হাতপাখা
এক একটা জিনিস কিভাবে যেন কালের হাত এড়িয়ে চলে আসে সেকাল থেকে একালে। জানালার গ্রিলে গোঁজা রয়েছে তালপাতার একটি হাতপাখা। পাখাটি আর পাখা নেই—একটি ইতিহাস। কবে এ তল্লাটে বিদ্যুৎ এসে গেছে। কয়লার উনানের জায়গায় এসে গেছে গ্যাস। সব কাজ থেকে ছুটি মিলে গেছে পাখাটির। রিটায়ার্ড হাতপাখা বয়স্ক এক বৃদ্ধের মতো তার নির্বাসিত জায়গাটি থেকে তাকিয়ে আছে গোটা পরিবারের দিকে। তা বয়স হল প্রায় ষাট। ফেলে দিলেই হত; কিন্তু ফেলা হয়নি। পাখাটি ইতিহাস হয়ে গেছে।
রথের মেলা থেকে মা কিনেছিলেন সাধারণ দর্শন এই পাখাটি। তারপর পাশে লাল কাপড়ের ঝালর লাগিয়ে দর্শনীয় করে তুলেছিলেন; সেই ঝালর এখনও আছে, তবে রঙের আর সেই জেল্লা নেই। তবু আছে। ষাট বছর আগে এ তল্লাটে বিদ্যুৎ ছিল না। পাখাটি ছিল আমার মায়ের খুব আদরের। সাজগোজ দেখলে এখনও তাই মনে হয়। ব্যবহারে-ব্যবহারে হাতলটি বেশ তেলা। নানা হাতের ঘর্ষণে পালিশ ধরে গেছে। বহুকাল হল, মা চলে গেছেন। আমার বয়স তখন মাত্র চার। শুনেছি, শিশু আমিটিকে গরমে বাতাস দেওয়ার জন্যে মা পাখাটিকে কিনেছিলেন। কিনে লাল ভেলভেটের ঝালর লাগিয়ে নিজের খাসপাখা করে রেখেছিলেন। বড় শৌখিন ছিলেন তিনি। খসখসের আতর মাখিয়ে বাতাস করতেন। সেই বাতাসের ভাগ পেতেন আমার কর্মক্লান্ত পিতা। পাখাটি আমাদের বিশাল বিছানায় ফেলে রেখে মা চলে গেলেন। পিতা সেটিকে তুলে নিলেন সংগ্রহশালায় স্মৃতি করে। হাতলে লেগে আছে মায়ের হাতের চাঁপার কলির মতো আঙুলের স্পর্শ। অনামিকায় ছিল সাপের চোখের মতো লাল চুনি বসানো একটি আংটি। আমার মা ছিলেন সুন্দরী। প্রবীণারা এখনও তাঁর রূপের, তাঁর গুণের বর্ণনা করেন। শুনে শুনে আমার মনে একটা ধারণাই তৈরি হয়ে গেছে—আমার মা ছিলেন রূপের আর গুণের শেষ কথা। মায়ের গুণে মনে বাসা বেঁধে আছে চাপা একটা গর্ব।
কিছুকাল পরে আমার পিতাও চলে গেলেন। সেই সময় চিকিৎসাবিজ্ঞান একালের মতো উন্নত হয়নি। মানুষের বেঁচে থাকাটা ছিল বড় অনিশ্চিত। তা ছাড়া কিছু মানুষ ছিলেন প্রকৃত প্রেমিক। লম্বা চুল আর পাউডার-ঘষা মুখ নিয়ে, আই লাভ ইউ বলে বছরখানেক নৃত্য করেই ‘আই ডিভোর্স ইউ’ বলে উকিলের কাছে ছুটতেন না। স্বামী-স্ত্রীর বন্ধনে একটা ‘থান্ডার লক’ তৈরি হত। স্ত্রী-বিয়োগে সে যুগে বহু পুরুষই ভীষণ কাবু হয়ে পড়তেন। সংসারবিরাগী সন্ন্যাসীও হতেন কেউ কেউ। কেউ গুমরে থেকে থেকে মৃত্যুকে এগিয়ে আনতেন কাছে।
আমি যখন সম্পূর্ণ অনাথ তখন এই হাতপাখাটিই হল আমার পিতা-মাতা। চলে না গেলে বোঝা যায় না, পিতা-মাতা ছাড়া মানুষের আপনজন আর কেউ নেই। আর সবাই একটা ভাসাভাসা বাইরের সম্পর্ক। কী, কেমন আছ? ভালো, আপনি কেমন? ছ’টি শব্দে জগৎ ঘুরছে। মরুভুমির মতো জীবনে লাল ঝালর লাগানো সামান্য একটি হাতপাখাই যেন আমার মরুদ্যান। মসৃণ হাতলে আমার মায়ের হাতের স্পর্শ। যে হাত দুটি চিরতরে হারিয়ে গেছে। পুনর্জন্ম থাকলেও, এ জীবনের সম্পর্ক আর পরের জীবনে ফিরে পাওয়া যাবে না। একবার। মানুষের যা-কিছু তা মাত্র একবারের জন্যেই। পাখার তালপাতা-অংশে গোল গোল, লাল লাল, আলতার ফোঁটা। মা লাগিয়েছিলেন সরু আঙুলের ডগা দিয়ে। সেই দাগ আজও আছে। নির্জন, নিরালা দুপুরে, রোদে যখন মাঠঘাট ঝলসাতে থাকে, কাক শুকনো গলায় অতি কষ্টে একটি ক্লান্ত কা বের করে, তখন আমি সাবধানে পাখাটি দোলাই। মনে হয় গায়ে আমার মায়ের নিশ্বাস লাগল। ব্যস্ত, বাস্তব পৃথিবী বলবে, বুড়োটার আদিখ্যেতা দেখে বাঁচি না। মা নেই, তাই এত স্মৃতিবিলাস। থাকলে বুড়িকে বাতাসা খাইয়ে ফেলে রাখত। হয়তো তাই। জীবন আর মৃত্যুর মাঝের এই ভীষণ উপত্যকায় সত্য কী আজও বোঝা গেল না। যা কিছু ঘটাটাই হয়তো সত্য।
পিতার মৃত্যু শয্যায় মাথার কাছে বসে এই পাখাটি মৃদুমন্দ নেড়ে যখন বাতাস করতুম অপলকে তিনি পাখাটির দিকে তাকিয়ে থাকতেন। আচ্ছন্ন, ঘোর লাগা চোখ। মাঝে মাঝে কপাল কুঁচকে উঠত। বুঝতে পারতুম, তিনি কানখাড়া করে শোনার চেষ্টা করছেন, হাত নাড়ার তালে তালে চুড়ি আর রুলির শব্দ। দেখার চেষ্টা করছেন গোল ফরসা একটি হাত। পরক্ষণেই ঠোঁটে খেলে যাচ্ছে মৃদু একটি হাসি। বুঝতে পেরেছেন, চলে যাওয়ার মতো নিষ্ঠুর সত্য আর কিছু নেই। এ যাওয়ার আর আসা নেই। পাখাটি নিয়ে যেতে মাঝপথ থেকে তিনি আর ঘুরে আসবেন না। ‘আচ্ছা, এক গেলাস জল দে, খেয়ে যাই’ বলে খাটের একধারে পা ঝুলিয়ে আর বসবেন না। যা রয়ে গেল তা রয়েই গেল।
অকারণে পাখাটি নাড়ি আর ভেসে আসে অতীত। পিতা আহারে বসেছেন, পাতে ল্যাংড়া আম। ভনভন করছে ডুমো মাছি। মা বাতাস করছেন জোরে জোরে। পিতা বলছেন, অত জোরে নয়, অত জোরে নয়, তোমার কাঁধে ব্যথা হয়ে যাবে। দৃশ্য ফুটে ওঠে, জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। কপালে জলপটি লাগিয়ে পিতা বাতাস করছেন আমাকে। মধ্য রাত। থমথমে চারপাশ। তিনি অস্ফুটে বলছেন, ‘দেখো প্রভু, যাওয়ার আগে আমার কাছে রেখে গেছে ভরসা করে, ভালো করে দাও মা।’ ভালোই আছি। আজও আছিঃ তবে বড়ই একা। পাখাটিই আমার একমাত্র আপনজন।