হাঁস
ঠাকুর! আপনার কাছে জরুরী কিছু প্রশ্ন পেশ করছি। না করে পারছি না; কারণ ইদানীং নিজেকে একটা ঘোড়া মনে হচ্ছে। সভ্য মানুষের আস্তাবলে আমার বসবাস। ফ্যান, ফোন, ফ্রিজ—সবই সেখানে আছে। একালের মানুষ ইংরেজীতে যাকে বলে ‘মডার্ন অ্যামেনিটিস’। ঘোড়া মনে হচ্ছে কেন? আমার জীবন অনবরতই আমাকে ছোটাচ্ছে ঐসব ভড়ং বজায় রাখার জন্য, জীবনের জঞ্জাল আরো বাড়াবার জন্য। টাকা, আরো টাকা—এই হয়েছে আমার ধ্যান- জ্ঞান। যে কাম-কাঞ্চন ত্যাগ করার উপদেশ আপনি আমাকে দিয়েছিলেন, সেই দুটি পরিত্যজ্য বস্তুই মানুষের ধ্যান-জ্ঞান হয়েছে। নতুন একটা আদর্শ তৈরি হয়েছে—স্বার্থপরতা, নিষ্ঠুরতা, হৃদয়হীনতা মেশানো এক নতুন জীবনদর্শন। তুমি এবং তুমিই সব, বাকি সব মায়া। “ভেবে দেখ মন কেউ কারো নয়”–এই সত্য মানুষকে ঈশ্বরনির্ভর করতে পারছে না, দানব করে তুলছে। উদ্দেশ্য একটাই—নিজের প্রতিষ্ঠা। অনেক রকমের মুখোশ পাশাপাশি। যদি বৈষয়িক লাভের আশা থাকে তাহলে আমি ধর্মের মুখোশ পরব, যদি প্রতিষ্ঠার আশা থাকে সমাজসেবীর মুখোশ পরব, জীবনের সাফল্য মাপব অর্থের পরিমাণে। আমাদের আধুনিক ব্যবস্থা শিশুর শৈশবকে হত্যা করেছে, যুবকের যৌবন ও স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছে, গৃহীর নিরাপত্তা হরণ করেছে। বৃদ্ধের আশ্রয় চুরমার করেছে। মানবের পৃথিবীতে ঈশ্বরের স্থান নেই। শয়তানের কারখানা!
দেবালয়ের দেবতা পাথর মাত্র। ধার্মিকের ধর্ম রাজনীতির হাতিয়ার। মহামানবের বাণী বোধহীনের আবৃত্তি। আত্মার ঐশ্বর্য উপহাসের বস্তু। বুদ্ধিজীবী আধুনিকের তর্কে ঈশ্বর দুর্বলের দুর্বলতা। মানুষের হাতে পৃথিবী এখন নিষ্পেষণের যন্ত্র। প্রকৃতি যত না মারে, মানুষ তার চেয়ে ঢের বেশি মানুষ মারে। সমস্ত জীবনই অশান্ত। এই ভয়ঙ্কর বিক্ষিপ্ত অবস্থায় কি করব আমি! আমাকে পথ বলে দিন। আমার বিশ্বাস টাল খেয়েছে।
তার মানে তুমি মুলো খেয়েছ। বঙ্কিমকে আমি এই কথাই বলেছিলাম। জিজ্ঞেস করেছিলাম, আচ্ছা, আপনি তো খুব পণ্ডিত, আর কত বই লিখেছ; আপনি কি বল, মানুষের কর্তব্য কি? কি সঙ্গে যাবে? পরকাল তো আছে!
বঙ্কিম কি বললেন জান? ‘পরকাল! সে আবার কি?’
আমি বললুম, হ্যাঁ, জ্ঞানের পর আর অন্যলোকে যেতে হয় না, পুনর্জন্ম হয় না।
কিন্তু যতক্ষণ না জ্ঞান হয়, ঈশ্বরলাভ হয়, ততক্ষণ সংসারে ফিরে ফিরে আসতে হয়, কোনমতে নিস্তার নাই।
এই ‘নিস্তার’ শব্দটি লক্ষ্য কর। সংসার জায়গাটা কখনোই সুখের হতে পারে না। কোনকালে সুখের ছিল না, সুখের হবেও না, হতে পারে না। কাম-কাঞ্চনই সংসার। এরই নাম মায়া। ঈশ্বরকে দেখতে, চিন্তা করতে দেয় না। পশুভাব না গেলে ঈশ্বরের আনন্দ আস্বাদন করতে পারে না। বঙ্কিমের মতো পণ্ডিত মানুষকে আমার প্রশ্ন ছিল, মানুষের কর্তব্য কি? বঙ্কিম বলেছিলেন, আজ্ঞে, তা যদি বলেন, তাহলে আহার, নিদ্রা, মৈথুন। আমি চমকে উঠে খুব তিরস্কার করেছিলাম, এঃ! তুমি তো বড় ছ্যাঁচড়া! তুমি যা রাতদিন কর, তাই তোমার মুখ দিয়ে বেরুচ্ছে। লোকে যা খায়, তার ঢেকুর ওঠে। মুলো খেলে মুলোর ঢেকুর ওঠে। ডাব খেলে ডাবের ঢেকুর ওঠে। কাম-কাঞ্চনের ভিতর রাতদিন রয়েছ, আর ঐ-কথাই মুখ দিয়ে বেরুচ্ছে! কেবল বিষয়চিন্তা করলে পাটোয়ারি স্বভাব হয়, মানুষ কপট হয়। ঈশ্বরচিন্তা করলে সরল হয়।
তুমি কোথায় আছ, সেইটা আগে বোঝার চেষ্টা কর। মনকে খাওয়াচ্ছ কি সেইদিকে নজর রাখ। কাদের সঙ্গ করছ, সেইদিকে প্রখর নজর রাখ। একটা গান শোন—
“আয় মন, বেড়াতে যাবি।
কালী-কল্পতরুমূলে রে (মন) চারিফল কুড়ায়ে পাবি।
প্রবৃত্তি নিবৃত্তি জায়া, (তার) নিবৃত্তিরে সঙ্গে লবি।
ওরে বিবেক নামে তার বেটা, তত্ত্বকথা তায় শুধাবি।।”
বৈরাগ্য আর বিবেক, এই দুজনের হাত ধর। জগৎ-সংসার, সমাজ, ইতিহাস এসব নিয়ে নিজেকে তোলপাড় করো না। হ্যাঁ, ঠাকুর, একথা তো ঠিকই-
“সংসার দুঃখজলধৌ পতিতস্য কাম-
ক্রোধাদিনক্রমকরৈঃ কবলীকৃতস্য।
দুর্বাসনা নিগড়িতস্য নিরাশ্রয়স্য
চৈতন্যচন্দ্ৰ মম দেহি পদাবলম্বম্।।” (শ্রীচৈতন্যচন্দ্ৰামৃতম্—প্রবোধানন্দ সরস্বতী)
সংসার কেমন? দুঃখের সাগর। সেই সাগরে শুধু পড়ে নেই, দুর্বাসনারূপ জালে আবদ্ধ হয়েছি। সেখানে আবার কুমির, হাঙর। আমাকে গ্রাস করতে আসছে। উপায় কি? কেমন করে নিজেকে বাঁচাব। প্রার্থনা। শরণাগতি। হে চৈতন্যচন্দ্র! আমি নিরাশ্রয়, আমাকে চরণাশ্রয় দাও। ঠাকুর, আপনার কাছেও আমার ঐ প্রার্থনা—হে ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ, এই নিরাশ্রয়, অনিকেতকে আপনি চরণাশ্রয় প্রদান করুন। কারণ, এই একই কথা আপনি বলেছেন : “রোগটি হচ্ছে বিকার। আবার যে-ঘরে বিকারের রোগী সেই ঘরে জলের জালা আর আচার-তেঁতুল। যদি বিকারের রোগী আরাম করতে চাও, ঘর থেকে ঠাঁইনাড়া করতে হবে। সংসারী জীব বিকারের রোগী; বিষয়-জলের জালা; বিষয়ভোগ- তৃষ্ণা—জলতৃষ্ণা। আচার-তেঁতুল মনে করলেই মুখে জল সরে, কাছে আনতে হয় না। সংসারে ভোগের সব জিনিস তোমার কাছেই রয়েছে। তাই নির্জনে চিকিৎসা দরকার।
“বিবেক-বৈরাগ্য লাভ করে সংসার করতে হয়। সংসার-সমুদ্রে কামক্রোধাদি কুমির আছে। হলুদ গায়ে মেখে জলে নামলে কুমিরের ভয় থাকে না। বিবেক-বৈরাগ্য-হলুদ। সদসৎ বিচারের নাম বিবেক। ঈশ্বরই সৎ, নিত্যবস্তু। আর সব অসৎ, অনিত্য, দুদিনের জন্য। এইটি বোধ আর ঈশ্বরে অনুরাগ।”
ঠিকই তো! কোন্ কালে পৃথিবীটা সহজ ছিল! কোন্ কালে পৃথিবী জীবনের অনুকূল ছিল! আর তাঁকে স্মরণ করলেই যে সবকিছু সহজ হয়ে যাবে, সেই আশাই বা করি কি করে! ঠাকুরই তো বলছেন : “ভীষ্মদেব দেহত্যাগ করবেন, শরশয্যায় শুয়ে আছেন, পাণ্ডবেরা শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে সব দাঁড়িয়ে। তাঁরা দেখলেন যে, ভীষ্মদেবের চক্ষু দিয়ে জল পড়ছে। অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে বললেন, ‘ভাই, কি আশ্চর্য! পিতামহ, যিনি স্বয়ং ভীষ্মদেব, সত্যবাদী, জিতেন্দ্রিয়, জ্ঞানী, অষ্টবসুর এক বসু, তিনিও দেহত্যাগের সময় মায়াতে কাঁদছেন।’ শ্রীকৃষ্ণ ভীষ্মদেবকে একথা বলাতে তিনি বললেন, ‘কৃষ্ণ, তুমি বেশ জান আমি সেজন্যে কাঁদছি না! যখন ভাবছি যে, যে-পাণ্ডবদের স্বয়ং ভগবান নিজে সারথি, তাদেরও দুঃখ- বিপদের শেষ নাই, তখন এই মনে করে কাঁদছি যে, ভগবানের কার্য কিছুই বুঝতে পারলাম না।”
প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছি। ভগবানের কার্য তো সহজে বোঝার নয়। বিশাল দুনিয়ায় যা হচ্ছে হোক না! তাতে আমার কি! “ডুব দিলে কুমির ধরতে পারে; কিন্তু হলুদ মাখলে কুমির ছোঁয় না। হৃদি-রত্নাকরের অগাধ জলে কামাদি ছয়টি কুমির আছে। কিন্তু বিবেক-বৈরাগ্যরূপ হলুদ মাখলে তারা আর তোমাকে ছোবে না।”
“তুমি দম-সামর্থ্যে এক ডুবে যাও, কুলকুণ্ডলিনীর কূলে।
জ্ঞান-সমুদ্রের মাঝে রে মন শান্তিরূপা মুক্তা ফলে,
তুমি ভক্তি করে কুড়ায়ে পাবে, শিবযুক্তি মতো চাইলে।
কামাদি ছয় কুম্ভীর আছে, আহার-লোভে সদাই চলে,
তুমি বিবেক-হলদি মেখে যাও, ছোঁবে না তার গন্ধ পেলে।।”
বড় আশার কথা বললেন ঠাকুর : “যার ঈশ্বরে আন্তরিক ভক্তি আছে, তার সকলেই বশে আসে—রাজা, দুষ্ট লোক, স্ত্রী। ঈশ্বরেতে শুদ্ধাভক্তি যদি না হয়, তাহলে কোন গতি নাই। কেউ যদি ঈশ্বরলাভ করে সংসারে থাকে, তার কোন ভয় নাই। নির্জনে মাঝে মাঝে সাধন করে কেউ যদি শুদ্ধাভক্তি লাভ করতে পারে, সংসারে থাকলে তার কোন ভয় নাই। চৈতন্যদেবের সংসারী ভক্ত ও ছিল। তারা সংসারে নামমাত্র থাকত। অনাসক্ত হয়ে থাকত।”
বঙ্কিমচন্দ্রকে ঠাকুর হাঁসের উপমা দিয়েছিলেন—”যারা কিন্তু ঈশ্বরচিন্তা করে, বিষয়ে আসক্তি এবং কাম-কাঞ্চনে ভালবাসা চলে যাবার জন্য রাতদিন প্রার্থনা করে, যাদের বিষয়রস তেঁতো লাগে, হরিপাদপদ্মের সুধা বৈ আর কিছু ভাল লাগে না, তাদের স্বভাব যেমন হাঁসের স্বভাব। হাঁসের সুমুখে দুধেজলে দাও, জল ত্যাগ করে দুধ খাবে। আর হাঁসের গতি দেখেছ? একদিকে সোজা চলে যাবে। শুদ্ধ ভক্তের গতিও কেবল ঈশ্বরের দিকে। সে আর কিছু চায় না; তার আর কিছু ভাল লাগে না।”
“মজলো আমার মনভ্রমরা শ্যামাপদ নীলকমলে।
যত বিষয়মধু তুচ্ছ হলো কামাদি কুসুম সকলে।।”