হাওয়া-বদল – অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত
দোতলায় সিঁড়ি ছাড়িয়েও একটা লাইন উঠেছে। সেই লাইনের ঠিক মাথায় একনম্বর, কৃষ্ণলাল দাঁড়িয়ে। ‘এর বেশি আর এগোনো যাবে না।’ নিজেই একটা দাঁড়ি টানল। তীক্ষ্ণ লক্ষ্য রাখল কেউ সিট ছেড়ে ওঠে কি না। উঠলে টুক করে বসে পড়বে। লাইনে এক নম্বর হয়ে দাঁড়ানোও ভাগ্যের কথা।
কিন্তু বসতে পেলে সহজে কেউ উঠতে চায় না।
রড নেই, শুধু সিটের পিঠ ধরে কতক্ষণ দাঁড়ানো যায় স্থির হয়ে!
হঠাৎ পিছন থেকে একটা লোক ধাক্কা মারল। কৃষ্ণলাল ভাবল এ বুঝি ভিড়েরই স্বাভাবিক ব্যবহার। গ্রাহ্য করল না।
ঠেলার সঙ্গে পিছনে এবার স্পষ্ট আওয়াজ হল: ‘এগোন!’
ঘাড় ফিরিয়ে একবার দেখল কৃষ্ণলাল। মৃদুস্বরে বললে, ‘আর এগোনো যাবে না।’
‘আপনি না এগোবেন তো আমাকে পাশ দিন। আমি এগোই।’
‘এর বেশি এগোনো বারণ।’
‘বারণ?’ পিছনের লোক তখুনি ফণা তুলল।
‘বারণ মানে বিপজ্জনক। সামনের দিকে ভিড় করলে বাস উলটে যেতে পারে।’
‘তাতে আপনার কী।’
‘আমার কী মানে, আমিও উলটোব।’
বসা লোকগুলির মধ্য থেকে কে একজন হঠাৎ বলে উঠল: ‘আপনি তো অনেক আগেই উলটেছেন।’
কে না কে কী বলছে, কাকে উদ্দেশ করে বলছে, মনোযোগ করল না কৃষ্ণলাল।
‘সরুন।’ পিছনের লোক জঙ্গি লাটের মতো তম্বি করে উঠল।
দৃঢ় থেকে অথচ শান্তস্বরে কৃষ্ণলাল বললে, ‘বলেছি তো এই পয়েন্টের বেশি এগোনো সম্ভব নয়।’
লোকটা মুখিয়ে উঠল : ‘কেন, যখন কণ্ডাক্টর টিকিট দিতে আসবে তখন সে মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াবে না?’
‘হ্যাঁ, তখন—তখন কী?’ সেই অচিহ্নিত যাত্রীটা খেঁকিয়ে উঠল: ‘উনি ভেবেছেন সমস্ত যুক্তি কেবল ওঁরই দিকে। অন্যদিকে কিছুমাত্র যুক্তি নেই। কিন্তু কণ্ডাক্টর যখন এসে দাঁড়াবে, তখন? ঠিক বলেছেন। তখন?’
যাত্রীটা কে একনজর তাকাল কৃষ্ণলাল। চিনতে পারল না।
সেই দিকে চোখ না দিয়ে পিছনের লোককেই লক্ষ করল কৃষ্ণলাল। বললে, ‘কণ্ডাক্টর তো একজন, সে আর কতক্ষণ দাঁড়াবে, ভাড়া নিয়ে নেবে, চলে যাবে। আর আপনি প্যাসেঞ্জার, আপনি যদি দাঁড়ান, আপনার নজির দেখিয়ে আরও প্যাসেঞ্জার গিয়ে দাঁড়াতে পারে, তাহলেই তো কুপোকাত। সুতরাং যেখানে আছেন সেইখানে থাকুন।’
সেই গায়ে-পড়া যাত্রী মন্তব্য করে উঠল: ‘এখনও বক্তৃতা মারে দেখি! নজির দেখায়! খবরদার এক জায়গায় থাকবেন না মশাই, কেউ থাকে না, সবাই এগোয়, উন্নতি করে।’ বলে কীরকম বিষাক্ত শব্দে হেসে উঠল।
পাগল নাকি লোকটা? কৃষ্ণলাল একটু স্থির দৃষ্টিতে দেখতে চাইল। কেমন চেনা-চেনা লাগছে না?
পিছনের লোকটাও নিবৃত্ত হয় না। ঠেলা মেরে বললে, ‘আমার দেখাদেখি আরও অনেক যাত্রী উপরের ডেকে এসে দাঁড়াতে চাইবে এ আপনি অনুমান করছেন কেন? আর কেউ আসছে, আসতে চাইছে?’
‘আসতে চাইলে ঠেকাবেন কী করে? একটা প্রিন্সিপল তো মানতে হবে।’
শুধু নজির নয়, প্রিন্সিপল দেখায়! কুলের বার হয়ে যাবার পরেও শাস্ত্র আওড়ায়!’
এবার কৃষ্ণলাল একটু সূক্ষ্ম করে তাকাল। সেই নিলফামারির অনঙ্গমোহন না? হ্যাঁ, সেই-ই তো, ঠিক সে-ই। মনে পড়ছে, তার কোর্টের আমলা ছিল। আদালত সংক্রান্ত কী একটা জঘন্য ব্যাপারে তার বিরুদ্ধে প্রসিডিং হয়। ঘোরতর শাস্তি হতে পারত, শুধু নীচের পোস্টে নামিয়ে দিয়েই রেহাই দেওয়া হল। চাকরিটা যে গেল না তার জন্য কৃতজ্ঞতা নেই, নামিয়ে যে দেওয়া হয়েছে এটাই তার কাছে নিদারুণ অবিচার।
সে তো কত যুগ আগের কথা। সে রামও নেই রাবণও নেই। আর সোনার লঙ্কা তো কবে পুড়ে-ঝুরে শেষ হয়ে গিয়েছে।
পিছনের লোক আবার ঠেলা মারল। ‘সঙ্গে এই ব্যাগটা আছে বলেই আপনাকে সরে যেতে বলছি, দাঁড়াতে অসুবিধে হচ্ছে।’
‘এমনি শুধু হাতেই লোকে উঠতে পারে না, আপনার আবার ব্যাগ! ব্যাগ নিয়ে ওঠে কে? ’
সেই বসা লোকটা আবার তড়পে উঠল তার সিট থেকে: ‘ব্যাগ নিয়ে ওঠা যাবে না—একথা কোথায় আছে? ব্যাগ নিয়ে কোনও কথা হয় সে কণ্ডাক্টার কইবে—উনি কে? বেশ করেছেন ব্যাগ নিয়ে উঠেছেন।’
‘সত্যি অসুবিধে হচ্ছে—’ পিছনের লোক আবার ঠেলা মারল।
অসুবিধে হচ্ছে, এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালে কী সুরাহা হবে প্রশ্ন তুলতে পারত কৃষ্ণলাল। কিন্তু যেহেতু লোকটার সুর একটু মৃদু হয়েছে, কৃষ্ণলালও নরম হল। বললে, ‘আপনার যখন অসুবিধে হচ্ছে তখন আমি আপনাকে এগোতে দিতে পারি, কিন্তু এক শর্তে—’
‘কী?’ সমস্ত বাস প্রায় একসঙ্গে কৃষ্ণলালের দিকে তাকাল।
‘সিট খালি হলে আমি প্রথমে গিয়ে বসব।’
‘কোন আইনে?’ সেই বসা লোকটা আবার হুমকে উঠল।
আচ্ছা, ও লোকটা কি তবে বাগেরহাটের যজ্ঞেশ্বর? যে আস্ত একটা দশ টাকার নোট খেয়ে ফেলে দেখিয়ে দিয়েছিল কাকে বলে ঘুষ খাওয়া? কৃষ্ণলাল সেদিকে দৃকপাত করল না। বললে, ‘আমি সকলের আগে উঠেছি, লাইনে আমি এক নম্বর, সুতরাং খালি সিটে আমারই প্রথম অধিকার।’
‘অধিকার! শুনুন। দুর্ভিক্ষের দেশে অধিকার! একটা বাস-এ এক জাহাজ লোক উঠেছে, তাতে কিনা প্রায়রিটি!’
‘দ্বিতীয়ত আমি বৃদ্ধ।’ কৃষ্ণলাল জোর দিয়ে বললে।
‘শুনুন! ব্যাগ নিয়ে বাস-এ ওঠা যদি অপরাধ হয় তাহলে বৃদ্ধত্ব নিয়ে ওঠাও অপরাধ। কেন, গাড়ি গেল কোথায়? সেই আদ্যিকালের বদ্যিবুড়ো লজঝড় যেটা ছিল?’
কৃষ্ণলাল এবার অনঙ্গমোহন না যজ্ঞেশ্বরের দিকে না তাকিয়ে পারল না। বললে, ‘আচ্ছা, আপনাকে তো আমি কিছু বলছি না, আপনি তৃতীয় পক্ষ—’
‘পক্ষ! শুনুন! এখানেও পক্ষদোষ! মিসজয়েণ্ডার অফ পার্টিজ। বলি সবই তো গেছে, কোট গেছে, গাউন গেছে, ব্যান্ড গেছে, প্যান্ট গেছে, আদালতি মেজাজটা এখনও যায়নি কেন? সামান্য বাস-এ দাঁড়ানোও নিয়ে জজিয়তি ফলাচ্ছেন!’ অধিকার শোনাচ্ছেন!’
‘আপনি কাকে কী বলছেন?’ কৃষ্ণলাল আকাশ পড়ার মতো মুখ করল।
‘ঠিক লোককেই বলছি।’
‘আপনার ভুল হয়েছে।’
‘ভুল হবে কেন? আপনি সেই জজ কেষ্টলাল না?’
নিষ্প্রভ মুখে কৃষ্ণলাল উদাসীনের মতো হাসল: ‘কাকে যে কী বলেন তার ঠিক নেই। আমি কেষ্ট বিষ্টু কেউ নই।’
‘তাতো নয়ই, তবে ডিষ্ট্রিক্টে যখন ছিলেন, ভাব দেখাতেন যেন হাতে মাথা কাটতে পারেন। কেন আমাকে চিনতে পারছেন না?’
‘বাঃ, আপনাকে কী করে চিনব?’
‘খুব চিনবেন। আমি সেই রাজসাহির কপিল ভাদুড়ি। যাকে ইনসাবঅর্ডিনেশনের জন্যে ডিমোট করে দিয়েছিলেন, কী, মনে পড়ে? মুখের উপর কথা বলেছিলাম, উত্তর দিয়েছিলাম, এই তো অপরাধ। তার জন্যে লোকে বড়জোর পাঁচ টাকা ফাইন করে, নীচের পোস্টে কে নামিয়ে দেয়! কী জঘন্য ভিনডিকটিভ আপনি!’
‘আপনার আগাগোড়া ভুল হচ্ছে।’ কৃষ্ণলাল প্রশান্ত স্বরে বললে।
‘কিন্তু এখন আপনি কী করতে পারেন? ইনসাবঅর্ডিনেশন! অবাধ্যতা! এখন আপনাকে দুটো বুড়ো আঙুল দেখালেও কিচ্ছু করতে পারেন না।’
‘দেখুন আমি তো আপনার সঙ্গে কোনো বচসা করিনি।’ অদ্ভুত ঠাণ্ডা গলায় কৃষ্ণলাল বললে, ‘আপনি কেন লাগছেন?’
‘একশো বার লাগব। সমস্ত বাসযাত্রীর পক্ষ থেকে বলব, নিজেও এগোবেন না অন্যকেও এগোতে দেবেন না, এ সাংঘাতিক অবিচার। আপনি আবার আইন দেখান, প্রিন্সিপল দেখান। রিটায়ার করেছেন, বনে চলে যান, কে পোঁছে আপনার আইন! আইনের ব্যাখ্যা করে দু’পৃষ্ঠা রায় লিখে দিন না, ঠোঙার কাগজের দরেও বিকোবে না।’
বাস-এর আর সব লোক কেউ শুনছে, কেউ হাসছে, কেউ মজা দেখছে, কোনও পক্ষ নেবে কি না, নিলে কোন পক্ষ নেবে, তা-ই আঁচ করছে। কৃষ্ণলাল পালটা কী বলে তারই অপেক্ষা করছে।
কৃষ্ণলাল চুপ করে রইল। স্তব্ধতাই সম্ভ্রান্ত।
শুধু পিছনের লোকটা যে এগোতে পারেনি, আটকে আছে, এই শুধু শান্তি।
কিন্তু শান্তি কখনও স্থায়ী নয়। পিছনের লোক আবার ধাক্কা মারল: ‘সরুন।’
কৃষ্ণলাল পাথর হয়ে রইল।
‘এই আমি আমার সিট ছেড়ে দিচ্ছি।’ কপিল উঠে পড়ল। পিছনের সেই ব্যাগওলা ঠেলামারা লোকটাকে লক্ষ করে বললে, ‘আপনি আসুন। আপনি এসে বসুন। আমার সিট আমি আপনাকে দিয়ে যাব।’
কৃষ্ণলাল পাশ দিল। পাশ না দিয়ে উপায় নেই। নিজে বসবার জন্যে এগোলে কপিলই আবার পরিত্যক্ত সিটে বসে পড়ে তাকে ঠেকাবে। সেটাতে আরও অপদস্থ দেখাবে।
পিছনের লোক সহজেই এগিয়ে গিয়ে বসল। আর কপিল দাঁড়িয়ে রইল। নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গের আনন্দে হাসতে লাগল।
‘কি, এটা ইনসাবঅর্ডিনেশান হল? কিন্তু আজ আর কী করতে পারেন আপনি? কোনও ক্ষমতা আছে? মুখে তুড়ে দিলেও কিছু করতে পারেন না। সেই সিল নেই, মোহর নেই দস্তখত নেই।’ মুখের কাছে এসে আঙুল নাড়ল কপিল: ‘কিচ্ছু নেই। এই তো দাঁড়িয়েছি ডেকের উপর, কী, প্রসিডিং করবেন?’ তারপর সরে এসে কৃষ্ণলালের সামনে পিছন ফিরে দাঁড়াল। বললে, ‘কী, আমিই তো এখন এক নম্বর হয়ে গেলাম। এখন সিট খালি হলে প্রথম বসবার অধিকার কার? আপনার, না, আমার? প্রিন্সিপল কী বলে?’
কৃষ্ণলাল কথা বলল না।
দেখা গেল পরের স্টপেই নামছে কপিল।
‘কী, এবার সরবেন তো? না, নামবার বেলায়ও আপনার অধিকার আগে হবে? অধিকার! অধিকার না ঘোড়ার ডিম! যে রিটায়ার করেছে, তার সমস্ত অধিকারটাও রিটায়ার করেছে। তার ভদ্রতা শালীনতা সব রিটায়ার করেছে। নইলে বাস-এ উঠে প্যাসেঞ্জারের সঙ্গে ঝগড়া করে! বলে, ইনসাবঅর্ডিনেশান! ক্ষমতা নেই, আস্ফালন আছে!’
পিছু-পিছু কৃষ্ণালও নেমে পড়েছে বাস থেকে। তারও স্টপেজ বুঝি এখানে। নামতে-নামতে চশমাটা খুলে নিয়ে পকেটে পুরেছে।
আর নেমে পড়েই কপিলের গলার কাছেকার জামার খানিকটা বাঁ হাতে মুঠ করে চেপে ধরে ডান হাতে তার মুখে প্রবল ঘুষি মেরে বসল। বললে, ‘আমার সব গেছে, কোট গেছে, গাউন গেছে, পায়ের ফিতে বাঁধা জুতো গেছে, সহ্য করার ক্ষমতা গেছে— ভদ্রতা-শালীনতা সংযম-সম্ভ্রম সব গেছে, কিন্তু এখনও মনুষ্যত্বটুকু যায়নি।’ বলছে আর চালাচ্ছে ঘুষি: ‘তোমার সেদিনের শাস্তি সম্পূর্ণ হয়নি, এটা বাকি ছিল—’
মার মার, পকেটমার পকেটমার— জনতা রুখে উঠল। প্রথমে যে মার খায়, জনতার চোখে সে-ই চোর, সে-ই অপরাধী বলে চিহ্নিত হয়। তাই জনতাও চাঁদা করে হাত মেলাল।
অগত্যা গালাগাল দিতে লাগল কপিল। রাগে চণ্ডাল হতে বাধা নেই, কৃষ্ণলালের মনে হল সে-ও ইচ্ছে করলে প্রচুর খিস্তি দিতে পারে। কিন্তু দেখল দরকার নেই। যে মারে সে হারে না।
যাত্রীরা অনেকে নেমে পড়ল। কেউ কেউ বললে, ‘ভদ্রলোক চটবে না তো কী! নিরীহ বুড়ো মানুষ, গোবেচারা, বাস-এর প্যাসেঞ্জার, তাকে বলে কিনা সাহেব, জজসাহেব!’
কৃষ্ণলালও হাসল।
ভাবল জীবনে কিছুই যায় না, শুধু হাওয়া বদল হয়। তার জীবনেও আবার হাওয়া বদল হবে। আদালতের শালু দিয়ে মোড়া এজলাসেই এতদিন বসে এসেছে, এবার জানবে কাকে বলে আসামি হয়ে কাঠগড়ায় দাঁড়ানো।
২৬.০৬.১৯৬৬
লেখক পরিচিতি
অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত : ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে নোয়াখালিতে জন্ম। নীহারিকা দেবী ছদ্মনামে তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় ১৩২৮ বঙ্গাব্দের প্রবাসী পত্রিকায়। শতাধিক বই লিখেছেন। ‘কল্লোল যুগ’ বইটি বাংলা সাহিত্যে একটি সমাদৃত স্মৃতিচারণী সমাদৃত। বহু ছোটগল্প লিখেছেন। ১৯৭৫-এ ‘উত্তরায়ণ’ কাব্যগ্রন্থের জন্য রবীন্দ্র পুরস্কার। মৃত্যু: ২৯ জানুয়ারি ১৯৭৬।