হাটগামারিয়ার আয়না
বাসটা ধুলো উড়িয়ে চলে গেল।
ওরা তিন জনে বাস থেকে নামল। সঙ্গে আরও জনাচারেক স্থানীয় লোক। ফিরতে করতে এগারোটা হল। ওরা সাতসকালে উঠে শালবনীতে গেছিল কালুর ভগ্নিপোতের সঙ্গে দেখা করতে। কাজুবাদামের বাগান আছে তাঁর।
স্থানীয় মানুষেরা হাইওয়ে থেকে বেরোনো একটি পায়েচলা পথে এগিয়ে গেল বাস থেকে নেমে ঝাঁটি জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে, দূরের নদীর কাছের গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে দেখা-যাওয়া একটি গ্রামের দিকে।
ওরা একটু অবাকও হল, কারণ, হাটের দিন বলে আশেপাশের দশ গাঁয়ের মানুষে হামলে পড়ে যখন সকালে জড়ো হয়েছে আজ এই হাটগামারিয়াতে তখন গ্রামাঞ্চলের মানুষ হয়েও হাটের এই অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ অপেক্ষা করে ওরা চলে গেল বলে।
মস্ত বড়ো হাট। হাটে নানা জিনিস। সময়টা এপ্রিলের গোড়া, চৈত্র শেষ। ঘাসের ঝাঁটা, ঘাসের মোড়া, ঘাসের কুলো, পেতলের নানা বাসন-কোসন, রুপোর গয়না ইত্যাদি ইত্যাদি। নানারকম খাদ্যসম্ভার তো ছিলই, যেমন সব হাটেই থাকে। টাটকা আনাজ, মুরগি, মুরগির ডিম, চাল-ডাল তেল-নুন-মশলা, তেলেভাজার দোকান, মিষ্টির দোকান, চায়ের দোকান ইত্যাদি ইত্যাদি, যা নইলে কোনো হাটই সম্পূর্ণ হয় না।
পায়ে পায়ে ধুলো উড়ছে। নানা নারী-পুরুষের গন্ধ মিশে গেছে মুরগি, মুরগির ডিম, সরষের তেল, ছাগল-পাঁঠা, খোল এবং জাবর-কাটা বলদের গায়ের গন্ধর সঙ্গে।
ওরা কে কী কিনবে ঠিক করতে পারল না প্রথমে। কিছু যে কিনবেই এমনও কোনো পণ করেনি ধনুকভাঙা। তাই অন্যদের পায়ে পায়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে এলোমেলো ঘুরে বেড়াতে লাগল। পেটা স্বাস্থ্য, রোদ-চাঁদে বড়ো হয়ে ওঠা মানুষ-মানুষীর চকচকে শরীরের দিকে চোখ পড়ছিল শহুরে ওদের। বিশেষ করে মেয়েদের দিকে। আঁটোসাটো ছিটের ব্লাউজ পরে, তারা পাখ-সাট দেওয়া যুবতী মুরগির মতো এদিকে-ওদিকে পাক দিচ্ছিল।
মহুয়ার দোকান লেগেছে শালগাছের নীচে। আর তিন দিকে গোল হয়ে বসেছে অনেকে। বড়ো বড়ো শালপাতার দোনায় মহুয়া খাচ্ছে মেয়ে-মরদে। তারপর চুট্টায় টান লাগাচ্ছে পরম সুখের সঙ্গে। এরা বড়ো ভাগ্যবান যে এখনও অকলুষিত পৃথিবীতে বাস করার অধিকার ওরা শহুরেদের মতো নিজেরাই নিজেদের হাতে জ্বণহত্যা করার মতো হত্যা করেনি।
এমন এমন জায়গায় এলে, ওই তিন বন্ধুর মতো জন্ম-শহুরে মানুষেরা আদৌ নিরাপদ বোধ করে না। এ ভয়টা চুরি-ডাকাতি বা ছিনতাইয়ের নয়। ভয়টা আরও অনেক গভীর। অন্যতর ভয়। বুকের অন্তঃস্থলে যে-ভয়টি সকাল থেকে রাত অবধি শহরে জিয়ল মাছের মতো সামান্য পরিসরে ঘুরে-ফিরে বেড়াবার সময়ে তাদের গোচর হয় না, অনুভূত হয় না, তেমন কোনো ভয়। মানুষ হিসেবে তাদের ন্যূনতম প্রার্থনা কী হওয়ার কথা ছিল, আর কী তারা পেয়েছে অথবা আর কীসের তীব্র তাগিদে ভর করে, তারা সকাল থেকে রাত জীবনযুদ্ধে শামিল আছে, সে-সব তাৎপর্যময় প্রসঙ্গ এই খোলা নীল আকাশ, এই হুড়োহুড়ি করা বৈশাখী বাতাস, এই পায়ে-পায়ে ওড়া ধুলো, মনে পড়ায় তাদের শহুরে দিনযাপনের ঘনঘটা যে সত্যিই তুচ্ছ তা এই হঠাৎ অবকাশ তাদের অচিরে শরীর-মনে ন্যাংটো করে দিয়ে বুঝতে শেখায়।
রুপোর গয়নার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে যোগেন বলল, আমি ভাই আমার ময়নার জন্যে একজোড়া রুপোর পায়জোড় কিনব। কী সুন্দর সব ডিজাইন দেখেছিস!
কালু বলল, হবেই তো! কাছেই একটি গ্রাম আছে যে। সেখানের পয়রারা ভারী বিখ্যাত।
চিনু বলল, পয়রাটা আবার কী জিনিস?
পয়রা একটি পদবি। স্যাকরাদের পদবি। এ-অঞ্চলের স্যাকরারা খুবই বিখ্যাত। তাদের হাতের কাজের জন্যে। ওড়িশার রুপোর ফিলিগ্রি কাজের কথা শুনেছিস তো? এ তো ওড়িশাই হল। যদিও পশ্চিমবঙ্গের প্রায় লাগোয়া। তাই হয়তো বংশপরম্পরায় এরা স্যাকরা হিসেবে এক ধরনের বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছে।
যোগেন বলল, একটা গল্প পড়েছিলাম, পরি পয়রা নামে। কোনো সিনেমা-ম্যাগাজিনে। কার লেখা মনে নেই ঠিক কিন্তু অবশ্যই পড়েছিলাম বলে মনে পড়ছে। পয়রা বাড়ির এক বউকে নিয়ে লেখা। এই অঞ্চলেরই পটভূমিতে।
কালু বলল, তোড়া কিনলে কেন, গয়না ময়না। আমার ময়নাই নেই কোনো, গয়না দেব কাকে? তার চেয়ে আমি দু-গাছা ঝাঁটা কিনি। একটা আমার বউকে দেব। একটা আমার জন্যে রেখে দেব। দু-জনেরই কাজে লাগবে। ঝাঁটার সঙ্গে ঝগড়ার কোনো মিলই যদি না থাকবে তা হলে ঝগড়াঝাঁটি কথাটা এল কী করে বল?
চিনু বলল, তুই যে একেবারে সুনীতি চাটুজ্যে হয়ে গেলি দেখছি। ফাইলোলজিস্ট।
কালু বলল, ফাইললালজিস্ট নয়, শব্দটা ফিললজিস্ট। ইংরেজি বলার দরকারই বা কী? ভাষাতত্ত্ববিদ বললেই তো হয়।
তারপর বলল, আমি আমার মায়ের জন্যে একটা পেতলের ঘটি কিনব। মা এখনও রোজ সকালে গঙ্গাস্নানে যান।
বলিস কী রে! এই বয়সেও মাসিমা প্রত্যেক দিন গঙ্গায় চানে যান? কীসে যান? রিকশায়?
ভবানীপুরের বলরাম বসু ঘাট রোড থেকে গঙ্গা আর কত দূর। হেঁটেই যান।
ওই টালির নালা কি গঙ্গা? ওখানে মাসিমা প্রতিদিন চান করেন? ওই তরল গরলে ডুব দিয়েও এতদিন যে বেঁচে আছেন, এটাই তো পরম আশ্চর্যের কথা!
কালু বলল, দ্যাখ দ্যাখ, কী সুন্দর আয়না নিয়ে বসেছে?
চিনু বলল, আমি একটা আয়না কিনব। কী সুন্দর পেতলের ফ্রেমে বসানো দেখেছিস! ছোট্ট একটি আয়না মুখের কাছে ধরে দাড়ি কামাই। আর ঠোঁটের নীচে গলার কাছে প্রতিদিনই কেটে যায়। আমি ভাই একটি আয়না কিনবই।
যোগেন বলল, ভয় দেখাচ্ছিস কেন? কিনলে কেন না! হাটে এসেছিস, যা ইচ্ছে তাই কেন। অত এক্সপ্ল্যানেশনের দরকার কী? সঙ্গে তো আর তোর মাস্টারনি বউ নেই।
চিনু বলল, তুই কি রোজই আয়নায় মুখ দেখিস?
হঠাৎ এ প্রশ্ন?
আয়নায় কে না দেখে মুখ?
যোগেন বলল।
কালু বলল, সকলেই মনে করে যে, দ্যাখে। কিন্তু নিজের নিজের মুখ কি সকলেই দেখে আয়নায়? কেউ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাড়ি কাটে, কেউ লিপস্টিক মাখে, কেউ চানঘরে গান গাইতে গাইতে নিজের মুখে সাবান মাখে। কিন্তু তবু, নিজের মুখ কি সত্যিই কেউ দ্যাখে?
চিনু বলল, ওই হল্লো! আরম্ভ হল ফিলসফাইজিং। থাম তো। একটু বেড়াতে এসেও এনজয় করতে দিবি না।
সকলেই চান করে উঠেছে। থ্রি-এক্স রাম-এর বোতল বের করেছে যোগেন। টেবিলের ওপরে জলের জাগ। গেলাস, কলকাতা থেকে আনা গুজরাটি ডালমুটের প্যাকেট সাজিয়ে মিনি-বার লাগিয়ে দিয়েছে চিনু। ওদের গুছিয়ে বসিয়ে দিয়ে চৌকিদার টাকা নিয়ে গেছে রাতের খাবারের জন্যে।
এ বাংলোতে খাওয়া-দাওয়ার বন্দোবস্ত নেই। বাজারে গিয়ে খেতে হয়। বাজার অবশ্য দূরে নয়। তবে ওরা সাব্যস্ত করেছে যে এখানেই বিলাসিতা করে খাবে। বাজার থেকে চৌকিদারের ছেলে খাবার নিয়ে এলে, চৌকিদার খাবার ভালো করে গরমও করে দেবে, এমনই কথা হয়েছে।
বাংরিপোসির বাংলোর বারান্দাতে ওরা তিনবন্ধু বসেছিল।
সামনেই একটা মস্ত বড়ো গাছ। গাছ না বলে মহিরুহই বলা ভালো। ঠাকুমার মতো ছায়ার আড়াল দিয়ে পুরো বাংলোটিকে স্নিগ্ধ স্নেহে আগলে রেখেছে যেন।
এখন রাত আটটা হবে। চাঁদের আলো ঝিকমিক করছে বৈশাখী বাতাসে আন্দোলিত হওয়া মহিরুহর পাতায় পাতায়। বাংলোর পেছনেই অনেকখানি টাঁড় জমি। পিচের পথটি ডানদিকে চলে গেছে ঘাটি পেরিয়ে বিসোই হয়ে, সিমলিপালের গেটওয়ে যোশীপুরে। অথবা সোজা গেলে রাইরাংপুরে।
যোগেনই ওদের নেতা। সাম্প্রতিক অতীতে বাংরিপোসির দু-রাত্তির উপন্যাসটি পড়ে এবং বন্ধুদের পড়িয়ে, তারা এই বাংরিপোসিতেই আসা মনস্থির করেছিল ফিনানসিয়াল ইয়ার। এন্ডিংয়ের পরেই। ওরা তিনজনেই সেলস-ট্যাক্সে কাজ করে। শনি-রবির সঙ্গে শুক্র-সোম ছুটি নিয়ে একসঙ্গে চারদিন ছুটি করেছে। করে, তিনবন্ধু কলকাতা থেকে বারিপাদার বাসে চড়ে বাংরিপোসিতে এসে নেমেছিল কাল দুপুরে। রাতটা ভালোই কেটেছে। সকালে বুড়িবালাম নদী দেখতে গেছিল। নদীর পাশ দিয়ে একটি পথ চলে গেছে সিমলিপালের দিকে। এদিক থেকে। গেলে সিমলিপাল অভয়ারণ্যের একটি বনবাংলো সবচেয়ে কাছে পড়ে। তার নাম লুলুং।
রাম খেয়ে যোগেনের ভাব এসেছিল, বলল, চিনু, একটা গান গা দেখি। বহুদিন তোর গান শুনিনি।
চিনু বলল, চুপ করে একটু চাঁদের আলো দ্যাখ।
কলকাতাতে তো কখন পূর্ণিমা আসে, আর কখন যায় তা বোঝা পর্যন্ত যায় না। কথা না বলে, একটু প্রকৃতিকে অনুভব কর।
কালু বলল, চিনুকে কাব্যি রোগে ধরেছে র্যা।
হুঁ! গান যেন আর কাব্যি রোগ নয়! গান বলতে তো তুই বুঝিস শুধুমাত্র তোর ওই ন্যাকা সংগীত।
ন্যাকা সংগীত মানে?
ওই তো রে। রবীন্দ্রসংগীত।
হ্যাঁ রে হাঁদা। বাঙালি যতদিন বাঁচবে, ওই রবীন্দ্রনাথ ছাড়া তোর তার গতি নেই। শোকের সময়ে, আনন্দের সময়ে, বিরহের সময়ে, প্রেমের সময়ে, বর্ষাতে, বসন্তে রবীন্দ্রনাথকে না মনে করে বাঙালির কি কোনো উপায় আছে? হস্তিমূর্খরা আর ইতর ধান্দাবাজেরা যে যাই বলুক না কেন! রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ। ধ্রুবতারার মতো। শেক্সপিয়র, টলস্টয়ের মতো। তোদের আজকালকার। চ্যাং-ব্যাংকাগা-বগা কবি-সাহিত্যিকেরা রবীন্দ্রনাথের পায়ের নখের যুগ্যিও নয়!
এই! এই! আরম্ভ করলি তো! এর পরেই তোর সম্পাদকের কথা তুলবি। তারপরেই বুদ্ধদেব গুহর শ্রাদ্ধ করবি। কবি আছিস, কবি থাক। তোর সম্পাদককে মেয়ে আর মদ সাপ্লাই করে যা, তুইও একদিন অনেক প্রাইজ-টাইজ পাবি। আমি শালা পেচ্ছাপ করে দিই তাদের এসব…
অ্যাই! হচ্ছেটা কী? মাইন্ড ইওর ল্যাঙ্গোয়েজ।
যোগেন বলল।
তোর ওই সাহিত্যের কচকচানি এখানেও শুরু করিস না, প্লিজ মাইরি। ক্ষ্যামা দে। উই আর নট দ্য লিস্ট ইন্টারেস্টেড।
চিনুর বাঁ পকেটে মানি ব্যাগের মধ্যে পাঁচটা পাঁচ-শো টাকার নোট ছিল। গোটা পাঁচেক এক-শো টাকার নোট, আর দশটাকা-পাঁচ টাকা নিয়ে আরও শ-দুয়েক টাকা।
এই গল্পগাছার মধ্যে মধ্যেই ডান হাতের সিগারেটে টান দিতে দিতে চিনু মাঝে মাঝেই বাঁ পকেটে হাত ঢুকিয়ে, মানি ব্যাগের মধ্যে আঙুল চালিয়ে, সেই পাঁচশো টাকার মসৃণ নোটগুলোকে খুঁচ্ছিল। ওগুলোতে আঙুল ছুঁইয়ে, পাকা ফোঁড়ার ওপরে আঙুল ছুঁইয়ে সুড়সুড়ি দিলে যেমন সুড়সুড়ি লাগে, ওর সেরকমই একধরনের সুড়সুড়ি লাগছিল।
গত বুধবারই বিঠলভাই অ্যান্ড কোম্পানির রেজিস্ট্রেশনটা করিয়ে দিয়ে, ঘুষ নিয়েছিল পাঁচ হাজার টাকা। ঘুষ নয়, যাকে বলে স্পিড মানি। ঘুষ-টুস, ঘুষ-ঘাষ এসব শব্দ আজকাল তামাদি হয়ে গেছে। এসব নিয়ে কোনো অপরাধবোধও আজ কারোই নেই. বালখিল্যদের জ্ঞান, যে-জ্ঞানে পূর্বপুরুষেরা অনেক মুখামির শিকার হয়েছিলেন, সেইসব জ্ঞান ওরা পুরোপুরি বর্জন করেছে। বিবেক নামক একটি শব্দ যা অভিধানে অনেক দিনই শোভা পেয়েছে তার মেয়াদ ফুরিয়ে গেছে, সে শব্দকে মুছে দিয়েছে ওরা। ছারপোকা কামড়ালেও কামড়ায়, কিন্তু বিবেক আর কাউকেই কামড়ায় না আজকাল। মাইনে যা পায়, তার দশগুণ ঘুষ-ঘাষ পায় মাসে। কিন্তু সমস্যা হয়, এই টাকাটা হজম করায়।
চামেলি একটু অন্য ধরনের মেয়ে। সে সকাল-সন্ধ্যা পুজো করে। কী মন্ত্র বলে সে নিজেই জানে! কিন্তু বলে, দ্যাখো, আমার বেশি টাকা একদমই চাই না। তুমি সৎ পথে থেকো, রিন্টি-সিন্টি। মানুষ হয়ে সুখী হবে জীবনে। বাবা সাঁইরামের দয়া থাকলে সবই হয়। অন্যায় পথে উপার্জন করা কোনোদিনও কোনো মানুষকে সুখ দিতে পারে না।
যোগেন এসব শোনে, আর মনে মনে হাসে এই অন্তঃপুরচারিণীর ভাবনাচিন্তার কথা ভেবে। সংসারে সে এমন কিছু টাকা দেয় না যে, টাকার গন্ধ চামেলি অথবা অন্য কোনো আত্মীয়স্বজন অথবা প্রতিবেশীদের নাকে যেতে পারে। নাকে গেলেই তারা বুঝতে পারবে যে, যোগেন কিছু লন্দ-ফন্দ করছে।
দ্বিতীয়ত, তার হাতে টাকা আছে জানলে, গাদা-গুচ্ছের আত্মীয়স্বজন বন্ধু-বান্ধব হামলে পড়বে তাদের দেখানো ভালোবাসা আর বানানো প্রয়োজন নিয়ে ধার বলে টাকা নেবে, শোধ দেবে না। তারপরেও তার শ্রাদ্ধ করবে। বলবে, শালার ঘুষের টাকা দিয়েছে, আবার এত কথা কীসের? বর্বস্য ধনক্ষয় করেছি, বেশ করেছি।
যে, দুঃস্থ আত্মীয়ার মেয়ের বিয়ে দেবে, সেই গিয়ে ভিজিলেন্সে লাগাবে। সংসার যোগেনের খুবই দেখা আছে কাছ থেকে। তাই উপরি-টাকা সে শখে, খেয়ালে, মদে এবং অনেকসময় মেয়েমানুষেও উড়িয়ে দেয়।
আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে সিগারেটে টান দিতে দিতে, এমন নানা কথা মাথার মধ্যে ভিড় করে আসে চিনুর। ড্রিঙ্ক করতে করতে যখন আড্ডা মারা যায় তখন সময় যে কী করে কেটে যায় তা ভাবা পর্যন্ত যায় না।
ইতিমধ্যে ওরা দেখল, চৌকিদারের ছেলে সাইকেল করে এসে ঢুকল সামনের গেট দিয়ে। ফিরে এল বাজার থেকে। সাইকেলের হ্যান্ডল-এ ঝোলানো টিফিন কেরিয়ারে, ওদের খাবার নিয়ে। চৌকিদারের বা তার ছেলের কাজ এসব নয়। কিন্তু ওরা তিন জনেই যখন স্পিড-মানি নিতে অভ্যস্ত, অন্য লোকের গতির ওপরেও ওরা বিলক্ষণ নজর রাখে। এবং প্রত্যেক মানুষেরই গতি কী করে বাড়াতে হয় তার আটঘাটও জানে। জানে বলেই, বাংলোতে ঢুকেই এদের প্রত্যাশার বেশি বকশিশ দিয়ে রেখেছিল এবং এ-ও আশ্বাস দিয়েছিল যে, বাংরিপোসি থেকে ফিরে যাবার আগে এসেই যা দিয়েছে, তার ডাবল দেবে।
ছেলেটি চৌকিদারের কোয়ার্টারের দিকে যেতে যেতে বলল, খাবার গরম করছি বাবু। এখনই খাবেন তো আপনারা? এখানে খাবেন, না ঘরে?
রোমান্টিক চিনু বলল, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের কবিতাতে জ্যোৎস্না দিয়ে ভাত মেখে খাওয়ার কথা পড়েছিলাম। কিন্তু নিজেরা কখনো খেয়ে দেখিনি। এমন সুযোগ কি আসবে? বল?
কালু বলল, শরীরটা কষে গেছে। কোথায় একটু আলু-পোস্ত দিয়ে কাঁচা কলাইয়ের ডাল খাব, তা নয়, তুই বললি, খিচুড়ি করতে। এই গরমের দিনে কেউ খিচুড়ি খায়!
খিচুড়ি সবসময়ই খায়। খিচুড়ি হচ্ছে সর্বজনহিতৈষী। রিলিফ ক্যাম্পের উদবাস্তুরাও খায়, আবার রাজা-মহারাজারাও খায়। তুই জানিস কতটুকু! অ্যাঁ!
কিছুক্ষণ বাদেই কাচের বাসনকোসন রেখে, খাবার গরম করে এনে টেবলে দিল চৌকিদার এবং ওরা সবাই হাত ধুয়ে এসে খেতে বসল।
খাবার দেখেই যোগেনের মাথায় রক্ত চড়ে গেল। চৌকিদারকে টাকা দিয়েছিল, খিচুড়ির সঙ্গে মুরগি ভাজা, ডিম ভাজা, আলু ভাজা, শুকনো লঙ্কা ভাজা, পেঁয়াজি-বেগুনি এই সব কিছুরই জন্যে। এই গ্রাম্য দোকানের খাদ্যসামগ্রীর তুলনাতে অনেকই টাকা দিয়েছিল তিন জন মানুষের খাবারের জন্যে। অথচ খেতে বসে দেখা গেল যে, খিচুড়ির একদিকে চাল, আর একদিকে ডাল। ভাজার মধ্যে আলু ভাজা আর একটু এঁচোড় ভাজা। জন্মেও ওরা এঁচোড় ভাজা চোখে দেখেনি। এঁচোড় যে ভেজেও খাওয়া যায়, এই প্রথম জানল। মাইক্রোস্কোপ দিয়ে দেখতে হয় এরকম। সাইজের মুরগির ডিমের পোচ, ওমলেটও নয়, এমনকী শুকনো লঙ্কা ভাজা পর্যন্ত নেই। মুরগি তো নেই-ই।
কালু বলল, এ কী! কী কী আনতে বলা হল, আর আনলে কী?
চৌকিদার বলল, তাও তো বাবু আমার ছেলে বলেই পারল। এত কিছুও এখানে পাওয়া যায় না। তা ছাড়া রাত সাড়ে নটা বাজে। আটটায় দোকান বন্ধ করে চলে যেতে চায় দোকানি। ভুজুং ভাজুং দিয়ে তা-ও তো এনেছে, নিন, এবারে গরম-গরম খেয়ে নিন।
গজগজ করতে করতে ওরা তিন জন খেতে বসল।
বলল। ঘি বা মাখন বা একটু সরষের তেলও কি হবে? খিচুড়ির সঙ্গে মেখে খাওয়ার জন্যে?
চৌকিদার বলল, এঁজ্ঞে না। আমার ঘরে কিছু নেই।
কালু বলল, লেবু হবে, লেবু?
সে বলল, এঁজ্ঞে না। চিনু স্বগতোক্তি করল, আলু আর এঁচোড়টা কোন তেলে ভেজেছে কে জানে! কী বিটকেল গন্ধ রে বাবা! নির্ঘাত জন্ডিস হবে!
চৌকিদার বলল, এখানে সব গরিব-গুরবো মানুষ, সস্তার তেলই চলে এখানে।
যোগেন কথা না বলে ভাবল, বড়ো বেশি কথা বলে এই হাড়গিলে-মার্কা চৌকিদার।
জ্যোৎস্নার বদলে ওরা রাগ দিয়ে খিচুড়িটা গলাধঃকরণ করল। অবশ্য খিচুড়ির স্বাদ তাদের মুখে ভালোই লাগল। কারণ সন্ধ্যের পর থেকে তিন জনে মিলে এক বোতল থ্রি-এক্স রাম জলের সঙ্গে তারা উদরস্থ করেছিল। রাম-এর মুখে ঘোড়ার পায়খানাও সুস্বাদু মনে হয়। কিন্তু রামজনিত কারণে বিরক্তি এবং রাগটাও তাদের যতখানি হওয়ার কথা ছিল, তার চেয়ে একটু বেশিই হল।
খাওয়ার পরে যখন হিসাব চাইল ওরা, তখন দেখা গেল যে দু-শো টাকার মধ্যে মাত্র পঁচিশ টাকা ফেরত দিল চৌকিদার।
যোগেন অবাক হয়ে বলল, তিন জনের এই খাবার এক-শো পঁচাত্তর টাকা। বলল কী হে!
চৌকিদার বলল, আঁইজ্ঞা বাবু। যে দেশে যেরকম।
চিনু বলল, এতগুলো দোকান ছিল, এখনও তো বাংলার হাতা পেরিয়ে রাস্তাতে নামলে রাস্তায় সব দোকানের আলো দেখা যাবে। এক দোকানে না পাওয়া যায় তো অন্য দোকান থেকে আনা যেত না? আর এই জিনিসের এই দাম?
সেটার নাম পনস বাবু।
শালা! এঁচোড় ভাজা না অণ্ডকোষ ভাজা! নিকুচি নিকুচি তোমার পনসে।
চৌকিদার বলল, আঁইজ্ঞা আপনাদের যদি দামের কথা বিশ্বাস না হয় বাবু কালকে দোকানে গিয়ে নিজেরাই জেনে আসবেন। আমার ছেলে কি চোর, না আমি চোর? ওসব হারামের পয়সাতে আমি খাইনা। খেটে খাই বাবু। চুরি-জোচ্চুরি কোনোদিন করিনি, করি না। ওসব শহুরে লোকদের অভ্যাস থাকে।
কালু বলল, এই! এই! মুখ সামলিয়ে কথা বলো। যা করেচ, করে, আবার কপচিয়ো না। আমরা শহুরে লোক বলে কি আমরা চোর?
চৌকিদার বলল, এঁজ্ঞে, বাবু আমি তা বলিনি। এমনি মুখে কথাটা এসে গেছিল। শহরের সব লোকই চোর, এমন কথা কি বলেছি আমি! এক মস্ত ডাক্তারবাবু কলকাতা থেকে এসেছিলেন এই বাংলোতে, গাড়ি করে। যাবার সময়ে ইনভার্টার মেসিনটাকে হোল্ডঅল-এর মধ্যে মুড়ে নিয়ে চলে গেলেন। তখন খুব লোডশেডিং হত তো। তাই নতুন ইনভার্টার লাগানো হয়েছিল। আমাদের। চাকরিই প্রায় যাবার অবস্থা হয়েছিল যে-চুরি করিনি সেই চুরির অপরাধে। যদি অন্যায় বলে থাকি বাবু তবে ক্ষমা-ঘেন্না করে দেবেন।
যে চোর, সে আর জেলে কবে গেছে! যে চুরি করেনি সেই তো গেছে চিরদিনই।
যোগেন বাথরুমে হাত ধুতে গেল। বেসিনে হাত ধুতে ধুতে হঠাৎ চোখ তুলে আয়নার দিকে তাকাল। আশ্চর্য, এমনিতে কখনো তাকায় না। আজকে কেন যে তাকাল! দেখল, তার চোখ দুটো লাল হয়েছে। চার পেগ রাম-এর কারণে। চুল উস্কোখুস্কো। ঠোঁটের কোণে খিচুড়ি লেগে আছে। ভালো করে মুখ ধুলো ও তারপরে টুথব্রাশ পেস্ট লাগিয়ে দাঁত মাজল। তারও পরে পূর্ণ দৃষ্টিতে আবার আয়নার দিকে তাকালো।
তড়িঘড়ি বাঁ-হাতটা বাঁ পকেটে ঢুকিয়ে দিয়ে একবার অনুভব করল, পাঁচশো টাকার নোটগুলোকে দেখল ঠিকঠাকই আছে। মত্ত অবস্থায় পাঞ্জাবির পকেট থেকে পার্স অনেক সময়ে পড়েটড়ে যায় তো! নোটগুলোকে অনুভব করে আশ্বস্ত হয়ে, আবার ও যখন তাকালো আয়নার দিকে, আয়নার মধ্য থেকে শুয়োরের বাচ্চা বিঠলভাই বলে উঠল, পাঁচ হাজারের কম কি হত না যোগেনবাবু?
যোগেন, যেমন তাকে বলেছিল, তেমনই সমান দাপটে তাকে আবারও দাবড়ে বলল, আমি ঘোড়াই নিচ্ছি টাকাটা! টাকাটা তো নিচ্ছে সি টি ও। তাঁকে গিয়েই না হয় বলুন, বেশি হল কি কম হল। আমাকে রেজিস্ট্রেশন করতে যে এক-শো টাকা করে দেন, সেটাই আমার রোজগার। বকশিশই বলতে পরেন। এত কথা কীসের? তা হলে নিজে দিলেই তো পারেন।
বিঠলভাই দু-হাত দু-কানে ঠেকিয়ে বলল, রাম, রাম! সে কোথা কেনো বোলছেন বাবুজি! আপনাকে বকশিস দিবো এমন বদতমীজি কি আমার হবে কোনোদিনও।
সঙ্গে সঙ্গেই আয়নার মধ্যে তরুণ আদর্শবাদী সাহিত্যপ্রেমী, সংগীতপাগল কমার্শিয়াল ট্যাক্স অফিসারের মুখটিও ফুটে উঠল।
যোগেনের বস।
তিনি হাসিমুখে বললেন, দেখবেন যোগেনবাবু। সব ঠিকঠাক আছে তো? এসব ধেঠখওঠগ ব্যাপারে আমার কোনোই ইন্টারেস্ট নেই। নেহাতই পেটের দায়ে এই চাকরিতে এসেছি। সব দেখেটেখে দেবেন। যা সই করতে বলবেন, আমি চোখ বুজে করে দেব। যোগেন বলেছিল, না স্যার, আমি থাকতে আপনার কোনো চিন্তা নেই। চোখ বন্ধ করে সই করে দেবেন।
হঠাৎই বাইরে একটা গোলমাল শুনে, তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসে দেখল, কালু মত্ত হয়ে চৌকিদারকে প্রায় মারতেই বাকি রেখেছে। বলছে, চোর হ্যায়, শ্যালা! তুম সব লোগ চোর হ্যায়।
কালু মাতাল হলেই হিন্দি বলে। টিভি-র এফেক্ট।
চোর বলাতে চৌকিদার যতখানি উত্তেজিত হল, তার দৌড়ে-আসা যুবক ছেলে আরও বেশি হল এবং বুদ্ধিমান যোগেন দেখল, কাছেরই পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্টের কোয়ার্টার থেকেও কয়েকজন মুখ বাড়িয়ে দেখছেন। তাঁদের মধ্যেও উৎসাহী কেউ কেউ এসে পড়তে পারেন।
সিচ্যুয়েশনটা সাইজ-আপ করে নিয়েই যোগেন বলল, যাও তো ভাই, তোমরা যাও। শুয়ে পড়ো তো গিয়ে। ডিশ-টিস সব নিয়ে গেছ তো? যাও ভাই, শুয়ে পড়ো। যাও। কিছু মনে কোরো না।
এই বলে যোগেন ব্যাপারটা মিটিয়ে দিয়ে বাপ-বেটাকে রওনা করিয়ে দিয়ে ফিরে এসে কালুকে বলল, চোর চোর করিস না বেশি। চোর নয়, কে রে শালা!
কালু বলল, আমি চোর নই। তুই হতে পারিস।
যোগেন বলল, সকলেই তাই ভাবে। যে আয়নাটা কিনেছি আজকে, সেটা তোকেই দিয়ে দেব। কলকাতায় ফিরে একা ঘরে পুচকি মরে যাবে মিথ্যা কথা বললে এই দিব্যি গেলে আয়নার। সামনে দাঁড়াস। আজকের দিনে চোর কে নয় রে শালা! কোন অফিসার? কোন কেরানি? কোন ব্যবসায়ী? কোন পেশাদার?
এক-শো পঁচাত্তর টাকা থেকে আর ক-টাকা মেরেছে চৌকিদারের ছেলে? তোর নিজের দিকে তাকা, তোর কাছের লোকদের দিকে তাকা। দু-পাতা ইংরিজি পড়লেই আর ভালো চাকরি করলেই চোরেরা আর দালালেরা কিছু সাধু বনে যায় না।
মেলা ভ্যাজরং-ভ্যাজরং করিস না তো। তুই শালা রাম-এর নেশাটাই দিলি নষ্ট করে। এমন। রোমান্টিক সারাউন্ডিংস! যা তুই! চৌকিদারকে বলে যদি পনস না অণ্ডকোষ ভাজা থেকে থাকে তো গিলে আয় আরও দুটো। দেখিস। বে-জোড় নম্বর খাস না আবার!
ধ্যাৎ!
চিনু বলল, যোগেনকে।