1 of 2

হাতির দাঁতের কাজ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

হাতির দাঁতের কাজ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

এ-কাহিনীর যেমন খুশি মানে অবশ্য করা যেতে পারে। প্রতিদিনের সাধারণ বাস্তব ঘটনার সীমা যেখানে শেষ হয়ে আজগুবির কিনারায় গিয়ে পড়েছে, সেইখানে এ-কাহিনীর জন্ম। নিজেদের মনের পাল্লা যেদিকে যেমন ঝুঁকবে, সেই হিসেবেই এ-গল্পের রূপ বদলে যেতে পারে। শুধু ঘটনাগুলো আমি তাই নিরপেক্ষভাবে এখানে বলে যাব।

ব্যাপারটার আরম্ভ যেভাবে হয়েছিল, তা স্মরণ করলে এখনো আমি কেমন যেন একটা অস্বস্তি বোধ করি। সেই অন্ধকার বাদলার রাত! থেকে থেকে বৃষ্টি হচ্ছে কিন্তু আকাশের অসহ্য গুমোট আর কাটতে চাইছে না। মোগলসরাই স্টেশনের থার্ড ক্লাসের—ওয়েটিংরুম ঠিক নয়, টিনের চাল দেওয়া বিশাল শেডের তলায়—একেবারে একলা, রাত দুটোয় একটি ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছি, আর আকাশের মেঘের ডাকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চারিধারে ইঞ্জিনের শান্টিং, মালগাড়ির পরস্পরের সঙ্গে ধাক্কা ও বিশাল জংশন স্টেশনের অসংখ্য অস্বাভাবিক অদ্ভুত আওয়াজ শুনছি। বিশাল টিনের শেডের মাঝখানে মিট্‌মিট্‌ করে যে একটিমাত্র তেলের আলো জ্বলছে, তাতে সামনের অন্ধকার একটু তরল হয়েছে মাত্র; শেডের কোণে কোণে সে আলো একেবারেই পৌঁছোয়নি।

শেডটি শুধ যাত্রীদের অপেক্ষা করার নয়, মাল রাখবারও জায়গা। একধারে টিনের চাল পর্যন্ত বড় বড় কিসের বস্তা স্তূপাকার করে সাজানো। আমি ওজন করবার যন্ত্রটার ওপর বসেছিলাম, সেখানে পরের পর সাজানো পিপের পাহাড় অস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। আর একপাশে কেরোসিন কাঠের একগাদা বাক্স ভালভাবে ঠাহর করে দেখলে চোখে পড়ে। মাঝে মাঝে বাইরের উজ্জ্বল বিদ্যুৎ চমকে সমস্ত শেড আলোকিত না হয়ে উঠলে অবশ্য এ-সমস্ত আমি লক্ষ্য করতাম কিনা সন্দেহ! বিদ্যুতের আলো মিলিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবার সমস্ত শেড আরো অন্ধকার হয়ে উঠছে যেন। কেমন একটা অস্বস্তিকর অদ্ভুত মিষ্টি গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে আছে, ঘোরালো অন্ধকারে জায়গাটা লাগছে রহস্যময়।

সখ করে অবশ্য এ জায়গায় আসিনি। স্টেশনের কোন ওয়েটিংরুমে জায়গা না পেয়েই বাধ্য হয়ে এখানে আসতে হয়েছে। সেকেন্ড ক্লাস ওয়েটিংরুমের সব ক’টা আসনই ভর্তি, ইন্টার ক্লাসের জন্য নির্দিষ্ট ঘরটিতে কে একজন যাত্রী হঠাৎ ভয়ঙ্কর অসুস্থ হয়ে পড়ায় ভয়ানক গোলযোগ ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে। মাত্র ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করলেই গাড়ি পাওয়া যাবে জেনে শেষে এইখানেই আশ্রয় নিয়েছি।

কিন্তু শেডের তলায় আর কোন যাত্রী না দেখে প্রথমটা একটু আশ্চর্য হয়েছিলাম। তৃতীয় শ্রেণীর যাত্রীরা কি আজকাল আর ট্রেনে চাপে না! তবে রাত এখন অনেক; যাত্রী যা দু-একজন আছে, বৃষ্টি সত্ত্বেও স্টেশনের প্ল্যাটফর্মেই হয়তো কোনরকমে আশ্রয় নিয়েছে, এমনও হতে পারে।

নির্জন শেডের ছমছমে অন্ধকারে বসে থাকতে থাকতে মনে হচ্ছিল, আমারও প্ল্যাটফর্মে কোনরকম একটা আশ্রয় খোঁজাই ভাল ছিল। হাত-ঘড়িটার উজ্জ্বল ডায়ালের দিকে চেয়ে দেখলাম, সবে একটা বেজেছে। আরো একঘণ্টা এই শেডের তলায় কাটাতে হবে জেনে মনটা বিশেষ প্রসন্ন হয়ে উঠল না।

ভয়কাতুরে আমি মোটই নয়, অতবড় জংশন স্টেশনের যাত্রীনিবাসে বসে ভয় পাওয়ার কোন কথাও নয়, তবু আবছা অন্ধকারে চারিধারে স্তূপাকার মালের মাঝখানে বসে থাকতে থাকতে অস্বস্তি বোধ করছিলাম।

বাইরের শান্টিং প্রভৃতির শব্দ ও মেঘের ডাকের ফাঁকে ফাঁকে ঘরের এক কোণ থেকে কেঠো পোকায় কাঠ কুরে ফুটো করবার একঘেয়ে শব্দ শোনা যাচ্ছে। একবার একটা শব্দে চমকে চেয়ে দেখলাম, প্রকাণ্ড একটা ইঁদুর বস্তাগুলোর ওপর থেকে দ্রুতবেগে নেমে অন্ধকারের কোণে চলে। গেল। কিন্তু সে-সব অস্বস্তির কারণ হিসাবে ধর্তব্যের মধ্যেই নয়।

পনেরো মিনিট আরো এইভাবে কেটে যাওয়ার পর কিন্তু সত্যই অস্বস্তিটা যেন অত্যন্ত বেড়ে গেছে মনে হল। বড় রেল-স্টেশনের শব্দের কোন ধরা-বাঁধা নিয়ম নেই, হঠাৎ মাঝে মাঝে সব একেবারে থেমে যায়, তারপর আবার শুরু হয় অতর্কিতে। এখন যেন শব্দের বিশৃঙ্খলার মধ্যে সেই রকম একটা ফাঁক পড়েছে, আকাশে মেঘের ডাক নেই, কেঠো পোকাটাও যেন ক্লান্ত হয়ে থেমে পড়েছে, অসাধারণ একটা নিস্তব্ধতা।

সে নিস্তব্ধতা আমার পেছন দিকে খুব কাছাকাছি আচমকা একটা প্রচণ্ড ফোঁস-ফোঁসানির শব্দে ভেঙে গেল। এটা যে নিকটের কোন লাইনের ইঞ্জিনের স্টীম ছাড়ার আওয়াজ তা বুঝেও চমকে ফিরে না তাকিয়ে পারলাম না এবং সেই মুহূর্তে নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।

বিচার করে দেখলে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠার এমন কোন হেতুই অবশ্য ছিল না; কিন্তু যে-ঘরে এতক্ষণ নিজেকে একা বলে জেনে এসেছি, সেখানে আচম্বিতে ঠিক নিজের পিছনেই অপরিচিত সাদা একটি মূর্তিকে বসে থাকতে দেখলে প্রথমটা একটু বিচলিত হয়ে ওঠা অস্বাভাবিক বোধ হয় নয়। আশ্চর্যের কথা এই যে, লোকটা আমার ঠিক পিছনে ওজন করবার যন্ত্রের উপরে এসে বসলেও কখন যে এসে ঢুকেছে, টেরও পাইনি। এখনো লোকটা পাথরের মূর্তির মতই নিশ্চল, এতটুকু সাড়া-শব্দও নেই!

আবছা আলোয় অনেকক্ষণ ধরে লোকটাকে নজর করে দেখলাম। দুটো হাঁটুর উপর ভর দিয়ে মাথা নিচু করে সে বসে আছে, পাশে একটা ছোট বোঁচকা। পোশাক ও মুখের যেটুকু অংশ দেখা যাচ্ছে, তাতেই তাকে সাধারণ দরিদ্র শ্রেণীর একজন চীনেম্যান বলেই সহজে বোঝা যায়।

বুঝে একটু বোকাই হলাম। এ-রকম নির্জন জায়গায় একজন সঙ্গী পেলে খুশি হওয়ারই কথা। দুটো আলাপ করে বাঁচা যায়, কিন্তু চীনেম্যানের সঙ্গে কী আলাপ করব? বাধ্য হয়ে তাই আবার মুখ ফিরিয়ে চুপ করে বসে রইলাম। চীনেম্যানও আমার সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নির্বিকার বলেই মনে হল। শেডের তলায় আর কেউ আছে বলে তার যেন খেয়ালই নেই।

মিনিট পাঁচেক এইভাবে কাটবার পর আর একবার কৌতূহলভরে তার দিকে ফিরে তাকিয়েছি, এমন সময় বাইরে বিদ্যুৎ চমকে উঠল। মাত্র এক সেকেণ্ডের সেই উজ্জ্বল আলোই আমার পক্ষে যথেষ্ট। চীনেম্যান মুখ ফিরিয়ে আমার দিকে একবার আধ-বোজা চোখ তুলে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল, কিন্তু আমি তখন যা দেখবার, তা দেখতে পেয়েছি। লোকটার গালের বাঁ-ধারে একটা লম্বা কাটা দাগ আর বাঁ ভুরুর কোণ থেকে কানের ধার অবধি টাট্‌কা ও জমাট রক্তের সঙ্গে মিশে সেটা দগদগে ঘা হয়ে আছে।

হঠাৎ ভয়ঙ্করভাবে চমকে ওঠায় আমার মুখ থেকে অস্ফুট একটা শব্দ নিজের অজান্তেই বেরিয়ে গেছিল, কিন্তু চীনেম্যানের তাতে ভ্রূক্ষেপও দেখা গেল না। হাঁটুর উপর ভর দিয়ে আগেকার মত নিঃশব্দে, নিশ্চল-নিস্পন্দভাবেই সে বসে রইল, মুখের অতবড় কাটাটাও যেন তার কিছুই নয়।

এবারে রীতিমত অস্থির হয়ে উঠলাম। এ-রকম অদ্ভুত সঙ্গীর সঙ্গে এই নির্জনে বসে থাকার মত মনের জোর সত্যিই হারিয়েছি।

বাইরে বৃষ্টি আবার জোরে পড়তে শুরু করেছে, তা সত্ত্বেও উঠে প্ল্যাটফর্মেই চলে যাব, ঠিক করলাম। সঙ্গে ছোট সুটকেশটা তুলে নিয়ে উঠতে যাচ্ছি, এমন সময় বাইরে অনেক লোকের গোলমাল শোনা গেল। গোলমালটা এই দিকেই আসছে। দেখতে দেখতে কয়েকটা টর্চের আলো শেডের ভিতর এসে পড়ল, তার পরেই কয়েকজন রেলওয়ে পুলিশ ও কর্মচারীর আবির্ভাব ঘটল।

টর্চের উজ্জ্বল আলো আমার দিকে ফেলে হিন্দুস্থানী দারোগা সাহেব একটু যেন বিস্মিতভাবেই এগিয়ে এলেন।

‘আপনি—আপনি কতক্ষণ আছেন এখানে?’

অবাক হয়ে বললাম, ‘তা প্রায় দেড় ঘণ্টা।’

‘দেড় ঘণ্টা! আপনি কি একলাই আছেন?’

‘একলা? না….’

আমার কথা শেষ করতে না দিয়েই দারোগা সাহেব উৎসুভাবে বললেন, ‘আর কে ছিল এখানে? চীনেম্যান, একজন চীনেম্যানকে দেখেছেন?’

পিছনে আঙুল দেখিয়ে বললাম, ‘ওইতো।’ কিন্তু বলার সঙ্গে সঙ্গে পিছন ফিরে তাকিয়ে একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম! কোথায় সে চীনেম্যান!

দারোগাবাবু আমার মুখের ভাব লক্ষ্য করে কৌতূহলভরে বললেন, ‘আপনার পেছনেই ছিল নাকি?’

‘এই তো কয়েক সেকেণ্ড আগেই দেখেছি। মুখের বাঁ দিকে একটা কাটার দাগ।’

পুলিশেরা সবাই মুখ-চাওয়াচাওয়ি করছিল। দারোগাবাবু বললেন, ‘হ্যাঁ, ঠিক দেখেছেন; কিন্তু কয়েক সেকেণ্ড আগে কি বলছেন? সে বেরিয়ে যায়নি এখান থেকে?’

‘আমার জ্ঞানত: তো নয়!’

শেডের মধ্যে স্তূপাকার মালের পিছনে কোন জায়গায় চীনেম্যান লুকিয়ে থাকতে পারে মনে করে পুলিশ তারপর তন্ন-তন্ন করে খোঁজার আর কিছু বাকি রাখল না, কিন্তু কোন চিহ্নই তার পাওয়া গেল না। কেমন করে যে সে এক সেকেণ্ডের মধ্যেই এমন অন্তর্হিত হয়েছে, কে জানে!

হয়রাণ হয়ে পুলিশ শেষ পর্যন্ত খোঁজা বন্ধ করে শেড ছেড়ে চলে গেল। আগাগোড়া এই অপ্রত্যাশিত ব্যাপারে আমি তখন স্তম্ভিত হয়ে আড়ষ্টভাবে দাঁড়িয়ে আছি।

পুলিশের লোক চলে যাওয়ার পর হঠাৎ খেয়াল হল, এ শেডের ভিতর একলা থাকা মোটেই আর নিরাপদ নয়। লোকটার কোন পরিচয় অবশ্য দারোগার কাছে পাইনি, কিন্তু মুখে অত বড় একটা ক্ষত নিয়ে নেহাত কোন সাধু-পুরুষ যে পুলিশের হাত থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে না, এটুকু বুঝতে পেরেছি। তা ছাড়া তার এই শেড থেকে অন্তর্হিত হওয়ার ব্যাপারটার কোন ব্যাখ্যাই যে পাওয়া যায় না।

কথাটা মনে হতেই সমস্ত শরীরটা শিউরে উঠল একবার। না, আর এখানে এক মুহূর্তও নয়। সুটকেশটা নিচে নামিয়ে রেখেছিলাম। সেটা তুলতে গিয়ে মেঝের উপর কী একটা জিনিস পড়ে রয়েছে বলে মনে হল। জিনিসটা তুলে আলোর নিচের নিয়ে গিয়ে ভাল করে দেখে বেশ অবাক হলাম।

হাতির দাঁতের খোদাই করা অপরূপ এক মূর্তি। এ-সব জিনিসের সঙ্গে যেটুকু পরিচয় আমাদের আছে, তাতেই বুঝলাম, কোন উঁচুদরের চীনে কারিগর ছাড়া এমন জিনিস কেউ গড়তে পারে না। মাত্র এক বিঘত পরিমাণ মূর্তিটির সমস্ত অঙ্গ, মায় চোখের ভুরু পর্যন্ত অপরূপ কৌশলে খোদাই করা। হাতির দাঁতে তৈরি সাধারণ চীনেমূর্তির কাল্পনিক দৈত্য-দানবের রূপ এটিতে নেই। সাধারণ একজন চীনে মজুর শ্রেণীর লোক পিঠে ঝোলা বেঁধে একটু নুয়ে পড়ে দাঁড়িয়ে আছে। অদ্ভুত শুধু সেই ক্ষুদে মূর্তির চোখের চাহনি, আর মুখের সূক্ষ্ম বিদ্রূপের রেখা-ফোটানোর কায়দা।

মূর্তিটা যে চীনেম্যানই তাড়াতাড়িতে ফেলে গেছে, এ-বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু আমি এখন করি কি? যেখানের জিনিস সেইখানেই রেখে যাব, না জমা দেবো পুলিশের জিম্মায়!

শেষ পর্যন্ত কিন্তু লোভই জয়ী হল। এমন অপরূপ শিল্পকৌশলের নির্দশন চুরি করতেও বুঝি সত্যিকার সমঝদারের বাধে না। আমি তো ঠিক চুরিও করছি না।

মূর্তিটা সুটকেশে ভরে আমি শেড থেকে বেরিয়ে পড়লাম।

কিন্তু সে মূর্তি আমি বাড়িতে নিয়ে আসতে পারিনি। পথেই সে মূর্তি আমার হাত থেকে খোয়া গেছে। কেমনভাবে আমি তা হারালাম, সেই কথা এবার বলি।

রাত্তির দুটোর ট্রেন আধ ঘন্টা লেট করে যখন স্টেশনে এসে পৌঁছাল, তখন বৃষ্টি মুষলধারে পড়তে আরম্ভ করেছে। সেই বৃষ্টির ভিতর ভাল কামরা খোঁজ করবার উৎসাহ আর ছিল না। সামনে যে কামরা পেলাম, তাইতেই উঠে কিন্তু খুশি হয়ে গেলাম। কামরাটি একেবারে খালি। একটা বাঙ্ক দখল করে শুয়ে পড়লে এরপরে যত লোকই উঠুক না কেন, বাকি রাতটা ঘুমের ব্যাঘাত আর হবে না।

ঘুমোবার আয়োজন করবার আগে কিন্তু আর একবার মূর্তিটি বের করে দেখবার কৌতূহল জয় করতে পারলাম না। ট্রেনের জোরালো আলোয় তার কারুকার্য আরো ভাল করে দেখবার সুবিধা হবে বলে সুটকেশটা খুলে ফেললাম, কিন্তু কোথায় মূর্তি! সব জিনিসের উপরে যে সেটিকে রেখেছিলাম, সে-কথা স্পষ্ট আমার মনে আছে। সুটকেশটি যে-রকম জিনিসে ঠাসা, তাতে নড়াচড়া বা ওলোট-পালোট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও নেই।

তবুও সন্দেহ ভঞ্জনের জন্য উপরের কাপড়-চোপড়গুলো এক-এক করে তুলে ফেললাম। দেখলাম, সে মূর্তিটা আছে ঠিক, কিন্তু এভাবে সিল্কের রুমালটায় জড়িয়ে সেটাকে সুটকেশের তলায় রেখেছি বলে কোন মতেই স্মরণ করতে পারলাম না। অবশ্য তখন মাথার অবস্থা আমার খুব ভাল ছিল না। হয়তো বিমূঢ়তার মধ্যে এইভাবেই রেখে থাকব মনে করে সিল্কের রুমাল খুলে সেটা বের করলাম।

ট্রেনের জোরালো আলোয় তার অপূর্ব কারুকার্য সত্যই আরো স্পষ্ট হয়ে উঠল। কিন্তু একটা খুঁতও সেই সঙ্গে দেখতে পেয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল। শেডের ম্লান আলোয় এ খুঁতটুকু ধরা পড়েনি। চীনেম্যানের হাত থেকে অসাবধানে মেঝেয় পড়বার সময়েই বোধহয় মূর্তিটির মুখের বাঁ-ধারে একটু চিড় খেয়ে গেছে। সামান্য একটু সূক্ষ্ম দাগ মাত্র, কিন্তু এমন মূল্যবান জিনিসের এইটুকু খুঁত থাকলে মনও ক্ষুণ্ণ হয়।

সযত্নে মূর্তিটিকে আবার সিল্কের রুমালে জড়িয়ে সুটকেশের ভিতর তুলে রাখলাম। তারপর সুটকেশটি মাথার কাছে রেখে পুলিশের ফেরারী আসামী সাধারণ একজন চীনেম্যানের হাতে এমন দামী জিনিস কেমন করে এসে পড়েছিল, ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি, জানি না।

ঘুমের ভিতরে অস্পষ্টভাবে সেই চীনেম্যানকেই যেন স্বপ্ন দেখছিলাম, আমার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে অজানা ভাষায় সে যেন কি বলে আমায় শাসাচ্ছে! হঠাৎ আমার মাথাটা ধরে সজোরে সে ঝাঁকুনি দিল। ঘুমটা সহসা ভেঙে গেল।

সভয়ে চোখ খুলে তাকিয়ে দেখি, চীনেম্যান নয়, একজন ভদ্রলোক আমার গায়ে ঠেলা দিয়ে জাগাচ্ছেন।

বিমূঢ়ভাবে উঠে পড়লাম। ট্রেন একটা স্টেশনে এসে থেমেছে, বাইরে কুলি ও যাত্রীদের হাঁক-ডাক শোনা যাচ্ছে।

এতক্ষণে ভদ্রলোকের কথায় আমার কান গেল ‘কি রকম ঘুমোচ্ছেন, মশাই! ট্রেনে এমন অসাবধানে ঘুমোয়!’

‘কেন, কি হয়েছে?’

‘কি হয়েছে, দেখতে পাচ্ছেন না?’

দেখতে আমি সেই মুহূর্তেই পেলাম। আমার সুটকেশ খোলা! কাপড়-চোপড় জিনিসপত্র তছনছ হয়ে কিছু বাঙ্কের উপরে, কিছু কামরার মেঝেয় পড়ে আছে।

‘টাকাকড়ি ছিল নিশ্চয়, দেখুন কি গেছে?’

টাকাকড়ি নয়, কি যে গেছে, আমি সুটকেশের ওই অবস্থা দেখামাত্র বুঝেছি। তবু দুরাশা করে সমস্ত কামরায় ছড়ানো জিনিসপত্র ও সুটকেশ তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখলাম। না, সে মূর্তিটা ছাড়া আর সব জিনিসই ঠিক আছে।

ভদ্রলোক আমার মুখ দেখে সহানুভূতির স্বরে বললেন, ‘খুব বেশি কিছু ছিল বুঝি? স্টেশন-মাস্টারকে খবর দিন এক্ষুনি।’

তারপর একটু থেমে কি ভেবে বললেন, ‘ঠিক হয়েছে; ট্রেন প্ল্যাটফর্মে থামবার আগেই একজন চীনেম্যান এই কামরাটা থেকেই নেমে গেছে বলে মনে পড়ছে এবার।’

‘চীনেম্যান!’

‘হ্যাঁ, পিঠে একটা বোঁচকা সমেত। তখন খেয়াল করিনি। তারপর কামরায় ঢুকেই দেখলাম, আপনার সুটকেশের এই দশা। ইশ! তখন যদি আমার বুদ্ধি হত! যাই হোক—পুলিশে খবর দিন এইবেলা, স্টেশন-মাস্টারকে বলে।’

কিন্তু আমি সিল্কের রুমালটা হাতে নিয়ে বিমূঢ় হয়ে বসেই রইলাম।

রুমালটার একধারে সামান্য একটুখানি রক্তের দাগ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *