হাতিচোর
মাহুতের নাম মূলচাঁদ। তার কালো কুচকুচে শরীর, খালি গা, শুধু একটা ধুতি মালকোচা এঁটে পরা। সেই ধুতির মধ্যে গোঁজা একটা ছুরি। লোকটির মুখখানা কিন্তু খুব দয়ালু—দয়ালু। মনে হয় না, কোনদিনও ঐ ছুরি কারুকে মারতে পারে।
সকালবেলা তাকে দেখেছিলাম জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে মস্ত বড় একটা হাতির পিঠে চেপে দুলতে দুলতে আসছে। আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম ডাক—বাংলোর বারান্দায়। আমাদের দেখে সে লম্বা একটা সেলাম দিল। অমনি ঝর্ণামাসির ছেলে বুবুন বলে উঠল, হাতি চড়ব, আমি হাতিতে চড়ব!
ঝর্ণামাসি বললেন, না না, অতবড় হাতির পিঠে চড়তে হবে না। বুনো হাতি!
আমি বললাম, বুনো হাতির পিঠে কি আর মাহুত থাকে? কোনো ভয় নেই। আমি বুবুনকে নিয়ে যাচ্ছি! এই মাহুত, দাঁড়াও!
ডাক—বাংলো থেকে আমরা দৌড়ে বেরিয়ে এলাম বাইরে। হাতিটা তার ছোট্ট—ছোট্ট চোখ দিয়ে আমাকে আর বুবুনকে একবার দেখে নিল, তারপর ফ—র—র—র ফ—র—র—র শব্দ করতে লাগল মুখ দিয়ে।
আমি বললাম, তোমার হাতিটাকে একটু নিচু করো না মাহুত, আমরা একটু চড়ব!
মূলচাঁদ হেসে বলল, এ হাতিটা বড় দুষ্টু, সাহেব। আপনারা চড়লে ভয় পাবেন!
বুবুন বলল, না, আমরা ভয় পাই না! আমরা হাতিকে ভয় পাই না!
বুবুনের বয়েস মাত্র পাঁচ। সে সত্যি খুব সাহসী। সব সময় তার কোমরে দুটো খেলনা পিস্তল থাকে। সে বলেছে, এ পিস্তল দিয়ে সে এবার একটা বাঘ মারবে।
সে মাহুতকে আবার বলল, আমাদের হাতির পিঠে চাপিয়ে বাঘের কাছে নিয়ে চলো!
মাহুত আমার দিকে তাকিয়ে বলল, সাহেব, আপনাদের কাল সকালে আমি হাতির পিঠে চড়াব। আজ আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে। নদীর উজানে হাতির পাল নেমেছে।
তাই শুনে আমি চমকে উঠে বললাম, বুনো হাতির পাল?
সে বলল, হ্যাঁ।
আমি বললাম, সেখানে তুমি যাবে? কেন, সেখানে গিয়ে তুমি কী করবে?
সে বলল, দেখি যদি একটা হাতি ধরতে পারি!
তুমি হাতি ধরো নাকি?
হ্যাঁ, সাহেব। লালজী সাহেব তো হাতি ধরার ব্যবসা করেন, আমি তার কাছেই কাজ করি।
তাই নাকি? নদীর ধারে যে কয়েকটা তাঁবু দেখেছি, সেগুলো বুঝি লালজীর তাঁবু?
হ্যাঁ।
সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে হলো, তাহলে তো আমিও হাতি—ধরা দেখতে যেতে পারি! ওদের পেছনে পেছনে চলে গেলেই হয়। বুবুনকে বললাম, তুমি মা’র কাছে যাও তো। আমি একটু ঘুরে আসছি!
ওইটুকু ছেলে, কিন্তু কী দারুণ বুদ্ধি! আমার দিকে চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে বলল, তুমি বুঝি হাতি—ধরা দেখতে যাবে? তাহলে আমি যাব!
আমি বললাম, না, আমি অন্য জায়গায় যাব!
বুবুন বললো, তুমি যেখানে যাবে আমিও সেখানে যাব।
সারাদিন আর বুবুন আমার সঙ্গ ছাড়ল না। কিছুতেই আর ওর চোখ এড়িয়ে যেতে পারি না। এটুকু কোথাও গেলেই ও অমনি দৌড়ে চলে আসে।
আমাদের ডাক—বাংলোর সামনেই একটা নদী। তার নাম জয়ন্তী। খুব সুন্দর ছিমছাম একলা একলা একটা পাহাড়ী নদী। দু’পাশেই জঙ্গল। খানিক আগে আছে একটা ছোট্ট রেলস্টেশন। রেলের লাইন ওখানেই শেষ। বনের মধ্যে হঠাৎ এরকম এক জায়গায় রেল—লাইন শেষ হয়ে যেতে আমি আগে দেখিনি। সারাদিনে একটা ট্রেন আসে, আবার সেটাই ফিরে যায়। অন্য সময় একদম চুপ।
নদী পেরিয়ে আরও গভীর জঙ্গল। তার মধ্য দিয়ে আছে গাড়ি চলার রাস্তা। দূরের পাহাড় থেকে বৃষ্টির জল গড়িয়ে এসে রাস্তাটার ওপর দিয়ে নদীর মতন বয়ে যায়। ওই সব পাহাড় থেকেই নেমে আসে বুনো হাতির পাল। আচমকা কখনো শোনা যায় বাঘের ডাক।
আমাদের বাংলোর খুব কাছেই একটা বড় শাল গাছ থেকে মাঝে মাঝে ডেকে ওঠে একটা তক্ষক সাপ। ঝর্ণামাসি তক্ষক সাপ দেখেননি। সেই ডাক শুনলেই আমাকে বলেন, দ্যাখ তো, সাপটাকে দেখা যায় কিনা।
আমি ছুটে যাই। বুবুনও যায়। কিন্তু সেটাকে কিছুতেই দেখা যায় না।
সন্ধের দিকে দারুণ হইচই শোনা গেল।
ছুটে রাস্তার ধারে গিয়ে দেখলাম, অনেক লোক একসঙ্গে চ্যাঁচামেচি করছে! আর মাহুত মূলচাঁদ বলছে, আস্তে, আস্তে চ্যাঁচাবেন না। ও ভয় পারে!
কে ভয় পাবে?
ভিড় ঠেলে উঁকি মেরে দেখলাম, মূলচাঁদের সেই মস্ত বড় হাতিটার পাশে দাঁড়িয়ে আছে একটা বাচ্চা হাতি। তার গায়ের সবুজ সবুজ রং দেখলেই বোঝা যায়, সদ্য বন থেকে এসেছে।
মূলচাঁদ ধরে এনেছে ওই বাচ্চা হাতিটাকে।
বুবুন অমনি লাফাতে লাগল, আমি ওই বাচ্চা হাতিটায় চড়ব! আমি ওই বাচ্চা হাতিটায় চড়ব!
বাচ্চা হাতিটা এত লোক দেখে ঘাবড়ে গেছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে হাতিটার পেটের নিচে ঢুকে পড়তে চাইছে। বড় হাতিটা দু’চার পা এগিয়ে গেলেই সেও ছুটছে সঙ্গে সঙ্গে।
লোকজনের ভিড় সরিয়ে দেওয়া হল। আর মূলচাঁদ তখন দৌড় করাতে লাগল বড় হাতিটাকে। বেশখানিকটা জায়গা নিয়ে বড় হাতিটা গোল হয়ে ছুটছে, আর সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছে বাচ্চা হাতিটা।
খানিক বাদে মূলচাঁদকে আর শেখাতে হল না। তার হাতি নিজেই ছুটতে লাগল সেই এক জায়গায়। আর মূলচাঁদ একটা গামছা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে হাওয়া খেতে লাগল।
আমি তখন জিজ্ঞেস করলাম, ভাই মূলচাঁদ, হাতি দুটো শুধু এইটুকু জায়গায় ওরকম দৌড়চ্ছে কেন?
মূলচাঁদ বলল, সাহেব, বাচ্চা হাতিটা না হলে যে ভয় পেয়ে যাবে। দৌড়তে থাকলে ও ভাববে, ও এখনো ওর দলের সঙ্গেই যাচ্ছে।
এরকম কতক্ষণ দৌড়বে?
তো ধরুন, সারা রাত!
কী করে ধরলে হাতিটাকে? বাচ্চা হাতিটা কি বনের মধ্যে একলা একলা ঘুরছিল?
না সাহেব। বাচ্চা হাতি কক্ষনো একলা থাকে না। দলের মধ্যে থাকে।
তা হলে কী করে দল থেকে একলা ওটাকে বার করে আনলে?
বুনো হাতির পালের মধ্যে আমাদের ট্রেনিং দেওয়া হাতিটাকে ছেড়ে দিই! ও মিশে যায় দলের মধ্যে। তারপর এক সময় করে কী, একটা বাচ্চা হাতিকে দু’পায়ের ফাঁকে আটকে চট করে থেমে যায়। অন্য হাতিগুলো কিছু বুঝতে পারে না, তারা এগিয়ে যায় সামনের দিকে। তখন আমাদের পোষা—হাতিটা ওই বাচ্চা হাতিটার মুখ ঘুরিয়ে দেয় অন্য দিকে। তারপর বড়টা চলতে শুরু করলেই ছোটটা তার পেছনে পেছনে আসে।
বাবাঃ, তোমরা হাতিকে এরকম ট্রেনিং দাও?
মূলচাঁদ লাজুক হেসে বলল, সে হুজুর আমাদের দয়ায় হয়ে যায়।
আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, এবার ওই বাচ্চাটাকে নিয়ে কী করবে? বিক্রি করে দেবে?
মূলচাঁদ বললো, না, এত তাড়াতাড়ি কি হয়! কালই ওকে এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। ওর মা যদি টের পেয়ে যায়, তাহলে ফিরে আসতে পারে। ওকে এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে কয়েকদিন ট্রেনিং দিতে হবে।
যদি ওর মা ফিরে আসে তা হলে কী হবে?
মূলচাঁদ কপালে হাত ছুঁইয়ে বলল, বাবু, সে—কথা বলবেন না! সে বড় বিপদের কথা! তবে, সাধারণত আসে না। হাতির পাল এক রাতে অনেক দূর চলে যায়!
আমরা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই হাতির দৌড় দেখলাম। তারপর ফিরে এলাম ডাক বাংলোতে। বুবুন প্রবল উৎসাহে ছোট মাসিকে শোনাতে লাগল হাতির গল্প।
সেই রাতে এক তুমুল কাণ্ড হলো। সন্ধের পরই চারদিকে একদম নিঝুম হয়ে যায়। বড় রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলাও বন্ধ হয়ে যায় অন্ধকার নামার পর থেকেই। রাত্তিরবেলা আমরা তখন থেকে বসেছি হঠাৎ একসঙ্গে অনেক লোকের চিৎকার শোনা গেল। জঙ্গলের মধ্যে এত লোক কোথায় ছিল কে জানে!
আমরা বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে দেখলাম, নদীর ওপারে জঙ্গলের মধ্যে কিছু লোক মশাল নিয়ে ছোটাছুটি করছে। মেসোমশাই বললেন, ডাকাত পড়ল নাকি?
ঝর্ণামাসি বললেন, এই জঙ্গলের মধ্যে ডাকাত?
তারপরই হাতির গলার আওয়াজ পাওয়া গেল। একটা নয়, অনেকগুলো। ক্রমেই কাছাকাছি এগিয়ে আসতে লাগলো সেই শব্দ। কারুকে কিছু বলে দিতে হলো না, আমরা বুঝে গেলাম, বুনো পাতির পাল আসছে এদিকে।
এর আগে আমরা শুনেছিলাম, কয়েক মাইল আগে রাজাভাতখাওয়া নামে একটা স্টেশনের ওপরে মাঝে মাঝে এসে পড়ে বুনো হাতির দল। স্টেশন মাস্টারের ঘরে পর্যন্ত ঢুকে যায়। গুদাম—ঘরের দরজা ভেঙে ফেলে শুঁড় দিয়ে খুঁজে দেখে, সেখানে তাদের কোনো খাবার আছে কি না।
এবার কি এখানেও হাতির পাল আসছে?
মেসোমশাই বললেন, বন্দুকটা আনলে হত দেখছি।
ঝর্ণামাসি বললেন, একটা বন্দুক দিয়ে ক’টা হাতি মারতে তুমি? মনে তো হচ্ছে, একশো—দু’শোটা হাতি আসছে!
দূরে জঙ্গলের মধ্যে লোকেরা দুমদাম করে আওয়াজ করছে। কয়েকটা মশাল উড়ে যাচ্ছে বনের মাথা দিয়ে। বোধহয় ওরা মশাল ছুঁড়ে হাতির পালকে ভয় দেখতে যাচ্ছে।
কিন্তু হাতিরা ভয় পেল না।
বেশ জ্যোৎস্না উঠেছে, বেশি অন্ধকার নেই। আমরা এক সময় দেখতে পেলাম, ব্রিজের ওপাশে এসে দাঁড়িয়েছে দুটো—তিনটে হাতি। তার মধ্যে একটা হাতি ব্রিজের মাঝখানে এসে শুঁড় উঁচু করে খুব জোরে ডাকল।
সেই ডাক শুনেই আমাদের বুক মুচড়ে উঠল। ডাক অসম্ভব করুণ। বুঝতে অসুবিধে হয় না যে, ওটা একটা মা হাতি, ঠিক যেন কাঁদছে তার সন্তানের জন্য।
দূরে লালজীর তাঁবুর দিকে থেকে গুড়ুম—গুড়ুম করে কয়েকটা বন্দুকের শব্দ হলো। ঝর্ণামাসি বললেন, গুলি চালাচ্ছে, শিগগির ঘরের মধ্যে চলে এসো!
আমি বললাম, এগুলো নিশ্চয়ই ফাঁকা আওয়াজ। হাতি ধরার লোকেরা গুলি করে হাতি মারে না। সে—রকম নিয়ম নেই।
বন্দুকের আওয়াজেও হাতির পাল ভয় পেল না। সেই মা—হাতিটা আর একবার ডাকল করুণ গলায়। তারপর দৌড়ে এগিয়ে আসতে লাগল এদিকে, তার পেছনে আরো হাতি! অনেকগুলো। শুধু মাথার পর মাথা এগিয়ে আসছে। সর্বনাশ! ওরা রেগে গেছে। যদি এদিকে এসে সব কিছু তছনছ করে দেয়? এমন কী ওরা এই ডাকবাংলোটাও ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে পারে।
বুবুন ঘুমিয়ে পড়েছিল। এতরকম আওয়াজে সে হঠাৎ ঘুম ভেঙে উঠে এল বারাবন্দায়। কিছুই বুঝতে না পেরে সে ‘মা মা’ বলে কেঁদে উঠল।
ঝর্ণামাসি চট করে তাকে কোলে তুলে নিলেন! যেন তাঁর ছেলেকেই কেউ চুরি করে নিয়ে যেতে এসেছে!
এমন সময় দেখলাম, এদিক থেকে মূলচাঁদ সেই বাচ্চা হাতিটার ল্যাজ মোচড়াতে মোচড়াতে নিয়ে আসছে। একা হাতির পাল এক্ষুনি বোধহয় ওকে টুকরো টুকরো করে ফেলবে।
আমরা ভেবেছিলাম মূলচাঁদ নিশ্চয়ই বাচ্চা হাতিটাকে ফেরত দিতে যাচ্ছে তার মায়ের কাছে। কিন্তু দেখলাম মূলচাঁদ চুপি চুপি সেটাকে নিয়ে নেমে যাচ্ছে নদীতে। ঝর্ণামাসি শিউরে উঠে বললেন, ওমা, ও লোকটা যাচ্ছে কোথায়?
মেসোমশাই গম্ভীর ভাবে বললেন, ও হাতিটাকে নিয়ে পালাচ্ছে।
সত্যিই মূলচাঁদ হাতিটাকে নিয়ে জলে নেমে পড়ল। বুবুন বলল, হাতিটা জলে ডুবে যাবে না?
আমি বললাম, হাতিরা বোধহয় জন্ম থেকেই সাঁতার জানে।
এরপর আমাদের আর কিছু দেখা হলো না। অনেকগুলো হাতি দুদ্দাড় করে চলে এলো এদিকে। আমরা সত্যিই ভয় পেয়ে গেলাম। হাতিগুলো সাঙ্ঘাতিক রেগে গেছে মনে হয়। ডাকবাংলোর বারান্দায় আমাদের দেখতে পেলে যদি তেড়ে আসে? আমরা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। কিন্তু হাতিগুলোর চিৎকারে আমাদের বুক কাঁপতে লাগল। কয়েকটা হাতি এসে ধাক্কা মারলেই আমাদের এই কাঠের ডাকবাংলোটা ভেঙে পড়বে।
অনেকক্ষণ ধরে চলল হাতিদের চ্যাঁচামেচি। সেই সঙ্গে দুমদাম করে পটকার শব্দ আর গুলির শব্দ। যেন এক দারুণ যুদ্ধ হচ্ছে। তারই মধ্যে বুবুন তার খেলনা পিস্তল দুটো হাতে নিয়ে বলতে লাগল, আমিও যুদ্ধ করব, আমিও যুদ্ধ করব আমাকে ছেড়ে দাও! আমরা ওকে জোর করে ধরে রাখলাম।
শেষপর্যন্ত এক সময় সব শব্দ আস্তে আস্তে দূরে চলে গেল। আমরা একটু একটু জানালা ফাঁক করে বাইরে দেখলাম। কিছুই দেখা গেল না।
পরদিন ভোর হতে না হতেই আমরা ছুটে এলাম বাইরে। সত্যিই যুদ্ধক্ষেত্রের মতন অবস্থা। চার পাঁচটা বড় বড় গাছ ভেঙে পড়ে আছে রাস্তার ওপরে। কিন্তু কোনো বাড়ি ভাঙেনি। একটা পাথর—ভর্তি লরি দাঁড় করান ছিল রাস্তার পাশে। সেটা কাত হয়ে হেলে আছে একদিকে। সব পাথর এদিকে ওদিকে ছড়ান।
এরই মধ্যে কিছু লোক জেগে উঠে ভিড় করে আছে ব্রিজের পাশে। তাদের কাছে শুনলাম, হাতির পাল নাকি নদীতে নেমে ঠিক উদ্ধার করে নিয়ে গেছে বাচ্চাটাকে। আর মূলচাঁদ? তার খবর ঠিক কেউ জানে না।
শুধু একজন বলল, মূলচাঁদকে ধরে নিয়ে গেছে হাতিরা।
তাই শুনে বুবুন বলল, চলো নীলু দাদা, আমরা ওকে উদ্ধার করে আনি!
আমি বললাম, হ্যাঁরে, তা তো যেতেই হবে!
কিন্তু ঝর্ণামাসি আর একবেলাও থাকতে চান না এখানে। কাল রাত্তিরের ঘটনায় তিনি ভয় পেয়ে গেছেন খুব। আবার যদি হাতিরা আসে? মূলচাঁদের কথা শুনে ঝর্ণামাসি বললেন, হাতিরা ওকে চুরি করে নিয়ে গেছে? বেশ হয়েছে! ও কেন হাতির বাচ্চা চুরি করতে গিয়েছিল?
আমাদের চলে যাবার একটুও ইচ্ছে নেই, কিন্তু ঝর্ণামাসি রাগারাগি করতে লাগলেন খুব। মেসোমশাই জিপ গাড়িটা বার করলেন। তাতে জিনিসপত্র তোলা হচ্ছে, এমন সময় বড় রাস্তায় আবার একটা হইহই শব্দ উঠল। আমি আর বুবুন ছুটে গেলাম সেখানে, শুনলাম, খোঁজ পাওয়া গেছে মূলচাঁদের। ওপারে জঙ্গলে দুটো গাছের মাথায় নাকি শুয়ে আছে মূলচাঁদ। একটু আগে তার জ্ঞান ফিরে এসেছে, সে সেই অবস্থায় চ্যাঁচামেচি করছে। নামতে পারছে না।
এরপর তো আর সব ঘটনাটা না—জেনে যাওয়া যায় না। পুলিশের গাড়ি এসে পড়েছিল। তার থেকে ক’জন পুলিশ মশমশিয়ে চলল ওপারের জঙ্গলে। আমরাও গেলাম সঙ্গে সঙ্গে। তারপর এক জায়গায় দেখলাম অবাক কাণ্ড! পাশাপাশি দুটো বেশ বড় গাছ। তার মধ্যে এক গাছের ডালে মূলচাঁদের মাথা আর অন্য গাছে তার দুটো—পা। দুটো গাছের মাঝখানে সে ব্রিজ হয়ে আছে।
মূলচাঁদ নেমে গিয়েছিল নদীতে। সেখান থেকে গাছের ডগায় এল কী করে? ‘সে ”বাঁচাও বাঁচাও” বলে চিৎকার করছে। আর নিচ থেকে সবাই বলছে, এই চেঁচিয়ো না, পড়ে যাবে।
বুবুন হঠাৎ খিল খিল করে হেসে উঠল। আমি ওকে ধমক দিয়ে বললাম, এই হাসতে নেই। একটা লোক বিপদে পড়েছে…।
কিন্তু বুবুনের হাসি শুনে অন্য সবাইও হেসে উঠল হো হো করে।
মূলচাঁদকে শেষ পর্যন্ত গাছ থেকে ঠিকঠাক নামিয়ে আনা হলো অবশ্য। সে নেমেই বলল, ও বাবারে, খুব বেঁচে গেছি। আর আমি হাতি ধরার কাজ করব না। আর এ জায়গাতেই থাকব না! একটা হাতি আমাকে জলের মধ্যে ধরে ফেলে শুঁড়ে তুলে যখন নিয়ে যাচ্ছিল, তখন ভাবলাম বুঝি আছাড় দিয়ে মেরেই ফেলবে!
একজন পুলিশ বলল, এবারের মতন হাতিরা একটু ঠাট্টা করে গেছে মূলচাঁদের সঙ্গে।
সঙ্গে সঙ্গে একজন জংলী লোক বলল, হ্যাঁ, স্যার! হাতিরা যখন ফিরে যায়, আমি তখন শুনেছিলাম তারা খুব হাসছে। হাসতে হাসতে এ—ওর গায়ে ঢলে পড়ছে!
তাই শুনে পুলিশরাও এ—ওর গায়ে ঢলে পড়ে হাসতে লাগল।