হাওয়া এলোমেলো – ৫

পাঁচ 

খুব উঁচুতে, খুব উঁচু আকাশের কোল ঘেঁষে, একখানা সাদা মেঘ ভাসছিল। দুধের মতো ধপধপে সাদা। আর তার চারপাশে ঢেউ তোলা তোলা ঝালর। 

মেঘখানা নীচে নামতে লাগল। নামতে নামতে, নামতে নামতে চম্পির একেবারে মাথার উপরে এসে থেমে গেল। কে যেন তার চারকোনায় দড়ি বেঁধে টান টান করে টাঙিয়ে রেখেছে। ঠিক যেন একখানা মশারির চাঁদোয়া। ওমা, মশারিই তো! পরিষ্কার ধপধপে একটা ঝালরদার মশারি। নেটের মশারি। তাদের বাড়ির লালচে লালচে ময়লা চিমসে গন্ধওয়ালা মশারি নয়। যার সর্বাঙ্গে নানারঙের তালিমারা, যার জায়গায় জায়গায় ঝুঁটি বাঁধা, যার চারকোনায় ছারপোকা মারার রস আর গন্ধ জমা হয়ে আছে, এ সে-মশারি নয়। একটুও ভ্যাপসা গন্ধ নেই। ভাঁজকরা নেটের ফুটোগুলো যেন বিলাতি চিনির চৌকো শক্ত দানার মাপে মাপে কাটা। 

এ-মশারিতে কারা শোয়? সেই তারা। ছোটবেলায় ঠাকুমার কোলে শুয়ে যাদের গল্প শুনেছে চম্পি, সেই শঙ্খমালা, কাঞ্চনমালা, মণিমালা, রাজকন্যারা। সোনার পালঙ্কে, পালকের নরম বিছানায় তারা শুয়ে থাকে। শিয়রে ঘৃতের প্রদীপ জ্বলে। কালপরি নিদ্রাপরি পুরীর উপরে উড়াল দিয়ে যেতে যেতে রাজকন্যার রূপ দেখে থমকে যায়, বলাবলি করে, এই রাজকন্যার যোগ্য বর, উজানী নগরের সেই রূপকুমার। চলো আজ মিলন ঘটাই। এই বলে তারা রাজকন্যার চোখে ঘুমের কাজল পরিয়ে পালঙ্ক সমেত তাকে নিয়ে হাজির করে রূপকুমার রাজপুত্রের দেশে। এ-মশারি সেই রাজকন্যা রাজপুত্রদের মশারি। 

চম্পি এখানে এল কী করে? সে চোখ ঘুরাতেই আরেক জোড়া ব্যগ্র চোখে তার দৃষ্টি আটকে যায়। এ চোখ চম্পির চেনা। স্বপ্নেই যেন এ মুখ সে দেখেছে। স্বপ্ন ছাড়া এমন সুন্দর একখানা মুখকে তার সান্নিধ্যে আর কে আনবে? এখনও সে স্বপ্নই দেখছে। 

চম্পিকে চাইতে দেখে সুন্দর মুখখানা হাসিতে ভরে গেল। দুর্ভাবনা মাখা আয়ত দুটো চোখ নিমেষে পরিষ্কার হয়ে গেল। মুখের হাসি চোখেও ছড়িয়ে পড়ল। তার হাতে একখানা পাখা ছিল। সে প্রাণপণে বাতাস করছিল। তার হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরা পাখার ডাঁটের উপর নজর পড়ল চম্পির। বেশ নরম বিছানায় সে শুয়ে আছে। পালকের গদি কি এমনি নরম হয়। 

সেই হাসি-হাসি মুখের দিয়ে চেয়ে চম্পির ঠোঁটেও এক হাসি ফুটে উঠল। চম্পি সে হাসি দেখতে পেল না। দেখছিল তাকে, ও হাসি যার চোখে রামধনুর তরঙ্গ ফুটিয়ে তুলল। 

এই যে বউদি, ইনি চোখ মেলেছেন। 

চম্পি রিনরিনে মেয়েলি এক গলায় একরাশ উদ্‌বেগ ফুটে উঠতে শুনল। সঙ্গে সঙ্গে দেখল ও দুটি চোখ থেকে রামধনু রং নিমেষে মিলিয়ে গেল। দুটি উজ্জ্বল চোখের তারা তার দিকে সন্ধানী দৃষ্টি ফেলে চেয়ে রয়েছে। এ চোখ তো সে চেনে, এই মেয়েলি গলাও সে চেনে। এ তো সুহাসবাবু। 

সুহাসবাবু তার দিকে এমনভাবে চেয়ে আছেন কেন? সে সুহাসবাবুকে এত কাছে আসতে দিয়েছে কেন? বিব্রত হল চম্পি। ছি ছি। তাড়াতাড়ি উঠতে গেল সে। সঙ্গে সঙ্গে সুহাস তার কপালে হাত দিয়ে শুইয়ে দিল। চম্পির সারা শরীরে উত্তাপের ঢেউ ভেঙে পড়ল। ব্যাপার কী? সে কোথায়? 

উঠো না মা, এখন উঠো না। এত গরমে এতখানি পথ এসেছ তো, তাই বোধহয় মাথাটা ঘুরে গিয়েছিল। শুয়ে থাকো এখন। আমি একটু গরম দুধ পাঠিয়ে দিই। 

ফুলুকাকিমার গলা। হ্যাঁ, ওই যে তিনি চেয়ারে বসে আছেন। এই যে শৈলদি তার হাঁটুর কাছে। সে মূর্ছা গিয়েছে নাকি? ছি ছি কী কাণ্ড! ফুলুকাকিমা উঠে গেলেন। 

শৈল বলল, আমি আর ঠাকুরপো নিজের মনেই বকে যাচ্ছি। ও একটা কথারও জবাব দেয় না। আমি বলি হল কী? শেষে এই কাণ্ড। বাব্বা! আমি তো ভয়ে মরি। 

সুহাস বলল, ভয়ে মরার একটা সুবিধে আছে, হাতে ব্যথা হয় না। কিন্তু বাতাস করতে করতে আমি যে মারা পড়লাম। 

সুহাস হাতের অদ্ভুত মুদ্রা করে বোঝাল ও দুটোর আর কিছু নেই 

ব্যাজার মুখে বলল, আগে জানলে আমিও ভয়েই মরার চেষ্টা করতাম, হাত দুটো বাঁচত।

সুহাসের কথায় সবাই হেসে উঠলেন। চম্পি লজ্জা পেল, তবু সে-ও হাসল।

বলল, আমি এবার উঠব। 

সুহাস বলল, উঠবেন উঠুন, কিন্তু দোহাই আর পড়বেন না যেন। আবার যদি পড়েন আমি কিন্তু আর পাখা ঠেলতে পারব না। 

চম্পি সলজ্জভাবে উঠে পড়ল। মুখ নিচু করে বসে বসে সে ঘামতে লাগল। সত্যিই বড় রকমের একটা কেলেঙ্কারি সে করে ফেলেছে। কেন সে অজ্ঞান হয়ে পড়ল। ছি ছি। 

শৈল সুহাসকে ধমক দিল। 

ও কী, ভাই ঠাকুরপো, ওভাবে কাউকে বলে নাকি? ছি। না ভাই চম্পি, ওর কথায় কিছু মনে কোরো না। ঠাকুরপোটা ওই রকমই। রাতদিন সকলের পিছনে লেগে আছে। 

সুহাস হাসতে হাসতে বলল, তবে তো আমার গুণের কথা সবই শুনে ফেললেন। আর বাকি রইল না কিছু। বউদির কথা শুনে এখন আমার ধারণা হচ্ছে আপনার গুণপনার যে ফিরিস্তি বউদি দিয়েছে সেটাও বোধহয় সেই রকম‍ই সত্যি। 

চম্পি সুহাসের কথা শুনে হকচকিয়ে শৈলর দিকে চাইল। ওর বিব্রত চোখমুখ যেন বলে উঠল, কী বলেছে শৈলদি? কী বলাবলি করছিলে তোমরা? চম্পির বুক ধুকপুক করতে লাগল। বিশেষ করে এখন মনে পড়তে লাগল, সে এত বয়েস পর্যন্ত যে-সব দোষ, যে-সব ত্রুটি করেছে, সেই সব অপরাধগুলোর কথা। টুনির সেই কাঁচির ব্যাপারটা কি শৈলদি জানে? ওরা কি তখন এখানে ছিল? না থাকলেই বা কী টুনি হয়তো চিঠি লিখে জানিয়েছে শৈলদিকে? এক মুহূর্তের লোভে চম্পি সেদিন যে কত গুরুতর এক অপরাধ করেছিল আজ এখন, এই ঘরে সুহাসের সামনে বসে বুঝতে পারছে। সুহাসবাবু কি সে-কথা জেনে ফেলেছেন? কী ভাবছেন তাকে? আপনার গুণপনার যে ফিরিস্তি বউদি দিয়েছে।…কেমন মিহি করে বলল সুহাস। কী কী ফিরিস্তি দিয়েছে। সে বাবার গলার কাঁটা হয়ে বসে আছে? বারে বারে তার সম্বন্ধ আসছে আর ভেঙে যাচ্ছে? সে কালো, তাই কেউ পছন্দ করছে না? সে অপরাধ কি আমার? সুহাসের কাছে সে আবেদন করল। আর কী বলেছে শৈলদি, কী বলতে পারে আর? সে ঝগড়াটে, যদি মুখ খোলে একবার, কেউ তার মুখের সামনে নাকি দাঁড়াতে পারে না। সত্য বটে, সে অন্যায় কথা সহ্য করতে পারে না, অপমান তার খুবই বাজে, জবাবও দেয়। তা বলে সে গায়ে পড়ে তো কাউকে কিছু বলতে যায় না, বলে না। এই গ্রামের অন্যেরাই বরং সে ব্যাপারে পটু। মর্মান্তিক অপমান তাকে কেউ করলে সে তাকে অল্পে ছেড়ে দেয় না। আপনি, আপনি কী করেন? যদি কেউ আপনাকে অপমান করে? সুহাসকে সে জিজ্ঞাসা করল মনে মনে। এই গ্রামের লোক তাকে কী চোখে দেখে, সবটা না জানলেও সে সম্পর্কে চম্পির নিজস্ব একটা ধারণা আছে। এ তার হীনম্মন্যতা। আর সেটা সে মেনেই নিয়েছে। কিন্তু সুহাসও কি সেই চোখে তাকে দেখছে? 

সেই সুহাস, যে কলকাতার শিক্ষিত মার্জিত ছেলে, যে তাকে আপনি বলে সম্মান দেখায় (জীবনে এই প্রথম একজন তাকে অদ্ভুত সম্মান দেখাচ্ছে, যে তাকে পাখার বাতাস করছে, যে উদ্‌বিগ্ন চোখে তার মুখের দিকে চেয়েছিল। ‘উঠবেন না উঠবেন না, আঃ’ এই স্বর সে জীবনে ভুলবে না। সুহাস তার কপালে হাত দিয়ে আবার বিছানায় শুইয়ে দিয়েছিল। স্পর্শটা চম্পির কপালে অকস্মাৎ জীবন্ত হয়ে উঠল। সুহাস কি এখনও ওখানে হাত দিয়ে আছে? ওর হাতটা কোমল, না কর্কশ? জীবনে আর-একবার সে পরপুরুষের স্পর্শ পেয়েছিল। চাকলার কাছারিতে বাসন্তী-পুজোর বিসর্জনের দিনে কোন এক বদমায়েশ লোক তার গাল টিপে দিয়েছিল। সে তাকে দেখেনি। অনুভব করেছিল, কী কর্কশ লোকটার হাতটা! সুহাসের হাত কেমন, সে খেয়াল করেনি। কিন্তু সে-স্পর্শের যে-অনুভব তার দেহে লেগে রয়েছে সেটা আদৌ বিরক্তিকর নয়।) হ্যাঁ, যে সুহাস তার মুখের দিকে চেয়েছিল, সে তাকে খারাপ ভাবুক চম্পির মন তা চায় না। সুহাস তার জন্য অপেক্ষা করেছিল। কী বাজে কথাই না বলতে পারেন সুহাসবাবু! কিন্তু দুটি উদ্‌বিগ্ন চোখ মেলে তার দিকে যে চেয়েছিল সুহাস। 

শৈল বলল, এই ত চম্পি আছে, তুমি ওকেই জিজ্ঞেস করো না, আমি বাজে কথা বলছি কি না? ভারী সুন্দর গলা চম্পির। কী ভাল যে গায় 

সুহাস বলল, আমাদের কি সে সৌভাগ্য হবে?

(সুহাস তার মুখের দিকে ততক্ষণ চেয়েছিল!)

শৈল বলল, চম্পি ভাই, একখানা গান শোনাবে? 

(যতক্ষণ সে অজ্ঞান হয়ে ছিল ততক্ষণ? আচ্ছা, কে ওকে শুইয়ে দিল বিছানায়? সুহাসবাবু কি? ) 

সুহাস বলল, গাইতে পারবেন কি? ওঁর শরীরটা বিশেষ ভাল নয় বলেই মনে হচ্ছে। 

(নিশ্চয়ই সুহাস। সুহাস ছাড়া তার এতবড় গতরখানা কে আর তুলতে পারে বিছানায়। চম্পি তো একটা হাতি। একটা ঢেঁকি।) 

শৈল বলল, চম্পি ও চম্পি! 

(যত্ন করে তাকে তুলেছে সুহাস। যত্ন করে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছে। যত্ন করে পাখার বাতাস করেছে।) 

চম্পি, ও চম্পি, কী ভাই কথা বলছ না কেন? 

(যত্ন যত্ন যত্ন। সুহাসের মতো একটা লোক, তার মতো নগণ্য একটা মেয়ের জন্য এত কষ্ট স্বীকার করেছে। আমি কি তার যোগ্য? এ কিন্তু সত্যি নয়। আমি বলছি, সত্যি নয়। এ এক মায়ার খেলা।) 

এই, এই, কী হয়েছে আপনার? 

সুহাস হঠাৎ চম্পির দুই ডানা ধরে ঝাঁকানি দিল। চম্পি সংবিৎ ফিরে পেল। এ কী ব্যাপার, অ্যাঁ! 

সুহাস বলল, কী, আবার শরীর খারাপ করছে নাকি? 

চম্পি তাড়াতাড়ি বলে উঠল, না না। 

শৈল বলল, তবে? খুব দুর্বল লাগছে বুঝি? 

চম্পি তেমনি তাড়াতাড়ি মাথা নাড়ল, হ্যাঁ। 

সুহাস বলল, বউদি, তুমি শিগগির দুধটা নিয়ে এসো।

শৈল বলল, ঠিক বলেছ। 

শৈল ঘর ছেড়ে চলে যাবার পর চম্পি বুঝল, একা ঘরে সে আর সুহাস। না না, ছি-ছি কী বিচ্ছিরি! তক্ষুনি চম্পিও ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে পারলে যেন বাঁচে। কিন্তু সে সাহস পেল না। সত্যিই তার তখন বেশ একটু দুর্বল দুর্বল লাগছে। উঠতে গেলে যদি কিছু হয়ে যায় আবার! তা হলে এই ফাঁকা ঘরে সুহাস আবার…না না, তার চেয়ে বসেই থাক চম্পি। কিন্তু তাতেও যে প্রবল অস্বস্তি লাগছে তার। কান মুখ ঝাঁ-ঝাঁ করছে। ধুকপুক করছে বুক। চম্পি ঘামতে লাগল। সে সুহাসের দিকে না চেয়েও বুঝল, সুহাস তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। একটু আড়াল পেলে চম্পির যেন সুবিধে হত। কিন্তু তার আর সুহাসের মধ্যে কোনও আড়াল নেই। ফাঁকা মাঠে প্রখর সূর্যের আলো যেমন আপন বিক্রমে ঝরে পড়তে থাকে, চম্পির দেহের উপর তেমনিভাবে যেন সুহাসের দৃষ্টি ঝাঁপিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। ভিতরে পরার জামা চম্পির নেই। হঠাৎ তার মনে পড়ল। একটা ছিল ছিঁড়ে গেছে। সে তো জানত না, সুহাস বলে এমন একজন কেউ এই পৃথিবীতে আছে। সে তো জানত না তাকে এমন অরক্ষিতভাবে সেই সুহাসের প্রতিরোধহীন দৃষ্টির সামনে পড়তে হবে। আগে জানলে সে হয়তো আসতই না। যদিও আসত, তবে সতর্ক হয়েই আসত, অন্তত কাকিমার জামাটা পরে আসত। শুধু সেমিজে তার যেন লজ্জা ঢাকছে না। কাপড়ের আঁচল দিয়ে সর্বাঙ্গ ঢেকে বসেছে, তবুও না। কী বিপত্তিতেই না সে পড়েছে। 

শৈলদিই বা আসছে না কেন? তার যাবারই বা দরকার ছিল কী? 

সত্যি, আপনার চেহারাটায় কিন্তু শিল্পী-শিল্পী ভাব আছে। 

সুহাসের হঠাৎ মন্তব্যে চমক খেয়ে চম্পি তার দিকে চাইল। সুহাসের চোখে কিন্তু ঠাট্টা নেই। সেই রামধনুর মায়াও নেই। এ চোখের দিকে তবু চাওয়া যায়। সুহাসের কথা সে বুঝল না। শিল্পী কথাটার কী মানে সে তো জানে না। কখনও শোনেনি। এসব হয়তো কলকাতার কোনও কথা। শিল্পী-শিল্পী ভাব? কথাটা শুনে তার পিলসুজের কথা মনে পড়ল। সে কি পিলসুজ? সে কি তবে পিলপে? চম্পি পিলসুজের সঙ্গে তার চেহারাটা কল্পনায় মিলিয়ে নিল। ধ্যাত, হাসি পেল তার। আর আশ্চর্য এই দুঃসহ অস্বস্তি অনেকখানি কমে গেল। 

সুহাস বলল, কী গান জানেন আপনি? 

কী গান আবার? সে কি কাউকে শোনাবার মতো নাকি? গ্রামের মেয়েদের মধ্যে সে আগে তার গান শোনাত। যা শুনত, তাই গাইতে পারত। শুধু এক বষ্টুমির কাছ থেকে গোটা কতক পদাবলী কীর্তন যত্ন করে শিখেছিল। আর মেজকাকার কাছে যশোরে গিয়ে একবার মাস পাঁচেক ছিল, তখন কাকার কলের গান থেকে কিছু গান শিখে এসেছিল। তাই তখন গাইত চম্পি। তখন তো সে যূথির চেয়েও ছোট। বারকয়েক বাসর-ঘরে গাইবার জন্য তার ডাক পড়েছিল। গেয়েও ছিল। খুব প্রশংসা পেয়েছিল নয়ন, বনা আর কমলার বরের কাছ থেকেও। ওরা কেউ গানের গ-ও জানত না, তবু এই নিয়ে এককালে গর্ব করত চম্পি। ভগবান তার শাস্তি দিচ্ছেন। ওরা সব্বাই কবেই শ্বশুর ঘর করতে চলে গেছে। আর গুণবতী চম্পি থুবড়ো হয়ে এখনও পড়ে আছে গ্রামে। গান অনেকদিন বন্ধ হয়ে গিয়েছে তার। শৈলদি বুঝি সেই কথাই বলেছে সুহাসকে। হা আমার কপাল! 

তবুও তো, শৈলদিই একমাত্র মনে রেখেছে সে-কথা। তার কলকাতার দেওরের কাছে বলেছে। সুহাস আন্তরিকভাবে আগ্রহ দেখাচ্ছে। আর কারও বোধহয় মনেই নেই। চম্পি নিজেও তো ভুলে গিয়েছিল। সে কেমন এক অদ্ভুত প্রেরণা পাচ্ছে যেন। প্রাত্যহিক জীবনের ব্যর্থতা, হতাশা, সংকীর্ণতার গণ্ডি থেকে তার হাত ধরে কে যেন মহত্তর কোন এক জায়গায় তুলে নিয়ে যেতে এসেছে। সে যেন বাক্সের কোণে বহুদিন পড়ে থাকা একটা পয়সা। এক পিঠ যার তেলা। ঘসা। এতদিন এই পিঠটা দেখেই সবাই তার মূল্য নির্ধারণ করেছে। আজ শৈলদি এসে সেটা যেন উলটে দিল। দেখা গেল ওপিঠটা একেবারে অক্ষত রয়েছে। ছাপটা পরিষ্কার পড়া যায়। তাই দেখে সুহাস যেন ভরসা দিচ্ছে, ও পয়সা একেবারে অচল নয়। চলতেও পারে। তাই যেন সে নেড়েচেড়ে দেখছে তাকে। চম্পির মতো মেয়ের পক্ষে তাই বা কম কী? 

সে সলজ্জ হেসে মৃদুস্বরে বলল, শৈলদি খুব বাড়ায়ে বলিছে। 

সুহাস বলল, যাক, কথা যখন ফুটেছে তখন সুর বেরুবার ভরসাও আছে। 

সুহাস এবার হেসে উঠল। শৈল দুধের বাটি নিয়ে ঢুকে পড়ল। 

টেবিলের উপর সেটা রেখে বলল, কী ভাই, হাসি কেন? আমি বাদ পড়লাম বুঝি? 

সুহাস হাসতে হাসতে বলল, না বউদি, বাদ যাতে না পড়ো, এতক্ষণে তো তারই ব্যবস্থা হল। ওর মুখে কথা ফুটেছে। 

শৈল ঘরে ঢুকবার সঙ্গে সঙ্গে চম্পির সংকোচ অনেকখানি কমে গেল। তার সহজ সত্তাটা সে ফিরে পেল। এতক্ষণ পরে তার মনটা সজীব হয়ে উঠল। 

শৈল বলল, বেশ হয়েছে। চম্পি ভাই, তুমি দুধটুকু খেয়ে নাও। 

চম্পি বলল, না না শৈলদি। দুধ খাব কী? 

কিছুতেই সে দুধ খেল না। সে এখন যথেষ্ট সুস্থ হয়ে উঠেছে। অসুস্থই বা কখন ছিল? কেন যে হঠাৎ অমন ভিরমি খেল, সে নিজেই জানে না। 

শৈল বলল, একখানা গান তবে শোনাও ভাই। ঠাকুরপো কলকাতার লোক, আমার বাপের বাড়ি যে ফ্যালনা নয়, একটু বুঝে যাক। আমাদের তো ভগবান মেরে রেখেছেন। গলা দিয়ে হাঁড়িচাঁচার আওয়াজ ছাড়া আর কিছু বেরোয় না। 

না না শৈলদি, সে সব কি আজকের কথা। গান-টান মাথায় উঠিছে অনেকদিন। 

মাথা থেকে গলার দূরত্ব খুব বেশি তো নয়। আর তা ছাড়া কোনও জিনিস ওঠাতেই যা কষ্ট নামাতে তেমন কষ্ট নেই। নিন চট করে নামিয়ে ফেলুন। 

কোনও ওজর খাটল না চম্পির। তখন গাইতেই মনস্থির করল। অকস্মাৎ তার প্রাণে প্ৰবল উৎসাহের জোয়ার এল। অনেকগুলি গান বিস্মৃতির তলা থেকে একসঙ্গে লুটোপুটি করে উঠে এল। একটা উত্তেজনার কম্পন ছড়িয়ে পড়ল তার দেহে। সুহাস সামনে বসে আছে। পাশে শৈলদি। শৈলদি তার দিকে চেয়ে আছে। সুহাসবাবু তার দিকে চেয়ে আছেন। সুহাসবাবুর চোখে সাগ্রহ প্রতীক্ষা। কলকাতায় কত ভাল ভাল গান হয়। কত ভাল গান শোনেন সুহাসবাবু। সে তাঁকে কী গান শোনাবে? তার গান শুনে মনে মনে তিনি হাসবেন। বন্ধুবান্ধবদের কাছে ঠাট্টা করবেন। ভয় পেয়ে গেল চম্পি। বিব্রত হয়ে পড়ল। মুহূর্তের মধ্যে সব গান সে ভুলে গেল। তার মাথা খালি হয়ে গেল। একটা গানের একটা কলি, একটুকু সুরও সে মনে করতে পারল না। তার সামনে পিছনে আশে পাশে আর-কিছু নেই। এই ঘর নেই, শৈলদি নেই, সে নেই, কেউ নেই। আছে শুধু দুটি উজ্জ্বল চোখের স্থির প্রতীক্ষা। এ দুটি চোখের ইচ্ছা সে পূর্ণ করতে পারছে না। পারবে না, কখনও পারবে না। চোখ বুজে নিশ্চল হয়ে বসে রইল। গানগুলো বিদ্যুৎবেগে ছুটোছুটি করতে লেগেছে। চম্পি প্রাণপণে হাতড়াচ্ছে অন্ধের মতো। আবছা-আবছা ভেসে উঠছে। আবার টুপ করে ডুব দিচ্ছে অন্তহীন বিস্মৃতির গহ্বরে। কাউকে সে ধরতে পারছে না। চম্পি হার মানল। অসম্ভব। হবে না। সে যখন হাল ছেড়ে দিয়েছে হতাশ হয়ে পড়েছে, এমন সময় একটা সুর গুনগুন করে ধরা দিল তার কাছে। একটা গান মনে পড়ল তার। সে গাইল: মাধব বহুত মিনতি করি তোয়। দেই তুলসী তিল এ দেহ সমর্পিলু দয়া জনু ন ছোড়বি মোয়। বিদ্যাপতির পদ। অনন্ত বষ্টুমি শিখিয়েছিল তাকে। পুঞ্জীভূত যে আকুতি জমে ছিল, আত্মসমর্পণের যে তীব্র আশা লালিত হয়েছিল চম্পির মনে অতি সযত্নে, অতিশয় গোপনে, গানের পাখায় বেঁধে চম্পি আজ তাকে মুক্ত করে দিল। তার বুক থেকে একটা ভার, যেন একটা পাষাণ নেমে গেল। চম্পির মন ভরে উঠল আনন্দে। দু’চোখের কোণ বেয়ে ধারা নামল। 

সুহাসের উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় যে খাদ নেই, চম্পি এক নজর তার চোখ দেখেই বুঝতে পেরেছিল। সেই রহস্যচপল চোখ দুটো মুগ্ধ হয়ে গভীর প্রশান্তিতে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়েছিল। রামধনু রঙের অদ্ভুত দ্যুতি খেলে বেড়াচ্ছিল দুটি উজ্জ্বল তারায়। চম্পিকে আর-কিছু বলার দরকার হয়নি, বোঝাবার দরকার হয়নি, সে আপনা থেকেই বুঝতে পেরেছিল, এর অর্থ কী? চম্পির খুব ভাল লাগছিল। 

এই অনুভূতিটা সে আগে কখনও পায়নি। সুহাসের প্রশংসা—সত্যিকারের প্রশংসা পাওয়া সহজ কাজ নয়। ওঁরা কলকাতার লোক, কত ভাল গান শুনেছেন। তা সত্ত্বেও সুহাসের, মানে সুহাসবাবুর ভাল লেগেছে তার গান। একটা শেষ হলে আর-একটা শুনতে চেয়েছেন। সে-ও গেয়ে গেছে মনের আনন্দে। চার-পাঁচটা গান গেয়ে ফেলেছিল চম্পি। 

কলকাতায় থাকলে আপনার অনেক আদর হত। সুহাস গদগদ হয়ে বলেছিল। বলেছিল, গান অনেকেই গায়, অনেকেই শেখে, কিন্তু আপনার মতো গলা ক’জনে পায়? এত দরদ ক’জনের থাকে? আপনার মতো এমন সুন্দর গলার জন্যই বোধহয় এসব গান সৃষ্টি হয়েছিল। প্রশংসার ভারে নুয়ে পড়েছিল চম্পি। খুশিতে আর লজ্জায় সে মুখ তুলতে পারেনি। তবু তার আকাঙ্ক্ষা মেটেনি। বলুক, বলুক সুহাস, আরও কিছু বলুক। সে যেন ঠিক রজনীগন্ধার ডাঁটা, ফুলের ভারে নুয়ে পড়েছে, তবু ফুল ফোটাবার আকাঙ্ক্ষা ছাড়ছে না। 

এ একটা আশ্চর্য দিন। চম্পির জীবনে এমন দিন আর আসেনি। শুয়ে শুয়ে চম্পি ভাবতে লাগল। ঘুম আসছে না তার। রাত কত হল কে জানে? যূথি আর সে খাটের উপর শুয়ে আছে। যূথির কাছে শুতে আজ আর তেমন অস্বস্তি লাগছে না। যূথিকে পছন্দ করে যাবার পর থেকে সে মনে মনে যূথিকে তীব্র ঈর্ষা করে এসেছে। যূথির কাছে তার যেন চরমতম পরাজয় হয়েছিল। আজ এখন তার আর তেমন কোনও আক্রোশ নেই। যারা যূথিকে পছন্দ করে গিয়েছিল তারা তো অজ গ্রামেরই লোক। এখন সে-কথা মনে পড়ছে চম্পির। সুহাসের মতো মার্জিত ভদ্র শিক্ষিত লোককে মুগ্ধ করতে পেরেছে চম্পি। যূথি পারত না। অনেক বড় জয় তার হয়েছে। 

কলকাতায় থাকলে আপনার অনেক আদর হত। কী সুন্দর কথাটা! কলকাতা যে সুন্দর জায়গা। সেজকাকারা থাকেন। সেজকাকিমা ওকে তো নিয়ে যেতেও চেয়েছিলেন। সেই যখন তার জলপানি পাওয়ার খবরটা বেরিয়েছিল। তখন সে বেশ ছোট, বছর দশেক বয়েস হবে তার। মা যেতে দিল না। মাকে ছেড়ে যাবার কথা ভাবতে তখন তারও খারাপ লেগেছিল। মন কেমন করেছিল। তা ছাড়া মা আবার সেজকাকিমাকে দেখতে পারত না। মা বলেছিল, তোর সেজখুড়ির বাঁদির দরকার পড়েছে, তাই তোকে নিতে চায়। এই কথা শুনে সে-ও তখন সেজকাকিমার উপর রেগে গিয়েছিল। কলকাতায় থাকলে আপনার অনেক আদর হত। ইস, কী বোকামিই না করেছে চম্পি? কেন তখন গেল না? চম্পির মনটা আজ হায় হায় করে উঠল। কলকাতা তার জীবনে যে এত বড় হয়ে উঠবে, সে-কথা চম্পি তো আজ দুপুর পর্যন্তও বুঝতে পারেনি। সুহাসকে দেখার আগে পর্যন্ত না। সুহাস যে কলকাতার বাসিন্দা, সেই কলকাতা উপযাচক হয়ে চম্পিকে প্রবেশাধিকার দিতে চেয়েছিল। সাধা নিমন্ত্রণ উপেক্ষা করেছে চম্পি। আজ তার হা হুতাশ করা ছাড়া উপায় কী?  

না হয় সে বাঁদি হয়েই থাকত। এখানেই বা সে কী! বাঁদিই তো। তবু কলকাতায় গেলে সে না-হয় কলকাতার বাঁদি হত। কিন্তু লেখাপড়াটা হত তার। গানটা শিখতে পারত, সেলাই শিখত। এমন অসহায় অবস্থা হত না। আর কিছু যদি না-ও হত, সেজকাকিমার বোনের মতো চাকরি করতে পারত সে কোনও ইস্কুলে। এই গ্রামের মতো খারাপ জায়গা কলকাতা নয়। পান থেকে চুন খসলে নিন্দে হয় না কারও। গ্রাম কী দেয়, কী দিতে পারে? কোন ভাল শিক্ষা? এক কণাও না। দিতে পারে শুধু নিন্দে। কলঙ্ক। এই দুটো সামগ্রীই দেদার ফলে গ্রামে। অকাতরে গ্রামের লোক তাই দু’হাতে বিলোয়। 

আর কলকাতা? কলকাতা গুণের আদর করে। সেই কলকাতার ডাক শুনেও শোনেনি চম্পি। তাই এই গ্রামের দম-আটকানো প্রকৃতি তাকে ক্রমশ ঠেলতে ঠেলতে এক পাঁচিলের গায়ে এনে যেন ঠেসে ধরেছে। আর এগোবার পথ নেই তার। অথচ একদিন এই গ্রাম ছাড়তে হবে ভেবে তার প্রাণ আকুল হয়ে উঠেছিল। 

কলকাতায় থাকলে আপনার অনেক আদর হত! আমার অনেক আদর হত। সুহাসবাবুর চোখে আমার দাম আরও বাড়ত। সুহাসবাবুর সঙ্গে আমার দেখা হত কী করে? কেন, শৈলদি বুঝি তার বাড়িতে আমাকে নিয়ে যেত না? না-হয় সেজকাকিমার বোন মণিকামাসির সঙ্গে আমি একদিন যেতাম। তখন আমার পেটেও তো কিছু বিদ্যে থাকত। সুহাসবাবুর সামনে এমন জবুথবু হয়ে বসে থাকতাম না নিশ্চয়ই। দু’কথা গুছিয়ে বলতে পারতাম। এখন যে ওঁর সামনে মুখ খুলতে পারিনে, লজ্জায় প্রায় মরে যাই, সে-তো আমি কিছু জানিনে বলে। 

আজ সুহাসবাবু তাকে যখন এগিয়ে দিতে চাইলেন, চম্পি অমনি শিউরে উঠেছিল কেন? সে কি চায়নি, সুহাসবাবু তার সঙ্গে আসুক। সে এখন মনে করতে পারছে না, তখন তার মন কী চাইছিল! অমন একটা আশ্চর্য সম্ভাবনার কথা ভেবে সে মনে মনে এমনই উত্তেজিত আর সঙ্গে সঙ্গে বিব্রত হয়ে উঠেছিল যে সে-সময়ের কথা তার স্পষ্ট মনে নেই। কিন্তু এখন, সুহাসবাবু নেই, তার উত্তেজনা নেই, সে একটুও বিব্রত বোধ করছে না। এখন তার মনে হচ্ছে সুহাসবাবু তাকে এগিয়ে দিতে এলে সে খুব খুশিই হত। কিন্তু এই গ্রামে, এই হতচ্ছাড়া জায়গায় কি তা হতে পারে? সর্বনাশ! কাল থেকে তা হলে কি গ্রামে আর কান পাতা যেত! তার নিন্দায় আকাশ বাতাস ভরে উঠত না! 

তাই তো সে সুহাসবাবুর প্রস্তাবে শিউরে উঠেছিল, একাই চলে এসেছে। কলকাতা হলে সুহাসবাবু নিশ্চয়ই তাকে সেজকাকার বাসায় অক্লেশে পৌঁছে দিতে পারতেন। কেউ কিছু মনে করত না। 

গ্রামে আর কলকাতায় কী প্রকাণ্ড তফাত। সেই পার্থক্যটা চম্পি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খতিয়ে দেখতে লাগল। ফুলুকাকিমা আর তার মায়েতে যে তফাত, শৈলদি আর টুনিতে যে তফাত, সুহাসবাবু আর এ গ্রামের গা-খালি ভুঁড়িদার, পান-বিড়ি-ফোঁকা বিষ্টুপদ, অভয় আর ছনে ঘোষে যে তফাত, কলকাতা আর তাদের গ্রামেরও তফাত ততটাই। এক লহমায় শৈলদিদের পরিচ্ছন্ন সংসারটার যে ছবি দেখে নিয়েছে চম্পি তার সঙ্গে নিজেদের সংসারটা মিলিয়ে দেখতে লাগল। শৈলদিদের পায়ের নখের যোগ্যও নয় তারা। একটা ঝকঝকে তকতকে সাজানো ময়ূরপঙ্খি নাও আর অন্যটা শতচ্ছিন্ন হতকুচ্ছিত তালের ডোঙা। কোনও তুলনাই চলে না। 

কলকাতা মানে ফুলুকাকিমা, কলকাতা মানে শৈলদি আর সুহাসবাবু। কালোর মধ্যেও যে আলোর টুকরো থাকে, সে শুধু ওদের চোখেই ধরা পড়ে। 

ভাগ্যিস গিয়েছিল চম্পি। আজ কার মুখ দেখে সকালে উঠেছিল, সে মনে করতে পারল না। না, দিনটা শুরু হয়েছিল অন্যদিনের মতোই সাধারণভাবে। কোনও বৈচিত্র্য ছিল না, চমক ছিল না। তার সমাপ্তিটাই অসাধারণ। খুব ভাল, মনোমত একটা ভোজ খাওয়া যেন শেষ হয়ে গেছে। চম্পি তবু পাত ছেড়ে ওঠেনি, এখন বসে বসে যেন ভাল ভাল মাছের কাঁটা চুষে চলেছে। 

হঠাৎ সে শুনল, ঠাকুমা বিড়বিড় করে পরিচিত সুর আউড়ে শ্রীকৃষ্ণের অষ্টোত্তরশত নাম আবৃত্তি করতে লেগেছেন — 

জয় জয় গোবিন্দ গোপাল গদাধর
কৃষ্ণচন্দ্র করো দয়া করুণাসাগর।
জয় রাধে গোবিন্দ গোপাল বনমালি
শ্রীরাধার প্রাণধন মুকুন্দ মুরারি ॥ 

অ্যা, চমকে উঠল চম্পি। সর্বনাশ! সে কি রাত কাবার করে দিল নাকি? হ্যাঁ, ওই যে ঠাকুমা বড় রকম একটা হাই তুলে একটু থামলেন। ওই যে গুনগুন করে সেই নরম শ্রুতিমধুর সুরটা একটানা স্রোতের মতো আবার বইতে লাগল— 

হরি নাম বিনে রে গোবিন্দ নাম বিনে 
বিফল মনুষ্যজন্ম যায় দিনে দিনে
দিন গেল মিছে কাজে রাত্রি গেল নিদ্রে
না ভজিনু রাধাকৃষ্ণচরণারবিন্দে। 

সেই জ্ঞান হওয়া ইস্তক শুনে শুনে সমস্ত পদগুলো মুখস্থ হয়ে গেছে। ঠাকুমার সাড়া পেয়ে তার মনের ঘুমন্ত সুরটাও জেগে উঠল। দিন গেল মিছে কাজে, রাত্রি গেল নিদ্রে। আজকের দিনটা, না আজকের নয়, কালকের দিনটা তো তার মিছে যায়নি, রাতটাও নিদ্রায় কাটেনি। বছরের পর বছর যে মাঠে বৃষ্টি পড়েনি, কাল বুঝি তাতে এক পশলা করুণার ধারা ঝরেছে। মনে মনে গুনগুন করল চম্পি, কৃষ্ণচন্দ্র করো দয়া করুণাসাগর! কেন তার চোখে হঠাৎ হঠাৎ এমন জল আসে? হাত দুটো জোড় করে চিত হয়ে শুয়ে শুয়েই চম্পি প্রণাম করল। কতদিন পরে সে এই অন্ধকার ভোরে ঠাকুরকে প্রণাম করবার অভ্যাসটা ফিরিয়ে আনল। তার মনে সারারাত যে চিন্তাগুলো এত তোলপাড় করল, তাকে জাগিয়ে রাখল, তারা এই অষ্টোত্তরশত নামের সুরের স্রোতে কোথায় যে ভেসে গেল কে জানে? 

চম্পি একসময় দেখল, ঠাকুমার গুনগুনানির সঙ্গে সে-ও কখন সমস্বরে গলা মিলিয়ে দিয়েছে: 

কৃষ্ণ ভজিবার তরে সংসারেতে আইনু
মিছে মায়ায় বদ্ধ হয়ে বৃক্ষ সম হৈনু।
ফলরূপে পুত্রকন্যা ডাল ভাঙি পড়ে 
কালরূপে সংসারেতে ‘পক্ষ’ বাসা করে।।

ঠাকুমা পক্ষীকে বারবার ‘পক্ষ’ বলে এসেছেন, আশ্চর্য, চম্পিও ‘পক্ষ’-ই বলে গেল। সে যেন সম্মোহিত হয়ে গেছে। ঠাকুমার গুনগুন স্রোত তাকে যেদিকে নিয়ে যাচ্ছে, সে গা ঢেলে দিয়ে সেই দিকেই ভেসে চলেছে। চম্পির গলা পেয়ে এক মুহূর্তের জন্য ঠাকুমা বুঝি থেমেছিলেন, তারপর আবার তাঁর সুরের স্রোত ছেড়ে দিলেন। দু’জনের গলা এক সুরে মিলে এক স্রোতে ভেসে চলল: 

যখন কৃষ্ণ জন্ম নিল দৈবকীর উদরে মথুরাতে দেবগণ পুষ্প বৃষ্টি করে বাসুদেব রাখি আইল নন্দের মন্দিরে নন্দের আলয়ে কৃষ্ণ দিনে দিনে বাড়ে শ্রীনন্দ রাখিল নাম নন্দের নন্দন যশোদা রাখিল নাম জাদু বাছাধন… 

ছয় 

সারাটা দিন, এই কিছুক্ষণ আগে পর্যন্তও, চম্পির মেজাজটা খুব ভাল ছিল। দেহ মনে যেন উৎসাহের ঢল নেমেছে তার। বাড়ির কাজ সারতে একটুও বিরক্ত লাগেনি। ভাল লেগেছে নাদুস-নুদুস ভাইটাকে কোলে নিয়ে আদর করতে। এইটুকু ছেলে, কিন্তু কত যে তার বুদ্ধি না দেখলে বিশ্বাস হয় না। ডাকো তো একবার শঙ্খ বলে, দ্যাখো কী করে? থপ থপ করে টলতে টলতে এগিয়ে আসবে, জড়িয়ে ধরবে তোমায়। তখন তুমি কি তাকে বুকে না তুলে পারো? চুমু না খেয়ে পারো? আজ চম্পির আদর যেন আর ফুরোয় না। আদরে আদরে ক্লান্ত করে সে শঙ্খকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। 

আর সে যা করেছে বাড়ির কেউ তা জানে না। চম্পি জানে আর তার মনই জানে। গুনগুন করে গান গেয়েছে সারাদিন। মনে মনে একজনকে শুধু গান শুনিয়ে গেছে, কী সুর বাজে, মম হৃদিমাঝে, আমি জানি, আমার মনই জানে। মেজকাকার যশোরের বাড়িতে শোনা কলের গানের গান। আঙুরবালার গাওয়া। সুন্দর গানখানা। হঠাৎ লাফিয়ে উঠল চম্পির মন। শুধু কি ওই গানখানাই? মোর ঘুমঘোরে এলে মনোহর, নম নম। ইন্দুবালার গান। মোর শিয়রে বসি চুপি চুপি চুপি মেলিলে নয়ন। এই লাইনটা মনে আসতেই কাল দুপুরে শৈলদির বাড়ির ছবিটা মনে পড়ে গেল। চম্পির শিয়রে চুপিচুপি একজন নয়ন মেলে বসে ছিল। ছবিটা হঠাৎ ভেসে উঠে চকিতে মিলিয়ে গেল। তার বুকের রক্ত ছলাত করে উঠল। সে বড় লজ্জা পেল। সচকিত হয়ে চারিদিকে চেয়ে নিল। কেউ টের পেল নাকি? 

সারাদিন এমন করে কাটল তার। কাজে অকাজে আজ গান মনে পড়েছে শুধু। সকালে সাজি ভরে ফুল তুলতে গেছে, অমনি নীহারবালার একটা গান গুনগুন করে উঠল মনে। সারা সকালটি বসে বসে সাধের মালাটি গেঁথেছি, পরাব বলিয়া তোমার গলায়, মালাটি আমার গেঁথেছি। পরাব বলিয়া তোমার গলায়… বারবার… এই কলিটা তার মনে ফিরে ফিরে এসেছে। যেন ভারী এক ভ্রমর বারে বারে ছোট্ট একটা ফুলের উপর বসতে চেষ্টা করছে, সেই ভ্রমরের ভারে ফুলটা নুয়ে পড়েছে, সঙ্গে সঙ্গে সে যেন আবার চট করে ফুল ছেড়ে উড়তে লেগেছে। পরাব বলিয়া তোমার গলায়… কার গলায় মালা পরাতে চায় চম্পি? বুকে আবার কাঁপন ধরে। কারও না কারও না। সে কারও গলায় মালা পরাতে চাইছে না, সে একটা গান গাইছে শুধু, না, তাও না, গানটা আপনা থেকেই বাজছে তার মনে। চম্পি তার কী করবে! কিন্তু আজ তার মনে শুধু এই গানগুলোই বা বেজে উঠছে কেন? চম্পি তা জানে না। সত্যি জানে না। 

এ গানগুলো তার গতকাল মনে পড়েনি। ভাগ্যিস মনে পড়েনি! কাল হয়তো সে গেয়েই দিত গানটা। কী হত তা হলে! বিশ্রী ব্যাপার হত। মুখ টিপে টিপে হাসতেন সুহাসবাবু। হাসত শৈলদি। নিজেদের মধ্যে বলাবলি করত, কালপেঁচার শখের বাহার আছে! বামন হয়ে চাঁদে হাত! কিন্তু এ-গানগুলো কি আমি বানাইছি! তর্ক তুলল চম্পি, রেকর্ডের গান যেমন শুনছি, তেমনি গাইছি। ও তো ফাঁকা কৈফিয়ত। চম্পি আবার নিজেকে বলল। গানগুলো কি তোমার কথাই বলেনি! এবার সে চুপ করে গেল। এ-কথার কী জবাব হতে পারে? জবাব নেই। বেশ, সে না-হয় আর কখনও কারও সামনে গাইবে না। না, কক্ষনও গাইবে না। 

সারাদিন ধরে বারে বারে চম্পি নানা পথ ঘুরে এই সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছেছে। খাওয়াদাওয়া সারা হলে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করল সে। চেয়ে দেখল, বেশ রোদ। আজ একটু বেলা পড়লে সে শৈলদির বাড়ি যাবে, তবে বেশিক্ষণ বসবে না। চম্পি তোরঙ্গটা খুলে দেখল, একখানাও ভাল কাপড় নেই তার। কাল সে নিতান্ত পেতনির মতো গিয়ে হাজির হয়েছিল শৈলদির বাড়িতে। কাপড়ের সেলাই দুটো ঢাকা দেবার জন্য অনেক চেষ্টা করেও সে ব্যর্থ হয়েছিল কাল। এটা ঢাকা পড়ে তো ওটা বেরিয়ে যায়। তার বারবার মনে হয়েছিল, সুহাসবাবুর একাগ্র দৃষ্টি যেন ওই ছেঁড়া জায়গাটাতেই আটকে গেছে। ফাটা ছাদে বৃষ্টির জল যেমন আটকে যায়, গড়িয়ে নর্দমায় না যেতে পেরে যেমন ঘরের মেঝেয় চুঁইয়ে পড়ে, সুহাসের দৃষ্টিও যেন তেমনি করেই আটকে গেছে চম্পির কাপড়ের ছেঁড়া জায়গার সেলাইতে, তা যেন আর গড়িয়ে অন্য কোথাও যেতে পারবে না, এবার ছেঁড়ার ফাঁক দিয়ে চুঁইয়ে পড়বে তার ত্বকের উপর। কাল এমন আশঙ্কাই দেখা দিয়েছিল চম্পির মনে। তাই প্রবল অস্বস্তি চোরকাঁটার মতো বিঁধছিল কাল। না, আজ সে আর ছেঁড়া কাপড় পরে যাবে না। 

বরঞ্চ ছোটকাকিমার কাছ থেকে একখানা ভাল শাড়ি চেয়ে নেবে। জামাও চাইবে একটা। আর যাওয়ার আগে সাবান মেখে গা-টাও ধুয়ে নেবে। কাল বড় ঘেমেছিল সে। সুহাসবাবুর অত কাছাকাছি বসে তার ঘাম-প্যাঁচপেচে শরীরটা নিয়ে সে বড় বিব্রত হয়ে পড়েছিল। তোরঙ্গে তার একখানা সাবান লুকোনো ছিল। বড়দাদা মাস কয়েক আগে যখন বাড়ি এসেছিল, সেই সময় চম্পি সাবানখানা চুরি করে সরিয়ে রেখেছিল। ঘিয়ে রঙের একখানা সাবান। বঙ্গলক্ষ্মী টার্কিশ বাথ। এ পর্যন্ত একদিনও সে ওটা ব্যবহার করেনি। আজ সে সাবান মেখে গা ধোবে। 

কিন্তু সাবানখানা গেল কোথায়? তোরঙ্গ ওলট-পালট করেও চম্পি সাবান পেল না। বাঃ রে! কে নেবে সে সাবান? কে নিল? একবার, দু’বার, তিনবার, সে বাক্স হাতড়াল। পেল না। কাপড়-চোপড়ের ভাঁজের মধ্যে নেই তো। চম্পি নানা জায়গা থেকে সংগ্রহ করা নানান রকম কাপড়ের টুকরো, গরম জামা, সেলাইয়ের বাক্স, সব নামিয়ে নামিয়ে হাতড়ে হাতড়ে দেখল। না, নেই। চম্পির চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে পড়ল প্রায়। কোথায় রাখল সে? নাকি কেউ গাপ করেছে? জিনিসটা সামান্য এক টুকরো সাবান হতে পারে, কিন্তু চম্পির কাছে ওর মূল্যই অসাধারণ। শখের জিনিস বলতে ওইটুকুই তার সম্বল ছিল। কতদিন তার মনে হয়েছে, একটু মাখি। কিন্তু অযথা জিনিসটা খরচ করতে সে চায়নি। বেশ একটা মৃদু গন্ধ ছিল। বারকয়েক শুঁকে শুঁকে সে আবার সেটা বাক্সবন্দি করে রেখে দিয়েছিল। আজ তার সর্বনাশ হয়ে গেছে। শূন্য চোখে সে খোলা তোরঙ্গের ডালার দিকে চেয়ে বসে রইল। 

কিছুক্ষণ পরে খসখস শব্দ পেয়ে তার সংবিৎ ফিরে এল। দেখল, যূথি গা ধুয়ে ছোটকাকিমার ভাল একটা জামা আর লাল টুকটুকে একটা সিল্কের কাপড় পরে আয়নার সামনে এসে চুল আঁচড়াতে বসল। 

চম্পি একটু অবাক হল। যূথি যে হঠাৎ পটের বিবি সাজতে বসল! বাব্বাঃ, ঢঙ কত! আয়নায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কতবার করে মুখখানা দেখছে! রূপের গরবে মাটিতে আর পা পড়ে না। তা রূপসি এখন যাচ্ছেন কোথায়? ভাবল একবার জিজ্ঞেস করে। কিন্তু করল না। 

যূথি নিজেই বলল, যাই, শৈলদির বাড়ির থে এক পাক ঘুরে আসি গে। 

ও, তাই বলো! শৈলদির বাড়ি যাওয়া হবে। তাই এত পরি সাজার ঘটা! চম্পির বুকে ঈর্ষা কুট করে একটু কামড়ে দিল। ভাবল, বাব্বা, কী হিংসুটে মেয়ে! কাল ওই যে আমি গিয়েছি শৈলদির বাড়ি, অমনি ওরও আজ যাবার তাড়া পড়ল। পরের জামা-কাপড় পরে সাজের বাহার খুলতে লজ্জা করে না! অমন সাজের গলায় দড়ি। যাও-না, ও বাড়িতে একবার। ওরা সব কলকাতার লোক। চটকে ভোলে না। যাও, খানকতক গান শুনিয়ে এসো। গান! কুল্লোর মতো গলা যূথির। চিৎকার ছাড়া আর-কিছু বেরোয় না। 

হঠাৎ চম্পির সন্দেহ হল। যূথির গা হাত পা মুখ এত চকচক করছে কেন? সে উঠে যুথির গা ঘেঁষে দাঁড়াল। 

চম্পি জিজ্ঞেস করল, আমার সাবান নিইছিস? 

যূথি চমকে উঠল। পরক্ষণেই সামলে নিল। পরম উপেক্ষাভরে চম্পির দিকে চাইল। তারপর কোনও কথা না বলে, ঠোঁটটা একটু উলটে দিয়ে আয়নার দিকে চেয়ে সিঁথি ঠিক করতে লাগল। চম্পির সর্বাঙ্গ জ্বলে গেল। 

বলল, মুখি কি পোক পড়িছে? কথার জবাব দিস নে ক্যান? ক্যান আমার সাবান চুরি করলি?

যূথি তেমনি অবজ্ঞাভরে বলল, খায়ে তো আর ফেলিনি। একটুখানি মাখিছি। 

তাই বা মাখবি ক্যান? ও কি তোর জিনিস? 

না, তুমার জিনিস। শ্বশুরবাড়ির থে আনিছ যে! যূথি খ্যারখ্যার করে উঠল। 

চম্পি এতক্ষণ রাগে কাঁপছিল। এবার আর সামলাতে পারল না। ঠাস করে যুথির গালে মারল এক চড়। 

চড় খেয়ে সাপের মতো ফোঁস করে উঠল যুথি। হারামজাদি, কালকুশি, পেঁচি, তুই আমারে মারলি? তুই ও সাবান কনে পালি? দাদার বাক্সর থে তুই চুরি করিসনি? আমি আর জানিনে কিছু না? পেতনি কুথাকার! তোর ওই হাত খসে পড়ুক। মর মর তুই! 

চম্পির ইচ্ছে হল, গলা টিপে মেরে ফেলে যূথিকে। ও হচ্ছে জন্মশত্রু। কিন্তু চম্পি কিছু করার আগেই যুথি বেরিয়ে গেল দুম দুম করে। চম্পি দুঃখে, অপমানে ঈর্ষায় জ্বলতে লাগল। ও আমার শত্তুর, শত্তুর, শত্তুর! চম্পির চোখ দিয়ে যেন আগুনের হলকা বেরোতে লাগল। 

যুথি বেরিয়ে যাবার কিছু পরেই রণমূর্তি হয়ে মা ঢুকলেন। পিছনে যূথি। 

দামিনী যেন চম্পির উপর ঝাঁপিয়ে পড়বেন। 

ওরে ও ঢেঁকি, তুই ওরে মারলি! তোর আস্পদ্দা বাড়ে গেছে! বলি ও কাল, তুমি পার হবা কবে?

কপাল চাপড়াতে লাগলেন দামিনী। 

চম্পি বলল, ও আমার সাবান চুরি করিছে ক্যান? 

তোর সাবান? যূথি চেঁচাল। 

চম্পিও চেঁচিয়ে উঠল, তোর সাবান ওটা? চোরের মা’র বড় গলা 

তুই চোর, তুই চোর, তুই চোর। যূথি মা’র আড়াল থেকে বিষ ঢালতে লাগল। 

দামিনী যূথির পক্ষ নিয়ে লড়তে লাগলেন। 

যে না ‘নুপ’, বেহ্মদত্যিরউ দাঁতকপাটি লাগে, ওতে আর সাবান ঘষে না। মারতি হয় গালে ঠাস ঠাস করে দুই চড়। কাজের কাজ নেই, হাতির দিনরাত ঝগড়া! আসুক আজ বাড়ি, কাল সকালে উঠে যার মুখ দেখব, হাড়ি ডোম মুদ্দফরাস, তার হাতেই সঁপে দিয়ে পাপেরে বিদেয় করতি কব। আর সহ্য হয় না। 

চম্পির শরীরে তরল আগুন কে যেন ঢেলে দিচ্ছে। অসহ্য যন্ত্রণায় জ্বলে মরছে চম্পি। 

কাঁপতে কাঁপতে বলল, আমি তো তুমার দু’চোখের বিষ। তুমার সুহাগি মেয়ের দোষটা তাই তুমার চোখি পড়ে না। মা হয়েও একচোখো দৃষ্টি তুমার। উপরে আরেকজন আছেন, সব দেখতিছেন। বিচার তিনিই করবেন। 

কী হারামজাদি! 

দামিনী ছুটে এসে চুল ধরলেন চম্পির। কী হারামজাদি! তুই শাপমন্যি দিস মা-রে! 

গুম গুম করে চম্পির পিঠে কিল মারতে থাকেন। 

তুমার আস্পদ্দা দেখি সীমা ছাড়ায়ে গেছে? 

দু’হাতে চম্পির চুল ধরে পাগলের মতো ঝাঁকাতে থাকেন দামিনী। চম্পি আর প্রতিবাদ করে না। পালাতে চেষ্টা করে না। সমস্ত শরীর শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকে অবাধ্য মোষের মতো। নীরবে মার খেতে থাকে। 

(মারো, মারো, মেরে ফ্যালো। একেবারে শেষ করে দ্যাও আমারে। তা হলে সব অপমান, জ্বালা, যন্ত্রণার হাত থেকে একেবারে রেহাই পাই।) 

হারামজাদি মেয়ে, গলায় পাথর হয়ে বসিছে। নড়ানো যায় না। অ্যাদ্দিন বিয়ে হলি যে দু’-তিন ছেলের মা হতি। তা এমন মেয়েই পেটে ধরিছি, গলার কাঁটা। 

(তুমি আমাকে পেটে ধরেছ, সে দোষও আমার! ধরলে কেন আমাকে পেটে। আমি তোমার হাতে পায়ে ধরে সেধেছিলাম— ওগো, আমায় পেটে ধরো।) 

গিরামে আর কান পাতা যায় না। কারুর কাছে মুখ দেখানো যায় না। চিন্তায় চিন্তায় ঘুম ছুটে গেছে, এই কালের জন্যি। 

(তোমার চোখে আমি রোজ গিয়ে খোঁচা মারি, তাই তোমার ঘুম হয় না। ) 

মর মর মর। তুই মরলি আমার হাড় জুড়োয় 

(হ্যাঁ, আমি মরব। ঠিক বলেছ। আমি মরব। মরলে শুধু তুমি নও মা, একা তুমি নও, আমিও জুড়োব।) 

এত যে কটু কথা শুনল চম্পি, এত মার খেল, অথচ আশ্চর্য, একটা টু শব্দ করল না। দামিনী হাঁপিয়ে উঠলেন, তাঁর বুক ধুকপুক করতে লাগল নিদারুণ পরিশ্রমে। এত বড় একটা মেয়েকে মারা কি কম পরিশ্রম! গলগল করে ঘাম বেরোতে লাগল তাঁর। দেহটা অস্থির অস্থির করতে লাগল তাঁর। যূথি নেই। সে শৈলদির বাড়ি হাঁটা দিয়েছে। একটু পাখার বাতাস খেতে পারলে হত। খুঁটি হেলান দিয়ে তিনি দাওয়ায় বসে পড়লেন। শরীরটা থরথর করছে। যূথির উপর রেগে গেলেন। কাজের সময় রাজনন্দিনীকে কখনও পাওয়া যায় না। চম্পি অবশ্য কাছেই দাঁড়িয়ে আছে। একেবারে যেন পাথরের মূর্তি একটা। তা ওকে ঠেঙিয়ে আবার ওর কাছ থেকে তো বাতাস খেতে চাওয়া যায় না। হাজার হোক, চক্ষুলজ্জা আছে তো। তিনি সে দাওয়াতেই আঁচল বিছিয়ে শুয়ে পড়লেন। 

.

এই আমি, চম্পি। 

সন্ধ্যার অন্ধকারে, পুকুর ঘাটের একগলা জলে দাঁড়িয়ে চম্পি ভাবল, এই তা হলে আমি। সকলের গলার কাঁটা, পরিবারের অনাবশ্যক এক বোঝা। সংসারের অবাঞ্ছিত এক জঞ্জাল। আমার জন্যে কারও চোখে ঘুম নেই, কারও মনে শান্তি নেই। কোথাও ছিটেফোটাও স্নেহ-ভালবাসা নেই। ভবিষ্যতে আলোর ইশারা নেই। আমার রং যেমন কালো, ভবিষ্যৎটাও তাই। 

অন্ধকার ঘন হয়ে এসেছে। জন্মক্ষণে কে যেন প্রকাণ্ড একটা দোয়াত উপুড় করে চম্পির অদৃষ্টের লিখনের উপর কালি ঢেলে দিয়েছিল। সেই কালি ছড়িয়ে পড়েছে আকাশে, এখন গড়িয়ে পড়েছে পুকুরে। পুকুরের জল তাই গাঢ় ঘোর কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করেছে। এক আঁজলা জল উপরে তুলে চম্পি আস্তে ছেড়ে দিল। জল নয়, কালি। আবার এক আঁজলা জল নিয়ে ওর হাতের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে দেখল। সব মিশে একাকার হয়ে গেছে। সবই যে অন্ধকার। এই অন্ধকারের মধ্যে অনায়াসে মিশে যেতে পারবে চম্পি। চিরতরে। সেই ভাল। সবাই তো চায়। জটিল সমস্যা সে সৃষ্টি করেছে তাদের সংসারে— না, সমস্যা সে সৃষ্টি করেনি, করেছে তার অদৃষ্ট। একই বাবা একই মা তার আর যূথির, একই ঔরসে, একই গর্ভে তার আর যূথির জন্ম, তবু কেন তার ত্বকে এত কালি, আর যূথির ত্বকে এত সোনা? কেন? এ যে তার অদৃষ্ট। মেজদিও ত কালো ছিল, বড়দির রংও এমন আহা মরি কিছু নয়, তবু বিয়ে কি তাঁদের আটকেছে? না। কারণ তখন মেয়ে বিয়ে দেবার মতো টাকা ছিল বাবার। তবে তার বেলাতেই বা এমন পৃথক ফল হল কেন? অদৃষ্ট। তার রংও কালো, তার বাবার টাকাও ফুরিয়ে গেল। বেশ মজা। সবই তার দোষ। তার ছাড়া আর কার? দোষ তার অদৃষ্টের। 

পুকুরের কোনও ঘাটেই এখন কেউ নেই। থাকলেও ক্ষতি ছিল না। কারও নজরে সে পড়ত না। সে যে আপন রঙে মিশে গেছে। ঠিক এমনি মিশে মিশেই সে একেবারে পুকুরের তলে পৌঁছে যাবে। সে আর কাউকে বিরক্ত করবে না, বারবার অশান্তির কারণ হবে না, কারও অন্যায় গঞ্জনাও আর সইতে হবে না তাকে। 

পুকুরের একেবারে নীচে, গহন তলে, চির অন্ধকারে তার জন্যে এক শান্তিময় বিছানা পাতা আছে। সেই ছায়ায় তার মনের জ্বালা জুড়োবে। যুথি নিষ্কণ্টক হবে। সাবান মাখার ভাগীদার আর কেউ থাকবে না। পথ আটকে থাকবে না কেউ। দেখতে আসবে যুথিকে, এবার যখন যুথিকে দেখতে আসবে কেউ, দেখামাত্র পছন্দ করে যাবে। চম্পির মতো একশো গন্ডা আজে-বাজে প্রশ্নের জবাব দিতে হবে না যূথিকে। কী সব বোকার মতো প্রশ্ন! পায়েসে কতখানি নুন দিতে হয়? চম্পির মনে পড়ল দ্বিতীয়বার তাকে যারা দেখতে এসেছিল, এক দোজবরে পাত্রের জন্য, তাদের মধ্যে একজন, এক হাড়গিলে, বোধহয় বরের বন্ধু, তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল: বলো দিনি, পায়েসে কতখানি নুন দিতি হয়? চম্পির তখন মনে হয়েছিল, ঠাস করে তার গালে এক চড় মারে। সেবার সেই দোজবরে পাত্তরও চম্পিকে পছন্দ করেনি। করেছিল, তবে নগদ চার হাজার টাকা আর কুড়ি ভরি সোনা চেয়েছিল। হায় রে, কালো হওয়া কি এতই অপরাধ যে, দোজবরেও টাকার খাঁই ছাড়ে না। 

চম্পি আর একটু গভীর জলে নেমে গেল। থুতনি পর্যন্ত ডুবল তার। শ্যাওলার গন্ধ নাকে এসে লাগছে। একটা ছোট্ট মাছ কুটুস করে তার গলায় কামড় বসিয়ে পালিয়ে গেল। 

কালো আর ফরসায় কতটা তফাত? কতক্ষণ সে তফাত থাকে? চম্পির বড় জানতে ইচ্ছে করে। জানতে ইচ্ছে করে, যে-লোক ফরসা মেয়ে ফরসা মেয়ে করে পাগল, সে যখন তার বউয়ের পাশে রাত্রে এসো শোয়, ঘরের আলো যখন নিবে যায়, তখনও কি কালোয় ফরসায় তফাত বোঝা যায়? কী জানি? হয়তো যায়। যাক, তাতে যূথির অসুবিধা হবার কথা নয়। ওর রঙের জোরটা আছে। ওকে হয়তো কেউ কোনও প্রশ্নই জিজ্ঞাসা করবে না। দেখবে আর পছন্দ করবে। দাবি-দাওয়াও বিশেষ কিছু করবে না। যূথির বিয়ে হয়ে যাবে। 

.

চম্পি নিঃশব্দে সাঁতার কাটতে লাগল। জলে বিন্দুমাত্রও শব্দ তুলল না। ওর শরীরের পাশ থেকে অজস্র ঢেউ গোল গোল দাগ তুলে, বড় হতে হতে পাড়ে গিয়ে আছাড় খেতে লাগল। চম্পি বুঝতে পারল ঢেউগুলো যাচ্ছে। দেখতে পেল না। ও জানে এমনিভাবেই ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে। আচ্ছা ঢেউগুলো এমন ডাঙা লক্ষ্য করে ছোটে কেন? ওরাও কি ডাঙার আশ্রয় কামনা করে? চম্পি দেখেছে, জলে হাত দেওয়ামাত্র কী নিদারুণ আলোড়ন ওঠে! যেন আগের মুহূর্তের ঢেউগুলোকে কেউ আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রেখেছিল, চম্পি তাদের মুক্ত করে দিল, আর সঙ্গে সঙ্গে তারা ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুট দিল চতুর্দিকের ডাঙা লক্ষ্য করে। ভয় পেলে শঙ্খ যেমন তার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে, ছোটকাকিমার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে, এই ঢেউগুলো পাড়ের মাটিতে গিয়ে ঠিক তেমনিভাবেই আছড়ে পড়ে। শঙ্খ, হ্যাঁ, শঙ্খ তাকে ভালবাসে। কালো বলে সে কখনও মুখ ফিরিয়ে নেয় না। শিশু কিনা! ও তো এখন দেবতারই শামিল। 

মাঝ পুকুরে চলে এল চম্পি। বাড়ির দিকে তাকাল। পাড়টা বেশ উঁচু। বাড়ির সবটা দেখা যায় না। ওদের আর ছোটকাকার ঘরের চাল দেখা যাচ্ছে। আর কিছু না। দূরে কোথায় যেন কীর্তন হচ্ছে, হয়তো জেলেপাড়ায় কিংবা বাইতিপাড়ায়। অস্পষ্ট গানের রেশ ভেসে আসছে। যূথি কখনই এখানে আসতে পারবে না। ও সাঁতার দিতেই পারে না। কিছুই পারে না যূথি। দরকারই বা কী? ফরসা মেয়েদের কিছুই শেখবার দরকার করে না। রঙেই পার পেয়ে যায়। 

চম্পি টুপ করে ডুবে গেল। প্রথমে সে চেয়েই ছিল। তরল একটা কালো ভুবনের মধ্যে দিয়ে সে তলিয়ে যাচ্ছে কেমন অনায়াসে। কোনও জোর লাগছে না তার। উপরটা তবু কিছুটা ফিকে ছিল। ক্রমশই একটা ভারী নিদারুণ হিংস্র অন্ধকার চারপাশ থেকে বিরাট জোরে চেপে ধরল চম্পিকে। চম্পি একবার বুড়বুড়ি কাটল। তার দম আটকে আসছে। আসুক। বুকের উপর অসহ্য চাপ পড়ছে। পড়ুক। চোখ দুটো ক্রমেই ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। চম্পি ঝটাপটি শুরু করল। জলের তলে অশরীরী যে কালো রাক্ষসটা আছে, চম্পি তার বুকে দু’পা দিয়ে ক্রমাগত লাথি মারতে লাগল। দু’হাতে প্রাণপণে হাঁচোড়-পাঁচোড় করতে শুরু করল। সেই অন্ধকার কবন্ধ ক্রমাগত প্রবল শক্তিতে চম্পিকে চাপ দিচ্ছে। তার ভিতরটা যেন ফেটে পড়বে। আর চম্পি এখন ক্রমাগত তার কবল থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। উপরে উঠবার চেষ্টা করছে। কতক্ষণ ধরে এমনি সংগ্রাম চলল দু’মিনিট, দশ মিনিট, এক ঘণ্টা, এক যুগ— চম্পি জানে না। শুধু তার মনে হল, সে হেরে যাচ্ছে, সে তলিয়ে যাচ্ছে। প্রাণপণে কয়েকবার জলে লাথি মারতেই ভুস করে ভেসে উঠল চম্পি। কয়েকবার খাবি গেল। হুস হুস করে বাতাস টানল বার কয়েক। একবার এক খাবলা জল ঢুকে গেল নাকে মুখে। নাকের ভিতর দিয়ে ঘিলু পর্যন্ত কে যেন সুতীক্ষ্ণ তলোয়ার ঢুকিয়ে দিল। খক খক করে কাশতে লাগল। তারপর অতিশয় ক্লান্ত দেহটাকে কোনওক্রমে ভাসিয়ে ভাসিয়ে এনে ঘাটের তালগুঁড়িটার উপর আছড়ে ফেলল। তখনও সে বেজায় হাঁফাচ্ছে। 

চিত হয়ে শুয়ে চম্পি দেখতে লাগল, আকাশে এর মধ্যেই কখন তারা ফুটেছে। অজস্র তারা। আকন্দ ফুলের ভারী তীব্র গন্ধ ভেসে আসছে নাকে। গোটা পুকুরটা স্তব্ধ হয়ে পড়ে আছে সামনে। তাকে আশ্রয় দিতে উদ্‌গ্রীব হয়ে আছে এক জমাট অন্ধকার। কিন্তু সেখানে যেতে পারল না চম্পি। তবে সে কোথায় যাবে? ফিরে যাবে সংসারে? অপ্রেম অনাদরের মধ্যে? এখানে, এই ঘাটের তালগুঁড়িতে পিঠ ঠেকিয়ে, চিরকাল তো সে এমনিভাবে শুয়ে থাকতে পারবে না! 

জল ঢুকে কান কটকট করছে তার। শীত লাগতে শুরু করেছে। চোখ জ্বালা করছে। মাথাটা টিপটিপ করছে। ভয়ানক ক্লান্ত হয়ে পড়ল চম্পি। ওর যা-কিছু ক্ষমতা ছিল পুকুরের তলার সেই কবন্ধটা যেন তা টিপে বের করে নিয়েছে। চম্পি খোসাটুকু নিয়ে পালিয়ে আসতে পেরেছে। 

চম্পি মরতে পারল না। ডুবতে পারল না। সে যে ভাল সাঁতার জানে। গ্রামের কোনও মেয়েই সাঁতারে তার সঙ্গে পারে না। ভাল করে সাঁতার শিখেছিল সে, তাই তার ডোবা আর হল না। কেন এমন ভাল সাঁতার শিখেছিল সে? 

এখন চম্পির অগত্যা বাড়ি ফেরা ছাড়া আর উপায় কী? আবার তাকে ফিরতে হবে লাঞ্ছনা গঞ্জনার মধ্যে। চাপা ঘৃণার মধ্যে। অসহায়ভাবে বাঁধা মার খেতে হবে ততদিন, যতদিন-না স্বাভাবিক মৃত্যু এসে তাকে কোলে ঠাঁই দেয়। অপমৃত্যু স্বেচ্ছায় সে আর ঘটাতে যাবে না। ওতে বড় যন্ত্রণা আজই সে টের পেয়েছে। সে বড় বিকট। বড় ভয়ংকর। না না, ও পথ আর মাড়াবে না চম্পি। 

আত্মহত্যাতেও তার রুচি নেই, সংসারে ফিরতেও তার আগ্রহ নেই। নিজের অসহায়তা যে কী পরিমাণ বড়, চম্পি সেই কথাই ভাবতে লাগল। সে যেন ধোপার কুকুর। যার ঘরও নেই ঘাটও নেই। সে যেমন মরেও নেই, তেমনি বেঁচেও নেই। সে নিরন্তর এক অপমৃত্যুর মধ্যেই যেন বেঁচে আছে। ছিলও তাই। এই অবস্থা তো সে মেনেই নিয়েছিল। যাবতীয় আশা ভরসা জলাঞ্জলি দিয়ে পীড়াদায়ক বর্তমানের সঙ্গেই তো সে সন্ধি করেছিল। তার মধ্যে থেকেই উনিশ-বিশ রকমফের বের করে নিয়েছিল। নতুন দুঃখ না পাওয়াকেই সে সুখ নাম দিয়েছিল। 

.

বেশ ছিল চম্পি। কিন্তু হঠাৎ তার মনের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেল। শৈল— শৈলদি এর জন্য দায়ী। আর— আর— হ্যাঁ তিনিও দায়ী। সকাল থেকে মনে মনে যে এত গান সে গেয়েছে, শুনিয়েছে একজনকে, সে একজন কে? শৈলদি? না। তবে? না, তার নাম উচ্চারণ করবে না চম্পি। নিজেকেও সে শোনাতে চায় না। সেটা রূপকথার কাহিনী হয়েই থাক। 

আগাগোড়া ব্যাপারটাই কি রূপকথার মতো নয়? যে-ঘটনা জীবনে ঘটে না, তাই তো রূপকথা। কল্পনায় যার জন্ম, কল্পনায় যার বসবাস। চম্পির রূপ নেই, কিন্তু গুণ তো আছে। কতদিন চম্পি কল্পনা করেছে, সেই গুণ দিয়েই সে মুগ্ধ করবে তার মনের মতো মানুষকে। সে যেমন যেমন কল্পনা করেছে ঠিক অবিকল তারই রূপ দিয়েছে সুহাস। সুহাসের মুগ্ধ নয়ন, (সই লো, ও দুটি নয়ন, আমার আসা-যাওয়ার পথে কেন তাকায় অনুক্ষণ! সত্যি কি সুহাস অনুক্ষণ চেয়ে ছিল তার দিকে?) আজ তো যায়নি চম্পি, ভাবছে কি তার কথা? সুহাসের কথা, সুহাসের ব্যবহার চম্পির কল্পনাকে মূর্ত করে তুলেছে। সুহাস কি তবে তার মনের মতো মানুষ? এ কথা যে চিন্তা করাও হাস্যকর। কোথায় সুহাস আর কোথায় চম্পি! সুহাস আকাশের চাঁদ আর চম্পি পুকুরের শ্যাওলা। চাঁদ আকাশে থাকে। সে হয়তো জানেও না তার অপার করুণা আলো হয়ে পাড়াগাঁয়ের পুকুরে জন্মানো এক শ্যাওলার গায়ে ছড়িয়ে পড়েছে। এমন কত সহস্ৰ জায়গাতেই তো চাঁদের কিরণ পড়ে। চাঁদ কি তার হিসেব রাখে। কিরণ ছড়ানোই যে চাঁদের অভ্যাস। তা বলে শ্যাওলা যদি সেই আলো পেয়ে ভাবে, চাঁদ আমার, তার এই কিরণ সে শুধু আমাকেই দিচ্ছে, তবে সে কি পাগলামি নয়? চম্পি তো পাগল হয়নি। ভাল কথা বলা, ভদ্রতা জানানো, সুহাসের অভ্যাস। মন রেখে কথা বলা সুহাসের অভ্যাস। সেই অভ্যাসকে যদি চম্পি অন্য কিছু বলে ভাবে— বয়ে গেছে চম্পির অন্য কিছু ভাবতে। সে কি নিজের ওজন বোঝে না? 

বোঝে যদি তবে যূথি শৈলদির বাড়ি যাবে শুনে সে অমন খেপে উঠল কেন? কক্ষনও না, কক্ষনও না। শৈলদির বাড়িতে যাবে বলে সে যূথির উপর রাগ করেনি। রেগেছে যূথি তার সাবানটা চুরি করেছে বলে। রেগেছে যূথি চম্পিকে তাচ্ছিল্য করেছে বলে। আর দেখলে না, মেয়েটা কেমন হ্যাংলা। ছোটকাকিমার কাছ থেকে কাপড় জামা ভিক্ষে করে রূপের বাহার খুলেছে। এই কাঙালপনা দেখতে পারে না চম্পি। তুই যে এমন মোহিনী সেজে চললি, কাকে ভোলাবি? তোর ওই ধার করা সাজ দেখে সে ভবি ভুলবে না। অমন অনেক সাজ ওরা নিত্য দেখে। কলকাতায় তোর মতো সাজ দাসী-বাঁদিরাও করে। যদি রেগে থাকে চম্পি তো এই সব কারণেই রেগেছে। 

যার যার ওজন তার নিজেরই বুঝে চলা উচিত। অন্তত চম্পি তো তাই মনে করে। 

ঝপাং করে পুকুরে একটা মাছ ঘাই মেরে উঠল। চম্পির থেকে বেশি দূরে নয়। 

চম্পি চমকে উঠল। অনেকক্ষণ ঘাটে এসেছে সে। এবার তাকে উঠতে হবে। চম্পি এবার মাঝ পুকুরে যেতে চাইল। ওখানে এখন তো আর তেমন অন্ধকার নেই। সে যদি ডুবেই যেত, কী হত তা হলে? নিশ্চয়ই আরও খানিকটা পর থেকে খোঁজাখুঁজি শুরু হত। পুকুরঘাটেও লোক জড়ো হত। কী করে জানত তারা, চম্পি ডুবে মরেছে? কেউ তো তাকে ঘাটে আসতে দেখেনি। চম্পির মনে হল, সে যেন জলের তলায় শুয়ে শুয়ে সব কিছু দেখতে পাচ্ছে। লোকগুলো সব হন্তদন্ত হয়ে খুঁজছে তাকে। কে যেন টর্চের আলো ফেলল। কে যেন বলে উঠল, আরে, এ ঘড়াটা কার! 

চম্পির হঠাৎ ঘড়ার কথা মনে হল। এই যে ঘাটের পাশে পড়ে রয়েছে ঘড়াটা। এটা দেখেই লোকে বুঝত, চম্পি কী সর্বনাশ ঘটিয়েছে। ঘড়ার কথা মনেই পড়েনি তার। তখন এটার কথা মনে থাকলে চম্পিকে আর ভেসে উঠতে হত না। ঘড়া নিয়েই সে ডুবত। হয়তো কোমরে, নয় গলায় বেঁধে নিত ঘড়াটা। 

তা হলে কী হত! সর্বনাশ! চম্পির ভয়চকিত কল্পনা একটা নিদারুণ ভয়াবহ ছবি তার চোখ ফুটিয়ে তুলল। সে যতবার ভেসে উঠতে চাইছে, এই ঘড়া, অতি শান্ত নিরীহ এই ভরনের পাত্রটি, উৎকট এক হিংস্র উল্লাসে ততবার তার টুটি টিপে টিপে দাবিয়ে দিচ্ছে তাকে পুকুরের তলায়। সেখানে আলো নেই, বাতাস নেই, নিস্তার নেই। এতক্ষণে চম্পি ভয় পেল। সাংঘাতিক ভয়। তার দেহ থরথর করে কাঁপতে লাগল। বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠল কপালে। ধড়াস ধড়াস করে হৃৎপিণ্ড আছড়ে পড়তে লাগল। ভয়ে সে ঘড়াটা আর স্পর্শও করতে পারছে না। 

না না না, এমন উৎকট, এমন ভয়াল, করাল, হিংস্র মৃত্যুতে তার অভিলাষ নেই। এর থেকে এমন বিড়ম্বিত জীবন নিয়ে বেঁচে থাকাও ভাল। আর কিছু না হোক, সুহাসের সঙ্গে একবার দেখা তো হতে পারে। 

আজ তো সে যেতে পারত। কিন্তু গেল না কেন? যূথি গেল বলে? গেলই বা যুথি। তার সঙ্গে চম্পির কী। যূথি না হয় শৈলদির সঙ্গে গল্প করত। তার শাড়ি গহনা নেড়েচেড়ে দেখত। যা বরাবর করে এসেছে যূথি। এই তো ওর আরেকটা বদভ্যেস। গ্রামের কোনও মেয়ে বাইরে থেকে এলেই যূথি সেখানে ছুটে যায়, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে আসে, ক’খানা শাড়ি, ক’টা গয়না সে পেয়েছে। তারপর ক’দিন ধরে সবিস্তারে তার বর্ণনা চলে বাড়িতে। বলতে বলতে যূথির লোভাতুর কণ্ঠ দিয়ে যেন লালা ঝরে পড়ে। ওটা এমনই হ্যাংলা। যূথি ঠিক শৈলদির বাক্স খুলে বসত। আর নড়ত না সেখান থেকে। 

আর চম্পি কী করত? বসে থাকত সুহাসবাবুর সামনে। শুধু সে আর সুহাস। সুহাস একটার পর একটা ফরমায়েশ করত। চম্পি প্রাণ ঢেলে উজাড় করে দিত তার মজুত গানের পুঁজি। আজ অনেক গান জমেছে তার মনে। প্রশংসা ঝরে পড়ত সুহাসের গলা থেকে, অজস্র বকুল ফুল যেমন আপন অভ্যাসে ঝরে পড়ে। ধন্য হয়ে যেত চম্পি। তার জীবনের অর্থ স্পষ্ট হয়ে উঠত। দুর, এসব কী ভাবছে সে? এসব কি এখানে ঘটে! হয়তো কলকাতায় ঘটে। পাড়াগাঁয়ে অনাত্মীয় কোনও যুবকের সামনে বসে কোনও বয়স্থা মেয়ে গান শোনাতে পারে নাকি? চম্পি কি একা ঢুকতে সাহস পেত, যে-ঘরে শুধু সুহাস আছে? সে মাসিমার কাছে বসে থাকত। ফুলুমাসিমা যদি তার গান শুনতে চাইতেন, তা হলেই চম্পি কৃতার্থ হয়ে যেত। চম্পি ফুলুমাসিমার সামনে বসেই বরং অনেক স্বচ্ছন্দে তার গানকে ঠিক জায়গায় পাঠিয়ে দিতে পারত। কেন সে তা হলে আজ গেল না? একটা অমূল্য দিন সে নষ্ট করে ফেলল নিজের দোষে? চম্পির মনটা হুহু করে উঠল। সে বোকা, সে বোকা, সে বড় বোকা। তুচ্ছ একটা সাবানই তার কাছে এত বড় হল! 

.

দুটি মেয়ে গল্প করতে করতে পুকুর পাড় দিয়ে আসছে। মাঝে মাঝে হেসে উঠছে তারা। তাদের কথায় তাদের হাসিতে চম্পির ভয় কাটল। এতক্ষণ ঘড়াটা ছুঁতে পর্যন্ত সাহস হয়নি তার। এবার সে ঘড়াটা টেনে নিল। অনেকক্ষণ সে ভিজে কাপড়ে আছে। উপরের দিকটা অনেকটা শুকিয়ে গিয়েছে। মাথাটা ভার ভার লাগছে। ঘড়ায় জল ভরে চম্পি উপরে উঠে এল। 

মেয়ে দুটো বুঝি তাদের বাড়ির দিকেই আসছে। 

একজন হাসতে হাসতে বলে উঠল, সাবধান, সাপে খাতি পারে। 

এটা তো যুথি। চম্পি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওদের দিকে চাইল। 

আরেকজন জবাব দিল, আর তোমাদের গায়ের গন্ধে বুঝি সাপ পালায়। তোমরা বেজি নাকি। 

এ তো সুহাসবাবু। ধক করে বুকে ধাক্কা খেল চম্পি। ওদিকে খিলখিল করে হাসতে হাসতে যুথি বুঝি গড়িয়েই পড়বে। 

সাত 

চম্পিকে ওরা কেউ দেখল না। না সুহাস, না যূথি 

অথচ চম্পি ওদের এত কাছে দাঁড়িয়ে আছে হুঁশ থাকলে না-দেখার কোনও কথা নয়। ঘাটের পাড় থেকে ওদের পাছ-দুয়ার এমন কিছু দূর নয়, মাঝখানে ফাঁকা রাস্তাটা শুধু, সেটা প্রায় ডিঙি মেরেই পার হওয়া যায়। তারা-ভরা আকাশ এমন কিছু অন্ধকারও নয়, পুকুরপাড়ের আকন্দ গাছগুলোও এমন বৃহৎ বনস্পতি নয় যে তার আড়ালে ঢাকা পড়বে চম্পি। 

চম্পি দাঁড়িয়েই থাকল। ভরা ঘড়াটা কাঁখে চম্পির সেই নিথর নিশ্চল মূৰ্তি যদি কেউ দেখত তখন, তা হলে নিশ্চয়ই মনে করত, কেউ বুঝি বা পাষাণের এক প্রতিমা গড়িয়ে রেখে গেছে। চম্পি নিজেই শুধু জমে যায়নি, সারাদিন ধরে যে সুন্দর মূর্তিখানি সে অতি যত্নে তিল তিল করে গড়ে তুলেছিল সেটিও জমে পাথর হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ আগেও তার মাথা দপদপ করছিল, শীত শীত করছিল, একটা চাপা অস্বস্তি শিরশির করে তার সর্বশরীরে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, ভরা ঘড়াটা বেজায় ভারী ঠেকছিল। এখন তার আর কোনও বোধ নেই। 

বোধ থাকলে তার চোখের উপর সুহাস আর যূথি যে বেহায়াপনাটা করল, যে রকম ঢলাঢলি করল দু’জনে, চম্পি তা কি সহ্য করতে পারত? ঈর্ষায় সে জ্বলে যেত না? লজ্জায় নুয়ে পড়ত না? ঘৃণায় তার মনটা তিতো বিষ হয়ে উঠত না? সে-সব কিছুই হল না। চম্পির রক্ত-মাংসের শরীরটা মুহূর্তের মধ্যে ঢালাই-করা এক সিসের মূর্তি হয়ে গেল। 

তাই, সুহাস গদগদ হয়ে যূথির হাত একবার যখন নিজের মুঠিতে চেপে ধরল, সমস্ত সোহাগ গলায় ঢেলে দিয়ে সুহাস যখন যূথিকে বলল, ‘তোমার মতো এত সুন্দর আমি আর দেখিনি যুথি, কী নরম তোমার হাত; এই কথা বলে সুহাস যখন যূথিকে একটু টানল আর ঘোর-লাগা যুথি যখন তার বুকের কাছে এগিয়ে গেল, সুহাসের দু’খানা হাত যূথির মুখখানাকে ধীরে ধীরে তুলে ধরল আর সুহাসের মুখখানা সেই নির্জন পৃথিবীতে একটি মাত্র লক্ষ্যে চিলের মতো ছোঁ মেরে নেমে এল, আর যূথি ‘যাঃ অসভ্য’ বলে চট করে সরে গেল, তারপর কেমন জড়ানো জড়ানো স্বরে বলল, ‘কাল দুপুরি যাব’, সুহাস বুঝি সঙ্গে সঙ্গে হাত বাড়িয়েছিল, তার আগেই যুথি বাড়ির ভিতরে বিদ্যুৎবেগে ঢুকে পড়ায় সে হাত দু’খানা বাতাসে চক্কর কেটে মালিকের দু’পাশে যেন ডানা গুটিয়েই বসে পড়ল, তখন (এসব দেখা সত্ত্বেও) চম্পি একটুও চঞ্চল হল না। অথবা এসব কিছুই ঘটেনি। কে যেন একজন এসেছিল তাদের বাড়ির দরজা পর্যন্ত, ওই যে দুলে দুলে পুকুরপাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে সে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। ঘাট ফাঁকা পথ ফাঁকা, সব ফাঁকা। সব ফাঁকা। ফাঁকির খেলা। এ পৃথিবীতে সুহাস বলে কোনও ভদ্রলোক নেই, কলকাতা বলে কোনও উদার শহর নেই, বিশ্বাস বলে ভাল বলে কোনও বস্তু নেই। 

.

তবে চম্পি আর খামকা এখানে দাঁড়িয়ে থাকে কেন? ভারী মন, ভারী ঘড়া বয়ে সিসের পা ফেলতে ফেলতে চম্পি বাড়ি ফিরল। বুঝতে পারল, এত বোঝা বইবার আর শক্তি নেই তার। ঘড়াটা কোনওক্রমে নামাল। তবুও পাষাণ ভারটা সে কোনওমতেই শরীর থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারল না। তার মাথায়, কাঁধে বুকে হাতে পায়ে এই রকম ভারী ঘড়ার শত শত ওজন কে যেন চাপিয়ে দিয়েছে। তাই পইঠা বেয়ে উপরে উঠতে তার হাঁফ ধরছে, কাপড় ছাড়তে হাত উঠছে না। 

অসাড় ভাবটাও ক্রমেই কেটে উঠেছে চম্পির। সেটা যত কাটছে ততই বাঁধভাঙা যন্ত্রণার বন্যা প্রবল বিক্রমে আক্রমণ করছে চম্পিকে। চম্পির দেহে যেন আর কোনও অংশই নেই, শুধু মাথা আর বুক। মাথা বুঝি এই ছিঁড়ে পড়ল আর বুকে এমন ভারী সব ওজন চাপানো যে শ্বাস টানতেও লাগছে। 

কোনওক্রমে একটা মাদুর বিছিয়ে চম্পি শুয়ে পড়ল। 

.

খুব ভুগল চম্পি। দেড় মাস তাকে নিয়ে যমে মানুষে লড়াই চলেছিল। শেষ পর্যন্ত ভূষণই জয়ী হল। চম্পির বয়েস কম, স্বাস্থ্য ভাল। তাই ডবল নিউমোনিয়া এত সহজে ওকে কাবু করতে পারল না। চম্পিকে নিয়ে পঁয়তাল্লিশটে দিন এ-বাড়ির লোকের যে কীভাবে কেটেছে, তা ভগবানই জানেন। দামিনী খাওয়াদাওয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন। হত্যে দিয়েছিলেন মদনমোহনতলায়, মঙ্গলচণ্ডীর থানে, পির সাহেবের দরগায়। যূথি রাতের পর রাত জেগে চম্পির কপালে জলপটি দিয়েছে, বুকে পুরনো-ঘি-মাখা আকন্দপাতার সেঁক। বাতাস করেছে শিয়রে বসে। ঠাকুমা ইষ্টনাম জপ করেছেন, ঠাকুরতলার মাটি এনে চম্পির কপালে মাখিয়ে দিয়েছেন, অঝোর ধারায় কেঁদেছেন। গিরিবালা সংসারের সব ঝুঁকি সামলেছে, পথ্যি রেঁধে, ফলের রস করে খাইয়েছে চম্পিকে। বিলাস মাঝে মাঝে টাকার ধান্ধায় ঘুরেছেন। মাঝে মাঝে চম্পির রোগশয্যায় এসে বসেছেন। বিকারের ঘোরে ভুল বকেছে চম্পি, দাঁত কিড়মিড় করেছে আর বিলাস চম্পির মুখের কাছে মুখ নিয়ে, ‘ও মা, কী বলছ, কষ্ট হচ্ছে, এই যে আমি, তুমার বাবা, চিনতি পারতিছ না, ও মা চম্পি, চম্পু, হায় হায়, আমার এমন মেয়ের হল কী? ওগো, ও ভূষণ, ও যূথি, মা, বউমা, শিগগির আসো তুমরা, হায় হায় আমার মা বুঝি যায়,’বলে এমনভাবে কপাল বুক চাপড়াতে শুরু করেছিলেন যে, তাঁকে সামলাতে বাড়ির লোক অস্থির হয়ে পড়েছে। আর জ্বালাতন করে মেরেছে শঙ্খ। দিদি, দিদি করে ছুটে গেছে চম্পির কাছে। বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে অসতর্ক মুহূর্তে, চম্পির গায়ের কাঁথা টান মেরে ফেলে দিয়েছে, ওষুধের শিশি ভেঙে ফেলেছে, পুরিয়া মুখে পুরে দিয়েছে। 

তবু ভাল, বেঁচে উঠল চম্পি। দু’মাসের মাথায়, বালাম চালের ওজন করা ভাত আর মাগুর মাছের ঝোল দিয়ে অন্নপথ্য করল। গায়ে বল পেতে আরও মাস দুয়েক কাটল। 

অমন নিটোল স্বাস্থ্য ছিল চম্পির, কালো রঙের উপর ছিল লাবণ্যের স্নিগ্ধ পালিশ। দুটোই হাতছাড়া হল তার। আর যে অমিত প্রাণশক্তিটুকু ছিল, সেটাও যেন চিড় খেয়েছে। কেমন জবুথবু মেরে গেল চম্পি। নড়তে চড়তে বিশেষ চায় না। বললে কাজকর্ম করে, না হলে চুপচাপ বসে থাকে। কোনও কিছুই যেন তার কাছে সাড়া জাগায় না। 

অনেক সময় মনে হয়, সে বুঝি কিছু ভাবছে। আসলে কিছুই ভাবে না সে। ভাবতেও পারে না। একটার পর একটা দিন নিঃশব্দে ঝরে যায়। মাস যায়। ঋতু বদল হয়। গ্রীষ্মের পর বর্ষা, তারপর শরৎ, হেমন্ত, শীত আসে। চলে যায়। বসন্ত হাতছানি দেয়। গ্রামের আরও একটা মেয়ের বিয়ে হয়। সানাইয়ের আর্তস্বর বাতাসে উঠে ভাসতে ভাসতে চম্পির কাছাকাছি আসে। কিন্তু চম্পির মনের দেউড়িতে বলটু লাগানো ভারী কপাট বন্ধ হয়ে গেছে। বিরাট তালায় মরচে ধরে উঠেছে। কোনও কিছুই তা ভেদ করতে পারে না। 

আট 

গিরিবালারও মাঝে মাঝে আশঙ্কা হয়, তার মনটা কি অসাড় হয়ে পড়ছে? সংসারের কাজে সে সুখ পাচ্ছে না কেন? 

সুখ পাওয়ার কী এমন আছে সংসারে যে, সে সুখ পাবে? 

উনুনে আগুন দিয়ে বসে আছে সে। বড়জা ভাশুরের আশায় এতক্ষণ বসে থেকে থেকে এইমাত্র উঠলেন। ঘরে চাল বাড়ন্ত হয়েছে। ভাশুরকে বলে বলে দু’কশে ফেনা জমে গেছে বড়জায়ের। এক প্রজার কাছে ধান পাওনা আছে, সেখানেই ধরনা মারতে গেছেন বিলাস। ভূষণ যথারীতি বেরিয়েছে ডাক্তারখানায়। 

ডাক্তারখানায় তার যাওয়া-আসাই সার। ঘর-ভাড়ার টাকাও জোটাতে পারেনি। তাই আগেকার ঘরটা এক বছর পরে ছেড়ে দিতে হয়েছে। সোনার মেডেল বাঁধা দিয়ে আগের ভাড়া মিটিয়েছিল ভূষণ। এখন অন্য একটা ছোট ঘরে নাকি আবার ডাক্তারখানা খুলেছে। এক দরজির দোকানের আধখানা নামমাত্র ভাড়ায় পেয়ে গেছে ভূষণ। 

ভূষণ গিরিবালাকে বলেছিল, ভালই হল। দরজির খদ্দেরদের রোগব্যাধি হলে ভূষণের ওখানে ওষুধ খেতে আসবে আর ভূষণের রোগীরা জামা-পিরেন বানাবে ওই দরজির কাছ থেকে। পরস্পরের সঙ্গে সহযোগিতা— ভূষণ গিরিবালাকে বুঝিয়েছিল, এ-যুগে বেঁচে থাকার এই হচ্ছে প্রকৃষ্ট পথ। হাতে হাতে উদাহরণও দেখিয়েছিল ভূষণ। দরজির ছেলের অসুখ করলে ভূষণ তাকে সারিয়ে তুলল। তার ক’দিন বাদেই দরজি শঙ্খর জন্য একটা জামা বানিয়ে দিয়েছিল। খুব উৎসাহ বোধ করেছিল ভূষণ। এমনিভাবে চললে আর ভাবনা থাকে না। কিন্তু সহযোগিতার এমন জাজ্জ্বল্যমান উদাহরণ ভূষণ খুব বেশি দিতে পারেনি। সত্যি বলতে কী, উদাহরণ ওই একটাতে এসেই ঠেকে গিয়েছিল। সম্ভবত দরজির বাড়িতে অসুখবিসুখ আর কারও হয়নি। 

আর হতও যদি কারও অসুখ তা হলেই বা কী এমন চতুর্বর্গ ফল হত শুনি, বড়জোর শঙ্খর আর একটা জামা হত। তাতে কি সংসারের পেট ভরত! এই জিনিসটা ভূষণ কেন যে বোঝে না, গিরিবালা শত চেষ্টা করেও বুঝতে পারে না। 

এই যে, আজ একদানা চাল নেই ঘরে, উনুনে আগুন দিয়ে চুপচাপ বসে আছে গিরিবালা, কখন বটঠাকুর আনবেন চাল, তারপর রান্না হবে, এ ব্যাপারটা কি ভূষণ কোনওদিনই বুঝবে না! নিজেকে নিয়েই মেতে আছে। দু’বেলা ভাতও যদি না জোটে তবে ও ছাতার নাড়ি টিপে হবেটা কী? কিন্তু এ-কথা ভূষণকে বলাই বিপদ। সঙ্গে সঙ্গে ভূষণ এমন একটা ব্যাবসা ফেঁদে বসবে, তার জের সামলাতে অস্থির কাণ্ড। 

ব্যাবসাই কি এর মধ্যে কম করল ভূষণ! মাছের ব্যাবসা করতে গিয়ে দেড়শো টাকা গুনাগার এই তো সেদিন দিল। গিরিবালার গহনা বন্ধক দিয়ে টাকা এনে কাকে যেন দিল আর সে লোকটা টাকা নিয়ে উধাও। ভূষণ সে টাকা উদ্ধারের কোনও ব্যবস্থাও করল না। গিরিবালা বার দুয়েক ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল, পুলিশে-টুলিশে খবর দিয়েছে নাকি ভূষণ। 

ভূষণ অবাক হয়ে বলেছিল, পুলিশ! পুলিশ টাকা উদ্ধার করে দেবে, তবেই হয়েছে। কখনও দিয়েছে শুনেছ? আর তা ছাড়া সে ব্যাটা টাকা চুরি করে কত যে লোকসান দিল সেটাও একবার ভেবে দেখো। ব্যাবসাটা টিকিয়ে রাখতে পারলে অমন কত দেড়শো টাকা ও তো মাসে মাসে রোজগার করতে পারত। চুরি করার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাটা নিজের জরিমানা নিজেই করেছে। 

ব্যস, হয়ে গেল মাছের ব্যাবসা। তারপর ঠিকেদারি করবে বলে দিন কতক লাফাল ভূষণ। চম্পির অসুখটা হতে আর সেদিকে মন দিতে পারেনি। এখন গিরিবালা দেখছে, ক’দিন ধরে ভূষণ আবার কে জানে কী সব হিসেব কষতে লেগেছে। কী যে এবারে তার মাথায় খেলছে ভূষণই জানে। 

অভাব অনটনের সংসারে ভূষণ যে পয়সা আনতে পারছে না, বউ-ছেলেকে খাওয়ানোর মতো রোজগার যে তার নেই, এ-কথা স্পষ্ট করে না বললেও বড়জা ঠারে ঠোরে জানাতে কসুর করেন না। আর লজ্জায় দুঃখে গিরিবালার মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করে। কখনও কখনও তার মনে হয় ভূষণকে এসব বলে। কিন্তু ভয় পায়। যদি চটে যায় ভূষণ! তাই তো সে সব কিছু সহ্য করে যায়। 

কিন্তু কাঁহাতক আর সহ্যই বা হয়! আজ মনে মনে গরম হয়ে উঠল গিরিবালা। এতখানি বেলা হল, এখনও পর্যন্ত সে কিচ্ছু মুখে দিতে পারেনি। চম্পি আর বড়জাও তাই। কিছু খুদ ছিল ঘরে, সকালে তাই দিয়ে জাউ রেঁধেছিল। বটঠাকুর, ভূষণ, বকশিমশাই আর যূথি তাই খানিকটা করে খেয়েছেন। শঙ্খকেও একটুখানি দিয়েছিল। আর একটু তার জন্য তুলে রেখেছিল। একটু আগেই খিদের চোটে চেঁচাচ্ছিল শঙ্খ। জাউ আর মুখে তুলল না। অতিকষ্টে তাই তাকে গিরিবালা ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। ঘুম ভাঙলেই তো খাই খাই করবে, তখন কী দেবে গিরিবালা? দুধ যেটুকু হয় তাতে শঙ্খর পুরো পেট ভরে না। 

.

হঠাৎ বড় ভাশুরের গলা শুনল গিরিবালা। বিলাস চেঁচাতে চেঁচাতে বাড়িতে ঢুকছেন। 

ওগো, কনে গেলে সব? শোনো, সব্বনাশ হয়েছে। 

গিরিবালার বুক ধক করে উঠল। কী সর্বনাশ আবার হল? বুক দুরদুর করতে লাগল তার।

দামিনী ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন তাড়াতাড়ি। যূথিও বারান্দায় এসে দাঁড়াল। 

দামিনী একরাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে! কী হয়েছে! 

চম্পিরি একজন দেখতি আয়েছেন যে! ইস্কুলি বসায়ে রাখে আইছি। অতি সজ্জন ব্যক্তি। তা ন্যাও, ব্যবস্থা-ট্যাবস্থা করো। 

গিরিবালা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। বাব্বাঃ, বটঠাকুরের কথার ছিরিই আলাদা।

বলো কী? 

দামিনী যেন আকাশ থেকে পড়লেন। 

কই, সকালে তো জানাওনি। 

জানাব কী, এর আর জানাব কী? 

বিলাস চটে উঠলেন। 

আমি কি নিজিই জানতাম! ভাদড়ায় যাব বলে তো বেরোলাম। বকশিবাড়ির কাছাকাছি যাতিই দেখা হয়ে গেল ওর সঙ্গে। বলি চিনা-চিনা ঠ্যাকছে, মানুষটা কিডা। উনিই দেখি হাঁ করে আমার মুখির দিকি চায়ে আছেন। হঠাৎ মনে পড়ল কাজিপাড়ার মামাগের ওখেনে দেখিছি। বলতিই বললেন, হ্যাঁ। আমারেও চেনলেন। আমাগের সঙ্গে কেমন যেন কুটুম্বিতেও আছে। মামাগের সম্পর্কে ভাই হন উনি। বললেন, ওঁর ভাইপোর জন্যি কনে যেন পাত্রী দেখতি আইছিলেন। তা সে মেয়ে পছন্দ হয়নি। আমার বয়স্থা মেয়ে আছে শুনে দেখতি চালেন। 

গড়গড় করে বলে গেলেন বিলাস। দামিনী হাসবেন কি কাঁদবেন বুঝতে পারলেন না।

বললেন, তা এতক্ষণ করতিছিলে কী? ছিলে কনে? 

কেন, ইস্কুল বাড়িতি বসে ছিলাম। বেশ ঠান্ডা তো জায়গাটা, আর নিরিবিলি। দু’কথা আলোচনা হল শাস্তর নিয়ে। ভাগবত-টাগবত বেশ পড়া আছে বুঝলাম। আমার সেই উদ্ধবতত্ত্বটাও শুনোয়ে দিলাম— বুঝলে? সেই যে গো শান্তিপুরির গুঁসাইরি যা দিয়ে পাড় করিছিলাম সিবার মনে নেই! 

দামিনীর সর্বশরীর তেলে-বেগুনে জ্বলে গেল। ইচ্ছে হল গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়েন। লোকটাকে নিয়ে যে কী করবেন দামিনী বুঝতে পারলেন না। সারাটা জীবন তাঁকে এমনিভাবে জ্বালিয়ে যাচ্ছে বিলাস। ধান আনতে বের হল, জানে এক বিন্দু দানা নেই ঘরে, তা না করে পথের মধ্য থেকে লোক জুটিয়ে শাস্তর আলোচনা হচ্ছে এতক্ষণ ধরে। আবার বলে, মেয়ে দ্যাখাও। দেড় পহর বেলা হল। এখন কী করবেন দামিনী? মাথা খুঁড়ে মরবেন? 

শাস্তর তো সবাই পড়ে। আপন মনেই বলে চলেছেন বিলাস, মর্ম বোঝে কয়জন? সেইটেই হল গিয়ে কথা। সেটা বুঝতি হবে। বলি, রাধা নয়, চন্দ্রাবলী নয়, ললিতা-বিশাখা নয়, জোর দিচ্ছি উদ্ধবের উপর। কেন? 

রাখো দিনি তুমার উদ্ধব। এই ভরদুপুরি অশৈলে আর বাড়ায়ে না। যে উদ্ধবরে এখন আনিছ, তার ব্যবস্থা করো। 

বিলাস বললেন, ব্যবস্থা তো করবা তুমরা। চম্পিরি একটু সাজায়ে গুজোয়ে রাখো। আমি একটু পরেই ওঁরে নিয়ে আসতিছি। 

দামিনী হতাশ হয়ে বললেন, তা হলিই কি হবে? খাওয়াদাওয়ার বন্দোবস্ত করতি হবে না? সে কাজ করবে কিডা? 

বিলাস এবার চটে গেলেন, কও কী, বাড়িতি এতগুলোন মেয়েলোক থাকতি, কুটুমসাক্ষাতের খাওয়ানোর ব্যবস্থা আমারে করতি হবে? হাতে কি সব কুড়িকুষ্টি হইছে? 

দামিনী বললেন, ঘরে কি কিছু আছে যে ব্যবস্থা করব? বলি জিনিসপত্তর আনে দিবা তো।

বিলাস গাঁক গাঁক করে উঠলেন, যেদিনির থে তুমি আইছ সেদিনির থে ঘরে কি কিছু থাকবার জো আছে! 

দামিনী জবাব না দিয়ে ঘরে ঢুকে গেলেন। বিলাস কিছুক্ষণ চেঁচামেচি করে হঠাৎ যুথিকে বললেন, যূথি, ধামাটা আন দিনি। 

সে ধামা এনে দিতেই বিলাস হনহন করে পুকুরপাড় দিয়ে কলুপাড়ার দিকে রওনা দিলেন। 

.

ভূষণ যখন বাড়িতে এসে পৌঁছোল তখন খাওয়াদাওয়া সেরে বগলাকান্তবাবু একটু গড়িয়ে নিচ্ছিলেন। ভূষণ তাঁর সঙ্গে আলাপ করে গেল। 

বগলাকান্তবাবুর বয়স বছর চল্লিশেক হবে। মাথায় টাক। দিব্যি ভুঁড়ি। বেশ মোটাসোটা মানুষটি। 

বিকেল নাগাদ মেয়ে দেখানোর বন্দোবস্ত করা হল। সাবান মেখে চান করল চম্পি। সেই সাবান, যূথির সঙ্গে যা নিয়ে একদিন তার ঝগড়া হয়েছিল। গিরিবালা আর যুথি সাজিয়ে দিল তাকে। কাকিমার কাপড়ে বেশভূষা করতে আজ আর চম্পির মানে লাগল না। ভীরু পায়ে এসে সে বগলাকান্তবাবুর সামনের আসনে বসল। মুখ নিচু করে। 

বগলাকান্ত চম্পির স্বাস্থ্যখানা দেখেই মুগ্ধ হয়ে গেলেন। 

একগাল হেসে বললেন, বেড়ে স্বাস্থ্য বটে বিলাসবাবু, আপনার মেয়ের। হ্যাঁ, গেরস্ত বাড়ির বউ, গড়নপেটন তো হওয়া চাই এমনি ধারাই। যাতে সব চোট সামলাতি পারে। ওসব ফঙ্গবেনে ধরনের মেয়ে মশাই আমাগের বাড়ির দু’চক্ষির বিষ। 

বিলাস বগলাকান্তর কথা শুনে মোহিত হয়ে গেলেন। কালো রঙের কথা তুলে বগলা যে তাঁদের অপ্রস্তুত করছেন না, চম্পির অন্তত একটা জিনিসও তাঁর ভাল লেগেছে, বিলাস এতেই খুশি। 

হাত কচলাতে কচলাতে বললেন, এ যা দেখতিছেন এ তো মা’র আমার অর্ধেক স্বাস্থ্য। ডবল নিমোনিয়ায় পঁয়তাল্লিশ দিন ভুগিছে। ফিরে যে পাব সে আশা তো ছাড়েই দিছিলাম। তারপরে মা’র আগের স্বাস্থ্য আর ফিরে আসেনি। ভাল খাতি পায় না, ভাল যত্ন পায় না তো। 

পাবে পাবে, বিলাসবাবু 

বগলাকান্তবাবু হাসতে লাগলেন। 

আমাগের বাড়ির বউগের খাবার অভাব হয় না। এই দুর্বছরেও চারটে গুলা একেবারে ধানে ভরা। দুটো পুকুরি মাছ আর আটটা দুধেল গাই। খাক না কিডা কত খাবে। বগলা বিশ্বেসের খাবার অভাব হয় না। আপনার কাজি পাড়ার মামাগের জিজ্ঞেস করে দ্যাখবেন। আর যত্নের কথা! হাঃ হাঃ হাঃ। বাড়ির বউ আমাগের মাথার মণি ঘরের লক্ষ্মী যে মশাই। জিজ্ঞেস করবেন আপনার মামারে। বগলা বিশ্বেসের কথা এক বর্ণও যদি মিথ্যে হয়! 

বিলাস একেবারে গলে গেলেন। সমানে দু’হাত কচলাতে লাগলেন।

বললেন, আমার মেয়ে আপনাগের ঘরে পড়বে, আমার কি এমন ভাগ্যি। 

কেউ বলতি পারে না সে-কথা। বগলাবাবু বললেন- যে যার কপালে খায়। আপনার মেয়ের কপালে যদি আমাগের বাড়ির অন্ন মাপা থাকে, তবে সে কি কেউ ঠ্যাকাতি পারবে? আপনিউ পারবেন না, আমিউ না, এমনকী আমার ভাইপোডাউ না। ভবিতব্য মশাই, সবই ভবিতব্য। 

সে তো ঠিক, সে তো ঠিক।— বিলাস সঙ্গে সঙ্গে সমর্থন করলেন। 

বগলাকান্ত বললেন, যদি কিছু মনে না করেন তো আপনার মেয়ের হাতখানা একবার দেখি আমার আবার ও-সব চর্চা আছে কিনা। মেয়ে দেখতি আসে বাজে ফাতরামো আমি পছন্দ করিনে। চুল দ্যাখা, দাঁত দ্যাখা। কী সব অসভ্যতা! এ কি গোহাটায় আইছি যে, দাঁত দ্যাখব! 

বগলাকান্তের কথার ধরনে অন্দরে বাইরে হাসির ধুম পড়ে গেল। 

বগলাকান্ত বললেন, তবে হ্যাঁ, যিডা দ্যাখার সিডা দেখতি হবে বই কী। স্বাস্থ্যটা দ্যাখলাম, ইবার ভাগ্য-রেখাটা দ্যাখা হলিই চুকে গেল। দেখি তুমার হাতখানা? 

বগলাকান্তবাবু প্রথমে চম্পির ডান হাতখানা চিত করে নিজের বাঁ হাতের তালুর উপর রাখলেন। বার দুয়েক মোলায়েম করে টিপলেন। এমনভাবেই টিপলেন যে চম্পির শরীর শিরশির করে উঠল। মুখচোখ লাল হয়ে উঠল। চম্পির পাঞ্জাটা তারপর উলটে দিলেন। আবার বার দুয়েক টিপলেন। প্রত্যেকটি আঙুলের ডগা দেখলেন। তারপর পাঞ্জাটা আবার উলটে দিলেন। করতলের রেখাগুলো দেখলেন। বার তিনেক চম্পির আঙুলগুলো মুড়ে দিলেন। এমনিভাবে ডান হাত দেখা হল। তারপর বাঁ হাত দেখা হল। তারপর একসঙ্গে দু’খানা হাত দেখা হল। অপরিচিত পুরুষের হাতের টিপুনি খেতে খেতে চম্পির হাত ঘেমে উঠল। বুক থরথর করে কাঁপতে লাগল। হাত দেখার পালা শেষ হতে সে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। 

বগলাকান্তবাবু এতক্ষণ তন্ময় হয়ে হাত দেখছিলেন। এবার বিলাসের দিকে চেয়ে হাসলেন।

বললেন, আপনার মেয়ের লক্ষণ খুব ভাল। যে-ঘরেই যাক সুখী হবে। 

বিলাসের চোখ ছলছল করে উঠল। 

বললেন, কিন্তু ওরে কোনও ঘরে দিবার মতো সামর্থ্যই যে আমার নেই। 

বগলাকান্তবাবু বললেন, ভবিতব্যের উপর হাত আছে কার? যে-ঘরে যাওয়া ওর কপালে লিখা আছে সে-ঘরে ও যাবেই। আপনি আমি চাই আর না-চাই। হ্যাঁ, আমাগের বংশের আর-একটা নিয়ম আছে। 

বলেই পকেটে হাত দিয়ে এক জোড়া সোনার বালা বের করলেন। 

বললেন, এই বালা যদি আপনার মেয়ের হাতে ঢোকে তবেই জানলেন, মেয়ের আশীর্বাদ হয়ে গেল। তারপর আপনারা গিয়ে ছেলে, তার বাড়িঘর দেখে আসে যে-দিন ধার্য করবেন, সেই দিনি আসে আমরা বিধিমতে আমাগের ঘরের বউ তুলে নিয়ে যাব। দেখি তুমার হাত। 

চম্পি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। দামিনী না, বিলাস না, কেউ না। অমন আশ্চর্য ঘটনা ঘটে নাকি? এমন লোকও আছে নাকি? ইনি মানুষ না দেবতা? 

চম্পি একখানা হাত বাড়িয়ে দিল। অনেক দিন পরে তার মনে আবার চঞ্চলতা দেখা দিল। বগলাকান্তবাবু একটা বালা নিয়ে চম্পির হাতে পরাতে লাগলেন। বালার মাপটা কিছু ছোট। বগলাকান্তবাবু চম্পির হাত টিপে টিপে নানা কসরত করে নিপুণভাবে বালা পরাতে লাগলেন। চম্পি টের পেল বগলাকান্তবাবুর হাতের তালুও ঘেমে উঠছে। একটা চাপা উল্লাসে ওই বয়স্ক হাত দুটোও থরথর করে কাঁপতে লেগেছে। চম্পির চোখও হঠাৎ একবার বগলাকান্তবাবুর চোখে পড়ল। সেখানেও যেন দুটো আগুনের শিখা জ্বলছে। 

নয় 

বাসর হয়েছে ভূষণের ঘরে। সন্ধের মুখেই লগ্ন ছিল, কাজকর্ম তাই তাড়াতাড়ি চুকেছে। 

চম্পির বড়দি কমল বরের কাছে বিশেষ ঘেঁষতে পারেনি। চম্পির বিয়ে উপলক্ষে বাপের বাড়ি এসে ইস্তক সে নাকের জলে চোখের জলে হচ্ছে। কোলের ছেলেটার একগা জ্বর। হামই উঠল বুঝি। বারে বারে ফিট হচ্ছে। বোনের বিয়ে মাথায় উঠল কমলার। ছেলে সামলাতেই সে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। 

মেজ মেয়ে বিমলাই যা বাসর জমাবার চেষ্টা করছিল। গিরিবালার ইচ্ছে করছিল, সেও বিমলার সঙ্গে যোগ দেয়। নিজের বিয়েতে সে ছিল কনে। আমোদ করার কোনও সুযোগ ছিল না তার। এবারে যদিও একটা সুযোগ এসেছিল, কিন্তু সেটা কাজে লাগাতে বাধো বাধো ঠেকছিল। বয়েসটা কম হলে হবে কী, সম্পর্কে সে তো গুরুজন। তা ছাড়া বিমলা একবার তো ডাকলও না তাকে। তাই আত্মীয়স্বজনের ঝক্কি সে সামাল দিয়েছে, আর ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিয়েছে বাসরে। এরা বড় স্বার্থপর। আমোদে আহ্লাদে তাকে বড় একটা ভাগ দিতে চায় না। কিন্তু নেবার বেলায় তো ভুল হয় না। তখন তো— ছোটকাকিমা তুমার বেনারসিটা দেখি, তুমার টায়রাটা একবার দ্যাও তো— সোহাগ একেবারে উথলে ওঠে। মনে মনে খুব চটেছে গিরিবালা। সকলের উপরেই সে চটে গেল। 

চটার কারণও আছে। চম্পির গলায় ওই যে মপচেনটা, ওটা গড়াতে ভূষণ গিরিবালার পাটিহারটা নিয়ে গিয়েছে। ছয় ভরির হার। সোজা নয়। চম্পির মপচেন হয়েছে আর বরের বোতাম আংটি। হারটা বের করে দেবার সময় ভূষণের বাগ্মিতার গুণে গিরিবালার মনটা বেশ উদার হয়েই উঠেছিল। সে একরকম স্বেচ্ছাতেই খসিয়ে দিয়েছিল পাঁজরার একখানা হাড়। বড়জা দিন দুয়েক খুব প্রশংসা করলেন। গিরিবালা কৃতার্থ হয়ে গেল। ভাবল, এবার বুঝি সে অদৃশ্য অবরোধ ভেদ করে এদের অন্তরে ঢুকে পড়তে পারল। 

কিন্তু তা ভুল। কত বড় ভুল, গিরিবালা বুঝতে পারল ভাশুরঝিরা এলে। গিরিবালা দেখল, ঝাঁকের পাখিরা কেমন ঝাঁকে মিশে গেল। সে আগেও যেমন একটা পাঁচিলের বাইরে ছিল, এখনও সেই বাইরেই রয়ে গেল। মাঝখান থেকে ভালমানুষি করতে গিয়ে সে তার অমন সুন্দর হারটা খোয়াল। আর কি অমন হার তার হবে! বাসরের দরজা দিয়ে যতবার ভিতরে উঁকি দিয়েছে, সেই হইচই, বদরসিকতা, প্রগল্ভতা ছাপিয়ে হ্যাজাগের-তীব্র-আলোর ঠিকরে-পড়া চম্পির গলার মপচেনের দীপ্তি তার চোখে এসে বারবার বিঁধেছে। আর গিরিবালার মন পাটিহারের শোকে হুহু করে উঠেছে। সে তো এদের কেউ না, তবে কেন সে এই লোকসানটা ঘটাল! 

.

বাড়িটা লোকে ভরতি হয়ে গেছে। সুখ-শান্তি একেবারে নষ্ট হয়েছে। যশোরের মেজোজার সঙ্গে রাতদিন ঝগড়া চলছে বড়জা আর তার মেজমেয়ের। গিরিবালা এই পরিবেশে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। কে কার ছেলেকে চুরি করে মাছ খাওয়াল, কে মিষ্টি সরাল, কে কাকে অপমান করল, তাই নিয়ে ঝগড়া। বিয়ের আগের দিন বাসরঘরের জন্য কার ঘর ছেড়ে দেওয়া উচিত, এই নিয়ে এমন ধুমতাল বেধে গেল যে, মেজজা একদিকে চলে যাবার জন্য বাক্স গোছাতে বসলেন, অন্যদিকে বিমলা তার বরকে গাড়ি ডাকবার জন্য ব্যতিব্যস্ত করে তুলল। ওদিকে বিলাস লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে চুল ছিঁড়ে, মুখ দিয়ে ফেনা তুলে, দামিনীর চোদ্দো পুরুষ উদ্ধার করে তুমুল কাণ্ড বাধিয়ে তুললেন। দামিনী ঘরে গিয়ে খিল দিলেন, বিলাস ঢুকলেন ঠাকুরঘরে। ভূষণ আর বকশিমশাই মাঝে পড়ে অতিকষ্টে সে ঝামেলা সামাল দিল। মাঝখান থেকে গিরিবালার ঘরখান ক’দিনের জন্য হাতছাড়া হল। শঙ্খকে নিয়ে গিরিবালাকে আশ্রয় নিতে হল ভাঁড়ার ঘরের একপাশে। 

এত কাণ্ড যে ঘটে যাচ্ছে বাড়িতে, তার আঁচ একজনের গায়ে কিন্তু একটুও লাগল না। সে চম্পি। সে আশ্চর্য শান্ত, আশ্চর্য ধীর। আজ এই বাসরঘরের কোনও চাঞ্চল্য তাকে স্পর্শই করছে না যেন। 

সেই আশীর্বাদের দিনই সে যা একটু চঞ্চল হয়েছিল। কিন্তু বিলাস আর বকশিমশাই পাত্তরকে আশীর্বাদ করে এসে যখন জানালেন, পাত্তর বগলাকান্ত নিজেই, তখন বাড়িতে তা নিয়ে কিছুক্ষণের জন্য শোরগোল, ঘোঁট ইত্যাদি চললেও চম্পি আশ্চর্যরকম শান্তই হয়ে গেল। বরং এইরকম কিছু না হলেই সে যেন অস্বস্তিতে ভুগত। এখন যেন সে ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য বলে গ্রহণ করল। হ্যাঁ, এ আর স্বপ্ন নয়, মায়া নয়, কোনও হুঁশিয়ার শহুরে যুবকের ছলনা নয়। এ হচ্ছে এক বৃদ্ধ তেজবরের অমোঘ সিদ্ধান্ত। বেশ ভেবেচিন্তে, যাচাই বাছাই করে চম্পির হাতে বালা পরিয়ে দিয়ে গেছেন বগলাকান্ত বিশ্বাস। চম্পির বিশ্বাস হয়েছে, এবার তার গতি হল। সব সংশয় মিটে গেছে তার, তাই সে এত শান্ত, এত ধীর। 

বিলাস অবশ্য আশীর্বাদ করে ফিরে এসে কৈফিয়ত একটা দিয়েছিলেন। খুব বেশি বাজে কথা নাকি বলেননি বগলাকান্ত। চারটে গোলা সত্যিই আছে বাড়িতে, দুটো পুকুর, গোটাকতক আম-কাঁঠালের বাগান। বড় রকমের তেজারতি কারবার আছে তাঁর। আর আছে আগেকার দুই. পক্ষের দুই ছেলে। বড়টার বয়েস তেরো, ছোটটার সাত। দুই পক্ষই এই দুটো চিহ্ন রেখে গত হয়েছেন। কোনওরকম বদ দোষ নেই তাঁর, আর নেই ভাইপো। ওইটুকু যা ছলনার আশ্রয় নিয়েছেন বগলাকান্ত। স্বভাবত একটু লাজুকপ্রকৃতি কিনা, নিজের জন্য মেয়ে দেখতে এসেছেন ও–কথা বলতে লজ্জা পেয়েছিলেন। আর কী রকম সজ্জন ব্যক্তি! পঁচিশ টাকা ধরিয়ে দিয়েছেন বিলাসের হাতে, আসবার সময়, শুভকাজের ব্যয়নির্বাহের জন্য। চম্পি সুখেই থাকবে। 

দামিনী বড় রকমের একটা কাঁদুনির তোড়জোড় করতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু সব শুনে দামিনীর কান্না মাঝপথেই বন্ধ হয়েছিল। এ চম্পির শিবপুজোর ফল। শিবের মতোই বর হল চম্পির। ভবিতব্য কে খণ্ডাতে পারে। 

.

বাসরঘরের ক্রিয়াকাণ্ড আরও কতক্ষণ চলত কে জানে? বিমলার ঢাকন-ঢোকন, কড়ি খেলানো শেষ হল। পাড়ার গুটি পাঁচেক এয়ো নানা রকমে জামাই-ঠকানো প্যাঁচ একে একে ঝাড়ল। যুথি রূপের বাহার খুলে বারকয়েক বগলাবাবুর গায়ে হাসতে হাসতে ঢলে ঢলে পড়ল। অবশেষে বকশি-বাড়ির বালবিধবা ক্ষ্যান্তদিদি আসরে নামলেন। 

বললেন, ও বর, তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকলি তো বিয়ে করতি আইছ। বলি যুবতী কনে সামলাতি পারো কেমন দেখি? কোলে তোলো দিনি? এ মুখির মিষ্টি ও মুখি তুলে দ্যাও। 

এতক্ষণ কী আজেবাজে একঘেয়ে মশকরা সব হচ্ছিল। বিরক্ত লাগছিল বগলাকান্তবাবুর। প্রথমবার তাঁর যখন বিয়ে হয়, তখন বোধহয় চম্পির জন্মই হয়নি। তখনও এই একই ধরনের রসিকতা সব হয়েছিল। সব যেন একই ছকে কাটা। তবুও তখন বয়েস ছিল কম, টাক ছিল না, ভুঁড়ি ছিল না, প্রথম বিয়ে, বেশ ভালই লেগেছিল। কে যেন গালে ঠোনাও মেরেছিল। দ্বিতীয় বিয়ের বয়েসও তো প্রায় বছর দশেক হল। তখনও বগলাকান্তবাবুকে এই একই রসিকতার তাড়না সহ্য করতে হয়েছিল। এবারও তাই। সেই কারণেই এতক্ষণ কোনও উৎসাহ পাচ্ছিলেন না। ক্ষ্যান্তদিদির কথায় নড়েচড়ে বসলেন। হ্যাঁ, এতক্ষণে তবু একটা কাজের কথা শোনা গেল। চম্পির হাত দুটো খুব নরম, মনে পড়ল তাঁর। সঙ্গে সঙ্গে নিরিবিলি পাবার জন্য মনটা আনচান করে উঠল। আর কতক্ষণ জ্বালাবে এরা! 

বগলাবাবু বললেন, অনেক হয়েছে, ইবারে বিশ্রাম চাই। আপনারা খ্যামা দ্যান। 

ক্ষ্যান্তদিদি বললেন, ওলো, বুড়োর যে আর তর সচ্ছে না। অব্যেসটা বুঝি চাড়া দিয়ে উঠতিছে। তা হবে না, পরিক্ষে দিতি হবে। না হলে ছাড়ব ক্যান? এই গ্যাঁট হয়ে বসলাম সব। 

সবাই খিলখিল হেসে এর গায়ে ও গড়িয়ে পড়তে লাগল। 

বিমলা মুখ টিপে হেসে বলল, ন্যাও ভাই ন্যাও, এইটেতে পাশ করলিই ছুটি। 

বগলাকান্তবাবু বৃথা বাক্যব্যয় না করে জড়সড় চম্পিকে টেনে নিলেন কোলে। এত লোকের চোখের সামনে সে অস্বস্তিতে, লজ্জায় বিরক্তিতে আড়ষ্ট হয়ে বসে রইল। একটা সন্দেশ কামড় দিয়ে বগলাকান্তবাবু বাকিটা চম্পির মুখে জোর করে গুঁজে দিলেন। গালের মধ্যে গুচ্ছের আবর্জনা নিয়ে চম্পি মুখখানা গোঁজ করে থাকল। ঘরে হাসির ধুম উঠল। ক্ষ্যান্তদিদির মনের খিদে চোখে গিয়ে জড়ো হল। 

এক গা জ্বালা নিয়ে সে বলে উঠল, চল বিমলি, চল। চম্পির চোখ যেমন ঢুলে আসতিছে তাতে মনে হয় বুড়োর কোলে ঢলে পড়তি আর দেরি নেই। ওরে, চল সব। ত্বরা করে যার যার বাড়ি হাঁটা দে। আমরা এখন থাকলি ওগের গায় ফুসকা পড়বেনে, কী বলো গো বর? 

সবাই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। চম্পি সরে বসল। তারও ওদের সঙ্গে বেরিয়ে যেতে ইচ্ছে করছিল। এতক্ষণে তার ভয় ঢুকল মনে। এ সুহাস নয়, (হঠাৎ তার সুহাসের কথা মনে পড়ল ) যে ইনিয়ে-বিনিয়ে কথা বলেই তাকে নিস্তার দেবে। বগলাকান্তবাবু উঠলেন, দরজাটা বন্ধ করলেন। 

গরদের জামাটা খুলতে খুলতে বললেন, কতক্ষণ আর সং সেজে বসে থাকা যায়? 

গেঞ্জিটাও খুলে ফেললেন একটানে। লোমভরতি একটা দেহ আর নিটোল এক ভুঁড়ি নির্লজ্জভাবে আত্মপ্রকাশ করল। 

উঃ, কী গরম! 

বগলাকান্তবাবু খাটের ধারেতে পা ঝুলিয়ে বসে একখানা হাতপাখা টেনে নিয়ে জোরে জোরে হাওয়া খেতে লাগলেন। 

বাবা, কী ঘামাচিই না ফুটিছে! চিটপিটোয়ে অস্থির করে ছাড়ল। 

বগলাকান্তবাবু পাখার ডাঁটিটা দিয়ে ঘ্যাস ঘ্যাস করে পিঠের ঘামাচি মারতে লাগলেন, চম্পি শীতল দুটি চোখ তুলে দেখতে লাগল। বগলাকান্তের বুকে গোছা গোছা লোম, কানের ফুটো দিয়েও রোমের গুচ্ছ বেরিয়েছে। কিছু পাকা কিছু কাঁচা। বুক থেকে রোমের একটা সরল রেখা বেরিয়ে স্ফীত উদরের উপর দিয়ে নেমে গেছে। অজস্র ছাগলের পাল যেন দূর কোন নদীর পাড় বেয়ে নামতে শুরু করেছে। বগলাকান্তবাবুর কোঁখে কাপড় পরার দাগ। ডানার উপর ছুলি। গা-ভরতি ঘামাচি। কিছুই তার নজর এড়াল না। 

কী গো লজ্জাবতী! 

বগলাকান্তের আকস্মিক সম্ভাষণে চমকে উঠল চম্পি। 

কী গো, মুখটুখ খোলো। বলি পছন্দ হইছে তো?

চম্পি জবাব দিল না। 

কোনও অভাবই রাখব না তুমার। কত শাড়ি চাও, কত গয়না চাও। বগলা বিশ্বেসের অভাব নেই কিছু। তার যা-কিছু আছে, সবই তো তুমার। আমি তো এখন ও চরণের দাস। দেহি পদপল্লবমুদারম্। হেঁ হেঁ হেঁ। বুঝিছ। হেঁ হেঁ। যে-মুহূর্তে তুমারে দেখিছি, সেই তখনের থেই কিনা গুলাম হয়ে গিইছি। বেশ শরীরখান তুমার। এই রকমই আমার পছন্দ। হেঁ হেঁ হেঁ হেঁ হেঁ। বুড়ো বলে ব্যাজার হইছ নাকি? পুরনো চাল আর পুরনো বর, ওই যে কী যেন বলে, হেঁ হেঁ হেঁ তাই। বুঝিছ। আসো, আসো, কাছে আসো। ভাবতিছ বুড়ো বর, আরে বুড়ো কি বয়েসে করে?

বলেই চম্পিকে আবার কাছে টেনে নিলেন। তাঁর বুকের ঘাম চম্পির মুখে ঠেকল। আগ্রহ দেখাল না সে। বিন্দুমাত্র বাধাও দিল না।

বগলাকান্তবাবু সেই রাত্রেই স্বামিত্বের স্বাক্ষর রাখতে যখন অতিমাত্রায় উদ্যোগী হয়ে উঠলেন, চম্পি তখনও বাধা দেয়নি। সে বুঝেই গেছে এখানে তার ইচ্ছা-অনিচ্ছা অবান্তর। বহুদিন আগে একটা টিকটিকি তার গায়ে থপ করে পড়েছিল। বগলাকান্ত সেই ছোট্ট একটা টিকটিকি নয়, তার মনে হল, একটা বিরাটকায় গিরগিটি যেন সারারাত ধরে তার শরীরের নানা জায়গায় মহোৎসাহে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর ডিম পেড়ে পেড়ে তার শরীরটা অপবিত্র করে দিচ্ছে। তার গা ঘিনঘিন করে উঠল। অপ্রবৃত্তির একটা দারুণ অস্বস্তি তাকে সর্বক্ষণ পীড়া দিতে লাগল। 

চম্পি বুঝতে পারল, তার আগামী জীবনের বহু রাত্রি যেভাবে কাটবে, এটা তারই একটা মহড়ামাত্র। সে ভেঙে পড়ল না, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতেও দেখা গেল না তাকে। সে এটাকে মেনে নিল। ভবিতব্যকে কে খণ্ডাতে পারে? তার দেহে প্রতিরাত্রে সরীসৃপ বিচরণ করবে, ক্ষমতার পরিচয় দেবার জন্য বিকৃত উল্লাসে অতিমাত্রায় উৎসাহী হয়ে উঠবে, অশ্লীল নৃত্য করবে, এই তো তার বিধিলিপি। এই লোকটি মহানুভব, সন্দেহ নেই। তবু তো কালো বলে তাকে পায়ে ঠেলেনি। তাই তো সে পার পেল। 

না, সে শিরে করাঘাত করবে না, কাউকে দোষারোপ করবে না। একবার তো সে অতল জলে ডুবে মরতে স্বেচ্ছায় গিয়েও ছিল। তবে আর তার ভয়টা কীসের? চম্পি জানে, এবার তার আর ফেরার উপায় নেই। দরকারই বা কী? 

.

অশেষ উপদ্রব সহ্য করার পরও, ওরই মধ্যে চম্পি যেন কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল। তারপর যখন জাগল তখন ওর মনটা ঘষা কাচের মতো হয়ে উঠেছে। অনভ্যস্ত পরিবেশ তাকে খুব বেশি পীড়া দিল না। নতুন তোশক, নতুন বালিশ, নতুন চাদর, নতুন মশারি। কেমন টানটান মশারিটা। মাড়ের গন্ধের সঙ্গে আশেপাশে ছড়ানো ফুলের গন্ধ মিলে অদ্ভুত এক গন্ধের সৃষ্টি হয়েছে। নাকে এই নতুন গন্ধ এসে লাগছে। অজগরগর্জন সৃষ্টি করছে পাশে-শোয়া ওই লোকটির নাক। ওই লোকটাই তোমার স্বামী।— চম্পি পরিচয় করাচ্ছে নিজের সঙ্গেই। এমন নরম বিছানায় আর কখনও শোয়নি চম্পি। না, শুয়েছিল। এর চাইতেও বোধহয় সে বিছানা আরও নরম ছিল। শৈলদিদের বাড়ি। চম্পি এখন নিজের বাড়িতেই শুয়ে আছে। ছোটকাকার ঘরে। বরসজ্জায় দানে-পাওয়া নতুন বিছানার উপরে। সে আর একা নয় এখন। পাশে তার বর। বরের একখানা হাত তার বুকের উপর এসে পড়েছে। চম্পি নির্বিকারভাবে হাতখানা নামিয়ে রাখল। উনুনের পাড়ে যেন একখানা চ্যালাকাঠ সরিয়ে রাখল। 

তারপর সে নিঃশব্দে উঠে বসল। সন্তর্পণে বাইরে চলে এল। ভোর হয়েছে। আলো ফোটেনি। কেউ ওঠেনি। বাঁশের খুঁটি হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল চম্পি। সেই খুঁটির ভিতরটার মতো চম্পির মনটাও নিরেট শূন্য দিয়ে ভরা। কোথাও বিন্দুমাত্র চাঞ্চল্য নেই। না আকাশে, না এই বাড়িতে, না চম্পির মনে। 

খুট করে কে যেন কোন ঘরের দরজা খুলল। চম্পি চমকে উঠল। শঙ্খ! কী করে যেন দরজা খুলে ভাঁড়ার ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। কাকিমা বোধহয় ঘুমুচ্ছে এখনও। 

চম্পিকে দেখতে পেল। একগাল হাসি ফুটল তার মুখে। 

ডাকল চম্পিকে, দিদি আয়। 

চম্পির বুকের মধ্যে এতক্ষণ পরে, শঙ্খের ডাক শুনে, একটা মোচড় দিয়ে উঠল। সে প্রায় ছুটে গিয়ে শঙ্খকে বুকে তুলে নিল। শঙ্খ তার নাকের ফুল ধরে, হার ধরে, কানের মাকড়ি ধরে টানাটানি করতে লাগল। এগুলো আগে তো দেখেনি সে। খুব মজা লাগল তার। 

বলল, দিদি পালা। 

বেড়াতে যাবার বায়না। পাড়া বেড়াতে শিখেছে শঙ্খ। চম্পি ওকে চুমু খেল। কোলে তুলে পুকুরপাড়ে এল। ঝিরঝির করে ঠান্ডা বাতাস বইছে। চম্পির শরীর যেন জুড়িয়ে আসছে। শঙ্খ সমানে তার গহনা ধরে টান দিয়ে চলেছে। 

শঙ্খ বলল, দিদি বউ। 

দু’বছরের ছেলে সব বোঝে। চম্পি হাসল। মনটা কিছু হালকা হল তার। ক’দিন ধরে মনে গুমোট ছিল। কথাবার্তা বন্ধই করে দিয়েছিল চম্পি। শঙ্খকেও সে কাল থেকে পাত্তা দেয়নি। 

বলল, শঙ্খ, আমি চলে যাব রে। 

শঙ্খ বলল, যাব না। মা 

চম্পি বলল, আমি চলে গেলে, তুই কাঁদবি? 

কাব। দিদি যাব না। কাব। 

শঙ্খকে বুকে চেপে ধরে কেঁদে ফেলল চম্পি। এতক্ষণ পরে সে কাঁদবার অবকাশ পেল। তুই কাঁদবি, আমি জানি। 

আর-কেউ কাঁদবে না। কেউ না। সবাই নিস্তার পেয়ে গেল। আমি তো চক্ষুশূল ছিলাম সবার। এবার দেখিস ওরা সুখে থাকবে। মনে মনে শঙ্খকে শোনাল চম্পি। প্রতিজ্ঞা করল, আর আমি আসব না এ-বাড়িতে। চম্পির বুক ঠেলে জমাট কান্না বেরোতে শুরু করেছে। আর আসব না এখানে। কোনওদিন না। কক্ষনও না, কক্ষনও না। আমি জানি, বুঝতে পেরেছি, কেউ আমাকে দেখতে পারে না। 

চম্পির চোখে জল দেখে শঙ্খ কচি কচি দুটো হাত দিয়ে তার চোখ দুটো চেপে ধরল।

বলল, ছাট ছাট, কানে না। মা্ব্‌ব না। কানে না। দুট্‌টু মা্ব্‌ব। দিদি ভাল। দিদি মাব্‌ব না।

চম্পি বলল, তোর কাছেই শুধু আমি ভাল। তুই-ই শুধু আমারে ভাল দেখিস। আর কেউ দেখে না। না বাপ, না মা। দেখিসনি আমারে কেমন ঠেলে দিল! বেশ, আমিও আর জীবন থাকতি এদিকি মাড়াব না। 

চম্পি এবারে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। তার পরনে বেনারসির চেলি। চেলির খুঁটে বরের গরদের চাদর বাঁধা। সে আষ্টে-পৃষ্টে বাঁধা পড়ে গেছে। তার কপালে, সিঁথিতে অনভ্যস্ত সিঁদুর। এখনও তা সামান্য ঘষা খেলেই উঠে যায়। বিয়ের রাত্রেই বগলাবাবুর আংটি মোটা করে যে-সিঁদুর চম্পির কপালে ঘষে দিয়েছিল তা এখনও সুস্থির হয়ে বসতে শেখেনি। 

কিছুক্ষণ কাঁদার পর সুস্থ হল চম্পি। বেশিক্ষণ আর ঘাটে বসল না। দু’জনে মিলে হাত মুখ ধুল। তারপর ফিরে এল বাড়িতে। 

গিরিবালা অস্থির হয়ে উঠেছিল শঙ্খকে না দেখে। আনাচ কানাচ খুঁজে দেখছিল। এখন চম্পির কোলে তাকে দেখে নিশ্চিন্ত হল। 

হেসে বলল, ওমা, তুমার কাছে আছে? আমি আরউ ভাবেই বাঁচিনে। বলি, গেল কুথায়? ওরে পালে কনে? 

চম্পি বলল, ও তো দেখি দরজা খুলে বেরোয়ে পড়িছিল। তাই এটটু পুকুরপাড়ের থে ঘুরে আলাম। 

শঙ্খ মা’র কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। 

গিরিবালা বলল, বেশ তো ছিলে এতক্ষণ। এখন বুঝি ঘুড়া দেখে খুড়া হলে? 

চম্পি ভাঁড়ারের পইঠের উপর বসে পড়ল। ধীরে ধীরে বাড়িটা জেগে উঠতে লাগল। 

.

যাবার সময় একটুও কাঁদল না চম্পি। এক মুঠো ইঁদুরের মাটি উলটোমুখ করে মা’র আঁচলে ফেলে বেশ স্পষ্ট করে বলল, মা, এতদিন তুমার যা খাইছিলাম পরিছিলাম, এই সব শোধ করে গেলাম। দোষ ঘাট যদি কিছু করে থাকি তো মাপ করে দিয়ো। বলেই গটগট করে পালকিতে গিয়ে উঠল। কারও মুখের দিকে সে চাইল না। কারও জন্য এক ফোঁটা জলও পড়ল না তার চোখ থেকে। ওর বড়দি, মেজদি, মা, কাকিমা, ঠাকুমা বিকাল থেকেই ফোঁপাতে ফোঁপাতে অস্থির হয়ে উঠেছেন। এমনকী তার বাবার চোখও শুকনো ছিল না। শুধু ভেজেনি চম্পির চোখ। সে সঙ্গে ঝি নিয়ে যেতেও কিছুতে রাজি হল না। একাই গেল শ্বশুরবাড়ি। 

ব্যাপারটা এতই অস্বাভাবিক যে, প্রথম চোটে সবাই থ মেরে গিয়েছিলেন। ফোঁপানি-টোপানি সব বন্ধ হয়ে গেল। ধাক্কা একটু সামলে নেবার পরই বাড়ির মেয়েরা গোল হয়ে বসে জিভের লাগাম খুলে দিলেন। 

যশোরের মেজবউই প্রথম মুখ খুললেন, ধন্যি বেহায়া বাবা, আজকালকার মেয়ে। 

বিমলা বলল, আমি তো কাঁদে ফাটে পড়িছিলাম। এ-বাড়ির থে বেরোতি পা যেন ওঠে না। বাবা কাকারা কোনওরকমে পাঁজাকুলা করে পালকির মধ্যি তুলে দিইলেন। আর এ মেয়ে একেবারে গটগটায়ে গিয়ে পালকিতে উঠলেন। 

দামিনীর কান্না অনেকক্ষণ শুকিয়ে গিয়েছিল। চম্পির ভাবসাব দেখে তাঁর আক্কেল গুড়ুম হয়ে গিয়েছে। 

কপাল চাপড়ে বললেন, আর শুনলে কথা! এতদিন যা খাওয়াইছি পরাইছি তা এক মুঠো ইঁদুরির মাটি দিয়েই শোধ করে গেল? 

তা ও-ব্যাপারে আর চম্পির দোষ কী? উটা তো নিয়ম। সবারই পালতি হয়। 

কমলার কথা শুনে দামিনী বললেন, তা ওইভাবে কেউ বলে নাকি? মা তুমার ধার শুধলাম, এ কথা কি মুখ দিয়ে বেরোতি চায়? তুই নিজি কতখানি চোখির জল ফেলিছিলি মনে করে দ্যাখ। 

দামিনী হাউহাউ করে কেঁদে ফেললেন। 

বললেন, বাপ-মা’র ঋণ কি কেউ শোধ করতি পারে? সিবার নিমুনিয়া হল। যমে-মানুষি টানাটানি। একটা মাস চোখির পাতা এক করতি পারিনি। তেজবরের হাতে তুলে দিতি হল বলে বুক আমার ফাটে গিয়েছে। জোর করে যে এ পাত্তর হাতছাড়া করব, তার পর? আর যদি পাত্তর না জোটে, তখন? তাই তো আমি শেষ পর্যন্ত মত দিছিলাম। আর সেই বরের বাড়ি যাবার বেলায় তুই নাচতি নাচতি গিয়ে পালকিতে উঠলি? আমাগের জন্যি পিরানও পুড়ল না একটু? কী নেমকহারাম মেয়েই পেটে ধরিছিলাম বাবা। 

তা চম্পির কান্না বিমলা পুষিয়ে দিল যাবার সময়। পাড়ার লোক প্রায় জড়ো করে ফেলে আর কী! ক’দিনের মধ্যে যশোরের সবাইও চলে গেলেন। কমলা থাকল কিছুদিনের জন্য। ছেলে সুস্থ হলে যাবে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *