হাইমির আর থরের মৎস্য শিকার অভিযান

হাইমির আর থরের মৎস্য শিকার অভিযান

এসগার্ডের দেবতারা সমুদ্রের ধারে এগিরের সুবিশাল প্রাসাদে উপস্থিত হলো। “কোথায় এগির? দেখো আমরা এসেছি,” ডাকল থর, যে ছিল দলের প্রধান। “আমাদের জন্য ভোজের আয়োজন করো।”

এগির ছিল সবচেয়ে বড় সমুদ্র দানব। তার স্ত্রী ছিল রেন, যারা সমুদ্রে ডুবে যায়, তারা রেনের জালে ধরা পড়ে। তার নয় কন্যা হলো সমুদ্রের ঢেউ।

দেবতাদের খাওয়ানোর কোনো ইচ্ছে এগিরের ছিল না, কিন্তু দেবতাদের সাথে যুদ্ধ করার কোনো ইচ্ছেও তার ছিল না। সে থরের দিকে তাকাল আর বলল, “আমি তোমাদের জন্য একটা ভোজসভার আয়োজন করব, এমন চমৎকার ভোজ তোমরা কখনো দেখোনি। আমার ভৃত্য ফিমাফেং তোমাদের আপ্যায়ন করবে, তোমাদের পেটে যত ধরে তত খাবার সে তোমাদের পরিবেশন করবে, যত চাও তত পানীয় তোমাদের পরিবেশন করা হবে। আমার শুধু একটা ছোট শর্ত আছে, আমি তোমাদের জন্য ভোজের আয়োজন করব, কিন্তু তোমাদের সবাইকে পান করানোর জন্য পর্যাপ্ত পানীয় তৈরির জন্য যথেষ্ট বড় একটা হাঁড়ি আমাকে এনে দিতে হবে। তোমরা সংখ্যায় অনেক আর তোমাদের জন্য পানীয়ও লাগবে অনেক।”

এগির ভালো করেই জানত, দেবতাদের কাছে এত বড় হাঁড়ি নেই। আর হাঁড়ি না আনতে পারলে তাকে আর দেবতাদের ভোজ করাতে হবে না।

থর তার সাথের অন্য দেবতাদের সাথে পরামর্শ করল, কিন্তু সবাই একই কথা বলল, এত বড় হাঁড়ি এসগার্ড কেন, দুনিয়ার কোথাও নেই। সবশেষে থর যুদ্ধ দেবতা টীরকে জিজ্ঞেস করল। টীর তার বাঁ হাত দিয়ে গাল চুলকালো, যেটা ছিল তার একমাত্র হাত, “মহাসমুদ্রের পাড়ে,” বলল সে, “বাস করে দানব রাজা হাইমির। তার একটা হাঁড়ি আছে, যেটা তিন মাইল গভীর। এটাই দুনিয়ার সবচেয়ে বড় হাঁড়ি।”

“তুমি কি নিশ্চিত?” জানতে চাইল থর।

টীর সম্মতিসূচক মাথা ঝোঁকাল।

“হাইমির আমার সৎ বাবা। সে আমার মাকে বিয়ে করেছে,” বলল সে। “আমার মা একজন দানবী। আমি সেই বিশাল হাঁড়ি নিজ চোখে দেখেছি। আর আমার মায়ের ছেলে হিসেবে, হাইমিরের প্রাসাদে আমাকে সবসময়ই স্বাগত জানানো হবে।”

টীর আর থর থরের রথে চড়ে বসল, যেটা স্নারলার আর গ্রাইন্ডার নামক দুই ছাগল টেনে নিয়ে যায়। তারা দ্রুত হাইমিরের বিশাল প্রাসাদের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল।

হাইমিরের প্রাসাদে পৌঁছে থর ছাগল দুটোকে একটা গাছের সাথে বেঁধে রাখল আর তারা দুজন প্রাসাদের অভ্যন্তরে প্রবেশ করল।

তারা রান্নাঘরে এক দানবীকে বিশাল পাথর খণ্ডের মতো বড় বড় পেঁয়াজ আর বড় বড় নৌকার মতো বাঁধাকপি কাটতে দেখল। থর চোখ ফেরাতে পারছিল না, বৃদ্ধা দানবীর নয়শত মাথা ছিল, একেকটা মাথা ছিল খুবই ভয়ংকর আর বিশ্রী দেখতে। অজান্তেই থর এক কদম পিছিয়ে উঠল। টীর এই দৃশ্য দেখে ভয় পেলেও প্রকাশ করল না। টীর ডেকে বলল, “হ্যালো, দাদি। আমরা এখানে হাইমিরের হাঁড়িটা ধার করতে এসেছি, যেটায় আমাদের পানীয় প্রস্তুত হবে।”

তোমরা দেখি খুবই ছোট, আমি তো ভেবেছিলাম, ইঁদুরের বাচ্চা বুঝি,” বলল টীরের দাদি আর যখন সে কথা বলছিল, মনে হচ্ছিল একদল লোক চিৎকার করছে। “আমার সাথে কথা বলার দরকার নেই, নাতি। তুমি তোমার মায়ের সাথে কথা বলো।”

দানবী চিৎকার করল, “ঘরে অতিথি এসেছে। তোমার ছেলে তার বন্ধুকে নিয়ে বেড়াতে এসেছে।” কিছুক্ষণ পরই ঘরে আরেক দানবী ঢুকল। সে ছিল হাইমিরের স্ত্রী, টীরের মা। তার পরনে ছিল সোনালি পোশাক। তাকে ততটাই সুন্দর দেখাচ্ছিল, তার শাশুড়িকে যতটা না কুৎসিত দেখাচ্ছিল। তার হাতে ছিল ঘরের সবচেয়ে ছোট পানীয় পাত্র, যাতে অতিথিদের জন্য পানীয় ভরা ছিল। থর আর টীর পাত্র দুটো নিল, যেগুলোর আকার ছিল একেকটা বালতির মতো, তারা দুজনে আগ্রহের সাথে পানীয় পান করে তৃষ্ণা মেটাল।

এটা ছিল খুবই চমৎকার পানীয়।

দানবী থরের নাম জিজ্ঞেস করল। থর প্রায় তার নাম বলে ফেলেছিল, কিন্তু সে কিছু বলার আগেই টীর বলে উঠল, “ওর নাম ভিওর, মা। সে আমার বন্ধু। আর সে হাইমির আর দানবদের শত্রুর শত্রু।”

দূর হতে তারা একটা গর্জন শুনতে পেল। মনে হচ্ছিল বজ্রের গর্জন হচ্ছে, পাহাড় ধসে পড়ছে অথবা বিশাল ঢেউ সমুদ্রতীরে আছড়ে পড়ছে, আর প্রতি গর্জনে মাটি কেঁপে কেঁপে উঠছে।

“আমার স্বামী বাড়ি ফিরে আসছেন,” বলল দানবী। “আমি তার নম্র পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি।”

এখন গর্জন পরিষ্কার শোনা যাচ্ছিল আর মনে হচ্ছিল সেটা দ্রুত কাছে আসছে।

“আমার স্বামী যখন বাড়ি ফিরে আসেন, তিনি প্রায়ই ক্রুদ্ধ, রাগান্বিত আর খারাপ মেজাজে থাকেন। তিনি তখন তার অতিথিদের সাথে খুবই খারাপ ব্যবহার করেন,” দানবী তাদের সতর্ক করল। “তোমরা দুজন এই হাঁড়ির ভিতরে লুকিয়ে পড়, ওনার মেজাজমর্জি ভালো হলে তোমরা বেরিয়ে আসবে।”

দানবী মেঝেতে রাখা একটা হাঁড়িতে তাদের লুকিয়ে রাখল। হাঁড়ির ভিতর অন্ধকারে তারা লুকিয়ে থাকল, বাইরের কিছুই তারা দেখতে পাচ্ছিল না।

দানবের পায়ের আঘাতে মাটি কাঁপতে লাগল, একটা দরজা জোরে লাগানোর শব্দ হলো, থর আর টীর বুঝতে পারল, হাইমির ঘরে ঢুকেছে। তারা শুনতে পেল, দানবী তার স্বামীকে বলছে, ঘরে অতিথি এসেছে, তার ছেলে আর ছেলের বন্ধু, বাড়ির কর্তা হিসেবে তাদের সাথে তার ভালো ব্যবহার করা উচিত, তাদের হত্যা করা উচিত হবে না।

“কেন?” দানব উচ্চ আর বিরক্ত স্বরে জানতে চাইল।

“কারণ, এদের একজন আমাদের সন্তান, টীর। তার কথা তোমার মনে নেই? আর আরেকজনের নাম ভিওর। তার সাথেও ভালো ব্যবহার করবে।”

“থর? আমাদের শত্রু থর? সেই থর, যে থর সবচেয়ে বেশি দানবকে হত্যা করেছে, এমনকি কোনো দানবও এত দানব হত্যা করেনি। সেই থর, যাকে আমি সামনে পেলেই হত্যা করার প্রতিজ্ঞা করেছি? সেই থর…”

“ভিওর,” দানবকে শান্ত করার জন্য বলল স্ত্রী, “থর না। ওর নাম ভিওর। সে আমাদের সন্তানের বন্ধু, আমাদের শত্রুর শত্রু, সুতরাং তার সাথে তোমার ভালো ব্যবহার করতে হবে।

“আমার মেজাজ খারাপ আছে, আমি বিরক্ত আর ক্রুদ্ধ। তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করার কোনো ইচ্ছে আমার নেই,” বলল দানব ক্রুদ্ধস্বরে। “তারা কোথায় লুকিয়ে আছে?”

“ওই পায়াটার পিছনে,” বলল তার স্ত্রী

থর আর টীর একটা কিছু ভাঙার শব্দ শুনল আর বুঝতে পারল ঘরের পায়াটা দানব ভেঙে ফেলেছে। তারা তারপর একের পর এক জিনিস ভাঙার শব্দ শুনতে পেল, তাকের ওপর থেকে সকল পাত্র আর হাঁড়ি ফেলে দেওয়া আর ভেঙে ফেলার শব্দ শোনা গেল।

“তোমার ভাঙাভাঙি কি শেষ হয়েছে?” জানতে চাইল টীরের মা।

“মনে হয় শেষ হয়েছে,” গজগজ করে জবাব দিল দানব।

“তাহলে এই হাঁড়ির নিচে দেখো,” বলল দানবী, “মেঝের এই হাঁড়িটা যেটা তুমি ভাঙনি।”

যে হাঁড়ির নিচে থর আর টীর লুকিয়ে ছিল, দানব সেটা তুলল, তারা দেখল, বিশাল একটা মুখ তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। থর বুঝল, এটাই হাইমির, দানব রাজা। তার দাড়ি ছিল শীতে তুষার ঢাকা জঙ্গলের মতো, ভ্রু কাঁটা ঝোপের মতো, নিশ্বাস পচা ডোবার মতো দুর্গন্ধময়।

“হ্যালো, টীর,” বলল হাইমির। তার কণ্ঠে আমন্ত্রণের লেশমাত্র নেই।

“হ্যালো, পিতা,” বলল টীর, তার কণ্ঠেও কোনো আগ্রহ দেখা গেল না।

“তোমরা আমাদের সাথে অতিথি হিসেবে রাতের খাবারে যোগ দেবে,” বলল হাইমির। সে তালি বাজাল।

দরজা খুলে গেল আর একটা বিশাল ষাঁড় ঘরে আনা হলো, সেটার পশম চকচকে, শিং ধারালো। সেটার পিছনে আরেকটা ষাঁড় আনা হলো, যেটা আরো সুন্দর। তারপর আরেকটা ষাঁড় আনা হলো, যেটা বাকি দুটোর চেয়েও সুন্দর।

“এই ষাঁড়গুলো দুনিয়ার সবচেয়ে চমৎকার ষাঁড়। মিডগার্ড আর এসগার্ডের পশুদের চেয়ে অনেক বড় আর মোটা। আমি আমার পশুর পালকে নিয়ে গর্ব করি,” বলল হাইমির গর্বভরে, “এগুলো আমার সম্পদ, আমি এদের নিজের সন্তানের মতো পালন করি,” এক মুহূর্তের জন্য দানবের মুখের ভাব নরম হয়েছে বলে মনে হলো।

নয়শত মাথাওয়ালা দাদি ষাঁড়গুলোকে হত্যা করল, চামড়া ছাড়িয়ে তার বিশাল রান্নার পাত্রে ফেলল। বিশাল পাত্রে খাবার রান্না হতে লাগল, পাত্রের নিচে আগুন যেন ক্রুদ্ধ গর্জন করল, আর দাদি ওক গাছের মতো বিশাল এক চামচ দিয়ে সেটা নাড়তে থাকল। রান্না করতে করতে দানবী গুনগুন করে গান করছিল, থরের মনে হচ্ছিল হাজারো বৃদ্ধা মহিলা চিৎকার করে গান করছে।

কিছুক্ষণ পর খাবার প্রস্তুত হয়ে গেল।

“তোমরা এখানে অতিথি। লজ্জা করো না। পাত্র থেকে নিজেই নিয়ে খাও,” বলল হাইমির, সে ভাবল, অতিথিরা আকারে খুবই ছোট, তারা আর কত খেতে পারবে? ষাঁড়গুলো অনেক বড় বড় ছিল।

থর বলল, সে লজ্জা পায় না, বলেই সে দুটি ষাঁড় নিজের জন্য নিয়ে খাওয়া শুরু করল, খেয়ে হাড়গুলো ফেলে রাখল আর তৃপ্তির ঢেকুর তুলল।

“তুমি তো অনেক খাবার খেয়ে ফেলেছ, ভিওর,” বলল হাইমির। “এটা আমাদের কয়েকদিনের খাবার ছিল। আমি এমনকি কোনো দানবকেও এক বসায় দুই ষাঁড় একবারে খেতে দেখিনি।”

“আমি ক্ষুধার্ত ছিলাম,” বলল থর, “আর আমি একটু বেশিই খেয়ে ফেলেছি। শোন, আমরা কি কাল মাছ ধরতে যেতে পারি না? আমি শুনেছি, তুমি খুবই ভালো মাছ ধরতে পারো।”

হাইমির তার মাছ ধরার দক্ষতা নিয়ে গর্ব করে, “আমি চমৎকার মাছ ধরতে পারি,” বলল সে। “আমরা আগামীকাল রাতের খাওয়ার জন্য মাছ ধরতে পারি।”

“আমিও খুব ভালো মাছ ধরতে পারি,” বলল থর। সে আগে কখনো মাছ ধরেনি, কিন্তু এটা কী এমন কঠিন কাজ?

“আমরা আগামীকাল সকালে সমুদ্রের তীরে মিলিত হব,” বলল হাইমির।

সেদিন রাতে বিশাল এক রুমে তাদের শুতে দেওয়া হলো। টীর থরকে বলল, “তুমি কি জানো তুমি কী করতে যাচ্ছ?”

“আমি জানি,” বলল থর। কিন্তু সে আসলে জানে না। তার মনে যা এসেছে, সে তাই করেছে। আর এটাই থর সবচেয়ে ভালো পারে।

ভোরের আবছা আলোয় সমুদ্র তীরের ঘাটে থর আর হাইমির মিলিত হলো।

“তোমাকে আমার সাবধান করে দেওয়া উচিত, ছোট্ট ভিওর,” বলল দানব, “আমরা বরফাবৃত সমুদ্রের অনেক গভীরে যাব। আমি বৈঠা বেয়ে অনেক দূরে চলে যাব, এত ঠান্ডা তোমার মতো ক্ষুদ্র প্রাণী সহ্য করতে পারবে না। তোমার চুল আর দাড়ি বরফ জমে শক্ত হয়ে যাবে আর তুমি ঠান্ডায় নীল হয়ে যাবে। তুমি হয়তো মারাই যাবে।”

“ও কিছু না,” বলল থর, “আমি ঠান্ডা পছন্দ করি। আমরা টোপ হিসেবে কী ব্যবহার করব?”

“আমি আমার টোপ নিয়ে এসেছি,” বলল হাইমির। “তোমাকে তোমারটা নিয়ে আসতে হতো। তুমি ষাঁড়ের পালের কাছে খোঁজ করতে পারো। গোবরের মধ্যে বড় বড় কীড়া হয়। দেখো, সেখান থেকে কয়েকটা নিয়ে আসতে পার কি না।”

থর হাইমিরের দিকে তাকাল। তার ইচ্ছে হলো হাতুড়ি দিয়ে হাইমিরকে আঘাত করে, কিন্তু সেক্ষেত্রে লড়াই করা ছাড়া ভালো পন্থায় হাঁড়িটা সে কোনোভাবেই পাবে না। সে টোপ সংগ্রহ করতে চলল।

তৃণভূমিতে হাইমিরের চমৎকার ষাঁড়গুলো চরে বেড়াচ্ছিল। মাটিতে দলায় দলায় গোবর পড়ে ছিল আর সেগুলোতে বড় বড় কীড়া ঘুরে বেড়াচ্ছিল। কিন্তু থর সেগুলোর কাছেও গেল না। পরিবর্তে সে সবচেয়ে বড়, মোটা আর চমৎকার দেখতে ষাঁড়ের কাছে গেল, ঘুসি পাকাল আর ষাঁড়ের দুই চোখের মাঝখানে আঘাত করল, ষাঁড়টি মুহূর্তেই ধরাশায়ী হলো।

থর পশুটির মাথাটি ছিঁড়ে নিয়ে নিজের থলেতে ভরে নিল আর সমুদ্রের পাড়ে ফিরে এলো।

হাইমির নৌকাতেই ছিল। সে ইতোমধ্যেই বৈঠা বেয়ে নৌকা নিয়ে অনেক দূরে চলে গেছে।

থর তার থলেটি পিঠে ঝুলিয়ে বরফশীতল জলে ঝাপ দিল আর সাঁতরাতে শুরু করল। সাঁতরে সে নৌকার কাছে পৌঁছে গেল আর প্রায় অবশ হয়ে আসা আঙুল দিয়ে নৌকার এক পাশ ধরল, আর নিজেকে নৌকার ওপর টেনে তুলল, তার গা থেকে বরফজল ঝরে পড়ছিল আর তার দাড়িতে বরফ জমে গিয়েছিল।

“আহ, এটা খুবই মজাদার ছিল। সকাল বেলা একটা সাঁতারের মতো মজা অন্য কোনোকিছুতে নেই।”

হাইমির কিছুই বলল না। থর এক জোড়া বৈঠা তুলে নিল আর তারা দুজনে একসাথে বৈঠা বাইতে লাগল। অল্প সময়ের মধ্যে ভূমি অদৃশ্য হয়ে গেল আর উত্তর সাগরের গভীর জলে তারা ছাড়া আর কাউকে দেখা যাচ্ছিল না। সমুদ্র গাঢ় বাদামি রঙের দেখাচ্ছিল, বড় বড় ঢেউ আসছিল আর বাতাস আর সীগালেরা চিৎকার করছিল।

হাইমির বৈঠা বাওয়া বন্ধ করল। “আমরা এখানেই মাছ ধরব,” বলল সে।

“এখানে?” বলল থর। “আমরা এখনো সমুদ্রের গভীরেই যাইনি।” বলেই সে বৈঠা তুলে নিল আর একাই বৈঠা বেয়ে নৌকা গভীর সমুদ্রে নিয়ে যেতে লাগল। নৌকা বড় বড় ঢেউয়ের ওপরে দুলতে লাগল।

“থামো,” চিৎকার করল হাইমির। “এটা বিপজ্জনক এলাকা। এখানে মিডগার্ডের সর্প জরমুনগুন্ডার ঘুরে বেড়ায়।”

থর বৈঠা বাওয়া থামাল।

হাইমির নৌকার তলা থেকে দুটি বড় মাছ তুলে নিল। সে মাছগুলোকে ধারালো ছুরি দিয়ে ছিদ্র করল, বড়শিতে গেঁথে সমুদ্রের জলে ফেলে দিল। সে অপেক্ষা করল, কিছুক্ষণের মধ্যেই তার ছিপের রশিতে টান পড়ল আর সে রশি টেনে আনতে শুরু করল। দেখা গেল বড়শিতে বিশাল দুটি তিমি মাছ আটকা পড়েছে, এত বড় তিমি মাছ থর কখনো দেখেনি। হাইমির গর্বিত ভঙ্গিতে হাসল।

“মন্দ নয়,” বলল থর।

থর তার থলে থেকে ষাঁড়ের মাথাটি বের করল। হাইমির যখন তার পছন্দের ষাঁড়ের মাথাটি দেখল, তার মুখ কালো হয়ে গেল।

“আমি আমার টোপ জোগাড় করেছি,” বলল থর, “ষাঁড়ের চারণভূমি থেকে। যেমনটা তুমি বলেছিলে।”

হাইমিরের চেহারায়, রাগ, দুঃখ আর ভয় খেলে গেল, কিন্তু সে কিছুই বলল না।

থর হাইমিরের একটা ছিপ তুলে নিল, বড়শিতে ষাড়ের মাথাটি গেঁথে সমুদ্রে ফেলে দিল। সে টের পেল বড়শি সমুদ্রের গভীরে ডুবে যাচ্ছে।

সে অপেক্ষায় থাকল।

“মাছ ধরা,” হাইমিরকে বলল থর, “আমার মতে হলো ধৈর্যের পরীক্ষা। আজ মনে হয় বড়শিতে মাছ ধরতে অনেক সময় লাগবে। কে জানে আমার বড়শিতে কী মাছ ধরা পড়ে।”

বলতে না বলতেই যেন সমুদ্র বিস্ফোরিত হলো। মিডগার্ডের সর্প জরমুনগুন্ডার বিরাট ষাঁড়ের মাথাটায় কামড় দিয়ে আছে আর বড়শির বাঁকানো মাথাটা সর্পের মুখের ভিতর তালুতে বিধে আছে। সৰ্প পানিতে মোচড় খাচ্ছে আর নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে।

থর ছিপের রশি শক্ত করে ধরে রাখল।

“ওটা আমাদের জলের তলায় টেনে নিয়ে যাবে!” ভয়ে চিৎকার করল হাইমির। “ছিপ ছেড়ে দাও।”

থর মাথা নাড়ল। সে ছিপের রশি শক্ত করে ধরে থাকল।

বজ্রদেবতা নৌকার তলা তার দু’পা দিয়ে ফুটো করে সমুদ্রের তলায় তার পা শক্ত করে আটকাল আর জরমুনগুন্ডারকে টেনে নৌকার ওপরে তুলতে চাইল।

সর্পটি তাদের দিকে কালো রঙের বিষ নিক্ষেপ করল। থর মাথা নিচু করে বিষের ছিটা এড়াল। সে আবার রশি টানতে লাগল।

“এটা মিডগার্ডের সর্প, বেকুব,” চিৎকার করল হাইমির, “রশি ছেড়ে দাও! নইলে আমরা দুজনেই মারা পড়ব!”

থর কিছুই বলল না, শুধু রশি টেনে আনতে লাগল, তার দুই হাত রশির ওপর আর চোখ শত্রুর ওপর নিবদ্ধ ছিল। “আমি তোকে হত্যা করব,” সর্পের ফোঁসফোঁস, বাতাসের গর্জন, ঢেউয়ের শব্দ ছাপিয়ে হিসহিস করে বলল থর।

থর ফিসফিস করে বললেও মনে হলো সর্প তার কথা শুনতে পেয়েছে। এটা তার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল আর এবারে বিষের ছিটা থরের এত কাছ দিয়ে গেল যে, তার মনে হলো সে বাতাসে বিষের স্বাদ পেল। বিষ কিছুটা ছিটে তার কাঁধে এসে পড়ল, যেখানে বিষ স্পর্শ করল, সেই স্থান জ্বলে গেল।

থর শুধু একটু মুচকি হাসল আর আবার রশি টানতে লাগল।

থরের মনে হতে লাগল, হাইমির দূরে কোথাও দাঁড়িয়ে দানবাকৃতির সর্প নিয়ে গজগজ করে কিছু বলছে, চিৎকার করে নৌকার তলা দিয়ে পানি ঢুকে যাওয়ার কথা বলছে আর কীভাবে তারা দুজনে এই শীতল সমুদ্রের মাঝখানে আজ মারা যাবে, সেটা বলছে। থর কোনোকিছুই পাত্তা দিল না। সে সর্পের সাথে যুদ্ধ করছিল, খেলছিল আর সর্পটিকে রশি টেনে আর ছেড়ে পর্যুদস্ত করার চেষ্টা করছিল।

থর ছিপের রশি টেনে নৌকার ওপর উঠাতে লাগল।

মিডগার্ডের সর্পের মাথাটা থরের খুব কাছে এসে গেল। থর চোখ না নামিয়েই নিচে হাত বাড়াল, তার হাতের আঙুলগুলো তার হাতুড়ির হাতলে শক্ত করে চেপে বসল। সে জানে ঠিক কোথায় আঘাত করলে সর্পটাকে মারা যাবে। রশিটা আরেকটু টেনে আনলেই …

হাইমিরের ছুরি ঝলসে উঠল হঠাৎ, আর ছিপের রশিটা কেটে গেল। জরমুনগুন্ডার, মিডগার্ডের সর্প লাফিয়ে পিছনে সরে গেল আর ঘুরে গিয়ে পানিতে পড়ল আর অদৃশ্য হয়ে গেল।

থর ওটার দিকে তার হাতুড়ি নিক্ষেপ করল, কিন্তু দানব সর্প ততক্ষণে ঠান্ডা ধূসর জলে অদৃশ্য হয়ে গেছে। হাতুড়ি থরের কাছে ফেরত এলো, আর থর সেটা ধরে ফেলল। সে ডুবন্ত নৌকার দিকে তার মনোযোগ ফেরাল। দেখল, হাইমির ফুটো হওয়া নৌকা সারাতে সর্বাত্মক চেষ্টা করছে।

হাইমির নৌকার তলা সারাতে সক্ষম হলো আর নৌকা থেকে পানি সেচে ফেলল। থর বৈঠা বেয়ে নৌকাটা তীরে নিয়ে এলো। বিশাল দুই তিমি মাছের কারণে, যে দুটো বিশাল তিমি মাছ হাইমির বড়শি দিয়ে ধরেছিল, নৌকা বাওয়া আগের চেয়ে অনেক কঠিন ছিল।

“এইতো তীরে পৌঁছে গেছি,” হাঁপাতে হাঁপাতে বলল হাইমির, “কিন্তু আমার বাড়ি তো এখান থেকে অনেক মাইল দূরে।”

“আমরা এখানেই নৌকা ভিড়াতে পারি,” বলল থর।

“এখানে ভিড়াতে পারো, যদি তুমি দুইটা তিমি মাছ আর আমাকে সহ নৌকাটা আমার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছাতে পারো,” হাইমিরকে পরিশ্রান্ত মনে হচ্ছিল।

“ঠিক আছে, তাই হবে,” জবাব দিল থর।

থর নৌকার পাশ দিয়ে লাফিয়ে তীরে নেমে এলো। একটু পরেই হাইমিরের মনে হলো, নৌকাটা শূন্যে উঠে যাচ্ছে। থর তাদের নিজের পিঠে তুলে নিয়েছে, দুইটা বিশাল তিমি আর হাইমিরকে সহ নৌকাটা নিয়ে থর সমুদ্রতির ধরে হেঁটে চলল। হাইমিরের প্রাসাদে পৌঁছে থর পিঠ থেকে নৌকাটা নামিয়ে রাখল।

“এই যে নাও,” বলল থর। “আমি তোমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিলাম, যেমনটা তুমি অনুরোধ করেছিলে। বিনিময়ে আমি একটা জিনিস চাই।”

“কী সেটা?” জানতে চাইল হাইমির।

“তোমার হাঁড়ি। সেই বিশাল হাঁড়িটা যেটাতে তুমি পানীয় প্রস্তুত করো। সেটা আমি ধার করতে চাই।”

হাইমির বলল, “তুমি খুবই শক্তিশালী, ভালো মৎস্য শিকার করতে পারো আর খুব ভালো নৌকা বাইতে পারো। কিন্তু তুমি দুনিয়ার সবচেয়ে ভালো আর বড় হাঁড়িটা চেয়ে বসেছ। এই হাঁড়িতে যে পানীয় জাদুমন্ত্রের মতো তৈরি হয়ে যায়, সেটা দুনিয়ার সেরা। আমি আমার হাঁড়িটা তাকেই একমাত্র দেব, যে আমার পানপাত্রটা ভাঙতে পারবে।”

“এটা মোটেই কঠিন কাজ মনে হচ্ছে না,” বলল থর।

সেদিন রাতে তারা তিমি মাছ দিয়ে রাতের খাবার সারল, অনেক বহুমাথাবিশিষ্ট দানব তাদের সাথে যোগ দিল, সবাই আনন্দ আর হইহুল্লোড় করল। খাওয়া শেষে হাইমির তার পানপাত্রটি এক চুমুকে খালি করল আর হাত তুলে সবাইকে চুপ করতে বলল। তারপর সে তার পানপাত্রটি থরের হাতে দিল

এটাকে ভেঙে দেখাও,” বলল সে। “এটা ভাঙতে পারলে আমার পানীয় প্রস্তুতের হাঁড়িটি তোমাকে উপহার হিসেবে দিয়ে দেব। আর যদি না পারো, তোমার গর্দান যাবে।”

থর সম্মতিসূচক মাথা ঝোঁকাল।

দানবেরা সবাই হাসিঠাট্টা আর গান-বাজনা থামিয়ে চুপ হয়ে গেল। তারা মনোযোগ দিয়ে থরকে দেখতে লাগল।

হাইমিরের প্রাসাদদুর্গ ছিল পাথরের তৈরি। থর পানপাত্রটি নিয়ে দুই হাতে শক্ত করে ধরল আর সর্বশক্তিতে সেটি ভোজসভার একটা স্তম্ভের দিকে নিক্ষেপ করল। কর্ণবিদারী একটা শব্দ হলো, আর ধুলোয় চতুর্দিক অন্ধকার হয়ে গেল।

চতুর্দিক যখন পরিষ্কার হলো, হাইমির উঠে গিয়ে গ্রানাইট পাথরের স্তম্ভটা যেখানে ছিল সেই স্থানে গেল। পানপাত্রটি পরপর দুইটি স্তম্ভ ভেদ করে চলে গেছে আর সেগুলোকে গুঁড়োগুঁড়ো করে ফেলেছে, তৃতীয় স্তম্ভটি দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু অনেকটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ধ্বংসস্তূপের ভিতর থেকে হাইমির পানপাত্রটি তুলে আনল, সেটায় কিছু ধুলো লেগে আছে কিন্তু সেটার বিশেষ কোনো ক্ষতি হয়নি।

হাইমির পানপাত্রটি মাথার ওপর তুলে ধরল। আর দানবেরা সবাই আনন্দে চিৎকার করে উঠল আর থরকে বিদ্রূপ করতে লাগল।

হাইমির আবার তার আসনে গিয়ে বসল। “দেখেছ?” সে থরকে বলল, “আমার মনে হয়নি তুমি আমার পানপাত্র ভাঙতে পারার মতো এত শক্তিশালী।” সে তার কাপটি উঁচু করল আর তার স্ত্রী সেটায় পানীয় ঢেলে দিল। হাইমির সেটা সুড়ুৎ করে পান করল। “এটা দুনিয়ার সবচেয়ে ভালো পানীয়,” বলল সে তার স্ত্রীকে, “তোমার সন্তান আর তার বন্ধু ভিওরকে বেশি করে পান করাও। দুনিয়ার সবচেয়ে মজাদার পানীয় তাদের শেষবারের মতো পান করতে দাও। দুঃখের বিষয়, তারা হাঁড়িটা নিয়ে যেতে পারছে না, এজন্য এই পানীয়ও তারা আর কখনো পান করতে পারবে না। আরো দুঃখের বিষয়, আমাকে এখন ভিওরকে হত্যা করতে হবে, কারণ সে আমার পানপাত্রটি ভাঙতে পারেনি।”

থর আবার টীরের পাশে খাবার টেবিলে বসল আর তিমি মাছের একটা বড় টুকরো নিল আর বিরক্ত মুখে কামড় বসাল। দানবেরা আবার হইহুল্লোড় শুরু করেছে, থরকে তারা আর পাত্তা দিচ্ছে না।

টীরের মা থরের কাপে পানীয় ঢালার জন্য নিচু হলো। “শোনো,” বলল সে ফিসফিস করে, “আমার স্বামীর মাথা অনেক মোটা। সে খুব জেদি আর তার মাথা অনেক শক্ত।”

“লোকে আমার ব্যাপারেও তাই বলে,” বলল থর।

“না, তুমি বুঝতে পারনি,” দানবী এমনভাবে কথা বলছে, যেন কোনো ছোট বাচ্চাকে বুঝাচ্ছে। “তার মাথা অনেক মোটা আর শক্ত। এতই শক্ত, সবচেয়ে শক্ত কাপ ভাঙার মতো শক্ত।”

থর তার পানীয় শেষ করল। এটা আসলেই তার জীবনে পান করা সেরা পানীয় ছিল। সে উঠল আর হাইমিরের কাছে গেল। “আমি কি আরেকবার চেষ্টা করতে পারি?” জিজ্ঞেস করল সে।

হলভর্তি সকল দানব থরের কথায় হাসল, সবচেয়ে জোরে জোরে হাসল হাইমির।

“অবশ্যই পারো,” বলল সে।

থর পানপাত্রটি হাতে নিল। সে পাথরের স্তম্ভের দিকে ফিরল, দুবার পানপাত্রটি স্তম্ভের দিকে তাক করল, তারপর হঠাৎ হাইমিরের দিকে ফিরে পানপাত্রটি দিয়ে হাইমিরের মাথায় আঘাত করল।

পানপাত্রটি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল আর ভাঙা টুকরোগুলো হাইমিরের কোলে গিয়ে পড়ল।

ভোজসভাস্থলে পিনপতন নীরবতা নেমে এলো। সেই নীরবতা ভেদ করে কারো ফোঁপানোর আওয়াজ ভেসে এলো। শব্দটা কোথা থেকে আসছে দেখার জন্য থর এদিক ওদিক তাকাল, তারপর সে পিছন ফিরল আর দেখল হাইমিরের শরীর কাঁপছে। বিশাল দানব ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

“আমার সবচেয়ে দামি সম্পদটা আর আমার নেই,” বলল হাইমির। “আমি শুধু বলতাম, ‘পানীয় তৈরি হয়ে যাও’, আর হাঁড়িটায় জাদুমন্ত্রের মতো নিজে নিজেই পানীয় তৈরি হয়ে যেত। আর কখনো এমন করে বলতে পারব না।”

থর কিছুই বলল না।

হাইমির টীরের দিকে তাকাল আর তিক্তস্বরে বলল, “এটা যদি তুমি নিয়ে যেতে যাও, নিয়ে যাও। এটা অনেক বড় আর ভারী। এটা তুলতে বারোজন দানবের প্রয়োজন হয়। তোমার কি মনে হয়, তুমি এতটা শক্তিশালী?”

টীর হাঁড়িটির কাছে গেল। টীর একবার, দুইবার, তিনবার চেষ্টা করল সেটা তোলার। কিন্তু হাঁড়িটি ছিল অনেক ভারী, সে সেটি তুলতে পারল না। সে থরের দিকে তাকাল। থর কাঁধ ঝাঁকাল, হাঁড়িটির হাতল ধরে সেটাকে উল্টে নিল আর নিজে সেটার ভিতর ঢুকে গেল।

তারপর হাঁড়িটি চলতে শুরু করল, চতুর্দিকের বহুমাথা দানবেরা বিস্ময়ে হা হয়ে গেল।

হাইমিরের কান্না থেমে গেল। টীর তার দিকে তাকিয়ে বলল, “হাঁড়ির জন্য ধন্যবাদ।” তারপর সে চলন্ত হাঁড়িটি নিজের আর হাইমিরের মাঝে রেখে দ্রুত ভোজসভা থেকে বেরিয়ে যেতে লাগল।

থর আর টীর হাইমিরের দুর্গ থেকে বেরিয়ে এলো, ছাগল দুটোকে বাঁধন থেকে ছুটিয়ে নিল আর রথে জুড়ে নিল। তারা রথে চড়ে বসল। হাঁড়িটি তখনো থরের পিঠে ছিল। ছাগল দুটো সর্বশক্তিতে দৌড়াল, কিন্তু স্নারলার দ্রুত দৌড়ালেও বিশাল হাঁড়ির ওজনের কারণে গ্রাইন্ডার খোঁড়াতে লাগল। গ্রাইন্ডারের পায়ের হাঁড় একবার মজ্জার জন্য ভাঙা হয়েছিল, থর যদিও সেটা জায়গামত বসিয়ে ঠিক করেছিল, কিন্তু ছাগলটা আর কখনোই আগের মতো শক্তিশালী হয়নি। গ্রাইন্ডার দৌড়াতে গিয়ে ব্যথায় ম্যা ম্যা করে চিৎকার করতে লাগল।

“আমরা কি আরো জোরে যেতে পারি না?” জিজ্ঞেস করল টীর।

“আমরা চেষ্টা করতে পারি,” বলল থর। সে ছাগলগুলোকে চাবুক দিয়ে আঘাত করল, যাতে তারা আরো জোরে দৌড়ায়।

টীর পিছনের দিকে তাকাল। “তারা আসছে,” বলল সে, “দানবরা আসছে।”

তারা আসলেই থর আর টীরের পিছনে আসছিল, দুনিয়ার এই অংশের সকল দানবেরা দল বেঁধে আসছিল। তাদের মধ্যে ছিল বহুমাথা দানবেরা, আরো ছিল জলাভূমির দানবেরা, ক্রুদ্ধ আর ভয়ংকর। সবার পিছনে ছিল হাইমির, যে সবাইকে জড়ো করে নিয়ে আসছিল, নিজেদের পানীয় হাঁড়ি ফেরত নিতে।

“আরো দ্রুত যেতে হবে!” বলল টীর

ঠিক তখুনি গ্রাইন্ডার নামক ছাগলটি হোঁচট খেয়ে মাটিতে পড়ে গেল, আর থর আর টীর উড়ে দূরে গিয়ে পড়ল।

থর কোনোমতে তার নিজের পায়ে খাড়া হলো। তারপর পিঠ থেকে হাঁড়িটি মাটিতে ফেলে দিয়ে হাসতে শুরু করল।

“তুমি হাসছো কেন?” জিজ্ঞেস করল টীর, “দেখতে পাচ্ছ শত শত দানব আসছে?”

থর তার হাতুড়ি ‘মিওলনিরের’ হাতল শক্ত করে ধরল। “আমি মিডগার্ডের সর্পটাকে মারতে পারিনি,” বলল সে, “এবার পারিনি। কিন্তু একশ দানব মেরে সেটা পুষিয়ে নেব।”

থর উৎসাহের সাথে একের পর এক দানব মারতে লাগল, যতক্ষণ পর্যন্ত না মাটি দানবদের রক্তে লাল না হয়ে গেল। টীর তার এক হাত নিয়েই যুদ্ধ করল, এবং সাহসের সাথেই যুদ্ধ করে গেল, সেও অনেক দানব হত্যা করল।

যখন তারা সকল দানবকে হত্যা করে শেষ করে ফেলল, থর তার আঘাত পাওয়া ছাগল গ্রাইন্ডারের পাশে বসে তাকে দাঁড়াতে সাহায্য করল। ছাগলটি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে লাগল আর থর লোকিকে অভিশাপ দিতে থাকল, যার দোষে ছাগলটির এই অবস্থা। মৃত দানবদের মধ্যে হাইমির ছিল না। টীর হাঁপ ছেড়ে বাঁচল, সে তার মায়ের জন্য আরো অমঙ্গলের কারণ হতে চায়নি।

থর হাঁড়িটি এসগার্ডে দেবতাদের সভায় বয়ে নিয়ে গেল।

দেবতারা সেটা এগিরের কাছে নিয়ে গেল। “এই নাও হাঁড়ি,” বলল থর, “আমাদের সবাইকে পান করানোর জন্য এটা যথেষ্ট বড়।”

সমুদ্রদানব দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “আমি যেমন চেয়েছিলাম, তোমরা এনেছ,” বলল সে, “খুব ভালো। সকল দেবতাদের জন্য আমার প্রাসাদে হৈমন্তি ভোজসভা হবে।”

সে তার কথা রেখেছিল। তখন থেকে, প্রতিবছর হেমন্তে নতুন ফসল ওঠার পর সমুদ্রদানবের প্রাসাদে দেবতারা এক ভোজসভায় মিলিত হয়, যেখানে তারা দুনিয়ার সেরা পানীয় পান করে উৎসবে মেতে ওঠে

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *