হাওর
বাংলাদেশের প্রথম ইতিহাস লেখেন জনৈক মোল্লা নাথন, নাথতু। বইখানার নাম বহার-ই স্তানই-গায়েবি অর্থাৎ অজানা চিরবসন্ত ভূমি– ফারসিতে লেখা। নাথু মিঞা দিল্লির লোক। ভাগীরথী পার না হওয়া পর্যন্ত তিনি এমন কোনও দ্যাশ দেখেননি যেখানে ঘোরতর গ্রীষ্মকালেও ঘাস সবুজ থাকে। তাই কেতাবের নাম দিয়েছিলেন চির বসন্ত ভূমি। মিঞা সাহেব এসেছিলেন বাংলা দেশে জাহাঙ্গিরের রাজ সেনানীর সঙ্গে শেষ পাঠান রাজা ওসমানকে পরাজিত করার জন্যে। জাহাঙ্গিরের পিতা আকবর বাদশাহ পুরো বাংলা দেশ জয় করতে পারেননি। তার একমাত্র কারণ মোগলরা শুকনো দেশের লোক; নৌযুদ্ধ কারে কয় জানে না। জাহাঙ্গিরের প্রধান সেনাপতি বেশিরভাগ ভয় দেখিয়ে কিছুটা ঘুষ দিয়ে কয়েকটি মীরজাফর যোগাড় করে নৌযুদ্ধ খানিকটা শিখল। তার পর তারা ওসমানের পিছনে ধাওয়া করল। ওসমানের প্রধান দুর্বলতা ছিল যে তার কাছে যেসব কামান বন্দুক ছিল, সেগুলো মোগলদের তুলনায় নিকৃষ্টতর। তদুপরি জাহাঙ্গিরের সেনাপতি যে প্রচুর সৈন্যদল নিয়ে এসেছিলেন তার সামনে দাঁড়ানো ওসমানের পক্ষে প্রায় অসম্ভব ছিল।
ওই সময়ে বাদশাহ জাহাঙ্গির চিঠি লিখলেন ওসমানকে : আত্মসমর্পণ করো। ওসমান অতি সংযত ভদ্র ভাষায় উত্তর দিলেন, যার মর্মার্থ, আপনি দিল্লীশ্বর, আপনার দেশ দেশব্যাপী বিরাট রাজত্ব। আমি তো তার তুলনায় সামান্য একটি চিড়িয়া। কিন্তু সামান্যতম পাখিটিও স্বাধীনভাবে থাকতে চায়।…. ওসমান জানতেন মোগলরা এতদিনে বেশ কিছুটা নৌ-যুদ্ধ শিখে নিয়েছে। তদুপরি সেটা শীতকাল (ইয়াহিয়া খানের কপাল ভালো যে শেখ মুজিবের সঙ্গে তার ঝগড়াটা চরমে পৌঁছায় মার্চ মাসে; বর্ষা নামলেই চিত্তির। তাই তিনি তিলব্যাজ না সয়ে মারলেন তাঁর হাতুড়ি ওই মোকাতেই)। তাই তিনি স্থির করলেন মোগলদের নিয়ে যেতে হবে সিলেটে। সেখানে যেসব হাওর আছে তার প্রধান ভাগ শীতকালে শুকোয় না। কারণ বৃষ্টির জন্য প্রসিদ্ধতম স্থল চেরাপুজি। তার কুল্লে পানি নেবে আসে সিলেট জেলায়, ডাউঁকি হয়ে জইন্তা হয়ে অসংখ্য নদনদী খাল নালা দিয়ে। এই সব হাওরে সামান্যতম ঝড় উঠলে ওই দেশেরই বহু কিশোর তরুণ তক বমি করতে থাকে– অর্থাৎ বাংলা কথায় সি-সিক হয় (পাঠকের স্মরণ থাকতে পারে ডিডে ল্যান্ডিঙের সমর প্রচুর সৈন্য নরমান্ডির বেলাভূমিতে নেমে সেখানে শুয়ে পড়ে। বমি করতে করতে তাদের পেটে তখন আর কিছু ছিল না যে লড়াই করে করে জর্মনদের ঘাঁটি দখল করে।
নেপোলিয়ন বলেছিলেন, এন আর্মি মার্চেজ অন ইটস স্টমাক। অন্যার্থে। কিন্তু এস্থলে এটা প্রযোজ্য)। এবং ঢাকা থেকে সিলেটের হাওর অবধি এক্কেবারে ফ্ল্যাট। সিলেট পৌঁছলেই আরম্ভ হয় টিলা, কোনও কোনও টিলাকে পাহাড়ও বলা যেতে পারে। ঘন বন জঙ্গল এবং প্রচুর সুপুরিগাছ।… ওসমান তাই পৌঁছলেন সিলেটে। রিয়ার গার্ড একশন করতে করতে। অর্থাৎ তিনটে সুপুরিগাছ জড়িয়ে বেঁধে তার সর্বোচ্চতম প্রান্তে একটা কাঠের প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে সেখানে কামান তুলে নিয়ে দুশমনের উপর কামান দাগতে দাগতে। মিয়াদের তখন তাজ্জব নয়া অভিজ্ঞতা হল। করে করে ওসমান সিলেট জেলার প্রায় আধখানা পেরিয়ে মিয়াদের নিয়ে গেলেন, আজ ম্যাপে যেখানে মৌলবি বাজার, তার তিন মাইল দূরে দুল্লভমপুরে (অধুনা নাম দুর্লভপুর)। তারই পরে হাইল হাওর। ওসমান ও তার সৈন্যদল হাওরের হাঁটুজলে পায়ে হেঁটে ওপারে চলে গেলেন। তিনি জানতেন, মোগলরা এ অঞ্চলে কখনও আসেনি। তারা জানে না কোন জায়গায় হাঁটুজল আর কোন কোন জায়গায় অথৈ জল। মোগলরা এপারে দাঁড়িয়ে। তার পর শুভলগ্নে ওসমান ওপার থেকে হাওর পেরিয়ে আক্রমণ করলেন– মোগল সৈন্যদের। তারা লড়েছিল প্রাণপণ। কিন্তু পরাজয় অনিবার্য বুঝতে পেরে তারা পালাতে আরম্ভ করল। এমন সময় হাতির-পিঠে-বসা অগ্রগামী ওসমানের চোখে এসে ঢুকলো একটা উটকো তীর। মাহুত ভয় পেয়ে হাতি ঘোরাল। ওসমান বুঝতে পেরে চেঁচাচ্ছেন, এগিয়ে চল চল। ওদিকে মোগল সৈন্যদের ভিতর বিজয়ধ্বনি আরম্ভ হয়েছে ওসমান পালাচ্ছে, ওসমান পালাচ্ছে। মোগলরাই জয়ী হল। সে এক করুণ কাহিনী। সুযোগ পেলে আরেকদিন সবিস্তর বলব।
কিন্তু আমি জালা জালা পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটছি কেন? যারা বাংলা দেশ থেকে আসছেন, তাঁরাই বলছেন গেল সাড়ে-দুই মাস ধরে সবচেয়ে মোক্ষম লড়াই দিয়েছে সিলেটের লোক। তাদের কী সুবিধে টিলাবন হাওর– অর্থাৎ তেরা– পূর্বেই বলেছি।
ওসমান যুদ্ধে হারেন শীতকালে মার্চ মাসে। এবারে দেখি ঘন বরষায় তারা হাওরের কী সুযোগ নেয়।
এপিলোগ : আকবর বাদশাহ মারা যান আমাশাতে। বাংলা বিজয় অভিযানে বেহারে! সে আবার আমাশা! ঢাকার আমাশা অলিম্পিক। পিণ্ডির জাঁদরেল যে এই বর্ষায় ঢাকায় আসছেন, তার যদি ভালো-মন্দ কিছু একটা হয়ে যায়। সম্পাদক মহাশয়, আপনি সহৃদয় লোক। তাই আপনাকে অনুরোধ করছি, পিণ্ডির খান সাহেবকে জানিয়ে দিতে, প্রতিদিন দুটো এনটেরো ভায়োফর্ম এবং এক বড়ি ত্রিফলাকস, তদভাবে ইসপগুল তিনি যেন সেবন করেন। যদি তিনি এ যাত্রায় নিস্তার পান তবে ইতিহাস হয়তো আপনার প্রতি কটুকাটব্য করবে! সাধু সাবধান।