হাঁটন্তি অশ্বত্থ গাছ
আমাদের গ্রামে একটা পোড়া অশ্বত্থ গাছ আছে। গাছটার একটা খুব মোটা গুঁড়ি। চারপাশে ছড়িয়ে থাকা অনেক শুকনো ডালপালা নিয়ে সে আমাদের সন্ধ্যেবেলা ভয় দেখাতে ছাড়ে না। ওর পাশেই আছে আমাদের বিকেল বেলার যাবতীয় হুল্লোড়ের ঠিকানা। একফালি খেলার মাঠ। মাঠটা এতটাই ছোটো যে, পনেরো-কুড়িজন দাঁড়ালেই থইথই ভরে যায়।
তবু ওই মাঠটাই হল আমাদের অ্যাডভেঞ্চার গল্পের আশ্চর্য ভান্ডার। ঠিক মাঠটা নয়, ওই পোড়ো অশ্বত্থ গাছটাই হল সমস্ত গা ছমছমে গল্পের নায়ক। অমাবস্যার গভীর রাতে নীচ দিয়ে যাওয়ার সময় অনেকে নাকি গাছটার তম্বি শুনতে পায়।
গাছটা কেন যে অমন করে শাসন করে, সেকথা কেউ আবিষ্কার করতে পারেনি। রাতে যখন বাতাস মরে আসে, তখন গাছটার শুকনো ডালপালার আড়াল থেকে প্যাঁচার ঘুৎকার শোনা যায়। কেউ কেউ বলে, ওগুলো নাকি পেঁচির ডাক। দূরে কোথাও নিশি বেরোলে তখন ভয় পেয়ে পেঁচি ডেকে ওঠে। অনেকে বলে, রাতের বেলা নিশির ডাকে আধঘুমন্ত মানুষও নিশির ডাক অনুসরণ করে ছুটতে ছুটতে গিয়ে মারা যায়।
ওই গাছটার নীচ দিয়ে যে যায়, সে-ই তখন শুনতে পায় খুব মিহি একটা টিপির টিপির শব্দ ভেসে আসছে গাছটার মগডালের দিক থেকে। সে তখন চারদিকে তাকিয়ে দেখে, না, কই, বৃষ্টি পড়ছে না তো! তখনই ওঠে একটা বোঁ বোঁ শব্দ। ওটাই নাকি গাছটার তম্বির ভাষা।
বড়োদের তম্বি শুনলে ভয় হওয়ারই কথা। সে লেখাপড়া নিয়েই হোক বা খেলার মাঠের দৌরাত্ম্যের নিষেধই হোক। আমরা ছোটোরা ভয়ও পাই। কিন্তু বড়োরাও যে গাছের তম্বি শুনে অমন ভয় পান, সেকথা শুনে আমরা থ মেরে যাই।
তা গাছটা অমন পুড়ে গেল কেন? বড়োদের মুখে শুনেছি, ওই গাছটা যখন পাতায়-পল্লবে সবুজ হয়ে থাকত, তখন সাতটা প্যাঁচা আশ্রয় নিয়েছিল ওর কোটরে। এখন দিনের বেলা শকুন এসে বিশ্রাম নেয়। বর্ষার আগে আগে দুটো ছন্নছাড়া হাড়গিলা পাখি কেন যে তাদের সব শিকারকর্ম ফেলে অনেকক্ষণ ধরে বসে থাকে ওই পোড়া অশ্বত্থের শুকনো ডালে, বোঝা যায় না। চন্দনা টিয়ার ঝাঁক জিরিয়ে নিতে ওর ডালে এসে বসে না যে তা নয়। ওদের ডানার পালকের উপরের লাল ছোপ চোখ পেতে দেখলে অনেক দূর থেকেই দেখা যায়।
একবার কার্তিক মাসের এক কৃষ্ণাচতুর্দশীর রাত। অসময়ের বৃষ্টিতে ভেসে যেতে লাগল মেদিনী। ঘন ঘন বাজ পড়তে লাগল। সেই ভূতচতুর্দশীর রাতে কড়াত করে এসে একটা বাজ আছড়ে পড়ল সেই অশ্বত্থ গাছটার মাথায়। পরদিন সকালে উঠে গ্রামের সকলে দেখল, অশ্বত্থ গাছটা পুড়ে ছারখার। সেই থেকে মাঠটার নামও হয়ে গেল ‘পোড়া আশদতলার মাঠ’।
আমরা ছোটোরা তাই কেউ খেলার পর বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যে পার করি না। বড়োদেরও দেখি, তাঁরা মাঝরাতে পাশের গ্রামে যাত্রা শুনে বাড়ি ফেরার সময় ও পথ ধরেন না। বাঁশপোতার খালপাড়ের পথটা একটু ঘুরপথ হলেও, সেটাকেই বেছে নেন। আর আমরা বড়োদের সঙ্গে যাত্রা-ফেরত পোড়া আশদতলার মাঠের অনেক আগে থেকেই তাঁদের কাঁধের পোঁটলা হয়ে যাই।
সে দিন আঁটুল এসে বিকেল বেলা আমাদের খবর দিল, ‘জানিস তো, ওই পোড়া অশ্বত্থ গাছটা নাকি হাঁটতে পারে, কথাও বলতে পারে!’
এর আগে ওই গাছটা নিয়ে নানারকম কথা আমাদের কানে এসেছে। কখনো শুনেছি, ওই গাছের সবচেয়ে উঁচু ডালের মাথায় নাকি ঝুলনপূর্ণিমার রাতে সপ্তর্ষিমন্ডলের অঙ্গিরা নক্ষত্র থেকে এক ফোঁটা শিশির এসে পড়ে। তারপর সেই রাতেই সেই শিশিরবিন্দু ফল হয়ে ঝুলতে থাকে রাতভর।
তারপর ভোর হলে, যখন সূর্যের প্রথম আলো এসে পড়ে ফলটার গায়ে, তখনই লাল টুকটুকে হয়ে পেকে যায় ফলটা। আর তখনই তার ছুটির সময় হয়। টুপুস করে খসে পড়ে নীচে। যে সেই ফলটা খায়, হয় সে রাজা হয়, নয়তো সে পাগল হয়ে যায়। আমাদের গ্রামের গগন পাগলা নাকি সেই ফলটা খেয়েছিল বলে আজও পাগল হয়ে পথেঘাটে ঘুরে-বেড়ায়।
ফলটা খেয়েছিল কি না আমরা জানি না, তবে গগন পাগলা যে সত্যি পাগল, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই আমাদের। তা না হলে, ক্লাসের যে অঙ্ক আশিস স্যার করতে হিমশিম খান, স্কুলের পাশের মহানিম গাছটার তলায় বসে গগন পাগলা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলে, ‘খি খি খি খি… ওসব অঙ্ক আমার জলভাত।’
এটা আমরা কেউই বিশ্বাস করিনি কোনোদিন। তবে আমরা ভাবতাম, গগন পাগলা পাগল না হয়ে যদি রাজা হয়ে যেত, কী এমন ক্ষতি হত? সেই পাকা ফলটা যখন খেয়েই ফেলেছিল।
পোড়া অশ্বত্থ গাছটা নিয়ে আরও কত কাহিনি যে ছড়িয়ে ছিল আমাদের গ্রামে, সে বললে একটা আঠারো পর্বের মহাভারত হয়ে যায়।
তবু তার দু-একটা না বললে গাছটার এলেম সম্পর্কে পুরোপুরি ধারণা দেওয়া মুশকিল। গাছটার একটা বড়ো কোটরে নাকি একসময় দুটো তক্ষক থাকত। গিরগিটির মতো দেখতে। এ খবরটা আমাদের দিয়েছিল অচিন। অচিন অবশ্য খবরটা পেয়েছিল গদাধরদাদুর কাছ থেকে। গদাধরদাদুও নিজে কি আর তক্ষক দেখেছেন কখনো? তা নয়।
তাঁর বাবা ছিলেন ডাকসাইটে সাপুড়ে। রাত গভীর হলে সাপের ঝাঁপির কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে হিসহিস করে সাপের সঙ্গে কথা বলতেন। সাপ নাকি তাঁর কথাও শুনত। তিনি ঝাঁপিতে একটা তক্ষক পুষেছিলেন। তক্ষকটা অনেকদিন বেঁচেও ছিল। যেখানে যেতেন, তক্ষকের ঝাঁপিটা তাঁর সঙ্গে থাকত। তবে কখনো ঝাঁপি খুলে কাউকে তক্ষকটা দেখাতেন না। অনেকে এই নিয়ে শেষে সন্দেহও করতে শুরু করেছিল। গদাধরদাদু তাঁর বাবার কাছ থেকে পোড়া অশ্বত্থ গাছের তক্ষকের কথা শুনেছিলেন।
তক্ষকরা কুরুক্ষেত্রের পাশের খান্ডববনে থাকত। অগ্নিদেবতার খুব খিদে পেয়েছিল বলে খান্ডববনকে পুড়িয়ে তিনি খেতে চান। মহাভারতে খান্ডবদাহের ঘটনার কথা আছে। তখন তক্ষক খান্ডববনের বাইরে ছিল। তাই পুড়ে মারা যায়নি। সে তখন কুরুক্ষেত্রে চলে আসে। তক্ষক হল বাসুকির ভাই। এর আর এক নাম অনন্তনাগ। আমাদের অনুমান, যদি এই পোড়া অশ্বত্থ গাছে সত্যিই কোনো দিন তক্ষক দুটো থেকে থাকে, তবে সেই তক্ষক দুটো এসেছিল সুদূর কুরুক্ষেত্র থেকে।
তক্ষক নিয়ে এত কথা বলার কারণ আর কিছুই নয়, আমাদের মধ্যে কেউ কেউ মনে করে সেই তক্ষক দুটোর ভূত এখনও বাসা বেঁধে আছে গাছটার শুকনো কোটরে।
আঁটুলের কথার পিঠে অলক বলল, ‘ওই যে পোড়া অশ্বত্থ গাছটা কথা বলে বলছিস, ও তো কথা বলে তক্ষক দুটোর ভূতের সঙ্গে।’
যেদিন এইসব গা ছমছমে কথা শুরু হয়, সেদিন খেলার পাট উধাও হয়ে যায় নিমেষে। সকলেই সরে এল আঁটুলের গায়ের কাছে।
চপল বলল, ‘দুটো তক্ষক ছিল বলে তো শুনেছি। তাহলে একটা তক্ষকের ভূত আর একটা তক্ষকের ভূতের সঙ্গে কথা বললেই পারে। খামোখা শুকনো গাছের সঙ্গে কথা বলতে যায় কেন? ওতে কী আনন্দ পায়?’
আঁটুল বলল, ‘আর একটা তক্ষক মুখ দিয়ে তো কোনো শব্দই করতে পারত না। তাই…’
চপল বলল, ‘আরও একটা কথা শুনেছি। যে তক্ষকটা ডাকতে পারে, তার আবার নাকি বই পড়ার খুব শখ। তাই তার কখনো বই পড়ায় মন হলে সে উড়ে চলে আসে কোনো ছোটো ছেলের পড়ার ঘরের টেবিলে।’
আমি এতক্ষণ অবাক হয়ে শুনছিলাম। বললাম, ‘হ্যাঁ রে. পড়ার টেবিলে এসে কী করে?’
আঁটুল ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল, ‘কিছু করুক আর না-ই করুক, সে কি আর আমি দেখতে গেছি? তবে জেনে রাখ, তক্ষকের ভূত দুটো যার পড়ার টেবিলে এসে বসে, তার সারাজীবনের মতো পরীক্ষায় পাস করা শেষ।’
আমি বললাম, ‘কেন, কেন? তক্ষকের ভূত কি পরীক্ষার খাতা দেখে নাকি যে, সব প্রশ্নের উত্তরে শূন্য দেবে?’
চপল চোখ দুটো বনবন করে ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, ‘পরীক্ষার খাতা দেখুক আর না-ই দেখুক, তার দ্বারা আর পাস করা হয় না।’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘বলিস কী? তাহলে আমার পড়ার টেবিলে এসে কোনোদিন কি তক্ষকের ভূত দুটো বসেছিল নাকি রে? ক্লাস ফাইভে দু-দুটো পরীক্ষা হয়ে গেল। একটাতেও তো পাস করতে পারলাম না? অ্যাই, বল না রে আঁটুল?’
আঁটুল বিজ্ঞের মতো মুখের ভঙ্গি করে বলল, ‘হতেও পারে। তুই তো দেখি সবেতেই গোল্লা পাস।’
আমি নিজের সম্মান রাখতে প্রতিবাদ করে উঠলাম, ‘শূন্য পাই, না তক্ষকের ভূত দুটো শূন্য পাইয়ে দেয়?’
আমার কথার উত্তর দেওয়ার আগেই পশ্চিম আকাশ কালো করে ঝড় উঠল। সকলেই ম্যারাথন দৌড়ে যে যার বাড়ি ফিরে এলাম।
সেই থেকে কথাটা আমার মাথা থেকে যাচ্ছে না। আমি পড়ার টেবিলের পাশের জানালা ভুলেও খুলে রাখি না। এমনকী, বইগুলো খোলা অবস্থায় ফেলে রেখে মাঠের দিকে দৌড়োই না। মা সেদিন আমার বই গুছোনো দেখে বললেন, ‘তোর তো দেখি এবার পড়ায় মতি এসেছে রে। বইগুলো গুছিয়ে রাখছিস অমন সুন্দর করে? আগে কতদিন তো বলেছি, বই খুলে রেখে উঠে চলে গেলে বইয়ের কষ্ট হয়। এখন যে বুঝেছিস, এই আমার ভাগ্য!’
আমি মাকে আর বললাম না তক্ষকের ভূত দুটোর কথা, যারা আমাকে ফাইভে পরপর দুটো পরীক্ষায় পাস করতে দেয়নি। মনে মনে ঠিক করে রেখেছি, জান-প্রাণ দিয়ে এবার অ্যানুয়ালের প্রস্তুতি নেব। তাতেও যদি পাস করতে না পারি, তাহলে বাবা-মাকে কথাটা বলবই।
২
আজ পঁচিশে বৈশাখ, আমাদের স্কুলে রবীন্দ্রজয়ন্তী। বিকেল থেকে হবে নানা অনুষ্ঠান। আমরাও কেউ না কেউ কিছু না কিছু করব। আমি রবীন্দ্রনাথের ‘লুকোচুরি’ আবৃত্তি করব। আমার ‘বীরপুরুষ’ আবৃত্তি করার ইচ্ছে ছিল। অত বড়ো কবিতা মনে রাখতে পারব না বলে চপলকে ছেড়ে দিয়েছি। আঁটুল আবৃত্তি করবে ‘জন্মকথা’। সুনেত্রা গান গাইবে ‘পথের সাথী, নমি বারংবার…’। সব শেষে হবে রবীন্দ্রনাথের নাটক ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’।
হেডস্যার বাংলা স্যারকে বলেছিলেন, ‘পুলকবাবু, ‘বাল্মীকি প্রতিভা’-টাই করুন। ছোটো- নাটক। ছেলে-মেয়েরা তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে পারবে। এখন তো আবার কালবৈশাখীর দিন। সন্ধ্যের দিকে কখন কী ঝড়-বৃষ্টি হয়।’
পুলক স্যার বলেছিলেন, ‘না স্যার, ওটা তো বড্ড ছোটো। আমরা বরং ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’ করি?’
হেডস্যার নিমরাজি হয়ে বলেছিলেন, ‘করুন! তবে নাটক শুরু করতে দেরি করবেন না। দেখবেন, যাতে সাড়ে আটটার মধ্যে শেষ করা যায়।’
ক্লাস নাইন আর টেনের দাদা-দিদিরাই নাটকে অংশগ্রহণ করবে। বেশ কিছুদিন ধরে জোর রিহার্সাল হয়েছে।
বিকেল সাড়ে পাঁচটায় শুরু হল পঁচিশে বৈশাখের অনুষ্ঠান। প্রথমে হেডস্যার বললেন বালক রবীন্দ্রনাথ নিয়ে। তার পরেই আমার কবিতা আবৃত্তি। এর পর গান হল দু-তিনটে। চপলের আর আবৃত্তির ডাক আসে না। আমরা মঞ্চের পিছনে জমায়েত হয়ে আছি। আমার এখন সামনে গিয়ে বসার কথা। কিন্তু চপল আমার জামার হাতা ধরে টেনে রেখেছে, ‘তুই যাবি না অংশু। যতক্ষণ না আমার আবৃত্তি শেষ হয়, ততক্ষণ এখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক।’
তারপর পুলক স্যার চপলের নাম বললেন মাইকে, ‘এবার রবীন্দ্রনাথের ‘বীরপুরুষ’ আবৃত্তি করবে চপল কান্ডার।’
খুব সুন্দর আবৃত্তি করল চপল। অত বড়ো কবিতা গড়গড় করে আবৃত্তি করে গেল, কোথাও একটুও আটকায়নি।
আঁটুলের ভালো নাম অটল। এর পর আঁটুলের আবৃত্তি শেষ হতেই আমি উঠে পড়লাম।
সন্ধ্যে হয়ে গেছে। আমাদের গ্রামের তিন-চারজন আসেনি। অচিনের শরীর খারাপ। সে আসতে পারেনি। অলক দিদির বাড়ি গেছে নামখানা।
আমি চপলকে বললাম, ‘কী রে, অন্ধকার হয়ে গেছে। বাড়ি চলে যাই চল!’
চপল বলল, ‘নাটকটা একটু দেখব না? আমরা তিনজন আছি, ঠিক চলে যাব।’
দেখতে দেখতে শুরু হয়ে গেল নাটক ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’। কিছুটা নাটক দেখার পর আমি আঁটুলকে বললাম, ‘চল, এবার বাড়ি চল। আটটা বেজে গেছে। এবার বাড়ি ফিরতে কিন্তু ভয় করবে। আমি এখন থেকেই বলে রাখছি, পোড়া আশদতলা দিয়ে আমরা যাব না।’
আঁটুল একরকম জোর করে চপলকে সিট থেকে তুলল, ‘চল, চল। আর দেরি করলে হবে না।’
মঞ্চে তখন নাটকের দ্বাদশ দৃশ্য শুরু হয়েছে। গুহার দরজায় দাঁড়িয়ে সন্ন্যাসী বলছে, ‘এইখানে সব বুঝি শেষ হয়ে গেল!’
এমন সময় দূর থেকে শোঁ শোঁ শব্দে নাটকের মঞ্চের ঘাড়ের উপর এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ল প্রবল কালবৈশাখী। সঙ্গে তুমুল বৃষ্টি। মঞ্চের মাথার উপরের ত্রিপল প্যারাসুটের মতো উড়ে গেল স্কুল বিল্ডিং-এর বারান্দায়। বৃষ্টিতে সকলেই ছুটল স্কুলে।
আমি আঁটুলকে বললাম, ‘এখন দাঁড়ালে ফিরতে আরও রাত হয়ে যাবে। চল, ভিজতে-ভিজতে বাড়ির দিকে ছুট লাগাই।’
আঁটুল আর চপলও আমার কথায় সায় দিয়েই দৌড়োতে শুরু করল। আমি ওদের পিছন-পিছন। জামা-প্যান্ট ভিজে একশা। দৌড়োতে দৌড়োতে আমরা যখন আমাদের গ্রামের বাঁশপোতার খালের ধারে এসেছি, চপল গলা নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বলল, ‘কোন দিক দিয়ে যাবি রে আঁটুল?’
এখান থেকে একটা রাস্তা পোড়া আশদতলা হয়ে আমাদের গ্রামের দিকে গিয়েছে। আর একটা রাস্তায় বাঁশপোতার খালপাড় ধরে বেশ কিছুটা গেলে তারপর আমাদের গ্রাম। এটা একটু ঘুরপথ।
আঁটুল বলল, ‘এখন এই অন্ধকারে ঘুরপথে যাবি? তাহলে তো আরও ভিজে যাব রে? তার চেয়ে চল, পোড়া আশদতলা দিয়েই যাই?’
আমি এর উত্তরে যে-কথা বলতে গেলাম, কড়কড়াত বাজের শব্দে ভয় পেয়ে কেঁপে উঠলাম। বলতেই পারলাম না। হঠাৎ আকাশ-চেরা বিদ্যুতের ঝিলিকে চিরে খানখান হয়ে গেল নিকষ অন্ধকার। পলকের আলোয় তিনজনের ভয় পাওয়া মুখ দেখে তিনজনেই ঘাবড়ে গেলাম।
আমি নাছোড় হয়ে বললাম, ‘না রে, আমি পোড়া আশদতলা দিয়ে কোনোমতেই যাব না। তুই আর চপল যাবি তো যা। আমি ঘুরপথেই চললাম।’ বলে বৃষ্টি আর বাজ মাথায় করে দৌড়োতে শুরু করলাম। আমার মধ্যে এক আশ্চর্য সাহস কোথা থেকে যেন এসে ভর করল। যেন ত্রিভুবনে আমি কাউকেই ভয় পাই না। কিছুটা দৌড়োনোর পর আমি পিছন না ফিরেই টের পেলাম, কেউ আমার পিছন পিছন আসছে। মনে হল, চপলই আসছে। তাহলে আঁটুল কি একা পোড়ো আশদতলা দিয়ে যাচ্ছে?
পিছন ফিরলাম। দূরে খুব জোরে বিদ্যুৎ চমকাল। তারই ক্ষীণ আলোয় দেখলাম, না, আমার পিছনে কেউ নেই। তাহলে কি ওরা দু-জনেই ওদিক দিয়ে যাচ্ছে?
ফের বিদ্যুৎ চমকাতে দেখলাম, আমার সামনে ঝোড়ো বাতাস কেটে কী দুটো যেন সরসর করে এগিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ আমি ভয়ে কেঁপে উঠলাম, আচ্ছা, ওটা সেই তক্ষক দুটোর ভূত নয় তো? ওরাই তো আমাকে গত দুটো পরীক্ষায় পাস করতে দেয়নি। এই অন্ধকারে ওদের আমি ঘুসি মেরে ফেলে দিতে পারি। পরীক্ষাফেলের বদলা নিতে পারি।
তার এক মুহূর্ত পরেই মনে হল, আমার সামনে সাঁইসাঁই করে কেউ দৌড়োচ্ছে। ওমা! তক্ষক দুটোর ভূতও তো হাওয়া হয়ে গেল দেখছি? মনে হল, সামনের লোকটাকে ঠিক গগন পাগলার মতো দেখতে। পট করে একটা ভয় আমাকে অন্ধকারের মতো জাপটে জড়িয়ে ধরল। ভালো করে দেখলাম, হ্যাঁ, গগন পাগলাই তো! পাগলকে আমি খুব ভয় পাই ঠিকই, কিন্তু এই মুহূর্তে মনে হল, এমন দুর্যোগের রাতে পথে অন্তত একজন মানুষকে তো পাওয়া গেল! গগন পাগলা পাগল হতে পারে, কিন্তু সে যে মানুষ, এ বিষয়ে কোনো সংশয় নেই।
এমন সময় গগন পাগলা চেঁচিয়ে বলল, ‘খি খি খি খি… ওই দ্যাখ, পোড়া আশদ গাছটা এই ঝড়-বৃষ্টিতে বেড়াতে বেরিয়েছে।’
মনে মনে আমি চিৎকার করে উঠলাম, কোথায়? কিন্তু মুখে কিছুই বলতে পারলাম না। গগন পাগলা থম মেরে দাঁড়িয়ে পড়ল সামনে। তারপর আঙুল তুলে দেখাল ‘ওই তো রে, বাঁশপোতার খালপাড় ছাড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে ফাঁকা মাঠে নামল পোড়া আশদ গাছটা। হাঁটন্তি পোড়া আশদ গাছ দেখেছিস কোনোদিন? দেখতে পাচ্ছিস না?’
আমি তাকিয়ে দেখি, সত্যি! ওই অত বড়ো শুকনো অশ্বত্থ গাছটা, লোকে যেমন করে বিকেল বেলা হাওয়া খেতে বেরোয়, অমন ভঙ্গিতে টুকটুক করে হাঁটছে। অন্ধকারে, ঝড়-বৃষ্টি ছাপিয়ে বাজ পড়ার শব্দের চেয়েও জোরে ওই অশ্বত্থ গাছের ডালপালা থেকে শোনা গেল একঝাঁক প্যাঁচার ঘুৎকার। সেই হাড়গিলা পাখি দুটোও ডানা ঝাপটাচ্ছে অন্ধকার ভেঙে। চন্দনা টিয়ার ঝাঁক উড়ছে ঝড়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সাঁইসাঁই সাঁইসাঁই।
ছুটছি আমি, প্রাণপণে বাড়ির দিকে ছুটছি। আমার চারপাশে আঁটুল নেই, চপল নেই, বাঁশপোতার খালপাড় নেই, গগন পাগলা নেই। নেই সেই পোড়া অশ্বত্থ গাছ, একজোড়া হাড়গিলা পাখি, একঝাঁক চন্দনা টিয়া।
অন্ধকারে আমাদের কচুরিপানা ভরতি পুকুরের পাড় পেরিয়ে প্রাণপণে দৌড়োচ্ছি বাড়ির দিকে। উঃ! আর পারছি না। এবার আমি হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাব। আর আমার শরীরে একটুও প্রাণশক্তি নেই।
হঠাৎ ভীষণ জোরে চমকে ওঠা বিদ্যুতের আলোয় দেখলাম, আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ। বৃষ্টিতে ভিজে চুপ্পুস হয়ে যাওয়া আমাকে লম্বা দুটো হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরলেন তিনি। আর আমার কিচ্ছু মনে নেই।
তখনও দূর থেকে শুনতে পেলাম ভেসে আসা তক্ষক ভূত দুটোর ডাক, ‘কুক্কুই, কুক্কুই!’