হলদে গোলাপ – ৩৫

৩৫

কীভাবে শুরু করা যায় দুলাল-উপাখ্যান? উত্তমপুরুষে লেখাই ভাল। “আমি দুলাল, সাইকেল চালাচ্ছিলাম, সাইকেলের হ্যান্ডেল থেকে ঝুলছে শেকলের মতো সেফটিপিন, ক্লিপ, টিপের প্যাকেট। পিছনের ক্যারিয়ারে বাসো রেখেছি কয়েকটা। তার মধ্যে ভাঁজ করা ব্রেসিয়ার রডের দু’পাশে গেরস্থালি। রোদ্দুর লাগছে। মাথায় একটা টুপি থাকলে ভাল হত।’ না, মাথায় টুপি পরার মতো স্মার্টনেস দুলালের নেই। রোদ্দুর লাগবে, তবু টুপি পরার কথা ভাববে না।

‘গাঁয়ের ভিতরে চলে যাই সাইকেল নিয়ে। ঘন্টি মারি। যেসব বাড়ির উঠোনে বড়-বড় ধানের গোলা আছে, সেসব বাড়িতে আমার তেমন খদ্দের নেই। যেসব বাড়ির গোলা ছোট, কিংবা গোলা নেই, গোয়াল ছোট—ওরাই আমার খদ্দের। বড়লোকের বিটিরা আমার কাছ থেকে এসব ‘কমা মাল’ নেয় না।

কমা মালের মহাজন আছে, ওদের থেকে মার্ল নিই। লোশনের নাম ‘লাইকমি’। সবুজ খাপে ‘বোরোনীল’। এক নম্বর মালের নাম ‘বোরোলিন’। কিন্তু ‘বোরোনীল’-এর টিউব-টা কিন্তু ‘বোরোলিন’-এর মতোই দেখতে। এগুলো সব নকল জিনিস। ‘নকল’ জিনিসেই লাভ বেশি।”

কলমটা কামড়ে রাখে অনিকেত। দুলাল কি নিজে বলবে, ওটা ‘নকল’ মাল? তা ছাড়া, ওইসব গাঁ-ঘরের বউ-ঝিদের দেখে ওর পার্সোনালিটি ‘স্প্লিট’ করে এটা তো দুলাল জানে না, কীভাবে ওইসব গাঁয়ের বধূর সঙ্গে ওর ‘সই’-সম্পর্ক হয়, তার ব্যাখ্যাও দুলাল দেবে না। অন্য কেউ একজন তার ব্যাখ্যা দেবে। এভাবেই তো আখ্যান রচিত হয়। সেই বঙ্কিমচন্দ্র থেকেই দেখা গিয়েছে লেখক অন্তর্যামী। রোহিণীর মনের কথাও জানেন, গোবিন্দলালেরও। কখনও অন্দর-মহলে ঢুকে যান, আবার দরজা বন্ধ করে কী গোপন ষড়যন্ত্র হল—বলে দেন সেটাও। লেখক হলেন ঈশ্বর। সর্বত্রগামী। সারা পৃথিবীই এটা মেনে নিয়েছে। সুতরাং উত্তমপুরুষে না- লিখে প্রথমপুরুষে লেখাই ভাল।

দুলাল ‘ঘরগিরক্তি-সাজার জিনিস-ফিতে-কিলিপ-মাথার উকুন-ফরসা হওয়া-আ-আ’ হেঁকে সাইকেলের ঘন্টি বাজায়। দু’টো জিনিসের খুব চাহিদা। মাথার উকুন মারার বিষ আর ফরসা হওয়ার ক্রিম। ওটার নাম ‘ফেয়ার অ্যান্ড লাভিং”। ‘ফেয়ার অ্যান্ড লালি’র মতোই টিউব-টার রং। বউগুলোর কাঁখে বাচ্চা। রান্নাঘর থেকে রান্নার গন্ধ আসছে। দুলাল জিগ্যেস করে, কচুর ফুল চচ্চড়ি করছ না কি গো দিদি?

—হ্যাঁ। ঠিক কয়েছ। খুব আনজাদ আছে দেখি তোমার…।

—আমি কচুর ফুলের চচ্চড়ি খুব খাই, রসুন বেশি করে দিতে হয়। আর কী রান্না হচ্চে দিদি?

—অই তো, একটা কুঁচে মাছ ধরে এনে থুয়ে দিয়ে মাঠে গেল খুকির বাপ। প্যাজ দে করব। তবে তেলের কী দাম। অ্যাইটুকু শিশিতে তেল এনি বলে—সাতদিন চালাতি হবে।

আঙুলে শিশির আকৃতি দেখায় ঘরের বউ।

দুলাল সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরেই কথা বলছিল। এবার উঠোনের একটা কাঁঠাল গাছে ঠেস দিয়ে রাখল।

বলো গো, কার কী লাগবে?

—টকঝাল নজেন আচে?

দুলাল দেখল, ওর পেট-টা বেশ ফুলেছে।

—ছোট খুকি বুঝি? বাপের বাড়ি এয়েচে? দুলাল অনেককেই চিনে গিয়েছে—ছোটর তো একুনো বে হয়নি। এটা মেজোটা।

দুলাল বোঝে, পোয়াতি মেয়ের টকঝাল খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু ছোট সাইকেলটায় এত আইটেম রাখবে কী করে?

ঠিক আছে, এইভাবেই লেখা যাবে। ছাপানোর কথা ভাবছেই না। দুলালের নিরুদ্দিষ্ট জীবনের দশ বছর। আজই শুরু করা উচিত। আর দেরি নয়।

ট্রেনে যেতে-যেতে এই সব ভাবছিল অনিকেত। আজ সোমনাথকে দেখতে পায়নি। একা- একা এসব ভাবতে-ভাবতে যাচ্ছিল। কাশফুল ফুটেছে ইতি-উতি। বর্ষা শেষে বসুন্ধরা সাত মাসের পোয়াতির মতো।

এখন জাহানাবাদি নেই। চলে গিয়েছেন। আগামী কাল বিকেলে মেরিলিন লাকড়া আসবেন। লাকড়া ম্যাডাম বাড়িতে থাকলে একটু অসুবিধেই হয়, কিন্তু কী করা যাবে, কাজ চালাতে গেলে রাখতেই হবে। অন্য লোক তো পাওয়া যাচ্ছে না। ম্যাডাম এলে রান্নাঘরটা ছেড়ে দিতে হয়। উনি ওঁর মতো রান্না করেন। ওর নাকি নানারকম রোগব্যাধি আছে। প্রেশার আছে, গ্যাস-অম্বল আছে, হাল্কা-হাল্কা স্যুপ খান। গলা-ভাত খান। বাইরে আর একটা প্লাগ পয়েন্ট আছে, ওটা ব্যবহার করে অনিকেত। ওখানে হিটারে প্রেশার কুকারটা চাপিয়ে কোনওরকমে চাল-ডাল সেদ্ধ করে নিতে হয়। কিছু সবজি দেওয়া যায়। রাত্তিরে রুটি আর সবজি আনিয়ে নেয়। কখনও কখনও এক কিলোমিটার দূরের একটি হোটেলে গিয়েও রুটি চিবিয়ে আসে। রাত্রের নির্জন পথ মন্দ লাগে না। কখনও শেয়ালের ডাকও শোনা যায়, কিছু- কিছু রাতের পাখির ডাকও। ওসব পাখিদের নাম জানে না। মাথার ওপর জেগে থাকে তারাভরা আকাশ। কলকাতার আকাশে ভাবাই যায় না, এত তারা জ্বলে আকাশে।

যখন অফিসের কাজ চালানোর জন্য হন্যে হয়ে রিটায়ার্ড অফিসার খুঁজছিল অনিকেত, তখন রাঁচির স্টেশন ডিরেক্টর তিন-চারজনের নাম বলেছিলেন। ঠিকানা জোগাড় করে চিঠি দিয়েছিল, শেষ পর্যন্ত এই দু’জনকে পাওয়া গিয়েছে।

মেরিলিন নামটা শুনেই মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিল অনিকেতের। মেরিলিন মনরো-কে নিয়ে। তবে অনিকেতদের কৈশোর-যৌবনে প্রচুর স্বপ্নদাত্রী মুম্বই নায়িকারা এসে গিয়েছিলেন বলে স্বপ্ন অতটা দূরগামী হয়নি। ম্যাডামের সঙ্গে প্রথম দেখা; বড় আশাহত করেছিল অনিকেত-কে। নাকের ওপর দিকটা প্রায় নেই। বাংলায় এঁদের বোঁচা নাক বলে। চোখ ছোট। ঠোঁট পুরু। রং কালো। ইনি ওরাওঁ। ‘লাকড়া’ মানে নেকড়ে। ওরাওঁ-দের অনেক গোত্র হয় পশুপাখির নামে।

জানালেন, ওঁর একটি মেয়ের এমন একটা অসুখ যে মাসে-মাসে অনেক খরচ হয়। স্বামী মারা গিয়েছেন। ছেলেটা পুনে-তে পড়াশোনা করে। ওঁর আর একটি বিধবা বোন আছে। মিশনারি ছিল। নান। চরিত্র ঠিক রাখতে পারেনি বলে চার্চ থেকে বিতাড়িত।

—বিতাড়িত কেন? যিশু ক্ষমা করলেন না?

—কতবার ক্ষমা করবেন যিশু? ম্যাডাম বলেছিলেন। সেই সুকুমারী বোনটিও এখন ওঁর আশ্রিতা। টিউশনি করে। বিহার ইংরেজিতে বেশ উইক। ওঁর বোন ইংরেজির টিউশন করে। যা আয় করে, সেই অনুপাতে টাকা সংসারে দেয় না। নিজের ভবিষ্যতের জন্য জমিয়ে রাখে। আর এদিকে, লাকড়া ম্যাডামের সর্বদা টেনশন, হাই প্রেশার। পেনশন-এর টাকায় সংসার চলে না। তাই এখানে আসা। ক’টাই বা টাকা, তবু এই টাকায় ওষুধের খরচটা যদি উঠে যায়…..।

ম্যাডাম প্রথম দিন এসে সব জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন। অনিকেতের বাড়িতে কে আছে, স্ত্রী চাকরি করে কি না, স্ত্রী কেন এখানে থাকল না ইত্যাদি।

তারপর সহানুভূতিশীল হয়ে বলেছিলেন—আমি যখন এখানে থাকব, যদি স্পেশাল কিছু রান্না করি, আপনাকে বলব। আপনি সেদিন রান্না করবেন না।

—’স্পেশাল’ মানে?

—চিকেন, ফিশ, রুগড়া…।

—রুগড়া-টা কী?

—ও গড, রুগড়া ঈশ্বরের একটা ওয়ান্ডারফুল সৃষ্টি। এটা হয় জঙ্গলে। যে-মাটিতে লোহা থাকে, সেখানে যদি শালপাতা পড়ে, সেই শালপাতা পচে মাটিতে মিশে গেলে, সেখানে এক ধরনের মাশরুম হয়। মাটির তলায় থাকে। দেখতে অনেকটা ছোট-ছোট আলুর মতো। কোথায় রুগড়া আছে, সেটা অভিজ্ঞ ট্রাইবাল-রা বোঝে। মাটি খুঁড়ে বার করে। অপূর্ব স্বাদ। বর্ষার পরই পাওয়া যায়। এই সময়টাতেই পাওয়া যাবে। একবার হাটে গিয়ে দেখব। তোমাকে রুগড়া খাওয়াব।

পরদিনই ম্যাডাম বলেছিলেন, সকালে চিকেন এনেছি, রাতে তুমি হোটেলে খেয়ো না, শুধু রুটি আনিয়ে নিও, চিকেন দিয়ে রুটি খেয়ো। রাত্তিরে চিকেন সাজিয়ে দিয়েছিলেন ম্যাডাম।

অনিকেত খেতে পারল না। মাংসটার ঝোলে জবাকুসুম তেলের গন্ধ।

জবাকুসুম তেল মাখতেন অনিকেতের মা। এই গন্ধটা খুব পরিচিত।

অনিকেত জিগ্যেস করেছিল, কী তেলে রান্না করেছেন ম্যাডাম?

—কেন? সাদা তেল। সানফ্লাওয়ার। আমার একটু হার্টের প্রবলেম আছে। সানফ্লাওয়ার ছাড়া কিছু খাই না।

ব্যাপারটা বুঝতে পারল না—মাংসের ঝোলে কী করে জবাকুসুম তেলের গন্ধ এল? ভুল হওয়ার কথা নয়। জবাকুসুম তেলের রংটা লাল, শিশিও আলাদা।

ব্যাপারটা পরে বোঝা গিয়েছিল। ম্যাডামের একটা অভ্যেস আছে, কিছুক্ষণ পরপরই একটা শিশি থেকে কিছুটা তেল হাতের তালুতে নিয়ে মাথায় থুপে দেন। তেলটার নাম শিরশান্তি। হিন্দিতে লেখা। তেলটার সম্পর্কে আগ্রহ প্রকাশ করাতে—ম্যাডাম বলেছিলেন—এটা একটা আয়ুর্বেদিক তেল। অনেক শক্তিশালী জড়িবুটি আছে। মাথা ঠান্ডা রাখে, প্রেশার কন্ট্রোল করে। বোঝা গেল, ম্যাডাম ওই জড়িবুটিওলা ‘শিরশান্তি’ মাথায় লাগিয়ে, সেই হাতেই মুরগির টুকরোগুলোতে নুন-হলুদ মাখিয়েছিলেন। শক্তিশালী জড়িবুটির গন্ধ ধারণ করেছিল মুরগির বেচারা টুকরোগুলো।

এরপর থেকে আর ‘স্পেশাল আইটেম’ খায়নি অনিকেত।

.

অনিকেত টাটানগরে নেমে একটা শেয়ার ট্যাক্সি পেয়ে গেল। অন্যসময় বাসে যায়। ট্যাক্সিতে অনেক আগেই পৌঁছে গেল। সোমবার। আজ থেকেই লেখাটা শুরু করে দেবে। কোয়ার্টারের দরজায় বাইরের তালাটা নেই। তার মানে, ভিতরে কেউ আছে। তালাটার তিনটে চাবি আছে। একটা নিজের কাছে, একটা জাহানাবাদি-র কাছে, আর একটা মেরিলিন ম্যাডামের কাছে থাকে। দরজাটায় ধাক্কা দিল। ধাক্কা দিতেই দরজাটা খুলে গেল। খুলে যেতেই এক আশ্চর্য, অভাবনীয়, অদৃষ্টপূর্ব, নয়ন-বিদারী, দৃশ্য! অচিন্ত্যনীয়-ও বলা যায়।

একই সঙ্গে সাংঘাতিক এবং ভয়ঙ্কর। যৌনদৃশ্য অথচ যৌনতা উপশমকারী।

ডাইনিং স্পেসে একটা জানালা দিয়ে বাইরের রোদ্দুর আসে।

সেই শারদ রোদ্দুরে, একটা জলচৌকির ওপর বসে, মেরিলিন ম্যাডাম গায়ে কুটোটি না- রেখে, আয়ুর্বেদিক তেল মালিশ করছেন। অনিকেত যখন দরজাটা খুলেছিল, ঠিক সেই সময় উনি উরু অঞ্চলে তেল মালিশ করছিলেন। অনিকেত কী করবে, বুঝতে পারে না। দরজাটা জোর ধাক্কায় অনেকখানি ফাঁক হয়ে গিয়েছিল। শৈশবে একটি ক্যালেন্ডারের খোপে-খোপে নরকের বিভিন্ন দৃশ্য দেখেছিল। ওরকম কোনও দৃশ্য যেন।

ওই সময় কী করা উচিত? তক্ষুনি উল্টো দিকে/মুখ করে চলে যাওয়া? তা হলে তো দরজাটা খোলাই থেকে যাবে। খোলা দরজাটা বন্ধ করতে গেলে আবার কিছুটা সময় যাবে। ‘সময়’ মানে হয়তো তিন সেকেন্ড। কিন্তু এখানে, এই পরিস্থিতিতে, সময়ের হিসেব হয় মাইক্রো-সেকেন্ডে। করণীয় কী, সেই সিদ্ধান্ত নিতেও চলে গেল কয়েক মাইক্রো-সেকেন্ড দরজাটা পুনরায় বন্ধ করে দেওয়াটাই ঠিক মনে হল। বন্ধ করতে গেল। ইতিমধ্যে মেরিলিন মনরো হাত দু’টোকে ডুমুর পাতা করে ঘরের দিকে চলে গেলেন। বলা ভাল, চলে যেতে চেষ্টা করতে লাগলেন, কিঞ্চিৎ ঘুরিয়ে। অনিকেত দরজাটা বন্ধ করে রাস্তায় নেমে গেল ফের গেটের সামনে দাঁড়ানো লোকটা জিগ্যেস করল, কী হল? এই গেলেন, এই ফিরে এলেন? চাবি নেই না কি?

অনিকেত বলল, সিগারেট কিনব। ছিল না একটাও।

সিগারেট কিনতে গেলেও মিনিট দশেক হাঁটতে হয়।

.

মেরিলিনের তো আজ আসার কথা ছিল না, ওর তো আগামী কাল আসার কথা। একদিন আগে চলে এলেন কেন? ঘরে তেল মাখছেন মাখুন। ছিটকিনিটা দেবেন তো। আজকে তো অনিকেত আসবে, এবং এই ট্রেনেই আসবে—সেটা জানা ছিল।

তবে?

কিন্তু যা দেখল, নারীরূপ সম্পর্কে সমস্ত মোহ ভেঙে গেল এই কয়েক মাইক্রো-সেকেন্ডে।

বুদ্ধদেব, মানে রাজপুত্র সিদ্ধার্থ, কি এরকমই কিছু দেখে ফেলেছিলেন সংসার-ত্যাগের প্রাক্কালে? এরই জন্য কত যুদ্ধ, রক্তপাত, হেলেন, ক্লিওপেট্রা, হেমা মালিনী, মাধুরী দীক্ষিত, শুক্লা, মঞ্জু—সবাইকে এই সুযোগে এক সারিতে বসিয়ে দেওয়া গেল।

কালীপুজোয় কালীমূর্তির পাশে ডাকিনী-যোগিনী থাকে। শিল্পীরা কত চেষ্টা করেন মূর্তি দু’টোকে যতটা পারে কুৎসিত তৈরি করতে। গালটা ভেঙে দেয়, দাঁত ভেঙে দেয়, চোখ গোল-গোল করে, স্তন দু’টো ঝুলিয়ে দেয়, চামড়া কুঁচকে দেয়…। মহিলাদের চামড়ার নাম ‘ত্বক’। ত্বক ঢিলা হলে ‘চামড়া’। নারীর শরীর আঁটো, যখনই তা ঢিলা, সংজ্ঞা পাল্টে তিনি হলেন ‘মহিলা’। মহিলাদের এই করুণ অবস্থা হয় চামড়া কুঁচকোলে, স্তন অতি ঢিলা হলে,. দাঁত পড়ে গেলে… ইশ্‍, কী সব হয়।

মোহমুদ্‌গর হয়ে গেল যেন। মনের সব কলুষ ধুয়ে গেল যেন। এই তো নারীশরীর। এর জন্য এত কামড়াকামড়ি, মারামারি, হানাহানি? সাধে কি কামিনীকাঞ্চন সম্পর্কে বিতৃষ্ণ ছিলেন মহাপুরুষগণ?

পৃথিবীর নিয়মই এই। যতদিন সন্তান ধারণ করতে পারে নারী, ততদিনই জীবন। কত ছোট গাছ একবার ফল দিয়েই মরে যায়। কত বড় গাছ আছে, যখন ফল ফলে না, শুকিয়ে মরে যায়। জীবজন্তুরাও তাই। শুধু মানুষই যেন ব্যতিক্রম। মেয়েমানুষদের উর্বরতা শেষ হয়ে যায় পঞ্চাশের পর। এরপরেও বাঁচে। কিন্তু পুরুষের উর্বরতা থেকে যায় আরও বেশ কিছুকাল। কামনাও। তবে পঞ্চাশোর্ধ্ব উর্বর পুরুষ-সমাজের জন্য প্রকৃতির বিধান কী? অন্য কোনও কামশীলা? এসব গূঢ়, গূঢ়তর প্রশ্ন। কিন্তু কোনটা কেন সুন্দর এর জবাব কে দেবে? কেন সবুজ সুন্দর, ঊষর সুন্দর নয়? কেন ফড়িং সুন্দর, আরশোলা সুন্দর নয়? কেন টাইট সুন্দর, লুজ অসুন্দর, উন্নত-স্তনা সুন্দর, কুঞ্চিত-স্কিনা অসুন্দর। তার মানে যতক্ষণ যা কিছু উর্বর, ততক্ষণই তা সুন্দর। কাদের চোখে? উর্বর-কুকুরের চোখে অনুর্বর-কুকুরী অসুন্দর। উর্বর পুরুষ-মানুষের চোখে অনুর্বর-মেয়েমানুষ অসুন্দর। উর্বর-মদ্দা তালগাছটির চোখে অনুর্বর মাদি তালগাছটি…। কুকুরটুকুরও কি চামড়ার কুঞ্চনে, শিথিলতায়, রোম উঠে যাওয়ায় সৌন্দর্য বিচার করে? না কি ওদের যাবতীয় আকর্ষণ ফেরোমোন-এর? শরীর-নির্গত গন্ধে? শরীর উর্বর হলে একটা গন্ধ বেরয়…

এসব উল্টোপাল্টা ভাবা মানে সময় পার করা। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল, কখন শুনতে পাবে—”প্লিজ কাম ইন ব্যানার্জি, কিন্তু কিছু বলছেন না। ম্যাডাম লজ্জা পেয়েছেন।

আরও কিছুক্ষণ আকাশ-গাছ-পাখি-পাউরুটির ঠোঙা-মরা-আরশোলা দেখে টেখে দরজায় টোকা মারল। কয়েকবার টোকা মারার পর ম্যাডাম কণ্ঠে শুনল—ইয়েস, ডোর ইজ ওপেন…। অনিকেত ঢুকল।

ম্যাডাম ম্যাক্সি-ট্যাক্সি পরে নিয়েছেন। অনিকেত বলল, সরি।

ম্যাডাম বলল, হোয়াই ইউ, আই অ্যাম সরি। বলার সময় ম্যাডাম কেমন মাথা নিচু করলেন? নতুন বউয়ের গলায় দাগ দেখে বড়-জা যেমন বলে, ‘আঁচলে গলা ঢেকে রাখ, দাগ পড়েছে’ এবং সেটা শুনে নতুন বউ যেভাবে মাথা নিচু করে সরমে—সেরকম ভাব কতকটা।

ম্যাডাম ম্যাসি খুঁটছেন। কী করবেন, আঁচল নেই তো—আঙুলে জড়াবেন কী?

ম্যাডাম আবার বললেন—আগামী কাল সাউথ বিহারে বন্ধ ডাকা হয়েছে। তাই আপনার তকলিফ হবে ভেবে আজই চলে এসেছি। এখন তো ঝাড়খণ্ডের দাবিতে হঠাৎ-হঠাৎ বন্ধ হচ্ছে।

অনিকেত বলল, ভালই করেছেন। তবে ছিটকিনিটা লাগাবেন তো…

ম্যাডাম বললেন, কী করব বলুন, দু’হাতেই ফ্রোজেন সোলডার। হাত ওঠাতে পারি না।

যাক কে যাক। শুভ কর্মানুষ্ঠানের আগে দধি, ধেনু, মধু এসব দেখার বিধান আছে। এই লোল, কুঞ্চিত, নিরাবরণা নিরাভরণাকে দেখে মোহমুদ্‌গরিত হয়ে লেখাটা শুরু করা যাক। অফিসে যাওয়ার আগে, ক’টা লাইন অন্তত লিখে যাবে।

.

দুলাল সাইকেলে যাচ্ছে। রাস্তায় পিচ কবে কখনও পড়েছিল। এখন স্মৃতি। এবড়োখেবড়ো রাস্তা। কাছেই গ্রাম। গ্রাম যে কাছেই, তার প্রমাণ হল রাস্তার ধারের মোটা গাছের গায়ে আলকাতরায় লেখা ‘গদাধর মল্লিককে ভোট দিন।’ আর একটু এগিয়ে রাস্তাটায় বাঁক নিতে গিয়ে দেখল, একটু দূরে একদল মেয়ে। রাস্তায় একটা মেয়ে বসে আছে, হাত দু’টো একটু পিছনে দিয়ে শাড়ি উঠিয়ে বসে আছে। নিশ্চয়ই হিসি করছে। ও সাইকেলটা থামাল। হিসিরত কোনও মহিলার পাশ দিয়ে সাইকেলে চড়ে যাওয়াটা উচিত নয়। একটু পরই মেয়েটা উঠে দাঁড়াল, দাঁড়িয়ে হাততালি দিল। এই শব্দটা দুলালের কাছেও এল। শব্দটা তো ‘ঠিকরি’-র মতো। হিজড়েদের তালির শব্দ। দুলালও চেষ্টা করেছে ওরকম শব্দে তালি দিতে। এমনিই দেখেছে, ও পারে কি না। অনেকটাই পারে। কিন্তু ওদের মতো ‘ঠিকরি’ দেয় না। নিজেকে ওদের সঙ্গে একাত্ম করতে চায় না। তবু একা থাকলে, তালি দিয়ে মেপে নিয়েছে ওদের মতো হয় কি না।

সামনে যারা যাচ্ছে, বোঝাই যাচ্ছে : ওরা কারা। হাঁটা দেখেই বোঝা যায়। ওদের সঙ্গে এর আগেও কয়েকবার কথা হয়েছে বাজারে। সবজি-মাংতি করতে আসা ওদের ক’জনের সঙ্গে গল্পগাছাও হয়েছিল। ওখানেই প্রথম ‘নুনে নুন’ শব্দটা শোনে। এর মানে হল, ‘তুমি আমাদেরই লোক।’

জিগ্যেস করেছিল, ঘরে বউমাগ আছে কি না, ছানা-পোনা আছে কি না। জিগ্যেস করেছিল, বসে মোতো, না দাঁড়িয়ে? দুলাল লাজুক হেসে বলেছিল, দাঁড়িয়ে।

আসলে ওরা বাচ্চা নাচাতে এসেছিল এদিকে। ফেরার সময় হাতের কাছে একটা বাজার পেয়ে কিছু বিনি-মাগনার বাজার নিয়ে যাচ্ছে।

ওদের দেখে বেশ লাগত।

ওদের কখনও মুখ-ব্যাজার দেখেনি। হাসছে, লাফাচ্ছে, ঠাট্টা-ইয়ার্কি করছে, কচুরি-জিলিপি খাচ্ছে। ওদের তো সুখ-দুঃখের কথা বলার সঙ্গী আছে। দুলালের কেউ নেই। কার সঙ্গে বলবে? বউয়ের সঙ্গে কি বউয়ের বিরুদ্ধে কথা বলা যায়? এক আছে বদু। বদরুদ্দিন মণ্ডল। বদু যখন দুলালের কথা শুনতে-শুনতে দুলালকে কাছে টেনে নেয়, দুলালের ভাল লাগে। ওকে সঙ্গী মনে হয়। দুলালের কাঁধে হাত রাখলেও, ভাল লাগে। মনে হয়, বদু-র সঙ্গে একসঙ্গে থেকে যায়।

চাইলেই হবে? বদু মোসোলমান। বদুর বউ আছে। বদুর সঙ্গে দুলালের যা হয়, বদু ভাবে, এসব ঠিক নয়। গুনাহ হচ্ছে। অনেকরকম নেকি-র কাজ করে, পুণ্য করে—এসব মেকআপ করতে হবে। বিয়ের পরপরই বদু বেশি করে এসব বলত, কিন্তু ওর বিয়ের আগে তো বলেনি।

দুলাল জানত, ওরা মেয়েছেলে নয়। কিন্তু অনেক আগে জানত, ভগবান ওদের মেয়ে করতে-করতেও পুরো মেয়ে করেনি। কিন্তু অনেক বড় হয়ে জেনেছিল—কাপড়-চোপড় খুলে দিলে ওদের দেখে ব্যাটাছেলেই মনে হবে।

আস্তে-আস্তে সাইকেল চালাচ্ছে দুলাল। খানাখন্দে সাইকেলের চাকা লাফাচ্ছে। ঝুমুর ঝুম শব্দ হচ্ছে। ক্যারিয়ারে বসানো টিনের বাক্সটা থেকে কাচের চুরির শব্দ, সেফটিপিনগুলোর সমবেত শব্দ, মাথার চুলের ক্লিপ ও কাঁটার শব্দ মিলে গিয়ে ঝুমুর-ঝুম শব্দে মেয়েলি আহ্লাদ। ওরই মধ্যে মিশে আছে না-গাওয়া গান।

অনিকেত লিখছে। কবে কোন বাঁকুড়ার গ্রামে ‘জেলা প্রোগ্রাম’ রেকর্ড করতে গিয়ে শোনা একটা গানের কথা মনে এল—

আমায় তুমি দাও গো কিনে
রুপো বাঁধানো চিরুনি
বউবাজারের মটরমালা
লালবাজারের হারমনি
হারমনি না দিলে পরে
বাপ ঘর যাব এখুনি
বাপের ঘরে গেলে পরে
কে মিটাবে জ্বলুনি?

ওই গানটাকে বেশ লাগিয়ে দিল অনিকেত। লিখল, ওই টিনের বাক্সের ভিতরে না-গাওয়া ওই সব গান। তারপর গানটাকে ‘ফিট’ করে দিল।

—হ্যাগো, ও মিনসে, ড্যাড়াও দেখি, কী রয়েছে সাইকিলে?

ওদের একজন হাত-ঝামটা দিয়ে বলল।

সাইকেল থামিয়ে, দুই হ্যান্ডেলে হাত দিয়ে দাঁড় করাল।

একজন দুলালের মুখের দিকে তাকাল। বলল, চেনা মুখখানা লাগচে? তুমি সেই বেগুনটা না?

আর একজন বলল, মুলোটা।

ওদের একজনের নাম ‘হাসি’।

দুলালের সঙ্গে তো ওরই গল্প হয়েছিল আগে।

দুলাল বলল, হ্যাগো দিদি, বেগুন-টেগুন। ছেড়ে দিইচি। ·

–কেন গা? বেগুন টিপে-টিপে কি হাতে কড়া পড়ে গেল নাকি?

–না গো। যেন লজ্জা পেল দুলাল।

কী বলবে বুঝতে না-পেরে বলল—বেগুন তো পোকা।

–বারে বোকা ধুরি। তোমার বউয়ের পেটেও তো গু।

নার্ভাস দুলাল বলল, ওই জন্যই তো…।

—ওই জন্যই তো কী?

—যাই না।

—নাঙা বাবা হয়ে গঙ্গাসাগর যা-না তবে।

একটু ফিক করে হাসল দুলাল।

হাসি বলল, এই যে দ্যাখো, আমার বডি-টা ভাল করে দ্যাকো। নীল শাড়ি পরিচি, বেগনে বেলাউজ। কপালের ওরম ম্যাচ করা টিপ বার কর দেখি, অনেকরকম টিপের পাতা তো রেকেচো। আর চুড়ি আচে?

—আচে, আচে।

–কাচের না পেলাস্টিক?

–কাচ-প্লাস্টিক সবরকম

—তারপর কাচের চুড়ি দিও। নিজে হাতে পরিয়ে দিও, ক্যামোন?

দুলাল বলে, থালে তো পশরা সাজাতে হয়। সামনের গাছ তলে চল।

সামনে ছিল একটা শিরীষ গাছ। গ্রাম্য রাস্তায় এই ধরনের বড় গাছ খুব একটা থাকে না আজকাল। চুরি হয়ে যায়। ওই গাছটার গায়ে অনেক টিনের পাতে অনেক কিছু লেখা। খান জাহান পিরের খাদেম আসিফ আলির আশ্চর্য মাদুলি, গোবৈদ্য তারিণী মণ্ডল। মানুষের চিকিৎসাও করা হয়। ব্যাংক লোন, কৃষি লোন, বৃদ্ধ ভাতা ইত্যাদি কাজ করিয়া থাকি।

ওখানে জড়ো হল।

–এই যে চুড়ি।

–এই যে টিপ।

—এই যে সোনো।

হাসি বলল, নীল চুড়ি হাতে পরিয়ে দাও। ও উবু হয়ে বসেছে। মাটিতে লেপ্টে বসেনি। একটা হাত বাড়িয়ে দেয় হাসি দুলালের দিকে।

দুলাল হাতটা চেপে ধরে।

দুলালের হাতের ভাষা কি পড়তে পারল হাসি?

হাসি, ওর আর একটা হাত দিয়ে দুলালের কাঁধে দু’বার আঙুলের চাপ দিল। এবং আঙুলগুলো নাড়াল, এবং ওই আঙুলের খেলায় দুলালের গায়ে তবলার বোল বেজে উঠল। আমিও আছি তুমিও আছো। তোমার জন্য আমি তো আছি।

চুড়ি হল। টিপ হল। ছোট্ট আয়নাটা বের করে দিল দুলাল।

হাসি খুশি হল।

আর খুশি হল বলেই যেন জিভ-টা বের করে দু’বার নাচিয়ে একটা শব্দ করল—ই-ই-ই-ই।

বুঝল খুশি হয়েছে।

একজন বলল, দ্যাখ না, ওয়াড়টার পিছনের হুক খুলে পড়ে গিয়েছে। হুক আছে। সেলাই করে দিতে পারবি।

দুলাল মাথা নাড়ায়।

—তবে সেপটিনি লাগিয়ে দে।

দুলাল বলে, একটা খুচরো সেপটিনি বিক্রি করি না। একপাতা নিতে হবে।

–একপাতা নিয়ে কী করব? দু’টো দিয়ে নাক, দু’টো দিয়ে চোখ, আর একটা দিয়ে নাক আটকাব না কি?

দুলাল বলে, ঠিক আছে, একটা দিচ্ছি, পয়সা লাগবে না।

ও বলল, তবে লাগিয়ে দাও—আমার পেছনে কি চোখ আছে? দুলালের সামনে পিছন ফিরে দাঁড়ায়।

দুলাল দ্যাখে, ব্লাউজের একটা হুক ছেঁড়া। ফাঁক হয়ে আছে। ঘামে ভেজা ব্লাউজ। ভিতরের সাদা ফিতে দেখা যাচ্ছে। ও সেপ্‌টিপিন-টা দিয়ে আটকে দেয়। কায়দা করে সেপটিপিন-টা এমনভাবে লাগায় যেন বাইরে থেকে বোঝা না যায়। ও পিছনে হাত চালিয়ে সেফটিপিনের অবস্থানটা দেখে খুশি হয়ে দুলালের থুতনি নাড়িয়ে দেয়।

আর কী-কী আছে দেখি?

ডালা খুলে দেয় দুলাল। ওরা টাকা দিল। পঁচিশ টাকার বিক্রি হয়ে গেল ওখানে বসেই।

তারপর ওরা ওঠে। দুলালও ওদের সঙ্গে-সঙ্গে যায়। সাইকেলে বসে না। হাঁটিয়ে নেয়।

একজন জিগ্যেস করে, তোমার নাম কী গো?

দুলাল নাম বলে।

—ও বলে আমার নাম, চাত্তারা।

অন্য একজন শুধরে দেয়। চাঁদতারা।

চাত্তারা বলে, তুমি কোতি?

‘কোতি’ মানেটা ঠিকঠাক জানে না দুলাল, আন্দাজ করতে পারে। কথাটা শুনেছে আগে এক নাপিতের কাছে। মেয়েদের হাবভাব-সম্পন্ন ব্যাটাছেলে/বোঝাচ্ছে। দুলাল মাথা নাড়ায়। চাঁদতারা বলে, নিজেকে ‘কড়ি’ করে রাখো কেন গা?

মানে না-বুঝে তাকায়।

একজন বলে—নুইকে রাখো তুমি। নিজেকে নুইকে রাখো।

মনে সুখ আছে? একজন দুলালকে জিগ্যেস করে।

চাত্তারা বলে, সুখ কী লো? কাকে বলে সুখ? সুখ হল গে মুরগির কচিকচি ছ্যানা। মায়ের শরীলের ওম-এ ওদের জম্মো। পায়ের পাশে-পাশে গুটি-গুটি সুখ হাঁটে। সুখের মালিক উল্টো করে সাইকেলে ঝুলিয়ে হাটে গিয়ে বেচে আসে। সুখের মাংস খেয়ে তখন অন্যের সুখ হয়

দুলাল বলে, তবে কি এ দুনিয়ায় সুখ নেই?

একজন বলল, সুখ স্বপনে শান্তি শ্মশানে।

একজন বলল, সুখ মাইরি, আজব চিজ। আচে বললে আচে, নেই বললে নেই। একজন গেয়ে উঠল—সুখ পুকুরে নাইতে গেলাম, নেয়ে এয়েচি। কত ডুব দিলাম তবু বড়ি ভেজেনি। সবাই ‘ঠিকরি’ দিয়ে উঠল।

ওদের মনে কত আনন্দ। দুলাল ভাবে। ওরা কতটা হাঁটছে, একসঙ্গে। গল্প করে। একসঙ্গেই খায়। যদি কাঁদে, একসঙ্গেই। দশে মিলি করি কাজ, হারি-জিতি নাহি লাজ।

কোথায় থাকো তোমরা? দুলাল জিগ্যেস করে

হাসি বলে, আমাদের পারমেন খোল অনেক দূর। পানাগড়। বড় গুরুমার একটা বড় ‘চেলি’ থাকে কসবায়। আমরা এখন ওখান থেকে ‘ছল্লা’ করছি।

টেম্পোরালি ঠেক-কে বলে ‘আটপুর’। এখন কসবার আটপুরে-তে আছে।

যেতে-যেতে কত কথা হল। ওর বউয়ের কথা হল। সন্তোষ মহাজন ওর বউয়ের কাছে আসে, সেই দুঃখের কথা জানাল। ওর যে দু-একটা পারিক আছে, সেটাও গোপন করল না। চাত্তারা বলল—আমাদের সঙ্গে ঠিপে যা। সবার কথাই ভাব। দ্যানা, তোর চিটিধারী বউ যদি কোনও আকখাট মদ্দর সঙ্গে ধুরপিট্টি চায়, তাতে তুই কেন কাঁটা হবি? ওকে ওর মতো চলতে দে, তুই তোর মতো চল। ভিড়ে যা এখানে। একই তো কতা। এখনও ঘুরচিস, পরেও ঘুরবি। সবার আগে পেট। পেটের তলা সেকেন—থার্ড। আমরা কিন্তু হেবি মস্তিতে থাকি। ছল্লায় যাই, ছমকাই, ছেমো-ছেনালি করি। বিলকুল ছক্কা লাইফ।

দুলালের বাড়িতে দুলাল যা বলেছিল, পুরোটা বসিয়ে দিল অনিকেত। এবার একটা গান বসিয়ে দিলে ভাল হয়। একটা জুতসই গান ভাবতে থাকে অনিকেত।

৩৬

দুলাল সাইকেলটাকে হাঁটিয়ে ওদের সঙ্গে-সঙ্গে গেল। গ্রামটা আসতেই ওদের তালি বেড়ে গেল। ইতিমধ্যে কয়েকজনের নাম জানতে পেরেছে দুলাল। হাসি, চাত্তারা, ফুলি, চামেলি। ওদের আসল নাম জানতে চাইল দুলাল। চাত্তারা বলল, সন্ন্যেসীরা কি ওদের পূর্বাশ্রমের নাম বলে?

এই লাইনটা লিখেই অনিকেত কেটে দিল। ওদের মুখে ‘পূর্বাশ্রম’ শব্দটা মানায় না। এবার লিখল, ফেলে আসা জেবনের নাম-ধাম-কাম জানতে চেও না বাপু

ফুলির গলায় ঢোল ঝুলছে, চাত্তারা-র কাঁধে একটা ব্যাগ। ব্যাগের ভিতর থেকে ঠুনঠুন শব্দ হচ্ছে। ওখানে কত্তাল আছে। একজন বলল, কাচ্চাবাচ্চার আকাল। এখন এই লাল তেকোণের ঠ্যালায় আমাদের রোজগারপাতি কমে গিয়েছে, জানলে…। গরমেন বিনি পয়সায় বাচ্চা বন্ধ করার অপরেশন করিয়ে দিচ্চে, আবার অপরেশন করালে লগদা ঝলকি দিচ্চে। পয়দা বন্ধ, গয়দা তো বন্ধ করেনি বাপু। গয়দা বলার সময় আঙুলের মুদ্রায় ব্যাপারটা বোঝাল।

গুরুমা-র ব্যাগে একটা ডায়রি আছে। ওটা হাসিকে দিয়ে বলল—পড় দেখি। হাসি পড়ল—রেবা প্রামাণিক, স্বামী সুরেন প্রামাণিক, সুচপুর, টোনা। অণিমা নন্দী, স্বামী তরুণ নন্দী, সুচপুর, টোনা। জবা গায়েন, স্বামী সনাতন গায়েন, কদমগাছি, টুনি।

একজন বলল, দেখবি ওই নন্দী বাড়িতেই ঝামেলি হবে। নামটা দ্যাখ না, অণিমা। ঠুংঠাং বাড়ির বউ। ওসব বাড়ি খুব ভেল করে।

হাসপাতালের খাতাপত্তর থেকে এসব নাম-ধাম ওরা জোগাড় করে। দশ-বিশ টাকা পান খাবার জন্য দিতে হয়। বাচ্চা হওয়ার পর বেশির ভাগ বউরা বাপের বাড়িতে থাকে। খাতায় বাপের বাড়ির ঠিকানা কমই থাকে, শ্বশুরবাড়ির ঠিকানাই দেয়। সেই ঠিকানায় গিয়ে শোনে, বাচ্চা মামার বাড়ি। মামার বাড়ির ঠিকানা দিতে চায় না। এ জন্য মাস ছয় পরে যায়। মুখেভাত- টা শ্বশুরঘরেই হয় কিনা।

বলছিল, আগে এত ঝামেলি ছিল না। মানুষের ধম্মো ছিল। ওরা ভাবত হিজড়ের কোলে বাচ্চা গেলে বাচ্চার ফাঁড়া কাটে, ভূত-জিনে নজর লাগা কেটে যায়। কেন ভাবত জানো? বিষে বিষে বিষক্ষয়। বাচ্চাদের কপালে কালো টিপ পরিয়ে দেয়, কখনও কান ফুড়ে খুঁতো করে দেয়, তখন নজর লাগে না। হিজড়ের কোলে গেলেও জিন-ভূত পালায়। হিজড়ে কোলে নিলে পুত, ছেড়ে যায় জিন-ভূত। এখন আর ওসবে বিশ্বাস নেই। আমাদের পোঁদে লাগে অনেকে। আরে, আমাদেরও খেতে হবে তো, আমাদের ভাতার চাগরি করে বিকেলে হাতে প্যাকিট ধরিয়ে তো বলবে না, ওগো, তোমার জন্য বিরিয়েনি এনিচি, খাও। যারা আমাদের দেখে মুখ করে, ওদের সুখ করে খিস্তি দিই। খিস্তি দিয়ে বড় সুখ।

অন্য একজন বলল, যদি যায় বিগড়ে, বিলা করে হিজড়ে।

হাসি বলল, একবার কি হয়েছিল জানো? একটা কৈবর্ত বাড়ি গিয়েছি। তিন টুনির পর টোনা হয়েছে। খুব খিঁচে নেব ভেবেছি। ওরা বলল, বাচ্চা এখানে নেইকো, মামাঘর। মামাঘর বহুত দূর। অন্য জেলায়, সেটা আমাদের হাতে নেই। আমরা জানি ওকেনেই আচে, পাকা খবর ছেল। ঘরে ঢুকে গেছি, বাচ্চা নেই, এমন সময় বাচ্চা কেঁদে উঠল ধান গোলার তলা থেকে। আমরা আসছি দেখে ধানগোলার তলায় নুইকে রেকেছিল। যখন বার করল, ওর হাতে-মুখে রক্ত। সাপে কাটলে মুকে কাটে না। ইঁদুরে কেটেছিল। ধাড়ি ইঁদুর হবে। বাড়িতে তখন ব্যাটাছেলে ছিল না কোনও। এই আমাদের ফুলি বাচ্চা কোলে নিয়ে ছুটল হাসপাতাল। বাড়ির ব্যাটাছেলেরা খবর পেয়ে পরে এল। এর মধ্যেই একটা সুঁই পড়ে গেল বলে বাচ্চাটা বেঁচে গেল।

ঢোল বাজাতে বাজাতে প্রামাণিক বাড়ি ঢুকল। ব্যাটাছেলেরা খেয়ে-দেয়ে আঁচাচ্ছিল উঠোনে। ফুলি ঢোল বাজাতে লাগল, হাসি গাইতে শুরু করে দিল।

প্রামাণিকের ঘরে এবার মানিক এসেচে
রেবা দিদি শিব ঠাকুরের বর পেয়েছে।
দাও দেখি, ছেল্যা দাও, কোলে করি
রোগ ব্যাধি বিপদ আপদ জিন ভূত দূর করি।

একটা ব্যাটাছেলে বাবলা গাছের একটা মোটা কাঁটা ভেঙে নিয়ে দাঁত খোঁচাতে-খোঁচাতে হেঁকে বলল—ওদের তাড়াতাড়ি বিদেয় করো। বোধহয় বাড়ির কর্তা। একটা বউ কাঁথায় জড়ানো একটা বাচ্চাকে নিয়ে আসতেই চাত্তারা ওকে প্রায় কেড়ে নিল।

মাথায় হাত বুলোল, নুনুতে ছোট্ট একটা চুমো খেয়ে ফুঁ দিল। বলল, যা করে দিলাম না, ওর বউ এলে বুঝবে। রেবা প্রামাণিকের বয়স বছর কুড়ি হবে। কচি মুখ। জিগ্যেস করল, পেরথম পোয়াতি? মাথা নাড়ল বউ। ওর চিবুক ধরে চাত্তারা বলল, রাজপুত্তুর বিইয়েছ গো। এবার বাচ্চাটা কোলে নিয়ে নাচাতে লাগল, ওর ব্যাগের কত্তালটা অন্য কেউ বাজাচ্ছিল, আর ফুলি ঢোল বাজাচ্ছিল—আর গান গাইছিল

মাটিতে চাঁদের উদয় হল রে হল
আকাশ থেকে ফুলের বিষ্টি হল রে হল
মায়ের কোলে সোনামণি এল রে এল
টোনার গায়ের বালাই যত গেল রে গেল।

এবার অ দিদিরা, এসো গো, বিদায় দাও গো…হিলি হিলি বিদায় দাও। পান-সুপুরি, সোনার গয়না, পাঁচপো চালের মূল্য ধরে দাও, আর পাঁচশো এক টাকা বকশিশ।

ব্যাটাছেলেটা খেঁকিয়ে ওঠে। সোনার গয়না? নিজের মেয়ের বে’তে সোনা দিতে পাল্লুম না, তোমাদের দেব?

—তা হলে, এক টুকরো গোটা হলুদ দিয়ে দাও। সোনার বদলে কাঁচা হলুদ চলে। শাস্তরে আছে, নইলে গোটা। কিন্তু বকশিস কিছু কম হবে না।

—এজন্য তোমাদের তাড়িয়ে দেয় লোকে। পাঁচশো টাকা? বলো কী?

–এই ছেলে বড় হয়ে অনেক হাজার রোজগার করবে। টেস্কি করে বাপ-মা’কে চিড়েখানা ঘোরাবে। খুশি করে দাও, দিল দিয়ে আশীর্বাদ করব।

—পঞ্চাশ টাকা দেব, ব্যস।

—পঞ্চাশ? কী বলছ গা? এই দ্যাকো দাদুর কতা শুনে নাতি হাসছে। ও সোনামণি, ওদের কয়ে দাও, কয়ে দাও…

বাচ্চার গায়ে একটু সুড়সুড়ি দেয় চাত্তারা, বাচ্চাটার মুখ দিয়ে একটা শব্দ বের হয়। চাত্তারা বলে—অই শোনো, সোনার চাঁদ কইছে, দিয়ে দাও, দিয়ে দাও। দিলে আবার আসবে। সৎপাত্রে দান বাড়ায় ধন-মান। উঠানে বাড়ির বাচ্চাকাচ্চারা জড়ো হয়েছে। আরও একটা বউ। ছেলের মা কোনও কতা কইছে না, বাড়ির বড় গিন্নি বলল—বড় খোকার সোময় একান্ন ট্যাকা দিয়েছিনু।

—সে কইলে হয়? প্যাজ ছিল ছ’টাকা কিলো এখন বিশ। একটা গামছা কিনতে বাপু পঞ্চাশ বেইরে যায়।

এভাবে দরদরাদরি করে ১৫১ টাকা নগদে রফা হল, এছাড়া পাঁচপো চালের দাম কুড়ি টাকা। সব শেষে ওরা বলল, এবার শাড়ি দাও।

–শাড়ির কথা তো হয়নি….

—ছেলে হয়েছে শাড়ি তো পাওনা, শাস্তরে আছে। ওরা বলছে মাপ করো দিদি, আমাদের অবস্থাও ভাল নয়। ঘরে কোনও নতুন শাড়ি নেই, কুড়িয়ে বাড়িয়ে ১৭০ টাকা দেওয়ার পর ঘরে কোনও পয়সাও থাকবে না।

দুলি বলে, শাড়ি চাই না, একটা ম্যাক্সির দাম দাও। পরার কিছু তো তোমরাই দেবে। নইলে কি উদোম থাকব নাকি? বলে দু’হাতে শাড়ির দু’প্রান্ত তুলে ওঠাতে গেল। হাঁটুর কিছুটা ওপরে উঠিয়ে শাড়িটা ধরে বলল, কী করবে বলো। চল্লিশ ট্যাকায় একটা ম্যাক্সি হয়ে যাবে।

ছেলের মা বলল, ঘরে একটা আচে। এনি দিইছিল, পরিনি। ওটা দিয়ে দিচ্ছি।

তাই হল। ওরা খুব আশীর্বাদ করল। ঢোল বাজিয়ে দিল ডুমুডুমু ডুমুডুমু। আনন্দের উচ্ছ্বাস। হাতে-হাতে ঠিকরি তালি।

ওই আনন্দের ছটা যেন দুলালেও লেগেছে। তালি দিয়ে ফ্যালে, ওদের মতো ফটাং-ফটাং শব্দ অবশ্য হয় না।

গান শুরু হয়—

খেলা থেকে কেষ্ট সোনা ফিরে এসেছে
খেলতে গিয়ে নরম পায়ে কাঁটা ফুটেছে
ছেলে কষ্ট পেয়েছে।
কেষ্ট ঠাকুর কদম ডালে উঠে বসিল
গোপীদিগের শাড়ি, বেলাউজ গাছে ঝুলাইল
ছেলে রগড় দেখিছে…

—আর একটু রসের গান হবে না কি গো…?

বাড়ির কর্তা বলে, থাক, থাক। খুব হয়েচে।

ওরা মায়ের হাতে ছেলেকে দিয়ে বলল—ছেলে তোমার পালোয়ান হোক, কলকলানো নাগর হোক, ছেলের জম্মু লিম হোক, আমার যত বাল আছে তত পেরমায়ু হোক।

ওরা বেরিয়ে যেতেই দুলাল সাইকেলের কিড়িং দিল। সোনো-পাউডার-ফিতে-কিলিপ- লেলপালিশ-টিপ-দুল চুড়ি-ই-ই।

একটা বালিকা এগিয়ে এল।

ওর মা বলল, চলে আয় বড় খুকি। কিচ্ছু লিতে হবেনে। বড় খুকি তবু আসে না। রুপো রঙের নেল পালিশ আছে? দুলাল বলে আছে। সোনা রং, রুপো রং, লাল নীল চকলেট রং সব আছে। বাক্সের ডালা খোলে। নতুন বাচ্চার মা ছেলে ঘরে রেখে এগিয়ে আসে। বলে, ভাল নিপুল আছে, নিপুল, রবাটের?

দুলাল বলে, নিপিল? নিপিল কেন? বোতলের দুধ দিও না। যতদিন বুকের দুধ আছে, অন্য দুধ দিও না। দুলাল স্বাস্থ্যসেবিকা হয়ে যায়। বাচ্চার মা বুকে আঁচল টেনে দেয়। লজ্জা পায়। দুলাল বলে, নিপিলের থেকে বাচ্চার পেটখারাপ হয়। আমি ওসব রাখি না।

একটা রুপো রং নেলপালিশ বিক্রি করে সাইকেলে এগোয়। ওদের ঠিক ধরে ফেলল।

ওরা যা বলেছিল, তাই হল। নন্দী বাড়িতে ঝামেলা হল। ওদের পাকাবাড়ি। প্রাচীর আছে। প্রাচীরের সামনে দরজা। হিজড়ে আসছে শুনে ওরা দরজা বন্ধ করে রেখেছে। দরজা ধাক্কাল, কেউ খুলল না। ওদের মধ্যে কেউ রাস্তার ধারের ইটের পাঁজার ওপর উঠে পাঁচিলের দিকে মুখ বাড়িয়ে চ্যাচাল, বাড়িতে সব মরেছে নাকি গা, কারও দেখি সাড়া নেই। হায় হায় হায়— নন্দী বাড়ির সব লোকজন মরে গেল, হায় হায়—নন্দী বাড়ির সব লোকজন মরে গেল, হায় হায় হায় হায়। নন্দীবাড়ির কি হাল হল গো…। সোনার চাঁদ বাচ্চাটাকে কে দেখবে, কে মাই খাওয়াবে গো…।

এধার থেকে একজন দুলালকে বলল, যেমন নন্দী তেমন ফন্দি।

শেষ অবদি দরজা খুলল। বাড়িতে ব্যাটাছেলে ছিল। দরজা খুলে বলল—চ্যাঁচাচ্ছ কেন, অ্যাঁ? আজব দেশে বাস করি। কেউ কিছু বলার নেই এদের। যাও। বিদেয় হও। ছেলেকে ছোঁবে না।

তা ঠিক আছে। হাজার এক টাকা দিয়ে দাও, নতুন শাড়ি দাও, দানসামগ্রী দিয়ে দাও, চলে যাব। ঢুকতে দাও বা না দাও, বাছাকে কিন্তু আশীর্বাদ দিয়ে যাব।

শেষ অবদি চারশো এক টাকায় রফা হল। ওরা কিন্তু বাড়ির ভিতর ঢোকাল না। গান- বাজনাও হল না। ওরা খিস্তি দিতে-দিতে বেরিয়ে গেল।

আর একটা বাড়ি ছিল ওদের লিস্টে। অনেক সময় এর বাইরেও নবজাতক থাকে। অনেক সময় বাড়িতেই প্রসব হয়। গাঁয়ের মানুষের কাছ থেকেই খবর পেয়ে যায়। চায়ের দোকান, মুদি দোকান বা দিনমজুরদের কাছ থেকে খবর পেয়ে যায় ওরা। এখন আর সে দিন নেই, তালি বাজিয়ে ‘কার হোলো গো’ হাঁক দিলেই বাচ্চা কোলে নিয়ে বেরিয়ে আসত।

গায়েনদের বাড়িটা খুঁজে বার করল ওরা। বাড়ির সামনে গিয়ে যখন তালি ও ঢোল বাজাচ্ছিল, বাড়ি থেকে একটা বুড়ি বেরিয়ে এসে বলল – দুমাস হল বাচ্চাটা মরে গেছে গা। ওদের বাচ্চাটা ছিল মেয়ে। মেয়ে হলে পয়দা ভাল হয় না। জোরজবস্তি করে নিতে হয়। রেট- ও অনেক কম। বুড়ি এমন করে বলল, যেন ল্যাটা চুকল। বুড়ি বলল, আশীর্বাদ করে যাও যেন ছেলে হয় এবার…। দু’হাতে আশীর্বাদ করি মা, দোয়া করি, যেন টোন্যা হয়, যেন ছেল্যা হয়, যেন বগবগি ছেল্যা, পালোয়ান ছেল্যা হয়।

চাত্তার গেয়ে উঠল,

একটা বছর গেলে পরে
পুত বিরোয়ক বউ আলো করে
ছেলে নাচবে উঠোনে
পাঁচপো চালের মুঠো নে…।

এবার সুর পাল্টে গান ধরে—প্রভাত সময়ে শচীর আঙিনা দিয়াকার গৌর নাচিয়া বেড়ায় রে। একে গোরার রাতুল বেশ দোলাইয়া মোহন কেশ সোনার অঙ্গ ধুলায় লুটায় রে…।

—দাও, আশীর্বাদী দাও।

বুড়ি বলে, আশীর্বাদী আবার কী গো, বাড়ির বাচ্চা মরে গেল, আবার পয়সা চাইছ?

চাত্তারা বলে, পাঁচপো চালের মূল্য ধরে দাও, তবে না আশীর্বাদী-টা জায়েজ হবে। মন্তরে তো বলে দিলাম পাঁচপো চালের মুঠোর কথা। বিশ টাকা ধরে দাও, আর কথা নেই। সামনে ছেলে হলে, সামনের বার এসে মাংতি নিয়ে যাব।

বুড়ি বলে, পাঁচপো চাল বিশ টাকা বলছ কেন গা? আমরা তো আট টাকা কিলো চাল খাই। পাঁচপো কত হয়? অ বউমা, আট টাকা হিসেবে পাঁচপো কত?

ভিতর থেকে জবাব আসে, দশ। দশটা টাকা আদায় করল। যাওয়ার সময় বলে গেল, ছেলেকে বোলো ভাল করে যেন ‘কাজ’ করে। স্বামীর কাজ

দুলালের বেশ রগড় লাগছে। ওরা পয়সাও ইনকাম করছে, অথচ রগড়ও করছে।

চাত্তারা দুলালকে বলল—হ্যাঁ গো, ভালই তো মজেছ। তোমাতেও মজেছি। তোমাকে ছাড়ব না গো। আমাদের খোল-এ এসো। আজ যাবে?

ওদের আস্তানার নাম-ও খোল, আবার বৈষ্ণবদের সংকীর্তনের জায়গাটার নামও খোল। যেমন শ্রীবাসের খোল, নিত্যানন্দের খোল—অনিকেত ভাবে।

দুলালকে এবার ওদের ডেরায় নিয়ে যাবে অনিকেত। দুলাল বলেছিল, কসবায় ওদের একটা ‘আটপুরে’ ছিল। দুলাল প্রথমে গিয়েছিল ওখানে, তারপর পানাগড়। পানাগড়টা অনিকেত জানে। সোজা দুলালকে পানাগড়ে নিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু দুলাল কি সেইদিনই ওদের সঙ্গে চলে গেল? এসব দুলালের কাছ থেকে জানা যায়নি। কী করে যাবে? সাইকেল ছিল না? পরের দিনই গেল। গিয়ে বেশ লাগল।

সবাই একটা সঙ্গ চায়। অ্যাসোসিয়েশন। কোনও গুরুর শিষ্যরা গুরুর নামে একত্রিত হয়। ওরা গুরু-ভাই, গুরু-বোন। গুরু-ভজনার ফাঁকফোকরে সুখ-দুঃখের কথা আদান-প্ৰদান কবিরাও গুরু-ভাই। একসঙ্গে কবিতা পড়তে যায়, কবিতার পর এক সঙ্গে চা-সিগারেট সহ অন্য কবির নিন্দা করে। মুক ও বধির মানুষও একসঙ্গে আড্ডা মারে সাংকেতিক ভাষায়। সবাই সমাজ চায়। দুলালের সমাজ নেই। সমাজ থেকে দুরছাই আছে। বউটাও দুরছাই করে। বাইরের ব্যাটাছেলেদের ঘরে ঢোকায়, ওকে তো মানুষ বলেই মনে করে না। মাঠের ব্যাঙের সামনে পোঁদের কাপড় তুলে হাগতে লজ্জা হয় না। দুলাল তো ব্যাঙ। ব্যাঙের অধম। নিজের পেটে- ধরা মা, সেও কি আর ভালবাসে? কতদিন কেউ দুলালের গায়ে হাত বুলোয়নি। ওর গা-টা নবাবগঞ্জের শ্মশান মাঠ। কেউ যায় না। যে সব ব্যাটা ছেলের কাছে গিয়ে মাঝেমধ্যে উপুড় হয় দুলাল, তারাও কেউ হাত বুলিয়ে দেয়নি ওর শরীরে। মা ঘুম পাড়িয়ে দিত। গায়ে সাবান ঘষে দিত—সেই কবেকার কথা। সেদিন বলেছিল, খুব পিঠ চুলকোয় মা, মা একটা হাতপাখা বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিল ডাঁটি দিয়ে চুলকে নে।

আর ছেলেটা? ধুর, ওটা ওর ছেলেই না। কী জন্য এই সংসারে থাকবে দুলাল? কোন সুখে?

এর আগে টুকটাক লিখেছে অনিকেত। বেশির ভাগই রেডিও-র জন্য। নানারকমের স্ক্রিপ্ট। ডায়রিয়ার ওআরএস, মাতৃদুগ্ধের মাহাত্ম্য, হিরোসিমা স্মরণ, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী-র অবদান—এরকম কত। দু-একটা গল্পও যে ছোট কাগজে ছাপা হয়নি এমন নয়। কিন্তু তেমন কিছু কখনও লেখেনি। এটা লিখতে গিয়ে বোঝে, লেখাটাকে ভালবাসার চেয়ে বড় কথা হল চরিত্রগুলোকে ভালবাসতে হবে। চরিত্রগুলোর সুখ-দুঃখ আনন্দ-শোকের মধ্যে নিজেতে মেশাতে হবে। যে-চরিত্র খারাপ, ঘৃণ্য, সেই ঘৃণাটাকেও ভালবাসতে হবে। এই দুলালকে কখনও ভালবাসেনি যখন সে জ্যান্ত ছিল। দুলালের জন্য যা করেছে, সেটা এক ধরনের ডিউটি। কর্তব্যকর্ম। গীতা-টা পড়েনি অনিকেত, ওখানে আছে কাজ করে যাও, ফলের আশা কোরো না। গীতা ‘ফলো’ কতটা করেছে কে জানে, শুক্লাকে ‘ফলো’ করেছে। যে-ডিউটি কর্তব্যবোধে দুলালের জন্য করেছে, তার চেয়ে বেশি ধর্তব্যবোধে করেছে। শুক্লাই তো ধর্তব্য। শুক্লাই তো ঠেলে দিয়েছে। এখন এইটুকু লিখেই মনে হচ্ছে জ্যান্ত-দুলালের চেয়ে মৃত-দুলালকে বেশি ভালবেসে ফেলেছে অনিকেত। সত্যি বলতে কী, মৃত-দুলালটাই বেশি ‘জ্যান্ত’ হয়ে উঠছে।

পানাগড় বাজারটা ঘিঞ্জি জায়গা। রেল লাইনটা চলে গিয়েছে, দুর্গাপুর, আসানসোল ছাড়িয়ে বহু দূরে। দিল্লি-এলাহাবাদ-অমৃতসর কত জায়গায় ট্রেন যায়। দুলালরা এসেছিল তুফান মেলে। তুফান মেল-এর কত নাম শুনেছে আগে। সেই তুফান মেল। বাজার ছাড়িয়ে একটা রাস্তা জিটি রোডের দিকে গিয়েছে। জিটি রোডটাও একটা লম্বা রাস্তা। কত বাস যায়। বাসের কতরকম নাম। অন্নপূর্ণা, মা সারদা, সুচিত্রা, মা মনসা, বিনোদিনী, সাবিত্রী। এই সাবিত্রী সতী সাবিত্রী না সিনেমার সাবিত্রী? বাসগুলো বেশির ভাগই মেয়েদের নামে। বাস কি মেয়ে? হতে পারে। বাসের ভিতরে মানুষ ঢুকে যায়। এই এলাকায় সর্বদা হইচই। বাসের মাথায় আনাজের ঝুড়ি চাপিয়ে চাষিরা আসে, মুরগির ঝাঁকা নিয়ে আসে পোলট্রির পাইকার। রুগি আসে হাসপাতালে, ইলামবাজার-বোলপুর—যাওয়ার বাসও এখানে। কাছেই বিরাট গাড়ির বাজার। মিলিটারির পুরনো গাড়ি নিলাম হয়। ওখানে আসে ভিনদেশি মানুষ, কত ভাষায় কথা বলা লোক আসে। ওইসব গাড়ি কিনে গাড়ির সারাই-মেরামতের কাজ করতে হয় বলে অনেক গাড়ির গ্যারেজ। কত মেকানিক। কাছেই বিরাট মিলিটারি এলাকা। এত লোকজন বলে হোটেল, নানারকমের দোকান এবং বেশ্যাপাড়াও। তারই পিছনে একটা বস্তিতে কয়েকটা ঘর হিজড়ে। হিজড়েদের ঘরগুলো লাইন-বাঁধা পরপর ছোট-ছোট ঘর নয়। একটা দরজা দিয়ে ঢুকলে উঠোন, উঠোনের চারদিকেই ঘর। ওই ঘরগুলোতে হিজড়েরা সব থাকে। একসঙ্গেই রান্নাবান্না হয়। ১০/১২ জনের রান্না একা করতে পারে না কেউ, এজন্য একজন মহিলা রাখা আছে, স্থানীয়। ঘুরিয়ে- ফিরিয়ে সাহায্য করে সবাই। সবার ঘরেই রেডিও আছে। গুরুমা-র ঘরে একটা টুইন ওয়ান রেডিও চলে, টেপ চালিয়ে গানও শোনা হয়। বেশ ভাল লাগল দুলালের। দুলাল-কে শাড়ি পরতে হয়।

দুলালকে তো পানাগড়ে এনে ফেলল অনিকেত। কিন্তু এর আগে আবেগঘন দু-একটা পৃষ্ঠা লেখার স্কোপ ছিল—যখন দুলাল বাড়ি ছেড়ে চলে আসে। ঘর ছাড়ার আগের দিন মা-কে একটা সরুপাড়ের কাপড় কিনে দিয়েছিল, ঝুপ করে পেন্নাম করেছিল, মা নিশ্চয়ই জিজ্ঞাসা করেছিল, কী হল রে হঠাৎ।

দুলাল কিছুই বলেনি, শুধু দাঁত দিয়ে নীচের ঠোঁটটা কামড়েছিল। ছেলেকে কি কিছু বলেছিল? মন্টুকে? এখানে মোক্ষম দু’টো ডায়লগ দেওয়া যেত। রাত্তিরে ঘুমন্ত স্ত্রীর মুখের দিকে চেয়ে শূন্যে চুম্বন শুধু। বউ জানল না। না জানুক গে। তোমার মহা বিশ্বে প্রভু হারায় না তো কভু। ভোরবেলায় ঘরের সামনের পেয়ারা গাছ থেকে একটা পেয়ারা পাতা ছিঁড়ে নিয়ে ঘ্রাণ নিয়েছিল, সারা গায়ে মেখেছিল পাতাটা। নিমগাছের ছায়াটাও গায়ে মেখেছিল।

এসব লিখল না। পারত না ঠিকমতো। তাই ডাইরেক্ট পানাগড়

ওরা শিখিয়ে দিয়েছিল গুরুমা-কে প্রণাম করতে হবে। বলতে হবে, আমি মায়ের পাও পড়তি। চেলি বলব।

চাত্তারা বলেছিল—আমাদের গুরুমা-র নাম নাগেশ্বরী। নামটা খটমট বলে আমরা নাগীমা বলে ডাকি। নাগীমা যেমন রাগী, তেমন সোহাগি। গেলেই বুঝবে। আমি হলাম ওর ভাল চেলি। কেউ কেউ আমাকে ছোটমা-ও বলে।

এটা বলে—অন্যদের কাছে থেকে সমর্থন আদায় করল। কী লা ঠিক না?

কয়েকজন ঘাড় নাড়ল। দু’জন ঘাড় নাড়ল না।

অনিকেত সমর্থন আদায় করা নিয়ে একটা লাইন লিখল—অজয় মজুমদার আর নিলয় রায়চৌধুরীর ‘হিজড়েদের সমাজ ব্যবস্থা’ পড়া ছিল বলে। ওঁরা ক্ষেত্র-সমীক্ষায় দেখেছেন— গুরু মায়ের প্রিয় চ্যালা বলার একটা প্রতিযোগিতা থাকে। ইন্টারনাল স্ট্রাগল। যে এক নম্বর চ্যালা হবে, তার হাতেই খোলের দায়িত্ব যাবে। হিজড়েরা বাঁধাই খেটে যা রোজগার করে, তার অর্ধেকই গুরুমা-কে দিয়ে দিতে হয়। তার মানে গুরুমা’র রোজগারপাতি বেশ ভালই। গুরুমা’র বয়েস হয়ে গেলে, কিংবা রোগ-ব্যাধি ধরে গেলে প্রধান শিষ্যাকেই দায়-দায়িত্ব ছেড়ে দেয়। এরপর নতুন হিজড়েরা প্রধান গুরুমা-কে ‘দিদিমা’ বলে ডাকে, আর প্রধান শিষ্য বা শিষ্যা হয়ে যান ‘গুরুমা’। এরকমও দেখা গিয়েছে, মৃত্যুর আগে গুরুমা ওর একনম্বর চেলিকে সম্পত্তি উইল করে দিয়ে গিয়েছে। গুরুমা যদি হঠাৎ মারা যান, গুরুমা হওয়ার জন্য শিষ্যাদের মধ্যে ঝগড়া-ঝামেলা হয়। অনেক সময় ‘সংঘ’ ভেঙে যায়। হিজড়ে বাড়িতে তিন ধরনের শিষ্য দেখা যায়! একজন প্রধান শিষ্য, কয়েকজন সাধারণ শিষ্য। ওরা পরস্পরের গুরু-বোন। এছাড়া ঠিকে- হিজড়ে বা জন-হিজড়েও কিছু থাকে। ‘জন’ হল শ্রম-দুনিয়ার একটা বহুল প্রচলিত শব্দ। দিনমজুর। জন-হিজড়েরা হিজড়ে খোলের সবচেয়ে কম আদৃত মানুষ। ওরা বাড়ির কাজ করে, রান্নাবান্না, বড় পরিবারের অন্যান্য বহু কাজ, কিন্তু জন-হিজড়েরা কোনও নির্দিষ্ট খোলে বেশিদিন থাকে না। না-পোষালে অন্য খোলে চলে যায়। ওরা হিজড়ে খোলই পছন্দ করে। তবে অনেক সময় কোনও হোটেল বা চায়ের দোকানেও এদের কাজ করতে দেখা যায়। ওখানে প্রচুর গঞ্জনা এবং খদ্দেরদের টিপ্পনি শুনতে হয় বলে হিজড়ে খোলে কাজ করাই পছন্দ করে। যে-খোলে কাজ করে, সেই খোলের নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয়। জন-হিজড়েরা কথাবার্তায় একটু দুর্বল। বাঁধাই খাটতে গেলে যেসব ছল-চাতুরি করতে হয়, সেটা তারা ভাল পারে না। দেখতেও ভাল হয় না। হিজড়ে সমাজে এরা একটু শোষিত। দুলাল কোনও পর্যায়ে যাবে সেটা এখনও ঠিক হয়নি। মানে, অনিকেত ঠিক করেনি।

তুমিও আমাকে ছোট মা বলবে, বুইচ? চাত্তারা বলেছিল। দুলাল বাধ্য শিশুর মতো ঘাড় কাত করেছিল।

—আর একটা কথা শোনো। আমরা হলাম ‘হাওড়াইয়া’। আমাদের নিয়মকানুন মেনে চলবে।

‘হাওড়াইয়া কী’? দুলাল প্রশ্ন করেছিল।

এটা হল আমাদের ঘরানা। অনেকরকম ঘরানা আছে। দিল্লিওয়ালা, লালনওয়ালা, ইব্রাহিমওয়ালা, লখ্লউ, শ্যামবাজারিয়া, হাওড়াইয়া…আমরা হাওড়াইয়া। আমরা দেখাটেখা হলে সেলাম আলাইকুম বলি না। গরু-শুয়োর খাই না। কিন্তু পারলে রমজান মাসে রোজা রাখি। সব বুঝতে পারবে আস্তে-আস্তে। প্রথমে দুলালকে নিয়ে গিয়ে ওর পায়ে এক ঘটি জল দেওয়ার হুকুম করল চাত্তারা। ও পা ধুয়ে নিল। একটা টিনের চালের ঘরে নিয়ে গেল। একটা খাটে বসে সিগারেট টানছে ম্যাক্সি-পরা একজন মহিলা। ঘরে একটা স্টিলের আলমারি আর একটা ড্রেসিং টেবিল। ঘরের ভিতরে একটা ফ্রিজ এবং টিভিও দেখতে পেল। চাত্তারা বলল, একটা লতুন গয়না নিয়ে এলাম গো মা। দুলালকে দেখাল। দুলাল বলল—পাও লাগি। গুরুমা জিজ্ঞাসা করল—কোতি না ধুরানি?

চাত্তারা বলল, ধুরানি। কড়ি ড্রেস।

কোতি হল নারী-স্বভাবের পুরুষ। ‘ধুরানি’ এর চেয়ে এক ডিগ্রি বেশি। পশ্চাদ্দেশ ব্যবহৃত হয়ে গিয়েছে। এবং কিছুটা রূপান্তরকামীও বটে। ‘কড়ি ড্রেস’ মানে—এই পাজামা আর শার্ট আসলে ছদ্মবেশ। খোলের অন্যান্যরাও এসে গিয়েছে। দুলালকে দেখছে।

নাগেশ্বরী বিছানায় ঠ্যাং-টা লম্বা করে দিল। ওর পুরুষ-পুরুষ পায়ের গোড়ালির বেশ কিছুটা ওপরে ফুল-ফুল ম্যাক্সির শেষ প্রান্ত গুটিয়ে রয়েছে। পায়ের আঙুলেও রুপোর আংটি। পায়ের নখে নেলপালিশ। পায়ের লোমগুলো যেন ধান কাটার পর সারা মাঠে পড়ে-থাকা ধান গাছের স্মৃতিচিহ্ন। মা পায়ের লোম চাঁচেন। আবার ওঠে। পায়ের পাতার ফাটা দাগে দাগে তৈরি হয়েছে কোনও অজানা দেশের ম্যাপ। ওখানে মাথা ছুঁয়ে প্রণাম করে দুলাল। আর তক্ষুনি চোখ ফেটে জল বেরুল।

নাগেশ্বরী বলল, সঙ্গে কিছু ঝলকি এনেছ? টাকাপয়সা?

দুলাল বলল, বেশি তো আনিনি, দুশো টাকা আছে। নাগেশ্বরী বলল, দু’টো ছাপা শাড়িও হবে না। চাত্তারাকে বলল, একটা সিনথেটি শাড়ি কিনিয়ে দে, বেলাউজ, শায়া, বুকবাঁধা। এখন আমি দিচ্ছি এক পোস্ত।

—লাচতে পারিস?

দুলাল মাথা নাড়ে।

—গান গাইতে পারিস?

আবার মাথা নাড়ে দুলাল।

—একটা গান গা দেখি…

দুলাল কী গান গাইবে? প্রথমেই মনে এল ‘জনগণমনঅধিনায়ক জয় হে’। ওটা কি গাওয়া যায়? গান মনে করতে থাকে। মাথা চুলকোতে-চুলকোতে আর একটা গান মনে পড়ে—’আজ মন চেয়েছে আমি হারিয়ে যাব, হারিয়ে যাব আমি তোমার কাছে…এরপর আর মনে পড়ে না।

এটা গাইতে লজ্জা করে। তারপর একটা ভাল গান মনে পড়ল। কিন্তু গাইতে লজ্জা করল।

—কী রে, গানটা ধর…..।

দুলাল গেয়ে দিল, এ আমার গুরুদক্ষিণা, গুরুকে জানাই প্রণাম, যার শুভ কামনায় আমি এখানে এলাম…।

সবাই হইহই করে উঠল।

—তোর হবে। তোর গানের গলাটা তো খারাপ নয়…। তোর হবে। কিন্তু এসব গানে চলবে না। লতুন-লতুন গান শিখতে হবে। এখন একটু আরাম করে লে।

দুলালের একটা ঘর দেখিয়ে দেওয়া হল। ছোট একটা ঘরে দু’পাশে দু’টো তক্তাপোশ ফেলা আছে। ওকে মাঝখানে মাদুর বিছিয়ে শুতে হবে আপাতত। দড়িতে ঝুলছে শায়া শাড়ি, একটা কাঠের তাক রয়েছে, ওখানে সাজগোজের জিনিসপত্র।

হাসি বলল, তোর সঙ্গে দু’টো আকুয়া আছে। ওরা বাঁধাই খাটতে গিয়েছে। খেয়েদেয়ে জিরেন করে নে, বিকেলে তোর নববস্তর হবে।

বিকেল হতে আর কতক্ষণ। গুরুমা-র ঘরে গেল। স্টিলের আলমারি খোলার ক্যাচাৎ শব্দ। একটা ছাপছাপ সিনথেটিক শাড়ি, শায়া, ব্লাউজ বের করল গুরুমা। বলল, এক পোস্ত আমি দিচ্ছি, এক পোস্ত তুই কিনে নিবি, বাকিটা রোজগার করে কিনবি। এখন পাজামাটা খোল।

পাজামা খুলল দুলাল। জাঙ্গিয়াও ছিল। জাঙ্গিয়াটা না পরলেও চলে। অনেক সময় পরেই না। আজ পরা ছিল। জাঙ্গিয়াটা টেনে খুলে দিল গুরুমা। তোর তো প্যাতপ্যাতে লিকম। তোর তো লিকম পতাতে সুবিধে হবে। গুরুমা-র ঘরে চাত্তারা, হাসি, ফুলি, আরও দু’জন ছিল। তাদের একজনের নাকে সুতো। নতুন নাক বিধোলে ফুটোর মধ্যে সুতো বেঁধে রাখতে হয়, সেই সুতো। গুরুমা বলল, হাসি, ওকে লিকম পতানোটা দেখিয়ে দে তো?

হাসি দুলালকে বলল, আয়, আয়নার সামনে দাঁড়া। তোকে দ্যাখ। কেমন লাগছে?

দুলাল বলল, ভাল না।

কেষ্টঠাকুর হ। বাঁ পায়ের উরুর ওপর ডান পা-টা চাপিয়ে দে। এবার ঠ্যাং-টা আড়াআড়ি রাখ। এবার দ্যাখ তো আয়নায়—

দুলাল দেখে।

হাসি বলে, তোর ধন কোথায় গেল?

দুলাল বলে, চাপা পড়েছে।

—এখন দেকতে কেমন লাগছে?

দুলাল মৃদু হাসে।

—ওটা আচে?

—আছে কিন্তু নেই।

এবার দ্যাখ, কেষ্ট ঠাকুরের ‘পোজ’ না দিয়েও কেমন করে পতানো যায়। দুই উরুর তলায় গুঁজে দিয়ে থাই দুটো টাইট কর। দ্যাখো, কী মনে হচ্ছে? চিপটি-র মতো লাগছে না? শুধু চেরা নেই। ও বোঝা যাবে না, বালে ঢাকা যে।

—এটা প্যাকটিস করবে কেমন?

–নাও। এবার শাড়ি পরো। জাঙ্গিয়াটা পরে নাও, ওটা এখন আর জাঙ্গিয়া না, প্যান্টি।

শাড়ি পরানো হচ্ছে, দুলি ঢোল বাজাচ্ছে। শাড়ির পর বডিজ পরানো হল। ভেতরে দু’টো জলভরা বেলুন ঢুকিয়ে দেওয়া হল, এরপর ব্লাউজ।

দাড়িটা ভাল করে কামিয়ে নাও এবার। এমনিতেই দুলালের দাড়িটাড়ি পাতলাই। মাকুন্দ বলতে যা বোঝায় ঠিক তাই নয়, তবে বেশ কম। বুকে লোম নেই। কামাতে বেশিক্ষণ লাগল না। ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা সন্না বার করল নাগেশ্বরী। বলল, এটার নাম দর্শন। একটা কিনে নিবি। সন্না দিয়ে একটা একটা করে মুখের চুল টেনে তুলে ফেলবি। তা হলে গজানো বন্ধ হয়ে যাবে। দোকানে ‘মালা ডি’ কিনতে পাওয়া যায়, পেট হওয়া বন্ধ করার পিল, রোজ একটা করে খাবি, তা হলে গোঁপ-দাড়ি ওঠা বন্ধ হয়ে যাবে, বুকেও একটু-একটু করে মাই গজাবে। নে এবার খারি-টা বার কর।

একটা পরচুলা বার করা হল।

ঠোটে লিপস্টিক, মুখে পাউডার, চোখে কাজল। এবার একটা পরচুলা পরিয়ে দেওয়া হল মাথায়। ঢোল বাজল।

উলু দিয়ে উঠল বাকিরা।

.

উলুর অন্য নাম ‘জোকার’। পূজো শেষে পুরোহিত বলতেন এবার জোকার দাও… শব্দটা নাকি ‘জয়জয়কার’ থেকে এসেছে।

৩৭

চাত্তারা বলল—কয়েকদিন বাঁধাইয়ে চল, আমাদের সঙ্গে থাকতে-থাকতেই প্যাটিকাল হয়ে যাবে। তারপর মাঝে-মাঝে দুর্গাপুর ইস্টিশন-এ পাঠাব। ওখানে সারাদিনে ভাল আমদানি।

—ওখানে কী?

—ওখানে রেলের টিকিটের লাইন পড়ে কি না, লেডিজ লাইন ছোট থাকে। লেডিজ লাইনে দাইড়ে মদ্দাদের টিকিট কেটে দিবি। আমাদের রোজগারের বহুত লাইন। ইস্টিশনে একটা মদ্দা কুলি সারাদিন খেটে, নিরখা ঝরিয়ে যা রোজগার করে, টিকিট কেটে তারচে’ বেশি রোজগার। পয়সা কামাবি, মস্তি করবি, খিলুয়া-খোবরা খাবি…।

ওরা ঢোল নিয়ে বাঁধাইয়ে বেরোয়। গুরুমার ঘরে একটা ঢোল আছে, ওটা ওখানেই থাকে। পুজো হয়। ঢোলের ওপর ফুল পড়ে, ঢোলের গায়ে সিঁদুর পড়ে। একটা কাঠের সিংহাসনে, একটা মুরগির ওপরে বসা ঠাকুর মূর্তি আছে। মেয়ে-ঠাকুর। ওর নাম বহুচেরা।

গুরুমা বলেছে—এখন দু’-চারদিন এমনি-এমনি ঘুরুক, তারপর ‘দীক্ষে’ হবে। দীক্ষের খরচা আছে, কিছু রোজগার করে নিক আগে।

বাঁধাইয়ের কাজে ঘুরল দুলাল। পানাগড় ছাড়িয়ে ইলামবাজারের দিকে এক কিলোমিটার গেলেই গ্রাম, তিন কিলোমিটার গেলেই জঙ্গল। জঙ্গলের ভিতরে-ভিতরে গ্রাম। ওইসব গ্রামে বড়লোক নেই। কিছু-কিছু সাঁওতাল ঘর আছে। ওদের বাড়ির উঠোন-দেয়াল খুব তকতকে হয়। অনেক দেয়ালে ছবি আঁকা থাকে। এগুলো দেখতে খুব ভাল লাগছিল। দুলালও গাঁয়ে-গাঁয়ে ঘুরেছিল। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার গ্রামগুলোর সঙ্গে এদিকের গাঁয়ের মিল নেই। মাটির রং আলাদা। এধারে কত শাল-সেগুন গাছ।

সাঁওতাল ঘরে গেলে ওরা এক বাটি করে হাঁড়িয়া খেতে দেয়। ওরা দুরছাই করে না। বেশ হাসে। ওদের সমাজে এসব নেই। সাঁওতাল ঘর থেকে কেউ হিজড়ে-সমাজে নাম লেখায় না। ওদের ‘চক্ষুদান’ বলে একটা ব্যাপার আছে। কেউ মরে গেলে, মৃত্যুর কয়েকদিন পর পটুয়া-রা যমপট নিয়ে বাড়িতে আসে, ওখানে একটা চোখহীন ছবির চোখ এঁকে দেয় পটুয়ারা। ওরা ভাবে, চোখটা আঁকা হলে মৃত-মানুষের আত্মাটা দেখতে পাবে। আদিবাসী ঘরে জন্মের পর এবং মৃত্যুর পর তোলা তুলতে আদিবাসীরা নয়, অ-আদিবাসীরাই আসে।

সাঁওতালদের ঘর থেকে বেশি আদায়পত্র হয় না। ওরা নিজেরাই ভাল নেই, ঠিকমতো জামা-কাপড় নেই, এখানে নতুন কাপড় চাওয়া যায়? এসব এলাকায় বেশি আসে না—চাত্তারা জানাল। তবে এক্কেবারে না-এলেও চলে না। এই এলাকাটা আমাদের কিনা, হামসি লেগা কম বহুত ঝলখা বাকর তো করতে হবে।

এই ধরনের সাংকেতিক কথা ওরা মাঝে-মাঝেই বলে। দুলালের ঘরে যে দু’জন থাকে, ওরা বলেছিল, হামসি ময়না মাহিয়া, অন্যজন বলেছিল হামসি ঝুমকা মাদিয়া। হামসি কে গুরুমা বহু ‘চিস্যা’ করে। ঝুমকা বলেছিল। ‘চিস্যা’ মানে পছন্দ। দক্ষিণের গ্রামগুলো বেশ ভাল। ওখানে অনেক ‘আগুড়ি’ আছে। ‘আগুড়ি’রা বড়লোক। ওদের উঠোনে বড়-বড় ধানের গোলা। গোয়ালঘরে হাম্বা হাম্বা। গরুদের পেচ্ছাপের ছরছর শব্দ। হাসি এই অঞ্চলটা খুব ভাল জানে কোনটা বামুন বাড়ি, কোনটা কৈবর্ত বাড়ি, কোনটা ‘আগুড়ি বাড়ি’ দেখেই বুঝতে পারে। বাউড়ি-বাগদি-মুচি এরা গাঁয়ের একধারে থাকে। ওসব গরিব বাড়িতে ছেলে নাচাতে গিয়ে খুব একটা ফয়দা নেই। যেহেতু এলাকাটা ওদের, রাজার কর্তব্য প্রজাদের দেখা, তেমনই হিজড়েদেরও কর্তব্য নবজাতকদের আশীর্বাদ করা। বাচ্চা নাচিয়ে ওদের কাছ থেকে কিছু নেয় না। নিয়মরক্ষার জন্য পাঁচ সিকে, বা কখনও পাঁচ টাকা। ডাক্তাররা যেমন অনেক গরিব রুগিকে ফিরিতে দেখে দেয়, তেমনই।

কিন্তু আগুড়ি বাড়িতে পয়দা হয় আগুড়ি বাড়ির জন্য আলাদা বাচ্চা নাচানোর গান বেঁধেছে ফুলি।

ঘরে ছেলে জন্মালে গানটা এরকম—

ওরে গাছে গাছে ফল পেকেছে
গুলাব গাছে ফুল ফুটেছে
টিয়া কুকিল কলকলাচ্ছে
কী হয়েছে কী হয়েছে
বড় বউয়ের ব্যাটা হয়েছে।
রাঙা পানা ব্যাটা হয়েছে
ধন ধনা ব্যাটা হয়েছে
গন গনা ব্যাটা হয়েছে
এক লিটার দুধ খাবে
মারুতি চড়ে শহর যাবে
শতাব্দী রায় বউ আনবে
লাখ টাকা পণ লিবে
বউ মাকে সুখ দিবে

এরপর সুযোগ থাকলে, মানে কড়া ব্যাটাছেলে না-থাকলে, বউকে কেমন করে ‘সুখী’ করবে তারও ‘ঘতাঘত’, ‘চপাচপ’ এসব শব্দমণ্ডিত বর্ণনা থাকে, কিন্তু ওইসব লাইন বুঝেসুঝে গাইতে হয়। ঘরের বউরা খিস্তি, গালাগাল এসব শুনতে ভালবাসে। কিন্তু যদি সেইসঙ্গে বালক-বালিকা থাকে, তখন ওরা চেপে যায়। যদি ব্যাটাছেলেরা না-থাকে, তখন অনেক সময় গিন্নিবান্নিরা বালক-বালিকা সরিয়ে দেয় শুধু খিস্তি-লোভে। যদি মেয়ে হয়, তবে গানের প্রথম দিকটা একই থাকে প্রায়, ব্যাটার বদলে ‘বেটি’ বলে, কিংবা ‘খুকি’ বলে। কিন্তু শেষের দিকে থাকে—

সতী লক্ষ্মী মেয়ে হবে
রূপের ছটায় চাঁদ হারাবে
ভাল ঘর বর পাবে
বিনা পণে বিয়ে হবে।

সকালবেলায় রুটি-তরকারি চা খেয়ে, পথে-পথে ঘোরা। দুপুরবেলায় বাইরে কোথাও খেয়ে নেওয়া, গাছতলায় বিশ্রাম করা, খিস্তি-খেউড় করা, বেশ তাইরে নাইরে নাইরে—চিন্তা কিছুই নাইরে’ জীবন। তবে এর মধ্যে যে খারাপ কিছু শোনেনি, এমন নয়। বাচ্চারা দল বেঁধে একটা গাঁয়ে বলেছে হিজড়ে-হিজড়ে, ধনের জায়গায় ছিবড়ে…এসব নিশ্চয়ই ওরা বড়দের কাছ থেকে শিখেছে। পানের দোকান-চায়ের দোকান থেকেও কানে এসেছে—যদি দ্যাখো হিজড়ে, দিন যাবে বিগড়ে।

চার-পাঁচদিন দুলালের অ্যাপ্রেন্টিস-পর্ব গেল। আরও কয়েকদিন হবে, তারপর ‘দীক্ষা’। ময়নার সঙ্গে দুলালকে দুর্গাপুর স্টেশনে পাঠাল। ময়না আর দুলাল দু’জনই শাড়ি পরেছিল, মুখে পাউডার, ঠোঁটে লিপস্টিক। ময়না দু’বছর হল এখানে এসেছে। খুব একটা পাকা হয়নি। ময়না বাউড়ি ঘরের ছেলে ছিল। এক চায়ের দোকানে কাজ করত। চা খেতে-খেতে ‘গুরুমা’ বুঝে গেল—ও ‘কোতি’। ছেলেটার সঙ্গে কথা বলে জানল, ওর বাবা সাপের কামড়ে মরে গিয়েছে। ওর মা অন্য একজনকে বিয়ে করেছে। ওর বাবা যখন মরে, ওর বয়েস ছিল দশ। ওর আর দুটো বোন আছে। বাবা মরার পরই ও চায়ের দোকানে কাজ করে। যা রোজগার হয়, ওর মা এসে নিয়ে যেত। আগে মাঝে-মধ্যে বাড়ি যেত, পরের দিকে আর বাড়ি যেত না। ওর মায়ের আবার একটা মেয়ে হল। ওর বাবা মা-কে ছেড়ে দিয়েছে। বলেছে, তোর পেটে শুধু মেয়েই হবে। তোর তো চারটেই মেয়ে। তার মানে, ওকে ‘ছেলে’ বলে মনে করত না। ওর দুই দিদির একজন কোথায় হারিয়ে গিয়েছে, তার খোঁজ নেই। বাড়িতে মায়ের জন্য কষ্ট হয়, কিন্তু যেতে ইচ্ছে করে না। চায়ের দোকানেই সারা দিন থাকে। রাতেও। মালিকের এক শালা আছে। সে মাঝে-মাঝে রাতে এসে ওকে দিয়ে খেলাত। তারপর সেই লোকটা ওর এক বন্ধুকে নিয়ে আসে। বাটুবাজি করত। এমন সময় ‘গুরুমা’-র চোখে পড়ে। দু-চারদিন কথা বলে ওকে খোলে ভিড়িয়ে নেয়। ওর আগে নাম ছিল মনুয়া। এখন ও ময়না।

দুর্গাপুর স্টেশনে ময়না আগে বহুদিন ডিউটি করেছে। এই ডিউটিটা ওর ভাল লাগে না। কোনও মস্তি নেই। সারাদিন খালি লাইনে দাঁড়াও। ও বাঁধাই খাটতেই চায়। কিন্তু ওখানে কাউকে না-পাঠালে ঠেক হাতছাড়া হয়ে যাবে। তাই ওখানে ছবিদি যায়। ছবিদি বেশি হাঁটতে পারে না। হাঁটুতে ব্যথা। ছবিদি তাই ইস্টিশন ডিউটি করে। ‘এখন ছবিদির জ্বর হয়েছে বলে আমায় পাঠিয়েছে।’

ময়না দেখিয়ে দিল—কী কী করতে হয়। ওরা যেতেই একটা খাকি পোশাক-পরা পুলিশ এল। ময়নার দিকে তাকিয়ে চোখ মারল। ময়না দুলালকে দেখিয়ে দিল। ‘ও কিন্তু মাঝে-মাঝে এখানে ডিউটি করবে।’

ময়না বলল, মাসের বেবস্থা আছে।

একটা লেডিজ কাউন্টার আছে। ওখানে ভিড় কম থাকে। এদিকে বর্ধমান আর ওদিকে আসানসোল পর্যন্ত টিকিট কেটে দিলে দু’টাকা করে লিবি, আর দূরে গেলে পাঁচ টাকা। হাওড়ার প্যাসেঞ্জার-রা পাঁচ টাকা দিতে চায় না। দু টাকা ধরিয়ে চলে গেলে খপ করে হাত ধরবি। গয়া প্যাসেঞ্জার, মোগলসরাই প্যাসেঞ্জারে ভিড় বেশি। ভাল আমদানি। যখন ভিড় থাকবে না নীচে বসে থাকবি।

বিকেল চারটে নাগাদ ঘুগনি-পাউরুটি খেয়ে নিল ওরা। সাতটা পর্যন্ত ডিউটি দিল। গুনে দেখল একশো আশি টাকা কামাই হয়েছে। বাইরে বেরিয়ে শিঙাড়া-রসগোল্লা খেল। সব টাকা গুরুমা-র হাতে তুলে দিতে হবে। গুরুমা খুশি হয়ে টাকায় সাড়ে ছ’আনা, মানে চল্লিশ পয়সা দেবে। দেড়শো টাকায় ষাট টাকা ওরা পাবে। খাবার পয়সাটা এখান থেকেই যায়।

দিন দশেক পরে দীক্ষার দিন পড়বে। পূর্ণিমা-অমাবস্যায় দীক্ষা হয়। দীক্ষার দিন সকালবেলা ‘বাবা’ এসেছে। ‘বাবা’ মানে গুরুমা-র প্রধান ‘পারিক’। বা গুরুমা যাকে বলে— দ্যাক্, এই হচ্ছে আমার স্বামী। তোদের বাপ

নাগেশ্বরী মায়ের বয়স এখন পঁয়তাল্লিশের এধার-ওধার। কিন্তু ওর এই স্বামীর বয়স তিরিশের বেশি হবে না। বেশ ফরসা রং। একটা জিন্স-এর প্যান্ট আর বুকে কুমির আঁকা গেঞ্জি পরে এসেছে। মোটা-সোটা, থলথলে। পানপরাগ খায় বলে মুখে থুথু জমে। মায়ের মেয়েদের ওর মুখের সামনে পিকদানি ধরতে হয়। ‘বাবা’ নাকি মাঝে-মাঝে আসেন। বাবা এলে কোনও মেয়েকে পা ধুয়ে দিতে হয়। সোজা মায়ের ঘরে চলে যান। বাবা-কে খবর দেওয়া হয়েছে আজ আসতে। নতুন কোনও ‘কোতি’ দীক্ষা নেবে। দীক্ষা নিয়ে ‘আকুয়া’ হবে। তারপর হয়তো লিঙ্গচ্ছেদ করে, মানে ‘ছিন্নি’ হয়ে ‘নির্বাণ’ হবে কোনওদিন। আজ ‘আকুয়া’ হবে, এবং দুলালী নাম আনুষ্ঠানিক ভাবে ধারণ করবে।

ঝুমকা নামের হিজড়েটা খোসাওলা লাল বাদাম এনে দু’হাতে বাদামের খোসা ছাড়িয়ে হালকা ফুঁ দিচ্ছিল। বাদামের লাল জামা হাওয়ায় উড়ছিল। ছবি মুরগি কুটছিল। ছবি নাকি ‘আকুয়া’ নয়। ‘ছিবড়ি’। দুলাল জেনেছে ছবি অল্প-অল্প মেয়েছেলে। শরীরেও। ওর কোনও ঝোলা বল নেই। নুনুটা নাকি ঠিক একটা হত্ত্বকির সাইজ। আসলে ওটা নাকি ব্যাটাছেলের লিকম-ই নয়। ওটা চিপটি-র ওপরে যে ছোট নাক থাকে, ছোলার মতো, ডাক্তার বাবুরা যাকে বলে ক্লিট, ওটাই বড় হয়ে গিয়েছে। ও-বেটির মধ্যে মাগীর অংশ বেশি বলে এখনই হাঁটু ব্যথা। মেয়েদেরই তো হাঁটু ব্যথাটা বেশি হয় মাসিক শেষ হওয়ার আগে। ছবিদির নাকি অল্পস্বল্প মাসিকও হত।

ছবিদি মন দিয়ে মুরগি কুটছে। আজ ‘ছোট খোবরা’ হবে। ‘ছোট খোবরা’ মানে মুরগি। ‘বড় খোবরা’ খাসি।

একটা প্লেটে করে জামা ছাড়ানো বাদাম আর খিলুয়া-র সাদা বোতল নিয়ে বাবার ঘরে গেল ঝুমকা

একটু পরেই নাগেশ্বরী মা দুলালকে ডেকে পাঠালেন। ময়না বলে দিল দু’জনকে পেন্নাম করবে।

দুলাল দু’জনকেই প্রণাম করল। পাও লাগি মা, পাও লাগি বাপ

দুলাল ওর বাপকে দেখছিল, যে-বাপ দুলালের চেয়েও ছোট। চোখটা লাল। গালেও লালের আভা। গেঞ্জিটার দু’টো বোতাম খোলা। বুকের লোম দেখা যাচ্ছে।

নাগেশ্বরীমা বলল—হাঁ করে গিলছিস দেখচি, বাপ-ভাতারি হয়ে বসিস না যেন। সবাই শোন। শোন, তোরা যদি কখনও বাপের গতরের দিকে লোভের দিষ্টিতে তাকিয়েছিস দেখি, একদম আঁশবটির কোপ ঝেড়ে দেব গলায়

বাবা পেন্নাম হয়ে গিয়েছে। এবার দীক্ষার কাজ শুরু হবে।

বাবাকে ঘর ছেড়ে বেরুতে হল। দীক্ষার সময় আকখাট-রা থাকতে পারে না। আকখাট হল পূর্ণ মদ্দপুরুষ। গুরুমা-র এই পারিক আক্খাট। হিজড়েরাও আকখাট-ই পছন্দ করে। একজন হিজড়ে যৌন-সঙ্গী হিসেবে আর একজন হিজড়েকে পছন্দ করে না।

চাত্তারা, ময়ূরী, ময়না, হাসি, ফুলি, ছবি, ঝুমকা, ঝরনা, সফি, সবাই এল। সবাই শাড়ি পরেছে। বেশির ভাগই লাল পাড়। তবে অন্য শাড়িও আছে। সবাই স্নান সেরে নিয়েছে। যারা খারি পরার পরে নিয়েছে। ব্লাউজের তলায় জলভরা বল নিয়ে ‘বাংলার বধু বুকে তার মধু’ হয়ে রয়েছে। চাত্তারা-র হাতে একটা কুলো। সেই কুলোর ভিতরে চকমকি কাগজ সাঁটানো। কুলোর মধ্যে একটা ছোট রেকাবিতে দু’টো লাড্ডু, একটা পাকা কলা, একটা আয়না, ছোট বাটিতে একটু চুন, একটু নুন, এক গ্লাস জল, আর এক শিশি আলতা। দুলালের মুখ এখনও জ্বালা করছে। দর্শন, মানে সন্না দিয়ে অনেক্ষণ ধরে ওর গোঁপ-দাড়ি ওপড়ানো হয়েছে।

দুলালকে একটা আসনে বসানো হল। আসনটা এক টুকরো হরিণের চামড়ার হলুদের মধ্যে কালো-সাদা বুটি। মাঝে-মাঝেই লোম উঠে গিয়েছে। এই আসনে ওর আগে আরও কতজন দীক্ষা নিয়েছে। এই আসনের লোমে-লোমে স্মৃতি। কুলোটা রাখা হল বহুচেরা দেবীর ছবিটার সামনে। এবার কুলোটা দুলালের মুখের সামনে সাতবার ঘুরিয়ে দুলালের সামনে রাখল নাগেশ্বরী। দুলাল নতুন শাড়ি পরেছে। শাড়ির সঙ্গে যা-যা পরতে হয়। দুলাল যেন কনে বউ। কুলোটা নাড়ানোর সময় লাড্ডু দু’টো গড়িয়ে দু’পাশে চলে গিয়েছিল। চাত্তারা লাড্ডুটাকে কলার দু’পাশে রাখল। একটা আখাম্বা কলার দু’পাশে দু’টো লাড্ডু।

চাত্তারা বলল, নাও, কলাটাকে ধরো।

দুলাল কলাটাকে ধরল।

নাগেশ্বরীমা মিটিমিটি হাসছে।

—এবারে জোরে চেপে ধরো। খুব জোরে।

দুলাল বলল, গলে যাবে।

—গলে যাক। গালিয়ে দাও।

দুলাল মুঠিটা শক্ত করে কলাটার মাঝখানটা ‘ভর্তা’ করে দিল।

—বলো, কলা কলা কলা, তোকে কল্লাম গলা।

দুলাল বলল।

—বলো, এই কলার জন্য আমার কোনও মায়া নেই।

দুলাল বলল।

—এবার ছুলে, এই রেকাবিতে রেখে, ছুরি দিয়ে ছোট-ছোট টুকরো করো।

—তাই করল।

—এটা হল পেসাদ। আমরা সবাই খাব।

এবার গুরুমা নাগেশ্বরী একটা-একটা করে দু’টো লাড্ডুই খাইয়ে দিল দুলালকে।

—বল,

লাড্ডু লাড্ডু লাড্ডু খাই
লাড্ডুর জন্য মায়া নাই।
নাও, এবার জল খাও বাছা।
দুলাল জল খেল।

চাত্তারা আয়নাটা দেখিয়ে প্রশ্ন করে, ওটা কী?

দুলাল বলে, আয়না।

বাকিরা কোরাসে বলে—

আয়নায় থাকে পারা।
গুরুমাকে ঠকাবে যে-হারামি হতচ্ছাড়া
তার গা ফুঁড়ে বেরবে পাপের পারা।
এবার চুনের বাটি দেখিয়ে, এটা কী?

দুলাল বলল, চুন।

সবাই কোরাসে—

যে করবে মায়ের বদনাম আর খোলের অনিষ্ট, তার গা ফুঁড়ে বেরবে চুনের মতো শ্বেত কুষ্ঠ।

এবার আর একটা বাটি দেখিয়ে বলল, এটা কী?

এটা নুন
খোলে থেকে খাবি নুন
সদা গাইবি মায়ের গুণ।

পুরো প্রক্রিয়াটা মোট তিনবার হল।

দুলালকে বলা হল বহুচেরা মা-কে প্রণাম করতে, তারপর ঢোল-কে, এবার ফের নাগেশ্বরীমাকে।

নাগেশ্বরীমা দুলালের মাথায় হাত রাখল। আঁচল দিয়ে মুখ মোছাল। বলল, তোর নাম হয়ে গেল দুলালী। দুলালী হিজড়ানি। সবাই কোরাসে বলল, দুলালী, দুলালী হিজড়ানি। নাগেশ্বরী একটু সুপুরির কুচি দিল দুলালের হাতে। বলল মুখে দে।

দুলাল মুখে দিল।

নাগেশ্বরী বলল—তুই আমার চেলী হলি। বেঁচে থাক বেটি। আমার যত চেলাচেলি তোর ও তত হোক। শরীল যেন ভালো থাকে ধরেনা রোগ পোক। নে, আশীৰ্বাদ লে।

দুলাল মাথা নিচু করে।

নাগেশ্বরী মাথায় হাত রাখে।

মা এবার বলল, খিয়া দে।

চাত্তারা মা-কে বোতল থেকে মদ ঢেলে দিল। আজ দেশি মদ নয়। ইংলিশ। গেলাসে হলুদ রঙা পদার্থ। দুলাল জানে, ওটা হুইস্কি।

—একটু টাকনি দিলি না?

ঝুমকা তাড়াতাড়ি বাদাম নিয়ে এল। বলল, একটু পরেই পকোড়া ভেজে দিচ্ছি মা।

মা আজ রাজরানি।

মা দুলালকে বলল—শোন, তুই হয়ে গেলি দুলালী হিজড়ানি, কিন্তু মনে ভাববি তুই রাজরানি। যদি পাস নাগরবাবু, ধমক মেরে করবি কাবু, দোলাবি কোমর, করবি খোমর। লিক্‌‍ ভাড়া করবি নে, পারলে বাড়ু ভাড়া দিবি। খাবিদাবি কলকলাবি। মনখারাপকে কলা দেখাবি। ময়না, টিয়া, কাকাতুয়া যাই পুষিস না কেন—ছ’টা ছ পুষতে ভুলবিনে। ছলনা, ছেনালি, ছাপান, ছেমো, ছেলেমি আর ছ্যাঁচড়ামি। ‘ছল্লা’ তুলে ছমকাবি। ছেমো মানে বুঝলি? পারিককে একটু রাগ দেখাবি। বেশি কথা কইবিনে, গোঁসা দেখাবি। আর ছাপান মানে অধিকার পিতিষ্টে করবি। পকট থেকে ফট করে কলম তুলে লিয়ে সুর করে বলবি, দেবো-ও-ওনি, রুমাল তুলে লিয়ে বলবি দেবো-ও-ওনি। যদি ঘরে বসে খিয়া খায়, দু’পেগ খাবার পর বোতল সরিয়ে লিবি। বলবি আর খাবেনি, আর মাল খেলে আমার মাথা খাও।

যখন বাঁধাই খাটতে যাবি, দেখতে চাইলে দেখাবি না। হাঁটু অবদি কাপড় তুলেই লাবিয়ে দিবি। লোকে জানতে চাইলে বলবি আমি জম্মো খুঁতো। জম্মো থেকেই নেই। লোকের মনে যত আহা আহা, তোদের মনে তত হাহা-হাহা।

আর শোন বলি। রেলে লেডিজে উঠবি। মনের মধ্যে নারী-ভাব আনবি। দুগ্গা মায়ের কথা ভাব, কী তেজ। কালী মা এক-এক কোপে এক-একটা মদ্দা মেরেছে। শিবকে পায়ের তলায় চেপে রেখে দিয়েছে।

নাগেশ্বরী মা খিলুয়া খেতে-খেতে এইসব বলছিল, আর সবাই মন দিয়ে শুনছিল। শুধু ছবি ওখানে ছিল না। ছবি রান্নাঘরে। কারণ ছবির ছিন্নি হওয়ার দরকার হয়নি কখনও, কারণ ছবিই কিছুটা মেয়েছেলে, ওর একসময় একটু-একটু মাসিক হত। সুতরাং ছবি রান্নাঘরে। মেয়ে কিনা। ওখানের ওর ডিউটি। কাজের মেয়েটা যদিও আছে, কিন্তু দেখভাল করার দায়িত্ব ছবির। গেরস্ত বাড়ির এই নিয়মের হিজড়ে-খোলেও ব্যতিক্রম হয় না।

খিলুয়া খাওয়াটা গুরুমা আগে শুরু করেছে। পরে পাশের সিনিয়াররা। দুলালকেও অল্পকারে দিল। গ্লাসে গ্লাস ঠেকিয়ে ঠং শব্দ করল। কে যেন বলল চিয়ার্স।

গুরুমা বলল এই চিয়ার্স বলা কে শুরু করেছিল জানিস?

সবাই জানে, কিন্তু বলতে নেই। গুরুমার মুখে এই একই গল্প বহুবার শুনেছে ওরা। কিন্তু ‘জানি’ বলতে নেই। শুনতে হয়।

গুরুমা বলছে—কামের দেবতা মদন দেব এটা চালু করেছিল। সঙ্গে সবাই যখন খিলুয়া পিটছিল, তখন মদন দেবতা বডিপার্টগুলো নিজেদের মধেও ‘বাহাস’ করতে শুরু করল। মন বলছে মাল খেলে সবচেয়ে লাভ হয় আমার। খুব আনন্দ হয়। মুখ বলল না আমার। আমি মাল খেলেই খুব খিস্তি দিই। চোখে বলল আমি কিসে কম! আমি সব গোলাপি দেখি। জিভ বলছে আমার খুব ঝাল মশলা খেতে ইচ্ছে করে। হাত বলছে আমার খুব সেক্স করতে ইচ্ছে করে। বেচারা কান কিছু বলছে না। কান কাঁদতে কাঁদতে মদন দেবকে বলল আমার কী হবে?

মদন দেব বলল দাঁড়া, তোর জন্য ব্যবস্থা করছি। মাল খাওয়া শুরু হওয়ার আগে গেলাসে গেলাসে ঠোকাঠুকিয়ে যে আওয়াজটা হবে, সেটা তোকে দিলাম। যাঃ।

এবার দুলালের দিকে তাকিয়ে বললেন—দুলালী, একটা সিব মার।

.

অনিকেত ঠিক করে, এবার থেকে দুলালকে দুলালীই লিখবে।

দুলালী আস্তে-আস্তে এই জীবনে অভ্যস্ত হতে থাকে। মাথায় লাগানো খাপড়িকে কখনও বিনুনি করা, কখনও উঁচু করে খোঁপা বাঁধা। ঘরে এলে ঠিক করে গুছিয়ে রেখে দেওয়া। চাত্তারা বলেছে, চুল কাটা বন্ধ করে দে, আস্তে-আস্তে চুল লম্বা হয়ে যাবে। তোর চুলের গোছ ভাল। কতগুলো আকুয়া-র বেশ ঝামেলা হয়। মাথায় টাক পড়ে। টাকটা মদ্দাদেরই বেশি হয় কিনা তুমি তো বাবা লিকমধারী মদ্দা। বাইরের বডি ভিতরের মেয়েটার খড়খড়ি দিয়ে ডাকা কথা শুনবে কেন? ভিতরের মেয়েটা বাইরের বডিকে বলে, আমি মেয়েমানুষ, আমার মাথায় টাক ফেলো না গো, বডি শুনবে? ওদের সব সময় খাড়ি পরে থাকতে হয়, শুধু শোয়ার সময় ছাড়া। খারি পরে শুলে ঘুম আসে না। চাত্তারা দুলালীর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, আমাদের গুরু মায়ের মাথায় মস্ত টাক। সবাই জানে। চ্যান করে ঘরে আসার সময় মাথায় গামছা দিয়ে আসে। .তবুও বোঝা যায়। কম বয়সে ছিবড়ে নিলে নাকি টাক পড়ে না। গলার স্বরটাও খ্যারখ্যারে হয় না। দ্যাখ না, হাসির গলার আওয়াজটা কেমন ভারি মিষ্টি।

অনেক সময় সন্ধেবেলায় খিলুয়া-র আসর বসলে মাথা থেকে খাড়ি ফেলে দেয়। শাড়ি ছেড়ে শুধু সায়া পরে থাকে। যাদের ব্লাউজের তলায় ইলু ইলু বল থাকে, খুলে রাখে। যেন নিজের প্রত্যঙ্গ খুলে রেখেছে। সে এ আজব দৃশ্য। খিলুয়া-র ঘোরে কোনও-কোনও আকুয়া’ দাঁড়িয়ে পেচ্ছাপ করতে শুরু করে দেয়। কেউ দেখে ফেললে চার অক্ষরের গালি ছুড়ে মারলে বসে পড়ে। সকালে সবাই স্নান করে শাড়ি-শায়া মেলে দেয় উঠোনের তারে, গামছা বা শায়া বুক পর্যন্ত উঠিয়ে তাড়াতাড়ি ঘরে যায় যেন কেউ দেখে ফেলবে। এগুলো সব মায়ের শেখানো ছেনালি। ঘরে গিয়ে দাঁতে কাপড় কামড়ে দু’হাত পিছনে নিয়ে গিয়ে ব্রেসিয়ারের স্ট্র্যাপ লাগানোর চেষ্টা। আর বেচারা ব্রেসিয়ার, তার ওই কাপড়ের ঠোঙাটা তেমন কিছু না-পেয়ে হতাশায় দুমড়ে থাকে। ঘরের মধ্যে থাকলে সচরাচর ওর মধ্যে কিছু ভরে দেয় না। বাইরে বেরনোর সময় ভরে রাখে, কিংবা ‘পারিক’ বসাবার সময়। সব সময় যে জল-ভরা গোল বেলুন বা ইলু রাখে তা নয়। ইলু-টা বড্ড নড়ে, আর হালকা একটা জলের শব্দ করে ছলছল, ছলছল। ওই শব্দটা বড় করুণ। নদীর ঘাটের কাছে জলগুলো এই শব্দই করে। বড় বিষণ্ণ, বড় করুণ।

এই হল মুশকিল। দুলালের মধ্যে অনিকেত ঢুকে গেল। দুলালের পক্ষে ওই অনুভূতিটা দিলে বোধহয় ঠিক হয় না। বরং লেখা যায়—ইলু-র ওই ছপরছপ শব্দ শুনে মনে হয় ওর বুকে যেন অন্য কেউ বসে আছে।

এজন্যই তো অনেকে জল-ভরা বেলুনের বদলে রবারের বল রাখে। ওতে শেপ ভাল হয় না। তাই অনেকে বলটা মাঝখান দিয়ে চির অর্ধেক করে নেয়, কেউ-বা স্পঞ্জ বা ফোমের টুকরোর পুঁটুলি ঢুকিয়ে নেয়। অনেকের আবার হরমোনের গুণে, বা ছিন্নি হওয়ার কারণে, বা ট্যাবলেটের কারণে কিছুটা বুক তৈরি হয়ে যায়। তার ওপর ওরা প্যাডওলা ব্রেসিয়ার পরে।

গোঁপ-দাড়িগুলো এখনও মুশকিল করছে। সন্না দিয়ে কিছুটা গোঁপ-দাড়ি গোড়া থেকে তোলা হয়। ওর ঘরের সঙ্গী ময়না বা ঝুমকাই তুলে দেয়। আবার ময়নারও কিছু-কিছু তুলতে হয়। দুলাল পারে না, ঝুমকা তুলে দেয়। দুলালের খুব লাগে। ওই সময়টা মায়ের কথা মনে পড়ে দুলালের। গরমের সময় ফোঁড়া উঠত, সবাই বলত আম খাওয়ার ফোঁড়া। মা গরম জলে ন্যাকড়া দিয়ে ফোঁড়ার ওপর ধরত ফোড়া ফাটানোর জন্য। ফোড়ার পাশে দু’আঙুলে টিপত ফাটানোর জন্য। আর ব্যথা ভোলানোর জন্য বলত—ব্যথা কই? উড়ে গিয়েছে। ক্যামনে উড়ল? পাখা দিয়ে। কোথায় গেল? পান্তাভাতে। পান্তাভাত খেয়ে দুলুর পেট ঢাইটাই। ওমা! ফোড়া দেখি নাই। আর এত বছর পরে গোঁপ-দাড়ির রোঁয়া টানার সময় ঝুমকা বলছিল, কিছু না, কিচ্ছু না, এই তো সোনা বেটি হল। এই তো সোনা স্বামী পেল। সোনা পাবে জম্মু লিকম। সোনার স্বামীর পকেট ঝমঝম।

তারপর একটু বোরোলিন মাখিয়ে দেওয়া মুখে।

সেজে-গুজে সকালবেলায় বাঁধাইয়ে বেরনোর সময় গুরুমা দরজায় দাঁড়ায়। ওরা দু’টো দলে ভাগ হয়ে কাজে যায়। দুলালী চাত্তারার দলেই আছে। সঙ্গে হাসি আর ঝুমকা। বাকি দু- তিনজন বাজারে বা ট্রেনে ‘মাংতি’ তোলে। যদি তিনটে দল হত, মা খুশি হত। একজন মায়ের ‘ক্যালি’ নির্ভর করে কতজনকে দীক্ষা দিয়েছে তার ওপরে। এই বিশ্বে সৃষ্টির নিয়মই হল সংখ্যা বাড়ানো। হিজড়েরা জন্ম দিতে পারে না, তবে তাদের সংখ্যা বাড়ে হিজড়ে-মা’র দাগ খেয়ে। . দীক্ষাকে আদর করে ওরা বলে ‘দাগ-খাওয়া’। গুরুমা ওর রোজগেরে দাগি মেয়েদের দেখে তৃপ্তি পায়। মা হাত নাড়ে। যেন বলছে, দুগ্গা দুগ্গা। যেন বলছে, জয় করে ফিরে এসো।

চাত্তারা-র ঢোলে ওর আঙুল নড়ে, খেলা করে। মৃদু শব্দ তৈরি হয় বুদুম বুম। বুদুম বুম উত্তরের হাওয়া বয়। বসন কাঁপে।

৩৮

পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির সামনে ম্যারাপ বেঁধে কবিতা উৎসব চলছে। প্রচুর কবির ভিড়। যাঁরা শ্রোতা, ওঁরাই কবি। আজ দু’টো পর্বে কবিতার অনুষ্ঠান। প্রথম পর্বের নাম ‘দূরে নির্জনে’, দ্বিতীয় পর্বের নাম করা হয়েছে ‘উদ্ভাস’। ‘দূরে নির্জনে’ পর্বে মফস্সলের কবিদের ডাকা হয়েছে। ‘উদ্ভাস’ পর্বে নবীন, নতুন কবিদের

এখন বিকেল পাঁচটা। শীতকাল, সন্ধে নেমে গিয়েছে। দর্শকাসনে ভিড় মোটামুটি ভালই। দূরদূরান্ত থেকে কবিরা এসেছেন, সঙ্গে স্ত্রী, কেউ-বা সন্তান নিয়ে। বাঁকুড়া-বীরভূম-মেদিনীপুরের কবিরা অনেকেই প্রবল প্রেমের কবিতা লিখলেও প্রেমিকা নিয়ে কলকাতা আসার সাহস দেখাতে পারেন না। তবে অধিকাংশ কবির প্রেমিকা-ই হল ‘মানসী’। মনের গহনে থাকে।

এখন যেমন, একজন অতি নিরীহ কবি বলছেন—আমার রতি-প্রার্থনা ফিরিয়ে দিয়েছ তুমি, আমি সন্ত্রাসবাদী হয়ে উপড়ে দেব ট্রেন লাইন। মাইন পুঁতে রাখব পথে-পথে, তারপর এক আশ্চর্য মেশিনগানে ট্রিগার টিপব, যেখান থেকে ধাবিত হয় চুম্বন।’ লোকটি পাজামার ওপর একটা কাজ করা পাঞ্জাবি পরেছেন। চুল বড়। রোগা শরীর। বয়স চল্লিশের মতো হবে। চামড়া কুঁচকে গিয়েছে।

একজন মহিলা-কবি, মেদিনীপুর থেকে এসেছেন। আধুনিকা হওয়ার চেষ্টায় চোখে কালো চশমা। কবিতা পাঠের পূর্ব মুহূর্তে কালো চশমা খুললেন। ওঁর কবিতা পাঠকালীন ঘন-ঘন ফ্ল্যাশ জ্বলতে লাগল। একজন বালক ও এক প্রায়-প্রৌঢ়ের মধ্যে ক্যামেরা টানাটানি চলছে। বালকটি কেবল বলছে, বাবা, আমায় দাও, আমি তুলব।

পরের পর্বের তরুণ কবিরা পেছনের দিকে জটলা করছে। অনেকের গায়ে বাহারি পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবের সন্ত্রাস এখন পাঞ্জাবিতে চালান হয়েছে। কোনও পাঞ্জাবিতে লেখা—’হলুদ কঠিন ঠ্যাং উঁচু করে ঘুমাবে সে শিশিরের জলে’। লম্বা পাঞ্জাবির তলায় পাজামা-মোড়া লিকপিকে ‘হলুদ কঠিন ঠ্যাং’ দেখা যাচ্ছে। কোনও-কোনও পাঞ্জাবিতে লেখা ‘শুধুই নীরার জন্য’। অন্য কোনও তুর্কি-কবি অন্য তুর্কিনীকে বললেন—এরা এখনও নীরা নিয়ে পড়ে আছে।

অনিকেত কলকাতা ‘মিস’ করে। মানে, এই সব অনুষ্ঠানগুলো। একাই ঘুরছে। দু’-একজন পরিচিতের সঙ্গে দেখা যাচ্ছে। এমন সময় ঘোষণা হল—এবার বর্ধমানের ভাতার থেকে আসা প্রেমার্থ কবি কবিতা পড়বেন।

‘প্রেমার্থ কবি’? এই কবিকে মনে পড়ল অনিকেতের, কবিতা পাঠাতেন রেডিও-র সাহিত্য অনুষ্ঠানে পাঠ করার জন্য। অমোঘ লাইন কয়েকটা এখনও মনে আছে। “তুমি নারী নিউটন- ফেল আকর্ষকরণী তুমি নারী আলফা বিটা গামিনী…’। ওখানে বারবারই রিজেক্টেড হয়েছেন, কিন্তু কাব্যসাধনা চালিয়ে গিয়েছেন।

একটা হুইলচেয়ারে বসে আছেন একজন ছোটখাটো মানুষ। একজন মহিলা ঠেলছেন। মঞ্চের সামনে নিয়ে গেলেন হুইলচেয়ার-টা। মঞ্চের ওপর হুইলচেয়ার ঠেলে তোলার ব্যবস্থা নেই। সিঁড়ি আছে। কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে ওঠানো যাবে না।

ঘোষক বললেন, আমাদের এই কবি শারীরিক প্রতিবন্ধী। উনি মঞ্চে উঠতে পারবেন না। উনি মঞ্চের সামনেই হুইলচেয়ারে কবিতা পড়বেন।

প্রেমার্থ কবি-র কবিতা সম্পর্কে একটা ব্যঙ্গভাব ছিল অনিকেতের। এক মুহূর্তে নিজেকে ছোট মনে হল। মানুষের কত দিক থাকে। একদিক দিয়ে দেখলে একটা মানুষকে বোঝা যায় না। পিরানদেলো-র কথা মনে পড়ল। পিরানদেলো বলতেন, সামগ্রিক সত্য খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। একটা দৃষ্টিকোণে যেটা ‘সত্য’ বলে মনে হয়, অন্য দৃষ্টিকোণে সেই ‘সত্য’ পাল্টে যায়। প্রেমার্থ কবি-র সামনে মাইক্রোফোন রাখা হল। উনি পড়ছেন

তোমায় নিয়ে চাঁদে গেছি। চাঁদেতে কম ‘জি’
তোমায় আমি কাঁধে নিয়ে কেবল লাফাচ্ছি
যেই না তোমায় চুমু খেলাম অমনি কী হল-
বিদ্যুৎ মোক্ষণে তৈরি অশান্ত এইচ টু ও।
তৈরি হল জলের ধারা আমরা সাঁতরাচ্ছি
চাঁদেতে খুব সাঁতরে মজা ওখানে কম ‘জি’

অনিকেত এবার ‘জি’র মানেটা বুঝল। ওটা ‘G’ : গ্র্যাভিটেশন। মাধ্যাকর্ষণ এর ধ্রুবক-ে ‘G’ শব্দে চিহ্নিত করা হয়। কবিতাটা বেশ বড়ই। কম করে কুড়ি লাইন। কোমরের তলা থেে বাকি অঙ্গগুলো কাজ করে না। ও কবিতায় লাফাচ্ছে, সাঁতরাচ্ছে, উড়ছে, ডিগবাজি খাচে চন্দ্রলোকে। অনিকেতের খুব ইচ্ছে হল কবিটির সঙ্গে আলাপ করে

—আপনি বুঝি খুব বিজ্ঞান-মনস্ক, তাই না?

কবি বললেন, ঠিক ধরেছেন। আমি প্রেমের সঙ্গে সায়েন্স-টা পাঞ্চ করে লিখি। এই কবিতা ওই জায়গাটা বুঝতে পেরেছেন তো, যেখানে হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন মিলে জল তৈরি হল। এজন্য বিদ্যুতের স্পার্ক লাগে। চুম্বন হল সেই পার্ক।

অনিকেত বলল, হ্যাঁ, সেটা বুঝতে পেরেছি। কিন্তু চাঁদে হাইড্রোজেন আর অক্সিজে কোত্থেকে এল সেটা বুঝতে পারিনি।

প্রেমার্থ কবি হাসলেন। বললেন, ওটা কবি-কল্পনা।

—’প্রেমার্থ’ তো ছদ্মনাম। একটা আসল নাম আছে তো?

—এটাই আসল এখন। এই নামেই সবাই চেনে।

—’প্রেমার্থ’ মানে কী?

—’প্রেমই অর্থ যার’। অর্থ মানে ‘মানি’ নয়। ‘মানে’।

—ও, আপনি সায়েন্সের স্টুডেন্ট?

—ওই আর কী, বিএসসি-তে ভর্তি হয়েছিলাম। তারপর তো অ্যাক্সিডেন্ট। আমি সাইকেলে, মোটরগাড়ি ধাক্কা মারল। শিরদাঁড়াটা গেল, শিরটা ঠিকঠাক রয়ে গেল ভাগ্যিস!

–কবিতা লেখা ছাড়া আর কী করেন?

–সারের দোকান আছে। ‘প্রেমার্থ সার সম্ভার’। প্রেমই সকল কিছুর সার। আর জীবে পটাশ বলুন, ইউরিয়া বলুন, সবই তো প্রেম। এ নিয়ে আমার একটা কবিতা আছে। চারদিে তাকান ‘প্রেমার্থ কবি’। যে-মহিলা হুইলচেয়ার ঠেলছিলেন, তিনি বললেন, ওটা এখন থাক শোনা যাবে না। নতুন কবি উঠে গিয়েছে।

‘প্রেমার্থ কবি’ পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমার স্ত্রী। রঞ্জনা।

রঞ্জনা হাসলেন। সবচেয়ে ভাল, দিব্য কবিতাটি রচিত হল যেন, অথবা বলা যায়, কবি উৎসবটাই ঝলমল করে উঠল।

এই যে প্রেমার্থ কবি, যাঁর নিম্নাঙ্গ অবশ, তিনি উদ্দাম প্রেমের কবিতা লেখেন। যাঁর নিম্না ক্রিয়াহীন, তাঁর প্রেমিকা আছে। স্ত্রী আছে। প্রেম নেই নয়, প্রেম-ও আছে। হে পূর্ণ তব চরণে কাছে যাহা কিছু সব আছে আছে আছে। কেমন একটা তৃপ্তির নিশ্বাস পড়ল অনিকেতের অনিকেত এবার একটু পিছনের দিকে যায়। কয়েকজনের একটা জটলা। দেখেই বোঝা যায় ওদের ‘কোতি’ ভাব। ওখানে পরিমলকে দেখতে পেল অনিকেত। মঞ্জুর ছেলে। পরি অনিকেত দূরে সরে গেল।

পরিমল কবিতা পড়ার ডাক পেয়েছে। পরিমল ‘প্রবর্তক’ পত্রিকায় দু’টো কবিতা লিখেছিল—’পরি’ নামে। নিজের অনুভূতির কথা লিখেছিল ওখানে। মামার বাড়ি গিয়ে জিম করতে দেখা পেশি-শরীরের পুরুষ, যার গায়ে ঘামের শিশির, সেরকম পুরুষ-শরীরের মুগ্ধতার কথা লিখেছিল, জয় গোস্বামীর ‘বেণীমাধব বেণীমাধব’ কবিতাটার ছন্দ চুরি করে। পরে বুঝেছিল ওগুলো কিছু হচ্ছে না, কবিতার ধরন পাল্টে ফেলেছিল। নামটাও পাল্টে ফেলেছিল। নাম নিয়েছিল সৌগত পাল। সৌগত পাল নামে ‘অবমানব’ পত্রিকায় কবিতা লিখেছিল দু’টো। ওই সব কবিতায় নিজের অস্তিত্বের সংকট ও লিখতে চেষ্টা করেছিল। ও লিখেছিল—দ্বিঘাত শরীরে অনেক মায়ার বাস…।’ এখন শুধু নিজের লিঙ্গ-প্রবণতার কথাই লেখে না, ও বুঝেছে কবিতার আরও অনেক বিষয় আছে। নিজের যৌন-পরিচয়ের সমস্যা নিয়েই লিখবে কেন? একজন কবির অনুভূতিতে পৃথিবীর নানা বিষয় নাড়া দিতে পারে। নানা পত্র-পত্রিকায় কবিতা পাঠিয়েছে পরি ‘সৌগত পাল’ ছদ্মনামে। ছাপাও হয়েছে কিছু-কিছু। ‘দেশ’ পত্রিকাতেও পাঠিয়েছিল দু’টো। ছাপেনি।

চক্রবাক’, ‘মায়ামৃদঙ্গ’, ‘সোনার তরী’ এসব পত্রিকায় ছাপা হয়েছে ওর কবিতা। সম্পাদকরা দেখাও করতে চেয়েছে কফি হাউসে, কিন্তু ওসব দেখা-সাক্ষাৎ সুখের হয়নি। কারণ ওর মেয়েলিপনা। প্যাঁক খেয়েছে। কখনও মৃদু, কখনও জ্বালা-ধরা। আঁতেলদের নানা স্তর আছে। উচ্চস্তরীয় আঁতেল-মন্তব্য এরকম—তুমি তো দেখছি পৌরাণিক কবি। ‘ব্রহ্মভার্গব পুরাণ’ থেকে উঠে এসেছ মনে হয়। ‘ব্রহ্মভার্গব পুরাণ’ মানে—কমল চক্রবর্তীর লেখা হিজড়েদের নিয়ে একটা উপন্যাস। উপন্যাসটা পড়েনি পরিমল, তবে নাম শুনেছে। আর একেবারে পেতি- আঁতেলদের মন্তব্য, এরকম লিরিক লেখো?

—কেন বলুন তো?

—কয়েকটা আধুনিক লিরিক লিখে তবে ওদের দিয়ে দাও, যারা ঢোল বাজিয়ে গান করে।

আর এই দুই ধরনের মাঝমাঝি অনেক মন্তব্য শুনতে হয়েছে ওকে। ওরা কফি হাউস ছেড়ে যখন অন্যত্র আড্ডা মারতে গিয়েছে, ওকে নেয়নি।

যখন টেবিলে পুঁজিবাদের সংকট কিংবা ফান্ডামেন্টালিজ্ম সম্পর্কে কোনও আলোচনা হত, সবাই যে যার মতো ভাট বকত, তখন ও কিছু বলতে চাইলেও, থামিয়ে দেওয়া হত। যেন এসব বিষয়ে কথা বলার মতো ‘ফান্ডা’ ওর নেই।

ও ‘সৌগত’ নামে লেখার আগে ‘পরি পাল’ নামেও লিখেছে দু’-একটা কবিতা। সেক্ষেত্রে আবার অন্য সমস্যা। একটা কবিতা লিখেছিল এরকম :

ও বাবু, মাথায় পালক টুপির বাবু,
ফের কেন বউ আনবে ঘরে
আমার মতন মেয়েকে যখন
রেখেছো আদর করে
আরও মাংস চাও তুমি, তুমি মাংসভুক
কোথায় কতটা মাংসে তোমার শরীরে আসে সুখ…

সম্পাদক একটা পোস্টকার্ড ছেড়েছিল :

প্রিয় পরি, আসুন না কোনও শনিবার। বসন্ত কেবিনে বসি, কলেজ স্ট্রিটে। কফি হাউসের ভিড়ভাট্টায় বসি না। বসন্তে নিজেরা ক’জন স্বজন থাকি। আরও ভাল লিখুন। সৌরভ রায়, সম্পাদক। চারুশিল্প।

পরি দেখা করতে গিয়েছিল। ব্যাগে আরও দু’টো কবিতা ছিল।

কতদিন পর ‘বসন্ত কেবিন’-এ এল পরি। লাস্ট অরূপদা নিয়ে এসেছিল বছর খানেক আগে। ব্রেস্ট কাটলেট খাইয়েছিল। ‘ব্রেস্ট’ বললেই কী যেন মনে হয়। কেমন যেন।

বসন্ত কেবিনে খুব বেশি ভিড় থাকে না। ভিতরে একটা টেবিলে দেখল পাঁচ-ছ’জন। দু’জন মহিলা। জায়গাটা ধোঁয়াময়, মানে কয়েকজনের সিগারেটের সমবেত ধোঁয়া। পরি জিগ্যেস করেছিল, এখানে কি সবাই চারুশিল্প-র লোকজন?

—হ্যাঁ। কাকে চাই?

—সম্পাদক আছেন? সম্পাদক আমাকে দেখা করতে লিখেছিলেন।

বাহারি ফতুয়া পরা একজন অবাক চোখে তাকায় পরির দিকে। বয়স বছর চল্লিশ।

—আপনার নাম?

—পরি পাল।

—আপনি পরি পাল?

অবাক চোখে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকে সম্পাদক। ওর শরীরটা জরিপ করতে থাকে।

সেদিন পরি প্যান্ট-শার্ট পরেই গিয়েছিল। একটু ঢোলা শার্ট। ভেতরে-ভেতরে কিন্তু ‘ব্রেস্ট’ একটু করে তৈরি হচ্ছিল ওর। ‘প্রবর্তক’, ‘বম্বে দোস্ত’ এসব পত্রিকার উপদেশ-মতো রোজ একটা করে জন্ম-নিয়ন্ত্রণের বড়ি খাচ্ছিল। ওসব বইতে ইস্ট্রোজেনের কথা লেখা ছিল। কিন্তু ডাক্তার না-লিখে দিলে ওষুধের দোকান ওসব ওষুধ দেবে কেন? অরূপদাকে কতদিন বলেছিল ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে। কিন্তু অরূপদা নিয়ে যায়নি। উল্টে অরূপদা বলেছিল, মালা-ডি খাও, ওতেই হবে। সস্তা-ও।

একটু-একটু করে হচ্ছে কিন্তু। ‘গোকুলে বাড়িছে’। কিন্তু এখনই শালোয়ার-টালোয়ার পরার ইচ্ছে নেই। আর একটু হোক…।

সম্পাদকের কী অন্তর্ভেদী দৃষ্টি! সেই দৃষ্টির তাপ খাদির কাপড় ভেদ করে ওর বুকে গিয়ে লাগে।

নাম শুনে আমাকে মেয়ে ভেবেছিলেন, না? পরি বলে।

সম্পাদক বলেছিলেন, হ্যাঁ, তাই। এছাড়া কবিতাটাও তো নারীবাদী কবিতা….।

একটি দাড়িওলা ছেলে বলে উঠল, সে কি সৌরভদা, নতুন লোক দেখে ভদ্র হয়ে গেলেন? আপনি তো ‘মাগিবাদী’ বলতেন…।

সম্পাদক হেসে বললেন—ওই একই হল। পরির দিকে তাকিয়ে বললেন, বসুন বসুন।

কোথায় বসবে? টেবিলের তিন দিকেই চেয়ার। দু’জন মহিলা পাশাপাশি বসে আছেন। ওঁদের পাশে একটা বেঞ্চি আছে। ওখানেই বসল। ও বসতেই, মেয়েরা একটু করে সরে গেল।

সম্পাদক বললেন, এই নামগুলো বেশ কনফিউজিং। নলিনী, পরি—এগুলো কখনও ছেলেদের নাম হয়? আচ্ছা, ডোন্ট মাইন্ড, আপনি কি পিওর ব্যাটাছেলে?

একটি মেয়ে খিলখিল করে হেসে উঠলেন। পিওর ব্যাটাছেলে…হিহি হিহি। অন্য একজন বললেন, লালিমা পাল (পুং)। পরি বলল, লালিমা পাল (পুং) হই বা মুং হই, কবিতাটা কি ভাল হয়েছিল?

—নিশ্চয়, নিশ্চয়ই ভাল হয়েছিল, নইলে আসতে বলব কেন?

পরি তখন ব্যাগ থেকে দু’টো কবিতা বের করে। ওদের টেবিলে রেখে একটা গেলাস চাপা দেয়। বলে, ভাল লাগলে ছাপবেন। উঠে পড়ে পরি। বেরিয়ে যায়।

বেশ তেজ দেখাল পরি, কিন্তু যখন ও বসন্ত কেবিন থেকে বেরচ্ছিল, তখন বেশ বুঝতে পারছিল মোটেই খটমট খটমট করে স্মার্ট ফুট স্টেপ পড়ছে না। ও যেমন হাঁটে, তেমনই হাঁটল। একটু বঙ্কিম। কোমর এবং হাত দোলে।

ওই কবিতাগুলো ছাপা হয়নি কখনও। আগে ‘প্রবর্তক’ পত্রিকায় শুধু ‘পরি’ নাম দিয়ে যা লিখেছে, ওগুলো হাবিজাবি। বাংলা অনার্সের ছাত্র হয়ে ও বেশ বোঝে। ওই লেখাগুলো থেকে নিজেকে কিছুটা আলাদা করার জন্য ‘পরি পাল’ নামে লিখতে গেল। ও বুঝল, সম্পাদকরা ওকে মহিলা ভাবছে, মহিলা ভেবে আহ্বান করছে, কিন্তু ওরা তো ভিতরের মহিলা-সত্তাটাকে দেখতে পাচ্ছে না, যেটা অ্যাবস্ট্রাক্ট, যেটার মূর্তি নেই, ওরা তো বাইরেটাই দেখছে, দেখে আশাহত হচ্ছে। আর এটাও বেশ বোঝে যে, মেয়ে হলে কবিতা ছাপাতে সুবিধে হয় সম্পাদকরা প্রায় সবাই পুরুষ, এবং মেয়েদের ওপর একটা বিগলিত ভাব দেখায়। ওসব সুবিধা আহরণ করার দরকার নেই, থাক। পরি ভেবেছিল পুরুষ-নামেই লিখবে—যতদিন না পরিপূর্ণ নারী না-হতে পারছে। ‘পরিপূর্ণ’ মানে বাইরের পূর্ণতা। ‘বাইরের পূর্ণতা’ মানে নারীসুলভ মাংস-সংস্থান। মাংস ব্যবস্থাপনা।

কিন্তু পরিমল নামটা ব্যবহার করতে ইচ্ছে করল না একদম। এই নামটা ওর স্কুল-কলেজে। আইডেন্টিটি কার্ডে। এই নামটাকে ভালবাসে না ও। একটা নতুন নামে লিখবে। হঠাৎ ‘সৌগত নামটা মনে এল ওর। হাতের কাছে অবমানব’ পত্রিকাটা ছিল। ওটা কিনত ‘পাতিরাম’ থেকে। সোমনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় যার সম্পাদক। কবিতাটা ছাপা হয়েছিল। এরপর সৌগত পাল নামে আরও কবিতা লিখেছে বেশ কিছু কাগজে। সেই সুবাদেই আজকের কবিতা উৎসবে ডাক পাওয়া।

অরূপদাকে আসতে বলেছিল, অরূপদা আসেনি। কবিতা লিখেও তেমন কবি-বন্ধু হয়নি ওর। ওর ‘মেয়েলি’ চালচলন আধুনিক, পোস্টমডার্ন, বারদুয়ারি-খালাসিটোলা ফেরত মুক্তমনের কবিরাও মেনে নিতে পারেন না।

সৌগত পালের নাম ঘোষণা হল। মঞ্চে ওঠার সময় ওর মনে হচ্ছিল, ও আসলে কে? পরি? পরিমল? না কি সৌগত?

ও একটা অন্যরকম কবিতা এনেছে। নারীবাদীও নয়, ওর দ্বিখণ্ডিত সত্তারও নয়, অন্যরকম। অন্যরকম মানে ‘সাধারণ’। পাঁচ পাবলিকের কবিতা

আমার প্রথম কবিতার নাম ‘ঋণ’।
সব ঋণ শোধ করে দেব একদিন।
যা কিছু শুশ্রূষা পেয়েছ, তার
হিসেব রেখেছি রুমালের গিঁটে।
যা কিছু অপমান, সেটাও সঞ্চয়
শরীরে ব্লেডের দাগে হিসেব রেখেছি।
যত ঋণ আছে কাশে, কিংশুকে
হিসেব রেখেছি ছোট এই বুকে
বহে যাওয়া জল, কেশে যাওয়া বুড়ো বাস
সবাইকে বলি আয়, আয়, আয়
ভালবেসে সব ঋণ শোধ করা যায়।…

দু’টো করে কবিতা পড়ার কথা ছিল। পরের কবিতা :

একটা পদ্য লিখে ফেলে দেখছি রে ভাই
ভুলে-ভরা পদ্যখানা শোধরানো চাই
আসলে তো পদ্যখানা নিজের কথা
জীবনটাতে ভর্তি কত ছাতা-মাথা
শোধরাব কী? পাণ্ডুলিপি নয়তো জীবন
কিংবা কোনও চিত্রনাট্য, যেমন-তেমন
বদলে দেব কেটে-জুড়ে এমন করে
মহান পাঠক পড়েন যাতে শ্রদ্ধাভরে…

পড়তে গিয়ে ওর মনে হচ্ছিল, এটাও তো নিজের কথা বলা হয়ে গেল, পরির কবিতা এটা, সৌগত পালের নয়। এ এক মহা মুশকিল, নিজেকে একবার বিভক্ত করা, আবার বিভক্ত- সত্তাকে জোড়া দেওয়া। পরিমল বা পরি বা পরি পাল বা সৌগত কবিতাটা পড়ল। তেমন হাততালি কিছু পড়ল না। কবিতা পাঠের আসরে এক অদ্ভুত ব্যাপার। কে যে শোনে, কী যে শোনে…। কবিতা-পাঠ চলাকালে পাশের লোকের সঙ্গে গল্প করে। আবার কবিতা শেষ হলে যন্ত্রের মতো হাততালি দেয়। ওই তালিতে যে খুব উচ্ছ্বাস থাকে তেমন নয়। দিতে হয় বলে ‘তালি’ দেওয়া। কোন মানে নেই। হিজড়েদের ‘তালি’তে তবু মানে থাকে।

কবিতা পাঠ করে প্রথম টাকা পেল আজ। একটা খামে কড়কড়ে পাঁচটা পাঁচশো টাকার নোট। একটা ব্যাগ। এই ব্যাপারটা বেশ ভাল লাগল।

সামনে দু-একজন ওকে দেখে কেমন করে যেন তাকাল। ওর মনে হল। এসব জায়গায় কিছু মানুষ আসে নেহাত সময় কাটাতে। করার কিছু নেই। কিছুটা সময় বেশ কেটে যায়। বাংলা আকাদেমি সভাগৃহে কিছু মুখ সব অনুষ্ঠানেই থাকে। পরিবেশ দিবসের অনুষ্ঠান হোক, হিরোশিমা দিবস উদ্যাপন হোক, তথ্যের অধিকার সংক্রান্ত আলোচনা হোক, বা কবিতা পাঠের আসর হোক। দু-একজন মহিলাও আছেন এই দলে। কুঁচি দিয়ে শাড়ি পরা, হালকা লিপস্টিক দেওয়া একজন ষাট ছুঁইছুঁই মহিলা পরিমলের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। ওই মহিলা আগের জন্মে ব্রাহ্ম ছিলেন নির্ঘাত। না কি মোনালিসা? ওই হাসিটা প্রশংসার না ব্যঙ্গের ঠিক বোঝা গেল না।

হয়তো প্রশংসারই হবে, মুগ্ধতারই হবে। কিন্তু ওর কেন যে এরকম মনে হয়…।

ও আবার সেই আগেকার ঠেক-এর দিকেই যায়, যেখানে পরি আড্ডা মারছিল। আগের ছেলেগুলোর সঙ্গে আরও দু’জন যুক্ত হয়েছে এখন। যে-দু’জন এসেছে, ওরা মেয়েলি পোশাকে এসেছে। একজন জিসের সঙ্গে টাইট গেঞ্জি পরেছে। ওর নাম অলোক। ও একটা এনজিও- তে কাজ করে। বিদেশি এনজিও। ওর বয়স সাতাশ-আটাশ। খুব সেজেছে। দু’কানেই চকচকে আমেরিকান ডায়মন্ড। ঠোটে চকোলেট-রং লিপস্টিক। বুকটা বেশ স্ফীত। এবং এই স্ফীত বক্ষে সে বেশ গর্বিত, এটা প্রকাশ করছে। আর একজন এসেছে, তার নাম ছিল রতন। সে নিজেকে ‘রত্না” বলে প্রকাশ করে। সে কুর্তি-পায়জামা পরেছে। একটা বেগুনি ওড়নাও আছে। বারবার ও ওড়না দিয়ে বুকটা ঢাকার অছিলা করছে। ওর মুখে উজ্জ্বলতা নেই। ধূসর পাণ্ডুলিপির একটা পৃষ্ঠা ওর মুখের ভিতরে মিশে আছে। ওরা এসব জায়গায় আসে। সোমনাথের সঙ্গে এরা অনেকেই পরিচিত ছিল। সোমনাথ যখন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তখন এখানে আসত, ও যেহেতু সংস্কৃতি-মনস্ক, রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী, গানমেলা, কবিতা উৎসব— এসব অনুষ্ঠানে আসত, এসব ছেলে-ছুকরিরাও আসত। সোমনাথ এখন আর আসতে পারে না, কিন্তু এরা আগে। বলা যায় নন্দন চত্বরে এদের একটা ঠেক হয়

পরি আসতেই দু’জন একসঙ্গে বলে উঠল—অ্যাই, কত পেলি? পাঞ্জা? না কি ডবল পাঞ্জা?

পরি বলল, যাই পাই না কেন, তোদের খাওয়াব বলেছি, খাওয়াব।

একজন বলল, অলোকদাও খাওয়াবে। কী বানিয়ে এনেছে দ্যাখ না বম্বে থেকে। টাইট গেঞ্জি-পরা অলোক বুকটা নাড়িয়ে বলল, দেখলে হবে? খরচা আছে। কত দিনের সাধনা জানিস? সেই কবে থেকে হরমোন নিচ্ছি বল, মুদি দোকানের মালা ডি নয়, রীতিমতো এন্ডোক্রিনোলজিস্ট দেখিয়ে। তারপর বোম্বে গেলাম। আমি ভাই ‘মুম্বই’ বলতে পারি না, বোম্বে বলি। ‘বোম্বে দোস্ত’ পত্রিকা পড়তাম তো, একদম বোম্বাই মাল বানিয়ে এনেছি, বাড়ি এলে খুলে দেখাব। সবাইকে নয়, কবিকে।

—কেন? কবিকে কেন?

—ওটা দেখে ও দু’লাইন লিখে দেবে। ‘দেখলাম আহা দু’টো চাঁদ—ফেঁদেছে কী আজব ফাঁদ…’ পরির থুতনি নাড়িয়ে দিল।

অন্য একজন বলল, ওর কি চাঁদে লোভ আছে? ওর গাজরে লোভ।

অলোক বলল, ওর এখনও চাঁদে লোভ আছে, পেয়ারা-বাতাবি সব কিছুতেই, গাজরেও। তাই না রে ভাই?

আবার থুতনি নাড়িয়ে দিল পরির।

অলোক টাইট গেঞ্জি পরেছে বটে, উঁচিয়ে আছে, কিন্তু গলাটা ঘরঘরে।

তুলনায় রতনের গলাটা অনেক কোমল। সরু। রতন নাকি একটা নির্দিষ্ট খাদে গলা সাধে। রতন বলল, অ্যাই শোনো, কী খাওয়াবে খাইয়ে দাও। অলোকদা, টাকা বার করো, পরি, টাকা বার করো। ঠান্ডা লাগছে। গলা খারাপ হয়ে যাবে।

অলোক ওর খরখরে গলায় বলল, উঃ, খুব যে গলা কনশাস, তোর ওড়নাটা দিয়ে গলাটা পেঁচিয়ে নে না। না কি বুক থেকে ওড়না ওঠাবি না। কেউ মাই দেখে ফেলবে? আরে এটা তো পাঁচ টাকার মাই। আমার সব নিয়ে ষাট হাজার খরচা হয়েছে। ব্যাংক লোন করেছি। আরে ভাই, মন চাই, দিল চাই। যেটা চাইব, করে ছাড়ব। তাই না রে পরি?

পরির হাতটা চেপে ধরল। হাতটা টেনে নিজের বুকে ঠেকাল অলোক, বলল, ষাট হাজার। কেমন? সিলিকোন। দামি সিলিকোন। পরির হাতটাই ফের টেনে নিয়ে রতনের বুকে ঠেকাল। ন্যাকড়া। ন্যাকড়া। তাই না পরি?

রতন খুব অপমানিত হল।

বলল, ছিঃ, তোমাদের ঘেন্না করি। আই হেট। অলোকদা, তোমার সব অহংকার একদিন বিলা হয়ে যাবে। আমি এখানে থাকব না। তুমি পারলে সবার সামনে ন্যাকড়া বলতে? থপথপ করে তো হেঁটে যায় রতন। ওদের সঙ্গ ত্যাগ করে। ‘নন্দন’ ছাড়িয়ে শিশির মঞ্চের দিকে চলে যায়।

এর মধ্যে কেন আমায় জড়ালে? পরি অলোককে বলল, তুমি কী, অ্যাঁ?

পরিও ঠেক ছাড়ল। কী অসভ্য দ্যাখ, না খাইয়ে পালাল। পেছনে শুনতে পেল ফিসফিস।

রতন পরির খুব ভাল বন্ধু। রতনকে নানা কারণেই পরির বেশ ভাল লাগে। খুব ভাল সফ্ট টয় করে। খুব ভাল আর্টিস্টিক সেন্‌স। দোকানের লোকজন এসে ওর ঘর থেকে টেডি বেয়ার, তুলোর বার্বি, হাতি, পাখি এসব তৈরি করে। ফেব্রিক-ও করে। ওর সফ্ট টয়ের ঝড়তি-পড়তি তুলো আর স্পঞ্জ দিয়ে ইলু বানায়। বেশ ভাল হয়। পরিকেও একটা সেট প্রেজেন্ট করেছিল রতন। কলেজে বেশি দূর পড়াশোনা করতে পারেনি রতন।

ওর বোনকে কলেজে পড়ায়। ওর বাবার রোজগারপাতি ভাল নয়। স্ট্রাগ্‌ল তো করছে রতন। ‘রত্না’ হওয়ার স্ট্রাগলটা চালাচ্ছে। কত কষ্ট করে গলাটাকে এরকম সফ্ট করেছে, ভাবা যায় না। পরি গিয়ে রতনের পাশে বসল। পিঠে হাত দিল। হাত বুলোতে থাকল। পরি রতনের পিঠের ব্রা-এর স্ট্র্যাপ টের পায়।

রতন বলল, অলোকদার বাপের টাকা আছে, ভাল করে ব্রেস্ট ইমপ্ল্যান্ট করিয়েছে, তাতে আমাকে প্যাঁক দেবে কেন? আমি আমার মতো করেছি, যা পেরেছি করেছি। আমি তো আর ওর মতো টাইট গেঞ্জি পরে, লোক দেখাচ্ছি না, কিন্তু আমি যদি টাইট গেঞ্জি পরি, ওর চেয়ে মোটেও খারাপ দেখতে হবে না। তাই বলে ‘ন্যাকড়া’ বলবি? এটা ‘এলজিবিটি ইউনিটি’? আমি একদম একা-একা থাকব। তোদের কারও সঙ্গে হার্গিস মিশব না। চোখ দিয়ে জল বের হয় রতনের।

পরি ওর চোখের জল মুছিয়ে দেয়—রুমালে।

বলে, ভ্যাট, এ নিয়ে এত সেন্টিমেন্টাল হচ্ছিস কেন? ওর কথা উড়িয়ে দে। আমার খারাপ লাগছে ও আমাকে ব্যবহার করল বলে। আমার হাতটা ধরে টেনে নিয়ে তোর বুকে লাগিয়ে দিল। আমি কী করে বুঝব বল যে, ও আমার হাতটা ওদিকে নিয়ে যাচ্ছে? রাগ করিস না, হ্যাঁ? পরি রতনের একটা হাত শক্ত করে চেপে ধরে অন্য হাত কাঁধে।

এই সময় পুলিশ আসে। সাদা ইউনিফর্ম পরা পুলিশ। কী হচ্ছে এখানে?

.

অনিকেতের সঙ্গে তথ্য দপ্তরের একজন অফিসারের দেখা হয়ে গিয়েছিল। নন্দন-এর ভিতরে ঢুকে গল্প করছিল। যখন বেরিয়ে এল, বাড়ি যাবে, তখন দেখল, একটা পুলিশ, দু’হাতে একজনের কলার, অন্যজনের হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। একজন কুর্তি- পায়জামা পরা। অন্যজনের ছেলের পোশাক। পিছন দিক থেকে মনে হল-পরিমল হতে পারে।

অনিকেত দ্রুত পা চালিয়ে এগিয়ে আসে। দেখল সত্যিই পরিমল। এবং অন্যজন মেয়েদের পোশাকে-থাকা পুরুষ।

অনিকেত বলল, এদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? পুলিশটির ইউনিফর্ম থেকে ঘামের গন্ধ আসছিল। ওর গলায় মাফলার ছিল। মাফলারটা গলা থেকে পড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু দুই হাতে দু’জন—মাফলারটা পড়েই গেল। অনিকেত মাফলারটা উঠিয়ে দিয়ে পুলিশের গলায় ঝুলিয়ে দিয়ে বলল, ওদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?

—থানায়।

—কেন?

—নুইসেন্স করছিল। থ্রি সেভেনটি সেভেন-এ রীতিমতো অফেন্স।

—নুইসেন্স? নুইসেন্স মানে?

—বোঝেন না? জাপ্টাজাপ্টি চলছিল।

অনিকেত বলল, ওখানে আরও কত ছেলেমেয়ে বসে আছে। ওরাও তো কত কী করে। এদেরই ধরলেন কেন?

—ওরা থ্রি সেভেনটি সেভেন-এ পড়ে না। এরা দু’জনই ব্যাটাছেলে। বুকের ভিতরে স্পঞ্জ ঢুকিয়ে মেয়ে সেজে আছে। খুলে ফেললেই স্পঞ্জ-এর দলা বেরবে। দু’টো ব্যাটাছেলে এরকম করতে পারে না। আইন আছে।

অনিকেত ‘আইপিসি ৩৭৭’ ধারাটা জানে। প্রকৃতির বিরুদ্ধে পশু কিংবা পুরুষের সঙ্গে যৌনতাও অপরাধ হিসেবে দেখা হয়। কারনাল ইন্টারকোর্স এগেনস্ট দ্য অর্ডার অফ নেচার উইথ এনি ম্যান, উওমেন অর অ্যানিম্যাল শ্যাল বি পানি। ৩৭৭ বলছে, যদি স্ব-ইচ্ছাতেও কারনাল ইন্টারকোর্স হয়, তা হলেও অপরাধ হবে। এর বিরুদ্ধে ‘প্রবর্তক’ পত্রিকায় লেখা পড়েছে। ‘অবমানব’-এও লেখা পড়েছে অনিকেত। ১৯৯৬ সালে ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিকাল উইকলি’-তে বিমল বালসুব্রহ্মন্যম নাকি একটা মূল্যবান প্রবন্ধ লিখেছিলেন, অনিকেত পড়েনি যদিও, কিন্তু অনেকেই ওই লেখা থেকে নানারকম পয়েন্ট উদ্ধৃত করে। কাগজে পড়েছে কোনও এক ফাউন্ডেশন নাকি মামলা করবে, যেখানে এই প্রাচীন ধারাটাকে চ্যালেঞ্জ জানানো হবে।

অনিকেত বলে—দেখুন পুলিশ সাহেব, আমি একজন সাংবাদিক। ৩৭৭ ধারা কিছুটা জানি। ওখানে কারনাল ইন্টারকোর্স বেআইনি বলা হয়েছে। কিন্তু এখানে কোথায় ইন্টারকোর্স দেখলেন?

পুলিশ বলল, কারনাল ছাড়া কী করবে ওরা? দু’টোই তো ব্যাটাছেলে। পেছন ছাড়া ওদের আছে কী? সরি। আপনি আমাদের কাজে ডিস্টার্ব করবেন না। রেড করতে এসেছি, মাল রেড হ্যান্ড ধরেছি, থানায় যাবে, কোর্টে তুলব, তারপর যা হয় হবে।

অনিকেত বলল, কিছুই হবে না কোর্টে। ওদের কারনাল রিলেশনশিপ প্রমাণ করতে পারবেন?

—কারনাল না বার্নাল সেটা কোর্ট বুঝবে।

অনিকেত পকেটে হাত দেয়। পুলিশটা একটু থমকে দাঁড়ায়। ভাবে টাকা বের করছে। কিন্তু অনিকেত বের করে একটা আইডেন্টিটি কার্ড। ওখানে একটা অশোক স্তম্ভের ছবি ছিল। ওটা সামনে ধরে।

পুলিশ সাহেব বলে, ও কার্ড দেখাচ্ছেন? থানায় গিয়ে কার্ড দেখাবেন। একবার থানায় ঢোকালে ছাড়াতে অনেক খরচ। তার চেয়ে এখানেই মিটমাট করে নিন।

দু’শোটা টাকা বের করে অনিকেত। ওখানেও অশোক স্তম্ভ এবং গান্ধীজি আছেন।

পুলিশ ওদের ছেড়ে টাকাটা ধরে। বলে, কে হয়?

অনিকেত পরিমলের কাঁধে হাত দিয়ে বলে, আমার ছেলের মতো।

পুলিশ বলে—সাবধানে থাকতে বলবেন। এসব অভ্যেস যেন না করে। পারলে মেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করুক, বসুক না এখানে, কিচ্ছু বলব না। এখানে ছুঁড়িদের অভাব আছে কোনও? কেন স্পঞ্জ-মারা ছেলেদের সঙ্গে বসবে।

পুলিশটি সামনে এগিয়ে গাড়িতে ওঠেন। যাওয়ার সময় বলে গেলেন একবার থানায় ঢোকালে দু’হাজারের কমে হত না।

গাড়ি ছেড়ে দিল। পুলিশের গাড়ি। কালো ধোঁয়া। ক্রুর শব্দ।

কবিতা পাঠ চলছে। এখন যশোধরা রায়চৌধুরী।

সমুদ্রের তলে এই খেলা
যাপনে যাপনে। জলে জল।
আলাদা আলাদা করে কী করে সে
বলে দেবে বলো
কোনটা জননক্রিয়া, কোনটা প্ৰণয়
কোনটা ছল।

পরিমল অনিকেতের পা ছুঁয়ে প্রণাম করে। সঙ্গের কুর্তা পরা ছেলেটিও। ওদের চোখে মুখে কৃতজ্ঞতা।

…তোমরা কেউ জানো না কীভাবে আটকে রেখেছি
লাল-টেপ বন্দি ফাইলের মতো।
দপ্তরে দপ্তরে
এই কলসাকৃতি অন্ধকার, এবং অন্ধকার বিচ্ছিন্ন কলসিটির
বিষয়ে
যা কিছু ক্লিপ দিয়ে এঁটে রাখা হয়েছিল
সেসব নেংটি ছিঁড়েখুঁড়ে আজ বেরিয়ে এসেছে
আমার নিজের কথা
ঝলকে ঝলকে আমি বমি করে দিচ্ছি তোমাদের
সন্তানদের অনুদ্‌গত ভ্রুণ…
অনিকেত বলল, তোমরা যাও এবার। সাবধানে। ভাল থেকো।
কুর্তা-পরা ছেলেটি বলল, কী করে ভাল থাকব স্যর?
পরিমল বলল, আপনার সঙ্গে অনেক কথা আছে কাকু…

৩৯

টাকা দিতে হয় মাসে-মাসে। থানা থেকে নিয়ে যায়। পুলিশের সঙ্গে কথাবার্তা চাত্তারা-ই চালায়।

দুলালকে দেখে থানার লোক বলল, নতুন আমদানি? চাত্তারা ঘাড় নাড়ে।

—তবে ওর ‘লাইফ’-টা থানায় জমা দিয়ে দিও।

‘লাইফ-টা লেখার সময় মনটা কেমন যেন করে উঠল। ওর বাড়ির ঠিকানা, কে আছে, বাবার নাম, মা-র নাম, এসব লিখে দিতে হল। অনেক খুনি-ডাকাতরা নাকি গা ঢাকা দিয়ে থাকার জন্য হিজড়ে দলে ভিড়ে যায়। এত দিন হয়ে গেল, মা-কে একটা চিঠি লেখা উচিত ছিল। মায়ের জন্য, ছেলেটার জন্য মনটা চিরচির করে। মা নিশ্চয়ই কান্নাকাটি করেছে। পুলিশে কি খবর দিয়েছে? পুলিশে-পুলিশে নিশ্চয়ই ভাব আছে। ও যে পুলিশকে ওর ‘লাইফ’ জমা দিল, তার সঙ্গে যদি মা-র করা ডায়রি মিলে যায়? এখানকার পুলিশ আবার জোর করে ঘরে দিয়ে আসবে না তো? চাত্তারা-কে এই আশঙ্কার কথা জানাল দুলালী।

চাত্তারা বলল, ধুর, ওদের ভারি দায় পড়েছে। তবু যদি তোর মনে খোঁচ থাকে, ঠিকানা ভেল করে দে। সত্যিকারের গাঁয়ের নাম যদি দিতে না-চাস তো দিসনে।

ও মার নামটা ভুল লিখল, কিন্তু বাবার নামটা ভুল লিখতে পারল না। গাঁয়ের নামও ভুল লিখল।

চাত্তারা-কে কাগজটা দিল। আবার যখন থানা থেকে ‘থাপ্পু’ নিতে আসবে, তখন এটা দিয়ে দেবে।

তবে দুলাল একটা পোস্টকার্ড কিনে, একটা চিঠি লিখেই ফেলল—মা গো, চিন্তা করিও না, আমি ভাল আছি। প্রণাম নিও।

এইটুকু লিখে অনিকেত কলমটা কামড়ে ধরে আছে।

এবার কী লিখবে? কোন দিকটা নিয়ে। এই যে পানাগড়ের খোল-টা, এখানে বারো- চোদ্দোজন একসঙ্গে কমিউন করে রয়েছে, একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করছে, রোজগারপাতির ধরনটাও এক, কিন্তু সবাই তো এক নয়। প্রত্যেকেরই আলাদা-আলাদা ইতিহাস-ভূগোল এবং বিজ্ঞান।

অনিকেতের লেখার উৎস তো দুলালের আত্মকথন। সে আর কতটুকুই বা? বাকিটা তো কল্পনা। কল্পনারও একটা খাদ্য দরকার। খাদ্য পেলে কল্পনা হাসে, নাচে, জীবন্ত হয়। বিভূতিভূষণ ‘চাঁদের পাহাড়’ লিখেছিলেন কল্পনায়, কিন্তু সেই কল্পনার শরীর গড়েছে আফ্রিকা নিয়ে পড়াশোনা। পানাগড়ের এই খোল, এই হাসি, ফুলি, ঝুমকো, মহুয়া, ময়না, চপলা, মাধুরী—এরাও তো কল্পনার শরীরই পাচ্ছে, কিন্তু কল্পনাটা অকল্পনীয় হত যদি বইপত্রের সাহায্য না-পেত। যদি ইন্টারনেট সার্ফিং-টা না-জানত। বেশ কিছু ওয়েবসাইট পত্র-পত্রিকা। বইপত্র পড়া হয়েছে। একটা পুরনো ধারণা মন থেকে সরাতে বেশ সময় লেগেছে। ধারণাটা হ’ল হিজড়েদের উভলিঙ্গত্বের বিষয়ে, জন্মগত ত্রুটির বিষয়ে। অনেক উপন্যাস, কাহিনি ইত্যাদিতে দেখানো হয়েছে হিজড়েদের শারীরিক ত্রুটির কথা। কোথাও হিজড়েদের দিয়ে কাঁদানো হয়েছে। বাবা জগন্নাথ, আর জনমে ছাইলা কর

জন্ম সুরাই লেওহে—
আর জনমে ছাইলা, ছাইলা, ছাইলা,
আর জনমে মাইয়া মাইয়া, মাইয়া…।

তা তো নয়, এরা তো মেয়েই হ’তে চায়। অপূর্ণ লিঙ্গ বৈশিষ্ট নিয়ে কেউকেউ জন্মায় ঠিকই, ওদের মধ্যে কেউ কেউ হিজড়েদের দলেও যায়, কিন্তু বেশিরভাগই পুরুষ। নব্বইভাগ হার্মাফ্রোডাইট বা উভলিঙ্গ ওরা নয়। ওরা শরীরে যতটা, তার চেয়ে বেশি মনে। জিনেটিক কারণও দেখায় অনেকে। বলা হয় ক্রোমোজোমের গন্ডগোল এজন্য দায়ী। এখন সিদ্ধান্তে আসা গিয়েছে, ওই তত্ত্ব ঠিক নয়। একটা মানুষের কোষের ক্রোমোজোম-সজ্জাই হল তার ‘ক্যারিওটিক টাইপ’। ৪৬ xy হল একজন পুরুষমানুষের স্বাভাবিক ‘ক্যারিওটিক টাইপ’। ৪৬ xx একজন স্বাভাবিক নারীর।

‘স্বাভাবিক পুরুষ’ কাকে বলা হবে? যার ব্যাকরণসম্মত পুং-গোনাড আছে। একটি ঝুলন্ত পুঁটুলিতে একজোড়া শুক্র-উৎপাদক গোলক, শৈশব ও বাল্যে যা প্রায় নিষ্ক্রিয়, যৌবনাগমনে ক্রিয়াশীল। সেইসঙ্গে একটি নল, যা শুক্রনিক্ষেপে সক্ষম। পুরুষ-কোষে একটা y ক্রোমোজোম থাকে, যা স্ত্রী-কোষে থাকে না। y কেমন যেন প্রতীকের মতো লাগে। y অক্ষর-টিকে উল্টো করে লিখলে যে-ছবিটা তৈরি হয়, সেটা যেন নর-গোনাডের প্রতীক। নারী-কোষে y ক্রোমোজোম থাকে না। দু’টিই x ক্রোমোজোম। এর মধ্যে একটি পিতার কাছ থেকে পাওয়া, একটি মায়ের দান। একটি ডিম্বাণু ২৩ টা ক্রোমোজোম বহন করে, এর মধ্যে একটি সেক্স-ক্রোমোজোম, এবং সেটা x। একটি শুক্রাণুও ২৩টি ক্রোমোজোম বহন করে, তার মধ্যে একটি সেক্স ক্রোমোজোম। শুক্রাণুর বেলায় একটা সমস্যা আছে। কিছু শুক্রাণু y ক্রোমোজোম বহন করে, কিছু শুক্রাণু x ক্রোমোজোম বহন করে। কোন জাতের শুক্রাণুর সঙ্গে ডিম্বাণুর মিলন হচ্ছে, তার ওপর নির্ভর করছে ভ্রুণের লিঙ্গ। y ক্রোমোজোম বহনকারী শুক্রাণুর সঙ্গে ডিম্বাণুর সংযোগে পুত্রসন্তান, এবং x ক্রোমোজোম বহনকারী শুক্রাণুর সঙ্গে ডিম্বাণুর মিলনে কন্যাসন্তান জন্মাবে, এটাই নিয়ম।

কিন্তু আকাশভরা সূর্য-তারায় যে নিয়ম অনড়, বিশ্বভরা প্রাণের ক্ষেত্রে সে-নিয়মের অত কড়াকড়ি নেই। প্রাণের ধর্মই তো তাই। মহাকাশে বিভিন্ন বল ও গতিবেগের এদিক-ওদিক হলে অনর্থ হয়ে যাবে। সূক্ষ্ম অণু-পরমাণুর মধ্যেও নিয়মের কড়াকড়ি। সেখানে বেনিয়মেরও একটা নিয়ম আছে। কিন্তু প্রাণিজগতের নিয়মটা বড়ই কেমিস্ট্রি-নির্ভর। শরীরের নানারকম গ্রন্থি থেকে নির্গত হয় রাসায়নিক পদার্থগুলো। আবার গ্রন্থির কাজ নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্ক, আবার মস্তিষ্কের ওপর প্রভাব আছে মনের, মুডের, পরিবেশের…। সব প্রাণীর মন নেই, চৈতন্য নেই। চৈতন্যহীন কীটপতঙ্গের জীবন সম্পূর্ণ রসায়ন নিয়ন্ত্রিত। একঘেয়ে, একইরকম। মৌমাছি, পিঁপড়ে, উইপোকা সবার। এটাকেই অনেকে বলে ডিসিপ্লিন। চৈতন্য-সম্পন্ন প্রাণীর কেমিস্ট্রি-টা বড় ভজঘট ব্যাপার, বড় গোলমেলে।

ভাবা যায়, লক্ষ-লক্ষ শুক্রকীট দৌড়চ্ছে ফ্যালোপিয়ান টিউবের সূক্ষ্ম নালিকায়। কারও ঘাড়ে চেপে আছে Y ক্রোমোজোম, কারও ঘাড়ে চেপে আছে x ক্রোমোজোম। একটি মাত্র ডিম্বাণুর সঙ্গে শেষ পর্যন্ত একটি শুক্রাণুরই মিলন হবে, এবং ৪৬টি ক্রোমোজোম-সম্পন্ন একটি ‘জাইগোট’ তৈরি হবে। যদি দু’টি ডিম্বাণুর সঙ্গে দৈবাৎ দু’টি শুক্রকীটের মিলন ঘটে যায়, তবে দু’টি ‘জাইগোট’ তৈরি হচ্ছে। সেক্ষেত্রে যমজ সন্তান হচ্ছে। যমজের একটি কন্যা, অপরটি পুত্র হতে পারে। দু’টিই কন্যা বা দু’টিই পুত্র হতে পারে। আবার যদি একটি ‘জাইগোট’ ভেঙে যায়, এবং কোষ বিভাজিত হয়ে দু’টি আলাদা ‘জাইগোট’ তৈরি হয়, সেক্ষেত্রে যমজ সন্তান হবে একইরকম। দু’টিই পুত্র, বা দু’টিই কন্যা। এরা একইরকম দেখতে হয়, প্রায় একই চরিত্রের হয়ে থাকে, কারণ ওদের দু’জনের ‘ক্যারিওটিক টাইপ’ একই। একটা ‘জাইগোট’ ভেঙে দু’টি ‘জাইগোট’ তৈরি হয়েছে বলেই এরকম ঘটেছে, এদের বলা হয় ‘আইডেন্টিক্যাল টুইন্‌স’।

কিন্তু কখনও-কখনও নিষিক্ত জাইগোট-টিতে ৪৬টি ক্রোমোজোম থাকে না। ৪৫টি ক্রোমোজোম নিয়ে মানুষ জন্মেছে। যাদের ৪৬টির পরিবর্তে ৪৫টি ক্রোমোজোম থাকে, তাদের সেক্স-ক্রোমোজোম হল x। ওদের ক্যারিওটাইপ ৪৫x। এদের স্ত্রী-জননাঙ্গ থাকে। কিন্তু স্ত্রী- জননাঙ্গ থাকলেই কি কন্যা হয়? নারী হয়? নারী তো গর্ভধারণ করে। আবার সব নারী তো গর্ভধারণ করতে পারে না। জরায়ু ও ডিম্বকোষ থাকা সত্ত্বেও কোনও আভ্যন্তরীণ ত্রুটির কারণে গর্ভধারণে অক্ষম। তা বলে কি সে নারী নয়? এবার কেউ যদি বলে জরায়ু ও ডিম্বকোষ থাকলেই সে নারী, সেক্ষেত্রে বলার, যদি কোনও অসুখের কারণে ওইসব বাদ দিতে হয়, তা হলে কি সে নারী থাকছে না? পুরুষরা যখন স্বেচ্ছায় বা বাধ্য হয়ে অণ্ডকোষ কেটে ফেলে, তখন তাকে আর ‘পুরুষ’ বলে না। পাঁঠা হলে খাসি। ষাঁড়কে বলদ, মানুষকে ‘খোজা’। কী গন্ডগোল রে বাবা! এই যে এই খোলে কতজন রয়েছে—কয়েকজন লিঙ্গধারী, কয়েকজন ছিন্নি, মানে নির্বাণ হয়ে যাওয়া, মানে বহির্লিঙ্গ ছিন্ন করে দেওয়া, ওদের মধ্যে তফাত করা হচ্ছে না, ওরা সবাই হিজড়ে। কিন্তু হাসি, কিংবা ঝুমকো, কিংবা চাত্তারা, কিংবা আরও যারা আছে, তারা সবাই কী-কী ক্যারিওটাইপ নিয়ে জন্মেছিল? জানার কোনও উপায় নেই। এখন কি অনিকেত ওদের সব জটিল পরীক্ষা করাতে যাবে নাকি?

কথা হচ্ছিল ৪৫x-ওলা মানুষ নিয়ে। ওদের বাইরের জননাঙ্গ স্ত্রী-যোনির মতোই। কিন্তু কখনও অপুষ্ট হয়। ভিতরের ভাঁজটা নাও থাকতে পারে। জরায়ু হয় থাকে না, নয়তো খুব ছোট। ডিম্বাশয় থাকে না। এদের বুক চওড়া হয়। বুকে রোম গজাতে পারে, এই বুকেই কৈশোরে স্তনোদ্‌গম হয়। এদের চোখ ছোট হয়। ১৯৩৮ সালে একজন বিজ্ঞানী এদের ক্রোমোজোমের এই অসামঞ্জস্য আবিষ্কার করেন, এই আপাত-নারীদের লক্ষণগুলোকে বলা হল ‘টার্নার সিনড্রোম’। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে ওদের কিডনির গন্ডগোল হয়। কথাতেও জড়তা থাকে, বুদ্ধিসুদ্ধিও কম হয়। ‘টার্নার সিনড্রোম’-এ আক্রান্ত মানুষরা হিজড়ে সমাজে সুবিধে করতে পারে না। ওরা বেশিদিন বাঁচেও না।

ক্রোমোজোম-ঘটিত আর একটা গন্ডগোলের নাম ‘ক্লাইনেফেল্টার সিনড্রোম’। এদের ক্যারিওটাইপ ৪৭xxy মানে স্বাভাবিকের তুলনায় একটা ক্রোমোজোম বেশি। ৪৬xy হলে ব্যাটাছেলে হত। একটা এক্সট্রা x-এর জন্য পুরোপুরি ব্যাটাছেলে হয়ে-ওঠা হয় না। কৈশোরে এদের ‘গাইনিকোমাস্টিয়া’ হয়, মানে স্তন বেশ ফুলে ওঠে। এদের শিশ্ন থাকে, কিন্তু ছোট। কখনও বেশ ছোট। অণ্ডকোষও ছোট। সাধারণত বাইরেই ঝুলে থাকে। কিন্তু শুক্রাণু তৈরি হতে পারে না, মুখে দাড়িগোঁফ কম গজায়, এরা একটু লম্বা প্রকৃতির হয়। কোমরের তলার অংশটা ওপরের তুলনায় বেশি লম্বা হয়। এটাকে বলে “ইউনিকয়েড গ্রোথ’। মানে, ইউনাক-সুলভ গ্রোথ। কারও একটু মানসিক জড়তাও থাকে। ১৯৪২ সাল নাগাদ আমেরিকান বিজ্ঞানী ক্লাইনেফেল্টার এই শারীরিক লক্ষণগুলোকে ব্যাখ্যা করেন। সেই থেকে বইপত্রে ৪৭xxy বা ৪৮xxxy মানুষদের অস্বাভাবিকত্বকে ‘ক্লাইনেফেল্টার সিনড্রোম’ বলা হয়।

অনিকেত এসব তথ্য সংগ্রহ করেছিল বিভিন্ন বইপত্র এবং ইন্টারনেট থেকে। কিন্তু একটা প্রশ্ন ছিল : যেখানে ৪৬টা ক্রোমোজোম থাকার কথা, সেখানে বেশি আসবে কোত্থেকে? ডিম্বাণু থেকে ২৩টা, শুক্রাণু থেকে ২৩টা। নিষিক্ত হওয়ার পর ৪৬টাই তো থাকার কথা। বেশি আসবে কোত্থেকে?

জবাব পাওয়া গেল এমব্রায়োলজি-তে। মানব শরীরের কোষের ৪৬টা ক্রোমোজোম অর্ধেক হয়ে বিরাজ করে শুক্র ও ডিম্বাণুতে। ডিম্বাণু-র তুলনায় শুক্রাণু কয়েক হাজার গুণ বেশি তৈরি হয়। লক্ষ-লক্ষ শুক্রাণুর মধ্যে মাত্র একটাই শেষ পর্যন্ত মিলিত হবে একটি ডিম্বাণুর সঙ্গে। কী কঠিন সংগ্রাম। মেয়েরাই তো বেছে নেয়। জীবজগতে সবচেয়ে বলশালী পুরুষকেই বেছে নেয় নারী। পুরুষরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে, যে জেতে, সেই কাম্য-নারী পায়। বাইরেও সংগ্রাম, ভিতরেও সেই শুক্রকীটদের সংগ্রাম। যে-শুক্রকীট সবার আগে ফ্যালোপিয়ান নালিকায় পৌঁছে ডিম্বাণুর কাছে যেতে পারছে, সে-ই শেষ পর্যন্ত ডিম্বাণুকে পায়। শুক্রকীটের কোনও পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার নেই, অথচ ডিম্বকুমারী রেস-এ ফার্স্ট হওয়া মি. শুক্র-কে পছন্দ করে।

ওই যে, ‘গোটা’ কোষ ভাগাভাগির কথা হচ্ছিল, পুরুষের ৪৬টা ক্রোমোজোম অর্ধেক হয়ে শুক্রের শরীরে অবস্থান করে, নারী-কোষের ৪৬টার অর্ধেক ডিম্ব-শরীরে, কিন্তু ভাগাভাগিতে যদি গন্ডগোল হয়ে যায়? পৃথিবীর কোনও জৈব ভাগাভাগি ঠিক মতো হয়েছে? অজৈব জগতে যে কঠোর শৃঙ্খলা, জৈব জগতে তার অভাব। ভাগাভাগির গন্ডগোলে কোনও-কোনও ডিম্বাণুতে একটা x ক্রোমোজোম বেশি চলে আসে। ফলে সেই ডিম্বাণুটায় ২৪টা ক্রোমোজোম। বিজ্ঞানের ভাষায় ২৪xx-এর সঙ্গে ২৩ ক্রোমোজোম-সম্পন্ন y-ধারী শুক্রের মিলনে তৈরি হয় ৪৭xxy ক্যারিওটাইপ। এদেরই ‘ক্লাইনেফেল্টার সিনড্রোম’ হয়। ভাগাভাগির সময় একটা ভাগে বেশি পড়লে, অন্যভাগে কম পড়বেই। যদি x ক্রোমোজোম কম পড়ে যাওয়া ২২ ক্রোমোজোম ডিম্বাণুর সঙ্গে x-বাহক ২৩ ক্রোমোজোমের শুক্রের মিলন হয়, তবে ৪৫x ক্যারিওটাইপ তৈরি হবে। এরাই টার্নার সিনড্রোম’-এ আক্রান্ত। অথচ কী আশ্চর্য, ৪৫x হয়, কিন্তু ৪৫y হয় না। y হল পুরুষ-প্রতীক। কোনও শুক্রাণুর কাঁধে y চড়ে থাকে, কোনও শুক্রাণুর কাঁধে x। সেক্স ক্রোমোজোম-হীন ২২ অটোজোমের ডিম্বাণুর ভিতর y-ওলা শুক্রকীট মাথাই গলাতে পারে না। ফলে ৪৫y হয় না।

কেন পারে না?

কে জানে?

বইপত্রে সদুত্তর পাওয়া যায়নি। রিসোর্স পার্সন’-রাও ঠিকমতো বোঝাতে পারেনি।

এই যে চলমান হিজড়ে সমাজ, এদের মধ্যে ‘টার্নার সিনড্রোম’-ওলা মানুষ খুব একটা থাকতে পারে না। কিন্তু খুব কম হলেও তো টার্নার শিশু জন্মায়। ফোলা-ফোলা শরীর, ছোট- ছোট চোখ, যোনিটাও ঠিকমতো বোঝা যায় না। সাধারণ মানুষ ভাবে, হিজড়ে বাচ্চা হল বোধহয়। হেলাফেলায় দিন কাটে। চিকিৎসা কি ঠিকমতো হয় ওদের? এরা বেশিদিন বাঁচে না। কেউ কেউ যৌবন আসার আগেই মারা যান। কেউ কেউ আরও বেশ কিছুদিন বাঁচেন, কিন্তু ৫০/৫৫ বছরের মধ্যেই হয় হার্টের গন্ডগোলে কিংবা কিডনির গন্ডগোলে ওরা পৃথিবী থেকে চলে যায়। ‘ক্লাইনেফেল্টার সিনড্রোম’-যুক্ত শিশুরা, যাদের একটি ছোট শিশ্ন আছে, অণ্ডকোষ নেই, কিংবা খুব অপরিণত, ঠিকমতো পুরুষ হয়নি বলে ওদের মা-বাপরা কষ্ট পায়, কোনও কোনও বাপ-মা ওদের মেয়েদের পোশাক পরিয়ে রাখে, বড় হয়ে ওরা না-পুরুষ। ওদের মধ্যে কেউ-কেউ হয়তো চলমান হিজড়ে সমাজে চলে যায়। কিন্তু এদের সংখ্যা খুবই কম। আজকের সার্জারি এবং চিকিৎসার এই উন্নতিকালে এদের অপরিণত অণ্ডকোষ কেটে ফেলে, উরুসন্ধিতে অস্ত্রোপচার করে নারী-জননাঙ্গের একটা চেহারা দেওয়ার চেষ্টা করা যায়। বিদেশে হয়। ‘নারী’ পরিচয়ে এরা বেঁচে থাকতেই পারে, সমাজের কাজেও লাগতে পারে। বোঝা না-হয়ে সম্পত্তিও হতে পারে। কয়েকজন শিল্পী এবং অধ্যাপক ছিলেন এবং আছেন এই পৃথিবীতে, যাঁদের এই সিনড্রোম রয়েছে। এগুলো তো সব ক্রোমোজোমের ভাগাভাগির গোলমাল। জেনেটিক খুঁতও বলা যায়। পরিপূর্ণ স্ত্রী-জননাঙ্গ বা পুরুষ-জননাঙ্গ তৈরি হতে পারল না যে-কারণে। বাইরের জননাঙ্গের বিকাশ না-হলেও তো ওদের মধ্যে প্রেম থাকে, ভালবাসা থাকে, দুঃখবোধ থাকে, ছন্দ-প্রভাবে নাচ জাগে, চাঁদের আলো সমুদ্রের ঢেউ ভাল লাগে, একসঙ্গে সবার সঙ্গে ফুচকা খেতেও ইচ্ছে হয়। জিন ওখানে কিছু করতে পারে না। কিছু মানুষের আবার অন্য একটা গন্ডগোল হয়। একই দেহে পুরুষ ও নারী-চিহ্ন। যদিও খুব কম। ৩০ হাজারে একজন। জিনের কারণেও হয়, আবার ভ্রূণাবস্থায় হরমোন সরবরাহের গন্ডগোলের কারণেও হতে পারে।

কিছু মানুষ দেখা গিয়েছে, যাদের শরীরে শুক্রাশয় এবং ডিম্বাশয় দু’টোই থাকে। কখনও একটা-একটা করে, কখনও বা জোড়ায়। শুক্রাশয় থাকে পেটের ভিতরে। ছোট্টমতো একটা শিশ্ন থাকতে পারে, কিন্তু মূত্রছিদ্রটা ঠিকঠাক থাকে না। শিশ্নের শেষে না-থেকে গোড়ার দিকে থাকে। কারও শিশুও থাকে না, থাকে যোনি-র মতো কিছু। কোনও ক্ষেত্রে আপাত-যোনির ভগাঙ্কুরটি এতটাই বড় হয় যে, শিশু-নুনুর মতো দেখায়। কারও পেটের ভিতরে ছোট জরায়ুও তৈরি হতে পারে। কৈশোরে স্তনগ্রন্থি কিছুটা বিকশিত হয়। কখনও ঋতুচক্রও দেখা দেয়। আর কী আশ্চর্য, যাদের প্রায়-যোনির পরিবর্তে প্রায়-শিশ্ন আছে, তাদেরও রজঃস্রাব হতে দেখা গিয়েছে। এই সময় গোপনে-থাকা বেচারা শুক্রাশয়টি বেদনায় টনটন করে। মানুষটা ব্যথায় কষ্ট পায়।

স্বাভাবিক জিনগ্রস্ত ৪৬xx বা ৪৬xy মানুষদের ক্ষেত্রেও লৈঙ্গিক ত্রুটি দেখা গিয়েছে, যারা ৪৬xx হয়েও নারী নয়, কিংবা ৪৬xy হয়েও পুরুষ নয়। মানব-ভ্রুণে জননাঙ্গ বিকশিত হয় বেশ কিছুদিন পরে। ভ্রুণ শরীরে একটা অংশকে চিহ্নিত করা হয়েছে, যাকে বলা হয় ‘গোনাড – অঞ্চল। এখান থেকেই পুরুষ-জননাঙ্গ এবং স্ত্রী-জননাঙ্গ বিকশিত হয়। কিছু টিস্যু হয় শুক্রাশয় কিংবা ডিম্বাশয়ে পরিবর্তিত হয়। ৪৬xx হলে ডিম্বাশয় হবে, ৪৬xy হলে শুক্রাশয় হবে— এটাই সাধারণ নিয়ম। জিনগত খুঁত থাকলে গন্ডগোল হয়ে যায়। পাঠ্য বইতে লেখা থাকে ‘অ্যাম্বিগুয়াস জেনেটালিয়া’। কিন্তু স্বাভাবিক জিন থাকলেও, কখনও এখান থেকে উল্টোপাল্টা টিস্যু তৈরি হয়ে যেতে পারে।

গোনাড অঞ্চলে উফিয়ান ডাক্‌ট এবং মুলেরিয়েন ডাক্‌ট তৈরি হয়, এখানে নিঃসৃত হয় কিছু রাসায়নিক, যা লিঙ্গ-চিহ্ন তৈরি করে। উল্ফিয়ান ডাক্‌ট ও নালি পুরুষ প্রজননতন্ত্রের বিকাশ ঘটায়, মুলারিয়ান ডাক্‌ট স্ত্রী-তন্ত্রের। ভ্রুণের দু’মাসের মাথায় দু’টোই থাকে। তিন মাসের পর, xx-দের ভ্রুণ-এর ক্ষেত্রে, ক্রমে উলফিয়ানের অবলুপ্তি ঘটে, মুলেরিয়ান তন্ত্রের বিকাশ ঘটে। পুরুষ xy-দের ক্ষেত্রে মুলেরিয়ান তন্ত্র লুপ্ত হয়, উলফিয়ানের বিকাশ ঘটে। যদি xx ভ্রুণের ক্ষেত্রে দেখা যায়, উল্ফিয়ান তন্ত্র পুরোপুরি বিলুপ্ত হল না, কিছুটা রয়ে গেল, এবং মুলেরিয়ান তন্ত্র থেকে জরায়ু, ডিম্বাশয়, ফ্যালোপিয়ান টিউব ইত্যাদি তৈরি হয়ে গেল, অথচ ঠিকমতো তৈরি হল না, উপরন্তু ভিতরে একটা বা দু’টো অপরিণত শুক্রাশয়ও রয়ে গেল। আবার xy ভ্রুণের ক্ষেত্রে মুলেরিয়ান নালি বিলুপ্ত হল না, বরং উলফিয়ান নালির বিকাশ ঘটল, এবং শেষ অবধি দেখা গেল যে-শিশুটি জন্মাল, তার শিশ্ন খুব ছোট, কিংবা প্রায় নেই। শুক্রাশয় বোঝা যাচ্ছে না। বড় হলে ওদের বাহুমূলে লোম হচ্ছে না, ভিতরে হয়তো একটা ডিম্বাশয়ও রয়ে গিয়েছে। কিংবা অপরিণত জরায়ু। স্তনগ্রন্থিরও বিকাশ হচ্ছে। ৪৬xy হয়েও পুরুষ হতে পারল না সে।

আবার, মুলেরিয়ান বা উলফিয়ান ডাফ্‌ট ঠিকমতো কাজ করে গেল, ক্রোমোজোম-সজ্জাও ঠিকঠাক। তা সত্ত্বেও আর এক ধরনের লিঙ্গ-অসংগতি হতে পারে-এর জন্য দায়ী হরমোন এবং এন্জাইম। জৈব শরীরের সবই তো রসায়ন-নির্ভর। মুলেরিয়ান এবং উফিয়ান নালি শেষ পর্যন্ত কী পরিণতি নেবে, সেটাও ঠিকঠাক রাসায়নিক পদার্থের জোগান এবং অভাবের ওপর নির্ভর করে। ভ্রুণাবস্থায় আম্বিলিক্যাল কর্ডের ভিতর দিয়ে মায়ের শরীরের রক্ত ভ্রুণ দেহে যায়। রক্তের সঙ্গে যায় এনজাইম, হরমোন ইত্যাদি। ডেসমোলেজ, বিটা হাইড্রক্সিস্টেরয়েড, আলফা হাইড্রোক্সিলেজ—এই রাসায়নিকগুলোর ভূমিকা নাকি খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই সব রাসায়নিকের জোগান ঠিকমতো না-হলে যৌনাঙ্গের পরিপূর্ণ গঠন হয়ে ওঠে না। একই দেহে দু’রকম লিঙ্গচিহ্ন তৈরি হয়ে যায়। এদের বলা হয় ‘উভলিঙ্গ’ বা ‘হার্মাফ্রোডাইট’।

কোনও-কোনও প্রাণী তো উভলিঙ্গ-ই। সমস্ত রকম কেঁচো, নানা ধরনের কৃমি, অনেক জাতের শামুক ও ঝিনুক—উভলিঙ্গ। কেঁচোদের একই দেহে শুক্রাশয় এবং ডিম্বাশয় আছে। দু’টো কেঁচো পরস্পরের উল্টোদিকে মিলন করলে দু’টো কেঁচোর ডিমই নিষিক্ত হতে পারে। নিচু জাতের প্রাণীদের মধ্যে উভলিঙ্গত্ব থাকলেও উচু জাতের প্রাণীর ক্ষেত্রে এটা দুর্ঘটনা। মানব শরীরে দু’রকম লিঙ্গচিহ্ন একসঙ্গে থাকাটাও খুব বিরল। কিন্তু হয়। জন্ম বড় জটিল প্রক্রিয়া। পুরো কোষ ঠিকমতো দুভাগ হয়ে ডিম্বাণু ও শুক্রকীট তৈরি হওয়া, ওদের ঠিকমতো ক্রোমোজোম ঠিকভাবে থাকা, ভ্রুণ তৈরি হওয়া, এরপর কতরকম রসায়নের খেলায় ধীরে- ধীরে তৈরি হয় একটা শিশু। কোথাও কোনও গন্ডগোল হয়ে যেতে পারে। কিন্তু খুব আশ্চর্য, গন্ডগোলটা কমই হয়। এসব গন্ডগোলের কারণে যে-শিশুটি লিঙ্গত্রুটি নিয়ে জন্মাল, সে কেন, কেউ কি জানতে পারল, কোথায় গন্ডগোলটা ছিল?

এক গাইনি-র ডাক্তার কথাপ্রসঙ্গে অনিকেতকে ওর জীবনের দু’টো অভিজ্ঞতার কথা বলেছিলেন। একবার একটি সদ্যোজাত বাচ্চাকে দেখে নার্স বলেছিল, মেয়ে হয়েছে। বাচ্চার অভিভাবক ছেলে হয়েছে জানলে বেশি খুশি হতেন, তবে মেয়ে হয়েছে—আচ্ছা ঠিক আছে কী করা যাবে—এভাবে চলে গিয়েছিল। পরে ডাক্তারবাবুর চোখে পড়ল, এ তো ঠিক মেয়ে নয়। ছোট্ট একটা শিশ্ন আছে মনে হল। এটা একটু ভাল করে দেখতে হয়। অনেক সময় যোনি অংশের ক্লাইটোরিস-টা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বড় হয়। ওটাও লৈঙ্গিক ত্রুটি, তবে ওরা মেয়েই। বর্ধিত ক্লাইটোরিস অনেক সময় অপরিণত শিশ্নের মতো মনে হয়। ভাল করে পরীক্ষা করে দেখে বুঝলেন, ওটা বর্ধিত ক্লাইটোরিস নয়, শিশু-ই। কিন্তু যোনি ছিদ্রও আছে। ভিতরে হয়তো শুক্রাশয় আছে, বাইরে থেকে বোঝা যাচ্ছে না, হয়তো আলট্রাসোনোগ্রাম-এ বোঝা যাবে। কিন্তু শিশু-টা নিশ্চিত। তার মানে ওই শিশুটি লিঙ্গ ত্রুটি যুক্ত। শিশুর অভিভাবকদের এটা জানানো হল। তারপর বাচ্চার মায়ের ছুটি হয়ে গেল। বাড়ি থেকে কেউ নিতে এল না। গ্রামের হাসপাতাল। বেশ দুরে বাড়ি। জোর করে বলাও যাচ্ছে না, ছুটি হয়ে গিয়েছে বাড়ি যাও। হাসপাতালের খাতায় ঠিকানা লিখতে হয়। সেই ঠিকানায় লোক পাঠিয়ে দেখা গেল—বাড়ির লোকজন উধাও। একটি হার্মাফ্রোডাইট শিশুর ভয়ে মদ্দ xy স্বাভাবিক পুরুষরা সব পালিয়েছে। শেষ অবধি থানা-পুলিশ করতে হয়। পুলিশ ওই বউটির স্বামীকে ধরে আনে।

তারপর বাচ্চাটির কী হল? ‘ফলো আপ করেছিলেন?’—অনিকেত জিগ্যেস করেছিল। ডাক্তারবাবু বলেছিলেন—ওর মা বছরখানেক পর বাচ্চাটাকে নিয়ে এসেছিল। বাচ্চাটার নাম রেখেছিল শিবগঙ্গা। পড়শিদের কেউ নাকি বলেছিল বাচ্চাটাকে হিজড়েদের দিয়ে দিতে। ওর মা দেয়নি। সর্বস্ব দিয়ে আগলে রেখেছিল। যখন হাসপাতালে নিয়ে এল, বাচ্চাটার পেটটা বেশ বড়, মানে পিলেটা খুব বেড়ে গিয়েছে, অ্যানিমিক। বেশিদিন বাঁচেনি বাচ্চাটা। আসলে হার্মাফ্রোডাইট বাচ্চারা আদর না-পেয়েই মরে যায়। ওদের কিন্তু ঠিকঠাক চিকিৎসা করা যায়।

কী করে?

দেখতে হয় বাচ্চাটা মূলত কী। ক্রোমোজোম পরীক্ষা করা সবসময় সম্ভব হয় না। যদি xx হয়, তবে ভিতরে একটা ওভারি ঠিকই থাকবে। সঙ্গে যদি টেটিস থাকে, ওটাকে সার্জারি করে বাদ দিতে হয়। পেনিস বা মাইক্রো-পেনিসটাও। তারপর ঠিকমতো হরমোন থেরাপি করে ওকে পরিপূর্ণ নারীর রূপ দেওয়া যায়। সে গর্ভধারণেও সক্ষম হতে পারে। যদি xy হয়, তবে একটু ঝামেলার। ওখানে উলফিয়ান প্রি-ডমিনেটিং কিন্তু মুলেরিয়ান-ও আছে। মানে সে মূলত পুরুষ। যদি ভিতরে ডিম্বাশয় থাকে, ওটা বাদ দেওয়া যায়। কিন্তু অপূর্ণ টেটিসকে কিছু করা যায় না। বরং থাকলেই ক্ষতি। ওটাও বাদ দেওয়া উচিত। অপূর্ণ শিশ্নটাও অপারেশন করে স্বাভাবিক করা যায় না। কৃত্রিম যোনি তৈরি করা সম্ভব হলেও, কৃত্রিম পুরুষ-লিঙ্গ তৈরি করা যায় না। মেল ফ্যালাস-টা বড় জটিল। কত ক্যাপিলারি, ভাল্ব, কখনও ছোট হচ্ছে, কখনও বড় হচ্ছে, কোনও প্লাস্টিক সার্জেন ঠিকমতো পেনিস বানাতে পারেনি। তাই xy হার্মাফ্রোডাইট- দেরও বাঁচাতে হলে মেয়ে বানিয়েই বাঁচাতে হয়। ও ফ্রক পরে, পায়ে নুপুর পরে বড় হবে। কিন্তু এরকম সার্জারি আমাদের দেশে কটা হয়? আলোকপ্রাপ্ত বড়লোকের ঘরে এরকম বাচ্চা হলে বেঁচে যায়, নয়তো…

‘আসলে কী জানেন?… – ডাক্তারবাবু বলছিলেন, ‘হার্মাফ্রোডাইট’ শব্দটাই আধুনিক মেডিক্যাল সায়েন্স আজকাল আর ব্যবহারই করে না। এখন বলা হয় ইন্টারসেক্স’।

‘হার্মোফ্রোডাইট’ কথাটার উৎস তো সেই গ্রিক পুরাণ। দেবতা হার্মেস আর দেবী অ্যাফ্রোদিতি-র যোগফল। এসব না-জেনেই অশিক্ষিত মেয়েটা ওর সন্তানের নাম রেখেছিল ‘শিবগঙ্গা’। ডাক্তারবাবু চুপ করলেন।

আর একটা কী ঘটনার কথা বলছিলেন—অনিকেত জিগ্যেস করেছিল।

—হ্যাঁ। এটা তো টু হার্মাফ্রোডাইটিজ্ম। একটা সিউডো হার্মাফ্রোডাইট-ও পেয়েছিলাম। ছদ্ম-উভলিঙ্গ। তখন আমি বাসন্তীতে কাজ করি। একটা বাচ্চা হল। বললাম, ছেলে। বেডে শুয়ে ওই অবস্থায় বাচ্চার মা উলু দিয়ে উঠল। আকাশে তাকিয়ে হাত কপালে ছোঁয়াল। আকাশ তো নয়, ফল্স সিলিংওলা অ্যাসবেস্টস-এর চালা। বাড়ির লোকজন আমাকে আর সিস্টারকে বাইরে ডেকে নিয়ে একটা পলিথিনের প্যাকেটে রসগোল্লা আর রস-মাখানো পেটা-পরোটা ধরিয়ে দিল। তিন মেয়ের পর ছেলেটা হল বলে।

একটু পরে নার্স জানাল, স্যর, বাচ্চাটা হিসির জায়গা দিয়ে হিসি করছে না, হিসিটা তলা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। ব্যাপারটা বোঝার জন্য জেনিটালিয়া ভাল করে দেখি।

দেখে তো শক্ড। ও তো ছেলে নয়, মেয়ে। ক্লাইটোরিসটা লম্বা হয়ে বেরিয়ে আছে। ল্যামিনা মিজোরা নেই, ল্যামিনা মিনোরা নেই—একদম প্লেন। একটা মূত্রছিদ্র আছে শুধু। ইউরিনারি ট্রাক্ট-টা ওখানে এসে শেষ হয়েছে।

কী মুশকিল! তবে একে ম্যানেজ করা যেত। কিন্তু বাসন্তীতে কিছু করার ছিল না। কলকাতায় নিয়ে গিয়ে ওকে হয়তো ঠিক করা যেত। সেটাই বলেছিলাম। কিন্তু ওরা কী করল জানেন? বাচ্চাটাকে শীতের মধ্যে বাইরে ফেলে রেখে মেরে ফেলল। হয়তো একটা ইনসারশন দিলেই ওর ভ্যাজাইনাল ক্যাভিটি বার করে দেওয়া যেত। হয়তো ওর সবই ছিল, নারীর যা থাকে, চামড়ায় ঢাকা ছিল বলে জানা যায়নি। ক্লাইটোরিস-টা এমনিতেই হয়তো কিছুদিন পরে ছোট হয়ে যেত, বা সামান্য সার্জারি। কিন্তু ওরা মেরে ফেলল!

এখন অনিকেত বোঝে, এসব কেস হল সিউডো হার্মাফ্রোডাইটিজ্‌ম। ছদ্ম-উভলিঙ্গত্ব। একটা শিশুকন্যাকে শিশুপুত্রের মত মনে হয়, বা পুত্রকেও কন্যা মনে হতে পারে। একটি স্বাভাবিক xy ছেলে, কিন্তু ফিটাল কেমিস্ট্রি-র কারণে লিঙ্গটি খুব ছোট, অণ্ডকোষ বা শুক্রাশয় পেটের ভিতরে গোপনে রয়েছে, বাহ্যিক পুংলিঙ্গত্বের বেশ অভাব, ওকে মেয়ে বলে মনে হতে পারে। এক ধরনের হায়না আছে, ওদের গায়ে ছিট-ছিট দাগ, ওদের বলে ‘স্পটেড হায়না”। এই জাতের স্ত্রী-হায়নাদের ক্লাইটোরিস স্বাভাবিক ভাবেই বেশ বড়। দেখে মনে হয় পুরুষ-লিঙ্গ। পুরুষদের লিঙ্গ-সংস্থানের সঙ্গে খুবই দৃশ্যগত মিল। এদের স্ত্রী-পুরুষ আলাদা করা বেশ মুশকিল।

ইন্টারনেটে ‘শী-মেল’-দের ছবিও দেখেছে অনিকেত। পাটেয়া, ব্যাংকক, ম্যাকাও-তে এরা যৌন-ব্যবসা করে। এদের বেশ পরিণত পুংলিঙ্গ, এবং সুডৌল বক্ষ। একই সঙ্গে এরা নারী ও পুরুষ কামক্রেতাদের সেবা করে। এরাও কি xxy? xxy হলেও সার্জারির সাহায্য নিতেই হয়েছে ওদের। পুরুষ লিঙ্গ থাকা সত্ত্বেও কৃত্রিম স্তন বানাতে হয়েছে। বিচিত্র ধরনের কামুকদের মনোরঞ্জনের জন্য।

পানাগড়ের যে-খোলটির কথা অনিকেত লিখতে চাইছে, সেখানে দুলালী আছে। দুলালীকে কেন্দ্র করেই ওদের কথা লিখবে বলে ভেবেছে। ওরা কারা? ওদের কি সবারই লিঙ্গ-পরিচয়ে গন্ডগোল আছে?

লিঙ্গ-পরিচয় কি বাহ্যিক চিহ্নই শুধু? না কি লিঙ্গচিহ্নের বাইরে ও অন্তরে, বা মনেও, কোনও লিঙ্গ-পরিচয় থাকে? মনের ভিতরে যেটা থাকে সেটা অভিলাষ। অভিলাষও লিঙ্গসত্তাকে নিয়ন্ত্রণ করে।

বাহ্যিক লিঙ্গ-পরিচয়ে সমস্যা কী কী কারণে হতে পারে, তার একটা লিস্ট করে নেয় অনিকেত।

ক্রোমোজোম-সজ্জার ত্রুটির কারণে যা-যা হতে পারে, তা হল— টার্নার সিনড্রোম : ৪৫x

ক্লাইনেফেল্টার সিনড্রোম : ৪৭ xy / ৪৮xxxy

৪৭ xy পুরুষ

৪৮xx পুরুষ

৪৬xx কিংবা ৪৬xy উভলিঙ্গ, ছদ্ম-উভলিঙ্গ

৪৭ xx সুপার-ফিমেল। শিমেল।

জিন-বাহক যে প্রোটিন কুণ্ডলীগুলি, তার মধ্যে যারা বাবা-মা’র বৈশিষ্ট্য বহন করে, ওরাই প্রকৃত পক্ষে ক্রোমোজোম, বাকিরা অটোজম। কিন্তু সাধারণভাবে সবাইকে একসঙ্গে ক্রোমোজোম-ই বলা হয়। বাবা-মা’র বৈশিষ্ট্যবাহী x বা y-কে সেক্স ক্রোমোজোমও বলা হয়। লিঙ্গ-নির্ধারণে অটোজমের ভূমিকা আছে। সাধারণভাবে একটা জাইগোটে ক্রোমোজোম ও অটোজোম মিলে ৪৬টি কণা থাকতে পারে। ৪৬xy মানে ওই সেল-এ অটোজোম ও ক্রোমোজোম মিলে ৪৬টি কণা আছে, এর মধ্যে ৪৪টি অটোজোম এবং দু’টি সেক্স ক্রোমোজোম। একটি x অপরটি y। ৪৬xx মানে, দু’পাশ থেকে ২২টি করে ৪৪টি অটোজোম এসেছে, এবং দু’টি সেক্স ক্রোমোজোম। মানে, ৪৪টি অটোজোমই স্বাভাবিক ব্যাপার।

কিন্তু ৪৮xx পুরুষে ৪৪টির বদলে ৪৬টি অটোজোম এবং দু’টি সেক্স ক্রোমোজোম। অটোজোম কী করে লিঙ্গ-নির্ধারণে ভূমিকা নিয়ে ফেলতে পারে, সেটা আজও পরিষ্কার নয়। আবার একই জিন পৃথক দেহের ওপর আলাদা-আলাদা কাজ করে। কেন করে? উত্তর নেই। এছাড়া বিজ্ঞানী এম. ও. স্যাডেজ বলছেন—অনেক নন-এন্ডোক্রিনাল ফ্যাক্টরও আছে, যারা গোনাড বা লিঙ্গ-চিহ্ন নিয়ন্ত্রণ করে। এ নিয়ে এখনও কিছুই কাজ হয়নি।

এবার, এই খোলের বাসিন্দা যারা, অনিকেতের হাতেই ওদের লিঙ্গ-ইতিহাস। ও কাউকে টার্নার আক্রান্ত করে দিতে পারে, কাউকে ক্লাইনেফেল্টার, কাউকে xx পুরুষ…। কিন্তু করবে না। কারণ ওর অভিজ্ঞতায় জেনেছে, এসব ছল্লাবাজ খোলগুলিতে বিশেষ সমস্যা-আক্রান্তদের নেওয়া হয় না। হ্যাপা সামলাবে কে?

টার্নার সিন্ড্রোম আক্রান্তদের দেখলেই বোঝা যায়। ওরা খুব একটা এসব খোলে থাকে না। ক্লাইনেফল্টার অল্প কিছু থাকতে পারে। xx মেলও থাকা সম্ভব।

আর থাকতে পারে ছদ্ম-উভলিঙ্গ। যাদের মনে হচ্ছে উভলিঙ্গ, আসলে নয়। লিঙ্গ-বিকৃতি। কিন্তু আসল ব্যাপারটা হ’ল ১০০ জনের মধ্যে ৮০/৮৫ জনই থাকে সম্পূর্ণ পুরুষ। এক্কেবারে ৪৬xy, কিন্তু ভিতরে-ভিতরে নারী। ওদের নিজেদের পুং-চিহ্নকে পছন্দ করে না, কিন্তু অন্য মানুষের পুং-চিহ্নকে পছন্দ করে।

অনিকেত এবার পানাগড় খোলের গুরুমা নাগেশ্বরী এবং ওর শিষ্যাদের ক্রোমোজোম বিতরণ করে। অনিকেত যা বলবে, যা লিখবে, তাই হবে। ওই তো ঈশ্বর।

গুরুমা নাগেশ্বরী একদম স্বাভাবিক ৪৬xy পুরুষ। আগেই দেখানো হয়েছে ওর মাথায় টাক আছে। পরচুলা পরে।

চাত্তারাকে ৪৭ xxy করে রাখা যেতে পারে। ও একটু লম্বা প্রকৃতির, ‘ইউনিকয়েড গ্রোথ’ আছে। হাসির গোনাড-গঠনের ত্রুটির কারণে ওই সব উল্ফিয়ান-মুলেরিয়ান ডাক্ট-এর কিচাইনে একটা ছোট শিশ্ন ছিল। অণ্ডকোষ ছিল না। চার বছর বয়সে ছল্লায় গিয়ে এক গরমকালে নাগেশ্বরী ওকে উলঙ্গ দেখে। গরিবের ঘর। ওর মা-কে নানারকম ভয় দেখিয়ে ওকে নিয়ে আসে। ও যদিও সবচেয়ে পুরনো, কিন্তু প্রধান ‘চেলি’ বনল চাত্তারা। হাসির ক্যারিওটাইপ হয়তো ৪৬xx—মেয়েই হওয়ার কথা ছিল। কম বয়সেই ওকে ছিন্নি করা হয়। ছোট্ট শিশ্নটি কেটে ফেলা হয়। কেটে ফেলা শিশ্ন ছিদ্রের তলায় ওর মূত্রছিদ্র ছিল। কৈশোরে ওর স্তনোদগম হয়েছিল। কেটে ফেলা শিশ্নের বেচারা ছিদ্রটি দিয়ে রজরক্তও প্রকাশিত হয়েছিল বার কয়েক। তখন ঢোল বেজেছিল। এখন ওসব আর হয় না। ঝুমকোর এখানে বেশিদিন হয়নি। ওর ছোট্ট একটি শিশ্ন আছে। মাইক্রো-পেনিস বলা যায়। অণ্ডকোষ বা শুক্রাশয় নেই। হয়তো ভিতরে আছে। ওর দাড়ি-গোঁফ ওঠে ভালই। শরীরে পেশি আছে। তার মানে, শুক্রাশয় পেটের ভিতরে থেকে টেস্টোস্টেরন নিঃসরণ করে চলেছে। ও কিন্তু পুরো ৪৬xy আর ছবি হচ্ছে ৪৬xx সিউডো ফিমেল হার্মাফ্রোডাইট। এনলার্জড ক্লিট উইথ ইম্‌ম্যাচিওরড ওভারি।

আর সব যারা আছে, ওদের কারও তেমন লিঙ্গ-পরিচয় সংক্রান্ত গন্ডগোল নেই। সবাই পুরুষমানুষ। অনেকেই ‘ছিন্নি’ হয়েছে। এবার আবার গল্পটা শুরু করা যাবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *