হাতপাখা
আগ্নেয়গিরি দীর্ঘকাল বেশ শান্তশিষ্ট। ফুসফুস করে পাতলা পাতলা ধোঁয়া ছাড়ছে, কিম্বা তাও নয়। তারপর বলা নেই কও না নেই হঠাৎ একদিন বিস্ফোরণ। আমার বিখ্যাত বড়মামা, ঠিক সেইরকম। এই একবছর কোনও সমস্যা তৈরি করেননি। মন দিয়ে ডাক্তারি, চেম্বার, রুগি, হাসপাতাল। ডাক্তারদের সভায় বেশ ভালো দুটো বক্তৃতা দিলেন লিভার, জন্ডিস, আলসার, তেলেভাজা খাওয়ার কুফল, সপ্তাহে একদিন উপবাসের উপকারিতা, বেশি নুন খাওয়ার অপকারিতা, দিনে ক’লিটার জল খাওয়া উচিত। কাগজে ইন্টারভ্যু। মেজোমামা বলতে লাগলেন, ‘লোকটা একটু একটু করে ফেমাস হয়ে উঠছে। আমারও একটা কিছু করা উচিত।’ বড়মামার খোঁচা, ‘তুই আর কি করবি? অধ্যাপকদের যুগ শেষ। এখন ছাত্র-ছাত্রীরাই সব। পেটাই খা। পিঠের দিকটা শক্ত কর। এরপর তো হেলমেট পরে কলেজে ঢুকতে হবে। বই নয় ইট নিয়ে ক্লাসে আসবে ছাত্রছাত্রীরা। আমার মতো ডাক্তার হওয়ার মেধা তোর ছিল না ঠিকই, তবে অন্য কিছু হতে পারতিস। কম্পাউন্ডার হলে আমার ডাক্তারখানায় চানস পেতিস। আজ কাছা খুলে দিচ্ছে, কাল কোঁচা খুলে দিচ্ছে এই যাচ্ছেতাই অবস্থাটা হত না।’
মেজোমামা শুধু একটা কথাই বললেন, ‘হোয়েন ঘুঁটে পোড়ে, গোবোর লাফস। সেকালে সতীদাহ হত একালে ডাক্তার দাহ। পেশেন্ট আর ডাক্তার একই চিতায়। ঘেরাও করে রেখে দিলে তিনদিন। বিপজ্জনক জীবিকা। আমার কিছু হলে, তুমি কী ভাব, তোমাকে আমি দেখাব?’
‘তোকে আমি দেখবই না, তোদের ডাক্তার আলাদা। তৃণভোজীদের জন্যে অন্য ব্যবস্থা।’ কথার লড়াই শুরু হলে আর রক্ষা নাই। ফটাফট চলতেই থাকল। মাসিমা আগে দুজনকে থামাবার চেষ্টা করতেন, এখন আর মাথা ঘামান না। মাঝে মাঝে বলেন, ‘দুটো শিক্ষিত দামড়া। মা যাওয়ার সময় বলে গেল, দুটোকে দেখিস, তুই ছাড়া এদের আর কেউ রইল না। হয়ে গেল। না হল বিয়ে, না হল সংসার। একটা ভালো হল, সেই ছেলেবেলা থেকে এই দুটো ছাগলের পেছনে ডাণ্ডা হাতে পড়, পড় করে ঘুরতে ঘুরতে বিরক্ত হয়ে নিজেই এম. এ-টা করে ফেললুম। একটু লেখাপড়া করলে কার কি ক্ষতি হয়, বুঝি না বাপু! ছেলেরা খুব বদমাইশ হয়। দেখিস না, গরুদের মধ্যে যারা ছেলে, মাথায় কচি কচি দুটো শিং। কোনও কারণ নেই ভোঁস করে গুঁতিয়ে দিলে। আর ছাগল সাইজে ছোট, কিন্তু বদমাইশিতে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। দুটো ছাগলে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড খেয়ে ফেলতে পারি।’
একটা পেল্লায় বাড়ি। দোতলাটা বারান্দা দিয়ে ঘেরা। বার কয়েক পাক মারলেই মর্নিংওয়াক। বাগান। সবই সুন্দর, কেবল যাঁরা থাকলে বাড়িটা জমজমাট হত, তাঁরা সব মিছিল করে স্বর্গে চলে গেলেন। মাসিমা যখন একা উদাস হয়ে বাগানে গাছতলায় বসে থাকেন, পাখিরা গান শোনায়, কাঠবেড়ালি নাচ দেখায়। সেইসময় আমাকে ডেকে কত পাশে বসিয়ে পুরনো দিনের কত কথা বলেন, ‘ভিটেটার দোষ আছে। তা না হলে পটাপট সব মরে যায়। ভাই দুটো এত ভালো না হলে এই বাড়ি, এই স্মৃতি ধ্বংস হয়ে যেত। মামলা-মকদ্দমা। বিয়ে করলে না। কী বললে জানিস, বাড়িতে দেয়াল ঢোকাবো না। মামলা না হোক। পার্টিশান। হাঁড়ি আলাদা। সুখে থাকতে ভূতে কিলোনো। আমাদের বাবা, তোর দাদুকে সবাই বলত ভগবান। অত বড় ডাক্তার। বিনা পয়সার চিকিৎসা। বলতেন মানুষের সেবা করতে এসেছি। গলা কাটতে আসিনি। লোকে বলত ডাক্তারবাবু মানে জীবন। বড়দা অনেকটা ওইরকম হয়েছে। চেহারাতেই সেই ভাবটা লেগে আছে। খুব মিল। মেজদা একেবারে মায়ের মতো। দুটো একেবারে পিঠোপিঠি। বেশ আছে দুজনে। ওরা আছে বলেই আমার দুঃখটা তেমন বুঝতে পারি না। আসে, উঁকি মেরে চলে যায়। তারপর তুই এলি। জানিস তো প্রবাদ আছে নরাণাং মাতুলক্রমঃ। ভাগনেরা মামাদের মতো হয়।’
‘কোথায় আর হচ্ছি! অঙ্কে ডিগবাজি।’
মাসিমা হেসে বললেন, ‘তবে শোন, আমার বাবা, তোর দাদু অঙ্কের ভয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিল। খোঁজ খোঁজ। শেষে কাশীর হাসপাতাল থেকে চিঠি এল ষাঁড়ের গুঁতো খেয়ে ওখানে বারো নম্বর বেডে পড়ে আছে। পেটের মাঝখানে দেড় ইঞ্চি ফুটো। কলকাতায় আনা হল। আশ্চর্যের ব্যাপার অঙ্কের মাথা খুলে গেল। একশোয় একশো। একেই বলে বাবার দয়া। তোর বড়মামা অনেক চেষ্টা করছিল ষাঁড়ের গুঁতো খাওয়ার। একটা ষাঁড়ও রাজি হল না। মাঝখান থেকে রামছাগলের গুঁতো খেয়ে যাও বা চল্লিশ-পঞ্চাশ পাচ্ছিল, হয়ে গেল, টায় টায় তিরিশ, তাও এক নম্বর গ্রেস। মেজোকে অঙ্ক শেখাতে এসে গৃহশিক্ষক নিজেই অঙ্ক ভুলে গেলেন।’
বাইরের রাস্তায় একটা টেম্পো এসে দাঁড়াল। কয়েকজনের গলা শুনতে পাচ্ছি, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, এই বাড়ি, এই বাড়ি। ডাক্তারবাবু, ডাক্তারবাবু।’
পাশের বাড়ির ললিতকাকু হন্তদন্ত হয়ে এসে বললেন, ‘কে মারা গেছে, কে মারা গেছে? কই খবর পাইনি তো!’
মাসিমা অবাক—’মারা গেছে? এই বাড়িতে?’
‘খাটিয়া, বাঁশ, নারকেল দড়ি, তোশক, বালিশ, সাদা চাদর, টেম্পো থেকে নামছে।’
উত্তরটা বড়মামাই দিলেন ঢুকতে ঢুকতে—’কেউ মরেনি, জ্যান্ত মড়া খাটে তোলা হবে।’
‘সে আবার কি?’
‘বাইরের ঘরে আসুন, চা পান করতে করতে শুনবেন।’
বৈঠকখানা। মাসিমার প্ল্যানে সাজানো। খুব সুন্দর। ললিতকাকু অনেকদিন পরে এলেন। বেশিরভাগ সময় উত্তর ভারত থাকেন। জঙ্গল আছে, আপেলবাগান আছে। ভবঘুরে মানুষ। বসার ঘরে অদ্ভুত দৃশ্য। মেজোমামা ঘরে হামাগুড়ি দিচ্ছেন। হাতে একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস। বড়মামা বললেন, ‘এ কি শার্লক হোমস কোথা থেকে এল? কে খুন হল?’
ললিতকাকু বললেন, ‘আহা! ঠিক যেন বুড়ো গোপাল!’
বড়মামা বললেন, ‘হাতে একটা টেনিস বল দিতে হবে।’
‘টেনিস বল কেন?’
‘গোপালের হাতে নাড়ু।’
মেজোমামা সোফায় পায়ার কাছ থেকে বললেন, ‘গদা, তোর চোখে একবার দেখ তো।’
ললিতকাকু বললেন, ‘কি খুঁজছ, সেটা যদি বলতে তা হলে আমরাও সাহায্য করার চেষ্টা করতুম।’
মেজোমামা থেবড়ে বসে বললেন, ‘ছোট্ট এতটুকু একটা স্ক্রু। চশমার ডাণ্ডিটা খুলে গেল। হাই পাওয়ার। চশমা ছাড়া লেখাপড়া করব কী করে?’
ললিতকাকু বললেন, ‘ওটা পাওয়া গেলেও লাগাবে কী করে?’
‘চেষ্টা করব কানখুশকি দিয়ে।’
সোফার গদির খাঁজ থেকে জিনিসটা পাওয়া যেতেই মেজোমামা বললেন, ‘এ ছেলেটার কোনও তুলনা নেই, রিয়েল ভাগনে।’
বড়মামা বললেন, ‘যখন ভাগ নেবে তখন বুঝবে, রিয়েল কতটা রিয়েল!’
‘কিন্তু চশমাটা কোথায়? কোথায় রাখলুম!’
বড়মামা বললেন, ‘দাঁড়া দাঁড়া, আমি বোধহয় বসে আছি, পেছনে শক্ত মতো কি একটা!’
চশমা ফ্ল্যাট। বড়মামার সে কি আনন্দের হাসি, ‘তোর চশমা, তোর চশমা!’
‘একবার দেখলে না? কোথায় কার ওপর বসছ?’
‘তুইও একবার ভাবলি না, কোথায় রাখছিস? সেই একইরকম, কেয়ারলেস। মনে পড়ে ছাতে চশমা খুলেছিলিস হনুমানে চোখে পরে চলে গেল। টুথব্রাশ নিয়ে গেল কাকে।’
‘কে কাকে বলছে! তুমি হ্যা হ্যা করে হেস না। ভিজে গামছার ওপর প্যান্ট করে হাসপাতালে চলে গেলে। সবাই বলতে লাগল, ভুলে হিসি করে ফেলেছে।’
‘তুই আর ফটফট করিস না, কল্যাণের বউকে নমস্কার করে বললি, স্টিল ইয়াং, ছেলে কিন্তু বুড়ো হয়ে গেছে।’
‘তুমিও আর বোলো ন, সেদিন ফটিককে কুমুদ ভেবে বলে বসলে, রোগটা আর ক’দিন আগে ধরা পড়লে তোমার বাবাকে বাঁচানো যেত।’
বড়মামা ললিতকাকুকে দেখিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা বল তো, এই ভদ্রলোক কে?’
মেজোমামা বললেন, ‘রাধারমণবাবুকে চেনে না, এ পাড়ায় এমন কে আছে?’
বড়মামার ঠোঁটে অদ্ভুত হাসি। খুব মিষ্টি স্বরে বললেন, ‘যা বাড়ি যা, ভালো করে রেস্ট নে।’
ললিতকাকু বললেন, ‘স্লাইট মিস্টেক। আমি ললিত। এ পাড়ায় রাধারমণ বলে কেউ তো নেই। বৃন্দাবন অথবা নবদ্বীপে থাকতে পারে।’
মাসিমা আর কাজলদি ঘরে ঢুকলেন। দুজনের হাতে দুটো ট্রে। চা আর গরম গরম আলুর চপ।
মাসিমার মুখ গম্ভীর। বড়মামা লক্ষ করেছেন। হম্বিতম্বি যতই করুন, মাসিমাকে ভয় পান।
বড়মামা বললেন, ‘কুসি, আমি তোকেই আশা করেছিলুম। একটু বসবি?’
‘না।’
‘কেন? না কেন? আমি একটা ব্যাপার একসপ্লেন করতে চাই।’
‘আমি শুনতে চাই না। আমি শান্তি চাই।’
‘এই বাড়িতে তো চির শান্তি! এমন বাড়ি কোথাও তুমি পাবে না খুঁজে। মেজোটা মাঝে মাঝে গোলমাল করে ফেলে, হট হেড, রগচটা। ওটা ওর শরীরের জন্যে। ভাল্লুকের মতো চেহারা। হজম করতে পারে না; কিন্তু খাওয়া চাই। কনস্টিপেশান।’
‘তুমি বকবক কর। চা-চপ ঠান্ডা হয়ে যাক। দাদা, আপনারা খান তো। শুরু করে দিন।’
বড়মামার এইবার করুণ সুর, ‘একটু বোস। আমি এমন একটা কাণ্ড করতে চাইছি, যা হবে এই শতাব্দীর এক নম্বর নিউজ। হেডলাইন। টিভির সব কটা চ্যানেল হেরে-রেরে করে ছুটে আসবে। ঘটনাটা ঘটবে আগামীকাল বিকেল পাঁচটায়।
‘ঘটনাটা কি?’
‘যখন ঘটবে তখন জানতে পারবে। তার আগে নয়।’
মাসিমা বললেন, ‘এই তোমার আলোচনা? এর জন্যে বসতে বললে!’
মেজোমামার দুটো চপ খাওয়া হয়ে গেছে। তৃতীয়টাকে আক্রমণ করেছেন। সেই অবস্থায় বললেন, ‘চিরকালই বাঙলায় উইক। কোনওরকমে তিরিশ। ও ঘোষণা আর আলোচনার তফাৎটা জানে না। কাল কিছু একটা করবে। অস্বাভাবিক কিছু। সেইটাই ঘোষণা করল।’
‘একটা অলুক্ষণে মড়ার খাট, দুটো লম্বা বাঁশ, নারকেল দড়ি, এইসব বাড়িতে ঢুকিয়েছে। এর মানেটা কি?’
বড়মামা বললেন, ‘দারুণ হয়েছে।’
‘মানে?’
‘আলুর চপ। ওয়ার্ল্ডস বেস্ট। রান্নাবান্নার জন্যে নোবেল পুরস্কার থাকলে আমি তোর নাম সুপারিশ করতুম।’
মাসিমা বললেন, ‘আমি জানতে চাই।’
‘আমিও জানাতে চাই।’
মেজোমামা বললেন, ‘আমি জানতে চাই না।’
ললিতকাকু বললেন, ‘আমি জানার জন্যেই ঢুকেছি।’
বড়মামার ঝাল লেগেছে, ‘এই লঙ্কাকাণ্ড একটা লঙ্কা থেকে এসেছে। আর ঐ কাণ্ডটা ঘটে আমাদের মুখে। প্রচুর ভিটামিন সি আছে, অ্যাপেটাইজার, রোগ প্রতিষেধক। বুদ্ধির বিকাশ ঘটায়। পোকামাকড় দমন করে।’
মেজোমামার ঠোঁটে বাঁকা হাসি—’লঙ্কার ক্লাস নিচ্ছে। আমার বড়দা কত কি জানে! জ্ঞানের ঢিপি।’
ললিতকাকু বললেন, ঢিপি শব্দটা চেঞ্জ করে বলুন কূপ, জ্ঞানকূপ।’
‘কূপ শব্দ জ্ঞানের সঙ্গে যায় না। অন্ধকার। অন্ধকূপ। জ্ঞান হল আলো, জ্ঞান-সমুদ্র।’
বড়মামা খুব খুশি হয়ে বললেন, ‘মেজোটাকে একটা কারণে আমি ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি। গুণের কদর করতে জানে, ভেতরটা ওর মন্দিরের মতো পরিষ্কার। সামান্য ছটি আছে। সে আমাদের ফ্যামিলির সকলেরই ছিল। যারা জিনিয়াস তাদের মাথার সামান্য সামান্য গোলমাল থাকবেই। আমার পিতামহ পূর্ণিমার রাতে সারা রাত ঘুড়ি ওড়াতেন। বলতেন, উড়তে উড়তে ঘুড়িটা হয়ে যেত পরী। আকাশে গান গাইত। ঘুড়ি পরী হয়ে গান গাইছে। রাত দুটো। ব্যাপারটা হল, দাঁড়ান, আমি উদাহরণ দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করি, হনুমান যখন যেখানেই জন্মাক না কেন, ল্যাজ নিয়েই জন্মাবে। হনুমান বড় হচ্ছে ল্যাজও বড় হচ্ছে। সেইরকম এই ফ্যামিলির আমরা জ্ঞান নিয়েই জন্মেছি। কিছু করার নেই। আমরা জগতকে দিতে এসেছি।’
ললিতকাকু ভয়ে ভয়ে জিগ্যেস করলেন, ‘এ পর্যন্ত আপনারা কি দিয়েছেন?’
‘সে বোঝা যাবে আমরা চলে যাওয়ার পর। লোকে হায় হায় করবে। যেন আকাশের গা থেকে একজোড়া পাহাড় সরে গেল।’
মাসিমা রেগেমেগে উঠে পড়লেন। বড়মামা বললেন, ‘এ কি, আসল কথাটা না শুনে চলে যাচ্ছিস? বোস। ফাইভ মিনিটস।’ বড়মামা খানিকটা পায়চারি করে বললেন, যেন বক্তৃতা—’মানুষ একদিন না একদিন মরবেই। জন্ম আর কিছুই নয় মৃত্যুর চক্রান্ত। মৃত্যু হল শিকারি, আমরা হলুম গিয়ে হরিণ। মৃত্যু সাঁট সাঁট করে তির ছুঁড়ছে। কারুর পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, কারো বুকে প্যাঁট, হয়ে গেল, ফিনিশ। মৃত্যু বললে, পালাবি কোথায়? ব্যাটা, আজ না হয় বাঁচলি, কাল! কাল, না হয় পরশু। তাহলে?’
মাসিমা বললেন, ‘তোমার মাথা।’
‘ঠিক! আমার মাথা। এ মাথা পৃথিবীতে খুব বেশি নেই। বৈজ্ঞানিক মাথা। এই মাথাটা কেবল জানতে চায়। গপগপ করে গাপ্পি মাছের মতো জ্ঞান গিলতে চায়। জানবো, আরও জানবো।’
‘ঢাক পেটাব।’ মেজোমামার মন্তব্য।
‘হ্যাঁ পেটাব। একটা নয় একজোড়া। স্পর্শকাতর, ঈর্ষাকাতর, দুর্বলচিত্ত মানুষদের দাওয়াই দিতে হয়। টনক নড়িয়ে দিতে হয়। যারা অজ্ঞান তাদের এইভাবে শব্দ করে জাগিয়ে দিতে হয়।’
মাসিমা বললেন, ‘মেজো শুনছিস?’
‘না, আমি এখন বিশেষভাবে ব্যস্ত আছি। প্রায় শেষ করে এনেছি। একটু গুঁড়ো পড়ে আছে।’
‘তার মানে?’
‘সোফায় বসা মাত্রই অনুভব করলুম, একটা কিছুর ওপর বসে পড়েছি। একটা কৌটো। বের করে দেখি লেখা রয়েছে ‘বাদশাহী গোলি’। দারুণ খেতে, ওয়ান আফটার অ্যানাদার।’
বড়মামা লাফিয়ে উঠলেন, ‘নিঃশব্দে সবটা মেরে দিলি?’
‘বড়দা, তোমার ভালোবাসাতেই বেঁচে আছি। বলো, বলো, তুমি বলে যাও। বিভোর হয়ে বলে যাও।’
বড়মামা বেশ ভেঙে পড়েছেন। ‘আমার এক পেশেন্ট লখনৌ থেকে এনে দিয়েছিল। আমার জন্যে একটুও রাখলি না।’
‘এই তো কৌটোর তলায় গুঁড়ো গুঁড়ো একটু রয়েছে। পরে টেস্ট করে দেখো। আর তোমার পেশেন্টকে দশ-বিশ কৌটো আনাতে বোলো। লোকটা মনে হয় কৃপণ। তোমার মতো এত বড় একজন ডাক্তারকে এক কৌটো? মিনিমাম দশ কৌটো দেওয়া উচিত। ডাক্তারদের লাজুক হওয়া উচিত নয়। ডাক্তার হল জীবনদাতা, নেকস্ট টু গড।’
বড়মামা বললেন, ‘হুঁ।’
মেজোমামা বললেন, ‘এটা একটা ইতিহাস। ভাইয়ের প্রতি ভাইয়ের এই ভালোবাসা। এমনটি পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যাবে না। সেই ত্রেতা যুগে রাম আর লক্ষ্মণ, আর এই কলিযুগে আমরা দুটি ভাই নাড়ু কিনে খাই, শিবের গাজন গাই। এই মানুষটাকে কেউ চিনল না। আমি ভাবছি প্রচারে বেরোবো। জ্যান্ত ভগবান!’
বড়মামা বললেন, ‘কাটা ঘায়ে কেন নুনের ছিটে দিচ্ছিস। যত আমি ভুলতে চাইছি।’
বৃন্দাবনকাকু আমাদের ম্যানেজার কাম দারোয়ান কাম মালী। ঘরে এসে বললেন, ‘খাটিয়াটা কি বিহারীর জন্যে আনিয়েছেন? ও জিগ্যেস করছে।’
‘না, ওটা আমার জন্যে।’
‘আপনার তো খাট আছে!’
‘না, আমার কিচ্ছু নেই। আমি ছাড়া আমার কিচ্ছু নেই।’
মেজোমামা বললেন, ‘চরম বৈরাগ্য। আমি লক্ষ করেছি প্রত্যেক বছর এই শ্রাবণ মাসে, বাবার মাসে দাদার মানে এই রকম একটা ভাব আসে। পূর্ব, পূর্ব জন্মে সাধক ছিল। গভীর অরণ্যে বল্কল পরে ঘুরত। পাশের তপোবনেই থাকত শকুন্তলা। আহা! সেই ঋষিকন্যাই রোজ সকালে একটু বেলপোড়া দিয়ে যেত কচি কলপাতায় মুড়ে। গোল করে রোল করে ‘বেল রোল’। সারা দিনের আহার। সেবারেই মোক্ষলাভ হয়ে যেত। সামান্য একটু আসক্তি!’
ললিতকাকু শেষ চপটা বেশ তারিয়ে তারিয়ে খেতে খেতে প্রশ্ন করলেন, ‘কি ধরনের আসক্তি?’
‘চুরি।’
‘সে কি চুরি?’
‘সোনাদানা নয়। বালকস্বভাব। দুপুরবেলা শকুন্তলার আশ্রমে বেদপাঠ করতে যেত। শকুন্তলা আবার আচার তৈরিতে সিদ্ধহস্ত ছিল। কুলের আমের, তেঁতুলের। স্বর্গে সাপ্লাই করত। সেই সব আচার আশ্রমের দাওয়ায় রোদে দিত। আমার পূর্ব, পূর্ব, পূর্ব জীবনের এই দাদা সেই সব লক্ষ করত; সেই সব আচার আশ্রমের দাওয়ায় রোদে দিত। আমার পূর্ব, পূর্ব, পূর্ব জীবনের এই দাদা সেই সব লক্ষ করত; কিন্তু কড়া নিয়ম সাধুরা টক, মিষ্টি, ঝাল, নুন ছুঁতে পারবে না এমন কি মনে ভাবতেও পারবে না। জিভে জল এলে, চোখে লোভ এলে সাধনা পণ্ড। আবার শুরু থেকে শুরু করতে হবে। প্রথম প্রথম দাদা ওসব দিকে তাকাত না। কিন্তু নানারকম মশলার গন্ধ নাকে আসছে। শকুন্তলার সখীরা মাঝে-মধ্যে আচারমাখা আঙুল চুষতে চুষতে আধবোজা চোখে টকাসটাস শব্দ করছে। কতক্ষণ আর নিজেকে ঠিক রাখা যায়। একদিন শকুন্তলা দুপুরে তার প্রিয় হরিণকে আদর করতে করতে গাছতলার ঘাসের ওপর শুয়ে পড়েছে। একটু তন্দ্রা এসেছে। দাদা তেঁতুলের আচার চুরি করে মুখে পুরেছে। আর একটু নেবে বলে হাত বাড়িয়েছে, এমন সময় খপ।’
ললিতকাকু জিগ্যেস করলেন, ‘খপ মানে?’
‘সিকিউরিটি। ধরে ফেলেছে। শকুন্তলা রাগী মেয়ে। বিশ্বামিত্রের মেয়ে, তার রাগ থাকবে না! টেরিফিক রাগী। না, সে কিছু অন্যায় বলেনি। বড়দাকে বললে, মাথা নেড়া করেছ, টিকি রেখেছ, গেরুয়া পরেছ, আমাকে বললে, আমি কি তোমাকে দিতুম না! তোমার হবে না, হবে না, কিস্যু হবে না। আরও হাজার বার জন্মাতে হবে। কাঁচি বের করে টিকিটা কচাত করে কেটে, হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললে, ‘নিকালো হিঁয়াসে।’
ললিতকাকু বললেন, ‘আপনি তখন কোথায় ছিলেন?’
‘নিমগাছে।’
‘নিমগাছে কেন?’
‘কাকের বাসা তো নিমগাছেই হবে। শকুদিদি রোজ বারোটা সময় আলোচালের ভাত ছড়িয়ে দিত। আমি আর আমার মিসেস খেয়ে মন্দাকিনীর তীরে চলে যেতুম। কখনো চুরি, ছিনতাই করিনি। মিথ্যে কথা বলার প্রশ্নই নেই। কারণ, আমরা ‘ক’ ছাড়া কিছুই বলতে পারি না। একটাই শব্দ বেরোয় কা। মিথ্যে কথা বলতে হলে অনেক কথা বলতে হয়। আমাদের তো একটাই সম্বল ‘কা’। সেই কারণে কাক সত্যবাদী। শ্রদ্ধেয়। আমরা তো রামায়ণে স্থান পেয়েছি।’
ললিতকাকু সহজে কিছু মানতে চান না। এক একজন এইরকম থাকেন। ভগবানের কলে অনবরত মানুষ তৈরি হচ্ছে। কোনটা কেমন হবে, সে যতক্ষণ না হচ্ছে, আগেভাগে বলা যায় না। কতকগুলো ছাঁচ তৈরি আছে। ঝপাঝপ বেরিয়ে আসছে। সে যাক, সে আমি পরে সময় পেলে বলব। স্বপ্নে আমি ভগবানের কারখানায় এক রাত ছিলুম। ললিতকাকু বড়লোক বলে নিজেকে কি ভাবেন? মেজমামাকে যে-কথাটা বললেন, শুনতে খুব খারাপ লাগল আমার। ক্যাটক্যাটে গলায় বললেন, ‘রামায়ণে জন্তু-জানোয়ার অনেক আছে, বাঁদর-হনুমানই বেশি। আর আছে পক্ষী-রাজ জটায়ু আর এক বিরাট গরুড়। সেখানে কাক?’
মেজোমামা বললেন, ‘আপনি ভুশুণ্ডি কাকের কথা শোনেনি। আমার এই দাদাটির তপস্যা যখন পণ্ড হয়ে গেল, নিজের টিকি হাতে নিয়ে আশ্রম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, পতিত, অধম। দয়াময়ী শকুন্তলা হাতে ধরিয়ে দিয়েছে তেঁতুলের আচারের বয়াম, ধরিয়ে দেওয়ার কারণ, এঁটো হয়ে গেছে, দেবতার ভোগে লাগবে না, তখন আমি কিন্তু আমার পোজিশানে ঠিক আছি। স্বয়ং শিব আমার প্রশংসা করছেন।’
‘আপনার মানে? যে আপনি আমাদের সামনে বসে আলুর চপ খাচ্ছেন?’
‘ধুস! আমি তো আমার পূর্ব পূর্ব জীবনের কথা বলছি। তখন আমি হরি ভক্ত, রাম ভক্ত ভুশুণ্ডিকাক। এই তো আজও বারাণসীতে গেলে শুনবেন, সাধু সমাবেশে তুলসীদাসের শ্রীরামচরিতমানস পাঠ হচ্ছে।
‘উত্তর দিসি সুন্দর গিরি নীলা। তই রহ কাকভুসুণ্ডি সুসীলা। পরম পবীণা। গ্যানী গুন গৃহ বহু কালীনা।’
‘কি বুঝলেন?’
‘কাঁচকলা!’
‘আমার সম্পর্কে প্রশংসা।’
‘মানে, আপনার সেই কাক জন্মের কথা।’
‘সাধারণ এই কা-কা করা কাক নয়। ভুশুণ্ডি কাক। হিমালয়ের উত্তরে সুন্দর একটি নীল পাহাড়, যে পাহাড়ের নাম সুমেরু, সেইখানে একটি অসাধারণ বট বৃক্ষে আমার বাসা। বাসা নয় আশ্রম। দিনের বেলা সেই গাছে তলায় আমাকে ঘিরে যত বৃদ্ধ প্রবীণ পাখিরা সরোবরের জলে স্নান করে এসে বসত। হরি নাম, রাম নাম, আর আমার ভালো ভালো জ্ঞানগর্ভ যত কথা। সেইসব কথা শুনে মানুষের দুঃখ দূর হয়ে যেত।’
‘একটু বোধ হয় ভুল হল, মানুষ নয়, পাখিদের দুঃখ।’
‘ভুল আপনার হল, লক্ষ লক্ষ কাক, হাটে-ঘাটে, গ্রামে-গঞ্জে একটি কথাই বলছে, কা-কা। কা মানে কি?’
‘কি মানে?’
‘ভুলে গেছি। ত্রেতা যুগের কথা। মনে থাকে?’
‘কাক থেকে মানুষ হলেন কত সালে? বিফোর খ্রাইস্ট, আর আফটার খ্রাইস্ট, আর আফটার খ্রাইস্ট?’
‘ও ডি এন এ টেস্ট করলেই ধরা পড়বে। এখন বিজ্ঞান এসে গেছে।’
মাসিমা ঘুমিয়ে পড়েছেন। বড়মামা বললেন, ‘যারা খুব বেশি কথা বলে, তারা বাজে কথা বলে।’
‘আরে বাবা, কথা বলতে হলে জ্ঞান থাকা চাই, লেখাপড়া চাই। জানতে হবে। না জানলে জানানো যায়।’
মাসিমা ঘুম জড়ানো গলায় বললেন, ‘কটা বাজল রে? কাক কি এখনো ডাকছে?’
বনমালীদা ধীরে ধীরে ঘুরে ঢুকল। অসাধারণ এক মানুষ। মালকোঁচা মারা ধুতি। হাতঅলা গেঞ্জি। চওড়া বুক। লোহার মতো শক্ত শরীর। সারাদিন কাজ করে। খুঁজে খুঁজে কাজ বের করে। মাসিমা বলেন, ‘এই বাড়িটার নাম হওয়া উচিত বনমালী ভবন।’ মানুষটার অতীত নেই। মধুপুরে একটা সুন্দর বাগানবাড়ি আছে। দাদুর শখের বাগান। গোলাপ যদি দেখতে হয় শীতকালে ওই বাগানে যেতে হবে। দাদু বনমালীদাকে ওই মধুপুরেই পেয়েছিলেন। নিজের ছেলের মতো করে মানুষ করেছিলেন। ভীষণ স্মরণশক্তি। মুখে মুখে যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ। কতদিন এমনও হয়েছে, অঙ্ক আটকে গেছে—’বনমালীদা, একটু দেখ না।’ পাঁচ মিনিটে সমাধান। দাদু বলেছিলেন, ‘তোকে আমি হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট করব।’
বনমালীদা বলেছিল, ‘আমি নামেও মালী, কাজে ওই মালী। আপনার একটা ছেলে মুখ্যুই থাক।’
বনমালীদা ললিতকাকুকে বললে, ‘বাড়িতে ডাকছে। কি একটা আটকে গেছে।’
‘ওঃ, এই এক আলমারি হয়েছে। বর্ষা এল তো পাল্লা আটকে গেল। এই আসর ছেড়ে আমার যেতে ইচ্ছে করছে না। আরও তিনকাপ চা খাব। রাতের খাওয়াটাও যদি এরা বলে!’
মাসিমা বললেন, ‘বলাবলির কি আছে? লুচি, ছোলার ডাল, মরিচের ঝাল দেওয়া শুকনো আলুর দম। পেটফুলো পটলভাজা।’
‘উঃ উঃ কতদিন এইসব খাইনি। বাবা বনমালী তুমি তো আমাদের সকলের বনমালী। যা না বাবা, খুলে দিয়ে আয় না। যদি না খোল লাথি মেরে ভেঙে দিয়ে আয়।’
সে আমি যাচ্ছি। বড়দা, তুমি খাটিয়াটা কি জন্যে আনালে? দুটো বাঁশ, দড়ি?’
‘আমার জন্যে।’
‘খাটিয়ায় শোবে কেন?’
‘তুই ঘুরে আয়। অনেক কথা আছে।’
মেজোমামা বললেন, ‘আমি বিকেলে রোজ মাইল চারেক হাঁটি। শরীর যদি ফিট না থাকে দেশের, দশের কাজ কি করে করব? আমরা সকলেই তো পরের জন্যে জন্মেছি। যেমন আপনি জন্মেছেন আমার জন্যে, আমি জন্মেছি আপনার জন্যে। ব্যাপারটা কি ইন্টারেস্টিং, তাই না! আমি একটা আইসক্রিম খেলুম আপনার জন্যে। আপনি একটা মোগলাই খেলেন আমার জন্যে। এই যে বলে, গিভ অ্যান্ড টেক—এটা কি বলুন তো?’
‘ও তো সেই জ্ঞান হওয়া তক শুনে আসছি, ফেলো কড়ি মাখো তেল। দাও, প্রথমে দিতে হবে, তারপর নেওয়ার প্রশ্ন। দুনিয়াদারি হল দোকানদারি। কত দাম? একশো টাকা কেজি। এই নাও একশো টাকা। মাল ওজন হচ্ছে। এক কেজি তো এক কেজিই। এক গ্রামও বেশি নয়। এই তো সেদিন একটা ইংরিজি গান শুনছিলুম। এই পৃথিবী তোমাকে ফ্রি লাঞ্চ দেবে না। এই ব্যবস্থা কোথাও নেই। এ যে একটা সেলুন! চুল তোমার কাঁচি আমার। সাউথে গিয়ে দেখি, বিনা পয়সায় মাথা কামিয়ে দিচ্ছে। ব্যাপারটা কী? ওই চুল বিদেশে চালান যাবে—পরচুল তৈরি হবে।’
মেজোমামা বললেন, ‘আমার কাছে সত্তরটা বিয়েবাড়ি ঘোরা একটা শাড়ি আছে।’
‘সে আবার কি?’
‘ওই যে গিভ অ্যান্ড টেক। কনের হাতে দিয়েই বলি, এইবার আমার হাতে দাও। সঙ্গে সঙ্গে অ্যাবাউট টার্ন। লেফট, রাইট, লেফট রাইট, কুইক মার্চ।’
বড়মামা এতক্ষণ পরে একটি কথা বললেন, ‘এই জন্যেই হল না। সব গল্প ফিরে এল। সব উদ্ভট। একটাও স্বাভাবিক ব্যাপার নেই। সব চরিত্রই পাগল। একটা গল্প আমাকে শুনিয়েছিল, তখন বুঝেছিলুম অসম্ভব। হবে না। বীরেশ্বর কুণ্ডু ছাতের কার্নিশে মর্নিংওয়াক করে। সেনাবাহিনীতে ছিল কর্নেল। একটা গুলিতে তিনজন ডেড। দমবন্ধ করে চব্বিশ ঘণ্টা থাকতে পারত। খাওয়ার ব্যাপারে ভেরি স্ট্রিকট। ভোরবেলা একদলা দই-চিঁড়ে। সারাদিনে কয়েক ফোঁটা গঙ্গাজল। বছরের শেষ দিনে একবারই টয়লেটে যেত। আর শরীরে ওজন ইচ্ছেমতো কমাতে-বাড়াতে পারত। কখনো তুলো, কখনো পাহাড়। যখন হাসত, মনে হত বালক। গর্জন করলে সিংহ। নিজেকে ছড়িয়ে দিতে পারে। এক হয়ে গেল এক হাজার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কামকাটস্কাকায় এক ভারতীয় যোগীর ঘাড়ে গিয়ে পড়েছিল বিপক্ষের তাড়া খেয়ে। যোগী ওরই পায়ের বুট খুলে বেধড়ক পিটিয়ে মহাভারত মুখস্থ করালেন। মহাভারত না পড়লে বীর যোদ্ধা হওয়া যায় না জানোয়ার কোথাকার! তারপর এটা ময়ূরের পালক হাতে নিয়ে বললেন এই তোর কৃষ্ণ! এই হল ওর গল্প। কে ছাপবে, কেন ছাপাবে! সকলে কি সব কিছু পারে? কেউ বললে, আমি গাইয়ে হব। আমার গলায় সুর নেই, আমি গাইয়ে হব। আমার ভেতরে ভাব নেই, আমি কবি হব। পাগল, পাগল, সব পাগল।’
বনমালীদা ফিরে এল, ‘বউদি জিগ্যেস করলে, কি করবে?’
‘কিসের কি করবে?’
‘তোমার বেড়াল ছটা বাচ্চা নিয়ে বিছানায় উঠেছে।’
‘ইচ্ছে হয়েছে উঠেছে। আমি কী করব!’
‘ওরা কি থাকবে?’
বড়মামা পশুপ্রেমী। বড়মামা বললেন, ‘মা তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে কি পথের ধুলোয় পড়ে থাকবে? এটা কোনও প্রশ্ন হল?’
ললিতকাকু বললেন, ‘কিছু মানুষ আছে নিজেকে ছাড়া কারোকে সহ্য করতে পারে না। বেড়ালটাকে দেখলে আপনি অবাক হয়ে যাবেন। বাসন্তী রঙের বেড়াল। আমার মনে হয় মা সরস্বতীর হাউসহোল্ড থেকে নামছে। মায়ের দেশটা যেন কোথায়? যদ্দুর জানি, মা তো মিস, মিসেস হননি, তাহলে তো বাপের বাড়ি কৈলাসেই থাকেন। এই বেড়ালটার পূর্ব পূর্ব ডট ডট ডট কম ওই কৈলাস! যেমন আমাদের মেজদা অধ্যাপক হলেও উনি কাক বংশের ক্রো। বিলেতে সায়েবদের টাইটেলে ক্রো আছে, মার্টিন ক্রো। বুল আছে। একজন নামকরা মহিলার নাম সারা বুল।’
বড়মামা বললেন, ‘বাসন্তী আপনার বাড়িতে অনাদরে আছে। আমি বুঝতে পারছি। বাসন্তী তার ছেলে-মেয়ে নিয়ে এখানে চলে আসুক। আমি পালকি পাঠাচ্ছি। এখানে সে কন্যার আদরে থাকবে। আপনি তার পিতার মতো যখন-তখন এসে দেখে যাবেন।’
‘এটা বোধহয় সম্ভব হবে না। কারণ, বাসন্তী আমাদের লক্ষ্মী, ফরচুন।’
‘বেড়ালের সঙ্গে মা লক্ষ্মীর নয় মা ষষ্ঠীর সম্পর্ক। বেশ বাসন্তীর মেয়ের রঙও বাসন্তী হবে। আমাকে দেখেন। একটা, দুটো, তিনটে।’
‘অ্যায়, এইটাই হল ট্রাজেডি। একটা বাচ্চাও মায়ের দিকে গেল না।’
‘বাসন্তী রঙের একটাও হল না, সাদা হল, ছাপকা, সাদা-কালো।’
খুক খুক একটা কাশি শোনা গেল। পণ্ডিতমশাই। সেই পোশাক-ধুতি, উত্তরীয়, চটি। থেকে থেকেই নাক টানেন, মুদ্রাদোষ। হাতে একটা পাঁজি থাকবেই থাকবে। একাদশী, অমাবস্যা, প্রতিপদ। গ্রহে গ্রহে ঠোকাঠুকি। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, ‘এবারে তাহলে পুজো হচ্ছে না?’
বড়মামা পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ‘কেন, পুজো হবে না কেন? আপনি বারণ করেছেন?’
পণ্ডিতমশাই খুব রাগী। অনেকে রেগে গেলে ইংরিজি বলেন, মাঝে মাঝে হিন্দি। পণ্ডিতমশাই বলেন সংস্কৃত। গলগল করে সংস্কৃত বেরোতে থাকে, অনুস্বর, বিসর্গ, চন্দ্রবিন্দু। ভীষণ রেগে গিয়ে বললেন, ‘আমি বারণ করব কেন? কস্য ত্বং বা কৃতঃ আয়ত,—কোন ঘাটের মড়া পুজোর মাঠে প্রোমোটারি করছে, আমি জানতে চাই।’
‘ও আর জেনে কি হবে? সর্বং খল্বিদং প্রোমোটারং। আশ্চর্যং আশ্চর্যং ইতি মে মতি। ত্রিভুবনং প্রোমোটারেণ থিক থিকং, যত্র যত্র দৃষ্টিং পততি। বৃহৎ বৃহৎ ইমারতং দর্শতি।’
‘মিটিং-এ বসছ কবে?’
‘সে তো কমিটি জানে। পুজো এবছর কোন কোম্পানি স্পনসর করছে?’
‘সে তো তোমার জানার কথা, তুমি তো আজীবন প্রেসিডেন্ট।’
‘প্রেসিডেন্ট তো একটা নাম। মালাপাড়া পুজো কমিটির প্রেসিডেন্ট তিন বছর হল মারা গেছেন। ওরা জানেই না।’
‘আরে গতবার তোমাদের সেক্রেটারিকে বললুম, নদের নিমাই যাত্রাপালাটা দাও না। সে বললে, ওসব নিমাই-টিমাই চলবে না। আমাদের পুজোর একটা ঐতিহ্য আছে।’
মাধাইদা ঘরে ঢুকল। পাড়ার সবাই বলেন, নামটা ড্যামেজিং তবে ছোলটা ভীষণ ভালো। খাঁটি। মাধাইদা প্রণাম-টনাম করে বড়মামাকে জিগ্যেস করলে, ‘কটায় বেরোবেন?’
‘বারোটা। তুই কি বলিস?’
‘রাস্তাঘাট নির্জন থাকবে, সমস্যা একটাই, কুকুর।’
‘ও তোরা চার-পাঁচজন থাকবি। হাতে একটা লাঠি থাকবে।’
‘বড়দা, লাঠি রাখব না। আজকাল সাদা-পোশাকে পুলিশ রাতবিরেতে ঘাপটি মেরে থাকে। আগে যেমন দেখলেই বোঝা যেত পুলিশের গাড়ি, এখন বোঝার উপায় নেই। আসলে ব্যাপারটা তো কিছুটা বেআইনি।’
‘বেআইনি বলছিস কেন?’
‘বডিটা তো ডেড নয়; কিন্তু সব কিছু ডেডবডির মতো। শ্মশানে ঢুকবে?’
‘ঢুকবে। নামাবি। কিছুক্ষণ রাখবি।’
‘হেভি রিস্ক। এত রাতে আর কোনও বডি না থাকলে চুল্লিতে ঢুকিয়ে দেবে। একটা ডেথ সার্টিফিকেট লিখে আমার কাছে রেখে দিন। সাবধানের মার নেই।’
‘এ তুই কি বলছিস, নিজের সার্টিফিকেট নিজে লিখবো?’
‘ও কাজে না লাগলে রেখে দেবেন, পরে একদিন না একদিন কাজে লেগে যাবে। পদ্ম আর গোলাপ এনেছি। প্রচুর গাঁদা, চার প্যাকেট চড়া গন্ধ ধূপ। অগরুও এনেছি।’
‘পুরো বডিটা ফুলের তলায় থাকবে। মুখটা বাদ।’
‘হয়ে যাবে। খই আনিনি। কুশল বললে খই আজকাল ছড়ায় না। রাস্তা নোংরা হবে। কেস খাবেন।’
‘তা যা, খাটিয়ায় দড়ি পরা। আর বেশি সময় নেই।’
‘কুশল আর মধু লেগে গেছে। বাড়ির কেউ কাঁধ দেবে?’
‘না, বাড়িতে কেউ নেই। একা। ওই মাধাই একটু দেখে-টেখে। রাত দশটা নাগাদ খাওয়া-দাওয়া করে বসে আছে। ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক। এইটাই হল কেস, স্টোরি। বুঝলি!’
‘তার মানে, খেয়ে-দেয়ে মরবেন।’
‘না খেয়ে মরব কেন?’
‘এই পোশাকে যাবেন?’
‘না না ধুতি-পাঞ্জাবি। মোটা খদ্দর। স্বাধীনতা সংগ্রামী।’
‘বলো হরি বলা হবে?’
‘খুব গম্ভীর গলায় থেকে থেকে বলবি হরি বোল, হরি বোল। শান্ত, ভদ্র।’
মাসিমার ঘুম ছুটে গেছে। জিগ্যেস করলেন, ‘মাধাই, ব্যাপারটা কি রে?’
‘দিদি, আমরা ঠিক বলতে পারব না। বড়দাকে জিগ্যেস করুন।’
বড়মামার মুখে সেই হাসি, যে হাসিকে তিনি স্বপ্নে দেখেছন। চাঁদের আলোর রাতে দোতলার বারান্দায় বেতের চেয়ারে ভগবান বসেছিলেন একা একা। বড়মামার কিছুতেই ঘুম আসছিল না। তখন ভাবলেন চাঁদের আলোয় চান করে আসি। দরজা খুলে বারান্দায়। ‘বেতের মোড়ায় কে বসে? মেজো! তোরও ঘুম আসছে না?’
‘আমি মেজো-সেজো নই। বড়র বড়, তারও বড়, সবার বড়, ভগবান।’
বড়মামা অজ্ঞান হয়ে ভগবানের পায়ের কাছে পড়ে গেলেন। ভগবান জ্ঞান ফেরালেন। চোখ চাইলেন। কেউ কোথাও নেই। হাসিটা ভাসছে। ভাসতে ভাসতে এদিক যাচ্ছে, ওদিক যাচ্ছে, মুখটা নেই, হাসিটা রয়েছে। বড়ামামা বলেন, ওই যে ভগবান জ্ঞান ফেরালেন, ওটা চরম জ্ঞান। এই পৃথিবীর বিলকুল জানা হয়ে গেছে। বড়মামা বলেন, আশ্চর্য ব্যাপার। আমার এই পৃথিবীতে কোনও প্রশ্ন নেই, সব উত্তর। সে নাকি খুব মজা হয়েছিল। ডাক্তারদের সেমিনার। দেশ-বিদেশের ডাক্তররা এসেছেন, রোগা, মোটা লম্বা, বেঁটে। প্রশ্নোত্তর পর্ব। ‘ডক্টর মুখার্জি! এনি কোশ্চেন?’
বড়মামা বললেন, ‘আমার কোনও প্রশ্ন নেই, সবই উত্তর।’
একজন দুষ্ট প্রকৃতির আমেরিকান ডাক্তার বললেন, ‘ইজ ইট? আচ্ছা বলো তো, মানুষের মাথাটা কেন ওপর দিকে?’
বড়মামা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘পা দুটো নীচের দিকে বলে!’
সায়েব একটু ব্যঙ্গ করলেন। আর যায় কোথায়। বড়মামা মাইক্রোফোনে—’মাই ডিয়ার ফ্রেন্ড!’ এক ঘণ্টার একটা বক্তৃতা। সাতটা আন্তর্জাতিক পত্রিকায় ছাপা হল। চিঠি এল সাতশো। বড়মামা শুরুই করলেন এইভাবে ‘সব মাথাই পায়ে পড়তে চায়, কারণ ওই জায়গাটাতেই মানুষ নিবেদন করতে চায় তার শ্রদ্ধা, তার প্রেম, তার হৃদয়েব সব ঐশ্বর্য। মাথাতেই আছে হাত, পা, দর্শন, শ্রবণ, ঘ্রাণ, অনুভূতি। মাথই হল কম্যান্ডার। বাকি সব তার অনুচর। মাথার শুরুটা পায়ের কাছেই। ইচ্ছার শক্তিতেই ওপরে ওঠে। কিন্তু মনে রাখতে হবে জ্ঞানীর উপদেশ—
Be wise
Soar not too high to fall, but stoop to rise.
খুব উপরে উঠো না অনিবার্য পতন, বরং নুয়ে পড় তবেই উঠবে। পা দুটো পথিক ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ করে অভিজ্ঞতা, জ্ঞান। আর মাথাটা হল ঝুলি, সব তুলে রাখে ওইখানে। তারপর নিজের মাথাই নিজের পায়ে পড়ে। পা তখন লাথি মেরে চলে যায় নতুন জীবনের দিকে।
আমি সব সময় বলি, ‘বড়মামা ইজ বড়মামা, নো তুলনা।’
মাসিমা খুব চড়া গলায় বললেন, ‘বড়দা! কী করতে চাইছ, বলবে?’
‘বলবো, কিছুক্ষণের জন্যে মরে যাব, তারপর আবার বেঁচে উঠব।’
‘মানে?’
‘একটা মানুষ মরে যাওয়ার পর কী করা হয়? তাকে খাটে তুলে ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়। রাস্তা থেকে ছ’ফুট উচ্চতায় শূন্যে ভাসতে ভাসতে চলল শ্মশানে। চারটে কাঁধ থেকে তিনি মাটিতে নামলেন। বডি রেখে সবাই চলল চা খেতে। সিগারেটে টান মারতে। যখন চিতায় চাপানো হত তখন কেউ গেল কাঠের অর্ডার দিতে। ডোমেদের হেড এসে বডি দেখে বলে দেবে ক’মন কাঠ লাগবে। তারপর এটা ওটা সেটা। তিনি চিতায় চড়লেন। মুখে আগুন। এক সময় ছাই। এই যে এতসব হচ্ছে, যে মরেছে সে কিছুই জানতে পারছে না। এত বড় একটা ব্যাপার। এ তো এই নয় যে, তালাবন্ধ করে কয়েকদিনের জন্যে কোথাও বেড়াতে যাচ্ছি। আবার ফিরে আসব!’
মেজোমামা বললেন, ‘তা তোমার প্ল্যানটা কি?’
‘আমার ধারণা, সে বুঝতে পারে, খুব ভালোভাবেই পারে, প্রকাশ করতে পারে না। ‘সিস্টেম ফেলিওর।’ যন্ত্র অকেজো হয়ে গেছে। অনুভূতিটা যাবে কোথায়! অনুভূতি তো কোনও যন্ত্র নয়। একটা ব্যাপার। আমি জ্যান্ত শব হয়ে আমি আগেভাগে অনুভব করে নিতে চাই শেষযাত্রাটা আমার কেমন লাগবে! এ কথা তো কেউ অস্বীকার করতে পারবে না যে আমি একজন বিজ্ঞানী। আত্মপ্রচার অসভ্যতা।’
ললিতকাকু বললেন, ‘ফ্যান্টাস্টিক! আপনি জাস্ট একদিন ওয়েট করুন, আমিও আপনার সঙ্গী হব। আজ তো দশকর্মা ভাণ্ডার বন্ধ হয়ে গেছে। কি কি লাগবে? খাটিয়া, নারকেল দড়ি, পাতলা তোশক, সাদা চাদর, ইত্যাদি ইত্যাদি। এটাও একটা ব্যাপার মানে সকলেই তো একা একা মরে, একা একাই শ্মশানে যায়, এ আমরা পাশাপাশি দুজনে গল্প করতে করতে যাব।’
‘গল্প করতে করতে? আপনি পাগল না কি? ডেডবডি কথা বলবে? লোকে কি ভাববে? ছ্যা ছ্যা করবে। গায়ে থুথু দেবে। মুখে চুন-কালি মাখাবে।’
‘সরি, সরি, আমি অতটা ভেবে দেখিনি। মনে করেছি বেঁচে আছি।’
‘বেঁচে থাকলে কার দায় পড়েছে আপনাকে কাঁধে করে শ্মশানে নিয়ে যাবে?’
‘বুঝেছি, বুঝেছি, একদম চুপচাপ। মনে মনে গুন গুন করে গান গাইব, হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হল, পার করো আমারে।’
‘সে আপনার যা ভালো লাগে করবেন। আমি চুপচাপ পড়ে থাকব শবাসনে। চোখের ওপর কালো আকাশ। আমি পাঁজি দেখে নিয়েছি। নটা তেত্রিশে অমাবস্যা লেগে গেছে। কালো আকাশ। ফুটকি ফুটকি তারা। দু’পাশে বাড়ি। দোতলার বারান্দা অন্ধকার। কেউ হয়তো দাঁড়িয়ে আছে। সিগারেট খাচ্ছে। অনেকটা উঁচুতে হ্যালোজেন বাতি…’
‘কি আশ্চর্য! আপনি দেখেছেন কেন? ডেডবডি দেখে না, দেখতে পায় না, পেলেও দেখা উচিত নয়। জোচ্চুরি হচ্ছে। চোখে তুলসীপাতা সেঁটে দেয়, নাকে তুলো। আমার গল্প বন্ধ করে দিলেন, এদিকে নিজে শুয়ে শুয়ে তারা দেখছেন? একে বলে পক্ষপাতিত্ব।’
‘একটা ডেডবডির আর একটা বডি কি করছে কখনোই দেখা উচিত নয়। এটা হল মিনিমাম সংযম, ভদ্রতা। যেমন পরীক্ষায় বসে টোকাটুকি অত্যন্ত গর্হিত কাজ। আমি কি দেখছি আপনি কি করছেন। একটা কথা মনে রাখতে হবে, আমরা মরে গেছি। বাংলা সিনেমায় দেখেননি, বড় বড় অভিনেতা, অভিনেত্রীরা কি ভাবে মরছেন। মরে পড়ে আছেন চিৎ হয়ে। সবাই ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। প্রার্থনা সঙ্গীত হচ্ছে। তারপর শবযাত্রা। চিতাও দেখানো হয়। মুম্বাই ছবিতে খুব ঘটা করে দেখানো হয়। ডেডবডি উনুনে ঢুকিয়ে দিলে সিনেমা মার খাবে। দাউ দাউ আগুন চাই। লেলিহান শিখা।’
‘তাহলে কি দাঁড়াল?’
‘আজ আমি শব। আপনারা শবযাত্রী। কাল আপনি শব আমরা শবযাত্রী। মড়ার ‘সেট’ তা তৈরিই আছে। কেনাকাটার দরকার নেই।’
‘এক মড়ার জিনিস আর এক মড়া ব্যবহার করবে?’
‘ওতে দোষ নেই, গঙ্গাজল ছিটিয়ে দিলেই হবে।’
ললিতকাকু বললেন, ‘তাহলে বাড়ি থেকে গামছাটা নিয়ে আসি। কোমরে বাঁধতে হবে তো। এই আমার প্রথম অভিজ্ঞতা। আগে কখনো মড়া পোড়াইনি। ভীষণ একসাইটেড লাগছে।’
‘সব আছে, এক ডজন নতুন গামছা। বড়, ছোট। বড়টা কোমরে, ছোটটা মাথায়।’
মেজোমামার আবার এইসময় একটা ঢুলুনি আসে। সময়টা পেরিয়ে গেলে সারারাত জাগতে পারেন। খুটখুট করে কত কি যে করেন! লেখাপড়া তো আছেই, তা ছাড়াও অনেক কিছু। মেজোমামা মাথাটা ঝাঁকিয়ে নিয়ে বললেন, ‘এইমাত্র একটা আইডিয়া এল। ভীষণ রোমান্টিক। ও বেশ খ্রিস্টান, ওকে আমরা কবর দেব। কালো একটা কফিন। মাটির তলায় সাত-আট ফুট গভীরে নামিয়ে দিয়ে মাটি চাপা দোবো।’
‘মরে যাবে তো!’
‘তা কি, বেশিক্ষণ বাঁচবে না। শুধু মরবে না, আমাদেরও মেরে যাবে। ফাঁসি হবে।’
বড়মামা বললেন, ‘ওর কথা বাদ দিন। ছেলেটার কোনও কল্পনাশক্তি নেই। কি করে অধ্যাপক হয়েছে কে জানে!’
ললিতকাকু বললেন, ‘সে আমি ছেড়ে দিচ্ছি। একটা কথাই ভাবছি, কেউ কি খেয়ে মরে?’
‘কি আশ্চর্য! খেয়েই তো মরে! আমার চার-পাঁচজন পেশেন্ট। এই তো রে বাবা, ক’দিন আগে নিতাইবাবু, আমাদের নিতাইবাবু, মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে একসঙ্গে সাতটা বাগদা চিংড়ি খেয়ে অন্ত্রিকে মারা গেল। আমি লুচি খেয়ে, গ্যাস অম্বলে হার্টফেল করলুম। আরে মশাই মরার তো একটা কারণ থাকবে। মরব বললেই মরা যায়!’
মাধাই এসে বললে, ‘সব রেডি। একবার শুয়ে দেখে নিন, পিঠে লাগছে কি না! তাহলে আর একটু খড় ঢুকিয়ে দেব।’
ললিতকাকু বললেন, ‘মৃত ব্যক্তির লাগে না। এত শবযাত্রা দেখেছ, কখনো শুনেছ কি, শব চিৎকার করে বলছে, ‘ওরে এত নাচাচ্ছিস কেন? আমি যে ছিটকে রাস্তায় পড়ে যাব।’
মাধাই বিরক্তি মেশানো গলায় বললে, ‘আপনি এমন ভাবে কথা বলছেন যেন বড়দা সত্যি সত্যি মারা গেছেন!’
বড়মামা বললেন, ‘মাধাই, আজ রাতে নো রাগারাগি।’
খাঁটি ঘিয়ে লুচি ভাজার গন্ধ। বড়মামা বললেন, ‘আমি পোশাকটা পাল্টে আসি। রাজবেশ। পণ্ডিতমশাই আজ ভগবান আপনাকে এখানে পাঠিয়েছেন। কুসি সাজিয়ে দিচ্ছে, আপনি রাধা-গোবিন্দকে একটা ভোগ নিবেদন করে দিন।’
বড়মামা কিছুক্ষণের মধ্যে রাজবেশ ধারণ করে নেমে এলেন। কি দেখাচ্ছে? কত সুন্দর! ওদিকে ঠাকুরঘরে ঘণ্টা বাজছে। পণ্ডিতমশাই বিশুদ্ধ সংস্কৃত মন্ত্রপাঠ করছেন। বড়মামা বললেন, ‘এসো, আমরা সবাই একসঙ্গে খেতে বসি। কেউ যেন বাকি না থাকে। কুসি তো আমাদের সকলের মা। কুসি! সেই ছেলেবেলায়, মনে পড়ে, ঘুমে চোখ ঢুলে আসছে, মা আমাদের তিনজনের মুখে একে একে খাবার তুলে দিচ্ছেন! তুই প্রথম গ্রাসটা আমার মুখে তুলে দে। এইটাই আমার শেষ গ্রাস। কুসি! তুই ভীষণ ভালো মেয়ে! তুই মা, তোর মধ্যে আমি আমার বিশ্বজননীকে দেখেছি। আর ওই মেজো, ও তো চির বালক! ওকে সাবধানে রাখিস। আর আমাদের এই ভাগনে, একে ডাক্তার করিস। আমার স্টেথিস্কোপটা যেন এর গলায় ঝোলে। আমাদের পরিবারের ঐতিহ্য জান-প্রাণ দিয়ে ধরে রাখিস। বনমালীদা আরও কিছুদিন থেকো, মানুষের বাগানের মালী হয়ে।’
ললিতকাকু বললেন, ‘কেমন যেন সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছে।’
মেজোমামা স্তব্ধ। মাসিমা স্তম্ভিত।
বড়মামা দেবতাদের প্রণাম করলেন। গৃহকে প্রণাম করলেন। পূর্বপুরুষদের ছবির সামনে দাঁড়ালেন। মনে মনে কিছু বলছেন। ঠোঁট নড়ছে সকলের দিকে হাসি হাসি মুখে তাকালেন। বনমালীদার হাত দুটো ধরে বললেন, ‘তুমি রইলে।’ পণ্ডিতমশাইকে প্রণাম করলেন। মাসিমাকে বললেন, ‘আমার কপালে ভাইফোঁটা দে।’ মাসিমা একটা চন্দনের ফোঁটা দিলেন। কি হচ্ছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না, সকলেরই কথা বন্ধ। স্তব্ধ রাত। পাতায় পাতায় বাতাসের শব্দ। বড়মামা ধীরে ধীরে খাটের দিকে এগোচ্ছেন। পাশেই একঝুড়ি সাদা ফুল। বড় বড় পদ্ম। ধবধবে সাদা চাদর। শববাহকরা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে কোমরে বাঁধা গামছা। ধূপের ধোঁয়া অন্ধকারে সাদা সাদা চুলের মতো ঘুরে ঘুরে আকাশের দিকে উঠছে। সেই পেঁচাটা সাদা শাঁখের মতো। একেবারে ঘড়ি ধরা সময়ে এসে গেছে। চিলের ছাতের কার্নিশে। কিছুক্ষণ ধ্যান করবে। তারপর চ্যাঁ চ্যাঁ করে উড়ে যাবে গঙ্গার ধারের শিবমন্দিরের দিকে।
খাটের কাছে এসে বড়মামা আমাদের দিকে ফিরে তাকালেন। জোড়হাতে বললেন, ‘জ্ঞানে, অজ্ঞানে যে সব খারাপ ব্যবহার করেছি, দুঃখ দিয়েছি, অবিচার করেছি, তার জন্যে আমি ক্ষমা চাইছি। আমি এসে কিছুদিন তোমাদের সংসারে থেকে গেলুম, ‘এবার পেয়েছি ছুটি বিদায় দেয় ভাই, সবারে আমি প্রণাম করে যাই।’ হ্যাঁ, একটা কথা, হঠাৎ একটা বাতাস আসবে, সব গাছে পাতা ঝপঝপ করে উঠবে, তখনই বুঝবে, আমি চলে গেলুম, চিরবিদায়। শুনতে পাবে, কোথাও যেন ঘণ্টা বাজছে, আরতি হচ্ছে, সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ার শব্দ শুনবে। আর কথা নয়, এবার আমাকে ধরাধরি করে শুইয়ে দাও, শবকে যেভাবে শোয়ায়। কুসি আমার বুকে একটা পদ্ম রাখবে, হৃদকমলে একটি কমল।’
কাজলদি আঁচল দিয়েছে চোখে। বড়মামার পেছন দিকে বাগান। আলো আর অন্ধকার। হঠাৎ, বড়মামা ফুলের ঝুড়িটা হাতে তুলে নিয়ে হা হা করে হাসতে হাসতে মাসিমার দিকে এগিয়ে গেলেন। সমস্ত ফুল মাসিমার মাথায় উজাড় করে ঢেলে দিতে দিতে বললেন, ‘ওরে! তোকে ছেড়ে এত তাড়াতাড়ি আমি যে যেতে পারব না।’
মাসিমার মাথায় একটা পদ্মফুল আটকে গেছে। পায়ের কাছে কত ফুল জমা হয়েছে। কাজলদি হাততালি দিচ্ছে, ‘সরস্বতী! আমাদের মা সরস্বতী। জয় জয় দেবি, চরাচরসারে…’
বড়মামা জিগ্যেস করলেন, ‘কেমন হল?’
মাসিমা বললেন, ‘অনেকদিন, অনেকদিন আমার হাতে পেটানি খাসনি। পাখাটা, সেই পাখাটা কোথায় গেল। যেটা তোর পিঠে পড়ত!’
পণ্ডিতমশাই বললেন, ‘তালপাতার হাতপাখা এক অসাধারণ সৃষ্টি। একদিকে শীতল বাতাস, আর একদিকে কঠোর শাসন। তা ডাক্তার, তুমি করলে ভালো, পাকা অভিনেতা হে! তা এখন বলো…।’
বড়মামা একটি ফুল তাঁর পায়ে রেখে বললেন, ‘মায়ের পুজো, হবে, হবে, হবে।’
সেই প্যাঁচা। মা লক্ষ্মীর বাহন চ্যাঁ চ্যাঁ করে জানিয়ে দিল এই বাড়িতে আমার মা আছেন, আছেন, আছেন।
আশ্চর্য! আজ আর উড়ে গেল না।