হাওয়া এলোমেলো – ১

এক 

ইদানীং সে অনুভব করছে, কে যেন তাকে বলছে, অনেকদিন চার পায়ে হেঁটেছ, আর না, এবারে ওঠো। মানুষ চিরকাল চার পায়ে হাঁটে না। তার পা মাত্র দুটোই। এবার দু’পায়ে ভর দিতে শেখো। 

কিন্তু তা কি সম্ভব? তাকে মাঝে মাঝে বেশ ভাবিত হতে দেখা যায়। 

মনের আনন্দে সে বাড়িটা চষে বেড়াচ্ছিল। হামাগুড়ি দিয়ে দিয়ে। তার ধারণা, হাতে পায়ে ভর দিয়ে চলা হয়তো অনেক নিরাপদ। আপদ-বিপদ সহজে সে ডেকে আনতে চায় না। বাঁধা পথে চলা অনেক ভাল। 

চৌকাঠের কাছে এসে সে থমকে গেল। এই জায়গাটা তাকে বড্ড জ্বালায়। গোটা ঘরে আর কোনও বাধা নেই, কোথাও প্রতিরোধ নেই। তরতর করে সে ঘুরে বেড়ায়। চৌকাঠ পর্যন্ত অনায়াসে আসে। এখান থেকে বাইরে নজর পড়ে তার। কত আলো, কত জায়গা, কত রকম জিনিস সেখানে। লাল, কালো, হলদে, সবুজ, নীল, বেগুনি, গোলাপি, সাদা। কত রকম রং! কোনওটা চিকচিক করে, কোনওটা নড়ে, কোনওটা দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ। কোনওটা শব্দ করে, কোনওটা নিঃশব্দ। কারওর প্রতি পক্ষপাত নেই তার। সবার দিকে হাত বাড়ায়। সব চাই তার। সবই তার। কিছুই ফ্যালনা নয়। 

ওই যে কী একটা থপ করে পড়ল তার সামনে! চট করে তার চোখ দুটো ঘুরে গেল। ওই যে ফুডুক করে কী একটা উড়ে এল! বসল দূরে। চট করে সে ঘুরে গেল। ওই যে কেঁউ কেঁউ করে কী যেন একটা ঘুরপাক খেয়ে চলে, খটখট করে ছুটে গেল কী, কোথায় ঠং করে একটা আওয়াজ হল! চটচট করে তার চোখ ঘুরে যাচ্ছে। দারুণ উত্তেজিত হয়ে পড়ছে সে। বড় চঞ্চল হয়ে উঠেছে, অকারণে চঞ্চল। খুব মজা লাগছে তার। শরীরটা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে অমিত উৎসাহে দোলাচ্ছে। হাঁটুতে ভর দিয়ে শরীরটাকে তুলছে। হাত দুটো বাড়িয়ে আহ্বান জানাচ্ছে। কাছে এসো, কাছে এসো। আয় আয় আয়। 

হঠাৎ তার পিছনে কেমন-দেখতে কী একটা এসে গেল। মিহি স্বরে ডেকে উঠল, মিউ। সে-ও তৎক্ষণাৎ ঘুরে গেল। দারুণ বিস্ময়ে, কৌতূহলে স্ফটিকের মতো চোখ দুটো চকচক করতে লাগল। আরে, এটা তো সেই, তার বন্ধুটা। তার কাছে যে প্রায়ই আসে। ঘুরঘুর করে বেড়ায়। মিউ মিউ ডাকে। ঘড়ঘড় করে। তড়াক তড়াক লাফ মারে। ওটাকে দেখে সে বেজায় খুশি হল। ডাকল, দাদা, দাদা, দাদা! 

ওই যে ওটা চলতে আরম্ভ করেছে, দাদা! সেও পিছু পিছু চলল। দাদা! দাঁড়াও। যেন ধমক দিল। তার ধমকে কান দিল না সেটা। ঢুকে পড়ল চৌকির নীচে। সে-ও চলল। দাদা! অত জোরে না, আস্তে চলো। সে যেন এবার মিনতি করল। তার মিনতিও ব্যর্থ হল। একটু ক্ষুণ্ণ হল সে। তবু সে চলল তার পিছু পিছু। যাঃ, কোথায় গেল! চৌকির নীচে অজস্র জিনিস। এক লাফে তার আড়ালে ওটা লুকিয়ে পড়েছে। বিস্মিত হয়ে এধার-ওধার চাইল। দাদা! কোথায় তুমি? কেউ সাড়া দিল না। দাদ দাদ্ দা! এই এই, কোথায়? না, কেউ সাড়া দিচ্ছে না। মনটা খারাপ হল তার। বিরস মুখে বসে থাকল চুপ করে। 

আরে ওটা কী? ওই যে ওই কোণে চিকচিক করছে! ওই যে, ওই যে, ওই যে। তার চোখ দুটো আবার চকচক করে উঠল। গুটি গুটি সেদিকে এগিয়ে গেল। খপ করে তুলে নিল হাতে। বেশ শক্ত জিনিসটা মুখে পুরে কামড় দিতে লাগল। মাড়িটা শুলুতে লাগল তার। কামড় দিলেই আরাম লাগছে। চুকচুক করে চুষতে লাগল, চুষতে চুষতে মাঝে মাঝে মাড়ির জোরে চাপ দিতে লাগল। বেশ লাগছে। বেশ লাগছে। এই নতুন কাজে উৎসাহের জোয়ার এল মনে। এতেই মেতে গেল। হুড়মুড় করে ওদিকে কী পড়তেই সে সচকিত হয়ে উঠল। সে দেখল, তার বন্ধু সাঁত করে বেরিয়ে গেল। হাসি পেল তার। সে আবার বন্ধুকে অনুসরণ করল। 

সে দেখল, তার বন্ধু এক লাফে চৌকাঠ ডিঙিয়ে গেল। কিন্তু সে পারল না। কী যে শত্রুতা আছে ওই চৌকাঠের সঙ্গে, কেন যে সে বারে বারে ওকেই আটকে দেয়, ও তা বুঝতে পারে না। মাঝে মাঝে বেজায় রেগে যায়! হাঁটু গেড়ে বসে প্রবল আক্রোশে দু’হাতে ঝাঁকাতে থাকে চৌকাঠটাকে। পারলে যেন উপড়েই ফেলত। 

আপাতত এই বাধাটায় সে মোক্ষম ঠেকা ঠেকে পড়েছে। ক’দিন ধরেই সমানে সে চেষ্টা করছে ওটা পার হতে। চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। ভাবনায় পড়েছে। সে জানে এটা পেরোতে না-পারলে তার মুক্তি নেই। তার স্বস্তিও নেই। 

.

বাধা সে কম পার হয়নি। এই তো সেদিনও, সে একেবারে নড়তে পারত না। অসহায় হয়ে বন্দি ছিল বিছানার কারাগারে। তখন শুধু হাত পা নেড়ে নেড়েই চলার সাধ মিটিয়েছে। পাশ ফিরতেও পারত না এতদিন, উপুড় হতেও পারেনি। তারপর ধীরে ধীরে তার রক্তে একদিন পিতৃপুরুষের চাঞ্চল্য জেগে উঠল। সে অনুভব করতে লাগল, এক তীব্র, এক অশান্ত পিপাসা তার মনে জেগে উঠেছে। তাকে অস্থির করে তুলছে। বাধা ভাঙো। কে যেন তাকে তাগিদ দেয়। বলে, এ তোমার জায়গা নয়। তোমার ভুবন এখানে নয়। সে অন্য কোথা, অন্য কোনওখানে। ওঠো, ওঠো, ওঠো। চলো, চলো। 

কিন্তু কী করে উঠবে সে? কী করে চলবে? তার শক্তি কোথায়? অসম্ভব, তার পক্ষে অন্যের সাহায্য ছাড়া পাশ ফেরা অসম্ভব, উপুড় হওয়া অসম্ভব। পারবে না সে। সে যে কিছুই পারে না। আবার তাগিদ আসে। তাগিদের পর তাগিদ। চেষ্টা করো, চেষ্টা করো। তোমার বাপ-ঠাকুরদা কেউই হার মানেনি। বিদ্রোহ করেছে, সংগ্রাম করেছে। একে একে সব বন্ধন ছিন্ন করেছে। সেই বিদ্রোহের উত্তরাধিকার না তোমার! জন্মসূত্রে তুমি না সৈনিক! বিজয়ী! 

ভাল করে মনেও পড়ে না তার, কবে কেমন করে, তার রক্তে বিরামহীন সংগ্রামের প্রবল আহ্বান সে শুনল। টেরও পেল না, তার অজ্ঞাতসারেই কবে সে অসম্ভবকে সম্ভব করবার দুর্দম সংগ্রামে লিপ্ত হয়ে পড়ল। সে বুঝতেও পারল না, তার পরাক্রমে পঞ্চভৌতিক শক্তিকে সে তার পথ থেকে সরে দাঁড়াতে এরই মধ্যে বাধ্য করেছে। ঠেলতে ঠেলতে সে একদিন কাত হল, উপুড় হল। ক্রমাগত চেষ্টায় সে একদিন মাধ্যাকর্ষণের প্রবল টানকে মিথ্যে করে দিয়ে বিছানায় উঠে বসল। হাতে পায়ে ভর দিয়ে ঘরময় ঘুরতে লাগল। সীমানাটাকে টেনে টেনে সে বৃহৎ থেকে বৃহত্তর করে তুলল। 

মাতৃজঠরের সংকীর্ণতা থেকে মুক্তি পেয়ে সে একদিন বিছানায় এসে বন্দি হয়েছিল। এখন বিছানার সীমানা উত্তীর্ণ হয়ে ঘরের চৌহদ্দিতে বন্দি হয়েছে। এ এক অদ্ভুত খেলা সে খেলছে। বন্দিত্বের দিগন্ত পার হয়ে মুক্তি পাচ্ছে। মুক্তি পেয়েই দেখছে সে আবার নতুন কারার বন্দি। এইভাবেই তো সে এতটা পথ এগোল। আর এত পথ এগিয়ে এসে শেষে কিনা ঠেকে গেল চৌকাঠে? 

বিরক্ত হল সে। বাইরে ওই যে ওরা হাঁটছে ফিরছে, মা গিয়ে লুকিয়ে থাকছে কোথায়, কিছুতেই সে নাগাল পাচ্ছে না কারও। ওরা সব যে চৌকাঠের ওপারে। ওদের নাগাল এ জীবনে বুঝি সে ধরতে পারবে না। লুকোনো সেই জায়গাটায় গিয়ে মাকে বুঝি আর খুঁজে বের করতে পারবে না। যদি সে এই চৌকাঠটা ডিঙোতে পারত! অন্তত একবার, একবারও যদি পারত! 

না, এ অসম্ভব। এ বাধা সে আর পার হতে পারবে না। কখনই না। হতাশা এল তার। শ্রান্ত হয়ে পড়ল। কোনও কিছুই ভাল লাগছে না। খুঁত খুঁত করে কাঁদতে লাগল। খানিকক্ষণ কাঁদল।

হঠাৎ তার হাত পা নিশপিশ করে উঠল। চনমন করে উঠল রক্ত। পুরুষ পুরুষ ধরে যে অতৃপ্তি জন্ম নিয়েছে মানুষের মনে, যে আকাঙ্ক্ষা পাগল করেছে তাকে, সেই অতৃপ্তি, সেই আকাঙ্ক্ষা, সেই তাগিদ প্রবলবেগে গুঁতো মারতে লাগল। অস্থির হয়ে উঠল সে। পাগল হয়ে গেল যেন। চৌকাঠটা দু’হাতে ধরে পায়ে ভর দিয়ে একটুখানি তুলে ধরল নিজেকে। ও বাবা, বড্ড টাল। সামলানো দায়। থপ করে বসে পড়ল। খানিক পরে আবার উঠল। আবারও পড়ল। দূর, এ কি পারা যায় নাকি? না, সে পারবে না। সে হার মানছে। 

কে হার মানে? আবার তার ভিতরে এক বর্বর তৃষ্ণা জেগে উঠল। তাকে হার মানতে দিল না। আমি যাবই, আমি যাবই, যাবই। যেন প্রতিজ্ঞা নিয়েছে সে। এই প্রতিজ্ঞার কাছে আর সব তুচ্ছ হয়ে গেল। এবার বারবার চেষ্টা করল উঠতে। থপথপ করে পড়লও বারবার। এমনি পড়তে পড়তে উঠতে উঠতে টাল ভাঙল। চৌকাঠ ধরে একসময় ত্রিভঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েও পড়ল। হ্যাঁ, পেরেছে। যে পৃথিবী প্রবল বেগে ঘোরে, যে পৃথিবী কাউকে করুণা করে না, তার উপর টেক্কা মারার কৌশল করায়ত্ত হয়েছে তার। এবার সাহস বাড়ল। টাল সামলাতে শিখে ফেলল। বেশ কয়েকবার সে দাঁড়াল। কী ফুৰ্তি, কী ফুৰ্তি! প্রচণ্ড উল্লাসে নাচতে লাগল সে। কী মজা, কী মজা! খুব নাচছে। উৎসাহ ফেটে পড়ছে তার নধর দেহে। এখন সে ধরে ধরে দাঁড়াতেই চায়। বারে বারে তাই দাঁড়াচ্ছে। 

বারান্দায় তার বন্ধুটা এসে বসেছে। যেই ঝোঁক দিয়ে দেখতে গেল অমনি উলটে পড়ল বারান্দায়। কী হল! সে ঠিক বুঝতে পারল না। হঠাৎ তার মনে হল, সোঁ করে যেন কোন অতলে তলিয়ে যাচ্ছে। ভয়ে প্রাণ উড়ে গেল। তাই থপ করে মাটিতে পড়ার পর কয়েক মুহূর্ত সে কান্নাকাটি কিছুই করল না। যেন একটু সামলে নিল। পরমুহূর্তেই কান্নার চোটে বাড়ি মাথায় করে তুলল। ভয়ে তার প্রাণ উড়ে গেছে। 

.

হেঁশেলে হিমশিম খাচ্ছিল গিরিবালা। পিতলের বড় ডেকচিটায় ভাত চড়িয়েছেন বড় জা। পুকুরের পানা তুলতে লোক লেগেছে। ঘরামিরা চাল ছাইছে। জন দশেক লোক খাবে। এই এক ডেকচিতে সকলের ভাত চড়েছে। চাল ফুটে উঠল। ভারী ঢাকনাটা ঢক ঢক করে যেন মাথা কুটতে শুরু করল। 

বড় ভাশুর দু’খালুই পুঁটিমাছ এনেছেন। গিরিবালা এতক্ষণ ধরে হেঁশেলঘরের এক পাশে বসে সেগুলো কুটছিল। এ কি এক হাতের কাজ! কিন্তু গিরিবালা জানে, এসব ছোট কাজে কেউ হাত লাগাবে না। বড় জা সেই ঘরেরই অন্য ধারে পা ছড়িয়ে বসে, দুই মেয়ে নিয়ে জমিয়ে গল্প করছেন আর কাজ করছেন। কাজ তো ভারী! যারা পুকুর সাফ করছিল, তারা এক ডাঁই কলমি শাক তুলে দিয়েছে। তিনজনে মিলে তাই বাছতে লেগেছেন। গিরিবালা একবার চেয়ে দেখল, এখনও অর্ধেকও হয়নি। 

বড় জা বড় মেয়েকে বললেন, ও চম্পি, ভাতটা একবার দ্যাখ তো? 

চম্পি অসন্তুষ্ট হল। 

গোমড়া মুখে বলল, ক্যান, চম্পি দ্যাখবে ক্যান, বাড়িতি কি আর মনিষ্যি নেই? 

ঝাঁ করে গিরিবালার কান লাল হয়ে গেল। কোন লক্ষ্যে যে এ বাণ ছোড়া, তা বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হল না তার। 

বড় জা বললেন, লোক থাকবে না ক্যান, লোকের মধ্যে তো দেখতিছি এক বাঁদি, এই আমি আর তো সবার হাতই জুড়া। 

গিরিবালা বুঝল, সবার মানে গিরিবালার কথা বলা হল। ওর অন্তরাত্মা শুকিয়ে গেল। এই বাড়িতে এসে অবধি সে বড় ভয়ে ভয়ে থাকে। কী জানি কেন, গিরিবালার মনে হয়, এখানকার কেউ তাকে ভাল নজরে দেখে না। বিশেষ করে মেয়েমহল। মুখে কেউ কিছু বলে না। কিন্তু ওদের আড়া-আড়া ছাড়া-ছাড়া ভাব দেখে গিরিবালা বুঝতে পেরেছে, ওকে খুব প্রসন্ন মনে কেউ যেন গ্রহণ করেনি। 

গিরিবালা প্রাণপণে পরিশ্রম করে. যে যা বলে করে দেয়। কারওর কোনও কথায় থাকে না। সকলের মন জুগিয়ে চলবার চেষ্টা করে। প্রত্যেকের সুবিধে অসুবিধে দেখে। কিন্তু তাকে কেউ দেখে না। এইটেই ওর কাছে আশ্চর্য লাগে। ব্যথাও পায়। 

সকাল থেকে উঠেই তার খাটুনি শুরু হয়। একে বাড়িটা বড়, তার উপর ছাড়া ছাড়া, এ পোঁতায় একখানা ঘর, ও পোঁতায় আরেকখানা, সে পোঁতায় আরেকখানা, এমনি ধারা বাড়ি। ছিরিছাঁদ সুবিধের ঠেকে না তার কাছে। ছুটোছুটি করতে করতেই প্রাণান্ত হয় তার। তায় এরা বড় অগোছালো। কী রকম যেন! অযত্নে অবহেলায় কত জিনিস যে নষ্ট হয়, সেদিকে কারওর কি লক্ষ আছে? কোনও কাজ কেউ গুছিয়ে করে না। অথচ বাড়িতে বড় বড় দুটো মেয়ে, চম্পি আর যুথি। বিয়ের বয়স দু’জনেরই হয়েছে। চম্পির বিয়ের চেষ্টাও চলছে. কিন্তু ওরা ওদের আড্ডা আর মেজাজ নিয়েই আছে। 

চম্পি কলমির বড় বড় ডগাগুলো পুট পুট করে ভাঙতে লাগল। যুথি কোনও সাড়াশব্দই দিল না। ডেকচির ঢাকনাটা বার কয়েক ঢকাস ঢকাস করে বড় বড় গুঁতো মারল। 

বড় জা বললেন, তা হলি পুড়ুক ভাত, পুড়ে যাক। গর্ভের সন্তান, সেই কথা শোনে না, কারে আর কী কব? 

চম্পি খরখর করে বলে উঠল, বাড়ির মেয়েরা কি চিরটাকাল হাঁড়ি ঠ্যালবে না কি? যদ্দিন লোক ছিল না, খাটতি তো কসুর করিনি। একটা কাজ হাতে নিয়ে দিন কাবার করার কায়দা আমরা শিক্ষে করিনি। 

চম্পির কথা শুনে গিরিবালার চোখ ফেটে জল এসে গেল। এত কাজ করার পরও কেমন সব কথা শুনতে হয় দেখো। গিরিবালা মাছ কোটা বন্ধ রেখে উঠে গেল। হাতটা বেশ করে ধুয়ে এসে ডেকচির ঢাকনাটা এক পাশে সরিয়ে দিতেই এক বলক ফেন উথলে উঠল, গরম বাষ্প বুজবুজ করে বেরিয়ে গেল। খুন্তি করে গোটাকতক ভাত তুলে এনে টিপে দেখল, হয়ে গেছে। ডেকচির ভিতর ভাতগুলো আস্তে করে ঘুটে খুন্তিটা ঠক ঠক করে ডেকচির কানায় ঠুকল গিরিবালা, তারপর একটা থালার উপর খুন্তিটা রেখে ঢাকনাটা আবার চাপা দিল। এবার ভাত নামাতে হবে। ডালের বোগনোর পাশে ন্যাতা পড়ে ছিল। গিরিবালা সে দুটো তুলে এনে ভাতের ডেকচি নামাতে গেল। 

ডেকচিটা কী ভারী! এতটা ভারী তা আগে বুঝতে পারেনি গিরিবালা। প্রথমবার তো তুলতেই পারল না। অপ্রস্তুত হল। 

বলল, ও বড়দি, এ যে দেখতিছি বেশ ভার। 

ভেবেছিল এ-কথা শুনে কেউ হয়তো হাত লাগাতে আসবে। কিন্তু যে রকম মন দিয়ে কলমির শাক বাছতে আরম্ভ করেছে ওরা, তাতে মনে হয়, ওরই সঙ্গে ওদের বাঁচন মরণ জড়িয়ে আছে। 

বড় জা একটা হাই তুলে বললেন, হ্যাঁ, খুব সাবধানে নামাস। 

গিরিবালা বড় জা’র জবাব শুনেই বুঝল, কারও আর হাত লাগাবার কোনও ইচ্ছেই নেই। এইবার গিরিবালা ভাবনায় পড়ল। এত ভারী ডেকচি যদি না নামাতে পারে? তবে বড় বে-ইজ্জত হয়ে যেতে হবে। ওরা হাসাহাসি করবে। চিরকাল খোঁটা দেবে। পাড়ায় পাড়ায় কথাটা রটে যেতে বিলম্ব হবে না। না, গিরিবালা কথা বলবার সুযোগ দেবে না কাউকে। তার কেমন জেদ চেপে গেল। দাঁতে দাঁত চিপে সে সর্বশক্তি দিয়ে ডেকচিটা তুলে ধরল। তুলতেই বুঝল, গোঁয়ারতুমিটা করে খুব ভুল করেছে। 

ডেকচির ভারে তার শরীরটা নুইয়ে পড়ল। সবসুদ্ধ উনুনের উপর উলটে পড়ে বুঝি। গরম ডেকচির তাপ তার গায়ে লাগছে। উনুনটা লকলক জিভ বের করে গিরিবালাকে গ্রাস করার জন্য এগিয়ে আসছে। অদৃশ্য হাতে জোরে টান মারছে। গিরিবালা প্রাণপণ শক্তিতে প্রতিরোধ করতে লাগল। তার পিঠ পেট কোমর টনটন করছে প্রবল চাপে। মনে পুড়ে মরার প্রবল আতঙ্ক। কপালের ঘাম টস টস করে পড়ছে, চোখে এসে ঢুকছে। শরীর থরথর করে কাঁপছে। হাতের পেশি সব যেন পট পট করে ছিঁড়ে যাবে। মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। চোখে অন্ধকার দেখল। আবার সেই গাঢ় অন্ধকারে উজ্জ্বল অজস্র সব আলোর বিন্দু ছুটাছুটি করতে লাগল। আর প্রতিরোধ করতে পারছে না গিরিবালা। ডেকচি সমেত সে নিজেও পড়তে শুরু করেছে। আর রক্ষা নেই। এবার হাঁড়িসুদ্ধ উনুনে পড়বে, সিদ্ধ হয়ে সে মরবে। খোকার কী হবে! ভূষণ কোথায়? 

ধপ করে গিরিবালা নামিয়ে ফেলল ডেকচিটা। উনুনে নয়, একেবারে ওর পায়ের উপর একটুখানি ফেন চলকে পড়ল পায়ে। ‘উঃ’করে উঠল যন্ত্রণায়। পায়ের আঙুল ছেঁচে গিয়েছে। গরম ফ্যান পড়ে পা জ্বালা করছে। ফোসকা পড়ে উঠল। মাথাটা যেন টলছে। মুখ টিপে ব্যথা সামলাল। চোখ বুজে টাল সামলাল। 

বড় জা নির্বিকারভাবে বলে উঠলেন, ও কী, পা-র উপর ফেললি। সাবধানে নামাতি কলাম না! কী ফুসকা পড়ল নাকি? আর পারিনে বাপু। যাও, একটু আলু ছেঁচে লাগায়ে দ্যাও। 

এমন সময় পরিত্রাহি চিৎকার করে কেঁদে উঠল গিরিবালার খোকা। যেন মাকে ওই অস্বস্তিকর পরিবেশ থেকে মুক্তি দিতে ইশারা করে ডাকল। 

গিরিবালা তাড়াতাড়ি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে দেখে, খোকা চৌকাঠের বাইরে গড়াগড়ি খাচ্ছে। বারান্দার একেবারে কিনারে চলে এসেছে! আর একটু হলেই উঠোনে গড়িয়ে পড়ত। সৰ্বনাশ! দরজা ডিঙোতে শিখেছে! আর বাঁচানো যাবে না ছেলেকে। কে সর্বদা চোখে চোখে রাখবে। নিজের যন্ত্রণা আর খোকার ভাবনায় সে জেরবার হয়ে ঘরের ভিতর গিয়ে ঢুকল। সে আর দাঁড়াতে পারছে না। খাটের উপর খোকাকে নিয়ে শুয়ে পড়ল। ফোসকার ব্যথায় কাতর হয়ে গোঙাতে লাগল সে। গিরিবালা ভাতের ডেকচিটা উপুড় না করেই চলে গেল দেখে বড় জা একটু অসন্তুষ্টই হলেন। চম্পিকে একটা ধমকও দিলেন। 

ভাত যে এতক্ষণ গলে পিন্ডি হয়ে গেল, ও চম্পি! কার ছিরাদ্দে দেওয়া হবে শুনি? 

ধমক খেয়ে চম্পি অপমানিত বোধ করল। 

কার ছিরাদ্দে আর দেব?— সে মুখে মুখে জবাব করল, যাই নিজির পিন্ডি নিজিই সাজাই গে। এ বাড়ির হয়েছে বেশ, এক এক কাজ সারতি জুনা সাতেক করে লোক চাই! 

দুম দুম পা ফেলে সে ডেকচিটার কাছে এগিয়ে গেল। ফেন গালতে সেটা সরাতে গেল। কিন্তু নড়াতে পারল না। ও বাবা, এ যে দেখছি জগদ্দল পাথর! ছোট কাকি নামাল কী করে? অবাক হয়ে গেল চম্পি। এই ডেকচি কাকিমার পায়ের উপর পড়েছে? কী সর্বনাশ, সে পায়ের তো আর কিছু নেই তা হলে। চম্পি ব্যস্ত হয়ে উঠল। তাড়াতাড়ি কোনওমতে গড়িয়ে-টড়িয়ে ফেন ঝরাবার জায়গাতে হাঁড়িটা নিয়ে গেল চম্পি। ডেকচিটাকে ঢাকনা সমেত কাত করে বসিয়ে রেখেই হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেল। 

.

বাঁ পায়ের আঙুলে আর ডান পায়ের গোড়ালির উপরে ফোসকা পড়েছে। সেখান থেকে তীব্র যন্ত্রণা উঠে সমস্ত শরীর যেন ছিঁড়ে ফেলছে। বিছানায় শুয়ে খোকাকে মাই খাওয়াচ্ছিল গিরিবালা আর ব্যথার বিষে নিঃশব্দে কাঁদছিল। ওর মনে হচ্ছিল বুঝি জ্বর এসে গেছে। 

চম্পি ঘরে ঢুকেই বলল, দেখি কাকিমা, তুমার পা দেখি। 

গিরিবালা ধড়মড় করে উঠে বসল। এ আবার কী খেলা! মনে মনে সে শঙ্কিত হল। খাওয়ার ব্যাঘাত ঘটায় খোকাও কেঁদে উঠল। 

শোও শোও, শুয়ে পড়ো। যা করছিলে, করো। আমি পা দু’খানা দেখি। 

গিরিবালার পায়ের অবস্থা দেখে চম্পি শিউরে উঠল, ই-স! 

গিরিবালা মনে মনে চটে গেল। আবার আদিখ্যেতা হচ্ছে! 

চম্পি সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে গেল সেখান থেকে। বড় অপরাধী বলে মনে হতে লাগল নিজেকে। সেই তো দায়ী। তার বোঝা উচিত ছিল, অত বড় অত ভারী ডেকচি নামানো কারও একার পক্ষে সম্ভব নয়। কেন সে তখন এগিয়ে যায়নি। যদি আজ মারাত্মক কাণ্ড কিছু ঘটে যেত! খুব ফাঁড়া কেটেছে আজ বাড়ির লোকের। আর মাকেও বলিহারি যাই, ভাঁড়ারঘরে ঢুকে নারকেল তেল আর চুন ফেটাতে ফেটাতে চম্পি মায়ের উপর চটে উঠল। ওই যজ্ঞি রাঁধার হাঁড়ি আজ নামাবার দরকার ছিল কী? না হয় তিন চড়া ভাত হত! 

চম্পি তেলে-চুনে মিশিয়ে নিয়ে গিরিবালার ঘরে গিয়ে ঢুকল। 

বলল, যাই বলো কাকিমা, তুমি লোক সুজা নও। একবার আসো বলে ডাকতি কী হয়েছিল? যদি আখার উপর গিয়ে পড়তে, পুলিশি যে আমাগের হাতে দড়ি দিত। দ্যাও, লাগায়ে দিই ওষুধটা। 

গিরিবালা বিব্রত হয়ে ‘না না’ করে উঠল। 

চম্পি ধমক দিল, থামো। 

তারপর জোর করে ব্যথার জায়গায় প্রলেপ লাগিয়ে দিতে লাগল। পাছে আরও ব্যথা লাগে তাই কিছুক্ষণ গিরিবালা সিঁটিয়ে রইল। সে অবাক হয়ে চম্পিকে দেখল খানিকক্ষণ। কই, ওর মুখে তো বিরাগের ছাপ নেই! চোখে মুখে তো আন্তরিকতাই ফুটে বেরোচ্ছে। তবে, এর সম্পর্কে তার খারাপ ধারণা হয়েছিল কেন?  

চম্পি বলল, দ্যাখো কী? আমার মন পাষাণ কি না? 

অপ্রস্তুত হয়ে গিরিবালা ডাহা মিথ্যে কথা বলল, ছি-ছি, তুমারে তা ভাবব ক্যান। কোনওদিন তা ভাবিনি। 

গিরিবালাকে সেদিন আর কাজকর্ম করতে দিল না চম্পি। প্রায় জোর করেই শুইয়ে রাখল বিছানায়। চম্পিকে মনে মনে শত ধন্যবাদ দিল গিরিবালা। তার পায় ব্যথা হয়েছে। পায়ের যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে উঠেছে সে। এর উপর কাজকর্ম করতে হলে সে ঠিক মরে যেত। চম্পির মনটা ভালই। সে এতদিন বুঝতে পারেনি। 

.

শ্বশুরবাড়ির প্রায় কাউকেই গিরিবালা বুঝতে পারে না। কেন যে এটাকে বিভুঁই বলে মনে হয়, কে জানে! এখানেও যে-আকাশ, যে-মাটি, তার বাপের বাড়িতেও তো সেই আকাশ, সেই মাটিই। সেই একই রোদ বৃষ্টি ঝড়। তবু বাপের বাড়ির আকাশে যেমন প্রশ্রয়, সে-মাটিতে যেমন স্নেহক্ষরা আশ্রয়, এখানকার আকাশ, বাতাস মাটিতে সেই আস্বাদটা কেন পায় না গিরিবালা। 

বাপের বাড়ির রোদে কেমন তেজ। আরাম দেয়। এখানকার রোদ তাকে পোড়ায়। এখানকার বৃষ্টি তাকে কেবল হেনস্থাই করে, ঝড় তাকে শাসায়। সে যেন এখানে অনধিকার প্রবেশ করেছে। এটা যেন তার বিরুদ্ধ পুরী। আর আশ্চর্য, শ্বশুরবাড়ির বিভিন্ন লোকের মুখে মনে যেন এই ভাবটাই লেখা আছে বলে গিরিবালার মনে হয়. সে হাঁফিয়ে ওঠে। মন কেমন করে তার। 

কাজের মধ্যে ডুবে থাকে গিরিবালা। বাড়িতে লোক তো কম নয়। শাশুড়ি, বড় জা, দুই ভাশুরঝি, ভূষণ, সে, খোকন, দু’জন বাইরের কাজ করার লোক। হ্যাঁ, আরও একজন আছেন, বকশিমশাই। ইনি যে এ-বাড়ির কে তা জানে না গিরিবালা। চুপচাপ থাকেন। দু’বেলা দুটো খান আর হুঁকো টানেন। বয়েস কত তাও বোঝা যায় না। রোগা, হাড় বার-করা শরীরটা। এত লোকের কাজ গিরিবালাকে সামলাতে হয়। দিনরাত কোথা দিয়ে বেরিয়ে যায়, সে বুঝতে ও পারে না। 

খোকাকে যত্ন করতে বলেছিল বড়মা। কিন্তু কখন করবে? প্রথম প্রথম দিনকতক খুব যত্ন নিয়েছিল গিরিবালা। কিন্তু সেটা নাকি আদিখ্যেতা, সে এই কথাই শুনতে পেল। চাপা কানাকানিও তার কানে গেল: ছেলে যেন এক গিরিবালারই হয়েছে, ত্রিভুবনে আর কারও ছেলে যেন মানুষ হয়নি। 

গিরিবালা না হয় জানে না, বোঝে না, কী করে কী করতে হয়। তাই হিমসিম খায়। সামলাতে পারে না। কিন্তু তার শাশুড়ি তো জানেন, বড় জা তো জানেন? তাঁরা কেন কিছু বলেন না? তাঁরা কেন এ-ভারটা নেন না? গিরিবালার না হয় ছেলেপুলে হয়নি এর আগে, ওঁদের তো হয়েছে। 

কিন্তু এটা তার বাপের বাড়ি নয়, এখানে বড়মা, পিসিমা, কাকিমা নেই। সহানুভূতি, সমবেদনা নেই। সহযোগিতা নেই। আছে শুধু নিষ্করুণ সমালোচনা, পদে পদে খুঁত ধরার বিকারগ্রস্ত উৎসাহ। শ্বশুরবাড়িটাকে গিরিবালার মনে হয় ফুল-ফলহীন শুধু চোরকাঁটা বিছানো এক বিস্তীর্ণ ক্ষেত্র। 

তাই গিরিবালা নিজেকে শামুকের মতো গুটিয়ে রাখে। এমনকী প্রকাশ্যে সে খোকনের উপরও দৃষ্টি দেয় না। সময়মতো খাওয়াতে পারে না, খিদেতে চিৎকার করতে থাকে তার ছেলে। কেঁদে কেঁদে বাড়ি ফাটিয়ে ফেলে। কিন্তু সে অবুঝটা তো বুঝতে পারে না তার মা বন্দি হয়ে আছে সংসারের কাজে। হেঁশেলে কি অন্য কোথাও। হাতের কাজে সে তখন মন বসাতে পারে না। মনে মনে সান্ত্বনা দিতে থাকে, চুপ কর, চুপ কর, বাবা আমার, এই যে হয়ে আলো, হয়ে আলো। কাজ সারবার জন্য সে তাড়াহুড়ো করতে যায় আর গোলমাল করে ফেলে। দেরি হতে থাকে তার। বিরক্ত হয়ে ওঠে গিরিবালা। মুন্ডুপাত করতে থাকে মনে মনে। বড় জা, ভাশুরঝি, শাশুড়ি, ভূষণ— কাউকেই সে রেয়াত করে না। নিজেকেও না। এমনকী, কখনও কখনও খোকনকেও ছাড়ে না। 

তার একমাত্র সুহৃদ এখন রাত। রাত গভীর হলে গিরিবালা বেঁচে যায়। খোকনের উপর অজস্রধারে সে তখন স্নেহ ঢালতে থাকে। ইস, কী ঘামাচিই না বেরিয়েছে দেখো ওর সারাটা গায়ে। এ কী, বুকে আবার বিষফোটটা কখন বেরোল? চুলে কেমন জট পাকিয়েছে দেখেছ। মা গো, সারা গায়ে ধুলো-মাটি থিগবিগ থিগবিগ করছে। আঁচল দিয়ে মুছিয়ে দেয় পরম যত্নে। চুলগুলো আঁচড়ে দিতে পারলে ভাল হত। কিন্তু এ-ঘরে চিরুনি নেই। এত রাত্রে চিরুনিটা আনতে বড় আলস্য লাগে তার। তার চোখেও ঘুম এসে গিয়েছে। যাক, কাল আঁচড়ালেই চলবে। ঘুমন্ত ছেলের মুখে গোটাকতক চুমু খেয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয় তাকে। ছেলেটা দিন দিন কেমন রোগা হয়ে যাচ্ছে। সে-ও ঘুমিয়ে পড়ে সঙ্গে সঙ্গে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে গিরিবালা বড়মা, পিসিমা আর কাকিমার ধমকানি শোনে। তাতে তার রাগ হয় না। সে বরং খুশি হয়। একেবারে নির্বান্ধব সে নয়। আছে আছে, এই পৃথিবীতেই এমন জায়গা আছে, যেখানে তার সান্ত্বনা, আশ্রয় মিলবে। পরম সুখে খোকাকে কোলে টেনে নেয় গিরিবালা। 

বুঝি তার ঘুমই এসেছিল। কপালে কার শীতল স্পর্শ পেয়ে সে চমকে উঠল। বড়মা! চোখ মেলে সে অবাক হল। বড় জা। তার পিছনে শাশুড়ি। ধড়মড় করে উঠে বসল গিরিবালা। 

বড় জা বললেন, ওলো, তোর যে জ্বর হয়েছে। শুয়ে থাক, শুয়ে থাক। 

এ তো বড় জা নয়, বড়মা। শরীর জুড়িয়ে গেল তার। চোখ দিয়ে জল ঝরে পড়ল।

শোও শোও, পালোয়ানের বিটি। শাশুড়ি বললেন। 

এ কোন শাশুড়ি! 

ভয় নেই মা, সামান্য গা গরম হয়েছে। তাড়শের জ্বর। চম্পির মুখে শুনে আমি তো থরথরায়ে মরি। কী কাণ্ড করিছিলে মা, অল্পের উপর দিয়ে গেছে, তাই রক্ষে। একটু এদিক-ওদিক হলিই একেবারে সব্বনাশের মাথায় বাড়ি। কাঁচা পুয়াতি তুমি, অমন গোঁয়ারতুমি কি করে? ছি-ছি! 

গিরিবালাকেও কোনওদিন বকেননি এঁরা, আজ বকছেন। কিন্তু কই, গিরিবালার মনে তো তার জন্য কোনও কষ্ট হচ্ছে না। সে এতে সুখ পাচ্ছে বরং। তবে কি এ-বাড়িতেও স্নেহ আছে, ভালবাসা আছে? তার জন্য দুশ্চিন্তায় অধীর হয়ে ওঠবার মতো হৃদয়ও আছে? এ কী আশ্চর্য আবিষ্কার করে ফেলল গিরিবালা! কার মুখ দেখে আজ ঘুম ভেঙেছিল তার! 

চম্পি এল এক বাটি দুধ নিয়ে। 

কাকিমা, খাও। 

কিন্তু গিরিবালার খিদে আর নেই। জ্বালা নেই, যন্ত্রণা নেই। সে যে অমৃত পেয়েছে আজ সারা জীবনই এখন না খেয়ে কাটাতে পারে। 

দুধের বাটি দেখে তার ছেলে উঠে বসল। কচি কচি হাত বাড়িয়ে, দুলে দুলে বলল, দাদ্‌দা!

চম্পি হেসে বলল, তবে রে হ্যাংলা! এ তুমার দুধ না। মা খাবে। 

চম্পির কথা শুনে ফোকলা মুখে সে হাসতে লাগল। 

দাদ্‌ দাদ্‌ দা! 

হাত দুটো উপরে তুলে ঘোরাতে লাগল। 

বড় জা, শাশুড়ি, চম্পি হাসতে লাগল। গিরিবালাও হেসে ফেলল। 

শাশুড়ি বললেন, বুঝিছি দাদু, বুঝিছি। খিদে পায়েছে। চলো, ছ্যান করে খাবা। 

চান করিয়ে, চুল আঁচড়ে, কাজল-টার্জল পরিয়ে চম্পি যখন খোকাকে দিয়ে গেল গিরিবালার কোলে, সে তখন তাকে প্রায় চিনতেই পারে না। 

চম্পি অনুযোগ করল, কী নোংরা করেই যে এরে রাখো কাকিমা? দ্যাখো দিন, কেমন রাজপুত্তুরির মতো দেখাচ্ছে এখন। যাই বলো বাপু, তুমি বড় ঢিলেঢালা। 

তা হয়তো সে একটু আছে। অস্বীকার করছে না গিরিবালা। একেবারে নতুন তো, বাপের বাড়িতে কি এত কাজ করতে হয়েছে নাকি কখনও! 

ন্যাও, আজ বাড়া ভাত খাওয়ার কপাল তুমার, পাটে বসে বসে তাই খাও। 

চম্পি হাসল। গিরিবালাও হেসে ফেলল। ঠাট্টা করছে চম্পি। তা করুক। এটা ঠাট্টাই। এতে ঝাঁজ নেই, হুল নেই। শরীরে বেঁধে না, কাতুকুতু দেয়। 

বেশ মেয়ে চম্পি। বেশ মেয়ে। 

.

ভূষণের বড়দা বিলাস মেজাজ গরম করেই বাড়ি ফিরলেন। এই দুপুর পর্যন্ত টো-টো করে প্রজার বাড়িতে ঘুরেছেন, এক পয়সা আদায় হয়নি। রোদ লেগে বড় কষ্ট হয়েছে তাঁর। তার উপর খিদে পেয়েছে। এখন একটু জিরোবেন, তারপর চান করে পুজোয় বসবেন। এক ঘণ্টার আগে পুজো সারা হবে না তাঁর। তারপর খেতে বসবেন। তিনটের আগে আজ আর খাওয়া হবে না। 

বাড়িতে পা দিয়েই দুর্ঘটনার কথা শুনলেন। আর শুনেই মাথা চাপড়াতে চাপড়াতে গাঁক গাঁক করে চেঁচাতে লাগলেন। 

বলি ওগো, কনে গেলে, বউমা আস্ত আছে তো? 

শোনো কথা! দামিনীর পিত্তি জ্বলে গেল। নিজের জ্বালায় মরছেন তিনি, সংসারের কাজ তাঁর ঘাড়ে, নিশ্বাস ফেলবার ফুরসত নেই, আর মদ্দ এখন আড়াই পহর বেলায় বাড়ি ঢুকে চিন্তা দেখাচ্ছেন। তিনি জবাব দিলেন না। 

বলি, কেউ কথা কয় না ক্যান, চিতেয় উঠিছে নাকি? 

না, এতক্ষণে ওঠেনি, মড়ারা সব শুকোচ্ছিল, এতক্ষণে ডোম আলেন, ইবার ওঠবে।

দামিনীর কথা শুনে বিলাস লাফাতে লাগলেন উঠোনে। 

ওই মুখখানা আছে, তাই করে খাচ্ছ। বুড়ো মাগি বসে বসে খাবে, আর কচি মেয়েটারে দিয়ে আধমনি হাঁড়ি ঠ্যালাবে। ক্যান, গতরখানা তো সাতটা কুমিরিউ শেষ করতি পারে না, উডা নাড়াতি হইছিল কী? 

দামিনী এবার রান্নাঘরের দাওয়ায় এসে বললেন, দ্যাখো, চাষার মতো চ্যাঁচায়ে না। 

বিলাস একেবারে গাড়ু নিয়ে ছুটে গেলেন। 

কী বললি? আজ তোর ওই মুখ থ্যাতো করে দেব। 

যুথি হাউমাউ করে ছুটে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরল। দামিনী রান্না ফেলে কাঁদতে কাঁদতে 

ঘরে গিয়ে খিল দিলেন। ভূষণের মা ভিতু মানুষ। বড় ছেলের হাঁকডাক শুনে এক কোনায় বসে ইষ্টনাম জপ করতে থাকলেন। চম্পি আর যুথিকে যাচ্ছেতাই করে বকলেন বিলাস। 

হাতিগুলো বসে বসে শুধু গেলবে। হাতিগের পার করতি করতি ফতুর হয়ে গেলাম, তবু পাল শেষ আর হয় না। হাড় যে জুড়োবে কবে! 

বাবার কথায় চম্পির বুকে যেন শেল বাজল। তার দোষটা কী? সে কি কাকিমার পায়ে হাঁড়িটা চেপে ধরেছে না গরম ফ্যান তার গায়ে ঢেলে দিয়েছে! হাঁড়িটা যে এত ভারী, সে তা জানবে কী করে? কাকিমা বলতেও তো পারত। একটা ডাক দিলেই সে গিয়ে হাত দিত হাঁড়িতে। এমন তো নয়, সে কাজকর্ম করে না। 

এ-সবই কাকিমার শয়তানি। ওর ওই আহ্লাদি আহ্লাদি ভাবখানা দেখে ওকে যত সাধাসিধে মনে হয়, উনি তা আদৌ নন। ইচ্ছে করেই ও আজ এই ব্যাপারটা ঘটিয়েছে। সবাইকে বকা খাওয়াবার জন্য। আসলে ওর তেমন লেগেছে কি না সে সম্পর্কেই চম্পির এখন সন্দেহ হচ্ছে। ঢং করে গিয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। 

রাগে কস কস করতে করতে গিরিবালার ঘরে গিয়ে উঠল চম্পি। 

যতটা পারে বিষ ঢেলে দিল কথায়, তুমারে একা একা ওই হাঁড়ি নামাতি কইছিল কিডা? খুব যে কাজ দ্যাখায়ে আলে? এখন তো বিছানায় আসে উঠিছ। কড়া দাসী বাঁদি সঙ্গে পাঠায়েছে তুমার বাবা? ইবার তাদের দিয়ে কাজ করাও। আমরা পারব না। 

কথা তো নয়, গিরিবালার বুকে ক্যাত ক্যাত লাথি মেরেই যেন চলে গেল চম্পি। সে ছটফট করতে লাগল অপমানে আর লজ্জায়। জিভে কী তীক্ষ্ণ ধার চম্পির? শুধু শুধু তাকে অপমান করে গেল। বটঠাকুরের চিৎকার শুনে মরমে মরে গিয়েছিল গিরিবালা। এখন চম্পির বাক্যের চোটে সে মৃত্যুর অধিক যন্ত্রণা পেল। 

এ-বাড়িতে গিরিবালা থাকতে পারবে না। আসুক ভূষণ। সব সে বলবে। প্রতিকার চাইবে। ভূষণ যদি কিছু না করে, করবে না বলেই বিশ্বাস, তখন বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে বলবে তাকে। না যদি পাঠায় তো বাবাকে আসতে লিখে দেবে। কালই চিঠি লিখবে বাবাকে। 

দুই 

বেলা অনেক হয়েছে। চৈত্রের রোদ দাউদাউ করছে। ভূষণ ডাক্তারখানা বন্ধ করি করি করেও করতে পারছিল না। চর ছোলেমানপুরের মনিরুদ্দি শেখের টাকা দিয়ে যাবার কথা আছে। প্রায় তিরিশ টাকা পাবে ভূষণ। ক’টাকা দেবে কে জানে? 

ভূষণ তার হিসেবের খাতাখানা খুলে দেখতে লাগল। কোটচাঁদপুর থেকে ডাক্তারখানা তুলে এনেছে ঝিনেদায়। বউ ছেলে বাড়িতে রেখে তার কোটচাদপুরে পড়ে থাকা ভাল দেখায় না। ওখানে ওদের নিয়ে যেতে পারলেও কথা ছিল। অবশ্য ঠিকেদার জোসেফ মণ্ডল আর রামগতি কুন্ডু ওকে সেই পরামর্শই দিয়েছিল। ভালমতো একখানা বাসা দেখে দেবে, সে-কথাও বলেছিল। জোসেফ তার ঠিকেদারির কাজেও অংশীদার করতে চেয়েছিল ভূষণকে। পরামর্শটা ভালই লেগেছিল ভূষণের। 

আর তার জন্য যে অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হত, তা তো নয়। রোগী দেখার ফাঁকে ফাঁকেই সে ঠিকেদারির তদারক করতে পারত অনায়াসে। কোটচাঁদপুরে তখনও ভালভাবে তার প্র্যাকটিস জমেনি। আর জমবার সময় যখন হল, ভূষণ তখন এমন একটা কাজে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে যে, প্র্যাকটিস তো দূরের কথা, তার নাওয়া-খাওয়ার সময় পর্যন্ত সে পায়নি। এত পরিশ্রমের পর, ভূষণ বুঝল কোটচাঁদপুরে মশা যেমন প্রচুর, তা নিয়ে গবেষণা করার সুযোগ তেমনই কম। না আছে সাজসরঞ্জাম, না বইপত্তর। তার উপর লোকগুলোর মনোভাব তেমন অনুকূল নয়। কতকগুলো ফক্কড় লোক তার পিছনে লেগে গেল। একদিন ডিস্পেনসারিতে এসে দেখল, কে বা কারা ওর দরজার পাল্লায় চকখড়ি দিয়ে বড় বড় কাজ করে ‘এম ডি’ অর্থাৎ ‘মশার ডাক্তার’ লিখে রেখে দিয়েছে। 

মনে মনে দুঃখ পেলেও, ও-সব আমলেই আনেনি ভূষণ। বড় বড় কাজ যারা করে এসব ব্যঙ্গবিদ্রূপ তাদের সইতেই হয়। সে জন্য সে কাতর হল না, কাতর হল অন্য কারণে। তার ইনকাম কমে গেল যে। ওখানে টিকে থাকাই মুশকিল হয়ে পড়ল। সেই সময় আবার শ্বশুরবাড়ি থেকে বউ-ছেলেকে নিয়ে ভূষণ বাড়িতে রেখে এল। তখন সবাই পরামর্শ দিল কোটচাঁদপুর ছেড়ে ঝিনেদায় এসে বসতে। কোটচাদপুরে বউ আর কচি ছেলেকে নিয়ে যাওয়া সমীচীন বোধ করল না। বড়দারও মত নেই তাতে। দাদাদের সে খুব মান্য করে। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভূষণকে অমন সুযোগটা ছেড়ে আসতে হল। 

সুযোগ বই কী? তালিমারা প্যান্ট আর হাত-কাটা কোট পরে জোসেফ এসে যখন বোঝাত, ঠিকেদারি এমন একটা জীবিকা যাতে লোক সহজেই লাল হয়ে উঠতে পারে, কুড়ি বছরের অভিজ্ঞতা থেকেই জোসেফ এ-কথা বলছে, তখন ভূষণের মুখ চোখ চকচক করে উঠত। ঠিকেদারিতে ঢুকে পড়তে পারলে ভূষণ ভালই করত। লাল হয়ে উঠলে সে কি আর পয়সা নিয়ে রোগী দেখত? কক্ষনও না। একেবারে বিনা পয়সায় চিকিৎসা শুরু করে দিত। 

এখনও অবশ্য তাকে বিনা পয়সাতেই রোগী দেখতে হচ্ছে। খাতাটায় চোখ বুলিয়ে দেখল, অধিকাংশ রোগীর কাছেই তার টাকা বাকি। বাকির পরিমাণও কম নয়। শ’ দুয়েক তো হবেই। 

.

ঝিনেদায় এসে মাস তিনেক বসতে-না-বসতেই এত টাকা বাকি পড়ে গেল। ভূষণ জানে, ও টাকা আর আদায় হবে না। ওরা দিতে পারবে না টাকা। না, অসৎ নয় এরা, কেউ অসৎ নয়। কিন্তু ভূষণ তো জানে ওদের অবস্থা! কী অপরিসীম দুর্দশা ওদের। বেশির ভাগই না খেয়ে থাকে। টাকা দেবে কোত্থেকে? তার মধ্যেও ক্ষমতা হলেই ওরা টাকা শোধ করতে আসে। পরিমাণ হয়তো সামান্য। যার কাছে দশ টাকা সে হয়তো আট আনা নিয়ে আসে। ভয়ে ভয়ে সেই আট গন্ডা পয়সা ভূষণের দিকে বাড়িয়ে এইসব জীর্ণশীর্ণ মুখগুলো যখন করুণভাবে চায়, তখন ভূষণ যেন সেই পয়সা নেবার জন্য হাত আর পাততে পারে না। এদের মতো মানুষ সত্যিই হয় না। ফসল হলে এরা ফসল দেয়। কিছু না পারলে জন খেটেও টাকা শোধ করতে চায়। 

ভূষণ ওদের চেনে, ওদের বোঝে। ওরাও খুব ভালবাসে ডাক্তারবাবুকে। তাই ওই অঞ্চলের নিঃস্ব চাষিদের মধ্যে ভূষণের পসার দ্রুত বেড়ে চলেছে। তারই সঙ্গে তাল রেখে ভূষণের আলমারি খালি হয়ে পড়ছে। 

ভূষণ যখন নতুন ডাক্তারখানা খোলে, তখন থাক-কাটা দুটো বড় বড় আলমারি বানিয়েছিল। থাকে থাকে অজস্র শিশি সাজানো থাকত। প্রত্যেকটিতে তখন আসল ওষুধ ছিল। সব ওষুধের মাদার টিংচার। ‘সিক্স এক্স’ থেকে শুরু করে থাউজেন্ড ডাইলিউশনের’ সবরকম ওষুধ। মহাত্মা হ্যানিম্যানের আপন দেশ জার্মানি থেকে আমদানি করা। হয় ‘পাউডার অব মিল্ক’ আর না হয় নানা রকম মিষ্টি ‘গ্র্যানিউলস’ ‘গ্লোবিউলস’-এর সঙ্গে মিশিয়ে পুরিয়া করে ওষুধ দিত ভূষণ। পারতপক্ষে জলের সঙ্গে সে ওষুধ দিতে চাইত না। দিলে যে ক্ষতি হত তা নয়, ওটা ভূষণের আভিজাত্যে বাধত। 

ভূষণের এখন বড় দুঃখ, তার আসল ওষুধ এসে ঠেকেছে মাত্র ছোট্ট দুটো হোমিওপ্যাথির বাক্সে। আলমারির শিশিগুলোতে এখন শুধু জল ভরতি। ভদ্রলোক রোগী এলে আগে যেমন ভূষণ বুক ফুলিয়ে আলমারির ডালা খুলে ফেলত, মনোমতো শিশিটা তাক থেকে বের করে এনে রোগীর সামনেই ওষুধ বানিয়ে দিত, এখন আর তা পারে না। এখন শিশিটা বের করে নিয়ে সে ছোট্ট একটু পরদা-ঘেরা জায়গায় চলে যায়। সেখানে সেই আড়ালে দাঁড়িয়ে, শিশিটা এক পাশে রেখে দেয়। তারপর সেই ছোট্ট বাক্স খুলে আসল শিশি বের করে ওষুধ বানায়। এই তঞ্চকতা তার ভাল লাগে না। কিন্তু সে যে বড় ডাক্তার, তার ওষুধ যে অফুরন্ত, সে-কথা বোঝাবার আর তো দ্বিতীয় কোনও রাস্তাও নেই। সব থেকে বড় আফশোস ভূষণের এই জার্মানি থেকে সরাসরি সে আর আজকাল ওষুধ আনাতে পারছে না। কিছুদিন আগে পর্যন্তও আনাতে পেরেছে। খাস জার্মানির বড় ফার্মের খাতায় তার নাম উঠেছিল। সেখান থেকে কত ক্যাটালগ আসত, ব্লটিং পেপার, প্রিন্টিং কার্ড, মাঝে মাঝে সুন্দর সুন্দর ক্যালেন্ডার! গর্বে ভূষণের বুক ফুলে উঠত। প্যাকেটের মোড়ক, চিঠির খাম, টিকিট সমেত টেবিলের উপর এমনভাবে রেখে দিত যেন সহজেই লোকের নজরে পড়ে। 

আজ ভূষণ শুধু একজন গেঁয়ো ডাক্তার। জীবনে কিছু করতে না পেরে কিছু লোক যেমন বাড়ি বসে মহেশ ভট্টাচার্যির বই পড়ে ‘এম-বি (হোমিও)’ হয়ে ওঠে, ভূষণও যেন তাদের গোত্রেরই একজন হয়ে উঠেছে। সে যে একদিন মেডিকেল স্কুলে অ্যালোপ্যাথি পড়তেই ঢুকেছিল, তিন বচ্ছর পড়েছিল, ক্লাসের সেরা ছেলে ছিল, অ্যালোপ্যাথি পড়া ছেড়ে না দিলে যে সে আজ মেরিটের সঙ্গে এল এম এফ হয়ে বেরোত, এ-কথা তো কেউ জানে না। 

না, জানেন। তার শিক্ষক, তার গুরু প্রতাপ মজুমদার জানেন। প্রতাপ মজুমদারের মতো অত বড় একজন ডাক্তার অ্যালোপ্যাথি প্রাকটিস ছেড়ে হোমিওপ্যাথিতে মন দিলেন। চৌষট্টি টাকা ভিজিট ছিল তাঁর। সোজা কথা! সেই লোক গড়পারে কলেজ খুললেন হোমিওপ্যাথির ভূষণ এসে তাঁর কলেজে যোগ দিল। প্রতাপবাবুর সেই খুশিতে-ফেটে-পড়া মুখ এখনও যেন দেখতে পায় ভূষণ। গোল্ড মেডেল নিয়ে সে পাশ করেছিল। বিদেশে যাবার বৃত্তিও জোগাড় করে দিয়েছিলেন সার। আশা করেছিলেন ভূষণ একদিন কলকাতার নামকরা ডাক্তার হবে। এখনও ভূষণের হাতের পোঁতা একটা গাছ তাঁর কলেজের গেটের পাশে রয়েছে। 

তার উপর ভূপতিরও খুব আশা ছিল। ভূপতি তার সেজদা। ভূষণ এরকম একটা লোক খুব কমই দেখেছে। যে সময়ে দেশের লোক বিলাত যাচ্ছে শুধু আই সি এস আর ব্যারিস্টার হয়ে আসতে, সে সময় তার সেজদা জাপানে গেলেন। যন্ত্রবিদ্যা শিখতে। পয়সাকড়ি ছিল না তাঁদের। তবুও সেজদা তাঁর ইচ্ছা পূরণ করেছিলেন। 

তা বিলাত না গিয়ে জাপানে কেন? সেজদার দূরদৃষ্টি ছিল, দেশপ্রেমও ছিল। সেজদা বলতেন, ইংরেজ আমাদের দেশটা দখলই করেছে তার শিল্পসম্ভার বিক্রির একচেটিয়া বাজার করে রাখবে বলে। এখান থেকে সস্তায় কাঁচা মাল কিনবে আর নিজের দেশের কলকারখানায় তাই দিয়ে মাল তৈরি করবে। আবার সেই সব মাল প্রচুর লাভ রেখে আমাদের কাছে এনেই বিক্রি করবে, করছেও। আমাদের গোটা জাতকে চাকর বানিয়ে রাখবে ওরা। রাখছেও। কোটি কোটি টাকা লুঠছে ওরা। লুঠবেও। অন্য কথা ছেড়েই দেওয়া গেল, এ দেশে একটা সুঁচও তৈরি হতে দেবে না ইংরেজরা। চিরকাল ওদের হাত-তোলা হয়ে থাকতে হবে আমাদের। আমরা তা যদি বন্ধ করতে চাই তো শিল্পপ্রতিষ্ঠার কৌশল আয়ত্ত করতে হবে। এ-বিষয়ে জাপান আমাদের গুরু। জাপান ইউরোপের কাছ থেকে কী কৌশলে তার বিদ্যা আয়ত্ত করল, কী কৌশলে ইউরোপকে হঠাল, সেই গুরুমারা বিদ্যেটা শেখবার জন্যই সেজদার আগ্রহ ছিল। শিখেও এসেছেন। সেলুলয়েড শিল্প প্রতিষ্ঠা করেছেন দেশে। এখন ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের উপর নজর পড়েছে তাঁর। এবার ফ্যাক্টরি গড়তে মন দিয়েছেন। 

সেই সেজদার খুব ইচ্ছে ছিল, ভূষণ আমেরিকায় যায়। সেখান থেকে ডিগ্রি নিয়ে আসে। টাকাপয়সা জোগাড় করে দিয়েছিলেন তিনি। পাসপোর্ট হয়ে গিয়েছিল তার। জাহাজের টিকিট, পোশাক-টোশাক কেনাও হয়ে গিয়েছিল। ভূষণ নিজেই সে-সব ভেস্তে দিয়েছিল। শেষ মুহূর্তে পালিয়ে গিয়েছিল। একেবারে নিরুদ্দেশ। সবাই জানে, ভূষণ মায়ের জন্যই যায়নি, যেতে পারেনি আমেরিকায়। আসল কথা কেউ জানে না। যে জানে সে ভূষণ, আর একজন হয়তো জানে। কিন্তু তার কথা এখন থাক। 

আমেরিকায় না গিয়ে তার যে খুব ক্ষতি হয়েছে, ভূষণ তা মনে করে না। বিদেশি ডিগ্রিতে তার সম্মান বাড়ত। কলকাতায় বসলে তার পসারও হত। কিন্তু কলকাতায় ডাক্তারি করতে তো সে চায়নি। সে গ্রামেই বসতে চেয়েছে। বিদেশি ডিগ্রি নিয়ে এখানে বসলে বেনাবনে মুক্তা ছড়ানোই হত। কিংবা এও তো হতে পারত, তখন আর ভূষণের গ্রামে এসে বসতে মনই চাইত না। সবাই যদি কলকাতায় যাবে, তবে গ্রামে থাকবে কে? 

গ্রামের লোকের হাতে পয়সা নেই, ভূষণ তা জানে। এও জানে, এদের চিকিৎসার কত দরকার। অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা ছাড়ার একটা প্রধান কারণও তাই। পয়সা কোথায় যে, দামি দামি সব ওষুধ কিনবে এরা? রোগী দেখলেই তো অসুখ সারবে না। প্রথম থেকেই ভূষণের কিন্তু এই চিন্তা ছিল। এমন একটা চিকিৎসা-পদ্ধতির কথা সে ভাবছিল যা নিতান্ত গরিবও অনায়াসে গ্রহণ করতে পারবে। এই হোমিওপ্যাথিই সে চিকিৎসা। হ্যানিম্যান, মহাত্মা হ্যানিম্যান এ যুগের সেই অশ্বিনীকুমার। 

একটা দমকা বাতাস এল। ভূষণের টেবিল থেকে ফরফর করে কতকগুলো হ্যান্ডবিল উড়ে ছড়িয়ে পড়ল মেঝেয়। ভূষণ তাড়াতাড়ি করে সেগুলো গুছিয়ে তুলতে লাগল। ভূষণেরই বিজ্ঞাপন। হাটে হাটে সে যেগুলো ছড়িয়ে দেয়। এগুলো বের করে রেখেছিল মনিরুদ্দির হাতে দেবে বলে। আর্ত-কল্যাণ চিকিৎসায়। এটা বড় বড় হরফে লেখা। ভূষণ বিজ্ঞাপনখানায় চোখ বুলিয়ে নিল। ডা. ভূষণচন্দ্র বসু, এম-বি, (হোমিও)। এটার হরফও বেশ বড় বড়। বেশ লাগে ছাপার হরফে নিজের নামটা পড়তে। গোল্ড-মেডেলপ্রাপ্ত। গোল্ড মেডেল কী, সে-কথা অনেক রোগীই বুঝতে পারে না। তাকে এ-সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে সে বেশ আত্মপ্রসাদ লাভ করে। ফার্স্ট হয়েছিলাম কিনা, সে গর্বের সঙ্গে জবাব দেয়। ‘ফার্স্ট’ কী তাও হয়তো জানে না ওরা, হাঁ করে থাকে। কলকাতা হোমিওপ্যাথিক কলেজের ভূতপূর্ব হাউস ফিজিশিয়ান। এই কথাটা বেশ গালভরা। ভূষণের প্রেস্টিজ বাড়িয়ে দেয়। সাত বৎসরের অভিজ্ঞ চিকিৎসক। না, আর সাত নয় তো, আট— এই নতুন সালে তার অভিজ্ঞতা যে আট বছরে পড়ল। ভূষণ তৎক্ষণাৎ ভুলটা সংশোধন করতে বসে গেল। প্রত্যেকটা বিজ্ঞাপনে কালি দিয়ে সাত কেটে আট বসাতে লাগল। এগুলো ফুরোলে আবার নতুন করে ছাপাতে দিতে হবে হ্যান্ডবিল। 

কিন্তু, কিন্তু সাইনবোর্ডের কী হবে? ওখানেও যে সাত বৎসর লেখা আছে। আবার নতুন করে লিখিয়ে নেবে নাকি? অনর্থক টাকা খরচ হবে আবার। তা হলে উপায়? তার অভিজ্ঞতার বয়স বছর বছরই তো বাড়বে। কিন্তু সাইনবোর্ডে তো অত সহজে আপ-টু-ডেট বসানো যাবে না বছরগুলো। তা হলে! একটা মিথ্যা ধারণা লোকের মনে ঢুকিয়ে দেবে ওই সাইনবোর্ডটা আর নয়তো বছর বছর টাকা খরচ করাবে। আর কি কোনও পথ নেই? এমন কোনও ব্যবস্থা করা যায় না যাতে সাপও মরে লাঠিও না ভাঙে? মাথায় চিন্তা ঢুকে গেল ভূষণের। 

কিন্তু মনিরুদ্দির হল কী? এতক্ষণেও এল না! আসবে তো, না কি? আর তো দেরিও করতে পারে না সে। বাড়ি যেতে যেতে খুব বেলা হয়ে যাবে। না খেয়ে বসে থাকবে গিরিবালা। 

টাকা দুটোর আশা শেষ পর্যন্ত ছেড়েই দিল ভূষণ। ডাক্তারখানা বন্ধ করে সাইকেলে উঠতে যাবার আগে সাইনবোর্ডখানায় একবার নজর পড়ল। সাত বৎসরের অভিজ্ঞ চিকিৎসক। তাকে যেন জব্দ করার ফন্দি এঁটেছে ওটা। নাঃ, এর একটা ব্যবস্থা করা দরকার। 

তিন 

খেয়াঘাটে এসে সাইকেল থেকে নেমে পড়ল ভূষণ। খাঁ খাঁ রোদে একটানা তিন মাইল পথ সাইকেল চালিয়ে এসে কিছুটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সে। কলকল করে ঘাম গেঞ্জির নীচে দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে। বল্লভ পাটনির ঘরের কাছে, আমবাগানের ছায়ায় এসে সে দাঁড়াল। 

বল্লভকে এখন আর নৌকো বাইতে হয় না। নবগঙ্গা মজে এসেছে। এখন এপার ওপার এক বাঁশের সাঁকো তৈরি হয়েছে। আড়াআড়ি বাঁশ পুঁতে পুঁতে তার উপর দিয়ে একখানা করে বাঁশ লম্বালম্বি ফেলে দেওয়া হয়। ওই ল্যাগবেগে বাঁশের উপর দিয়ে সবাই পারাপার করে। আর একখানা করে বাঁশ বাঁধা হয় একটু উপরে, যাতে হাত দিয়ে সেটা ধরে টাল সামলাতে পারা যায়। বাঁশগুলো শক্ত করে বাঁধাও থাকে না সব সময়। কোনও কোনও বাঁশ পা পড়ামাত্র বোঁ করে ঘুরে যায়। 

আষাঢ় মাসের জল এলে বল্লভকে নদীতে নৌকো নামাতে হয়। কার্তিক মাস পর্যন্ত নৌকো একরকম করে খেয়া মারতে পারে। অঘ্রাণ মাসেই সব থেকে মুশকিল। এদিকে কাদা, ওদিকে কাদা, মাঝখানের খানিক দূর জল। বল্লভ কষ্টেসৃষ্টে সেইটুকুতেই খেয়া মারে। পৌষ মাসে সাঁকোটা বাঁধতেই হয়। জ্যৈষ্ঠের শেষ পর্যন্ত সেইটেই ভরসা। জোয়ান পুরুষদের বিশেষ অসুবিধে হয় না। সাঁকো তারা অনায়াসেই পার হয়। মুশকিলে পড়ে মেয়েরা, বুড়োরা। প্রতি বছর ভূষণদের ওদিককার ওই কয়েকখানা গ্রামে এই অসুবিধা নিয়ে আলোচনা হয়, দলাদলি হয়। কিন্তু সাঁকোর আর সুরাহা হয় না। 

বল্লভ পাটনি বুড়ো হয়েছে। ছেলেবেলা থেকেই সে ভূষণকে দেখে আসছে। ঘরের দরজায় বসে বসে কড়া তামাক টানছিল। ভূষণকে দেখে হাসল। ভূষণও। 

বল্লভ বলল, শুনিছ তো ও ভূষণবাবু, কাল হন্যেকুড়োয় প্রেসিডেন্টের বাড়ি মিটিং হয়ে গেছে। 

ভূষণ বলল, কীসের মিটিং বল্লভ খুড়ো? 

বল্লভ গুড়ুক গুডুক হুঁকোয় টান মেরে বলল, রাবণের স্বগগে উঠার সিঁড়ি বাঁধার গো।

ভূষণ বলল, তা যা বলেছ। আমাদের পুল বাঁধা, ওই স্বর্গের সিঁড়ি তৈরির মতোই। ও হবে না।

বল্লভ বলল, ভাল দেখিছ! কাজের বেলা সব অষ্টরম্ভা, গলাবাজিতি দড়। তুমাগের ওই নকুলে বকশি আবার আমার নামে প্রেসিডেন্টের কাছে নালিশ করিছে। আমি নাকি কিছু করিনি। করিনে। আরে আমি করব কী? নদীতি জল যতক্ষণ আছে, ততক্ষণ তুমাগের পার করে দিই। একদিনির তরেও কসুর করিছি, বলুক দিনি কেউ? সাঁকো কি আমার বাঁধার কথা! তুমাগের কষ্ট হয়, তাই উজ্জুগ-আয়োজন করে দিই। আমি রাজার চাকর। কাছারির মাইনে খাই। তোগের প্রেসিডেন্টের আমি ধার ধারি? 

বল্লভ চটে গেল। পাকা পাকা মোটা ভুরু উঁচিয়ে যেন নকুল বকশিকে শাসাল। 

বলল, তুমার প্রেসিডেন্টেরই তো সাঁকো বাঁধার কথা. বাঁধে না ক্যান রে বাপু? নালিশ, বকশির বিটার বড় নালিশির গলা হয়েছে! 

ভূষণ বলল, আরে, ওর কথা ছেড়ে দাও। 

বল্লভ বলল, দুঃখু হয় না, শুনলি? মানুষির মতো মানুষ তো দেখি এক ওই ভূপতিবাবুরি। দেশে যদি থাকত, দেখতে এতদিনি এখেনে পাকা পুল বানায়ে ছাড়ত। 

ভূষণ সায় দিয়ে গেল। কথাটা ঠিক। গ্রামের যা-কিছু উন্নতি হয়েছে, সব সেজদার জন্যে। জাপান থেকে ফিরে ক’দিনই বা গ্রামে ছিলেন। তার মধ্যেই ছেলেদের জুটিয়ে নিয়ে বন-জঙ্গল কেটে, খানা-ডোবা বুজিয়ে গ্রাম থেকে ম্যালেরিয়া নির্মূল করে দিয়ে গিয়েছিলেন। কাজ ছাড়া সেজদা এক মুহূর্তও থাকতে পারেন না। প্রাইমারি ইস্কুল প্রতিষ্ঠা করে, ইস্কুলের পাকা বাড়ি গেঁথে দিয়ে গিয়েছেন সেজদা। 

আর গ্রামের লোক তার বদলে তাঁকে কী পুরস্কার দিয়েছিল? একঘরে করে রেখেছিল তাঁদের। নকুলে বকশির কাকা বিলে বকশি ছিল সে ঘোঁটের পাণ্ডা। তা একঘরে করে করলেটা কী? নলডাঙার রাজা নিজের ছেলের পইতেতে নেমন্তন্ন করলেন সেজদাকে। এক পঙ্ক্তিতে খেতে বসলেন তাঁকে নিয়ে। বিলে বকশি কি কম জ্বালিয়েছে তাঁদের! ওর মেয়ে পারুল, না পারুলের কথা আর ভাববে না ভূষণ। সে এখন পরস্ত্রী। সম্ভবত সুখেই আছে। সুখেই থাক সবাই। এ-সংসারের কারও সম্পর্কেই মন্দ ভাবে না ভূষণ। ভাবতে সে পারেও না। তার ধারণা, যা ঘটে ভালর জন্যই ঘটে। 

ভূষণ বলল, চলি গো বল্লভ খুড়ো। বেলা হয়েছে। 

বল্লভ বলল, হ্যাঁ শোনো, মাজার সেই ফিকির ব্যথাটা আবার চাগাল দিয়ে উঠিছে। সুজা হতি পারতিছিনে। কী করি কও দিনি? 

ভূষণ বলল, সেই যে তার্পিন তেল এনে দিয়েছিলাম, আছে, না ফুরিয়ে গিয়েছে? 

বল্লভ বলল, আছে বোধহয়। 

তা হলে আজ রাতে তাই বেশ করে মালিশ করে দেখো। যদি না কমে কাল একটা ওষুধ দেব। 

বলেই ভূষণ ঢালু বেয়ে সাইকেলখানা সাবধানে নামিয়ে নিল। সাঁকোর কাছে এসে কাঁধে তুলল সাইকেল। তারপর সন্তর্পণে বাঁশের উপর পা দিতেই বাঁশখানা ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে উঠল। 

.

পায়ের নীচে আর জল দেখা যায় না। শুধু কচুরিপানা আর দাম-কলমি। নদীটা যেন একটা কঠিন সবুজে জমাট বেঁধে রয়েছে। ওই দূরে, যেখানে খানিকটা জল চিকচিক করছে, সেখানে বন্ধু জেলে বাঁশ পুঁতে জাল ফেলে রেখেছে। বাঁশের মাথায় মাথায় বক আর মাছরাঙা বসে আছে। আর এপাশে পেতেছে গোটাকতক সাগড়া। চাঁছা বাঁশ দিয়ে তৈরি তিনকোনা সাগড়াগুলোর যে-ক’টা নদীর পাড়ে পড়ে আছে, সেগুলোকে দূর থেকে দেখলে বড় বড় শিঙাড়া বলেই মনে হয়। ওগুলোর ভিতর বাবলার ডাল ভরে জলে ফেলে দেয় বন্ধু। বাবলার ডালপালা খেতে ওর ভিতর মাছ ঢোকে। সকালে গিয়ে সে-সব টেনে সে ডাঙায় তোলে। 

ঝিঁঝি দাম, কলমি আর কচুরিপানার উপর তেজালো রোদ পড়ায় অসহ্য এক ভ্যাপসা গরম ছুটছে। আর জল, কাদা আর দামের এক মিশ্র গন্ধ নাকে এসে ঢুকছে ভূষণের। চিলগুলো উড়ছে আর মাঝে মাঝে কাতর স্বরে ডেকে উঠছে। মড়িপড়া গোরুগুলো একহাঁটু জলে দাঁড়িয়ে শান্ত চোয়ালে পটাস পটাস ঘাস ছিঁড়ছে। একটা জলঢোঁড়া অতিকষ্টে দামের জঙ্গল ঠেলতে ঠেলতে চলে গেল। হা-ম্বা— বাছুর ডেকে উঠল। সদ্যবিয়ানো একটা ছাগি তিনটে বাচ্চা নিয়ে ঘাস খুঁটতে খুঁটতে ঘুরে বেড়াতে লাগল। 

সাঁকোটা পার হতে ভূষণ যেন নেয়ে উঠল। সাইকেলটা এরই মধ্যে তেতে উঠেছে। পাড়ে নেমে সাইকেলটা কাঁধ থেকে নামাল ভূষণ। কাঁধটা একটু ডলে নিল। রুমাল বার করে মুখের ঘাম বেশ করে মুছল। তারপর সাইকেলে উঠে চলতে শুরু করল বাড়ির দিকে। 

খেয়াঘাট থেকে একটা মাঠ পেরিয়ে, গ্রামে ঢুকতেই, মুখেই যে দোতলা কোঠা বাড়িটা পড়ে সেটা ভূষণদেরই জ্ঞাতি পাগলা বোসের বাড়ি। বাড়ির কর্তা বহুদিন যাবৎ পাগল। রাস্তার ধারে, দোতলার ঘরে তালা দিয়ে রাখা হয়েছে তাঁকে। গ্রামে কাউকে ঢুকতে দেখলেই তিনি চিৎকার করেন, কে-ও, খাজনা দিয়েছ? ছেলেবেলা থেকেই সে এটা শুনে আসছে। প্রথমে ভয় পেত, আরেকটু বড় হলে সে মজা পেত, এখন বড় কষ্ট হয় তার। 

ভূষণের সাইকেলের আওয়াজ পেতেই তিনি জানলার দিকে ফিরে ঝুঁকে পড়লেন। মুখ বাড়িয়ে চিৎকার করলেন, কে-ও! খাজনা দিয়েছ? 

ভূষণ কোনওদিকে না চেয়ে এগিয়ে গেল। ওই বাড়িখানার পরেই কৈবর্তপাড়া। চুন তৈরি করে বাইতিরা। কলিচুনের ভাঁটিগুলোর পাশে পাশে বিস্তর ঝিনুক শামুক ডাঁই করা হয়েছে। এখানটা একটু সাবধানে পার না হলে সাইকেলের টায়ার ফাটবার আশঙ্কা। যে পরিমাণ ভাঙা শামুক ছড়িয়ে রাখে চারদিকে! ভাঙা শামুকের খোলায় বেজায় ধার। তারপরেই বন্ধু জেলের বাড়ি। তারপর রাস্তার দু’পাশে রাংচিতে আর পাতাবাহারের বন। সেটা পেরুলেই একতলা ইস্কুল বাড়ি। দু’দিকে দুটো রাস্তা বেরিয়ে গেল। বাঁয়ের রাস্তা ধরে এগুলেই হরিসভা, আমকাঁঠালের বন। তারপরেই মাটির পাঁচিল দিয়ে চতুর্দিকে ঘেরা ভূষণদের বাড়ি। 

ভূষণ সাইকেল থেকে সদরে নামল। রাঙ্গি গাইটা বাছুরকে দুধ খাওয়াচ্ছিল। এগিয়ে এসে ভূষণের দিকে গলা বাড়িয়ে দিল। বড্ড আদুরে গাই। ভূষণ সস্নেহে হেসে ওর গলায় হাত বুলিয়ে দিল। তারপর হুড়কো খুলে ভিতরে ঢুকল। 

বকশি মশাই ভূষণকে দেখেই এগিয়ে এলেন। রোগা দড়ি-পাকানো চেহারা। হাঁপানির রোগী। বয়েস হয়েছে বেশ। কত, বলা মুশকিল। 

বকশি মশাই ফিসফিস করে বললেন, ভূষণ, বাড়িতি তো আজ কুরুক্ষেত্তর। খুব ধুম হয়ে গেছে। বাড়ির মেয়েরা ঘরে দরজা আঁটে পড়ে আছেন। রাঁধিছেন কি না কবে কেডা? পেটে দড়ি বাঁধে পড়ে থাকো। 

ভূষণ অবাক হল। জিজ্ঞাসা করল, ব্যাপার কী? 

বকশি মশাই বললেন, আরে, এ-বাড়িতি গোলমাল বাধতি আবার ব্যাপার লাগে নাকি? ছোটবউমা ভাত নামাতি যায়ে বুঝি পা পুড়োয়ে ফেলিছেন। বড়বাবু বাড়ি আসে তাই শুনে অ্যাইসা আড়ারাম তাড়ারাম করতি লাগলেন যে, বড়বউ ঘরে গিয়ে দরজা দেলেন। মেয়েগুলোও রাগ করে শুয়ে পড়িছে। দ্যাখো দিনি কী গেরো, বাড়িতি দুই খালুই মাছ আলো, কনে আরউ ভাবলাম আত্মারাম আজ সধবা হবে, তা না হরি মটর চিবোয়ে আছি। তা না-হয় আমরা চিবোলাম, কিন্তু জনেগের কী হবে? একটু পরেই তো তারা খাই-খাই করে আসে পড়বেনে। 

ভূষণের যদিও প্রচণ্ড খিদে পেয়েছিল, তবু সে মেজাজটা খারাপ করল না। বকশি মশাইয়ের রসিকতা সে উপভোগই করল। দুনিয়া সম্পর্কে ভূষণের পরিষ্কার একটা হিসেব আছে। সে কোনও ব্যাপারে নালিশ বড় একটা জানায় না। সত্যিই তো, আঁতে ঘা লাগলে, মেয়েদের রাগ হতেই পারে। রাগ হলে ঘরের দরজা দেওয়াটাও মেয়েদের প্রকৃতির বাইরে নয়। এখন দুটো রাস্তা ভূষণের সামনে— এক, উপোস দেওয়া; আর দুই, রান্নাবান্নার ব্যবস্থা করা। উপোস দিতে ভূষণ পিছপাও নয়। হাসিমুখেই সে না খেয়ে থাকতে পারে। কিন্তু সে কখন? যখন ঘরে খাবার কিছু থাকে না, তখন? এখন ঘরে যখন খাবার রয়েছে, তখন সে খামাকা কেন শরীরকে কষ্ট দেবে? কেউ যদি রান্না না-ই করে, সে-ই না হয় আজকের মতো কাজটা চালিয়ে দেবে। 

ভূষণ ভিতরে এসে ক্লিলিলিং করে বেলটা বাজাল, কোনও ঘর থেকেই কেউ সাড়া দিল না। তার নিজের ঘরের ডোয়ার ছায়ায় সাইকেলটা ঠেস দিয়ে রেখে ভিতরে উঠে গেল। 

গিরিবালা ঘুমুচ্ছে। তার মুখে খানিকটা যন্ত্রণার ছাপ লেগে আছে। দু’চোখের কোনা বয়ে কখন যেন জলের ধারা নেমেছিল, এখন জল নেই, মরা সোতার মতো দেখাচ্ছে। কোলের মধ্যে ছেলেটাও ঘুমিয়ে রয়েছে। 

ভূষণ একবার উঁকি মেরে গিরিবালার পা-টা দেখে নিল। পোড়েনি, ফোসকা পড়েছে পায়ে। ও কিছু না। এক ডোজ আর্নিকা থার্টি খাইয়ে দিলেই ব্যথার ভাবটা কমে যাবে। ভূষণ নিশ্চিন্ত হল। এখন বরং গিরিবালা ঘুমোক খানিকটা। ভূষণ জামা-কাপড় ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এল। 

প্রথমে দেখতে হবে দাদা এখন কোথায়? ভূষণ ভাবল। মা’র ঘরে গেল। মা একেই ভিতু মানুষ, তারপর আজকের এই হাঁকডাক। নিজের রান্নাবান্না সব সেরে চুপ করে বসে আছেন। ভূষণকে দেখে বুকে বল পেলেন। 

ফিসফিস করে বললেন, ও ভূষণ, সর্ব্বনাশ হয়েছে আজ। বউমার পা পুড়িছে। তার উপর বিলেস আজ বড়বউমারে তাই নিয়ে পিরায় মারে আর কী? তাতেপুড়ে আলি, খিদেয় তো তোর মুখ শুকোয়ে গেছে। খাবি? আমার ভাতগুলোই খায়েনে। 

ভূষণ বলল, তা হলে আপনি খাবেন কী? 

বুড়ির দু’চোখ ভেসে গেল জলে। 

বললেন, আমার আবার খাওয়া। বাড়ির কেউ দাঁতে একটা কুটো কাটল না, আর আমি বুড়ো মাগি দাড়ি জুবড়োয়ে খাই। তা কি হয়? 

ভূষণ বলল, আমি ব্যবস্থা করছি, আপনি ভাববেন না। বড়দা কই? 

বুড়ি ঠাকুরঘরটা দেখিয়ে দিলেন। ভূষণ উঠে গিয়ে উঁকি মেরে দেখে এল, বিলাস ধ্যানে বসেছেন। বোধ করি চিত্তশুদ্ধিই করছেন। 

বিলাসের রাগটা কিছু বেশি। খপ করে জ্বলে ওঠেন। ব্যস্তবাগীশ লোক। কিন্তু মনটা বড় ভাল। কারও মনঃকষ্টের কারণ হয়েছেন তিনি, এটা যে-মুহূর্তে বুঝতে পারেন, অমনি প্রায়শ্চিত্ত করার একটা ঝোঁক প্রবল হয়ে ওঠে। ঠাকুরঘরে ঢুকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে চিত্তশুদ্ধি করেন। রাধাগোবিন্দের শ্রীচরণে আছাড় খেয়ে পড়ে কৃত অপরাধের জন্য মার্জনা চাইতে থাকেন। আজকের দিনটা অনশন চলবে তাঁর। 

বড়বউয়ের রাগ পড়ে গিয়েছে। তিনি উঠলেন। তাঁর আবার খিদেটা কিছু বেশি। খিদে যত বাড়ে, ততই তাঁর রাগ-অভিমান কমে আসে। ঠাকুরপো এসে গিয়েছে। আহা, বেচারার খিদে পেয়েছে খুব! সেই সকালে বেরিয়েছে বাড়ি থেকে। মেয়েগুলোও তো কিছু খায়নি। 

বড়বউ ডাকলেন, চম্পি, ও চম্পি! যূথি, ও যূথি! 

যূথি উঠে এল। চম্পি সাড়া দিল না। 

বড়বউ বললেন, হেঁশেলে চল, মাছগুলো বাছে দে। চম্পি গেল কনে? 

যুথি গোমড়ামুখে বলল, ঘুমোচ্ছে। 

বড়বউ বললেন, অবেলায় ঘুমোলি কি চলে? উঠোয়ে দে। কাকা বাড়ি আসে গেছে। দ্যাখ দিনি তোর বাবা গেলেন কনে? 

যূথি বলল, বাবা তা সেই কখনের থে ঠাকুরঘরে ঢুকিছেন। 

অ্যাঁ, কস কী? 

বড়বউ তাড়াতাড়ি উঠে পড়লেন, এই রে, পিরাশ্চিত্তির করতি বসল নাকি? 

বললেন, দ্যাখ, দ্যাখ, কী করতিছে, দেখে আয়। 

বড়গিন্নির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। বিলাসের চিত্তশুদ্ধিকে দামিনীর বড় ভয়। স্বামী যদি সারাদিন না খেয়ে চিত্তশুদ্ধি করতে থাকে তো সতী-সাধ্বী স্ত্রীর অবস্থা কী দাঁড়ায়! সেটা ভেবেই বড়বউয়ের চোখে অন্ধকার নেমে এল। তাঁকেও যে এখন শুকিয়ে থাকতে হবে। অতীতের অভিজ্ঞতা আছে তো! দামিনী পারতপক্ষে বিলাসের চিত্তশুদ্ধির কারণ হতে চান না। গোলমাল এড়িয়ে থাকার চেষ্টাই করেন। তবু কখনও কখনও বেধে যায়। এই আজ যেমন হল। কী সাজা বলো দিনি? 

বড়গিন্নি রান্নাঘরে এসে দেখেন, ভূষণ ওর মধ্যেই একটা গোছগাছ করে ফেলেছে। ভাতের হাঁড়ি সরিয়ে রেখেছে। নেবা উনুনে কাঠ ধরিয়েছে আবার। আধ-সাঁতলানো ডাল চাপিয়ে দিয়েছে। বাড়ুন দিয়ে কলমির জঙ্গল সাফ করছিল, এমন সময় বড়গিন্নি ঘরে ঢুকলেন। 

বড়গিন্নি একটানে বাড়ুনটা কেড়ে নেবার চেষ্টা করলেন। ধমকে দিলেন ভূষণকে। 

অশৈলে রাখো। যাও এখেনের থে। আর কাজ দেখাতি হবে না। ও চম্পি, ওলো যূথি, দেখসে আয়, তোগের কাকার কাণ্ড। 

এতক্ষণে চম্পি উঠে এল। ঘরে ঢুকে একনজর চেয়েই হেসে ফেলল। 

মরি মরি, বাড়ুন হাতে কী রূপই তুমার খুলিছে ছোটকাকা! কাকিমা দেখলি ভিরমি খায়ে পড়বেনে! 

ভূষণ ছদ্ম গাম্ভীর্যের সঙ্গে বলল, আহা, বেচারাদের জন্য বড় দুঃখ হচ্ছে। একটা দিন রাগ করে শুয়ে থাকবে। শত্তুররা তা-ও দেবে না। 

বড়গিন্নি বললেন, রঙ্গের কথা না ভাই। মেয়ে হয়ে জন্মাইছি বলে গন্ডারের চামড়া তো আর গায় দিইনি। মান-অপমান সকলেরই সুমান 

ভূষণ হেসে ফেলল। 

তাই তো আমিও বলছি। তবে এটা দেখা গেল, রাগ পুষে রাখার ভাল সাজ-সরঞ্জাম এ-বাড়িতে নেই। তোমার ওই রোগা শরীরে আর কতটুকু রাগ ধরবে! হ্যাঁ, গতর হবে কুল বকশির বউয়ের মতো। বসতে তিন কাঠা জায়গা লাগবে, যাতায়াত করতে খান দুয়েক ঘোড়ার গাড়ি লাগবে। নাকে একটা একপোয়া ওজনের নথ থাকবে। ওই রকম একজন কেউ যদি রাগে তো সেই হল আসল রাগ। বাড়ির লোক থরহরি কম্পমান, গ্রামের লোক তটস্থ। তাই সকলের সদা-সর্বদা চেষ্টা থাকে, লোকটা যেন না রাগে। তোমাদের হল— 

বড়গিন্নি হাসতে হাসতে বললেন, এখন যাও দিনি, আর জ্বালায়ে না। ওই কুল বকশির বউর সঙ্গে পারো তো তুমার দাদারে বিয়ে দিয়ে দাও। কুল বকশির বউর রাগ আর উনার পিরাশ্চিত্তির, একেবারে রাজযোটক হবেনে। 

ভূষণ হাসতে লাগল। 

বলল, জনদের ভাত দেবার জোগাড় করো। ওদের চানটান সারা। আর সেই সঙ্গে বকশি মশাইকেও দিয়ে দাও। 

বড়গিন্নি বললেন, তুমিও বসে পড়ো। 

চম্পি বলল, ছোটকাকিমার পা-টা কি দেখিছ? 

ভূষণ বলল, হ্যাঁ, ও তেমন কিছু না। ফোসকা একটু বেশি পড়েছে, এই যা। 

চম্পি বলল, পাগলামিটা একবার দ্যাখো দিনি। ওই হাঁড়ি কি একা নামানো যায়? আমরা বসে আছি এখেনে। মুখির কথাডা খসালেই তো উঠে গিয়ে ধরতি পারি। 

ভূষণ বলল, ভাবিসনে, এখানে, এই উনুনের উপরে একটা ছোট্ট কপিকল খাটিয়ে দেব। আর ওই ডেকচির গায়ে আংটা লাগানো থাকবে। ভাত হয়ে গেলেই আংটার গায়ে একটা শিকল পরিয়ে কপিকলে আটকে দিবি তোরা। তারপর টেনে টেনে নামিয়ে ফেলবি ভাত। অতি সহজেই ভাত নামানো যাবে। ওই ডেগ তো তুচ্ছ, ওর ডবল ডেগও তোর মতো লোক অনায়াসে নামাতে পারবে। একাই পারবে। এটা বিজ্ঞানের যুগ। বিজ্ঞানসম্মত প্রণালীতে না চললেই দুর্ঘটনা অনিবার্য। দাঁড়া কাল-পরশুর মধ্যেই ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। 

আইডিয়াটা হঠাৎ মাথায় এসে গেল ভূষণের। এর সুদূরপ্রসারী সম্ভাবনার কথা ভেবে তার শরীরে রোমাঞ্চ হল। 

বড়গিন্নি এক ধমক দিলেন, আরে রাখো। রান্নাঘরে উনি কপিকল টাঙাবেন! যত অশৈলের কথা। আমাগের জন্যি ভাবে তো আর ঘুম হচ্ছে না কারও! বলি, আজ এক মাস ধরে যে বলছি— কাপড় নেই, কাপড় নেই, তা সে বুঝি কানে যাচ্ছে না। ছিঁড়া ধূলি-ধূলি কাপড় পরে সোমথ মেয়েরা চোখির উপর ঘুরে বেড়াচ্ছে, সে বেলায় তো মদ্দগের এত ভাবনা হয় না। রান্নাঘরে ভাতের হাঁড়ি নামাতি উনি কপিকল আনবেন! বলি, মেয়েগুলোন কি কপিকল পরে বেরোবে। 

বড়গিন্নির ধমক খেয়ে ভূষণ একটু বিব্রত হল। কারণ বড়বউদির অভিযোগটা সত্যি। অস্বীকার করার উপায় নেই। এই সব অসুবিধাজনক প্রশ্নের সামনে পড়ে গেলে ভূষণ খুব অস্বস্তি বোধ করে। কাপড় কিনতে টাকা লাগে। রোগীদের টাকা দেবার অবস্থা আছে নাকি? এসব কথা বাড়ির মেয়েরা বোঝে না। ওরা বেজায় স্বার্থপর। দুনিয়া রসাতলে যাক, আমার কাপড়টা হয়ে গেলেই হল, এই ওদের মনোভাব। কোনও ভাল জিনিস ওরা বোঝে না। বুঝবে না তো। স্বার্থপর যে! 

.

এই যে কপিকলের ব্যাপারটা, এটার কথাই ধরা যাক। যত তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য বড়গিন্নি করছেন, অমন ফুস করে উড়িয়ে দেবার জিনিস এটা নয়। আমাদের দেশের কোটি কোটি নারী এর সুবিধে ভোগ করবে। হাত দিয়ে গরম হাঁড়ি-কড়াই নামাতে নিত্য যে কত দুর্ঘটনা হয়, কত মেয়ের হাত-পা পোড়ে, যন্ত্রণা পায়, পুড়ে মরে, তার কি ঠিক-ঠিকানা আছে? সামান্য একটা যন্ত্ৰ, একটা কপিকল ফিট করে দিলেই কিন্তু এ-সব এড়ানো যায়। নিরন্তর আগুনের তাতে থাকতে থাকতে কত রকম ব্যাধি মেয়েদের, সে-সবও কমে যেতে পারে। 

প্রথমে নিজের বাড়িতে পরীক্ষা করে দেখে যদি সুফল পেত ভূষণ, তা হলে চাই কী এটা পেটেন্ট করে সে ব্যাবসাও ফাঁদতে পারত।”ডা. ভূষণচন্দ্র বসু আবিষ্কৃত রান্নাঘরের কপিকল অথবা ইংরাজিতে ‘ডা. বোসেস কুকিং পুলি’। এই কল ব্যবহার করিলে মাতৃজাতি রান্নাঘরের মারাত্মক দুর্ঘটনা এবং অনর্থক পরিশ্রম হইতে চিরতরে মুক্তিলাভ করিবেন।” খবরের কাগজে হয়তো ছবি দিয়ে তার আবিষ্কারের কথা ছাপাও হত। ডা. বোসেস কুকিং পুলি। ইংরাজি নামটাই ভূষণের বেশি পছন্দ হচ্ছে। কুকিং পুলি। হ্যাঁ, রান্নাঘরের কপিকল থেকে কুকিং পুলি শুনতে অনেক ভাল। মেড ইন যশোর। যশোরের তৈরি। সেজদার চিরুনি যেমন ভারতবিখ্যাত হয়েছে। যশোর বেঙ্গল নামটা সেজদার কল্যাণে যেমন দিক্‌বিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে, তেমনি তার কুকিং পুলিও একদিন বিখ্যাত হয়ে যেতে পারে। পারে বই কী! মানুষের অসাধ্য কী আছে? 

ভূষণ হিসেব কষতে বসল। অবশ্য মুখে মুখে। এটা একেবারেই থাউকো হিসেব। বিস্তারিত সে পরে কষবে। কিন্তু এতেই, এই থাউকো হিসেবেই সে দেখিয়ে দিতে পারে, তার সামান্য একটা আবিষ্কার থেকে কত টাকা রোজগার হতে পারে। ধরা যাক, বাংলা দেশে এখন চার কোটি লোক আছে। গড়ে দশজন লোক নিয়ে যদি এক-একটা পরিবার ধরা যায়, তা হলে পরিবারের সংখ্যা দাঁড়ায় চল্লিশ লক্ষ। তার মানে চল্লিশ লক্ষটা রান্নাঘর। গুড। এবার এর থেকে থ্রি-ফোর্থই বাদ দাও। চার ভাগের এক ভাগের হিসেবই ধরো। তা হলেও দশ লক্ষ রান্নাঘরে দশ লক্ষ কুকিং পুলি অনায়াসেই বিক্রি হতে পারবে। ভেরি গুড। ভূষণ খুবই উৎসাহিত বোধ করছে। এখন প্রতি কুকিং পুলিতে যদি সে মাত্র চার আনা লাভ করে, ওনলি ফোর অ্যানাস, তা হলে কী দাঁড়ায়, আড়াই লক্ষ টাকা। আচ্ছা, তার থেকে আরও না হয় দেড় লক্ষ টাকা বাদ দাও। তা হলেও থাকে নেট একটি লাখ টাকা। এর আর মার নেই। এক লাখ টাকার কোনও ধারণাই নেই বড়গিন্নির। খালি কাপড় কাপড় করছে। আরে, কত কাপড় চাই, তখন ফরমাশ কোরো। যেন বড় গিন্নিকেই বলল ভূষণ। 

চম্পির খ্যারখেরে আওয়াজে ভূষণের চিন্তা ছিন্ন হল। 

ও ছোটকাকা, বার্লি আনিছ? 

ভূষণের উৎসাহটার জোয়ার এবার কিঞ্চিৎ মন্দা পড়ল। মুখের চকচকে ভাবটাও মলিন মলিন হয়ে উঠল। ভূষণ রবিনসনের বার্লি কিনবে বলেই তো এতক্ষণ মনিরুদ্দির আশায় বসে ছিল। কিন্তু সে যে এল না। 

বলল, আজকের দিনটা চালিয়ে নে মা। কাল এনে দেব। 

চম্পি বলল, চালাব কি আমার মুড়ো দিয়ে! খুকার পেটটা খারাপ, দুধ এক ফোঁটাও ধরতিছে না। তুমারে বলে বলে তো হয়রান হয়ে গেলাম। এখন ও বিচারা খাবে কী? 

ভূষণ ভাবতে লাগল, এরা নিজেদের সংসারটাকে সমস্ত জগৎ থেকে আলাদা করে দেখে। তাই অভাব অভিযোগ এদের চোখে এত বড় বলে মনে হয়। আমাদের উচিত জগতের পরিপ্রেক্ষিতে নিজের সংসারটাকে দেখা। তা হলেই এ জ্ঞানটা অন্তত হবে, বার্লির অভাবে পৃথিবী রসাতলে যাচ্ছে না। 

মানুষ কী খায় আর কী পরে, তা দিয়ে মানুষকে বোঝা যায় না চম্পি। মানুষের পরিচয় তার চিন্তায়, তার কর্মে। চম্পিকে মনে মনে বোঝাতে চেষ্টা করল ভূষণ। রবিনসনের বার্লি সে আনতে পারেনি বলে এরা তার উপরে চটেছে। আরে, ওটা তো মাত্র একটা পরিবারের, একটা, একটা সাময়িক সমস্যা। ভূষণ মনে মনেই মন্তব্য করল। কিন্তু সে যে-সমস্যার সমাধানের কথা ভাবছে, তার মধ্যে বৃহত্তর মানবের কল্যাণ নিহিত আছে। 

তাই বাজে চিন্তায় মন না দিয়ে, ভূষণ ঘরে উঠে গেল কুকিং পুলির নকশা আঁকতে। 

চার 

বাসন মাজতে মাজতে চম্পি অন্যমনস্ক হয়ে গেল। কলুপাড়ায় কাদের বাড়ি যেন বিয়ে। পুকুরের পশ্চিম পাড় দিয়ে সার বেঁধে সব জল সাধতে চলেছে। একটা গলা-চেরা সানাই তারস্বরে চেঁচাচ্ছে। একটা ঢোল আর কাঁসি তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। 

চম্পি সেদিকেই চেয়ে ছিল। বগি থালাখানা আধমাজা হয়েছে। আর দু’-চারটে ঘষা দিলেই সাফ হয়ে যায়। তবু তার হাত আটকে গেল। শেষ বউটিও একসময় পথের বাঁকে মিলিয়ে গেল। সানাই কাঁসি ঢোলের আওয়াজও আর শোনা যায় না। তবু হাত তুলে বসে রইল। কাজের উৎসাহটাকে এক নিমেষে কে যেন শুষে বের করে নিয়ে গেছে! 

সন্ধে হতে তখনও দেরি আছে। জ্যৈষ্ঠের প্রচণ্ড গরম সারাদিন গ্রামখানাকে যেন ভেজেছে। এখন পুকুরের জল থেকে তার ভাপ উঠছে। এখানে তবু তো অনেক ঠান্ডা। ঘরের ভিতরে যেন আগুন জ্বলছে। 

কিন্তু এই পুকুরের ঘাটও চম্পিকে আর আরাম দিচ্ছে না। অথচ সেই আরামটুকু পাবার জন্যই না বেলা পড়লে সে তাড়াতাড়ি ঘাটে এসে বসে ছিল। এনেছিল বাসনের পাঁজা। বেশ তোড়জোড় করে মাজতেও বসেছিল। এই সময় কলুপাড়ার জলসাধার দলটা তার চোখের উপর দিয়ে বাজনা বাদ্যি বাজিয়ে গাঙের দিকে চলে গেল। আর অমনি একটা দমকা বাতাসের ধাক্কায় চম্পির বুকখানা যেন খালি হয়ে গেল। তার দৃষ্টিতে অপার শূন্যতা নেমে এল। 

চম্পি কিছু করছিল না, কিছু দেখছিল না, কিছু শুনছিল না। 

অনেকগুলো তে-কাটা মাছ বুজবুজ করে চম্পি ঘাটের যে তাল-গুঁড়িটার উপর বসেছিল তার নীচে ঘুরছিল। সেই মোটাসোটা বেলে মাছটা, চম্পি যার নাম রেখেছে ভোম্বল, একটু একটু করে এগিয়ে এসে জলের তলে চুপচাপ শুয়ে বিশ্রাম করতে লাগল। অন্যদিন চম্পি তার সঙ্গে অনেক কথা বলে, গল্প করে। মুঠ মুঠ এঁটো কাঁটা ছড়িয়ে তাকে যত্ন করে খাওয়ায়। ধারেকাছে যদি কেউ না থাকে তবে মৃদুস্বরে তার কাছে অনেকের নিন্দে করে। 

আজ ভোম্বল যে অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে, সেদিকে চম্পির নজর পড়ল না। দম দেওয়া পুতুল, হাত পা নাড়ছিল যেন, হঠাৎ দম ফুরোতে মাঝপথে এখন থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে। 

এই গ্রামের আরেকটি মেয়ের বিয়ের ফুল ফুটল। চম্পি খবরটা যেন তার মনকেই দিল। হুস করে দীর্ঘশ্বাস তার বুক ঠেলে বেরিয়ে পড়ল। কাদের মেয়ের বিয়ে? কলুপাড়ার কাউকে সে চেনে না, তাই বুঝতে পারল না। 

নিশ্চয়ই সে আমার চেয়ে ছোট। কলুরা খুব ছোট ছোট মেয়ের বিয়েই দেয়। বড়দিরও খুব ছোট বয়েসে বিয়ে হয়েছে। গৌরীদান করেছিলেন বাবা। মেজদির বয়েস তেরো পেরোতেই গ্রামে ‘গেল গেল’ রব উঠেছিল নাকি! বাবা অন্নজল ত্যাগ করে পাত্তর খুঁজতে বেরিয়েছিলেন। ভাল একটা জমি বিক্রি করতে হয়েছিল মেজদির বিয়েতে। তাইতে মেজকাকা খুব রাগ করেছিলেন। অনেকদিন ধরে ঝগড়াঝাঁটি, অশান্তি চলেছিল। সেজকাকা বা ছোটকাকার মতো নন মেজকাকা। পৈতৃক সম্পত্তি সম্পর্কে তাঁর অধিকারবোধ প্রবল। ভাগের টাকার অধিকার তিনি শেষ পর্যন্ত ছাড়েননি। তাই ছোটকাকার বিয়েতে পণ নিয়ে সেই টাকা মেজকাকাকে দিয়েছিলেন বাবা। আর প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, সম্পত্তি বেচে মেয়ের বিয়ে দেবেন না। 

তাই তো আমার বিয়ে দেবার জন্য বাবার আর তেমন চাড় নেই। 

চম্পি হতাশ হয়ে মনে মনে যেন পুকুরটাকেই শোনাল। ষোলো পূর্ণ হয়েছে তার। নিটোল স্বাস্থ্যের জন্য আরও বড় দেখায়। সে কারণে খোঁটা খেতে হয় উঠতে বসতে। সে নাকি হাতি! 

চম্পির বয়েস যত বাড়ছে ততই সে গুটিয়ে নিচ্ছে নিজেকে। পারলে সে পাতালে প্রবেশ করত। কত ছোট জগতে তার এখন ঘোরাফেরা! এই বাড়িটুকুর মধ্যে! খালি রান্নাঘর আর শোবার ঘর। একমাত্র মুক্তির আস্বাদ সে পায়, এই পুকুরঘাটে এলে। 

এ আমারই মতন। নির্দিষ্ট চৌহদ্দির বাইরে যাবার কোনও উপায় নেই। আমারও নেই, পুকুর, তোমারও নেই। এক অভাগী যেন আরেক অভাগীকে সমবেদনা জানাল। 

চম্পি অভাগী বই কী? এই গ্রামে অব্যিয়েত আর কোনও মেয়ে নেই। তার বয়সি যে মেয়েরা ছিল, কবেই তাদের সিঁথেয় সিঁদুর উঠেছে। অনেকের কোলে ছেলেমেয়েও এসে গেছে। একমাত্র তারই কোনও গতি হল না। তার চেয়ে ছোট অনেক মেয়ে ছিল এই গ্রামে। তাদেরও অনেকে পার হয়েছে। তাদের মা কাকিরা ঘাটে আসে। ঠেস দিয়ে অনেক কথা শোনায়। মা’র কানে সে-সব কথা গেলে চম্পির লাঞ্ছনার আর অন্ত থাকে না। 

কথা শোনার মেয়ে চম্পি নয়। সে-ও একদিন জবাব দিয়েছে মুখে মুখে, তর্ক করেছে মা’র সঙ্গে, ঝগড়া করেছে। বিয়ে যে হচ্ছে না তার, এ যেন তারই দোষ। সে যেন পৃথিবীর ছেলের বাবাদের সঙ্গে আগেভাগে ষড়যন্ত্র করে বসে আছে, যাতে তাকে কেউ পছন্দ না করে। কথার ভাব দেখলে গা জ্বলে যেত চম্পির। 

তখন সে ঝগড়া করত, কারণ তখনও তার আশা যায়নি। সে নিয়মিত শিবপূজা করত, গোকাল করত। শিবের মতো স্বামী পাবার জন্য কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করত। চোদ্দো থেকে পনেরোতে পড়ল, পনেরো উতরে ষোলোয়, সেই ষোলোও বুঝি যায়! 

বয়েস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চম্পি আশা হারিয়ে ফেলেছে। এই ক’বছরে তার গোটা পাঁচেক সম্বন্ধ এসেছিল। একজনও পছন্দ করেনি। প্রতিবার সে পরিপাটি করে সাজতে বসেছে, বিনম্রভাবে এসে বসেছে কয়েকজন অপরিচিত লোকের সামনে, পরীক্ষা দিয়েছে সাধ্যমতো। কিন্তু তাকে পছন্দ হয়নি কারও। সে কালো, দেখতে ভাল না, হাতির মতো বড়। সে হাতি 

তারপর ক’দিন ধরে নিঃশব্দে এক লাঞ্ছনা চলেছে তার উপর। বাবা যেন কেমনভাবে চেয়ে চেয়ে দেখেছেন তাকে, মা’র স্তব্ধ মুখে কী মুখর গঞ্জনা, পাড়াপ্রতিবেশীর মুখে চাপা বিদ্রূপ! কিন্তু উপেক্ষার এক কঠিন বর্ম গায়ে দিয়ে চম্পি ঘুরে বেড়িয়েছে। একটি শরও তার গায়ে বেঁধেনি। কারণ, তার আশা মরেনি। এমনি করে চারবার সে আত্মরক্ষা করেছে অমিত বিক্রমে। 

কিন্তু পাঁচবারের বার আর সে পারেনি। চরম হার সে হেরেছে। তাকে সেবার যারা দেখতে এসেছিল, যুথিকে তাদের বড় পছন্দ হয়েছিল। তারা সেধে লোক পাঠিয়েছিল কয়েকবার যূথির বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। ওদের তরফে আগ্রহ যেমন প্রবল ছিল তাতে নামমাত্র খরচেই যূথিকে পার করা যেত। কিন্তু বাবা তাতেও বাদ সাধল। সে যে যূথির বড়। বড়কে রেখে ছোটর বিয়ে ভাল দেখায় না। তাই শেষ পর্যন্ত এ সম্বন্ধ হাতছাড়া করতে হল। 

বাবা আবার তেমন চোখে তার দিকে দিনকতক চাইতে লাগলেন। মা’র মুখে অব্যক্ত গঞ্জনা ফুটে উঠল। পাড়াপ্রতিবেশীর মুখে চোখে বিদ্রূপের বান ছুটল। তাতেও চম্পি বিচলিত হয়নি। কিন্তু মোক্ষম মার তাকে মারল যূথি। তার চেয়ে দু’বছরের ছোট, তার আপন বোন, যূথি 

যূথির চোখে বিষ ঝরতে লাগল। তার তীব্রতায় অস্থির হয়ে উঠল চম্পি। কী বিদ্বেষ, কী ঘৃণা যূথির দৃষ্টিতে! প্রতিনিয়ত যূথির কটা চামড়া চম্পিকে যেন ছ্যাকা দিতে লাগল। ওর গর্বিত ভঙ্গি যেন বলতে লাগল, নিজে তো চিরকাল আইবুড়ো থাকবি, আবার আমার ভবিষ্যৎও খাবি। তোর জীবনে ধিক। তুই মর, তুই মর না। 

যূথি তারপর থেকে কোনওদিন আর তাকে দিদির সম্মান দেয়নি। সংসারের কাজে কর্মে তার যেটুকু ভাগ, তাও বাঁদিজ্ঞানে চম্পির উপর তুলে দিয়েছে। আগে হলে চম্পি কখনওই এসব সহ্য করত না। এখন চম্পি যে আর সে চম্পি নেই। তাই সব অপমান সে এখন হজম করে। চুপচাপই থাকে। 

যূথির উপর লোকের এত টান কেন? কী জানে যূথি? জীবনে বইয়ের পাতা ওলটাল না, সামান্য লিখতে জানে, কিন্তু কী বিশ্রী তার হস্তাক্ষর! একপদও রাঁধতে জানে না, শিল্পকাজের ধারে কাছেও কখনও ঘেঁষেনি। তবু তার দর কত চড়া! কারণ তার রংটা ফরসা। 

আর চম্পি কালো। তার চামড়ার রংটুকু ময়লা বলে তার সব গুণ শূন্য হয়ে গেল। বাড়ির স্কুল থেকে সে ছাত্রবৃত্তি পাশ করেছিল। পড়াশুনা করলে সে জলপানি পেত। মেয়েদের ইস্কুল ঝিনেদায়। তাই তার লেখাপড়া হল না। মুক্তোর মতো হাতের লেখা চম্পির। ক্রোচেটের কাজ শিখেছিল বকশিদের সেজ ছেলের বউয়ের হাত-পায়ে ধরে। কতরকম রান্না জানে সে। কীর্তনে তার অপূর্ব গলা খোলে। প্রত্যেকটা জিনিস সে শেষ পর্যন্ত শিখতে চেয়েছিল। কোনওটাই শেখা হয়নি। সুযোগ পায়নি। এই অজ পাড়াগাঁয়ে কেউ তাকে সাহায্য করেনি। সামান্য উৎসাহও কারও কাছ থেকে পায়নি সে। তবুও সব দিক থেকে সে এই গ্রামের চৌকশ মেয়ে। কিন্তু সে কালো। কালো, কালো, কালো। তাই সে কিছু না। কিছু না। 

চম্পির এমব্রয়ডারির কাজ দেখিয়ে শ্রীনাথ কাকার মেয়ে সুজাতার বিয়ে হয়ে গেল সেবার। শুধু শ্রীনাথ কাকা কেন, কায়েত পাড়ার অনেক মিঞাই চম্পির হাতের নানা কাজকে নিজের মেয়ের কাজ বলে চালিয়েছেন। তারা সব তরে গেছে। শুধু চম্পি পড়ে আছে। ভগবানের এ কেমন বিচার? নকল জিনিস আসলের চেয়ে ভাল চলে! 

অথবা চম্পি যেগুলোকে এতকাল গুণ বলে মনে করেছে, সেগুলো কোনও গুণই না। বাঙালির ঘরের মেয়ের একমাত্র গুণ তার চামড়ার রং। সেখানে চম্পি মার খেয়েছে। সে কালো। 

এক একটা বিয়ে হয় গ্রামে আর চম্পিকে জানিয়ে দেয় সে কালো। তার বিয়ে হবে না। সে কালো। কালো। 

চম্পির কাছে নতুন দিন কোনও বার্তা বয়ে আনে না। রাত অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে না। ছয় ঋতুর নিয়ত পরিবর্তন কোনও সম্ভাবনার আগমনী গায় না। চম্পি গোকাল পুজো ছেড়ে দিয়েছে। শিব গড়িয়ে আর প্রার্থনা জানায় না। অধিকাংশ সময়েই মুখ বুজে খাটে। কখনও কখনও বিদ্রোহ করে। 

শুধু যূথির সঙ্গে এক বিছানায় রোজ রাতে তার যদি শুতে না হত! বিছানার ছোট্ট পরিসরে দু’বোনের দুটো দেহ বড় কাছাকাছি এসে পড়ে। দুটো দেহ, না দু’প্রস্থ চামড়া! এক প্রস্থ কালো আরেক প্রস্থ বড় ফরসা। তাই চম্পি মরমে মরে যায় তখন। 

.

দূরে আবার সানাইয়ের শব্দ ভেসে উঠল। ওরা জল সেধে ফিরছে। এ কী, এতক্ষণে যে একটাও বাসন মাজা হয়নি। ছিঃ। 

চম্পি সংবিৎ ফিরে পেয়ে তাড়াতাড়ি হাত চালাতে গেল। কে যেন ডাকল, চম্পি না, ও চম্পি! চম্পি ও ঘাটে চোখ ফেরাল। ওমা, শৈলদি যে। বাঃ, বেশ সুন্দর চেহারা হয়েছে তো শৈলদির। কবে এল? 

চম্পি একটু হাসল সেদিকে চেয়ে। 

বলল, শৈলদি যে, কবে আলে? 

শৈল বলল, কাল এসেছি রে। বাবা বললেন, অনেকদিন পরে দেশে যাচ্ছি শৈল, আম কাঁঠাল খেয়ে আসি, যাবি? ওদেরও অমত হল না, চলে এলাম। বাড়ি পরিষ্কার করতেই কাল আর আজ সারাদিন কাটল। তাই একটু গা ধুতে এলাম। 

চম্পি বলল, বেশ করিছ। চার-পাঁচ বছর হয়ে গেল তুমরা আর এ-মুখো হওনি। পত্তর পায়ে জানলাম কলকাতায় বিয়ে হল তুমার। তুমার ভাগ্যিটা খুব ভাল শৈলদি। এ গিরামের সক্কলের উপরে তুমি টিক্কা মারিছ। কলকাতায় শ্বশুরবাড়ি কি সুজা কথা! 

সঙ্গে সঙ্গে হাত চালাল চম্পি। বাসন অনেক। সন্ধে নেমে এল। অন্ধকার ধীরে ধীরে শৈল আর চম্পির মধ্যে ব্যবধান রচনা করতে লাগল। মুখ চোখ অস্পষ্ট হয়ে আসতে লাগল। শুধু গলার স্বরে দু’জনের অস্তিত্ব ঘোষিত হতে লাগল। 

কিছুদিন থাকবা ত শৈলদি? আম কাঁঠাল ফুরোলি যাবা ত? 

ও বাবা, তা কি হওয়ার জো আছে রে। সঙ্গে পেয়াদা এসেছে। মাত্র সাতদিনের মেয়াদ। উনি নিজে আসতে পারলেন না তো। আপিসের কাজ। কাজ না ছাই! 

খিলখিল করে হাসি বেজে উঠল। শৈলদি হাসছে। শৈলদির হাসি। শৈলদির গলার স্বর চম্পির মতো মিষ্টি না। তবু শৈলদির বিয়ে হয়, তার গায়ের রংটা ফরসা। কিন্তু এখন, চম্পি ভাবল, এই তো অন্ধকার নেমেছে, গায়ের রং ঢাকা পড়েছে, এখন পাশাপাশি যদি দাঁড়ায় সে আর শৈলদি, দু’জনে যদি শুধু কথা বলে যায়, হাসে, তা হলে কি তার কাছে শৈলদি দাঁড়াতে পারে? 

কাজ না ছাই! 

শৈল খিলখিল করে হাসল। 

আসলে কী জানিস? ওঁর বড় ম্যালেরিয়ার ভয়। তাই বাবাকে ওই কথা বলে এড়িয়ে গেল।

চম্পিও হেসে উঠল। সুরে বাঁধা সেতারের তরফের তারে যেন নিপুণ আঙুল কে চালিয়ে দিল। 

বলো কী শৈলদি, জামাইবাবুর এত ম্যালেরিয়ার ভয়! 

চম্পি আবার হাসল। সেই অপূর্ব সুরেলা হাসি তরঙ্গে তরঙ্গে যেন পুকুরময় ছড়িয়ে পড়ল। চম্পি অনেকদিন পরে হাসল। কোনও সুযোগই সে আজকাল পায় না, যাতে একটু হাসতে পারে। শৈলদিকে শোনাবার জন্যই সে এই হাসি ব্যবহার করেছিল। দেখল তা ব্যর্থ হয়নি। 

শৈল নিজেও বুঝি অবাক হল, হাসিতে এত ঝংকার ওঠে! শৈলও হাসল। 

শুধু কি ছাই ম্যালেরিয়ার ভয়, ভয় যে কত রকম ওর, কী বলব? পাছে আমি হারিয়ে যাই, সেই ভয়ে লক্ষ্মণ ভাইকে সঙ্গে পাঠিয়েছে। 

ম্যালেরিয়া তারে বুঝি ছোঁবে না? 

চম্পি আবার হাসল। এখন সে কথায় কথায় হাসবে। হাসছে। সে বুঝেছে শৈলর হাসির রং এর মধ্যেই জ্বলে গেছে। শৈলদিও হাসছে তো, কিন্তু তার কাছে সে হাসি কত ম্যাটমেটে। 

চম্পি বলল, নিজির পিরানের দাম আঠারো আনা, আর সব বুঝি নিলামওয়ালা ছ’-ছ’ পয়সা।

যা বলেছ ভাই। 

শৈল আর চম্পি একসঙ্গে এবার হেসে উঠল। 

বউদি, ও বউদি! 

সুহাস ব্যস্ত হয়ে ডাক দিল। চম্পির কানে মেয়েলি হালকা একটা রিনরিনে সুর বেজে উঠল। শৈলদির দেওর। বাব্বা, ছেলেটার টান তো খুব বউদির উপর। 

খিলখিল হাসিতে চম্পি ফেটে পড়ল। কলকাতার লোক ভাবে পাড়াগাঁয়ে বুঝি আর লোক থাকে না। 

বলল, ওই ন্যাও শৈলদি, তুমার পিয়াদা আইছেন বোধহয়। গায় আর ম্যালেরিয়া না লাগায়ে উঠে পড়ো। 

শৈল আর চম্পি এমন হাসি হাসতে লাগল যে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে শৈলর দেওর চুপ মেরে গেল। শৈল উঠে পড়ল। 

শৈল বলল, এসো-না ভাই, কাল দুপুরে। একটু কথা বলা যাবে। কে-ই বা আর আছে।

চম্পি জবাব দিল না। সে তখন উৎকর্ণ হয়ে শৈলদির দেওরের ধমকানি শুনছে। 

এই সন্ধেয় পুকুরের জলে নাইলে? জ্বর হল বলে তোমার। বাপের বাড়ির সব ভাল বলে কি ম্যালেরিয়াও ভাল? 

ছ্যামড়াটার ত বড় পাকা পাকা কথা। মুখ চিপলি বোধহয় এখনও দুধ বেরোয়। কিন্তু কথা বলছে মার্কণ্ড বুড়োর মতো। 

হঠাৎ চম্পির কানে এল, হাসছিল ও কে বউদি? খুব সুন্দর হাসিটা, না? 

শৈলর উৎফুল্ল গলাও শুনতে পেল, ও বড় গুণের মেয়ে ঠাকুরপো। ওর অনেক গুণ। 

আর কিছু শুনতে পেল না চম্পি। শৈলদির একটা মন্তব্যেই তার চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে গেছে। নিত্যদিনের অবজ্ঞা উপেক্ষা বিদ্বেষ বিদ্রূপের মাঝখানে হঠাৎ এই প্রশংসাটুকু বিধাতাই যেন শৈলদির মুখ দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন। অনেক, অনেক দিন পরে চম্পির মনের বন্ধ কপাটগুলো খুলে গেল। গুমোট কেটে গেল। খোলা হাওয়া যেন ছুটোছুটি করতে লাগল। একটা অকারণ খুশি ঠেলে ঠেলে উঠছে। মন গুনগুন সুর ভাঁজছে। 

.

শৈল যখন চম্পিকে তাদের বাড়িতে যেতে বলেছিল, তখন চম্পি সে-কথার কোনও জবাব দেয়নি। কেননা চম্পি কোথাও আর আজকাল যায় না। অথচ আগে এই যূথির মতো বয়সেও চম্পি কত ঘুরেছে পাড়ায়। কত মেয়ে তাকে বাড়িতে ডেকে নিয়ে গিয়েছে। আসন তৈরি শিখবার জন্য। কত মেয়েকে সে যে উলের আসন তৈরি করে দিয়েছে তার ঠিক নেই। তাকে ওরা ডেকে নিত আসন শিখবার জন্য। কিন্তু শিখত না কেউ-ই। টাকা খরচ করে মাল-মশলা কিনত; ভাল ভাল চট, উল, লেসের সুতো, এমব্রয়ডারির সাজ-সরঞ্জাম। তোড়জোড় করে আরম্ভও করত, কিন্তু ওই পর্যন্ত। কারওরই কাজে উৎসাহ ছিল না। পরিশ্রম করতে চাইত না। এক ফোঁড় দু’ফোড় দিয়ে ফেলে রাখত। চম্পি সেই সব অসমাপ্ত কাজ বাড়িতে নিয়ে আসত। রাত জেগে জেগে শেষ করত কাজগুলো। তারপর দিয়ে আসত যার জিনিস তাকে। 

আরও একটা কাজ সে করত। ভাল ভাল উল, কাপড়ের টুকরো, লেসের সুতো, কুরুশ কাঁটা সে সরিয়ে ফেলত। টুনি বলে একটা আহ্লাদি মেয়ে ছিল, এই শৈলদিরই খুড়তুতো বোন। অকর্মার ধাড়ি। তার একটা কাঁচি সে চুরি করেছিল। টুনি তাকে সন্দেহ করেছিল ঠিকই। চম্পিকে সে মুখে কিছু বলেনি। কিন্তু সব বাড়িতে বলে এসেছিল, চম্পি চোর। তারপর থেকে সবাই তাকে সন্দেহের চোখে দেখত। চম্পি যেদিন সে-কথা জানতে পারল, সেদিন সে মর্মান্তিক চটে গিয়েছিল। অপমানে তার মুখ কালো হয়ে গিয়েছিল। সে চোর! চোর? একে কি চুরি বলে? অমন সুন্দর জিনিসটায় তোর হাতে তো মরচে ধরত। কোনও কাজেই লাগাতিসনে। আমি তাকে কাজে লাগাচ্ছি। আমি চোর হলাম! কিন্তু চম্পির যুক্তিতে জোর থাকত না। তার নিজেরই মনে হত কাজটা ঠিক হয়নি। সে চুরিই করেছে। তাই সে আর কোথাও বের হত না। অনেকবার মনে হয়েছে কাঁচিটা সে না হয় ফেরতই দিয়ে আসবে। টুনিকে বলবে, অন্যমনস্কভাবে নিয়ে এসেছিল। এই নাও ভাই তোমার জিনিস। নষ্ট করিনি। কিন্তু চম্পি তা পারেনি। পারা যায়ও না। টুনি খুব ঠ্যাকারে মেয়ে। আরও অনেক কেলেঙ্কারি সে ছড়াত। তার চেয়ে এই ভাল। না দেওয়াই ভাল। নিইনি তো নিইনি। যার যা ইচ্ছে সে তাই ভাবুক। চম্পি সেধে সেধে তো কারও বাড়িতে যাচ্ছে না। যাবেও না। 

সে আর যায়ও না কোথাও। সেই টুনির বিয়ে হয়েছে। চলে গেছে গ্রাম ছেড়ে। তবুও সে বেরোয় না। আজকাল তো বেরোতে ইচ্ছেও করে না। 

তাই শৈলর ডাকে সে সাড়া দেয়নি। কিন্তু শৈলর মুখে তার অবিমিশ্র প্রশস্তি শোনার পর তার মন ঘুরে গেছে। সে বড় গুণের মেয়ে। গুণের মেয়ে, তার দাম আছে। সে তুচ্ছ নয়, শূন্য নয়, গুণের মেয়ে। সারাদিন গুনগুন করে কথাটা তার কানে বেজেছে। অজস্রবার খুশি করেছে তাকে। বাড়ির প্রত্যেককে, প্রতিটি কাজকে তার আজ অসামান্য বলে মনে হয়েছে। 

শৈলদি নিজে তো লোক ভাল, তাই সবাইকে ভাল দেখে। কাজকর্ম সব চুকিয়ে ভিজে গামছায় মুখ মুছতে মুছতে চম্পি ভাবল। বাইরে চেয়ে দেখল রোদ বড় কড়া। এই রোদে যাবে? একবার ভাবল। নাঃ যাই একবার ঘুরেই আসি। নয়তো আবার কী ভাববে শৈলদি। কতদিন পরে এল দেশে। আর আসবে কি না, দেখা হবে কি না, কে জানে? কত মেয়ের তো বিয়ে হল, গ্রাম ছেড়ে চলে গেল। তাদের সঙ্গে আর কি দেখা হচ্ছে? একদিন সেও তো চলে যাবে। তার শ্বশুরবাড়ি শৈলদির মতো কলকাতায় আর হবে না তো। কোন অজ পাড়াগাঁয়ে তার অন্ন মাপা আছে কে জানে? 

ঘুরেফিরে সেই বিয়ের কথা। চম্পিকে নিশিদিন এই ভাবনা তাড়া করে বেড়াচ্ছে। কিছুতেই কি সে নিস্তার পাবে না। 

একটা কাচা কাপড় পরে চম্পি তৈরি হয়ে নিল। ভিতরের জামা নেই চম্পির। মোটা সেমিজের নীচে তার সবচেয়ে বড় লজ্জা ঢাকা পড়েছে। তার উপর বারবার সে আঁচল টেনে দিচ্ছে। তবু চম্পির মনে হল, না, যথেষ্ট হল না। অনেকদিন বেরোয়নি। দ্বিধা পায়ে পায়ে বাধা দিতে লাগল। 

মা বললেন, ওরে, তোর ফুলু কাকিমারে কস শৈলিরি নিয়ে একদিন যেন আসে। কতদিন যে দেখিনি ওগের। ঠাকুরপোরে জিজ্ঞেস করিস তো তোর সাজেকাকার কোনও খবর জানে কি না? 

.

বকশি বাড়ির ভাঙা দেউড়ি দিয়ে ভিতরে ঢুকতে চম্পির পা আর ওঠে না। বিরাট বড় পাকা দালান বকশিদের। শরিকের অন্ত নেই। তাই কোনও অংশ ভেঙে পড়ছে কোনও অংশ চকচক করছে। সবাই থাকেও না দেশে, অনেকে আসেও না। টুনির বাবা ঝিনেদায় বাড়ি করে উঠে গেছেন। কুল বকশিরা এখন তো ঝিনেদারই লোক। শৈলদির বাবা শ্বশুরের সম্পত্তি পেয়ে কলকাতাবাসী হয়েছেন। 

পুজোদালানের পাশ দিয়ে যেতে যেতে চকিতে চম্পির চোখে ছেলেবেলার সেই ধুমধামের ছবিটা ফুটে উঠল। শৈলদির ঠাকুরদা তখন বেঁচে। কতবার যে যাত্রাগান, ঢপ, কীর্তন শুনতে এসেছে চম্পিরা তার ঠিক-ঠিকানা নেই। একবার তো থিয়েটারও হয়েছিল। চম্পির দুর্ভাগ্য সে তখন জ্বরে অচৈতন্য। জীবনের সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে তার। 

পুজোদালান পেরিয়ে বাঁ হাতি পারুল পিসিদের মহল। ছোটকাকা তার জন্যে নাকি সন্নেসি হয়ে গিয়েছিলেন। পারুলি তুই তো কাছা খোলালি। ছড়া বেঁধেছিল গ্রামের দুষ্টু ছেলেরা। চম্পির হাসি পেল। 

তারপর টুনিদের অংশ। টুনির বিধবা পিসি এখন থাকে। টুনিদের পূর্বদিকের দালানটা শৈলদিদের। দোতলা বাড়ি। ও বাবা, কত লোক জমেছে বাইরের ঘরে। সুবলকাকা বেশ ফরসা হয়েছেন দেখি। মাথায় টাক পড়তে শুরু করেছে। বুকের আঁচলটা আবার টেনে দিল। একসঙ্গে এতগুলো পুরুষের চোখের সামনে দারুণ অস্বস্তিতে পড়ল। কী জানি, শুধু সেমিজ গায়ে পরে বাইরে বেরুলে এত অস্বস্তি কেন হয়। সেমিজের ভিতর লজ্জার অস্তিত্ব অনুক্ষণ বিঁধতে থাকে। বারে বারে মনে হয়, এই বুঝি প্রকাশ হয়ে পড়ল। 

সুবলকাকার গম্ভীর আওয়াজ কাকে যেন জিজ্ঞাসা করল, বিলেসদাদার মেয়ে না? 

কে যেন বলল, হ্যাঁ। বিয়ে থা দেচ্ছে না বিলেস। মেয়ে ঘরে পুষে রাখিছে। 

মাথাটা নিচু করে চম্পি ভিতরে ঢুকল। তার স্বভাবসিদ্ধ উপেক্ষার বর্মটি সে আজ এঁটে আসেনি, ভুলেই গিয়েছিল। তাই অতর্কিত এই আক্রমণ তার মর্মে গিয়ে বিঁধল। কেন সে মরতে এখানে এল? উচিত হয়নি। 

ফুলুকাকিমা পালঙ্ক খাটে শুয়ে ছিলেন। ঝি তাঁকে ঝালরের পাখার বাতাস করছিল। চম্পিকে দেখে একগাল হেসে ফেললেন। 

এসো মা এসো। থাক, থাক, শোয়া মানুষকে আর প্রণাম করে না। এমনিই আশীর্বাদ করি। ভাশুর ঠাকুর, বড়দিদি, খুড়িমা সব ভাল তো? 

ফুলুকাকিমার কথায় চম্পির মনের জ্বালা নিভে গেল। বড়লোকের মেয়ে বড়লোকের বউ, কিন্তু একটুও দেমাক নেই। 

চম্পি একে একে সব কথার জবাব দিল। 

ফুলুকাকিমা বললেন, তারপর আমাদের সন্নেসি ঠাকুরের খবর কী? বিয়ে হয়েছে শুনলাম। বউ কেমন হল? 

ফুলুকাকিমার কথার টানে চম্পিও হেসে ফেলল খিলখিল করে। 

শৈলর গলা উপর থেকে শোনা গেল, কে হাসে মা? চম্পি এসেছে নাকি? 

ফুলুকাকিমা বললেন হ্যাঁ, এই এল। রোদে একেবারে সিদ্ধ হয়ে এসেছে। ঠান্ডা হয়েই যাচ্ছে। ওলো চারি, হাতটা একটু জোর করে নাড়। বাছার গায়ে বাতাস লাগুক 

চারি খ্যার খ্যার করে উঠল, আমার গতর তো আর মেশিং নয় বাছা যে, ফরফর করে রাতদিন সমানতালে ঘুরবে। হাতটা এলিয়ে গেছে। যে দেশে ইলেকটেরি নেই, সেই দেশে কি মনিষ্যি আসে গা। রাত হলেই অন্ধকার, সাপের ঘাড়েই পা দিই, কি বিছেতেই কাটে। ভয়ে ভয়ে মরে থাকি। ম্যা গোঃ। 

চারির কথা, শৈলদির বরের কথা, ওর সেই ছোকরা দেওরের কথা, সব দেখি এক সুরে বাঁধা। এরা সব কলকাতার লোক। 

চুপ করো বাছা, চুপ করো। তোমাকে আনাই ঝকমারি হয়েছে। কালকেই কলকাতায় পাঠিয়ে দেব। 

হ্যাঁ, তাই পাঠ্যে দিয়ো। এই জঙ্গলে আমি থাকতে পারবনি। 

জঙ্গল তোমাকে গিলে খাচ্ছে। চুপ করো, এখন একটু কথা বলি। হ্যাঁ, তারপর সন্নেসি ঠাকুরপোর বউ কেমন হল? 

চম্পি উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করল কাকিমার। 

আর ছেলেটাও খুব সুন্দর হয়েছে কাকিমা। অবিকল কাকার মতো দেখতে। কী দস্যিপানাই না করে। একটু একটু হাঁটতে শিখেছে তো। এখন সামলানো দায়। 

ও মা, কতক্ষণ চম্পিকে আর আটকে রাখবে। দয়া করে এখন একবার ছেড়ে দাও। 

ফুলুকাকিমা বললেন, যাও মা, যাও। চম্পি চম্পি করে হাঁপিয়ে উঠেছে শৈল। সঙ্গী সাথী তো নেই এখেনে। ছেলে দুটো এল না। শৈলর দেখলাম তবু টান আছে দেশের উপর। বলতেই ও রাজি হয়ে গেল। ওর এক দেওর, সে কখনও পাড়াগাঁ দেখেনি, বললে আমিও যাব। উনি তো খুব খুশি। চলে এলাম সবাই। 

মা! 

ফুলুকাকিমা এবার চটে উঠলেন। 

মেয়ের রকম দ্যাখো একবার। আমি যেন চম্পিকে খেয়ে ফেলছি। ও কি ভীমনাগের সন্দেশ যে টপাস করে মুখে পুরে দেব। এতদিন পরে এলাম দেশে, কোথায় লোকজনের সঙ্গে দুটো কথা বলব, তা কি হবার জো আছে। হ্যাঁ, মেয়ের ওই এক ধারা। যাও মা, যাও। নইলে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করবে। 

চম্পি খিলখিল করে আবার হেসে উঠল। শৈলদি এখনও সেই আদুরে খুকিটিই আছে। 

বেশ হালকা মনেই চম্পি সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে উঠে গেল উপরে। বাড়িটা অনেকদিন বন্ধ ছিল, ঘরের ভ্যাপসা গন্ধটা এখনও সম্পূর্ণ যায়নি। তার মধ্যে থেকেও বেশ একটা সুগন্ধ পাউডার কি এসেন্সের কে জানে— চম্পির নাকে এসে ঢুকল। 

শৈলর ঘরে ঢুকতে গিয়েও চৌকাঠের বাইরে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল চম্পি। শৈলদির খাটে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে ও লোকটা কে? চম্পি বিব্রত হল। 

শৈল ডাকল, এসো ভাই চম্পি, ভিতরে এসো। লজ্জা কী, ও আমার দেওর। 

সুহাস হাসতে হাসতে বলল, কিংবা বলতে পারেন বউদির সেই পিয়াদা। 

এ সেই কালকের রিনরিনে মেয়েলি গলা। পিয়াদা কথাটা আবার যশুরে কায়দায় বলা হল। চম্পি হাসতে গিয়েও হাসতে পারল না। জড়সড় হয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকল, তারপর একপাশে মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘামতে লাগল। কাল সন্ধ্যায় চম্পি সুহাসের গলা শুনে ভেবেছিল, বড়জোর সে বারো-তেরো বছরের একটা ছেলে হবে। সে যে এতবড় তা চম্পি স্বপ্নেও ভাবেনি। সামান্য সংশয় থাকলেও সে আজ আসত না। অন্তত এ ভাবে আসত না। 

শাড়িটা সেলাই করা, তবে ফরসা আছে ওই যা। সেমিজ, সেই ঢিলে সেমিজের অস্বস্তি আবার হাজারগুণ বড় হয়ে দেখা দিল। নিজের সম্পর্কেও অতিমাত্রায় সচেতন হয়ে উঠল চম্পি। অপরিচিত জোয়ান পুরুষের এত কাছে আসা, এই তার প্রথম। থাকলই বা শৈলদি তার কাছে। 

সুহাস উঠে বসল। 

বলল, বউদি, তোমরা চৌকিতে এসে বসো। আমায় চেয়ারটা ছেড়ে দাও। 

জড়তাহীন কী পরিষ্কার উচ্চারণ। চম্পি ভাবল, গলাটা ওর মেয়েলি, কিন্তু এত সুন্দরভাবে কথা বলতে পারে, এমন একটা ছেলেও কি এই গ্রামে আছে। চাইব না চাইব না করেও চম্পি লুকিয়ে একবার দেখে নিল। রং খুব ফরসা নয়। মুখ চোখ যে আহামরি তাও না। তবু সুহাসকে খুব সুন্দর লাগল। একটা নতুন জিনিস চোখে পড়ল তার। এত পরিষ্কার কামানো গাল চম্পি আর কারও দেখেনি। এই গরমেও সে একটা ফিনফিনে পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে আছে। ভিতর থেকে হাতকাটা গেঞ্জির চেহারা আর সুহাসের বুকের হাতের রং উঁকি মারছে। ধুতিটা পায়ের গোড়ালি অবদি ঢেকে রয়েছে। সুহাস কত ওজন করে কথা বলে। এক মুহূর্তে চম্পির মনে সুহাসের এই চেহারার একটা শক্ত ছাপ পড়ে গেল। চম্পি তাইতে আরও লজ্জা পেল। ঘামতে লাগল সে। 

সুহাস মেঝেতে নেমে এল। এখন চম্পির থেকে তার দূরত্ব দেড় হাতও না। কেমন মৃদু মনোরম এক সৌরভ সুহাসের দেহ থেকে ভেসে এল চম্পির নাকে। সিঁড়ি দিয়ে উঠবার সময় এমনি গন্ধই যেন পেয়েছিল। হাঁটুর উপর কাপড় তোলা, গা খালি, বকবক করে বকা গ্রামের যে জোয়ান পুরুষদের এ যাবৎ দেখেছে চম্পি, তাদের সবাইকে সুহাসের পাশে অকিঞ্চিৎকর, অসভ্য, জংলি ভূত বলে মনে হতে লাগল তার। 

বসুন! দাঁড়িয়ে রইলেন কেন? 

তাকে আপনি আজ্ঞে করছে সুহাস। গ্রামের মেয়ে, কালো মেয়ে, বয়েস গড়ানো আইবুড়ো মেয়ে চম্পিকে এতবড় সম্মান আজ পর্যন্ত কেউ দেয়নি। চম্পির কেবলই মনে হতে লাগল সত্যি সত্যিই এ-সব ঘটছে তো? নাকি দিবাস্বপ্ন দেখছে সে। 

আমরা কখন থেকে আপনার অপেক্ষায় বসে আছি। 

আমার জন্য এরা অপেক্ষা করছিল, আমার আশায় বসে আছে! চম্পি ভাবল, ঠাট্টা করছে নাকি সুহাস। 

জানো চম্পি, ঠাকুরপোর ভাই কেমন ধারণা হয়েছিল তুমি আসবে না। 

সত্যিই তাই। আমি কিন্তু সেই রকমই ভেবেছিলুম। 

সুহাসবাবুরা ভেবেছিলুম বলেন। কলকাতার লোকমাত্রেই নাকি সুন্দরবনের বাঘের মতো হালুম হুলুম খেলুম বলে। চম্পি কথাটা শুনেছিল। দেখল মিথ্যে নয়। 

কেন ভেবেছিলুম জানেন, বউদি জানে, আমি মনে মনে যা আশা করি তা হয় না। আমি খুব আশা করছিলুম তো আপনি আসবেন বলে। 

সুহাসবাবু আমাকে আশা করছিলেন! আমাকে! সব মন রাখা কথা! কিন্তু তবুও এমন মন রেখেই বা ক’টা মিথ্যে কথা ক’জন শুনিয়েছে চম্পিকে? চম্পি কালো, চম্পি হাতি, চম্পি চোর, এমন অজস্র কঠিন সত্যই সে নিত্যদিন শুনে এসেছে। সত্য তাকে শুধু পীড়া দেয়। যন্ত্রণা দেয়। সত্যের প্রতি কোনও আকর্ষণ নেই তার। সে জানে কলকাতা থেকে আগত এই শিক্ষিত মাৰ্জিত সুবেশ তরুণটি তাকে ডাহা মিথ্যে বলছে। আমার জন্য ওঁরা আশা করে বসে ছিলেন, অপেক্ষা করছিলেন। কী পদের লোক আমি! একেবারে ইংলন্ডেশ্বরী! ইংলন্ডেশ্বরী কথাটা এখনও ভোলেনি চম্পি। ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষায় প্রশ্ন এসেছিল। দয়াময়ী ইংলন্ডেশ্বরী যে পথ দিয়া যাইতেন সেই পথের দুই ধারে আবালবৃদ্ধবনিতা তাঁহার দর্শন লাভের আশায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়াইয়া থাকিত। এই ইংলন্ডেশ্বরী কে? সেদিন চম্পি জবাব লিখেছিল মহারানি ভিক্টোরিয়া। এখন সুহাসের কথায় মনে হচ্ছে সে-ও বুঝি ওই ইংলন্ডেশ্বরীর পর্যায়েই উঠে গেছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইহারা আমার দর্শনলাভের আশায় অপেক্ষা করছে। আজগুবি আর কাকে বলে। কলকাতার লোক, বড্ড চালিয়াত হয়। হোক চালিয়াত। বলুক মিথ্যে। তবুও এ মিথ্যে শুনতে ভাল লাগে। চম্পিকে নিয়ে এক রুচিবান পুরুষের যে মিথ্যে বলবারও ইচ্ছে হয়, চম্পির পক্ষে তাই যথেষ্ট। সুহাসের প্রতি কৃতজ্ঞ হল চম্পি। তিনি ওর দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। সুহাস যেন নিলামওয়ালার ভাড়াটে খদ্দের। কিনবে না, কিন্তু ডাক বাড়িয়ে দেবে। যাকে কানাকড়ির মূল্যও কেউ কখনও দেয়নি, তার পক্ষে এটুকুও তো যথেষ্ট। 

চম্পি খুশিই হল। 

শৈল বলল, সত্যি ভাই চম্পি। লেখক লোক কিনা, কাল সন্ধের অন্ধকারে তোমাকে তো দেখতে পায়নি, শুধু তোমার হাসি শুনেছে। তাইতেই ঠাকুরপোর আমার কবিত্বভাব জেগে উঠেছে। কাল থেকে তোমায় নিয়ে আমাদের দু’জনে কেবল কথা হচ্ছে। 

স্বপ্ন স্বপ্ন এ শুধু স্বপ্ন। মিথ্যে এ মিথ্যে, এ ডাহা মিথ্যে। আচ্ছা এখন, এই মুহূর্তে এই অসম্ভব আজগুবি স্বপ্নটা দেখতে দেখতে আমি মরে যাই না কেন? অনেক উপেক্ষা, অনেক অপমান, অবহেলা, ঘৃণা সয়ে সয়েও যে কারণে বেঁচেছিলাম এতদিন, মনের গভীরতম কোনায় যে আশাটাকে আড়াল করে পালন করেছিলাম একদিন কিছু পাব বলে, এমন কিছু যা দিনগত দৈন্য গ্লানি উত্তীর্ণ করে আমাকে পৌঁছে দেবে নতুন এক জীবনের হাটে, নতুন দাম ধরা হবে আমার। আজ যদি তা দৈবাৎ পেলাম, যদি বাসনা পূরণ এখানেই হয়ে গেল তবে হে ভগবান, হে মদনমোহন, হে শিবশঙ্কর, হে মা ভগবতী, এতদিন শুদ্ধচিত্তে তোমাদের যে পুজো করেছি আজ তার ফল দাও, আমাকে তোমাদের কোলে টেনে নাও। আমার জীবনে আগামীকাল যেন আর না আসে। কালো, কালো, কালো, আমি কিছু না, কিছু না, এই ভয়ংকর নিষ্ঠুর সত্যের সুতীক্ষ্ণ দাঁতের ফাঁকে দোহাই তোমাদের, আমাকে আর ঠেলে ফেলে দিয়ো না। 

আপনি গান জানেন, না? নিশ্চয়ই জানেন। 

চম্পি এ-কথা শুনতে পেল না। তার মন প্রার্থনায় মগ্ন। 

তুমি যে দৈবজ্ঞ হয়ে উঠলে ঠাকুরপো। আমাদের গ্রামে ও-ই যা কিছু জানে। 

চম্পির কানে এ-কথাও পৌঁছোল না। সে দেখল সুহাস আর শৈল ধীরে ধীরে তার কাছ থেকে পিছিয়ে যাচ্ছে। কথা বন্ধ হয়ে গেল ওদের, বোবাদের মতো শুধু ঠোঁট নেড়ে যাচ্ছে এখন। ওরা অনেক দূরে চলে গেল। জানালার বাইরে। শূন্যে ভাসছে। প্রখর আলো ঘিরে রয়েছে ওদের। ওর দিকে আঙুল দেখাচ্ছে মাঝে মাঝে। হাসছে। না, সুহাসের চোখে, শৈলদির চোখে বিদ্রূপ নেই, অবজ্ঞা নেই। কী যেন তাকে বলল সুহাস। আবার বলল। ওর চোখে বিস্ময়। শৈলদিও তাকে কী যেন বলছে। আবার বলল, আবার, আবার। বোবা হয়ে গেল নাকি দু’জনে? না, শুধু ওরা নয়, সমস্ত জগৎ থেকেই শব্দ লুপ্ত হয়েছে। আর কেউ তাকে কুকথা শোনাতে পারবে না। পারলেও সে শুনতে পারবে না। বেশ হয়েছে। নিশ্বাসটা কখন যেন ফুরিয়ে এসেছে। যাক ফুরিয়ে। শব্দ যাক, বাতাস যাক, শৈলদি, সুহাসবাবু, যূথি, বাবা মা, এই সংসার, জগৎ‍, এই মুহূর্তে ফুরিয়ে যাক। চম্পিও যাক। আর কিছু চাইনে তার। 

কিন্তু বড় কষ্ট! বড় কষ্ট! উঃ বাতাস! বাতাস! এ কী হল? এ কী যন্ত্রণা বুকে! বিরাট একটা পাষাণ তার শ্বাসনালীর মুখে আটকা পড়েছে। উঠছে না সেটা, উঠছে না। থেকে থেকে সহস্র বর্শা যেন চম্পির হৃৎপিণ্ডে একসঙ্গে খোঁচা মারছে। উঃ! উঃ! 

চম্পি কি তবে মরছে? এই কি মৃত্যু! এত যন্ত্রণা! না, না, তবে সে মরবে না। মরতে চায় না, চায় না, চায় না। যন্ত্রণার গভীর খাদে পা ফসকে পড়ে গেল চম্পি। 

সুহাসবাবু, সুহাসবাবু, হাতটা বাড়িয়ে দিন, আপনার হাতখানা। তারস্বরে চম্পি যেন ডাকল। কিন্তু সুহাস তো শূন্যে ভাসছে। অত তাড়াতাড়ি এগিয়ে আসতে পারছে না। অবশেষে আসতে পেরেছে সুহাস। হাতখানা বাড়িয়েও দিল চম্পির দিকে। কিন্তু চম্পি সেটা ধরবার আগেই সুহাস উলটে গেল। চম্পিও সাঁত করে তলিয়ে গেল অন্ধকারে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *