হাতছানি

হাতছানি

সরাইঘাট এক্সপ্রেস নিউ আলিপুরদুয়ার স্টেশনে ঢুকেছে ভোর চারটেয়, আশ্চর্যজনকভাবে সময়ের প্রায় আধ ঘন্টা আগে। শীত শেষ হয়ে বসন্ত এসেছে, কিন্তু ভোরের দিকটায় হাওয়া এখনও শিরশিরানি ধরাচ্ছে চামড়ায়। আমার গন্তব্য ধুপগুড়ি গ্রামীণ হাসপাতাল। স্টেশন থেকে দূরত্ব প্রায় তিরিশ কিলোমিটার। আপাতত তিন বছরের পোস্টিং এই হাসপাতালে। এত সকালে সরাইঘাট বেছে নেওয়ার কারণ ডিউটিতে আমি আজই জয়েন করতে চাই, সকাল সকাল কোয়ার্টারে পৌঁছে লাগেজগুলো ধপাস করে নামিয়েই ডিউটিতে ছোটার পক্ষপাতী আমি নই।

হাতে এখন যথেষ্ট সময়, আপাতত একটা চায়ের দোকান খুঁজে বার করতে পারলেই গতরাতের মাত্র চার ঘন্টার ঘুমের কমতিটা পুষিয়ে যাবে। দুই নম্বর প্ল্যাটফর্মের এই মাথায় কোনও চায়ের দোকান চোখে পড়েনি, এই প্ল্যাটফর্মেই যাদের সংসার তাদেরই এখনও ঘুম ভাঙেনি। চাদর মুড়ি দেওয়া কিছু শরীর এমনভাবে ছড়িয়ে রয়েছে এদিক ওদিক, যে খুব কাছে, খুব পাশে গিয়ে দাঁড়ালেও তাদের ঘুম ভাঙবে বলে মনে হয় না। ছেঁড়া চাদরের নীচে কুণ্ডলী পাকানো অবয়বগুলো গুনতে গুনতে প্ল্যাটফর্মের ওদিকটায় এগোই আমি। দূর থেকে যেন একটা কয়লার উনুনের ধোঁয়া জানান দিচ্ছে যে ওদিকেই চায়ের দোকান থাকলেও থাকতে পারে। হাতের ট্রলিটার হ্যান্ডলটা ধরে টানতেই বিপত্তি বাধালাম একটা, হ্যান্ডলটা ট্রলির পেছনের কভারটা ছিঁড়ে বেরিয়ে এল হাতে, আর প্রায় তিরিশ কেজির ট্রলিটা প্ল্যাটফর্মের নিস্তব্ধতা কাটিয়ে ধমাস শব্দে হাত থেকে ছিটকে মাটিতে এসে পড়ল। অবশ্য এই অতর্কিত শব্দে ঘুম ভেঙে বিরক্ত হওয়ার মত কেউ নেই। ট্রলির ভাঙা হ্যান্ডলটা হাতে নিয়ে, এদিক ওদিক তাকিয়ে কী করব ভাবছি, ঠিক তখনই পেছন থেকে একটা আওয়াজ পেয়ে ঘুরে তাকাতেই অবাক হয়ে গেলাম। যাকে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি সে এককালের আমার অভিন্নহৃদয় বন্ধু হলেও দীর্ঘ তিন বছর তার সাথে আমার দেখা হয়নি। বলা ভালো, দেখা করার হাজারো প্রচেষ্টা সে ব্যর্থ করেছে। দিনের পর দিন ফোন ধরেনি, তাকে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের অ্যাকাউন্টে খুঁজে পাওয়া যায়নি, গত তিন বছরের মধ্যে তার বাড়িতেও যতবার দেখা করতে গেছি ততবারই তার দেখা পাইনি। সব্যসাচী দাশগুপ্তর মুখোমুখি হচ্ছি বছর তিনেক পর, এম.ডি শেষ করার পর ওই কটা বছর জলের মতই কেটে গেছে।

মনের মধ্যে উঠতে থাকা হাজারো প্রশ্ন আর অজস্র অভিযোগের ঘূর্ণিঝড় সামলে চেনা মুখটার দিকে তাকিয়ে হাসলাম, “কী ব্যাপার! তুই এখানে?” সব্যসাচীও আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসল, দেখলাম হাসিটা এখনও একই রকম আছে। ট্রলিটাকে মাটি থেকে তুলতে তুলতে ও জবাব দিল, “হ্যাঁ, আমি তো লাস্ট তিন বছর ধরেই এদিকেই আছি।”

মনে পড়ে গেল, ওর পোস্টিং হয়েছিল তুফানগঞ্জের মেন্টাল হসপিটালে। শেষ খবর পেয়েছিলাম বছর দুয়েক আগে ওর বাড়িতে দেখা করতে গিয়ে, সব্যর মার মুখে। সব্যসাচী দাশগুপ্ত, ওয়ান অফ দ্য ব্রাইটেস্ট স্টুডেন্টস অফ সায়কায়াট্রি, আইপিজিএমআর, তুফানগঞ্জের প্রায় নতুন নিউরোসায়কিয়াট্রি হাসপাতালের মেডিক্যাল অফিসার পদে চাকরি করছে। হঠাৎ হিসেবটা মাথায় এল, তিন বছরের পোস্টিং আর সেই তিন বছরই প্রায় নিরুদ্দেশ… দুটোর মধ্যে যোগসূত্র আছে কি কোনও! ট্রান্সফারের চিঠি চলে আসা উচিত এতদিনে, আর বাধ্যতামূলক রুরাল পোস্টিংয়ের এই বিড়ম্বনা সেরে, এই পাণ্ডব বর্জিত জায়গা থেকে বেরিয়ে সব্যসাচীর মত ছেলের কেরিয়ার হওয়া উচিত কোনও ঝাঁ চকচকে শহরের বিত্তনন্দিত পরিকাঠামোয় মোড়া কোনও প্রাইভেট হাসপাতাল। মনে পড়ে, শেষ যেদিন ওর খোঁজে লেক রোডে ওর বাড়ি গিয়েছিলাম, কাকিমা মানে সব্যর মা খুব দুঃখ করেছিলেন। ছেলে বাড়িতে কম আসে, কম কথা বলে, যোগাযোগ রাখে না।

সব্যসাচী মিশুকে, হইহুল্লোড়বাজ কোনওদিনই ছিল না। এমনকি গ্রুপ ছবি তুলতে গিয়ে সবাই একে অপরের কাঁধে হাত দিয়ে দাঁড়ালেও, ও দাঁড়াত একটেরে কোনও একটা কোণে। ভাবতাম, এটাই ওর স্বভাব। থট রিড করার একটা স্বাভাবিক ক্ষমতা ছিল ওর, গভীর অন্তর্দৃষ্টি ছিল। সেটা অন্য অনেকে না জানলেও আমি জানতাম। স্টুডেন্ট লাইফ আর ইন্টার্নশিপ মিলিয়ে সেই বারোটা বছরে সত্যি কথা বলতে সব্যসাচী দাশগুপ্তর বন্ধু বলতে সে অর্থে কেউ ছিল না, এক এই শর্মা বাদে। বাকিদের কাছে সব্যসাচী ছিল একসেনট্রিক, মুডি, জেদী, আত্মমগ্ন আর অবুঝ। তাই পিজি এনট্র্যান্সে দুর্দান্ত ৱ্যাঙ্ক করে ও যখন সায়কিয়াট্রি বেছে নিল, বাকিরা অবাক হলেও আমি হইনি।

সেই প্রাণের বন্ধু সব্য যখন নিজের বাবা মায়ের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখে না দেখলাম, তখন খুব রাগ হয়েছিল ওর উপরে। সেই এমবিবিএসের সময় থেকে ও আমার বন্ধু, এম ডিতে গিয়ে স্ট্রিম আলাদা হয়ে গেলেও একই হোস্টেল, একই রুম শেয়ার করাতে বন্ধুত্ব নিবিড় ছিল। ভাবতাম আমি হয়তো আইস ব্রেক করে ওর কাছাকাছি পৌঁছাতে পেরেছি, কিন্তু… ওকে প্রশ্ন করলাম, “তুই কি কোনও কাজে এসেছিলিস আলিপুরদুয়ার? তোর পোস্টিং তুফানগঞ্জে না?”

“হুম, টাউন থেকে কটা জিনিস কেনার ছিল রে।”

সব্যর হাতে দেখলাম বেশ কটা প্যাকেট, সব কটারই মুখ বন্ধ, আকার দেখে মনে হয় বইয়ের প্যাকেট।

“কী এগুলো?”

সব্যসাচী অদ্ভুতভাবে ঠোঁটে আঙুল লাগিয়ে আমায় চুপ করতে বলে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। এতক্ষণে খেয়াল করলাম ওর চেহারার বেশ পরিবর্তন হয়েছে এই ক’বছরে। কন্ঠার হাড় দেখা দিয়েছে, গাল চুপসে গেছে, নোসব্রিজ খাড়া ওর ছিলই, এখন গাল ভেঙে যাওয়ায় নাকের হাড়টা বেমানান ভাবে উঁচু দেখাচ্ছে। চেহারার সামগ্রিক মালিন্যের মধ্যে উজ্জ্বল দুখানি চোখের তারায় বিভ্রান্তির ছাপ। সব্যসাচী ফিসফিস করে বলে উঠল, “আস্তে বল, শুনতে পাবে।”

“কে শুনতে পাবে? কী শুনতে পাবে?”

সব্যসাচী কথার উত্তর দিল না। বুঝলাম ওর কিছু সমস্যা হচ্ছে। হোস্টেলে থাকতে এই ছেলেটার সাথেই রাতের পর রাত জেগে লেঁব্ল্যা, জেমস জয়েস, এরউইন ভন আলোচনা করেছি। পড়ার বইয়ের বাইরেও সব্যসাচীর অন্যান্য বিষয়েও প্রচুর আগ্রহ ছিল। অন্তর্মুখী হলেও ওকে এত লস্ট কোনওদিন আগে লাগেনি।

কথা ঘোরালাম, জিজ্ঞাসা করলাম “তোর চাকরি কেমন চলছে?”

“এই চলছে… বলে সব্যসাচী উদাস হয়ে গেল।”

“বাড়ি যাসনি কতদিন?”

“হুম, বাড়ি? তা যাইনি… অনেকদিন হল।”

“কাকু কাকীমা আসেন?”

আমার প্রশ্নে সব্যসাচী যেন শিউরে উঠল।

“না, না ওদের এখানে আসতে দেওয়া যায় না। ওদের… মানে ওদের খুব খারাপ লাগবে।”

“কেন? ঠিক করে বল তো কী হয়েছে?”

সব্যসাচী ফ্যালফ্যাল করে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকল, তারপর বলল, “কিছু না… মানে একটা লোক… তুই কাউকে বলবি না তো রুদ্র?” ও হাত চেপে ধরল আমার।

“না, বলব না।”

“একটা লোক জানিস, একটা লোক… আমার সব যুক্তি, পড়াশুনা, বিচারবুদ্ধি, সব কিছু লাটে তুলে দিয়েছে রে। আমি খুব চেষ্টা করছি তাকে আটকানোর, আমার যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে তার সব কার্যকলাপের একটা বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা দেওয়ার, কিন্তু পারছি না বিশ্বাস কর।”

“কোন লোক? কীসব ভুলভাল বলছিস বল তো?”

সব্যসাচী দুই হাতে মুখ ঢেকে সামনের বেঞ্চটায় বসে পড়ল। আমি পড়লাম মুস্কিলে, কাঁদে নাকি? এদিকে আমাকেও বেরোতে হবে এবার, নাহলে ডিউটি জয়েন করতে পারব না।

“একটু বস, তোর জন্য চা নিয়ে আসি। তারপর শুনব তোর কথা।”

সব্যসাচী উত্তর দিল না, একইভাবে মুখ ঢেকে বেঞ্চটার উপর বসে রইল।

চায়ের দোকানটার দিকে এগোতে এগোতে পুরোনো কিছু কথা মনে পড়তে লাগল। এমবিবিএসের অ্যানাটমির ডিসেকশনের প্রথমদিনের ক্লাস, একটা ক্যাডাভার শোওয়ানো টেবিলে। ফর্মালিনের অসহ্য গন্ধের সঙ্গে মৃত শরীরের বোঁটকা গন্ধ মিশে মাথা ধরে যাচ্ছিল। স্যার ডেকে বললেন, “কে আগে ইনশিসন করবে?” জীবনে প্রথম বার মৃত শরীরের অঙ্গ ছুঁয়ে দেখতে আমাদের সবারই ভয় মেশানো দ্বিধা কাজ করছিল। সব্য নির্বিকারভাবে এগিয়ে গিয়েছিল, স্ক্যালপেল দিয়ে চামড়ার সুপারফিসিয়াল লেয়ারটাকে প্রথমবার কাটার সময়ও ওর মধ্যে কোনও দ্বিধা দেখিনি। অর্গ্যান হাতে নিয়ে দেখার ব্যাপারেও সবার আগে ও-ই উৎসাহী ছিল। তাতে অন্তত এইটুকু বুঝেছিলাম যে সব্যসাচী দাশগুপ্তের নার্ভ অসম্ভব শক্ত, সহজে কাবু হওয়ার ছেলে সে নয়।

আজকের দেখা ভীতু, নড়বড়ে, আত্মবিশ্বাসহীন চেহারাটার সঙ্গে পুরোনো চেহারাটা কিছুতেই মেলাতে পারছিলাম না। কীসের জন্য, কোন বিশেষ পরিস্থিতিতে সব্যসাচীর এই অবস্থা হয়েছে, এই মানসিক অবস্থাতে ও ডাক্তারিই বা করছে কীভাবে জানতে দুনির্বার আগ্রহ জন্মাচ্ছিল। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে দুরন্ত স্পিডে আবার ওর কাছে ফিরতে গিয়ে দেখি বেঞ্চ ফাঁকা, আমার লাগেজগুলো মাটিতে বেওয়ারিশ পড়ে আছে।

খুব রাগ হল সব্যর ওপর, যাকে বলে জ্বালাময়ী ক্রোধ। একে তো এতদিন পরে দেখা, তার উপর একটা দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়ে কিচ্ছু না বলে বেরিয়ে গেল চুপচাপ। যাক তাও এই ভেবে শান্তি পেলাম যে কোথায় পোস্টিং সেটা যখন জানা গেছে, তখন খুঁজে বার করতে সমস্যা হবে না। কোনও একটা ছুটির দিনে ওর সাথে দেখা করতে যাব এই ভাবতে ভাবতে স্টেশনের বাইরে রওনা দিলাম। ঘড়িতে তখন বাজে পৌনে পাঁচটা, আলিপুরদুয়ার স্টেশন জেগে উঠেছে বেশ খানিকক্ষণ।

******

হাসপাতালে জয়েন করে কেটে গেছে বেশ কটা সপ্তাহ। মাঝখানে দুবার কলকাতা ঘুরে আসলেও তুফানগঞ্জ যাওয়া হয়নি সময় করে। আজ হঠাৎ আমার রাঁধুনী কাম বাজারসরকার কাম গৃহমন্ত্রী রঘুবীরের মুখে তার দেশের বাড়ি তুফানগঞ্জের নাম শুনে সব্যর কথা মনে পড়ে গেল। অদ্ভুত মানুষের মন, যে হারিয়ে যাওয়া বন্ধুকে এত বছর পর দেখতে পেয়ে মনটা উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিল, যার জন্য রীতিমত দুশ্চিন্তা নিয়ে স্টেশন ছেড়েছিলাম, তার প্রসঙ্গই নিজের ব্যস্ততার আড়ালে চাপা পড়ে গেছে কীভাবে!

ধুপগুড়িতে আমার কোয়ার্টারটা বেশ বড়, দুটো বিরাট বিরাট ঘর, একটা বিরাট শান বাঁধানো উঠোন, উঠোনের দরজাটা খুলছে হাসপাতালের দিকটায়, উঠোনের ডানদিকটায় একটা কলতলা আছে,ওখানেই রঘুবীর জামাকাপড় কাচে, রান্নার বাসন মাজে। আজ সে ছুটি নিয়ে দেশে যাওয়ায় বাড়িতে আমি একাই ছিলাম, আজ নাইট ডিউটি। এই নির্বান্ধব জায়গায় এই সময়গুলোতে সঙ্গীর অভাব খুব বোধ হয়, দুটো কথা বলার জন্য প্রাণ হাঁপিয়ে যায়। তিনজন মেডিক্যাল অফিসারের ভ্যাকান্সিতে আপাততঃ আমি একাই সবেধন নীলমণি। আর রোগী দেখতে হয় ডায়েরিয়া থেকে ডায়াবেটিস সবই। রোবটের মত কাজ করতে হয়। দিনে একশ ষাট-সত্তর পেশেন্ট কোন ব্যাপারই নয়। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলেছে, উঠোনে মেলা জামাকাপড়গুলো তুলে ঘরের দিকে পা বাড়িয়েছি, হঠাৎই খিড়কি দরজায় খুট খুট আওয়াজে চমকে গেলাম। কে যেন অতি সন্তর্পনে, খুব আস্তে আস্তে খিড়কির দরজায় লাগানো হাতলটা ধরে টানছে। ওই দিকের দরজা দিয়ে কেউ আমার কোয়ার্টারে আসে না, দরজাটা কবে লাস্ট খোলা হয়েছিল সেটাও মনে নেই।

আওয়াজ শুনে এগিয়ে গিয়ে ছিটকিনি খুলেই চমক, দরজায় দাঁড়িয়ে সব্য। সেই একই পোশাক, একই রকম বিভ্রান্ত দৃষ্টি। খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “তুই! কী করে জানলি আমি এখানে আছি?”

“তোর বাড়িতে ফোন করেছিলাম, কাকিমা বললেন তুই এখানে। সেদিনের জন্য স্যরি রুদ্র।” সন্তর্পণে চারিদিক দেখতে দেখতে সব্যসাচী উত্তর দিল।

“ভেতরে আয়।” আমি বলে উঠলাম।

“হ্যাঁ আসব, তোকে চট করে আমার সমস্যাটা বলে চলে যাব। তুইই তো একমাত্র বুঝতিস আমায়, এবারেও বুঝবি আমি জানি।” সব্যসাচী হাতদুটো ধরে বলল আমায়।

উঠোনে রোদের তেজ প্রবল, দুটো মোড়া পাতা থাকলেও সব্যসাচীকে নিয়ে ঘরে বসালাম। পরবর্তী দেড় ঘন্টায় ও আমাকে যে গল্পটা বলল সেটা কতটা সত্যি আর কতটা ওর কল্পনার রঙ মেশানো তা বুঝতে পারলাম না, কিন্তু পুরো আজগুবি বলে উড়িয়েও দিতে পারলাম না।

“আমার পোস্টিং তুফানগঞ্জে হয়েছিল বছর তিনেক আগে। ডিসেম্বর মাসের তিন তারিখ, হাড়কাঁপানো শীতের দিনে। মনে প্রচুর উদ্দীপনা নিয়ে তুফানগঞ্জের আনকোরা হাসপাতালটাতে ঢুকেছিলাম। হাসপাতালে সুপারভাইজার বাদে মেডিক্যাল অফিসার আমাকে নিয়ে হাতে গুনে দুটি। আরেকটি পোস্ট ভ্যাকান্ট। এমনিতে আমাদের দেশে মাথার অসুখ চূড়ান্ত পর্যায়ে না উঠলে কেউ ডাক্তারের ধার ধারে না, যতক্ষণ না পর্যন্ত তাকে বেঁধে রাখার পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে ততদিন মানসিক সমস্যাটা কোনও রোগের পর্যায়েই পড়ে না। এসব সত্ত্বেও আমাদের দেশে মানসিক হাসপাতালে পেশেন্টের সংখ্যা সবসময়েই সারপ্লাস। তিরিশটা বেডের ছোট হাসপাতাল হলেও, মনে মনে ভেবেই নিয়েছিলাম হাসপাতালে বেশ রুগীর ভিড় পাব। কিন্তু ছ’মাস কেটে গেলেও, হাসপাতালে প্রতিদিন গোনাগুনতি দশ বারো জনের বেশি পেশেন্ট হত না। অন্য জায়গা থেকে রেফার করা পেশেন্ট অ্যাডমিট হতে আসলেও কোনও এক জাদুবলে তাদের বাড়ির লোক ভর্তি করতে চাইত না। অনেকদিনের চেষ্টার পর মূল কারণটা আবিষ্কার করতে পারলাম।

তুফানগঞ্জের কাছেই এক গ্রাম আছে কাজীপাড়া। সেখান থেকে আসত হাসপাতালের কিছু ক্যাসুয়াল স্টাফ। তাদের একজনের কাছ থেকে একদিন জানতে পারলাম, কাজীপাড়া, মাহিসর, তালিবপুর এই গোটা অঞ্চল জুড়ে নাকি সুলেমান রহমান নামে এক ফরিস্তা পীরবাবার আবির্ভাব হয়েছে। মাথার রোগের চিকিৎসায় তিনি সাক্ষাৎ ধন্বন্তরি। এমনিতে বাবা সবরকম রোগেরই চিকিৎসা করেন, কিন্তু পাগলের ডাক্তার হিসেবে তাঁর বেশ নাম ডাক হয়েছে। বাবাটিও বেশ উদার, যে কোনও পাগলামি সারাতে সামান্যই দক্ষিণা নেন। বাবার মন্ত্রের জোরে মানুষের ভাঙা সংসার জোড়া লেগেছে, মারকুটে রোগী শান্ত হয়েছে, পাগল পেশেন্ট সেরে গিয়ে বিয়ে করে সুখে শান্তিতে ঘর সংসার করছে। সুলেমান রহমানের পসার এতটাই বেড়েছে যে আসাম, ত্রিপুরা থেকেও দলে দলে লোক এসে তার দুয়ারে ধর্ণা দিয়ে পড়ে। পীর সুলেমান রহমান অবশ্য একদিনে চল্লিশ জনের বেশি পেশেন্ট দেখেন না। কারণটা জানার পর আমি আমার মত করে পেশেন্টদের সচেতন করার চেষ্টা করলাম। বশীকরণ, মারণ, উচাটন— এসবে যে মাথার রোগ সারে না, উল্টে সমস্যা আরও বাড়ে তা জনে জনে বলতাম। অথচ বেশ কয়েকমাস চেষ্টা করার পরও পরিস্থিতি খুব একটা বদলাল না। প্রথম দু’ তিনবার পেশেন্ট আসলেও কোন এক জাদুবলে তারা সুলেমানের কাছে চলে যাচ্ছিল। প্রতিদিন হাসপাতালে গিয়ে মনটা হতাশায় ডুবে যেত। শেষে এক অশিক্ষিতের হাতে এভাবে পর্যুদস্ত হব! আমার চাকরিটা আমার আত্মসম্মান যেন দিনদিন কমিয়ে দিচ্ছিল। আমার মনে একইসাথে রাগ, হতাশা আর অসহায়তা মিলিয়ে একটা খাপছাড়া অনুভূতি হত। এত পড়াশুনা, এত আয়োজন, এত সদিচ্ছা সবই কি বৃথা! এর মধ্যে একদিন একটা ঘটনা ঘটল।

একদিন হাসপাতালে তখন সন্ধে নেমেছে। ওয়ার্ডের পাশ দিয়ে লম্বা করিডরটার আলোগুলো তখনও জ্বলেনি। করিডরের লোহার তারজালি লাগানো লম্বাটে জানালার ফাঁক দিয়ে শেষ সূর্যের আলোটুকু মেঝেতে খোপকাটা ডিজাইন তৈরী করেছে। আমি আরেকজন স্টাফের সঙ্গে কথা বলতে বলতে করিডর দিয়ে হাঁটছিলাম, পীর সুলেমানের গল্প শুনতে গিয়ে একজায়গায় দাঁড়িয়েছিলাম। সুলেমানের ঠেকায় একদিন নিয়ে যাওয়ার কথা বলে সেই স্টাফকে সেখান থেকে সেদিনের মত বিদায় জানিয়ে নিজের কোয়ার্টারের দিকে ফিরতে যাবো, সেই সময়ে ওর পাশে কারুর একটা উপস্থিতি অনুভব করে স্থির হয়ে গেলাম। হঠাৎ কোথা থেকে শিরশিরে হাওয়া এসে কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছিল রক্তে, অজান্তেই আমার গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেল। নজর গিয়ে পড়ল করিডরের মেঝেতে, অবাক হয়ে দেখলাম, পাঁচ ফুট ইঞ্চি দশেকের একটা ছায়া আমার পাশেই পড়েছে, বিকেলের পড়ন্ত আলোয় সেই ছায়া যেন আরও ঘনীভূত হচ্ছে, আমার নিজের ছায়ার তুলনায় কয়েক পোঁচ পুরু কালো সেই ছায়া। হতভম্ব হয়ে পাশে তাকাতেই আমার রক্ত হিম হয়ে গেল, ছায়া রয়েছে অথচ মানুষের দেখা নেই… এক মিনিটের বিভ্রম আর তারপরেই ছায়াটা মিলিয়ে গেল, ঠিক যেন কর্পূর উবে গেছে হাওয়ায়। খানিকক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে থেকে এগোতে যাব, দেখি হাসপাতালের পেছনের গেটটার পাশে একটা লম্বাটে লোক একদৃষ্টে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। একটু এগোতেই লোকটা সামনে এসে দাঁড়াল, মুখে কদিনের না কামানো দাঁড়ি, পরনে একখানি হাফ হাতা শার্ট আর ময়লা ময়লা লুঙ্গি― ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “সুলেমান স্যারের কাছে যাবেন? ওনার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করছিলেন নাকি? আমি আনিসুর, নিয়ে যাব আপনাকে ওনার কাছে।” লোকটা আমার খুব কাছে চলে এসেছিল, এত কাছে যে লোকটার নিঃশ্বাসের শব্দটাও শুনতে পাচ্ছিলাম, বুকের ওঠাপড়ার শব্দটাও যেন বড় বেশি স্পষ্ট… যেন রোগা বুকটায় একমণি হাপর খোলা রেখেছে কেউ! আমার আবার ঠান্ডা লাগছিল, আনিসুর নামের লোকটা আচমকা হাত ধরে আবার বলে উঠল, “চলুন না, ডাগদারবাবু! পীর খুব খুশি হবেন!” আমার কব্জিতে সেই শক্ত মুঠো চেপে বসতে লাগল, মনে হল যেন লোকটা চাপ দিয়ে মট করে ভেঙে ফেলবে আমার কব্জি। কোনওমতে হাত ছাড়িয়ে বেরিয়ে এসে ছুট লাগালাম কোয়ার্টারের দিকে, পিছনে ফিরে একবার তাকাতেই দেখলাম আনিসুর আমার দিকে শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সেই দৃষ্টি প্রকৃতিস্থ মানুষের থেকে আলাদা। হাসপাতাল চত্বরের চাপ চাপ অন্ধকারের মধ্যে আলোর একটা ক্ষীণ ফুলকি যেন আনিসুরের চোখের মণিতে জ্বলছে নিভছে। ছুটতে ছুটতে মনে হল, কে যেন খুব জোরে জোরে হাসছে, হাসির দমকে কেঁপে কেঁপে উঠছে নিস্তব্ধ হাসপাতাল চত্ত্বর—” সব্যসাচী থামল একটু। বলল, “আমায় একটু জল দিবি?”

“হ্যাঁ দাঁড়া।”

সব্যর ক্লান্ত নুইয়ে পড়া মাথার চুলগুলোকে একবার আদর করে ঘেঁটে ওকে জল এনে দিলাম।

“তারপর তুই গেলি সেই পীরের কাছে?”

“হুম, দোনামনা করে ঠিক করলাম যে একবার দেখেই আসি। কাজীপাড়া গ্রামের প্রায় শেষ প্রান্তে একটা খড়ের চাল দেওয়া বাড়িতে অবশেষে লোকটার সঙ্গে দেখা হল। বাড়িটাকে ঘিরে ঘন কলাগাছের জঙ্গল। বাড়িতে ঢোকার প্রায় হাফ কিলোমিটার আগে থেকেই দেখলাম রুগীদের আর তাদের বাড়ির লোকেদের লম্বা লাইন। কেউ বসে, কেউ দাঁড়িয়ে। জিজ্ঞাসা করে জানলাম পীর সুলেমান চল্লিশ জন রুগী দেখার পর পরের দিনের জন্য নাম লিখে রাখেন, তাই রাত থেকেই লম্বা লাইন পড়ে।”

“মাই গড! অ্যাডভান্স বুকিং!”

“হ্যাঁ। মনে মনে ভাবলাম পরিচয় দেব না। আগে গিয়ে দেখি কীরকম ভাবে এতগুলো লোকের মাথা খাচ্ছে একটা ভণ্ড। লাইনের প্রথম মাথায় গিয়ে দাঁড়ালাম, ভাবলাম রুগীর আত্মীয় পরিচয়ে ভিড়ের মধ্যে মিশে খেলা দেখব। কিন্তু তার দরকার পড়ল না!”

“কেন?”

ঘরটার দাওয়ায় লোকটা বসেছিল। এক রুগীর বাড়ির লোক ট্রিটমেন্ট সেরে পীরের হাতে পয়সা তুলে দিচ্ছিল। পাশেই একটা টেবিলে ছোট্ট একটা টিনের বাক্সে লোকটা টাকা ঢোকাচ্ছিল। পরনে কালো ফতুয়া, আর একটা মলিন লুঙ্গি। গলায় একটা সবুজ পাথরের মালা, কী পাথর দিয়ে তৈরী জানি না, চকচক করছে। বাঁ হাতের আঙুলে অনেকগুলো আংটি, আর ডানহাতে ময়ূরের পালক দেওয়া একটা পাখা। সমস্ত চেহারাটায় একটা অদ্ভুত ক্ষিপ্রভাব রয়েছে, হিংস্র বাঘের মত দৃষ্টি। হাতের আঙুলগুলো মটকে, আড়মোড়া ভেঙে পরের রুগীকে ডাকতে গিয়েই লোকটার চোখ পড়ল আমার উপর। আমি চোখ সরিয়ে নিতে যাচ্ছিলাম কিন্তু পারলাম না। লোকটার চোখ… অনেকটা অন্ধকারে চোখের উপর আলো পড়লে যেমন চোখ ধাঁধিয়ে যায় ঠিক তেমনি মনে হল আমার। মনে হল চোখ বুজে ফেলি, নাহলে কী একটা যেন ক্ষতি হবে আমার, কিন্তু বিশ্বাস কর পারলাম না।”

লোকটা মুচকি হেসে আমায় ডাক দিল, “আইসেন ডাগদার বাবু, জানতাম আপনে আসবেন।”

ক্যাসুয়াল স্টাফটার উপর খুব রাগ হল, ওই নিশ্চয়ই খবর দিয়েছে। বা সেদিনের সেই আনিসুর… সেই বা কীভাবে জানল! কিছু যে একটা স্বাভাবিক নয়, সেটা বুঝতে পারছিলাম কিন্তু ঠিক মেপে উঠতে পারছিলাম না।

সুলেমান পীর তখনও আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল। এমন সময় সামনে লাইনে দাঁড়ানো একটা মেয়েকে নিয়ে ওর বাড়ির লোক দাওয়ায় উঠল। মেয়েটাকে আগেই লক্ষ করেছিলাম। কতই বা বয়স, আঠেরো উনিশ হবে, রোগাসোগা গড়ন, কব্জিতে একটা ঘন মোটা নীলচে দাগ, মোটা কিছু দিয়ে বাঁধা ছিল যেন জায়গাটা। মেয়েটার সাথে ছিল সম্ভবত ওর বাবা আর গ্রামসম্পর্কের কোনও জ্যাঠা। বাবার কব্জিতে প্লাস্টার ঝুলছে।

পীরের চোখ আমার থেকে সরে মেয়েটার উপর গিয়ে পড়ল। মেয়েটার সঙ্গে থাকা সেই জ্যাঠা পীরের কানে কানে কিছু একটা বলাতে পীর উঠে দাঁড়িয়ে ওদের নিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করবে, ঠিক তখনই কী মনে পড়াতে সে আমার দিকে পেছন ফিরে তাকাল। দেখলাম ওর ঠোঁটে আবার সেই মুচকি হাসি, একইরকম ভাবে হেসে বলল, “ভিতরে আইসেন না ডাগদারবাবু, একটু অন্যরকম টিরিটমেন্ট দেখবেন।”

বিনা বাক্যব্যয়ে ওর সঙ্গে উঠে এলাম ঘরে। স্যাঁতসেতে একটা ঘর, ঘরে ঢোকার সম্ভবতঃ একটাই দরজা, আমরা ঢোকার পর সুলেমান সেটা নিজে হাতে বন্ধ করল। সারাঘরে কোনও আলো নেই, একটা বাদে। একটা ষাট ওয়াটের বাল্ব সিলিং থেকে ঝুলছে, তার তলায় একটা কাঠের চেয়ার পাতা। সারা ঘরে চাপচাপ অন্ধকার যেন আলোর একমাত্র উৎসটাকে গ্রাস করতে আসছে। মেয়েটাকে ওর বাবা ধরে চেয়ারে বসাল, মেয়েটা চেয়ারে এসে বসল বটে, কিন্তু মনে হল ঠেলা মারলেই পড়ে যাবে… বহুদিনের হা ক্লান্ত একটা শরীর, চোখের পাতা আধা বোজা, ঘরে কে আছে, ওর সাথে কী হচ্ছে কোনও কিছুর দিকেই কোনও হুঁশ নেই।

সুলেমান খানিকক্ষণ মেয়েটাকে দেখল, তারপর মেয়ের বাপকে জিজ্ঞাসা করল, “মাইয়াকে খাতি দাও না বুঝি? ইতো পুরাই কঞ্চি হইয়ে গিছে, গায়ে একটুও মাস নাই।”

মেয়েটার বাপটাকে আগেই খেয়াল করেছিলাম, ভীত, উদ্ভান্ত্র একটা চেহারা, পীরের কথায় সে একেবারে কেঁদে তার পায়ে পড়ল। হাউমাউ করে মিনিট পাঁচেক ধরে যা সে উগড়াল তাতে বোঝা গেল লোকটির নাম তারক মন্ডল, নিবাস আউচা। সঙ্গের মেয়েটি তার একমাত্র মেয়ে, চার ছেলেমেয়ের সবচেয়ে ছোট। ছমাস আগে মেয়েটির মা মারা যাওয়াতে মেয়েটি খাওয়া দাওয়া প্রায় ছেড়েছিল, জানালার ধারে বসে বসে আপন মনে হাসত, আপন মনে কাঁদত। বাড়ির লোকে ভেবেছিল মায়ের শোকে অমন হয়েছে, সময়ে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু তার পর থেকেই…”

“তারপর থেকে কী হল, কিছু আনন্যাচারাল?” সব্যকে জিজ্ঞাসা করলাম।

“এক্সাক্টলি সো, এরপরের ভার্সনটা হুবহু তারকের মুখে যেমন শুনেছি, তেমনই বলছি।” বলল সব্য।

“তারকের গ্রামের এক অলস দুপুরের কথা। গ্রামেরই কোনও পুকুরপাড় ধরে হরি বামনী বলে একজন দুপুরবেলা স্নান সেরে ফিরছিল। সেই মহিলা স্থানীয় মন্দিরে ঠাকুরের ভোগ রাঁধত। ভোগ রেঁধে, তার নিজের ভাগেরটি পেতলের জামবাটিতে নিয়ে রোজই পুকুরে স্নান সেরে বাড়ি গিয়ে সে সেই ভোগ খেত। সেদিন সে স্নান করতে যাবে, বেলা তখন প্রায় তিনটে, রটন্তী অমাবস্যার দিন হওয়াতে ভোগ রাঁধতে বেলা হয়েছে ঢের, পুকুরপাড় নির্জন, গাঁয়ের রাস্তাঘাটেও বিশেষ লোক নাই। হরি বামনীর মনে হল কে যেন পায়ে পায়ে আসছে… পুকুরপাড়টি বেশ পুরোনো, কিছু বাবলা, শিরীষ আর কলাগাছে ঘেরা অন্ধকার একটা জায়গা। হরি বামনী জোরে জোরে হাঁটতে লাগল। যতবার সে জোরে জোরে হাঁটে ততবার সরসর সরসর করে পাতা মাড়িয়ে কে যেন পাশে পাশে চলে। শ্যাওলা বাঁধানো ধাপে ভোগপ্রসাদের বাটিটা রেখে হরি বামনী সবে ধাপ থেকে নেমে জলে ডুব দিয়েছে… একবার… দুবার… তিনবারের আগেই কে যেন প্রবল শক্তিতে বামনীর মাথা জলের তলায় চেপে ধরল, নিঃশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে প্রচুর জল ঢুকতে লাগল, বামনীর মনে হল কে যেন বুকের মধ্যের কলজে ছিঁড়ে নিচ্ছে, শরীর ভারি হতে লাগল, বাঁচার শেষ চেষ্টাতে বামনী হাত বাড়িয়ে আততায়ীর গলা টিপে ধরল। কতক্ষণ খেয়াল নেই, হয়তো মিনিট দশেক হবে, হরি বামনী আর সেই অজ্ঞাত আততায়ীর মধ্যে খণ্ডযুদ্ধের পর হঠাৎ সবকিছু থেমে গেল। বামনীর মাথার উপর থেকে প্রবল চাপ সরে গেল, একটা প্লাস্টিকের বলকে জলে জোর করে ডুবিয়ে হঠাৎ ছেড়ে দিলে যেমন ভুস করে ভেসে ওঠে, বামনীও ঠিক তেমন জলের উপর ভেসে উঠল। ততক্ষণে তার পেটে জল ঢুকে গেছে, আর সাঁতরানোর ক্ষমতা নেই। হয়তো ডুবেই যেত, ঘটনাচক্রে সেই সময় গাঁয়েরই অন্য এক মহিলা এসে যাওয়াতে সে যাত্রায় বামনী বেঁচে গেল।”

“বুঝলাম, কিন্তু এর সাথে ওই মেয়েটির কী সম্পর্ক?”

“সেই রাতে সুস্থ হয়ে বামনী গ্রামের সবাইকে সবকিছু খুলে বলে। বামনী বাঁচবার তাগিদে হাঁকপাক করতে করতে জলের মধ্যে যখন হাত-পা ছুঁড়ে আততায়ীর হাত সরানোর চেষ্টা করছিল তখন তার হাতে ঠেকেছিল কয়েকগাছা চুরি পড়া দুটো সরু সরু হাত। পরেরদিন সকালে তারক মন্ডলের মেয়ের গলায় পাঁচ আঙুলের কালশিটে দাগ দেখে কারুর আর বুঝতে বাকি রইল না যে পুকুরপাড়ের কীর্তিটি কার হতে পারে! বিশেষতঃ হরি বামনীর সঙ্গে তারক মন্ডলের মৃতা স্ত্রীর কোনও এক সময় ভোগের ভাগ নিয়ে ঝগড়া হয়েছিল, ফলে দুইয়ে দুইয়ে চার করতে লোকের দেরী হল না। মেয়েটি দেখা গেল আপাত নির্বিকার, তাকে জিজ্ঞাসা করলে কিছু মনে করতে পারে না, বেশি প্রশ্ন করলে নিজের মধ্যে গুটিয়ে যায়।”

“তারপর?”

“তারপর একে একে গ্রামের সেই সব লোক যাদের সঙ্গে মেয়েটির মায়ের কোনও না কোনও সময় ঝামেলা হয়েছিল, দেখা গেল তাদের উপরই একের পর এক হামলা হচ্ছে। বারবার তারক মন্ডলের মেয়েই যে জড়িত তারই প্রমাণ পাওয়া যেতে লাগল, শেষে সালিশী সভা ডেকে গ্রামের মাতব্বরেরা বিধান দিল মেয়েটিকে বাইরে ছেড়ে দেওয়া বিপজ্জনক, ঘরেই তাকে বেঁধে রাখা হোক।”

“তারক মন্ডল অত বড় মেয়েকে ঘরে বেঁধে রাখতে রাজি হল?”

“উপায় ছিল না, মেয়েটি এমনিতে শান্ত নিরীহ স্বভাবের, কিন্তু বিশেষ বিশেষ সময়ে খেপে উঠলে তাকে সামলানো যেত না, তার অপুষ্ট শরীরে যেন হাজার হাতি ভর করত, চোখ উল্টে মুখে ফ্যানা তুলে ভয়ানক আর্তনাদে তার শরীরের সবটুকু শক্তি যেন সে ব্যয় করে ফেলত। বাধ্য হয়ে তারক মন্ডল মেয়েটাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতে শুরু করল। গ্রামের লোকের পরামর্শে ওঝা দিয়ে ঝাড়ানো, ঝাড়ফুঁক সবই করা হল। এক দেড়মাস পর্যন্ত নতুন আর কোনও ঘটনা ঘটল না। তারক মন্ডলের দুশ্চিন্তা খানিক কমতে লাগল। কিন্তু একদিন খাবার দিতে গিয়ে শিকল খুলে সে যেই না মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে গেছে, মেয়ে বাবার কব্জি ধরে এমন মুচড়ে দিল যে তারক মন্ডলের ডান হাতের রিস্ট ভেঙে দুটুকরো হয়ে গেল।”

“স্কিৎজোফ্রেনিয়া?” সব্যকে জিজ্ঞাসা করলাম।

“হ্যাঁ, অন্তত সব লক্ষণ ক্যাটানোটিক স্কিৎজোফ্রেনিয়ার দিকে নির্দেশ করছিল।

আমি আর থাকতে পারলাম না, বলে উঠলাম, “আপনার মেয়েকে ডাক্তার দেখানোর দরকার, ওর মনের অসুখ হয়েছে, ডাক্তার দেখালে সেরে যাবে। আমাদের ডাক্তারি ভাষায় একে স্কিৎজোফ্রেনিয়া বলে, রোগী যখন তখন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতে পারে। শুধু আপনি কেন সবার জন্যই ও বিপদজনক তখন।

তারক মন্ডল করুণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনে আমার মাইয়ারে তহন দেহেন নাই ডাক্তার বাবু, ওই রোগা পটকা মেয়ের গায়ে অত জোর… অ্যামনি করে আমার হাত মটকাল যেন হাত নয়, দুখান কঞ্চির কাঠি। এ আমনে জানি, এই মাইয়ার উপরে আমার বৌ ভর কইরে আচে, এত তাবিজ কবজ মাদুলি ওঝা গুণীণ কল্লাম, কেউ তো ছাড়াইতে পারল না… অনেক আশায় পীরসায়েবের লগে এয়েছি, যদি দয়া কইরে মাইয়াটারে বাঁচায়ে দ্যান।”

পীর সুলেমান মন দিয়ে তারক মন্ডলের কথা শুনছিল। আমার আলটপকা মন্তব্যে সে একবার আমার দিকে তাকাল বটে,কিন্তু সে দৃষ্টিতে শুধুই তাচ্ছিল্য।

সুলেমান তারক মন্ডলকে জিজ্ঞাসা করল, “ঠিক কইরে ভাবেন কত্তা… কার লগে চিকিচ্ছা কইরাবেন! দেহেন, নতুন ডাক্তারবাবু যদি কিছু ভালা কইরতে পারেন, মন্দ কী!” সুলেমান আমায় ওপেন চ্যালেঞ্জ দিচ্ছিল, আর সেই চ্যালেঞ্জ নেওয়ার আগেই আমি হেরে বসেছিলাম।

তারক মন্ডল এবার সুলেমানের পায়ে গিয়ে পড়ল। আমার নির্বাক দর্শক হওয়া ছাড়া কোনও উপায় রইল না। তারক মন্ডলকে ঘরের বাইরে যেতে বলে সুলেমান বলল, ঘরের ভেতর থেকে যা শব্দই পাক না কেন, ঘরের মধ্যে আসা যাবে না, কোনওক্রমে ভুল করে ঢুকলে মেয়েকে আর জীবিত নাও পেতে পারে। দরজাটা ঠকাস করে বন্ধ করে ও ছিটকানি তুলে দিল।”

এত অবধি বলে সব্যসাচী দম নিল। বাইরে বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হয়ে গেছে, কারেন্ট চলে গেছে ঘন্টাখানেক হবে, চায়ের জল বসিয়ে কেরোসিনের লম্ফ জ্বালিয়ে আনলাম। কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী কাচের চিমনির উপর দিয়ে পাকিয়ে পাকিয়ে উঠতে লাগল, আর সব্যও পীর সুলেমানের এই অদ্ভুত গল্পটা বলে যেতে লাগল।

“দরজা বন্ধ করতেই সুলেমান অন্ধকারের মধ্যে কোথায় যেন ভ্যানিশ হয়ে গেল। এদিক ওদিক তাকিয়ে কোথায় গেল ভাবছি, হঠাৎ কোথাও থেকে একটা সুরেলা বাজনার শব্দ কোথা থেকে কানে আসতে লাগল। ঘরটা হঠাৎ করে ভয়ানক পচা একটা দুর্গন্ধে ভরে গেল। এতই উৎকট সে গন্ধ, মিনিটের মধ্যে পেট গুলিয়ে বমি আসবে। সহ্য করতে না পেরে ঘর থেকে বেরিয়ে আসব, তখনই সুলেমানকে দেখতে পেলাম।

আগেই বলেছিলাম, ঘরের মাঝখানে একখানা বাল্ব বাদে আলোর আর কোনও সোর্স ছিল না। ঘন অন্ধকার যেন একটা দেওয়াল তুলে দিয়েছিল চারধারে, সেই আলো আঁধারির মধ্যে থেকে সুলেমান বেরিয়ে এল একটা অদ্ভুতদর্শন যন্ত্র হাতে নিয়ে।”

“কী রকম?”

“যন্ত্রটা ছোট, আধ ফুটেক হবে। দূর থেকে যা বুঝলাম, একটা ছোট গোলচে পাটাতনের ঠিক মধ্যিখানে একটা মোটা রডের মত লাগানো আর রডটাকে ঘিরে বেশ কটা তার লাগানো পাটাতনটায়। সুলেমানের সারা শরীর ঘামে ভিজে গিয়েছিল, খুব জোরে জোরে তারগুলো ধরে টানছিল ও, মুখ থেকে বিড়বিড় করে মন্ত্র বলছিল আর সেই যন্ত্রটা থেকে অদ্ভুত সুর বেরোচ্ছিল। আমার কোনও পরিচিত সুরের সাথে সেই সুরের মিল নেই। বাদ্যযন্ত্রের একটানা তীক্ষ্ণ সুরের সাথে যদি কেউ অনেকগুলো গলার গোঙানিকে মিশিয়ে দেয় তবে হয়তো খানিকটা ব্যাখ্যা করা যাবে। তারক মন্ডলের মেয়ে চেয়ারে বসে ঝিমোচ্ছিল। সুলেমান চিবুক ধরে মুখটা উপরের দিকে তুলতেই চোখ খুলে সে সুলেমানের দিকে তাকাল, দু’ চারবার মণি এদিক ওদিক ঘুরল। সুলেমান কিন্তু চোখ সরালো না, আস্তে আস্তে মেয়েটার চোখের দৃষ্টি পালটাতে লাগল। বিশ্বাস কর রুদ্র, আমি কোনওদিন কারুর চোখে এত আতঙ্ক ফুটে উঠতে দেখিনি। মেয়েটা ছটফট করছিল… যেন কেউ ওকে শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছে, ওর হাত পা ভায়োলেন্টলি নাড়িয়ে ও যেন সেই বাঁধন থেকে বেরোনোর চেষ্টা করছিল, কিন্তু পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম ওর মস্তিষ্কের উপর ওর নিয়ন্ত্রণ আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে। হাজার চেষ্টা করেও মেয়েটি সুলেমানের চোখ থেকে চোখ সরাতে পারল না। তারপর পাঁচ সাত সেকেন্ড হবে সব নিশ্চুপ, মণির কোনও মুভমেন্ট নেই, মেয়েটার চোখের পলক আবার পড়ে গেল, মনে হল, আবার সে ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেছে।”

“দাঁড়া, দাঁড়া। এ তো ক্লিয়ার কেস অফ হিপনোসিস… সম্মোহনবিদ্যা। দ্যাট ম্যান, পীর সুলেমান ইস এ ট্রেইনড হিপনোটিস্ট। আর ওই যন্ত্রটা ও হিপনোসিসের জন্য ব্যবহার করে।”

“ঠিক, আমিও ঠিক তাই ভেবেছিলাম। তুই তো জানিস, অল্টারনেট মেডিসিনের শাখায় বহু আগে চিকিৎসকরা হিপনোটিজম প্র্যাকটিস করতেন… এই নিয়ে আমরা কিছু পড়াশুনাও করেছিলাম হোস্টেলে। কিন্তু, রুদ্র, হিপনোটিজমের কিছু লিমিটেশন থাকে জানিস তো। মানে হিপনোটিজমে আমরা শুধু কিছু ইলিউশন মানে দৃষ্টিবিভ্রম সৃষ্টি করতে পারি, কিন্তু ফিজিক্যালি সেই বিভ্রমের কোনও ছাপ, কোনও প্রমাণ রেখে যেতে পারি কি?”

“না, তাহলে আর সেটা বিভ্রম কীভাবে হবে? যা বিভ্রম নয়, তাই সত্যি… পুরোপুরি ইদার অর অপশন। দুটো একসঙ্গে থাকতে পারে না।”

“তারক মন্ডলের মেয়ের সঙ্গে তারপর যেটা হতে দেখলাম সেটা আর হিপনোটিজমের মধ্যে সীমাবদ্ধ রইল না রে।”

“কী দেখলি?”

“পীর সুলেমান মেয়েটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল… প্রচণ্ড গতিতে ও যন্ত্রটার তারগুলোকে টানছিল… শব্দটা প্রবল হচ্ছিল… একটানা। মেয়েটার পাশে গিয়ে সুলেমান ডাক দিল— ‘চোখ খুলো’ … একবার, দুবার, তিনবার… মেয়েটা হঠাৎ যেন ঘুম থেকে উঠে চোখ চাইল। যা দেখেছিলাম, একটুও বানিয়ে বলছি না। মেয়েটাকে দেখলাম স্থির, নিষ্পন্দ, চোখ খোলা, অথচ মণির কোনও মুভমেন্ট নেই। যেন কোনও মরা মানুষকে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে।”

“তারপর?”

“সুলেমান এরপর হাতে একটা সাদা লোমের চামর তুলে নিয়ে মেয়েটার গায়ে, হাতে পায়ে বোলাতে লাগল। মেয়েটা ওইরকম অবস্থাতেই কঁকিয়ে উঠল বারবার। পরিষ্কার দেখলাম, মেয়েটার সারা গায়ে নীলচে কালশিটে দাগ পড়ে যাচ্ছে। মেয়েটা প্রচণ্ড চিৎকার করছিল, আমি এগিয়ে গিয়ে সুলেমানকে থামাব ভাবলাম কিন্তু পারলাম না। কে যেন শক্ত করে আমার হাত পিছুমোড়া করে ধরে রাখল, একপাও এগোতে পারলাম না। সে যে কে, পিছনে তাকিয়ে দেখতে পেলাম না। অথচ তার সাঁড়াশির মত হাতের চাপে আমার কব্জি ব্যথা করতে লাগল।”

মিনিট পাঁচ সাত হবে, সুলেমান চামর নামিয়ে রাখল মাটিতে। দরজা খুলতেই হুড়মুড়িয়ে তারক ভেতরে ঢুকে এল, ওর দিকে তাকিয়ে সুলেমান বলল, “তোমার মাইয়া এহন কদিন নড়ন চড়ন করবেনি, খাতি দিবা, হাঁ করাইয়া মুখে খাবার ঢালবা, বলবা ‘গেলো’, মাইয়া গিইল্যা নিবে। এরে আমি ঘুম পাড়াইয়া রাখলাম, তোমার বিবিজান আসি এরে জ্বালাইতে পারবেনি। একমাস এরম থাহনের পর আমার লগে ফের আইস, পরিস্থিতি বিচার করে তহন দেখব কী করা যায়! ভয় নাই, মাইয়ার আর তোমাদের ক্ষেতি করার ক্ষ্যামতা নাই, ও ক্ষ্যামতা আমি নষ্ট কইরা ফ্যালাইছি।”

চোখে ভয়ানক আতঙ্কের ছাপ নিয়ে তারক মন্ডলের মেয়ে চলে গেল। চলৎশক্তিহীন মেয়েকে বাপে পাঁজকোলা করে নিয়ে গেল। সারা জীবন যা পড়াশুনা করেছিলাম, সব কেমন যেন মাথার ভিতরে জট পাকাতে লাগল। তারকরা বিদায় নেওয়ার পর পরই সেই অদৃশ্য হাতের বন্ধন থেকে আমার কব্জিদুটো মুক্ত হল। সিলিং থেকে ঝোলানো বাল্বটার তলায় চেয়ারের উপর বসে সুলেমান একটা বিড়ি ধরালো, এক নিঃশ্বাসে বিড়ির খানিক ধোঁয়া টেনে চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে লাগল, “টিরিটমেন্ট দ্যাখলেন ডাগদারসাব? ওষুধ নাই, কাটাছেঁড়া নাই… অথচ কেমন অসুখ ঠিক হল? শিখবেন নাকি নতুনধারার টিরিটমেন্ট আমার লগে?”

সুলেমান অট্টহাস্যে ফেটে পড়ল। বাইরে বেরিয়ে দুমাইল লম্বা উৎসুক রুগীর ভিড় ঠেলে হসপিটালের দিকে পা বাড়ালাম আমি… অত ক্লান্ত অবসন্ন বোধহয় কোনওদিন লাগেনি এর আগে।”

“তারপর?”

“তারপর কীসের ঝোঁকে যে গত আড়াই বছরে বারবার লোকটার কাছে দৌড়ে গেছি… হিপনোটিজমের বই কিনে পড়াশুনা করেছি, লোকটার জালিয়াতি ধরব বলে মনে মনে পণ করেছি… কিন্তু বিশ্বাস কর রুদ্র এটা ঠিক হিপনোটিজম নয়… শেষ যেদিন ওর কাছে গেলাম…”

“হ্যাঁ, কী হল সেদিন?”

সব্যসাচী চুপ করে গেল। দেখলাম ওর চোখ আমার পিছনের দেওয়ালে আটকে আছে। পেছন ফিরে দেখলাম, ফাঁকা দেওয়াল, কোথাও কিছু নাই। সব্য দেখলাম ঘামছে, আঙুলগুলো থর থর করে কাঁপছে। তড়বড় করে চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়িয়ে সব্যসাচী বলে উঠল, “না আমায় উঠতে হবে বুঝলি! পরে কথা হবে… চলি রে রুদ্র।”

সব্যসাচী প্রায় ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে দরজার দিকে এগোল, খিড়কীর দরজা প্রায় ঠেলে খুলে ঝড়ের গতিতে ও বেরিয়ে গেল।

খিড়কীর দরজার পাল্লাটা হাওয়ায় দুলে দুলে সব্যর ধাক্কিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার প্রতিবাদ করতে লাগল। আমি হতভম্ব হয়ে ওখানে দাঁড়িয়ে আছি, ঠিক সেই সময় সামনের গেটের দিক থেকে রঘুবীরের ডাকাডাকির আওয়াজ পেলাম। দেশ থেকে ফেরার কথা ছিল আজ। সেদিন রাতে বাসন ধুতে গিয়ে দুটো চায়ের কাপ দেখে রঘুবীর আমাকে জিজ্ঞাসা করল, “স্যার, কেউ এসেছিলেন নাকি!”

আমার কোয়ার্টারে কেউ সেরকম আসত যেত না, ওর কৌতূহল স্বাভাবিক। অন্যমনস্কভাবে উত্তর দিলাম, “হ্যাঁ, ওই আমার বন্ধু তুফানগঞ্জ মেন্টাল হাসপাতালের ডাক্তারবাবু।”

“তুফানগঞ্জের ডাক্তারবাবু! কী নাম স্যার?”

“ডাঃ সব্যসাচী দাশগুপ্ত।”

“উনি এখানে!”

অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “তুমি চেনো ওকে?”

“চিনব না কেন স্যার? উনি তো আমাদের পাগলা ডাক্তার, কিন্তু ওনারে তো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না, সেই যে সেপ্টেম্বর মাসে ওনাকে ছাছপেন্ড করেছে, তার পর থেকে তো তুফানগঞ্জে ওনারে কেউ দেখে নাই।”

“সাসপেন্ড! বল কী?”

“হ্যাঁ, আপনি জানেন না?”

“না! সাসপেন্ড কেন হয়েছিল?”

“পাগল ডাক্তার স্যার, মাথা খারাপ! পাগলের টিরিটমেন্ট করবে কী, পেছেন্ট ভেবে হাসপাতালের করিডরে পড়ে থাকা একটা কুকুরকে বেডে শুইয়ে ইনজেকশন লাগাচ্ছিলেন, প্রেছক্রিপশন লিখতে লিখতে ভুলভাল বকতেন। মাঝখানে একদিন ছুরি নিয়ে নিজেই নিজের গলা কাটতে যাচ্ছিলেন… হাসপাতালের লোক দেখতে পেয়ে থামায়। প্রচুর কমপেলেন এল ওনার নামে, ছুপারসায়েব ওপরতলায় চিঠি লিখে ছাছপেন্ড করে দিলেন।”

মনটা হঠাৎ ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। আমার কলেজের বন্ধুরা সব্যকে পাগলা বলত, খাপছাড়া বলত, কিন্তু আমি মনে মনে বিশ্বাস করতাম, আজও করি যে ডাক্তার সব্যসাচী দাশগুপ্ত একলাষেঁড়ে, গোঁয়ার হতে পারে কিন্তু পাগল সে নয়। জগতে কিছু মানুষের মনের দরজা সবার জন্য হাট খোলা থাকে না। এদের জন্যই সাইকলজিতে লোনার বলে একটি প্রতিশব্দ আছে… কিন্তু সেপ্টেম্বর মানে পাঁচ মাস, এখন ফেব্রুয়ারি! এই দীর্ঘ পাঁচ মাস সময় সব্য তাহলে কোথায় কাটাল? কলকাতায় তো যায়নি বলল! কোন মাঠে ঘাটে নিজের পয়েন্ট লোককে বোঝানোর জন্য পাগলের মত ঘুরে বেরিয়েছে? মনে মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মালো, পীর সুলেমান অত্যন্ত উচ্চমানের হিপনোটিস্ট, আর তার সম্মোহনের সামনে সব্যসাচী অসহায়ের মত আত্মসমর্পণ করেছে। কিন্তু সাসপেন্ডের ব্যাপারটা কী ঠিক বোঝা গেল না! ঠিক করলাম ছুটি দেখে তুফানগঞ্জে যাব। সব্যকে খুঁজে বার করে ওকে প্রকৃতিস্থ করতে হবে, কিন্তু তার দরকার পড়ল না।

*****

ধুপগুড়ির গ্রামীণ হাসপাতালের আউটডোরটা খুবই ছোট। এক কোণে ডাক্তারের টেবিল পাতলে ঘরে একসাথে দশ জনের বেশি দাঁড়াতে পারে না। বাইরে প্রকাণ্ড লাইন পড়ে। আজ শুক্রবার, কাল দোল। রুগীর ভিড় একটু কম। বিড়ি খেয়ে খেয়ে ঝাঁঝরা এক পেশেন্টের বুক পরীক্ষা করছিলাম। এটাই আজকের শেষ পেশেন্ট। প্রেসক্রিপশন লিখতে গিয়ে হঠাৎ পিলারের কোণটায় চোখ পড়ল। পিলারটাকে আঁকড়ে আমার দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে আছে সব্য, আমাকে তাকাতে দেখে পিলারের পাশ থেকে বেরিয়ে রুমের বাইরে চলে গেল।

সামনের পেশেন্ট তখন কাশতে কাশতে ধনুকের মত বেঁকে গেছে। তাকে দেখা শেষ হলে টেবিল থেকে উঠে সব্যর খোঁজে যাচ্ছি, হঠাৎ দেখি ও ঢুকছে। আমার কাছে এগিয়ে এসে আমার টেবিলে রাখা স্টেথোস্কোপ হাতে তুলে নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে একটা অদ্ভুত আবদার করে বসল— “একদিন দেখতে দিবি তোর পেশেন্টদের?”

অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, “এ কেমন কথা বলছিস? জানিসই তো সেটা হয় না। তাছাড়া এটা তো তোর ফিল্ডই নয়!”

সব্য মাথা নীচু করে মাথা নাড়াল। “আসলে অনেকদিন কোনও পেশেন্টই দেখি না তো! সব ভুলে যাচ্ছি!”

“তুই আগে বলিসনি তো তুই সাসপেন্ডেড? আমার কাজের লোক বলল।”

একটা চেয়ার টেনে তাতে ধপ করে বসে সব্যসাচী ওর উস্কোখুস্কো চুলগুলোকে হাতের আঙুলের মধ্যে নিয়ে পেছন দিকে টানল। আমার প্রশ্নের কোনও উত্তর দিল না। আমি আবার ডাকলাম, “সব্য!”

“তুই কোনওদিন ইচ্ছা করে মানুষ মেরেছিস?”

“মানে?”

“মানে, ধর কেউ মরে বেঁচে আছে, তাকে জীবন থেকে নিষ্কৃতি দিয়েছিস?”

“ইউথ্যানাশিয়া? সে তো হালে লিগাল হল…”

“আমার এক পেশেন্ট ছিল, মতিউফ, ভালো ফুটবল খেলত। বছর কুড়ি বয়স হবে, যখন ওর দাদা বৌদি আমার কাছে নিয়ে এল তখন স্টেট টিমে চান্স না পেয়ে অ্যাকিউট ডিপ্রেশনের পেশেন্ট। একদিন হাসপাতালের টয়লেটে গলায় গামছা দিয়ে সুইসাইডের চেষ্টা করল। টের পেয়ে যখন সবাই বার করল তখন ব্রেনে অক্সিজেন সাপ্লাই ডিলেড হয়ে অ্যানক্সিয়া সেট ইন করেছে। জেনারেল ফিজিশিয়াল দেখলেন। খুব চেষ্টা করলাম, কিন্তু হেমিপ্লেজিয়া হয়ে গেল। কথা বলারও ক্ষমতা নেই। হাত পা নাড়ানো দূরের কথা। তুফানগঞ্জের হাসপাতালে আমার প্রথম জটিল কেস।

হাসপাতালেই রেখেছিলাম, একমাস। নিয়ম করে দুবেলা দেখতে যেতাম। মুখটা খুব মিষ্টি, চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকতে দেখে মনে হত এই হেসে উঠবে। নিজের পয়সায় অ্যাম্বুলেন্সে করে আলিপুরদুয়ার নিয়ে এসে সিটি স্ক্যান করালাম, লাম্বার পাংচার করে ইনফেকশন হয়েছে কিনা দেখলাম। কোনওটাতেই কোনও পজিটিভ রেজাল্ট এল না। এক মাসের উপর বেড অক্যুপ্যান্সি দেখে সুপারভাইজার উপরতলায় লিখে জানাল, মানসিক হাসপাতালে এরকম পেশেন্ট রাখার নিয়ম নেই, উপর থেকে চিঠিতে বলল হয় ছুটি দিয়ে দাও, নাহলে অন্য কোথাও রেফার কর। আমিও বাধ্য হলাম ওকে ছেড়ে দিতে। তার প্রায় দুতিন মাস পর, নিজের কোয়ার্টারে রাতে বসে আছি, হঠাৎ আনিসুর এল—”

“আনিসুর, মানে সেই লোকটা?”

“হ্যাঁ, সেই লম্বাটে ক্ষয়াটে চেহারা। চোখের দৃষ্টি পাথরের মত।”

“কী বলল এসে?”

“আমার কোয়ার্টারের দরজাটা কোলাপসিবল দেওয়া, বেলের আওয়াজ শুনে বেরিয়ে দেখি বাইরে দাঁড়িয়ে ও।

আমাকে দেখে বলল, “স্যার নেমতন্ন আছে… যাবেন নাকি?” ওর কথায় উত্তর না দিয়ে ঘরে ঢুকে যাচ্ছি, বলে উঠল, “স্যার, শুনবেন তো, আপনার সেই কেস… মতিউফ। ভাইয়া ভাবী মিলে মেরে ফেলতে চলেছে, একবার দেখতে যাবেন নাকি জনাজা বেরোনোর আগে?”

খবরটা শুনে এত শকড হয়ে গেলাম যে কোলাপসিবলের ফাঁক দিয়ে হাত বাড়িয়ে আনিসুরের কলার ধরে ফেললাম, কিন্তু বললে বিশ্বাস করবি না রুদ্র লোকটার গায়ে কী আসুরিক শক্তি! সাঁড়াশির মত আঙুলগুলো দিয়ে একপলকে আমার হাত ছাড়িয়ে বলে উঠল, “চলুন স্যার… পীর সুলেমান ডেকেছেন আপনারে।”

নামটা মাথার মধ্যে একসাথে এতটা বিতৃষ্ণা, ঘেন্না, রাগের স্মৃতি চাগিয়ে তুলল যে সেই রাতে আনিসুরের সাথে কাজীপাড়া রওনা দিলাম। পৌঁছালাম যখন, তখন রাত প্রায় একটা। সুলেমানের ঘরের ভেজানো দরজার ফাঁক দিয়ে হাল্কা আলোর রেখা দেখা যাচ্ছিল। ঘরে সেই একটাই বাল্ব জ্বলছে। আনিসুর আমার সাথে ঢুকে কোথায় যে অন্ধকারে হারিয়ে গেল, বুঝতে পারলাম না। বাল্বের আলোতে দেখি, মেঝেতে একটা মাদুরে মতিউফের বডি শোওয়ানো, ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম খুব ধীরে ধীরে শ্বাস চলছে। হঠাৎ অন্ধকারের মধ্য থেকে সুলেমানের আওয়াজ ভেসে এল, “কী দ্যাখতাছেন ডাগদারসাব? আপনের হাসপাতালে তো কিসুই কইরতে পারে নাই… খালি ইদিক উদিক রিফার কইরাই কাম সারে… গরীব মানষে আর কী করে… জানমাল ফ্যালাইয়া কয়দিন মরা রোগীর সেবা কইরবে আর ইদিক উদিক দৌড়াইবে? উ তো মইরাই গেছে গে, উয়ার বাড়ির লোকেও এহন চায় না ও বাঁচে, আমার থানে দিয়া গেসে একটা গতি করনের লগে… তায় আমি ভাবতাছিলাম আপনে এত ভালোবাসেন উয়ারে… শেষ বেলাটা দ্যাখবেন না? তাই আনিসুরকে কইলাম…”

“কী গতি করবে ওর? ওর বয়স কুড়ি, হান্ড্রেড পার্সেন্ট না হলেও আংশিক রিকভারির চান্স আছে ওর।” আমি বলে উঠলাম।

অন্ধকার ফালা ফালা করে সুলেমানের হাসির শব্দ ভেসে এল… আর তারপর একদলা অন্ধকার গায়ে মেখে ঝুপ করে আমার সামনে এসে দাঁড়াল ও। বাল্বের আলোর নীচে ওর মুখটা বীভৎস লাগছিল, মুখের অসংখ্য বলিরেখার মধ্যে ভীষণ নিষ্ঠুর একটা মানুষের মুখ দেখতে পেলাম।

“বিহানাতেই হাগে মোতে, বিহানাতেই খায়, এমনে জিন্দগীর থিকা উয়ার মরণ ভালো ডাগদারবাবু… কী কন আপনে?”

“তুমি মারবে ওকে? মানে খুন করবে?”

সুলেমানের গলাটা হিসহিস করে উঠল। শক্ত শক্ত আঙুলগুলোর মধ্যে আমার হাতটাকে জোর করে ধরে বলতে লাগল, “খুন তো অনেকই কইরতে পারি ডাগদারবাবু, কিন্তু এমনি এমনি খুনে মজা নাই। আমার হয়ে কাজ আমার শাগরিদরাই করে দেয়… আজ দেহেন না আরেকখান শাগরিদ বাড়বে। সে মজা দেহনের লগেই তো আপনারে ডাইকা আনসি। আপনের মত মানষরে নিজের বিদ্যা দেইখে ভারি সুখ!”

চোখের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটা খুন হতে দেখলাম, রুদ্র, কিন্তু কিস্যু করতে পারলাম না। সেদিনের মত আবার সেই যন্ত্রটা বেজে উঠল। অন্ধকারের ভেতর থেকে দলা দলা কুণ্ডলীর মত, প্রেত শরীরের মত আকারহীন কারা যেন বেরিয়ে মতিউফের শরীরের চারপাশে ভিড় করতে লাগল। ওর শরীরটা নিষ্পন্দ পড়ে ছিল, হঠাৎ মনে হল অদৃশ্য কেউ ওর মাথাটাকে ধরে ঘোরাচ্ছে। মাথাটা বাঁ থেকে ডানে রোটেট করতে শুরু করল, আমি ছুটে গিয়ে আটকানোর চেষ্টা করতেই কে যেন আমাকে হাওয়ায় তুলে আছাড় মেরে মাটিতে ফেলে দিল।

সুলেমান জোরে জোরে মন্ত্র পড়ছিল,

“ইজ কলা রহুলব্বুহু আসলিম, কলা আস্লামতু লি রব্বিল আলামিন।”

মতিউফের মাথাটা একশ আশি ডিগ্রী ঘুরে গিয়ে খট করে একটা শব্দ হল… মাটিতে শুয়ে প্রচণ্ড ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে বুঝতে পারলাম সব শেষ।

যন্ত্রটা হাতে নিয়ে সুলেমান আমার দিকে পায়ে পায়ে এগিয়ে এল। আমি মাটিতেই আধশোয়া অবস্থায় কাতরাচ্ছিলাম, হাঁটু মুড়ে আমার পাশে বসে সুলেমান ফিসফিস করে প্রায় আমার কানে কানে বলল, “অত জোরে জোরে কাঁদেন ক্যান ডাগদার? আমার শাগরিদদের বেশি শব্দ পছন্দ নয়, দেহেন নাই ক্যামনে নিস্তব্ধে কাম সারে? এই যন্তর দেখতাসেন আমার হাতে, এক এই যন্তরের সুরই পসন্দ উয়াদের। এক এক তারে আমি বাঁইধা রাখসি উয়াদের, বাজাইলেই হাজির হয়। আপনের মতিউফ, সেও শাগরিদ হইল আইজ থেকে আমার। দুঃখ পান ক্যান? আপনাগো ধর্মেই না কয় শরীলের মিরিত্যু হয়, আত্মার নয়।”

“কী যা তা বলছ সুলেমান?”

“যা তা কই কইতাসি কত্তা! চোখের সামনে অ্যামন জলজ্যান্ত পোমাণ পাইলেন, তাও আপনাদের বিশ্বেস হয় না! আচ্চা আর কী করন যাবে, আরেকবার দেহেন তাহলে!”

সুলেমান যন্ত্রটা হাতে নিয়ে বাজাতে শুরু করল, আর বিড় বিড় করে কীসব যেন বলতে লাগল। ওই মাটিতে পড়ে থাকা অবস্থাতেই আমার বাঁহাত উপরের দিকে উঠে গেল, মনে হল কে যেন হাতটাকে জোর করে তুলে দিচ্ছে। তারপর এলবো জয়েন্টের উল্টো দিকে হাতটা মুড়তে শুরু করল… প্রচণ্ড ব্যথায় আমি চিৎকার করে উঠলাম। সুলেমান হেসে মুখ দিয়ে চুকচুক শব্দ করতে করতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমাদের ডাগদার তো বড় নাজুক দেখতাসি… ব্যথা দিলে বড় কাঁদে, ছাইড়া দিই আপনেরে?”

সুলেমান যন্ত্রটা বাজানো বন্ধ করল, আমার হাতটা উঁচু থেকে ধপ করে নীচে পড়ে গেল। অসম্ভব যন্ত্রণা হচ্ছিল, জয়েন্টের জায়গাটা হাত দিয়ে চেপে আমি উঠে দাঁড়ালাম।

সুলেমান আমার কাঁধদুটো শক্ত করে ধরে বলল, “বিশ্বেস হইল ডাগদারবাবু? আমি চাইলে এহনই আপনারে জাহান্নামে পাঠাইতে পারতুম… কিন্তু আপনে বাঁইচা থাহেন। ভারি রগড় হইবে, এত কামের পর মাজে মাজে রগড় হইলে মন্দ কী? কী কন? ডাগদারবাবু!”

সুলেমানের একটানা হো হো হাসির শব্দ পিছনে ফেলে সে রাতে ওর ঘর থেকে আমি পালিয়ে বেরিয়ে এলাম রুদ্র। পেছন থেকে শুনতে পেলাম সুলেমানের গলা… “একদিন আপনে নিজেই আসবেন ডাগদারবাবু, আমার পা ধইরে চোকের জল ফেইলবেন, কইবেন, “সুলেমান আমায় মাইরা ফ্যাল।” আল্লাহ কসম, সেদিন আপনারে ফিরামু না।”

তারপর থেকে… মাঝে মাঝেই মাথাটা… মা বাবাকে কিছু বলতে পারি না, কষ্ট পাবে ওরা! কী ভেবে আমায় ডাক্তারি পড়াল আর আমি কী সব… আমি জানি কাউকে বললে আমার এ কথা কেউ বিশ্বাস করবে না, তুই ছাড়া!”

“তুই সাসপেন্ড হলি কীভাবে?”

“ভূত পিশাচ মন্ত্র তন্ত্রের একটা আলাদা জগৎ আছে, একটা গভীর বিশ্বাসের জগৎ। তোর মত মানুষেরা সেই জগতের হদিশ পাসনি, আমিও পেতে চাইনি… শুধু জোর করে আমাকে এই অস্বাভাবিক জগতে ঠেলে দেওয়া হল। কীসের জন্য আমি এই শাস্তি পেলাম বলতে পারিস রুদ্র? যখন সেন্সে থাকি তখন মনে হয় আমার বুদ্ধিবৃত্তি, আমার বিশ্বাস সব ছাপিয়ে কাউকে এভাবে জিততে দেব না। তারপর ধীরে ধীরে সে যখন আমায় কনট্রোল করতে শুরু করে তখন…”

“কনট্রোল! তোর চিকিৎসার দরকার সব্যসাচী!”

সব্য আমার কথা যেন শুনতেই পেল না। “ছয় মাস রুদ্র, ছয় মাস ধরে আমি পালিয়ে বেড়াচ্ছি। হাসপাতালে একদিন ডিউটি দিচ্ছি, মেল ওয়ার্ডটায় জনা দুয়েক পেশেন্ট ভর্তি। দুজনকে দেখে বেরোব, হঠাৎ ওয়ার্ডের বাইরে দরজাটার দিকে চোখ আটকে গেল। এক ঝলক যেন আনিসুরকে দেখলাম, হাতে সেই বিশ্রী দেখতে বাজনাটা। একবার দেখা দিয়েই আনিসুর হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল আর বললে বিশ্বাস করবি না সেই শব্দটা, সেই অদ্ভুত যন্ত্রের শব্দটা আমার কানের কাছে বাজতে লাগল। যত সময় যেতে লাগল শব্দটা কানের মধ্যে তীব্র হয়ে বাজতে লাগল… বুঝতে পারছিলাম সারা শরীরের লোম উত্তেজনায় খাড়া হয়ে গেছে, হার্টবিট বেড়ে গেছে সাংঘাতিক। চারপাশে লোকের অস্তিত্ব দেখতে পাচ্ছি কিন্তু কিছু শুনতে পাচ্ছি না। শরীরের সব কটা মাসল প্রচণ্ড স্টিফ হয়ে গেল। এদিকে শব্দটা এত বেড়ে গেল যে মনে হল কালা হয়ে যাব! নিজে সাইকিয়াট্রি নিয়ে যা পড়াশুনা করেছিলাম বুঝতে পারছিলাম স্বপ্নের মত ঘোরের মধ্যে ঢুকছি…”

“তারপর?”

“স্বপ্নে তুই কী দেখবি তার উপর কি কোনও কনট্রোল থাকে? তেমনি ঘোরের মধ্যে তুই কী করবি যদি অন্য কেউ সেটা কনট্রোল করে?”

“তুই কী করলি?”

“ঘোরের মধ্যে আমি কী করেছি আমার মনে নেই। কতক্ষণ হবে জানি না, দেখি হসপিটাল সুপার আমার কাঁধ ধরে ঝাঁকাচ্ছেন। সেই ঝাঁকুনিতে যেন বহুকালের ঘুম থেকে উঠলাম। দেখি, বেডের ধারে দাঁড়িয়ে আছি, হাতে একটা ইনজেকশনের সিরিঞ্জ। বেডের দিকে তাকাতেই চমকে গেলাম ঘেন্নায়, দেখি একটা ঘেয়ো কুকুরকে কোথা থেকে তুলে এনে বেডে শুইয়ে রেখেছি। সুপার স্যার বিস্ময়ে আতঙ্কে ঘাবড়ে গিয়ে ঘামছিলেন, আমার ঘাড় ধরে ঝাঁকিয়ে বললেন, “কী করছ কী সব্যসাচী!”

ছয় সাত মাস ধরে ভীষণ নৃশংস খেলা শুরু হল, কখনও প্রেসক্রিপশন লিখতে গিয়ে বীভৎস মুখের ছবি আঁকছি, কাউন্সেলিং সেশনে পেশেন্টকে বলছি সুইসাইড করুন, কখনও চেকাপ করতে গিয়ে পেশেন্টকে ব্যথা দিয়ে ফেলছি। ওই অবস্থায় যারা আমাকে দেখেছে, বলেছে আমি নাকি সাক্ষাৎ শয়তানের প্রতিরূপে পাল্টে যাই, অথচ আমি যে মানুষের কোনও ক্ষতি করেছি, তাদের ভয় দেখিয়েছি… বিশ্বাস কর রুদ্র, এর কোনটাই নিজের আয়ত্তে থেকে করিনি। শুধু মনে পড়ে, প্রতিবার বাহ্য জ্ঞান হারানোর আগে বাজনাটা আমি শুনতে পেতাম। শেষ দিন যেদিন হাসপাতাল গেছি, আপেল কাটার ছুরি দিয়ে নিজের অফিসে বসে নিজেরই গলা কাটতে যাচ্ছিলাম। সুপারের ধৈর্যের বাধ ভাঙল, সাসপেন্ড হয়ে গেলাম।”

সব্যর মুখের দিকে তাকালাম। কথা বলতে বলতে কোয়ার্টারে পথে হাঁটা ধরেছিলাম আমরা। আজ রঘুবীরের ছুটি। সে দেশে গেছে। রাতে আজ আর সব্যসাচীকে যেতে দেব না। গেটটা খুলতে খুলতে ওকে প্রশ্ন করলাম, “তুই এতদিন করলি কী?”

সব্যসাচী ম্লান হাসল।

“বাঁচার চেষ্টা! অগুণতি বার সুলেমান আমায় মেরে ফেলতে চেয়েছে… স্বপ্নের মধ্যে, ঘুমের মধ্যে মৃত্যুর স্বপ্ন দেখেছি। একটা অদৃশ্য আওয়াজ ফিসফিস করে কানের কাছে বলেছে, “গলায় দড়ি দাও ডাগদার… একটা হ্যাঁচকা টান… কল্পনা করো তোমার শরীরডা সিলিং থেকে ঝুলতাসে, চোখের মণিদুটো ঠিকরে বাইর হইয়া আসতাসে… জিভ ঝুলতাসে… কী বীভৎস সুন্দর ডাগদার!” গলাটা কানের কাছে সমানে বেজেছে… “রক্তমাংসের শরীরটাকে মুক্তি দাও ডাক্তার… দেহটারে শ্যাষ কর…।”

হতাশার শেষ সীমায় দাঁড়িয়ে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলতে গেছি। একবার স্টেশনের কাছে চলে গিয়েছিলাম লাইনে গলা দেব বলে, কিন্তু একেবারে শেষ মুহূর্তে ফিরে আসতে পেরেছি। আমার কাছে জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে একটা সুতোর ফারাক । তাও সে সুতোয় টান মেরে সুলেমান কখন জিতে যাবে কে জানে! যুদ্ধ বুঝিস? মানসিক ভাবে যুদ্ধ করে করে ক্লান্ত আমি। ঠিকানা পাল্টেছি কিন্তু সুলেমান স্বপ্নে আমায় বার বার তাড়া করেছে। একবারও প্রত্যক্ষে নয়, দূর থেকে ও আমায় নাচিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। আমার একটা কথা রাখবি?”

“বল!”

“একবারের জন্য, শেষবারের জন্য আমি লোকটার মুখোমুখি হতে চাই। এইভাবে পালিয়ে বেড়াতে বেড়াতে আমি ক্লান্ত। আমার সঙ্গে যাবি? আমার মনের অবস্থা ঠিক নেই, তুই থাকলে ভরসা পাই।”

সব্যসাচীর মাথাটা যে ঠিক নেই সেটা আমি আন্দাজ করেছিলাম, হয়তো পীর সুলেমান একটা উপলক্ষ্য মাত্র। এতদিনে বন্ধুদের কথায় বিশ্বাস হল আমার, নিঃসঙ্গ নির্বান্ধব থাকতে থাকতে সব্যসাচী পাগল হয়ে গেছে, এত দিন ধরে খেপে খেপে যতটুকু আমায় বলেছে, বুঝতে পারছিলাম হ্যালুসিনেশানে ভুগছে ও। তাও মনের ভাব লুকিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “কবে যেতে চাস?”

“তোর উইকলি অফ কবে?”

“পরশু।”

“সেদিন রাতে বেরোব রুদ্র। তৈরী থাকিস।”

****

কাজীপাড়ার মুখটায় সব্যসাচীর জন্য ওয়েট করছিলাম আমি। রাত একটা বাজে, পুরো গ্রাম নিস্তব্ধ। ওর সঙ্গে আগে থেকেই কথা হয়েছিল, একাকী রাতের অন্ধকারে অসতর্কে ধরতে হবে সুলেমানকে। হাতের রেডিয়াম কোটেড ডায়াল মৃদু আলোতেও সঠিক সময় দেখাচ্ছিল, রাত একটা দশ। জায়গাটা এমনিতেই নির্জন, উঁচু উঁচু গাছের অন্তরালে অল্প কটা ঘর এদিক ওদিক ছড়ানো। লাইটপোস্টগুলোর ম্যাড়মেড়ে আলো ছাড়া পুরো গ্রামটায় কোনও আলো নিদেনপক্ষে কোনও মোমবাতি বা লন্ঠনও জ্বলছে না। মাঝে মধ্যে দূর থেকে একটা কুকুরের একটানা কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছিল। সামনের অন্ধকার ফুঁড়ে সব্যসাচীর চেহারাটা হঠাৎ উদয় হল। সেদিনের পর এই প্রথমবার দেখা হল। এত দূর থেকেও আজ ওকে দেখে মনে কোনও দ্বিধা রইল না, নিঃসংশয় হলাম যে সব্যসাচী অপ্রকৃতস্থ। ওর বিস্ফারিত চোখগুলো ভয়ে আতঙ্কে যেন ঠেলে বেরিয়ে আসছে। গলার কন্ঠার হাড় দেখা যাচ্ছে, হাঁটাচলা অসংলগ্ন। আমাকে নিজেই এখানে দাঁড়াতে বলেছিল ও, অথচ এখন এমন ভাবে তাকাল যেন আমায় না, আমার শরীর ভেদ করে কোনও দূর অনাগত বিপদকে চোখের সামনে দেখছে। বুকের শার্টের বোতামগুলো এলোমেলো করে লাগানো, উস্কোখুস্কো চুল, মাঝে মাঝেই মুঠো করা হাত খোলাবন্ধ করা… সব্যসাচী নার্ভাস ব্রেকডাউনের দোর গোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। ফিয়ার সাইকোসিস, এই স্টেজে এমন হয়! বুঝতে পারছিলাম, প্রবল শক্তিশালী অসম একটা শক্তির সঙ্গে লড়তে যাচ্ছি। ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, “কতক্ষণ লাগবে সব্য এখান থেকে?” শূন্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে কী যেন বলার চেষ্টা করল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত মাথা নীচু করে ফেলল। ঠোঁট চেটে আমার দিকে তাকিয়ে সোজা হাঁটা শুরু করল। পেছন থেকে ডাকলাম, “সব্য… দাঁড়া… তুই একা এগোচ্ছিস কেন? আমি আসছি।” আমার ডাক শুনেও পিছন ঘুরে একবারের জন্য ও তাকাল না। মাথা নীচু করে হেঁটে যাওয়া বিধ্বস্ত আমার বন্ধুকে দেখে মনটা হু হু করে উঠল। শেষমেষ কি ও নিজেকে সুলেমানের হাতে সঁপে দেবে বলে ঠিক করেছে!

সব্যসাচীর হাতে একটা টর্চ জ্বলে উঠল। টর্চের আলোর বৃত্তের বাইরে চাপ চাপ অন্ধকার আরও যেন ঘিরে ধরছিল আমাদের। দূরে আবার সেই কুকুরটা ডেকে উঠল। আমি সব্যর পিছন পিছন নিঃশব্দে হাঁটা শুরু করলাম সুলেমানের বাড়ির দিকে। যতবারই ওর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করি, ও কোনও উত্তর করে না। শুধু এঁকে-বেঁকে, কখনও ডাইনে কখনও বাঁয়ে অসংলগ্ন ভঙ্গিতে ও হেঁটে চলেছে। কোনওদিকে কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। যেন সুলেমানের বাড়িতে তার মুখোমুখি হওয়ার জন্য সে তার গোটা জীবনটাকে পিছনে ফেলে এগিয়ে চলেছে। ওর সাথে সাথে আমারও গতিবেগ বেড়েছে। যতই সব্যর সহায় হওয়ার চেষ্টা করি না কেন, আমার নিজের নার্ভও উত্তেজনার শেষ সীমায় দাঁড়িয়ে আছে। নিজেই বুঝতে পারছি, শরীরের প্যারামিটারগুলো আগের মত নর্মাল নেই আর। আমার মা গীতার একটা শ্লোক খুব আওড়ায়, “যদা সংহরতে চায়ং কূর্ম্মোহঙ্গানীব সর্ব্বশঃ।” মৃত্যুর পূর্বে বিপদ আশঙ্কায় কচ্ছপ হাত পা খোলায় গুটিয়ে নেয়। চরম বিপদজনক সেই মানুষটার সঙ্গে প্রথমবার দেখা হতে চলেছে আমার। মনে প্রাণে বুঝতে পারছি, সব্যর এখন ঠিক কীরকম লাগছে। অথচ হাত পা গুটিয়ে চুপচাপ বসার মত পরিস্থিতি নেই আর।

হাঁটতে হাঁটতে প্রায় গ্রামের শেষ সীমায় পৌঁছে বাড়িটাকে দেখা গেল। মেঘলা আকাশের চাঁদের আলোয় হলদেটে ক্ষয়ে যাওয়া বাড়িটাকে ঘন সবুজ জঙ্গল চারিদিক থেকে ঘিরে ধরেছিল। পথের ধারে কটা ঝাঁকড়া খেজুর গাছের পাতায় পাতায় ঘষা লাগা মৃদু শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই চারিদিকে, এমনই নিস্তব্ধ চারিদিক যেন সেই নৈঃশব্দকে হাত দিয়ে ছোঁওয়া যায়। দেওয়ালগুলোর বিবর্ণ হলদেটে আভায় শ্যাওলার সবুজ চেপে বসে ছোপ ছোপ দাগের মত দেখাচ্ছিল। শ্যাওলাগুলোর আঁকিবুকি রেখায় দেওয়ালে নানা প্রতিকৃতি তৈরী হয়েছে। হা মুখ দৈত্যের মত মনে হয় দূর থেকে। জানালাদুটো বন্ধ, ভেতরে কেউ জেগে আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। খেজুর গাছে একটা প্যাঁচা ডেকে উঠল, হু…হুউ…হুউট!

সব্যর সাথে আগে থেকেই কথা হয়েছিল, পিছনের দিক দিয়ে কোনও ঢোকার রাস্তা আছে নাকি বার করতে হবে। নিঃসাড়ে ঢুকে যন্ত্রটাকে কেড়ে নিলেই সুলেমানের ক্ষমতার ইতি, তা সে যে ধরণের ক্ষমতাই হোক না কেন, আমার মতে হিপনোটিক বা সব্যর মতে অতিলৌকিক! ওকে সেদিনই পরামর্শ দিয়েছিলাম, সুলেমানের কাছে গেলে যন্ত্রটাকে ছিনিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সব্যর কাছে শুনে মনে হয়েছিল ওই যন্ত্রটাই সুলেমানের প্রধান অস্ত্র। সুরের মাধ্যমে সম্মোহন! আমাকে সব্যর সঙ্গে এমন ভাবে ঢুকতে হবে ঘরটায়, যাতে সুলেমান দেখতে না পায় সহজে। যাতে কোনওভাবে ও না পারলে, আমি তুলে আনতে পারি যন্ত্রটা। ঘরটার আলোআঁধারির সুযোগ নিতে হবে আমাকে।

তবে কাজটা যে সহজ নয়, তা আমি আর সব্য দুজনেই জানতাম।

বাড়ির পেছনদিকটায় ঘন ঝোপের মধ্য দিয়ে এগোচ্ছিলাম আমরা দুজন, সব্য আগে আর আমি ওর পেছন পেছন। কলাগাছের বনে থিক থিক করছে অন্ধকার, পায়ের তলায় পুরোনো খসে যাওয়া কলাপাতাগুলো মশমশ করছে, পুরো জায়গাটা জুড়ে পাতাপচা বোঁটকা গন্ধকে ছাপিয়ে আর একটা গন্ধ প্রবল হয়ে উঠছে। জোনাকির আলো জ্বলছে নিভছে, ঝিঁ ঝিঁ ডাকছে একটানা। সব্য মুহূর্তে মুহূর্তে দূরে চলে যাচ্ছে আমার থেকে। উন্মাদের মত ও সুলেমানের দরজার দিকে এগিয়ে চলেছে। এতক্ষণ একটানা পথ চলার ফলে ও হাঁপাচ্ছে, বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে, চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে— তবু ওর থামবার যেন কোনও উপায় নেই। সুলেমানের মুখোমুখি হয়ে ওর নিষ্ঠুর খেলা শেষ করা নয়, ওর কাছে নিজেকে সঁপে দেওয়ার ব্যগ্রতায় সব্যসাচী ছুটে চলেছে। সুলেমান যেন বন্ধ ঘরের ভেতর থেকে ওকে ডাক পাঠাচ্ছে— আয়— আয়— আয়।

যত এগোচ্ছি সুলেমানের ঘরের দিকে, ততই সেই পচা গন্ধটা জোরালো হচ্ছে। মনে পড়ল, সব্য বলেছিল মৃত মানুষের শরীরের থেকে উঠে আসা সেই পরিচিত গন্ধের কথা। কুয়াশার মত অর্দ্ধস্বচ্ছ শরীর দেখা যাচ্ছে বেশ কটা, আমার কানের পাশ দিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়ার মত ফিসফিসিয়ে বলে সরে যাচ্ছে কোথায়! স্থান কালের অতীত যেন সুলেমানের বাড়ির এই চারপাশটা! কোনওভাবেই মনে হয় না, বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে আছি। এই যে আমার সামনে দুহাতের মধ্যে ওই বাড়িটার পিছন দিকের দরজা, চারপাশের ভিড় করে থাকা কলাগাছগুলো, আমার সামনে হাঁটতে থাকা সব্যসাচী— সব এই মুহূর্তে কেমন যেন অবাস্তব লাগছে। কলাগাছের বড় বড় পাতার আড়ালে আরও অনেকে দাঁড়িয়ে আছে— তাদের দেখতে পাচ্ছি না ঠিকই কিন্তু জানি ওই আড়াল থেকে তারাও আমার দিকে নির্নিমেষে তাকিয়ে আছে। এক একটা সময় মনে হচ্ছে এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই, কোত্থাও কিচ্ছু নেই, এমনকি এক কণা শব্দও নেই। শুধু শ্বাস রুদ্ধ করে কারা গভীর প্রতীক্ষায় আমাদের আসার প্রহর গুণছে!

দূর থেকে একটা শব্দ শুনতে পেলাম হঠাৎ। কেউ তারের কোনও যন্ত্র বাজাতে শুরু করেছে। শব্দটা শুরু হতেই, কুয়াশার তৈরী শরীর নিয়ে যারা আমার চারপাশে এসেছিল, তারা হঠাৎ কোথায় লুকিয়ে গেল। যন্ত্রের শব্দটা দু-তিনবার বেজেই থেমে গেল। এখন স্তব্ধ চারদিক। যারা লুকিয়েছিল, তারা আবার বেরিয়ে এসেছে। তাদের ফিসফিসানি ছুঁয়ে যাচ্ছে আমায়। ওরা কী যেন বলতে চায়! অথচ বলছে না! চোখের সামনের দৃশ্যগুলো নিঃসীম শূন্যতায় ভাসছে। নিস্তরঙ্গ পুকুরে ঢিল পড়লে যেমন ঢেউগুলো কাঁপতে কাঁপতে ছড়ায় চারিদিকে, আমার চারপাশের হাওয়ায় এখন সেই একই কম্পন। একটা আঙুল ছুঁয়ে দিলেই হয়তো সেই কম্পন স্তব্ধ হবে, বা কে জানে হয়তো হাজারগুণ বেড়ে যাবে! সুলেমান, সুলেমানের আস্তানা, তার অাস্তানার পেছনে ভিড় করা অশরীরি অস্তিত্বেরা সবই বড় জীবন্ত! বাকি যা কিছু জাগতিক, তা যেন অবাস্তব। অন্য কোনও জগতের উপাদান তারা।

সব্য আমার আগে এগিয়ে থমকে গেছে, অবাক হয়ে তাকিয়ে কী যেন বেশ দেখছে।

সামনে অন্ধকার যেন একটু ফিকে হয়ে এসেছে, কলাবনের গাছগুলোও সংখ্যায় কমে এসেছে এবার। মাটির উপর একটা কাঠের চুল্লী পড়ে রয়েছে। কী জন্য ব্যবহার করা হয় ওটা! মানুষের শরীরের পোড়া মাংসের গন্ধ ভুরভুর করে উঠে আসছে ওটা থেকে। একটু একটু বুঝতে পারছিলাম, সুলেমানের শিকার হওয়া হতভাগ্য রোগীগুলোকে রাতের অন্ধকারে কেমন করে গতি করা হয়! আমার শরীরের সব শক্তি প্রাণকেন্দ্রে কেন্দ্রীভূত করছি। এইবার গতিপথ রোধ করে দাঁড়াচ্ছে ওরা। ভুল করেছিলাম আমি, খুব ভুল করেছিলাম সব্যসাচীকে বিশ্বাস না করে। ওরা আছে আমার চারপাশে, আর ওদের মধ্যেই কি আছে হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলো! অসহায় মতিউফ বা বশে বাঁধা আনিসুর! কী চায় ওরা? বুঝতে পারছি না ঠিক! আকাশের স্থির নক্ষত্রের মত ওদের জ্বলন্ত দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে আমার চোখের সামনে। হাজারো জোনাকি জ্বলছে যেন ঠিক! যে কোনও লজিক্যাল স্থির বুদ্ধির মানুষ তাই বলবে! রুপোলি আলোর ওই যে ঝিকিমিকি— ওগুলো জোনাকি ছাড়া আর কিছু নয়! কদিন আগে হলে, আমি নিজেও হয়তো তাই বলতাম। কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে সব যুক্তিবুদ্ধির সীমারেখা ছাড়িয়ে যে জগতের দ্বার খুলে গেছে সামনে, তা আমাকে আর সব্যকে একই উপলব্ধির সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। কিঞ্চিৎ আগে আর পরে, এই যা!

সুলেমানের বাড়ির পেছন দিকের টিনের দরজাটার পাল্লা বন্ধ ছিল। প্রস্রাবখানার গন্ধ উঠে আসছে এদিকটায়। টিনের দরজাটা তিরতির করে কেঁপে উঠল। দরজা ঠেলে যে বেরোলো, তার চেহারার মত চেহারার বর্ণনা বহুবার শুনেছি আগে। যদি না ভুল হই, এই সেই আনিসুর। গল্পে শোনা লম্বাটে ক্ষয়াটে চেহারা, কিন্তু না চেহারা বলা ভুল হবে, আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে শুধুই একটা প্রেত-ছায়া। সব্য কি ওকে দেখতে পাচ্ছে না? পাশ কাটিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে! আনিসুরের প্রেতশরীরটা এবার এগিয়ে আসছে সব্যর দিকে। ওর গতির মধ্যে কোনও তাড়াহুড়ো নেই, যেন এভাবেই সব্যকে দেখতে পাবে জানত ও! সব্যকে ডাকলাম, “দাঁড়া সব্যসাচী!” আমার আহ্বান কানে গেল না ওর, বদলে আনিসুর হেসে উঠল। ওর বুকটায় কত জন্মের হাসি ভরা আছে কে জানে!

আচমকা একটা দমকা হাওয়া উঠল কোথা থেকে, আস্তে আস্তে সেই হাওয়ার বেগ বাড়তে থাকল, আমাদের ঠেলে সেই হাওয়া নিয়ে যেতে লাগল সুলেমানের ঘরের খোলা দরজার দিকে, কাছে যেতেই বুঝতে পারলাম, সেই ঘরে আলোর আভাস দেখা দিচ্ছে আর সেই সঙ্গে সেই রহস্যময় বাজনার শব্দটা ভেসে আসছে আমাদের কানে। হাসতে হাসতে আনিসুরের কুয়াশাময় শরীরটা মাটিতে নুইয়ে পড়তে লাগল।

চারিদিকে হাওয়া যেন আমাদের কানে কানে এসে ভীষণ আক্রোশে গুমরে গুমরে উঠতে লাগল। তার সঙ্গে যোগ দিল অসংখ্য চাপা গলার আর্তনাদ, কিছু খলখলে গলায় হাসি, কিছু ক্রুদ্ধ গলার সাবধানবাণী। আমাকে আর সব্যকে কারা যেন ঠেলে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল আর দরজাটা আমাদের পেছনে দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল। ঘরের মিশকালো অন্ধকারের মধ্যে জাগ্রত একটাই বাল্ব। আলোর শঙ্কুটার তলায় একটা লোককে বসে থাকতে দেখতে পেলাম, মাটিতে বসে জোরে জোরে হাতের বাজনাটার তারগুলোয় টান দিচ্ছিল। বাল্বের তীব্র আলোর নীচে তার মুখের সবকটা রেখা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। চোখ লাল, নিঃশ্বাস বন্ধ করে ও প্রবল বেগে বাজনাটা বাজিয়ে যাচ্ছিল। এই তাহলে সুলেমান! বাজনাটা প্রথমবার দেখলাম, সঙ্গে সুলেমানকেও! ময়লা লুঙ্গি, মেটে রঙের ফতুয়া পড়া খাটো শরীরটায় চোখে পড়ার মত পেশীশক্তির বাহুল্য। বাজনাটা ছোট, কিন্তু কী সুরেলা, ঝিম ধরানো তার সুর! ছড়ে টান দিচ্ছে সুলেমান, কিন্তু কর্কশ কোনও শব্দ নয়, বদলে তার কম্পনে নেশা ধরে যায় মাথায়! ছড়ে এত জোরে জোরে টান দেওয়ায় সুলেমানের হাতের গুলিগুলো ফুলেফেঁপে উঠেছে। কুতকুতে চোখ, মোটা নাক, বড় বড় ঠোঁটের পেছনে বড় বড় দাঁতগুলো দেখা যাচ্ছিল অনায়াসে।

ঘরে ঢুকেই সব্যর পেছন দিক দিয়ে আমি অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে গেলাম। সেরকমই কথা ছিল আমাদের। সব্যসাচী কথায় কথায় সুলেমানের মনোযোগ আকর্ষণ করবে আর আমি তার ফাঁকে বাজনাটাকে তুলে নেব আমার হাতে! কিন্তু ঘরের কোণের এই অন্ধকারেও প্রেতমূর্তির মত কারা ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলছে! যন্ত্রের তারের মূর্চ্ছনার সঙ্গে তাদের গতি যেন বাঁধা। তারা ফুঁসছে, রেসের অ্যাথলিটদের মত শুধু বাঁশি বাজার অপেক্ষা! তারপর বোধহয় একসাথে ঝাপিয়ে পড়বে নির্দিষ্ট শিকারের উপর। তাদের সেই আগ্রাসী হিংস্রতা, উন্মত্ত নির্মম আক্রোশে সুলেমানের সারা ঘর বিষাক্ত হয়ে উঠেছে।

সব্যকে দেখে সুলেমান বাজনার গতি কমাল, ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল চাপা একটা হাসি, হিমশীতল, ঠান্ডা, বুকের রক্ত জল করা হাসি। যেন এতক্ষণ সব্যসাচীর জন্যই অপেক্ষা করছিল ও। শান্তভাবে বলল, “আইস আইস ডাগদার! তোমার লগেই বইসা ছিলাম! কয়েছিলাম না, আসতেই হবে একদিন! “

সব্যর গলাটা ধরে এল। কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারছে না ও! আন্দাজ করছিলাম, এমন একটা কিছুই হতে চলেছে। কাঁপা কাঁপা গলায় ও বলে উঠল, “তুমি কী চাও? আমার মৃত্যু! তবে এতদিন ধরে বাঁচিয়ে রেখেছো কেন আমায়? আরও কত মৃত্যু চোখের সামনে সহ্য করে আমায় বেঁচে থাকতে হবে? কত ক্ষতি করব মানুষের আর? সুলেমান! মেরে ফেলো আমায়… মেরে ফেলো প্লিজ!”

সব্যসাচীর কথা শুনতে শুনতে সুলেমান বাজনাটার তারগুলোর গায়ে বড় আদর করে হাত বুলাচ্ছিল। সব্যর চারপাশে তখন ঘন কালো কালো ছায়া ঘনীভূত হচ্ছে। ঘরের সমস্ত কোণগুলোয়, অন্ধকারে যারা লুকিয়ে আছে এইবার বেরিয়ে এসেছে তারা। ঘরের মধ্যে অলক্ষ্যে ঝড় উঠেছে একটা। ওরা অপেক্ষা করেছিল এতক্ষণ, আর বুঝি তর সইছে না। ওদের হিংস্র দৃষ্টি, ওদের ব্যগ্র অপেক্ষা সব্য বুঝতে পারছে কিনা জানি না। শুধু দেখতে পাচ্ছি ওর আত্মবিশ্বাস বলে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। হাত পা থরথর করে কাঁপছে। বিন্দু বিন্দু ঘাম কপালের ধার বেয়ে টুপ টুপ করে গড়াচ্ছে। শার্টটা এমন ভাবে ঘামে ভিজে গেছে যেন সদ্য স্নান করে উঠেছে ও।

সুলেমানের হাতে বাজনাটা আবার সুর তুলেছে। ওর হাতের আঙুলগুলো দেখে কেন জানি না অক্টোপাসের শুঁড়ের কথা মনে পড়ে যায়। সব্যসাচীর আর্ত ভঙ্গী দেখেও ওর রোমশ অক্টোপাসের মত আঙুলগুলো থামল না। এ জগতে যেন বাজনাটুকু বাজানো ছাড়া সুলেমানের আর কোনও কাজ নেই। বড় নিশ্চিন্তে, একমনে সে তার যন্ত্রে সুর তুলে চলেছে। সম্পূর্ণ মনোযোগ ওই তারগুলোয় আটকানো। শিল্পীর নিখুঁত ভঙ্গিমায় সে সুরগুলোকে প্রাণ দিচ্ছে। কাঁটার মত খাড়া খাড়া তারগুলো কাঁপছে। ঘরের মধ্যে ঝোড়ো হাওয়াটারও গতিবেগ বাড়ছে। সব্য আবার ডেকে ওঠে, “সুলেমান!”

ঠোঁটের আড়াল থেকে গম্ভীর চাপা আওয়াজ আসে, “চুউউউপ! পেথ্থম দিন থেকে দেখতাসি বড় ব্যস্ত আপনে! তাই তো এত সহজেই হার মানেন…” সুলেমান হেসে উঠল। সেই হাসি বড় অদ্ভুত। ব্যঙ্গ, করুণা আর ঘৃণা মেশানো সে হাসিতে।

সব্যসাচী হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছিল। সুলেমানের হাসি শুনে মুখ তুলে একবার ওর দিকে তাকাল। যন্ত্রটাকে মাটিতে রেখে সুলেমান এবার উঠে দাঁড়াল। দেখলাম, ওর খাটো দেহে, উদ্ধত ভঙ্গিতে, ওর ব্যক্তিত্বের পরতে পরতে মেশানো রয়েছে দম্ভ। এগিয়ে এসে উবু হয়ে ও সব্যর সামনে বসে পড়ল। তারপর আঙুলের ডগায় সব্যসাচীর চিবুকটা উঁচু করে তুলে ধরে বলল, “তোমার লগে এ খেলাখান খেলে বড় মজা পেয়েছি। শ্যাষটা বড় তাড়াতাড়ি করে ফেললে ডাগদার… আরেকটু আশা ছিল তোমার থিকা!”

কথা বলতে বলতে সুলেমানের গলার আওয়াজ হুইসলের বাঁশির মত তীক্ষ্ণ হয়ে উঠছিল। সব্যসাচীর হাত দুটো ধরে ও হাসতে হাসতে বলে উঠল, “মনে পড়ে সেদিন, এই দুখান হাত দিয়া কী কামটা করেছ? কী ডাগদার! মনে পড়ে?”

সুলেমানের কথা শুনতে শুনতে সব্যসাচী উঠে দাঁড়িয়েছিল। সুলেমানের শেষ কথাটায় ওর মুখে যেন কেউ একপোঁচ কালি লেপে দিল। চিৎকার করে কেঁদে উঠল ও। সব্যসাচীর কান্নায় সুলেমান দুলে দুলে হাসতে লাগল, উল্লাসে ওর চোখদুটো চকচক করছিল। সব্য কাটা কলাগাছের মত ওর পা দুটো ধরে বসে পড়ে আবার বলল, “মেরে ফেলো সুলেমান! মেরে ফেলো আমায়!”

মনে মনে ভাবলাম, এই একমাত্র সুযোগ। সুলেমানের চোখ সব্যসাচীতেই আঁটকে আছে। অজগর যেমন তার অহংকারী মাংসপেশীর পাকে পাকে শিকারকে গুঁড়িয়ে ফেলে, একই রকম আত্মবিশ্বাস সুলেমানের চোখে মুখে। অন্ধকার কোনা থেকে এক ছুটে তীরগতিতে বেরিয়ে তুলে নিলাম যন্ত্রটা হাতে। সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ঝোড়ো হাওয়ার দাপট থেমে গেল। শান্ত হয়ে গেল চারদিক।

অন্ধকার যে ভাবে সব্যর দিকে পা টিপে টিপে এগোচ্ছিল, তার গতিও যেন আটকে গেল।

সুলেমান অবাক হয়ে দেখছিল আমার দিকে! কোথা থেকে এত সাহস আর শক্তি জুটিয়ে ওর মুখোমুখি হলাম বুঝতে পারছিল না ও। যন্ত্রটা এক ঝটকায় তুলে নিলাম আমি, অন্তত আমাকে ও ওই যন্ত্রের তারে তো আর বেঁধে ফেলতে পারেনি! আমি জানি! এ যন্ত্র যার হাতে, সে সেই মুহূর্তের রাজা! শুধু রাজা পাল্টালে শিকারও পাল্টে যায়। কিন্তু না! আর দেরী নয়। বন্ধ দরজাটা খুলে দেওয়ার দরকার। সব্য বেরিয়ে যাক এ ঘর থেকে। টিনের দরজাটা খুলে দিই আমি।

সব্যসাচী স্থির হয়ে একজায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল। পরিস্থিতি যে পাল্টে গেছে, সেটুকু বোঝার মত বিচারবুদ্ধিও ও হারিয়ে ফেলেছে। দেখে বুঝতে পারছিলাম, দরজা খোলার মৃদু আওয়াজটাও বুঝতে পারেনি। দৌড়ে গেলাম ওর দিকে, ধাক্কা দিলাম একটা, সেই ধাক্কায় সব্যসাচীর হুঁশ ফিরে এল। এক সেকেন্ডও নষ্ট না করে খোলা দরজা দিয়ে সব্যসাচী বেরিয়ে গেল, ঘরে রয়ে গেলাম একা আমি আর হতবাক সুলেমান।

সুলেমানের সাধের বাজনা হাওয়ায় ভাসছিল। ওর উদ্ধত শিরদাঁড়া বেঁকে গেছে এবার, দেওয়ালের দিকে একটু একটু করে সরছে ও। বাজনাটা হাতে ধরে ওর দিকে এক পা এক পা এগোচ্ছিলাম আমি। আমাকে, এই রুদ্র স্যান্যালকে সুলেমান দেখতে পাচ্ছিল কি! নাকি হাওয়ায় ভাসমান যন্ত্রটার দিকে তাকিয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল ওর! সুলেমানও ভয় পায়! লোমশ হাত দুটো দিয়ে ও দেওয়ালটা আঁকড়ে ধরেছে, আমার দিকে পেছন ফিরে থর থর করে কাঁপছে। হয়তো ভেবেছে ওরই কবলে থাকা কোনও প্রেতাত্মা বন্দিত্ব থেকে মু্ক্তি পেয়ে অধিকার করেছে যন্ত্রটা। ও আন্দাজ করতে পারছে, তার পরিণাম কী হতে পারে! আমাকে ও ধর্তব্যের মধ্যে ধরেনি, কারণ আমার অস্তিত্ব ওর পোষা অসংখ্য প্রেত শরীরের ভিড়ে হারিয়ে গিয়েছিল। আমিও যে ওদেরই মত…

কাল অমন করে সব্যসাচীর কথায় সন্দেহ প্রকাশ না করলেই ভালো ছিল! ও বলেছিল বটে, সাক্ষাৎ শয়তান জেগে ওঠে ওর মধ্যে— কথা বলতে বলতে হঠাৎ একবার আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিল বটে, “রুদ্র, সেই বাজনাটা আবার বাজছে, কিছু একটা ভয়াবহ হবে— পালা রুদ্র, পালা এখান থেকে।” বিশ্বাস করিনি, বুঝতে পারিনি কখন মূর্তিমান শয়তান সব্যর শরীরকে আশ্রয় করে…

একবার শুধু বলেছিলাম, “সব্য, এসব ভূত প্রেত পিশাচ দৈত্য এ সব মনের ভ্রম, ভুল। তুই ভালো করে মেডিক্যাল হেল্প নে।”

বুঝতে পারিনি, কখন অশরীরি অমানুষিক এক শক্তি হয়ে সব্য আমার বুকের উপর চেপে বসবে, আর ভারী পাথরের মত দুটো হাত নেমে এসে এক ঘায়ে আমার কন্ঠার হাড়, আমার সোলডার ব্লেড, ভেঙে গুঁড়িয়ে যাবে। বুঝতে পারিনি, কখন নিমেষের মধ্যে আমার বারোজোড়া পাঁজরার হাড় ভেঙে চুরচুর হয়ে যাবে। এখনও চোখ বন্ধ করলে একটা একটা পাঁজর ভাঙার আওয়াজ শুনতে পাই আমি… আর আমার মৃত্যুর দুঃসহ বোঝা বয়ে সব্যসাচীর মনে মনে মরে যাওয়া অনুভব করতে পারি। সেন্সে ফেরার পর ওর সেই ডাকছাড়া কান্না, আমার নিথর শরীরটাকে জড়িয়ে ধরে অবুঝের মত জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করা… সবই বড় কষ্ট দেয় আমায়।

যাক! এখন সুলেমান আমার মুখোমুখি, আমিও ওর মুখোমুখি। যাদের ও বশ করে রেখেছিল, তাদের কর্তৃত্বও এখন আমার মুঠোয়। সুলেমানের অবাক, ভীতু চোখটার সামনে যন্ত্রটা আবার বাজতে শুরু করেছে, হাওয়ায় ভেসে ভেসে অদ্ভুত সুর ছড়াচ্ছে চারিদিকে, কাঁপছে চারদিক, লাইটের বাল্বটা দুলছে প্রচণ্ড অস্থিরতায়। সুলেমানের শরীরটা আস্তে আস্তে উপরের দিকে উঠছে, শূন্যে ভাসছে, ভীষণ জোরে পাক খাচ্ছে হাওয়ায়। যারা ভীষণ আগ্রহে অপেক্ষা করেছিল তাদের মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। তাদের হাতের ছোঁয়ায় বনবন বনবন করে সুলেমানের শরীরটা ঘুরছে এমন ভাবে যেন পালকের তৈরী… এভাবে বেশিক্ষণ চললে হার্টফেল করেই মরে যাবে ও, কিন্তু এত সহজে তো ওকে মরতে দেওয়া যায় না! হাতের যন্ত্রের তারগুলো ভীষণ জোরে টানতে থাকি আমি। সুলেমানের দেহটা এবার দেওয়ালে ঠোকা খেতে শুরু করেছে, অশরীরি প্রেতশক্তিরা প্রবল আক্রোশে ওর মাথাটা ধরে ঠুকে দিতে শুরু করেছে দেওয়ালে। মাথা ফেটে রক্তের ছিটে লাগতে শুরু করেছে দেওয়ালে… একটু পরে মাথার স্কাল ভেঙে ঘিলুগুলোও ছিটকাবে জানি আমি, শুধু ততক্ষণ কিছুতেই যন্ত্রটাকে থামতে দেওয়া যাবে না… কিছুতেই না। প্রাণপণে বাজাতে থাকি আমি, আমার কায়াহীন শরীর ছায়ার মত ভাসতে থাকে… আর শুনতে থাকে অপার্থিব সেই মূর্চ্ছনা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *