হলুদপোড়া – মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

হলুদপোড়া – মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

সে-বছর কার্তিক মাসের মাঝামাঝি তিন দিন আগে-পরে গাঁয়ে দু’দুটো খুন হয়ে গেল৷ একজন মাঝবয়সী জোয়ান মদ্দ পুরুষ এবং ষোল-সতের বছরের একটি রোগা ভীরু মেয়ে৷

গাঁয়ের দক্ষিণে ঘোষেদের মজা পুকুরের ধারে একটা মরা গজারি গাছ বহুকাল থেকে দাঁড়িয়ে আছে৷ স্থানটি ফাঁকা, বনজঙ্গলের আবরু নেই৷ কাছাকাছি শুধু কয়েকটা কলাগাছ৷ ওই গজারি গাছটার নিচে একদিন বলাই চক্রবর্তীকে মরে পড়ে থাকতে দেখা গেল৷ মাথাটা আটচির হয়ে ফেটে গেছে, খুব সম্ভব অনেকগুলি লাঠির আঘাতে৷

চারিদিকে হইচই পড়ে গেল বটে কিন্তু লোকে খুব বিস্মিত হল না৷ বলাই চক্রবর্তীর এইরকম অপমৃত্যুই আশেপাশের দশটা গাঁয়ের লোক প্রত্যাশা করেছিল, অনেকে কামনাও করেছিল৷ অন্যপক্ষে শুভ্রা মেয়েটির খুন হওয়া নিয়ে হইচই হল কম কিন্তু মানুষের বিস্ময় ও কৌতূহলের সীমা রইল না৷ গেরস্তঘরের সাধারণ ঘরোয়া মেয়ে, গাঁয়ের লোকের চোখের সামনে আর দশটি মেয়ের মতো বড় হয়েছে, বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি গেছে এবং মাসখানেক আগে যথারীতি বাপের বাড়ি ফিরে এসেছে ছেলে বিয়োবার জন্য৷ পাশের বাড়ির মেয়েরা পর্যন্ত কোনোদিন কল্পনা করার ছুতো পায়নি যে মেয়েটার জীবনে খাপছাড়া কিছু লুকানো ছিল, এমন ভয়াবহ পরিণামের নাটকীয় উপাদান সঞ্চিত হয়েছিল! গাঁয়ে সব শেষের সাঁঝের বাতিটি বোধ হয় যখন সবে জ্বালা হয়েছে, তখন বাড়ির পিছনে ডোবার ঘাটে শুভ্রার মতো মেয়েকে কে বা কারা যে কেন গলা টিপে মেরে রেখে যাবে ভেবে উঠতে না পেরে গাঁ-সুদ্ধ লোক যেন অপ্রস্তুত হয়ে রইল৷

বছর দেড়েক মেয়েটা শ্বশুরবাড়ি ছিল, গাঁয়ের লোকের চোখের আড়ালে৷ সেখানে কি এই ভয়ানক অঘটনের ভূমিকা গড়ে উঠেছিল?

দুটো খুনের মধ্যে কি কোনো যোগাযোগ আছে? বিশ-ত্রিশ বছরের মধ্যে গাঁয়ের কেউ তেমনভাবে জখম পর্যন্ত হয়নি, যখন হল পর পর একেবারে খুন হয়ে গেল দুটো! তার একটি পুরুষ, অপরটি যুবতী নারী৷ দুটি খুনের মধ্যে একটা সম্পর্ক আবিষ্কার করার জন্য প্রাণ সকলের ছটফট করে৷ কিন্তু বলাই চক্রবর্তী শুভ্রাকে কবে শুধু চোখের দেখা দেখেছিল তাও গাঁয়ের কেউ মনে করতে পারে না৷ একটুখানি বাস্তব সত্যের খাদের অভাবে নানাজনের কল্পনা ও অনুমানগুলি গুজব হয়ে উঠতে উঠতে মুষড়ে যায়৷

বলাই চক্রবর্তীর সম্পত্তি পেল তার ভাইপো নবীন৷ চল্লিশ টাকার চাকরি ছেড়ে শহর থেকে সপরিবারে গাঁয়ে এসে ক্রমাগত কোঁচার খুঁটে চশমার কাচ মুছতে মুছতে সে পাড়ার লোককে বলতে লাগল, ‘পঞ্চাশ টাকা রিওয়ার্ড ঘোষণা করেছি৷ কাকাকে যারা অমন মার মেরেছে তাদের যদি ফাঁসিকাঠে ঝুলোতে না পারি—’

চশমার কাচের বদলে মাঝে মাঝে কোঁচার খুঁটে সে নিজের চোখও মুছতে লাগল৷

ঠিক একুশ দিন গাঁয়ে বাস করার পর নবীনের স্ত্রী দামিনী সন্ধ্যাবেলা লণ্ঠন হাতে রান্নাঘর থেকে উঠান পার হয়ে শোবার ঘরে যাচ্ছে, কোথা থেকে অতি মৃদু একটু দমকা বাতাস বাড়ির পুব কোণের তেঁতুল গাছের পাতাকে নাড়া দিয়ে তার গায়ে এসে লাগল৷ দামিনীর হাতের লণ্ঠন ছিটকে গিয়ে পড়ল দক্ষিণের ঘরের দাওয়ায়, উঠানে আছড়ে পড়ে হাত-পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে দামিনীর দাঁতে দাঁত লেগে গেল৷ দালানের আনাচে-কানাচে ঝড়ো হাওয়া যেমন গুমরে গুমরে কাঁদে, দামিনী আওয়াজ করতে লাগল সেই রকম৷

শুভ্রার দাদা ধীরেন স্থানীয় স্কুলে মাস্টারি করে৷ গাঁয়ে সে-ই একমাত্র ডাক্তার পাশ-না-করা৷ ফিজিক্সে অনার্স নিয়ে বি.এস.সি. পাস করে সাত বছর গাঁয়ের স্কুলে জিওগ্রাফি পড়াচ্ছে৷ প্রথম দিকে প্রবল উৎসাহের সঙ্গে সাতচল্লিশখানা বই নিয়ে লাইব্রেরি, সাতজন ছেলেকে নিয়ে তরুণ সমিতি, বই পড়ে পড়ে সাধারণ রোগে বিনামূল্যে ডাক্তারি, এইসব আরম্ভ করেছিল৷ গেঁয়ো একটি মেয়েকে বিয়ে করে দু-বছরে চারটি ছেলেমেয়ের জন্ম হওয়ায় এখন অনেকটা ঝিমিয়ে গেছে৷ লাইব্রেরির বইয়ের সংখ্যা তিনশ’তে উঠে থেমে গেছে, তার নিজের সম্পত্তি হিসাবে বইয়ের আলমারি তার বাড়িতেই তালাবন্ধ হয়ে থাকে, চাঁদা কেউ দেয় না, তবে দু-চারজন পড়া-বই আর একবার পড়ার জন্য মাঝে মাঝে চেয়ে নিয়ে যায়৷ বছরে দু-তিনবার তরুণ সমিতির মিটিং হয়৷ চার-আনা আট-আনা ফি নিয়ে এখন সে ডাক্তারি করে, ওষুধও বিক্রি করে৷

ধীরেনকে যখন ডেকে আনা হল, কলসী কলসী জল ঢেলে দামিনীর মূর্ছা ভাঙা হয়েছে৷ কিন্তু সে তাকাচ্ছে অর্থহীন দৃষ্টিতে, আপনমনে হাসছে আর কাঁদছে এবং যারা তাকে ধরে রেখেছিল তাদের আঁচড়ে কামড়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করছে৷

ধীরেন গম্ভীর চিন্তিত মুখে বলল, ‘শা’পুরের কৈলাস ডাক্তারকে একবার ডাকা দরকার৷ আমি চিকিৎসা করতে পারি, তবে কি জানেন, আমি তো পাস করা ডাক্তার নই, দায়িত্ব নিতে ভরসা হচ্ছে না৷’

বুড়ো পঙ্কজ ঘোষাল বলাই চক্রবর্তীর অনুগ্রহে বহুকাল সপরিবারে পরিপুষ্ট হয়েছিলেন, তিনি বললেন, ‘ডাক্তার? ডাক্তার কি হবে? তুমি আমার কথা শোনো বাবা নবীন, কুঞ্জকে অবিলম্বে ডেকে পাঠাও৷’

গাঁয়ের যারা ভিড় করেছিল তারা প্রায় সকলেই বুড়ো ঘোষালের কথায় সায় দিল৷

নবীন জিজ্ঞেস করল, ‘কুঞ্জ কত নেয়?’

ধীরেন বলল, ‘ছি, ওসব দুর্বুদ্ধি কোরো না নবীন৷ আমি বলছি তোমায়, এটা অসুখ, অন্য কিছু নয়৷ লেখাপড়া শিখেছ, জ্ঞান-বুদ্ধি আছে, তুমিও কি বলে কুঞ্জকে চিকিৎসার জন্য ডেকে পাঠাবে?’

নবীন আমতা-আমতা করে বলল, ‘এসব খাপছাড়া অসুখে ওদের চিকিৎসাই ভালো ফল দেয় ভাই৷’

বয়সে নবীন তিন-চার বছরের বড় কিন্তু এককালে দু-জনে একসঙ্গে স্কুলে একই ক্লাসে পাশাপাশি বসে লেখাপড়া করত৷ বোধহয় সেই খাতিরেই কৈলাশ ডাক্তার ও কুঞ্জ মাঝি দু-জনকে আনতেই নবীন লোক পাঠিয়ে দিল৷

কুঞ্জই আগে এল৷ লোক পৌঁছবার আগেই সে খবর পেয়েছিল চক্রবর্তীদের বউকে অন্ধকারের অশরীরী শক্তি আয়ত্ত করেছে৷ কুঞ্জ নামকরা গুণী৷ তার গুণপনা দেখবার লোভে আরো অনেকে এসে ভিড় বাড়িয়ে দিল৷

‘ভরসাঁঝে ভর করেছেন, সহজে ছাড়বেন না৷’

ওই বলে সকলকে ভয় দেখিয়ে সঙ্গে সঙ্গে আবার অভয় দিয়ে কুঞ্জ বলল, ‘তবে ছাড়তে হবেই শেষতক৷ কুঞ্জ মাঝির সাথে তো চালাকি চলবে না৷’

ঘরের দাওয়া থেকে সকলকে উঠানে নামিয়ে দেওয়া হল৷ বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়তে পড়তে কুঞ্জ দাওয়ায় জল ছিটিয়ে দিল৷ দামিনীর এলোচুল শক্ত করে বেঁধে দেওয়া হল দাওয়ার একটা খুঁটির সঙ্গে, দামিনীর না রইল বসবার উপায়, না রইল পালাবার ক্ষমতা৷ তাকে আর কারো ধরে রাখবার প্রয়োজন রইল না৷ নড়তে গিয়ে চুলে টান লাগায় দামিনী আর্তনাদ করে উঠতে লাগল৷

কুঞ্জ টিটকারি দিয়ে দিয়ে বলতে লাগল, ‘রও, বাছাধন রও! এখনি হয়েছে কি! মজাটি টের পাওয়াচ্ছি তোমায়!’

ধীরেন প্রথম দিকে চুপ করে ছিল৷ বাধা দিয়ে লাভ নেই৷ গাঁয়ের লোক কথা শোনে না, বিরক্ত হয়৷ এবার সে আর ধৈর্য ধরতে পারল না৷

‘তুমি কি পাগল হয়ে গেছ, নবীন?’

‘তুমি চুপ করো, ভাই৷’

উঠানে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ জন পুরুষ ও নারী এবং গোটা পাঁচেক লণ্ঠন জড়ো হয়েছে৷ মেয়েদের সংখ্যা খুব কম, যারা এসেছে বয়সও তাদের বেশি৷ কমবয়সী মেয়েরা আসতে সাহস পায়নি, অনুমতিও পায়নি৷ যদি ছোঁয়াচ লাগে, নজর লাগে, অপরাধ হয়! মন্ত্রমুগ্ধের মতো এতগুলি মেয়েপুরুষ দাওয়ার দিকে তাকিয়ে ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে থাকে, এই দুর্লভ রোমাঞ্চ থেকে তাদের বঞ্চিত করার ক্ষমতা নবীনের নেই৷ দাওয়াটি যেন স্টেজ, সেখানে যেন মানুষের জ্ঞানবুদ্ধির অতীত রহস্যকে সহজবোধ্য নাটকের রূপ দিয়ে অভিনয় করা হচ্ছে, ঘরের দুয়ারে কুঞ্জ যেন আমদানি করেছে জীবনের শেষ সীমানার ওপারের ম্যাজিক৷ এমন ঘরোয়া, এমন বাস্তব হয়ে উঠেছে দামিনীর মধ্যে অদেহী ভয়ঙ্করের এই ঘনিষ্ঠ আবির্ভাব! ভয় সকলে ভুলে গেছে৷ শুধু আছে তীব্র উত্তেজনা এবং কৌতূহল-ভরা পরম উপভোগ্য শিহরন৷

এক পা সামনে এগিয়ে, পাশে সরে, পিছু হটে, সামনে পিছনে দুলে দুলে কুঞ্জ দুর্বোধ্য মন্ত্র আওড়াতে থাকে৷ মালসাতে আগুন করে তাতে সে একটি-দুটি শুকনো পাতা আর শিকড় পুড়তে দেয়, চামড়া পোড়ার মতো একটা উৎকট গন্ধে চারিদিক ভরে যায়৷ দামিনীর আর্তনাদ ও ছটফটানি ধীরে ধীরে কমে আসছিল, একসময়ে খুঁটিতে পিঠ ঠেকিয়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে সে বোজা-বোজা চোখে কুঞ্জর দিকে তাকিয়ে নিস্পন্দ হয়ে রইল৷

তখন একটা কাঁচা হলুদ পুড়িয়ে কুঞ্জ তার নাকের কাছে ধরল৷ দামিনীর ঢুকুঢুলু চোখ ধীরে ধীরে বিস্ফারিত হয়ে উঠল৷ সর্বাঙ্গে ঘন ঘন শিহরন বয়ে যেতে লাগল৷

‘কে তুই? বল, তুই কে?’

‘আমি শুভ্রা গো, শুভ্রা৷ আমায় মেরো না৷’

‘চাটুয্যেবাড়ির শুভ্রা? যে খুন হয়েছে?’

‘হ্যাঁ গো হ্যাঁ৷ আমায় মেরো না৷’

নবীন দাওয়ার একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল, তার দিকে মুখ ফিরিয়ে কুঞ্জ বলল, ‘ব্যাপার বুঝলেন কর্তা?’

উঠান থেকে চাপা গলায় বুড়ো ঘোষালের নির্দেশ এল, ‘কে খুন করেছিল, শুধোও না কুঞ্জ? ওহে কুঞ্জ, শুনছো? কে শুভ্রাকে খুন করেছিল শুধিয়ে নাও চট করে!’

কুঞ্জকে কিছু জিজ্ঞেস করতে হল না, দামিনী নিজে থেকেই ফিসফিস করে জানিয়ে দিল, ‘বলাই খুড়ো আমায় খুন করেছে৷’

নানাভাবে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে অনেকবার তাকে প্রশ্ন করা হল কিন্তু দামিনীর মুখ দিয়ে এ ছাড়া আর কোনো জবাব বার হল না যে সে শুভ্রা এবং বলাই তাকে খুন করেছে৷ তারপর একসময় তার মুখ বন্ধ হয়ে গেল, নাকে হলুদপোড়া ধরেও আর তাকে কথা বলানো গেল না৷ কুঞ্জ অন্য একটি প্রক্রিয়ার আয়োজন করছিল কিন্তু কৈলাস ডাক্তার এসে পড়ায় আর সুযোগ পেল না৷ কৈলাসের চেহারাটি জমকালো, প্রকাণ্ড শরীর, একমাথা কাঁচাপাকা চুল, মোটা ভুরু আর মুখময় খোঁচা খোঁচা গোঁফদাড়ি৷ এসে দাঁড়িয়েই ষাঁড়ের মতো গর্জন করতে করতে সে সকলকে গালাগালি দিতে আরম্ভ করল, কুঞ্জর আগুনের মালসা তার দিকেই লাথি মেরে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, ‘দাঁড়া হারামজাদা, তোকে ফাঁসিকাঠে ঝুলোচ্ছি! ওষুধ দিয়ে বউমাকে আজ মেরে ফেলে থানায় তোর নামে রিপোর্ট দেব, তুই খুন করেছিস!’

কৈলাস খুঁটিতে বাঁধা চুল খুলে দামিনীকে ঘরে নিয়ে গিয়ে বলাই-এর দাদামশায়ের আমলের প্রকাণ্ড খাটের বিছানায় শুইয়ে দিল৷ প্যাঁট করে তার বাহুতে ছুঁচ ফুটিয়ে গায়ে ঢুকিয়ে দিল ঘুমের ওষুধ৷

দামিনী কাতরভাবে বলল, ‘আমায় মেরো না গো, মেরো না৷ আমি শুভ্রা৷ চাটুয্যেবাড়ির শুভ্রা৷’

কয়েক মিনিটের মধ্যে সে ঘুমিয়ে পড়ল৷

দামিনীর মুখ দিয়ে শুভ্রা বলাই চক্রবর্তীর নাম করায় অনেক বিশ্বাসীর মনে যে ধাঁধার সৃষ্টি হয়েছিল, বুড়ো ঘোষালের ব্যাখ্যা শুনে সেটা কেটে গেল৷ শুভ্রার তিন দিন আগে বলাই চক্রবর্তী মরে গিয়েছিল সন্দেহ নেই কিন্তু শুধু জ্যান্ত মানুষ কি মানুষের গলা টিপে মারে? আর কিছু মারে না? শ্মশানে-মশানে দিনক্ষণ প্রভৃতির যোগাযোগ ঘটলে পথভোলা পথিকের ঘাড় তবে মাঝে মাঝে মটকে দেয় কিসে!

ব্যাখ্যাটা দেওয়া উচিত ছিল কুঞ্জ গুণীর৷ বুড়ো ঘোষাল আগেই সকলকে শুনিয়ে দেওয়াতে জোর গলায় তাকে সমর্থন করেই নিজের মর্যাদা বাঁচানো ছাড়া তার উপায় রইল না৷ তবে কথাটাকে সে ঘুরিয়ে দিল একটু অন্যভাবে, যার ফলে অবিশ্বাসীর মনে পর্যন্ত খটকা বাঁধা সম্ভব হয়ে উঠল৷ বলাই চক্রবর্তীই শুভ্রাকে খুন করেছে বটে কিন্তু সোজাসুজি নিজে নয়৷ কারণ মরার এক বছরের মধ্যে সেটা কেউ পারে না, ওই সময়ের মধ্যে শ্রাদ্ধ-শান্তি না হলে তবেই সোজাসুজি মানুষের ক্ষতি করার ক্ষমতা জন্মায়৷ বলাই চক্রবর্তী একজনকে ভর করে তার মধ্যস্থতায় শুভ্রাকে খুন করেছে, তার রক্তমাংসের হাত দিয়ে৷

না, যাকে সে ভর করেছিল তার কিছু মনে নেই৷ মনে কি থাকে?

এক রাত্রে অনেক কান ঘুরে পরদিন সকালে এই কথাগুলি ধীরেনের কানে গেল৷ অগ্রহায়ণের উজ্জ্বল মিঠে রোদ তখন চারিদিকে ছড়িয়ে আছে, বর্ষার পরিপুষ্ট গাছে আর আগাছার জঙ্গলে যেন পার্থিব জীবনের ছড়াছড়ি৷ বাড়ির পিছনে ডোবাটি কচুরিপানায় আচ্ছন্ন, গাঢ়-সবুজ অসংখ্য রসালো পাতা, বর্ণনাতীত কোমল রঙের অপরূপ ফল৷ তালগাছের গুঁড়ির ঘাটটি কার্তিক মাসেও প্রায় জলে ডুবে ছিল, এখন জল কমে অর্ধেকের বেশি ভেসে উঠেছে৷ টুকরো বসিয়ে ধাপগুলি এবার ধীরেন বিশেষ করে শুভ্রার জন্য বানিয়ে দিয়েছিল, সাত মাসের গর্ভ নিয়ে ঘাটে উঠতে-নামতে সে যাতে পা পিছলে আছাড় না খায়৷ পাড়ার মানুষ বাড়ি বয়ে গাঁয়ের গুজব শুনিয়ে গেল, আবেষ্টনীর প্রভাবে উদ্ভট কথাগুলি সঙ্গে সঙ্গে ধীরেনের মন থেকে বাতিল হয়ে গেল৷ ক্ষুব্ধ হবার অবসরও সে পেল না৷ ডোবার কোনদিক থেকে কিভাবে কে সেদিন সন্ধ্যায় ঘাটে এসেছিল, কেন এসেছিল, এই পুরানো ভাবনা সে ভাবছিল অনেকক্ষণ থেকে৷ তাই সে ভাবতে লাগল৷ একমাত্র এই ভাবনা তাকে অন্যমনস্ক করে দেয়৷ ক্ষোভ ও বিষাদের তার এত প্রাচুর্য এখন যে মাঝে মাঝে কিছুক্ষণের জন্য অন্যমনস্ক হতে না পারলে তার অসহ্য কষ্ট হয়৷ অন্য কোনো বিষয়ে তার মন বসে না৷

ভাতের থালা সামনে ধরে দিয়ে শান্তি বলল, ‘আমার কিন্তু মনে হয় তাই হবে৷ নইলে—’

কটমট করে তাকিয়ে ধীরেন ধমক দিয়ে বলল, ‘চুপ! যা খুশি মনে হোক তোমার, আমায় কিছু বলবে না৷ খবর্দার!’

স্কুলে যাওয়ার পথে যাদের সঙ্গে দেখা হল, মুখে তারা কিছু বলল না কিন্তু তাদের তাকানোর ভঙ্গি যেন আরো স্পষ্ট জিজ্ঞাসা হয়ে উঠল : কথাটা তুমি কি ভাবে নিয়েছ শুনি? পুরুতঠাকুর তাকে অনেকক্ষণ দাঁড় করিয়ে রেখে দোষ মোচনের জন্য দরকারী ক্রিয়াকর্মের বিষয় আলোচনা করলেন, উপদেশ দিলেন, বিশেষ করে বলে দিলেন যে স্কুল থেকে ফিরবার সময় তাঁর বাড়ি থেকে সে যেন তার নিজের ও বাড়ির সকলের ধারণের জন্য মাদুলি নিয়ে যায়৷ স্কুলে পা দেওয়ার পর থেকে ধীরেনের মনে হতে লাগল, সে যেন বাইরের কোনো বিশিষ্ট অভ্যাগত, স্কুল পরিদর্শন করতে এসেছে, তার সাত বছরের অভ্যস্ত অস্তিত্বকে আজ এক মুহূর্তের জন্য কেউ ভুলতে পারছে না৷

প্রথম ঘণ্টাতেই ক্লাস ছিল৷ অর্ধেক ছেলে আড়ষ্ট হয়ে বসে আছে, বাকি অর্ধেক নিজেদের মধ্যে গুজগাজ ফিসফিস করছে৷ নিজেকে জীবন্ত ব্যঙ্গের মতো মনে হচ্ছিল৷ বইয়ের পাতায় চোখ রেখে ধীরেন পড়তে লাগল৷ চোখ তুলে ছেলেদের দিকে তাকাতে পারল না৷

ঘণ্টা কাবার হতেই হেডমাস্টার ডেকে পাঠালেন৷

‘তুমি একমাসের ছুটি নাও ধীরেন৷’

‘এক মাসের ছুটি?’

‘মথুরবাবু এইমাত্র বলে গেলেন৷ আজ থেকেই ছুটি পাবে, আজ আর তোমার পড়িয়ে কাজ নেই৷’

মথুরবাবু স্কুলের সেক্রেটারি৷ মাইল খানেক পথ হাঁটলেই তাঁর বাড়ি পাওয়া যায়৷ চলতে চলতে মাঝপথে ধীরেনের মাথাটা কেমন ঘুরে উঠল৷ কদিন থেকে হঠাৎ চেতনায় ঝাঁকি লেগে মাথাটা তার এইরকম ঘুরে উঠছে৷ চিন্তা ও অনুভূতির আকস্মিক পরিবর্তনের সঙ্গে এই ঝাঁকি লাগে৷ অথবা এমনি ঝাঁকি লেগে তার চিন্তা ও অনুভূতি বদলে যায়৷

গাছতলায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে সে বাড়ির দিকে পা বাড়াল৷ মথুরবাবু এখন হয়তো খেয়ে-দেয়ে বিশ্রাম করছেন, এখন তাঁকে বিরক্ত করা উচিত হবে না৷ স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়নি, এক মাসের ছুটি দেওয়া হয়েছে৷ একমাসের মধ্যে মথুরবাবুর সঙ্গে দেখা করার অনেক সময় সে পাবে৷ আজ গিয়ে হাতে-পায়ে না ধরাই ভালো৷ মথুরবাবুর যদি দয়া হয়, যদি তিনি বুঝতে পারেন যে তার বোন খুন হয়েছে বলে, দামিনীর ঘোষণার ফলে তার বোনের কাল্পনিক কেলেঙ্কারি নিয়ে চারিদিকে হই-চই হচ্ছে বলে তাকে দোষী করা উচিত নয়, তাহলে মুশকিল হতে পারে৷ ছুটি বাতিল করে কাল থেকে কাজে যাবার অনুমতি হয়তো তিনি দিয়ে বসবেন৷ এতক্ষণ খেয়াল হয়নি, এখন সে বুঝতে পেরেছে, নিয়মিতভাবে প্রতিদিন স্কুলে ছেলেদের পড়ানোর ক্ষমতা তার নেই৷ মথুরবাবুর সামনে গিয়ে দাঁড়াতে লজ্জা হচ্ছে৷ চেনা মানুষের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবার ভয়ে সে মাঠের পথ ধরে বাড়ি চলেছে৷ বাড়ি গিয়ে ঘরের মধ্যে লুকোতে হবে৷ দুর্বল শরীর বিছানায় লুটিয়ে দিয়ে ভারী মাথাটা বালিশে রাখতে হবে৷

সারা দুপুর ঘরের মধ্যে শুয়ে বসে ছটফট করে কাটিয়ে শেষবেলায় ধীরেন উঠানে বেরিয়ে এল৷ মাজা বাসন হাতে নিয়ে শান্তি ঘাট থেকে উঠে আসছিল, ডোবার ধারে প্রকাণ্ড বাঁশঝাড়টার ছায়ায় মানুষের মতো কি যেন একটা নড়াচড়া করছে৷

ধীরেন আর্তনাদ করে উঠল, ‘কে ওখানে? কে?’

শান্তির হাতের বাসন ঝনঝন শব্দে পড়ে গেল৷ উঠিপড়ি করে কাছে ছুটে এসে ভয়ার্ত কণ্ঠে সে জিজ্ঞাসা করল, ‘কোথায় কে? কোনখানে?’

বাঁশঝাড় থেকে চেনা গলার আওয়াজ এল৷—‘আমি, মাস্টারবাবু৷ বাঁশ কাটছি৷’

‘কে তোকে বাঁশ কাটতে বলেছে?’

শান্তি বলল, ‘আমি বলেছি৷ ক্ষেন্তিপিসি বলল, নূতন একটা বাঁশ কেটে আগা মাথা একটু পুড়িয়ে ঘাটের পথে আড়াআড়ি ফেলে রাখতে৷ ভোরে উঠে সরিয়ে দেব, সন্ধের আগে পেতে রাখব৷ তুমি যেন আবার ভুল করে বাঁশটা ডিঙিয়ে যেয়ো না৷’

সন্ধ্যার আগেই শান্তি আজকাল রাঁধাবাড়া আর ঘরকন্নার সব কাজ শেষ করে রাখে৷ অন্ধকার ঘনিয়ে আসার পর ধীরেনকে সঙ্গে না নিয়ে বড় ঘরের চৌকাট পার হয় না৷ ছেলেমেয়েদেরও ঘরের মধ্যে আটকে রাখে৷ সন্ধ্যা থেকে ঘরে বন্দী হয়ে ধীরেন আকাশপাতাল ভাবে আর মাঝে মাঝে সচেতন হয়ে ছেলেমেয়েদের আলাপ শোনে৷

‘ছোটপিসি ভূত হয়েছে৷’

‘ভূত নয়, পেত্নী৷ ব্যাটাছেলে ভূত হয়৷’

ঘরের মধ্যেও কারণে অকারণে শান্তি ভয় পেয়ে আঁতকে ওঠে৷ কাল প্রথম রাত্রে একটা প্যাঁচার ডাক শুনে ধীরেনকে আঁকড়ে ধরে গোঙাতে গোঙাতে বমি করে ফেলেছিল৷

বড় ঘরের দাওয়ার পুব প্রান্তে বসে তামাক টানতে টানতে দিনের আলো ম্লান হয়ে এল৷ এখানে বসে ডোবার ঘাট আর দু-ধারের বাঁশঝাড় ও জঙ্গল দেখা যায়৷ জঙ্গলের পর সেনেদের কলাবাগান৷ সেনেদের কাছারি-ঘরের পাশ দিয়ে দূরে বোসেদের মজা পুকুরের তীরে মরা গজারি গাছটার ডগা চোখে পড়ে৷ অন্ধকার হবার আগেই কুয়াশায় প্রথমে গাছটা, তারপর সেনেদের বাড়ি আবছা হয়ে ঢাকা পড়ে গেল৷

‘তুমি কি আর ঘাটের দিকে যাবে?’ শান্তি জিজ্ঞেস করল৷

‘না৷’

‘তবে বাঁশটা পেতে দাও৷’

‘বাঁশ পাততে হবে না৷’

শান্তি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল৷

‘তোমার চোখ লাল হয়েছে৷ টকটকে লাল৷’

‘হোক৷’

শোবার ঘর আর রান্নাঘরের ভিটের সঙ্গে দুটি প্রান্ত ঠেকিয়ে শান্তি নিজেই বাঁশটা পেতে দিল৷ কাঁচা বাঁশের দু-প্রান্তের খানিকটা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে৷ অশরীরী কোনোকিছু এ বাঁশ ডিঙোতে পারবে না৷ ঘাট থেকে শুভ্রা যদি বাড়ির উঠানে আসতে চায়, এই বাঁশ পর্যন্ত এসে ঠেকে যাবে৷

আলো জ্বালার আগেই ছেলেমেয়েদের খাওয়া শেষ হল৷ সন্ধ্যাদীপ না জ্বেলে শান্তির নিজের খাওয়ার উপায় নেই, ভালো করে সন্ধ্যা হওয়ার আগেই সে তাড়াতাড়ি দীপ জ্বেলে ঘরে ঘরে দেখিয়ে শাঁখে ফুঁ দিল৷ দশ মিনিটের মধ্যে নিজে খেয়ে ধীরেনের ভাত বেড়ে ঢাকা দিয়ে রেখে, রান্নাঘরে তালা দিয়ে, কাপড় ছেড়ে ঘরে গিয়ে ঢুকল৷ বিকালে আজকাল সে মাছ রান্না করে না, এঁটোকাঁটা নাকি অশরীরী আত্মাকে আকর্ষণ করে৷ খাওয়ার হাঙ্গামা খুব সংক্ষেপে, সহজে এবং অল্প সময়ে সম্পন্ন হয়ে যায়৷

‘ঘরে আসবে না?’

‘না৷’

তখনো আকাশ থেকে আলোর শেষ আভাসটুকু মুছে যায়নি৷ দু-তিনটি তারা দেখা দিয়েছে, আরো কয়েকটি দেখা দিতে দিতে আবার হারিয়ে যাচ্ছে৷ আর এক মিনিট কি দু-মিনিটের মধ্যে রাত্রি শুরু হয়ে যাবে৷ জীবিতের সঙ্গে মৃতের সংযোগ স্থাপনের সবচেয়ে প্রশস্ত সময় সন্ধ্যা৷ ভরসন্ধ্যাবেলা শুভ্রা দামিনীকে আশ্রয় করেছিল৷ আজ সন্ধ্যা পার হলে রাত্রি আরম্ভ হয়ে গেলে চেষ্টা করেও শুভ্রা হয়তো তার সঙ্গে কথা বলতে পারবে না৷ আর দেরি না করে এখুনি শুভ্রাকে সুযোগ দেওয়া উচিত৷

চোরের মতো ভিটে থেকে নেমে বাঁশ ডিঙিয়ে ধীরেন পা টিপে টিপে ডোবার মাঠের দিকে এগিয়ে গেল৷

অদ্ভুত বিকৃত গলার ডাক শুনে শান্তি লণ্ঠন হাতে ঘর থেকে বেরিয়ে এল৷ বাঁশের ওপারে দাঁড়িয়ে হিংস্র জন্তুর চাপা গর্জনের মতো গম্ভীর আওয়াজে ধীরেন তার নিজের নাম ধরে ডাকাডাকি করছে৷ গেঞ্জি আর কাপড়ে কাদা ও রক্ত মাখা৷ ঠোঁট থেকে চিবুক বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে৷

‘বাঁশটা সরিয়ে দাও৷’

‘ডিঙিয়ে এসো! বাঁশ ডিঙিয়ে চলে এসো! কি হয়েছে? পড়ে গেছ নাকি?’

‘ডিঙোতে পারছি না৷ বাঁশ সরিয়ে দাও৷’

বাঁশ ডিঙোতে পারছে না! মাটিতে শোয়ানো বাঁশ! শান্তির আর এতটুকু সন্দেহ রইল না৷ আকাশ-চেরা তীক্ষ্ন গলায় সে আর্তনাদের পর আর্তনাদ শুরু করে দিল৷

তারপর প্রতিবেশী এল, পাড়ার লোক এল, গাঁয়ের লোক এল৷ কুঞ্জও এল৷ তিন-চার কলস জল ঢেলে ধীরেনকে স্নান করিয়ে দাওয়ার খুঁটির সঙ্গে তাকে বেঁধে ফেলা হল৷ মন্ত্র পড়ে, জল ছিটিয়ে, মালসার আগুনে পাতা ও শিকড় পুড়িয়ে ঘণ্টাখানেকের চেষ্টায় ধীরেনকে কুঞ্জ নিঝুম করে ফেলল৷

তারপর মালসার আগুনে কাঁচা হলুদ পুড়িয়ে ধীরেনের নাকের কাছে ধরে বজ্রকণ্ঠে সে জিজ্ঞাসা করল, ‘কে তুই? বল তুই কে?’

ধীরেন বলল, ‘আমি বলাই চক্রবর্তী৷ শুভ্রাকে আমি খুন করেছি৷’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *