হাইওয়ে

হাইওয়ে

আমরা তখন হাঁটতে হাঁটতে সেই দোকানে গিয়ে বাঁশের বেঞ্চির উপরে তিনজন বসলুম। বেশ ক্লান্ত। আমাদের তিনজনেরই কপালে ঘাম জমেছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। সেই কোন সকালে বেরিয়েছি। বলতে গেলে সূর্য ওঠার আগে। প্রথমে আমাদের হাঁটতে বেশ ভালোই লাগছিল। চারিদিকে গাছগাছালি। মাঝে মাঝে পাখি ডাকছে। শহরের সীমানার শেষে সেই গ্রাম পরিবেশ। একটা দুটো পুকুর। একটা দুটো পাতিহাঁস। একদিক দিয়ে চওড়া সড়ক বেরিয়ে গেছে। মাঝে মাঝে দূর পথের যাত্রীবাহী বাস হু-হু করে ছুটে চলে যাচ্ছে। মালবাহী লরি। কোনো কোনো ড্রাইভার স্ফূর্তিতে গান গাইতে গাইতে চলেছে।

প্রথম প্রথম আমরা পরস্পর অল্প অল্প কথা বলছিলুম। তারপর যত রোদ চড়েছে, পায়ের ডিম চলার ক্লান্তিতে শক্ত হয়েছে, কথাও ফুরিয়েছে। কী দরকার ছিল এত হাঁটার। সোজা বাসে করে এলেই চলত।

পথের পাশের দোকান তার একটা আলাদা আকর্ষণ। বাঁশের বেঞ্চির তলায় দূর্বাঘাসের জাজিম বিছানো। দোকানির উনুনে চায়ের জল ফুটছে কালো কেটলিতে। দূরে একটা বাচ্চা মেয়ে গাছের ভাঙা ডাল কুড়োচ্ছে। খড় বোঝাই গরুর গাড়ি মন্থর গতিতে চলেছে। চাকায় তেল শুকিয়েছে, ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ উঠছে। দোকানের দিকে পেছন ফিরে রাস্তার দিকে মুখ করে আমরা তিনজন বসেছি। দূরে সবুজ মাঠ আকাশের কোলে গিয়ে মিশেছে। মাঝে মাঝে রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে নিচ্ছি। ঝিরঝিরে হাওয়ায় শরীর জুড়িয়ে যাচ্ছে।

দোকানির দিকে না ফিরেই সুব্রত বললে—

‘তিনটে চা দাও, বিস্কুট-টিস্কুট কিছু আছে।’

‘এজ্ঞে সে যা আছে তাকি আপনাদের চলবে?’

‘আরে চালালেই চলবে, দুখানা করে দিয়ে দাও।’

‘বুঝলি নৃপেন’—দূর মাঠের দিকে চোখ রেখে সুব্রত বললে—‘এসব দেশি বিস্কুটের একটা আলাদা টেস্ট।’

‘সে তো বুঝলুম’—পরেশ একটু খুঁতখুঁতে, খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে তো কথাই নেই। সাজ-পোশাক সব কিছুতেই ভীষণ পিটপিটে; এই রাস্তার ধারের চা, ধুলো ভরতি বিস্কুট সে খাবে হয়তো পাল্লায় পড়ে; কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে তার ভিতর একটা দ্বন্দ্ব চলবে। পরেশ তার আপত্তিটা একটু ঘুরিয়ে প্রকাশ করলে—‘আমি একবার একটা ছোটো বেকারি দেখেছিলুম বুঝলি—সে একেবারে নরক। হেলথ অ্যাণ্ড হাইজিনের কোনো বালাই নেই। শালা পা দিয়ে ময়দা ঠাসছে। বুঝলি ময়দা আর ভেলিগুড়ের বস্তা পাশাপাশি। বর্ষায় রাস্তার নোংরা জল ঢুকে একাকার।’

‘আরে রাখ তোর একাকার। খিদে পেলে হাতের কাছে যা পাবি পেটে পুরবি। আজ আর তোর নিস্তার নেই। পড়েছ মোগলের হাতে খানা খেতে হবে সাথে।’

দোকানির মেয়ে চা আর সাদা সাদা বিস্কুট রেখে গেল আমাদের পাশে। ছোটো ছোটো গ্লাসে কালচে কালচে চা।

‘চায়েরই কত রকম রূপ দেখো। গ্র্যান্ডের প্রিনসেসের চা, ময়দানে টি বোর্ডের গাড়ির চা, তোমার বাড়ির মাসিমার সেই গঙ্গাজলের চা, স্টেশনের চা…

‘তুই একটু থামবি পরেশ। তোর ওই চা-তত্ত্ব, ওটা টি বোর্ডে গিয়ে শোনাস, চায়ের শতনাম।’

সুব্রত একটা চুমুক দিয়ে বললে—‘অসাধারণ।’ শালা কী সুপারফাইন টেস্ট। বিস্কুটটা যেন নিরেট এক টুকরো শুকতলা।’

‘এখানে কীসের চাষ বেশি হয়?’

‘এজ্ঞে আলু। আলুই তো এ অঞ্চলের সেরা ফসল।’

‘পয়সা থাকলে একটা কোল্ড স্টোরেজ করতুম। ভীষণ লাভ বুঝলি। মনে আছে সেই আমাদের সঙ্গে কলেজে একটা ছেলে পড়ত। বাবার কোল্ড স্টোরেজ ছিল। ছেলে দু-হাতে পয়সা ওড়াত। কম কাঁঠাল ভেঙেছি আমরা তার মাথায়, মনে আছে তোর?’

‘তুই কোল্ড স্টোর করলে আমরা সব কিছু ছেড়ে আলুর চাষে নেমে পড়ব। তোর কোল্ড স্টোরে আমাদের আলু। অসাধারণ ব্যাপার কী বলিস?’

‘তুই শহরে বাড়ি করবি হাল ফ্যাশানের, সুইমিং পুলে তোর ওই ভুঁড়িদাস চেহারা কস্টিউম পরে ভাসবে। গ্যারেজে ঝকঝকে গাড়ি, কলকাতায় মেয়েমানুষ, মদের বোতল। শালা আইডিয়াল শিল্পপতি। আর আমরা কাদামাখা চাষা আলুর চাষ করে মরব।’

‘আর আমি ক্রেতা, তোরা দু-জনে বাজারে আলুর দাম বাড়াবি কমাবি, তোদের কেরামতিতে অসাধারণ আনন্দে থাকব।’

‘কোথায় শুরু করেছিলুম কোথায় চলে এলি। একে বলে ডে ড্রিমিং—একটা মনস্তাত্বিক বিকার। মেয়েটা দেখ। যেন টাটকা পালম শাক। দেখেছিস সুব্রত কী ন্যাচারাল বিউটি।’

‘তুই দেখ। আমি দেখব না। আমার স্ত্রী শুনলে রাগ করবে।’

‘খুব সাধু হয়েছিস। বলব তোমার কথা। ভাঙব হাটে হাঁড়ি। তুমি কি করেছিলে একদিন। কোথায় গিয়েছিলে।’

‘পুরোনো কথা। আমরা সবাই গিয়েছিলুম। তোকে প্রাইভেটলি বলছি—শিখা আর সেই বাজারের মেয়েতে কোনো তফাত খুঁজে পাই না ইদানীং! সেই একই ছলাকলা। সেই অনাবৃত ফালি কোমর, কাপড় কীভাবে রেখেছে সেই জানে। ব্লাউজের হাতা দুটো কেটে বাদ দিয়েছে। ব্রার ফিতে কাঁধের পাশে উঁকি দিচ্ছে। সেই খোঁপার বাহার। তফাত কোথায়! কিছু আদায় করার দরকার হলেই ‘সেক্স’ ছুড়ে মারবে। সেই একধরন, সেই এক মোডাস অপারেন্ডি।’

‘চা-টা বেশ গরম ছিল। চা গরম হলেই হল। ফ্লেভার-টেভার আর কোথায় পাবি? চল্লিশ, পঞ্চাশ টাকা পাউণ্ডের চা হলে তবে হয়তো কিছু গন্ধ পাওয়া যাবে।’

মাটির গন্ধের কাছে আর কিছু লাগে না। কেমন ভিজে ভিজে সোঁদা সোঁদা গন্ধ! অসাধারণ।’

‘রেবেকার কথা মনে পড়ে। কী একটা বিলিতি সেন্ট মাখত! খুব ফিকে অথচ কেমন একটা গুমোট গন্ধ। গন্ধ আর রেবেকা, রেবেকা আর গন্ধ যেন অনেকটা, ওই কি যেন বললি—মাটি আর গন্ধের মতো।’

‘রেবেকার কথা এখনও ভুলতে পারছিস না।’

‘চাষা কী মাটির কথা ভুলতে পারে—না ভুলে থাকতেও পারে।’

‘কোথায় চাষা, কোথায় মাটি আর কোথায় রেবেকা! পাগল হয়ে গেছিস।’

‘মেয়েরা মাটির মতো উর্বর আর শ্যামল। মনে পড়ে সেই নিরঞ্জনের কথা! ভোরবেলা আমরা তাকে খুঁজে পেলুম। হাত পা ছড়িয়ে কেমন নিশ্চিন্তে শিশির ভেজা মাটির উপর ঘাড় মুখ গুঁজড়ে পড়েছিল। রেবেকার বুকে মুখ গুঁজে আমার মাটির কথা, মাটির গন্ধের কথা মনে হত। মনে হত গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে রেবেকার শরীরে মিশে যাই।’

‘আর তিনটে চা দাও হে। বেশ যেন গরম থাকে।’

‘কী অসাধারণ শরীর দেখ মেয়েটার। পোড়াপোড়া রং। রোদে ঝলসানো। রিয়েল সানট্যান। কী মনে হচ্ছে জানিস—যেন মালটি ভিটামিন ট্যাবলেট।’

‘শিখার কথা মনে আছে। ঠোঁটে সাদা সাদা দগদগে ঘায়ের মতো লিপস্টিক, পাছা ল্যাপ্টানো শাড়ি, ঘাড়ের উপর টেনে তোলা খোঁপা, ভিজে টয়লেটের মতো একটা ঘিনঘিনে ভাব হত ওকে দেখলে।’

‘ক-টা বাজল?’

‘কী হবে সময় দেখে? এখনও অনেক সময় আছে।’

‘কী নাম বললে তোমার?’

‘এজ্ঞে সুকুমার।’

‘আর একটু চিনি আনো তো খুকি।’

‘হাসছে দেখো ফিকফিক করে। মেয়েদের খুকি বললেই হাসে। আসলে ও খুকি নয় কিশোরী। দেহের পাপড়ি খুলছে, মন উড়ছে তার চারপাশে ভ্রমরের মতো।’

‘কী নাম বললে তোমার? সুকুমার? কোথায় দেশ ছিল?’

‘ওপার বাংলায়।’

‘ঠিক ধরেছি শরণার্থী, না হয় উদ্বাস্তু। যা হয় একটা কিছু হবে। আমাদের মতোই এ অঞ্চলে প্রক্ষিপ্ত। না ঘরকা না ঘাটকা। তা বেশ করেছ, বসে না থেকে লড়ে যাও।’

‘এজ্ঞে লড়াই খুব হয়েছে। খান সেনাদের সঙ্গে খুব লড়েছি আমরা। আমার বড়োছেলে এজ্ঞে মুক্তিফৌজ।’

‘কী শয়তান দেখ। প্রথম ধাক্কাতেই হয়তো হুড়হুড় করে পালিয়ে এসেছে। এখন ওই মুক্তি সংগ্রামীদের সঙ্গে নিজেকে আইডেন্টিফাই করে হিরো হতে চাইছে। গাছেরও খাবে তলারও কুড়োবে।’

‘তুই ভয়ানক সিনিক। লোকটা ‘সাফার’ করেছে। আরে লড়াই কী শুধু তাদের যারা কেবল রাইফেল হাতে লড়ে গেল! লড়াই একটা সামগ্রিক ব্যাপার, সকলকেই তা কোনো-না-কোনোভাবে স্পর্শ করে যায়।’

‘তা অবশ্য ঠিক। চা-টা ভীষণ কম দিয়েছে। দু-চুমুকেই শেষ। কীরকম প্রফিটিয়ারিং টেনডেন্সি দেখেছিস। শেখাতে হয় না, শিখে যায়। এই ব্যাপারে কী গ্রামের মানুষ, কী শহরের মানুষ—ফাদার দে আর অন দি সেম বোট—হা: হা: হা:।’

‘অত জোরে হাসলি কি রে? ফুসফুসে যদি কোনো ডিফেক্ট থাকে শালা পাংচার হয়ে পটল তুলবি। তারপর ক্লেম করবি হামভি শহীদ।’

‘দেখবি সেক্সের ব্যাপারেও সবাই সমান। গ্রেট ইকোয়ালাইসার। দেখলি না ওদেশে কী হল? মরতে মরতে মারতে মারতে মেয়েগুলোকে নিয়ে কী কান্ড করলে? দেখবি শক্তি আর ব্যভিচার যেন জড়িয়ে-মড়িয়ে আছে।’

‘তা বলতে পারিস। শিখাকে ওই একটা সময়েই যেন ভালো লাগে, অন্যসময়ে যেন মনে হয়, যেন মনে হয় একটা ডার্টি টাওয়েল।’

‘কতক্ষণ বসে আছি আমরা?’

‘ক-পয়সা হল তোমার সুকুমারবাবু?’

‘এখন আমাদের কিছু সুবিধে হবে—কী বলিস? ভালো ভালো মাছ আসবে—যশোরের কই, সিরাজগঞ্জের রুই। বাজারে মাছের দাম হু-হু করে কমবে।’

‘শুধু মাছ কেন রে, চাল, নারকেল, তরিতরকারি। অসাধারণ ব্যাপার হবে কী বলিস?’

‘রেপ অব বাংলাদেশ তোরাই সম্পূর্ণ করবি। তোমরা সব আস্তিন গুটিয়ে পঙ্গপালের মতো গিয়ে পড়বে। মনের আনন্দে সব বাগিয়ে টাগিয়ে, খেয়ে-দেয়ে, গায়ে-গতরে হয়ে সাফারিং হিউম্যানিটির জন্যে গলা ছেড়ে কাঁদবে। সুবিধেবাদী শয়তানের দল।’

‘মূর্খ দুটো দেশের মধ্যে একটা ট্রেড ডেভালাপ করবে না। ইডিয়ট। মাটির ফসল, জলের মাছ, মানুষের শ্রমের উৎপাদন কী জমিতে পড়ে পচবে?’

‘আমরাও কী কম সাফার করেছি? ওই শরণার্থীদের চাপ এই ট্যাক্সেশান, এই যুদ্ধ, সেই পার্টিশান, এই বেকারি, ওই রাজনৈতিক খুনোখুনি, কীসব অসাধারণ সময়ের মধ্য দিয়ে এই দেহতরী দুলে দুলে চলেছে।’

‘অনেকদিন দেহতত্ত্বের কোনো গান শোনা হয়নি। এদিকে খুব ভোরে এলে হয়তো কোনো বাউল-টাউলের গান শোনা যেত?’

‘ওরা এখন সব অ্যামেরিকায় চলে গেছে। কলকাতায় আসর মারছে—কোথায় পাবি তারে তোর মনের মানুষ যেরে।’

‘দেহতত্ত্ব বড়ো শক্ত জিনিস রে! মনে আছে নিখিল কতবার অ্যানাটমিতে ফেল করেছিল? কীসব শক্ত নাম দেহের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের—সোলার প্লেকসাস, মেডুলা অবলঙ্গেটা, দাঁত ভেঙে যায়।’

‘দূর দেহতত্ত্ব ব্যাপারটা অন্যরকম। বুঝেছিস—সেটা খুব কোমল, অনেকটা নরম একটা কাবুলি বেড়ালের গায়ে হাত বোলাবার মতো অনুভূতি।’

‘শিখার কাছে আমি অনেক দেহতত্ত্ব শিখেছি। সে একটা দেহতত্ত্বের স্কুল খুলছে ইদানীং—বেশ ভাল রোজগার—জমজমাট ব্যবসা।’

‘ঘুরে ফিরে সেই এক কথা। শিখা, শিখা, শিখা।’

‘ও শালা পাগল হয়ে যাবে, ডেফিনিট, কোনো সন্দেহ নেই।’

‘সুকুমারের দোকানের একটা বৈশিষ্ট্য দেখলি—বেশ নির্ঝঞ্ঝাট—কোনো খদ্দের-পত্তর নেই। ডেলি ক-পয়সা হয় তোমার?’

‘এজ্ঞে আমাদের বিক্রি-টিক্রি সব রাতের বেলা। এদিকের এই স্টাইলের দোকানের এই রীতি।’

‘বাবা বলে কি রে? এ যেন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। সূর্য ডুবলেই ভিড় বাড়ে। ভেলপুরী উড়ছে, ফুচকা ফুটো হচ্ছে, আইসক্রীম জিভে গলছে, এলাহি ব্যাপার।’

‘এদিকে রাতেই খদ্দের বাড়ে, কেন জানিস? যত দূরপাল্লার গাড়ির পথ বিশ্রাম, পান্থশালা।’

‘সেই জিনিস পাওয়া যায় না কি রে—সেই সর্বসুখপ্রদ ক্লান্তি হয়, অতি মনোহর।’

‘যায় যায়, ওইটাই তো আসল রোজগার।’

‘সুকুমারবাবু একটু আসল মাল ছাড়বে?’

‘কী যে বলেন বাবু এজ্ঞে।’

‘সুকুমার কেন বাবা টাল-বাহানা করছ। খদ্দের লক্ষ্মী, হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলতে আছে ম্যান?’

‘দেখবি আমাদের কাছে কিছুতেই ভাঙবে না। সাধু সেজে যাবে। যেন কিছুই জানে না?’

‘আসলে ও সব জানে। ব্যাটা মেয়েছেলেও সাপ্লাই করে, হয় পয়সা না হয় জোর এই দুটোর কাছে আত্মসমর্পণ করতে শিখেছে।’

‘আমাদের কোনোটাই নেই কি বল? আমরা চুকচুক করে ছোটো ছেলের মতো চা খাব—কি বল? আমরা ওর এলে-বেলে খদ্দের।’

‘সুকুমার ভালো কথায় বলছি ভন্ডামি না করে তিন পাত্তর মাল ছাড়।’

‘কি যে বলেন বাবু। বেশ তো বসে বসে চা খাচ্ছিলেন আর গল্প করছিলেন—কি যে মাথায় ভূত চাপল।’

‘ও বোধ হয় আমাদের পুলিসের লোক ভেবেছে।’

‘আরে দূর এসব লাইনে পুলিশকে ওরা ভয় পায় না। আসলে জেদ। প্রচন্ড জেদ। আমরাও ছাড়ব না ও-ও দেবে না। কম শয়তান। ও একটা সার্কেলে ঘোরে। এসব হচ্ছে চক্রের ব্যাপার।’

‘ভৈরব চক্র তাই না।’

‘করাপ্ট শালা। পরগাছা প্যারাসাইট। দেখছিস না পথের ধারে গ্রাম ঘেঁষে বসে আছে। গ্রামের সুবিধে নিচ্ছে আর শহরের পাপগুলো এখানে আমদানি করছে। থ্রু আউট দ্য হাইওয়ে তুই এদের দেখবি।’

‘ঠিক বলেছিস। মাঠের মানুষ ঘনঘন চা খায় না। তারা আঁজলা ভরে বিশুদ্ধ জল খায় তেষ্টার সময়। এসব হল মডার্ন ভাইসেস। বেটা শয়তানের দোসর।’

‘ব্লাডারে চোলাই মাল আসে আর ওই নিরীহ সরল লোকগুলো এর ফাঁদে পা দিচ্ছে।’

‘আবার মুখে কত বড়ো বড়ো বুলি। লড়াই, মুক্তি সংগ্রাম।’

‘আসলে লোভের বিরুদ্ধেই আমাদের সংগ্রাম। অসাধারণ সংগ্রাম।’

‘সুকুমার সুকুমারই তো বললে, নাকি? সুকুমার বেশি সাধুগিরি ফলিও না। ঝট করে তিন পাত্তর ঢেলে ফেলো বাবা, কেমন।’

‘এজ্ঞে সেই যে আপনাদের এক গোঁ। তিনটে চা দেবো বাবু, বেশ মোটা করে দুধ দিয়ে।’

‘শালা ন্যাকা সেজে পার পাবে। নিকালো আভি নিকালো মাল।’

‘এই সুব্রত, সুব্রত ছেড়ে দে, ছেড়ে দে, মরে যাবে বেটা।’

‘ছেড়ে দেব, আগে বেরকরুক মাল। শালা আগেই কবুল করুক যে ও নরকের পথে ব্যবসা করছে।’

‘সুব্রত দাঁড়া, দাঁড়া অন্য রাস্তায় ওর স্বীকারোক্তি আদায় করতে হবে।’

‘কী যে করিস তোরা সামান্য ব্যাপারে। ওই দেখ মেয়েটার মুখ কীরকম কাঁদো-কাঁদো করুণ হয়ে গেছে।’

‘ও-ও তো ওই শয়তানের দোসর। দেখছিস না ওর চোখে-মুখে পাপের ছায়া, মোটেই ইনোসেন্ট নয়, রাতের বেলায় ওর চেহারাই অন্যরকম দাঁড়ায়।’

‘এইবার দেখ কোনোরকম বলপ্রয়োগ নয়, কীরকম সুড়সুড় করে সব বলে দেবে। এটি বাছাধন খেলনার পিস্তল নয় আসল কোল্ট।’

‘একটা লক্ষ্যভেদ করে শালার পিলে চমকে দে না?’

‘বেশ ওই ছবিটা টার্গেট, কী বলিস। মা কালীর ছবি ঝুলিয়ে যত অনাচার তাই না? ওয়ান টু থ্রী…

‘বিউটিফুল! কাঁচগুলো ভেঙে দুধের ডেকচিতে পড়ল।’

‘বাবা সুকুমার এবার কবুল করো?’

‘এজ্ঞে কিছু মাল তো রাখতেই হয়। নানারকম খদ্দের তো আসেই। এই যেমন আপনারা।’

‘চোপ শালা টিটকিরি। খুলি উড়িয়ে দেব।’

‘কোথায় আছে?’

‘এজ্ঞে ওই জালার ভেতর।’

‘সুব্রত দেখে আয় তো।’

‘ওরি ফাদার! অগুনতি বোতল—সব মাকালী মার্কা।’

‘সুকুমার আর কিছু? রাতে আর কী কী হয়। তোমার মেয়ে?’

‘এজ্ঞে ওকে তো দোকানেই থাকতে হয়। কে আর আমাকে সাহায্য করবে একলা লোক। কত রকমের খদ্দের।’

‘কী শয়তান! ওই ফুলের মতো মেয়েকে দিয়ে ব্যবসা!’

‘দে না বেটার ভবলীলা সাঙ্গ করে। তারপর চল মেয়েটাকে নিয়ে যাই। ওকে বাঁচতে দে। ওকে ওর মর্যাদা ফিরিয়ে দিতে হবে।’

‘কার জন্যে ভাবছিস, ওই দেখ শয়তানের বাচ্চা শয়তানই হয়। ওই দেখ লোহার রড তুলছে। সাবধান সুব্রত। ফায়ার!’

‘কী হল খুকি? এদিকে এসো। এসো এদিকে। ফেলে দাও রড!’ এই তো লক্ষ্মী মেয়ে!’

‘এজ্ঞে বাবু দোকানের পিছনে একটা ঘর আছে। একে একে ওকে নিয়ে যেতে পারেন বা সকলে এক সঙ্গেও যেতে পারেন।’

‘এই তো বাবা সুকুমার কবুল করেছ। একেই বলে জীবনসংগ্রাম—কী বল! মুক্তি সংগ্রাম নাকি! বিবেকের হাত থেকে মুক্তি—সাবাস।’

‘কী নাম তোমার?’

‘শেফালি—। অসাধারণ। যাও ওখানে চুপটি করে বোসো। তোমাকে আমরা এই লজ্জার জীবন থেকে মুক্তি দেব।’

‘তা সুকুমার রোজগারপাতি কেমন হয়?’

‘এজ্ঞে খুবই সামান্য, গরিব লোক বাবু।’

‘আবার মিথ্যে কথা? তুমি তো বাবা মাটির মানুষ নও। তুমি তো বাবা নিজের শ্রমে রোজগার কর না। তুমিও তো সোনার হরিণ খুঁজছ বাছাধন।’

‘সুব্রত টাইম ইজ আপ? সময় দেখো। ঠিক চারটে বেজে কুড়ি মিনিট তাই না।’

‘দেন গেট রেডি। মনে আছে চকোলেট রঙের গাড়ি WBG…,

‘শেফালি তোমার একটা ছোট্ট কাজ আছে। তারপর তোমার আমার, আমাদের সকলের মুক্তি। বিরাট ঐশ্বর্য! শালা গরিবি হাটাও।’

‘কথায় কথায় উচ্ছ্বাসে। আসল কথাটা বল না।’

‘একটু পরে ওই হাইওয়ে দিয়ে একটা চকোলেট রঙের অ্যামবাসাডার আসবে। কেমন ফাইন। গাড়িটা হু-হু করে আসবে আর তুমি প্রাণের মায়া ছেড়ে গাড়িটার সামনে লাফিয়ে পড়ে হাত তুলে থামাবে। তারপর, তারপর..সুকুমার চিন্তা করতে পারো রাশিরাশি টাকা, কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা, লক্ষ্মী মেয়ে শেফালি। ইস! তোমার চুলে কী আঠা? শ্যাম্পু করতে পার না!’

‘শোনো সুকুমার, তোমার মেয়ে যদি কাজটা ঠিকমতো করতে পারে ব্যাস! কোথায় তোমার উঞ্ছবৃত্তি! তুমি, আমি, আমরা টাকার গদিতে শুয়ে থাকব।’

‘কিন্তু খবরদার প্ল্যান মাফিক কাজ না হলে—দুম।’

‘সুব্রত চারটে আঠাশ। ওই দেখ দূরে।’

‘সুকুমার রাজি?’

‘এজ্ঞে আপনারাই আমার মা বাপ।’

‘অসাধারণ! শেফালি রেডি।’

‘ওই আসছে আসছে। সুব্রত রেডি! রেডি! সবাই রেডি!’

‘আসছে টপ স্পিডে। ভয় নেই। শেফালি, থামতে ওকে হবেই।’

‘এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়…’

‘ইস। কী অসাধারণ। শালা চাপা দিয়ে বেরিয়ে গেল। ইস কী তাজা শরীর ছিল মেয়েটার। আমার কাঁদতে ইচ্ছে করছে। আমি যে ওকে ভালোবেসে ফেলেছিলুম—সুকুমার।’

‘ইডিয়েট—কী রক্ত, কী রক্ত!’

‘সুকুমার তোমার লাকটাই খারাপ। তোমার অভাব ঘোচাতে পারলুম না!’

‘তোর অস্ত্র ফেলে দে। তোর একটা এম নেই। তুই তিন তিনটে গুলি ছুড়লি অথচ টায়ারে একটাও লাগাতে পারলি না।’

‘অসাধারণ। সুকুমারের চায়ের দামটা দিয়ে দে। ওর কথা বন্ধ হয়ে গেছে। আহা নিজের মেয়ে, তায় রোজগেরে মেয়ে। কিছু বেশি দিয়ে দিস।’

‘কার মেয়ে ছিল কে জানে!’

‘সুব্রত ভেবে দেখেছিস। কী সাংঘাতিক! ওরা কী ফিরে আসতে পারে? এই স্পট ওদের চিনতে অসুবিধে হবে না। শেফালির ডেড বডি হবে ওদের নিশানা।’

‘তাহলে?’

‘কী অসাধারণ ব্যাপার! তাহলে চল শেফালিকে আমরা লোপাট করে দি।’

‘কিন্তু ওই চাপ চাপ রক্ত। ষোলো বছরের মেয়ের ওই তাজা রক্ত।’

‘অসাধারণ। আমার মাথাটা দেখেছিস? বিপদেও কী ক্লিয়ার! সুকুমার বালতি বালতি জল দিয়ে পরিষ্কার করবে।’

‘ইউ সুকুমার, একটা সাদা কাপড় আছে। নেই। তবে তোমারটাই খোলো। কুইক। ক-টা বাজল। চারটে পঞ্চান্ন। সামনের চেক পোস্ট থেকে ওরা ফিরবে, আর মাত্র কয়েক মিনিট সময়।’

‘খোল খোল খুলে নে ওর কাপড়। বিপদের সময় আবার লজ্জা।’

‘কী আশ্চর্য! বিপদের সময় আর সেই সমস্ত চরম আনন্দের সময় আমরা কেবল নি:সঙ্কোচে উলঙ্গ হতে পারি।’

‘নে জড়িয়ে নে। গায়ে রক্ত লাগাসনি। তুলে নে। সুকুমার জল ঢালো। উঁহু দেখছ হাতে কী? নিষ্কৃতি নেই। ঢালো এক দুই…ফাইন? দেখছিস পিচে রক্ত লাগে না।’

‘মেয়েটা এখন হাল্কা হেয়ে গেছে। কী ঠাণ্ডা। যদি বেঁচে থাকত কী অসাধারণ হত।’

‘সামনে এগিয়ে চল। আর হাইওয়ে নয়। মাঠের রাস্তা ধর।’

‘ওকে শুইয়ে দে ওই সাঁকোর তলায়। অন্ধকার নামছে ধীরে ধীরে। বেচারা। মুক্তির সংগ্রামে মুক্তি পেয়ে গেল!’

‘কী টাটকা শরীর ছিল এই একটু আগে। এখন মাটির কত কাছাকাছি। আমি ওকে একটু চুমু খেতে পারি!’

হাইওয়ের উপর দিয়ে আলোর সারি ছুটে চলেছে উত্তর-দক্ষিণে। যত রাত বাড়ছে, তত আলো বাড়ছে, যত রাত বাড়ছে তত আলো বাড়ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *