত, সুন্দরী স্ত্রী। পৃথিবীর সমস্ত ঝোল এরা নিজেদের কোলেই টানছে। একটা বাচ্চা একবার খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তার চিকিৎসার জন্যে শঙ্কর সাহায্য সংগ্রহে বেরিয়েছিল। পাড়ার সকলেই সামর্থ্য অনুসারে যে যা পারলেন দিলেন। পাড়ার বড়লোক শিল্পপতি মানিক ব্রহ্ম বললেন, ‘চাঁদা তুলে তুমি ক-জনের চিকিৎসা করাবে? সারা দেশটাই তো অসুস্থ। এইসব দায়িত্ব হল স্টেটের।’ ভুরু কুঁচকে ভদ্রলোক বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশের সমস্যাটা কী বলো তো, এই রকেটের যুগে আমরা এখনো পড়ে আছি পল্লিমঙ্গলের আইডিয়া নিয়ে। ওসব বাজে কাজ ছেড়ে দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করো। কিছু মরবে কিছু বাঁচবে। যাদের অধিকার নেই, তাদের মরতে দাও। একটা গাছে যত ফল ধরে সবই কী আর বাঁচে, পাকে? কিছু পাখিতে ফেলে দেয় ঠুকরে। কিছু পড়ে যায় ঝড়ে। কিছুতে পোকা লেগে যায়। জীবজগতের এই হল নিয়ম। তুমি কী করবে, আমিই বা কী করব!’ মানিক বহ্ম আচ্ছা করে উপদেশ পাম্প করে শঙ্করকে ছেড়ে দিলেন। এদেশে তিনটে জিনিস খুব সহজে পাওয়া যায়, বিনা পয়সায়। কলের জল, উপদেশ আর গণধোলাই।
অপুটাকে দেখতে ভারি সুন্দর; কিন্তু ভাগ্যটা ভীষণ অসুন্দর। তিন বছর বয়েসে বাবাকে হারিয়েছে। ভদ্রলোক হাওড়ার এক ঢালাই কারখানায় কাজ করতেন। সেইখানে এক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। স্ত্রী, ছেলে, বৃদ্ধা মা আর সাবেককালের একটা একতলা বাড়ি রেখে গেছেন। অপুর মা যে কীভাবে সংসার চালান, শঙ্কর তা জানে না। সবাই আশা করেছিলেন, অপুর মা বাড়ি-বাড়ি বাসন মেজে বেড়াবে। অন্তত পাড়ার লোক একজন সুন্দরী যুবতী ঝি পাবে। সে গুড়ে বালি। অপুর মা আজ সাত-সাতটা বছর ঠিকই চালিয়ে যাচ্ছেন, ভদ্রঘরের বউদের যেমন চালানো উচিত। এই নিয়েও গবেষণার শেষ নেই। একটা সিদ্ধান্তে এসে এখন সবাই বেশ সন্তুষ্ট, অপুর মা লুকিয়ে দেহ-ব্যবসা করে। আরে ছি: ছি:। এই ছি-ছি শব্দটা বলতে পারায় সকলেরই বেশ কোষ্ঠ-সাফ।
অপু শঙ্করের হাতে একটা কাগজের মোড়ক দিয়ে বললে, ‘মা তিলের নাড়ু করেছিল, তোমার জন্যে নিয়ে এলুম। জিনিসটা কেমন হয়েছে খেয়ে বলো তো! তুমি তো তিলের নাড়ু ভালোবাসো!’
‘ভালোবাসি মানে! তিলের নাড়ু আমার জীবন। গোলাপের গন্ধ আছে?’
‘না গো, গোলাপ আমরা পাবো কোথায়! শোনো না, আমি অনেক অনেক বড় হয়ে, যখন তোমার মতো বড়ো হয়ে যাব, তখন তো আমি চাকরি করব, তখন তোমাকে আমি গোলাপ তিলের নাড়ু খাওয়াব, প্যাঁড়া খাওয়াব।’
‘বড়ো হলেই কি আর চাকরি পাওয়া যায় রে অপু! এই তো দেখ না, আমি বড়ো হয়ে বসে আছি।’
‘তুমি চাকরি পাওনি তো সে বেশ হয়েছে। কেন বলো তো, তুমি চাকরি পেলে রোজ নটার সময় বেরিয়ে যাবে, আর রাত নটায় আসবে, তাহলে আমাদের কী হবে বলো। তুমি শঙ্করদা চাকরি কোরো না। তুমি একটা দোকান দাও। আমার মা বলছিল, আমাদের রাস্তার দিকের ঘরের দেয়ালটা ভাঙলে সুন্দর একটা দোকানঘর হবে। সেখানে একটা দর্জির দোকান করলে কেমন হয়! তা মা বললে, আমি তো ছাঁটকাট বেশ ভালোই জানি, সঙ্গে একজন পুরুষমানুষ থাকলে করা যেত। তুমি আজ মায়ের সঙ্গে কথা বলো না শঙ্করদা। আমার তাহলে টেরিফিক আনন্দ হয়।’
‘তোর না অপু কোনো বুদ্ধি নেই, একেবারে গবেট মেরে যাচ্ছিস। অঙ্কে তুই রসগোল্লা পাবি। দোকান করতে গেলে টাকা চাই। অ্যাতো অ্যাতো টাকা। সেই টাকাটা কোথা থেকে আসবে পাঁঠা!’
‘টাকা?’ কথা হচ্ছিল রকে বসে। অপু গালে হাত রাখল। শঙ্কর অপুর সেই ভঙ্গিটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মোড়ক খুলে একটা তিলের নাড়ু মুখে ফেলল। বেশ মুচমুচে। পাকটা বেশ ভালোই হয়েছে।
অপু হঠাৎ যেন আশার আলো পেল। গাল থেকে হাত সরিয়ে শঙ্করের হাঁটুতে একটা চাপড় মেরে বললে, ‘নো প্রবলেম! আমরা এবছর মা দুর্গার পুজো করব! বারোয়ারি।’
‘হচ্ছে দোকানের কথা, তুই চলে গেলি দুর্গাপুজোয়! তুই কেমন করে ফার্স্ট-সেকেণ্ড হোস? আয়, তোর মাথাটা ওপেন করে দেখি।’
‘শোনো না আমার প্ল্যানটা। তারপর তুমি আমাকে গাধা বলো গাধা, পাঁঠা বলো পাঁঠা। আমরা ঘুরে ঘুরে, ঘুরে ঘুরে অনেক টাকা চাঁদা তুলব, তারপর ছোটো এতকুটু একটা মূর্তি এনে পুজো করে বাকি টাকায় দোকান।’
শঙ্কর অপুর মাথায় টাক করে একটা গাট্টা মেরে বললে, ‘ওরে আমার চাঁদুরে, তারপর গণধোলাই। হাতে হাতকড়া। কোমরে দড়ি। কী প্ল্যানই বের করলে!’
‘তা হলেও তুমি একবার আমার মায়ের সঙ্গে কথা বলো। জান তো, তোমাদের বাড়ির ওই রতনবাবু মাকে খুব জপাচ্ছে। লেডিজ টেলারিং করবে। লোকটা একবারে দু-নম্বরী। যখন-তখন আমাদের বাড়িতে ঢুকে পড়ে। কাল রাতে চুল্লু খেয়ে এসেছিল। আমি কিন্তু একদিন পিছন থেকে ঝেড়ে দেবো। লোকটা কাল রাতে আমার মায়ের গায়ে হাত দেবার চেষ্টা করেছিল। শঙ্করদা, তুমি আমার মাকে ভালোবাসো তো?’
‘ভীষণ! যারা সৎ পথে থেকে লড়াই করে, আমি তাদের সকলকেই ভালোবাসি।’
‘মা-ও তোমাকে ভীষণ ভালোবাসে। তুমি একটা কিছু করো শঙ্করদা।’
‘দাঁড়া, ব্যাপারটা সিরিয়াসলি ভেবে দেখি। আজ দুপুরে তুই আমাকে মিট কর। তারপর দুজনে মিলে লড়ে যাব। তুই ভাইরাস কাকে বলে জানিস?’
‘না গো।’
‘ভাইরাস এমন রোগ জীবাণু, যা কোনো ওষুধে মরে না। এই রতন-টতন হল সেই ভাইরাস।’
‘তিলের নাড়ু কেমন খেলে?’
‘জমে গেছে।’
‘মাকে গিয়ে বলতে হবে। মা তোমাকে ভীষণ খাওয়াতে ভালোবাসে। বলে, আমার যদি সেরকম অবস্থা হত, তাহলে তোর শঙ্করদাকে আমি রোজ রোজ নানারকম করে করে খাওয়াতুম। আমার মা কত কী যে করতে জানে।’
‘সে আর কী হবে! বেশি বাজে বাজে খাবি না। পেলেও না। ডাল, ভাত, একটা যেকোনো তরকারি। বাকি সব বোগাস। এই নে, এই দুটো নাড়ু তুই খা।’
‘আমি তো খেয়েছি।’
‘তবু খা। আমি দিচ্ছি।’
শঙ্কর শিশুমহল ছেড়ে উঠে পড়ল। শঙ্করের কড়া নিয়ম, এইবার সব পড়তে বসবে। সবাই জানে ঠিকমতো লেখাপড়া না করলে শঙ্করদা আর ভালোবাসবে না। তা ছাড়া শঙ্করদা ওই বড়ো বাড়ির ছেলেদের দেখিয়ে বলে দিয়েছে, ওদের হারাতে হবে লেখাপড়ায়, খেলাধূলোয়, শরীর-স্বাস্থ্যে। ওই যে ছাইরঙের বাড়ির ছেলেরা খুব কেতা মেরে সাদা প্যান্ট, স্পোর্টস গেঞ্জি পরে ক্রিকেট প্র্যাকটিস করতে বেরোয়। ব্যাট, লেগগার্ড, গ্লাভস, টুপি, ওয়াটার বটল, হটবক্সে লাঞ্চ। শঙ্করদা বলেছে, তোরা কাঠের বল আর দিশি ব্যাটে অনেক বড়ো খেলোয়াড় হবি। শরীরটাকে আগে ভালো করে পেটা। লোহা তৈরি কর লোহা। শঙ্কর যা বলে, এরা তাই শোনে। শুধু শোনে না, প্রত্যেকে ভালোভাবে গড়ে উঠেছে।
শঙ্কর যখন রাস্তা দিয়ে হাঁটে তখন মনে হয় রাস্তার দু-ধারে আনন্দ ছড়াতে ছড়াতে চলেছে। এ-পাড়ার প্রতিটি মানুষ তাকে ভীষণ ভালোবাসে, কারণ শঙ্কর সকলের। শঙ্করের সেই শিক্ষকমহাশয় অনেক দিন আগে শঙ্করকে বলেছিলেন, ‘দেখ শঙ্কর, ভাগ্য কাকে বলে জান?’
‘গ্রহ।’
‘না। গ্রহ যাদের ভাগ্য, তারা হল দুর্বল, স্বার্থপর। একটা জিনিস চিরকালের জন্যে জেনে রাখো, সবলের জন্যে গ্রহ, নক্ষত্র, ঠিকুজি কোষ্ঠী, পাথর নয়। তুমি আর তোমার পৃথিবী। মাঝখানে কেউ নেই, মাথার ওপরেও কেউ নেই। এই পৃথিবীর সঙ্গে যে সম্পর্ক তুমি গড়ে তুলবে সেইটাই তোমার ভাগ্য। পৃথিবীর সঙ্গে যদি ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে তুলতে পার, তাহলেই তুমি সফল মানুষ। কৃতী পুরুষ। পৃথিবী মানে শুধু মানুষ নয়, জীবজন্তু, প্রকৃতি। আর পৃথিবীর সঙ্গে যদি তোমার ঘৃণার সম্পর্ক হয়, তাহলে অন্যভাবে তুমি যত সফলই হও, পৃথিবী তোমার কাছে আর স্বর্গ থাকবে না। হয়ে যাবে নরক।’ শিক্ষকমহাশয় বারে বারে ইংরেজি করে বলেছিলেন, ‘ইউ অ্যাণ্ড ইওর ওয়ার্লড।’
শঙ্কর সেই শিক্ষাটিই মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছে। প্রথম প্রথম অভ্যাস করতে হয়েছে, এখন স্বভাবে এসে গেছে। এখন সে চেষ্টা না করেও ভালোবাসতে পারে। কোনো কারণ ছাড়াই আনন্দে থাকতে পারে, আনন্দ বিলোতে পারে। শঙ্কর যে বাজারে বাজার করে, সেই বাজারের বাইরে চাষীরা এসে বসে। তারা কিছু সস্তায় আনাজপাতি দেয়। শঙ্কর তাই অকারণে ভিতরের বাজারে ঢোকে না। ভিতরে সব পয়সাঅলা লোকের তান্ডব। কেউ অসময়ের কপি কিনছে, কেউ কিনছে টোম্যাটো। কারো আবার বিট-গাজর না হলে চলে না। বইয়ে পড়েছে, বিট-গাজরে হেলথ ভালো হয়, আর যায় কোথায়। পুলিসের আস্তাবলে ঘোড়া গাজর খাচ্ছে, এদিকে গুপীবাবুও খাবার টেবিলে বসে গাজরের স্যুপ খাচ্ছেন। মুখ চোখ দেখলে করুণা হয়, মনে হয় সতীদাহর বদলে পতি-দাহ হচ্ছে!
শঙ্কর দূর থেকে দেখলে, ফুলের দোকানের সামনে বেশ যেন একটা গন্ডগোল মতো হচ্ছে। ছোটাখাটো একটা ভিড় জমে গেছে। শঙ্কর দোকানটার পাশ দিয়ে যেতে যেতে দেখলে, গোলমালটা হচ্ছে আরতির সঙ্গে। ফুলঅলার গলাই বেশি কানে আসছে। শঙ্কর প্রথমে ভেবেছিল নাক গলাবে না। মেয়েদের ব্যাপারে সে মাথা ঘামাতে চায় না। কখন কী হয়ে যায়। মন নয় তা মতিভ্রম। কোনোভাবে একবার খপ্পরে পড়ে গেলেই সংসার। তখন কামিনী-কাঞ্চনের দাসত্ব। মেয়েরা মানুষের সত্তা হরণ করে। নাকে দড়ি বেঁধে সংসারের ঘানিতে জুতে দেয়। এত ভেবেও শঙ্কর না এগিয়ে পারল না। পাশ থেকে সে আরতির মুখটা দেখতে পেল। ধারালো, অভিজাত একটি মুখ। টিকোলো নাক। ঘাড় পর্যন্ত লম্বা রেশমের মতো চুল। আরতিকে বাইরের আলোয় আরও ফর্সা দেখায়। টান টান পাতলা দেহত্বকের ভেতর থেকে রক্তের আভা বেরিয়ে আসে। সাধারণ বাঙালি মেয়ের চেয়ে দীর্ঘকায়। শরীরের কোথাও অপ্রয়োজনীয় মেদ নেই। শঙ্করের মনে হচ্ছিল, সে যেন শাড়ি পরা একটা জিপসি মেয়েকে পাশ থেকে দেখছে। মুখে ফুটে আছে অসহায় একটা বিরক্তির ভাব। আরতি কথা বলছে খুবই নীচু স্বরে, ফুলঅলা চিৎকার করছে গাঁক গাঁক করে। আরতির বিব্রত আর বিরক্ত মুখ দেখে শঙ্করের খুব করুণা হল। এই শ্রেণির মানুষের কাছ থেকে শঙ্কর সরে থাকতেই চায়। অবস্থা থেকে পতন হলেও, আরতিরা ক্যাপিট্যালিস্ট মনোবৃত্তির মানুষ। বাবা ছিলেন শিল্পপতি। বহুলোক কাজ করত তাঁর কারখানায়। তিনি ডাণ্ডা ঘোরাতেন। দুর্ব্যবহার করতেন। ন্যায্য দাবি থেকে তাদের বঞ্চিত করতেন আজ জার্মানি। কাল প্যারিস করে বেড়াতেন। বিলিতি সুরার সঙ্গে মোলায়েম চিকেন খেতেন। শ্রমিকের রক্ত শোষণ করতেন।
এই অবধি শুনে চিত্রপরিচালক আর প্রযোজক দু-জনেই চিৎকার করে উঠলেন, ‘মারো ফ্ল্যাশব্যাক। লোকটাকে তুলুন বিছানা থেকে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটা চরিত্র বিছানায় শুয়ে থাকলে চলে। স্রেফ শুয়ে শুয়ে আর কোঁত পেড়ে পয়সা নিয়ে যাবে। তা ছাড়া স্টোরির এই জায়গায় একটা অবৈধ প্রণয়ের স্কোপ আছে।’
কথা বলছিলেন প্রযোজক। দশটা কোল্ড স্টোরেজের মালিক। চারটে পশ্চিম বাংলায়। সেখানে পা থেকে মাথা পর্যন্ত হরিপাল আর তারকেশ্বরের আলু। আলুর একেবারে এক্সপার্ট। কোন আলু কখন পচবে, একবার উঁকি মেরেই বলতে পারেন। এম. পি.-তে দুটো কোল্ড স্টোর। সেখানে শুধু ডিম। ইউ পিতে আপেল। একসময় উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা ছিল শিরা কেটে খানিক রক্ত বের করে দেওয়া। প্রযোজক ভদ্রলোকের তহবিলে কিছু কালো রক্ত জমেছে। সেই রক্ত কিঞ্চিৎ ঝরাবেন। নায়ক-নায়িকাদের সঙ্গে একটু গা ঘষাঘষি করবেন। প্রতিষ্ঠিতরা তেমন পাত্তা দেবেন না। নতুন মুখ আনবেন।
ঠিক তাই। প্রযোজক পরিচালককে বললেন, ‘আরতির ক্যারেকটারটা বেশ ফুটছে। আপনি কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দিন—আমাদের নতুন বাংলা ছবির জন্যে নতুন নায়িকা চাই। যাঁদের চেহারা জিপসিদের মতো। কোমর সরু, পিছন ভারি, বুক উঁচু, ছবি সহ আবেদন করুন। ফুল সাইজ। সামনে থেকে, পিছন থেকে, পাশ থেকে।’
পরিচালক বললেন, ‘তারপর আমি প্যাঁদানি খেয়ে মরি। দমদম সেন্ট্রাল জেলে গিয়ে লপসি আর ধোলাই দুটোই একসঙ্গে খাই। নতুন মুখ আজকাল আর পেপার পাবলিসিটি দিয়ে হয় না। দিনকাল বিগড়ে গেছে। ট্যালেন্ট সার্চ করতে হয়। বড়ো বড়ো হোটেল রেস্তোরাঁয় রোজ দুপুর থেকে বন্ধ হওয়া পর্যন্ত গিয়ে বসে থাকতে হয়। বিশ-তিরিশ হাজার খরচ হয় হোক, কিন্তু উঠে আসবে একটা নতুন মুখ।’
‘আপনার মশাই সবেতেই টাকা ওড়াবার ধান্দা।’
‘এই লাইনটাই যে ওড়বার আর ওড়াবার।’
পরিচালক আমাকে বললেন, ‘আমার একটা সাজেসান আছে। আপনি ফুলের দোকানের বদলে ওনাকে তরমুজের দোকান করে দিন। আমার একটু সুবিধে হয়।’
‘কি আশ্চর্য! আপনার সুবিধে! আরতির আজ একটা ফুলের মালার প্রয়োজন যে। তার বাবার আজ জন্মদিন। তা ছাড়া এটা কি তরমুজের সময়। আম চলে গেছে। আপেল ঢুকছে। আঙুর আসছে। কমলালেবু পাকছে।’
‘আপনাকে সে নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না। আই সে তরমুজ, অ্যাণ্ড দেয়ার শুড বি তরমুজ। লাল লাল অজস্র গোল, গোল তরমুজ ডাঁই হয়ে আছে। তরমুজ হল সেক্সসিম্বল। আমি আমার ক্যামেরার অ্যাঙ্গল থেকে ভাবছি। একটা সাইড থেকে ধরছি। কিছু তরমুজ ফোকাসে, কিছু অফ ফোকাসে। কাঁধকাটা গেঞ্জি পরা তরমুজঅলার চকচকে পুরুষ্ট কাঁধ, বাহু, ঘাড়, গলায় একটা লকেট। চোখ দুটো কমলাভোগের মতো। ক্যামেরা ধীরে ধীরে প্যান করছে। তরমুজঅলার ছাপকা ছাপকা নীল লুঙ্গি। তার আড়ালে স্তম্ভের মতো ঊরু। ক্যামেরা ঘুরছে, সামনে দাঁড়িপাল্লা, তরমুজ, তরমুজ, আরতির বুক। ক্যামেরা আরতির গা চেটে চেটে উঠছে ওপর দিকে। ঘাড়, গলা, চিবুক, মুখ, চুল, ব্যাকলাইটে সিল্কের কেশরের মতো, চুল বেয়ে আবার নীচে, পিঠ, নিতম্ব, ক্যামেরা ব্যাক করছে, আরতির, পুরো শরীর, সামনে তরমুজ, তার পাশে তরমুজঅলার অশ্লীল মুখ। ক্যামেরা টপে। আরতির ব্রেস্টলাইন, বুকের কাছে মোমপালিশ করা লাল একটা তরমুজ, ফর্সা টুকটুকে হাতে ধরে আছে। শর্ট ডিজলভ। এক গেলাস লাল তরমুজের সরবত নিয়ে আরতি এগিয়ে আসছে, শঙ্কর বসে আছে সোফায়। আরতি স্লো-মোশানে আসছে। তার ম্যাকসি আর চুল বাতাসে উড়ছে। সে স্লো-মোশানে এসে তুলোর মেয়ের মতো শঙ্করের সোফার হাতলে শরীরে শরীর ঠেকিয়ে বসে পড়ল। বাঁ-হাত শঙ্করের কাঁধে, ডান হাতে পাতলা গেলাস। গেলাসে লাল তরমুজের সরবত। এইখানে একটা গানের স্কোপ। গজল টাইপের গান, ফুরোবার আগে পান করে নাও থ্যাঁতলানো যৌবন। আর কদিনই বা পৃথিবীতে আছি, বলো না আলাদিন। আলাদিন। এইখানে ইকো লাগাবো। একেবারে ফেটে যাবে। এদিকে গান আর নাচ চলেছে। ওদিক থেকে মরা মাছের মতো তাকিয়ে আছে বৃদ্ধ দুটো চোখ। ইনভ্যালিড বুড়ো বাপ দেখছে মেয়ের রঙ্গ। শরীর পুড়ে গেছে। কথা সরে না মুখে; কিন্তু স্মৃতি আর চেতনা দুটোই কাজ করছে। ফের এগেন ফ্ল্যাশ-ব্যাক। আরতির মা বাতাসে উড়তে উড়তে আসছে, ব্যালে ড্যান্সারের পোশাক পরে। বাংলা ছবিতে ব্যালে আমিই প্রথম চালু করব। আরতির ডবল রোল। একবার মা, একবার মেয়ে। মেয়েকে দেখে বাপের মেয়ের মায়ের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। এক ঢিলে দু-পাখি। কায়দা করে বুড়োর ললিতা কমপ্লেক্স দেখানো হয়ে গেল।’
প্রযোজক বললেন, ‘আর শঙ্করকে দিয়ে অত ভাবিয়েছেন কেন? সিনেমায় ভাবনার কোনো স্কোপ নেই। কেবল অ্যাকসান, অ্যাকসান।’
‘সে তো আপনার দিক। আমাকে তো গল্পটা আগে ছাপাতে হবে। সাহিত্য একটু জীবনদর্শন, চিন্তাভাবনা, এসব চায়। প্রুস্ত-এর নাম শুনেছেন? সেই ভদ্রলোকের লেখায় শুধুই ভাবনা। ভাবতে ভাবতেই শেষ। আগে আমাকে সাহিত্যের কথা ভাবতে হবে। আপনারা তো প্রথমে আমাকে পাঁচ-শোটি টাকা ছুঁইয়ে সরে পড়বেন, তারপর তো আপনাদের আর টিকির দেখা পাওয়া যাবে না।’
‘ওটা আমাদের লাইনের একটা রীতি। লেখককে বলি দিয়ে আমাদের শুভমহরত হয়। প্রাচীনকালে কী প্রথা ছিল জানেন, ব্রিজ তৈরির সময় নরবলি দেওয়া হত। একটাকে মেরে আরও হাজারটা মৃত্যু ঠেকানো। ব্রিজও বড়ো কাজ ফিল্মও বড়ো কাজ। বিশ, তিরিশ লাখ টাকা গলে যাবে।’
‘আপনার বাজেট চল্লিশ, পঞ্চাশ লাখ, আর লেখক বেচারার পাওনা পাঁচ-শো। কী বিচার মাইরি আপনাদের!’
‘না, পাঁচ-শো নয়। আপনাদেরও তো পয়সার খাঁকতি কম নয়। কচলাকচলি, ধস্তাধস্তি করে সেই হাজার পাঁচেকেই গিয়ে ঠেকে। সেকালের সাহিত্যিক তো আর নেই। তাঁরা সাহিত্যটাই বুঝতেন। আপনারা সাহিত্য বোঝেন না, কেবল বোঝেন টাকা আর পুরস্কার। শেম! শেম! সাহিত্য-সেবা করুন। সরস্বতীর সেবা, লক্ষ্মীর সেবা নয়। তিন পাতা, কী লিখলেন তার ঠিক নেই, আধবোতল হুইস্কি উড়ে গেল।’
প্রযোজক বললেন, ‘আমি আর একটা জায়গায় সাংঘাতিক রকমের সেক্স, রেপ, ভায়োলেন্স দেখতে পাচ্ছি। কড়া মশলা। অপুর মা। মধ্যবয়সী এক মহিলা। আট কি ন-বছর বয়সের একটা ছেলের মা। সাবেককালের একতলা একটা বাড়ি। গাঁথনির ইঁট সব ফাঁক ফাঁক হয়ে গেছে। সেই ইটের ফাঁকে আটকে ঝুলছে সাপের খোলস। তার মানে ভিটেতে বাস্তু সাপ বসে আছে ঘাপটি মেরে। সাপের খোলস দেখলেই গা শিরশির করে। সেই শিরশিরে ভাবটা এসট্যাবলিস করতে হবে। খোলস দুলছে বাতাসে, বাতাসে দুলছে শাড়ি। প্রতীকী ব্যাপার। সাপ এখনও আছে। ছোবল এখনও মারতে পারে। সিনেমার প্রতীকী শট হল, আপনাদের সাহিত্যের ভাবনা। মহিলার ভরাট শরীর, যাকে বলে রাইপ যৌবন। সুন্দরী তো বটেই। ডিসপেপটিক নয়। স্বামীর মৃত্যুর পর অনেক বছর হয়ে গেছে। স্মৃতি ফেড আউট করেছে। শরীর শরীরের ধর্ম পালন করতে চায়। মন আনচান করে। সব শাসন ছিঁড়ে যেতে ইচ্ছে করে। যত রাত বাড়ে শ্বাস ততই দীর্ঘ হয়। জ্বর নয়, জ্বর-জ্বর লাগে।’
‘এ তো আপনার সাহিত্য!’
‘সাহিত্য তো বটেই। এক সময় আমিও লিখতুম মশাই। আলুতে আমাকে শেষ করে দিয়েছে।’
‘সাহিত্য পর্দায় আসবে কী করে। পিছন থেকে কমেন্ট্রি হবে। ভারি গলায় কোনো শ্রেষ্ঠ আবৃত্তিকার পাঠ করে যাবেন, এঁর বগলে থার্মোমিটার দিলে জ্বর উঠবে না, কিন্তু সূর্য পশ্চিম আকাশে নেমে যাবার সঙ্গেসঙ্গেই এঁর জ্বর লাগে। আড়মোড়া ভাঙতে ইচ্ছে করে।’
প্রযোজক চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। মুখে হুইস্কির গন্ধ হালকা হয়ে এসেছে। বুকের কাছে বিলিতি গন্ধ ছুঁড়েছিলেন, সেই গন্ধে শরীরের গন্ধ মিলে, মানুষের জীবনের বেঁচে থাকার বিচিত্র এক সুবাস তৈরি হয়েছে।
‘কি হল মশাই?’
‘আপনাকে এখুনি পাঁচ-শো টাকা অ্যাডভানস করে যাব; এ স্টোরি আমার চাই।’
‘আপনার এই আকস্মিক উত্তেজনার কারণ?’
‘উঃ, অসাধারণ একটা কথা আপনি বললেন, ‘আমায় গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।’
‘কী কথা মশাই?’
‘ওই যে বগল আর থার্মোমিটার। সুন্দরী এক মহিলা নিজের বগলে নিজে থার্মোমিটার গুঁজছেন। ভাবতে পারেন দৃশ্যটা? আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে। দৃশ্যটা সামনে করিয়ে এখুনি দেখতে ইচ্ছে করছে।’
প্রযোজক উত্তেজনায় চেয়ার মিস করে ধুপ করে মেঝেতে বসে পড়লেন। সেই অবস্থায় থেকেই বললেন, ‘ডিরেক্টার, এই রোলটা কে নেবে? কাকে দেওয়া যায়? সেই যে সেই মহিলা, কী যেন একটা ছবিতে করলেন, বিবাহিতা হয়েও ফোটোগ্রাফারের সঙ্গে লড়ালড়ি।’
‘বুঝেছি। ভালো হবে।’
‘তুমি তা হলে বুক করে ফেলো। যত টাকা লাগে। যদ্দিন আমার আলু আছে, তদ্দিন আমার টাকার অভাব নেই। কোথায় পাওয়া যাবে তাকে?’
‘বোম্বাই।’
‘তুমি আজই ফ্লাই করো।’
পরিচালক বললেন, ‘ফুলটাকে তাহলে তরমুজ করে দিন। আমি একটা বিউটি অ্যাণ্ড দি বিস্ট ধরনের মারাত্মক শট দিয়ে বাংলার কেন, সারা বিশ্বের চিত্রজগৎকে স্তম্ভিত করে দেবো।’
প্রযোজক বললেন, ‘তরমুজের বদলে আলু করলে হয় না! আমার খরচ তা হলে কমে।’
‘ধুর মশাই, আলুর কোনো গ্ল্যামার নেই। কালার ফিল্মে আলু যায় না। তরমুজ হল ইতালির জিনিস। ইতালি মানে সোফিয়া লোরেন, ব্রিজিৎবার্দো। ডিরেক্টার আমি না আপনি?
‘আমি প্রযোজনা না করলে তোমার পরিচালনা হয় কী করে?’
‘আর আমি ভালো ছবি না করে দিলে, আপনার বিদেশ যাওয়া হয় কী করে? আলু করে তো আর ফরেন যাওয়া যায় না।’ প্রযোজক একটু দমে গেলেন। ব্রিফকেস খুলে ময়লা ময়লা পাঁচটা এক-শো টাকার নোট বের করে আমার হাতে দিতে দিতে বললেন, ‘আলুর আড়তে নোট এর চেয়ে পরিষ্কার হয় না। আপনি বগল আর থার্মোমিটারটা ঠিক করুন। আর একটা জায়গা আপনি কামাল করে দিয়েছেন, সেটা হল সেলাই মেশিন। উঃ আপনার মাথা মশাই। মাথা না বলে হেড বলাই ভালো।’
‘সেলাই মেশিন পেলেন কোথায়!’
‘কি আশ্চর্য, এই আপনার হেডের প্রশংসা করলুম। অপুর মা টেলারিং করবে। শঙ্কর জয়েন করবে, এইরকমই তো ঠিক হল।’
‘গল্প সেদিকে যায় কিনা দেখি। এখনো তো ফুলের দোকানেই আটকে আছে।’
‘যায় মানে! যাওয়াতেই হবে। অপুর মা জোরে জোরে সেলাইকল চালাচ্ছে, শঙ্কর ঠিক উলটো দিকে মেঝেতে বসে আছে। এইখান থেকেই স্টোরিতে শঙ্করের পতনের শুরু। দুটো গোল গোল পা আর ভারি ঊরু মেশিনের তালে তালে নাচছে। শঙ্করের মনও নাচছে। নামছে, নীচের দিকে নামছে। ক্যাবারে ড্যান্সারের পোশাকের মতো আদর্শ খুলে খুলে পড়ে যাচ্ছে।’
পরিচালক বললেন, ‘বাকিটা আমার হাতে ছেড়ে দিন। এই শটেও আমি ফ্র্যাকচার করে দেবো। মেশিনের চাকা ঘুরছে, চাকা ঘুরছে। ক্যামেরা ক্লোজ ফোকাসে ঘুরন্ত চাকা ধরছে। চাকা ধীরে ধীরে থেমে আসছে, আর সেই চাকার ভিতর দিয়ে টাইট-ফোকাসে দু জোড়া পা, মেঝেতে, জড়াজড়ি, ঘষাঘষি, মহিলার কলাগাছের কান্ডের মতো পায়ের অনেকটা ওপরে শাড়ির কালো ফিতে-পাড়। একটা হাত, মাথার পাশে মাথা, আর একটা হাত, একটা বড় কাঁচি, ক্লোজআপে।’
প্রযোজক বললেন, ‘এইবার আমার হাতে ছেড়ে দাও। কাঁচিটাকে আরও ক্লোজ-আপে নিয়ে এসো। উলটো দিকের দরজাটা অল্প ফাঁক হল। একটি কিশোরের মুখ। বড়ো বড়ো চোখ। চোখ ভরা বিস্ময়। ছেলেটি আততায়ীর মতো ঢুকছে। পায়ে পায়ে এগোচ্ছে কাঁচিটার দিকে। নীচু হয়ে তুলে নিল কাঁচিটা। তারপর ক্যামেরার ভিসানে একটা তালগোল পাকানো দৃশ্য। একটা হাত উঠল। একটা কাঁচি। ভীষণ একটা চিৎকার। সেলাই মেশিনটা উলটে পড়ে গেল। শঙ্কর উপুড় হয়ে আছে। তলায় অপুর মা। শঙ্করের পিঠে বড়ো কাঁচিটার আধখানা ঢুকে আছে। আর রক্ত-ভেজা সেই পিঠে মুখ গুঁজে অপু হাপুস কাঁদছে আর বলছে, শঙ্করদা, শঙ্করদা তুমি আমার শঙ্করদা। আর শঙ্কর ওই অবস্থায় ফ্যাঁসফেঁসে গলায় বলছে, অপু, তুই ঠিক করেছিস, তুই ঠিক করেছিস, তোকে কেউ বুঝবে না, তুই পালা। তুই সোজা পালিয়ে যা। তা না হলে তোকে পুলিসে ধরবে। অপু উঠে দাঁড়াল। ভয়ে ভয়ে তাকাল এদিকে ওদিকে। তারপর হঠাৎ দু-হাতে দরজাটা ঠেলে খুলে, পাগলের মতো ছুটতে লাগল আর চিৎকার, ‘আমি খুন করেছি, আমি খুন করেছি।’
পরিচালক বললেন, ‘এইবার আমার হাতে ছেড়ে দিন। লম্বা, সোজা রাস্তা ধরে অপু ছুটছে, ছুটতে ছুটতে অপু হোঁচট খেয়ে ছিটকে পড়ে গেল। বিশাল একটা লরি আসছিল স্পিডে। চাকার সামনে অপুর মাথা। ব্রেক। স্ত্রী-ই-ই-চ শব্দ। অপুর ঘুম ভেঙে গেল। বিছানা। পাশে হাত রাখল। মা নেই। অপু বোঝার চেষ্টা করছে।’
প্রযোজক বললেন, ‘আগের শটটাকে স্বপ্ন করে দিলে?’
‘তা কী করব! মাঝরাস্তায় হিরোকে মেরে দেবো! তাহলে বই তো মার খেয়ে ভূত হয়ে যাবে। চুপ করে শুনুন। এইবার রিয়েল খেল। অপুর কানে একটা শব্দ আসছে। যেন কোথাও দুটো সাপ ফোঁস ফোঁস করছে। অপু বিছানায় উঠে বসল। ঘর অন্ধকার। একটামাত্র জানালা খোলা। সেই খোলা জানালায় রাতের আকাশ। দূরে কোথাও একটা কুকুর কাঁদছে। অপু বসে আছে চুপ করে। সেই ফোঁস ফোঁস শব্দটা এখনো কানে আসছে। ক্যামেরা একবার বাড়িটার বাইরে ঘুরে গেল। জনপদ নিদ্রিত। অনেক উঁচু একটা বাড়ির সর্বোচ্চ তলের একটি ঘরে জোরালো আলো। একটা মানুষের সিল্যুয়েট। অপুদের বাড়ির ইঁটের ফাঁক থেকে বেরিয়ে আসা হিলহিলে সেই সাপের খোলসটা বাতাসে দুলছে। পাশের বাড়ির টিভির অ্যান্টেনায় প্রায় টাটকা একটা ঘুড়ি বাতাসে বনবন ঘুরছে। তার পাশেই একটা বাড়ির কবজা ভাঙা জানালার পাল্লা যেন ভূতে দোলাচ্ছে। ক্যামেরা আবার ফিরে এল ঘরে। অপু বসে আছে মশারির ভেতরে। সেই ফোঁস ফোঁস শব্দ। অপু মশারি তুলে নেমে এল। অন্ধকারে হাতড়াতে হাতড়াতে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। খোলার চেষ্টা করল। বাইরে থেকে বন্ধ। তিন-চারবার টানাটানি করল। অপু কাঁদো কাঁদো গলায় ডাকল, মা, ওমা, তুমি কোথায়! অপু বন্ধ দরজার সামনে বসে পড়ল। ফোঁস ফোঁস শব্দটা থেমে গেল। ক্যামেরা চলে এল ঘরের বাইরে। অন্ধকার প্যাসেজে দানবের মতো একটা লোক অপুর মাকে ভাল্লুকের মতো জড়িয়ে ধরে আছে। অপুর মা প্রাণপণ চেষ্টা করছে নিজেকে ছাড়াবার, ছাড়ুন, ছাড়ুন ছেলেটা উঠে পড়েছে। লোকটা জড়ানো গলায় বলছে, শালাকে একদিন গলা টিপে শেষ করে দেবো। শয়তানের বাচ্চা! তোমাকে আমি এখন ছাড়তে পারব না। অপুর মা লোকটাকে ঠেলে সরাবার চেষ্টা করছে। লোকটা বলছে, তোমাকে আমি দোকান করার জন্যে পঁচিশ হাজার টাকা দেব অমনি অমনি! তুমিও মাল ছাড়ো আমিও মাল ছাড়ি। অপুর মা লোকটাকে কামড়ে দিল। লোকটা নেশার ঘোরে অপুর মায়ের গলাটা দু-হাতে চেপে ধরল। অপুর মা একটা শব্দ করল। অপু দরজা ঝাঁকাচ্ছে। চিৎকার করছে। লোকটা অন্ধকারে রাস্তায় নামলো। টলতে টলতে এঁকেবেঁকে চলেছে। তিনটে বাড়ি পরে, রকে একটা লোক শুয়েছিল। সে মাথার চাদর সরিয়ে লোকটাকে দেখে নিল। কানে আসছে কিশোরের গলার মা-মা ডাক। দরজা ঝাঁকাবার শব্দ। শব্দের পর শব্দ। দরজা, জানালা খোলার শব্দ। সারা পাড়া জেগে উঠেছে। অপুদের বাড়ির সামনে ভিড় জমে গেছ। তিনটি সাহসী ছেলে ভিতরে ঢুকছে। ক্যামেরা ফলো করছে। তিনধাপ সিঁড়ি! দালান। একজনের পায়ে লেগে একটা বোতল ছিটকে চলে গেল। সে বলে উঠল, শালা! সে আরও দু-ধাপ এগিয়ে কীসে লেগে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। পড়ে পড়েই সে চিৎকার করতে লাগলো, মার্ডার, মার্ডার! যে দুজন পিছনে ছিল, তারা ওরে বাব্বারে বলে ছুটে বাইরে চলে গেল। অপু সমানে মা, মা, করে যাচ্ছে। কাট! পুলিসের জিপ আসছে। শেষ রাত। তিন-চারজন লাফিয়ে নেমে পড়ল। টর্চের আলো। সকলে ঢুকে গেল ভেতরে। ক্যামেরা অনুসরণ করছে। টর্চের আলো গিয়ে পড়ল অপুর মায়ের মুখে। মহিলাকে গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে। কিছুদূরে গড়াগড়ি যাচ্ছে একটা হুইস্কির বোতল। পড়ে আছে গ্যাস-লাইটার। দালানের আলোটা জ্বালা হয়েছে। সঙ্গে আছে টর্চের আলো। পুলিশ আতিপাতি করে জায়গাটা খুঁজছে। পড়ে আছে সিগারেটের টুকরো। একটা মিনিবাসের টিকিট। দলাপাকানো একটা রুমাল। নতুন, বড় একটা মোমবাতি। আরতির মায়ের হাতের মুঠোয় কয়েকগাছা চুল। পুলিসের অফিসার লাশ তুললে না। খড়ির গুঁড়ো ছড়িয়ে গোটা জায়গাটা বেষ্টন করে দিলেন। একজন পাহারায় রইল। অফিসার জনসাধারণের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘এ বাড়িতে আর কে আছে?’
‘এর একটা ছোটো ছেলে আছে স্যার, ওই ঘরে পুরে বাইরে থেকে চাবি বন্ধ করে দিয়েছে।’
‘চাবি নয় স্যার, ছিটকিনি।’
ক্যামেরা সঙ্গেসঙ্গে দরজায়। সাবেক কালের দরজা। বাঘের মুখ কোঁদা। রং চটে গেলেও বোঝাই যায় ভীষণ পোক্ত। একটা জায়গায় খড়ি দিয়ে বড়ো বড়ো করে লেখা অপু। দরজা খোলা হল। ক্যামেরা পুলিশের দু-পায়ের ফাঁক দিয়ে ঘরের ভেতরে নজর করল। জানালা দিয়ে ভোরের আলো আসছে। ফুলের মতো একটি কিশোর মেঝেতে বসে আছে হামাগুড়ি দিয়ে। কাট। পুলিশ বেরিয়ে আসছে। তাদের মাঝখানে অপু। বাইরে অনেক লোক। তার মাঝে একটা দাড়ি-গোঁফঅলা শক্ত-সমর্থ পাগল। সে হা-হা করে হাসছে, তালি বাজাচ্ছে আর বলছে, ‘কে করেছে খুনখারাবি, সবই আমি বলতে পারি, কে করেছে খুনখারাবি।’ সবাই তাকে দূর দূর করছে—‘বেরো ব্যাটা পঞ্চা পাগলা।’
‘পাগল ছাড়া বাংলা ছবি জমে না। মনে আছে সেই পাগল ধীরাজ ভট্টাচার্য, আই ক্যান ফোরটেল ইওর ফিউচার। কী অসাধারণ অভিনয়, এক পাগলেই পয়সা উসুল!’
আমি সেই ময়লা ময়লা এক-শো টাকার নোট পাঁচটা বের করে প্রযোজক ভদ্রলোকের হাতে দিয়ে বললুম, ‘এই নিন আপনারা দু-জনে হাফাহাফি ভাগ করে নিন, স্টোরি তো আপনারাই করে ফেলেছেন!’
‘আহা রাগ করছেন কেন! একেই বলে তোমার আছে সুর, আর আমার আছে ভাষা। আপনাদের ওরিজিন্যাল স্টোরির তো শেষ পর্যন্ত ওই অবস্থাই হয়, মলাট আর খুদে খুদে অক্ষরে পর্দার গায়ে একটা নাম, এই তো শেষ পরিণতি। ফিল্ম সাহিত্য নয়, ফিল্ম হল ইন্ড্রাস্ট্রি। পয়সা ঢালেগা, পয়সা তোলেগা। আপনাদের সাহিত্য হল অক্ষর সাজাবেন আর নাম কিনবেন। মবলগ যা পাচ্ছেন পকেটে ভরে ফেলুন, কাজে লেগে যান। বাকিটা আমরা ফ্ল্যাশব্যাক করে ড্রিমে সেক্স ভরে নামিয়ে দেবো। লিখতে বসার সময় স্লাইট একটু ঢুকু করে নেবেন, দেখবেন অটোমেটিক মাল বেরিয়ে আসবে। পেটে ডিজেল না ঢুকলে লেখার অটোমোবিল চলবে কীসে!’
দুই মাল বেরিয়ে গেলেন। আমি পয়মাল বসে রইলুম হাঁ করে!
ফুলের দোকানের সামনে আমার শঙ্কর আর আরতি দাঁড়িয়ে। আমার স্বর্গীয় কিশোর অপু এইবার স্কুলে যাবে। তার মা পরিষ্কার সাদা হাফ প্যান্টের ভেতর গুঁজে দিচ্ছে সাদা জামা। অমন দেবীর মতো মায়ের দিকে আমি আর ভালোভাবে তাকাতে পারছি না। বিশ্রী পাপবোধ আসছে। সত্যিই কী শঙ্করকে তিনি দেহের ফাঁদে ফেলবেন? রতন হালদারের পক্ষে অবশ্য সবই সম্ভব। পৃথিবীতে বেশ কিছু গাছ আর প্রাণী আছে, যারা অকারণে গরল ছড়ায়। অনেক বিকল্প খাদ্য থাকা সত্ত্বেও মানুষ নিরীহ মুরগির পালক ছাড়ায় চড় চড় করে। নিজের সুন্দরী স্ত্রী ফেলে বেশ্যালয়ে গিয়ে ধুমসো মেয়েছেলের গোদা পায়ের লাথি খায় পয়সা খরচ করে। এই যেমন কারণাসক্ত ব্যবসাদার দু-জন, আমার চোখ দুটো ঘোলা করে দিয়ে গেল। যেন আমার জণ্ডিস হয়ে গেল! শঙ্কর রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ ভাবাশ্রিত। পরোপকারী। প্রকৃতিপ্রেমী। বিশ্বপ্রেমী। যার জীবনের আদর্শই হল নি:স্বার্থ সেবা, তাকে কেমন করে আমি অপুর মায়ের পায়ের সামনে বসাই! লোক দুটো কী সাঙ্ঘাতিক বদ! কী বিশ্রী রুচি-বিকৃতি নিয়ে সমাজে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে! মেশিনের সামনে আমার শঙ্করের মতো ছেলেকে বসতে হবে। সে বসে বসে দেখবে দুটো পৃথুল পা নাচছে। আমিও এক মহাপাপী। যে বই আমার পড়া উচিত নয়, সাইকোলজি, সেই বই পড়ে জেনেছি, সেলাই মেশিনে পা দিয়ে চালাতে চালাতে মেয়েদের এক ধরনের দৈহিক উত্তেজনা হয়, তখন তাদের পা আরও দ্রুত চলতে থাকে। যে কারণে মেয়েদের পা-মেশিন চালানো বারণ। শঙ্করকে বসে বসে এই দৃশ্য দেখতে হবে। দেখতে দেখতে উত্তেজিত হতে হবে। তার উচ্চ মানস-ভূমি থেকে ধপাস করে পড়ে যেতে হবে। এক ভদ্রমহিলা খোলা গায়ে বগলে থার্মোমিটার লাগাচ্ছেন। সেখানেও সেক্স। এরপর কোনো মহিলা দাঁতে টুথব্রাশ ঘষছেন, সেখানেও সেক্স। দেখার কী দৃষ্টি! আমার নিজেরই ভয় লাগছে এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে!
শঙ্কর এগিয়ে গেল ভিড় সরিয়ে। ঝগড়া শুনতে অথবা মিটমাট করতে নয়, ভিড় জমেছে আরতিকে দেখতে। এমন রূপসী মেয়ে এ-তল্লাটে নেই। এই লোকগুলোকেই বা আমি কী বলবে! সব বয়েসেরই মানুষ আছে। আরতিকে চোখ দিয়ে গিলছে। কেউ চোখ দিয়ে কোমর ধরেছে, কেউ ধরেছে নিতম্ব, কেউ চেষ্টা করছে বুকটাকে ভালো করে দেখার, যেন কার্ডিয়োলজিস্ট। কেউ তার ফুরফুরে ঘাড় পর্যন্ত লম্বা বাদামি চুলের দিক থেকে নজর সরাতে পারছে না।
ফুলঅলা শঙ্করের পরিচিত। খুবই পরিচিত। একসময় দু-জনে জুভেনাইল ক্লাবে ফুটবল খেলত। শঙ্করকে সামনে দেখে ছেলেটা একটু থতমত খেয়ে গেল। শঙ্কর বললে, ‘এসব কী হচ্ছে, মানিক? জানিস, তুই কার সঙ্গে কথা বলছিস?’
‘মাইরি বলছি শঙ্করদা, আমি দু-টাকা ফেরত দিয়েছি। মাইরি বলছি।’
আরতি তেজালো গলায় বললে, ‘দু-টাকা ফেরত দিলে, টাকা দুটো আমার হাতেই থাকত। টাকা দুটো নিশ্চয় আমি গিলে ফেলেনি! সব কেনার পর আমার হাতে শেষ একটা পাঁচটাকার নোট ছিল। মালার দাম তিন টাকা। দুটো টাকা গেল কোথায়?’
শঙ্কর বললে, ‘মানিক তোর ভুল হচ্ছে। এইরকম ভুল হতেই পারে। তোকে ঠকিয়ে দুটো টাকা নেবার মতো মহিলা ইনি নন।’
‘ভুল তো ওনারও হতে পারে।’
‘হলে টাকাটা ওঁর হাতেই থাকত, কারণ ওঁর বুকপকেট নেই।’
কথা বলতে বলতে শঙ্করের নজর চলে গেল ছোটো একটা বালতির দিকে। ছোট্ট অ্যালুমিনিয়ামের বালতি। সেই বালতিতে রয়েছে একগুচ্ছ গোলাপ ফুল। সেই ফুলগুলোর পাশে, জলে একটা কী ভাসছে। শঙ্কর বললে, ‘ওটা কী?’ তারপর আরতির পাশ দিয়ে হাত বাড়িয়ে নিজেই তুললে। আধভেজা একটা দু-টাকার নোট।
‘মানিক এটা কী? দেখেছিস কিভাবে ভুল বোঝাবুঝি হয়! টাকাটা এখানে পড়ে গেছে। তোর দেখা উচিত ছিল। তা না করে তুই সমানে গলাবাজি করে যাচ্ছিস।’
মানিক হাতজোড় করে বললে, ‘দিদি, আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন।’
‘আপনি আমাকে অনেক যা-তা কথা বলেছেন। শঙ্করদা এসে না পড়লে আপনি এই এতগুলো মানুষের সামনে জোচ্চোর প্রমাণ করে ছাড়তেন। আমার টাকা আর মানসম্মান দুটোই যেত।’
‘এই দেখুন দিদি, আমি কান মলছি। ব্যবসাদার জাতটাই বহত…।’
শঙ্কর বললে, ‘মানিক, আর না।’
আর একটু হলেই মানিকের মুখ ফসকে একটা গালাগাল বেরিয়ে আসত।
শঙ্কর বললে, ‘যান, এবার আপনি সোজা বাড়ি চলে যান।’
আরতির ভেতর সুন্দর একটা ছেলেমানুষী ভাব আছে। যখন হাসে, গালে একটা টোল পড়ে। ভুরুর কাছটা, ঠিক নাকের ওপরের জায়গায় অদ্ভুত একটা ভাঁজ পড়ে যার কোনো তুলনা হয় না। আরতির এই হাসি দেখলে শঙ্কর অবশ হয়ে পড়ে। তার মনে একসঙ্গে অনেক দরজা খুলে যায়। অনেক আলো জ্বলে ওঠে। নানা রঙের কাঁচ বসানো জানালায় রোদ পড়লে যে বর্ণসুষমা হয়, তার মনেও সেইরকম একটা রং খেলা করে। সুন্দরী কোনো নর্তকী পায়ে ঘুঙুর বেঁধে নাচতে থাকে। ভীষণ একটা টানাপোড়েন চলতে থাকে ভেতরে। এক মন বলে, ছি: ছি:, আর এক মন বলতে থাকে, এইটাই তো স্বাভাবিক! শঙ্কর যখন নোট তোলার জন্যে হাত বাড়াচ্ছিল তখন আরতির অনাবৃত কোমরে হাত ছুঁয়ে গিয়েছিল। মসৃণ, ভিজে ভিজে। সারা শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গিয়েছিল। সেই অনুভূতিটা শঙ্কর কিছুতেই ভুলতে পারছে না। তার কেঁদে ফেলতে ইচ্ছে করছে।
আরতি সেই অদ্ভুত হাসি হেসে বললে, ‘আপনি যাবেন না?’
‘আমার তো সবে শুরু হল।’
‘আমি যদি আপনার সঙ্গে থাকি, তাহলে রাগ করবেন?’
‘আমাকে কোনোদিন রাগতে দেখেছেন! আপনার কষ্ট হবে।’
‘আমাকে তুমি বলতে কি আপনার খুব কষ্ট হবে?’
শঙ্কর হেসে ফেলল। তার মনে হচ্ছে, নেশা হয়ে গেছে। কিছু আর ভাবতে পারছে না। শীতের সকালে স্নান করে রোদে দাঁড়ালে যে-রকম একটা সুখ সুখ ভাব হয়, সেইরকম একটা সুখ-বোধ হচ্ছে। শঙ্কর আর আপত্তি করতে পারল না। আরতিকে পাশে নিয়ে চাষীরা যেদিকে বসে সেইদিকে যেতে যেতে বললে, ‘চলো তোমাকে সস্তার বাজারটা চিনিয়ে দি। দাম কম, টাটকা জিনিস।’
‘আমার না অনেক অনেক বাজার করতে ইচ্ছে করে একসঙ্গে। ব্যাগ ভর্তি, ঝুড়ি ভর্তি বাজার।’
‘আমারও করে, তবে আমার বাজেট সাত টাকা। বেশ ভালোই বাবা, বেশি বাজার মানে বেশি বোঝা।’
‘আমার বাজেট মাত্র পাঁচ টাকা। তবে আমি একসঙ্গে তিন দিনের বাজার করি।’
‘তোমার বেঁচে থাকতে কেমন লাগে, আরতি?’
‘যখন আমাদের অনেক কিছু ছিল, তখন খুব একঘেয়ে লাগত; এখন কিন্তু বেশ উত্তেজনা পাই। এই মনে হচ্ছে, বাবার কী হবে! বাবার কিছু হলে আমার কী হবে! আজ গেলে কাল কী হবে, এই ফুরিয়ে গেল কেরোসিন তেল, কে লাইন দেবে! কে যাবে ব্যাঙ্কে ইন্টারেস্ট তুলতে! আপনি বোধহয় জানেন না, আমাদের আবার অনেকদিনের পুরোনো একটা মামলা আছে। তার জন্যে প্রায়ই উকিলের বাড়ি ছুটতে হয়। মামলাটা বেশ মজার। আমাদের ছোট্ট একটা বাগানবাড়ি আছে বারাসতে। সেই বাড়ির কেয়ারটেকার ছিলেন বাবার এক বন্ধু। তিনি বাবার এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে বাড়িটার দখল ছাড়ছেন না। আমি কেস ঠুকে দিয়েছি। কেসটা যদি জিততে পারি তাহলে আমাদের কষ্ট অনেকটা কমবে। যেভাবে আছি সেভাবে থাকা যায় না। তারপর ওই রতন হালদার। এগজিবিসনিস্ট।’
‘সে আবার কী?’
‘সে আপনাকে আমি মুখে বলতে পারব না। যেদিন ধরে জুতোপেটা করব সেদিন বুঝতে পারবেন। আচ্ছা আপনি আমাকে দেখলে অমন মুখ ফিরিয়ে নিতেন কেন? কথা বললে হুঁ-হাঁ করে পালিয়ে যেতেন?’
‘সত্যি কথা বলব, আমার মধ্যে একটু ভন্ডামি আছে, পাকামিও বলতে পারো। বেকার মানুষ তো, কাজের কাজ না পেয়ে নানারকম স্বপ্ন দেখি। সন্ন্যাসী হব, বিরাট সমাজসেবক হব, বন্যাত্রাণে নৌকো নিয়ে ভেসে পড়ব, দন্ড-কমন্ডলু নিয়ে চলে যাব কৈলাস। এই সব মাথায় ঢোকার ফলে মেয়েদের ভীষণ ভয় পাই। যদি কোনোভাবে আটকে যাই! নিজের খাবার জোগাড় নেই, তার ওপর সংসার!’
‘মেয়েরা কী পুরুষজীবনের বাধা?’
‘সংসারজীবনের নয়, সন্ন্যাসজীবনের বাধা তো বটেই।’
‘সন্ন্যাসী কেন হবেন? সংসারে কোনো কাজ নেই? এই যে আপনি একগাদা বাচ্চাকে মানুষ করছেন, সারা পাড়াকে আনন্দে মাতিয়ে রেখেছেন, এটা কাজ নয়?’
‘কি বলবো বলো! আমার ভালো লাগে। এখন ধরো আমি যদি সেজেগুজে পক্ষীরাজ মার্কা হয়ে প্রেম করি, আমার এই মনটা হারিয়ে যাবে। আর একটা সত্য কথা বলব, রাগ করবে না, বলো?’
‘নির্ভয়ে বলুন।’
‘তোমাকে আমি ভয় পাই। তুমি এত সুন্দরী, আর তোমার এমন সুন্দর ভাব, তোমাকে দেখলেই আমার ভালোবাসতে ইচ্ছে করে, ভীষণ ভালোবাসতে।’
আরতি শঙ্করের হাতটা মুঠোয় ধরেই ছেড়ে দিল। ছেড়ে দিয়ে বললে, ‘আমিও আপনাকে ভীষণ ভালোবাসি আপনার গুণের জন্যে।’
কথায় কথায় বাজার হয়ে গেল। শঙ্কর আজ আর তার সাত টাকার সীমার মধ্যে নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। ছিটকে বেরিয়ে গেল। অনেক দিন পরে বাজারে শোলাকচু এসেছে। শঙ্করের ভীষণ প্রিয়। ছাঁকা তেলে শোলাকচু ঝুরো করে কেটে ভাজলে ফুলে উঠে যা অসাধারণ স্বাদ হয়!
শঙ্কর বললে, ‘তুমি তো একা! তাই ইচ্ছে থাকলেও অনেক কিছু রাঁধতে পার না। আমার মা আছে বোন আছে। ভীষণ ভালো রাঁধেন আমার মা। তোমাকে আজ আমি তাঁর রান্না খাওয়াব। খাবে তো?’
‘নিশ্চয় খাব। তাহলে আজ আমি বাবার স্যুপটা করব, আর কিছু করব না। আমার তৈরি স্যুপ খুব খারাপ হয় না। আপনি একটু টেস্ট করবেন?’
‘না গো, আমি তো একা কিছু খেতে পারি না। সকলকে দিতে গেলে তুমি কুলোতে পারবে না। আর একদিন হবে।’
দু-জনে বাড়ি ফিরে এসে অবাক! আরতিদের ঘরের সামনে ছোটোখাটো একটা জমায়েত। শঙ্করের মা ঘরের ভেতরে। শ্যামলী বাইরে যাবার জামাকাপড় পরেও বেরোতে পারেনি। আরতিদের ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে। হাতে একটা ভিজে তোয়ালে। শঙ্কর মাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে মা?’
‘ঘরে একটা শব্দ হল, এই তোরা আসার এক মুহূর্ত আগে। ছুটে এসে দেখি এই ব্যাপার।’
করুণাকেতন পড়ে আছেন মেঝেতে। চিৎ হয়ে। চোখ দুটো ঊর্ধ্বে স্থির। শ্বাস-প্রশ্বাস পড়ছে কিনা সন্দেহ। আরতি রোজ সকালে সাতটার মধ্যে বাবাকে সাজিয়ে-গুজিয়ে দেয়। এক মাথা পাকা চুল। ভিজে তোয়ালে দিয়ে মুছে, পাউডার ছড়িয়ে, সামনে সিঁথি করে আঁচড়ে দেয়। একদিন অন্তর আরতি নিজেই সুন্দর করে দাড়ি কামিয়ে দেয়। আজ ছিল দাড়ি কামাবার দিন। ফর্সা দুটো গাল চকচক করছে। করুণাকেতনের ঠোঁটের পাশ দিয়ে জলের মতো একটু কিছু গড়িয়েছে।
শঙ্কর করুণাকেতনের পাশে হাঁটু মুড়ে বসে বুকে কান পাতল। তারপর ডানহাতটা তুলে নিয়ে নাড়ি চেপে ধরল। একসময় হাতটা ধীরে ধীরে নামিয়ে রাখল। মুখ তুলে তাকাল। প্রথমেই চোখে পড়ল আরতির মুখ। অসাধারণ দুটো চোখ। একেই বলে কাজললতা চোখ। দুটো অপরাজিতা ফুলের পাপড়ি। শঙ্কর এমন চোখ কখনো দেখেনি। এমন নাক সে দেখেনি। যেন অ্যালফ্যানসো আমের আঁটি স্টেনসিলকাটার দিয়ে কেটে তৈরি করেছেন ভগবান স্বয়ং।
শঙ্কর হাঁটু ভাঙা অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়াল মাথা নীচু করে! দু-হাত জোড় করে নমস্কার করল। বুঝিয়ে দিল করুণাকেতন চলে গেছেন। সঙ্গেসঙ্গে আরতি শঙ্করের চওড়া বুকে মাথা গুঁজে দিল। শঙ্করের মা এগিয়ে এসে আরতির মাথার পিছনে হাত রেখে অঝোরে কাঁদতে লাগলেন। শঙ্করের একটা হাত আরতির কাঁধে। আর একটা হাত মায়ের পিঠে। তার দু-হাতে দু-রকম অনুভূতি।
করুণাকেতনকে ধরে বিছানায় তোলা হল। ভদ্রলোক পড়ে যাবার সময় বিছানার চাদরটা খামচে ধরার চেষ্টা করেছিলেন। খাটের ধারে একটা বেড়া ছিল, দুপাশে দুটো ছিটকিনি দিয়ে আটকানো যায়। সেই বেড়াটা কী করে খুলে গেল কে জানে! আরতি জন্মদিনের মালাটা মৃত্যুদিনের মালা করে বাবার বুকে পেতে দিল। আরতি খুব শক্ত মেয়ে। ভিতরে ভাঙলেও বাইরে ভাঙেনি। তার চেহারা যেমন ধারালো, মন আর চরিত্রও সেইরকম ধারালো। শঙ্করের মা আর বোন যতটা ভেঙেছে আরতি ততটা বিচলিত হয়নি। সে জানে, আজ থেকে সে সম্পূর্ণ একা।
শঙ্কর পথে নেমে এল। তার শিশুবাহিনী স্কুলে। পাশে কেউ না থাকলে শঙ্কর তেমন জোর পায় না। বড়ো কেউ হলে চলবে না, ছোটোরাই তার শক্তি। তাদের সঙ্গে বকবক করতে করতেই সে পথ খুঁজে পায়। শঙ্কর তার পরিচিত ডাক্তারবাবুকে ডেকে নিয়ে এল। করুণাকেতনকে যে ডাক্তারবাবু দেখতেন, তিনি কয়েক সপ্তাহের জন্যে ফরেনে গেছেন।
করুণাকেতন যখন ঘরে ফেরার জন্য পথে নামলেন, তখন দিন শেষ হয়ে এসেছে। শঙ্করের শিশুবাহিনী এসে গেছে। মানী লোকের যেভাবে যাওয়া উচিত শঙ্কর ঠিক সেইভাবেই ব্যবস্থা করেছে। ফুলে ফুলে সাজানো পালঙ্ক। শিশুবাহিনীকে সে এখন থেকেই মানুষের যাওয়াটা দেখাতে চায়। যাওয়ার পথ চেনা থাকলে হাঁটতে অসুবিধা হয় না। অপু ফিসফিস করে বললে, ‘তুমি যে বলেছিলে বড়লোকের কোনো সাহায্যে লাগবে না, তাহলে?’
‘এরা বড়লোক নয়, মানীলোক, জ্ঞানী, গুণী, বিজ্ঞানী। জিনিসটা বুঝতে শেখ। আর একমাস পরে তোর গোঁফ বেরোবে গবেট।’
অপুর হাতে খইয়ের ঠোঙা। অপু এই প্রথম শ্মশানে চলেছে। শ্যামল একবার ঘুরে এসেছে। তিন মাস আগে শ্যামলের বাবা আন্ত্রিকে মারা গেছেন। করুণাকেতন চোখে চশমা পরে, আরামে শুয়ে আছেন। মানুষের শেষ যাত্রাটা বেশ আরামেই হয়। রোগযন্ত্রণা চলে গেছে। এই মহানিদ্রায় যদি মহাস্বপ্ন থাকে, সে স্বপ্ন আর ভেঙে যাবার ভয় নেই। শঙ্করের ডাকে, শঙ্করের সমবয়সী আরও চার-পাঁচজন নেমে এসেছে করুণাকেতনকে কাঁধ দেবার জন্যে। মানুষটির জীবন যখন ধনেজনে ভরপুর ছিল তখন বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনের অভাব ছিল না। ফ্ল্যাশব্যাকে করুণাকেতনের জীবন আমি দেখতে পাচ্ছি। তাঁর ইন্ড্রাস্ট্রি, গাড়ি-বাড়ি, ঝাড়লন্ঠন লাগানো বিশাল খাওয়ার ঘর, খানা-টেবিল। দিনরাত অতিথি-অভ্যাগতের আনাগোনা। সুন্দরী, শিক্ষিতা স্ত্রী। শিফনের শাড়ি। বিলিতি সুগন্ধ। অনেক রঙিন বেলুনের গুচ্ছ। তারপর সব একে একে ফাটতে শুরু করল। ঝুলে রইল নিজের জীবনের সরু একটি সুতো।
প্রায় ছ-ফুট লম্বা শঙ্কর। কোমরে কোঁচার গাঁট বেঁধে দিশি একটা ধুতি পরেছে একটু উঁচু করে। তার ওপর সাদা ধবধবে একটা গেঞ্জি। চাঁপা ফুলের মতো গায়ের রং। এক মাথা রেশমের মতো চুল। ডান কাঁধে লাল একটা গামছা পাট করা। তার ওপরে খাটের একটা দিক। শঙ্করের পাশে আরতি। সামনে, পিছনে শঙ্করের শিশুবাহিনী। কারোর হাতে এক গোছা জ্বলন্ত ধূপ। কেউ ছড়াচ্ছে ফুল। কেউ ছড়াচ্ছে খই আর পয়সা। শবযাত্রা সুগম্ভীর কবিতার মতো এগিয়ে চলেছে শ্মশানের দিকে। যে শাড়ি পরে আরতি সকালে বাজারে গিয়েছিল, সেই শাড়িটাই পরে আছে। আজ আর দুটি পরিবারে হাঁড়ি চড়েনি। শঙ্কর আজ আরতিকে মায়ের হাতের ঝিঙে- পোস্ত আর শোলাকচু ভাজা খাওয়াতে চেয়েছিল। ভাগ্যের কী পরিহাস, প্রতিটি মানুষ এক একটি ঘড়ি। জন্মের সঙ্গেসঙ্গেই সেই ঘড়ি চলতে থাকে টিকটিক করে। দমে ক-বছরের পাক মারা আছে তা একমাত্র ঈশ্বরই জানেন। আরতি পায়ে পায়ে সামনের দিকে এগোলেও মনে মনে সে চলেছে পেছন দিকে। মাকে তার স্পষ্ট মনে আছে। বিচিত্র এক মহিলা। রূপটাই ছিল, গুণ বলে কিছুই ছিল না। ভীষণ অর্থলোভী উচ্ছৃঙ্খল দুর্দান্ত এক মহিলা। রূপের গর্বে, বাপের বাড়ির ঐশ্বর্যের গর্বে একেবারে মটমট করত। কতদিন সে দেখেছে, বাবা গভীর রাতে একা একটা আর্মচেয়ারে বাগানের দিকে বারান্দায় অফিসের জামাকাপড় পরেই বসে আছেন চুপচাপ।পাইপের ধোঁয়া আর নিবছে না। সারা বাড়ি তামাকের গন্ধে থমথম করছে। বসার ঘরে সাদা কাঁচের ডোমে একটিমাত্র দুঃখী-দুঃখী আলো জ্বলছে। মা কোথায় কেউ জানে না। করুণাকেতনের সেই ছবিটাই লেগে আছে আরতির মনে। নি:সঙ্গ, পরিত্যক্ত একটা মানুষ। বাবার টাকাতেই মা স্ফূর্তি করত। বাবার টাকাতেই হীরের আংটি, নাকছাবি, দুল। করুণাকেতন ছিলেন কাজ-পাগলা মানুষ। সত্যেন বোসের সেরা ছাত্র।
শ্মশান-চিতায় শোয়ানো হল করুণাকেতনকে। চেহারার এতকালের রুগ্নভাব কেটে যেন ফুলের মতো ফুটে উঠেছেন। আমি শুধু শঙ্কর আর আরতিকে দেখছি। কে বলবে, এরা একই পরিবারের ভাইবোন নয়! দুজনেই মাথায় প্রায় সমান সমান। শঙ্করের কিশোর বাহিনীর কিশোররা একটা বেদিতে পাশাপাশি বসে, বড়ো বড়ো নিষ্পাপ চোখে সব দেখছে। দুটো চিতা জ্বলছে লাফিয়ে লাফিয়ে। একটাতে এক যুবক অন্যটায় একজন মহিলা। মহিলার দশ-বারো বছরের ছেলেটি হাতে একটা বাঁশের টুকরো ধরে উবু হয়ে বসে আছে জ্বলন্ত চিতার অদূরে। এক বৃদ্ধ বারে বারে ছেলেটিকে বলছেন, ‘নিমু সরে বোস। চিতা থেকে কাঠ গড়িয়ে পড়লে পুড়ে যাবি।’ ছেলেটি সেই কথায় বৃদ্ধের দিকে তাকাচ্ছে, কিন্তু সরছে না। তার চোখের দৃষ্টি স্থির। যেন বরফের দু-ফালি চোখ।
শঙ্করই করুণাকেতনের অনাবৃত দেহে ঘৃত-মার্জনা করল। নিম্মাঙ্গের খন্ড বস্ত্রটি টেনে নেওয়া হল। এইবার মুখাগ্নি। কাঠের পর কাঠ। তার ওপর করুণাকেতন। তার ওপর কাঠ। করুণাকেতনের মুখটি কেবল বেরিয়ে আছে। সেই মুখের ঠোঁট দুটিতে আগুন স্পর্শ করাতে হবে। আরতির হাতে ধরা জ্বলন্ত পাটকাঠি কাঁপছে। শঙ্করই মুখাগ্নি করল। আরতি শঙ্করের কনুইয়ের কাছটা স্পর্শ করে রইল। এইবার চিতার ডান পাশে আগুন ছোঁয়াতেই চিতা জ্বলে উঠল দাউ দাউ করে। করুণাকেতনের দেহ কালো হয়ে উঠছে। আগুনের হাহা হাসি কাঠের গুঁড়ির ফাঁকে ফাঁকে। করুণাকেতনের মাথার তলায় জ্বলন্ত কাঠের বালিশ। মুখটা তখনো অবিকৃত। ওই নিটোল, গোল মাথাটিতে কত পরিকল্পনা ছিল, কত আশা ছিল, ছিল সুখের সন্ধান। একটু পরেই ফেটে যাবে ফটাস করে। তিন চার ঘণ্টা পরে এক মুঠো ছাই। সেই ছাইয়ের নাম করুণাকেতন। কর্মকান্ডের মধ্যে পড়ে রইল, আকাশের তলায় একটা চিমনি। যার মাথাটা আশ্বিনের ঝড়ে মচকে গিয়ে বাতাসে দোল খায়। ভাঙা এক জোড়া গেট। অস্পষ্ট একটা নেমপ্লেট। একখন্ড জংলা জমি। একটা মরচে ধরা বয়লার।
শঙ্কর, আরতি আর তার কিশোরদের নিয়ে গঙ্গার ধারে এসে বসল। আরতি এইবার ভাঙতে শুরু করেছে। শঙ্করের বুকে মাথা রেখে ভিতরে ভিতরে ফুলছে। সকালে আরতির কোমরে হাত ঘষে যাওয়ায় শঙ্করের ভেতরে একটা বেসুর বেজেছিল। এখনকার এই ঘনিষ্ঠতায় তার কিছুই মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে, একই প্রাণ এই দেহে, আর ওই দেহে। এই দেহের নাম শঙ্কর বলে তার ভেতরে আগুন ততটা জ্বলছে না। মৃত্যুকে মৃত্যু বলে মনে হচ্ছে। এই দেহর নাম আরতি, তাই চিতাটা ভেতরেও জ্বলছে। মৃত্যুকে মনে হচ্ছে বিয়োগ, শঙ্করের চিবুকটা ডুবে আছে আরতির চুলে।
অন্ধকার জলধারা সামনে তরতর করছে। ওপারে মিটমিট করছে ঘুমজড়ানো আলোর চোখ। স্লিক স্লিক করে ভেসে যাচ্ছে জেলেডিঙি। কে একজন চিৎকার করে বললে, জোয়ার আসছে। তিনটে নৌকো সঙ্গেসঙ্গে তীর থেকে সরে গেল মাঝগঙ্গায়। বিশাল একটা জেটি এগিয়ে গেছে জলের দিকে। যেন নদীর বুকে স্টেথিসকোপ বসাবে।
অপু হঠাৎ বললে, ‘শঙ্করদা, ওই ওনার খুব কষ্ট হচ্ছে, না?’
‘না রে! ওটা তো দেহ, পুড়ছে। ওতে প্রাণ নেই। তোর জামা প্যান্ট খুলে পুড়িয়ে দিলে কষ্ট হবে?’
‘তাহলে সব কষ্ট প্রাণে?’
‘ধরে নে তাই।’
‘প্রাণটা কোথায় গেল? প্রাণ কেমন করে আসে, কেমন করে যায়?’
‘তোদের ছাদের ঘুলঘুলিতে পাখি কেমন করে আসে, কেমন করে যায়।’
শঙ্কর হঠাৎ তার সুরেলা ভরাট গলায় গেয়ে উঠল—‘এসব পাখি এমনি করে উড়ে বেড়ায় ঘরে ঘরে। একদিন উড়বে সাধের ময়না।’ আরতির মাথা ধীরে ধীরে পড়ে যাচ্ছে নীচের দিকে। ক্লান্তিতে, মানসিক বিপর্যয়ে মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়ল। আরতির মাথা নেমে এল শঙ্করের কোলে। শঙ্করের নাকে এসে লাগল আগুনের গন্ধ। শঙ্কর আবার গান ধরল। প্রায় শেষ রাতে এক পাত্র ছাই হাতে ফিরে এল শ্মশানযাত্রীরা। শেষ রাতে শ্মশানঘাটে গঙ্গাস্নান। আরতি জীবনে গঙ্গার জলে পা দেয়নি। জলে নামতে ভয় পাচ্ছিল। শঙ্কর বলেছিল, ‘আমার কাঁধে হাত রাখো, তোমার কোনো ভয় নেই। আমি তোমাকে ধরছি।’ আরতির কোমরের কাছটা সাবধানে ধরে পিছল পাড় বেয়ে দু-জনে নেমে গেল জলে। গেরুয়া রঙের গঙ্গার জল। কনকনে শীতল। আরতি প্রথমটা ভয়ে শঙ্করকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরেছিল, যেন সে ডুবে যাচ্ছে। এইমাত্র এতগুলো মৃত্যু পাশাপাশি দেখেও আরতির প্রাণভয় গেল না। প্রাণভয় কারোরই যেতে চায় না। জলে ভিজে শাড়ি জড়িয়ে যাচ্ছিল। স্রোতের টানে খুলে যাচ্ছিল আঁচল। আরতির বুকের কাছে দুলছিল লালপাথর বসানো একটা হার। শঙ্কর বলেছিল, ‘হার সামলে! দেখো, খুলে চলে না যায়।’ বলেই তার মনে হয়েছিল, পৃথিবীটা হল বিষয় আর বিষয়ীর। ছোটোখাটো লাভক্ষতির চিন্তাটাই আগে আসে। শঙ্কর মনে মনে গেয়ে উঠেছিল, শ্যানপাগল বুঁচকি আগল কাজ হবে না অমন হলে। শঙ্কর বাচ্চাগুলোকে আর জলে নামতে দেয়নি। তাদের গায়ে জল ছিটিয়ে দিল। আশ্চর্য, একটা বাচ্চারও ঘুম পায়নি। সব কটা সমান উৎসাহে বড়োদের সঙ্গে লেগে আছে। ঘটি ঘটি জল এনে চিতায় ঢেলেছে। কেবল সবকটাকেই একটু বিষণ্ণ আর মনমরা দেখাচ্ছে। শঙ্কর এইটাই চেয়েছিল। শঙ্কর আরতি দু-জনে যখন পাশাপাশি ভিজে কাপড়ে হেঁটে চলেছে তখনই আমার মন বলছিল, এমনিভাবে বাকি জীবন তারা পাশাপাশিই হাঁটবে।
পরিচালক ভদ্রলোক এইবার একাই এলেন, ‘শুনুন, আলুঅলা টাকা দিচ্ছে বলে তার কথাই বেদবাক্য হবে, এমন ভাববেন না। অর্থ দিয়ে সাহিত্য কেনা যায় না। আর আমি ডিরেক্টার, আমারও একটা ফিউচার আছে। আপনি শুধু একটা কাজ করুন, করুণাকেতনের চিতাটা আরও একটু পরে নেবান। সূর্যোদয় হয়েছে, চিতায় পড়ল প্রথম জল। হু-হু ধোঁয়া। সূর্যের প্রথম আলো। বাচ্চাগুলো হাঁ করে, বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে আছে ঊর্ধ্বগামী ধোঁয়ার কুন্ডলির দিকে। তারপর শঙ্কর আর আরতির রোমান্টিক স্নানের দৃশ্য। সকালের রোদ। গঙ্গার জলে চুরচুর ঢেউ। দিনের প্রথম আলোর সুন্দরী আলেয়া…।’
‘আজ্ঞে আলেয়া নয়, আরতি।’
‘আরে মশাই ওই হল। হোয়াট ইজ ইন এ নেম। আপনাদের এ উপন্যাসে পাত্র-পাত্রীর নাম পাকা ক্রিমিন্যালদের মতো ছত্রিশবার পালটে যায়, মনে রাখতে পারেন না। শেষে নোট দিতে হয়, শঙ্কর ওরফে শোভন, ওরফে বরেন, ওরফে মিলন। আমার কথা হল, সব কাহিনিরই একজন নায়ক, একজন নায়িকা আর এক পিস ভিলেন থাকে। নায়ক শঙ্কর নায়িকা নিশ্চয় আরতি আর ভিলেন হল গিয়ে ওই রতন হালদার। এখন ভিলেনের কাজ কী? সেটা অবশ্যই মনে আছে? ভিলেনের কাজ হল নায়ক-নায়িকার মিলনে বাধা দেওয়া। এখন আগেরটা বলি। শিফন পরা নায়িকাকে ভিজেয়েছেন। উত্তম করেছেন। তার আগে নায়কের কোলে শুইয়েছেন, অতি উত্তম। গানের সিকোয়েন্স এনেছেন। বেশ করেছেন। আমার মনের মতো হয়েছে, তবে ওসব ময়না মার্কা গান একালে অচল। ওখানে একটা মডার্ন লোকসংগীত বসাতে হবে। সে অবশ্য আপনার কাজ নয়। গীতিকার করবেন। কথা হল, রাজকাপুর মশাই জলে ভেজা নায়িকা পেলে কী করতেন? আপনি অমন একটা সিকোয়েন্স অমাবস্যার অন্ধকারে ফেলে দিলেন। ভিজে কাপড়ে আরতি উঠে আসছে। শঙ্কর তার কোমর ধরে আছে। আরতি উঠছে। সামনে। আরতি হাঁটছে ক্যামেরা পিছনে। সূর্যের আলো সামনে থেকে চার্জ করছে, সানগান। এদিকে ব্যাকলাইট। শঙ্কর আর আরতি সামনে এগিয়ে চলেছে। আহীর ভাঁয়রোতে একটা গান—জাগো, জীবন জাগো, যৌবন জাগো। নার্গিস, রাজকাপুর যেন নতুন করে ফিরে এল। চিত্রজগতে শুরু হল নতুন পুরোনো যুগ।’
‘শ্মশানে সেক্স? জিনিসটা বড়ো দৃষ্টিকটু।’
‘ধুর মশাই! পাবলিক তো এইটাই চায়। তা ছাড়া সমালোচকরা এর ভেতর থেকে কত বড় একটা মিনিং পাবে জানেন! চিতা মানে জীবনের শেষ পরিণতি। সেই চিতার সামনে মিলন। সামনে উদিত সূর্য। জীবনের পথ। পেছনে একদল কিশোর। নবজীবন। নবযুগের প্রতীক। তার মানে মৃত্যুর কাছে জীবন জয়ী। উলটে গেল, কথাটা হবে জীবনের কাছে মৃত্যু পরাজিত। কত বড় ফিলজফি একবার ভাবুন। নেতারা যেমন বলেন, আমিও আপনাকে সেইরকম বলি, আপনাদের হাত শক্ত করার জন্যে আমাদের হাত শক্ত করুন। এরপর আপনি ভিলেনটাকে একটু ফিল্ডে নামান। ভিলেন ছাড়া স্টোরি জমে! কে মশাই পয়সা খরচ করে শুধু চিতা জ্বলা দেখতে যাবে? একটা জিনিস নতুন এনেছেন, ভালোই করেছেন, এগজিবিশানিজম। জিনিসটাকে কায়দা করে কাজে লাগান। আরে মশাই, মহাভারতের সেই দৃশ্যটার কথা একবার চিন্তা করুন, ফ্যান্টাস্টিক। দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ হবে। দুর্যোধন বসে আছে, আরও সব বসে আছে কৌরব পক্ষীয়রা। দুর্যোধন সিল্কের লুঙ্গি তুলে উরু বের করে চাপড় মেরে বলছে, এসো সুন্দরী, এসো, বোসো এইখানে মাই ডারলিং। উঃ, এগজিবিশানিজমের কী অসাধারণ প্রয়োগ। শুনুন মশাই, এদেশে অরিজিন্যাল বলে কিছুই নেই, সবই কপি। স্টোরি কপি, মিউজিক কপি, বিজ্ঞাপন কপি। অরিজিনাল হয় বিলেতে। আপনি মহাভারত থেকে ঝট করে ঝেড়ে দিন। মেয়েটার বাপটাকে মেরেছেন। মেয়েটা এখন ওপেন টু অল। রতন ব্যাটাকে দু-পাত্তর গিলিয়ে ঠেলে দিন মেয়েটার ঘরে। পরনে লুঙ্গি, উদোম গা। মুখে সিগারেট। চেয়ারে গিয়ে বসল। মেয়েটা কিছু বলতে পারছে না, ভদ্র, শিক্ষিতা মেয়ে। রতন হাঁটুর ওপর লুঙ্গি তুলে এলিয়ে বসে আছে। চোখ নাচাচ্ছে। মিটিমিটি হাসছে। মুখে চুকচুক শব্দ করছে। যেন বেড়ালকে ডাকছে দুধ খেতে।
‘কোনো কারণ ছাড়া ঘরে ঢুকে পড়বে? মামার বাড়ি নাকি?’
‘ফিল্মের গোটাটাই তো মামারবাড়ি। আমার ওই সিচ্যুয়েশটান চাই, আপনি এবার মাথা খাটান। সেদিনেই তো বলেছি, তোমার আছে সুর, আর আমার আছে ভাষা। মনের কোণে আছে যত দুষ্টুমির বাসা।’
ভদ্রলোক পুকুরে চার ফেলে বিদায় নিলেন। করুণাকেতন যে খাটে এতকাল শুয়ে ছিলেন সেই খাটটি শূন্য। যেন বিশাল একটি হাহাকারের মতো ঘর জুড়ে পড়ে আছে। ঘরের কোণে ওপাশে একটা প্রদীপ জ্বলছে। আরতি বসে আছে চেয়ারে। সামনে টেবিল। টেবিলে জ্বলছে ল্যাম্প। রাত প্রায় আটটা সাড়ে আটটা হবে। প্রদীপটা জ্বেলে রেখে গেছেন শঙ্করের মা। করুণাকেতন যতদিন ছিলেন, শঙ্করের মা বড়ো একটা আসতেন না। পঙ্গু হয়ে মানুষটি পড়ে থাকলেও তাঁকে ঘিরে ছিল অহঙ্কারের একটা বলয়। সেই কথায় বলে, ‘মরা হাতি লাখ টাকা।’ এখন শঙ্করের মা অসহায় মেয়েটাকে অসম্ভব ভালোবেসে ফেলেছেন। এমন জীবন তিনি দেখেননি, মৃত্যুর পর একজনও এল না পাশে দাঁড়াতে। আত্মীয়স্বজন অবশ্যই আছে। বড়ো বংশের ছেলে ছিলেন করুণাকেতন। বড়োরা বোধহয় এইরকম নি:সঙ্গই হয়। শঙ্করের মা সারাদিনে বহুবার এই ঘরে চলে আসেন। এসে খাটের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন চুপ করে। এই বয়সে মৃত্যুর প্রতি মানুষের স্বাভাবিক একটা কৌতূহল জন্মায়। কী অদ্ভুত, এই ছিল, এই নেই। শঙ্করের মা আরতিকে মেয়ের মতো গ্রহণ করেছেন।
আরতি আলো জ্বেলে তাকে লেখা বাবার পুরোনো চিঠি পড়ছে। আরতি যখন রাজস্থানের স্কুলে পড়ত, সেই সময়কার চিঠি। তখন বাড়ির অবস্থা রমরমা। রাজস্থানের সেই স্কুলে, রাইডিং, শুটিং সবই শেখাত। আরতি অতীতে চলে গেছে। এদিকে রতন হালদার গুটিগুটি ঢুকছে। সর্বনাশ করেছে। লুঙ্গি, গেঞ্জি পরেনি অবশ্য। বেশ ভদ্র সাজগোজ। আজ বৃহস্পতিবার। মদ মনে হয় খায়নি। আজ তো ড্রাই-ডে। পা অবশ্য টলছে না। রতন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে একবার কাশল। আরতি চিঠিতে এত বিভোর, শুনতেই পেল না। তখন রতন বললে, ‘আসতে পারি দিদি?’
‘কে?’ চমকে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল আরতি। দরজার সামনে এসে রতনকে দেখে ভয় পেয়ে গেল। তবু ভদ্রতা। বললে, ‘আসুন, আসুন।’
‘দিদি, আমি খারাপ লোক। আমার খুব বদনাম। অশিক্ষিত। ছোটো ব্যবসা করি। মাল খাই। বউ পেটাই। আমার ভিতরে যাওয়া উচিত হবে না। আপনার পিতা মারা গেছেন। আমি মাদ্রাজ গিয়েছিলুম। আজ ফিরেছি। খবরটা শুনে আমার ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেছে। আপনার মতো বয়সে আমিও আমার পিতাকে হারিয়েছিলুম। পিতার মৃত্যু কত দুঃখের আমি জানি। বাবা তারকেশ্বর আপনাকে ভালো রাখুন। আমি আপনার জন্যে খুব ভালো দোকানের মিষ্টি আর কিছু ফল এনেছি। আর একটা মালা এনেছি, আপনার পিতার ছবিতে পরাবার জন্যে। আমি খুব শুদ্ধভাবে এনেছি। আজ আমি কোনো নেশাভাঙও করিনি।’
আরতি লক্ষ করল, রতন হালদারের চোখে জল এসে গেছে। আরতি অবাক হয়ে গেল।
‘যাব? যদি কেউ কিছু ভাবে?’
‘ভাবে ভাববে। আপনি আসুন।’
জমিদারের ঘরে যেভাবে প্রজা ঢোকে, রতন সেইভাবে ভয়ে ভয়ে, চোরের মতো ঢুকে মেঝেতে বসতে যাচ্ছিল, আরতি বলল, ‘ও কী করছেন? চেয়ারে বসুন, চেয়ারে।’
রতন জড়োসড়ো হয়ে চেয়ারে বসল। মালার প্যাকেটটা আরতির হাতে দিয়ে বললে, ‘ছবিতে পরিয়ে দেবেন।’
‘আপনি পরিয়ে দিন না।’
‘আমি ছবি ছোঁবো?’
‘কেন ছোঁবেন না? ছুঁলে কী হবে?’
‘আমাকে সবাই চরিত্রহীন বলে তো। তবে বিশ্বাস করুন, আমার চরিত্রে কোনো দোষ নেই। আমি একটু মদ খাই। সে আমার নিজের রোজগারে খাই। না খেলে আমার জীবনের অনেক দুঃখ ভুলতে পারব না বলে খাই। বউকে আমি যেমন পেটাই আমার বউও তেমনি আমাকে ক্যাঁত ক্যাঁত করে লাথি মারে। কী মুখ! যেন নালা-নর্দমা! আবার কী বলে জানেন, বিয়ের আগে প্রফেসারের সঙ্গে প্রেম করত। কত দুঃখ দেখুন, আজও আমাদের কোনো ছেলেপুলে হল না। কী বলে জানেন! আমি মদ খাই বলে হচ্ছে না। তাহলে তো বিলেতে কারোর ছেলেপুলে হত না।’
হঠাৎ রতন হালদার নিজের দু-কান ধরে জিভ কেটে বললে, ‘ছি: ছি: আপনার সামনে এসব আমি কি কথা বলছি! অশিক্ষিত হলে যা হয়!’
রতন হালদার খাটের ওপর বালিশে হেলানো করুণাকেতনের ছবিত মালা পরিয়ে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করে উঠে দাঁড়ালো। তারপর চেয়ারে না বসে বললে, ‘আমি তেজস্বী মানুষকে ভীষণ শ্রদ্ধা করি। আমি যা শুনেছি, তাতে আপনার পিতাকে ভীষণ তেজস্বী মনে হয়েছে। আপনিও তেজস্বী। আপনার মনে আছে, একদিন আমি আপনার হাত ধরেছিলুম। আপনি আমাকে ভুল বুঝে বলেছিলেন, জুতো মারব। আমি তখন ব্যাপারটা বোঝাবার মতো অবস্থায় ছিলুম না। নেশার ঘোরে পড়ে যেতে যেতে আমার মনে হয়েছিল আপনি আমার স্ত্রী। বিশ্বাস করুন, আমার ভুল হয়েছিল। আমি নিজের স্ত্রী ছাড়া অন্য সকলকে দেবীর মতো শ্রদ্ধা করি। এ আমার গুরুর নির্দেশ।’
ঠিক এই সময় শঙ্কর ঘরে এসে রতনকে দেখে বললে, ‘এ কী, আপনি এখানে?’
আরতি বললে, ‘না, না, কোনো ভয় নেই শঙ্করদা। ইনি খুব সুন্দর মানুষ। আমরা সবাই দূর থেকে এতদিন এঁকে ভুল বুঝে এসেছি। ইনি প্রকৃত ভদ্রলোক। কাছে না এলে মানুষকে ঠিক বোঝা যায় না।’
রতন শঙ্করের দিকে ঘুরে বলল, ‘নমস্কার, শঙ্করবাবু। জানি, একটা কারণে আপনি আমার উপর খুব রেগে আছেন। আপনি আদর্শবাদী, সমাজসেবক, চরিত্রবান, কালীভক্ত, শিক্ষিত, সুন্দর, আপনি সব সব। আপনাকে আমি শ্রদ্ধা করি। এও জানি, আপনি তিন চারবার পুলিসের কাছে আমার নামে কমপ্লেন করেছেন। আমি তার জন্য আপনার ওপর এতটুকু রাগ করিনি। কেন আমি মদ খাই জানেন? আমার মা আর আমার ওই লাল পিঁপড়ে বউটার জন্যে। কী সাংঘাতিক কামড়, আপনি জানেন না! আর একটা জিনিস আপনি জানবেন, মদ খেলেই বউকে পেটাতে ইচ্ছে করবে। তাহলে জিনিসটা কী দাঁড়াল, বউয়ের জন্যে মদ, মদের জন্যে বউকে পেটানো। একটা গোলাকার ব্যাপার। আমার কী দোষ বলুন। আমি কি পেটাই? পেটায় আমার পেটের বোতল। জানেন কি আমার কোনো দাম্পত্যজীবন নেই?’
‘আপনার ওই রুগ্ন স্ত্রীকে দিয়ে রোজ সকালে ভারি লোহার উনুনটা তোলান কেন? নিজে পারেন না?’
‘কেন পারব না, ওই তো আমাকে তুলতে দেয় না। আমার কোমরে একটা ফিক ব্যথা মতো আছে। মাঝে মাঝেই কষ্ট দেয়। তা আমার বউ বলে, ওই ভারি উনুন তুলতে গিয়ে চিরকালের মতো বিছানায় পড়ে গেলে কোন মিঞা দেখবে?’
‘তার মানে আপনার স্ত্রী আপনাকে ভীষণ ভালোবাসেন।’
‘বাসেই তো। আমিও ভীষণ ভালোবাসি; ওই তো আমার একটিমাত্র স্ত্রী। জানেন তো, জীবনে স্ত্রী একবারই আসে। রাখতে পারলে রইল, না রাখতে পারলে গেল।’
‘তাহলে অমন চিৎকার চেঁচামেঁচি, গালিগালাজ করেন কেন?’
‘ছেলেবেলা থেকে ওইটাই আমার আদত। জানেন তো, মানুষ আসলে বাঁদরের জাত। আপনারা যাঁরা পড়ালেখা করেন তাঁরা জানেন। ঠিক মতো ট্রেনিং না পেলে আমার মতো দামড়া হয়ে যায়। ছেলেবেলায় বাবা আমাকে শুধু রতন বলতেন না, বলতেন, দামড়া রতন। আর আমার বউ, আমার এই স্বভাবটাই পছন্দ করে। চিৎকার, চেঁচামেচি, যেদিন কম হয়, সেদিন জিজ্ঞেস করে, কী গো, তোমার শরীর ঠিক আছে তো?’
‘তা এই যে বললেন আপনার দাম্পত্যজীবন নেই!’
‘সেটা হল, ছেলেপুলে না থাকলে দাম্পত্যজীবনের কী হল বলুন? তারপর তো ওই শরীর। ছত্রিশটা ব্যামো। সম্প্রতি যোগ হয়েছে ছুঁচিবাই। এইবার আমাকে বলুন, আমি কাকে পাশে নিয়ে শুই? বউ না ডিসপেনসারি। আমার এতখানি শরীর। তাই আমি মদ খাই। মদে একটা জিনিস হয়, চরিত্রটা মদেই আটকে থাকে। আর বেশি নড়াচাড়া করতে পারে না।’
‘এই যে বললেন, স্ত্রী আর মায়ের জন্যে মদ ধরেছেন।’
‘সে কথাটাও ঠিক। রোজ মশাই দম খাটা খেটে বাড়ি ফেরার সঙ্গেসঙ্গে শুরু হয়ে গেল কীর্তন। মা আসে বউ-এর নামে বলতে, বউ আসে মায়ের নামে বলতে। লে হালুয়া।’
রতন হালদার জিভ কেটে কান মললেন, ‘এই আমার চরিত্র। কোথায় কী বলে ফেলি। মুখ নয় তো…।’
রতন তাড়াতাড়ি নিজের মুখ চেপে ধরে ঢোঁক গিলল। গিলে মুখ থেকে হাত সরিয়ে বললে, ‘বুঝতে পারলেন ব্যাপারটা! কী বেরোতে চাইছিল! অ্যায় এই হল রতন হালদার। লক্ষ্মী ক্লথ স্টোরের মালিক। লক্ষ্মী হল আমার স্ত্রীর নাম। তা নামটা মিলেছে জানেন। আসার পর থেকে রোজগারপাতি বেড়েছে। তা হয়েছে। ছোটোলোক হতে পারি মিথ্যেবাদী তো নই। না, আমি এবার যাই। আমার বউ একেবারে সিঁটিয়ে আছে। আসার সময় বলেই দিয়েছে, যাচ্ছ যাও, খুব সাবধান। যা-তা বলে মোরো না। খুব একটা যা-তা কিছু বলিনি, কী বলুন? খালি একটা শব্দ লিক করছিল।’
রতন আবার খাটের দিকে হাত তুলে নমস্কার করল, তারপর যেমন এসেছিল, সংযত হয়ে মাথা নীচু করে বেরিয়ে গেল। আমি অবাক। শঙ্কর আর আরতিও অবাক। শঙ্কর তৈরিই ছিল,। এলোমেলো কিছু করলে, জীবনের প্রথম ঘুষিটা রতনের চোয়ালে গিয়েই পড়বে।
শঙ্কর বললে, ‘এত সহজ সরল মানুষ আমি কমই দেখেছি।’
টেবিলের ওপর সাজানো রয়েছে রতন হালদারের আনা শহরের সেরা আপেল, মুসাম্বি, আতা, সবেদা, কলা। বিশাল এক বাক্স সন্দেশ। করুণাকেতনের ছবিতে দুলিয়ে দিয়ে গেছে টাটকা গোড়ের মালা। তলায় ঝুলছে টাটকা একটা গোলাপ। রোলেক্স চিকচিক করছে, আনন্দাশ্রুর মতো।
রতন হালদার তক্ষুনি আবার ফিরে এল। হাতে একটা বেশ বড়ো রঙিন প্যাকেট। ঘরে সেই একই ভাবে সমীহ হয়ে ঢুকল, ‘একটা জিনিস ভুলে ফেলে এসেছিলুম। ধূপ। থেকে থেকে, ঘরের চারপাশে জ্বালিয়ে দিন। আমি আর দাঁড়াচ্ছি না। এদিকে এক কান্ড হয়েছে, আমার বউকে মনে হয় কাঁকড়া বিছে কামড়েছে। সেই কথায় বলে না, গোদের ওপর বিষফোড়া। আমি যাই দিদি।’
শঙ্কর আর আরতির সেই রাতটা রতন হালদারের বউকে নিয়েই কেটে গেল। ডাক্তার, ইঞ্জেকশন, বরফ, পাখার বাতাস। সেবা। সব মিলিয়ে একটা রাত। মৃত মানুষের আত্মা এই খেলাটাই খেলেন। দুঃখ ভোলবার জন্যে একের পর এক বিপদ তৈরি করতে থাকেন। যাতে সব একেবারে তালগোল পাকিয়ে থাকে। মাথা না তুলতে পারে। সেই রাতেই রতন হালদারকে চেনা গেল। লোকটা কত খাঁটি। সারাটা রাত তার দৌড়ঝাঁপ। ছোটাছুটি। মনে হচ্ছিল, তার স্ত্রীকে নয়, বিছে তাকেই কামড়েছে। রতন যেন সেই প্রবাদ—শাসন করে, যে-ই, সোহাগ করে সে-ই। ভোরের দিকে মনে হল, বিপদটা কেটে গেছে। একে রোগা শরীর তার উপর বিছের কামড়। বিছে মানে বিছের রাজা, কাঁকড়া বিছে, প্রায় সাপের সমান। রতন হালদার ঠিকই বলেছে, তার বউয়ের শরীরে হাড়কখানাই সার। স্রেফ ভেতরের তেজে মহিলা লড়ে যাচ্ছেন। রতন হালদার সত্যই সংযমী। অন্য কেউ হলে নারীসঙ্গের জন্য ছটফট করত। মদে আরও বাড়িয়ে দিত তার নারী-লিপ্সা। আর একটা ব্যাপার জানা ছিল না সেটা হল রতনের ঈশ্বর-বিশ্বাস। দেয়ালের হুক থেকে ঝুলছিল রুদ্রাক্ষের মালা। রতন মাঝে মাঝেই সেটা মালাটা নামিয়ে ঘরের কোণে বসে যাচ্ছিল জপে। সেটা এত আন্তরিক যে কেউ বলতেই পারবে না, এটা ভন্ডামি। কেউ হাসতেও পারবে না। নিউক্লিয়ার এজে, জপের শক্তি, ব্যাটা অশিক্ষিত গেঁয়ো কোথাকার।
মিনিবাস ছুটছে হইহই করে। জানালার ধারে বসে আছে আরতি। পাশে শঙ্কর। আরতির রুক্ষ চুল বাতাসে উড়ছে। করুণাকেতনের মৃত্যু আরতি সহজভাবেই নিয়েছে। কষ্ট পাচ্ছিলেন ভীষণ। চলে গেলেন। আরতি এখন নিজের জীবনের পরিকল্পনা নিয়েই ব্যস্ত। বাগানবাড়ির দখলটা পেয়ে গেলেই সে একটা নার্সারি, কেজি স্কুল করবে। সে যোগ্যতা তার আছে। সে ঘোড়ায় চড়তে জানে, সে বন্দুক চালাতে জানে। ইংরেজি জানে সাংঘাতিক ভালো। ওই স্কুল কালে বড়ো হবে। বিশাল এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বাবার নামে নাম রাখবে সেই প্রতিষ্ঠানের—করুণাকেতন।
কণ্ডাক্টর কাছে আসতেই শঙ্কর পকেটে হাত ঢোকাতে যাচ্ছিল, আরতি সঙ্গেসঙ্গে শঙ্করের হাত চেপে ধরল। খুব আস্তে বললে, ‘এরই মধ্যে ভুলে গেলেন, আমাদের কাল রাতের চুক্তি।’
শঙ্কর আরতির আঙুলগুলো দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল। ঈশ্বর যাকে দেবেন মনে করেন, তার সবই ভালো করে দেন। লম্বা লম্বা মোচার কলির মতো আঙুল। একেবারে দুধে আলতা রঙ। ডগাগুলো সব টোপর টোপর গোলাপি। অনামিকায় একটা টুকটুকে লাল পাথর বসানো সোনার আংটি। যা মানিয়েছে। চোখ ফেরানো যায় না। শঙ্করকে ওইভাবে মুগ্ধ হয়ে যেতে দেখে আরতি বললে, ‘কি হল আপনার?’
‘তোমার আঙুল। ঠিক যেন নন্দলাল বসুর ছবি।’
‘এইরকম আঙুল আপনি কত মেয়ের পাবেন। আপনি মেয়েদের সঙ্গে মেশেন যে জানবেন?’
‘তুমি এই আঙুলে বন্দুক ছুঁড়তে?’
‘হ্যাঁ। আমার টার্গেট খুব ভালো ছিল। সত্যি রাজস্থানের সেই দিনগুলো ভোলা যায় না। আমার জীবনের সবচেয়ে ভালো দিন। দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না, সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি।’
শঙ্কর হঠাৎ মুখ তুলে দেখে একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল। কণ্ডাক্টর ছেলেটি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে চুপ করে। সে-ও অবাক হয়ে আরতিকে দেখছে। টিকিটের পয়সা নিতে নিতে বললে, ‘দিদি আমি এত বছর কণ্ডাক্টরি করছি, আপনার মতো সুন্দরী দেখিনি। মনে হচ্ছে জ্যান্ত মা দুর্গা। আপনি কেন সিনেমায় নামছেন না দিদি। সুচিত্রা সেনের পর আর তো একই সঙ্গে অত সুন্দরী আর শক্তিশালী কেউ এলেন না।’
আরতি বললে, ‘সিনেমায় নামা কি অত সোজা ভাই?’
‘আপনি একটু চেষ্টা করলেই চান্স পেয়ে যাবেন।’
আরতি আর শঙ্কর ভবানীপুরে নেমে পড়ল। আরতিদের অ্যাডভোকেট ভবতোষবাবুর চেম্বারে যখন গিয়ে পৌঁছোলো, তখন সন্ধ্যা হয়-হয়। ভবতোষবাবু কোর্ট থেকে ফিরে সবে বসেছেন। এক মারোয়াড়ি মক্কেল রাজস্থানী বাংলায় খুব ক্যাচোর-ম্যাচোর করছেন। আরতিকে আসতে দেখে ভবতোষবাবু বললেন, ‘একটু চুপ করুন।’
আরতির এমনই প্রভাব ভবতোষবাবু চেয়ার ছেড়ে প্রায় উঠেই পড়েছেন, ‘এসো মা এসো।’
সামনের চেয়ারে বসতে বসতে আরতি বললে, ‘বাবা মারা গেছেন কাকাবাবু।’
মুখে মশলা দিতে যাচ্ছিলেন ভবতোষবাবু, তাঁর হাত নেমে এল। বললেন, ‘যা:, একটা যুগ শেষ হয়ে গেল।’
ব্যবসায়ী ভদ্রলোক পাশ থেকে আরতিকে দেখছেন হাঁ করে। শঙ্করের মনে হল মনে মনে তিনি হিসেব করছেন, ‘ভাও কিতনা।’
ভবতোষবাবু বললেন, ‘তোমরা জান না, করুণাদা কত বড়ো ফাইটার ছিলেন! হি ওয়াজ এ গ্রেট সোল।’
কাজের মানুষ। সেন্টিমেন্ট নিয়ে পড়ে থাকার সময় নেই। ওই এক মিনিট নীরবতা পালনের মতো দু-কথাতেই সেরে দিয়ে আসল কথায় এসে গেলেন, ‘খুব নিষ্ঠুরের মতোই বলছি মা, করুণাদাদা মারা গিয়ে তোমার কিছুটা সুবিধে করে দিলেন। কেসটাকে এবার আমি অন্যভাবে প্লেস করতে পারব। তুমি এখন হেল্পলেস অসহায়। তোমার কেউ নেই। অ্যালোন ইন দিস ওয়ার্লড। বাই দি বাই, এই ছেলেটি কে? এত সুন্দর, স্বাস্থ্যবান, উজ্জ্বল যুবক, একালে সহসা দেখা যায় না।’
‘আমরা একই বাড়িতে থাকি। আমার বন্ধু, আমার দাদা, আমার শিক্ষক, আমার আদর্শ— আমি ঠিক বোঝাতে পারবো না, ইনি কে। একটি রেয়ার স্পেসিমেন, আই ক্যান সে।’
ছেলেটিকে আমার ভীষণ ভালো লেগে গেল। আজকালকার খুব কম ছেলেই আমাকে মুগ্ধ করতে পারে। তুমি কি ব্রহ্মচর্য পালন কর।’
শঙ্কর বলল, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’
‘ভেরি গুড। তুমি আমার বইটা পড়েছ? ইন প্রেইজ অফ ব্রহ্মচর্য।’
‘বইটা আপনার লেখা? আপনি সেই ভবতোষ আচার্য? আপনার ওই বই-ই তো আমার ইন্সপিরেসান।’
শঙ্কর ঝট করে চেয়ার ছেড়ে উঠে ভবতোষবাবুকে প্রণাম করল। ভবতোষবাবু সোজা দাঁড়িয়ে উঠে শঙ্করকে জড়িয়ে ধরলেন বুকে। সেই অবস্থায় এক হাতে শঙ্করের পিঠ চাপড়াতে লাগলেন। দু-হাতে শঙ্করের দু-কাঁধ ধরে, সামনে সোজা দাঁড় করিয়ে, শঙ্করকে দেখতে দেখতে বললেন, ‘চেষ্ট কত?’
‘ছেচল্লিশ।’
‘ভেরি গুড।’
শঙ্কর ফিরে এসে চেয়ারে বসল। মারোয়াড়ি ভদ্রলোক অবাক হয়ে বাঙালিদের কান্ডকারখানা দেখছিলেন, অবশেষে থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেসটা কী ছিল? প্রোপার্টি কী ডামেজ স্যুট?’
ভবতোষবাবু বললেন, ‘প্রপার্টি। হিউম্যান প্রপার্টি।’
‘বিষোয় বিষ আছে। আমি তো মোশাই পাগোল হয়ে গেছি। চার ছেলেকে চারটে প্রোপার্টি দিলিয়ে দিলুম, লেকিন শান্তি হোলো না দাদা। বোড়োটা ওখোন বলছে কী, আমাকে আরও দাও। মেজোর মকানের সামনের দিয়ে পাতাল রেল গেছে। আরে উল্লুকা পাঠঠে মেজোর তো ফ্ল্যাট। তোর তো বাগানবাড়ি। একটা গাড়ি নতুন মোডেল, আর একটা গাড়ি প্রাণা মোডেল। আমি কী দিল্লি যাব। দরকার লাগাবো। বেলেঘাটামে পাতাল রেল চালিয়ে দাও। মোশা আমি ভাবছি কি ভিখিরি হোয়ে যাই। জোয় রাম। দেখি একটা হুমন লাগাই, কী দোশ মণ ঘিউ ঢালি।’
‘আপনার তো মশাই টাকায় ছাতা পড়ছে। এক বস্তা দিয়ে দিন না।’
‘টাকা তো আমাদের কাছে টয়লেট পেপার। নো ভ্যালু। আমরা চাই রিয়েল এস্টেট। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউতে নো বাড়ি। এদিকে কুছু আছে পুরোনো বাঙালি বাড়ি। চেষ্টা তো চালিয়েছি। লেকিন সোব লিটিগেশানে আটকে আছে। ফ্রি প্রোপার্টি কোথায়? এই আপনারটা ফ্রি আছে। হামি এক কোটির অফার দিয়ে রাখছি।’
‘দশ বছর অপেক্ষা করুন। আমি আগে মরি।’
‘লেকিন আপনি মোরলেই তো লিটিগেশানে চলে যাবে। যা করবেন মরার কম সে কম সাতদিন আগে করুন।’
‘আমি কনট্যাক্ট করে ফাইন্যাল ডেটটা জেনে নিই।’
মারোয়াড়ি ভদ্রলোক হাহা করে হাসলেন।
ভবতোষ আরতিকে বললেন, ‘ডেথ সার্টিফিকেটটা আমাকে আগে পাঠাও। ফাইনাল লড়াইটা শুরু করা যাক। তোমাদের দু-জনের বিয়ে হলে আমি খুব খুশি হব। তবে কেসটা ফয়সালা হবার আগে নয়। ফাইন ইয়্যাং ম্যান, তোমার নামটা কি?’
‘আজ্ঞে আমার নাম শঙ্কর মুখার্জি।’
‘আরতিকে তোমার পছন্দ?’
‘আমি বেকার! আমার বোনের এখনো বিয়ে হয়নি। বিয়ের বাজারে আমি অচল কাকাবাবু।’
‘তুমি অচল থাকবে না শঙ্কর। তুমি সচল হয়ে যাবে। যদি তুমি বিবাহ কর, আরতিকে কোরো। আমি নিজে আরতিকে সম্প্রদান করব তোমার হাতে। যাও। তোমাদের মঙ্গল হোক। এইবার আমাকে কাজ করতে দাও।’
দু-জনে হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূরে চলে এল। আরতি বললে, ‘শঙ্করদা, আপনি ছাড়া সত্যিই কিন্তু আমার আর কেউ নেই। এই পৃথিবীতে আমি কিন্তু একেবারে একা। এই কথাটা আপনাকে মনে রাখতে হবে। আমি কী খুব বেশি দাবি করে ফেলছি?’
‘আরতি, তোমার স্বামী হবার যোগ্যতা আমার নেই, তবে এইটুকু বলতে পারি, যতদিন প্রয়োজন হবে, আমি তোমার ম্যানেজারি করব। তোমার সেবা করব। আমি কামজয়ী নই। কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় কামজয়ী হওয়া। চেষ্টা করবে, হারবে, আবার চেষ্টা করবে। বাইরে একটা ভাব দেখাবে নির্বিকার, কিন্তু ভিতরে ভিতরে জ্বলে পুড়ে যাবে। তবে নিজেকে নানাভাবে ব্যস্ত রাখলে আক্রমণটা কম হবে। সত্যি কথা বলব, তোমাকে কখনো মনে হয় প্রেমিকা, কখনো মনে হয় আমার আদরের ছোটো বোন। দু-রকমের ভাব হয় আমার। তবে তৃতীয় আর একটা ভাব ভীষণ প্রবল তোমাকে আগলে রাখা, তোমাকে সামলে রাখা, তুমি আমার এত আদরের যে তোমার গায়ে যেন কোনো কিছুর স্পর্শ না লাগে। কর্কশ জীবন, কর্কশ সময় যেন তোমাকে ছুয়ে না দেয়। আমার চোখে, তুমি হলে পৃথিবীর সুন্দরতম ফুল। তুমি বলবে, হঠাৎ আমার এমন ভাব হল কেন? আমি বলব, এইভাবেই হয়। তোমার ওই ভুরু কোঁচকানো হাসি, তোমার কন্ঠস্বর, তোমার কথা বলার ধরন, এইগুলো হল তোমার ব্যক্তিত্বের দিক, আমাকে এককথায় কাবু করে ফেলেছে। তুমি প্রথম আমাকে চুম্বকের মতো টেনেছিলে সেই ফুলের দোকানের সামনে। পাশ থেকে রোদঝলসানো তোমার ধারালো মুখ দেখে, তোমার চাবুকের মতো শরীর দেখে আমি আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলুম। তোমার কাছে আমি নিজেকে লুকোতে চাই না। গোপনীয়তাটাই পাপ। সেদিন তোমার ঘামে ভেজা কোমর ছুঁয়ে আমার ডান হাত এগিয়ে গিয়েছিল বালতি থেকে নোট তুলতে। সেই স্পর্শে আমি পেয়েছিলুম বিদ্যুৎতরঙ্গ। সেদিন আমি তোমার প্রেমিক। আবার যেদিন শ্মশানে, গঙ্গার ধারে আমার বুকে মাথা রাখলে, তখন মনে হচ্ছিল আমাদের দু-জনেরই পিতৃবিয়োগ হয়েছে। আমরা দু-টি ভাইবোন। আবার শেষ রাতে স্নানের পর তোমাকে যখন ভিজে কাপড়ে জল থেকে তুলছিলুম তখন মনে হচ্ছিল তুমি আমার নায়িকা। এইবার বলো আমাকে তোমার কেমন লাগে? আমার সম্পর্কে তোমার কী ভাব?’
দু-জনে অন্ধকার মতো একটা জায়গায় চলে এসেছে। দোকানপাট নেই। কিছুটা দূরে আবার আলোর এলাকা। ডানপাশে একটা পার্ক। আরতি দাঁড়িয়ে পড়ল। শঙ্করকে বললে, ‘আমার মুখটা এই আলোছায়ায় তুমি দেখো। যেকথা বলা যায় না, সে-কথা ফুটে ওঠে মুখে।’
শঙ্কর আকাশের আলোয় আরতির মুখের দিকে তাকাল। এ মুখ নায়িকার। চোখ দুটো যেন ইরানি ছুরি। পাশ দিয়ে এক প্রবীণ যেতে যেতে বললেন, ‘উল্কি পোকা পড়েছে চোখে। অন্ধকারে হবে না, আলোতে নিয়ে যাও। নরম রুমালের কোণ দিয়ে টুক করে তুলে নাও। বাড়ি গিয়ে দু- ফোঁটা গোলাপজল।’
পরিচালক আর প্রযোজক দু-জনেই এসেছেন আজ, সাদা রং-চটা একটা অ্যামবাসাডর চেপে। যাক, আর কিছু না হোক, একটা বাহন হয়েছে! প্রযোজক বললেন, ‘স্টোরির কী খবর?’
‘এই খবর।’
‘সে কী, ভিলেনটাকে মেরে ফেললেন!’
‘মারিনি তো, প্রাণে মারিনি। এখন আমি আর লিখছি না। আমি আজ্ঞাবহ দাসমাত্র।’
‘ওই হল। ওসব আপনাদের ভড়ং আছে। ধর্মের পথ মানেই মৃত্যুর পথ। স্টোরিটার আর কী রইল। তারপর আবার সেই রাত। আপনি নায়ক-নায়িকাকে একটা ঘনিষ্ঠ অবস্থায় নিয়ে এলেন, এনে কী করলেন, ডুবিয়ে দিলেন অন্ধকারে। আপনাকে অন্ধকারে পেয়েছে।’
পরিচালক বললেন, ‘না, না, আধো অন্ধকার, ডানপাশে একটা পার্ক, ইরানি ছুরির মতো চোখ, আমার ক্যামেরার পক্ষে খুব ভালো। এসব সফট সিন। এর মর্ম আপনি বুঝবেন না। আপনি শুধু দয়া করে ওদের পার্কের মধ্যে ঢুকিয়ে দিন, তারপর খেল কাকে বলে আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।’
প্রযোজক বললেন, ‘তারপর কী হবে, পুলিস দু-ব্যাটাকেই মারতে মারতে নিয়ে যাবে ভবানীপুর থানায়?’
পরিচালক বললেন, ‘আজ্ঞে না, এইখানেই আসবে নতুন এক ভিলেন, প্রেমের ঘুঘুটির পালক ছেঁড়ার জন্যে। আর প্রেমিক মোরগটির সঙ্গে লেগে যাবে ঝটাপটি। ফাইট সিকোয়েন্স।’
প্রযোজক বললেন, ‘আমি সাফ কথা জানতে চাই, শঙ্কর আর আরতির বিয়ে হবে কী হবে না?’
পরিচালক বললেন, ‘বলুন কী হবে?’
এই ঘটনার ঠিক তিন দিন পরে একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল আরতিদের বাড়ির সামনে, নেমে এলেন ভবতোষ আচার্য ও আর এক ভদ্রলোক। শঙ্কর বেরোচ্ছিল পড়াতে যাবে বলে।
ভবতোষ বললেন, ‘এই যে আমার ইয়াংম্যান, আরতি আছে?’
‘আছে কাকাবাবু। আসুন, ভেতরে আসুন।’
আরতি সবে চান সেরে চুলের জট ছাড়াচ্ছিল। ভবতোষ বললেন, ‘মা, দেখো কে এসেছেন?’
আরতি বললে, ‘কে, রাধুকাকা!’
‘দু-জনেই ঘরে ঢুকলেন। ভবতোষ শঙ্করের মুখের ওপর দরজাটা বন্ধ করতে করতে বললেন, ‘ইয়াংম্যান, আমরা একটু একান্ত বৈষয়িক কথা বলব, বাবা। যাবার সময় দেখা করে যাবো তোমার সঙ্গে।’
শঙ্করের মা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে রে শঙ্কু?’
‘আরতিদের উকিলমশাই। তুমি একটু চা বসাও মা। আমি খাবার কিনে আনি। মস্ত মানুষ। আমার গুরুও বলতে পার।’
রাধুবাবু বললেন, ‘করুণা মারা গেছেন আমি শুনেছি। তুমি আমার বন্ধুকন্যা। তোমার প্রতি আমার একটা কর্তব্য আছে। বলতে পার, স্রেফ জেদাজেদির বশে এই কোর্ট কাছারি-মামলা। আমি এখন আমার সেন্সে ফিরে এসেছি। আর মামলা নয়। এইবার সহজ সমাধান। এই পরিবেশে তোমার আর এক মিনিট থাকা চলবে না।’
‘চোদ্দো বছর রয়েছি কাকু।’
‘সে তোমার বাবার জেদে। আর না, প্যাক-আপ, প্যাক-আপ।’
ভবতোষ বললেন, ‘প্যাক আপ, প্যাক আপ।’
‘কোথায় যাব আমরা?’
‘বারাসাতে, তোমার বাগানবাড়িতে। যা আমি আজ চোদ্দো বছর আগলে বসে আছি। দেখবে চলো, সেখানে তোমার মানসদা কী করেছে? বিশাল এক নার্সিংহোম। সেই নার্সিংহোমের নাম হবে, করুণাকেতন। সেখানে তোমার কত কাজ। এক যুগ ধরে তুমি সেবা করেছ বাবার। এইবার করবে সমাজের। তুমি হবে নিবেদিতা। দিস ইজ নট ইয়োর প্লেস, মা। তুমি এখন বন্ধনমুক্ত, তোমার সামনে নবদিগন্ত।’
‘আমি একবার শঙ্করদার সঙ্গে পরামর্শ করে নিই।’
ভবতোষ বললেন, ‘কোনো দরকার নেই মা, আমরা ছাড়া তোমার কে আছে? রোমান্স রোমান্স, জীবন জীবন। তোমার ব্যাগে সামান্য কিছু ভরে নাও, ভ্যালুয়েবলস। পরে সব লরিতে যাবে। তোমার ফিউচারের একটা সমাধান করতে পেরে আজ আমার ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে গেল।’
‘আমি শঙ্করদার সঙ্গে একবার কথা বলব।’
‘না, করুণাকেতকনের মেয়ে হয়ে তুমি কোনো ফিল্মি নাটক করতে পারবে না। তুমি আর দেরি কোরো না। ওদিকে মানস বেচারা রাইটার্স বিল্ডিং-এর সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে।’
‘আমি যদি না যাই?’
রাধুকাকা বললেন, ‘তোমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার হবে। আমার স্বপ্ন ভেঙে যাবে। তোমার পিতা দুঃখ পাবেন। আমরা ঠিক করেছিলুম, আমাদের দু-জনের যদি ছেলে আর মেয়ে হয়, তাহলে তাদের বিয়ে হবে। আমার ছেলে মানস এফ. আর. সি. এস।’
রাধুকাকা বললেন, ‘এতে হবে কি, তুমি তোমার সম্পত্তি ফিরে পেলে। প্লাস পেলে আধুনিক এক নার্সিংহোম। যে হোমের নাম হবে করুণাকেতন। মামলা লড়ে যা তুমি কোনো দিন পাবে না।’
‘কাকাবাবু, ক-লাখ?’
‘ক-লাখ মানে?’
‘রাধুকাকা ক-লাখ খাইয়েছেন আপনাকে?’
দুই প্রবীণের চোখ-মুখ লাল হয়ে গেল। হড়াস করে দরজা খুলে গেল। দুজনে ছিটকে বেরিয়ে এলেন। শঙ্কর আর তার মা চা-খাবার নিয়ে আসছিলেন, ছিটকে পড়ে গেল। ভবতোষ ঝড়ের বেগে বেরিয়ে যেতে যেতে বললেন, ‘ব্রহ্মচারীর বিয়ে করা উচিত নয়।’
আরতি একটু গলা ছড়িয়ে বললে, ‘চোদ্দো বছর যখন একা চলতে পেরেছি, বাকি জীবনটাও পারব।’
প্রযোজক বললেন, ‘সেই পাঁচ-শো টাকা আছে, না খরচ হয়ে গেছে?’
‘চলেনি, সব কটা অচল।’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ, ওটাই আমাদের হাতের পাঁচ, হাতের প্যাঁচও বলতে পারেন। দিন। আবার আর এক জায়গায় গিয়ে টোপ ফেলি।’
বিকট শব্দ করে গাড়িটা চলে গেল। আমার নিয়তির অট্টহাসি।