হাওয়া সাপ
(কর্নেলের জার্নাল থেকে)
হোটেল দা সি ভিউয়ের দোতলার ব্যালকনি থেকে বাতিঘরটা দেখা যায়। পাখিওড়া পথে দূরত্ব এক কিমি হতে পারে, আমার বাইনোকুলারের হিসেবে। তবে মানুষ পাখি নয়। জঙ্গল বালিয়াড়ি এবং পাথর ডিঙিয়ে সিধে পৌঁছুনো যদিও একটা অ্যাডভেঞ্চার, অন্তত আমি সেই ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত নই।
গভীর এবং ভয়াল একটা খাঁড়ির মাথায় ছোট্ট টিলার ওপর দাঁড়ানো পোড়ো ওই বাতিঘর কাদের কীর্তিস্তম্ভ পর্তুগিজ না মোগলদের, এ নিয়ে পণ্ডিতী তর্ক আছে। কিন্তু এটাই ছিল চন্দনপুর অন-সিতে পর্যটন দফতরের দ্রষ্টব্য তালিকার এক নম্বরে।
মাসদুয়েক আগে শোনা গেছে একটা বিপজ্জনক হাওয়ার কথা, স্নেকউইন্ড কোনও কোনও রাতে সমুদ্র থেকে উঠে আসে নাকি সাংঘাতিক হাওয়া, যার আনুমানিক গড়ন বিশাল সাপের মতন, এবং এঁকেবেঁকে তীক্ষ্ণ শিস দিতে দিতে ঘুরপাক খেতে খেতে বাতিঘরের ভেতর ঢুকে যায়। সিঁড়ি বেয়ে শীর্ষে উঠে ভাঙা জানালাগুলোর কোনও একটা গলিয়ে সমুদ্রে আছড়ে পড়ে ঝোড়ো প্রশ্বাসের মতো। তারপর ফুরিয়ে যায়, যদিও তার অন্তিম শ্বাসাঘাত ব্রেকারের পর ব্রেকারে কতক্ষণ ধরে সমুদ্রকে আলোড়িত করতে থাকে।
প্রাকৃতিক কেনও রহস্যময় ঘটনা গণ্য করা চলে, যেমন নাকি বার্মুডা ট্রাঙ্গল। কিন্তু নীচের খাঁড়িতে পর পর কয়েকটি এ্যাতলানো দলাপাকানো লাস রহস্যটিকে ভিন্নমাত্রা দিয়েছে। এগুলো নাকি সেই ঘাতক হাওয়ারই কীর্তিকলাপ, এবং এর বিস্ময়কর দিকটা হল, কেনই বা অত রাত্রে ওরা বাতিঘরে ঢুকেছিল। নীচের দরজার তালা প্রতিবারই ভাঙা ছিল। পাহারাদার থাকে খানিকটা দূরে তার সরকারি ঘরে। রাত দশটায় তালা এঁটে সে ফিরে যায়। যাওয়ার আগে অবশ্যই বাতিঘরের ভেতরে কেউ থেকে গেল কি না দেখে নেওয়া তার কর্তব্য।
গত ডিসেম্বরে এসে কিন্তু তেমন কোনও রহস্যময় রাতের হাওয়ার গুজব শুনিনি। তবে একটা ঘটনা মনে পড়ছিল। বিকেলে বাতিঘরটার শীর্ষে আমাকে উঠতে দেখে একদল যুবক-যুবতীর চোখে অবিশ্বাস লক্ষ করছিলাম। তারা আগেই সেখানে উঠেছিল। প্রচণ্ড ঝাঁপটানি স্বাভাবিক সামুদ্রিক হাওয়ার, যা তাদের স্থির হতে দিচ্ছিল। আমি যখন বাইনোকুলারে সমুদ্রদর্শন করছি, কানে এল তাদের হাসিতামাশা।
‘মাই গড! হি ডানা ইট্টা’! ·
ইট্টা ই হার্ডা ফার আন ওল্ড মান!
ওল্ডা ইসা গোল্ডা। হে! হি লুক্কা পাডার ক্রিসমাসা…!
দলটি নিঃসন্দেহে দক্ষিণী। বাইনোকুলার নামিয়ে তাদের দিকে ঘুরে আমার ব্যক্তিগত সৌজন্য অনুসারে জ্যাকেটের পকেট থেকে একমুঠো চকোলেট বের করে যেই বলেছি, ‘ফ্রম ফাদার ক্রিসমাস টু অল অব য়ু অন দা ইভ অব হ্যাপি ক্রিসমাস’, অমনই তারা যেন আমি সাইনাইড ক্যাপসুল দিচ্ছি এমন আতঙ্কে হুড়মুড় করে সিঁড়ি বেয়ে পালিয়ে গেল। কতক্ষণ তাদের পায়ের শব্দ ক্রমশ নিচের দিকে। আমি অপ্রস্তুত।
এবং দুঃখিত।
চন্দনপুরমের আর দলটির দেখা পাইনি। কিন্তু আমার মনে প্রশ্নের কাঁটা খচখচ করে বিঁধছিল। ওরা আমাকে কী ভেবেছিল? শুনেছি টুপি দিয়ে আমার চওড়া টাক ঢাকলে নাকি আমাকে ফাদার ক্রিসমাস দেখায়। এও শুনেছি আমার মুখে নাকি সর্বোত্তম অমায়িকতার রেখাগুলো শোভা পায়। ওরা আমায় অমন ভয় পেয়েছিল কেন? অত উঁচুতে উঠতে পেরেছি বলে কি? তবে উল্লেখযোগ্য ঘটনা, আমার সাদাদাড়ি বিশৃঙ্খলভাবে উড়ছিল, যা দৃষ্টিকটু। এখন মনে হচ্ছে, বাতিঘরটা সম্পর্কে বরাবর কোনও ভৌতিক গুজব চালু ছিল, যা আমি জানতে পারিনি। আসলে কিছু জানতে চাইলে তবেই তো জানা যায়। অজানা কিছু এমনি এমনি কারও জানা হয়ে যায় না। চোখ অনেককিছু দেখাতে পারে, জানাতে পারে না। দেখা আর জানা এক নয়।
সি ভিউ হোটেল চন্দনপুরম-অন-সির শেষ প্রান্তে। পারিপার্শ্বিক নিরিবিলি। এ কারণে এই ছোট হোটেলটাই আমার পছন্দ। কিন্তু পর্যটকরা স্বভাবে হুল্লোড়বাজ। তারা আসে ফুর্তি করতে, সমুদ্র উপলক্ষ মাত্র। পেছনকার মসৃণ ও নতুন রাস্তা সমুদ্রের সমান্তরালে দক্ষিণ পশ্চিমে এগিয়ে বাঁক নিয়েছে। বাঁকের মুখে ডাইনে একটা পুরনো বাড়ি পড়ে। বাড়ি বললে অসম্মান করা হয়, প্রাসাদ। রাজপ্রাসাদই ছিল মধ্যযুগে। হাতফেরতা হতে হতে বোম্বের এক কোটিপতি জনেশ্বরজীর (পুরো নাম জানি না) হাতে এসেছিল। তিনি মাঝে মাঝে আসতেন এবং পার্টি দিতেন। মন্ত্রী, নেতা, আমলারা আমন্ত্রিত হতেন। সারারাত আমোদমোদ খানাপিনা চলত।
গত সপ্তাহে একটা পার্টি চলছিল। সকালে বাতিঘরের নিচের খাঁড়িতে থ্যাতলানো একটা লাস পাওয়া যায়। সেটা জনেশ্বরজীর। বাতিঘরের দরজার তালা ভাঙা ছিল। কাজেই দুয়ে দুয়ে চার। আরও বিভীষিকা, আরও গুজব। প্রবল সরকারি তোলপাড়। কিন্তু রহস্যের আস্কারা হয়নি।
জনেশ্বরজীর প্রাসাদ থেকে পায়ে চলা পথ গেছে বাতিঘরের দিকে সিধে পূর্বে। বড় বড় পাথর, জঙ্গল, বালিয়াড়ি পেরিয়ে বাতিঘরের টিলা। কিন্তু চূড়ান্ত প্রশ্ন, কেন ভদ্রলোক পার্টি থেকে কখন বেরিয়ে বাতিঘরে যান এবং তালা ভেঙে ভেতরে ঢোকেন?
পাহারাদার আসলাম সে রাতে সেই তীক্ষ্ণ শিস শুনতে পেয়েছিল। ফলে পুলিশ তাকেই গ্রেপ্তার করেছে।
সি ভিউয়ে আমার প্রিয় পরিচারক কুণ্ডনাথনের বক্তব্য, নিশির ডাকের মতো সেই ঘাতক হাওয়া মানুষকে ডেকে নিয়ে যায় এবং তালাটা সে ছাড়া আর কে ভাঙবে? উল্টো ভ্রুর মতো পেঁচালো হাওয়াটা পাক খাইয়ে খাইয়ে জনেশ্বরজীকে ওপরে তোলে। তারপর জানালা গলিয়ে নীচের সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। আসলামের কী দোষ?
এখানকার সমুদ্রে সবখানেই অসংখ্য পাথর দেখেছি। বুনোহাতির পাল যেন সমুদ্রস্নানে নেমেছে। আমি দেখেছি, ব্রেকারগুলো কী মর্মান্তিক ধরনের ছেলেমানুষী করে। পাথরের পর পাথরে দাপাদাপি করতে করতে তীব্র গতিশীল হতে হতে গুঁড়ে গুঁড়ো ফেনিল আত্মবিনাশ! আঁশটে গন্ধটাও বিরক্তিকর। আর মাঝে মাঝে লক্ষকোটি শূন্য ড্রাম গড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো অভ্যন্তরীণ গর্জন। এমন সমুদ্রে স্নান করা দুঃসাহসিকতা।
সব মিলিয়ে চন্দনপুরম উপকূল সৌন্দর্য এবং বিভীষিকার আশ্চর্য সমন্বয়। এখন সেপ্টেম্বরে পর্যটক বিরল। বিকেলে বাতিঘরের দিকে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু ঘন কালো মেঘ দেখে মনে হচ্ছিল তুমুল বৃষ্টি আসন্ন। বরং সামনে বিচের দিকটায় ঘুরে আসা যায়। পর্তুগীজ বা মোগলদের তৈরি পাথরের সারবকি গুদামঘর যত জরাজীর্ণ হোক, মাথা বাঁচানোর পক্ষে যথেষ্ট। বিচ জনশূন্য। একটু পরে ঝিরঝিরে বৃষ্টি এলে বিচের মাথায় একটা পাথরের ঘরে ঢুকে পড়লাম। হঠাৎ দেখি, সামান্য দূরে বিচের ওপর প্রকাণ্ডপাথরে বসে এক যুবক আর যুবতী সামুদ্রিক বৃষ্টি সারা শরীর দিয়ে নিচ্ছে। ঈর্ষা হচ্ছিল। যৌবন প্রেমের জন্য কতকিছু করতে পারে। এ তো সামান্য।
দুপুরে ব্যালকনিতে বসে বাইনোকুলারে সম্ভবত এদেরই দেখেছিলাম। আমার এই বাইনোকুলারটি আমার বয়সকে নিয়ে কখনও-সখনও অশালীন রসিকতা করে, পরে মনে হয়েছিল, চুম্বনরত প্রেমিক প্রেমিকাকে কেন প্রয়োজন হয় অন্ধ প্রকৃতির? তা কি নিজের অর্থহীনতাকে অর্থপূর্ণ করে নিতে? সৌন্দর্যকে কিছুক্ষণের জন্য করতলগত করতে? অবশ্য প্রকৃতিতে অশ্লীল বলে কিছু নেই।
রদ্যাঁর ভাস্কর্য! তোমাদের ঠিকানা কোথায়?
সন্ধ্যায় বৃষ্টিটা থেমে গিয়েছিল। ব্যালকনিতে বসে সমুদ্রের শ্বাসপ্রশ্বাসে তৃপ্তির স্বাদ অনুভব করছিলাম। অথবা আমার অনুভূতির ভুল। এ সময় এক পেয়ালা কড়া কফির প্রতীক্ষা ছিল। কিন্তু কুণ্ডনাথন কফি আনতে বড় বেশি দেরি করছে।
দক্ষিণপশ্চিমে বাতিঘরটা অন্ধকারে ডুবে আছে। সেদিকে একটা লাল স্ফুলিঙ্গ সদ্য নিভে গেল। চোখের ভুল নয়। নিশ্চয় কোনও প্লেন মেঘের ভেতর এইমাত্র ঢুকে গেল।
কিন্তু আবার সেই লাল ফুলিঙ্গ। বাইনোকুলার হাতের কাছে বেতের টেবিলে রাখা ছিল। দ্রুত চোখে রাখলাম। কয়েক সেকেন্ড পরে আলোটা আবার নিভে গেল। বাইনোকুলারের হিসেবে টর্চের মুখের সাইজ লাল আলো। কিন্তু আলোটা স্থির ছিল। রশ্মি বিকীরণও করছিল না।
কুণ্ডনাথনের সাড়া পেয়ে বললাম, এস। দরজা খোলা আছে।
সে ব্যালকনিতে এসে টেবিলে ট্রে রাখল। বিনীতভাবে বলল, বাতি জ্বেলে দিই স্যার।
থাক। অন্ধকার আমার পছন্দ। কফির পেয়ালা তুলে নিয়ে বললাম, আচ্ছা কুণ্ডনাথন, তুমি কি কখনও রাতের দিকে বাতিঘরে লাল আলো জ্বলতে দেখেছ?
এটা নেহাতই প্রশ্ন। আমার সিদ্ধান্তকে ঝালিয়ে নেওয়ার জন্য। কিন্তু প্রশ্নটা শুনেই কুণ্ডনাথন ভীষণ চমকে উঠল। লাল আলো স্যার?
হ্যাঁ লাল আলো। জ্বলে। আবার নিভে যায়।
সে গম্ভীর মুখে চাপা স্বরে বলল, “দেখেছি স্যার! জনেশ্বরজীর লাস যেদিন পাওয়া যায়, তার আগের রাতে এই ঘরে এক আমেরিকান সায়েব মেমসায়েব ছিলেন। ওদের কফি সার্ভ করতে এসে হঠাৎ চোখে পড়ল বাতিঘরের মাথায় যেন লাল আলো জ্বলছে। তার আগেও একবার দেখেছিলাম। তারপর সকালে একজন টুরিস্টের লাস পাওয়া গেল। কাকেও বলিনি স্যার! কিন্তু আপনি কি আলো দেখেছেন?”
লোকটি বুদ্ধিমান। গত শীতে এসে ওর সঙ্গে ভাব জমিয়েছিলোম। ওর ফ্যামিলি থাকে কয়েক কিমি দূরে একটা গ্রামে। সেখানকার পাহাড়ী জঙ্গলে আমাকে কিছু অর্কিডের খোঁজ দিয়েছিল কুণ্ডনাথন।
আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে সে ভয় পাওয়া গলায় ফের বলল, “দেখে থাকলে কাল সকালে আবার একটা লাস পাওয়া যাবে।
একটু ঠাট্টার সুরে বললাম, “আজ রাতে তা হলে ওই সাংঘাতিক শিসও শোনা যাবে। কী বলো কুণ্ডনাথন?’
‘যাবে স্যার!’ কুণ্ডনাথন জোর দিয়ে বলল, ‘শিস দিতে দিতে হাওয়াটা আসবে।
‘তুমি শিসের শব্দ তো শোননি কখনও?’
নাহ্। নিজে শুনিনি। অনেকে শুনেছে। শুনেছে বলেই তো কথাটা রটেছে। সে তার কাঁধের তোয়ালেতে মুখের ঘাম মুছে বলল, আপনি কি সত্যিই আলো দেখেছেন স্যার?
‘দেখেছি।‘ কফিতে চুমুক দিয়ে একটু হেসে বললাম, তবে প্লেনের আলো হতে পারে।
‘আমিও তো স্যার প্লেনের আলো ভেবেছিলাম। কিন্তু পরদিন খাড়িতে লাস পাওয়া গেল। একবার নয়, দুবার। দুবারই খাঁড়িতে লাস।“
‘আগের লাসটা শনাক্ত হয়েছিল জানো?’
‘না স্যার। কোনও টুরিস্ট হবে।’
‘টুরিস্ট হলে নিশ্চয় কোনও হোটেলে এসে ওঠার কথা।’
কুণ্ডনাখন আস্তে বলল, ‘পুলিশের ঝামেলার ভয়ে হোটেল মালিকেরা চেপে যায়।
‘কিন্তু রেজিস্টার চেক করলে তো–’
আমার কথার ওপর সে বলল, “রেজিস্টারে চেকআউট দেখালেই হল।’
‘কুণ্ডনাথন!’ হাসতে হাসতে বললাম, “সে তোমাদের হোটেলে ওঠেনি তো?
তার মুখটা হঠাৎ কাতর হয়ে গেল। বছর পঞ্চাশ বয়স বেঁটে মোটাসোটা থলথলে গড়নের এই পরিচারকের তাগড়া কঁচাপাকা গোঁফ আছে। গোঁফটা কাঁপতে লাগল। কিছু গোপন কথা চেপে থাকতে বাধ্য হয়েছে, অথচ বলার জন্য মনে ছটফটানি আছে, এটা সেই সঙ্কটাপন্ন ভাব।
সাহস দেবার ভঙ্গিতে ফের বললাম, ‘উঠেছিল?’
কুণ্ডনাথন বড়বড় চোখে তাকিয়ে থাকল। একটু পরে বলল, ‘আমি তাকে যেন দেখেছিলাম।
‘তুমি তার নাম ঠিকানা, চেক-ইনের তারিখ এনে দিলে বকশিস পাবে কুণ্ডনাথন।’
মাথাটা একটু দুলিয়ে সে সেলাম ঠুকে বেরিয়ে গেল। কফিতে চুমুক দিয়ে নিভে যাওয়া চুরুটটা জ্বালিয়ে নিলাম। সামুদ্রিক হাওয়া ব্যালকনিকে ছুঁয়েছুঁয়ে খেলছে। সামনে সোজাসুজি তাকালে সমুদ্র ঝাউবনের আড়ালে পড়ে যায়। একটু বাঁদিকে ভাঙাচোরা পাথুরে একতলা মোগলাই বা পর্তুগিজ ঘরগুলো দাঁড়িয়ে আছে। এখানে অনেকটা ফাঁকা। সেই ফাঁক দিয়ে সমুদ্র দেখা যায়। রাতের বিচে কোনও আলো নেই। আমার ধারণা বা ইচ্ছে হল, সেই প্রেমিক প্রেমিকা বিচে বসে থাক অন্ধকারে। পরিব্যাপ্ত প্রাকৃতিক স্বাধীনতা সেখানে। আমি তাদের অবাধে খেলতে দিলাম।
আসলে নিজে বৃদ্ধ বলে যৌবনকে অনেক বেশি দাম দিয়ে থাকি।…
.
এই বে-মরসুমে চন্দনপুরম-অন-সিতে আমার ছুটে আসার পিছনে সুনির্দিষ্ট একটা উদ্দেশ্য ছিল, যেটা এবার বলা দরকার। গতমাসের শেষাশেষি এখানে কেন্দ্রীয় শক্তিমন্ত্রকের উদ্যোগে সমুদ্রতরঙ্গ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা শীর্ষক একটি সেমিনার হয়। আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সেমিনার। কাজেই ঝাঁকেঝকে তথাকথিত মিডিয়াম্যানদের আবির্ভাব স্বাভাবিকই ছিল। তাদের মধ্যে ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকের সংখ্যা কম ছিল না। সেমিনার শেষে সবাই যে-যার ঠিকানায় ফিরে যায়। ফেরেনি শুধু একজন। সুমিত্র গুহরায়। ছাব্বিশ বছর বয়স। রোগা, ফর্সা, উচ্চতা আন্দাজ পাঁচফুট তিন ইঞ্চি। কয়েকটা ইংরেজি বাংলা হিন্দি পত্রিকায় পুলিশের মিসিং স্কোয়াডের পক্ষ থেকে ছবি ছাপানো হয়েছিল। টিভিতেও ছবিটি দেখেছি। কিন্তু এ যাবৎ খোঁজ মেলেনি। চন্দনপুরম পুলিসও হদিস দিতে পারেনি। অথচ এখানে এসে শুনছি, বাতিঘরের খাঁড়িতে পাঁচটা লাসের খবর!
আশ্চর্য ব্যাপার, স্থানীয় পুলিস কিংবা চন্দনপুরম ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (সি ডি এ) এ নিয়ে মাথা ঘামায়নি সেটা বোঝা যায়, সেই খবর কাগজে বেরোয়নি। এখানে পৌঁছুনোর পর কুণ্ডনাথনের মুখে আমি খবরটা পেয়েছি। সি ভিউ হোটেলের ম্যানেজার গোপালকৃষ্ণনের বক্তব্য, খবর চেপে রাখার পিছনে পর্যটন দফতরের হাত আছে। পর্যটন অর্থনীতি ঘা খাবে!
পর্যটন-অর্থনীতি! আজকাল শব্দ জুড়ে জুড়ে অদ্ভুত সব টার্ম চালু করা আমলাতন্ত্রের আরামকেদারা বিলাস। নিছক বিলাস বলা ভুল হবে। এর পিছনে অর্থনীতি (!) আছে। কমিশনভোগী দালাল রাজনীতিওয়ালা, কন্ট্রাক্টার আর আমলাতন্ত্রের একটা দৃষ্টচক্র অধুনা দেশজুড়ে লুঠ চালাচ্ছে।
তো সুমিত্র গুহরায় ফোটোফিচারিস্ট হিসেবে বেশ নাম করেছিল। কলকাতার সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকায় তার কিছু সচিত্র ফিচার আমি পড়েছিলাম, যেগুলি প্রায় অ্যাডভেঞ্চারারের মানসিকতার লক্ষণ এবং প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে তথ্যসংগ্রহ। এ থেকে সুমিত্র সম্পর্কে আমার একটা স্পষ্ট ধারণা গড়ে উঠেছিল। তাই সত্যসেবক পত্রিকার সাংবাদিক আমার বিশেষ প্রীতিভাজন জয়ন্ত চৌধুরী তার নিখোঁজ বন্ধু সম্পর্কে আমাকে অনুরোধ করামাত্র রাজি হয়েছিলাম। জয়ন্তকে সঙ্গে নিইনি সতর্কতার দরুন। তাছাড়া তার স্বভাবে হঠকারিতার ঝোঁক আছে।
সকালে এখানে পৌঁছুনোর পর থানা এবং সি ডি এ আপিসে যাব ভেবেছিলাম। কিন্তু পরে মনে হয়েছিল, সেটা হঠকারিতাই হবে। এ ধরনের কেসে তাড়াহুড়ো করা ঠিক নয়। আজকাল বোঝাই যায় না, কোথায় কোন স্বার্থ ওঁত পেতে আছে। এক বৃদ্ধ রিটায়ার্ড কর্নেল নীলাদ্রি সরকার কেনই বা খাঁড়ির লাস বা সমুদ্রতরঙ্গ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন’-সংক্রান্ত সেমিনার নিয়ে খোঁজখবর করতে এসেছেন? একটা স্বাভাবিক সন্দেহের উদ্রেক হবে এবং আমার পথ নিরঙ্কুশ হবে না।
সি-ভিউয়ের ম্যানেজার গোপালকৃষ্ণন অবশ্য গতি ডিসেম্বরেই আমাকে বাতিকগ্রস্ত সাব্যস্ত করেছিলেন। এটাই আমার বাড়তি সুবিধা। সমুদ্রতরঙ্গ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাপারটা নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছি। শুনেছি, বাতিঘরের নিচের খাঁড়িতেই একটা প্রজেক্ট হবে। সাইট সিলেকশন হয়ে গেছে নাকি। গোপালকৃষ্ণন বিষয়টি বোঝেন। খাড়িতে একটা কংক্রিটের ঘর তৈরি হবে, যার একদিকে তলার অংশ খোলা থাকবে। সমুদ্রের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে তীব্রবেগে এসে ফাঁক দিয়ে ঢুকে একটা টারবাইনকে ধাক্কা দেবে ক্রমাগত। টারবাইন ঘুরবে। ঘরের মাথায় থাকবে জেনারেটর। গোপালকৃষ্ণনের মতে, কস্টলি প্রডাকশন। মিসইউজা লাট্টা অব মানি অ্যান্ড লেবার।
‘বাতিঘরে সাংঘাতিক হাওয়ার উপদ্রব সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?’
‘হাঃ হাঃ! দ্যাটা স্নেক-উইন্ডা?’
‘নিছক গুজব?’
‘জানি না। তবে বাতিঘরটা নিয়ে আগের অনেক ভুতুড়ে গল্প শুনেছি। এবারকারটা নতুন। তবে
বলুন!
‘এখানে সমুদ্র খুব আদিম। সভ্যভব্য নয়। শুধু টুরিস্টরা নয়, আমরা সবাই সভ্যভব্য সমুদ্র দেখতে ভালবাসি। সে সমুদ্রে স্নান করা যায়, হুল্লোড় করা যায়। নেড়েচেড়ে দেখা যায়, স্বাদ নেওয়া যায় এমন সমুদ্রই মানুষের প্রিয়। এখানকার সমুদ্রকে আকর্ষণীয় বলা চলে না কর্নেল সরকার। এখানকার একমাত্র আকর্ষণ ওই বাতিঘর। উঁচুতে উঠে অনেক দূর পর্যন্ত সমুদ্রের চেহারা দেখার সুযোগ দেয় বাতিঘরটা। পূর্ব উপকূলে আর কোথায় আপনি সমুদ্রের অতটা বিশালতা দেখতে পাবেন, চিন্তা করুন!’
‘শুনলাম, বাতিঘর সম্প্রতি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।’
‘হাঃ হাঃ! জনেশ্বরজীর আত্মার সম্মানে। সেমিনারের জন্য উনি তিন লাখ টাকা দান করেছিলেন। চক্ষুলজ্জা কর্নেল সরকার। প্রজেক্টের কন্ট্রাক্ট, জনেশ্বরজীই পেতেন, আমি বাজি রেখে বলতে পারি।’
সম্ভবত গোপালকৃষ্ণ সেই ধরনের লোক, যাঁরা সব ঘটনার যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা দিতে চান। তবে বুঝতে পেরেছি স্নেকউইন্ড অর্থাৎ কিনা ঘাতক সামুদ্রিক সর্পিল হাওয়া সম্পর্কে উনি কোনও ব্যাখ্যা খুঁজে বের করতে পারেননি এখনও। আবার এ-ও বুঝেছি, বাতিঘরটা নিয়ে বরাবর ভুতুড়ে গুজব ছিল…।
.
রাত নটায় নিচের ডাইনিং হলে ডিনার খেতে গেলাম।
ডাইনিং হলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পাঁচজন ডিনার-প্রত্যাশী বসেছিলেন। এক প্রৌঢ়। দম্পতি–সম্ভবত গোয়ানিজ, একজন বেঁটে গাঁট্টাগোট্টা মধ্যবয়সী সম্ভবত তামিল, একজন রাগী চেহারার যুবকসম্ভবত বাঙালি এবং একজন শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয়। এরা সবাই বোর্ডার কি না জানি না। কারণ এখানে রুচির কারণে বাইরের লোকেরাও মহার্ঘ খাদ্য খেতে আসে। লাঞ্চের সময় ডাইনিং হলে আমি একা ছিলাম। কারণ ততক্ষণে লাঞ্চপর্ব শেষ। আমার ফিরতে দেরি হয়েছিল এবং তখন প্রায় আড়াইটে বেজে গিয়েছিল।
কোনার দিকে জানালার পাশের টেবিলে বসলাম। পিছনের দরজায় ঝোলানো পর্দার ফাঁকে রিসেপশন এবং লাউঞ্জের কিছু অংশ দেখা যাচ্ছিল। রিসেপশন কাউন্টারে মোটামুটি সুন্দরী অ্যাংলো যুবতী (ডিসেম্বরে একে দেখিনি) হেসে হেসে কথা বলছিল কারও সঙ্গে। একটু ঘুরে দেখে নিলাম কাউন্টারের টেবিলে বাঁহাত কনুই পর্যন্ত বিছিয়ে ঝুঁকে আছেন ম্যানেজার গোপালকৃষ্ণন্ন। লাউঞ্জে সোফায় বসে পত্রিকা পড়ছেন এক ভদ্রলোক। পরনে টাইসুট। কোনও কোম্পানি এক্সিকিউটিভ না হয়ে যান না।
কুণ্ডনাথন এগিয়ে এল আমাকে দেখে। আপনার ডিনার ওপরে পাঠিয়ে দিতাম স্যার!
আস্তে বললাম, ‘এঁরা সবাই কি বোর্ডার?’
হ্যাঁ স্যার। আজকাল রাতে এতদূরে কেউ ডিনার খেতে আসে না।
স্নেকউইন্ডের ভয়ে নাকি?
কুণ্ডনাথন হাসল না। তাকে উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল। বলল, সন্ধ্যার পর রাস্তায় লোক দেখা যায় না।
এই সময় যে রাগী চেহারার যুবকটিকে বাঙালি ভেবেছিলাম, সে দক্ষিণী ভাষায় কুণ্ডনাথনের উদ্দেশে কিছু বলল। কুণ্ডনাথন তার কাছে চলে গেল। মনে মনে হাসলাম! তা হলে সত্যিই দেখা এবং জানা এক জিনিস নয়। অথচ আমার সম্পর্কে চালু গুজব, আমি নাকি অন্তর্যামীর প্রায় একটি পার্থিব সংস্করণ এবং আমার দৃষ্টি নাকি গামা রশ্মির মতো ইস্পাতের প্রাচীরভেদী!
খাওয়া শেষ করেছি, এমন সময় আমার বুক কাঁপিয়ে বিচে দেখা সেই প্রেমিক-প্রেমিকার আবির্ভাব। দুটো টেবিলের ওধারে ওরা মুখোমুখি বসল। এমন চঞ্চল হাসিখুশি যৌবন এদেশে কদাচিৎ দেখেছি। ওরা বাংলায় কথা বলছিল চাপা স্বরে। এও আমার বিহ্বলতার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু প্রশ্ন হল, ওরা কি স্নেকউইন্ড সম্পর্কে কিছু শোনেনি? সাবলীল সৌন্দর্যের সঙ্গে ঈষৎ কুণ্ঠার পরিশীলিত মিশ্রণ আমাদের প্রাচ্য যৌবনের নাকি সাধারণ লক্ষণ। সেই মিশ্রণ দেখছি না। বেপরোয়া উদ্দামতা চন্দনপুরমের বন্য আদিম সমুদ্রের কাছেই কি ওরা সংগ্রহ করেছে? কিন্তু হনিমুন করতে চন্দনপুরমকে বেছে নিল কেন, যে সমুদ্রে স্নান করা প্রায় অসম্ভব? মেয়েটির সিঁথিতে সিঁদুর আছে কি না কম আলোর জন্য দেখা যাচ্ছিল না। ন্যাপকিনে হাত মুছে চুরুট ধরালাম। কুণ্ডনাথন এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, কফি ঘরে পৌঁছে দেবে, না কি এখানে বসেই খাব।
কুণ্ডনাথন ভাঙাচোরা ইংরেজি বলে। সঠিক শব্দটি খুঁজে না পেলে হিন্দি বসিয়ে দেয়। ওর প্রশ্নের জবাবে ইচ্ছে করেই বাংলায় বললাম, ওপরে পাঠিয়ে দিও।
স্যার?
এবার ইংরেজিতে বললাম। কুণ্ডনাথন সরে গেল। কিন্তু আমার তীর লক্ষ্যভেদ করেছিল। ওরা দুজনেই ঘুরে আমার দিকে তাকাল। দৃষ্টিতে ঈষৎ বিস্ময় ছিল। অনেকে আমাকে বিদেশী কিংবা কোনও সময়ে পাদ্রিবাবা বলে ভুল করে। বিদেশি পাদ্রিরা আবার চমৎকার বাংলাও বলেন। কিন্তু ওদের বিস্ময় সে ধরনের নয়। হকচকিয়ে ওঠার মতো।
যবকটি দৃষ্টি সরিয়ে নিল। কিন্তু তার হাবভাবে আর সেই স্বাভাবিকতা লক্ষ্য করছিলাম না। যুবতীটি মাঝে মাঝে চোখ তুলে আমাকে দেখে নিচ্ছিল। কাজেই সিদ্ধান্ত করলাম, হনিমুন নয়। অর্থাৎ ওরা দম্পতি নয়, খাঁটি প্রেমিক প্রেমিকা। সিঁদুর এক্ষেত্রে ধর্তব্য নয়। কিন্তু চন্দনপুরম বেছে নিল কেন ওরা?
আমি উঠে দাঁড়াতেই যুবকটি আমার দিকে তাকাল। এই সুযোগটা নিলাম। ‘কলকাতা থেকে?
হ্যাঁ।
কোথায় উঠেছেন?
কাছেই।
একটু হেসে বললাম, এক কিলোমিটারের মধ্যে কোনও হোটেল নেই। কাজেই নিশ্চয় কাছাকাছি নয়।
সো হোয়াট?
এই ফুঁসে ওঠা আশা করিনি। দেখা এবং জানায় সত্যিই দুস্তর ফারাক। ছোটখাটো আট্টহাসি হেসে বললাম, শুভ মধুচন্দ্রিমা!
তারপর পিছু না ফিরে লাউঞ্জে গিয়ে ঢুকলাম।
গোপলকৃষ্ণন নেই। সম্ভবত নিজের ঘরে গেছেন। রিসেপশনিস্ট মেয়েটি ‘হাই’ করল। তার সম্ভাষণে সাড়া দিয়ে সোফায় বসে পত্রিকাপড়া ভদ্রলোকের দিকে তাকালাম। উনি আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। এবার ঘড়ি দেখলেন। কারও প্রতীক্ষা করছেন হয়তো। হাট করে খোলা বড় দরজার বাইরে পোর্টিকোর নিচে একটা গাড়ি দেখা যাচ্ছিল।
কার্পেটমোড়া সিঁড়ি বেয়ে ঘরে ফিরলাম। দরজা খোলাই রইল। ডিনারের পর এক পেয়ালা কফি আমার চাই-ই। ব্যালকনিতে বসে অন্ধকারে বাতিঘরটার দিকে তাকিয়ে চুরুট টানতে থাকলাম। আবার সেই লাল আলো, ঘাতক হাওয়া এবং খাঁড়িতে লাস পড়ার সম্ভাবনা আমার মগজে ঘুরপাক খাচ্ছিল।
কিছুক্ষণ পরে কুণ্ডনাথনের সাড়া এল। সে জানে, তার জন্য দরজা খুলে রাখি। কিন্তু লোকটি অতিশয় ভদ্র। ক্রিশ্চান মিশনারি স্কুলে কবছর পড়েছিল। বিলিতি আদবকায়দা জানে।
টেবিলে কফি রেখে সে উর্দির পকেট থেকে ভাঁজ করা একটা কাগজ দিল। আস্তে বলল, মেরি রিসেপশনে নতুন এসেছে। তারিখটা আমার মনে ছিল। ২৭ অগাস্ট। সন্ধ্যা ৬টায় চেক-ইন করেছিল। মেরিকে বলামাত্র রেজিস্টার দেখে লিখে দিল। ওকে বলেছি আপনার দরকার আছে।
কাগজটা খুলে নিরাশ হয়েছিলাম। সুমিত্র গুহরায় নয়। এ কে দাশগুপ্ত এবং ঠিকানা কলকাতারই। বললাম, তুমি লাসটা দেখেছিলে?
হ্যাঁ স্যার। আমিই দেখে এসে বললাম ম্যানেজার সায়েবকে। উনি বললেন, চেপে যাও। সকাল ছটায় চেক আউট দেখিয়ে দিলেন রেজিস্টারে। সাড়ে ৬টায় একটা বাস ছাড়ে। চন্দনপুরম স্টেশনে নটায় কলকাতার ট্রেন। পাক্কা হিসেব।
চেহারা মনে পড়ছে?
রোগা মতো।
গায়ের রঙ?
ফর্সা।
সঙ্গে ক্যামেরা ছিল?
ছিল। একটা স্যুটকেসও ছিল।
উত্তেজনা চাপতে চুপচাপ কফিতে চুমুক দিলাম। সুমিত্র হোটেল দা শার্কে। উঠেছিল ২২ অগাস্ট সকাল নটায়। সেখান থেকে চেক আউট করে ২৭ আগস্ট বিকেল তিনটেয় চন্দনপুরম স্টেশনে আপ মাদ্রাজ মেল পৌঁছয় সন্ধ্যা ছটায়। কাজেই পুলিশের তদন্তে কোনও গণ্ডোগোল নেই। বিশেষ করে তার ফেরার টিকিট ছিল ওই ট্রেনেরই। রেলে তদন্ত করে পুলিশ জেনেছে সুমিত্র গুহরায় নির্দিষ্ট বগির নির্দিষ্ট বার্থেই ফিরে গিয়েছিল।
কিন্তু দেখা যাচ্ছে :
১। কোনও কারণে সে ওই ট্রেনে কলকাতা যায়নি।
২। তার টিকিটে অন্য কেউ গিয়েছিল। টিকিট কি সে কাউকে বেচে দিয়েছিল? নাকি তার টিকিট চুরি করা হয়েছিল?
৩। সে কোনও কারণে নাম বদলে সি ভিউয়ে উঠেছিল এবং সকালে তার এ্যালানো লাস খাঁড়িতে পাওয়া যায়। শনাক্ত করার মতো কোনও জিনিস লাসের সঙ্গে ছিল না। কিন্তু শুধু কুণ্ডনাথন তাকে চিনতে পেরেছিল।
পয়েন্টগুলো মাথার রেখে বললাম, তুমি সকালে খাড়িতে কেন গিয়েছিলে কুণ্ডনাথন?
সে ভড়কে গিয়ে বলল, “অনেকে গিয়েছিল স্যার!
তার চোখে চোখ রেখে বললাম, তুমি কি তাকে রাত্রে হোটেল থেকে বেরোতে দেখেছিলে?
ডিনার খেয়েই উনি বেরিয়ে যান।
কিছু বলে গিয়েছিল তোমাকে বা অন্য কাউকে?
না স্যার! হোটেল তো চব্বিশঘণ্টা খোলা থাকে। আমরা শিফট ডিউটি করি।
ওর ক্যামেরা, স্যুটকেস বা অন্য জিনিসপত্র কী হল?
কুণ্ডনাথন বিব্রতভাবে তাকাল। করজোড়ে বলল, আমি সামান্য টাকার চাকরি করি স্যার। কোনও বিপদ হলে আমার পরিবার সমুদ্রে ভেসে যাবে।
তোমার কোনও ক্ষতি হয়, এমন কিছু করব না কুণ্ডনাথন! আমাকে আশা করি তুমি ভালো জানো। তুমি বুদ্ধিমান কুণ্ডনাথন! তোমার ভালভাবে বেঁচে থাকার জন্য চাই শুধু খানিকটা সাহস। আর দেখ, আমি একজন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসার। তুমি আমার ওপর ভরসা রাখতে পারো!
এবার কুণ্ডনাথন এদিক-ওদিক তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, সব ম্যানেজারসায়েব নিয়ে গিয়েছিলেন। হয়তো নষ্ট করে ফেলেছেন।
কথাটা বলেই সে চলে গেল। উঠে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলাম। ঘরে শুধু টেবিলবাতিটা জ্বালিয়ে রেখে ব্যালকনিতে এসে বসলাম। ওপরে তিনটে সুইট এবং তিনটে ব্যালকনি। আমারটা পূর্বমুখী, অন্যদুটো দক্ষিণমুখী। তাই দেখা যায় না। তা ছাড়া আমার এই সুইটের পরই সিঁড়ি। অন্য দুটি সুইট সিঁড়ির উল্টো দিকে। একটা করিডর হয়ে পৌঁছুতে হয় সে-দুটিতে।
তাহলে নিখোঁজ সুমিত্র গুহরায়ের খোঁজ পাওয়া গেল। এর পরের ধাপ গোপালকৃষ্ণনের কাছে পৌঁছানো। লোকটা তো আপাতদৃষ্টে অতিশয় ভদ্র। যুক্তিবাদীও বটে। কিন্তু সুমিতের ব্যাপারে নিছক পুলিশের ঝামেলা এড়াতেই ব্যাপারটা চেপে যাওয়া এবং তার জিনিসপত্র গাপ করা সঙ্গত মনে হচ্ছে না। ঝামেলাটা কী আর হত? একজন বোর্ডার বেঘোরে মারা পড়তেই পারে। কোনও হোটেল নিজস্ব এলাকার বাইরে বোর্ডারের কিছু ঘটলে তার জন্য দায়ী হতে পারে না। আইনতই পারে না।
কাজেই গোপালকৃষ্ণনের আচরণ খুবই সন্দেহজনক।
কিন্তু আগবাড়িয়ে তাকে চার্জ করতে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে। একটা ব্যাপার স্পষ্ট। রিসেপশনিস্ট মেরির সঙ্গে কুণ্ডনাথনের বোঝাঁপড়া আছে। ম্যানেজারের সঙ্গে মেরির হেসে হেসে কথাবার্তা বলা অবশ্য দেখেছি। সেটা চাকরির স্বার্থেই বলা যায়। কুণ্ডনাথনের সঙ্গে মেরির বোঝাঁপড়া না থাকলে নাম ঠিকানাটা আমি পেতাম না। কিন্তু নাম-ঠিকানার বদলে কুণ্ডনাথনকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলেই তো সুমিত্রকে আবিষ্কার করতে পারতাম।
একটু ভুল করে ফেলেছি। মেরির সঙ্গে কুণ্ডনাথনের বোঝাঁপড়া থাক বা না-ই থাক, মেরিকে আমার তদন্তের সুতোয় জড়িয়ে ফেলেছি। এর কোনও দরকারই ছিল না।
চুরুটটা নিভে গিয়েছিল। লাইটার জ্বেলে ধরিয়ে নিলাম। নাহ! হয়তো ঠিক করেছি। গোপালকৃষ্ণনের কানে ব্যাপারটা দৈবাৎ গেলে তার প্রতিক্রিয়া বোঝা যাবে। সে নিজে থেকেই আমার সঙ্গে বোঝাঁপড়ায় আসতে চাইবে। দেখা যাক।
বাইরে গাড়ির শব্দ শোনা গেল। উঠে গিয়ে পশ্চিমের জানালায় উঁকি দিলাম। পোর্টিকো থেকে সেই গাড়িটা বেরিয়ে যাচ্ছে। গেট পেরিয়েই চন্দনপুরমের দিকে চলে গেল খুবই জোরে।…
.
ঘুম ভেঙে গেল। দরজায় কেউ টোকা দিচ্ছিল। টেবিলবাতি জ্বেলে ঘড়ি দেখলাম। বারোটা কুড়ি। বললাম কে?
আমি কুণ্ডনাথন স্যার!
কী ব্যাপার কুণ্ডনাথন?
এত রাতে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত স্যার। কিন্তু এই ভদ্রমহিলার জন্য আপনার ঘুম ভাঙাতে হল।
কোথায় কোন ক্রুর স্বার্থ ওঁত পেতে আছে ভেবে আগে রিভলভারটা হাতে নিলাম। তারপর ঘরের আলো জ্বেলে দিলাম। আই হোলে চোখ রেখে দেখি কাঁচুমাচু মুখে কুণ্ডনাথন দাঁড়িয়ে আছে এবং তার পেছনে সেই প্রেমিকা।
তবু ফাঁদের কথা মাথায় রেখেই দরজা খুলে সরে এলাম। আমার হাতে রিভলভার দেখে কুণ্ডনাথন হকচকিয়ে গেল। স্যার! এই ভদ্রমহিলা আপনার সাহায্য চান।
কী সাহায্য?
ভদ্রমহিলা ঘরে ঢুকে আমার পা ছুঁতে ঝুঁকল। আপনি আমার বাবার মতো। আমাকে বাঁচান। আমি ভীষণ বিপদে পড়েছি। সে কান্না ও শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে কথা বলছিল। আমাকে লাউঞ্জে বসিয়ে রেখে ও চলে গেল। এখনও ফিরছে না। আমার ভয় করছে। আপনি কলকাতা থেকে এসেছেন! তাই ওকে বললাম আপনার কাছে নিয়ে যেতে।
বসো। আগে শান্তভাবে বসো।
ওকে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিলাম। কুণ্ডনাথনকে বললাম, ম্যানেজারসায়েব কি বাড়ি চলে গেছেন?
সে বলল, রাত সাড়ে দশটায় গুপ্টাসায়েবের গাড়িতে চলে গেছেন।
কে গুপ্টাসায়েব?
মাদ্রাজে থাকেন। জনেশ্বরজীর কারবারের পার্টনার। মাঝেমাঝে আসেন এই হোটেলে। ম্যানেজার সায়েবের সঙ্গে বন্ধুত্ব আছে।
গাড়িতে আর কে গেল দেখেছ?
তাকে চিনি না। চুস্ত পাঞ্জাবি পরে এসেছিলেন। উনি এলে ওঁর সঙ্গে গুপ্টাসায়েব আর ম্যানেজারসায়েব বেরিয়ে গেলেন।
ঠিক আছে। তুমি এস। দরকার হলে তোমাকে ডাকব।
পালিয়ে বাঁচার ভঙ্গিতে কুণ্ডনাথন সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল। আমার হাতে রিভলভার দেখার আশা করেনি সে। আমিও অবশ্য একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি। কিন্তু যে-কোনও অবস্থার জন্য তৈরি থাকা ভাল। এ একটা ফাঁদ হতেও পারত।
দরজা বন্ধ করে যুবতীর মুখের দিকে তাকালাম। প্রেমিকার সৌন্দর্য ছত্রখান। আমার চোখ কবির নয় যে বিষাদময়ী প্রতিমার সৌন্দর্য দেখতে পাব! তা ছাড়া ওই মুখে বিষাদ নয়, উদ্বেগ আর আতঙ্ক নখের আঁচড় কেটেছে। বলালম, কী নাম তোমার?
দীপা।
দীপা–কী?
দীপা মিত্র।
তোমার সঙ্গীর নাম কী?
দীপার ঠোঁট কেঁপে উঠল। একটু ইতস্তত করে ভাঙা গলায় বলল, অমল…দাশগুপ্ত।
এক মিনিট। বলে টেবিলে রাখা কিটব্যাগের চেন টেনে কুণ্ডনাথনের দেওয়া কাগজটা বের করলাম। ওর সামনে খুলে বললাম, দেখ তো, চেনো মনে হয় নাকি?
দীপা নাম ঠিকানাটা পড়ে দেখেই চমকে উঠল। এ তো অমলেরই নাম ঠিকানা!
বাই এনি চান্স তুমি সুমিত্র গুহরায় নামে কাকেও চেনো?
চিনতাম। দীপা নড়ে উঠল। শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, অমলের বন্ধু ছিল। আমার কয়েকটা ছবি তুলে দিয়েছিল। কাগজে তার ছবি দেখেছিলাম। তার কী হয়েছিল, অমল জানে। এখান থেকে অমলকে সুমিত্র একটা চিঠি লিখেছিল।
কী লিখেছিল?
আমি পড়িনি। অমল বলছিল, সুমিত্রকে নাকি কারা ফঁদে ফেলে মার্ডার করেছে।
তোমরা এখানে কবে এসেছ?
গতকাল সকালে।
কোথায় উঠেছ?
অমলের এক ম্যাড্রাসি বন্ধুর একটা কটেজ আছে, সেখানে।
অমল বলেনি কেন এখানে আসছে?
জায়গাটা নাকি দেখার মতো। খুব নির্জন বিচ। দীপা রুমালে চোখ মুছে আস্তে বলল, আমার ভয় হচ্ছে অমল আর বেঁচে নেই। হয়তো সুমিত্রের মতো তাকেও কারা ট্র্যাপ করেছে। কর্নেলসায়েব! আপনি একটা কিছু করুন।
আমাকে তুমি চেনো?
চিনতাম না। হোটেলের বেয়ারা ভদ্রলোক বলল, আপনার নাম কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। আপনি আমাকে সাহায্য করতে পারেন।
তুমি লাউঞ্জ থেকে থানায় ফোন করলে না কেন?
দীপা মুখ নামিয়ে বলল, আমরা লিগ্যালি স্বামী-স্ত্রী নই। পুলিশ যদি–
বুঝেছি। উত্তেজনা এলে চুরুট তা প্রশমিত করে। চুরুট ধরিয়ে বললাম, অমল কোথায় যাচ্ছে বলে যায়নি?
কিচ্ছু না। বলে গেল, ঘণ্টাখানেক পরেই ফিরবে।
কোথায় যাচ্ছে তুমি জানতে ইনসিস্ট করোনি কেন?
আমার মাথায় আসেনি। ভাবলাম পত্রিকা পড়ে একঘণ্টা কাটিয়ে দেব।
তুমি কী কর? একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে স্টেনো-টাইপিস্ট।
বাড়িতে কে কে আছেন?
বাবা বেঁচে নেই। মা আমার কাছে থাকে। দাদা রাঁচিতে থাকে। দীপা আবার ছটফটিয়ে বলল, কর্নেলসায়েব! আপনি একটু খোঁজ নিন প্লিজ! আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, ওর কোনও বিপদ হয়েছে।
এখানে আসার পর অমলের সঙ্গে কাকেও মিট করতে দেখেছ?
নাহ্। এখানে কারও সঙ্গে ওর চেনাজানা আছে বলে মনে হয়নি। ওর ম্যাড্রাসি বন্ধু তো কলকাতায় থাকে। তার কাছে কটেজের চাবি নিয়ে এসেছি আমরা!
অমল কী করে?
একটা অ্যাড এজেন্সিতে চাকরি করে।
উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, তুমি নিচে লাউঞ্জে গিয়ে অপেক্ষা করো। আমি যাচ্ছি। একটা কথা। কেউ বাইরে যেতে ডাকলে যাবে না। এমন কি কুণ্ডনাথন ডাকলেও না। দু মিনিটের মধ্যে আমি যাচ্ছি!
দীপা বেরিয়ে গেলে পোশাক বদলে নিলাম। রেনকোট, টুপি চড়িয়ে এবং অস্ত্রটি বুকের কাছে সহজ আয়ত্তে রেখে বের হলাম। দরজা লক করে আস্তেসুস্থে নেমে গেলাম। লাউঞ্জে দীপা দাঁড়িয়ে ছিল। রিসেপশনে মেরির। বদলে এখন আরুলাস্থান। কুণ্ডনাথনকে দেখতে পেলাম না। আরুলাস্থান সম্ভাষণ করে বলল, খারাপ কিছু কি ঘটেছে স্যার? পুলিশকে জানিয়ে দিন না।
স্মার্ট ছোকরা আরুলাস্থানকে মার্কিন ব্ল্যাক বলে ভুল হতে পারে। গলায় সোনার চেনে ক্রস ঝুলছে। গায়ে লাল গেঞ্জি, পরনে ব্যাগি প্যান্ট, ঝকড়মাকড় কেঁকড়া চুল। ওকে বললাম, খারাপ কিছু ঘটার কথা ভাবছ কেন তুমি?
মেরি বলছিল এই মহিলার স্বামী নিখোঁজ হয়েছেন। সে চোখ নাচিয়ে বলল, অ্যাণ্ড য়ু নো দা স্নেকউইন্ড স্যার! আরুলাস্থানের মুখে সবসময় হাসি মেখে থাকে। কাউন্টারে যেন দাঁড়িয়ে নেই, নাচছে।
দীপাকে বললাম, চলো! আগে তোমাকে কটেজে পৌঁছে দিই। তোমাদের কটেজটা একবার দেখা দরকার।
যেতে যেতে দীপা বলল, কটেজে অমল যায়নি। গেলে একা কেন যাবে?
কোনও কথা বললাম না। নির্জন রাস্তায় দূরে দূরে দাঁড়ানো ল্যাম্পপোস্ট। থেকে নিষ্প্রভ আলো ছড়াচ্ছে। দুধারে বসতি নেই। টিলা, বালিয়াড়ি, কেয়াঝোপ আর বড় বড় পাথরের চাঁই ঘেঁষে ঘন উঁচু নিচু জঙ্গল। সতর্ক দৃষ্টি রেখে হাঁটছিলাম। কিছুক্ষণ পরে রাস্তা বাঁদিকে বেঁকে গেল। সেদিকটায় বসতি। ডানদিকে খোয়া-ঢাকা সংকীর্ণ রাস্তা গেছে সমুদ্রের সমান্তরালে। বাঁকের মুখে দীপা বলল, এই দিকে।
খোয়াঢাকা রাস্তাটা উত্রাই। নিচু টিলার ঢেউখেলানো বিস্তার। কোথাও নগ্ন, কোথাও জঙ্গলে ঢাকা। ছোট-ছোট বাংলোবাড়ি এখানে-ওখানে এলোমেলো দাঁড়িয়ে আছে। একখানে দীপা ডাইনে ঘুরল। সামনে কাঠের বেড়া এবং গেট। গেটের আগড় সরিয়ে টালিঢাকা ছোট্ট বাংলোর সামনে দাঁড়ালাম। সমুদ্রের শব্দ। কানে এল এতক্ষণে। বারান্দায় কম পাওয়ারের বালব জ্বলছিল। দীপা দরজার তালা খুলে দিল। দেখলাম ভেতরেও আলো জ্বালানো আছে। দীপা একটা। জানালা খুলে বলল, এখান থেকে সমুদ্র দেখা যায়।
এ অবস্থায় তার মুখে সমুদ্রের সংবাদ অপ্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু আমার তত্ত্ব অনুসারে যৌবনের উপাদানগুলি এরকমই হয়। নিজস্ব ধর্ম মেনে চলে। দীপা বলল, এটা বসার ঘর। ওটা বেডরুম! ওদিকে কিচেন আছে। আমরা অবশ্য রান্না করিনি।
বেডরুমটাও ছোট। ডাবলবেড একটা খাট, দেওয়ালে ঝোলানো ডিমালো আয়না, তার নিচে একটা ছোট্ট টেবিলে কিছু প্রসাধনসামগ্রী। কোনার দিকে একটা ওয়ার্ডরোব।
দীপা ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়েছিল। বললাম, হাতে সময় কম। তোমরা সঙ্গে নিশ্চয় স্যুটকেস এনেছ?
স্যুটকেস আর ওই কিটব্যাগটা।
স্যুটকেসের চাবি তোমার কাছে আছে?
দীপা চোখে প্রশ্ন রেখে বলল, আছে।
ততক্ষণে বিছানার কোনায় পড়ে থাকা কিটব্যাগটা আমি খুলেছি। ময়লা জামাকাপড় ছাড়া কিছু নেই। দুদিকের চেন খুলে শূন্য দেখলাম।
আপনি কী খুঁজছেন?
এবার তোমার হ্যান্ডব্যাগটা দেখতে চাই।
দীপা কথা না বলে তার কালো হ্যান্ডব্যাগটা দিল। তিনটে একশো টাকার নোট, কয়েকটা দশ, পাঁচ, দুই, এক টাকার নোট এবং খুচরো পয়সা দেখতে পেলাম দুদিকের দুটো খোপে। মেয়েদের হ্যান্ডব্যাগে অনেকগুলো খোপ থাকে কেন, আমার কাছে দুর্ভেদ্য রহস্য। দুটো রেলের টিকিট বেরুল। জার্নির তারিখ আগামীকাল সকালের ট্রেনের। বললাম, তোমাদের সকালে কলকাতা ফেরার কথা তা হলে?
দীপা চোখে প্রশ্ন এবং বিস্ময় রেখে বলল, হু। কিন্তু আপনি কী খুঁজছেন?
জানি না। স্যুটকেসটা খোলা।
স্যুটকেসে দুজনেরই জামাকাপড় ঠাসা। যত দ্রুত সম্ভব দেখে নিয়ে ওপরকার চেন টেনে হাত ভরলাম। অমলের অ্যাড এজেন্সির নেমকার্ড বেরুল অনেকগুলো। একটা নিলাম। তারপর একেবারে কোনা থেকে বেরুল একটা ইনল্যান্ড লেটার। দেখেই বুঝলাম, যা খুঁজছিলাম পেয়ে গেছি। সুমিত্রের চিঠি। ২৭ আগস্ট লেখা।
চিঠিটায় চোখ বুলিয়ে পকেটে ভরে বললাম, তুমি এখানেই থাকো। আমার ধারণা, এখানে থাকাই তোমার পক্ষে নিরাপদ। কিন্তু সাবধান! আমি কিংবা অমল না ডাকলে দরজা খুলো না। জানলা দিয়ে আগে দেখে নিও। আর কোন হামলা হলে প্রচণ্ড চিৎকার-চেঁচামেচি করবে। আশপাশের কটেজ থেকে লোকেরা বেরিয়ে আসবে। তবে আমার বিশ্বাস, তত কিছু ঘটবে না।
দীপা শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, আমার ভয় করছে। বরং আপনার হোটেলে–
না। সাহসী হও। বলেই আমি বেরিয়ে এলাম।..
জানতাম, যে টিলার ওপর এইসব কটেজ করেছেন বিত্তবান মানুষেরা, তার নিচে বিচ নেই। ওদিকটায় গভীর খাঁড়ি। সমুদ্রের ধাক্কায় টিলার পাথুরে পাঁজর বেরিয়ে পড়েছে। বাঁকের মুখে পৌঁছে দেখলাম, সি-ভিউয়ের দিক থেকে একটা গাড়ি আসছে। একটা কেয়াঝোঁপের আড়ালে গেলাম। গাড়িটা চলে গেল চন্দনপুরম বসতির দিকে। এই গাড়িটাই হোটেলের পোর্টিকোতে দেখেছিলাম। সম্ভবত গোপালকৃষ্ণনকে হোটেলে ফেরত দিয়ে এল।
তারপর আচমকা ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হল। বিরক্তিকর বৃষ্টি। প্রায় পৌনে এককিমি চলার পর বাঁদিকে বিচে নামার রাস্তা। এখান একে সি-ভিউয়ের আলো দেখা যাচ্ছিল। সংকীর্ণ পাথরের ইটে ঢাকা রাস্তার দুধারে কয়েকটা মাচা, যেখানে শঙ্খমালা, কড়ি, শঙ্খ এইসব সামুদ্রিক নিদর্শন বিক্রি করে স্থানীয় আদিবাসীরা। একটা মাত্র চায়ের দোকান, সিগারেট এবং পানও বিক্রি হয়– সেটার দেয়াল কাঠের, চাল টিনের তৈরি। এটা পুরনো বিচ এবং এর আয়ু নাকি কমে আসছে। বিচের ঢালু গড়ন দেখে সেটা অনুমান করা চলে। সামান্য দূরে সেই মোগল কি পর্তুগিজদের তৈরি পাথরের সারবন্দি পোড়ো ঘর। নতুন বিচ উত্তরে দু কিমি দূরে। চন্দনপুরম বসতি এলাকার কাছাকাছি। কিন্তু সে বিচের দৈর্ঘ্য বড়জোর পাঁচশো মিটার এবং অজস্র পাথরে ধাক্কা খেয়ে ফেনিল সমুদ্রচূর্ণ মানুষজনকে মুহুর্মুহু ভিজিয়ে দেয়। বিব্রত করে।
এর কারণ, নতুন বিচে সামুদ্রিক হাওয়াকে বাধা দেওয়ার মতো কোনও আড়াল নেই, যা আছে পুরনো বিচে। পাথরের ঘরগুলো হাওয়াকে প্রতিহত করে। তাই মরসুমে যা কিছু ভিড়, তা পুরনো বিচেই। কিন্তু আমলাতন্ত্রের ফাইলে পুরনো বিচের মৃত্যুসংবাদ ঘোষিত হয়ে গেছে। অতএব সি ডি এ এখানে টাকা ঢালতে চাননি। বিদ্যুৎ দেওয়া হয়নি। চায়ের দোকানটিতে হ্যাঁজাগবাতি জ্বলতে দেখেছি। এখন রাত সওয়া একটায় দোকানটা বন্ধ। টর্চের আলো পায়ের কাছে ফেলে দোকানটার গা ঘেঁষে একটু দাঁড়িয়ে রইলাম।
বৃষ্টিটা থেমে গেল। তখন বিচে নেমে গেলাম। হঠাৎ মনে হল, কী বিস্ময়কর আমার আচরণ। বাতিঘরে পাখিওড়া পথে এগিয়ে যাওয়ার অ্যাডভেঞ্চার একটা কঠিন ঝুঁকি এবং সেই ঝুঁকি নিতে কদাচ চাইনি। কিন্তু এখন আমি ঝুঁকি নিচ্ছি।
আমার স্বভাব, ঝুঁকি নিলে আর পিছু হটি না। হটলাম না। পাথরের ঘরগুলো যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে উঁচু বালিয়াড়িতে ঝাউবনে উঠে গেলাম। সি-ভিউ চোখে পড়ল।
এবার সত্যিকার অ্যাডভেঞ্চার শুরু হল। দিনের আলোয় বাইনোকুলারে যেমনটা দেখেছি, তেমনটি নয়। বড় বড় পাথর, দুর্ভেদ্য শরবন এবং বালিয়াড়ি, দুর্গম জঙ্গলে ঢাকা ছোট-ছোট টিলা। টিলার নিচে গভীর খাঁড়িতে সমুদ্র ভয়ঙ্কর গর্জন করছে।
কিন্তু আর পিছিয়ে আসা অসম্ভব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে, বার্মাফ্রন্টে একবার দলছড়া হয়ে এমনি অবস্থায় পড়েছিলাম। কিন্তু তখন আমি তরুণ।
আবার একটা বালিয়াড়ি এল সামনে। কালো পাথর ঢুকে আছে বালির ভেতর। এসে সুবিধেই হল ওপরে ওঠার। আকাশে নক্ষত্র দেখা যাচ্ছে না। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে দক্ষিণ এবং পূর্বে সমুদ্রের শিয়রে। একটু বিশ্রাম নিতে হল। সেইসময় পূর্বে অনেক দূরে সমুদ্রের বুকে আলো জ্বলতে-নিভতে দেখলাম। বাইনোকুলার চোখে রাখতেই একটা জাহাজ দেখা গেল। ঢেউয়ের আড়ালে ঢাকা পড়ছে বারবার। জাহাজুটা যে দূরের সমুদ্রে সরে যাচ্ছে, তাতে ভুল নেই।
জাহাজ নিয়ে এখন চিন্তার মানে হয় না। আবার বিদ্যুৎ চমক দিল। এতক্ষণে সামান্য দূরে বাতিঘরটা দেখতে পেলাম। স্বস্তির শ্বাস পড়ল। বালিয়াড়ি থেকে নেমে পাথর আর জঙ্গলের ভেতর দিয়ে বাতিঘরের টিলার নিচে পৌঁছলাম।
কিছুক্ষণ গুঁড়ি মেরে বসে চারিদিকটা খুঁটিয়ে দেখছিলাম। ঘন ঘন বিদ্যুৎ ঝলসে ওঠায় পারিপার্শ্বিক স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। কোনও লোক নেই। সন্দেহজনক কোনও শব্দ শুনছি না, শুধু খাঁড়ির নিচের সামুদ্রিক গর্জন ছাড়া।
বাতিঘরের দরজা দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে। কারণ ওদিকেই টিলায় ওঠার রাস্তা। রাস্তা বেয়ে ওঠার সময় হাওয়ার তোলপাড় ছিল। দরজার কয়েকমিটার দূরে পৌঁছে টর্চের আলো ফেললাম। চমকে উঠলাম। দরজা হাট করে খোলা।
সবে পা বাড়িয়েছি, হঠাৎ খাঁড়ির দিক থেকে একটা জোরালো হাওয়া এসে ধাক্কা দিল। টাল সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। মনে হল, হাওয়াটা আমাকে টানছে। উপুড় হয়ে পড়ে হাতের কাছে একটা ঝোঁপের গোড়া চেপে ধরলাম। টর্চটাসুদ্ধ চেপে ধরেছিলাম। আমার রেনকোট খুলে যাওয়ার উপক্রম। তারপরই শুনলাম বাতিঘরের ভেতর তীক্ষ্ণ শিসের শব্দ! শি..ই…ই…ই…চি…ই..ই…ই….
শব্দটা যেন সত্যি ঘুরে ঘুরে ওপরে উঠে যাচ্ছে। বাতিঘরের লোহার কপাটও ঝনঝন শব্দে কাঁপছে। শিসের শব্দে কানে সুচ ঢুকে যাচ্ছিল। টুপিটা উড়ে গেছে কখন। মাথা কাত করে অন্য হাতে কানে আঙুল গুঁজে দিলাম। টুসুদ্ধ হাতটা ঝোঁপের গোঁড়া আঁকড়ে রইল। কারণ ওই হাতটা ছাড়লেই আমাকে হাওয়াটা টেনে নিয়ে গিয়ে বাতিঘরে ঢোকাবে।
কোনও সাংঘাতিক ঘটনা যত দীর্ঘক্ষণ বলে মনে হয়, আসলে ততক্ষণ ধরে ঘটে না। এই ঘটনাটা পাঁচ মিনিট, না তিন মিনিট, নাকি এক মিনিট ধরে ঘটল বলতে পারব না। তারপর সত্যি যেন শ্বাস ছাড়ার মতো শব্দ ভেসে এল। সমুদ্রের দিক থেকে। অজস্র বাষ্পীয় রেলইঞ্জিনের একসঙ্গে বাষ্প ছাড়ার মতো আওয়াজ।
তাহলে ‘স্নেকউইন্ড’ আমার দেখা হয়ে গেল! অদ্ভুত এবং বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা।
এবং হয়তো আমি দৈবাৎ বেঁচে গেলাম। বাতিঘরে ঢুকে যাওয়ার পর ভুতুড়ে হাওয়াটা এসে পড়লে আমাকে নিশ্চয় ঘুরপাক খাইয়ে ওপরে তুলত এবং জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিত।
ঘড়ি দেখলাম। রাত দুটো পঁয়ত্রিশ। টর্চের আলোয় টুপিটা সেই ঝোঁপের গায়ে আটকানো অবস্থায় খুঁজে পেলাম। এবার উঠে দাঁড়ানো উচিত। চুরুট টানাও খুব দরকার। যা দেখলাম, তা না বুঝে চলে যাওয়া উচিত হবে না।
বাতিঘরের লোহার কপাট ভেতরের দিকে খোলে। টর্চের আলোয় দেখলাম, প্রকাণ্ড একটা তালার মাথার দিকটা কাটা এবং গলে গেছে কিছুটা। অ্যাসিটিলিন দিয়ে কাটা। অতএব মানুষেরই কাজ। তার মানে ‘স্নেকউইন্ড’ দরজা ভাঙে না। সম্ভবত বাতিঘরের গায়ের ফোকরগুলো দিয়ে ঢোকে। এখন দরজা খোলা পেয়েছিল।
সাবধানে টর্চের আলো ফেলে ভেতরে ঢুকে গেলাম। ঘোরাল লোহার সিঁড়িতে কাদাবালি আর ঘাসের কুটোয় কি জুতোর ছাপ? আতস কাঁচে ছাপগুলো পরীক্ষা করলাম। কারা ওপরে উঠেছিল কিছুক্ষণ আগে। অনেকগুলো ধাপ ওঠার পর কালো পাথরের দেয়ালে রক্তের ছাপ ছোখে পড়ল। রক্তটা টাটকা।
তাহলে কি কেউ একটু আগে ভেতরে ঢুকেছিল এবং স্নেকউইন্ড ধাক্কা মেরে তাকে রক্তাক্ত করতে করতে ওপরে তুলে ছুঁড়ে ফেলল? আমার যুক্তিবোধ ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছিল। শরীর এবং মেধার পার্থক্য আমাকে বাঁচাল। উঠতে কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু পিছু হটা আমার ধাতে নেই। প্রায় ষাট ফুট উঠতে জায়গায়-জায়গায় তেমনই জুতোর দাগ এবং রক্তের ছোপ দেখতে পেলাম। ওপরতলায় প্রচণ্ড হাওয়ার তোলপাড়। কিছুক্ষণ বসে দম নেওয়ার পর পূর্বের জানলার ফাঁকে চাপচাপ রক্ত দেখে শিউরে উঠলাম। রক্ত সবে জমাট বাঁধতে শুরু করেছে।
তারপর চোখে পড়ল মেঝেয় দেয়ালের নিচের খাঁজে আটকে আছে এক টুকরো ছেঁড়া দড়ি। কেউইন্ডের টানেই সম্ভবত খাঁজে আটকে গেছে। ইঞ্চি পাঁচেক রক্তাক্ত দড়ির একদিকটায় গিট আছে।
বৃত্তাকার পাথরের কুণ্ডের মতো একটা জায়গায় পর্তুগিজ বা মোগলরা আগুন জ্বালিয়ে রাখত। সেখানে প্রায় এক মিটার গর্ত। ইন্ধন বোঝাই করার জায়গা। বাঁহাতের দুটো আঙুল চিমটের মতো করে দড়িটা তুলে সেখানে ফেলে দিলাম। কেন এমন করলাম জানি না। অনেক সময় নিজের অজ্ঞাতসারে, সম্ভবত ইনটুইশন এ ধরনের কাজ করায়।
এরপর আপাতত এখানে কিছু করার ছিল না। জুতোর ছোপগুলো আগের মতো এড়িয়ে নিচে নামলাম। তারপর বেরিয়ে গেলাম। ক্লান্তিতে পাথর শরীর টেনে-টেনে মাতালের মতো টলতে-টলতে হাঁটছিলাম।
এবার সোজা রাস্তায় ফিরে যাওয়াই উচিত। জনেশ্বরজীর সেই প্রাসাদপুরিতে আলো জ্বলছে। সেখানে রাস্তা এড়িয়ে গুঁড়ি মেরে ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে কিছুটা চলার পর পিচরাস্তায় উঠলাম। এ রাস্তা গেছে সি-ভিউয়ের সামনে দিয়ে। জনেশ্বরজীর বাড়ি থেকে কিছুদূর অন্তর একটা করে লাইট পোস্ট। সেই হাল্কা আলোয় আমাকে দানব বা পিশাচ দেখানো স্বাভাবিক। সি-ভিউয়ে পৌঁছুলাম রাত তিনটেয়।
দুজন নাইটগার্ডকে ঝিমোতে দেখছিলাম পোর্টিকোর সিঁড়িতে। গেট বন্ধ। প্রচণ্ড ক্লান্তিতে গলার ভেতরটা শুকনো। জিভ ব্লটিং পেপার। গেটের রড ধরে ঝাঁকুনি দিলাম। নিশুতি রাতের বিরক্তিকর এই শব্দ ওদের একজনকে জাগিয়ে দিল। সে আস্তে-সুস্থে উঠে দাঁড়াল এবং এগিয়ে এল। ঘুমঘুম চোখে সেলাম ঠুকে গেট খুলে দিল।
আরুলাস্থান রিসেপশন কাউন্টারে দুই পা তুলে দিয়ে ঘুমোচ্ছিল। টেবিলে শব্দ করে তাকে জাগালাম। সে কয়েক সেকেন্ড আমার দিকে তাকিয়ে থাকার পর পা নামিয়ে একটু হাসল। এনিথিং রং স্যার?
নাহ্। এক গ্লাস জল খাওয়াতে পারো?
কেন নয়? বলে সে বেরিয়ে গেল ডাইনিংয়ের দিকে।
কাছাকাছি একটা চেয়ারে বসে পড়লাম। আরুলাস্থান জল এনে দিল। জল খেয়ে ধাতস্থ হলাম। এখন এক পেয়ালা কফির দরকার ছিল। কিন্তু রাত তিনটেয় সেটা আশা না করাই ভাল। আরুলাস্থান আমার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে বললাম, ম্যানেজার-সায়েব ফিরেছেন?
না। উনি সকালে ফিরবেন বলে গেছেন।
চুরুট ধরিয়ে চুপচাপ টানতে থাকলাম। কী করা উচিত ভাবছিলাম। থানায় ফোন করে জানাব কি? সুমিত্রের মতোই নির্বোধ অমল ফাঁদে পা দিয়ে বেঘোরে মারা পড়েছে। নাকি সেই ঘাতক হাওয়া–কেউইন্ডের পাল্লায় পড়েছিল।
আরুলাস্থান কাউন্টারে ঢুকে বলল, আপনি কি ওদের ওখানে ছিলেন? কী ঘটেছে?
কাদের ওখানে?
সেই স্বামী-স্ত্রী। সে হাসল। অদ্ভুত লোক। আপনি যাওয়ার ঘণ্টাদেড়েক পরে এলেন।
চমকে উঠলাম। কে?
ভদ্রমহিলার স্বামী। আমি বললাম আপনি ওঁর স্ত্রীকে নিয়ে ওঁকে খুঁজতে বেরিয়েছেন। তখন চলে গেলেন ভদ্রলোক।
তুমি ঠিক চিনতে পেরেছিলে?
আরুলাস্থান একটু অবাক হয়ে বলল, চেনার প্রশ্ন ওঠে না। ভদ্রলোক এসে জিজ্ঞেস করলেন লাউঞ্জে ওঁর স্ত্রীর অপেক্ষা করার কথা ছিল। কাজেই আমি সব বললাম। তাছাড়া কুণ্ডনাথন আমাদের কথাবার্তা শুনে বেরিয়ে এসেছিল। সে চেনে। কারণ সে ডিনার সার্ভ করেছিল ওঁদের। কিন্তু আপনি তাহলে কোথায় ছিলেন?
ভদ্রমহিলাকে তাদের কটেজে পৌঁছে দিয়ে বিচে বসে ছিলাম।
আপনাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। প্রায় সওয়া তিনটে বাজে। আমার মনে হয়, এবার আপনার শুতে যাওয়া উচিত।
উঠে দাঁড়ালাম। তখনও মনে প্রশ্ন, থানায় ফোন করে বাতিঘরে রক্তের খবর দেব কিনা।
স্যার!
বলো।
ব্রান্ডি আছে। দেব কি? আপনাকে সত্যি বড্ড ক্লান্ত দেখাচ্ছে।
ধন্যবাদ। বলে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলাম। বাতিঘরে রক্ত অমলের নয়, এটা আপাতত আমার স্বস্তির কারণ। কিন্তু অমল কোথায় গিয়েছিল?…
.
যত রাত জাগি না কেন, ভোরে ঘুম ভাঙবেই। পাঁচটা থেকে ছটার মধ্যে যে কোনও সময়। আজ ছটায় ভেঙেছিল। সুইচ টিপে কুণ্ডনাথনকে ডাকলাম। ব্যালকনিতে গিয়ে দেখি আকাশ নির্মেঘ এবং নীলাভ। বাইনোকুলারে বাতিঘরটা দেখে নিলাম। প্রশ্নটা ধাক্কা দিল কার রক্ত?
কুণ্ডনাথন কফি নিয়ে হাজির হল। বলল, আপনি যাওয়ার পর সেই ভদ্রলোক
তাকে থামিয়ে বললাম, জানি। তো খাঁড়িতে কি লাস পড়েছে কুণ্ডনাথন?
সে বিব্রতভাবে বলল, জানি না স্যার। একটু বেলা হলে জানা যাবে।
কীভাবে জানা যাবে? এর আগে কীভাবে জানা গিয়েছিল?
জনেশ্বরজীর দারোয়ান বা কোনও কর্মচারী বাতিঘরের দিকে টাট্টিতে যায়। দরজা খোলা দেখলে, তাদের সন্দেহ হয়। আসলাম দরজা খোলে নটা থেকে দশটার মধ্যে।
এখন তো আসলাম পুলিসের হাজতে!
হ্যাঁ স্যার!
ঠিক আছে। তুমি এস। আমি কফি খেয়ে বেরুব।
কুণ্ডনাথন সেলাম ঠুকে চলে যাচ্ছিল। তাকে ডাকলাম। আচ্ছা কুণ্ডনাথন! তুমি বলেছিলে বর্ষার পর এই এলাকায় জগন্নাথ প্রজাপতি দেখা যায়!
কুণ্ডনাথনের আড়ষ্টতা কেটে গেল। অনেক স্যার! অনেক দেখা যায়।
তুমি বলেছিলে জগন্নাথ প্রজাপতি ধরা যায় না। আমি কিন্তু ধরব।
সে একটু হাসল। দেবতাকে ধরা যায় না স্যার! ধরলে পাপ হয়।
জীবনে একটু-আধটু পাপ করে দেখা ভাল কুণ্ডনাথন!
আমি তা ঠিক মনে করি না স্যার!
কিন্তু কুণ্ডনাথন, আমরা কি না-জেনেও কোন পাপ করতে পারি না?
আমি সামান্য লোক। আমি মনে করি, না-জেনে পাপ করলে ভগবান শাস্তি দেন না!
কুণ্ডনাথন! না জেনে আগুনে হাত দিলে কি হাত পোড়ে না!
সে ভয়ার্ত চোখে তাকাল। তারপর কোনও কথা না বলে বেরিয়ে গেল। বুঝলাম, স্পর্শকাতর জায়গায় খোঁচা দিয়েছি।
কিছুক্ষণ পরে গলায় ক্যামেরা, বাইনোকুলার এবং পিঠে কিব্যাগে প্রজাপতিধরা নেটের স্টিক খুঁজে বেরিয়ে গেলাম। লাউঞ্জ ফাঁকা। রিসেপশনে একজন অচেনা মধ্যবয়সী লোক ডিউটিতে এসেছে। সে খাতায় কিছু লেখালিখিতে ব্যস্ত।
বেরিয়ে কটেজের দিকে হাঁটছিলাম। রাস্তায় শর্টস পরা এবং হাতের চেনে বাঁধা অ্যালসেশিয়ান নিয়ে এক বৃদ্ধকে দেখলাম। চন্দনপুরমের দিক থেকে দুটি মেয়ে এবং একটি ছেলে জগিং করে আসছে দক্ষিণী চেহারা। আমার পাশ দিয়ে তিনটি তাজা যৌবন চলে গেল। ঘুরে তাদের কিছুক্ষণ দেখলাম। ওরা কি। বাতিঘর পর্যন্ত যাবে?
কটেজ এলাকা এখনও শুনশান স্তব্ধ। ঘাসে গাছপালায় ভিজে কোমল ধূসরতা। এখনও প্রজাপতিদের বেরুনোর সময় হয়নি। রাতে দেখা কটেজটা খুঁজে বের করতে একটু সময় লাগল। কিন্তু কাঠের গেটে তালা। ঘরের দরজায় তালা।
ভোরেই চলে গেছে? এখনও স্টেশনে গেলে হয়তো দেখা পাওয়া যাবে। কিন্তু এভাবে চলে যাওয়া কেন! বড় লজ্জার কারণ আমার পক্ষে। আমাকে ডিটেকটিভ ভেবেছে। ডিটেকটিভ কথাটা আমার বরাবর অসহ্য। একটা গালাগালিই গণ্য করি, কেন না বিচ্ছিরি ‘টিকটিকি’ টার্মের উৎস ওই কথাটাই।
তবে তুরুপের তাস এখন আমার হাতে। সুমিত্রের সেই চিঠিটা!
শেষপ্রান্তে একটা চওড়া পাথরে দাঁড়িয়ে রইলাম। সূর্যোদয় দেখার জন্য। নিচে খাঁড়ি। পূর্বে সমুদ্রের শিয়রে লালচে মেঘ। মেঘ ক্ৰমে ঘন হচ্ছিল। সমুদ্র জুড়ে চাপ চাপ রক্ততরঙ্গ। অসহ্য লাগল। ফিরে এলাম।
হোটেলের আগে বাঁদিকে পুরনো বিচের পথ ধরলাম। মাচাগুলো এখনও খালি। চায়ের সেই দোকানটা সবে খুলেছে। একটা বাচ্চা আঁচ দেবার যোগাড় করছে। একজন বুড়ো আদিবাসী বেঞ্চে বসে আছে। দোকানদার ধুনো জ্বেলে ধ্যান করছে।
বিচে সেই দৌড়বাজ ছেলেমেয়েদের দেখতে পেলাম। বালিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। বালি মাখছে। একটি মেয়ে দুঃসাহসে সমুদ্র ধারণ করতে বুক পেতে দাঁড়িয়ে গেল। একটা বড় ব্রেকার ভাঙচুর হয়ে এসে তাকে ফেলে দিল। বাকি দুজন হেসে অস্থির হল। এবার তিনজনেই বুক পেতে দাঁড়াল।
এখন সমুদ্র গলানো সোনার। কালো মেঘগুলো উঠে আসছে সমুদ্র পেরিয়ে। ক্যামেরায় টেলিলেন্স এঁটে তিনটি যৌবনের সমুদ্রকে আহ্বানের ছবি নিলাম। তারপর বিচে নেমে গতরাতের মতো অ্যাডভেঞ্চারে গেলাম।
এখন অবাক লাগছিল নিজের নৈশ স্পর্ধা স্মরণ করে। কী দুঃসাহস না দেখিয়েছি! পাথর, টিলা, জঙ্গল এবং বালিয়াড়ির দুর্গমতা তো বটেই, সাপের কথা ভাবিইনি! যেখানে-যেখানে আমার জুতোর ছাপ পড়েছিল বালি বা বালিমেশানো মাটিতে, সাবধানে মুছে বা তার ওপর পা ফেলে-ফেলে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। তারপর হঠাৎ মনে হল, এই সতর্কতা অকারণ। শেষ বালিয়াড়ির মাথায় উঠতেই সামনে একটু দূর বাতিঘরের নিচের খাড়ি দেখা গেল। আমার হাত কাঁপছিল। বাইনোকুলাব তন্নতন্ন খুঁজছিলাম কোনও ক্ষতবিক্ষত লাস।
কোনও লাস নেই। বাতিঘরের ওপরতলাটা দেখতে বাইনোকুলার তুলেছি, অমনি একটা লোক ধরা পড়ল বাইনোকুলারে। তার একটা পাশ দেখা যাচ্ছিল। তার চোখেও বাইনোকুলার। সে দূরের সমুদ্রে কিছু দেখছে। কোনও টুরিস্ট? ঝটপট ক্যামেরায় টেলিলেন্স পরিয়ে তার ছবি নিলাম।
বালিয়াড়ি থেকে পিছু হটে নেমে একটা বড় পাথরের আড়ালে গুঁড়ি মেরে বসলাম। এখান থেকে সমুদ্র এবং বাতিঘরের শীর্ষ দেখা যায়। কিন্তু সমুদ্রের প্রকাণ্ড ব্রেকারগুলো বাধা। কাজেই বাতিঘরের লোকটাকে দেখতে থাকলাম। একটু পরে সে অদৃশ্য হয়ে গেল। গেল তো গেলই।
সময় কাটতে চায় না। কিছুক্ষণের জন্য রোদ ইচ্ছেমতো সবকিছুকে ছুঁয়ে থাকার পর সমুদ্রের দিকে সরে গেল। তারপর ঘন মেঘের ছায়া এসে পড়ল। বৃষ্টির ভয় করছিলাম। কিন্তু বৃষ্টিটা এল না। সেই লোকটা বেরিয়ে এল বাতিঘরের দরজা দিয়ে। অমনি আবার তার কয়েকটা ছবি তুললাম। সে এদিক ওদিক দেখে নিয়ে ওপাশের জঙ্গলে ঢাকা টিলার আড়ালে চলে গেল। কিন্তু তাকে চিনে ফেলেছি। সেই গুপ্টাসায়েব!
আর লুকোচুরি না করে বাতিঘরের নিচের রাস্তায় চলে গেলাম। সেখান থেকে জনেশ্বরজীর বাড়ির গেট পর্যন্ত পরিষ্কার দেখা যায়। গুপ্টাসায়েব জঙ্গল ঘুরে যে পিচরাস্তায় পৌঁছেছিলেন তা বোঝা গেল। পিচরাস্তার বাঁক ঘুরে আস্তে সুস্থে এসে জনেশ্বরজীর বাড়িতে ঢুকে গেলেন।
আমার মাথায় এখনও অন্য চিন্তা। বাতিঘরের পশ্চিমদিকে চলে গেলাম। তারপর বাইনোকুলারে নিচের খাঁড়িতে এতক্ষণে সত্যিই একটা লাস দেখতে পেলাম। কোনও অনিবার্যতার জন্য প্রস্তুত থাকলে বুদ্ধিসুদ্ধি টাল খায় না। খুঁটিয়ে দেখছিলাম, ফেনিল জলে দুলে দুলে ওঠা এবং পাথরের খাঁজে মাঝেমাঝে আটকে যাওয়া লাসের মাথাটা ঘেঁৎলে চ্যাপ্টা হয়ে গেছে। পরনে পোশাক বলতে কিছু নেই। প্রকৃতি থেকে যেভাবে মানুষ আসে, সেইভাবেই ফিরে গিয়েছে।
আর এখানে থাকা ঠিক নয়। গুপ্টারও বাইনোকুলার আছে। ঝোপঝাড়ে মিথ্যে প্রজাপতি ধরার ভঙ্গিতে নেট খুলে কিছুক্ষণ ছুটোছুটি করার পর সোজা পিচরাস্তায় উঠলাম। তারপর মাঝেমাঝে আকাশে বুনোহাঁসের আগাম দু’একটা ঝক খোঁজার চেষ্টা করতে করতে সি-ভিউয়ের দিকে হাঁটতে থাকলাম।
তাহলে কুণ্ডনাথের কথাটা ঠিকই ছিল। বাতিঘরে লাল আলো দেখা গেলেই নিচের খাড়িতে লাস পড়া অনিবার্য।…
বেলা নটায় কুণ্ডনাথন আমার ঘরে ব্রেকফাস্ট নিয়ে এল। বিনীতভাবে সে জানতে চাইল, আমি জগন্নাথ প্রজাপতি ধরতে পেরেছি কি না। আমি মাথা নাড়ায় সে একটু হাসল। চেষ্টাকৃত হাসি। গতরাত থেকে তার মুখে উদ্বেগ, অস্বস্তি এবং কাতরতার গাঢ় ছাপ লেগে আছে। সে কি বাতিঘরে আমার লাল আলো দেখার কথায় কুসংস্কারাচ্ছন্ন একজন সাধারণ লোকের প্রতিক্রিয়া?
সে চলে যেতে ঘুরেছে, তাকে ডাকলাম, কুণ্ডনাথন!
সে তাকাল শুধু। আমার কণ্ঠস্বরে সন্দিগ্ধ হয়েছিল। বোবা চাউনি চোখে।
ম্যানেজারসায়েব ফিরেছেন?
না স্যার?
কাল রাতে গুপ্টাসায়েবের গাড়ি এদিক থেকে ফিরে যেতে দেখেছিলাম।
কুণ্ডনাথন একটু পরে বলল, গাড়ির শব্দ দুবার শুনেছি। একবার চন্দনপুরম থেকে এসে হোটেলের সামনে দিয়ে যাওয়ার, আর একবার কিছুক্ষণ পরে আবার চন্দনপুরের দিকে যাওয়ার। রাতে আমার ঘুম হয়নি। আপনি ফিরলেন, তখনও জেগে ছিলাম।
তার মানে, গুপ্টাসায়েব, ম্যানেজারসায়েব এবং সেই চুস্ত পাঞ্জাবিপরা ভদ্রলোক প্রথমে চন্দনপুরমে যান। ম্যানেজারসায়েবের গত রাতে বাড়িতে থাকার কথা শুনলাম। আরুলাস্থান বা মেরিকে বলে গিয়েছিলেন। তাহলে বোঝা যাচ্ছে, গুপ্টা এবং সেই ভদ্রলোক জনেশ্বরজীর বাড়িতে ফেরেন। তারপর গাড়ি ফের চন্দনপুরমে গিয়েছিল। সম্ভবত সেই ভদ্রলোককে পৌঁছে দিতেই গিয়েছিল। এরপর গাড়িটা ফিরে আসার কথা।
নিশ্চয় ফিরেছিল। তখন হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
তুমি জানো ওটা গুপ্টাসায়েবের গাড়ি?
জানি। উনি এলেই ম্যানেজারসায়েবের সঙ্গে দেখা করতে আসেন।
ম্যানেজারসায়েবের তো গাড়ি আছে দেখেছিলাম।
শুনেছি গ্যারেজে দিয়েছেন। কলকজা খারাপ হয়েছে। কুণ্ডনাথন এবার একটু ইতস্তত করে বলল, কেন এসব কথা জিজ্ঞেস করছেন স্যার?
খাঁড়িতে একটা লাস দেখে এলাম।
কুণ্ডনাথনের গোঁফ কাঁপতে লাগল। চোখ দুটো বড় হয়ে গেল। ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বলল, আমি জানতাম?
লাসটা উলঙ্গ। মাথা এ্যালানো। তাছাড়া বাতিঘরে প্রচুর রক্ত দেখেছি।
সেই সাংঘাতিক হাওয়ার পাল্লায় পড়েছিল কেউ। সে ব্যস্তভাবে বলল। দরজার তালা ভাঙা ছিল?
হ্যাঁ। ব্রেকফাস্টের সঙ্গে আমার কথাও চলছিল। খাওয়াটা আজ দ্রুত সেরে নিচ্ছিলাম। ন্যাপকিনে হাতমুখ মুছে কফির পেয়ালায় চুমুক দিয়ে বললাম, কিন্তু সমস্যা হল কুণ্ডনাথন, তালা মানুষেরই ভাঙা। গ্যাসকাটার দিয়ে কাটা হয়েছে।
সে উত্তেজিতভাবে শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, কেউইন্ডের তাপে তালা গলে যায় স্যার! পাঁচবারই দেখেছি তালা গলে গেছে। সবাই জানে।
পুলিশ কী বলে শুনেছ?
জানি না। আমি সামান্য লোক স্যার! তবে আসলামকে গ্রেপ্তার করার পর সবাই বলছে, আসলামই একাজটা করে। কিন্তু কেন সে তা করবে? এবার দেখুন, প্রমাণ হয়ে গেল। আসলাম থানার হাজতে থাকা সত্ত্বেও তালা গলে দরজা খুলে গেছে। বলুন স্যার! আসলাম কেন দোষী হবে?
কুণ্ডনাথন! বাতিঘরের খাড়িতে আমার লাস দেখার কথা চেপে যাও।
কিন্তু স্যার–।
না। খবর পুলিসের কাছে বরাবর যে-ভাবে যায়, সেইভাবেই যেতে দাও।
ঠিক আছে স্যার!
পকেট থেকে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বের করে ওকে দিলাম তোমার এবং মেরির বখশিস।
সে টাকা নিয়ে সেলাম ঠুকে চলে গেল। চুরুট টানতে টানতে চোখ বুজে ভাবছিলাম, এবার আমার কী করা উচিত। সেইসময়ে পেছনের রাস্তায় ক্রমাগত গাড়ির শব্দ কানে এল। উঠে গিয়ে জানলায় উঁকি দিলাম।
পুলিসের জিপ, একটা ভ্যান, একটা অ্যাম্বুল্যান্স আর একটা ক্রেনবসানো লালরঙের ব্রেকভ্যান চলেছে কনভয়ের মতো। পুলিস যেভাবে খবর পায়, সেইভাবেই পেয়েছে তাহলে। নিচে গিয়ে দেখি, হোটেল কর্মচারীরা অনেকে গেটের কাছে, কেউ পোর্টিকোতে উত্তেজিতভাবে জটলা করছে। কুণ্ডনাথনকে দেখতে পেলাম না। ধরেই নিলাম, সে বাতিঘরের খাড়ির দিকে ছুটে গেছে।
আস্তেসুস্থে হাঁটছিলাম পিচের রাস্তায়। একবার পিছু ফিরে দেখে নিলাম সাইকেল রিকশ, মোটরবাইক এইসব যানবাহনের ঝক আসছে চন্দনপুরমের দিক থেকে। পায়ে হেঁটেও লোকেরা আসছে। কেউইন্ডের ভয়ঙ্কর কীর্তি দেখতে এই উত্তেজিত অভিযান অনিবার্য ছিল। খবর হাওয়ায় রটে গেছে, নাকি ক্রেনটা দেখেই?
জনেশ্বরজীর প্রাসাদের গেটে চাকর-নোকর ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। সেই গাড়িটা লনে একটা গাছের তলায় নির্জীব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পিচ রাস্তা বেঁকে গেছে পশ্চিমে। রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলাম। সেই রাস্তায় দশকিমি এগুলে মাদ্রাজগামী হাইওয়ে পড়ে।
আন্দাজ পঞ্চাশ মিটার যাওয়ার পর বাঁদিকে জঙ্গলের ভেতর একফলি পায়ে চলা পথ চোখে পড়ল। এই পথেই তখন গুপ্টাসায়েব বাতিঘর থেকে ফিরেছিলেন সম্ভবত।
পথটার ওপর কাঁটালতাগুল্ম ঝুঁকে আছে। প্রজাপতিধরা নেটস্টিক দিয়ে কাটা সরিয়ে-সরিয়ে হাঁটছিলাম। তারপর একটুকরো খোলা বালিয়াড়িতে পৌঁছলাম। বালিয়াড়িতে শরবন আর কেয়াঝোপ অজস্র। অনেক পাথরও গেঁথে আছে। হঠাৎ একটা কেয়াঝোঁপের তলায় কালোবালির এলোমেলো বিন্যাস দেখে থমকে দাঁড়ালাম। এদিক-ওদিক দেখে নিয়ে সেখানে গেলাম। হাঁটু মুড়ে বসে দেখি, এখানে কিছু পোড়ানো হয়েছিল এবং ছাইগুলো বালিতে ইচ্ছে করেই মেশানো হয়েছে। হাতড়াতে গিয়ে চমকে উঠলাম। কোনও সিন্থেটিক জিনিসই পোড়ানো হয়েছে। আতস কাঁচে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া গেল, জিনিসটা ফোটোফিল্ম।
তলায় হাত ভরে ওলটপালট বালির সঙ্গে যে আধপোড়া কুচি বেরুলো সেগুলো অবশ্যই ফটোগ্রাফের।
এ অবস্থায় সুমিত্রের ক্যামেরাটা কোথায় যেতে পারে অনুমান করা কঠিন নয়। দামি জাপানি ক্যামেরা খাড়ির জলে ফেলার মানে হয় না। গোপালকৃষ্ণন অনায়াসে ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু সুমিত্রের তোলা কিছু ছবির নেগেটিভ এবং প্রিন্ট যে এখানে পোড়ানো হয়েছে, এত আমি নিশ্চিত।
কেয়াঝোপের তলায় দুষ্কর্মর্টা করা হয়েছে। তাই তা কাল রাতে বৃষ্টির আগে না পরে, বোঝা গেল না। লক্ষ্য করলাম, চারপাশে বালির অবস্থা কেমন যেন অস্বাভাবিক। পায়ের দাগ মুছে ফেলার চেষ্টা স্পষ্ট। তবে সেটা সম্ভবত ভোরের দিকে আলো ফোঁটার পর করা হয়েছে।
আমার নিজের পায়ের ছাপ নষ্ট করার অর্থ হয় না। ঝোপটা গলিয়ে গেলাম, কেন গেলাম জানি না–অনেক সময় দেখেছি ইনটুইশন আমাকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেয়। কেয়াপাতার কিনারার কাটা থেকে বাঁচতে গিয়ে টুপ টুপ করে লাল কয়েকটা ফোঁটা পড়ল। বালি তক্ষুনি সেগুলো শুষে নিল।
ওপাশে ঝলমলে রোদ পড়েছে। কারও রক্ত ছিটকে এসে পড়েছিল কেয়াঝোপটায়। রাতের বৃষ্টিতে ধুয়ে গেছে। সামনের বালি এবং ঘাসে ঢাকা বালিমেশানো মাটির দানাগুলো বাইনোকুলারের কাছে সেঁটে পাথরের চাইয়ের মতো দেখাচ্ছিল। ঘাসের পাতাও অস্বাভাবিক চওড়া। তলার রক্তের খয়েরি ধারা ছড়িয়ে আছে। তবে বালিটা এলোমেলো করে দেওয়া হয়েছে।
হত্যাকাণ্ডটা তাহলে এখানেই হয়েছিল। তারপর বাতিঘরের দরজার তালা গলিয়ে খুলে লাসটা তুলে নিয়ে গিয়ে ওপরতলার জানালা দিয়ে ঠেলে ফেলা হয়েছিল। তাই জানালায় অত বেশি রক্ত দেখেছি।
কিন্তু এসব কাজ মাত্র একজনের সাধ্যের বাইরে। একাধিক লোক ছিল।
তবে এবার আমি বুঝে গেছি লাসটা কার। কাজেই কোনও গাছের ছায়ায় নিশ্চিন্তে বসে চুরুট টানা যেতে পারে।
.
হোটেলের গেটে পৌঁছে পুলিসের দশন পেলাম। পুলিসের গাড়ি ছাড়াও কয়েকটা প্রাইভেট গাড়ি রাস্তায় এবং পোর্টিকোর তলা পর্যন্ত প্রলম্বিত। বোঝা যাচ্ছিল হোটেলের মালিকরা এবং স্থানীয় হোমরা-চোমরা লোকেরাও এসেছেন। আরুলাস্থান পোর্টিকো থেকে বেরুল। ভাঙা গলায় বলল, দা ব্লাডি স্নেকউইন্ড।
ম্যানেজার গোপালকৃষ্ণনকে মেরেছে?
আরুলাস্থান বুকে ক্রস এঁকে আস্তে বলল, পুলিস ঝামেলা করছে। বোর্ডারদেরও জেরা করছে। আমি বুঝতে পারছি না কেন লোকটা রাত্রে বাতিঘরে গিয়েছিল। পুলিসের এই পয়েন্টটা ঠিক।
পোর্টিকোয় আমাকে দেখে এক পুলিস অফিসার বললেন, আপনি বোর্ডার?
হ্যাঁ।
লাউঞ্জের একপাশে গিয়ে অপেক্ষা করুন। আপনাকে প্রশ্ন করা হবে।
লাউঞ্জে সম্ভ্রান্ত চেহারার কয়েকজন ভদ্রলোক বসে আছেন। গুপ্টাসায়েবকেও দেখতে পেলাম। দুজন অফিসার জেরা করছেন মেরিকে। কুণ্ডনাথন কাতরমুখে ডাইনিং হলের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে।
রিসেপশনের কাছাকাছি একটা চেয়ারে বসলাম। মেরিকে জেরা শেষ করে একজন অফিসার আমার দিকে তাকালেন। নিভে যাওয়া চুরুট জ্বেলে নিলাম। কানে এল, আপনি এখানে আসুন। শুনতে পাচ্ছেন?
কথার ভঙ্গিতে পুলিসের চিরাচরিত অশালীনতা। কিন্তু পুলিসকেই আমার এবার বেশি দরকার। কাছে গিয়ে সামনাসামনি একটা খালি আসনে বসে পড়লাম।
আপনি বোর্ডার? বলে অফিসার হোটেল রেজিস্টারের পাতায় চোখ রাখলেন। কর্নেল নীলাদ্রি সরকার নাম? কলকাতা থেকে? বেড়াতে এসেছেন? বয়স সত্তর? আপনি তো রিটায়ার্ড সামরিক অফিসার?
পকেট থেকে নেমকার্ডটা বের করে দিলাম।
কার্ডটা দেখে অফিসার জিজ্ঞেস করলেন, নেচারিস্ট কী?
একটু হেসে বললাম, প্রকৃতির মধ্যে রহস্য খুঁজে বেড়াই। বিরল প্রজাতির পাখি আর প্রজাপতির পিছনে ছুটোছুটি করি। অর্কিড দেখলে সংগ্রহ করি। ছবি তুলি।
অফিসারদ্বয় হাসলেন না, যদিও আমার কণ্ঠস্বরে যথেষ্ট রসিকতা ছিল। অপরজন বললেন, গত রাতে বারোটা নাগাদ আপনি বেরিয়েছিলেন?
একটি মেয়েকে তার কটেজে পৌঁছে দিতে গিয়েছিলাম।
জানি। কিন্তু আপনি ফিরেছিলেন রাত তিনটে নাগাদ। এতক্ষণ কোথায় ছিলেন?
সি বিচে!
অদ্ভুত!
আমি একজন অদ্ভুত মানুষ, অফিসার!
রসিকতা করবেন না। আপনি যে সত্যি কর্নেল ছিলেন, প্রমাণ দাবি করছি।
প্রমাণ দিচ্ছি। আগে এই ছবিটা দেখুন, চিনতে পারেন কি না।
কিটব্যাগ পিঠ থেকে নামিয়ে ছবিটা বের করতে যাচ্ছি, প্রশ্ন এল, ওটা কি ছাতা?
নাহ্। প্রজাপতিধরা নেট-স্টিক।
আপনার সবই অদ্ভুত।
ঠিক ধরেছেন। এবার ছবিটা দেখুন।
ছবিটা দুজনে দেখাদেখি করলেন। তারপর প্রশ্ন এল, কার ছবি? কটেজের সেই যুবকটির? তাকে আমরা ধরে ফেলব। কলকাতায় খবর দেওয়া হয়েছে। অবশ্য জানি না কলকাতার পুলিস কতটা সহযোগিতা করবে। তারা তো রাজনীতি সামলাতেই ব্যস্ত থাকে।
আস্তে বললাম, সব ইংরেজি দৈনিক ও নিখোঁজ তালিকায় এই ছবি বেরিয়েছিল।
আমরা লক্ষ্য করিনি।
২৮শে আগস্ট সকালে এর লাস আপনারা বাতিঘরের খাঁড়িতে পেয়েছিলেন।
দুজন অফিসারই আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। একটু পরে একজন বললেন, মিলিয়ে দেখতে হবে। বিকৃত লাসের ছবি থানায় আছে। কিন্তু আপনি কীভাবে নিশ্চিত হলেন, ব্যাখ্যা চাইছি।
ব্যাখ্যা খুব জটিল। আপাতত এটুকু বলতে পারি, যুবকটি একজন ফোটোফিচারিস্ট।
আপনার আত্মীয়?
বলতে পারেন। সে এখানে এসেছিল সমুদ্রতরঙ্গ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন সংক্রান্ত সেমিনার কভার করতে। তার লাস ওই খাঁড়িতে পাওয়া যায়। আপনারা শনাক্ত করতে পারেননি বা চেষ্টা করা হয়নি। সে এই হোটেলে ২৭শে আগস্ট ছদ্মনামে চেকইন করেছিল। রেজিস্টার দেখুন। এ. কে. দাশগুপ্ত। তার লাসের খবর পেয়েই গোপালকৃষ্ণ ঝামেলার ভয়ে পরদিন ভোরে চেকআউট। দেখিয়েছিলেন।
দুই অফিসার রেজিস্টারের পাতা ওল্টাতে ব্যস্ত হলেন। খুঁটিয়ে দেখার পর। বললেন, আপনি তা হলে নিছক বেড়াতে আসেননি? কে আপনি?
কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।
আপনি প্রাইভেট ডিটেকটিভ!
ছিঃ! কথাটা একটা গালাগাল। আমি গোপালকৃষ্ণনের কাছে কথায় কথায় সব জেনেছি।
আপনি সত্যিই অদ্ভুত লোক। যাই হোক, গোপালকৃষ্ণন মারা পড়েছেন। কাজেই আপনার জানার সত্যমিথ্যা ঠিক করা কঠিন।
গোপালকৃষ্ণন আমাকে বলেছেন, বাতিঘরের স্নেকউইন্ড কলকাতার ফোটোফিচারিস্টের মৃত্যুর কারণ। জনেশ্বরজীরও মৃত্যুর কারণ। গোপালকৃষ্ণনের মৃত্যুর কারণও তা হলে স্নেকউইন্ড। সেই সাংঘাতিক ঘাতক হাওয়ার কবলে পড়ে ছটা মানুষের প্রাণ গেল। আমি গম্ভীর মুখে বলছিলাম কথাগুলো। চুরুটে শেষ টান দিয়ে কাছাকাছি একটা ছাইদানিতে ফেলে দিলাম। তারপর বললাম, কাল রাতে সি বিচে বসে থাকার সময় আমি দুরে কোথাও অদ্ভুত ধরনের শিসের শব্দ শুনেছিলাম। স্নেকউইন্ড নাকি শিস দিতে দিতে সমুদ্র থেকে উঠে এসে বাতিঘরে ঢোকে। শুধু এটাই আমি বুঝতে পারছি না ছ-জন লোক পরপর অতরাত্রে বাতিঘরে কেন গিয়েছিল?
গুফো কালো বেঁটে অফিসারটি তীক্ষ্ণদৃষ্টে আমাকে দেখছিলেন। একটু ঝুঁকে এসে বললেন, আপনি শিসের শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন?
তা-ই তো বললাম।
কিছু দেখতে পেয়েছিলেন?
তেমন কিছু না। তবে দূরের সমুদ্রের একটা জাহাজের আলো দেখছিলাম। আর
বলুন!
সন্ধ্যার পরই আমার ঘরের ব্যালকনি থেকে বাতিঘরের মাথায় লাল আলো দেখেছিলাম। আলোটা দুবার জ্বলে নিভে গিয়েছিল।
লাল আলো? অফিসারটি তার সহযোগীর দিকে তাকালেন।
সহযোগী অফিসার সাদা পোশাকপরা। নিশ্চয় পুলিসের গোয়েন্দা। আস্তে বললেন, কুণ্ডনাথনও দেখেছে। কাজেই এটা একটা পয়েন্ট।
বললাম, গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। লাল আলো দেখা গেলে কেউই আসে এবং খাঁড়িতে লাস পাওয়া যায়। স্থানীয় লোকের মুখে শুনেছি, হাওয়াটা এত গরম যে বাতিঘরের দরজার তালা গলে যায়—
আপনি কী শুনেছেন, সেটা কথা নয়। কী দেখেছেন সেটাই আমাদের জিজ্ঞাস্য।
যা যা দেখেছি, বললাম।
আপনি কবে কলকাতা ফিরবেন ঠিক করেছেন?
কিছু ঠিক করিনি। অন্তত একটা জগন্নাথ প্রজাপতি না ধরা পর্যন্ত ফিরছি না।
গুফো অফিসার চোখ পাকিয়ে বললেন, রসিকতা পছন্দ করি না। আপনি আমাদের অনুমতি ছাড়া কলকাতা ফিরতে পারবেন না।
বেশিদিন থাকার মতো টাকাকড়ি আমার নেই। সি-ভিউয়ের খরচ বড় বেশি।
গোয়েন্দা অফিসার একটু হেসে বললেন, টাকা ফুরিয়ে গেলে আমাদের জানাবেন।
আপনারা টাকা দেবেন নাকি?
নাহ্। আপনি আমাদের গেস্ট হয়ে থাকবেন।
লকআপে নয় তো?
হাঃ। নিজের রসিকতায় গোয়েন্দা অফিসার নিজেই হেসে উঠলেন।
গুঁফো অফিসার বললেন, ঠিক আছে। আপনি আসুন। দরকার হলে থানায় ডেকে পাঠাব।
হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়লাম। এবার সত্যিই জগন্নাথ প্রজাপতি ধরার অভিযানে চলেছি। অন্তত বাকি ফিল্মগুলো শেষ করে দুপুরেই প্রিন্ট করে ফেলতে হবে। বাইরে গেলে বাথরুম আমার এই কাজে ডার্করুম হয়ে ওঠে। সঙ্গে ওয়াশ-ডেভালাপ-প্রিন্টের সরঞ্জাম থাকে। বিশেষ করে এবার তো তৈরি হয়েই এসেছিলাম।
.
জগন্নাথ প্রজাপতি ধরা সত্যিই অসম্ভব। দুটো ডানা মেললে জগন্নাথদেবের মূর্তির আদল ফুটে ওঠে বলেই লোকেরা এই নাম দিয়েছে। বাইনোকুলারে দেখলাম রঙের আঁকিবুকিতে ওইরকম একটা রূপ ধরে নেওয়া যায়। এদের বোধশক্তি এত তীক্ষ্ণ যে তিনমিটার দূর থেকেই টের পায় হামলা আসছে। তবে ছবি নেওয়ার অসুবিধে ছিল না। বিচ দিয়ে ঘুরে আবার একটা অ্যাডভেঞ্চার হয়ে গেল। অনেক সময় নিজেই জানি না কী করছি এবং কেন করছি।
দেখলাম, বাতিঘরের দরজায় আবার তালা আঁটা হয়েছে। পুলিস রুটিন জবের পথ ধরে চলে এবং নিঃসাড়, কৌতূহলহীন একটি শ্রেণীতে পরিণত। এ বিষয়ে আমার একটা অনবদ্য অভিজ্ঞতা আছে। বহুবছর আগে গ্রীষ্মের এক দুপুরে কলকাতা রাজভবনের উত্তরফটকের কাছে একটা লোক একজনকে ছুরি মারতে যাচ্ছে এবং আক্রান্ত লোকটি ড্রেনে নেমেছে। কাছাকাছি আর মানুষজন। ছিল না সেই মুহূর্তে। শুধু ফটকে এক পুলিসপ্রহরী দাঁড়িয়ে ছিল এবং তার কোমরে চামড়ার খাপে ফায়ার আর্মস। আমার তাড়া খেয়ে আততায়ী পালিয়ে গেল। তখন প্রহরীটিকে বললাম, তার চোখের সামনে একটা মানুষ খুন হতে যাচ্ছিল এবং তার কাছে তো ফায়ার আর্মস আছে। সে গম্ভীর মুখে বলল, সে রাজভবনে ‘ডিউটি’ করছে। কাজেই বাইরে কী ঘটছে, তা নিয়ে তার কিছু করার নেই। বললাম, তবু একজন মানুষ হিসেবে কিছু করার ছিল না কি? অন্তত একটা ধমকই যথেষ্ট ছিল। প্রহরীটি আরও গম্ভীর হয়ে বলল, তাকে যা করতে বলা হয়েছে, তার বাইরে কিছু করার ক্ষমতা তার নেই। তাতে তার ঝামেলা বাড়বে।
কোনও একটি পদ্ধতির প্রতি যান্ত্রিক আনুগত্যই রাষ্ট্রীয় অভিপ্রায়। যাইহোক, আলব্যের কামু কথিত ‘প্রতিষ্ঠানের শক্তিশালী গেরিলা’ সম্পর্কে পরে ভাবা যাবে। বাতিঘরের সামনে দিয়ে দক্ষিণের ঢিবির দিকে এগিয়ে গেলাম। পিছু ফিরে দেখলাম, দরজার কাছাকাছি একটা বেঁটে আঁকড়া গাছের তলায় দাঁড়ানো দুজন বন্দুকধারী পুলিসপ্রহরী আমার দিকে হাত নেড়ে চলে যেতে ইশারা করছে। অতএব আমি চলে গেলাম।
কিছুক্ষণ পরে সমুদ্রের সমান্তরাল বালিয়াড়ির মাথায় উঠে একটা জেলে বসতি চোখে পড়ল। ঢালু বালিমেশানো মাটি ও পাথরের ওপর অজস্র ভেলানৌকো রাখা আছে। বসতির পেছনদিকের মাঠে জাল শুকোতে দেওয়া হয়েছে। মাঠটার ওধারে বহুদূর ছড়ানো লালফুল দাগড়াদাগড়া ফুটে আছে সবুজ ঢেউখেলানো কার্পেটে। বাইনোকুলারে সেই হাইওয়েটি দেখা যাচ্ছিল টিলা পাহাড়ের ফাঁকে।
বলেছি নিজের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন ছিলাম না। বসতি থেকে আমাকে অভ্যর্থনা জানাতে ছুটে এল কয়েকটা কুকুর। তারপর নাকে ঝাঁপটা দিল শুঁটকি মাছের পচা গন্ধ। কুকুরগুলোর অভ্যর্থনায় সাড়া না দেওয়ায় তারা ক্রমশ অবাক হতে হতে থেমে যাচ্ছিল। এইসময় উলঙ্গ ছোট ছেলেমেয়ের একটা দল ‘সায়েব! সায়েব!’ বলে চেঁচাতে চেঁচাতে আমাকে ঘিরে ধরল। অভ্যাস অনুযায়ী তাদের চকোলেট বিলি করলাম এবং ছবি তুললাম। তারা চমৎকার পোজ দিল।
একটা কুঁড়েঘরের পিছনে ছায়ায় দাঁড়িয়ে একজন বুড়োমানুষ আমাকে দেখছিল। সমুদ্রের লোনা জল এই নুলিয়াদের প্রচণ্ড কালো এবং ক্ষয়াটে প্রভাস্কর্য করে ফেলে। ব্রেকার পেরিয়ে দূরের সমুদ্রে এদের অভিযান দেখেছি। যথার্থ সমুদ্রজয়ী এইসব আদিম বীরের প্রতি আমার শ্রদ্ধা আছে।
বুড়ো ভাঙাভাঙা হিন্দিতে তার ছবি তুলতে চাইল। ইচ্ছাপূরণ করলাম। বসতির ভেতর মেয়েরা সব কষ্টিপাথরের যক্ষিনী এবং যে যার জায়গায় টেরাকোটা হয়ে সেঁটে আছে। বুড়ো আমার প্রশ্নের উত্তরে বলল, সব জোয়ান এখনও মাঝদরিয়ায় লড়ছে। তবে তাদের ফেরার সময় হয়ে এল। বিকেলে চন্দনপুরম থেকে ট্রাক এসে দূরের রাস্তায় দাঁড়াবে। তারা মাছ পৌঁছে দেবে। তবে কোনও দিন মাছ আশাতীত হয় কোনওদিন তেমন কিছুই না।
বললাম, বাতিঘরের খাড়িতে লাস পড়ার খবর সে জানে কি না?
সে শুনেছে।
এ নিয়ে দুমাসে ছটা লাস পড়ল। তাই না?
তাই হবে। তবে এই বসতির তিনজন লাস হয়েছে।
তারা অতরাতে সমুদ্রে গিয়েছিল কেন?
সেটা তারাই জানে। বাতিঘরে রাতবিরেতে কাণ্ডিলম আসে।
স্নেকউইন্ড? (মুখ ফসকে ইংরেজি বেরিয়ে গেল।)
হাওয়াসাপ। বাতিঘরের নিচে সমুদ্রের তলায় সুড়ঙ্গে তার বাসা।
কাণ্ডিলম কি বরাবর আসে ওখানে?
আসে। তার ঠাকুর্দা একবার তার পাল্লায় পড়েছিল। জোর বেঁচে যায়। তিনপুরুষ ধরে নুলিয়ারা জানে কালিমের উপদ্রবের কথা। তাই তারা কখনই বাতিঘর এলাকার সমুদ্রে যায় না। রাতে যাওয়ার কথা তো ভাবাই যায় না তবে। তারা হাওয়া শুঁকে টের পায় কখন কাণ্ডিলম সুড়ঙ্গ থেকে বেরুবে।
তিনজন রাত্রে গিয়েছিল। কাণ্ডিলম তাদের মেরেছিল। কেন গিয়েছিল তারা?
বসতির কেউ জানে না কেন গিয়েছিল। পুলিস খুব ঝামেলা করেছিল। তাদের বাবা-মায়েরা কিছু জানলে তো বলবে?
ভেলানৌকো নিয়েই গিয়েছিল কি?
হ্যাঁ। বসতির অনেক জোয়ান আছে, খাঁড়িতে ঢেউ বা পাথরের পরোয়া করে না। ওই তো সমুদ্রে কত পাথর দেখা যাচ্ছে। সেগুলো এড়িয়ে মাঝদরিয়ায় যেতে জানে নুলিয়ারা।
জনেশ্বরজীকে কি চেনে সে?
নামে জানে। রাজার অতবড় বাড়ি কিনেছিল যে, তার অনেক টাকা। ‘কাণ্ডিলম’ তাকে মারল।
মাছ বিক্রি করা হয় কার কাছে?
চন্দনপুরমে মাছের আড়তদার আছে। তার নাম দণ্ডরাঘবন।
গুপ্টাসায়েবকে কি সে চেনে?
কে সে? এমন নাম তার জানা নেই। কিন্তু তাকে এ সব প্রশ্ন কেন করা হচ্ছে? সায়েব কি সরকারের নোক?
‘না’ বলে তাকে একটা কুড়ি টাকার নোট দিলাম। সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ইতস্তত করে সে দু-হাত বাড়িয়ে টাকাটা নিল এবং মাথায় ঠেকাল। তারপর কোমরের কাপড়ে গুঁজল। এবার জিজ্ঞেস করলাম, এই সমুদ্রে জাহাজ সে দেখেছে কি না?
রোজই দু-একটা জাহাজ মাঝদরিয়া দিয়ে যায়। দিনে যায়, রাতেও যায়।
কাছাকাছি স্পিডবোট দেখেছে কখনও দিনে বা রাতে।
সেটা কী জিনিস?
নৌকোর মতো গড়ন। প্রচণ্ড জোরে ছোটে। যন্ত্র তাকে ছোটায়।
একটি মেয়ে কাছাকাছি দাঁড়িয়েছিল। বলে উঠল, বোট্টা! বোট্টা!
বুড়ো নুলিয়া বলল, হ্যাঁ বোট্টা। একবার রাতে দেখেছিল মনে পড়ছে।
মেয়েটি বলল, সে একবার নয়, কয়েকবার বোট্টা দেখেছে। খুব জোরালো আলো।
বুড়ো গম্ভীর মুখে বলল, কাণ্ডিলম!
মেয়েটি তার সঙ্গে মাতৃভাষায় তর্ক জুড়ে দিল। তর্ক থামাতে মেয়েটিকে দশটা টাকা দিতেই হল। প্রায় একটা বাজে। এবার ফিরতে হবে।
বাইনোকুলারে দেখে নিলাম, কোথাও কেউ আমার দিকে লক্ষ্য রেখেছে কি না। তারপর হাত নেড়ে তাদের বিদায় জানিয়ে চলে এলাম। কুকুরগুলো দূরে দাঁড়িয়ে আমাকে বিদায় সংবর্ধনা জানাল।
ছবির নেগেটিভগুলো চমৎকার ছিল। সবগুলো প্রিন্ট করার দরকার ছিল না। বাতিঘরের ওপরে এবং নিচে দরজার সামনে গুপ্টাসায়েবের মোট তিনটে ছবি প্রিন্ট করতে দিয়েছিলাম। ডার্করুমে! সেই ছরি শুকোতে দিয়ে ব্যালকনিতে বসে অপেক্ষা করছিলাম। পাঁচটা বাজে। এখন কফি দিয়ে যাওয়ার কথা কুণ্ডনাথনের।
পাঁচমিনিট দেরি করে সে এল। চেহারায় ঝড়ঝাঁপটা খাওয়া কাকতাড়ুয়ার ছাপ। বললাম, তুমি কি অসুস্থ কুণ্ডনাথন?
সে আস্তে বলল, না। আমার কিছু হয়নি।
কাণ্ডিলম তা হলে ম্যানেজারসায়েবকে মারল!
কাণ্ডিলম? সে অবাক চোখে তাকাল। না স্যার! ম্যানেজারসায়েব জানতেন রাতে বাতিঘরে কাণ্ডিলম আসে। উনি কেন যাবেন সেখানে? ওঁকে খুন করে খাঁড়িতে ফেলে দেওয়া হয়েছে।
তুমি জানো?
কুণ্ডনাথন জোরে মাথা নাড়ল। জানি না। কিন্তু আমার সন্দেহ হচ্ছে। একটু দ্বিধার সঙ্গে সে খুব আস্তে বলল, আপনাকে বলছিলাম, রাতে দুবার গাড়ির শব্দ শুনেছি। আরুলাস্থান বলছিল, চুস্ত পাঞ্জাবিপরা যে লোকটা এসেছিল সে এলাকার সাংঘাতিক গুণ্ডা, মাছের কারবার আছে লোকটার।
লোকটার নাম দণ্ডরাঘবন?
সে চমকে উঠে বলল, আপনি চেনেন তাকে?
নাম শুনেছি। তো তুমি পুলিসকে বলেছ দণ্ডরাঘবন আসার পর গুপ্টাসায়েব এবং ম্যানেজার সায়েব বেরিয়ে যান?
বলেই ভুল করেছি। আরুলাস্থান চালাক ছেলে। দণ্ডরাঘবন আমাকে মেরে ফেলবে। কুণ্ডনাথন কাঁপাকাঁপা গলায় বলল, আমি মরতে ভয় পাই না। কিন্তু আমার স্ত্রী ছেলেমেয়ে বুড়ো বাবা-মায়ের কী হবে?
দরাঘবন কেন ম্যানেজারসায়েবকে খুন করবে?
গুপ্টাসায়েব ওকে দিয়ে খুন করিয়েছেন। আমার সন্দেহ।
গুপ্টাসায়েব কেন গোপালকৃষ্ণনকে খুন করাবেন?
এদিক-ওদিক দেখে নিয়ে খুব আস্তে কুণ্ডনাথন বলল, জনেশ্বরজী মারা যাওয়ার দিন গুপ্টাসায়েব হোটেলে এসেছিলেন। ম্যানেজারসায়েবের ঘরে দুজনে, কী নিয়ে তর্ক হচ্ছিল। আমি চা দিতে গেলাম। দুজনের মুখ খুব গম্ভীর দেখলাম। চলে আসার সময় কানে এল গুপ্টাসায়েব বলছেন, ঠিক আছে এক লাখই দেব। এক সপ্তাহ সময় চাই। করিডরে একটু দাঁড়ালাম। আর চড়া গলায়। কথা হচ্ছিল না। তবে একটা কথা কানে এল। ছবি।
ছবি? আমি শান্তভাবেই বললাম, ছবির বদলে লাখ টাকা!
কুণ্ডনাথন শ্বাস ছেড়ে বলল, তাই হবে। এখন মনে হচ্ছে ছবি নিয়েই ঝগড়া হচ্ছিল।
আমার উত্তেজনার কোনও কারণ তার ছিল না। বললাম, রিসেপশনে এখন, কে আছে?
মেরি।
ঠিক আছে। তুমি এস।
কুণ্ডনাথন টলতে টলতে বেরিয়ে গেল। উঠে গিয়ে দরজা এঁটে ডার্করুমে ঢুকলাম। আলো জ্বেলে দেখলাম, ছবি শুকিয়েছে। তিনটে ছবি খুলে নিয়ে দড়িটা খুললাম। লিন্টেনের মাথায় আটকানো কালো কাপড়টা খুলে ফেললাম। ডার্করুম আবার বাথরুম হয়ে গেল।
বাকি কফি শেষ করে চুরুট ধরিয়ে ঘরদোর বন্ধ করে নিচে গেলাম। মেরিকেও এ-বেলা কাতর দেখাচ্ছিল। সে আমাকে দেখে আস্তে বলল, গুড ইভিনিং স্যার!
ইভনিং! মেরি, একটা টেলিফোন করতে চাই। থানার নাম্বারটা জানো?
এক মিনিট। আমি ধরে দিচ্ছি।
সাড়া পেয়ে সে আমাকে টেলিফোন দিল। বললাম, অফিসার ইন-চার্জের। সঙ্গে কথা বলতে চাই। হোটেল সি-ভিউ থেকে বলছি। আমি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।
একটু ধরুন।
প্রায় এক মিনিট পরে ভারী গলায় সাড়া এল। বলুন কী করতে পারি আপনার জন্য?
আমি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি। সি-ভিউ হোটেল থেকে।
হ্যাঁ। আমাদের অফিসার আপনার কথা বলেছেন আমাকে। আপনি কি কলকাতা ফিরতে চাইছেন? দুঃখিত কর্নেল সরকার! তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত
তদন্ত শেষ।
তদন্ত শেষ? আমি রসিকতা পছন্দ করি না।
আমিও না। কয়েকটা কাজ এখনই করা উচিত পুলিসের। না হলে আমি মাদ্রাজ কাস্টমসকে ট্রাঙ্ককল করতে বাধ্য হব।
কী বললেন? কাস্টমস?
হ্যাঁ। কাস্টমস এবং এনফোর্সমেন্টের অ্যান্টিনার্কোটিড ডিপার্ট! ওরা আমাকে চেনে।
আপনি অদ্ভুত কথাবার্তা বলছেন!
মন দিয়ে শুনুন এবং লিখে নিন। দেরি করবেন না। গোপালকৃষ্ণনের বাড়ি সার্চ করুন। বাতিঘরের কয়েকটা ছবি পাওয়ার চান্স আছে। কোনও ক্যামেরা পেলে সিজ করুন। গোপালকৃষ্ণন বুদ্ধিমান ছিলেন। কাজেই একলাখ টাকার লোভে নেগেটিভগুলো দিলেও কয়েকটা প্রিন্ট রেখে দেওয়ার চান্স আছে। দুই, মাছের আড়তদার দণ্ডরাঘবনকে এখনই গ্রেফতার করুন। সে গোপালকৃষ্ণনের খুনী। তিন, জনেশ্বরজীর বাড়িতে গুপ্টাসায়েবকেও অ্যারেস্ট করুন। বাড়িটা তন্নতন্ন সার্চ করুন। ওর গাড়িটাও। নার্কোটিকসের পেটি পেয়ে যেতে পারেন। এই কেস প্রমাণের দায়িত্ব আমি নিচ্ছি। তিনজন নুলিয়া, কলকাতার ফোটোফিচারিস্ট সুমিত্র গুহরায়, জনেশ্বরজী এবং গোপালকৃষ্ণনকে কাণ্ডিলম স্নেকউইন্ড মারেনি। মেরেছে গুপ্টা এবং দণ্ডরাঘবন। অন্তত গোপালকৃষ্ণকে কোথায় মারা হয়েছে, আমি দেখিয়ে দেব। কোনও সাড়া না পেয়ে বললাম, হ্যালো! আমার কথা বুঝতে পারলেন কি?
দেখছি।
দেখছি নয়। প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান। খুনীরা পালিয়ে গেলে আপনি দায়ী হবেন।
ফোন রেখে দিলাম। দেখলাম, মেরি চোখ বড় করে তাকিয়ে আছে। স্ফীত নাসারন্ধ্র। প্লেটে আঁকা মুখ। একটু হেসে তাকে আশ্বস্ত করলাম, তোমার উদ্বেগের কিছু নেই।
.
লাউঞ্জে বসে কফি খাচ্ছিলাম। জোরালো বৃষ্টি এসে গেল। আলোয় বৃষ্টি দেখতে আমার ভাল লাগে না। কিন্তু পুলিসের দুটো গাড়ি গেছে জনেশ্বরজীর বাড়ির দিকে। এখনও ফিরছে না। রফা করে ফেলল কি না বলা যায় না। গুপ্টাকে দেখেই বুঝেছিলাম খলিফা লোক।
এইসময় টেলিফোন বাজল। মেরি ভীতু গলায় ডাকল, আপনার টেলিফোন স্যার!
উঠে গিয়ে সাড়া দিলাম।
কর্নেল সরকার? অফিসার-ইন-চার্জ মোহন আচারিয়া বলছি। দণ্ডরাঘবন লক-আপে। গোপালকৃষ্ণনের বাড়িতে পাঁচটা কালার প্রিন্ট পেয়েছি। ফ্ল্যাশে তোলা। গুপ্টা আর দণ্ডরাঘবন খাড়ি থেকে দড়িতে কিছু টেনে ওঠাচ্ছিল। পরপর ছবি সাজিয়ে বোঝা গেল, গুপ্টা দড়িটা ধরে একটা পেটি ওঠাচ্ছিল খাঁড়ি থেকে। দুঃসাহসী ফোটোগ্রাফারকে তেড়ে এসেছিল দণ্ডরাঘবন। হাতে একটা ছোট লোহার রড।
হ্যাঁ ফোটোগ্রাফার সুমিত্র গুহরায়কে মেরে বডিটা বাতিঘরে তুলে নিয়ে গিয়ে খাড়িতে ফেলা হয়েছিল। মুখটা গোপালকৃষ্ণনের মতোই বিকৃত করা হয়েছিল। আমার ধারণা, জনেশ্বরজী গুপ্টার এই কারবার জানতে পেরে তাকে হুমকি দেন। তাই পার্টি চলার রাতে তাকেও কোনও ছলে ডেকে এনে একইভাবে মারা হয়। কাণ্ডিলম চমৎকার আবহাওয়া তৈরি রেখেছিল।
বুঝতে পারছি। কিন্তু তিনজন নুলিয়াকে মারার কারণ কী?
দণ্ডরাঘবন মাছের কারবারী। নুলিয়াদের সঙ্গে তার ভাল চেনাজানা আছে। জাহাজ থেকে স্পিডবোটে নার্কোটিকস পেটি পাঠানো হয়েছে। স্পিডবোট পাথরে ধাক্কা খেয়ে ভেঙে টুকরো টুকরো হওয়ার চান্স আছে। কাজেই নুলিয়াদের ভেলানৌকোর সাহায্য নেওয়া দরকার ছিল। দণ্ডরাঘবনের কাছে কথা আদায় করুন। আমার ধারণা তিনজন ডানপিটে নুলিয়া ব্ল্যাকমেল করছিল ওদের। তাই তিনজনকে একে-একে খতম করেছিল। যাইহোক, ক্যামেরার কী খবর?
পাওয়া গেছে। কিন্তু একটা পয়েন্ট স্পষ্ট হচ্ছে না কর্নেল সরকার! গোপালকৃষ্ণন ক্যামেরা পেলেন কীভাবে?
মৃতরা আর কথা বলবে না। তবে পয়েন্টটা ব্যাখ্যা করা চলে। গোপালকৃষ্ণনও সম্ভবত গুপ্টার দলে ছিলেন। গুপ্টা প্রায়ই হোটেলে আসতেন। ঘটনার সময় গোপালকৃষ্ণন যেভাবেই হোক, ক্যামেরাটা হাতিয়েছিলেন। সুমিত্রের হাত থেকে ছিটকে পড়ে থাকবে।
কিন্তু গোপালকৃষ্ণন্ন ছবিতে নেই।
তা হলে নিশ্চয় পিছনে আড়ালে কোথাও গার্ড দিচ্ছিলেন।
কর্নেল সরকার। আমার মনে হচ্ছে, ফোটোগ্রাফার পালাতে গিয়ে গোপালকৃষ্ণনের পাল্লায় পড়েন। গোপালকৃষ্ণন তার ক্যামেরা কেড়ে নেন।
তা-ও সম্ভব। দণ্ডরাঘবন এসে ফোটোগ্রাফারের মাথায় রড মারে। বাকিটা স্পষ্ট।
ধূর্ত গোপালকৃষ্ণন ক্যামেরার ফিল্ম প্রিন্ট করিয়েছিলেন। কোথায় করিয়েছিলেন আমরা খুঁজে বের করব। তবে আপনি ঠিকই ধরেছেন। গোপালকৃষ্ণনও নুলিয়াদের মতো গুপ্টা এবং দণ্ডরাঘবনকে ব্ল্যাকমেল শুরু করেন। তাই গতরাতে তাকে মারা হয়।
হ্যাঁ। নেগেটিভগুলোর বদলে এক লাখ টাকা লবি করেছিলেন গোপালকৃষ্ণন। সাক্ষী আছে। কোথায় নেগেটিভগুলো কয়েকটা প্রিন্টসমেত পুড়িয়ে নষ্ট করা হয়েছে, আমি দেখেছি। কিন্তু গুপ্টার খবর পেলে?
জনেশ্বরজীর বাড়িতে ওকে ধরা হয়েছে। বাড়ি সার্চ এখনও শেষ হয়নি। আমি ডিটেকটিভ ইনস্পেক্টর রঘুনাথ মিশ্রকে বলেছি, আপনার সঙ্গে দেখা করে আসবেন।
ধন্যবাদ। রাখছি।
ফোন রেখে দিলাম। তারপর ঘরে ফিরে অমলকে লেখা সুমিত্রের চিঠিটা আবার খুঁটিয়ে পড়লাম। অমলের আচরণ, কালিমের মতো রহস্যময়। দেখা যাক, কোনও সূত্র মেলে কি না।
অমল,
তাড়াতাড়ি লিখছি। একটা চমকপ্রদ স্টোরির খোঁজ পেয়েছিলাম এখানে। হেডিং দিলাম চন্দনপুরম বাতিঘরে রহস্যময় হাওয়া সাপ, কিন্তু গতরাতে বাতিঘরের কাছে হাওয়া সাপের জন্য ওঁত পাততে গিয়ে অন্য একটা রোমাঞ্চকর স্টোরির খোঁজ পেলাম। নার্কোটিকস স্মাগলিং র্যাকেট। হোটেল সি-ভিউ ওদের রর্দেভু। অপারেশন জোন হল বাতিঘর। তাই আজ বিকেলে সি-ভিউয়ে এসে উঠেছি। সতর্কতার জন্য তোর নাম-ঠিকানা ব্যবহার করেছি। কারণ তোর দাদা। তো মাদ্রাজ পোর্টে কাস্টমস-চিফ। আমার কিছু বিপদ হলে তুই যেন অ্যাকশন নিস। এখানে চলে আসতেও পারিস। দীপাকে সঙ্গে আনলে বাড়তি আনন্দ পাবি। দীপারও ভাল লাগবে। বন্য আদিম সমুদ্রের একটা আলাদা স্বাদ আছে। প্রেমের জন্যও আছে অবাধ নির্জনতা। তোদের দুজনকেই প্রীতি ও শুভেচ্ছা। ইতি– সুমিত্র
ইনল্যান্ড লেটার। আতসকাচে স্থানীয় ডাকঘরের তারিখটা পড়া যাচ্ছে ২৭ আগস্ট। কলকাতার ডাকঘরের ছাপ খুব অস্পষ্ট। ২ এবং ‘এস’ থেকে বলা চলে ২ সেপ্টেম্বর। তা হলে অমল মুখ বুজে ছিল কেন? সব কাগজে সুমিত্রের ছবি ছাপা হয়েছিল। চোখ এড়িয়ে গেলেও দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার জয়ন্ত চৌধুরিকে তার না-চেনার কারণও নেই। আজ ১৫ সেপ্টেম্বর। অমল, আর দীপা এখানে এসেছিল ১৩ সেপ্টেম্বর। তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, দীপাকে কাল রাতে লাউঞ্জে বসিয়ে রেখে কোথায় গিয়েছিল সে? ফিরল রাত একটায় এবং ভোরে। দুজনে কটেজ থেকে উধাও হয়ে কলকাতা ফিরে গেল কেন?
বৃষ্টিটা হঠাৎ থেমে গেল। ঝাউবনের ভেতর দিয়ে সমুদ্রের গর্জন পরিশ্রুত হয়ে শ্বাসপ্রশ্বাসের ধ্বনিতে রূপ নিয়েছে। চিঠিটা ভাজ করে পকেটে রেখে ব্যালকনিতে গেলাম। আবার প্রশ্নটা ফিরে এল। অমলের আচরণ কালিমের চেয়ে রহস্যময়…।
ডিটেকটিভ ইনস্পেক্টার রঘুনাথ মিশ্র রুটিনমাফিক জানিয়ে গিয়েছিলেন, গুপ্টার গাড়ির সামনের আসনের তলার খোঁদলে তিনটে নার্কোটিকসের পেটি পাওয়া গেছে। মোট দাম আনুমানিক ৩০ লক্ষ টাকা। পেটিগুলো ওয়াটার প্রুফ কালো রঙের উৎকৃষ্ট পলিথিনে তৈরি, যা নাকি গুলি করেও ফাটানো যায় না। পূর্ব উপকুলের বন্দরে বন্দরে মাল পৌঁছে দিয়ে ‘দা ওডিসি’ নামে যে বিদেশি জাহাজটি ঘুরছে, তাকে তাড়া করা হবে। ওই জাহাজ থেকেই স্পিডবোটে পেটিগুলি নামিয়ে নুলিয়াদের ভেলানৌকোয় পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। তবে কোনও প্রমাণের আশা কম।
আর কাণ্ডিলম সম্পর্কে নুলিয়াবসতিতে একটা আশ্চর্য খবর মিলেছে। নুলিয়ারা সন্ধ্যার দিকেই সমুদ্রের হাবভাবে নাকি টের পায়, বাতিঘরের নিচের খাঁড়িতে সুড়ঙ্গের ভেতর কালিমের ঘুম ভাঙছে। তাই বাতিঘরের ওপর উঠে আগাম লাল আলো জ্বেলে জাহাজকে নিষেধ করা হয়েছিল, আজ রাতে মাল পাঠিও না।
আমার বিশ্বাস-অবিশ্বাসে কিছু যায় আসে না। প্রকৃতির রহস্য অন্তহীন। আমিও কালিমের এক প্রত্যক্ষদর্শী। তবে শিসের শব্দের একটা ব্যাখ্যা সম্ভব যদিও ভুল বা ঠিক এ দাবি করছি না। বাতিঘরের ভেতর ঘোরালো সিঁড়ির মেরুদণ্ড হিসেবে যে লোহার ফাঁপা থামটি দাঁড়িয়ে আছে, সেটি সুপ্রাচীন। কোথাও কোথাও ছিদ্র থাকা সম্ভব। যার ভেতর দিয়ে সামুদ্রিক নৈশ ঘূর্ণি হাওয়াটা ঢুকলে তীক্ষ্ণ শিসের শব্দ হতে পারে। সকালে গিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে হবে।
রঘুনাথ মিশ্রের কণ্ঠস্বর নিরাসক্ত ছিল। সেটা স্বাভাবিক। কে এক বুড়োহাবড়া অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি কর্নেল তার মতো ঝানু গোয়েন্দা অফিসারকে টেক্কা দিল। তার পক্ষে ব্যাপারটা হজম করা শক্ত।
.
রাত সাড়ে নটায় ডিনার সেরে লাউঞ্জে বসে কফি খাচ্ছিলাম। আরুলাস্থান রিসেপশনে পা-দুটো তুলে দিয়ে কানে হেডফোন লাগিয়ে পপ শুনছিল (আর কী শুনবে তা ছাড়া?) এবং কুণ্ডনাথন এসে বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করে গেল, আর তাকে আমার দরকার আছে কি না। ছিল না।
একটু পরে দেখি, গেটের কাছে একটা সাইকেল রিকশ এসে দাঁড়াল। যারা নামল, তারা আমার বুকের ভেতরকার পুরনো যন্ত্রকে কাঁপিয়ে দিল। অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে বহুবার আমার থিওরিকে লাথি মেরে শুইয়ে দিয়েছে। এবারও তাই হল আর কী!
উঠে দাঁড়ালাম অভ্যর্থনার জন্য। নিশ্চয় আমি হেরে গেছি কোথাও। আস্তে বললাম, তোমরা।
দীপা দ্রুত বলল, আপনার ঘরে চলুন।
ঘরে গিয়ে ব্যালকনিতে বসলাম। ওরাও বসল। বললাম, আমি ভেবেছিলাম তোমরা কলকাতা চলে গেছ।
দীপা বলল, না। আমরা ট্রেনের টিকিট বদলাতে গিয়েছিলাম।
সারাদিন কোথায় ছিলে?
নিউ-বিচের একটা হোটেলে। দীপা একটু হাসল। অমল এত ভীতু জানতাম না। আপনাকে ভয় পেয়েছিল। আমিই টানাটানি করে ওকে নিয়ে এলাম। রিকশ দাঁড়িয়ে আছে। বেশিক্ষণ বসব না।
বলো অমল!
অমল বিব্রতমুখে বলল, সুমিত্রের চিঠিটা আপনি নিয়ে এসেছেন শুনে আমি ভয় পেয়েছিলাম। অথচ এখানে আমার থাকা দরকার।
চিঠিটা পেয়েও তুমি চুপ করে ছিলে কেন? কাগজে সুমিত্রের ছবি বেরিয়েছিল।
চিঠি আমি পেয়েছি ১২ সেপ্টেম্বর। গুয়াহাটি এবং শিলং থেকে ফিরেছি, সেদিনই ডাকে চিঠিটা এল। দীপার মুখে কাগজে সুমিত্রের ছবির কথা শুনলাম। সেদিনই আমার ম্যাড্রাসি বন্ধু আইয়ারকে বলে ওর কটেজের চাবি নিলাম। রেলে দালালের থ্রু দিয়ে দুটো বার্থ ম্যানেজ করলাম।
এক মিনিট! চিঠিটা তুমি ১২ সেপ্টেম্বর পেয়েছিলে?
হাসলাম। অদ্ভুত! ডাকঘরের সিল থেকে শ্রীমান ১ বেমালুম অদৃশ্য। আমি পড়েছি ২ সেপ্টেম্বর। যাইহোক, তারপর?
কাল সন্ধ্যায় সি-বিচে বসে থাকার সময় বাতিঘরের ওপর দুবার লাল আলো জ্বলতে এবং নিভতে দেখলাম। দূরের সমুদ্রে একটা জাহাজ থেকেও দুবার সার্চলাইটের মতো আলো জ্বলে নিভে গেল। সুমিত্র সি-ভিউ হোটেলের কথা লিখেছিল। তাই ভাবলাম, আজ রাতেই একটা অপারেশন হবে। অপারেশন জোন বাতিঘর। তাই লাউঞ্জে দীপাকে বসিয়ে রেখে চুপিচুপি বাতিঘরে গিয়েছিলাম। একটা ঝোঁপের আড়ালে বসে আছি, টর্চের আলো ফেলতে ফেলতে কারা আসছে দেখলাম। তারা বাতিঘরের দিকে এল না। দক্ষিণের জঙ্গলে ঢুকে গেল। কোনও সাড়া নেই আর। চলে আসব ভাবছিলাম। হঠাৎ দেখি বাতিঘরের দরজায় নীল আলোর ফ্ল্যাশ।
গ্যাসকাটারে দরজার তালা কাটছিল।
তা-ই হবে। এবার ভাবলাম, পুলিশকে খবর দেওয়ার সময় হয়েছে। ফিরে এসে দীপাকে নিয়ে কটেজে যাব আগে। তারপর পুলিশ স্টেশন। এই ছিল প্ল্যান। কিন্তু এই হোটেলে ফিরে শুনি দীপাকে আপনি কটেজে রাখতে গেছেন। আপনাকে আমি ভুল বুঝেছিলাম। ক্ষমা চাইছি।
কপট চোখ পাকিয়ে বললাম, ক্ষমা নেই। বলো! তারপর হেসে ফেললাম।
অমল বলল, কটেজ থেকে আপনি বেরিয়ে যাওয়ার পর আমি গেলাম। দীপার মুখে শুনলাম আপনি আমাদের জিনিসপত্র সার্চ করে সুমিত্রের চিঠিটা নিয়ে গেছেন। আমার আর থানায় যাওয়া হল না। খুব ভয় পেয়ে গেলাম। উল্টে এবার আমিই না ফেঁসে যাই। দুজনে মরিয়া হয়ে কটেজ ছাড়লাম। হাঁটতে হাঁটতে বাস-স্টেশনে গেলাম। রাত তিনটেয় একটা বাস রেলস্টেশন হয়ে ম্যাড্রাস যায়।
দীপা তাকে থামিয়ে বলল, আমি ওকে ইনসিস্ট করলাম টিকিট রিফান্ড করতে। ফিরে এসে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বললাম। শেষে রাজি হল। কিন্তু কটেজে গেল না। সারাদিন শুয়ে কাটাল। যে হোটেলে উঠেছি, ওখানে খাওয়ার ব্যবস্থা নেই। তাই বাইরে খেতে গিয়েছিলাম। সেখানে শুনলাম, একটা স্মাগলিং র্যাকেটের লোকেরা ধরা পড়েছে। তখন
বাধা দিয়ে বললাম, অমল! তুমি মাদ্রাজে তোমার দাদাকে খবর দিয়েছ?
অমল বলল, সুমিত্র জানত না। দাদা দিল্লি এয়ারপোর্টে আছেন এখন।
দীপা উঠে দাঁড়াল। চলি কর্নেল সায়েব। বরং সকালে আসব। আমরা আরও তিনদিন থাকছি।
ওদের বিদায় দিতে গেলাম লাউঞ্জ পর্যন্ত। তারপর আস্তে বললাম, যৌবন চরম সাহস দেখাতে পারে শুধু একটি ক্ষেত্রে। যাই হোক, শুভরাত্রি!
দীপা তাকিয়েই চোখ নামাল! ভারতীয় নারীর সেই ঐতিহ্যগত শালীনতা, যার আটপৌরে নাম লজ্জা। আর অমল নিতান্ত গাড়োলের মতো হেসে গেল। সে জানত না, তার জীবনের বাতিঘরে রহস্যময় কাণ্ডিলম ঢুকেছে।…