হাওয়ার্ড থার্সটন : একজন বিখ্যাত জাদুকর
প্রায় বছরেরও আগের কথা। আলেকজান্ডার হারম্যন-এর জাদু দেখে খুশিমনে শিকাগোর এক থিয়েটার হল থেকে ভয়ানক শীতের রাতে দলে-দলে দর্শকরা বের হয়ে আসছিল। তখনকার সময়ের শ্রেষ্ঠ জাদুকর ছিলেন হারম্যন।
থিয়েটার হলেন সামনে এক বালক রাস্তায় দাঁড়িয়ে খবরের কাগজ বিক্রি করছিল। তার গায়ে কোনো ওভারকোট ছিল না, ঘর বাড়ি ছিল না এবং থাকার মতো জায়গাও ছিল না। লোকজনের ভিড় কমে যাওয়ার পর থিয়েটার হলের পেছনে শুয়ে পড়ল, সে দেহটাকে প্রচণ্ড শীত থেকে রক্ষার জন্য একটা লোহার ঝাঁঝরির ওপর খবরের কাগজ দিয়ে শরীরটাকে জড়িয়ে নিল। শুয়ে থাকতে থাকতে এই বালক প্রতিজ্ঞা করল, সে একজন বড় জাদুকর হবে এবং ফারের কোট গায়ে জড়িয়ে জাদু দেখাবে, লোকজন হাততালি দিয়ে তাঁর প্রশংসা করবে। সে আরো প্রতিজ্ঞা করল, সে একজন বিখ্যাত জাদুকর হয়ে এ থিয়েটার হলে জাদু দেখাবে এবং বড় বড় হরফে তার নাম ছাপা হবে। এই বালকটির নাম হাওয়ার্ড থার্সটন।
তিনি যা ভেবেছিলেন, বিশ বছর পরে তাই-ই করলেন। এই থিয়েটার হলে তিনি জাদু দেখাতে এলেন। অনুষ্ঠান শেষ করার পর থিয়েটার হলের পিছনে গেলেন এবং যে জায়গায় তিনি গৃহহীন ও ক্ষুধার্ত অবস্থায় শুয়ে-শুয়ে নিজের নামের আদ্যাক্ষরটা দেয়ালের গায়ে খোদাই করছিলেন, সেটা দেখালেন।
থার্সটনের ছেলেবেলায় তার বাবা একদিন তাকে নিষ্ঠুরভাবে মারলেন। থার্সটনের অপরাধ হল তিনি একদল ঘোড়াকে বেশি জোরে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। রাগে দুঃখে তিনি চিৎকার করে কাঁদতে-কাঁদতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন, পাঁচ বছরে আর ফিরে যান নি। বাবা-মা ভেবেছিলেন, তিনি মারা গেছেন। এরপর তিনি কখনো বক্সগাড়িতে চড়ে, কখনো-বা ভিক্ষা করে, আবার কখনো চুরি করে তার দুঃখজনক দিনগুলো কাটালেন। বিভিন্ন অপরাধের জন্য তিনি অনেকবার গ্রেফতার হলেন এবং বহুবার ফেরারি আসামি হলেন। লোকে তাকে গালাগালি দিল, অভিশাপ দিল আবার লাথি মেরে ট্রেন থেকে ফেলে দিল। তিনি ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতায় ঘোড়সওয়ার হলেন।
সতের বছর বয়সে নিউইয়র্কে তাঁর জীবনে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটল। যখন তিনি নিউইয়র্কে আটকা পড়লেন তার কাছে তখন একটা ডলারও ছিল না, সাহায্য করার মতো একজন বন্ধুও ছিল না। হাঁটতে হাঁটতে থার্সটন এক উপাসনালয়ে গিয়ে হাজির হলেন। এক খ্রিষ্ট ধর্মপ্রচারককে তখন ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ করতে শুনলেন, ‘তোমার মধ্যে একজন মানুষ আছে।’ কথা ক’টি শুনে তিনি অভিভূত ও বিচলিত হলেন! তখন তার মনে স্থির বিশ্বাস জন্মাল, তিনি পাপ করেছেন। সুতরাং তিনি হেঁটে বেদীর কাছে গিয়ে ধর্মপ্রচারকের পায়ের তলায় লুটিয়ে পড়ে অশ্রু বিসর্জন করলেন, অবশেষে ধর্মের দীক্ষা গ্রহণ করলেন। এবং দু’সপ্তাহ পরে তাকে দেখা গেল চায়না টাউনের এক রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে তিনি লোকজনকে ধর্মের বাণী শোনাচ্ছেন। তিনি নিজেকে এত সুখী বোধ করলেন যে, তিনি ধর্মপ্রচারক হবেন বলে স্থির করলেন। ম্যাসাচুসেটস-এর এক বাইবেল স্কুলে ভর্তি হলেন থার্সটন এবং নিজের খাওয়া ও থাকার খরচ চালানোর জন্য দারোয়ানের চাকুরি নিলেন। কিন্তু ছয় মাসের পর স্কুলে যান নি তিনি। শেষপর্যন্ত স্থির করলেন যে, তিনি ধর্মপ্রচারক চিকিৎসক হবেন। আর তাই পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য রওনা হলেন।
এ সময় একটা ঘটনা ঘটল, যা তার জীবনের সম্পূর্ণ গতিপথকে পাল্টে দিল। ম্যাসচুসেটস থেকে ফিলাডেলফিয়া যাওয়ার পথে আলবানিতে গাড়ি বদলাতে হবে। ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছেন, ট্রেন আসতে দেরি ভেবে হাঁটতে হাঁটতে এক থিয়েটারে এসে উপস্থিত হলেন। সেখানে আলেকজান্ডার হ্যারম্যান জাদু প্রদর্শন করছেন। আগেই বলেছি, জাদুবিদ্যায় থার্সটনের আগ্রহ ছিল অঢেল। তাই তিনি জাদু সম্রাট হ্যারম্যানের সাথে দেখা করার জন্য উদগ্রীব হয়ে ছিলেন। হ্যারম্যানের কাছে দীক্ষালাভের জন্য। কিন্তু দরজায় নক করার মতো সাহস হারিয়ে ফেললেন তিনি। পরদিন সকালে জাদুকর হ্যারম্যানকে অনুসরণ করে রেল স্টেশনে গেলেন এবং হ্যারম্যানের দিকে নীরব, নির্বাক ও প্রশংসাপূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন। জাদুকর তখন সিরাকিউসে যাচ্ছিলেন, থার্সটন যাবেন ভাবলেন নিউইয়র্কে। টিকেট কিনতে গিয়ে তিনি ভুলবশত সিরাকিউসের টিকেট কিনে ফেললেন। আর এই ভুলটাই বদলে দিল তার ভাগ্য। এই ভুলের জন্য তিনি একজন কিখ্যাত জাদুকর পরিণত হলেন।
থার্সটন যখন একজন বিখ্যাত জাদুকর হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেলেন, তখন প্রতিদিন তিনি প্রায় এক হাজার ডলার করে রোজগার করলেন। থার্সটন স্বীকার করেছেন, অনেক জাদুকর তার চেয়ে আরো ভালো জাদু বিদ্যা জানতেন। তাহলে, তার সফলতার গোপন রহস্যটা কী ছিল?
তাঁর সফলতার পেছনে মূলত দুটো কারণ নিহিত ছিল–তার ব্যক্তিত্বকে রঙ্গমঞ্চের দর্শকদের মনে গেঁথে দেয়ার আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল। তিনি মানবপ্রকৃতি উত্তমরূপে অনুধাবন করতে পারতেন এবং প্রদর্শনীতে এভাবে নিজের অনুশীলন ও অভিজ্ঞতার দ্বারা দর্শকদের মাঝে আকর্ষণীয়রূপে উপস্থাপন করতেন। আরেকটি হল তিনি তাঁর দর্শকদের ভালোবাসতেন। অনুষ্ঠান শুরুর আগে মঞ্চের পাশে দাঁড়িয়ে লাফ ঝাঁপ দিয়ে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সতেজ করে তুলতেন। আর বলতে থাকতেন, ‘আমি আমার দর্শকদের ভালোবাসি। আমি দর্শকদের আপ্যায়ন করতে চাই। আমি একটি চমৎকার কাজ পেয়েছি এবং আমি বড় সুখী। তিনি বিশ্বাস করতেন, নিজে সুখী না হলে অন্যকে তিনি সুখী করতে পারবেন না।
১৯৩৬ সালের ১৩ এপ্রিল তাঁর মৃত্যুর পূর্বে তিনি জাদুকরগণের অধ্যক্ষ এবং ইন্দ্রজালরাজরূপে সর্বজনস্বীকৃত হয়েছিলেন। জীবনের শেষ চল্লিশটি বছর হাওয়ার্ড থার্সটন বিক্ষিপ্তভাবে পৃথিবীর বহুদেশে বহুবার ভ্রমণ করেছিলেন। হাজারো দর্শককে জাদুবিদ্যায় অভিভূত করেছিলেন তিনি।
বিশ্বের ছয় কোটিরও বেশি লোক তার প্রদর্শনী দেখেছিল এবং তিনিও লাভ করেছিলেন বিশ লক্ষ ডলার।