হাওয়া এলোমেলো – ১৫

পনেরো 

একটুর জন্য ওঁরা কলকাতার ট্রেনখানা ধরতে পারলেন না। প্রায় নাকের উপর দিয়েই সেখানা বেরিয়ে গেল। সারা রাতের মধ্যে কলকাতার ট্রেন আর নেই। এর পরে আছে দার্জিলিং মেল। তা সে তো শেষরাত্রে। হতাশ হলেন মেজকর্তা। রাগ হল হতচ্ছাড়া বাসখানার উপর। ঝিনেদা থেকে চুয়াডাঙার ইস্টিশান, বাইশ মাইল তো মোটে রাস্তা। এর মধ্যে যে কতবার বিগড়ে গেল বাসখানা তার ইয়ত্তা নেই। 

এখন কী আর করা যায়! ওয়েটিং রুমে বিছানা খুলে পাতিয়ে দিলেন কুলিকে দিয়ে। গিরিবালা ঘুমন্ত ছেলেকে শুইয়ে নিজে আরাম করে বসল। শঙ্খর জন্য বোতলে দুধ আছে। দশটা নাগাদ একবার খাইয়ে ঘুমটা পাড়িয়ে দিলেই নিশ্চিন্ত। সকালের আগে সে আর উঠবে না। মেজকর্তা টাইম-টেবল দেখলেন, সকাল পাঁচটা পনেরো মিনিটে শিয়ালদহ পৌঁছে যাবে গাড়ি। সেখান থেকে গড়পারে ভূষণের দাদার বাসায় পৌঁছোতে বড়জোর আধ ঘণ্টাই লাগুক। 

মেজকর্তা দোকান থেকে কিছু লুচি তরকারি আনলেন। গিরিবালার এ-সব খাবার খেতে প্রবৃত্তি হচ্ছিল না, তবু খেল। তার মনটা বিশেষ ভাল ছিল না। চাঁপার জ্বরটা ছেড়েও ছাড়ল না। ঠিক তাদের আসবার আগেই নতুন করে জ্বর এসে গেল। ওর শরীরটা ফ্যাকাশে হয়ে উঠছে। ভাল ডাক্তার না দেখালে আর চলবে না। বাবাকে ভাল করে বলে যাবে। আবার কবে এ দেশে আসবে গিরিবালা কে জানে? 

বাপ ভাই আত্মীয় বন্ধু ছেড়ে গিরিবালা চলল কোন অকূলপাথারে ঘর বাঁধতে! এখন একমাত্র ভরসা ভূষণ। এবার যে সংসার পাতবে গিরিবালা তাতে সে-ই হবে কর্ত্রী। হ্যাঁ, তাই তো। তার মাথার উপর আর তো কেউ থাকবে না। এ-কথাটা তো আগে খেয়াল হয়নি। এই নতুন সংসারটা হবে তার আর ভূষণের। ভূষণ, সে আর শঙ্খ। 

গিরিবালা তার এই নতুন ভাবনাটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগল। বাপের বাড়িতে বড়মার জায়গা যেখানে, শ্বশুরবাড়িতে বড়জায়ের যেখানে, ডোমারে বাবার বাসাবাড়িতে তার মায়ের জায়গা যেখানে ছিল, গিরিবালা তার নতুন সংসারে একলাফে এবার সেই জায়গায় উঠে পড়বে। কারও অধীন হয়ে, খোঁটা খেয়ে, হাততোলা হয়ে আর থাকতে হবে না তাকে। সংসারে কোন জিনিস কতটা আনতে হবে, কাকে কী দিতে হবে, কে ঠিক করবে? গিরিবালা। সেই গিরিবালা যে কিছুদিন আগে পর্যন্তও সবার হুকুম মেনে চলেছে। কোথাও বিশেষ জোর খাটাতে পারেনি। ভয়ে ভয়ে থেকেছে। বিয়ে হয়ে যাবার পর বাপের সংসারে মেয়ের আর জোর থাকবে কী করে? শ্বশুরবাড়ি গেল গিরিবালা। কিন্তু সেখানেও তো জোর পেল না। কী করে পাবে? এখন গিরিবালার মনে হচ্ছে, সেটা তো তার সংসার ছিল না, সেটা যে দিদির সংসার। 

হ্যাঁ, এইবার তার জোর হবে। তার নিজের সংসার পাবে সে। ভালমন্দ যা কিছু ঘটবে, তার সব দায়িত্ব গিরিবালার। গিরিবালা ভাবতে লাগল, সে দেখিয়ে দেবে সংসার করা কাকে বলে। সে কাউকে খোঁটা দেবে না অবজ্ঞা করবে না, তার সংসারে কাউকে মনে কষ্ট পেতে দেবে না। এই অল্প দিনের মধ্যে সে যে তিক্ততার স্বাদ পেয়েছে, তার আশ্রয়ে কেউ যাতে সে আস্বাদ না পায়, প্রাণপণে তার ব্যবস্থা করবে গিরিবালা। 

আর এই প্রথম গিরিবালার মনে হল, চা-বাগানের চাকরিটা নিয়ে ভূষণ খুব খারাপ কিছু করেনি। বরং গিরিবালাকে একটা গোটা সংসারের গিন্নি হবার সুযোগ করে দিয়েছে। এখন যতই ব্যাপারটা তলিয়ে ভাবছে গিরিবালা, ততই দেখতে পাচ্ছে ভূষণ ভালই করেছে কাজটা। সে ভাগ্যিস গিরিবালার কথা শুনে তখন মেজভাশুরের আদেশটা অমান্য করেনি। ভূষণকে এখন কত কাছে কাছে সে পাবে। বিয়ের পর থেকেই তো তার এই বাসনা, ভূষণকে একান্ত করে সে পাবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত সে বাসনা তার পূর্ণ হয়নি। বিয়ের পর ভয় আর লজ্জা কাটতেই তো এক বছর গেল। তারপর আরেকটা বছর না ঘুরতেই জানতে পারলে সে মা হতে যাচ্ছে। তখন আবা, নতুন এক লজ্জা। সেটা যদিও বা সামাল দিল, তবুও সে ভূষণকে মনের মতন করে পেল না। নিজে যেমন সংসারের কাজে, শঙ্খের পরিচর্যায় দিনরাত মগ্ন হয়ে গেল, তেমনি ভূষণও যেন হারিয়ে গেল বহুজনের ভিড়ে। এই ভিড়, গুরুজনদের সদা উপস্থিতি, এসব তো আর নতুন সংসারে থাকবে না। শুধু সে আর ভূষণ। গিরিবালা হিসেব করতে লাগল। একদিকে সে বাবা বোন বড়জেঠি পিসি জা এদের সঙ্গ যেমনি হারাচ্ছে, তেমনি পাচ্ছেও কিছু। কিছু কেন, অনেক পাচ্ছে। ভূষণকে একান্ত করে পাওয়া তার যে দুমুঠি ভরে যাওয়া। কথাটা মনে পড়তেই রোমাঞ্চ জাগছে তার। 

ভস ভস ভস ভস করে একখানা গাড়ি এসে দাঁড়াল। তাদের গাড়ি নাকি? গিরিবালার মন ছ্যাঁক করে উঠল। তাড়াতাড়ি সে উঠে বসল। 

মেজকর্তা একটা বেঞ্চিতে বসে ছিলেন। 

জিজ্ঞাসা করলেন, কী রে, উঠে পড়লি যে? 

গিরিবালা থতমত খেয়ে গেল। 

বলল, ভাবলাম গাড়ি বুঝি আসে গেল। 

মেজকর্তা একটু হেসে বললেন, এখানা মালগাড়ি। আমাদের গাড়ির ঢের দেরি। 

গিরিবালা অপ্রস্তুত হয়ে চেয়ে দেখল সত্যিই মালগাড়ি। রাতের আবছা অন্ধকারে ভুতো-ভুতো লাগছে। ডোমারেও সে মালগাড়ি দেখেছে। তার মোটে পছন্দ লাগে না। সবটা মিলিয়ে কেমন যেন একটা বুক চাপা নিরেট ভাব আছে মালগাড়ির চেহারায়। আলো নেই, খোলামেলা নেই। দমবন্ধ করা ভাব। একবার এলে সহজে নড়তে চায় না। স্টেশন জুড়ে পড়ে থাকে। ঘটাং ঘটাং, ঠকাস ঠকাস কতরকম বিশ্রী শব্দ করে! এগোয় পেছোয়। ইঞ্জিনটা হঠাৎ ভস ভস করতে করতে তেড়ে-মেড়ে যেন চলে যায়। ভাব দেখে মনে হয়, আর বুঝি ফিরবে না। ওমা, পরক্ষণেই আবার বেহায়ার মতো ফিরে আসে। ওই তাদের গ্রামের সরকার মশাইয়ের মতো স্বভাব আর কী? সকালে উঠেই খুড়ির সঙ্গে খিটিমিটি বাধে। অবস্থা চরমে উঠলে হঠাৎ ছাতিখানা বগলে করে চেঁচিয়ে ওঠেন সরকার মশাই, “থাকল তোর কাঁচকলার সংসার, এই চললাম যেদিকি দু’চোখ যায়।” বেরিয়ে পড়েন বাড়ি থেকে। তারপর দুপুরবেলা খাবার সময় আবার গুটগুট করে বাড়িতে ঢুকে পড়েন। যেন কিছুই হয়নি। মালগাড়ির ইঞ্জিনগুলোর রকম-সকম সেই সরকার মশাইয়ের মতোই বটে। 

গিরিবালা শুয়ে পড়ল। কখন যে এই মালগাড়িখানা বিদায় হবে! বিরক্তি লাগল তার। কখন আসবে কলকাতার গাড়ি? অসহিষ্ণু হয়ে উঠল সে। 

তা অস্বীকার করে লাভ নেই, গিরিবালা কলকাতায় পৌঁছোবার জন্য এর মধ্যে বেশ চঞ্চল হয়ে উঠেছে। আবার ভয়-ভয়ও করছে তার। সেজভাশুর সাহেব লোক। সেজজা কলকাতায়-থাকা মেয়ে। বিয়ের সময় সেই যা গিরিবালা তাঁদের দেখেছিল। তার মনে পড়ে, সেজজা তার চুলগুলো দেখে খুব খুশি হয়েছিলেন। প্রশংসা করেছিলেন। তারপর নতুন ফ্যাশানে তার চুল বেঁধে দিয়েছিলেন নিজের হাতে। পাটি-খোঁপা না কী যেন একটা ইংরেজি নাম বলেছিলেন। গিরিবালার মনে নেই। তার বলে তখন সসেমিরা অবস্থা। ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গিয়েছিল সে। চম্পির বিয়েতে ওঁরা কেউই আসেননি, টাকা কাপড় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেই সেজজা শঙ্খকে দেখতে চেয়েছেন। যে বাউত্তারা ছেলে হয়েছে একখান, সেখানে গিয়ে কী যে অসভ্যতা করবে, গিরিবালা সেই ভাবনায় অস্থির হয়ে উঠল। 

ঘরের ভিতর বড্ড গুমোট। গরমে অস্থির হয়ে উঠল গিরিবালা। সে ঘামছে। শঙ্খ গলগল করে ঘামছে। বাবাকেও বারে বারে ঘাম মুছতে দেখছে। মাঝে মাঝে বাবা বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছেন। পাখা একখানা পেলে হত। গিরিবালা আঁচলটা দিয়ে প্রাণপণে হাওয়া খেতে লাগল। 

এর আগে গিরিবালা কখনও ইস্টিশানে রাত কাটায়নি। অদ্ভুত এক জায়গা বটে! ওয়েটিং রুমের এক খুপরি ঘরে বাক্স বিছানা নিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। ঘরে ছায়া-ছায়া অন্ধকার। দেওয়ালে বড় একটা আলো। দেওয়ালগিরির পেটের লাল কালিতে লেখা চুয়াডাঙ্গা’ কথাটা সে আলোয় জ্বলজ্বল করছে। কিন্তু ঘরে ভাল আলো হয়নি। কুলি দুটো প্রথমে গিরিবালাকে আরেকটা ঘরে ঢুকিয়ে দিতে গিয়েছিল। সে ঘরের দরজায় একটা মেয়েলোকের ছবি আঁকা। তলায় লেখা ‘জেনানা’। এ আবার কী কথা? বাবা ওকে একা-একা সে-ঘরে রাখতে সাহস পাননি। তাই এই ঘরে এনে তুলেছেন। আরও দু’-তিনজন লোক আছে সে-ঘরে। তাই গিরিবালা এক কোণে গুটিসুটি মেরে ছেলেকে নিয়ে শুয়েছে। 

মালগাড়িটা একটু আগে চলে গেল। তবুও গুমোট গেল না। পিড়পড় করে বৃষ্টি পড়ছে ধারে-কাছের কোন টিনের চালে। গোটাকতক হিন্দুস্থানি খচমচ খচমচ বাজনা বাজিয়ে, গান গেয়ে কানের পোকা নড়িয়ে দিচ্ছে। বাব্বাঃ, এর নাম গান! রক্ষে করো। কাঁচা চামড়ার বিশ্রী গন্ধ মাঝে মাঝে ভেসে আসছে। গায়ে পাক দিয়ে উঠছে গিরিবালার। 

এর মধ্যেও একটু তন্দ্রা এসে গিয়েছিল গিরিবালার। হঠাৎ এক বিকট শব্দ, হইচই, চেঁচামেচিতে তার ঘুম ভেঙে গেল। শঙ্খও ভয় পেয়ে কেঁদে উঠে পড়ল। গিরিবালা দেখল একখানা প্যাসেঞ্জার ট্রেন প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়িয়েছে।”চা-গ্রাম, পাউরুটি বিস্কুট”— টেনে টেনে সুর করে করে বলতে বলতে গোটাকতক লোক এধার-ওধার যাচ্ছে। গিরিবালা আবার ধড়মড় করে উঠে বসল। তাদের গাড়ি এল নাকি? 

মেজকর্তা রাতজাগা গলায় বললেন, শো, শো, শুয়ে থাক। আমাদের গাড়ি শেষরাত্তিরে আসবে। এখনও অনেক দেরি। 

এখনও অনেক দেরি! বাবা, আর কত দেরি হবে! গিরিবালা খানিকটা হতাশ হল। জল তেষ্টা পেয়েছে তার। পেট ভুটভাট করছে। শঙ্খ খুঁতখুঁত করে কান্না জুড়ল। কিছুতেই শোবে না। বিশ্রী লাগছে গিরিবালার। কোনওমতে কলকাতায় পৌঁছোতে পারলে সে বাঁচে। 

.

মেজকর্তা নিঃঝুম প্ল্যাটফর্মে শঙ্খকে কোলে নিয়ে ঘুরে ঘুরে অনেকক্ষণ পরে ওকে ঘুম পাড়ালেন। ঘরে যে গরম। এই কচি শিশু কি ঘুমোতে পারে! একটা পাখা আনা উচিত ছিল। মাঝে মাঝে পশলা পশলা বৃষ্টি হচ্ছে আর ততই যেন গরম বাড়ছে। একেবারে যেন সিদ্ধ করে ছাড়বে। মেজকর্তার পিঠে পেটে এর মধ্যেই বেশ ঘামাচি গজিয়ে গেল। ঘরে এসে ঘুমন্ত নাতিকে মেয়ের কোলে দিয়ে দিলেন। 

আবার বাইরে এলেন। বাইরে তবু কিছুটা আরাম পাওয়া যাচ্ছে। চারিদিক নিস্তব্ধ। শুধু তারবাবুর ঘরে টেলিগ্রাফ-যন্ত্রটা মাঝে মাঝে কিট কিট করে উঠছে, আবার থেমে যাচ্ছে। তারবাবু টেবিলে হাতের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে নিচ্ছেন খানিক খানিক, আবার ধড়মড় করে ঠেলে উঠে চাবি টিপে টরে-টক্কা টরেটক্কা টরে-টক্কা টরে করছেন। আর দূরে, প্ল্যাটফর্মের শেষ মুড়ো ছাড়িয়েও অনেক দুরে, সিগন্যালের লাল চোখ নিষ্কম্প চেয়ে আছে। আর মাঝে মাঝে ঝুপ ঝুপ বৃষ্টি পড়ে তাঁর দৃষ্টি আবছা করে দিচ্ছে। আর মাঠ থেকে ভেসে আসছে ব্যাংদের ঐকতান: মক মক মক গ্যা গোঁ মক মক মক মক……. 

কলকাতায় পৌঁছেই আর বিলম্ব নয়, ভূষণকে নিয়ে বেরিয়ে পড়তে হবে সুধাময়ের খোঁজে। বড়বউ ভুগে ভুগে বড্ড কাহিল হয়ে পড়েছে। বড্ড উতলা হয়ে উঠেছে সুধার জন্য। ওকে বাড়িতে এবার আনতেই হবে। বড়বউয়ের ইচ্ছে, সুধার বিয়ে দেবার, দিতে হবে ওর বিয়েটা। দায়িত্ব পড়ুক ঘাড়ে। ভাবনা-চিন্তাগুলো অনেক বাস্তব হয়ে উঠবে তা হলে। 

দেশ স্বাধীন করার ব্রত নিয়েছে সুধা। বিয়ে করবে না বলে জানিয়েছে। মেজকর্তা হাসলেন। কপনি আঁটার দেশে তো জন্ম। রাতদিন ব্রহ্মচর্য, তপশ্চর্যা, এইসব জিনিস ঘুরছে। স্বাধীনতা মানে যে সমৃদ্ধি, সম্ভোগের অধিকার, সেটা আর এদের মাথায় ঢোকে না। উপোসি আত্মার কি কখনও সদ্‌গতি হয়? কিন্তু বলে দেখো এ কথা, আজকালকার ছেলেরা কেমন তেড়ে আসে, দেখো। মেজকর্তার মাথা আবার কিলবিল করে উঠল। পরনে কপনি হাতে গীতা, দেশোদ্ধারের সব নয়া ফ্যাশান চালু হচ্ছে। আরেক দিকে আসরে নেমেছেন গান্ধী মহারাজ। চরকা কাটো চরকাতেই স্বরাজ। সবাই যেন ফুসমন্তরে স্বরাজ এনে ফেলবেন। দেশের লোকের বিচারবুদ্ধি ঘোলা করে দিয়ে চোখ বুজে মন্তর জপাও। আমার কথা শোনো, এতেই স্বরাজ আসবে। লোকেরা অজ্ঞ, অবিবেচক থাকুক, তাদের চোখ ফোটাতে অনেক পরিশ্রম। তার চেয়ে কানামাছি খেলাও। 

সুধাময় বারবার কানামাছি খেলতে গেছে। মেজকর্তা বারবার তার চোখ ফোটাতে চেষ্টা করেছেন। কে জানে এবার সুধা তাঁকে আমল দেবে কি না? 

আকাশের দিকে চেয়ে মেজকর্তা আশ্বাস পেতেই চেষ্টা করলেন হয়তো। কিন্তু কোথায় আকাশ? বর্ষার মেঘে লেপ মুড়ি দিয়ে সে মুখ ঢেকে আছে। 

একসময় ট্রেন আসবার নির্দিষ্ট সময় উত্তীর্ণ হয়ে গেল। ট্রেন এল না। শোনা গেল দার্জিলিং মেল এক ঘণ্টা লেট। ধীরে ধীরে ইস্টিশানটার ঘুম ভাঙল। সময় গড়াল। ভোর হল, তবু আলো ফুটল না। আকাশে মেঘ। আলো পলাতক। বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। গিরিবালা অতিকষ্টে ইস্টিশানের জল দিয়ে মুখ ধুয়ে এল। শঙ্খকেও ধুইয়ে মুছিয়ে আনল। শঙ্খের ক্ষিধে পেয়েছে। দুধ নেই। যেটুকু এনেছিল গিরিবালা, সেটুকু রাত্রেই খেয়ে ফেলেছে শঙ্খ। এমন বিপত্তি হবে কে জানত? ওদের তো কাল রাত্রেই পৌঁছে যাবার কথা। শঙ্খ ক্ষিধের চোটে কান্না জুড়ে দিল। 

মেজকর্তাও বড় বিরক্ত হলেন। দুধ তিনি এখন কোথায় পাবেন? চা-ওয়ালাদের কাছ থেকে কিনতে চেষ্টা করলেন, ওরা দুধ বেচে না। মহা মুশকিল! এর উপর আবার ট্রেনটাও লেট করছে। মেজকর্তা এদিক-ওদিক ঘুরছেন দুধের সন্ধানে। দেখলেন, এক জায়গায় বেশ লোক জড়ো হয়েছে। জনাকুড়ি লোক খদ্দর-টদ্দর পরে হাতে ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একপাশে। জনাকয়েক মুসলমানও আছে সেই দলে। কী ব্যাপার? 

বোধহয় নেতা-টেতা কেউ আসবে, কি মুক্ত রাজবন্দি। মেজকর্তা ভাবলেন, তাই সংবর্ধনা জানাবার জন্য এসেছে। শঙ্খ তাঁর কোলে। সে প্রবলভাবে কান্না জুড়েছে। কী যে তিনি করবেন, ভেবে পেলেন না। এমন বৃষ্টি শুরু হয়েছে যে, ইস্টিশানের বাইরের দোকানেও যেতে পারছেন না। কিন্তু কী আশ্চর্য, সেই বৃষ্টি মাথায় করে আরও যে লোক আসছে ইস্টিশানে। এবার যে দলটা এল, তাদের মধ্যে জনাদুয়েক খদ্দর-পরা মহিলাকেও দেখলেন মেজকর্তা। অঝোর ধারায় তাঁরা কাঁদছেন। ব্যাপারটা কী? 

শঙ্খ কেঁদে কেঁদে অস্থির হয়ে উঠল। মেজকর্তা ওকে নিয়ে আবার ইস্টিশানের ভিতরের দিকে চলে এলেন। প্ল্যাটফর্মে এর মধ্যেই আরও অনেক লোক এসে জমেছে। অনেকের হাতেই মালা। মুখ থমথমে, পা খালি। 

দুধ কি মিলবেই না নাকি? বড় মুশকিল হল। শঙ্খ কেঁদে কেঁদে একেবারে বাঁকা হয়ে যাচ্ছে। কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না তাকে। নিস্তব্ধ ইস্টিশানে শঙ্খর গোঁয়ার কান্না রীতিমতো অস্বস্তির মধ্যে ফেলল মেজকর্তাকে। গিরিবালা শেষ পর্যন্ত ওকে কোলে নিয়ে মাই খাওয়াতে বসল। কিছুতেই খাবে না শঙ্খ। এমন সময় ট্রেনের ঘণ্টা বাজল। মেজকর্তা টিকিট কিনতে গেলেন। টিকিট কিনে অগত্যা এক পাউরুটিওলার কাছ থেকে রুটি কিনে খেতে দিলেন শঙ্খকে। শঙ্খ এবারে থামল। 

দার্জিলিং মেলখানা যখন ধীরে ধীরে প্ল্যাটফর্মে এসে ঢুকল, তখন সেটা আষ্টেপৃষ্ঠে ভিজে গিয়েছে। ছাত দিয়ে গা দিয়ে জল গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। যে লোকগুলো এতক্ষণ ফুল, মালা হাতে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ছিল, তারা হুড়মুড় করে ইঞ্জিনের দিকে ছুটল। মেজকর্তা অতিকষ্টে ভিড় ঠেলে গিরিবালা আর শঙ্খকে নিয়ে একখানা ইন্টার ক্লাস কামরায় উঠে পড়লেন। ততক্ষণে গাড়িসুদ্ধু লোক গলা বের করে চিৎকার করতে লেগেছেন, ও মশাই, সামনে নয়, সামনে নয়, পিছনে যান, পিছনে। গার্ডের গাড়ির সঙ্গে যে লাগেজ ভ্যান, সেইখানে। সেই ভ্যানেই আছেন। 

মেজকর্তা সকলের সমস্বর চিৎকারে ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেলেন। শঙ্খও দাদুর কোলে চড়ে রুটিতে কামড় দিতে দিতে অবাক হয়ে থেমে গেল। 

মেজকর্তা দেখলেন, এদের চিৎকার শুনে বাইরের সেই জনতা হন্তদন্ত হয়ে আবার পিছনে ছুট দিল। সেই মহিলা ক’জনকেও ছুটতে দেখলেন তিনি। 

অবাক হয়ে একজনকে জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে মশাই, এত ছুটাছুটি কীসের জন্য? একজন জবাব দিলেন, সে কী, আপনি জানেন না? দেশবন্ধু যে মারা গেছেন! এই ট্রেনে ডেডবডি যাচ্ছে। লাগেজ ভ্যানে আছে। 

দেশবন্ধু মারা গেছেন! মেজকর্তা প্রথমে ধরতে পারলেন না কথাটা। কোন দেশবন্ধু? দেশবন্ধু আর ক’টা আছে বাংলায়? সি আর দাশ মারা গেছেন! মেজকর্তার বুকে কথাটা যেন বুলেট হয়ে এসে বিঁধল। সে কী, কোথায় মারা গেলেন? দার্জিলিঙে! কাল মারা গেছেন। উঃ, কী প্রোসেশন মশাই, মনে হল দার্জিলিং বুঝি ভেঙে পড়বে। যাত্রীরা বলে যাচ্ছেন যে যার কথা। দেখছেন তো কী ভিড় ইস্টিশানে ইস্টিশানে। এখানেই দেড় ঘণ্টার উপর লেট। কলকাতায় সন্ধের আগে পৌঁছোলে হয়। মেজকর্তার কানে কথাগুলোর আওয়াজ ঢুকছে, মানে বুঝতে পারছেন না। দেশবন্ধু এই গাড়িতেই যাচ্ছেন, অথচ তিনি নেই! আশ্চর্য! মুহূর্তে সব ফাঁকা হয়ে গেল যেন। যেন এই ট্রেন নেই, এই ইস্টিশান নেই, বুঝি এই যুগটাও নেই। তাঁর বুকের মধ্যে কেমন যেন শূন্যতার সৃষ্টি হল। ধপ করে বসে পড়লেন মেজকর্তা। বর্তমান কালের সীমা ছাড়িয়ে তাঁর স্মৃতি হুহু করে উড়ে চলল পিছনে, কলেজি জীবনে। এই অমিত উৎসাহী এক অগ্নিশিখার সংস্পর্শে তখন তিনি এসেছিলেন। অনেক অগ্নিগর্ভ ভাষণ তিনি তখন শুনেছিলেন। পরবর্তী জীবনে দাশ সাহেবের অনেক ভাষণ তিনি কাগজেও পড়েছেন। কিন্তু সব ছাড়িয়ে এখন হঠাৎ তাঁর মনে একটি ভাষণের গোটা লাইন ভেসে উঠল। যে ভাষণটির কথা মেজকর্তার মনে পড়ল, সেটা তাঁর কানে শোনা নয়, কাগজে পড়া। সেটাই যে কেন তাঁর মনে হঠাৎ লাফিয়ে উঠল এখন, মেজকর্তা তা বলতে পারেন না। ইংলন্ডে পড়তে গিয়ে প্রকাশ্য সভায় চিত্তরঞ্জন সেই ভাষণটি দিয়েছিলেন। 

“Gentlemen, I was sorry to find it given expression to in Parliamentary speeches on more than one occasion that England conquered India by the sword and by the sword must she keep it! England, gentlemen, did no such thing; it was not her swords and bayonets that won for her this vast and glorious empire; it was not her military valour that achieved this triumph, it was in the main a moral victory or a moral triumph. England might well be proud of it. But to attribute all this to the sword and then to argue that the policy of sword is the only policy that ought to be pursued in India is to my mind absolutely base and quite unworthy of an Englishman. 

ইংলন্ড ভারতকে তরোয়ালের জোরে নয়, বেয়নেটের জোরে নয়, জয় করেছে নৈতিক শক্তির জোরে। তাই ভারতকে তরোয়ালের জোরে দাবিয়ে রাখার কথা ইংরেজের মুখে শোভা পায় না। অতি সত্যি কথা। কিন্তু সত্য কথা বলার সাহস ক’জন রাখে? 

সারাজীবনে অনেক ভাষণ দিয়েছেন দেশবন্ধু, কিন্তু এমন কথা আর বলেননি। অন্তত মেজকর্তা আর তো শোনেননি। কী আফশোস, এ-কথাতে কোনও পক্ষই কর্ণপাত করেনি। কথাটা কেউ মনেও রাখেনি আজ। এ-কথা সম্ভবত আর-কেউ বলবেও না। যাঁদের ভাবনায় এমন কথা স্থান পেত, তাঁদের যুগ এই হয়তো শেষ হয়ে গেল। 

পরক্ষণেই মনে পড়ল, এই গাড়িতেই দেশবন্ধুর দেহ যাচ্ছে কলকাতায়। তিনিও যাচ্ছেন। তিনি যেন তাঁদের যুগের শবদেহকেই বহন করে নিয়ে চলেছেন। কী আশ্চর্য যোগাযোগ! যাত্রীরা আবার আলোচনায় মেতে উঠলেন। হ্যাঁ, এ-মৃত্যু রাজার মৃত্যু। দেশবন্ধু এখন কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র, কাউন্সিলে বিরোধী দলের নেতা, স্বরাজ্য পার্টির লিডার আর বাংলার দেশবন্ধু। শুধু বাংলার নয় মশাই, উনি গোটা ইন্ডিয়ার। আরেকজন মন্তব্য করলেন। হঠাৎ মেজকর্তার প্রবল ইচ্ছে হল তাঁকে একবার গিয়ে দেখে আসেন। উঠে পড়লেন চট করে। 

বললেন, যাই, একবার দেখে আসি। 

একজন সহযাত্রী হাঁ-হাঁ করে উঠলেন, এখন কোথায় যাচ্ছেন? হুইসেল দিয়েছে গার্ড। গাড়ি ছাড়বে। পরের স্টপেজে গিয়ে দেখে আসবেন। 

একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে গাড়ি ছাড়ল। কয়েক ধাক্কায় বেরিয়ে এল ইস্টিশানের বাইরে। জোরে বৃষ্টি নামল। মেজকর্তার সামনের জানলা দিয়ে ছাট আসছে জোরে। যাত্রীরা পটাপট কাচের শার্শি তুলে দিলেন। একটু পরে পিছন থেকেও ছাট আসতে লাগল। সেদিককার শার্শিও তুলে দেওয়া হল। জলের ঝাপটা লেগে কাচের শার্শি অস্বচ্ছ হয়ে যেতে লাগল। হঠাৎ মেজকর্তার মনে হল, গোটা কামরাটাই, হয়তো বা গোটা ট্রেনটাই, এক বৃহৎ শবাধারে পরিণত হয়েছে। 

শূন্য মনে শূন্য চোখে মেজকর্তা অনেকক্ষণ বসে থাকলেন। হঠাৎ শঙ্খর চিৎকারে তাঁর সংবিৎ ফিরে এল। এই তো মৃতের রাজ্যে প্রাণের কোলাহল! হঠাৎ শঙ্খ দুমদাম শার্শিতে কিল মারছে, লাফাচ্ছে, চেঁচাচ্ছে: বিট্‌টি বিট্‌টি, বিট্‌টি! 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *