হাতুড়ি

হাতুড়ি

রতন নাকি?

আজ্ঞে।

খবর কীরে!

খবর নাই।

তার মানে? চিঠিটা দিসনি?

কারে দেব? তিনি বাড়িতে থাকলে তো!

কোথায় গেছেন?

কোন চুলোয় গেছেন তা কে জানে! কিম্ভূত জায়গায় পাঠিয়েছিলেন বাপ, এই মারে কি সেই মারে। যেন চোর। তিনটে বাঘাকুত্তার সে কী চিল্লামিল্লি, শেকল ছিঁড়ে ঘাড়ে এসে পড়ে আর কি। বুকের ভিতর তখন থেকে ধড়াস ধড়াস।

দরজা খুলল কে?

কে জানে কে। চাকরবাকরই হবে বোধহয়। তার সে কী পুলিশের মতো জেরা। কোথা থেকে আসা হচ্ছে, নাম কী, নিবাস কোথায়, কী প্রয়োজন। কথা শেষ করার আগেই প্রশ্ন করে। আর সে কী তাড়াং তাড়াং চোখ রে বাবা!

তারপর?

সে কিছু কবুল করল না। ”দাঁড়াও” বলে দরজা দিয়ে ভিতরে গেল। পাঁচ—সাত মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে থাকার পর দরজা খুলে এক মহিলা দাঁড়ালেন এসে।

সে কেমন?

দেখতে—শুনতে খারাপ নয়। ফরসা, লম্বা, মুখখানাও ঢলঢলে। হলে কী হয়, ওই চেহারাখানাই যা দেখনসই। মেজাজে একেবারে দুর্বাসা।

সর্বনাশ! চিঠিটা কি ওর হাতেই দিলি নাকি?

পাগল! আপনার বলা ছিল দুলাল ছাড়া কারও হাতে চিঠি দেওয়া চলবে না।

সে আমার খুব মনে ছিল। তবে মেয়েটা এমন চেঁচিয়ে সব কথা বলছিল যে আমার ধাত ছাড়ার উপক্রম। বরাবরই জিজ্ঞেস করে কোথা থেকে আসছি, আর কে পাঠিয়েছে।

কিছু বললি?

না। শুধু একটা কথাই ঘুরিয়ে—ফিরিয়ে বলা, হাটখোলা থেকে আসছি, দুলালবাবুর সঙ্গেই দরকার। সেই কথাই হাজার বার ধরে বলাল। চোখে ফুটিল সন্দেহ।

তারপর কী হল?

ভদ্রমহিলা বলল, আপনাকে আমার সন্দেহ হয়েছে, দাঁড়ান, পুলিশে খবর দেব।

ও বাবা। তুই কী বললি?

ভয় খেয়ে বললাম, আমার দোষটা কোথায় হল বলবেন? এসেছি দুলালবাবুর কাছে একটা দরকারে, তা এমন করছেন কেন? পুলিশে খবরই বা দেবেন কেন? চুরি—ডাকাতি তো করিনি। বারবারই জিজ্ঞেস করে দুলালবাবুর সঙ্গে আমার কীসের সম্পর্ক।

তুই কী বললি?

বললাম, চেনাজানা আছে। বিষয়কর্মেই আসা। আচ্ছা দাদা, এ মহিলাটি কে?

ওর নাম পলা।

ওর নাম দিয়ে কী হবে? মহিলা আসলে কে?

ও দুলালের বউদি।

অ, তাই বলুন। দু—ভায়ে ঝগড়া বুঝি!

না, কোনো ঝগড়া নেই। দুলালের দাদা রামলালকে পলা বছর খানেক আগেই নিজের হাতে মেরে ফেলেছে।

উরেব্বাস! বলেন কী?

রামলাল আর পলার বনিবনা ছিল না।

দশ বছর বিবাহিত জীবনে ওদের এক ঝগড়ার মধ্যে রামলাল কিছু ক্লান্ত হয়ে পড়ে— সেদিন তার বিস্তর খাটুনি গেছে— চোখ বুঁজে বিছানায় পড়ে ছিল। সেই সময়ে পলা একটা হাতুড়ি দিয়ে তার কপালে মারে।

উরেব্বাস!

খুন করার ইচ্ছে হয় তো ছিল না। কিন্তু রামলাল ক্ষীণজীবী মানুষ ছিল। ওই এক ঘায়েই তার প্রাণবায়ু বেরিয়ে যায়।

থানাপুলিশ হয়নি?

না। তার কারণ ওদের হাতে একজন ডাক্তার ছিল। সে প্রথমে ডেথ সার্টিফিকেট দিতে চায় নি। তাকে কিছু টাকাপয়সা দিয়ে কাকুতি—মিনতি করে রাজি করানো হয়। মাথার ক্ষতটা খুব একটা চোখে পড়ার মতোও ছিল না। ডেথ সার্টিফিকেটের জোরে রামলালকে সৎকারও করা গিয়েছিল।

এ যে পতিঘাতিনী সতী!

বলেছি তো, রামলালকে খুন করার ইচ্ছে পলার হয়তো ছিল না। খুনটা অ্যাক্সিডেন্টাল।

আপনি কিছু করলেন না?

কী করব?

উকিল মানুষ, কত কী করতে পারতেন।

পারতাম বটে, কিন্তু তাতে ওদের কচি ছেলেটা ভেসে যেত। সবদিক বিবেচনা করে কেসটা আর করিনি। তবে সন্দেহ হওয়ায় নিজেই খানিকটা তদন্ত করেছিলাম। ডাক্তার পাল আমার কাছে কবুলও করে ফেলেছিল যে, মৃত্যুটা স্বাভাবিক ছিল না।

আপনাকে আমি ভালো করে বুঝতেই পারি না। কেমন মানুষ আপনি বলুন তো!

কেমন মানুষ বলে তোর মনে হয়?

সময় সময় বেশ ভালো, সময় সময় কেমন যেন।

ঠিক ধরেছিস।

এখন দুলালবাবুকে লেখা চিঠিটা কী করব?

রেখে দে। দুলাল ফিরলে গিয়ে দিয়ে আসবি।

ও বাবা, ও বাড়িতে আবার? হাতুড়িবাজ মহিলার খপ্পরে গিয়ে পড়তে হবে জেনেই যে ভয় লাগছে।

যে চাকরটা প্রথম দরজা খোলে সে কেমন?

বড়োসড়ো চেহারা, মাঝবয়সি।

ও হচ্ছে গেনু।

আপনি চেনেন?

হ্যাঁ।

লোক কিন্তু সুবিধের নয়।

জানি। তবে গেনু পলাকে কোলে করে মানুষ করেছে। পলাকে ও বুক দিয়ে আগলে রাখে। বাবার মতোই।

দুলালবাবুর সঙ্গে আপনার জরুরি দরকারটা কীসের?

দুলালের এখন ও বাড়ি ছাড়া উচিত। ও বোকা বলে বুঝতে পারছে না, ও বাড়িতে ও আর নিরাপদ নয়।

কেন বলুন তো!

গেনুর জন্য।

বুঝলাম না।

গেনু দুলালকে ঘেন্না করে।

বাড়িটা পলা গাপ করতে চায় বুঝি?

না। পলা আর দুলাল দুজনে দুজনকে চায়।

বলেন কী দাদা! এ তো রোমাঞ্চকর নাটক!

জীবনটাই নাটক।

এইটুকু বলেই থামলেন কেন? বাকিটা বলুন।

আঁশটে গন্ধ পাচ্ছ বুঝি? মানুষ আঁশটে গন্ধ খুব ভালোবাসে। অবৈধ সম্পর্ক, কেচ্ছা—কেলেঙ্কারি, বউ ভাগানো মানুষের কাছে খুব রুচিকর।

লজ্জা দেন কেন দাদা! লোক শুঁটকি মাছ খায়, হিং খায়, পেঁয়াজ—রসুন খায়, বিট লবণ খায়— তা এসবের গন্ধ তো আসলে নিঘিন্নে নানা দুর্গন্ধেরই এপিঠ— ওপিঠ। তবু কি ভালোবেসে খায় না?

তা বটে।

মনে হচ্ছে রামলালের খুনের পিছনেও এইটেই কারণ, তাই না?

না হে, রামলাল বেঁচে থাকতে দুলাল পিকচারে আসেনি। সে তখন পাহাড়—পর্বতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বরাবরই ডাকাবুকো, বরাবরই অ্যাডভেঞ্চারের নেশা। লম্বা সাঁতারে খুব নাম ছিল। ভালো অ্যাথলিট। তারপর কয়েক বছর ধরে তার পেশা হয়েছে পাহাড়ে চড়ার। চড়েছেও অনেক পাহাড়ে। বিপজ্জনকভাবে বাঁচতে ভালোবাসে। সে ঘরেই থাকেনি কখনো। পলার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা হওয়ার মতো সুযোগ ছিল না।

তা হলে?

রামলাল মারা যাওয়ার পর খবর পেয়ে দুলাল ফিরে এল। সে খুব বুদ্ধিমান ছেলে। দাদার মৃত্যু যে হার্ট অ্যাটাকে হয়নি তা অনুমান করতে দেরি হল না তার। পলার ভাবগতিক দেখেও সন্দেহটা হয়ে থাকবে। পলা তখন নিজের কৃতকর্মের জ্বালায় পাগলের মতো আচরণ করছিল। শোকের ওই বাড়াবাড়িটাও স্বাভাবিক ছিল না। কারণ পলা এবং রামলালের মধ্যে সম্পর্কটা যে মধুর ছিল না তা সবাই— যারা ওদের চিনত— জানে। দুলাল বউদিকে নানাভাবে লক্ষ করে বুঝতে পারল, ডাল মে কুছ কালা হ্যায়। তখন সে একদিন আমার কাছে আসে।

পাহাড়ে কি সে আপনার সঙ্গেও চড়ত?

তা ঠিক। দুজনে আমরা হিমালয়ে অনেক পাহাড়ে চড়েছি। পরে সে অবশ্য অন্য দলের সঙ্গে জুটে যায়। আমিও ওকালতি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। দুলালের চেয়ে আমি প্রায় দশ বছরের বড়ো।

সে আপনাকে এসে কী বলে?

সে বলে যে, পলার আচরণ তাকে সন্দিহান করে তুলেছে। সে অবশ্য গেনুকে সন্দেহ করেছিল। কিন্তু আমি কিছু ভাবনাচিন্তার পর বুঝতে পারি, কাজটা গেনুর নয়।

কী করে? চাকরটাও তো বেশ গুন্ডা গোছের।

গেনুকে আমি চিনি।

গেনু কী ভালো লোক? এই যে বললেন সে দুলালকেও খুনও করতে পারে!

ঠিক কথা। গেনু খেপে গেলে ভয়ংকর। কিন্তু একটা কথা কী জানিস? গেনু কিন্তু রামলালকে খুব ভালোবাসত। খুব। রামলাল এমনিতে পলার সঙ্গে ঝগড়া করত বটে, কিন্তু মানুষটা খুব খাঁটি ছিল। আরও একটা কথা, সে প্রাণ থাকতে পলাকে বিধবা করবে না।

আপনি তো জন্মেও ও বাড়িতে যান না, তবে এতসব জানলেন কী করে বলুন তো!

শুনে শুনে জানি।

কথাটা বিশ্বাস হচ্ছে না।

বিশ্বাস না হওয়ার কী?

এই যে বললেন গেনুকে আপনি চেনেন। কীভাবে চেনেন?

গেনু আগে আমার কাছে আসত।

কেন আসত?

এমনি। রামলাল পাঠাত কোনো খবর—টবর দিয়ে। তখন গেনু এসে অনেক কথাটথা বলত।

আর পলা?

বন্ধুর বউ হিসেবে ওই একটু যা পরিচয়। দু—একপ্রকার দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে।

সে কী বরাবরই এমন খান্ডারনি ছিল?

একটু রোখাচোখা ছিল বই কী।

লোককে মুখের ওপর স্পষ্ট কথা বলে দিত।

কী করে জানলেন?

ওই নানাভাবে জানা।

রামলাল মরার পর ও বাড়িতেই আপনি যাননি?

না। আমি তখন আমেরিকায় ছিলাম। ঘটনার মাসখানেক বাদে ফিরে জানতে পারি।

তখন যাননি।

না। গিয়ে কি লাভ হত বল!

যেতে তো পারতেন। শত হলেও রামলাল আপনার বন্ধু ছিল।

এমনি যাইনি। গেলে মনটা খারাপ হত।

পলা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি?

না।

এবার দুলালের কথাটা শেষ করুন।

হ্যাঁ, দুলাল। দুলাল যখন আমাকে সব কথা বলল তখন আমার সন্দেহ হল পলাকে। দুলালের সন্দেহ গেনুকে। আমি আমার সন্দেহের কথা দুলালকে বলিনি। দুলাল সন্দেহের বশবর্তী হয়ে গেনুর ওপর চড়াও হয়েছিল। থানা—পুলিশ করারও চেষ্টা করে। কিন্তু প্রমাণ তার হাতে ছিল না। আমি ডাক্তার পালকে ডাকিয়ে অভয় দিয়ে তার পেট থেকে কথা বের করি। তবে ডাক্তার পালও জানে না খুনটা কে করেছে। তার সন্দেহও গেনুর দিকেই। ব্যাপারটা এরকম জায়গাতেই ঝুলে আছে।

সত্যটা কেবল আপনি জানেন?

তা বলছি না। সত্য জানা সহজ নয়। তবে জোরালো অনুমান।

তবে ধরিয়ে দিচ্ছেন না কেন?

পাগল! বলেছি তো, পলার জেল হলে ওর ছেলেটা ভেসে যাবে। তা ছাড়া প্রমাণও তো কিছু নেই।

দুলালের সঙ্গে পলার ভাব হল কী করে?

দুলাল যখন এল তখন পলার মানসিক অবস্থা ভয়ংকর। সেই অবস্থায় দুলাল তার বউদিকে খুব আগলে রেখেছিল। সাইকিয়াট্রিস্ট দিয়ে চিকিৎসা করানো, বাইরে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া, মন ভালো রাখার জন্য নানা ব্যবস্থা করা— সব করেছিল। আর পলাও ওর মধ্যে একটা খুব নির্ভরযোগ্য আশ্রয় খুঁজে পায়।

তারপর?

ঘি আর আগুন। বুঝলি?

বুঝেছি।

ও দু—জন দু—জনকে বেশ আঁকড়ে ধরেছে।

বিয়ে করবে?

এখনো ততটা এগোয়নি। তবে আমার অনুমান, ওরা সেদিকেই এগোচ্ছে।

সেটা গেনুর পছন্দ নয়।

তাও বোঝা যাচ্ছে। গেনুর দুলালকে পছন্দ হওয়ার কথাও নয়।

ঠিক। গেনু চায় না যে, পলা ফের বিয়ে করুক।

আচ্ছা, গেনু কি জানে যে, রামলালকে পলা খুন করেছে?

বোধহয় জানে। সেই সময়ে গেনু বাড়িতে ছিল। হাতুড়িটাও সে—ই সরিয়ে ফেলে।

হাতুড়ি দিয়েই যে খুন করা হয়েছিল তা আপনি জানলেন কী করে?

অনুমান।

আপনার দেখছি সবই অনুমান।

অনুমানও একটা দামি জিনিস। ঠিকমতো লজিক্যালভাবে অনুমান করতে করতে সত্যে পৌঁছানো যায়।

খুনের সময় আপনি এ দেশে ছিলেন না, এক মাস বাদে ফিরে এসে শুধু কানে শুনেই অনুমান করতে লেগে গেলেন, এ কি বিশ্বাসযোগ্য কথা?

তোর দেখি খুব সন্দেহই হয়েছে।

আপনার সঙ্গে থেকে—থেকেই হয়েছে। চামচাগিরি তো সেই কত বছর ধরে করছি।

বাজে কথা। আগে তো তুই নানা ধান্ধায় ঘুরতি, আমাকে এসে মাঝে—মাঝে একটু সেলাম বাজিয়ে গেছিস। গত ছয় মাস ধরে দেখছি একটু কাজে মন হয়েছে।

ওকালতি আমার ভালো লাগে না দাদা, এ কর্ম আমার হওয়ার নয়। অত আর্টিকেল আর সাব ল মনে রাখতে গেলে প্রাণটা শুকিয়ে যাবে।

আমারও কি তাই হয়েছে বলে তোর ধারণা?

সত্যি কথা বলব?

বলেই ফেল।

আপনি তো পা থেকে মাথা অবধি রসকষহীন লোক। বিয়েটা অবধি করলেন না। দিন—রাত আইনের বই, মক্কেল আর মামলা নিয়ে পড়ে আছেন। আপনার সঙ্গে থেকে থেকে আমারও না তাই হয়।

ওরে, আইনের মধ্যে যে—রস আছে তার সন্ধান তো পাসনি। পেলে দেখতি বাইরে চেহারা খেজুর গাছের মতো হলে কী হয়, ভিতরটা টইটম্বুর।

সে রস আপনার থাক, আমার দরকার নেই। যা বলছিলেন বলুন।

ওই তো। বলা তো হয়ে গেছে।

না, হাতুড়ি কথাটা শেষ করেননি।

হ্যাঁ, হাতুড়ি। হাতুড়িটা তো আমার অনুমান। শিলনোড়ার নোড়াটাও হতে পারে, আধলা ইটও হতে পারে। মোটা কাঠের রুল হওয়াও বিচিত্র নয়।

কথা ঘোরাচ্ছেন কিন্তু।

মানুষ মারতে যেকোনো অস্ত্রই যথেষ্ট। তবে আবার বলছি, রামলালের মৃত্যুটা হয়তো ইচ্ছাকৃতভাবে ঘটানো হয়নি।

সে তো কয়েকবারই বললেন।

তুই প্রসঙ্গটা থেকে সরছিস না কেন?

সরতে বলছেন কেন?

খুন জখম কী ভালো প্রসঙ্গ?

আপনি নিজেই তো ক্রিমিন্যাল ল’ইয়ার, খুনজখম নিয়েই তো আপনার কারবার। সেইজন্যই তো মাঝে—মাঝে হাঁফ ছাড়তে ইচ্ছে যায়।

তবু হাতুড়িটার কথা আমি জানতে পাই। মারণাস্ত্রটা যে একটা হাতুড়িই সেটা আপনি খুব ভালো করেই জানেন। কী করে জানলেন?

না শুনেই ছাড়বি না?

কেউ ছাড়ে এই ইন্টারেস্টিং পয়েন্ট?

গেনুই বলেছে।

গেনু পলাকে অত ভালোবসে, সে কেন বলে দেবে আপনাকে?

না বললে যে তার ঘাড়ে দায় বর্তায়।

তার মানে আপনি তাকে জেরা করে করে জেনেছেন।

তাই বটে।

লোকটা কী বোকা?

না তা নয়। আসলে পলাকে সে মেয়ের মতোই ভালোবাসে। সে একটু প্রাচীনপন্থী লোক। একটা মেয়ে তার স্বামীকে খুন করেছে— এটাই তার কাছে একটা ভয়ংকর ব্যাপার। পলাকে পাপমুক্ত করার কথাই সে ভেবেছিল। আমার কাছে যখন এসেছিল তখন কথাবার্তায় কিছু অসংগতি পেয়ে আমি তাকে ধীরে ধীরে কবুল করতে বাধ্য করি। সে সবই স্বীকার করে। এমনকী পরদিন হাতুড়িটা অবধি আমাকে এনে দেয়।

বলেন কী? সেটা কোথায়?

আমার কাছেই আছে। হাতুড়িতে পলার হাতের ছাপ পাওয়া গেছে, রামলালের রক্তের চিহ্নও। আমি সব ফরেনসিকে পরীক্ষা করিয়ে ডকুমেন্টসহ রেখে দিয়েছি।

তবু কিছু করলেন না?

না। এগুলি দিয়েও খুনটা প্রমাণ হওয়ার নয়। রামলাল মারা গেছে এবং প্রসঙ্গটা খুঁচিয়ে তোলা অর্থহীন।

আপনি অত উদার লোক নন দাদা। আমার মনে হচ্ছে ডাল মে কুছ কালা হ্যায়।

হ্যায় তো হ্যায়, ছেড়ে দে।

এবার প্রেমের ব্যাপারটা খুলে বলুন।

বলেছি তো। গত কয়েক মাস ধরে পলা আর দুলাল দু—জনে দু—জনকে খুব আঁকড়ে ধরেছে। ওদের প্রেমটা প্রয়োজনভিত্তিক। পলার একজন শক্তসমর্থ অবলম্বন দরকার ছিল এ সময়ে। আর দুলালের ছন্নছাড়া জীবনেরও একটা নোঙরে বাঁধা পড়বার সময় হয়েছে।

আপনি এই দেওর—বউদির সম্পর্ককে পছন্দ করছেন?

করেছিলাম। কিন্তু মনে হচ্ছে গেনু সেটা হতে দেবে না। তাই দুলালকে সাবধান করা দরকার।

ওরা আমার সঙ্গে এরকম করল কেন বলুন তো!

মানসিক চাপ থাকলে মানুষ অদ্ভুত আচরণ করে।

মানসিক চাপ কেন?

বাঃ, এই তোর বুদ্ধি! বাড়িতে সাড়ে তিনজন মানুষ। বাচ্চা ছেলেটাকে বাদ দিলে তিনজন অ্যাডাল্টই তো মানসিক চাপে ভুগছে।

কীরকম?

পলার কথাই ধর। স্বামীর মৃত্যু হয়েছে তার হাতে, সেই পাপবোধ, তার ওপর দেওরকে ভালোবেসে ফেলার অপরাধবোধ ছিঁড়ে খাচ্ছে ওকে। গেনু চোখের সামনে রামলালকে পলার হাতে খুন হতে দেখে অস্থিরতায় ভুগছে, তার ওপর পলা ঢলাচ্ছে দুলালের সঙ্গে— সেই রাগ। দুয়ে মিলে মাথার ঠিক নেই। দুলালের অবস্থাও ভালো নয়। মুক্ত জীবন ছেড়ে বদ্ধ জীবনের দিকে এগোচ্ছে, বউদির সঙ্গে প্রেম— সেও স্বাভাবিক নেই। ওদের সকলেরই আচরণে তাই ওই অস্বাভাবিকতা। সবাইকে সন্দেহ করে। অচেনা লোক এলেই ভয় পায়।

একটা কথা জিজ্ঞেস করব দাদা?

বল।

হাতুড়িটা আপনি নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন কেন?

এমনিই। কোনো কারণ নেই।

একেবারেই নেই?

না।

আপনি একজন মস্ত ক্রিমিন্যাল উকিল। অপরাধবিজ্ঞান সম্পর্কেও কম জানেন না। আপনি অযৌক্তিক কোনো কাজ করবেন, এটা বিশ্বাস করা কঠিন।

হাসছেন যে!

তোকেও যে সন্দেহবাতিকে পেল।

আর একটা কথা। পলাকে আপনি কতদিন চেনেন?

রামলালের বিয়ের পর থেকে।

রামলালের বিয়ে কবে হয়েছিল মনে আছে?

বছর দশেক। ন—বছর কয়েক মাস।

বিয়েতে খুব ঘটা হয়েছিল বোধহয়?

তা হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ রামলালের বিয়ে নিয়ে পড়লি কেন?

রামলালের বিয়ে নিয়ে নয়, আমি আপনাকে অ্যাসেস করার চেষ্টা করছি।

আমাকে! আমাকে অ্যাসেস করার কী আছে?

আপনি বিয়ে করেননি কেন দাদা?

ওরে বাবা! এ উলটোপালটা জেরা করে সাক্ষীর মুখ থেকে কথা আদায়ের চেষ্টা করছে।

ধরুন তাই। জবাবটা দিন।

এমনি করিনি। ইচ্ছে হয়নি।

হাতুড়িটা আপনি লুকিয়ে রেখেছেন কেন?

এমনি।

পলাকে আপনি কতদিন চেনেন?

বছর দশেক।

দুলালকে পলার কাছে থেকে সরিয়ে দিতে চাইছেন কেন?

দুলালকে গেনু খুনও করতে পারে।

আর কোনো কারণ নেই?

আর কী কারণ থাকবে?

বলব?

কী বলবি?

আপনি পাকে—প্রকারে আমাকে সবই বলে দিয়েছেন। অন্তত হিন্ট করেছেন।

আমি তা থেকে থিয়োরিটা দাঁড় করাতে পারব।

সত্যি?

হ্যাঁ। বলব?

গো অ্যাহেড।

কিছু মনে করবেন না তো!

ঠিক বলতে পারলে মনে করব কেন?

তাহলে বলি! পলাকে আপনি বিয়ের অনেক আগে থেকেই চিনতেন। খুব সম্ভব, আপনাদের গভীর প্রেম ছিল। কোনো কারণে পলার সঙ্গে রামলালের বিয়ে হয়। আমার অনুমান, পলাকে বিয়েতে বাধ্য করা হয়েছিল। সেই কারণে বেচারা রামলালের সঙ্গে তার নিত্য খিটিমিটি। খুনটা ইচ্ছাকৃত না হলেও সেই রাগেরই পরিণতি। ঠিক আছে দাদা?

বলে যা।

কিন্তু পলার ওপর আপনার পরোক্ষ প্রভুত্ব বরাবরই ছিল।

তার মানে কি ব্যাভিচার?

না। আমি যতদূর জানি আপনার ইগো ভীষণ প্রবল। আপনি অপরের এঁটো জিনিস ভোগ করার মানুষ নন। সেইজন্য পরকীয়া আপনার কাপ অফ টি নয়।

কিন্তু প্রভুত্ব অন্য ব্যাপার।

প্রভুত্ব করেছি কী করে বুঝলি?

আপনি প্রভুত্ব ছাড়া মেয়েদের সঙ্গে অন্য সম্পর্ক মানেন না। ঠিক বলেছি?

বলে যা।

কাজেই পলার লাগাম বরাবরই আপনার হাতে ছিল। তার বিবাহিত জীবনেও পরোক্ষে আপনার হুকুমেই পলা চলত। তাই ওদের সংসারে শান্তি ছিল না। শান্তি থাক তা আপনিও চাননি। পলাকে বিয়ে করতে না পারলেও বরাবর সে আপনরাই সম্পত্তি হয়ে থেকেছে। শারীরিকভাবে ভোগ করার চেয়ে এইটেই অনেক বেশি প্রয়োজন ছিল আপনার। ঠিক আছে?

চালিয়ে যা।

খুনের দায় থেকে পলাকে বাঁচিয়েছেন আপনিই। কিন্তু পুরোপুরি বাঁচাননি।

মারাত্মক প্রমাণাদি নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন। পলার ওপর আপনার আয়রন হ্যান্ড।

মুশকিল হল, দুলাল এসে পড়ায়। দুলাল রামলালের মতো ভেড়ুয়া নয়। সে ঝকঝকে পুরুষ। সে এবং পলা প্রেমে পড়ায় আপনার বিপদ দেখা দিয়েছে।

দুলাল পলাকে বিয়ে করলে তাকে পুরোপুরি দখল করবে। আপনার জারিজুরি খাটবে না। ঠিক আছে?

বলে যা না?

আর সেইজন্যই আপনি গেনুকে খাড়া করেছেন। বলাই বাহুল্য গেনুও আপনার অনুগত এবং আজ্ঞাবহ। দুলালকে সরিয়ে না দিলে পলা নামক আপনার প্রিয় ক্রীতদাসীটিকে আপনি চিরকালের জন্য হারাবেন। তাই না?

আর কিছু?

হাতুড়িটা দিন দাদা।

কী করবি?

প্রমাণ নষ্ট করে দেব। কারণ পলা যদি একান্তই দুলালকে বিয়ে করে, তা হলেও তাকে আপনি শান্তিতে থাকতে দেবেন না। হাতুড়িটা তাকে ব্ল্যাকমেল করার কাজে লাগাবেন।

পাগল নাকি?

হাতুড়িটা দিন দাদা।

দিচ্ছি। তোকে একটা কথা বলব?

বলুন।

ওকালতিতে মন দে। খুব ভালো ক্রিমিন্যাল ল’ইয়ার হতে পারবি। আমার চেয়ে অনেক বড়ো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *