হাওয়া এলোমেলো – ১০

দশ 

ভূষণ এর মধ্যে একখানা চিঠি পেল ভূপতির। অতি সংক্ষিপ্ত চিঠি। কিন্তু অতি স্পষ্ট। 

ভূপতি লিখেছেন : 

শুনিলাম দেশে বসিয়া কিছুই করিতে পারিতেছ না। এইভাবে সময় নষ্ট করো, ইহা আমার ইচ্ছা নহে। পত্রপাঠ কলিকাতায় চলিয়া আইস। তোমার জন্য একটা ভাল কাজ জোগাড় করিয়াছি। শ্রীহট্টে যাইতে হইবে। একটি চা-বাগান কেনা হইয়াছে। ওই বাগানের ডাক্তারের চাকুরিটি তোমাকে দেওয়া হইতেছে। আশা করি, তোমাদের সকলের কুশল। 

আঃ তোমার সেজদা 

এর জন্য তৈরি ছিল না ভূষণ। অপ্রত্যাশিত এই ডাকটা পেয়ে তার রক্তে চঞ্চলতা জেগে উঠল। কিন্তু ফ্যাসাদ বাধল গিরিবালাকে নিয়ে। সিলেটের কথা শুনলেই সে ভয় পায়। দু’দিন লাগে যেতে। সেখানে সহায়-সম্বল কে আছে? বিপদে আপদে কে দেখবে? যত সব বাজে চিন্তা গিরিবালার। ভূষণ কখনও সিলেটে যায়নি। তবুও এমন পরিষ্কার সব বর্ণনা দিতে লাগল সিলেটের যে, গিরিবালার মনও শেষ পর্যন্ত ভিজে উঠল। 

গিরিবালা নরম হল অন্য কারণে। এই সিলেট যাওয়া উপলক্ষ করে ভূষণ তার মতামত চাইছে। তার মানে তাকে উপেক্ষা করছে না ভূষণ। শুধু তাই নয়। রোজ রাত্রে তারা পরামর্শ করছে। গিরিবালা একটু কথা বলে বাঁচছে তার সঙ্গে। ভূষণের সঙ্গে দুটো কথা বলার জন্য, পাঁচটা খোশগল্প করার জন্য গিরিবালা লালায়িত হয়ে থাকে। কিন্তু তার এই সামান্য দাবিটুকুও ভূষণ মেটাতে পারে না। 

সকালে বেরিয়ে যায়, আসে বেলা তিন প্রহরে। বিশ্রাম চান খাওয়া-দাওয়া সেরে সে একটু গড়ায়। দিনে তো কথা বলার কোনও সুযোগই হয় না। রাত্রেও কি হয়? অনেক রাতে গিরিবালা যখন কাজকর্ম সেরে শুতে আসে, ততক্ষণে ভূষণের নাক ডাকা শুরু হয়ে যায়। ক্বচিৎ কখনও ভূষণকে জাগন্ত অবস্থাতেও পেয়েছে গিরিবালা। তবুও কথা বলার সুযোগ সে পায়নি। ভূষণ তখন ব্যস্ত হয়ে পড়েছে নানারকম হিসেব কষায়। তখন কথা বলতে গেলে খেঁকিয়ে উঠেছে ভূষণ। 

এই এখন, সেজ ভাশুরের চিঠিখানা আসবার পর থেকে, গিরিবালা দেখছে তার দর বেড়ে গেছে। ভূষণ অনেক রাত পর্যন্ত পরামর্শ করে তার সঙ্গে। তার মতামত চায়। সে ভয় পেলে তাকে সাহস দেয়, তার চোখে সচ্ছল এক সংসারের রঙিন স্বপ্ন তুলে ধরে। 

গিরিবালা টের পাচ্ছিল, সে অনুভব করছিল, ভূষণ আর তার মধ্যে ভালবাসার যে উষ্ণ স্রোতটা বয়ে যেত, সেটা যেন ধীরে ধীরে ঠান্ডা হয়ে আসছিল। কেমন একটা ব্যবধানের পাঁচিল যেন দু’জনকে আলাদা করে দিচ্ছিল। 

এখন, এই সিলেট যাবার প্রস্তাব আসার পর থেকে, গিরিবালা যেন আবার একটু একটু করে ফিরে পাচ্ছে আগের ভূষণকে। 

দেশে কিছু করে উঠতে পারল না বলে যে ভূষণ দেশ ছেড়ে শ্রীহট্ট যেতে মন করল, তা কিন্তু নয়। এখানে সে যে কিছুই করতে পারেনি, সে-কথা সত্য নয়। অল্প সময়ের মধ্যে সে পসার জমিয়ে নিয়েছিল। তার যশ ছড়িয়ে পড়েছিল। ডাক আসতে শুরু করেছিল দূর দূর গ্রাম থেকেও। 

চিকিৎসা করাটাই তার আয়ত্তের মধ্যে আছে সেটা তার দায়িত্ব, সে তাই প্রাণপণে চিকিৎসা করে গিয়েছে। তার বদলে পয়সা সে অবশ্য পায়নি। পেয়েছে খুবই সামান্য। প্রায় না-পাওয়াই। তবে তার জন্য ভূষণকে দায়ী করা বৃথা। কারণ টাকা দেবার কথা তার রোগীদের, তারা তাদের কর্তব্য পালন করেনি, করতে পারেনি। 

তা হলে কি এটা বলা ঠিক হবে, তুমি কিছুই করতে পারছ না দেশে? ভূষণ, তুমি কিছুই করতে পারোনি। না না, তা কেন? ভূষণ নিজের মনকেই বলল, তার যা সাধ্য তা করেছে। শত অসুবিধা, উপেক্ষা এবং উপহাস সহ্য করেও সে কি জনহিতের জন্য নানারকম আবিষ্কারের চেষ্টা করেনি? সে কি ডাক্তারি ছাড়াও অন্যান্য উপায়ে টাকা রোজগারের চেষ্টায় ক্ষান্ত দিয়েছে কখনও? কখনও না। কস্মিনকালেও সে ক্ষান্ত দিত না। 

না, ব্যাপারটা তা নয়। ব্যর্থ হয়ে অথবা অভাবের তাড়নায় সে দেশ ছাড়ছে না। ব্যর্থতা কাকে বলে ভূষণ জানে না। ভূষণের দুনিয়ায় অভাব বলে কোনও বস্তুর অস্তিত্ব নেই। তবে যে সে ভূপতির চিঠি পাওয়ামাত্র যাব যাব বলে নেচে উঠল, তা সম্পূর্ণ অন্য কারণে। ভূষণের রক্তে প্রচণ্ড এক নেশা আছে। চঞ্চলতার নেশা। এই নেশা কখনও তাকে সুস্থির থাকতে দেয়নি। তাকে শুধু ছুটিয়ে নিয়ে বেড়ায়। এই নেশা তাকে দিওয়ানা বানিয়েছে, সন্ন্যাসী করে ছেড়েছে। সংসার পাতার পর অনেক দিন ঘুমিয়ে ছিল সেটা। সেজদার চিঠিখানা সেই ঘুমন্ত নেশাটাকে যেন উসকে দিল। জাগিয়ে দিল। আর ভূষণের কাছে এই বহুদিনের অভ্যস্ত সীমানায় চলাফেরা নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর বলে মনে হতে লাগল। 

সত্যি বলতে কী, যেদিন ভূপতির চিঠিখানা হাতে পেয়েছে ভূষণ, সেই দিনই সে শ্রীহট্টের অজানা এক চা-বাগানে চলে গেছে। এই যে যে-ভূষণকে সবাই এখানে দেখছে, সেটা কিন্তু আসল ভূষণ নয়, তার খোলস। 

কিন্তু খোলসটাই বা অনর্থক একটা মাস এখানে পড়ে থাকল কেন? ভূষণ মনে মনে তাতেই বিরক্ত হয়ে উঠল। ভূষণ যে তাড়াতাড়ি যেতে পারছে না, বলাই বাহুল্য, তার প্রধানতম কারণ গিরিবালা। গিরিবালা খুব বেগ দিয়েছে তাকে। অচেনা জায়গায় যেতে তার বড় ভয়। আরে, অচেনা বলে কিছু আছে নাকি জগতে? আজ যে অচেনা, কাল সে-সব লোক অন্তরঙ্গ। কিন্তু কূপমণ্ডূক গিরিবালা, জগতের কোনও কিছুই দেখেনি, তাই কিছুই সে জানে না। 

যা হোক, অনেক কষ্টে সে শেষ পর্যন্ত বোঝাতে পেরেছে গিরিবালাকে। গিরিবালার ভয় যে অনেকটা ভেঙেছে, ভূষণ এতেই খুশি। আর সে অনর্থক বিলম্ব করতে চায় না। 

ভূষণের মন বলছে, ওই চা-বাগানে গেলেই তার অনেক স্বপ্ন সফল হবে। প্রথমত, বাঁধা একটা রোজগার থাকায় সংসারের ভাবনা তাকে ভাবতে হবে না। নিশ্চিন্ত মনে সে তার অসমাপ্ত গবেষণাগুলো একে একে শেষ করে ফেলতে পারবে। 

আপাতত, সে স্থির করল, তার দুটো ওষুধের আলমারির একটা (অপেক্ষাকৃত খারাপ যেটা) বিক্রি করে দেবে। বাকিটা বাড়িতে এনে রাখবে। সাইকেলটা সে নিয়েই যাবে সঙ্গে করে। আলমারির খদ্দেরও পেয়ে গিয়েছে ভূষণ। মহিন্দির কম্পাউন্ডার সরকারি হাসপাতাল থেকে পেনশন নিয়ে এখন ডাক্তার হয়ে বসতে চায়। বুড়ো বড় কঞ্জুষ। প্রথম দামটা এতই কম হেঁকেছিল যে, ভূষণ পত্রপাঠ তাকে বিদায় করে দিয়েছিল। তারপর ভূষণ দেখল, আলমারির খদ্দের জোটানো শক্ত। শেষ পর্যন্ত মহিন্দির বুড়োই দাঁও মারল। ষাট টাকার ভাল কাঠের আলমারি বিক্রি হল মাত্র পঁচিশ টাকায়। যাক, তার জন্য ভূষণ হা-হুতাশ করল না। বরং ভালই হল, সে ভাবল, তবু তো ওষুধই থাকবে ওর ভিতর। 

ব্যস, এখন সে মুক্ত। এবার সে কলকাতায় যাবে। সেজদার কাছ থেকে নির্দেশ নেবে। তারপরে চলে যাবে শ্রীহট্ট। হ্যাঁ, আর-একটা কাজ বাকি। কলকাতায় যাবার আগে গিরিবালাকে তার বাপের বাড়িতে রেখে যাবে। ফিরতি পথে এসে ওদের নিয়ে যাবে সে। ব্যস, সব ব্যবস্থা পাকা। তবে সামান্য একটা কাজ বাকি আছে। কিছু টাকা সংগ্রহ করা। ভূষণের কলকাতায় যাওয়া, গিরিবালাদের শ্বশুরবাড়ি পাঠানো, এমনি সব কাজের জন্য কিছু টাকার দরকার। ভূষণ প্রথমে ওর পাওনা টাকা আদায়ের চেষ্টা করল, পারল না। ধার পাওয়া সম্ভব নয়, সে জানে। আলমারি বেচে সে অবশ্য কিছু পেল। কিন্তু আরও কিছু চাই তো। শেষ পর্যন্ত অগতির গতি, গিরিবালার গহনায় হাত দেওয়া-ছাড়া আর উপায় দেখল না ভূষণ। 

কিন্তু প্রস্তাবটা সরাসরি গিরিবালার কাছে পেশ করা খুব সহজ ঠেকল না। কারণ বাক্সের গহনা যা ছিল, গিরিবালা তা ধরে দিয়েছে কয়েকবার, মাছের ব্যাবসা, কনট্রাক্টরি, ডাক্তারখানার বাকি ভাড়া এবং দোকানের দেনা শোধ, চম্পির বিয়ে— এই সব নানান খাতে গিরিবালার তোলা গহনাগুলো একে একে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। কোনওবার গিরিবালা স্বেচ্ছায় দিয়েছে, ‘সুদ সমেত আসল’ ফেরত পাবার প্রতিশ্রুতি পেয়ে। মাছের ব্যাবসার সময় ভূষণ যখন গিরিবালার আর্মলেট জোড়া নেয়, তখন বলেছিল, লাভের টাকা দিয়ে (ভূষণ তখন হিসেব করে দেখেছিল, একশো টাকা লাগালে আড়াইশো টাকা ঘরে আসছে) আর্মলেট তো ফিরিয়ে দেওয়া হবেই গিরিবালাকে, তার উপর সুদ হিসেবেও একটা গহনা দেওয়া হবে তাকে, তার যা পছন্দ। 

গিরিবালা আপত্তি করেনি, আর্মলেট জোড়া বের করে দিয়েছিল। গিনিবসানো আর্মলেট। গিরিবালা বলেছিল, সুদের টাকায় তাকে একছড়া মটরমালা গড়িয়ে দিতে হবে, দেশি স্যাকরার গড়ানো হলে চলবে না, কলকাতার বি সরকারের দোকানের জিনিস চাই। ভূষণ তাতেই ঘাড় নেড়েছিল। 

সেই কোন ছোটবেলায় গিরিবালা বি সরকারের মটরমালা দেখেছিল, সে-কথা বড় হয়ে ও ভুলতে পারেনি। সে তখন ডোমারে। বাবার কর্মস্থলে। তখন তার মা-ও বেঁচে। হঠাৎ একদিন সাজ সাজ রব পড়ে গেল সেখানে। ম্যানেজারবাবুর বড়মেয়ে লাবণ্যর মুখে গিরিবালা শুনল, “পূজা স্পেশাল” আসবে। পূজা স্পেশাল কী, অজ গ্রামের মেয়ে গিরিবালা তা জানত না। লাবণ্যই বলল, সে নাকি দারুণ জিনিস। আসলে রেলগাড়ি, কিন্তু প্যাসেঞ্জার যায় না তাতে। গাড়িগুলো সব দোকান-পসারে ভরতি। ম্যাজিক, বাইস্কোপ, কাপড়, পোশাক, গহনা, কলকাতার খাবার, মনোহারি জিনিসে ঠাসা। সত্যিই তাই। পূজা স্পেশাল দেখে গিরিবালার গ্রাম্য নাবালিকা চোখে যেন স্বপ্ন নেমে এসেছিল। মনে মনে সে ট্রেনসুদ্ধ সব জিনিস কিনে নিতে ইচ্ছে করেছিল। তবে সব চাইতে তার মন কেড়েছিল বি সরকারের দোকানের মটরমালা। সেদিন জিনিসটা কিনতে পারেনি সে। পারেনি বলেই মটরমালা পাবার বাসনা এত অক্ষয় হয়ে আছে। 

ভূষণ এ-কথা জানত। এ-কথাও জানত, গিরিবালার আর্মলেট-বেচা টাকায় তিন থেকে চার চালান মাছ আনতে পারলেই লাভের টাকা থেকে অনায়াসে মটরমালা গড়িয়ে দেওয়া যাবে। ফাঁকা কথা বলবার লোক নয় ভূষণ। দস্তুরমতো হিসেব কষে সে বুঝিয়ে দিতে পারে, ব্যাবসাটা চালু করতে পারলে, সাত পেটি করে মাছ দৈনিক চালান আনতে পারলে, সামান্য মাত্র লাভে সে-সব বিক্রি করলেও মাস গেলে দেড় হাজার টাকা লাভ থাকত তার। তার থেকে আরও পাঁচশো টাকা বাদই দিয়ে দাও না হয়, তবুও তো এক হাজার টাকার কোনওমতেই মার ছিল না। আর ব্যাবসাটা গিরিবালার নামেই খুলেছিল ভূষণ। শুধু মাছ কেন, গিরিবালার গহনা বেচে যে ব্যাবসাই করেছে ভূষণ, তার “প্রোপ্রাইটার” গিরিবালাকেই করেছে। লাভ হলে গিরিবালারই হত। প্রতিবারই কোনও-না-কোনও বিভ্রাটে ব্যাবসাগুলো লোকসানে দাঁড়িয়ে গেছে। তাই গিরিবালার কোনও গহনাই স্বস্থানে ফিরে আসেনি। 

চম্পির বিয়ের সময়েও গিরিবালা অবশ্য তাদের মুখরক্ষা করেছে। যদিও জানে ভূষণ, গিরিবালা যথেষ্ট ক্ষুণ্ণ হয়েছে তাতে। তবুও না হয় চম্পির বিয়েতে স্বার্থত্যাগের একটা আনন্দ ছিল। এখন যে কারণে ভূষণকে গিরিবালার গহনা চাইতে হবে, তাতে তো লাভের আশাও নেই, মহৎ হবার আনন্দও নেই। 

দিতে কি রাজি হবে গিরিবালা? কীভাবে পাড়া যায় কথাটা? 

ভূষণ শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগল। অন্যদিন, এতক্ষণ তার নাক ডাকা শুরু হয়ে যায়। আজ চোখের পাতা আর এক হতে চাইছে না। যাবার জন্য ছটফট করছে তার মন। সময় তো আর মোটেই নেই। অথচ এদিকে সে পাথেয়ই জোগাড় করে উঠতে পারছে না। সাংঘাতিক সমস্যায় পড়ে গিয়েছে ভূষণ। 

.

গিরিবালা কাজকর্ম সেরে ঘরে এসে যখন ঢুকল, তখনও লজ্জা যেন জিউলির আঠার মতো তার সারা গায়ে লেপটে আছে। বড়জায়ের চোখকে শেষ পর্যন্ত সে আর ফাঁকি দিতে পারল না। তার রকমসকম দেখে বড়জায়ের বুঝি সন্দেহ হয়েছিল। একটু আগে এমন জেরা করতে শুরু করলেন যে, গিরিবালা লজ্জায় মুখ নামিয়ে সবই স্বীকার করে ফেলল। 

দামিনী হাসতে হাসতে বললেন, তা ভাল। ঠাকুরপোরে বলিছিস ত? 

গিরিবালা কথা বলল না, মুখ নিচু করে এঁটো থালে আঁকিবুকি কাটতে লাগল। 

দামিনী ধমক দিলেন, ও কী করিস! থালে আঁক কাটে না, দিনা হয়। এমনিই তো ধার-দিনার সীমা-সংখ্যা নেই। 

তারপর তিনি নরম গলায় আবার আগের প্রসঙ্গে ফিরে গেলেন। 

বললেন, ওরে ও বুকা মাধাই, এ-কথা লুকোয়ে রাখিছিলি ক্যান? ও কি চাপা থাকে?

গিরিবালা বলতে পারল না, সে নিজেও বুঝতে পারেনি আগে। দামিনীর আজকের ব্যবহার খুব ভাল লাগল গিরিবালার। মাঝে মাঝে এদের ব্যবহারে-আচরণে খুবই ধাঁধা লেগে যায় গিরিবালার। সে বুঝে উঠতে পারে না, এদের কোন মূর্তিটা আসল! কখনও এদের ভাব দেখে ব্যথা পায়, কখনও আনন্দে ভাসে। এ-বাড়ির লোকগুলো যেন একটা দেহের খাপে দুটো করে রূপ ভরে রেখেছে। একটা যদি রণচণ্ডী, তা হলে অন্যটা জগদ্ধাত্রী। 

গিরিবালা ঘরে ঢুকেই বুঝতে পারল, ভূষণ জেগে আছে। নইলে তার নাক ডাকছে না কেন? তার কেমন যেন মনে হতে লাগল, বড়জায়ের মতো ভূষণও বুঝি টের পেয়ে গিয়েছে ব্যাপারটা। সে আর ভাল করে ভূষণের দিকে চাইল না। সোজা নিজের জায়গায় উঠে গিয়ে শঙ্খকে কোলে তুলে নিল। তার কাঁথাটা বদলে দিতে না দিতেই সে উঁ-আঁ করে উঠে পড়ল। বড্ড পাজি হয়েছে ছেলেটা। আগে কেমন সারারাত ঘুমোত। এখন দিনে তো বটেই, রাত্রেও তার দৌরাত্ম্যির শেষ হয় না যেন। মাঝে মাঝে গিরিবালার মনে হয়, ও বুঝি ক্লান্ত হতে জানে না। 

শঙ্খ খুঁতখুঁত করছে আর হাত দিয়ে গিরিবালার কাপড় টানছে। তার আর তর সইছে না কিছুতে। গিরিবালার মনে মনে হাসি পেল। দাঁড়া বাবা, দাঁড়া। একটু সবুর কর। উঃ, কী যে করে! একেবারে পাগল হয়ে উঠেছে। বাবা, বাবা! 

ক্লান্ত গিরিবালা সেমিজের বোতাম খুলে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। শঙ্খ গুঁতো মেরে, ঢুঁ মেরে গিরিবালাকে অস্থির করে তুলে হঠাৎ কাম্য বস্তুটির নাগাল পেল। তখন শান্ত হয়ে চুকচুক করে মাই খেতে লাগল। গিরিবালা তার সারা গায়ে মাথায় আদরের হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মনে মনে বলতে লাগল, বুড়ো খুকা, এখন ত আমারে তিষ্ঠতিউ দ্যাও না, এর পর ভাগিদার জুটলি কী করবা? 

.

যে সন্দেহ গিরিবালার মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল, দামিনীর মুখে প্রকাশ্যে তার সমর্থন পেয়ে সে প্রথম দিকে হকচকিয়ে গিয়েছিল। সেই ভাবটা কাটলে গিরিবালার শরীরে একটা চাপা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে থরথর করে তাকে খানিকটা কাঁপিয়ে দিল। পরমুহূর্তেই পুরনো কথা মনে পড়ল। আতঙ্কে তৎক্ষণাৎ তার শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল। 

গিরিবালার ভয় আরও বাড়ল বিদেশে যাওয়ার কথা ভেবে। আগেরবার সে তো বাপের বাড়িতে ছিল, আপনার লোকেদের মধ্যে, তাই সে অমন ধকলটা সহ্য করতে পেরেছিল, এবার সে কোন মগের মুলুকে যাচ্ছে! কেউ থাকবে না সেখানে, কেউ দেখাশোনা করতে পারবে না…. না না, সেখানে গেলে আর বাঁচবে না গিরিবালা। সেই ভয়ংকর দিনটা যখন আসবে, তখন… তখন গিরিবালা মরেই যাবে। 

কেন তাকে এই অবস্থার মধ্যে ঠেলে দিল ভূষণ! এই সমস্ত গন্ডগোল পাকাবার জন্য সে বারবার ভূষণকেই দায়ী করতে লাগল। 

কী, ঘুমিয়ে গেলে নাকি? 

ভূষণের আওয়াজ পেতেই গিরিবালা নড়ে-চড়ে শুল। আবার সোহাগ জানানো হচ্ছে। গিরিবালা চটল না কিন্তু। তার ভালই লাগল। সেই মুহূর্তে এমনও ভাবল, ভূষণকে দেবে নাকি খবরটা! খবরটা শুনলে সেও কি গিরিবালার মতো হকচকিয়ে যাবে? একটা জিনিস লক্ষ করল গিরিবালা, শঙ্খের বেলাতে এই সব ব্যাপারে সে যে রকম লজ্জাবতী লতা গোছের ছিল, এবারে আর ঠিক তেমনটি নেই। শঙ্খ তার লজ্জার ভার অনেকটা লাঘব করে দিয়েছে। শঙ্খের বেলায় তার লজ্জাটা যত প্রবল ছিল, ভয় বা আতঙ্ক ততটা ছিল না। ব্যথা উঠবার পর সে ভয়ে কাবু হয়ে পড়েছিল। সেই ভয়াবহ যন্ত্রণার আভাস মাত্রও তার স্মৃতিতে নেই এখন। আছে প্রবল আতঙ্কের সেই অনুভূতিটা। আজ খবরটা প্রকাশ হবার পর সে লজ্জা পেয়েছিল ঠিকই তবে তার পরিমাণ সামান্যই। আসলে তার ঘাড়ে এখন ভয়ই চেপে বসেছে। 

এর আগেরবার কি ভূষণকে গোপন কথাটি জানাবার বাসনা তার মনে কখনও হয়েছিল? ও বাবা, সে বলে তখন পাতালে লুকোতে পারলে বাঁচে! স্বামীর সঙ্গে প্রথম রাত্রিবাসের পর গিরিবালা পরদিন সকালে যেমন কারও সামনে মুখ তুলতে পারেনি লজ্জায়, তেমনি লজ্জা পেয়েছিল শঙ্খ হবার বেলায়, প্রথম যখন ব্যাপারটা ধরা পড়ল তার কাছে। মানুষের কত পরিবর্তন হয়! আশ্চর্য! 

এবার ব্যাপারটা এত সহজ ঠেকবে তার কাছে, গিরিবালা তা আগে ভাবতে পারেনি। ভূষণের কাছে খবরটা দেবার কথা এখন সে কত সহজে ভাবতে পারছে। 

ভূষণ বলল, কী গো, কথা বলছ না কেন? শোনো, তোমার সঙ্গে একটা জরুরি পরামর্শ আছে। 

ভূষণ গিরিবালার দিকে একটু সরে গেল। ভূষণও কি টের পেয়েছে নাকি? গিরিবালা উৎকর্ণ হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। 

ভূষণ বলল, দ্যাখো, আলমারি বেচা টাকা আজ তো পেলাম। মাত্তর পঁচিশ টাকা পাওয়া গেল। ওতে তো সব খরচ কুলোবে না। আমি কলকাতায় যাব, তোমাকে রেখে আসব তোমার বাবার বাড়িতে। তারপর ধরো, এতদিন পরে আবার যাচ্ছ ওখানে, তোমার হাতেও তো কিছু টাকার দরকার। জামা-কাপড়ও কিনতে হবে কিছু। যতক্ষণ এখানে আছি, ততক্ষণ শুধু তোমার আমার কাপড় কিনলেই তো চলবে না— মা, বউদি, যূথি, বড়দা ওদেরও তো কারও কাপড়-চোপড় নেই, তাও তো কিনতে হবে। বাগানে গিয়ে পৌঁছোতে পারলে অবিশ্যি আর কোনও ভাবনা থাকবে না। 

ভূষণ শেষ কথাটা খুব জোর দিয়েই বলল। 

কারণ, সেখানে তো বাঁধা মাইনের সংসার। আজ দু’টাকা পেলাম তো দু’দিন নট কিচ্ছু এমন তো নয়। এ একেবারে ফার্স্ট ডে অব দি মনথ, পয়লা তারিখেই একসঙ্গে সব টাকা পেয়ে যাচ্ছ তুমি। তারপর যেমন ইচ্ছে, যত ইচ্ছে খরচ করো। মাইনের চাকরির এই একটা মস্ত সুবিধে। টাকা-পয়সার ভাবনা ভাবতে হয় না। ফুরিয়ে গেল টাকা, তাতেও পরোয়া নেই, আবার মাস পয়লায় তুমি পেয়ে যাচ্ছ টাকা। যেমন খুশি খরচ করো। ব্যাবসা-বাণিজ্যে এই সুবিধেটা কিন্তু নেই। 

গিরিবালা অনেক আশা করে মুখিয়ে ছিল, না-জানি কী বলবে ভূষণ! ও হরি, শেষ পর্যন্ত এই কথা! 

গিরিবালা ফস করে বলে বসল, এতই যদি চাকরিতি সুবিধে, তা এতদিন চাকরি-বাকরি নিলে না ক্যান? 

এ আবার কী কথা? ভূষণ হকচকিয়ে গেল। সহসা কথা জোগাল না তার মুখে। সাধে কি মেয়েলোক বলে! ভূষণ একটু অবজ্ঞার ভাব নিয়ে এ-কথার জবাব দেবার জন্য তৈরি হল। 

কিন্তু তার আগেই সুর নরম করে ফেলল গিরিবালা। ভূষণের একখানা হাত সে কাছে টেনে নিল। দু’হাতে সেখানা শক্ত করে চেপে ধরল। 

বলল, ওখেনে আর যায়ে কাজ নেই। পরের চাকরি করে হবেটা কী! এখেনেই তুমার যথেষ্ট পসার হবে, তুমি দেখে নিয়ো। ভাশুর ঠাকুরিরি তুমি বরং জানায়ে দ্যাও, উনারা অন্য লোক দেখে নেবেন। 

ভূষণ বলল, পাগল, তা আবার হয় নাকি! চিঠি লিখে দিয়েছি যাব বলে। আমার আশায় সেজদা বসে আছেন। এখন কি আর না গেলে হয়? তা ছাড়া এ তো পরের চাকরি নয়। সেজদারাই ও-বাগানখানা কিনে ফেলেছেন। খুব বিশ্বাসী লোক চান তিনি। 

গিরিবালা চটে গেল। 

তুমি ছাড়াউ ঢের বিশ্বাসী লোক আছে ওঁর। তুমি না গেলি আর বাগানের কাজ যেন চলবে না!

গিরিবালার চোখ ফেটে জল আসে আর কী? আসল কথাটা বোঝে না কেন ভূষণ? এই অবস্থায় গিরিবালা ওই নির্বান্ধব দেশে গেলে কি বাঁচবে? কক্ষনও না। ভূষণ কি চায় যে, গিরিবালা ওই ওখানে গিয়ে অক্কা পাক! ভূষণ গিরিবালাকে মোটেই ভালবাসে না, এক ফোঁটাও না। সে দেখেছে, ভূষণের কাছে দুনিয়াসুদ্ধ সকলেরই দাম আছে। দাম নেই শুধু গিরিবালার। দাদার কথা রাখবার জন্য সে শ্রীহট্টে ছুটবে, কিন্তু গিরিবালার অনুরোধ অনুনয় মিনতি সে দু’পায়ে মাড়াতে কসুর করবে না। গিরিবালার মাঝে মাঝে জানতে ইচ্ছে করে, সবাই কি তাদের বউকে ভূষণের মতো এত তাচ্ছিল্য করে! 

গিরিবালা ধীরে ধীরে হাতের মুঠি আলগা করে দিল। ভূষণের ভারী হাতখানা নোঙর ছাড়া হয়ে গিরিবালার গায়ের উপর দিয়ে পিছলে বিছানায় গিয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে সে ও-পাশ ফিরে শুল। শঙ্খর গায়ে হাত রেখে সে মনের জ্বালা জুড়োতে চেষ্টা করল। 

গিরিবালা এত আপত্তি করছে কেন? ভূষণ কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না। একেবারে পাগলের মতো আবোল-তাবোল বকছে। অনেকক্ষণ ধরে বোঝাতে বোঝাতে গিরিবালা শেষ পর্যন্ত নরম হয়। সায় দেয় ভূষণের কথায়। কিন্তু গিরিবালা আবার পরের দিনই মত পালটায়। এ এক আচ্ছা ফ্যাসাদে পড়েছে ভূষণ। আর কী করে যে সে গিরিবালাকে বোঝাবে, ভূষণ তা ভেবে পেল না। সে হতাশ হয়ে চুপ করে শুয়ে রইল। 

ভূষণের নিজের ইচ্ছের কথা সে না হয় ছেড়েই দিল। যদিও আর এক মুহূর্তের জন্যও তার এখানে থাকবার ইচ্ছে নেই। তবুও না-হয় গিরিবালার মুখ চেয়ে নিজের ইচ্ছেটা দমন করল (বিয়ে-থা করলে কোনও ‘লোকই আর জীবনে মহৎ কাজ করতে পারে না), কিন্তু গিরিবালা একথাটা কেন বুঝছে না, সেজদার সিদ্ধান্ত মানেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। এর আর নড়চড় হয় না। আমেরিকায় ডাক্তারি পড়তে না গিয়ে সে একবার সেজদার আদেশ অমান্য করেছে, দ্বিতীয়বার আর তার পুনরাবৃত্তি করবার হিম্মত ভূষণের নেই। তা ছাড়া সেজদা আবার যে তাকে ডাকবেন, তার উপর কাজের ভার চাপাবেন, তার আগের অপরাধ মার্জনা করবেন, এই জিনিসটাই তার কাছে অভাবনীয়। এ-সুযোগ সে কি ছাড়তে পারে? গিরিবালাকে রাতের পর রাত একথা বোঝাতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু সবই দেখি ভস্মে ঘি ঢালা হয়েছে। ধুত! ভূষণ বড় বিরক্ত বোধ করল। 

কিন্তু সে হাল ছাড়ল না। 

বলল, আচ্ছা তোমার সত্যিকারের আপত্তিটা কোথায়, একটু খোলসা করে বলো তো।

গিরিবালা জবাব দিল না। পাশও ফিরল না। তবে সে একটু খুশি হল এই ভেবে, তাকে একেবারে তুড়ি মেরে উড়িয়েও দিতে পারছে না ভূষণ। গিরিবালা যদি বোঝে, ভূষণ তাকে পাত্তা দিচ্ছে, তা হলে আপনা থেকেই তার মন খুশি হয়ে ওঠে। একটু সাধুক না তাকে। 

ভূষণ বলল, না, সত্যি, রাগের কথা নয়। খোলসা করে বলোই-না, কীসের এত আপত্তি তোমার? 

এতক্ষণে গিরিবালা আবার এ-পাশে ফিরল। 

বলল, আমার শরীর খারাপ হয়েছে। এ অবস্থায় অতদূর যাওয়া ঠিক হবে না। 

ভূষণ কথাটা ধরতে পারল না। ভাবল গিরিবালা নুতন প্যাঁচ কষছে। দিব্যি তো আছে গিরিবালা। ইদানীং বরং আরও চেকনাই ছাড়ছে। শরীর খারাপ, হুঁঃ! 

ভূষণ হালকাভাবে বলল, ও-শরীরের আবার খারাপ হল কোথায়, তাও তো বুঝিনে।

অ্যাঁ, খোঁটা দিচ্ছে ভূষণ! তার মানে প্রকারান্তরে তাকে মিথ্যাবাদী বলা হচ্ছে। বেজায় চটে গেল গিরিবালা। 

বলল, বুঝবা কী করে? তুমি কি কোনওদিন আমারে বুঝবার চিষ্টা করিছ? আমার সুখ-অসুখ কিছুই ত তুমার চোখি পড়ে না। ভাবো, আমি বুকা, কিছুই বুঝিনে। সব বুঝি। বুঝেউ কিছু বলিনে। তেমন তেমন কারুর পাল্লায় পড়লি বুঝতে ঠ্যালাখানা। 

ভূষণ তাড়াতাড়ি বলে উঠল, আহা-হা, এত রাত্রে আবার গোলমাল বাড়ানো কেন? কী হয়েছে, তাই বলো না। আজেবাজে কথা বলে লাভ কী? 

গিরিবালা রাগে ফুলতে লাগল। 

আমি একটা কথা বললিই তো তুমার গায় ফুসকা পড়ে। আমার আর সহ্য হয় না। দ্যাখো, আমারে বাপের বাড়ি পাঠায়ে দ্যাও। দিয়ে যেখেনে ইচ্ছে সেখেনে যাও। 

এবার ভূষণ ঘাবড়ে গেল। এত রাগতে সে গিরিবালাকে কখনও দেখেনি। গিরিবালা ততক্ষণে ফোত ফোত করতে লেগেছে। এ তো আচ্ছা ফ্যাসাদ! এত রাত্রে, কোথায় অল্প কথায় কাজ সারতে গেল ভূষণ, ফল হল উলটো। 

যথাসম্ভব মোলায়েম গলায় বলল, দ্যাখো, তোমার মনে ব্যথা দেবার জন্য আমি ও-কথা বলিনি। তোমার শরীর খারাপ বললে কিনা, আমি তাড়াতাড়ি সেইটেই জানতে চাইছিলাম। 

গিরিবালা চুপ করে গেল। তার অভিমান তখনও যায়নি। 

বলল, আমার কথা ত তুমার বিশ্বাস হবে না। তুমি বরং কাল বড়দিরি জিজ্ঞেস করে নিয়ো।

ভূষণ সুর নরম দেখে গিরিবালাকে খুব কাছে টেনে নিল। 

বলল, এটা কি একটা কথা হল! তোমার কথা তোমার মুখ দিয়ে শুনতেই আমার ভাল লাগে। 

ওরে বাস রে! কথার কায়দা কত! ভূষণের বলার ঢঙে গিরিবালা হেসে ফেলল। হঠাৎ তার লজ্জাও হল। ইতস্তত করল খানিক। 

তারপর বলল, যাও, এ-কথা বলা যায় না, বুঝে নিতি হয়। 

বলেই ভূষণের বুকে মুখ লুকোল 

ফিসফিস করে বলল, তুমি কী রকম ডাক্তার গো, ঘরের লোকের রোগ বুঝি তুমার চোখি ধরা পড়ে না? 

এগারো 

গিরিবালা বুঝি এত আনন্দ আর কখনও পায়নি। অথচ নৌকা চড়ার ভয় তার বরাবরের। কিন্তু আজ, এই পরিষ্কার চকচকে দিনটিতে নৌকোয় চড়তে তার তেমন ভয় হচ্ছে না তো। 

অথচ সকালে বাড়ি থেকে ওরা যখন বিদায় নেয়, গিরিবালার মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছিল। শাশুড়ি শঙ্খকে বুকে নিয়ে হাউহাউ করে কাঁদছিলেন। যেন কেউ মারাটারা গেছে এমনি ভাবখানা তাঁর। বড়জা কেঁদেছেন গিরিবালাকে বুকে চেপে ধরে। গিরিবালা নিজেও কেঁদেছে। না কেঁদে পারেনি। এবার একটানা তিন বছর ছিল এই বাড়িতে। এ বাড়ির সব-কিছুই তার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। 

যতদিন এ-বাড়িতে ছিল, ততদিন এর অবহেলা, এর উপেক্ষা তার প্রাণে বড় বাজত। এই বাড়িতে এসেই গিরিবালা টের পায় অভাব কাকে বলে। বাপের বাড়িতে তাকে কখনও না খেয়ে থাকতে হয়নি, চালের পিত্যেশে উনুন কোলে করে বসে থাকতে হয়নি। এ বাড়িতে ওসব যেন ইদানীং নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে উঠেছিল। ঈর্ষা দ্বেষ কাকে বলে, এ বাড়িতে এসে তার পরিচয়ও পেয়েছে গিরিবালা। তার শখ-সাধের শাড়িগুলো একখানা একখানা করে ছিঁড়েছে, গহনাগুলো এক এক করে অদৃশ্য হয়েছে। অনেক সময় পালাই পালাই করে তার মন অস্থির হয়ে উঠেছে। তবু কী আশ্চর্য, এ-বাড়ি ছেড়ে যাবার সময় হলে দেখল, সে খুব কষ্ট পাচ্ছে। বাপের বাড়ি ছেড়ে আসবার সময় সে যেমন কষ্ট পেয়েছিল, অবিকল তেমনই ব্যথা। যে-যূথিকে সে দেখতে পারত না মোটে, সেই যুথির জন্যও সে দেখল তার প্রাণ পুড়ছে। আর মনে পড়ল চম্পির কথা। দুরন্ত অভিমানী সেই মেয়েটা, যে বিয়ের পর বিদায় নেবার সময় এক ফোঁটা কাঁদেনি, যে অষ্টমঙ্গলায় এসে দু’দিনের মাথায় আবার ফিরে গিয়েছে শ্বশুরবাড়ি, আর আসেওনি, চিঠি-চাপাটিও লেখেনি। 

নৌকো একটু দুলে উঠতেই গিরিবালা চমক খেল। দেখল একটা পুলের তলা দিয়ে নৌকোটা যাচ্ছে। একটু আগেই ছেড়েছে নৌকোখানা। ঝিনেদার সীমানা এখনও ছাড়ায়নি। 

ভূষণও খুব খুশি। তার চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। অবশেষে সে অনড় জীবনের শিকড় ছিঁড়তে পেরেছে। বেরিয়ে পড়েছে পথে। এখন আপাতত সে শ্বশুরবাড়িতে যাচ্ছে গিরিবালাদের রাখতে। ওখান থেকে সে যাবে কলকাতায়। সেখান থেকে শ্রীহট্ট। শ্রীহট্ট যাবার আগে সে এসে গিরিবালাদের নিয়ে যাবে শ্বশুরবাড়ি থেকে। এই ঠিক করেছে ভূষণ। এতে সে গিরিবালার সম্মতিও পেয়েছে। 

পুলের তলা দিয়ে ওরা যাচ্ছে আর উপর দিয়ে যাচ্ছে বেতো ঘোড়ার এক্কা। ভূষণের চোখের উপর দিয়ে এই পুলটা তৈরি হয়েছে। দেখতে দেখতে বছর পঁচিশেক হয়ে গেল। 

ভূষণ গিরিবালাকে বলল, এই পুলের উপর দিয়ে চম্পির শ্বশুরবাড়ি যেতে হয়। 

গিরিবালা অমনি ছইয়ের বাইরে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। 

ভূষণ বলল, এই পুলটা কে বানিয়েছেন জানো? যতীনদা। বাঘা যতীন। 

গিরিবালা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল ভূষণের দিকে। যতীন নামে তার কোনও ভাশুর আছে, সে তো তা শোনেনি এর আগে। 

ভূষণ বলল, বাঘা যতীনের নাম শোনোনি? 

গিরিবালা ঘাড় নেড়ে জানাল, না। ভূষণ তার অজ্ঞতায় হাসতে লাগল। 

বলল, দেশসুদ্ধু ছেলেবুড়ো তাঁর নাম জানে, আর তুমি জানো না? তুমি কী গো?

গিরিবালা এবার সত্যিই লজ্জা পেল। 

জিজ্ঞাসা করল, কী করেন ভাশুর ঠাকুর? 

ভাশুর ঠাকুর! 

ভূষণের চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল। 

কার কথা বলছ? 

আহা, ভূষণ যেন কী! নাম করতে পারে নাকি গিরিবালা? 

ওই যে তুমার যে দাদার কথা বলতিছ। যিনি এই পুল বানায়েছেন। 

শোনামাত্র ভূষণ হা হা করে হাসিতে ফেটে পড়ল। 

ভাশুর ঠাকুর! বাঘা যতীন ভাশুর ঠাকুর! হা হা হা। 

গিরিবালাও আরও বোকা বনে গেল। কেন, উলটোপালটা কিছু বলেছে নাকি সে?

কিছুক্ষণ পরে হাসি থামাল ভূষণ। 

বলল, তা বলেছ ভাল। ভাশুর ঠাকুরই বটে। একদিক দিয়ে কথাটা কিন্তু ঠিক। আপন পর ভেদ ছিল না তো তাঁর কাছে। 

ভূষণ গম্ভীর হয়ে গেল। অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। তার মন স্মৃতির পাখায় ভর করে পিছিয়ে চলল। 

বলল, জানো, ওঁরা সব দারুণ লোক। দেশকে উদ্ধার করার ব্রত নিয়ে ওঁরা এসেছিলেন। দেশের কাজেই আত্মোৎসর্গ করেছেন। 

একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল ভূষণ। নৌকোটা বাঁক নিয়েছে ততক্ষণে। পুলটা চোখের আড়াল হয়ে গিয়েছে। 

ভূষণ ধীরে ধীরে বলতে লাগল, আমরা তখন ইস্কুলে পড়ি। যশোর-ঝিনেদা রেলের ঝিনেদার স্টেশন-মাস্টারি করেন মেজদা। আমি সেই বাসাতেই তখন থাকি। পাশের বাসাতেই থাকেন যতীনদা। ওঁর বউকে বউদি বলতাম। বড়মেয়ের কথাও মনে আছে আমার। মহেশপুরে বিয়ে হয়েছিল তার। নাম ছিল আশা। এতদিনে নিশ্চয়ই সে মস্ত গিন্নিবান্নি হয়ে উঠেছে। যতীনদা তখন কনট্রাক্টরি করেন। ওই যে পুলের কথা বললাম, ওই শৈলকুপো যাওয়ার পুলটা তখন তৈরি করছেন তিনি। অমন দশাসই চেহারা আমি আর দেখিনি। হাফপ্যান্ট হাফশার্ট পরে, শোলার টুপি মাথায় দিয়ে কাজকর্ম তদারক করে বেড়াচ্ছেন, তাঁর এই চেহারাটাই সর্বক্ষণ চোখে ভাসে আমার। বাঘা নাম হয়েছিল কেন জানো? 

ভূষণ একটু থামল। তার গলাটা ভারী হয়ে এসেছে। সাফ করে নিল গলাটা। 

বলল, শুধু হাতে, গাড়ুর বাড়ি মেরে তিনি বাঘ মেরেছিলেন। বাঁ হাতের কনুই বাঘের মুখে ঢুকিয়ে দিয়ে ডান হাতে গাড়ু ধরে মেরেছিলেন ঘাই। তাতেই আস্ত একটা বাঘ অক্কা পেয়েছিল। আমরা তাঁর কনুইয়ে বাঘের কামড়ের দাগ দেখেছি। আমাদের তিনি ব্যায়াম শেখাতেন। মাঝে মাঝে আবার মজাও দেখতেন। আমাদের চিত করে ফেলে দিতেন মেঝেয়, তারপর চেয়ারে বসে এক পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে এক এক করে আমাদের পেট ঠেসে ধরতেন, বলতেন, ওঠ, উঠে পড়। কিন্তু তাঁর সঙ্গে গায়ের জোরে আমরা পারব কেন! কেউই আমরা উঠতে পারতাম না। তিনি বলতেন, হাল ছাড়িসনে, শক্তি সঞ্চয় কর। এমনি করে আমাদের সবাইকে যারা বুটের চাপে দাবিয়ে রেখেছে, তাদের তো একদিন উলটে ফেলে দিতে হবে। গায়ে জোর কর, গায়ে জোর কর। তখন আমরা ছোট। ও-সব হেঁয়ালির কথা কি বুঝি! তবু তাঁর কথা শুনে আমরা পরমানন্দে শরীর তৈরি করতে লেগে গিয়েছিলাম। তারপর একদিন শুনি যতীনদা উধাও। কেউ তাঁর কোনও খোঁজই পেল না। বউদিরা বাসা তুলে দিয়ে বোধহয় বাপের বাড়িই চলে গেলেন। তার প্রায় এক বছর পরে একদিন কী হইহই! শুনলাম, বালেশ্বরে জন চারেক শাগরেদ নিয়ে যতীনদা ইংরেজদের সঙ্গে সম্মুখসমরে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। 

.

ভূষণ চুপ করল। বর্ষা অকালে শেষ হয়ে আসছে নাকি? আকাশ যেন এরই মধ্যে শরতের আগমনী-বার্তা শোনাতে শুরু করেছে। এই চকচকে রোদ, মুহূর্তে একটা জলভরা কালচে মেঘ তাকে একটুক্ষণের জন্য ঢেকে দিয়ে ভেসে চলে গেল। জলো হাওয়া বইছে। ভরা নদী, এখানে ওখানে দু’-চারটে করে লাল শালুক মুখ বাড়িয়ে রয়েছে। মাঝে মাঝে ভিখারি চিল করুণ স্বরে ডাক দিয়ে জেলেদের কাছে কাছে উড়ে বেড়াচ্ছে। 

সব দুঃখ বেদনা ছাপিয়েও আনন্দের রং গিরিবালার মনে লাগছে। সে এটা চেপে রাখতে পারছে না কিছুতেই। শঙ্খ সেই থেকে ঘুমুচ্ছে। ভূষণ উদাস চোখে ভাবছে। একটা মাঝি হাল ধরে বসে তামাক খাচ্ছে। কড়া তামাকের গন্ধ ছইয়ের ভিতর ঘুরপাক মারছে। অন্য মাঝিটা নদীর পাড় দিয়ে গুন টেনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কখনও তাকে দেখা যায়, কখনও সে মিলিয়ে যায়। 

ধোপাঘাটের বাঁক পার হয়ে এসেছে তারা। পবহাটির কাছে এসে পড়েছে। ওই যে ওপারে ছলিমুল্লা চৌধুরীর বিরাট বাড়িটা দেখা যাচ্ছে। নদীর ভিতর থেকে বাড়িটা যেন গেঁথে তোলা হয়েছে। কে ছলিমুল্লা চৌধুরী, কতকালের বাড়ি এটা, তা জানে না গিরিবালা। এই গ্রামের নামটাও সে শুনেছে, মনে নেই। কিন্তু ছলিমুল্লা চৌধুরীর বাড়ি তার মনে অক্ষয়ভাবে খোদাই হয়ে গেছে। বাড়িটা দেখে কেমন যেন গা-ছমছম করে গিরিবালার। সেই ছোটবেলাতেও করত, এখনও করছে। 

বাকড়ির বাঁকে গিয়ে মাঝিরা নৌকো বাঁধল। একটু জিরোবে ওরা। খাবে। তারপর ছাড়বে নৌকো। বাপের বাড়ির ঘাটে পৌঁছোতে সন্ধে হয়ে যাবে। গাড়িতে গেলেই হত। ভূষণও প্রথমে তাই ভেবেছিল। কিন্তু এই নৌকোখানা যার, সে-ই বাদ সাধল। সে বুঝি ভূষণের রোগী। অনেক চিকিৎসা করেছে ভূষণ। ওরা পয়সাকড়ি দিতে পারেনি। ভূষণ দেশ ছেড়ে চলে যাবে শুনে জলভরা চোখে দেখা করতে এসেছিল তার সঙ্গে। তারাই জোর করল, গতরে খেটে ভূষণের ঋণ কিছুটা শোধ দেবে বলে। 

ভূষণ ওদের খাওয়াতে নিয়ে গেল। গিরিবালার মনও অস্থির হয়ে উঠেছে। এখনও অনেকটা পথ বাকি। বাকড়ি ছাড়ালে হরিশঙ্করপুর। মাধববাবুর বাঁধানো ঘাট। এখানকার ইস্কুলে সুধাময় পড়ত। তার ছোটমামা ছিলেন হেডমাস্টার। তারপর পড়বে বোসেদের ঘাট। কে পি বোসের অ্যালজেবরা না কী, সেই তাদের ঘাট। কে পি বোসকেও চেনে না গিরিবালা, অ্যালজেবরা সাপ কি ব্যাং তাও জানে না, তবু শিশুকাল থেকে যতবার এই পথে সে গিয়েছে, ততবার কথাটা শুনেছে। শুনতে শুনতে তার মুখস্থ হয়ে গিয়েছে। 

হরিশঙ্করপুর ছাড়ালে আর পারে মধুপুরের ঘাট। কুঠির সাহেবের মেম থাকে সেখানে। সেই হল অর্ধেক পথ। মধুপুরের পর গোবিন্দপুর, সুতুলে, ওপারে কড়ইতলা। কড়ইতলার কালী খুব জাগ্রত। কড়ইতলার পর পলেনপুর, তারপর পাইকপাড়া। পাইকপাড়ার উলটোপারে লোহাজাঙ্গা। গোপাল বিশ্বেসদের বাড়ি। ঘাটের উপরই নবীন তাঁতির ঘরখানা। অনেক সময় নৌকোর থেকে তার গানও শোনা যায়। ছোটকাকার খুব বন্ধু। এই লোহাজাঙ্গার ঘাট পার হয়ে খানিকটা এলেই তাদের গ্রামের কামারদের ঘাট। 

ভূষণরা গেল যে সেই গেলই। ফেরার তো নামগন্ধও নেই। নৌকো বাঁধা থাকায় হাওয়া চলছে না। গলগল করে ঘামছে গিরিবালা। শঙ্খও উঠে পড়ল। সে তো প্রায় চান করে উঠেছে। গিরিবালা ব্যস্ত হয়ে উঠল। 

এমন সময় ভূষণ রসগোল্লা, দই, চিঁড়ে, সবরি কলা নিয়ে হাজির হল। 

বলল, খিদে পেয়েছে নাকি? এসো, এগুলো খেয়ে নিই। 

পাগল হয়েছে নাকি ভূষণ? মুসলমানের নৌকোয় চড়েছে না তারা! ভূষণের কোনও বাছবিচার নেই, সে খাক। গিরিবালা বাড়ি গিয়ে চানটান না করে একটা দানাও কিছু মুখে দেবে না। 

মুখে বলল, তুমি খাও। আমার খিদে পায়নি। 

বলেই গিরিবালা একপাশে শুয়ে পড়ল। শুতে-না-শুতেই ঘুম এসে গেল তার। 

গিরিবালার বাপের বাড়ির ঘাটে যখন ওদের নৌকো লাগল, তখন সন্ধে হয় হয়। বর্ষাকালের লম্বা বেলা শেষ হতে বেশ সময় লাগে। ঠিক ওদের নৌকোর পাশ ঘেঁষেই আরেকখানা ছইখোলা নৌকো বেগে এসে ঘাটে লাগল। 

উত্তেজিতভাবে কারা তাতে কী সব বলাবলি করছে। 

একজন বলল, মুক্তার মিঞা যখন রেফারি হইছে তখনই জানি নাড়ে শালারা আজ জেতবে।

আর-একজন বলল, জেতানো বের করে দিতাম, শালা পির মহম্মদ আমাগের ফকরেডারে যদি ঘায়েল না করত। 

এক মাঘে শীত পালায় না। ওই পির মহম্মদের ঠ্যাংউ ভাঙব, এই তোরে কলাম। 

শালারা আজ ত খেলতি আসেনি, কা’জে বাধাতি আইছিল। লাঠি-সোটা নিয়ে কেউ ম্যাচ খ্যালাতি আসে! 

আসুক না ইবার আমাগের মাঠে, পুঁতে ফ্যালব শালাগের। 

চলেক, গুপাল খুড়োরে আজ তো জানাই ব্যাপারটা। 

গোটা কতক ছেলে লাফিয়ে লাফিয়ে নামল নৌকো থেকে। একজনের হাতে একটা ফুটবল কানে বিড়ি গোঁজা। 

সে ছোকরা গিরিবালাকে দেখেই থমকে দাঁড়াল। 

আরে বাস, এ যে দেহি বড়দিদি। একেবারে দুগ্‌গো ঠাকরুনির মতো চিহারা করে ফেলিছ যে! 

বলেই ফুটবল বগলে করেই ঢিপিস করে একটা প্রণাম করল গিরিবালাকে। 

গিরিবালা বিস্ময়ে প্রায় চেঁচিয়েই উঠল, অ মা, নরা! কত বড়ড়া হয়ে গিছিস! গিছিলি কনে?

নরা ভূষণের দিকে একবার চেয়ে গর্বের সঙ্গে জবাব দিল, ম্যাচ খেলতি। আজ মধুপুর পলেনপুর খেলা ছিল কিনা। পলেনপুর আমাগের হায়ার করে নিয়ে গিছিল। 

গিরিবালার খুশিভরা অবাক চোখের সামনে দাঁড়িয়ে হাসতে লাগল নরা 

বারো 

ইস্কুলের ছুটি অনেকক্ষণ হয়ে গিয়েছে। মাস্টারমশাইরা সকলেই চলে গিয়েছেন। সাগর অ্যাকাডেমির হেডমাস্টারের ঘরখানা ছাড়া ইস্কুলবাড়ির আর সব ঘরের দরজা বন্ধ করে শ্রীকণ্ঠ বেহারা বারান্দায় বসে ঢুলছিল। মেজবাবু কখন বাড়ি যাবেন কে জানে? 

ইস্কুলের মাঠে খেলার তোড়জোড় শুরু হয়েছে। হঠাৎ ইস্কুলের ঘণ্টায় ঢং করে শব্দ হতেই ধড়মড় করে জেগে উঠল শ্রীকণ্ঠ। দেখল, কেউ কোথাও নেই, ঘণ্টাটা দুলছে। নীচে একখানা ঝামা ইট পড়ে আছে। শ্রীকণ্ঠ বেজায় চটে গেল। দৌড়ে নীচে নেমে এল, আনাচ-কানাচ খুঁজল, কাউকে পেল না। 

খেলার মাঠের দিকে এগিয়ে যেতেই থার্ড ক্লাসের গোটা আষ্টেক ছেলে ওকে দেখে তালি বাজিয়ে গান গাইতে শুরু করে দিল: ‘ড়সবতী তু কুঁয়াড়ে যাউছি, পায়েতে খড়মড় গলাতে চন্দ্রহাড় নাকেতে বেসড় ঝুলাউছি।’ 

শ্রীকণ্ঠ কটকের লোক। কিন্তু ও বুড়ো হয়ে গেল এ-অঞ্চলেই। আগে ও পালকি বইত। তারপর বহুদিন ধরে হরিশঙ্করপুর ইস্কুলে দপ্তরির কাজ করেছে। বয়েস হলে কাজ ছেড়ে বাড়িতে বসে ছিল। শেষে এই ইস্কুলটার পত্তন হতে, বছর তিনেক ধরে এখানকার কাজে‍ই লেগে আছে। হরিশঙ্করপুরের ইস্কুলটা ছিল বড়। হাই ইস্কুল। আর সাগর অ্যাকাডেমি হচ্ছে এম-ই— মিডিল ইস্কুল। মেজবাবু হেডমাস্টারও বটেন, সেক্রেটারিও বটেন। তা মেজবাবুর সম্পর্কে কোনও নালিশ নেই শ্রীকণ্ঠের। তার অভিযোগ এই ইস্কুলের যত হতভাগা বদমায়েশ, গুন্ডা, বাঁদর ছেলেদের বিরুদ্ধে। সুযোগ পেলেই ওরা শ্রীকণ্ঠকে খেপিয়ে মারে। 

শ্রীকণ্ঠ তাড়া করতেই ওরা দৌড়ে পালাল। তবে আবার একটু দূরে গিয়ে হাততালি দিতে দিতে গান শুরু করল: ‘ড়সবতী তু কুঁয়াড়ে যাউছি, পায়েতে খড়মড় গলাতে চন্দ্রহাড় নাকেতে বেসড় ঝুলাউছি।’ 

শ্রীকণ্ঠ খানিকক্ষণ ছুটাছুটি করে শ্রান্ত হয়ে হার মানল। বিড়বিড় করে বকতে বকতে ফিরে এল। নালিশ করবার জন্য মেজকর্তার ঘরে ঢুকে দেখল, একখানা খোলা চিঠি চাপা দিয়ে রেখে মেজকর্তা গভীরভাবে কী যেন ভাবছেন। শ্রীকণ্ঠ তাঁকে আর বিরক্ত না করে বাইরে গিয়ে বসল। 

মেজকর্তা দু’খানা চিঠি পেয়েছেন সেদিন। একখানা ডিস্ট্রিক্ট ইস্কুল ইন্‌সপেক্টরের, আর একখানা সুধাময়ের। ইন্‌সপেক্টরের চিঠিখানা পড়ে বিরক্ত হয়েছেন তিনি। বিরক্ত হবার কারণও আছে। এত খেটে ইস্কুলটা গড়ে তুলতে চাইছেন তিনি, কিন্তু একটার পর একটা প্রতিবন্ধক এসে তাঁকে কাহিল করে দিচ্ছে। মকর বিশ্বেসই যদিও সব থেকে বেশি টাকা দিয়েছে, তবুও মেজকর্তা গ্রামের আরও অনেকের কাছ থেকে এর জন্য সাহায্য আদায় করেছেন। কেউ জমি দিয়েছে, কেউ বাঁশ-খড়, কেউ বা শারীরিক পরিশ্রম। সাহায্য কেউ কি করতে চায়! এদেশের লোক ঘেঁটুপুজোয়, মনসাপুজোয় ঘটা করে টাকা খরচ করে, এমনকী সরস্বতীপুজোতেও কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢালতে রাজি, কিন্তু ইস্কুল গড়ার ব্যাপারে উপুড়হস্ত করতে চায় না। যা হোক তবুও তো কিছু কিছু তাদের কাছ থেকেও আদায় করেছেন। কিন্তু মেদ্দা ছাহেবের ব্যবহারেই সব থেকে বেশি আঘাত পেয়েছেন মেজকর্তা। মেজকর্তার কাজে শরিক হয়নি মেদ্দা। 

মেজকর্তার ইচ্ছা ছিল, সবাইকে নিয়েই এই ইস্কুলটা গড়ে তুলবেন। এম-ই ইস্কুল নয়, মেজকর্তার ইচ্ছে ছিল একেবারে হাই ইস্কুলের ভিত পত্তন করা। গোপাল বিশ্বাসের ইচ্ছে ছিল না, মেদ্দা ছায়েবকে এর মধ্যে মাথা গলাতে দেয়। কিন্তু মেজকর্তার দৃঢ়তা এবং মকর বিশ্বেসের চাপে গোপালও শেষ পর্যন্ত রাজি হয়েছিল। 

মেজকর্তা তারপর মেদ্দার কাছে গিয়ে প্রস্তাবটা করেন। একটা ইস্কুলের যে দরকার তাঁদের গ্রামে, মেদ্দা ছাহেব সে-কথা স্বীকার করেছিলেন। এও জানিয়েছিলেন যে, এমন একটা বাসনা মেদ্দা ছাহেবের মনে বহুকাল থেকেই আছে। শুনে উৎসাহ বোধ করেছিলেন মেজকর্তা। অনেক আলোচনা, অনেক বৈঠক হল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই দাঁড়াল না। মেদ্দা ছাহেব একটার পর একটা এমন সব শর্ত করতে লাগলেন, যার কোনও মানে নেই। তুচ্ছ সমস্ত ব্যাপার এদের কাছে দারুণ গুরুত্ব নিয়ে হাজির হতে লাগল। 

প্রথম ফ্যাকড়া উঠল নাম নিয়ে। সাগর অ্যাকাডেমি নামটা মেদ্দা ছাহেবের পছন্দ নয়। মেদ্দা ছাহেব স্পষ্টাস্পষ্টি মেজকর্তাকে কিছু বলেননি। কিন্তু নানান রকমে তাঁর আপত্তিটা বুঝিয়ে দিয়েছেন ঠিকই। কিন্তু তা কী করে হয়? মকর বিশ্বেস টাকা দিয়ে ইস্কুল করে দিচ্ছেন তাঁর বাবার নামে। এই শর্ত মেনে নিয়েই মেজকর্তা কাজে হাত দিয়েছেন। অনেক দূর এগিয়েও গিয়েছেন। এখন তাঁকে কী করে বলা যায় যে ইস্কুলের নামটা বদলে দিতে হবে? আর তাতে রাজিই বা হবেন কেন তিনি? 

দ্বিতীয় ফ্যাকড়া মেদ্দা তুলেছিলেন ইস্কুলের কমিটি বানাবার ব্যাপারে। তিনি বললেন ইস্কুল কমিটির মেম্বর অর্ধেক হবে মুসলমান আর বাকি অর্ধেক হবে হিন্দু। আবার হিন্দুদের সংখ্যার ভিতর শিডিউল কাস্টও থাকা চাই। 

মেদ্দা ছাহেবের এই প্রস্তাবে গোপালরা খুব গরম হয়ে গেল। মেজকর্তা আকাশ থেকে পড়লেন। এরা যে এর মধ্যে রাজনীতি ঢুকিয়ে ফেলবে, মেজকর্তা সেটা বুঝতে পারেননি। তাঁর ইচ্ছে ছিল বাছা বাছা ক’জন লোক নিয়ে ইস্কুল কমিটিটা তৈরি করবেন। ইস্কুলের উন্নতিই হবে এই কমিটির আদি এবং অকৃত্রিম উদ্দেশ্য। মেদ্দা ছাহেবকে বোঝাবার অনেক চেষ্টা করেছিলেন মেজকর্তা। বলেছিলেন, এটা ইস্কুল, ইউনিয়ন বোর্ড নয়, জেলা বোর্ড নয়, কি কাউন্সিলও নয়। ইস্কুল কমিটিতে বেছে-গুছে লোক নিলেই কাজ ভাল হবে। 

মেদ্দা ছাহেব সে-কথায় ভোলেননি। বলেছিলেন, তিনি যে কাজই করুন না কেন, মোছলেম দুনিয়ার খেদমত যেন তাতে হওয়া চাই। মোছলেম স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হয়, এমন কোনও কাজ তিনি জান গেলেও করতে পারবেন না। মেদ্দা এও শুনিয়েছিলেন, এখন মোছলেম দুনিয়ার ঘুম ভাঙতে লেগেছে। নিজেদের অধিকার সম্মান ইত্যাদি ব্যাপারে তাঁরা খুব সচেতন হয়ে উঠেছেন। বিশেষত যে-সব ছোকরা লেখাপড়া শিখছে, তারা। মেদ্দা মাতব্বর হলে কী হবে, কওমের রায়ের বিরুদ্ধে যাবার কোনও ক্ষমতা তাঁর নেই। 

.

আসলে এসব কথা যে মেদ্দার নয়, তার জামাইয়ের, সে-কথা বুঝতে দেরি হয়নি মেজকর্তার। মেদ্দাকে তিনি দীর্ঘকাল ধরে চেনেন। তাঁর দুঃখ লাগল, মেদ্দার মতো লোকও এইরকম গোটা কতক অসার বুলি পাখি-পড়ার মতো করে বলতে শুরু করেছে। আবার তাও কার কাছে? না, তাঁরই কাছে। মেদ্দার জামাই, ওই মোক্তার মিঞার সঙ্গেও তাঁর কথা হয়েছে। ছোকরা এখন নামের আগে মৌলভি লিখতে শুরু করেছে। বয়েসে সুধার চেয়ে বড় হবে না, কিন্তু এরই মধ্যে নুর গজিয়ে দিব্যি ভারিক্কি হয়ে উঠেছে। মোক্তার মিঞা বললে বিরক্ত হয় এখন। এখন সে মৌলভি মোদাব্বের হোসেন। চালু নাম মোক্তার মিঞা। 

ওই মোক্তার মিঞাই এখন প্রকৃতপক্ষে এ অঞ্চলে মুসলমান-সমাজের মাতব্বর। মেদ্দা ধীরে ধীরে শিখণ্ডীতে পরিণত হচ্ছে। সেই ছোকরাই সি আর দাশের দোহাই পেড়ে গেল মেজকর্তার কাছে। শুনিয়ে গেল হিন্দু-মুসলিম প্যাক্টের কথা। সি আর দাশ নাকি স্বরাজ্য চুক্তিতে কবুল করেছেন, হিন্দু-মুসলমানের স্বতন্ত্রভাবে অধিকার আদায়ের হক আছে। জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্বের দাবি স্বীকার করেছেন ব্যারিস্টার নেতা সি আর দাশ। কাজেই সে চুক্তি ইস্কুল কমিটির বেলাতেই বা মান্য করা হবে না কেন? মোক্তার মিঞা মেজকর্তাকে প্রশ্ন করেছিল। তবে কি সি আর দাশের চুক্তি ভূয়া? নাকি হিন্দুরা এখন কথার খেলাপ করছে? 

প্রশ্নটার পিছনে জোর ছিল। মেজকর্তা মোক্তার মিঞার মুনশিয়ানা দেখে চমৎকৃতও হয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে এক রাজনৈতিক অবিমৃশ্যকারিতার মারাত্মক পরিণামের কথা ভেবে শঙ্কিতও বোধ করছিলেন। দাশ সাহেব ইলেকশনের বৈতরণী পার হতে গিয়ে যে বিষবৃক্ষের চারায় সার জল ঢেলেছিলেন, এই দু’বছরে তার শিকড় কত দূরে প্রসারিত হয়েছে! অ্যাঁ! দাশ সাহেবের মতো ব্যক্তিত্বকেও সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে আপস করতে হল! কী পেলেন তিনি? কাউন্সিলে একচ্ছত্র মেজরিটি। কীসের জন্য? দলবদ্ধভাবে গবর্নরের কাউন্সিলে বাধা সৃষ্টির জন্য। 

মেজকর্তা যেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করছেন। এই দু’বছরে কী করলেন দেশবন্ধু? মন্ত্রীদের বেতন যাতে না বাড়ে, শুধু তাই নিয়ে হইচই। এর পরিবর্তে কী দিতে হল? সাম্প্রদায়িকতার বাঘের মুখে মাংসের টুকরো। যে আন্দোলন মানুষের মন থেকে এই হিংস্র বাঘকে চিরতরে তাড়িয়ে দিত, তেমন কোনও আন্দোলন গড়ে উঠল না কেন? না, তা হলে যে জনতার প্রিয় হওয়া যেত না। অনেক অপ্রীতিকর সমস্যার মুখোমুখি দাঁড়াতে হত যে। ভেলকি দেখানো যেত না। তাই কোনও নেতাই তো সেদিকে পা বাড়ালেন না। 

মেজকর্তা আপন মনেই বললেন, সে-আন্দোলনে যে উত্তেজনা নেই। উত্তেজনা না ছড়ালে কোনও আন্দোলন যে গড়ে তোলাও যায় না। তাতে যে ঘটা করে লোক জমানো যায় না। আর এই অনড় অথর্ব সমাজটার মূল ধরে যে নাড়া দিতে হত তাতে। মেজকর্তা ভাবলেন, তাতে প্ৰিয় হওয়ার চাইতে অপ্রিয় হওয়ার ভয়ই যে বেশি। 

একটা সোজা কথা কেন আমরা ভুলে যাই! বারবার নিজেকেই বলেছেন মেজকর্তা। ভিত যদি আলগা থাকে, তা হলে তার উপর ইমারত গড়ে যত রংই লাগাই না কেন, সে ইমারতের আয়ু বেশি হতে পারে না। নোনা ইটে কি মজবুত দালান বানানো যায়? আমরা হিন্দু, আমরা মুসলমান, আমরা খ্রিস্টান, আমরা উচ্চবর্ণ, আমরা নিম্নবর্ণ এই যদি আমাদের পুঁজির প্রধান কড়ি হয়, তবে কতদূর যেতে পারি আমরা? মেজকর্তা অন্তত তার হদিশ জানেন না। 

আকর থেকে লোহা এনে, সমস্ত আবর্জনা থেকে লোহাটাকে যেমন নিষ্কাশন করে ইস্পাত বানাতে হয়, তেমনি করে সাম্প্রদায়িকতার আবর্জনার মধ্য থেকে ব্যক্তি মানুষকে নিষ্কাশিত করে আনতে পারলে তবেই স্বাধীন সমাজ পত্তন করা সম্ভব। সে-বিষয়ে মেজকর্তার মনে কোনও দ্বিধা নেই। নেই বলেই তো বুড়ো বয়সের শক্তিটুকু একত্র করে একটা চেষ্টায় নেমেছিলেন। সব দিক থেকে বাধা পেয়ে পেয়ে এখন কেমন যেন হাঁপিয়ে উঠছেন। 

মেজকর্তার ইচ্ছে ছিল, সংস্কারমুক্ত শিক্ষার একটা ঘাঁটি তৈরি করবেন। যে শিক্ষা মানুষকে মানুষের মূল্যে গ্রহণ করবার প্রেরণা জোগাবে, সেই শিক্ষা বিতরণের চেষ্টা করবেন। 

তাঁর কলেজি জীবনের চাপা-পড়া স্মৃতি বহুদিন পরে তাঁকে আবার হাতছানি দিয়ে ডাকতে শুরু করেছিল। বারবার শুধু তাঁর দুটি লোকের কথা স্মরণ হতে থাকে। ডিরোজিও আর বিদ্যাসাগর। দু’জনেই শিক্ষাদাতা। শেষ কথা বলার বাতিক ওঁদের কারওরই ছিল না। শিখবার প্রবৃত্তিকে উসকে দিয়েই ওঁরা কাজ শেষ করেছেন। ওঁদের জ্বালিয়ে-দেওয়া মশালের আলোই আজ আমাদের এতদূরে এগিয়ে এনেছে। মেজকর্তা ভাবেন, কিন্তু দুর্ভাগ্য এই, সে আলো আরও চারিদিকে ছড়িয়ে দেবার চেষ্টা আর হচ্ছে না। 

তাই তো তিনি শেষ পর্যন্ত মকর বিশ্বেসের প্রস্তাবে রাজি হয়ে পড়লেন। ইচ্ছে ছিল সকলকে নিয়ে পথ চলবেন। পারলেন কই? 

মেদ্দারা সরে পড়ল। সরেই শুধু পড়ল না, মেজকর্তা ইস্কুল খোলবার এক বছরের মধ্যেই মেদ্দারা, একটু দূরে, মোছলেম মিডল মাদ্রাসা খুলল খুব হইচই করে। এস ডি ও মুনির হোসেন সাহেবকে নিয়ে উদবোধন করাল মোক্তার মিঞা। এস ডি ও সাহেবকে করল প্রেসিডেন্ট, নিজে সেক্রেটারি হল। দশ হাজার টাকা মোছলেম কওমের তরক্কির জন্য এককালীন দান করে মেদ্দা সরকারের সুনজরে পড়ে গেল। খুব গুজব, এই বছরের নিউ ইয়ারে মেদ্দা যাতে খান সাহেব খেতাব পান এস ডি ও তার জন্য সরকারের কাছে খুব দরবার চালাচ্ছেন। খেতাব পাবার পর হজ্জ করতে যাবেন মেদ্দা সাহেব। 

.

কিন্তু এখন, এই নির্জনে বিকালে, ছুটির পর ইস্কুলে বসে বসে সেজন্য বিরক্ত হয়ে ওঠেননি মেজকর্তা। মেদ্দা ছাহেব খেতাব পান, হজ্জে যান, এমনকী মাদ্রাসা খোলার জন্য খয়রাত করাতেও তাঁর বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ মেজকর্তার অন্তরে নেই। তিনি দুঃখ পেয়েছেন, শঙ্কিতও হয়ে উঠেছেন, এ-কথা সত্য। তবে সে অন্য কারণে। দুনিয়ার হাওয়া যেভাবে বদলাচ্ছে, তা দেখেই কিছুটা হতাশা বোধ করছেন তিনি। 

সমস্ত বিচার বিবেচনা ত্যাগ করে সরকার এখন মুসলমান-সমাজকে মাথায় তুলে নাচতে শুরু করেছেন। পরিণাম ভাল নয় বলেই শঙ্কা জাগছে মেজকর্তার। এ গ্রামে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে রেষারেষি প্রকাশ্য বিরোধিতায় এসে দাঁড়াবে, এ কখনও ভাবেননি মেজকর্তা। 

মুসলমান-সমাজ নতুন প্রভু ইংরেজদের কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েছিল। এখন দ্রুত সে দূরত্ব কমাতে তারা উঠে-পড়ে লেগেছে। হিন্দু-সমাজ পুরনো প্রভু মুসলমানদের বিকল্প বলেই ইংরাজদের কাছে সরে এসেছিল। তাদের ভালমন্দ দোষগুণ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অনেকদিন ধরে আত্মসাৎ করেছে হিন্দু-সমাজ। ইংরাজি-শিক্ষায় শিক্ষিত, নিতান্ত চাকুরিনির্ভর এক মধ্যবিত্ত শ্রেণী সৃষ্টি হয়ে উঠেছে হিন্দু-সমাজের মধ্যে। বিশেষ করে কেরানিদের জন্মভূমি এই বাংলাদেশে। কী অদ্ভুত এই মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়! বিপরীত ভাবধারার শত স্রোতে ভাসা। 

মাঝে মাঝে অবাক লাগে মেজকর্তার। ইয়োরোপে একদিন শিল্পবিপ্লব হল, ফরাসি-বিপ্লব হল। পুরাতন কাঠামো ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে বেরিয়ে এল এক মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়। চিন্তায়, কর্মে জীবিকার্জনের উপায়ে যারা একেবারেই নতুন। পৃথিবীর রংই যারা বদলে দিল। মানুষ সম্পর্কে ধারণার ভূগোল অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামির সংকীর্ণ সীমানা পেরিয়ে বৃহত্তর পরিধিতে ব্যাপ্ত হয়ে পড়ল। যুক্তি, বিবেক, বিজ্ঞানকে অবলম্বন করে মানুষের নতুন মূল্য নির্ধারিত হল। ইয়োরোপের মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের এই হল নতুন অর্ঘ্য। 

আর আমরাও মধ্যবিত্ত। মেজকর্তা নিজেকে শোনাতে লাগলেন। অতীতের কিছুই বর্জন করিনি আমরা। শুধু একটা নতুন কুর্তা গায়ে চাপিয়ে পুরনো চেহারা ঢাকা দিয়েছি। ইংরেজের মারফত আমরা এই মধ্যবিত্তয়ানা পেয়েছি। যেন মেকেঞ্জি লায়ালের নিলামখানা থেকে কেনা পুরনো সোফা কৌচ দিয়ে মানসচেতনার চণ্ডীমণ্ডপটা সাজিয়েছি শুধু। তাই আমাদের ব্রাহ্মণত্ব ঘোচেনি, হিন্দুয়ানি যায়নি। তাই প্রতিবেশী হিসেবে বাস করেও মুসলমানদের আমরা মানুষ বলে ভাবতে শিখিনি। এবার মুসলমানও মধ্যবিত্ত হয়ে উঠছে। ইস্কুল কলেজে ইংরেজি বিদ্যায় হাতেখড়ি নিচ্ছে। আর তাদের মধ্যে মনুষ্যত্ব যত-না জাগছে, মুসলমানত্ব তার চেয়েও দারুণ বেগে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। উঠতির মুখে সদ্য-লব্ধ সাম্রাজ্য হাতে রাখার জন্য ইংরেজ এককালে হিন্দুতোষণ শুরু করেছিল। এখন পড়তির মুখে এসে সেই সাম্রাজ্য কোনওমতে টিকিয়ে রাখবার জন্য সেই ইংরেজ আজ মহোৎসাহে মুসলমান-তোয়াজ শুরু করেছে। স্বদেশ থেকে মানব-প্রেম, ন্যায় নিরপেক্ষতার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে এসে ইংরেজ এদেশে, বিভেদ, বিদ্বেষ আর ঘৃণার বীজ বপন করছে। অদৃষ্টের কী নিদারুণ পরিহাস! 

টেবিলের উপর যে সরকারি চিঠিখানা পড়ে ছিল, সেদিকে চেয়ে তিক্ত হাসি হাসলেন মেজকর্তা। 

.

ডিস্ট্রিক্ট ইস্কুল ইন্‌সপেক্টার লিখেছেন, আপনার ইস্কুলকে সরকারি স্বীকৃতি আপাতত দেওয়া সম্ভব হইল না। তজ্জন্য দুঃখিত। দুইটি কারণে এই সিদ্ধান্ত নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমাদিগকে গ্রহণ করিতে হইল: 

(১) আপনাদের গ্রামেরই একটি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, মোসলেম মিডল মাদ্রাসাকে এবার স্বীকৃতি দিতে হইয়াছে। কারণ মাইনরিটি কমিউনিটির মধ্যে শিক্ষার প্রসারের অগ্রাধিকার দানই বর্তমান সরকারি নীতি। 

এবং (২) আপনার কমিটি যথোপযুক্ত প্রতিনিধিত্বমূলক নয় বলিয়াও আমরা মনে করি। কমিটির পুনর্গঠন সম্পর্কে আপনারা বিবেচনা করিবেন, আশা করি। নিবেদন ইতি, রায় সাহেব আর সি মিত্র, ডি-আই অব স্কুলস্। 

মেজকর্তা চিঠিখানা আরেকবার পড়ে বিরক্ত হয়ে ড্রয়ারে রেখে দিলেন। এম ই ইস্কুলের অনুমতিও পাওয়া গেল না! বেশ! মেজকর্তা ভাবলেন, কড়া একখানা জবাব কাল মুসোবিদে করতে হবে। আর ইস্কুলটাকে এ বছরই হাই ইস্কুলের স্ট্যান্ডার্ডে তুলে দিতে হবে। আমার ছাত্ররা নিজের জোরেই দাঁড়াতে পারবে। দু’বছরের মধ্যেও যদি সরকারি স্বীকৃতি না পাই, তবে ছেলেদের হরিশঙ্করপুরের ইস্কুল থেকে পরীক্ষা দেওয়াব। তারপর ধরনা দেব বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে। আশু মুখুজ্জের দ্বারস্থ হব। 

তুড়ি মেরে আমাকে উড়িয়ে দেবে ভেবেছ! পারবে না। চিঠিখানার উদ্দেশে মেজকর্তা বেশ জোরেই কথাগুলো বলে উঠলেন। 

শ্রীকণ্ঠ সঙ্গে সঙ্গে ভিতরে ঢুকল।

মেজকর্তা বললেন, কী চাই রে?

শ্রীকণ্ঠ বলল, আপুনি ডাকিলা নাকি? 

মেজকর্তা বললেন, না তো। হ্যাঁ, শোন, আমার দেরি হবে, তুই বাড়ি যা। চাবিটা আমাকে দিয়ে যা। লন্ঠনটা জ্বেলে দিয়ে যাস। 

.

ইস্কুল ইন্‌সপেক্টরের চিঠিখানা পড়ে মেজকর্তা বিরক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু সুধাময়ের সুদীর্ঘ চিঠিখানা তাঁকে ভাবিত করে তুলল। 

সন্ধ্যা হয়ে আসছে। ইস্কুলের মাঠে আর ছেলে নেই একটাও। বাজার করে নিয়ে অনেকে হাটতলা থেকে বাড়ি ফিরতে শুরু করেছে। কারও কারও কথাবার্তা কানে এসে লাগছে। চেহারাগুলো ধীরে ধীরে স্পষ্টতা হারিয়ে ফেলছে। শ্রীকণ্ঠ যাবার সময় লণ্ঠনটা হাতের কাছে রেখে গিয়েছিল। মেজকর্তা সেটা উসকে নিলেন। তামাক খাবার ইচ্ছে হচ্ছিল খুব। কিন্তু এখানে কোনও সরঞ্জাম নেই। 

তিন বছর বাড়ি আসেনি সুধাময়। বড়দা, মেজদি, বড়বউ ওর বিয়ের জন্য অস্থির হয়ে উঠেছেন। মেজকর্তারও ইচ্ছে, সুধাময় এবার বিয়ে করুক। কিন্তু কোথায় সুধাময়? সেই কবে পরীক্ষায় পাশ করার খবর দিয়ে লিখেছিল, চাকরির চেষ্টায় সে ব্যস্ত, তাই আসতে পারবে না। তার অনেক দিন বাদে লিখল, শত চেষ্টাতেও চাকরি জোগাড় করতে পারছে না। তারপর কিছুদিন বাদে লিখল, আসাম বেঙ্গল রেলে একটা কাজ পেয়ে সে লামডিং চলল। হঠাৎ কাজে চলে যাওয়ায় বাড়ি আসার সময় পেল না। দু’মাস না-যেতেই সে কাজ গেল, সে-কথাও জানিয়েছিল কলকাতায় এসে। ব্যস, আর তাঁর কোনও পাত্তাই নেই। কারও চিঠির জবাব দেয় না। কী করছে না-করছে, সে সবও কিছু লেখে না। মেজকর্তা এবার ওকে বিশেষ করে আসতে লিখেছিলেন। আসতে বলার কারণ কী তাও জানিয়েছিলেন। তারই জবাব দিয়েছে সুধাময়। মেজকর্তা প্রায় দু’মাস আগে চিঠিখানা লিখেছিলেন আর তার জবাব পেলেন আজ। 

সুধাময় স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছে, আপাতত বিয়ে করার বাসনা তার নেই। কারণ, নিদারুণ অনিশ্চিত এক ভবিষ্যতের মধ্যে সে বাস করছে। কোনও চাকরিই সে আর জোগাড় করতে পারেনি এর মধ্যে। পারবে কি না, তাও জানে না। এমতাবস্থায় বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা ছাড়া তার গত্যন্তর নেই। এর জন্য সুধাময় সকলের কাছেই ক্ষমা চেয়েছে। 

বড়বউ শুনলে খুব দুঃখ পাবে। সুধা-অন্ত প্রাণ তার। সুধাময়কে একবার দেখবার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে। কিন্তু মেজকর্তা সে জন্য বিশেষ উদ্‌বিগ্ন হননি। ভাবিত হয়েছেন অন্য ব্যাপারে। 

সুধাময় লিখেছে: 

অনুভব করছি এমন একটা কিছু করার যাতে সব গ্লানির মোচন হয়। নিশ্চিন্তভাবে বুঝতে পেরেছি, ইংরেজ যতকাল এদেশে আছে আমাদের কোনও ভবিষ্যৎ নেই। আমার দেশে আমি প্রতিষ্ঠা পাব না। আমার দক্ষতা যতই থাকুক, জ্ঞান যত বেশিই থাক, কিন্তু আমি ইংরেজ নই— মাত্র এই কারণেই যোগ্য পদে আমাকে নিয়োগ করা হল না। নিতান্ত অজ্ঞ এক ইংরেজের বাচ্চাকে তিনগুণ মাইনে দিয়ে আমার উপর বসিয়ে দেওয়া হল। সেই অপমানে আমি রেলের চাকরি ছেড়েছি, কিন্তু অপমানের জ্বালা ভুলতে পারছি না। শুধু এই একটি মাত্র ঘটনাই নয়। আরও অনেক দাগ বুকে জমেছে। চাকরি করার মোহ আমার ঘুচেছে। মেজকাকা, চাকরি আর করব না, এ সিদ্ধান্ত খুব সহজে নিতে পারিনি। জানি আপনারা দুঃখ পাবেন। আপনাদের অনেক আশা ছিল আমার উপর। সে আশা পূর্ণ করতে পারলাম না। বাবার মুখ, মায়ের মুখ আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। ধিক্কার দেবার জন্য তৈরি হয়ে আছেন তাঁরা। কিন্তু কী করব? 

মেজকর্তা চিঠিখানা পড়তে পড়তে দুঃখ পেলেন মনে। না, না, ধিক্কার দেব কেন? যেন সুধাকে সান্ত্বনা জানালেন। তোমার তো দোষ নেই কিছু। 

আবার তিনি পড়তে শুরু করলেন: 

কিন্তু কী করব? ইউনিভার্সিটির সার্টিফিকেট থাকলেই চাকরি পাওয়া যায় না। চাকরি যদি পেতে চাই তা হলে হয় আমাকে ইংরেজ, নয় মুসলমান আর নইলে শিডিউলড কাস্ট হতে হবে। 

আহা বেচারা! মেজকর্তার মন সমবেদনায় ভরে উঠল। তিনি পড়ে চললেন: দেশের মুক্তি না হলে, আমার দেশ আমার না হলে, আমার কোনও ভবিষ্যৎ নেই। তাই কাকা, এখন আমি কাজের মতো কাজে লাগব, এমন কাজ, যার মূল্য কখনও কমবে না, যার গৌরব ম্লান হবে না। যে পথে আমরা চলেছি, সে পথে ফুলের মালা নিয়ে আমাদের জন্য কেউ অপেক্ষা করে থাকবে না তা জানি। জীবনের জয়গান জহ্লাদের শোণিতসিক্ত হাতে যাঁরা রচনা করে গেছেন, তাঁদেরই অনুসরণ শ্রেয়। 

সুধাময়ের চিঠিখানার নীচের অংশে শব্দে শব্দে যে আক্রোশ ফুটে বেরুচ্ছে তাই নয়, কেমন একটা স্থূলতার পরিচয়ও সর্বত্র ছড়ানো। পরিষ্কার অর্থই বা কী? কী করতে চায় সুধাময়? 

একটা জিনিস বোঝা গেল, সুধাময় আবার দেবতা বদলেছে। স্পষ্টই লিখেছে: কাউন্সিলে ঘটা করে ঢুকে বিরোধিতা-বিরোধিতা খেলায় ইংরেজের শাসন টলানো যাবে না, অহিংসার নির্বীজ প্রতিরোধেও মহামান্য সম্রাট বাহাদুরের আসন তিলমাত্র সরানো যাবে না। সভার মঞ্চে দাঁড়িয়ে ‘স্বরাজ চাই, স্বরাজ চাই’ বলে চেঁচালেও ইংরেজ স্বরাজ দিয়ে দেবে না। ইংরেজকে তাড়াবার ভাষা একটিই আছে, বুলি নয়— গুলি, এ-কথা যাঁরা বলেন তাঁরা আমার নমস্য। 

না, সুধাময় কোনও অস্পষ্টতা রাখেনি। নূতন দেবতা প্রতিষ্ঠা করেছে, সে-কথা বোঝাই যাচ্ছে। অসহিষ্ণু, একালের ছেলেরা বড্ড অসহিষ্ণু। মেজকর্তার মনে পড়ল তাঁর কলেজি জীবনের কথা। 

তখন তাঁদের মনেও দেশাত্মবোধ জাগ্রত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এমন ক্ষিপ্ততার মধ্য দিয়ে নয়। উত্তেজনা যে কম ছিল তাও তো নয়। মেট্রোপলিটন কলেজে গিয়ে যেবার তিনি ভরতি হলেন, সেইবারই কী দারুণ হইচই হয়ে গেল সুরেন বাঁড়ুজ্জেকে নিয়ে! ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস থেকে সুরেন্দ্রনাথকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। তাই নিয়ে ছাত্রমহলে কী সাংঘাতিক আলোড়ন! সি আর দাশ তখন শুধুমাত্র চিত্তরঞ্জন। প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র। কলকাতার অবিসংবাদী ছাত্রনেতা। তাঁর পোশাক-আশাকের বাহার দেখেই গ্রামের এই লাজুক ছাত্রটির তখন চোখ ছানাবড়া হয়ে যেত। তখন ছিল স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিপত্তি। গরম গরম বক্তৃতা তখনও শুনেছিলেন মেজকর্তা। পরাধীনতার গ্লানি অন্তরে বেজেছে। তবু যেন ইংরেজের প্রতি তীব্র বিদ্বেষ তখন জেগে ওঠেনি। 

বিশ্বাস ছিল তাঁর ন্যায়বিচারের প্রতি। তাঁর শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের মধ্যে এমন অনেকে ছিলেন, যাঁরা মনে করতেন ইংরেজের সংস্পর্শে এসে নতুন ভাবধারায় দীক্ষিত হয়েছি আমরা। আমরা উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারলে, আমাদের ভাগ্য গড়বার অধিকার আমরা ইংরেজদের কাছ থেকে পেয়ে যাব। তাঁদের বিশ্বাস ছিল, মানবতার উদার বন্ধনে দুটো দেশের মনে রাখী বাঁধা হবে। ভারত আর ইংলন্ড, এ তো শুধু মাত্র দুটো পৃথক ভৌগোলিক সীমানা নয়, দুটো সভ্যতার প্রতীক। 

মেজকর্তা ইতিহাসের ছাত্র ছিলেন। তিনি জানেন, সভ্যতা কোনও বিশেষ জাতির বা দেশের রপ্তানিযোগ্য মাল নয়। সভ্যতায় সমগ্র মানবজাতিরই অধিকার আছে। পৃথিবীর যে-কোনও কোণেই সভ্যতার উন্মেষ হোক না কেন, তার প্রসাদ মানুষ মাত্রেরই প্রাপ্য। এ-অধিকার থেকে কেউ কাউকে বঞ্চিত করতে পারবে না। ভারত একদিন সভ্যতার শীর্ষে উঠেছিল। একদিন আবার সে ধীরে ধীরে নেবে গেল। উঠল আরব সভ্যতা। তার কাজ শেষ করে সে বিদায় নিল। ইয়োরোপীয় সভ্যতার পুনর্জাগরণ হল। ভারতীয় সভ্যতার সুকৃতির বহু ফল আরব সভ্যতা আত্মস্থ করেছিল, আরব সভ্যতার অনেক রোশনাই ইয়োরোপের নতুন সভ্যতার উন্মেষে সাহায্য করেছে। ইয়োরোপীয় সভ্যতার একটি ধারাই ইংরেজ আবার বয়ে এনেছে। তাই তো আশা হয়েছিল, এই নতুন সভ্যতার সংস্পর্শে এসে ভারতের জড়ত্ব ভাঙবে। ছোট ছোট নিষেধের বন্ধনে যে বিরাট মানবাত্মা সতত পীড়িত হচ্ছিল এদেশে, নবীন স্রোতের বিরাট প্লাবনে সেসব বাধা-বন্ধ ঘুচে যাবে। 

কিন্তু সে আশা সফল হয়নি। শিক্ষকের ভূমিকার চেয়ে ইংরেজ শাসকের ভূমিকার প্রতিই পক্ষপাত বেশি দেখাল। এতে সে জগতের ক্ষতিই শুধু করেনি, নিজেকেও অনেক দীনতার মধ্যে নিক্ষেপ করেছে। নিজের সভ্যতা, নিজের সংস্কৃতির প্রতিই চরম বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। গণতন্ত্রের প্রবক্তা ইংরেজ ভণ্ড বলে পরিগণিত হয়েছে। 

আপাতবিরোধিতার জন্ম ইংরেজ যে এদেশে কত দিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। যে ইংরেজি শিক্ষা এককালে সমগ্র ভারতে একাত্মবোধের জন্ম দিয়েছিল, সেই ইংরেজি শিক্ষাই এখন ‘ডিভাইড অ্যাড রুলে’র চক্রান্তে সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতা আর প্রাদেশিকতার জন্ম দিচ্ছে। এমন দিন আসবে, মেজকর্তা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন আসবেই, যখন এই ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত লোকেরাই সমস্তরকম সংকীর্ণ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবে। গোঁড়ামির ধারক-বাহক এবং প্রচারক হবে। 

এদেশের চিন্তারাজ্যে যে অগ্নি-সংস্কার হওয়া উচিত ছিল, ইংরেজ তা ঘটতে দেয়নি। সে পুরাতনের সঙ্গে সর্বতোভাবে রফা করেছে। তাই অধ্যাত্মবাদের জীর্ণ খোলস এখনও আমরা আঁকড়ে ধরে বসে আছি। শিল্প-বিপ্লবের প্রসার হতে ইংরেজ দিল না, দীর্ঘদিনের আন্দোলনের দ্বারা যে ইংরেজ নিজের দেশে সামন্ততন্ত্রের উচ্ছেদ করল, জীবিকা অর্জনের নতুন উপায় বের করল বিজ্ঞানের কল্যাণে, সেই ইংরেজই ভারতে গাঁটছড়া বাঁধল সামন্ততন্ত্রের সঙ্গে। রফা রফা রফা। স্বভাবজ বানিয়া বুদ্ধির নির্দেশে ইংরেজ শুধু রফাই করে গেল। নইলে নিজের পণ্য এদেশে যে বেচা যায় না। 

নিজের দেশে যে ইংরেজ আইনের রাজ প্রতিষ্ঠা করেছে, সেই ইংরেজ ‘রুল অব ল’ ছেড়ে ভারত শাসন শুরু করল ‘রেগুলেশন লাঠি’র দাপটে। নিজেকে বারবার অস্বীকার করেছে ভারতের ইংরেজ প্রতিনিধিরা। 

যে লিবারেল ভাবধারা এদেশে উনিশ শতকে জন্মগ্রহণ করেছিল, ইংরেজ তাকে বুঝতে পারেনি। অবহেলা উপেক্ষায় তার পরিপুষ্টির অভাব ঘটিয়েছে। এবং তার ফলে উগ্র হিংস্র ইংরেজ-বিদ্বেষের সৃষ্টি হয়েছে এদেশে। সুধাময়দের রক্তে বিদ্বেষের সেই আগুনই বুঝি দাউদাউ করে জ্বলে উঠছে আবার। এরই নাম কি প্ৰতিফল? 

মেজকর্তার চোখের উপর কত আন্দোলন হয়ে গেল, কত ঝড় বয়ে গেল। বঙ্গভঙ্গ, স্বদেশি, সন্ত্রাসবাদ, নন-কো-অপারেশন, সিভিল ডিসওবিডিয়েন্স— নরম গরম অনেক আন্দোলন। কতরকম দাবি উঠল। হোমরুল, ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস। এখন ‘স্বরাজ চাই’তে এসে ঠেকেছে। 

দেশে নাড়া যে পড়েছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই মেজকর্তার। সন্দেহ আছে এই নাড়ার পরিণাম সম্পর্কে। বিদ্বেষের আগুন শুধু পরকে পুড়িয়েই থামে না, নিজের মুখও যে পোড়ায় সম্ভবত সে-কথা বোঝবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে সুধাময়। সুধা তো ছেলেমানুষ। মগজের চেয়ে রক্তের তেজেই বেশি বিশ্বাস তার। সুধাময় না হয় ছেলেমানুষ। কিন্তু নেতারাও কি একই ঘূর্ণিতে ঘুরপাক খাচ্ছেন না? 

গতকালের অমৃতবাজারে লিখেছে, মেজকর্তা পড়ছিলেন, গোলটেবিল বৈঠকের কথাবার্তা চলছে। ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস যদি নাই দাও, তবে ওরই কাছাকাছি দায়িত্বশীল সরকার একটা গঠন করতে দাও, আপাতত তাতেই চলবে। নেতাদের নাকি এখন এই ভাব। 

সুধাময়রা ওতে সন্তুষ্ট নয়। উগ্রতার পথ অবলম্বনের কথা ওরা ভাবছে। মেজকর্তা অন্য কথা ভাবছেন। রাজনীতিক চেতনা আমাদের যতদূর বিকশিত হবার তা তো হয়েছে। সামাজিক চেতনা আমাদের সেই তুলনায় এগিয়েছে কি? রাজনৈতিক পরিবর্তনে দেশ খানিকটা এগোয়, মানুষ এগোয় সামাজিক পরিবর্তনে। সম্ভবত এ-কথা বোঝার মতো ধৈর্য আজ আর কারওর নেই। 

নাঃ, সুধা চিন্তায় ফেলেছে তাঁকে। ওর সঙ্গে দেখা হওয়া দরকার। কলকাতায় শেষ পর্যন্ত তাঁকে যেতেই হবে? হবে বই কী? সুধার এই চিঠির পর কি নিশ্চিন্ত হয়ে থাকা যায়! নরা হাঁফাতে হাঁফাতে এসে বলল, মাজেবাবু, বড়দি আর জামাইবাবু আয়েছেন। মেজকর্তার মাথায় সুধাময়ের কথাই ঘুরছিল। চমকে উঠলেন। 

সুধা এসেছে? 

নরা বলল, না, বড়দি আর জামাইবাবু আর তিনাগের ছাওয়াল। বাবু, বড়মা কয়ে দেলেন, বাজার করে নিয়ে যাতি হবে আপনারে। ঘরে তো সব বাড়ন্ত হয়েছেন। 

মেজকর্তার বুকটা হঠাৎ খুশির ঢেউয়ে তোলপাড় করে উঠল। হঠাৎ গিরিবালারা এল কেন? আগে তো লেখেনি কিছু! 

নরাকে বললেন, আলোটা নিবো। দরজায় তালা দে। চল, যাই। 

তেরো 

নেড়ি কুকুরের বাচ্চা দুটো বড় অসভ্য। একটুও কথা শুনছে না। শঙ্খ অনেক কষ্টে ওদের জন্য একটা নৌকো জোগাড় করেছে। নৌকো মানে সুপারি গাছের আস্ত একটা ডেগো। গোড়ার দিকটা ডোঙা মতন। সেইটে হল শঙ্খর নৌকো। 

অবশ্য এ নৌকোর আবিষ্কর্তা শঙ্খ নয়, নরা। নৌকো চড়ে মামাবাড়ি এসে নৌকো চড়ার শখ চেপেছে শঙ্খর। দিন চারেক বায়না ধরবার পর হঠাৎ নরার মাথায় বুদ্ধি খেলেছে। সুপারির ডেগো কুড়িয়ে এনে তার ডোঙায় শঙ্খকে বসিয়ে উঠোনময় টেনে নিয়ে বেড়িয়েছে তাকে। নে, কত নৌকো চড়বি চড়। বাবুগের বাগানে সুপুরি গাছের অভাব নেই। 

শঙ্খ খুশিই হয়েছে নৌকো চড়ে। কিছুক্ষণ আগেও নরা তাকে টেনে বেড়িয়েছে। একটু আগে বাজার আনতে গেল। শঙ্খ অমনি একা হয়ে গেল। একা একা সে থাকতে চায় না। তার খুব খারাপ লাগে। এ বাড়িটা কেমন বড় বড়। এ বাড়িটার চারিধারে কেমন বন জঙ্গল। শঙ্খর ভয় ভয় করে, গা ছমছম করে। বড় ভিতু। একা থাকতে ভয় পায়। 

গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। সে একটু ভিজল। ভালই লাগছিল। আরেকটু ভিজলে আরও ভাল লাগত। কিন্তু মাসি চেঁচামেচি করল। দিদা ছুটে এল। তাকে উপরে তুলে নিয়ে গেল। আঁচল দিয়ে তার মাথা মুখ মুছিয়ে দিল দিদা। দুধ খেতে দিল। দুধ খেতে তার ভাল লাগে না। কেমন জল জল। বিচ্ছিরি। বড়রা কত কী খায়! বড় বড় পিঁড়িতে বসে। বড় বড় থালা বাটিতে কত ভাল ভাল জিনিস থাকে। ওরা খায়। ওর বাবা দু’-একবার সেইসব জিনিস একটু মুখে তুলে দিয়েছে ওকে, মা দিয়েছে, দিদি দিয়েছে, দাদা দিয়েছে, মাসি দিয়েছে, দিদা দিয়েছে। কোনওটা খেতে তার ভাল লেগেছে, কোনওটা লাগেনি। তবু সে তা খেয়েছে, তবু সে তা খায়। সে-সব জিনিসের ঝাঁজালো আস্বাদ আর-এক নতুন রোমাঞ্চে অভিভূত করে তাকে। ওসব জিনিস ছেড়ে দুধ, রামোঃ, ও কি মুখে তোলা যায়! 

কিন্তু এ-কথা বড়মা বোঝে না, মা-ও না। সবাই মিলে ঠেসে ঠুসে তাকে দুধ খাওয়াল। তার কোনও আপত্তি টিকল না। আগে জানলে সে পালিয়ে যেত। দুধ খেয়ে বড় বিরক্তি লাগল তার। গুম মেরে বসে রইল খানিক। ধীরে ধীরে সবাই যে যার কাজে চলে গেল। আবার সে একা হয়ে পড়ল। 

ঘরের ভিতর চুপ করে বসে থাকতেও ভাল লাগল না। বাইরে এল। বারান্দায় অনেকগুলো হুঁকো কলকে ছিল। বেশ দেখতে বটে জিনিসগুলো। বড়দের মুখের কাছে মুখ নিয়ে ভুডুক ভুডুক কেমন ডাকে! কী আছে ওর ভিতরে? একটা হুঁকো টেনে নিল। একটু কাত হয়েছে কী, কলকেটা পড়ে ভেঙে গেল। যাক গে। ওটার ভিতরে কিছু নেই। শুধু গুঁড়ো গুঁড়ো ছাই। আসল ব্যাপার হয়তো লুকিয়ে আছে এই কালো পেটের মধ্যে। সে বার-দুই ঝাঁকাল। কী যেন খলখল করছে। জল। এই যে জল বেরুচ্ছে। জল পড়ে মেঝে ভেসে গেল। যাঃ। যাক গে। আর কী আছে ওর ভিতরে! ভিতর থেকে কথা বলে কে? নলচে ধরে বার কয়েক ঝাঁকি দিল সে। শেষে ধাঁই ধাঁই করে আছাড় মারল গোটা কয়েক। বেশ ঠক ঠক শব্দ হল। শব্দটা বেশ লাগছে। ঠক ঠক ঠকাস। মার, আরও জোরে আছাড় মার। ঠক্কাস। নলচে থেকে হুঁকোর খোলটা খুলে বেরিয়ে গেল। বাঃ বাঃ! এ তো মজা মন্দ নয়। খোলটা কেমন গড়াচ্ছে! কী সুন্দর লাঠি হয়েছে নলচেটায়! শঙ্খ খুশিতে ফেটে পড়বে যেন। নলচেটা দিয়ে খোলটাকে ঠেলা মারছে সে, আর খুশিতে লাফাচ্ছে। 

রামকিষ্টো এসে দেখে বড়কর্তার হুঁকোটার ও কম্ম হয়ে গেছে। সর্বনাশ! বড়বাবু দেখলে আর আস্ত রাখবে না। রামকিষ্ট তাড়াতাড়ি ওর হাত থেকে নলচেটা কেড়ে নিতে গেল। 

বলল, ভাঙ্গাচুরার একেবারে যে মা-গুসাই হয়ে উঠিছ মণি, অ্যাঁ। একদণ্ডও বুঝি সুস্থির হতি মন চায় না, কেমন? যত কোপ কাজের জিনিসি! দ্যাও উটা। 

শঙ্খ নলচে দেবে না। কিছুতেই না। 

বলল, লাঠি। আমাল লাঠি। মাব। 

রামকিষ্ট বলল, ওর চাইতিউ ভাল লাঠি আমি তুমারে বানায়ে দিবানে। লক্ষ্মী ছাওয়াল। এখন নলচেডা দ্যাও দিনি। দাদু তামাক খাবে। 

না, তামাক খাবে না। আমাল লাঠি। মাব। 

রামকিষ্টর অনেক কাজ। বাদবিতণ্ডার সময় নেই। সে বৃথা বিলম্ব না করে নলচেটা নিয়ে নিল। শঙ্খর খুব রাগ হল। এ কী কথা! সে যে জিনিসে হাত দেবে, অমনি ওরা ছোঁ মেরে সেটা নিয়ে নেবে! বেশ, সে চায় না, এদের কোনও জিনিসই সে চায় না। প্রচণ্ড অভিমান হল তার। কেউ তাকে দেখতে পারে না। কেউ না। কেউ না। খানিকক্ষণ দুরন্ত অভিমানের জোয়ারে সে ভেসে চলল। কাঁদল। হঠাৎ দেখে উঠোনে নৌকোটা পড়ে আছে। 

শঙ্খ উঠোনে নেমে গেল। নৌকোটা টেনে নিয়ে উঠোনময় ঘুরে বেড়াতে লাগল। হ্যাঁ, এইবার একটা ভাল কাজই তো পাওয়া গেছে। কিছুক্ষণ নৌকো টানবার পর খেয়াল হল, তার নৌকো খালি। যাত্রী নেই কেউ। এদিক ওদিক চাইতেই দেখে ডুয়ার ধারে নেড়ি কুকুরের বাচ্চা দুটো খেলা করছে। শঙ্খ খুব খুশি হল। 

ডাকল, আয় আয়। 

ওরা সে ডাকে সাড়া দিল না। বারকয়েক ডাকাডাকি করেও যখন ওরা এল না, তখন শঙ্খ নিজেই ওদের কাছে গেল। 

ডাকল, আয়, নৌকো চাবি আয়। 

ওরা তবুও এল না। তখন শঙ্খ একটা বাচ্চাকে ধরে এনে ওর নৌকোর উপর বসিয়ে দিল। তারপর আরেকটি বাচ্চাকে ধরে এনে দেখে অন্যটা ততক্ষণে আরেক জায়গায় চলে গেছে। শঙ্খ বোকা বনে গেল। 

হাতের বাচ্চাটাকে নৌকোয় বসিয়ে, সে তখন আগের বাচ্চার পিছনে ধাওয়া করল। কিছুক্ষণ ছুটাছুটি করে যখন ওটাকে ধরে নিয়ে এল তখন এটা আবার আরেক দিকে হাঁটা দিয়েছে। 

সে ডাকল, আয় আয়। 

কিন্তু কে কার কথা শোনে! শঙ্খ মহা মুশকিলে পড়ল। সে একটা করে বাচ্চা ধরে এনে নৌকোয় বসায়, ততক্ষণে আরেকটা অন্যদিকে হাঁটা মারে। দৌড়ে দৌড়ে সে হয়রান হয়ে গেল। বিরক্ত হয়ে উঠল। তখন একটা বাচ্চার পেটে মারল লাথি। কেঁউ কেঁউ করে সেটা আর্তনাদ করে উঠল। বা রে, এ তো বেশ খেলা! মারল আরেক লাথি। বাচ্চাটা কেঁউ কেঁউ করে আবার কঁকাতে লাগল। বাঃ বাঃ! খুশিতে ফেটে পড়ল শঙ্খ। হাততালি দিয়ে হাসতে লাগল। 

বাচ্চাটাকে শাসাতে লাগল, আর দুটু করবি। দুটু করবি? 

আবার মারল লাথি। আবার, আবার। বারবার লাথি মারছে শঙ্খ, বারবার আর্তনাদ করে উঠছে ছোট্ট কুকুরছানাটা। আর খুব মজা লাগছে তার। চেঁচামেচি শুনে গিরিবালা বেরিয়ে এল। শঙ্খকে কুকুরের ছানা ঘাঁটাঘাঁটি করতে দেখে বেজায় রেগে গেল। 

ডাক দিল, খুকা, উঠে আয়। অসভ্য কোথাকার! কুকুর ছেনতিছ! উঠে আয় পিচেশ।

শঙ্খ মাকে দেখে নালিশ করল, মারব। দুট্‌টু। মারব। 

থাক, তুমার আর শাসন করতি হবে না। তুমি এখন আসো দিনি। কাদা মাখে একেবারে ভূত হয়ে উঠিছ। আসো, চ্যান করায়ে দিই। গিরিবালা শঙ্খকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেল। তার এখন অনেক কাজ বাকি। 

বড়মার জ্বর, চাঁপার জ্বর। ম্যালেরিয়ায় পাড়ু করেছে দু’জনকে। খুব ভোগান্তি যাচ্ছে। ফুলির মা, ফুলিও নেই, মেয়েকে নিয়ে বছরখানেক হল শ্বশুরবাড়ি চলে গিয়েছে ফুলির মা। ছোটকাকিমা কাকার ওখানে। কাকা ঝিকরগাছায় বদলি হয়েছেন। প্রায় মাসখানেক ধরে শুভদাই সবদিক সামাল দিচ্ছিলেন, গিরিবালা আসতে তাঁর পরিশ্রম একটু লাঘব হয়েছে। এবারে বাপের বাড়িতে এসে গিরিবালাকে খুব খাটতে হচ্ছে। ফুরসত মোটে পাচ্ছে না। তাড়াতাড়ি করে বাবার ইস্কুলের ভাত রেঁধে দিতে হয়। দু’-দুটো রোগীর সেবা করতে হয়। মাঝে মাঝে চাল ফুরিয়ে গেলে, ধান ভেনেও নিতে হচ্ছে। সে যে বাপের বাড়ি এসেছে তা সে বুঝতে পারছে না। সাত দিনও আসেনি, এরই মধ্যে সে যেন ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। 

তিন বছর সে আসেনি। তার চোখে এতদিন বাপের বাড়ির যে ছবিটা ভেসেছে, সেটা তো তিন বছর আগেকার। এর মধ্যে কত পরিবর্তন হয়েছে এ সংসারের তার কোনও ধারণাই ছিল না। নদীর ঘাটে নরাকে দেখে তাই সে অত অবাক হয়ে গিয়েছিল। যে নরাকে সে বছর তিনেক আগে দেখে গিয়েছিল, আর এখানে এসে যে নরাকে দেখল, দুইয়ের মধ্যে প্রায় আকাশ-পাতাল তফাত। তারপর এখন গিরিবালা বুঝতে পারছে, শুধু নরারই নয়, এখানকার সব কিছুরই পরিবর্তন হয়েছে। 

শ্বশুরবাড়ি যখন ছিল, তখন তার বাপের বাড়িটাকে তুলনায় অনেক উজ্জ্বল বলে মনে হত গিরিবালার। এবার সে বাপের বাড়ির সঙ্গে শ্বশুরবাড়ির বিশেষ তফাত কিছু দেখতে পাচ্ছে না। সেই আজ-আনা আজ-খাওয়া এখন এখানেও শুরু হয়েছে। বাড়িঘরের বাইরেকার চেহারাও অনেক খারাপ হয়ে গিয়েছে। আগে বারবাড়ি আর ভিতর বাড়ির মধ্যেকার চেগারের বেড়াটা সবসময় মজবুত থাকত। এবার গিরিবালা এসে দেখল, বেড়াটা জরাজীর্ণই শুধু হয়ে ওঠেনি, একপাশে হেলে পড়ার ফলে ভিতরের আবরু প্রায় নষ্টই হতে বসেছে। পিসিমা অনেক খিটখিটে হয়ে উঠেছেন, বড়মা চাঁপা রুগ্‌ শীর্ণ, বাবা অনেক গম্ভীর, জ্যাঠামশাই চিন্তার ভারে ন্যুব্জ। সব মিলিয়ে এখানে এখন যে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, সেটা যেন ঠিক আগের মতো গিরিবালাকে সোৎসাহে আমন্ত্রণ জানাল না, যেন আগের উষ্ণতা অনেকখানি মিইয়ে গিয়েছে। 

বাইরের দিক থেকে দেখতে গেলে যত রকমের পরিবর্তন চোখে পড়ে, ভিতরে ভিতরে অত পরিবর্তন হয়েছে কি না গিরিবালা জানে না। সে শুধু অনুভব করছে, এই বাড়িটা তার কাছ থেকে অনেকটা দূরে সরে গেছে। সেটা কার দোষ, তার, না এ-বাড়ির, গিরিবালা তাও জানে না। শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে এখানে আসবার জন্য তার প্রাণটা কেন যে এত আকুলি-বিকুলি করত, এখন যেন সে তার সঙ্গত কোনও জোরালো কারণ খুঁজে পাচ্ছে না। শ্বশুরবাড়ি থাকতে সে ভেবেছিল, ভূষণ একবার তাকে বাপের বাড়িতে এনে ফেলুক, তারপর গিরিবালা দেখবে সে কেমন করে তাকে চা-বাগানে নিয়ে যায়। 

এই তো ভূষণ তাকে এখানে রেখে এখন কলকাতায় গিয়েছে। কয়েকদিনের মধ্যে এসেই তাকে সঙ্গে নিয়ে আসাম চলে যাবে। শ্বশুরবাড়ি থাকতেই গিরিবালা মনে মনে অনেক যুক্তি এঁটে এসেছিল। তার পক্ষে শ্রীহট্টে না যাবার সপক্ষে অনেক অকাট্য কারণ সে তৈরি করে রেখেছিল। কিন্তু, এখন, তার মতো ভিতু লোকেরও যেন মনে হচ্ছে, সত্যিই সে সব অজুহাতের কোনও মানে নেই। শ্বশুরবাড়ি থাকতে বারবার তার মনে হত, বাপের বাড়িই বুঝি তার সব থেকে বড় আশ্রয়। এখন তার মনে হচ্ছে চা-বাগানে গেলেও সে এমন কিছু জলে পড়বে না। অর্থাৎ বাপের বাড়ির এই পরিবেশে সে আলাদা এমন কিছু খুঁটির জোর পেল না, যা তাকে শ্রীহট্টে যেতে প্রবলভাবে বাধা দিতে পারে। বরং উলটোই হল। এরই মধ্যে গিরিবালা মনে মনে, ভূষণ কবে আসবে, তারই জন্য যেন তৈরি হয়ে বসে থাকল। 

চোদ্দ 

জ্বরটা যখন আসে তখন কিন্তু এত কষ্ট হয় না বড়বউয়ের। মাঝে মাঝে শুরুটা বরং ভালই লাগে। কেমন একরকম নেশার মতন। হয়তো রাঁধতে বসেছেন, কি বাসন মাজতে, কি কাপড় নিয়ে গেছেন পুকুরে কাচতে, অমনি বড়বউ টের পেলেন তাঁর রক্তে কেমন যেন এক অস্থিরতা জেগে উঠতে শুরু হয়েছে। বুঝলেন, জ্বর আসছে। ম্যালেরিয়া এমনি করেই আসে। বড়বউ আর বিশেষ বিলম্ব করেন না। যতটা পারেন হাতের কাজ তাড়াতাড়ি চুকিয়ে দেন। জানেন, কপালের রগ দুটোর টিপটিপনি শুরু হলেই কম্প দিয়ে এসে পড়বে জ্বর। তখন আর দিশে-বিশে পাওয়া যাবে না। 

তাই বড়বউ সময় থাকতেই সতর্ক হয়ে ওঠেন। জ্বর আসবার লক্ষণ দেখলেই হাতের কাজ চুকিয়ে ফেলেন। এমনকী, দাঁতে খানিকটে গুঁড়ো ঘষে নিতেও ভোলেন না। তারপর হয় চাঁপাকে নয় অন্য কাউকে, যে তখন হাতের কাছে থাকে তাকেই বিছানাটা পেতে দিতে বলেন। তারপর পাতা বিছানায় শুতে-না-শুতেই ম্যালেরিয়ার কম্প শুরু হয়ে যায়। দারুণ শীত করতে থাকে। লেপের উপর লেপ, কাঁথার উপর কাঁথা চাপা দিয়েও শীত কমানো যায় না। চাঁপা কি ফুলি, ফুলির মা কি শুভদা জোর করে ঠেসে ধরলেও কম্প থামাতে পারা যায় না বড়বউয়ের। জ্বরের তাপ বাড়তে থাকে। কানের ভিতর হাজার হাজার ঝিঁঝি পোকার ডাক শোনা যায়। মাথার দপদপানি শতগুণ বেড়ে যায়। তারপর জোয়ার ভেঙে বন্যা, মহাপ্লাবন…। বড়বউয়ের শরীরটা শক্ত শক্ত ধাক্কায় ভেঙে পড়তে থাকে। খণ্ড খণ্ড হয়ে যায়। এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ভাবনাগুলো এলোমেলো হয়ে ওঠে। তারপর কখন যেন দেখবার বোঝবার ভাববার অনুভব করবার ক্ষমতা বিলুপ্ত হয়। চেনা জগৎটা তলিয়ে যায়। অনেকক্ষণ আর কোনও কিছুর সাড় থাকে না। 

হঠাৎ একসময় চৈতন্য ফিরে এলে বড়বউ দেখেন, তাঁর নির্জীব দেহটা লেপ কাঁথার বিরাট স্তূপের ভিতর বন্দি হয়ে গলগল করে ঘামছে। বিস্বাদ মুখ, অবসন্ন দেহ। নড়তে-চড়তে আর ইচ্ছে করে না। মনে হয়, কোন এক হিংস্ৰ দৈত্য ছেঁচে থেঁতলে তাঁর দেহ থেকে রস বের করে নিয়ে ছিবড়েটা নয়নজুলিতে ফেলে দিয়েছে। এই সময়টা খুব খারাপ লাগে বড়বউয়ের। খুবই অসহায় অসহায় ঠেকে। 

আর কেবলই সুধার কথা মনে হয়। 

কেমন আছে সুধা? এত করে লেখা হচ্ছে বাড়ি আসার জন্য, আসছে না কেন? কতদিন আসেনি সুধা। এক বছর, দু’বছর, এক যুগ। আর কি আসবে না? আসবেই না? যদি হঠাৎ মরে যান তিনি, সুধার মুখখানা তো আর দেখতে পাবেন না। পাবেনই না? সর্বনাশ! বুক ধড়ফড় করতে থাকে। শীর্ণ নিস্তেজ চোখ দুটো দিয়ে অবিরলধারে জল ঝরে পড়ে। 

সুধাকে নিয়ে কত আশা ছিল তাঁদের। এখানকার পড়া শেষ করে কলকাতায় পড়ার আবদার ধরেছিল সুধা। বড়বউয়ের মোটে মত ছিল না। মাজেবাবুর কথা মনে ছিল তাঁর। কলকাতা সম্পর্কে মহাভয় ছিল। কলকাতায় গেলে ধর্মাধর্ম লোপ পায় বলে ধারণা ছিল বড়বউয়ের। তবুও মাজেবাবুর কথার উপর ভরসা করে বুক বেঁধেছিলেন তিনি। সাহস করে কলকাতায় পাঠিয়েছিলেন ছেলেকে। শেষ পর্যন্ত কলকাতাই গ্রাস করল সুধাকে। যা ভয় করেছিলেন, তাই হল। কই, এখন মাজেবাবু কোনও কথা বলেন না কেন? ‘সুধা’ ‘সুধা’ করে তাঁর প্রাণ যখন বেরিয়ে যাবার জোগাড় হচ্ছে, তখন এনে দিতে পারছেন না কেন তাঁরা ছেলেকে? খুব তো সাহস দিয়েছিলেন তখন 

মাঝে মাঝে বড়বউয়ের মনে হয়, সুধা হয়তো বেঁচেই নেই। সবাই মিলে তাঁকে ধোঁকা দিয়ে রেখেছে। বেঁচে নেই সুধা? ষাট, ষাট! এ কী অলক্ষুনে ভাবনা! তেত্রিশ কোটি দেবতার কাছে প্রার্থনা করেন বড়বউ, জাগ্রত দেবতাদের কাছে মানত করেন, সুধাকে তাঁর কোলে ফিরিয়ে দিতে। বুক চিরে রক্ত দেবেন তাঁদের পায়ে ঢেলে 

কখনও মনে হয়, লেখাপড়া না শেখানোই উচিত ছিল সুধাকে। কোলের ছেলে তা হলে কোলেই থাকত। জমিজমা দেখত। বিয়ে দিয়ে দিতেন তাঁর। এতদিনে বেটার বউ নাতি নাতনি নিয়ে সুখের ঘর বসে যেত। লেখাপড়া না শিখলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হত! লেখাপড়া শিখে এই তো হল, সে মা-বাবাকে পর্যন্ত গেরাহ্যি করে না। নিশ্চয়ই সুধা কলকাতায় কোনও বড় রকমের কেলেঙ্কারি-টেলেঙ্কারি ঘটিয়ে বসেছে। নইলে আসছে না কেন বাড়িতে? বড়বউয়ের মন বলছে, কিছু একটা ঘটেছে সুধার। কিছুদিন ধরে তাঁর মনটা কেবলই কু গাইছে। চিঠির পর চিঠি লেখা হচ্ছে ‘বাড়ি এসো’ ‘বাড়ি এসো” বলে, কোন সাহসে সুধা তা উপেক্ষা করছে? এর মধ্যে দু’-তিনটে ভাল ভাল সম্বন্ধ এসেছিল ওর। বিনোদপুরের অক্ষয় ঘোষের মেয়েটাকে তো পছন্দও হয়েছিল কর্তাদের। মেয়ের বাবারও এখানে বিয়ে দেবার খুব ইচ্ছে ছিল। দেড় বছর ধরে কী ঝুলোঝুলিই না তারা করেছে। কিন্তু বিয়ে যে করবে, তাকে তো ভিড়ানোই গেল না। বোশেখ মাসে তারা সে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। 

তবে কি সুধা কলকাতায় বিয়ে-থা করেছে। তাঁদের না জানিয়েই বিয়ে করে বসবে সুধা? না না, তা কি হয়? তা কখনও সুধা করবে না। বিশ্বাসই বা কী? বড়বউ বিরক্ত হয়ে ওঠেন। আজকালকার ছেলেদের মতিগতির কি কিছু ঠিকঠিকানা আছে! এই তো আজ বছর দেড়েক ধরে ক্রমাগত ভুগছেন বড়বউ, কবে হয়তো একদিন পট করে মরে যাবেন, সে সব কথা সুধাকে লেখা হয়েছে, সুধা জানে, তবু কি একবার এসেছে চোখের দেখা দেখতে? আর তাঁর অসুখের কথা শুনেও একবার তাঁকে দেখে যাবে না সুধা, বড়বউ কি এ-কথা ঘুণাক্ষরেও কখনও ভাবতে পেরেছিলেন? যে-ছেলে এ-কাজ পারে, তার অসাধ্য এ জগতে আর কী আছে? 

বড়বউই শুধু ‘সুধা’ ‘সুধা’ করে ভেবে মরেন। সুধা মা’র জন্য কাঁচকলাটাও ভাবে না। কত যে দুঃস্বপ্ন দেখেন সুধাকে ঘিরে, বিছানায় নির্জীব হয়ে যে সময়টা পড়ে থাকেন তখন, তার কি সীমা-সংখ্যা আছে! 

.

আজ, এই তো কিছুক্ষণ আগে জ্বরটা ছাড়ল। একটু বুঝি তন্দ্রাটা এসেছিল। দেখলেন ভূষণ সুধাময়ের অচৈতন্য দেহটা কাঁধে করে বয়ে আনছে। গাড়ি ধরতে পারেনি ভূষণ, হেঁটে হেঁটেই কলকাতা থেকে এসে পড়েছে। সুধাময়ের মাথাটা ফেটে গেছে, গলগল করে রক্ত পড়ছে। বারান্দায় এনে ওকে শোয়ানো হল। রক্তে বারান্দা ভেসে গেল, উঠোন ভেসে গেল। হুড়হুড় করে বৃষ্টি পড়ে উঠোনে একগলা জল দাঁড়িয়ে গেল। সুধার রক্তে সেই জল লাল হয়ে উঠল। বড়বউ রান্নাঘরে ছিলেন। তাড়াতাড়ি করে সেই গলা-জল ভেঙে গুদামের বারান্দায় উঠতেই আছাড় খেয়ে তিনি সুধার গায়ের উপর পড়ে গেলেন। সুধার দেহটাও অমনি পিছলে জলে পড়ে গেল, আর কে যেন বলে উঠল, হা অভাগী, ছেলেরে জলে ঠেলে ফেলে দিলি! বড়বউ তাড়াতাড়ি করে হাত বাড়িয়ে ধরতে গেলেন সুধাকে আর অমনি জলে প্রবল স্রোতের টান উঠল। মুহূর্তের মধ্যে সুধা ভাসতে ভাসতে অদৃশ্য হয়ে গেল। 

বড়বউ ‘ওরে ধর ধর’ বলে চেঁচিয়ে উঠলেন। তাঁর তন্দ্রা ভেঙে গেল। ভয়ে আতঙ্কে থরথর করে তাঁর শরীর কাঁপতে লেগেছে। বুক অস্থির অস্থির করছে। বড়কর্তা পাশের ঘরে ছিলেন। চিৎকার শুনে এ-ঘরে এসে পড়লেন। বড়বউয়ের ভাবগতিক দেখে বড়কর্তা জিজ্ঞাসা করলেন, কী হল? 

বড়বউ শ্রান্ত চোখে বড়কর্তার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলেন। তিনি তখনও হাঁফাচ্ছেন।

বড়কর্তা আবার জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে বড়বউ? অমন করে চেঁচিয়ে উঠলে ক্যান?

বড়বউ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। যেন প্রকৃতিস্থ হলেন খানিকটা। তারপর ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। 

একটু পরে খানিকটা সামলে নিয়ে বললেন, তুমরা মানুষ না গো, পাষাণ, আজ পর্যন্ত ও আমার সুধারে আনে দিতি পারলে না! 

বড়কর্তা বললেন, চিঠি লিখলি হারামজাদা জবাব দেয় না। করব কী কও? 

বড়বউ বললেন, এক কাজ করো, আমারে কলকাতায় নিয়ে চলো। আমার মনডা বড় উতলা হয়ে পড়িছে। ওগো, আজ যাচ্ছেতাই স্বপ্ন দেখিছি। নিয়ে যাবা আমারে কলকাতায়? 

বড়কর্তা বললেন, কলকাতায় যাওয়া কি মুখির কথা বড়বউ? আমি ছাই কিছু চিনিউনে। উতলা হয়ে আর করবা কী? কপালে যা আছে তা কি খণ্ডাতি পারবা? দেখি, জামাইরি তো কয়ে দিইছি, কলকাতায় যায়ে যেন সে নবাবের সঙ্গে দেখা করে। জামাই তো এই পথেই ফেরবে, যেন তারে ধরে নিয়ে আসে। 

বড়বউ বললেন, জামাই কি চিঠিপত্তর কিছু দেছে? 

বড়কর্তা বললেন, মহী তো কিছু ক’ল না। আসেনি বোধহয়। 

আরে ও কী, ও দাদু, ওষুধির শিশি পালে কনে? 

শঙ্খ চাঁপার মিকশ্চারের শিশিটা দুহাতে ধরে থপ থপ করে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। বড়কর্তা তাড়াতাড়ি ওষুধের শিশিটা নিতে গেলেন। শঙ্খ দিল না। বড়বউয়ের কাছে সরে গেল। 

বড়কর্তা বললেন, দিয়ে দ্যাও দাদু, দিয়ে দ্যাও। ওষুধ ন্যায় না। 

শঙ্খ বলল, ওচুদ নে না। দিদি খাবে। দিদি অচুখ 

বড়বউয়ের হাতে শিশিটা দিয়ে দিল শঙ্খ। 

বলল, দিদি অচুখ, দিদি খাবি, ওচুদ খাবি। 

অমনি বড়বউয়ের মনের গুরুভার অনেকটা লাঘব হয়ে গেল। মুখে হাসি ফুটল। ওইটুকুন ছেলের বুদ্ধিটা দেখেছ একবার! ঠিক ধরেছে কেমন? আমার অসুখ, আমাকেই ওষুধ খাওয়াতে এসেছে। 

বললেন, হ্যাঁ দাদু, ওষুধ খাব। তুমি এতক্ষণ কনে ছিলে? 

শঙ্খ বললে, ওচুদ খাবি, ওচুদ খাবি। 

বড়বউ শঙ্খকে কাছে টেনে নিলেন। ওর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। দেখেছ, মাথায় কত ময়লা! জট পড়ে যাচ্ছে। চুলগুলো ভাল করে আঁচড়িয়ে না দিলে মাথায় যে খুশকি পড়বে। কিন্তু দেয় কে? তিনি তো বিছানায় পড়ে। চাঁপাও পড়েছে। বেচারি বুড়ি! দু’দিনের জন্য বেড়াতে এল, আজ বাদে কাল চলে যাবে কোন মগের মুল্লুকে। কোথায় হাত পা ছড়িয়ে বিশ্রাম করবে দু’দিন, না এসে ইস্তক হেঁশেলে ঢুকে হাঁড়ি ঠেলতে লেগেছে। 

গিরিবালা এক জামবাটি গরম সাবু রেঁধে নিয়ে ঢুকল। কাগজি লেবুর গন্ধ ছাড়ছে সাবুর বাটি থেকে। 

বড়বউ গিরিবালাকে হাসতে হাসতে বললেন, ও বুড়ি, এই দ্যাখ, তোর ছেলে কেমন ডাক্তার হয়ে উঠিছে। ওষুধির শিশিডে আমারে দিয়ে কয় কী, দিদি ওষুধ খাবে। দিদির অসুখ। 

কথাটা শুনে শঙ্খ মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, দিদি ওচুদ খাবে। দিদি অচুখ। 

বড়কর্তা বললেন, ডাক্তারের বিটা তো। বাপকা বিটা সিপাহিকা ঘুড়া, কুচ নেহি তো থুড়া থুড়া। 

ঘোড়ার কথা কানে যেতেই শঙ্খ বড়বউকে ছেড়ে বড়কর্তাকে ধরল। 

দাদু গোড়া। 

বড়কর্তা বললেন, ঘুড়ায় চড়বা? 

শঙ্খ লাফাতে লাফাতে বলল, গোড়া চৰ্‌ব্ব। দাদু গোড়া। 

গিরিবালা হেসে ফেলল। 

বলল, আপনি আবার হাভাতেরে শাগের খেত দ্যাখালেন তো! 

শঙ্খ ততক্ষণে বড়কর্তার হাত ধরে টানাটানি শুরু করেছে। 

দাদু গোড়া চৰ্‌ব্ব। গোড়া দে। 

বড়কর্তা বললেন, তবে চল যাই দাদু, দু’জনে মিলে ঘোড়া ধরিগে। 

বড়কর্তা শঙ্খকে নিয়ে যাবার উপক্রম করতেই গিরিবালা বলল, জ্যেঠামশাই, রান্না হয়ে গেছে কিন্তু। চ্যানটা সারে ফ্যালেন। 

ওরা বেরিয়ে যেতেই বড়বউ সাবুর বাটি কোলে করে ছেলেমানুষের মতো খুঁতখুঁত করতে লাগলেন। 

সাবু আর মুখি তুলা যায় না রে মণি। বমি আসে। আমি বরং চাড্ডে ভাতই খাব। 

গিরিবালা হাসতে হাসতে বলল, তুমি যে চাঁপার উপর দিয়ে যাও। চাঁপা তবু তো সাবুর পায়েস পালিই খুশি হয়। 

বড়বউ বিরক্তি চেপে বললেন, দিনির পর দিন এ ছাই কি গিলা যায়! 

গিরিবালা বলল, জ্বরডা না ছাড়লি তো আর অন্নপথ্যি দেবে না ডাক্তারে। ন্যাও, খায়ে ন্যাও। আমি লেব-টেবু দিয়ে শরবত বানায়ে আনিছি। খারাপ লাগবে না। 

বড়বউ আর দ্বিরুক্তি না করে ঢকঢক করে গিলে ফেললেন সাবুটুকু। তারপর মুখ মুছে শুয়ে পড়লেন। 

.

ভূষণের চিঠি এসেছে। ভূষণ মেজকর্তাকে লিখেছে: 

শ্রীচরণকমলেষু, 

বাবুজি, আমাদের যাবার দিন স্থির হইয়াছে। এই সপ্তাহের শেষেই চা-বাগান অভিমুখে রওনা দিতে হইবে। হাতে সময় আর মোটে নাই। এদিকে বাগানের ডিস্পেনসারির জন্য সাজ-সরঞ্জাম ও প্রয়োজনীয় ঔষধপত্রাদি কেনাকাটা করিবার জন্য আমার এখন কলিকাতা ত্যাগ করিবার উপায় নাই। মেজবউদির বিশেষ ইচ্ছা তিনি শঙ্খকে দেখিবেন। তাই উহাদিগকে কলিকাতায় আনিতে হইবে। অথচ আমি গিয়া উহাদিগকে লইয়া আসিব আমার হাতে এমন সময়ও নাই। কাজেই উহাদিগকে কলিকাতায় পৌঁছাইয়া দিবার ভার আপনাকেই লইতে হইবে। এবং দুই-এক দিনের মধ্যেই পৌঁছাইয়া দিতে হইবে। 

সেজদা বলিয়াছেন, বাগানের ব্যবস্থাদি ভালই। কাহারও কোনও প্রকার অসুবিধা হইবে না। আমাদিগকে কলিকাতা হইতে ঢাকা অথবা চিটাগাং মেলে গোয়ালন্দ যাইতে হইবে। চিটাগাং মেলে যাওয়াই সুবিধাজনক। গোয়ালন্দ হইতে চাঁদপুর পর্যন্ত স্টিমারে এবং চাঁদপুর হইতে পুনরায় রেলযোগে লাকসাম এবং কুলাউড়া জংশন হইয়া দক্ষিণভাগ স্টেশনে নামিতে হইবে। দক্ষিণভাগ হইতে হাতি অথবা অন্যান্য যানবাহনে বাগানে পৌঁছিতে হইবে। ভাবনার কিছুমাত্র কারণ নাই। তবে আপনি হাতির কথা কাহাকেও জানাইবেন না। অনর্থক ত্রাসবৃদ্ধি পাইবে। আসামে হাতি দিয়া জমি চাষ করে। উহা বলদ অপেক্ষাও নিরীহ। 

আমি বর্তমানে এক শত টাকা বেতন পাইব এবং পঞ্চাশ টাকা অ্যালাউন্স পাইব। এতদ্ব্যতীত একটি বাংলো এবং চাকর কোম্পানি আমাকে দিবেন। ব্যাবসা ইত্যাদি করিবারও প্রচুর সুযোগ আছে জানিলাম। উহাতেও আরও উৎসাহ বোধ করিতেছি। 

এবার সুধাদার ব্যাপারে কিছু বলি। কী যে বলিব, বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। আপনারা যে ঠিকানা দিয়াছিলেন, সুধাদা সেই ঠিকানায় আর থাকে না। উহা একটি মেসবাড়ি। ওইখানে গিয়া সুধাদার খোঁজ করিয়া জানিতে পারি, সে অনেকদিন হইল ওখান হইতে চলিয়া গিয়াছে। কোথায় কেহ জানে না। আগে মাঝে মাঝে ওখানে আসিত এবং চিঠিপত্র থাকিলে লইয়া যাইত। মেসের ম্যানেজার কোনও কথা বলিতেই চাহেন না। শেষে আমি পুলিশের লোক নহি, সুধাদার আত্মীয়, এ-কথা বিশ্বাস করাইবার পর আমার ঠিকানা রাখিয়া দিলেন এবং বলিলেন, সুধাদার খবর কিছু থাকিলে তিনি আমাকে জানাইবেন। এ সকল কী ব্যাপার কিছুই বুঝিতেছি না। আমার ভাল ঠেকিতেছে না। সে কারণেও আপনার পক্ষে কলিকাতায় আসা প্রয়োজন। যাহা হউক, আপনি পত্রপাঠ উহাদিগকে লইয়া চলিয়া আসিবেন। 

বড়মা এবং চাঁপার শরীর কি ভাল হইয়াছে? আশা করি আর সকলের কুশল। অত্র সকলের মঙ্গল জানিবেন। আপনি ও অন্যান্য গুরুজনগণ ভক্তিপূর্ণ প্রণাম লইবেন। ছোটদের আশীর্বাদ দিবেন। ইতি— 

আপনার জামাতা ভূষণ 

এই চিঠির পর আর নিশ্চিন্ত থাকা যায় না। ব্যাপারটা যে কতদূর গড়িয়েছে, এখান থেকে তা জানা যাবে না। মেজকর্তা চঞ্চল হয়ে উঠলেন। ঠিক করলেন, সাতদিনের জন্য কলকাতায় যাবেন। যে করেই হোক সুধাময়কে খুঁজে বের করতেই হবে। কী চায় সুধাময়, জানতে হবে। সত্যিই যদি সে কোনও সর্বনাশা সংকল্পের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে থাকে, তা হলে সর্বশক্তি দিয়েই তাকে প্রতিনিবৃত্ত করতে হবে। 

ভূষণের চিঠির কথা বাড়ির সবাইকে মেজকর্তা খানিকটা জানালেন। শুধু বললেন, সুধাময়ের সঙ্গে ভূষণ দেখা করতে পারেনি। গিরিবালাদের নিয়ে তিনি তো কলকাতায় যাচ্ছেন। আসবার সময় সুধাকে ধরে আনবেন। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *