‘হলো না’-টাই ‘হলো’
ঠাকুর! আমার হবে তো?
কি হবে?
ঐ যে সবাই বলেন—দীক্ষা, তারপর জপ-ধ্যান, তারপরে কিছু একটা হতে পারে। মারাত্মক একটা কিছু। একদিন মাঝরাতে দরজা-জানালা ভেদ করে গোলমতো একটা আলোর বল ঘরের মাঝখানে এসে পড়বে। টেনিসবলের মতো বারকতক লাফালাফি করে ফস করে একটা মূর্তি বেরিয়ে আসবে। আমি অমনি মশারির মধ্যে ধড়মড় করে উঠে বসব। বিদ্যুতের নীল আলো স্থির হয়ে গেলে যেমন হয়, সেইরকম একটা আলো।
তারপর
সারা ঘরে ভরভর করবে পদ্মফুলের সুগন্ধ।
পদ্মফুলের গন্ধ কোনদিন শুঁকেছিস?
না ঠাকুর!
তবে?
ঐ যে আপনি বলেছিলেন, নরেন্দ্রনাথ সহস্রদল পদ্ম। পদ্মফুল দেরিতে ফোটে। দেরিতে শুকোয়। অপূর্ব তার গন্ধ। সারা ঘর সেইরকম গন্ধে ভরে যাবে।
মূর্তিটা কেমন? দেবতা, না দেবী? দ্বিভুজা, চতুর্ভুজা, দশভুজা?
সে তো জানি না ঠাকুর। একটা আবির্ভাব একটা দর্শন। তিনি বরাভয় মুদ্রা দর্শন করিয়ে বলবেন : যা, তোর হয়ে গেল।
কি হয়ে গেল?
এই ‘হয়ে গেল’টা যে কি, সেটাই আমার জানা নেই ঠাকুর!
দেখ, যখন তখন আমার ভাবান্তর হয়, শাস্ত্র যে-অবস্থাকে বলেছে ‘সমাধি’। মন্দিরের মূর্তি জীবন্ত হয়ে আমাকে দর্শন দিয়েছেন। নাকের কাছে তুলো ধরে দেখেছি, শ্বাস পড়ছে। মা বালিকার রূপ ধরে আমার সঙ্গে খেলা করেছেন। তাতে কি আমার একটা ন্যাজ বেরিয়েছে, না দুটো শিং গজিয়েছে? এই দেখ, পরনে একটা খাটো ধুতি। তার একটা প্রান্ত গায়ে জড়ানো। মাঝে মাঝে এও থাকে না। দেবেন ঠাকুর ব্রাহ্মসমাজে নিমন্ত্রণ করলেন। বললেন, সেজেগুজে যেতে হবে। আমি বললুম, সাজতে-গুজতে পারব না বাপু। পরে খবর পাঠালে, আসতে হবে না।
*
মথুরমোহনের বাড়ির ঘটনাটা আমাদের মনে পড়ছে। কালীঘাটের হালদার পুরোহিত। মথুরমোহনের বাড়িরও পুরোহিত। পুরোহিত, কিন্তু লোভী। তাহলে মানেটা বোঝ। দিনের পর দিন দেবার্চনার ফল কি হলো?–লোভ, হিংসা! ভেবেছিল, জমিদার মথুরমোহনকে বাগে এনে নিজের অবস্থা ফেরাবে। সে-গুড়ে বালি। কোথা থেকে দক্ষিণেশ্বরের এক পাগলা এসে বাবুকে অ্যায়সা হাত করেছে, বাবু একেবারে বশীভূত! তুকতাক জানে। বাবুকে গুনটুন করেছে। কত ঢঙ! থেকে থেকে মুচ্ছা যায়। আবার ভাব দেখায়, যেন অবোধ শিশু! বালক! তা বালক, তো বলে দিলেই হয় বশীকরণের মন্ত্রটা। তা বলবে না। নিজের যত বিদ্যা সব ঝেড়েঝুড়ে বাবুটা একটু বাগে আসছিল, এমন সময় কোথা থেকে এই আপদ এসে হাজির!
মথুরমোহনের ধ্যান-জ্ঞান তখন একমাত্র শ্রীরামকৃষ্ণ। তোমার সেবার জন্য এসেছি। তোমার সেবাই আমার পূজা। তুমি আমার ইষ্ট। দক্ষিণেশ্বর থেকে অনেক সাধ্যসাধনা করে ঠাকুরকে মাঝেমধ্যে জানবাজারে নিয়ে যান। ‘বাবাকে কি যা-তা পাত্রে খেতে দেওয়া যায়!’ অর্ডার দিয়ে একপ্রস্থ সোনা আর রুপোর বাসন তৈরি করিয়েছেন। ভাল ভাল পোশাকাদি। ঠাকুরকে সাজিয়ে দিয়ে বলেন : ‘বাবা, তুমিই তো সবকিছুর মালিক। আমি তোমার দেওয়ান ছাড়া কিছু নই। এই দেখ না, তুমি সোনার থালায়, রুপোর বাটি-গেলাসে খেয়ে উঠে চলে গেলে, ফিরেও তাকালে না। এইবার আমার কাজ হলো—তুমি তো আবার খাবে, সেইসব মাজিয়ে, ঘষিয়ে, পালিশ করিয়ে তুলে রাখি, চুরি গেল কিনা দেখি, ভাঙা ফুটো হলো কিনা খবর রাখি, আর এই নিয়েই আমি মহা ব্যস্ত। এইতেই আমার মহা আনন্দ। ‘
হালদার পুরোহিতের এইসব চোখে পড়ে আর সর্বাঙ্গ জ্বলে যায়। জানবাজার থেকে ফিটন বেরল। মথুরমোহনের পাশে ঠাকুর। গড়ের মাঠে হাওয়া খেতে যাচ্ছেন। উপায় নেই। উপায় থাকলে অবতারকে চিৎপাত করে ফেলে দিয়ে হালদারমশাই মথুরবাবুর পাশে বসতেন। রামকৃষ্ণের মতো বোকা আর দুটো আছে! বেনারসী শাল! এক হাজার টাকা দাম! বাবু নিজের হাতে পরিয়ে দিলেন। ‘বাবা পরো, বাবা পরো।’ বাবারও কী আনন্দ! নিজে দেখছেন, সকলকে ডেকে ডেকে দেখাচ্ছেন। মথুর দিয়েছে। দাম জান? এক হাজার। ও মা! পরমুহূর্তেই শাল মেঝেতে। লাথি মারছেন, থু থু করে থুতু ছিটোচ্ছেন। উন্মাদ আর কাকে বলে! দামী শালটা মেঝেতে ঘষছেন, শেষে পুড়িয়ে দেবেন বলে আগুন জ্বেলেছেন।
ভাগ্যিস, ঠিক সেইসময় মানদা এসে পড়ল! একি! এটা কি হচ্ছে?
এতে আর আছে কি? কতকগুলো ছাগলের লোম! এটা গায়ে দিলে কি সচ্চিদানন্দ লাভ হবে? উলটো হবে। অহঙ্কার আর অভিমান বাড়বে। ঈশ্বর থেকে আরো দূরে সরিয়ে দেবে এই শালার শাল!
মথুরমোহন শালের কাহিনী শুনে বললেন : বাবা বেশ করেছেন, ঠিক করেছেন।
হালদারমশাই শুনলেন। মনে মনে বললেন : হ্যাঁ, পেয়ারের লোকের সাতখুন মাপ!
এই পর্যন্ত তো জান?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
*
এইবার এর শেষটা শোন। সেদিন সন্ধ্যার একটু আগে, জানবাজারে, ‘একটা ঘরের মেঝেতে অর্ধবাহ্যদশায় পড়ে আছি। কেউ কোথাও নেই। সবে বাহ্যজগতের অল্প অল্প হুঁশ আসছে। এমন সময় সেই হালদার পুরোহিত! দেখছে, আমি মেঝেতে পড়ে আছি। আশপাশে কেউ নেই। এদিক-ওদিক তাকিয়ে আমার একেবারে কাছে এসে গায়ে হাত দিয়ে ঠেলছে আর বলছে : ‘অ বামুন, বল না–বাবুটাকে কি করে হাত করলি? কি করে বাগালি, বল না। ঢঙ করে চুপ করে রইলি যে! বল না।’ আমি কি বলব? আমার তো তখন কথা বলার মতো অবস্থা নেই। শুনতে পাচ্ছি সব। ‘অ বামুন, বল না—বাবুটাকে কি করে হাত করলি? কি করে বাগালি বল না।’ শেষে রেগে গিয়ে ক্যাত ক্যাত করে লাথি মারতে লাগল আর বলতে লাগল : ‘শালা বলবি না, যাঃ শালা, বললি না!’ এইবার তোমার প্রশ্নে এস—’আমার হবে তো?’ আমার কি হয়েছে? আমি যখন পড়ে পড়ে লাথি খাচ্ছি, তখন আমার মা দক্ষিণেশ্বর থেকে ছুটে এসে লোকটাকে ভস্ম করে দিলেন? মথুর এসে দেখলে ঘরের মেঝেতে এক মুঠো ছাই পড়ে আছে? ছাই এল কোত্থেকে? ছাই নয়, হালদারের দেহাবশেষ! না, সেইরকম কিছু হওয়ার নয়!
দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের কর্মচারীরা আমার ঘোর শত্রু ছিল। মথুরমোহনের কাছে আমার নামে নালিশ করতে গিয়েছিল। ভেবেছিল, মন্দির থেকে আমাকে দূর করে দেবে। ব্রাহ্মসমাজে আমার হেনস্থার কথাটা জান? এক সপ্তাহ গেল, দু- সপ্তাহ গেল। নরেন্দ্রর দেখা নেই। ভেতরে একটা গামছা নেঙড়ানোর ভাব প্রাণ বুঝি যায়! ভাবলুম, অন্য কোথাও দেখা না হলেও সাধারণ ব্রাহ্মসমাজে হবেই। সান্ধ্যোপসনায় নরেন ভজন গাইতে যায়। গেলুম সেখানে ছুটে। আচার্য বেদিতে। উপদেশ দিতে শুরু করেছেন। এইবার শোন আমার জীবনীকারের কলমে—”এমন সময় অর্ধবাহ্যদশাপন্ন দক্ষিণেশ্বরের পরমহংস শ্রীরামকৃষ্ণ বেদিকায় উপবিষ্ট আচার্যের দিকে ধীরপদক্ষেপে অগ্রসর হইতে লাগিলেন। সমবেত উপাসকদের অনেকেই তাঁহাকে চিনিতেন; কাজেই তাঁহার আগমনবার্তা অচিরে সমাজভবনের সর্বত্র প্রচারিত হইল এবং পূর্বে যাঁহারা তাঁহাকে দেখেন নাই তাঁহারা ভাল করিয়া দেখিবার জন্য সহসা উঠিয়া দাঁড়াইলেন, কেহবা বেঞ্চির উপর উঠিলেন। এইরূপে মন্দিরাভ্যন্তরে এক অবাঞ্ছিত চাঞ্চল্য ও বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হইল দেখিয়া আচার্যের ভাষণ থামিয়া গেল। ভজনমণ্ডলীতে উপবিষ্ট নরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আগমনের উদ্দেশ্য বুঝিতে পারিয়া ঝটিতি তাঁহার পার্শ্বে আসিয়া দাঁড়াইলেন। কিন্তু আচার্য বা অপর কোন ব্রাহ্মনেতা অগ্রসর হইলেন না, বা সৌজন্য প্রকাশের প্রয়োজন-বোধ করিলেন না। সেসব দিকে ভ্রূক্ষেপহীন ঠাকুর বেদি-সমীপে আসিয়াই সমাধিস্থ হইলেন; তখন বিশৃঙ্খলা চরমে উঠিল এবং অবস্থা আয়ত্তে আনার অন্য কোন উপায় না দেখিয়া জনতা ভাঙিয়া দিবার উদ্দেশ্যে কর্তৃপক্ষ গ্যাস বন্ধ করিয়া একসঙ্গে সব আলো নিভাইয়া দিলেন। ইহাতে গণ্ডগোল বৃদ্ধি পাইল এবং অনন্যোপায় নরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পার্শ্বে দাঁড়াইয়া তাঁহার সমাধিভঙ্গের অপেক্ষা করিতে লাগিলেন। অতঃপর তিনি সাধারণ ভূমিতে নামিয়া আসা মাত্র তাঁহাকে পশ্চাতের দ্বারপথে বাহিরে আনিলেন এবং একখানি ঘোড়ার গাড়ি ডাকিয়া তাঁহাকে স্বয়ং দক্ষিণেশ্বরে পৌঁছাইয়া দিয়া আসিলেন। নরেন্দ্র পরে বলিয়াছিলেন : ‘আমার জন্য ঠাকুরকে সেদিন ঐরূপ লাঞ্ছিত হইতে দেখিয়া মনে কতদূর দুঃখকষ্ট উপস্থিত হইয়াছিল তাহা বলা অসম্ভব। ঐ কার্যের জন্য তাঁহাকে সেদিন কতই না তিরস্কার করিয়াছিলাম। কিন্তু পূর্বোক্ত ঘটনায় ক্ষুণ্ণ হওয়া বা আমার কথায় কর্ণপাত করা—কিছুই করেন নাই।’
আবার তোমার প্রশ্নে আসি—’আমার হবে তো?’ কি হবে? ব্রাহ্মসমাজে ঐদিন মা ভবতারিণী কি বেদির ওপর এসে দাঁড়িয়েছিলেন? লকলকে জিভ, হাতে খড়্গা! কোটি সূর্যের প্রভায় উপাসনাগৃহ উদ্ভাসিত? উপেক্ষাকারী ব্রাহ্মনেতারা জড়বৎ? শিবনাথ শাস্ত্রী বজ্রাহত? না, সেসব কিছুই হলো না। মা মায়ের জায়গায়, আমি আমার জায়গায়। একে ঐ লাঞ্ছনা, তার ওপর সারাটা পথ নরেন্দ্রের উত্তম-মধ্যম! ঐ যে নরেন্দ্র বললে : “পূর্বোক্ত ঘটনায় ক্ষুণ্ণ হওয়া বা আমার কথায় কর্ণপাত করা—কিছুই করেন নাই
আসলে কি জান, আমার কিছু হলো না। আর ‘হলো না’-টাই হলো। সেইটাই হয়। পৃথিবীটা কি যে-সে জায়গা! ইন্দ্রিয়ের হাত ধরে এখানে আসা। সাপের ছোবলে বিষক্রিয়া হবে না, বৃশ্চিক-দংশনে জ্বলবে না, অভাবের জ্বালায় পুড়বে না, মৃত্যু এসে প্রিয়জনকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে না, জ্ঞাতিরা কোর্টে মামলা ঝোলাবে না, পথেঘাটে মানুষ মানুষকে অপমান করবে না, শত্রুরা বাড়া ভাতে ছাই দেবে না! তা কি হয়?
আমার নরেন্দ্রকে দেখ। সপ্তঋষির এক ঋষি। সাক্ষাৎ শিব। পৃথিবী তাকে কি দিয়েছে! গোলাপ ছড়িয়েছে চলার পথে? আরো পিছনে যাও, পুরাণের কালে। “কবিকঙ্কন চণ্ডীতে আছে যে, কালুবীর জেলে গিছিল, তার বুকে পাষাণ দিয়ে রেখেছিল। কিন্তু কালুবীর ভগবতীর বরপুত্র। শ্রীমন্ত বড় ভক্ত। আর তার মা খুলনাকে ভগবতী কত ভালবাসতেন! সেই শ্রীমন্তের কত বিপদ! মশানে কাটতে নিয়ে গিছিল। একজন কাঠুরে পরম ভক্ত, ভগবতীর দর্শন পেলে। তিনি কত ভালবাসলেন, কত কৃপা করলেন। কিন্তু তার কাঠুরের কাজ আর ঘুচল না! সেই কাঠ কেটে আবার খেতে হবে। কারাগারে দেবকীর চতুর্ভুজ, শঙ্খচক্রগদাপদ্মধারী ভগবানের দর্শন হলো। কিন্তু কারাগার ঘুচল না!”
গোটা কতক কথা শুনে রাখ—(১) যার যা কর্মের ভোগ আছে, তা করতে হয়। সংস্কার, প্রারব্ধ এসব মানতে হয়। (২) প্রারব্ধ কর্মের ভোগ। যে-কদিন ভোগ আছে, দেহধারণ করতে হয়। একজন কানা গঙ্গাস্নান করলে। পাপ সব ঘুচে গেল। কিন্তু কানা চোখ আর ঘুচল না। পূর্বজন্মের কর্ম ছিল তাই ভোগ। এই দেখ, আমার গলায় ক্যান্সারের ক্ষত! হাসি পায়, অবতারের ক্যান্সার! দেহের সুখ-দুঃখ যাই হোক, ভক্তের জ্ঞান ভক্তির ঐশ্বর্য থাকে। সে-ঐশ্বর্য কখনো যাওয়ার নয়। দেখ না, পাণ্ডবদের অত বিপদ! কিন্তু এ-বিপদে তারা চৈতন্য একবারও হারায় নাই। ধর্মসাধনে স্থৈর্য পাবে। অচল অটল হবে। ‘কিছু হলো না’-টাকে উলটে নাও। জগৎজ্ঞান ওলটালেই ঈশ্বরজ্ঞান। পৃথিবীর সব চক্রান্ত ব্যর্থ হলো, বলো—’আমার কিস্যু হলো না’। ফেল, ফেল! “সত্যং শিবসুন্দর রূপ ভাতি হৃদিমন্দিরে।”