হলদে গোলাপ – ৩০

৩০

কোয়ার্টারের সামনেই একটা কাজুবাদামের গাছ। কাজুবাদামের একরকমের ফল হয়, ফলটার তলায় ‘কমা’ চিহ্নের মতো দেখতে একটা বীজ ঝোলে। ফলটা পাকলে বেশ নাকি মিষ্টি হয়। ফলটার তলায় যে-বীজ, সেই বীজের ভিতরেই থাকে বাদাম। পড়শিরা বলল, কিছুদিনের মধ্যেই ফলগুলো লাল হয়ে যাবে। আর একটু দূরে একটা বড় তেঁতুলগাছে ঝুলছে বাবুই পাখির বাসা। কতরকমের পাখি ওড়াউড়ি করে। ভোরবেলা কুয়াশার চাদরে ঢেকে থাকে দূরের পাহাড়। পাশের জলাশয়ে কালো-কালো পানকৌড়ি ডুবসাঁতার খেলে। সাদা সাদা বক একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রকৃতির এত সমারোহ, তবু তিন দিন পরই শুক্লা বলে, বাড়ি যাব।

অনিকেত বলে, এটাই তো বাড়ি, এখানেই তো থাকছি। ফ্রেশ তরিতরকারি, ফ্রেশ হাওয়া- বাতাস। কী ভাল জল, গ্যাস-অম্বল সব উধাও

শুক্লা বলে, সবই তো ভাল, কিন্তু আমি ফিরেই যাব।

অনিকেত মিষ্টি করে বলে, ফিরে তো যাবেই। আমিও যাব। এই সপ্তাহের শেষেই যাব। তারপর আবার দু’জনই ফিরে আসব, কেমন?

শুক্লা বলে, আমি আবার আসব কেন? তোমার সংসার তো গুছিয়েই দিয়েছি। পারো তো একজন রান্নার লোক দেখে নিও। তুমি নিজেও তো রান্নাবান্না মন্দ জানো না।

অনিকেত বলে, সে না-হয় প্রেশার কুকারে খিচুড়ি-টিচুড়ি করে নেব। কিন্তু তুমি কাজু ফলের ক্রমশ পেকে-ওঠাটা দেখবে না? বাবুই পাখির বাসা থেকে ডিম ফুটে বেরিয়ে সদ্য- উড়তে-শেখা বাবুই-ছানা দেখবে না?

শুক্লা বলল, তুমি দেখো।

অনিকেত বলে, পতির পুণ্যে সতীর পুণ্য তো হয় জানি, কিন্তু পতি দেখলে কি সতীর দেখা হয় নাকি? ‘পুণ্য’ একটা অ্যাবস্ট্রাক্ট জিনিস, কিন্তু দেখাটা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য।

শুক্লা সদ্য লাল-লাল পাতা-ভরা নিমগাছের ঝিরিঝিরির দিকে তাকিয়ে বলল, ও ঠিক আছে।

—তুমি তা হলে একা থাকবে ওখানে?

—কেন? মন্টু থাকবে তো।

একটা ট্যাবলেট গিলে নেওয়ার মতো করে অনিকেত বলল—ও-ও।

কোমায় থাকা কেউ হাসপাতালে। বাড়িতে ফোন এল—এক্সপায়ার্ড, তখন যেমন বলে ‘ও- ও’, তেমন করেই বলল। যেন ভবিতব্যই ছিল।

সপ্তাহ শেষে ওরা ফিরল। পরদিনই অনিকেতকে যেতে হল খাজাইতলা। পঞ্চাননের সঙ্গে দেখা করল। মন্টুকেও দেখল, মন্টু বাইরের টিউবওয়েলের জলে শাক ধুচ্ছিল। পঞ্চাননকে বলল, মন্টুকে আমরা নিয়ে যাব, বাড়িতে রাখব।

— কেন?

—ওখানে থেকে লেখাপড়া করবে।

—এখানে থেকেও পড়ালেখা করছে ও।

—থাকুক না আমাদের ওখানে। আমার স্ত্রী-র ইচ্ছে।

বলেই মনে হল বেশি আগ্রহ দেখানো হয়ে গেল বোধহয়। আসার আগে ভেবেছিল, ওরা যদি না রাজি হয়, তবে ভালই হয়। শুক্লাকে বলে দেবে ওরা রাজি নয়।

শুক্লা নিশ্চয়ই নিজে খাজাইতলায় আসত না। অনিকেত একটা ঢোক গিলে বলল, তবে আপনারা রাজি না-হলে কী করব? ঠিক আছে।

উল্টো দিকে ঘুরল অনিকেত।

—দাঁড়ান দাঁড়ান। রাজি নই তো বলিনি….

অনিকেত ভাবল, এ তো মহা গেরো। সঙ্গে-সঙ্গে ঘুরে যাওয়া মানে উষ্মা প্রকাশ হয়ে গেল না তো? আরও দু-তিন সেকেন্ড পরে ‘ও আচ্ছা, ঠিক আছে’—বলে আস্তে-ধীরে চলে এলেই হত।

ঠিক তক্ষুনি মন্টু এসে দাঁড়াল। বলল, জেঠু, আমি যাব।

কয়েক সেকেন্ড চুপ থাকল অনিকেত। বলতেই পারত ‘ঠিক আছে, চল তবে।’ সঙ্গে করে নিয়ে গেলে শুক্লা হয়তো বেশি খুশি হত। অনিকেত বলল—ঠিক আছে, বিকেলে চলে আসিস তবে, জামা-প্যান্ট-বইপত্তর নিয়ে।

ক্যামেরায় ফিল্ম ভরে অনিকেত। চাইবাসা গিয়ে ছবি তুলবে। বড় পাতাটির নীচে বসে থাকা ভোরের দোয়েল পাখির, পল্লবের স্তূপের, কলমির গন্ধ ভরা জলের, নীলাভ আকাশজোড়া সজনে ফুলের…। ঝুলিতেছে বাবুইয়ের বাসা, ঝিকিমিকি নিমপাতা রোদের কিরণে…ধুর। জীবনানন্দ-র কোটেশন থেকে বাইরে বেরিয়ে, জীবনানন্দ-র মতো কিছু ভাবতে গেলেই কেলিয়ে যায় ও। ক্যামেরায় ফিল্ম ভরে প্রথম ছবিটা তুলল—মন্টুর। থানা থেকে সবসময় বলে বাইরের লোককে ঘরে ঢোকালে ছবি তুলে রাখবেন, থানায় ছবি জমা দেবেন।

শুক্লাকে বলল, আলমারিটা হাট করে খুলে রেখো না, চাবিটা সাবধানে রেখো, গয়নাগাটি ঘরে থাকলে লকার-এ রেখে দিও।

আর অনিকেত যখন ফিরে যাচ্ছে, শুক্লাও বলল—সকালবেলা যা হোক কিছু খেয়ে নিও, ঘরে ডিম রেখো, ভেজা হাতে হিটারের সুইচে হাত দিও না, ‘খারাপ জল’ খেয়ো না। অ্যালকোহল-কে শুক্লা এটাই বলে।

যাদের কপালে প্রচুর নারীসঙ্গ থাকে, তাদের নির্দিষ্ট করার জন্য গ অক্ষর দিয়ে একটা বাংলা স্ল্যাং প্রচলিত আছে। কিন্তু অনিকেতের মনে হয়, ও হল ‘গে’কপালে। যাবতীয় ‘গে’ ওর কপালেই জোটে। এটা মনে হল স্টেশনে সোমনাথকে দেখে। সোমনাথ আজ শাড়ি পরেছে। সোমনাথ দেখতে পায়নি অনিকেতকে। নিজেই নিজেকে সংশোধন করল অনিকেত। ‘গে’- কপালে নয়, ও হল ‘এলজিবিটি’কপালে। ‘এলজিবিটি’ বলে একটা শব্দ চালু হয়েছে ইদানীং। পুরো কথাটা হল : লেসবিয়ান, গে, বাইসেক্সুয়াল, ট্রান্সজেন্ডার। মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এই চার রকম সত্তাকে একসঙ্গে করে এই নাম দেওয়া হয়েছে, এবং ‘এলজিবিটি’ একটা কমিউনিটি হিসেবে গড়ে উঠছে। আইভি কি লেসবিয়ান? ঠিক জানে না, তবে ও মনে-মনে পুরুষ হওয়ার ইচ্ছে পুষে রাখে, এটুকু বুঝেছে। তার মানে, ও হয়তো রূপান্তরকামী। লিঙ্গান্তরকামী। এই যে সোমনাথ, সোমনাথের মেয়ে হওয়ার ইচ্ছে। সোমনাথও রূপান্তরকামী, মানে ‘ট্রান্সসেক্সুয়াল’। ওর পুরুষ শরীরের ভিতরে যদি একটা নারীসত্তা বাসা বেঁধে থাকে, তা হলে সে লিঙ্গ-অণ্ডকোষ-সম্পন্ন হয়েও নারী। অন্তত নিজে তা-ই ভাবছে। ফলত পুরুষের প্রতি তার আকর্ষণ। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ তো প্রাকৃতিক ব্যাপার, যাকে বলে ‘ন্যাচারাল’। ওর দিক থেকে সত্যিই ‘ন্যাচারাল’। কিন্তু আমরা ‘আনন্যাচারাল’ ভাবি। তার মানে সোমনাথ শরীর-সূত্রে পুরুষ হয়েও পুরুষের প্রতিই ওর যৌন-আকর্ষণ। সুতরাং ‘গে’। আবার একইসঙ্গে রূপান্তরকামী। সব গে আবার রূপান্তরকামী হয় না। মানে দাঁড়াচ্ছে, সব রূপান্তরকামীই ‘গে’। কিন্তু সব ‘গে’ রূপান্তরকামী নয়। আবার যে ‘গে’রা টপ’, মানে ট্রান্সজেন্ডার-দের ঘাঁটে, আদর-টাদর করে, ওদের মধ্যে রূপান্তরকামিতা নেই।

ওদের দেখে ধারণাই করা যায় না। কিন্তু ‘বটম গে’-দের দেখে আঁচ করা যায়। সব ‘বটম গে’-রাই কিন্তু শারীরিক যৌন-চিহ্নের পরিবর্তনের পথে যায় না। বড়জোর মেয়েদের পোশাক পরে। মেয়েদের মতো সাজে। ওরা ট্রান্সভেস্টাইট। বাংলায়, বিপরীত-সাজসজ্জাকামী।

এবারে মুশকিলটা দ্যাখো। আমাদের মা-মাসি-পিসিরা শাড়ি পরতেন। কোনও-কোনও কাকিমা সালোয়ার-কামিজ। আমাদের বোনরাও অনেকেই সালোয়ার-কামিজ। কিন্তু আমাদের মেয়েরা জিন্‌স-শার্ট। এগুলো তো ছেলেদের পোশাক একালের অথচ ছেলেদের পোশাক পরা মেয়েদের ‘ট্রান্সভেস্টাইট’ বলছি না তো…।

কথা হচ্ছিল ‘গে’-দের নিয়ে। কার সঙ্গে কথা হচ্ছিল? নিজেরই সঙ্গে। নিজের ফান্ডা ঝালিয়ে নিচ্ছিল।

স্টিল এক্সপ্রেসে রিজার্ভেশন করাই ছিল। কোচ এবং সিট নম্বর দেখে উঠল। জানালার ধারে সিট পেল। জানালার ধারে বসলে স্টেশনের গন্ধ একটু বেশি করে পাওয়া যায়। শিয়ালদা স্টেশনের গন্ধটা একটু যেন উগ্র। হাওড়ার গন্ধটা তত উগ্র নয়। প্রতিবন্ধীদের নিয়ে অনুষ্ঠানটা করার সময় একজন দৃষ্টিহীন বলেছিল, শিয়ালদা স্টেশনে নেমে গন্ধ পেতে-পেতে ও বৈঠকখানা বাজারে যায়। বঙ্গবাসী কলেজের গন্ধ। মশলাপট্টির গন্ধ, ফলপট্টির গন্ধ পেতে- পেতে ও ধূপকাঠির মহাজনের কাছে যায়। বনগাঁ লাইনে ধূপকাঠি বিক্রি করে ও। বামনগাছি দত্তপুকুর-বিড়া-হাবড়া ও স্টেশনের গন্ধে চিনে যায়।

—কী অনিকেতদা, আমাকে অ্যাভয়েড করবেন ভেবেছিলেন? পারলেন না তো, দেখুন, আমার সিট আপনার পাশেই পড়েছে।

পড়বেই তো। ‘গে’-কপালে যে, মনে-মনে ভাবে। কিন্তু মুখে হাস্য আনয়ন করে। ‘বসুন সোমনাথ’…বলেই থেমে যায়। ‘সোমনাথবাবু’ বলতে গিয়েছিল অনিকেত। প্রথম যখন আলাপ হয়েছিল, ‘সোমনাথবাবু’-ই বলেছিল ও। শাড়ি-পরা অবস্থায় ‘বাবু’ বলা যায় না কি কাউকে?

—আমাকে ‘আপনি’-আজ্ঞে’ না-করলেও হবে অনিকেতদা। আমি আপনার চেয়ে কত ছোট…।

অনিকেত বলে, আচ্ছা, ঠিক আছে। সোমনাথ অনিকেতের কাঁধে মৃদু ঠেলা দেয়।

—এই অনিকেতদা, আমায় একটু জানালার ধারটায় বসতে দিন না, প্লিজ…। আমি তো ঝাড়গ্রাম নেমে যাব, তারপর আপনি জানলার ধারে বসবেন, জঙ্গল দেখতে-দেখতে যাবেন।

অনিকেত বলে, আর আপনি তো শুধু ধানখেত দেখতে-দেখতে যাবেন। একই দৃশ্য তো কতবার দেখেছেন…

সোমনাথ একটু লাস্য মিশিয়ে হাসল। বলল, এ তো দেখছি ‘তুমি’-তে আসতে পঞ্চাশের দশকের সিনেমা করে ফেলবেন। ষোলো রিল-এর সিনেমায় ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’-তে আসতেই দশ রিল খরচ হয়ে যেত।

অনিকেত বলল—ও হয়ে যাবে। আস্তে-আস্তে হয়ে যাবে।

সোমনাথ বলল—কী যেন বলছিলেন…একই দৃশ্য বারবার ভাল লাগে কেন? কিছু দৃশ্য আছে, কখনও পুরনো হয় না। কতবার রূপনারায়ণের ওপর দিয়ে গিয়েছি, হয়তো ঝিমুচ্ছিলাম, জেগে উঠলাম। রবীন্দ্রনাথও রূপনারায়ণের কূলে জেগে উঠেছিলেন। এক নদী, বারবার দেখি। আমার নৈহাটির গঙ্গাটা, এক ছবি, কিছুতেই পুরনো হয় না। জানেন, বাংলার নদী-মাঠ- ভাটফুলও পুরনো হয় না। মাঠই কতরকম। কখন সবুজ কার্পেট বিছানো, কখনও ধানের ওপর ঢেউ খেলে যায় বাতাস…আবার ধান কাটা হয়ে গেলে আর একরকম রূপ। ধান কাটা হয়ে গিয়েছে কবে যেন—খেতে মাঠে পড়ে আছে খড়। পাতা কুটো ভাঙা ডিম সাপের খোলস নীড় শীত। এইসব উৎরায়ে ওইখানে মাঠের ভিতর ঘুমাতেছে কয়েকটি পরিচিত লোক আজ— কেমন নিবিড়। কই, জীবনানন্দের একই কবিতা পুরনো হয় না তো…অনিকেত মাথা নাড়ায়।

—হুঁ। চাঁদও পুরনো হয় না। কতবার দেখেছি জীবনে, তবু দেখি।

—আর মাই পুরনো হয় না, তাই না? কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে সোমনাথ। গায়ে সামান্য কনুই-খোঁচা দেয়। ওর গা থেকে পারফিউমের গন্ধ আসে।

ট্রেনটা আন্দুল পেরতেই সোমনাথ ওর ব্যাগ থেকে একটা কাগজ বার করল। বলল, দেখুন, ‘অবমানব’-এর শেষ সংখ্যা। চলচ্চিত্রকার গৌতম ঘোষের একটা ইন্টারভিউ আছে, একটা কবিতা—সৌগত পালের লেখা—

দ্বিঘাত শরীরে অনেক মায়ার বাস
বাচ্চা নাচাও নেচে ওঠে একতারা
দিকে দিকে শুধু হলুদ সর্বনাশ
বেঁচে থাকা মানে মায়াময় নাড়াচাড়া
আকাশ বোঝে না কতটা জ্বালায় জল
বাষ্প হয়েছে দুনিয়াদারের চোখে
অভিশাপ মুছে যন্ত্রণা চঞ্চল…

কে এই সৌগত পাল কে জানে? কবিতাটা তো ভালই লিখেছে। কবিতাটা পড়তে-পড়তেই অনিকেত একবার আড়চোখে সোমনাথের বুকের দিকে তাকায়। একটু পাশ থেকে। লক্ষ করে ওর বুক কতটা স্ফীত। সোমনাথ শাড়িটা পরেছিল বেশ আঁটোসাঁটো করে। বগলের তলা থেকেই একটা বর্তুলাকার ভাব। বেগুনি ব্লাউজের ওপর মেরুন আঁচল।

মেয়েদের চোখ-কান ছাড়াও একটা অতিরিক্ত ইন্দ্রিয় আছে। ওরা কী করে যেন বোঝে, কে বা কারা—ওদের শরীরের ঠিক কোথায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে। সোমনাথও বুঝে ফেলল। বাইরের ধানখেত থেকে দৃষ্টি সরিয়ে অনিকেতের দিকে তাকাল। মুচকি হাসল।

অনিকেত একটু অপ্রস্তুত হল, তারপরই সামলে নিল। স্মার্ট হয়ে গেল।

জিগ্যেস করল, ভিতরে কিছু ভরেছ, না?

সোমনাথ বলল, না, গুরু। কোনও ভেজাল নেই।

কী করে হল?

—হরমোন-থেরাপি করছি তো।

— তাই?

—হ্যাঁ। খরচা আছে। ভাল এন্ডোক্রিনোলজিস্ট-এর ট্রিটমেন্ট-এ আছি। ওষুধ খাই। বেশ উপকার হয়েছে না?

অনিকেত এবার ভাল করে তাকাল ওর বুকের দিকে।

অনিকেত বলল—তাই তো দেখছি।

সোমনাথ বুকের আঁচল টানে।

জানালা গলে হাওয়া আসে। বুকের কাপড় হাওয়ায় উড়াইয়া লইয়া যায়।

পত্রিকাটা দেখতে থাকে অনিকেত। চার পাতার কাগজ। দেখল, একটা ধারাবাহিক উপন্যাস লিখছে সোমনাথ। ‘প্রোষিতভর্তৃকা’।

অনিকেত পড়ে—”এরপরই মা ফটাফট হাতে তালি মেরে কোমর দুলিয়ে নাচতে থাকে—

মাগীদের বুকে বড়ো জ্বালা
হিজড়ে নিয়ে ঘুরছে দেখো বড়লোকের লালা।
মাগীদের চিপটিতে থুক ফেলছে বড়লোকের নাতি
মাগীদের গরব গেছে, মুখ শুকনো, নিভেছে দেমাক বাতি।

গান থামিয়ে মা সঞ্জুর চিবুক চুমড়িয়ে চুক করে হাতের চার আঙুল ঠোঁটে ঠেকিয়ে চুমু খায়। বলে—’বেঁচে থাক বেটি, কে বলে হিজড়ে মাগীদের বাঁধা ভাতার হয় না। আর বাঁধা ভাতারেই কাম কি মা—নতুন-নতুন পারিক ধরবি, পুরনো হলে ছেড়ে দিবি। পারিককে বাটলির ভুখা ধরিয়ে ছেড়ে দিবি। যত বয়স বাড়বে, দেখবি সঞ্জু, তোর কচি কচি ছোঁড়া খেতে ইচ্ছে করছে।’—শ্যামলী মায়ের এই অসংলগ্ন কথা থেকেই সুবীর বুঝতে পারে কত যন্ত্রণার নিরেট পাথরে ইট সাজিয়ে শ্যামলী মায়ের বুকের পাঁজর গড়া। হিজড়েদের একমাত্র জ্বালা-যন্ত্রণা- প্রতিহিংসার বিষয় হল নরনারীর ‘স্বাভাবিক’ জীবন। বেশ্যাপাড়ার সত্যিকারের মেয়েদের হারিয়ে সঞ্জু যে পারিক ধরতে পারছে, মেয়েদের চেয়েও সঞ্জুর যে বেশি ডিমান্ড—এটা মায়ের কাছে এক চরম জয়।”

এটা তো উপন্যাসের অংশ। ধারাবাহিক ভাবে বেরচ্ছে। অনিকেত বেশ বুঝতে পারছিল এইসব খুঁটিনাটি। বোঝাই যাচ্ছে সঞ্জু নামের ছেলেটাকে মা, মানে গুরুমা, বেশ স্নেহের চোখে দেখে। ছেলেটার অনেক খদ্দের জুটছে, কিন্তু প্রেমিক জুটছে না। ‘পারিক’ হল অস্থায়ী প্ৰেমিক সঞ্জুকে মনের মতো করে তৈরি করতে চাইছে। বলছে : পারিককে বাটলি-র ভুখা ধরিয়ে দিবি। ‘বাটলি’ তো পশ্চাদ্দেশ। অন্য কথায় ‘বাটু’। অনেকদিন ধরেই জানে। প্রথমেই কোমর নাচিয়ে যে-ছড়াটা বা গানটা গেয়েছিল গুরুমা, ওখানে বলা আছে বড়লোকের ছেলেরা নারী- যোনিতে আসক্ত না-থেকে হিজড়ে নিয়ে ঘুরছে দেখে স্ত্রী-বেশ্যাদের খুব কষ্ট। এই মর্মার্থ বা সরলার্থ বা ভাব সম্প্রসারণে নিজেই সন্তুষ্ট হয়ে নিজেকে ফার্স্ট ডিভিশন নম্বর দিয়ে দিল। তারপর অবাক হল সোমনাথের কথা ভেবে—যে জীবনানন্দের কবিতা মুখস্থ বলতে পারে, সে এত খুল্লমখুল্লা লিখতেও পারে?

সোমনাথ জিগ্যেস করল, কেমন লাগল?

অনিকেত বলল—অল্প একটু তো পড়লাম। আমাকে গ্রাহক করে নাও, পুরোটা পড়ব বোঝাই যাচ্ছে অভিজ্ঞতার ওপর…।

অনিকেত জানত, সোমনাথ এ বিষয়ে ফিল্ড-ওয়ার্ক করেছে। সোমনাথকে নিয়ে হিজড়েদের সঙ্গে কথা বলতেও গিয়েছিল। অভিজ্ঞতা তো ওর আছেই।

অনিকেত জিগ্যেস করল, উপন্যাসটা কত বড় হবে?

সোমনাথ বলল—এটা তো এই ‘অবমানব’-এর ওপর নির্ভর করছে। ‘অবমানব’ যদি উঠে যায়—উপন্যাসটাও শেষ হয়ে যাবে। উপন্যাসটা তো বাইপ্রোডাক্ট। বিয়ারের গ্লিসারিন, বা রাম-এর ভিনিগার। যেখানে রাম তৈরি হয়, সেইসঙ্গে ভিনিগারও তৈরি হয়, জানেন তো। আমি নিজেকে বোঝার তাগিদে, নিজেকে জানার তাগিদে হিজড়ে-খোলে ঘুরেছি, আমার এই চেহারা আর কথাবার্তার জন্য গুরুমা-রা আমায় ফোটায়নি। ‘কোতি’ ভেবে কথা বলেছে। মানে— ভেবেছে চান্স আছে, ওদের দলে ভিড়ে যাব। কিন্তু সাধারণত ঠুংঠাং’-রা ওদের দলে আসে না। ‘ঠুংঠাং’ মানে হল লেখাপড়া জানা ভদ্রলোক। জানেন তো?

—এই তো জানলাম।

–এরকম আরও অনেক কিছু জানবেন। যদি জানতে চান।

—উপন্যাস-টার নাম ‘প্রোষিতাভর্তৃকা’ কেন? কথাটার মানে তো যাদের স্বামী বাইরে থাকে।

—হ্যাঁ, তাই তো, আমি তো হিজড়েদের নিয়েই লিখছি, ‘হিজড়ে’ শুনতে খারাপ লাগলে—বলা যায় তৃতীয় সত্তার মানুষদের নিয়েই। ওরা বাহ্যিক লিঙ্গ-চিহ্নে যা-ই হোক, ভেতরে-ভেতরে নারী। একটা স্বামী খুঁজে যাচ্ছে। মনের মানুষ। ‘মনের মানুষ’ না বলে ‘মনের পুরুষ’ বলাই ভাল। কখনওই পায় না। কিন্তু ভাবে আছে, কোথাও আছে, তার ‘মনের পুরুষ’। বলা যায়, ওরা অন্তহীন ‘প্রোষিতভর্তৃকা’। যদি এটা কোনওভাবে শেষ করতে পারি, তা হলে নামটা পাল্টে দেব। ওরা কিন্তু অন্তরিনও বটে। নিজেদের ভাবনায়, বিশ্বাসে, পাগলামিতে নিজেরাও অন্তরিন। ওরা-ওরা করছি কেন। আমিও তো তা-ই। এই তো আজ শাড়ি পরেছি। কলেজে যখন প্যান্ট-শার্ট পরে যেতাম, তখন লেডিজ টয়লেটে ঢুকতে পারতাম না। এরপর সালোয়ার-কামিজ ধরলাম। কলেজের কর্তারা কী গেরোয় পড়লেন ভাবুন তো? পেটের তলায় তো একটা পাইপ আছে। দাঁড়িয়ে হিসি করার ব্যবস্থা ভগবান করে রেখে দিয়েছেন। কিন্তু পোশাকটা? সালোয়ার কিংবা শাড়ি পরে ছেলেদের বাথরুমে ঢুকতে দেওয়া যায়? আবার সবাই জানে, পেটের তলায় পাইপ ঝুলছে, তা সত্ত্বেও মেয়েদের টয়লেটে ঢুকতে দেওয়া যায় কীভাবে? টয়লেটের শ্লীলতাহানি হবে না? আমাকে কিন্তু আমার ‘হেড’ আগেই বলে দিয়েছিলেন, আপনি কিন্তু জেন্ট্স টয়লেট ‘ইউজ’ করবেন। মানে, যখন আমি হরমোন করাচ্ছি, আস্তে-আস্তে দাড়ি ওঠা কমে যাচ্ছে, চামড়াটা লিলি হচ্ছে, মানে পেলব হচ্ছে, সরি, ব্রেস্ট ডেভেলপড হচ্ছে, জিন্‌স-এর সঙ্গে গেঞ্জি পরছি, তখনই বলেছিলেন জেন্ট্স টয়লেট ‘ইউজ’ করার কথা, কারণ ওঁরা ভেবেছিলেন এবার হয়তো লেডিজ টয়লেটে যাব। আমাকে বললেন, আপনি একজন অধ্যাপক, পোশাকে শালীনতা বজায় রাখবেন। ঠিক আছে, সালোয়ার পরতে শুরু করলাম। এবার? এবার আমারে ঠেকায় কে রে? লেডিজ টয়লেটে গেলাম। রিপোর্ট চলে গেল। আমাকে বললেন, ‘মিস্টার ব্যানার্জি’—ইচ্ছে করেই মিস্টার ব্যানার্জি বললেন। কী করব, আমার অ্যাডমিট কার্ডে তো সোমনাথ ব্যানার্জিই লেখা। অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার-এও তাই। আমি মনে-মনে নিজের নাম পাল্টেছি। ‘মানবী’ রেখেছি। কিন্তু ওঁরা শুনবেন কেন? আমাকে তো ‘সোমনাথবাবু’ বলেই ডাকছেন। আমি এবার এফিডেবিট করে নামটা চেঞ্জ করব। যাকগে, যা বলছিলাম—যেবার প্রথম মেয়েদের বাথরুমে গিয়ে বসে হিসি করলাম, সেদিন মনে-মনে যে কী তৃপ্তি হয়েছিল…কী আনন্দ কী আনন্দ, তা-তা-থৈ-থৈ। দেখি সেখানে গোপন জল ম্লান হয়ে হীরে হয় ফের; সৌন্দর্য রাখিছে হাত অন্ধকার ক্ষুধার বিবরে; গভীর নীলাভতম ইচ্ছা চেষ্টা মানুষের—ইন্দ্রধনু ধরিবার ক্লান্ত আয়োজন হেমন্তের কুয়াশায়….।

লেডিজ টয়লেট ব্যবহার করার সামাজিক সম্মতি পাওয়াটা ওর নীলাভতম ইচ্ছা। ওঃ জীবনানন্দ!

এমন সময় হাততালির শব্দ। হিজড়ের দল এসেছে ছল্লা’ তুলতে। মানে ‘মাংতি’ করতে- মানে ‘তোলা’ তুলতে।

ওরা অনিকেতদের সিটের কাছাকাছি এসে গিয়েছে। অনিকেত ওদের লক্ষ করতে থাকে। একজন চৌকো মুখের, দাড়ি কামানোর খরখরে ভাব রয়ে গিয়েছে। একজন লম্বা মুখের, শ্যামলা গড়ন। রোগা-রোগা। একজনের বেশ মেয়ে-মেয়ে ভাব। মুখ লক্ষ করে। মসৃণ মুখ। বুকটাও বেশ। চোয়াড়ে মুখের লোকটা সোমনাথকে বলল, গোর লাগি। সোমনাথও বলল, গোর লাগি।

দু-তিনজন উচ্ছ্বাস-মাখানো তালি মারল। একজন বলল, ঠুংঠাং টোন্যা? পারিক না কি?

সোমনাথ হাসল। বলল, সাংবাদিক।

সোমনাথের কাছে পয়সাকড়ি চাইল না ওরা।

ওকে সমীহ করে বোঝা গেল। ওদের একজন হাতটা নাড়াল—বাই-বাই করতে যেমন হাত নাড়ায়।

সোমনাথ বলল—যদি লেখাপড়াটা না-চালিয়ে যেতাম, হয়তো আমিও ছল্লায় নামতাম …।

অনিকেত আস্তে-আস্তে সোমনাথকে বলল—একজনকে দেখে মনে হল সত্যিকারের মেয়ে…। এদের কি ‘জেনানা হিজড়ে’ বলে? নিলয় চৌধুরীদের বইতে পড়েছি….।

সোমনাথ বলল-মেয়ে-হিজড়েদের ‘জেনানা’ বলে না। মেয়ে-হিজড়ে হয় না। জানানউলিদের অনেকে ‘জেনানা’ বলে। ‘জানানউলি’ মানে যার ‘জানান’ আছে, মানে, যাদের পেটের তলায় পাইপ আছে, এবং সেটা মাঝে-মাঝে জানান দেয়। জানিয়ে দেয়, আমি আছি। শাড়ি পরলেও সে আসলে পুরুষ। ‘আকুয়া’ বলতে যা বোঝায় প্রায় তা-ই। তবে আপনার চোখ ভালই বলতে হবে। ওদের দলে সত্যিই একটা মেয়েমানুষ আছে। মানে, ‘চিপটি-ওলা’ মেয়েমানুষ। আসলে কী জানেন, সব বাউল যেমন বাউল নয়। বাউল একটা ‘স্কুল অফ থট’। ওদের কিছু ফিলোজফি আছে, এবং ওদের জীবনচর্চাকে গাইড করে ওই ফিলোজফি। গানগুলো সেই দর্শনটাই ‘এক্সপ্রেস’ করে। তবে কেউ যদি তালি-মারা আলখাল্লা পরে একতারা বাজিয়ে ওইসব গান গায়, আমরা ওদেরও ‘বাউল’ বলি। আসলে ওরা হল ‘বাউল গায়ক’। এটা পেশা। বাউল-গান গেয়ে পয়সা রোজগার করে। আবার হিজড়েদের মধ্যে যারা ছল্লা তোলে, ট্রেনে তালি বাজিয়ে তোলা তোলে, তাদের মধ্যে দু-একজন মেয়ে চলে আসে আজকাল। ট্রাডিশনাল খোলে মেয়েদের অ্যালাউ করা হয় না। এদের দলে যে-মেয়েটা আছে, ওকে রোজ দেখি না। কোনও-কোনও গুরুমা হয়তো ওদের খোলে মেয়েদের অ্যালাউ করছে। আজকাল মেয়েরা ওখানে খুব সেফ। ধর্ষণের কোনও ভয় নেই। যাদের সঙ্গে আছে, ওরা কেউ চিপ্‌টি ভুখি নয়। তবে কোনও ‘আকুয়া’, মানে লিকারী যদি ওর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করে, সেটা কিন্তু লেসবিয়ানিজ্ম-এর নামান্তর। এবং পারস্পরিক সম্মতিতেই হয়। তবে ওসব খোলে অনেক ডাব্লডেকার খদ্দের আসে, মানে ‘বাইসেক্সুয়াল’। যারা হিজড়ে সম্ভোগও করে। আবার রেডি চিপ্‌টি পেয়ে গেলে, সেটারও সদ্ব্যবহার করে। তবে এরা এক্সেপশনাল। বেশির ভাগ খোল-ই নারীবর্জিত, অথচ সবাই নারী। আমরা সবাই নারী আমাদের ওই মায়ের রাজত্বে। এরপরে আর একটা দল আসবে, খড়গপুর থেকে উঠবে। ওদের দলের দু’জনকে দেখে একদম মনে হবে মেয়ে। আসলে ওরা মেয়ে নয়। ছিন্নি। ছোটবেলায় ছিড়ি হয়ে গেলে ওদের গোঁফ- দাড়ি ওঠে না, মুখটাও পেলব টাইপের হয়ে যায়।

—ছোট বয়সে কী করে আসে? অনিকেত জিগ্যেস করে। এখানেও কি ট্রাফিকিং আছে? ছেলেদের বিক্রিবাট্টা করার কোনও চক্র-টক্র?

সোমনাথ বলল—ছেলেধরারা এদের কাছে বিক্রি করে—এরকম কোনও ঘটনা জানি না— আমি অন্তত জানি না। তবে কমবয়সে কী করে আসে—পরে একদিন বলব।

সোমনাথ আর অনিকেত এভাবে গল্প করছে। অনেকেই ওদের দিকে তাকাচ্ছে। সোমনাথের শাড়ি-পরা পুরুষালি চেহারা দেখছে অনেকেই।

অনিকেত বলল, গল্প করতে করতে যাচ্ছি—ভালই লাগছে। অন্যদিন কী করো সোমনাথ? সঙ্গী জোটে?

সোমনাথ বলল—আমার পাশের সিটটা অনেকক্ষণ খালি পড়ে থাকে। কেউ বসতে চায় না তো। সব সিট ভরে গেলে, বা কোথাও সিট না-পেলে কেউ আমার পাশে বসে। ছেলে হোক, মেয়ে হোক, সবাই ‘অ্যাভয়েড’ করে। আমি বই পড়তে-পড়তে চলে যাই।

অনিকেত জিগ্যেস করে, স্টুডেন্টরা কীভাবে দ্যাখে তোমাকে?

প্রথম-প্রথম প্যাঁক দিত। এখন দেয় না। ভাল শিক্ষক’ বলে নাম হয়েছে। পড়ানোর জন্য আমি মাইনে পাই। ওই কাজটা ভাল করে করি। এর বাইরে কী পোশাক পরি, বাথরুমে গিয়ে কী করি, এসব তো ওদের দেখার কথা নয়। কলেজের মেয়ে-স্টুডেন্টরা কিন্তু আমাকে খুব ভালভাবে নিয়েছিল। ছেলেরা একটু রেজিস্ট্যান্ট ছিল, এখন অনেক ঠিক হয়েছে।

—’স্যর’ বলে না ‘ম্যাডাম’?

—’স্যর’-ই বলে। ‘ম্যাডাম’ আনতে টাইম লাগবে।

এরপর একটা ফোন এল। রিং টোনে ‘ভালবাসি—ভালবাসি’। রবীন্দ্রসংগীত। ওরও মোবাইল আছে? অনিকেত ভাবে ওকে এবার সত্যি-সত্যি কিনতে হবে। মঞ্জু বলেছিল, ওকেও একটা কিনে দিতে। মোবাইল ছাড়া কথা হবে কী করে? শুক্লার সঙ্গে তো অফিসের ফোনেই কথা বলা যাবে বাড়ির ল্যান্ড-ফোনে।

সোমনাথের মুখটায় ধানের খেতের শ্যামলিমা লাগে।

—হ্যাঁ, বলো বলো।

… … …

—এই তো আর দশ মিনিটের মধ্যেই খড়গপুর পৌঁছে যাব।

… … …

—হ্যাঁ-হ্যাঁ, পুরি-আলুর দম খেয়ে নেব। তুমি কিছু চিন্তা কোরো না।

… … …

—লক্ষ্মীর পাঁচালি? আরে, আজ তো সবে সোমবার।

… … …

—আমি সোজা কলেজে চলে যাব।

—বিকেল হবে। পাঁচটা। চাবি তো আছে আমার কাছে।

… … …

—না বাবা, রসগোল্লা রাখতে হবে না। অত কষ্ট করতে হবে না সোনামণি…।

… … …

—ঠিক আছে। রাখছি। চু-চু-চু-চুম্‌মা

সোমনাথের মুখ যেন রেডিয়াম লাগানো এখন। আলফা, বিটা বেরচ্ছে। ছোট্ট করে বলল, লাভার। আশ্চর্য, ‘পারিক’ বলল না। ‘লাভার’। কৌতূহল হলেও আর কোনও প্রশ্ন জিগ্যেস করল না অনিকেত।

সোমনাথ নিজে থেকেই বলল—আমায় খুব ভালবাসে। মাস ছয় হল আলাপ হয়েছে।

অনিকেত বলল, প্রতি সোমবারই তুমি যাও এই ট্রেনে?

সোমনাথ বলল, হ্যাঁ। প্রতি সপ্তাহেই আসি। বাড়িতে বুড়োবুড়ি আছে তো…।

ফোন নম্বরটা চাইল না। কী হবে?

ওর তো মোবাইল নেই। এবার কিনতে হবে একটা। পাহাড়ের টিলায় জ্যোৎস্নায় দাঁড়িয়ে মঞ্জুকে ফোন করবে। বলবে, চলে এসো মঞ্জু।

চাঁদ তো পুরনো হয় না কখনও। আর?

৩১

মোবাইল ফোন কিনল অনিকেত। তিন হাজার টাকা দাম। হাচ কোম্পানির কানেকশন। টেস্ট করার জন্য বাড়িতে ফোন করল ল্যান্ড-ফোনে

—শুক্লা, মোবাইল কিনেছি, প্রথম ফোনটা তোমাকেই করছি।

—জেঠিমা পুজো কচ্চে।

ঘড়িতে দেখল বেলা সাড়ে এগারোটা। এখন আবার কী পুজো? পুজো তো সকালে হয়, স্নান করে। তারপর সন্ধেয়, আর রাতে শোওয়ার আগে। শোওয়ার আগে প্রার্থনা টাইপের কিছু করে, কারণ তখন ওর ঠোঁট নড়ে। একই তো প্রার্থনা। রেকর্ডেড প্রার্থনা প্রতিদিন রি-ওয়াইন্ড করে-করে বলা। এত রিপিট ব্রডকাস্ট, ঠাকুর রাগ করেন না? বোর হন না? আগেও তিনবার করেই করত শুক্লা, কিন্তু ডিউরেশন কম ছিল। ক্রমশ ডিউরেশন বাড়ছে। এছাড়া করবেই বা কী? অনেক আগে, হয়তো এক যুগেরও বেশি আগে, কোত্থেকে একটা ‘জোক’ শুনে এসে অনিকেত শুক্লাকে বলেছিল : প্রার্থনার চেয়ে সেক্স ভাল, অনেকগুলো কারণেই ভাল। একনম্বর কারণ, প্রথম ক্ষেত্রে উভয়ের সম্মতির দরকার হয় না, দ্বিতীয় ক্ষেত্রে দু’জনেরই সম্মতির দরকার হয়। সেক্স-এর সময় ‘ওহ্ গড’ বলা হয়, কিন্তু প্রার্থনায় কখনও ‘ওহ্ ফাক’ বলা হয় না।

এরকম করে চার-পাঁচটা পয়েন্ট শোনার পর শুক্লা বলেছিল—ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমি দু’ঘণ্টা ধরে প্রার্থনা করছি, তুমি দু’ঘণ্টা ওই কম্মো করো তো দেখি… আমি দু’বেলা প্রার্থনা করছি, কিংবা তিনবেলা। তুমি তিনবেলা করো তো দেখি? প্রার্থনার পর ফ্রেশ হয়ে যাই, আর ওসবের পর কেতরে যাও। কোনটা ভাল?

ফোন ধরে আছে মন্টু। মোবাইলের প্রথম ফোনটা মন্টুকেই করা হয়ে গেল। অনিকেত বলল, এখন কেন ঠাকুরের কাছে?

—ফুলের জন্য।

—ফুলের জন্য মানে?

—আমাকে ফুল দেবে তো…ঠাকুরের ফুল। আমার পরীক্ষা কিনা… ।

—বেলা সাড়ে এগারোটা বাজে, কখন পরীক্ষা?

–বেলা একটা থেকে…।

কথা বাড়াল না অনিকেত। পয়সা উঠবে। এবার মঞ্জুকে। ওর অফিসের ফোনে। ‘হ্যালো’ শুনেই মঞ্জু গলা চিনে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল—ডাবুদা, কবে এলি?

–কাল রাতে। একটা মোবাইল কিনলাম, এইমাত্ৰ।

—এইমাত্র? আমাকেই প্রথম ফোন করছিস?

—হ্যাঁ।

—উঃ, কী ভাল লাগছে! কেমন লাগছে নতুন জায়গায়?

—বেশ ভালই তো লাগছে। ভাল জল-হাওয়া, বড়-বড় গাছ, পাখি, কিন্তু তোকে ‘মিস’ করছি।

—ইঃ, ঢং, বাজে কথা বলার জায়গা পাস না? কলকাতায় যখন ছিলি, কত যেন দেখা করতিস…। পাত্তাই দিতিস না।

—পাত্তা দিতাম না মানে? যা কিছু পাত্তা—সে তো তোকেই দিতাম। তুই ছাড়া আমার আর কোনও ‘গার্লফ্রেন্ড’ আছে না কি?

—আবার বাজে কথা? আইভি ঘোষ না কী যেন? ওর কথা তো খুব বলতিস…

—ও ‘গার্লফ্রেন্ড’ না ‘বয়ফ্রেন্ড’ নিজেই জানি না।

—যাক গে। এখন তো ছুটিতে। এখন তো আর অফিস দেখাতে পারবি না…।

–কাল একবার অফিসে যাব ভাবছিলাম, একটু দরকার ছিল।

—যেতে হবে না অফিসে। কাল আমিও যাব না। ডুব মারব। কাল সারা দুপুর আমার…মানে কালকের দুপুরটা আমাকে দে ডাবুদা।

—কোথায় যাব? রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে ভাল লাগে না। এই বয়সে মাঠে-ঘাটে বসলে ছেলে-ছোকরারা প্যাঁক দেয়।

—দক্ষিণেশ্বর গেলে হয় না?

—আর জায়গা পেলি না?

—এখনও তো গরম পড়েনি। গঙ্গার ধারে বসা যায়। কেউ কিছু বলবে না।

—ধুর, ওখানে কী যাব, তারচে’ ওখানে যাবি? ওই চেম্বারে?

—যা বলবি…।

‘ওই চেম্বার’ মানে হল একটা কেবিন। সাধারণ কেবিন নয়, বার-এর কেবিন। মধ্য কলকাতায় দু-একটা বার-কাম-রেস্তোরাঁ আছে, যেখানে এখনও ‘খোপ’ পাওয়া যায়। পর্দা- ঢাকা। ভারী পর্দা, বাতাসে খুব একটা ওড়ে না। একবার ওখানে গিয়েছিল। সেবারও দুপুরে। ওখানে লাল জামা পরা বেয়ারা আছে এখনও। স্যালুট দিল। ওখানে খুব একটা রং-এ ঢুকেছিল, এমন নয়। মঞ্জু যদি সুন্দরী হত, তা হলে রং-এ ঢুকত। যদি কমবয়েসি হত, তা হলেও। মধ্যবয়স্কা এক মহিলা, প্রসাধনেও পরিপাটি নেই। চাকরিটা করে বলে এক ধরনের স্মার্টনেস আছে—এই যা। ‘বাজারের মেয়ে’ বলে মনে হয় না। বেয়ারা যে স্যালুট-টা মেরেছিল তাতে সম্ভ্রমের চিহ্ন ছিল না। যান্ত্রিক ছিল। আরও কয়েক বছর আগে বেতার নাটকে জাতীয় পুরস্কার পাওয়া এক অভিনেত্রী বলেছিল, চলুন অনিকেতদা, খাওয়াব। এখানেই ঢুকেছিল। সেদিন স্যালুটের কায়দাটাই আলাদা রকমের ছিল। পায়ে শু ছিল না বেয়ারার। চটি। তাতেই পা ঠোকার শব্দ হয়েছিল।

সেদিন পর্দা-ঢাকা কেবিনে একটু অবাক চোখে চারদিক তাকাচ্ছিল। বোঝাই যাচ্ছিল, এসব জায়গায় যাওয়া-আসার খুব একটা অভ্যেস নেই মঞ্জুর। ওর অফিস কলিগরা কতই বা মাইনে পায়? এসব ছোটখাটো ট্যুরিজম-এর কোম্পানি বেশি মাইনেপত্তর দেয় না। ওর পুরুষ- কলিগ’রা বড়জোর অনাদি-তে মোগলাই পরোটা খাওয়াতে নিয়ে যেতে পারে। আর মালিক স্বয়ং? কে জানে? তবে ওরা যদি এসব করতে চায়—আরও সুন্দরী পাবে।

অনিকেত জিগ্যেস করেছিল, বিয়ার খাবি?

ও ঘাড় নাড়িয়ে ছিল। নিষেধের। মৃদু। ‘বিয়ার’ শুনেই ঘটঘট করে ‘না’ বলা বা নাক ওঠানো, বা কপাল কুঁচকোনো—ওরকম কিছু নয়। অনিকেত জিগ্যেস করেছিল, খাসনি কখনও?

মঞ্জু বলল, আমার বর আনত। বেশির ভাগ দিন বাইরে খেত, মাঝে-মাঝে বাড়িতেও। আমাকেও খেতে বলত। ওটা বিয়ার নয়, হলুদ। সোনালি রং। ওটা বোধহয় হুইস্কি। চকোলেট রঙেরও একটা জিনিস আনত। ওকে ওর কোনও বন্ধু বলেছিল, বউকেও একটা খাওয়াবি, তা হলে ওর হবে। তোকে তো বলেছি, আমার ইচ্ছে হত না। শুধু ওর জন্যই শুতে হত। ওকে গায়ে নিতে হত। ও ব্লু-ফিল্ম দেখাত। ওখানে মেয়েরা যেসব কাণ্ড করত, ওসব দেখে ঘেন্না হত আমার। দেখতে পারতাম না। ও চাইত, আমিও ওরকম করি। আমি পরতাম না। ওর ধারণা হয়েছিল, হুইস্কি খাইয়ে দিলে আমি ওরকম করব। আমার খেতে ভাল লাগত না। কীরকম ঝাঁঝ লাগত। একটু তিতকুটে। ও একটু সোডার জল ঢেলে দিয়ে বলত ‘আস্তে-আস্তে খেয়ে নাও’। আমি তাই করতাম। আমার ঘুম এসে যেত। আমি চিত, দু’পাশে দু’হাত। আমার দু’পাশে দু’টো হাত শুকনো বাঁশের মতো পড়ে আছে। ও আমার হাত দু’টোকে ওর দু’হাতে ধরে ওর পিঠের ওপর উঠিয়ে বলত, চেপে ধরো। খামচাও। আমি ওর কথা মান্য করার চেষ্টা করতাম, কিন্তু ঘুম-ঘোরে শুনতাম—আজব মাগি। ভেজেও না। ঘা হয়ে যাবে। ভেতরে থেঁতো ঢ্যাঁড়স- ঢুকিয়ে দেব। সেটাও করেছিল। ঢ্যাঁড়স কেটে, জলে ভিজিয়ে, সেই পিছল জল…। এমনি এমনি আমাকে ছেড়েছে ও?

—ডাক্তার তো দেখিয়েছিল, মনের ডাক্তার। কী বলেছিল ডাক্তার?

—ডাক্তারবাবু ছবিতে বুঝিয়েছিল অনেক কিছু। সারা শরীরে কম্পন কীভাবে হয়, ‘অর্গ্যাজম’ নামে একটা শব্দ বারবার বলত। বলত, ওটা আপনাকে পেতেই হবে।

আজ একটু বিয়ার খা। অল্প করে। ভাল না-লাগলে খাবি না। অনিকেত বলে।

বেয়ারা ঝপ করে ঢোকে না। ‘মে আই কাম ইন’ বলে ঢোকে। মেনু নিয়ে ঢুকেছিল। দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। অনিকেত বলে, পাঁচ মিনিট পরে আসুন।

–কী খাবি? কার্ডটা মঞ্জুর দিকে ঠেলে দিয়েছিল।

—আমি কী জানি? মঞ্জু ঠেলে দিল ফের।

—চপ সোয়ে?

–আমি ওসব জানি না। আমি শুধু চাউমিন জানি, আর চিলি-চিকেন। যা রাস্তায় বিক্রি হয়।

—তা হলে চাউমিন-ই খা। হাক্কা।

ইচ্ছে করেই এসব জার্গন’ উচ্চারণ করছিল অনিকেত। মঞ্জু যে এসব জানে না এবং স্বীকার করবে সেটা, আর তা এক ধরনের আনন্দ দেবে।

—হাক্কা না পাক্কা, যা খুশি বলে দে।

চাউ, মাঞ্চুরিয়ান, আর দু’টো বিয়ার বলেছিল। মঞ্জু বলেছিল, আমি কিন্তু খাব না।

অনিকেত বলেছিল—যতটা পারবি খাবি, আমি তো আছিই।

—তুই রোজ এসব খাস?

—এসব মানে? চাউ, চিকেন—এসব?

—না, মদ।

—কালেভদ্রে। বিয়ার কি মদ নাকি? চিরতার জল।

—তোর বউ জানে?

—বউ রাগ করে। বাড়িতে একদম না।

—বাইরে খেয়ে গেলে মুখে গন্ধ পায় না?

—না।

—কেন? আমি তো খুব পেতাম।

—ও বেশি খেত। আমি তো বেশি খাই না, এছাড়া খাই কোথায়? আজ তোর অনার-এ…।

হাফ গ্লাস বিয়ার ঢেলে দিয়েছিল মঞ্জুকে।

মঞ্জু বলল, এত ফেনা কেন? তারপর বলল, লস্যির ফেনা অনেকক্ষণ থাকে, এটা মিলিয়ে যায়।

একটু চুমুক দিল। বলল, তেতো, কিন্তু খেতে খুব খারাপ না তো…।

অনিকেত বলল, আরে—এ তো চিরতার জল…

মঞ্জু একটু-একটু করে পান করছিল। মঞ্জুর গ্লাস অর্ধেক শেষ হওয়ার আগেই অনিকেতের দু-গেলাস হয়ে গেল। আবার ঢালল। ফেনা।

অনিকেত বলল, অর্গ্যাজম হচ্ছে, দ্যাখ…।

—কোথায়?

—এই গেলাসে। এই ফেনায়।

—ওই ব্যাপারটা কী রে?

—আমি তোকে বোঝাব। একদিন বোঝাব।

–বোঝা…।

—এখানে হবে না। বোঝাতে গেলে প্রথমে…

কথা না-বলে মঞ্জুর উরুতে হাত দিল। হাত-কে গতি দিল। ‘হারমনিক মোশন’ নয়, কিছুটা ‘ক্যাওটিক মোশন’ বরং। অনিকেত লক্ষ করল, মঞ্জু চোখ বুজেছে। হাল্কা আলোয় মদির মুখখানি দেখতে থাকে। বরং বলা যায়—অবলোকন করতে থাকে। কাঁধে হাত দেয়। মঞ্জু কিছু বলে না। গালে ঠোঁট ছোঁয়ায়। ঠোঁটেও। মঞ্জু চোখ বুজে আছে। অনিকেতের অন্য হাত উরুদেশে চঞ্চল।

—ও, সরি সরি। বেয়ারা ঢুকে বলল।

নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিল অনিকেত।

মঞ্জু বলল, এ মা, ছিছি

অনিকেত বলল, ছিছি-র কী আছে? কিন্তু অনিকেত বুঝতে পারছিল ওর বুকের ধপধপ। গ্লাসে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে আবার হাতটা কাঁধে রাখে। মঞ্জু হাত সরিয়ে দেয়।

বলে, চল, এখান থেকে চলে যাই।

অনিকেত বলে, এখন কেন যাব? শেষ করি…।

মঞ্জু বলল, ওরা কী ভাবল ….

অনিকেত আবার স্পর্শ করার চেষ্টা করল। মঞ্জু সরে গেল।

আবার বলল—তাড়াতাড়ি বেরিয়ে চল।

অনিকেত, যাব না। তোর ফ্রিজিডিটি-টাকে দেখে নেব। এদিকে আয়। মঞ্জু উঠে দাঁড়ায়।

অনিকেত বলে, তোর বর এমনি-এমনি ফুটেছে?

মঞ্জু মুখ নিচু করে থাকে। প্লেটে খাবার পড়ে থাকে। বেয়ারা এলে বিল মেটায়। দশ টাকা টিপ্‌স দেয়। বেয়ারা জিভ কেটে বলে, দশে হয়? পঞ্চাশ…। অনিকেত মনে-মনে খিস্তি দেয়। একটা পঞ্চাশ-ই বের করে।

মঞ্জু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যায়। যেন বেরতে পারলে বাঁচে। বেরিয়েই অনিকেত বলে— -তুই কোথায় যাবি যা। আমি চললাম।

মঞ্জু বলেছিল, রাগ করলি?

অনিকেত উত্তর দেয় না।

মঞ্জু বলে, ঠিক আছে, আর একদিন। আমাদের বাড়িতে। পরিমল তো থাকে না দুপুরে…।

লোভ দেখাচ্ছে? যেন ওর শরীরের জন্য কাতর। যেন খুব লোভ আছে…। ইচ্ছে করলে আর চেষ্টা করলে অনেক পেত। নেহাত ছোটবেলার একটা ইয়ে’ আছে, তাই।

ক’দিন পর মঞ্জু-ই ফোন করেছিল আবার। অনিকেত ফোনটা তুলতেই ও শুনতে পেয়েছিল—রাগ করে না রাগুনি, টেকোমাথায় চিরুনি, আমি আসব এক্ষুনি, নিয়ে যাব তক্ষুনি…..।

—কোথায় নিয়ে যাবি?

—ময়দানে।

—না, ময়দানে বসে বাদামভাজা খেতে আমি রাজি নই। তা ছাড়া পুলিশ আছে।

এই কথাটার মধ্যে কয়েকটা ‘মেসেজ’ ছিল। ময়দানে যেসব ‘ফ্লাইং-মেয়ে’ ঘোরে, তোমাকে ওদেরই একজন ভাবতে পারে পুলিশ, তার মানে তুমি মোটেই ভাল নও মঞ্জু। তবু আমি রাজি, কিন্তু শুধু বসে বসে গল্প করতে নয়। ওসব অনেক হয়েছে।

—ময়দানে যাবি না? মঞ্জু বলে, তা হলে আমাদের বাড়িতেই চল।

—এখন বেলা একটায় বেরব কী করে? তোর অফিস?

—এলাকায় গন্ডগোল। অফিস বন্ধ।

—কেন?

—আমাদের এই এলাকার একটা পেপার মার্চেন্ট-কে কাল কারা ছুরি মেরেছিল, আজ সে মারা গিয়েছে। তাই এলাকার ব্যবসায়ীরা থানায় যাচ্ছে।

অনিকেতের তেমন কাজ ছিল না অফিসে। তা ছাড়া, ওর কাজের ধরনটাই এমন, ইচ্ছে করলে বেরতে পারা যায়।

ওরা দেখা করল, মৌলালির মোড়ে।

মঞ্জুর বাড়িতে কখনও যায়নি আগে। মঞ্জুও বলেনি কখনও।

এন্টালি বাজারের পিছনে একটা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে একটা গলির মধ্যে পড়ল। পুরনো শিশি-বোতলের আড়ত, সস-তেল এসবের চেয়ে মদের বোতলই বেশি। মদের বোতলের ছিপি খুলে বোতলের তলায় পড়ে থাকা কয়েক ফোঁটা ঢেলে রাখছে একটি বছর দশের ছেলে। বলা ভাল–সংগ্রহ করছে। প্রতিটি বোতল থেকে দশ-বারো ফোঁটা করে ক্রমশ দিল তো পাগল হ্যায় …। ফুলুরি। ছোট-ছোট টিনের এক বিচিত্র ককটেল। সিনেমার পোস্টার আঁকছে বড় কাপড়ে। তেলেভাজার দোকানের নোংরা কাচের ভিতর দিয়ে দেখা যায় রু কিংবা খোলার চালার ঘরের ফাঁকে-ফাঁকে দু’টো-একটা তিন-চারতলা বাড়ি। ধপ করে সামনে পড়ল এক পলিথিন নোংরা। পলিথিনটাতে গিঁট দেওয়া ছিল না, একটা নেংটি ইঁদুর বেরিয়ে আসতেই একটা কাক ছোঁ মেরে নিয়ে চলে গেল। একটা শনি মন্দিরের পাশ থেকে গান বাজছিল ‘কলকাতা, কলকাতা–ডোন্ট ওয়্যারি কলকাতা’। ওরা আর একটা আরও সরু গলিতে ঢোকার আগে মঞ্জু একটু দাঁড়িয়ে পড়ল।

ও বলল, দেখতেই তো পাচ্ছিস কীরকম পাড়ায় থাকি। এদিকে অবাঙালিই বেশি, কিন্তু আমি যে-বাড়িতে থাকি, ওখানে চার ঘরই বাঙালি। আমার বাড়িতে বাইরের লোক খুব একটা আসে না, শুধু ছেলের বন্ধুরা। আমার কোনও পুরুষ-বন্ধু নেই। এখানে ও আসেনি তেমন ভরদুপুরে হঠাৎ কেউ এলে কৌতূহল তো হতেই পারে। যদি কেউ কিছু জিগ্যেস করে, ট্যুর- সংক্রান্ত কথা বলবি। আমার আশেপাশে যারা থাকে, ওদের কারও চায়ের দোকান, কেউ সবজির ব্যবসা, একজন ছাপাখানায় কাজ করে, কেউ ছোটখাটো ব্যবসা করে—এরকম।

দরজা খোলা। কিন্তু দরজা দিয়ে ঢুকলে একটা উঠোন। উঠোনে একটা জলের কল। উঠোনের চারদিকে চারটে টিনের চালের ঘর। ঘরগুলো পাকা। বাইরে বারান্দা। ওরা ঢুকতেই একটা নেড়িকুকুর তুমুল ডেকে উঠল। কুকুরের ডাক শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে এল একটা বুড়ি, আর একজন মোটামতো প্রৌঢ়া। ওদের দেখল। মঞ্জু একটা ঘরের সামনে দাঁড়াল। গ্রিলের দরজার তালা খুলে ভিতরে ঢুকল। বারান্দার একদিকে পার্টিশন করে রান্নাঘর, বারান্দার অন্যপাশে একটা ছোট ঘর।

মঞ্জু বলল—ছেলের ঘর।

ওর ঘরে ঢুকল। ঘরের দেওয়ালে একজন পুরুষ-সংলগ্ন মঞ্জু। বোধহয় বিয়ের পরে তোলা। ঘরটা ছোট। একটা খাট, আলনা, একটা আলমারি। একটা ফ্রিজ, টিভি। মাঝখানে সামান্য লাল সিমেন্টের মেঝে—অবশিষ্ট।

মঞ্জু বলল, বোস। এভাবেই থাকি। কখনও ভেবেছিলাম, আমার ঘরে তুই আসবি। কত বড় চাকরি করিস…।

অনিকেত বলল—এসব বাজে কথা রাখ। তোদের বাথরুম কোথায়?

মঞ্জু বলল, বাইরে। কলের পাশে। দু’টো আছে। চৌবাচ্চায় জল থাকে। ছেলেরা বাইরেই করে। মেয়েরা ভেতরে। টিন দিয়ে ঘেরা। কেন, বাথরুম যাবি?

অনিকেত মাথা নাড়ায়।

মঞ্জু হাত-পা ধুয়ে এসে মুখ মোছে। খাটে বসে। দূরত্ব রেখে। এ-কথা সে-কথা হয়। হতে- হতে স্বামী-প্রসঙ্গে আসে।

অনিকেত জিগ্যেস করে, মনে কর তোর স্বামী এখন যার সঙ্গে আছে, সে নেই। চলে গিয়েছে, বা কিছু হয়েছে। তারপর ওর অসুখ হয়েছে খবর পেলি। কী করবি?

মঞ্জু হাসে। বলে—অসুখ তো? রুগ্‌ণ। উইক। তখন নিশ্চয়ই করতে-টরতে চাইবে না। আমি যাব, সেবা করব।

—তারপর ভাল হয়ে গেলে?

—জানি না—যাঃ। এই বলে ভ্রু-ভঙ্গি করে। কাছে এসে অনিকেতের থুতনিটা নাড়িয়ে দেয়।

অনিকেত জানে, ওটা গ্রিন সিগন্যাল। কাছে যায়। বাৎসায়ন-নির্দেশিত উপযুক্ত স্থানে স্পর্শাদি করতে গেলে মঞ্জু বলে, দাঁড়া চা করে নিয়ে আসি।

এগুলোকে কী বলে? ছলনা, ছেনালি, না ছমকানো? না কি মনোবিজ্ঞান-মতে, ফ্রিজিডিটি- র সিম্পটম?

—ডিমের অমলেট খাবি?

জোরে মাথা নাড়ে অনিকেত।

মডার্ন হয়েছে, এখন মামলেট নয়, অমলেট।

চা নিয়ে এল মঞ্জু।

চা-টা তো খেতে হল।

অনিকেত বলল—চা এনে ভালই করেছিস। মাথা ধরেছিল।

মঞ্জু বলল—আয় মাথাটা টিপে দি। শুয়ে পড়

মঞ্জু ছিটকিনিটা টেনে দিল।

মঞ্জুর কোলে মাথা রাখল অনিকেত।

মঞ্জু মাথা টিপছিল। পাতলা হয়ে-আসা-চুলে বিলি কেটে দিতে-দিতে বলল—সেই ছোটবেলায় ঝপ করে বাথরুমে ঢুকে, খপ করে না-ধরে যদি দু’টো ভাল-ভাল কথা বলতিস…

অনিকেত বলল—আজ আর খপ করে ধরব না। আস্তে-আস্তে…।

আস্তে-আস্তেই উন্মোচন করছিল অনিকেত। চেষ্টা করছিল উষ্ণতা এনে দেওয়ার।

এমন সময় দরজায় ধাক্কা।

তাড়াতাড়ি শাড়ি ঠিক করল মঞ্জু। ভাগ্যিস বেশি কিছু হয়নি। অনিকেত খাটের কোনায় চলে গেল।

বলতে লাগল, জব্বলপুর ঠিক আছে। কিন্তু জব্বলপুর থেকে ভীমবেটকা যেতে চাই, আর ইয়ে ইয়ে…যেখানে শোন, নর্মদা এসব নদীর উৎস…মহানদীও…অমরকন্টক নামটা কিছুতেই মনে পড়ছিল না। ঝরনা, ঝরনা, খাজুরাহো…ফ্যামিলি নিয়ে যাব। গাড়ি…বিদিশা…শ্রাবন্তী…

দরজাটার ছিটকিনি খুলল মঞ্জু। মোটামতো প্রৌঢ়া মহিলাটি বাইরে। চেঁচিয়ে বলল-গ্যাস জ্বলছে হাউ-হাউ করে, এদিকে দরজা বন্ধ। আমি নিব্যে দিয়েছি। কী করিস, অ্যাঁ? খেয়াল থাকে না? আগুন লেগে যেত…।

মঞ্জু বলল—ইশ গো, একদম ভুলে গিয়েছি তাড়াতাড়িতে গ্যাস নিভাতে। অফিস তো বন্ধ, খুলতে দিল না, ও-পাড়ায় ঝামেলা হয়েছে। ক্লায়েন্ট এসেছে বাড়িতে।

অনিকেত ওর বিদিশা—শ্রাবন্তী থামিয়ে বলল—কত টাকা তা হলে দিতে হবে বলুন? বলার পরই, নিজের কানে কথাটা খারাপ শোনাল। দরজার ছিটকিনি বন্ধ, ব্লাউজের পিছনের হুক খোলা, যদিও দেখতে পাচ্ছেন না ওই মহিলা, ‘কত টাকা দিতে হবে’ এই পরিস্থিতিতে খুব খারাপ কথা।

অনিকেত বলল, যেখানে-যেখানে যাব বললাম, সেগুলো যেন ট্যুর-এ থাকে। টাকাটা বলুন। মহিলা চলে গেল।

মঞ্জু দরজাটা ভেজাল না আর।

অনিকেত বলেছিল—তোকে খারাপ ভাবল?

মঞ্জু স্বর নামিয়ে বলল—কে জানে? আগে তো কখনও দেখেনি এমন। আমার বর কেন আমার সঙ্গে থাকেনি, কিছুটা জানে। ওটার জন্য আমার প্রতি সম্ভ্রম আছে। আমার ইয়ে’ কম, ওটা আমার প্লাস পয়েন্ট।

ও একদিন বলেছিল—তোর কী সুন্দর আঁটো-গড়ন, তোকে ছেড়ে তোর স্বামী অন্য মেয়ের ঘর করে। তুই রোজ জায়ফলের গুঁড়ো খা। দেখবি এমন হবে, স্বামীকে ছিঁড়ে খাবি।

অনিকেত বলে, খেয়েছিলি?

ও বলে, উঁহু।

—চলি রে…। অনিকেত ওঠে।

ওই ঘটনা মাস ছয় আগের। ওসব লাইনে আর ভাবেনি। দুলাল-টুলাল…ঝামেলা কম ছিল না কি?

মঞ্জুর আহ্বানে আবার বেরল অনিকেত।

মঞ্জুর বাড়িতে আর যাওয়া নেই। ওই মুটকি-টা মুখ চিনে রেখেছে। ক্লায়েন্ট সেজে বারবার তো যাওয়া যায় না। একটা এসপার ওসপার হয়ে যাবে আজ। একটা বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে।

কিন্তু বৈপ্লবিক সিদ্ধান্তটার কথা ভাবলেই, বুকটা ধুকপুক করে ওঠে কেন?

বলতে গেলে। সচ্চরিত্র ছিল ও। বিশেষত বিয়ের আগে। এজন্য মঞ্জুই দায়ী। মঞ্জুকেই থ্যাক্স জানাতে হয়। কিংবা ওকেই দোষ দিতে হয়। সেই বয়ঃসন্ধিতে মঞ্জু ওকে যে-অপমানটা করেছিল, এবং পরবর্তী বহু দিন ওর মুখে, দেহের ভাষায় ঘৃণা বজায় রেখেছিল, সেটাই ওকে মেয়েদের থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল। বহুকাল একটা অপরাধ-বোধ কাজ করে গিয়েছে। লোকে ওকে ‘চরিত্রবান’ কিংবা ‘সচ্চরিত্র’ বলে জানে। আর চরিত্রটার অবস্থান প্যান্টের তলাতেই। কিন্তু ওর ‘চরিত্রবান’ হওয়ার কারণটা তো জানে না।

আজ সে-চরিত্র খোয়াবেই। পুরোপুরি। ‘চরিত্র’-টা এমনি ওঠানামা করলে তেমন কিছু হয় না। ‘প্রোথিত’ হলেই চরিত্র নষ্ট হয়। আজ এই বসন্তে ‘চরিত্র’ নষ্ট করতে চলেছে ও।

ওর এক বন্ধুর খালি ফ্ল্যাট আছে। ওদিকে যাবে না। মিথ্যে বলতে হবে। মিথ্যের পেট থেকে আরও ডিম পড়ে। তা ছাড়া সত্যিটাও বলা যাবে না। হোটেল-ই ভাল। শিয়ালদা অঞ্চলে অনেক হোটেল আছে। হোটেলের লোকজন বুঝলে—বুঝুক। ওখানে এসব কম্মো খুব হয়।

ওরা তো ভাববে মেয়েছেলে ‘ফিট’ করে এখানে এসেছে। ওরা তো বুঝবে না, আর জানবেও না—এই লোকটা নিছক ফূর্তি করতে একজন ভদ্রমহিলাকে আনেনি। একটা…’মহৎ উদ্দেশ্য’ আছে ভাবতে যাচ্ছিল, কিন্তু ‘মহৎ’ শব্দটা যেন একটু প্যাক দিল। তা হলে ‘বৃহৎ’। ‘বৃহৎ উদ্দেশ্য’। একজন মহিলাকে ফ্রিজিডিটি থেকে মুক্ত করতে হবে। মুক্ত করতে পারুক, না-পারুক চেষ্টা করতে হবে।

মঞ্জু বেশ সেজেগুজে এসেছে। লাল টিপ, হাল্কা লিপস্টিক, মিনু শাড়ি। যখন এল, ঘড়ি দেখল বারোটা পঁয়ত্রিশ। কোনও ষড়যন্ত্রের অংশীদার রেডিও-নাটকে যেমন প্রশ্ন করে, তেমন করেই অনেকটা, প্রশ্ন করল মঞ্জু—কী প্ল্যান?

অনিকেত কাঁধ ঝাঁকায়। বলতে চায়—কে জানে? বলতে চায়, ও প্ল্যানহীন। সবই ভবিতব্যে ছাড়া, কিংবা হাওয়ায়।

অথচ ও ভেবে রেখেছিল, কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে এয়ারপোর্ট অঞ্চলে যাবে। ওখানে হোটেল আছে, যারা বহরমপুর, গাইঘাটা, চাকদা, রানাঘাট, স্বরূপনগর—এসব অঞ্চল থেকে আসে, প্লেন ধরে কোথাও যায়, বেশির ভাগই আগরতলার যাত্রী ওরা, কেউ-কেউ শিলচরের, ওরা বেশ কিছুটা আগে আসে। দু’তিন ঘণ্টা হোটেল থাকে, খাওয়া-দাওয়া করে, ওরা ঘণ্টা হিসেবে হোটেল ভাড়া দেয়। ওরা ওখানে যাবে, যেন যাত্রী। কিন্তু এজন্য তো একটা পেট-মোটা ব্যাগ চাই সঙ্গে, নইলে ক্যামুক্লাজ হবে না। শিয়ালদা বরং ভাল।

কিন্তু হোটেলের কথা বলল না মঞ্জুকে

তুই কিছু প্ল্যান করেছিস? অনিকেত জিগ্যেস করে।

মঞ্জু বলে, না। চ’ ময়দানে ঘুরে বেড়াই, আমার মুক্তি আলোয় আলোয়। এখনও গরম পড়েনি। তারপর বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়াম-এ ঢুকে যাব বেশ…।

ওটাই তো হিন্ট। প্ল্যানেটোরিয়াম বলল যখন, ‘প্ল্যান’ আছে।

অনিকেত বলে, প্ল্যানেটোরিয়াম-এ তো আধঘণ্টা-পঁয়তাল্লিশ মিনিট মাত্র অন্ধকার। বলেই চোখ মারে।

মঞ্জু বলে, অসভ্য।

বাঃ, ভাল লক্ষণ। এই তো…। পথে এবার নামো সখি পথেই হবে এ পথ চেনা…।

অনিকেত বলল—চ’ হাঁটি।

মৌলালি থেকে হাঁটতে-হাঁটতে শিয়ালদা। ওখানে ভিড়ের ফাঁকে হোটেলে দরজা। তরুণ হোটেল…রিজেন্ট হোটেল…ঢোকে না। পার হয়ে যায়।

মঞ্জুকে বলে—রাস্তায় রাস্তায় কোথায় ঘুরব? আর কেবিনেও সুবিধে হয় না। হোটেলে চল, কেমন? আমরা বেশ হ্যাজব্যান্ড-ওয়াইফ, অ্যা….

মঞ্জু বলল, ভয় করছে…।

অনিকেত বলল, কীসের ভয়?

বাঁ দিকে একটা সাইনবোর্ড দেখতে পেল। ‘পরিচ্ছন্ন পরিবেশে এ্যাটাচ বাথরুম সহ’…ছেঁড়া ধুলোমাখা লাল কার্পেট। ঢুকে গেল। সামনের কাউন্টারে চোখ-ফোলা একটা লোক।

অনিকেত বলল, একটা ভাল ঘর দিন। তারপর মঞ্জুকে বলল, কোনও মানে হয় বলো, একটার সময় বন্ধ হয়ে গেল, খুলবে সেই পাঁচটায়…। লোকটাকে বলল, ফ্যানট্যান আছে তো? চার ঘণ্টা কাটাতে হবে তো…।

লোকটা বলল, সব আছে। তবে যতক্ষণই থাকেন না কেন, একদিনের চার্জ। চারশো।

অনিকেত বলল, কী আর করা যাবে।

দোতলায় ঘর। বিছানার চাদরটা নোংরা। বাথরুমের গন্ধ আসছে। যে-খুলে দিয়েছিল ঘরটা, সে বলল, পাঁচ মিনিট বসেন। আসছি।

একটা ফিনাইলের বোতল আর একটা চাদর নিয়ে এল। বাথরুমে ফিনাইল ঢেলে দিল। জানালার পাল্লা খুলে দিল, আর বাস-ট্রাম-লরি-হকার-বাজারের কলরব নিয়ে কলকাতা ওই ঘরে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

মঞ্জু বলল, জল।

একটা প্লাস্টিকের জার ছিল, ঢাকনায় হলুদের দাগ। হয়তো মাংসের শুকনো ঝোল হাতলের খাঁজে নোংরা।

অনিকেত এক বোতল মিনারেল ওয়াটার কিনে নিয়ে এল বাইরে থেকে।

তারপর ঘরে ঢুকে-পরা কলকাতাকে তাড়াল। জানালা বন্ধ করে দিল।

দেওয়ালে একটা আয়না। আয়নার কোনায় সেঁটে আছে একটা লাল টিপ।

দেওয়ালের রং হলুদ। বিচ্ছিরি রকমের হলুদ। দেওয়ালের গায়ে মনোজ—রেখা ইত্যাদি লেখা। দু-এক জায়গায় মানব-অঙ্গের ডটপেন স্কেচ।

ওসব যাকগে যাক।

অনিকেত বলল, এবার?

এবার যা হতে লাগল, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দেওয়ার দরকার নেই। অনিকেত চেষ্টা করে চলেছে। বেশ কয়েকবার বাহুতে বন্ধন করেছে মঞ্জু। কম্পনও টের পেয়েছে। অনিকেত কানে গরম নিশ্বাস মিশিয়ে জিগ্যেস করেছে, মেন্‌স তো রেগুলার হচ্ছে। তাই না?

মঞ্জু বলে, হুঁ। পরশু শেষ হল।

অনিকেত বোঝে ‘সেফ’। অনিকেত টের পায়, মঞ্জু ঘামছে। ওর ঘাড়, গলা এবং যোনিদেশও। সিক্ততা অনুভব করে। মেলে দেওয়া শরীরটাকে আদর করতে থাকে নানা ভাবে। অনিকেত দ্যাখে, ওর হাতের চামড়া আর ততটা টানটান নেই। হাতের শিরাটা যেন কোনও গ্রাম্যপথ, যেন কোনও শ্মশানের দিকে চলে গিয়েছে—যেন ‘পথের পাঁচালী’-র ‘হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হল’ ধ্বনিত হচ্ছে, সেই শিরাটার ওপর বুলিয়ে দেয়—পুষ্প বনে পুষ্প নাহি রে, আছে অন্তরে। মুখের ছোট্ট মেচেতা-চিহ্নকে মনে হল নীলাঞ্জন ছায়া। ওখানে চুম্বন। এবার উপগত হতে গেল, আর তখনই উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল মঞ্জু।

মঞ্জু নিজের পশ্চাদ্দেশে হাত রেখে মৃদুস্বরে বলল, তা হলে এখানে, এখানে।

চমকে গেল অনিকেত। সে কী, পেছনে কেন? তবে কি মঞ্জুও পায়ুকামী?

অনিকেত বলে—কেন? এখানে কেন?

মঞ্জু বলল, প্লিজ, প্লিজ ডাবু, এখানে।

এখানে পারব না। অনিকেত বলে।

মঞ্জু বলে, পরে সামনে করিস। প্লিজ ডাবু, তোর পায়ে পড়ি।

সো? ইউ আর দ্য কালপ্রিট? তোর জন্যই তোর ছেলে এমন হয়েছে। তোর এক্স- ক্রোমোজমের খেলায়?

অনিকেতের শিথিল হয়ে যায়। বলে, অসম্ভব। ইম্‌পসিবল।

মঞ্জু লেহন ইত্যাদিতে উপযুক্ত করে তোলে ওকে। আবার উপুড় হয়। নিজেই নিতম্বের দু’পাশের পেশি টেনে উন্মুক্ত করার চেষ্টা করে। অনিকেত প্রবিষ্ট হয়।

মঞ্জু বলে, আরও জোরে।

অনিকেত প্রায়-সম্মোহিতের মতো তাই করে।

মঞ্জু কাতরে ওঠে। উঠে বসে। দু’হাতে মুখ চাপা দেয়। বলে, ইশ, কী ভীষণ কষ্ট কাঁদতে থাকে। ওর উন্মুক্ত শরীর কান্নায় কাঁপে। বলে, ছেলেটা কতটা কষ্ট পায় সেটা দেখছিলাম রে ডাবু। ভীষণ কষ্ট। কেন ও এসব করে?

একটা ছবি দেখেছিল অনিকেত। পেন্টিং। কার আঁকা মনে নেই। মা মেরি নিজের হাতে পেরেক ফোটাচ্ছেন। রক্তাক্ত হাত। মেরি-র মুখের অভিব্যক্তিতে কষ্টের সঙ্গে মিশেছিল আরও কিছু। অনেকটা মমতা, কিছুটা ক্ষোভও বোধহয়। দূরে ক্রুশবিদ্ধ যিশু। মা বোঝার চেষ্টা করছেন সন্তানের ক্লেশ। যিশুর শিষ্য জন ছুটে আসছেন মেরি-র দিকে।

অনিকেত প্যান্ট পরে নেয়। জামা গলিয়ে নেয়। মঞ্জু তখনও বিছানায়। উপুড়। কম্পন। ফোঁপাচ্ছে। কান্না-মেশানো গলায় মঞ্জু বলতে লাগল—সেই যে গঙ্গার ধারে…মনে আছে? কৃষ্ণকথা হচ্ছিল…মা যশোদা নিজের পায়ে কাঁটা ফোটাচ্ছিল…কৃষ্ণের খেলতে গিয়ে কাঁটা ফুটেছিল বলে। মা জানার চেষ্টা করছিল গোপালের কষ্ট…। সেটা মনে পড়ে গেল রে…। মুডটা খারাপ করে দিলাম তোর, তাই না?

অনিকেত বলল, বড্ড গুমোট লাগছে। জানালা খুলে দিল।

কলকাতা ঝাঁপিয়ে পড়ল আবার ওই ঘরে। মাইকে কোথাও মান্না দে-র গান—পথের কাঁটায় রক্ত না ঝরালে কী করে তোমায় ভালবাসব…

৩২

মন্টুকে নিয়ে শুক্লা নাকি বেশ আছে। মন্টু বাজার করতে পারে। এখন তো বাজারে যেতে হয় না কলকাতার ‘আবাসন’ এলাকায়, বাজার নিজেই আসে। চার চাকার ভ্যানে তরি-তরকারি দোরগোড়ায় চলে আসে। মন্টু বেছে বেছে বেগুন, ঢ্যাঁড়শ এসব কিনতে পারে। শুক্লা তো উচ্ছ্বসিত।

—জানো, পুঁইশাক নিয়েছিলাম, সঙ্গে তো কুমড়োও নিতে হয়। বললাম, কুমড়োও দাও। মন্টু বলল, ও কুমড়ো নিও না জেঠি। কাঁচা। জানো, ও বলেছে, যে-কুমড়োর চোকলার পরই সবুজ পাড় হয়, সে-কুমড়ো ভাল হয়। জানো, ও কতভাবে হেল্প করে, বিছানার চাদর পেতে দেয়…কাজের লোক কামাই করলে ও ঘর ঝাঁট দিয়ে দেয়। সব পারে…।

অনিকেতও মন্দ নেই এখানে। এটা হল ‘এলআরএস’ মানে ‘লোকাল রেডিও স্টেশন’। কেন্দ্রীয় সম্প্রচার দপ্তরের মাথায় এসেছিল বড়-বড় শহর ছাড়াও, জেলা শহরগুলোতে রেডিও স্টেশন করা উচিত, সেখানে স্থানীয় সংস্কৃতি, স্থানীয় সমস্যা ইত্যাদি প্রতিফলিত হবে। কিছু দিন আগে এই অঞ্চলের গ্রামে-গ্রামে ‘বাহা পরব’ হয়ে গেল। ‘বাহা’ মানে মুন্ডারি ভাষায় ‘‘ফুল’। ‘বাহা পরব’ নিয়ে দিল্লিতে কোনও অনুষ্ঠান হয় না, পাটনাতেও নয়। রাঁচিতে কিছুটা হয়, কিন্তু এখানে পরপর তিনদিন ধুম করে ‘বাহা পরব’-এর গান হল। সাঁওতাল, হো, মুন্ডা—সবাই ‘বাহা পরব’ করে। বসন্তে শুকনো ডালে নবকিশলয়। পলাশ এবং নানারকম ফুলে ভরে থাকে জঙ্গল। রবীন্দ্রনাথ লেখেন—ফাগুনের শুরু হতেই শুকনো পাতা ঝরল যত, তারা আজ কেঁদে শুধায় সেই ডালে ফুল ফুটল কিগো। আর এদিকের কোনও অজানা গ্রাম্যকবি কুরমালি ভাষায় গান বাঁধে —

শুকনা শুকনা ডালে ও দেখ ফুল ফুটে গো
ফুল ফুটেছে নাচের জন্য নাচবি চল
শুকনা শুকনা শরীরেও ফুল ফুটে গো।
যৌবন তোর ঘরে এল নাচবি চল…

রবীন্দ্রনাথ লেখেন, আজি কমল মুকুলদল খুলিল—দুলিল রে দুলিল।

এরা গায়,

এত যে শালফুল ফুটেছে
গাছে গাছে দুলেছে
কেন বা গাছেই ফুল থাকবে
সারা গায়ে তোরা ফুল ফোটা

বাইরে থেকে রেকর্ড করে এনেছে কিছু গান। এখন গরম পড়েছে। এপ্রিল মাস চলছে। বুদ্ধপূর্ণিমা-য় শিকার উৎসব। পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ে এই উৎসব খুব ধুম করেই হয়। দূর- দূর থেকে সাঁওতাল পুরুষ আসে। রাত থেকেই জঙ্গলে ঢুকে যায়। সারা রাত ধরে শিকার চলে। তারপর পাহাড়ে উঠে যা শিকার পাওয়া গেল, সেটা রান্না হয়। চাল-ডালও সেদ্ধ হয়। সঙ্গে থাকে মহুয়া কিংবা হাঁড়িয়া। রাতে চলে নাচ-গান। সেইসব নাচ-গানের মাধ্যমে নাকি যৌবন-দীক্ষা হয়। দু-একটা লোকসংস্কৃতি-র প্রবন্ধে এরকমটাই পড়া গেছে।

এখানেও একটা পাহাড়ে ওইদিনে এই ধরনের উৎসব হয়। অনিকেত ওটা ‘মিস’ করতে চায় না।

যে-পাহাড়ে এই উৎসব-টা হয়, সেটার নাম ‘কাঁদরবুরু’। যে-ম্যাপটা অফিসে আছে, সেটা দেখলে দেখা যায়, এই পাহাড়টার নাম লেখা আছে ‘কানাডা হিল্‌স’।– CANADA HILLS। এই ম্যাপটার কপি আনানো হয়েছিল ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট-এর অফিস থেকে। ব্রিটিশ আমলের তৈরি ম্যাপ। কী আশ্চর্য ব্যাপার, একটা পাহাড়কে সবাই কেমন কেড়ে নিতে চেয়েছে। ‘কাঁদর’ মুন্ডারি ভাষায় ভাম জাতীয় একটা প্রাণী। পাহাড়টাকে দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন পাহাড়ের একটা মাথা এবং একটা লেজ আছে। হতেও পারে, ওই পাহাড়ে এরকম জন্তু প্রচুর ছিল। তবে এরকম হয় না যে, একই এলাকার অমুক পাহাড়ে হাতি থাকে, তমুক পাহাড়ে শেয়াল থাকে। এই পাহাড়ে খরগোশ, ওই পাহাড়ে শজারু। তবে এসব অঞ্চলে অনেক পাহাড়ই জীবজন্তুর নামে হয়। সাহেবরা ম্যাপ তৈরি করেছিলেন। ‘কাঁদরবুরু’-কে বানিয়ে দিলেন ‘কানাডা হিল্স’। ‘কাঁদর’ লিখতে গেলে CANDAR লিখতে হয়। ওঁদের মনে হয়েছিল তার চেয়ে কানাডা ভাল। না কি ছাপার ভুল? কিন্তু ভদ্রলোকরা ওই পাহাড়টাকে বলে ‘কন্দর্প পাহাড়’। কাঁদর-কে ‘কন্দর্প’ করে নিয়েছে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র। এদিকে বেশ কিছু বাংলা ভাষাভাষী মাহাতো সম্প্রদায়ের মানুষ আছে। বাংলার ডায়লেক্ট-কে ‘কুর্মালি’ বলতে চান অনেকে। এই অফিসেও একজন মাহাতো আছে। সেও ওটাকে ‘কন্দর্প পাহাড়’-ই বলে। গাড়ি ‘নিয়ে বাইরে কিছু রেকর্ডিং করতে গিয়ে একবার সঙ্গে নিয়েছিল পায়েস মাহাতোকে। ও-ই খবরটা প্রথমে দেয়। উটা ‘কন্দর্প পাহাড়’ স্যর, বৈশাখ পূর্ণিমা লাগলে উখানে দমে উঝালপাঝাল হয়…।

পাহাড়টা সরাইকেল্লা-র দিকে। বৈশাখের আকাশে চাঁদটা বাড়তে থাকলেই নাকি ছেলে- ছোকরাদের মন হাঁকুপাঁকু করতে থাকে কবে পূর্ণিমা আসবে। ছোট-ছোট ছেলে তির-ধনুক নিয়ে খেলতে নামে। কিন্তু ওরা শিকার উৎসবে যাওয়ার অনুমতি পায় না। বছর বারো বয়স হতে হবে। ওসব ছেলে-ছোকরার তো বার্থ সার্টিফিকেট থাকে না, বয়সটাও ঠিকঠাক জানা থাকে না। সুতরাং নিয়ম হল, গোঁফের রেখা না-উঠলে শিকার উৎসবে যাওয়া যাবে না। ওই উৎসবে মেয়েদের কোনও অধিকার নেই। অধিকার নেই তার কারণ, ছেলেরা সবাই নেশা- টেশা করে ঠিক থাকে না। ওই জন্যই গ্রামসমাজ বিধান দিয়েছিল পাহাড়ের গ্রামের মেয়েরা সেদিন বেরবে না। ঘরের বাইরের উঠানেও নয়।

ভোরবেলা রওনা হয়ে গিয়েছিল অনিকেত। সঙ্গে নিয়েছিল মাইকেল পুরতি-কে। চাইবাসা খ্রিস্টান মিশনারি স্কুলের শিক্ষক। ওই স্কুলেই একসময় বিরসা মুন্ডা কিছুদিন পড়েছিলেন। বছর তিরিশের মতো বয়স মাইকেল পুরতি-র। অনিকেতের চেয়ে অনেক ছোট। চাইবাসা বেতার কেন্দ্রের হো ভাষার ক্যাজুয়াল অ্যানাউন্সার। ও হিন্দিতে বলেছিল, ওখানে গেলে একটা অভিজ্ঞতা হবে। অনিকেত বলেছিল, তুমিও চলো। ও বলেছিল, আমি গেলে আপনার কাছে অস্বস্তিতে পড়ব। খুব খিস্তি-খেউড় হয়, অনেক নোংরা ব্যাপার স্যর…।

অনিকেত বলেছিল—না ভাই, কোনও অস্বস্তির ব্যাপার নেই। তুমিও শাদিসুদা আদমি, আমিও তাই। কোনও অসুবিধে নেই।

মাইকেল হিন্দি, হো, মুন্ডারি ভাষা জানে। হো ওর মাতৃভাষা। মুন্ডারি ভাষার সঙ্গে হো ভাষার খুব একটা তফাত নেই। মাইকেল আবার সাঁওতালিও কিছু-কিছু বোঝে। কিন্তু অনিকেত লক্ষ্য করল, ও আদিবাসীদের এই উৎসবটাকে একটু অবজ্ঞাই করল। খ্রিস্টান হয়েছে বলে? মিশনারিরা কিছু সাঁওতালকে প্রভাবিত করতে পেরেছিল, কিছুটা মুন্ডাদেরকেও। হো-দের মধ্যে এই প্রভাব খুবই কম। অল্প কিছু খ্রিস্টান-হো-দের মধ্যে থেকেই মাইকেল এসেছে। ওর পুরো নাম মাইকেল কিনুয়া পুরতি। এম কে পুরতি। ‘এম কে পি’নামেই পরিচিত। অনিকেত জিগ্যেস করেছিল, তুমি কখনও ওই উৎসবে যাওনি? ও বলেছিল, দশ-বারো বছর আগে গিয়েছিল। কিন্তু ও শিকার-টিকার করে না। আর একবার রগড় দেখতে গিয়েছিল। অনিকেত বলল, এবারও রগড় দেখতে চলো।

পাহাড়ে গাড়ি ওঠে না। নীচে রেখে হেঁটে উঠতে লাগল ওরা। গরম, কিন্তু বৃক্ষছায়ার ঠান্ডা প্রলেপ। কত জংলা ফুল। মাইকেল বলছিল, এই হলুদ ফুলগুলোর নাম গলগলি। এগুলো ঢেঁশ। পিয়ালের পাকা ফল খাচ্ছে পাখি। কেঁদ ফলও পড়ে আছে ভুঁয়ে। মহুল ফলও পড়ে আছে। সুগন্ধি আতপের মতো আশ্চর্য গন্ধ। গাছে-গাছে এক ধরনের লম্বা ডাঁটা ঝুলছে। বাঁদরলাঠি তো চেনা। এছাড়াও সজনের চেয়ে অনেক মোটা, কিন্তু সজনের ডাঁটার চেয়ে একটু ছোট, মাথার দিকটা ফোলা এবং লালচে। কী ফল জিগ্যেস করাতে দু’বার এড়িয়ে গেল মাইকেল। তৃতীয়বারে জবাব দিল। বলল, পুংগা—বলেই জিভ কাটল।

পাহাড়ের খাঁজে গ্রামও আছে। গ্রাম যেন শুনশান। কোনও মহিলাকে দেখা গেল না, এমনকী উঠোনে মেয়েদের কোনও পোশাকও শুকোতে দেওয়া নেই। ধামসা-র শব্দ শোনা যাচ্ছে ধিদিম ধিম। মাদলের টুংগুল টুংগুল।

মাইকেল বলল, পাহাড়ের ওপর অনেকটা সমান জায়গা। মাঠের মতো। ওখানে এখন উৎসব চলছে। গত রাতে পূর্ণিমা গিয়েছে। পূর্ণিমার আলোয় ওরা শিকার করেছে। আজকাল টর্চও নেয়। তারপর পাহাড়ের ওপরে উঠে খাওয়াদাওয়া হবে।

—কী শিকার পাওয়া যায়?

—উঠলেই দেখতে পাবেন। তেমন কিছুই পাওয়া যায় না। জঙ্গলে জানোয়ার নেই। ওই দু-একটা বেজি, ভাম। যদি বুনো শুয়োর জুটল তো তকদির ভাল বুঝতে হবে।

ধোঁয়ার গন্ধ পাচ্ছিল। বাজনার শব্দও বাড়ল। একটা ঝোরা আছে। ওখান থেকে প্লাস্টিকের বালতিতে জল নিয়ে যাচ্ছে। দু’আঁজলা পেতে জল খেল ওরা। ঠান্ডা। ব্যাগের মিনারেল ওয়াটারের বোতলটা শেষ হয়ে গিয়েছিল। ভরে নিল ফের।

পাহাড়ের ওপর বেশ চাতালের মতো। বড়-বড় কিছু গাছও আছে। গাছের তলায় গোল হয়ে বসেছে মানুষ। নানা আকৃতির পাথর ছড়ানো। পাথরের ওপরও বসা যায়। হাঁড়িয়া নেই। কারণ হাঁড়িয়া মেয়েরাই বানায়, এবং বিক্রিও করে মেয়েরা। এখানে মেয়েদের যোগদান নিষিদ্ধ। মহুল পাওয়া যাচ্ছে প্রচুর। মহুল মানে মহুয়া।

সাঁওতাল, মুন্ডা, হো, খেড়িয়া, কুর্মি… এক মিলনমেলা। এরা আলাদা ঠেক-এ বসলেও নিজেদের মধ্যে হাসি ও আনন্দ-বিনিময় হচ্ছে। পাগলামি বিনিময়ও। বলা যায়, অশ্লীলতা বিনিময়ও। এই ঠেক থেকে কেউ একটা হাতের আঙুল গোল করে সেই বৃত্তের মধ্যে অন্য হাতের আঙুলটা নাড়িয়ে দিল, অন্য ঠেক থেকেও অন্যরকম প্রত্যুত্তর এল শারীরিক মুদ্রায়। শিকার বলতে কয়েকটা রক্তফেনা মাখা ধেড়ে ইঁদুর হয়ে আছে চিৎ। কেউ পেয়েছে সাপ, কোথাও শজারুও দেখা গেল কাত হয়ে পড়ে আছে রক্তমাখা মুখে। খরগোশ কিছু-কিছু। মুরগি বিক্রি হচ্ছে। পয়সা দিয়ে কেনা মুরগি ছেড়ে দেওয়া হল, তারপর ওকে তির মারা হল। শিকার। এক জায়গায় দেখা গেল, গাছের ডালে দড়ি ঝুলিয়ে বেশ কয়েকটা কন্ডোম ফুলিয়ে বেলুন বানিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। কাঠ জ্বালিয়ে ভাত রান্না হচ্ছে, কোথাও খিচুড়ি। শিকারের মাংসও রান্না হবে।

মহুল নিয়ে আসা হয়েছে, বোতলে। কাচের বোতলও আছে, পলিপেট-এর বোতলও, যে- বোতলে ভদ্রলোকরা মিনারেল ওয়াটার খায়। বহু ব্যবহারে বোতলগুলোর স্বচ্ছতা কমে এসেছে। ওরা মহুল বিক্রি করছে, কিন্তু বোতল দিতে চাইছে না। বোতলের বড় অভাব। ওরা তো হাঁড়িয়া খায় টিনের বাটিতে কিংবা শালপাতার টুঙিতে। ওরা মহুল নিয়ে যাচ্ছিল জঙ্গল থেকে জোগাড় করা বেলের খোলায় কিংবা পাতার ঠোঙায়। কেউ বা রান্নার জন্য নিয়ে আসা হাঁড়িতে। হাতা করে মুখে ঢালছিল।

অনিকেতের কাছে মিনারেল ওয়াটারের বোতল ছিল। মাইকেলকে দিল। বলল, ভরে নাও মাইকেল বলল—এসব খাবেন স্যর?

অনিকেত বলল, সবাই তো খাচ্ছে। তুমি খাও না এসব?

মাইকেল বলল—খাই না বললে ভুল হবে। ইংলিশটাই খাই। তবে এরকম ফেস্টিভ মুডে খাওয়া যায়।

খেল।

অনিকেত আজই প্রথম মহুয়া পান করল—এমন নয়। এখানে এসে দু-একবার খেয়েছে। ভালই বেশ। গন্ধটা দারুণ।

মাদল আর ধামসার শব্দে শরীর নেচে ওঠে। ওর ভদ্রলোক-সত্তা নাচতে নিষেধ করে।

ঘুরে বেড়ায় অনিকেত ও মাইকেল। বৈশাখের রোদ্দুর। যেখানে গাছের ছায়া, সেখানেই মানুষ। একটা গাছের ছায়ায় একটা লম্বা পাথরে বসে আছে একজন বয়স্ক মানুষ। মুখে দাড়ি। চুলে জটা। ওকে ঘিরে কিছু মানুষ। বয়স্ক মানুষটা কিছু বলছে। মাইকেল বলল, লোকটাকে দেখে মনে হচ্ছে জানগুরু। দেওড়া ভি হো সাকতা হ্যায়।

দেওড়া আর জানগুরু-র মধ্যে তফাত কী? অনিকেত জিগ্যেস করে।

মাইকেল বলে—সব সেম ক্যাটিগরিকা হ্যায়।

মাইকেল বোঝায়—জান, ভকত, মাতি, দেওড়া—সবাই মন্ত্রটন্ত্র জানে, গুপ্তবিদ্যা জানে বলে বিশ্বাস করে এই অঞ্চলের মানুষ।

ভিড়ের মধ্যে ঢোকে অনিকেত। বাতাসে মদির গন্ধ। সবাই খেয়ে আছে।

মাইকেল বলে—ওই যে লম্বা পাথরটা, ওটাকে আমরা বলি শ্মশানদিরি। মৃত্যুর পর, কবরের ওপর একটা পাথর চাপা দেওয়া হয়। এই পাহাড়ের ওপর নিশ্চয়ই কোনও গাঁ-মাঝি’র কবর হয়েছিল। গাঁ-মাঝিই হচ্ছে গ্রামের প্রধান। নিচে কয়েকটা গ্রাম দেখলাম, সেরকম কোনও গ্রামেরই হবে হয়তো। আমাদের বিশ্বাস, শ্মশানদিরি-র ওপর বসে কেউ মিথ্যা কথা বলে না।

ওই লোকটা শ্মশানদিরি-র ওপরই বসে আছে। কিছু বলছে, সবাই শুনছে।

মাইকেল অনিকেতকে অনুবাদ করে হিন্দিতে বলে—যে বসে আছে, সে মুন্ডা নয়, সাঁওতাল। ওদের লোককথা বলছে। বলছে—অনেক বছর আগে স্ত্রী-রা পুরুষদের খুব অত্যাচার করত। মেয়েছেলেরা খুব কামুক ছিল। দিন রাত রমণ চাইত…। মাইকেল অবশ্য ওই বাক্যটা ইংরেজিতে বলেছিল—দে অলওয়েজ প্রেশার্ড ফর ফাকিং স্যর…। ইসকে লিয়ে আদমি লোগ বহুত কমজোরি হো যাতা থা। এছাড়াও আরও অত্যাচার করত। দুধের ছানা করে নিজেরা খেয়ে নিত, পুরুষদের দিত ছানার জল। মুরগির ঠ্যাং আর বুক নিজেরা খেত, পুরুষদের দিত কাঁকাল। তখন সাঁওতাল পুরুষরা দল বেঁধে মারাংবুরু-র কাছে গেল। বলল, কিছু একটা বিহিত করুন। মারাংবুরু বলল, ঠিক আছে ওদের ‘কাম’ কমিয়ে দেব। পুরুষরা বলল, শুধু কাম’ কমালেই হবে না, ওদের অত্যাচার থেকে বাঁচান। মারাংবুরু বললেন, আজ হবে না, আজ অন্য কাজে ব্যস্ত আছি, সামনের পূর্ণিমায় এসো, ‘তোমাদের ত্রাণমন্ত্র দিয়ে দেব।’ কিন্তু মেয়েছেলেগুলো জানতে পেরেছিল যে, ব্যাটাছেলেরা মারাংবুরুর কাছে যাতায়াত করছে। একটা ‘বহুত সেক্সওয়ালি উওমেন’ ওর নিজের কিছুটা সেক্স আর আত্মার কিছুটা অংশ কয়েকটা ব্যাটাছেলের মধ্যে চালান করে দিয়েছিল। তখন কয়েকটা ব্যাটাছেলের পেটের তলায় থলিয়া- ডান্ডা ঝুললেও ভিতরে-ভিতরে ওদের গড়বড় হয়ে গেল। ওরা গুপ্তচর বনে গেল। ওরা মেয়েদের খবর দিয়েছিল যে, পূর্ণিমার দিন মরদ-রা যাবে মারাংবুরু-র কাছে। মেয়েরা তখন করল কী, পূর্ণিমার আগের দিন থেকে ছেলেদের খুব করে হাঁড়িয়া খাওয়াল। ভাল-ভাল চাখনা খাওয়াল। খুব করে চুষে দিল, আর হাঁড়ি-ভরা হাঁড়িয়া আর কুঁকড়ার কালিজা রেখে দিল। মরদগুলো সারাদিন খুব করে খানাপিনা করে পুরা বেহুঁশ হয়ে গেল, আর জেনানা-রা করল কী, পুরুষের পিরান গায়ে চাপাল, ছাগলের দাড়ি কেটে গোঁফ তৈরি করল। তারপর মারাংবুরু- র কাছে গেল। মারাংবুরু-ও ওদের মরদ মনে করে ‘ত্রাণমন্ত্র’ দিয়ে দিলেন।

অনিকেত জিগ্যেস করে, মারাংবুরু-ও কি খেয়েছিল?

মাইকেল বলে, প্রব্যালি। ওরকমই তো হিন্ট পাওয়া যাচ্ছে।

শ্মশানদিরি-র প্রাজ্ঞ মানুষটা ইতিবৃত্ত বলতে থাকে…। মেয়েরা ওই মন্ত্রটা পেয়ে গেল, তারপর ওই মন্ত্রটাই পুরুষদের ওপর প্রয়োগ করতে থাকে। পুরুষরা আরও অত্যাচারিত হতে থাকে।

মরদগুলোর মনে পড়ে—মারাংবুরুর কাছে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু যায়নি। এরপর ওরা ভুল বুঝতে পেরে মারাংবুরুর কাছে যায়। মারাংবুরু ভীষণ আশ্চর্য হন। বলেন, তুমকো তো ত্রাণমন্ত্র দিয়া ঢুকা। মরদ-রা বলে, সরি, সেদিন আসতে পারিনি, বহুত হাঁড়িয়া খেয়ে ফেলেছিলাম, অন্যায় হয়ে গিয়েছে…। মারাংবুরু তখন বুঝতে পারেন নারীরা সব চাতুরি করে গিয়েছে। তখন তিনি নারীসমাজের ওপর রেগে যান। প্রতিবিধান হিসেবে ডাকিনীদের বিরুদ্ধে ‘জানবিদ্যা’ দান করে। যে-ক’জন মরদ ‘জানবিদ্যা’ জেনেছিল, ওরাই শিষ্যদের শিখিয়ে দেয়। এবার বলব, ডাকিনীদের ‘কাম’ কেমন করে দমাতে হয়।

প্রাজ্ঞ মানুষ বলতে থাকেন। ছড়া কেটে। মাইকেল বলে, চলুন স্যর।।

খুব খিস্তি হচ্ছে এখন। পরিবেশটা আর একটু উত্তাল হয়েছে। নাচটাচ চলছে। অনেকেই দড়ি দিয়ে কোমরে বেঁধে নিয়েছে বাঁদরলাঠি কিংবা পুংগা।

পুংগা ঝুলছে দুই পায়ের মাঝখানে। আট-দশ ইঞ্চি লম্বা। বাজনার তালে-তালে হাতে ধরে নাচাচ্ছে ওই লাঠি। গানও চলছে কোথাও-কোথাও। কোনও-কোনও রসিকপ্রবর দু-চার কলি ছড়া কাটছে। বুড়ো-বাচ্চা সবাই হাসছে, হুলাহুলি দিচ্ছে।

কী বলছে ওরা? অনিকেত জিগ্যেস করে।

মাইকেল মহুয়া-ভরা বিলারি বোতলে লম্বা চুমুক দিয়ে বলে, বোলতা হ্যায়—যব অন্দর ঘুসেগা তো সমঝমে আয়্গা, ক্যায়া চিজ হ্যায় ইয়ে।

মাইকেলও কাঁধ নাচায়।

পায়ের স্টেপিং পাল্টে যায় মাইকেলের। বাকি মহুয়াটুকু গলায় ঢেলে দেয় অনিকেত। মাইকেলের বলা বাক্যটার বঙ্গানুবাদ করে—’এ যে বড় দণ্ড জাদু এ যে বড় দণ্ড।’ আর মেলাতে পারে না। মেলাতে গেলেই অণ্ড এসে যাচ্ছে। ‘কোথায় যেন লুকিয়ে আছে ছোট্ট দু’টো অণ্ড’…এরকমই ভাবে। বোঝে, নেশা হয়ে গিয়েছে।

একটা গাছতলায় দেখল—একজন কেউ মেয়ে সেজেছে। জামার ভিতরে বোঁটাসমেত বুনোফল, মাথায় গামছার ঘোমটা। সে বাঁদরলাঠিটা চেপে ধরছে, কোথাও কেউ-বা হাতে লাঠিটা উঁচিয়ে ধরে তাড়া করছে কোনও নারী-সং-সাজা পুরুষকে। এবং সেই সং-সাজা পুরুষ সেটা উপভোগ করছে।

মাইকেল বলল, এদিকে ওড়িশার শূন্যবাদী ভীম ভই-এর একটা ইনফ্লুয়েন্স আছে। ওঁর একটা গানে আছে, আমি যখন পুরুষ তো পুরুষ আছি, যখন নারী তো নারী ভি আছি। দুই হলেও আমি এক। ওড়িয়ায় গাওয়া হয়।

অনিকেত বলে, বৈষ্ণব পদাবলিতেও আছে শ্রীচৈতন্য বলছেন আমি ক্ষণে রাধা, ক্ষণে নারী।

খিদে পাচ্ছে। কোথাও ভাব জমিয়ে বসে গেলেই হল। মাইকেল তো আছেই। আবার মহুয়ার সন্ধানে যায় অনিকেত। মাত্র দেড় হাজার ফিট ওপরে একটা অন্য রাজ্যে অবস্থান করছে ওরা।

আর একটা জায়গায় বসেছে আর একজন। চোখ লাল-লাল। বাবরি চুল। ও বোধহয় কথকতা ধরনের কিছু করছে। গলায় মালা। কী ফুলের মালা, বোঝা যাচ্ছে না। ও কুর্মি উপভাষায় কথা বলছে।

.

….লকটার ধানগোলা ছিল, ঝিলিক-মারা বউ ছিল, কিন্তুক কুন ছেল্যা-ছুলু লাই। এক বছর চাষের গতিক দমে খারাপ হঁঞে গেল। সে বচ্ছর আষাঢ় শরাবন মাসে টুকুন জল হল নাই। মাটি শুখা হঞে গেল, ঘাসটুকু লাই। ঘরের গরুগুলা কুছু না খিতে পেয়ে ভুখা মরে গেল। উয়ার তবু গোলায় ধান ছিল, কিন্তুক গরিব লকরা কী খাবে? একদিন গোলা ভেঙে সব ধান লিয়ে গেল। লকটার নাম ছিল মহীরাম। মহীরাম একদিন ঘুরতে-ঘুরতে জঙ্গলে গিয়ে সূর্য দ্যাক্তাকে খুব বাখান করল। এক্কেবারে খ্যাপা হয়ে মুখখিস্তি করল দ্যাত্তার বাপ-মা তুলল। এত বাখান দ্যাক্তা সইবে কেনে? সে রেগে গিয়ে মহীরামকে শাপ দিয়ে বলেন, ধুর শালা — তুই পাখর হয়ে যা। মহীরাম পাখর হয়ে জঙ্গলে পড়ে রইল। মহীরামের বউ-এর নাম রূপামতী। রূপামতী বড় সতী। ক’টা কেঁদফল আর শুখা মহুল সাজিয়ে বসে আছে কখন স্বামী আসবে, টুকু খাবে। স্বামী খেলে রূপামতী খাবে। কিন্তু স্বামী আর ফিরে না। সারা দিন বিতে গেল। রাতও বিতে গেল। পরদিন স্বামী ছুঁড়তে এপটে-সিপটে বুলতে লাগল। বুলতে বুলতে জঙ্গলে। ওই জঙ্গলে রূপামতীকে দেখে, একজন ব্যাটাছেলের দমে কাম উগলাল। সে রূপামতীর সামনে এসে বলে, হে প্রিয়ে, মেরা প্যার কি রানি, মাই ডাল্লিং, আসো ডান্স করি।

সমবেত লোকজন হেসে উঠল। লোকটা এবার ওই কাম-উগলানো লোকটার অভিনয় করতে লাগল।

দড়ি দিয়ে বাঁদরলাঠি বাঁধল কোমরে। বলতে লাগল, লকটার পুংগাটা এই সাইজের হঁঞে গেল।

বাঁদরলাঠিটাকে সোজা করে ধরল। রূপামতী তখন বলল—তুই দূর যা পাপিষ্ঠ। আমার ধারে আসবি না। সেই লকটা বলল, এমন কথা বলে না সুন্দরী, আসো আমার কোলে বস পিয়ার করি। আসো আমার বুকে আসো। মুখে আসো। আমার ইটার ওপর চেপে বসো। লকটার জিভ বের হঞে গিয়েছে। সে দু’হাত দিয়ে পেইচ্যে ধরতে আসে রূপামতীকে। সে মেঁঞা তখন সূর্যদ্যাকে ডাকে। বলে, হে দ্যাব্‌ত্তা, আমি সতী নারী। এই বেথুয়া লকটা আমার সতীত্ব কাড়ছে। হে দ্যাক্তা, কোথায় তোমার তেজ? তুমি পুড়িয়ে দাও।

রূপা তখন ছুটে পালাতে যায়। সামনে ওই পাথরটা। যে-পাথরটা আসলে উয়ার স্বামী বটে। পাথরটাকে দুই হাত দিয়ে পেইচ্যে ধরে। আর ওই লকটা উয়াকে ছাড়াতে পারে না। সে পাথর পেইচ্যে থাকে। লকটা তখন মেঁঞাটার পিছনে পুংগা ঘষে। লকটা পুংগা ঘষছে, আর রূপামতী দ্যাক্তা ডাকছে। দ্যাতা কথা শুনল। পুংগা-য় বান মেরে দিল, পুংগা খসে গেল। লকটা পাইল্যে গেল।

—ইবার তুমাদের শুধাই, রূপামতী সতী রইল না কি সতীত্ব লষ্ট হল?

কথকমশাই নিজেই জবাব দিল—সতী রূপামতী সতী-ই রইল। কারণ? কারণ টুনটুনির বাসায় সাপ ঢুকতেই পারল না। সতী রূপামতী পাথর জড়িয়ে পড়েছিল। টুনটুনির বাসা তো লেপ্টেছিল পাথরে।

আহা রে, কত অনুরাগে, কত অনুভবে স্ত্রী-অঙ্গের কতরকম নাম দিয়েছে পুরুষ।

কথক বলে, হাগার গর্ত মিছা। ওটায় ইঁদুর-বেজি-সাপ মুখ গলালে কিছু যায় আসে না।

সতীত্বের এক নব ব্যাখ্যা শুনল ওই গ্রাম্য-কথকের কাছে। এ যেন আইপিসি ৩৭৭ ধারারই। আইন অনুযায়ী, স্ত্রী-যোনিতে পুরুষ জননা! প্রবিষ্ট না-হলে ধর্ষণ হয় না।

সতী রূপামতীও সতী থেকে গেলেন।

কথকমশাইয়ের কথা শেষ হয়নি। উনি বলতে থাকল—ওই মেঁঞাটা সারা রাত আর বের হল না। সারারাত পার্থর আঁকড়ে পড়ে থাকল। ওই পাথরের গা থেকে একটা বাস বেরুতে থাকল। গন্ধ, মেঁঞাটার মনে হয়, ওর স্বামীর গায়ের গন্ধ পাচ্ছে। মেঁঞাটা কেমন যেন ধুকপুকির শব্দও শোনে। আস্তে-আস্তে ওই পাথরটা প্রাণ ফিরে পায়। মানুষ হয়ে উঠে দাঁড়ায় মহীরাম। চাঁদের আলোয় ওরা খুব সঙ্গম করে। আর তখনই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে।

—উঃ দ্যাখো মাইকেল, ‘ফার্টিলিটি কাল্ট’ কাকে বলে।

তারপর সারারাত বৃষ্টি চলল। পরদিনও। ফসল ফলল মাটিতে। আর রূপমতীরও ছেল্যা হল।

বলো পম পমাপম।

লোকজন নাচতে লাগল—পম পমাপমচমচমাচম। চদরবদর চুম। পুম পুমাপুম পুম।

পশ্চাৎ-প্রহারে সতীত্ব যায় না। এটাই কি এই লোককাহিনির নীতিবাক্য?

মঞ্জু এই বিশ্বাসেও উপুড় হয়ে গিয়েছিল না কি সেই হোটেল-বিছানায়?

প্রশ্নটা হঠাৎ চক্কর খেল মহুয়া-জমাট অনিকেতের মাথায়।

ঘড়িতে দেখল বেলা আড়াইটে বাজে। মাইকেল বলল, আরও ঘণ্টা তিনেক চলবে এই হইহই। ঢোল-ধামসা-কাঁসর আর গালাগালিতে গলাগলি করে আছে মুন্ডা-হো-সাঁওতালি- কুর্মিরা। উত্তর-পূর্বের রাজ্যে নাগা-মিজো-কুকিদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি আছে। এখানে নেই।

কথক-ঠাকুরের গল্পটার টুকরো ঘটনাগুলো ঢোল-কাঁসরের শব্দের সঙ্গে নাচছে। পাথরের মধ্যে ধুকপুকি শুনল মেয়েটা। বলে কী? এ তো কবিতা মাইরি! ওর পাথর স্বামীকে দীর্ঘ আলিঙ্গন করেছিল বলে স্বামীর পাথর শরীরে প্রাণ এল।

তারপর ওরা মিলিত হল, পৃথিবী রসবতী হল, ফলবতী হল।

কামাখ্যাতেও তো পাথর-যোনিতে ঋতুরক্ত আসে। মানুষ কী সুন্দর ভাবতে পারে। দু’হাতে জড়িয়ে ধরল মাইকেল-কে। মাইকেল বলল, ক্যা হুয়া সার?

—কুছ নেহি।

একটা পাথরে বসল, অনিকেত।

অনিকেত কথক-ঠাকুরের মতোই বলতে লাগল, দুনিয়া বড়া আজিব হ্যায় মাইকেল, সুন্দর ভি হ্যায়…।

আলিঙ্গন প্রাণ দিতে পারে। আলিঙ্গন মানে তো ভালবাসা মাইকেল…। ডাক্তারের ভালবাসা রোগীকে প্রাণ দিতে পারে, বিডিও-র ভালবাসা কয়েকটা গ্রামকে প্রাণ দিতে পারে, আমাদের ভালবাসাও এই রু রেডিও স্টেশন-টাকে প্রাণ দিতে পারে…। বহুত বড়া-বড়া বাত বোলতা না? তব ছোড়।

অনিকেত বুঝতেই পাচ্ছে নেশা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু বলতে থাকে। কথা বলতে ভাল লাগছে।

বলছে—মাইকেল, দ্যাখো মাইকেল, মানুষ পশ্চাৎদেশকে গুরুত্ব দেয় না। মেয়েটার কেমন সতীত্ব রয়ে গেল দেখলে তো? অনেক গান্ডুলোক আছে। যারা প্রস-কোয়ার্টারে গিয়ে সামনে করে না, পেছনে। চরিত্র বাঁচায়। মাইকেল মধুসুদন…।

মাইকেল বলে, উঠিয়ে স্যর। আউর মাত পিজিয়ে। আইয়ে।

বলে—আমরা কোথাও কিছু খাবার জোগাড় করতে পারি কি না দেখি…

মাইকেল আর অনিকেত হাঁটতে থাকে উৎসবের পাহাড়ে। কাঁদুর পাহাড়ে। ভদ্রলোকেরা যাকে বলে ‘কন্দর্প পাহাড়’। কামদেবতার নাম কন্দর্প। তাঁর স্ত্রী রতি।

ওড়িয়া কথাও শুনতে পাচ্ছে।

ওড়িয়া ভাষাভাষী মানুষও বেশ কিছু আছে।

একটা উচ্চস্বর—আফুটি বিয়া…

কোরাস—যতনে ঠিয়া

উচ্চস্বর—ফুটিলা বিয়া…

কোরাস—নিতি ঘিয়া।

এর মানে নিজেই বুঝতে পারে অনিকেত। ‘বিয়া’ মানে স্ত্রী-যোনি। ‘পদ্মানদীর মাঝি’ চলচ্চিত্রে একটা গানে ‘বিয়া’ শব্দটা বারবার আছে। জাতীয় চ্যানেলে এই পুরস্কার পাওয়া- ছবিটা দেখানো হচ্ছিল। অনিকেত তখন কটকের একটা হোটেলে। তখনও কেব্‌ল আসেনি। দূরদর্শন-ই দেখতে হত। টিভি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। হোটেল ম্যানেজারই সব টিভি স্তব্ধ করে দিয়েছিল এই অশ্লীল গানের জন্য।

এই খর-রোদে যৌন-শিক্ষা চলছে। অপরিণত যোনি যত্নে রেখো। পরিণত যোনি সংগম যোগ্য।

আরও সামনে যায়। এক জায়গায় কিছু বড়-বড় পাথর পড়ে আছে। সে-পাথরে মুখ ঢেকে যায়। সেখানে পাথরে শেকড় বসানো-গাছ। ওখানে কয়েকজন শাড়ি-পরা মানুষ।

অনিকেত বলে, ওখানে মেয়েমানুষ? তোমরা যে বলো এখানে মহিলারা আসতে পারে না…।

মাইকেল বলে—আমিও তো তাই জানতাম…।

কাছে যায়। অনিকেত বোঝে ওরা মহিলা নয়। মহিলা-পোশাকে কিছু পুরুষ।

মাইকেল বলে, লন্ডা স্যর। ওরা লন্ডা।

ওরা হাঁড়িয়া বিক্রি করছে।

কিছু পুরুষমানুষ ওখানে। হাতে শালপাতার ঠোঙা। হাঁড়িয়া পান করছে।

মাইকেল বলে—হাঁড়িয়া ছাড়া আমাদের কোনও উৎসব হয় না স্যর। যে কোনও অনুষ্ঠানে প্রধান উপকরণ হাঁড়িয়া। হাঁড়িয়াটা মেয়েরাই বানাতে পারে। ওরাই পরিবেশন করে। আবার এখানে নিয়ম অনুযায়ী, মেয়েদের প্রবেশ নিষেধ। এজন্যই এই আইন বাঁচানো। মেয়েলি-পুরুষরা শাড়ি পরে হাঁড়িয়া বিক্রি করছে। লিঙ্গচিহ্নে এরা পুরুষ। সুতরাং আইন বেঁচে গেল। আবার এরা মেয়েও বটে। তাই হাঁড়িয়া বিলি করতে পারছে। সব জায়গায় আইনের ফাঁক আছে স্যর। স্যর লিঙ্গটা বড় গড়বড়িয়া কেস। হিন্দিতে কম নম্বর পেতাম লিঙ্গটা ঠিক হত না বলে। লিঙ্গর সঙ্গে সঙ্গে ভার্ব, অ্যাডজেটিভ সব পাল্টে যায় স্যর। একটা জোক বলছি স্যর। এখন তো আমরা মাইডিয়ার হয়ে গিয়েছে। বলতেই পারি।

একজন টিচারকে কনফিউজ্‌ড স্টুডেন্ট জিগ্যেস করেছিল, কাঁঠাল কী লিঙ্গ স্যর? স্যর বললেন, ওটা পুংলিঙ্গ হবে। কারণ কাঁঠালের বিচি আছে।

—তা হলে হোমগার্ড?

—হোমগার্ডও পুংলিঙ্গ। কারণ হোমগার্ডের ডান্ডা আছে।

—তা হলে আইন কী লিঙ্গ?

—ওটা নির্ঘাত স্ত্রী-লিঙ্গ। কারণ আইনের ফাঁক আছে।

মাইকেল হাঁড়িয়া খেতে গেল।

৩৩

‘এই জানালার ধারে বসে আছি, করতলে রেখে মাথা’–এই গানটার কথা মনে হল শুক্লার। ও সত্যিই ‘জানালার ধারে’ বসে আছে। আকাশে বর্ষার মেঘ। এক পশলা হয়ে গিয়েছে আজ সকালেই। আষাঢ় মাসের মাঝামাঝি এখন। কদম গাছটার সারা গায়ে ছোট-ছোট গুটি। কিছুদিনের মধ্যেই হলুদ-সাদায় সুন্দর করে সেজে উঠবে। নববরষার কদম ফুল। এই যে আষাঢ়, ‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবস’ না-হলেও, নববরষা তো বটে। এই যে জানালার ধারে বসে আছে মাথায় হাত দিয়ে, কই, বিরহের কথা তো মনে হচ্ছে না একবারও? মনে হচ্ছে না তো- ‘কেটেছে একেলা বিরহের বেলা আকাশ কুসুম চয়নে…।’ নিজেকে প্রোষিতভর্তৃকাও মনে হচ্ছে না। প্রোষিতভর্তৃকাদের একটা আলুথালু ভাব থাকে। মাথাটা ঠিকমতো আঁচড়ায় না, সাবান- টাবানও ঠিকমতো দেয় না, হয়তো মাথায় উকুনও হয়।

উঁহু, ভুলভাল ভাবছে। প্রোষিতভর্তৃকা হলেই যে বিরহিনী হতে হবে, এমন কথা কে বলেছে? বিরহিনীর একটা ‘জ্বালা’ থাকে। বিরহ-জ্বালা।

আচ্ছা, ‘জ্বালা’ বলা হচ্ছে কেন? ছোটবেলা থেকেই তো শুনতে হচ্ছে ‘বিরহ-জ্বালা’। বিভিন্ন গানে, কবিতায়, কথায়…। ‘জ্বালা’-টা কোথায়? ‘বিরহদুখ’ বললেই তো হয়। আচ্ছা ঠিক আছে। দুঃখ। ছোটবেলায় বাংলায় মানে লিখতে হত। ‘প্রোষিতভর্তৃকা’র মানে হচ্ছে ‘যাহার স্বামী বিদেশে থাকে।’ কারও স্বামী বিদেশে থাকলেই তো স্ত্রী বিরহ-জ্বালায় জ্বলবে বা বিরহ- দুঃখে কাতর হবে—এমন কথা নেই। কোনও-কোনও ‘প্রোষিতভর্তৃকা’ স্বামীকে দূরে পাঠিয়েই বরং ভাল থাকে। স্বাধীন থাকে।

শুক্লার কোন পর্যায়? ভাল-থাকা ‘প্রোষিতভর্তৃকা’, না কি খারাপ-থাকা?

নিজের অবস্থানটা নিয়েই ভাবতে লাগল।

ও নেই বলে খুব যে দুঃখে আছে এমন নয়, আবার খুব যে আনন্দে আছে এমনও নয়।

ও থাকলে ভালই লাগে। লোকটা খারাপ না। খুব একটা বায়না নেই। অত্যাচারও করে না, মদ খেলে চেঁচামেচি দূরের কথা, সিঁটিয়ে থাকে। কিন্তু কিছুদিন ধরে, মনে হয়, কিছু একটা গোপন করছে। খোলা আলমারির ভিতরে একটা ছোট্ট ‘ভল্ট’ থাকে। সেই ‘ভল্ট’ হল আলমারিটার গোপন কুঠুরি। ওর জীবনেও আছে। থাক। সেই মন-লকারের চাবিটা অনিকেতের কাছ থেকে নিতে চায়নি। সেই লকার খুলতেও চায়নি শুক্লা। কিন্তু একটা কৌতূহল থেকেই যায়।

ছোটবেলার একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে। ওর একটা কীরকম যেন জ্যাঠামশাই ছিলেন। সেই জ্যাঠামশাই ছিলেন ব্যাচেলর। রিটায়ার করে ঝাড়গ্রামে একা-একা থাকতেন। একটা বাড়িও বোধহয় কিনেছিলেন। উনি মারা গিয়েছেন খবর পেয়ে সব ভাইপো ওখানে গেল। ওদের কাউকেই তো মুখাগ্নি করতে হবে। মুখাগ্নির আগেই সবাই তোশক উল্টে দেখতে লাগল, তোশকের তলায় পয়সাকড়ি আছে কি না। একজন কাজের লোক গোছের ছিল, মধ্যবয়সি মহিলা, সে-ই মৃতদেহটা আগলে বসেছিল। টেবিলে কিছু বইপত্র, ওষুধের শিশি এসব ছিল। ড্রয়ারে আলমারির চাবি পাওয়া গেল। আলমারির মধ্যেও দামি কিছু ছিল না। বেশ কিছু ‘ঝাড়গ্রাম বার্তা’। ওইসব কাগজে ওঁর কবিতা ছাপা হত।

লকার খোলা হল।

লকারের মধ্যে একটা কৌটো, কৌটোর মধ্যে একটা চাবি। ওটা ব্যাঙ্কের লকারের চাবি। সেই মহিলা বলেছিল। দেহ সৎকারের পর ব্যাঙ্কে যাওয়া হল। ব্যাঙ্কের লোকজন কেন লকার খুলতে দেবে? অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে কোর্ট-আদালত করে ওঁর ভাইপো রা লকার খোলার অধিকার আদায় করল। এদিকে ব্যাঙ্কের ‘পাশ-বুক’ দেখে ভাইপোরা জানতে পারল, প্রতি মাসে বেশ ভাল টাকা আশালতা মাইতি নামে একটা অ্যাকাউন্ট-এ জমা হচ্ছে। কিছু টাকা এই আশ্রম ওই আশ্রমে দানছত্র হয়েছে। অনেক আশা নিয়ে লকারটা খোলা হল। লকারে একটা মুখবন্ধ প্যাকেট। প্যাকেটের ওপরে লেখা : ‘পাইবেন শ্রীমতী আশালতা দাস।’ বুকটা ধক করে উঠেছিল। নিশ্চয়ই উইল। জ্যাঠামশাই কি বাড়ি, টাকাপয়সা সব কিছু আশালতাকে দিয়ে গিয়েছেন? খামটা খোলা হল। খামের ভিতরে কিছু কবিতা। আশালতাকে নিয়ে। বোঝো, কার ভল্টে যে কী থাকে।

অনিকেতের ভল্টে যা খুশি থাকুকগে যাক। পৃথিবীতে অনেক কিছুই দেখা যায় না। দেখার চেষ্টা করেও দেখা যায় না। রাত্তিরে প্যাঁচা, বাদুড় ওরা সব কিছু দেখতে পায়, মানুষ কি পারে? মুনি-ঋষি, যোগীরা না কি পারেন। এসব অবশ্য অনিকেত মানে না। সাতটা রঙের বাইরেও অনেক নাকি রং আছে। মানুষ জানে না। যে-শব্দ শুনতে পায় মানুষ, এর বাইরেও অনেক শব্দ আছে। মানুষ জানে না। মানুষের মধ্যেও কত কী হয়? মানুষ নিজেও সব জানে না। একটা বড় ব্যাগের মধ্যে মাঝারি ব্যাগ, মাঝারি ব্যাগের মধ্যে ছোট মানিব্যাগ।

শুক্লার নিজের ভল্টেও কি কিছু নেই? ওর সব খবর কি অনিকেত জানে? কেউ কাউকে উজাড় করে সব কিছু দিতে পারে না। কিছু-কিছু নিজের কাছেও রাখতে হয়।

অনিকেত প্রায় প্রতি সপ্তাহেই আসে। শনিবার। সোমবার ফিরে যায়। বাজার-টাজার সবই করে যায়। হাঁটুর অসুবিধের জন্য একটা ওষুধ খেতে হয়, জিগ্যেস করে—ওষুধ আছে কি না জানলার কাচ-টাচও পরিষ্কার করে কোনও সময়। কর্তব্য-কর্মগুলো নিয়ে কোনও অভিযোগ নেই। কিন্তু কোনওদিন তো কাঁধে হাত রেখে জিগ্যেস করে না, ভাল আছো তো? কপালে হাতের স্পর্শ পায় শুধু জ্বর হলে। জ্বর-জারিও তো বহুদিন হয় না। একটু স্পর্শ চায় প্রিয় কারও। শরীরের বিশেষ-বিশেষ জায়গায় নয়, হয়তো শরীরেও নয়, কিন্তু স্পর্শ। লেখায় কিছু ভুলভ্রান্তি হলে, রবার ঘষে পেনসিলের দাগ ওঠানো যায়। তেমনই সত্তার কোনও কালিমা মোছার জন্যও, একটু রবার লাগে। ‘রবার’ মানে ভালবাসা, মানে সহানুভূতি। আলতো করে গায়ে হাত বুলিয়ে দিলেই মনে হয় কত ক্লান্তি মুছে গেল, কত গ্লানি মুছে গেল। এরকম হাতের স্পর্শ পাওয়া যেত বহু আগে। অপারেশনটার আগে। পরেও কিছুবার। একটা হার ছিনতাই হয়েছিল, তখনও। আজকাল যদি স্পর্শ পায়—সেটা বিশেষ স্থানে। ওগুলো তো স্পর্শ নয়, আঙুলের মাস্তানি। আঙুল কম্যান্ড করছে—ওঠো ওঠো। জাগো জাগো। কামবতী হও। স্কুলের ড্রিল- পিরিয়ডের ‘সা-ব-ধা-ন’, ‘আ-রা-ম’-এর মতো কম্যান্ড। আঙুলের হুকুমে কখনও কখনও কামবতীর অভিনয় করেছে। বিছানায় দু’জনের ভিতরের দেড়ফুট দূরত্বকে আগে দেড় কিলোমিটার বানিয়ে পরে অভিসারিকা হয়েছে। পথের কাঁটায় গায়ে রক্ত ঝরিয়েছে। কিন্তু সেই রাতটা বড় অদ্ভুত ছিল, যেবার দুলালটাকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে এসেছিল ও। কে জানে কী হয়েছিল। একজন কাউকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর সঙ্গে কামের কী সম্পর্ক? সেই ছোট্টবেলায় দেখা কী যেন একটা সিনেমা, ‘পলাতক’? ওখানে একটা গান ছিল, এখনও রেডিওতে মাঝে-মাঝে হয়, ‘আহা রে বিধি গো তোর লীলা বোঝা ভার।

মহিলাদের জন্য কত কাগজ আজকাল। তাতে মহিলাদের নানা সমস্যা। নিয়মিত রাখে না, মাঝে-মাঝে একটা-দু’টো কেনা হয়। ওইসব কাগজ পড়ে মনে হয়, মহিলারা যেন আলাদা কোনও প্রাণী। ঠিকঠাক মানুষ নয়। একটা লেখা ছিল, পুরুষদের সন্তুষ্ট করার কিছু ‘টিপ্‌স’। ওখানে যা-যা বলা হয়েছিল, তার অনেকগুলো মরে গেলেও পারবে না শুক্লা।

এই যে স্পর্শের কথা ভাবছিল শুক্লা, যা ওর শরীর ও সত্তা চায়, সেটা কি অনিকেতও চায় না? অন্য কিছু না। সহানুভূতি। যে-হাত বলবে, ও গো, তোমার কী কষ্ট? তোমার কষ্ট তো আমি বুঝি, কিন্তু আমি কী করব বলো? ইশ, কত দিন আঁচল দিয়ে ঘামটুকু মুছিয়ে দেয়নি ওর না-ঘামলেও। একবার জল খেতে গিয়ে একটু বিষম লেগে কাশছিল অনিকেত। শুক্লা ওর মাথায় মৃদু চাপড় দিয়ে বলছিল, ষাট-ষাট …।

অনিকেত বলেছিল—থাক, মা-গিরি করতে হবে না। ‘মা-গিরি’ শব্দটায় বেশ কিছুটা অভিযোগ কি ছেটানো ছিল না? আসলে ওর দরকার ‘বউগিরি’, ‘মা-গিরি’ নয়। আরও ঠিক করে বলতে গেলে…ইয়ে। ঠিক আছে। কাল তো ও আসছে, কাল একটু অভিসারিকা হওয়া যাবে’খনে। আজ থেকে মাটি কাদা করে পিছল পথে হাঁটা প্র্যাকটিস করবে।

অনিকেত আসে বলে রোববার লুচি হয়। আগেকার রোববারগুলোতে নিয়ম করে লুচি হত না। রুটি-আলুর চচ্চড়ি বা দই-চিঁড়ে—যা হোক কিছু। রাত্তিরে একটু যত্ন করে ভাল রান্নাবান্না করার চেষ্টায় ও থাকে। এগুলোও তো কর্তব্যকর্ম। শুক্রবারটা এলেই মনের ভিতরে ‘ও আসবে, ও আসবে’ এরকম একটা ভাব হয় ঠিকই, কিন্তু বুকের ভিতরে কোনও কোকিল ডাকে না। আগমনি গানও তৈরি হয় না। সোমবার ভোরবেলা যখন ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে যায়, শুক্লা দরজা পর্যন্ত আসে, কিন্তু তেমন কোনও করুণ সুর বাজে না। কিন্তু সতী-নারীর তো এমন হওয়া উচিত নয়। বিদায়বেলায় আঁখি ছলোছলো হবে, আঁচলে চোখের কোনার জল মুছবে- এমনটাই তো সঙ্গত। শুক্লা কি আবেগ-বর্জিত হয়ে গিয়েছে? কই, আগে তো এমন ছিল না…। ওকে তো ‘আহ্লাদী’ নাম দিয়েছিল মামাতো দাদারা। আহ্লাদিপনা করত বলে নয়, বেশি করে হাসত, তা-ই। সুকুমার রায়ের কবিতার ওই ‘আহ্লাদী’-দের একজন বলে ওই নাম দিয়েছিল। ‘হাসছি মোরা হাসছি দেখ হাসছি মোরা আহ্লাদী তিন বোনেতে যুক্তি করে ফোকলা হাসির পাল্লা দি’।

সোডার মতো নাকি হাসি আসত ভসভসিয়ে পেট থেকে, আবার কান্নাও নাকি খুব ছিল ছোটবেলায়। অল্পে হাসত, অল্পে কাঁদত, আবার অল্পতেই কান্না থেমে যেত। একবার, মনে পড়ছে, ভীষণ কাঁদছিল, কান্না থামাতে পারছিল না কেউ, ছোটবেলার কথা, শুক্লার এক মামা কাজ করত একটা ছোট স্টেশনে, কী সুন্দর নাম জায়গাটার, রূপসা। ছোটবেলায় মায়ের সঙ্গে যেত ওখানে। সারা দিনে একটা ট্রেন যেত, সেটাই ফিরত। রেলের লাল কোয়ার্টারের সামনে একটা মাঠ, মাঠ পেরোলেই রেললাইন। রোজ সকালে ঝমঝম রেলগাড়ি চলে যেত, আর রেলগাড়ির শব্দ শুনেই মাঠে দাঁড়াত শুক্লা। একদিন রেলগাড়ি এল না। ট্রেন তো কখনও- কখনও ‘লেট’ করেই। মামা বলল, আজ রেলগাড়ি যাবে না। হরতাল। ‘হরতাল’ মানে কী, শুক্লা জানত না। ও বলেছিল, তা হলে বিকেলে? বিকেলেও রেলগাড়ি যাবে না জেনে ও নাকি পা ছড়িয়ে কান্না জুড়েছিল। কেউ ওর হাতে পুতুল, কেউ নারকোল নাড়ু এসব দিয়ে কান্না থামাতে চেয়েছিল। ও বলেছিল, আমাকে রেলগাড়ি এনে দাও। একটা খেলনা রেলগাড়ি কেউ জোগাড় করে দিয়েছিল। ওটা ছুড়ে ফেলেছিল, বলেছিল ওইখানে রেলগাড়ি এনে দাও। ওর হাতের আঙুল ছিল রেললাইনের দিকে তাক করা।

মানুষের কত পরিবর্তন হয়। ওর মত হাসনে-কাঁদুনে মেয়েটা হাসে না, কাঁদেও না। ওই যে ‘গীতা’-য় কী একটা শ্লোক আছে না—দুঃখে যার দুঃখ নেই, আনন্দে যার হাসি নেই…কী যেন, ডায়রিতে আছে। বাবার দেওয়া ডায়েরিতে। ডায়েরিটা খোলে। ডায়েরিটা খুললেই কেন যে অদ্ভুত অথচ অস্পষ্ট একটা ছবি আর কিছু শব্দ ভেসে আসে! আয়-আয়-আয়। চইচইচই। কুয়াশা-মাখা একটা সন্ধে। একটা পুকুর, সেখানে কলমি শুশনি ল’ল’ করে। জল থইথই। আয়- আয়-আয়, চইচইচই।… দূর থেকে ভেসে আসে। মাথা-থেকে-ঘোমটা খুলে যাওয়া কোনও বউ আকূল হয়ে ডাকছে ওর হাঁসগুলোকে। জল বেয়ে পাড়ে আসে ধূসর রঙের হাঁস। ডায়েরি খুলে সেই গ্রাম্যবধূর ‘আয়-আয় চইচই’ যেন নিজের ভিতর থেকেও শোনে। কাঠের মিস্ত্রি দিয়ে খাট বানাচ্ছেন বাবা। বিয়ের খাট। একদিন সন্ধেবেলা হাতে করে নিয়ে এলেন বিছানার চাদর। খাটে পাতা হবে। একদিন নিয়ে এলেন বালিশের ওয়াড়। মা বলছেন—রং যে মিলল না। বাবা বলছেন, এক রঙের ঢাকনা দিয়ে দিও দুই বালিশে, রং মিলে যাবে। দু’টো আলাদা রঙের বালিশে একই রঙের ঢাকনা। ঢাকা দিয়েই তো আছি। দিব্য আছি। শুক্লা মনে-মনে ভাবে।

সেই সব পুরনো ছবি হাঁস হয়ে আসে। পুজোর নতুন ফ্রকের গন্ধ, লাল ফিতে, সাইকেলে ঠেস দিয়ে স্কুলের সামনে তরুণদার দাঁড়িয়ে থাকার ছবি হাঁস হয়ে আসে। একসঙ্গে খেতে বসা, থালায় আধখানা ডিম। সাদা ফ্রেমে বাঁধানো আধখানা উজ্জ্বল সোনা-রং ডিমের কুসুম। মা খাইয়ে দিচ্ছেন ভাত। ভাতের গরস ডিমের কুসুমটা স্পর্শ করছে, আর শুক্লার মুখে ঠেলে দিচ্ছেন মা। আর ভাইয়ের মুখে দিচ্ছেন ডিমের কুসুম। শুক্লার জন্য মিছিমিছি ডিম, ভাইয়ের মুখে সত্যি-সত্যি ডিম। রোজ-রোজ। খুব অভিমান। মেয়ে বলে ডিম দেবে না? ছেলে বলে ডিম দেবে? বাবাকে নালিশ করে সব বলেছিল। মা আমাকে মিছিমিছি ডিম দেয় বাবা, ভাইকে সত্যি-সত্যি। ঝুলনের মেলায় বাবা নিয়ে গেলেন। একটা গোটা ডিমের অমলেট। শালপাতায়। হালকা ধোঁয়া বেরোচ্ছে ডিমের শরীর থেকে। একটু-একটু করে ভেঙে খাচ্ছে, আর বাবার মুখের দিকে তাকাচ্ছে। বাবার মুখে কী সুন্দর হাসি। একাদশীর চাঁদের মতো। স্মাইলি-স্মাইলি ‘আয়-আয়-আয় চইচই…’। ডায়েরির পাতা উল্টোয় শুক্লা। সুখেও সুখ নেই, দুঃখেও দুঃখ নেই—কোথায় যেন আছে। পেয়ে গেল।

দুঃখেষুবনুদ্বিগ্নমনাঃ সুখেষু বিগতস্পৃহঃ।
বীতরাগভয়ক্রোধঃ স্থিতধীমুনিরুচ্যতে।।

দুঃখে যিনি স্থির, উদ্বেগহীন—সুখেও যাঁর স্পৃহা নাই, যিনি যে কোনও বিষয়েই আসক্তিহীন, ভয় ও ক্রোধশূন্য, তিনিই স্থিরপ্রজ্ঞ বলিয়া খ্যাত। তলায় ব্র্যাকেটে লেখা ‘গীতা’।

ও কি তবে স্থিরপ্রজ্ঞ নাকি? নিজের প্রশ্নে নিজের মুখেই ‘স্মাইলি’ এল শুক্লার।

ওসব বড় কিছু নয়। তবে আজকাল কেমন যেন হয়েছে ওর। আনন্দ হয় না কেন? দুঃখ হয় না কেন? ক্রোধ হয় না কেন?

‘ক্রোধ’ একটা ভারী-কথা। রাগ। রাগ হয় না তো, এই যে সপ্তাহান্তে বাড়ি আসে অনিকেত, বাজার-টাজার করে, ফ্রিজ পরিষ্কার করে দেয়, ওষুধ শেষ হলে ওষুধ কিনে এনে দেয়, কিন্তু রোববারটা বিকেলে বাড়ি থাকে না। সেই রাত করে বাড়ি ফেরে। মোবাইলে কথা বলার সময় দূরে চলে যায়। কখনও ছাদে। কার সঙ্গে কথা বলে ও? ও না কি সেই ওর ছোটবেলার হারিয়ে যাওয়া কোনও বাল্যবান্ধবীর খোঁজ পেয়েছিল। ওর সঙ্গে তবে? বলুকগে যাক। ওর জীবনে ও ‘আয়-আয় চইচই’ থাকতে পারে।

তরুণদার কথাও তো মনে পড়ে শুক্লার। খবর কাগজে পুলিশ নিহত শুনলেই তো বুকটা ধক করে ওঠে। সেই যে কবে সাইকেল থামিয়ে বলেছিল, পুলিশে চাকুরি পেয়েছি, ট্রেনিং-এ যাচ্ছি, পরে এলে দেখা হবে। আর দেখা হয়নি। তখন ক্লাস টেন। একটা ছোট্ট কাগজের প্যাকেট দিয়েছিল, খুলে দেখেছিল লিপস্টিক। ওটা লুকিয়ে রেখেছিল কত দিন। তারপর ওটা হারিয়েই গিয়েছিল। এরপরই ঠোঁটে লিপস্টিক বোলালেই সাইকেলের ঘণ্টির উচ্ছ্বাস শুনতে পেত : টিরিং টিরিং টিরিং। একদিন দেখেছিল টিভিতে। কোথায় কী যেন গন্ডগোলের পর কোনও পুলিশ অফিসার বিবৃতি দিচ্ছিলেন। ঠিক চিনতে পেরেছিল শুক্লা। টিভির মানুষটা তো ওকে দেখতে পায়নি, তবুও টিরিং টিরিং শুনেছিল শুক্লা, সত্যিকারের। বেল-টা টিপেছিল যে, কাউকে ডাকার জন্য যে-বেল’টা থাকে টেবিলের ওপর। ভালই লেগেছিল এটা জেনে যে, লোকটা এই পৃথিবীতেই আছে। হ্যাঁ। বলছিল তো কসবা থানার ওসি, কসবা থানা খুব একটা দূর নয় এই বাড়ি থেকে। কিন্তু ওর সঙ্গে দেখা করার কোনও ইচ্ছেই তো হল না শুক্লার। কোনও তাগিদই নেই মনের ভিতরে। যদি দেখা হয় এই বাড়িটার ঠিক সামনে কখনও? হয়তো খুব জলতেষ্টা পেয়েছে, জিপ থেকে নেমেছে ‘একটু জল পাই কোথায়’ দেখতে… যদি ওর বাড়িতেই বেল টিপে জিগ্যেস করে, ‘একটু জল পাই কোথায়’ বলতে পারেন? ও কি বলবে, ‘এখন তো জলপাইয়ের সময় নয়, কাঁচা আম চান তো দিতে পারি।’ তখন কি তরুণদার মনে পড়বে পাড়ার প্যান্ডেলে ‘অবাক জলপান’ নাটকটার কথা? তরুণদা অবাক চোখে তাকাবে। চিনতে পারবে? হয়তো কিছু বলবেই না। শুধু মন্টুকে বলবে—ভদ্রলোককে এক গেলাস জল দিয়ে দে তো? ব্যস।

মন্টু ছেলেটা বেশ কাজের। ওকে মোটেই কাজের ছেলে হিসেবে রাখা হয়নি, নিজের ছেলে হিসেবেও নয়। নিজের ছেলে হিসেবে দেখলে তো পাশেই শোয়াত। স্নান করিয়ে দিত…। না না, এই বয়সে বোধহয় স্নান করানো যায় না। বারো বছর তো বয়স হল ওর। গলাটা একটু ভাঙছে। হালকা একটা গোঁফের রেখা উঠেছে। ওর জন্য বাথরুমে আলাদা সাবান নিজের ছেলে ভাবলে কি আলাদা সাবান রাখত? তবে মন্টু কী-কী খেতে ভালবাসে শুক্লা জেনে ফেলেছে। ফুলুরি-মুড়ি। ফুলুরি বাড়িতে বানাতে পারে না শুক্লা। পয়সা দেয়, ও কিনে আনে। ও রসগোল্লা অদ্ভুতভাবে খায়। প্রথম জিভ দিয়ে একটু করে চাটে। ‘লিক’ করা যাকে বলে। তারপর অর্ধেকটা মুখে রাখে। কামড়ায় না। বেশ কিছুক্ষণ পরে কামড়ায়। ওর কি কামড়াতে মায়া লাগে? কী সুন্দর দুলে-দুলে পড়ে ও। ঘরটা কীরকম ‘আলোয় ভুবন ভরা’ হয়ে যায়। এ দৃশ্য আগে দ্যাখেনি কখনও। ওই ঘর থেকে কখনও ভেসে আসে ব্যাবিলনের সভ্যতা, বাইজেনটাইন সাম্রাজ্য, নীলনদের যাত্রাপথ, সিঁড়িতে ধপধপ শব্দ, জেঠিমা…কাপড়টা কোথায় মেলব? ‘জেঠিমা’ শব্দটার শেষে একটা ‘মা’ আছে। ওখানটায় কী সুন্দর একটা সুর। শুক্লা বলেনি, মন্টু-ই শেষ শব্দটায় সুর মিশিয়ে দেয়।

শুক্লার কাজেও সাহায্য করে ও। কাচা কাপড় মেলে দেয়, বাজার থেকে কাঁচা তরকারিগুলো প্যাকেটে ভরে ফ্রিজে গুছিয়ে রাখে, চা-ও করতে পারে। বলে, তরকারিগুলো ধুয়ে দিই? কথা-টথা বলার সময় একটু কেমন যেন ‘সুর’ থাকে ওর। হাতের কবজি এবং কনুই একটু বেশি নড়ে। অন্য ছেলেদের এরকম হয় না। বল কিনে দিয়েছে। বল খেলে না। অথচ বিকাশদার ছেলেটা কীরকম খেলোয়াড় হয়েছে এই বয়সে। বিকাশ ক্রিকেট খেলার ইস্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে। ছেলেটা অনেক ব্যায়াম-ট্যায়াম করে। ওর নাকি ছেলেটাকে সৌরভ বানানোর ইচ্ছে।

শুক্লার অত ইচ্ছে-টিচ্ছে নেই বাপু। ছেলেটা বিপদে পড়েছিল, ঘরে এনে রেখেছে। ওর ঘরে যখন আছে—ঠিকমতো মানুষ হোক। ভাল ছেলে হোক। ভাল ছেলে বলতে উকিল- ব্যারিস্টার-ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে এমন কেন? সৌরভ, কপিল দেবও হতে হবে না।

যা হোক কিছু করুক। সৎ ছেলে হোক, ব্যস। একটা মোটামুটি চাকরি-বাকরি কি পাবে না? যতটা পড়তে চায়, পড়াবে শুক্লা। ইশ, ও কী করে পড়াবে? ওর কি নিজের উপার্জন আছে? ওর বরের টাকায় ওর ইচ্ছাপূরণ। কী আর করা যাবে, তবু যা হোক, ইচ্ছেটা আছে। ইচ্ছে মানেই তো জীবন।

মন্টুর বউ শুক্লাকে কী বলে ডাকবে? জেঠিমা। না কি মা-ই ডাকবে? মন্টুর বউটাকেই ওই মোটা হারটা দেবে। কুলো ঘুরিয়ে বরণ। উলু। ‘আয়-আয়-আয় চইচই’…।

এইসব আকাশকুসুম চয়নে বেলা যায়। বিরহের বেলা যায়। আবার ‘বিরহ’ শব্দটা কেন আসে? বিরহ না, বরাহ। এমনি-এমনি ভাবছে এসব। যা হওয়ার হবে। ভগবান যা করে।

ভগবান কোথায় থাকেন? কে জানে? স্বর্গ বলে কিছু আছে না কি ওই মহাকাশে? আত্মা, পরমাত্মা, ব্রহ্ম। সব কেমন গুলিয়ে যায়। কিন্তু কিছু একটাকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে যে, একটা আশ্রয়। এই যে ছোট্ট গোপালটাকে সাজায়, স্নান করায়, খেতে দেয়, ঘুম পাড়ায়- মানে ‘অদৃশ্য’ কিছুকে সেবা করে। আসলে স্মরণ করে। কৃতজ্ঞতা জানায়। এই অনন্ত রহস্য মাঝখানে বিস্ময়ভ্রমণ। এই ভ্রমণে কী এক আনন্দ। বৃষ্টিফোঁটার টাপুর-টুপুরে কী এক আনন্দ। রাস্তার গর্ভে জমা জলে মেঘের ছায়া। ছোট-ছোট জুঁই ফুল ফুটে উঠলে ওরা কী কথা বলে? ঠিকই বলে, ও শুনতে পায় না। মেঘেদেরও কথা আছে। তারাদেরও। রাতের আকাশের দিকে তাকালে সহস্র নক্ষত্র-তারার মধ্যে কীরকম যেন হারিয়ে যায়। তখন কি মনে পড়ে, উচ্ছে- বেগুন-ধামা-কুলো? তখন কেন যে ইচ্ছে হয়, সারা শরীর অঞ্জলিবদ্ধ করি। এই মহান, বিরাট, অনন্ত সৃষ্টিকে প্রণাম করি। স্রষ্টা-কে নয়, সৃষ্টিকেই। সৃষ্টিই ঈশ্বর। দুর্ব্বেয় অবগুণ্ঠনটাই ভগবান মুগ্ধতাই—আনন্দ। হে ভগবান, আমাকে মুগ্ধতা দাও।

অনিকেত ভগবান মানে না। ভগবানের সঙ্গে সবসময় ও ‘টগবান’ মেশায়। সব কিছু যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে চায়। সব যুক্তি তুমি জানো? কেন গান ভাল লাগে, তুমি বোঝাতে পারবে যুক্তি দিয়ে? ভোরবেলাটা কেন ভাল লাগে পারবে যুক্তি দিয়ে বোঝাতে? কথায়-কথায় বিবর্তন তত্ত্ব, ডারউইন, মার্কস-এঙ্গেল্স, জিন, ক্রোমোজম….। আমার ওসব দরকার নেই। আমার বাবা সেই প্রাচীন তত্ত্বটাই ভাল—বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহু দূর।’ এসব ভাবছিল শুক্লা। ভাবনার কোনও ক্রমপর্যায় নেই। কিন্তু এই স্বপন-বপন ভালই লাগছিল শুক্লার।

এ সময়ে জানলা দিয়ে সেই মেয়েটাকে দেখল। রিকশায়।

একটু দূরে কোথাও থাকে। ওর পা দু’টো অপরিণত। বোধহয় শৈশবে পোলিও হয়েছিল। ওকে দেখেছে হাঁটুর তলায় হাওয়াই চটি বেঁধে ছেঁচড়ে চলতে। কোথাও ও বই-বাঁধানোর কাজে যায়। বই-বাঁধাতে পা লাগে না। দুলালের মায়ের কাছে জেনেছিল। পা না-থেকেও নিজের পায়ে দাঁড় করাতে চেয়েছিল নিজেকে।

রিকশায় ওর পাশে একটি পুরুষ। ওই মেয়েটির কোলে একটি শিশু। শিশুর হাত দু’টো আকাশ নাড়াচ্ছে। উঃ মুগ্ধতা। আনন্দ? আনন্দ কি টের পাওয়া যাচ্ছে ভিতরে? প্রচণ্ড ভাল লাগার একটা অনুভব তো হওয়া উচিত ছিল এখন। একটি পা নেই, অথচ মেয়ে বর পেয়েছে, ঘর পেয়েছে, সন্তানও…।

তবে কি হিংসে?

পা-নেই-মেয়েটার কোলেও সন্তান, অথচ …।

দুঃখে কষ্ট না-পাওয়া, সুখে আনন্দ না-পাওয়া, বা আনন্দে সুখ না-পাওয়াটা প্রাজ্ঞতার লক্ষণ নয়। জড়তার লক্ষণ তবে।

এক-রিকশা সুখ চলে গেল। সুখ-লাগা বাতাসে জলের গন্ধ। আনন্দধারা এই ভুবনে বইছে তো, আমার ঘরেও একটু এসো গো, প্লিজ।

তার চেয়ে উচ্ছে-বেগুন-পটল-মুলো ভাল। বেতের বোনা ধামা কুলো ভাল।

ও আসবে। কাল। ও এলে, পাখিগুলোও বেশি শিস দেয় না, কদম গাছের ডালও নড়ে ওঠে না, জুঁই ফুলও বেশি গন্ধ দেয় না, তবে রান্নাঘরের গন্ধটা পাল্টে যায়। রোববার সকালে লুচি হয়। বেচারা খালি সেদ্ধ-সেদ্ধ খায়, নইলে খিচুড়ি। আগের দিন মাছ কিনে আনে বেশি করে। সকাল হলেই যেন ওর মা বলেন, বউমা, কাঁচামুগের ডাল রেঁধো, পারো যদি লাউয়ের খণ্ড দিও। বেগুনের গায়ে একটু ব্যসন মাখিয়ে ভেজে দিও। মনের কথা মিশিয়ে দিও মাছের ঝোলটায়। ছোটমাছ যদি থাকে, একটু টক কোরো তেঁতুল দিয়ে। দই পাতোনি বুঝি? ভুলে গিয়েছ?

আজ শুক্রবার। মন্টু স্কুল থেকে এলে এক প্যাকেট দুধ বেশি আনতে বলবে। দই পাততে ভুলে যায় বড়।

শুক্রবারই অনিকেত চলে এল। রাত আটটা নাগাদ। মুখে অনেকটা হাসি ফোটাল শুক্লা। ও জুঁইগাছ, বেশি করে গন্ধ দে। ও বৃষ্টি-বাতাস, বও, বও, বও। ওগো উতল হাওয়া।

একদিন আগেই? বাঃ!

শুক্লা বলল। ফোন করে দিলে না কেন?

–ফোন করলে কি সারপ্রাইজ-টা হত?

—সেটা ঠিক, কিন্তু বাজার তো কাল করব ভেবেছিলাম।

—ছাড়ো তো, ডাল আর আলুসেদ্ধ মেখে দিও।

যথেষ্ট ভালবাসা দেখানো হল না মনে হল। তাই জুড়ে দিল ‘তোমার হাতের’।

এই জুড়ে দেওয়াটার মাঝখানে সামান্য ‘পজ’ রয়ে গিয়েছে, অনিকেত বোঝে। রেডিও-র কাজে দু’টো কথা জুড়তে হয়। জোড়ার সময় ‘পজ’ খুব ইম্পর্ট্যান্ট।

‘পজ’ মেক-আপ করার জন্য বলল—তুমি দারুণ আলুসেদ্ধ মাখো—শুকনো লঙ্কা ভাজা, কালোজিরে দিয়ে। আমি তো এমনি একটা কাঁচালঙ্কা মেখে খেয়ে নি।

জল এনে দিল শুক্লা। লেবু-চিনি দিয়ে।

কী খবর বলো? অনিকেত বলল।

—চলছে। – মন্টু?

—ঠিক আছে।

—পড়াশোনা করে?

—হ্যাঁ, করে।

—অন্য কোনও ঝামেলা নেই তো—ওকে নিয়ে?

—না না, কী আর ঝামেলা…

মাঝখানে মন্টু একবার এসে উঁকি দিয়ে গেল। অনিকেতের মনে হল টু-উ-কি….।

শুক্লার মনে হল, অনিকেত খুব শ্রান্ত। বলল, দুপুরে বেরিয়েছ, না?

অনিকেত বলল, মাথা নাড়ল।

—চা খাও।

চা এনে দিল শুক্লা। বলল, খুব ভিড় ছিল বুঝি বাসে? জামাটা কীরকম কুঁকড়ে গিয়েছে। না কি ইস্ত্রিটাও করো না।

শুক্লা দেখল, জামার একটা বোতাম ছেঁড়া। একটু অপরাধী লাগল নিজেকে। ও যদি ওখানে ওর কাছেই থাকত…।

.

অনিকেতেরও একটু অপরাধী লাগছে নিজেকে।

আজ সক্কালবেলাতেই বেরিয়েছিল। সারাটা দুপুর মঞ্জুর সঙ্গে। আজ বড্ড পাগলামি করছিল মঞ্জু। বোতামটা ওখানেই ছিঁড়েছে।

রাতে শুয়েছিল ওরা। দেওয়ালের দিকে পাশ ফিরে অনিকেত। দু’জনের মাঝে দেড়-দু’ফুট ব্যবধান। শুক্লার হাত অভিসারে যায়। এই পঙ্কিল দু’ফুট পার হয়ে… ‘আয়-আয়-আয় চইচই…।’

৩৪

মনের ভিতরে একটা মেঘ জমে থাকে। একটা অস্বস্তিকর অনুভব। শুক্লার কাছে লুকিয়ে-রাখা গোপন-জীবনের অংশগুলোই একটু অস্বস্তিতে রাখে। শুক্লা জানলে দুঃখ পাবে। শুক্লার কোনও গোপন-জীবন নেই সেটা অনিকেত খুব ভাল করে জানে। ও হল পুরো সতী নারী। সতীর কি পুংলিঙ্গ হয়? বোধহয় নেই। ‘সৎ’ বললে ঠিক বোঝায় না। স্ত্রী-র প্রতি একান্ত বিশ্বস্ত পুরুষকে কী বলে? বাংলা, ইংরেজি কোনও ভাষাতেই কি আছে? স্ত্রী-র প্রতি বিশ্বস্ত থাকাকে অনেক সময় স্ত্রৈণতা বলা হয়। জাহানাবাদিকে জিগ্যেস করেছিল হিন্দিতে সতীর কোনও পুংলিঙ্গ হয় কি না। জাহানাবাদি বলেছিল, ভেড়ুয়া।

জাহানাবাদি একজন অবসরপ্রাপ্ত রেডিও-কর্মী। এখানে লোকজন কম, বহু বছর কোনও নতুন লোক নেওয়া হচ্ছে না। ঘোষকের কাজটা ক্যাজুয়াল দিয়েই করানো হচ্ছে—দৈনিক মজুরিতে। কিন্তু সম্প্রচার চলার সময় একজন তত্ত্বাবধায়ক দরকার হয়, যিনি ঘোষকদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেন, বা দরকার মতো পূর্বনির্ধারিত অনুষ্ঠান সূচি পরিবর্তনও করেন। ক্যাজুয়াল কর্মীদের দিয়ে এসব হয় না। জাহানাবাদি আবার কবিও বটেন। ওদিকে, কবিদের নামের সঙ্গে অনেক সময় নিবাসটাও যোগ করা হয়। যেমন, এঁর নাম হচ্ছে লছমীশংকর দুবে জাহানাবাদি। এরকম মোরাদাবাদি, কানপুরিয়া, মজফ্ফরপুরিয়া, এলাহাবাদি এসব হয়। ওঁর অনেক নিজস্ব তত্ত্ব আছে। যেমন যিশু খ্রিস্ট ভারত থেকেই ওধারে গিয়েছিলেন। ঘরের ঈশান কোণে তাঁর জন্ম হয়েছিল বলে নাম হয়েছিল ঈশা। যিশুর অন্য নাম। খ্রিস্টান মানে কৃষ্ণান। ‘গীতা’-র অনুকরণই হল বাইবেল। বেথলেহাম আসলে বেতলাইসান। ওটা বিহারের মজফ্ফরপুর জেলায়। মধ্য এশিয়ার লোকজন ‘স’-কে হ’ উচ্চারণ করে, যেমন সিন্ধু-কে বলে ‘হিন্দু’। হিব্রু আসলে ‘শিবরু’। শিবের ভাষা। আর মিশরে সভ্যতা তো ভারত থেকেই গিয়েছে। ওদের নদীর নাম নীল। এক্কেবারে সংস্কৃত শব্দ। জাহানাবাদি রোজ সকালে একটা শিশি থেকে দু’চামচ কী একটা আরক ধরনের খায়। শিশিটার গায়ে গরুর ছবি। হিন্দিতে লেখা গোমৃত।

জানাহাবাদি এলে অনিকেতের কোয়ার্টারেই থাকেন। অনিকেত যেহেতু একা, ওর কোয়ার্টারটা বড়-ই। একটা ঘরে জাহানাবাদি থেকে যান। মাসে দশ-পনেরো দিন করে ডিউটি। দিনে তিনশো কুড়ি টাকা করে দেওয়া হয়। কাজ চালানোর জন্য জাহানাবাদিদের রাখতে হয়। আলাদা বাড়ি ভাড়া করে থাকতে গেলে এই টাকায় পোষাবে কেন? জাহানাবাদি থাকলে রান্নাবান্নাটা উনিই করে রাখেন। রাত্রে মাঝে-মধ্যেই গল্পগাছা হয়।

জাহানাবাদির মতো আর একজনও আছেন। ওঁর নাম মেরিলিন লাকড়া। ‘ওরাওঁ’ উপজাতির মহিলা, খ্রিস্টান। কখনও লাকড়া ম্যাডাম, কখনও জাহানাবাদি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে থাকেন।

ওঁরা চলে গেলে, ওঁদের ঘরে কিছু-কিছু অবশেষ রয়ে যায়। যেমন, জাহানাবাদি-র ঘরে একটা ফাঁকা ‘গোমূতে’র শিশি। শিশির গায়ে হিন্দিতে লেখা ছিল এটা কোন কোন বিমারি থেকে ইলাজ দেয়। খুদি-খুদি অক্ষরে ‘অ’-এ অর্শ থেকে শুরু করে হ-এ হাঁপানি, এবং ‘স’-এ সবকুছ পর্যন্ত বহুরকম অসুখের নাম ছিল। শিশিটা ও নিয়েছিল খুচরো তেল কিনবে বলে। ছিপিটা খুলতেই অ্যামোনিয়ার তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ। আবার শোঁকে। অ্যামোনিয়াই তো। ইউরিয়ার দ্রবণ ভেঙে গেলে অ্যামোনিয়া হয়। তবে কি ওই শিশিতে গরুর হিসি ছিল? পরে, জাহানাবাদি এলে অনিকেত জিগ্যেস করেছিল। জাহানাবাদি বলেছিলেন জি হাঁ। সফেদ মাঈ কা। গাই নয়, উনি বললেন, ‘মাঈ’। ‘গো’-মায়ের পেচ্ছাপ পান করেন উনি। জানা গেল এটা অনেকেই খায়। শুধু রাঁচি কেন, হাজারিবাগ, টাটানগর, পাটনা সর্বত্রই পাওয়া যায়।

—কোথায় পাওয়া যায়?

—কেন? দাবাখানায়।

রেড ক্রশ লাগানো ওষুধের দোকানে গরুর পেচ্ছাপ ‘সিল’ করা শিশিতে বিক্রি হয়। ভাবা যায়? চাইবাসার বড় ওষুধের দোকানেও পাওয়া যায়। অনিকেত খোঁজ নিল। দেখল আলমারিতে নানারকম ওষুধের সঙ্গে ‘গোমৃত’ সাজানো, পাশেই সান্ডা তেল। শিশিতে বলীয়ান পুরুষের ছবি, খালি গা, জাঙ্গিয়া পরা, জাঙ্গিয়াটা ফোলা। কলকাতার রাস্তায় বেদেনি-বানজারা এইসব তেল বিক্রি করে। ও দেখেছে। গিরগিটি-র মতো দেখতে কী একটা প্রাণীকে তেলের মধ্যে ফোটায়। সেই তেলটা বিক্রি করে ওরা। এই তেলের আর একটা নাম ‘পালঙ্কতোড় তেল’। মানে, এই তেল ঠিকঠাক অঙ্গে মর্দন করলে রমণকালে পালঙ্ক ভেঙে যাবে।

জাহানাবাদি-র বয়স পঁয়ষট্টির মতো। ধুতি এবং খদ্দরের জামা পরেন। অনিকেতের চেয়ে বয়সে অনেকটাই বড়। ‘সান্ডা’ বিষয়ে ফান্ডা নেওয়ার মতো সম্পর্ক এখনও তৈরি হয়ে ওঠেনি। সবরকম কথা বলার পরিবেশ তৈরি হল, যখন মাসখানেক পরে এসে ছেলের বিয়ের কথা জানালেন। বিয়ে হয়ে গিয়েছে, ১০৮টা হাউইবাজি উড়েছে আকাশে, আর এগারোজন ‘লওন্ডা’ নাচিয়েছে। ‘লওন্ডা’ নাচানোটা উৎসবের অঙ্গ। তা ছাড়া বিয়ে বাড়িতে ‘লওন্ডা’ এলে নববিবাহিত স্বামী-স্ত্রী সুখে থাকে। অনিকেত বলল জাহানাবাদি সাহেব, ‘লওন্ডা’ নাম থেকেই কি লন্ডন শহরের নাম হয়েছে?

উনি ইয়ার্কিটা বুঝলেন। বললেন, ইয়ার্কি কোরো না। লন্ডনের সাহেবরাও ওদের বাড়িতে ‘লন্ডা’ নাচাত। সে একটা সময় গিয়েছে। সাহেবরা এদেশে এসে মেম পেত না। নারী-শরীরের জন্য ভুখ তো ছিলই। এদেশের মেয়েদের লুকিয়েচুরিয়ে, কিংবা দালালের মাধ্যমে ওদের বাংলোয় আনত, কিন্তু পাটনা-র মতো শহরে সহজে যেটা পাওয়া যেত, সেটা হল লন্ডা। পাটনায় মারুফগঞ্জের কাছে এখনও একটা লন্ডা বাজার আছে, সেখানে তিন-চার ঘর নাচুনে আছে, ওদের বলা হয় ‘লন্ডনিয়া’। কহবত আছে, কোনও সাহেব নাকি ওদের নাচে এমন মোহিত হয়ে গিয়েছিল যে চার-পাঁচজন লন্ডাকে বিলেত নিয়ে গিয়েছিল। ওদের ছেলে চার্চ থেকে বিয়ে করে ঘরে এল, তখন ফূর্তিতে ‘লন্ডা’ নাচিয়েছিল। ওরা ওখানে গিয়ে বিলিতি নাচ ও শিখেছিল। ওরা কিছুদিন পর দেশে ফিরে আসে। ওদের ‘খ্যামটা’ জাতীয় নাচের সঙ্গে বল নাচের মিশ্রণ ঘটায়। মানেটা হল, ওরা নিজেরা নাচতে-নাচতে দর্শকদের ভিতর থেকে কাউকে পার্টনার বেছে নেয়, তারপর হাত ধরে, পায়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঘুরে-ঘুরে নাচে। এখনও নাকি ‘লন্ডনিয়া’ নাচের কদর আছে। অনিকেত ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করে। এটা হল, একটা ‘স্কুল অফ লন্ডা’ ড্যান্স। বলা যায় ‘লন্ডন স্কুল অফ লন্ডা ড্যান্স’।

জাহানাবাদি বলছিল—শুধু বিয়ের উৎসব নয়, অন্নপ্রাশন, ছটপুজোতেও ওদের নাচ খুব দরকার। আর হোলি-র আনন্দ তো ‘লন্ডা’ ছাড়া বেকার। কিন্তু সকালবেলায় এদের মুখ দেখতে নেই, দেখলে সারাদিন খারাপ যায়। এরা অপবিত্র।

বিয়ের সময়, পবিত্র, শুভ। কিন্তু অন্য সময় অশুভ—এর কী ব্যাখ্যা? অনিকেত জিগ্যেস করে।

জাহানাবাদি বলেন, বহুত আচ্ছা কোয়েশ্চেন কিয়া হ্যায় আপনে। ইয়ে তো ‘ফাক সোসিওলজি’ কা মামলা হ্যায়।

একটু ভুল শুনেছিল। ওর উচ্চারণ দোষে। ‘ফোক সোসিওলজি’ হবে।

জাহানাবাদি ওঁর ঘর থেকে মহুয়ার জ্যারিকেনটা নিয়ে আসেন। বলেন, গেলাস দিজিয়ে।

দু’টো চুমুক দিয়ে জাহানাবাদি বলতে লাগলেন—এরা আগের আগের-আগের জন্মে ছিল দেবরাজ ইন্দ্রের রাজসভার নর্তকী। মূল নর্তকী হচ্ছে রম্ভা-মেনকা-ঊর্বশী। এঁদের অনেক অ্যাসিস্ট্যান্ট লাগে। দেখতে নেহি হ্যায় সিনেমা-উনেমা মে? এক লেড়কি নাচতি হ্যায় তো উসকি সাথ সাথ এক ডজন লেড়কি ভি পায়েল লাগাতি হ্যায়? স্বর্গে ঊর্বশীদের ওপর দেবতাদের আশীর্বাদ আছে। ওঁদের কখনও ‘হায়েজ’ হয় না। ‘হায়েজ’ মতলব ‘মেন্‌স’। কিন্তু সহকারিণীদের তো এতটা স্ট্যাটাস নেই। সহকারিণীরা হল ফালতু। ওদের জ্বর, সর্দি, পেটখারাপ, ঋতুস্রাব সব হয়। মাঝে-মাঝেই ওদের ভিতরে কারও কারও শরীর খারাপ হয়, নাচতে পারে না, ইন্দ্র ওদের অভিশাপ দেয়। ইন্দ্ৰ তো নাচ-টাচ দেখার সময় প্রচুর সোমরস খেয়ে থাকেন, আর ওইসময় ওঁদের ‘রাজা’ ভাব অতি প্রবল হয়। ‘তমো’-গুণ সমঝতে হ্যায়? ওহি গুণ কা প্রভাব মে। অভিশাপ দিয়ে বলে—তোমার মধ্যে একটা পুরুষ অঙ্গ দিয়ে দিলাম। উসি লিয়ে উনকা দো পয়ের কা বিচ মে এক ছোটা সা ল্যাওড়া পয়দা হো গিয়া হ্যায়। লেকিন, আসল মে ই লোগ লেড়কি যেইসাই হ্যায়। দেখিয়ে স্যর, ক্যায়া মুসিবত। কপালে হাত রাখলেন।

জাহানাবাদিজি এবার বলতে থাকেন, আরে বাবা ইন্দ্র মহারাজ হল গিয়ে আমাদের এমপি মহারাজদের মতো। ওদের ক্ষমতা আছে, যা-খুশি-তাই করেছে। ওই বেচারা মেয়েগুলোর ওপর নিজের জ্বালা মিটিয়েছে।

—সেটা আবার কীরকম?

—আপ জানতে হ্যায় ইন্দ্রমহারাজ কা পেলহড় কা বারে মে?

—পেলহড় ক্যায়া হ্যায়?

—নেহি জানতে হ্যায়? বৃষন বৃষন।

—বৃষন ক্যায়া হ্যায় জি?

—ইঃ বাবা, বৃষন ভি নেহি জানতে হ্যায়। অণ্ডকোষ। অণ্ডকোষ। নিজের আঙুলগুলো বলের মতো করে দেখালেন।

—ক্যায়া হুয়া থা ইন্দ্ৰজি কো?

জাহানাবাদি যা বললেন—মহর্ষি গৌতমের পত্নী অহল্যা ছিলেন খুব সুন্দরী, আর সুন্দরী দেখলেই ইন্দ্রের মাথা খারাপ হয়ে যেত। একবার দুই দৈত্য—সুন্দ-উপসুন্দকে মারার জন্য সব দেবতারা তাঁদের সব রূপ আর শক্তি দিয়ে তিলোত্তমা নামের এক নারী তৈরি করেছিলেন। তিলোত্তমা ত্রিভুবনের সেরা সুন্দরী। অ্যাকশনে যাওয়ার আগে তিলোত্তমা মহাদেব আর ইন্দ্রকে প্রদক্ষিণ করছিলেন। ইন্দ্রের দু’চোখে প্রাণ ভরছিল না। উনি নিজের সারা শরীরে এক হাজার চোখ পয়দা করে নিলেন। সেই ইন্দ্র, সুন্দরী মেয়েছেলে দেখলেই যাঁর সবকুছ গড়বড় হয়ে যায়। গৌতম মুনির বউ অহল্যাকে দেখে ওঁর বহুত লোভ হল। একদিন গৌতম মুনির রূপ ধারণ করে অহল্যার সঙ্গে সঙ্গম করলেন। গৌতম মুনি হঠাৎ ঘরে এসে ডুপ্লিকেট গৌতমকে দেখে সব সমঝে গেলেন। ইন্দ্রর ওপর রাগ করে অভিশাল দিলেন—গির যা বৃষণ। আর অমনি ইন্দ্রের ওটা খসে গেল।

যেই না অণ্ডকোষ খসে গেল, তখন ইন্দ্র কি আর মরদ রইলেন? তখন ইন্দ্র কী করতেন? ওঁর কি তখন সেই বড়িয়া মোচটা ছিল? তখন স্ত্রী-সঙ্গম করতে পারতেন? ওসব কোনও কিতাবে লেখা নেই। ওসব নিয়ে একটা ‘বিগতবৃষণ’ কাব্য লেখার ইচ্ছা বহু দিনের, এখনও হল না।

ইন্দ্র মহারাজ ‘বিগতবৃষণ’ হয়ে যাওয়ার পর দেবতারা মহা মুশকিলে পড়লেন। এমন লোক কী করে রাজা থাকবেন, যিসকো আসলি চিজ নেহি হ্যায়? উসকো বাদ বহুত ক্লোজ ডোর মিটিং হুয়া, আউর নির্ণয় লিয়া গিয়া—পাঠা কা অণ্ডকোষ ইন্দ্র কা বডি মে জোড় দিয়া যায়গা। ইসকে বাদ প্লাসটিক সার্জারি হুয়া, ইন্দরজিকা বডিমে পাঠা কা পেলহড় জোড় দিয়া গিয়া। উসি লিয়ে না হাম লোগ ইন্দরজি কা পূজা নেহি করতা হ্যায়।

বাব্বা। এসব তো কিছুই জানত না অনিকেত। দেবরাজ হয়েও ইন্দ্রর তো কোনও পুজো নেই। বাঁকুড়া-পুরুলিয়ায় ইঁদ পরব বলে একটা অনুষ্ঠান হয়। ওটা নাকি ইন্দ্রের স্মৃতি। ইন্দ্রের কোনও মন্দির নেই—শুধু ওই একটা কারণেই। জাহানাবাদিজী এরপর যা বলেন, তার সারমর্ম হল : ইন্দ্রের কিছু মাথার ঠিক ছিল না কি? শরীরে যদি মানুষের বদলে পাঁঠার বিচি ঝোলে, তা হলে যা হওয়ার তা-ই হয়। ওই একটি কম্মো ছাড়া আর কিছুই জানত না, দৈত্যদের কাছে বারবার হারত, আর ব্রহ্মা-মহেশ্বরের কাছে গিয়ে হাতজোড় করত। একবার হল কী…ইন্দ্রের জীবন-বৃত্তান্তের দিকেই চলে যাচ্ছেন জাহানাবাদি।

অনিকেত বলে—কিন্তু লন্ডারা নাচলে শুভ হয় কেন বললেন না তো…।

ও আর বলার কী আছে? সারকথা তো বলেই দিয়েছি। লন্ডারা হচ্ছে শাপভ্রষ্টা নর্তকী। মৌগাদের মধ্যে সবাই লন্ডা হয় না। মৌগা-রা নিজেরাই বুঝে যায় ওরা লন্ডা। ওদের কোমর সরু হয়। নাচতে ভালবাসে। ইন্দ্র যখন অভিশাপ দিলেন, ওরা বলল প্রভু, শাপ তো দিলেন, শাপমুক্তি কী করে হবে? ইন্দ্র বললেন, এখানেও নাচতিস, এবার পৃথিবীতে গিয়েও নাচবি আগে দেবতাদের আনন্দ দিতি, এবার মানুষদেরও আনন্দ দে। আনন্দ হল সবসে বড়িয়া দান আনন্দই সর্বোৎকৃষ্ট দান। মানুষ আশীর্বাদ করবে। মানুষের আশীর্বাদে পরের জন্মে আবার নারী হয়ে জন্মাবি। ওরা নাচে, আনন্দ দেয়, আর পাপ খণ্ডায়।

—ওরা নাচলে গৃহস্থের কল্যাণ হয় কেন? জাহানাবাদি একটু গম্ভীর, তারপর বলতে থাকেন—দেখিয়ে সাহাব, দুনিয়া মে দো চিজ হ্যায়, যেতনা ভি খচ, খছয় নেহি হোতি হ্যায়। যতই খরচা করো না কেন, ক্ষয় হয় না। বিদ্যা, আর আনন্দ। ওরা তোমাকে আনন্দ দিচ্ছে, তুমি ওদের আশীর্বাদ দাও, শুভ কামনা দাও, শুভেচ্ছা দাও…। তোমাকে আশীর্বাদ দেওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে ওরা। ওদের প্রত্যেক পায়ের ধাক্কায় গৃহস্থের অশুভ-শক্তি দূরে সরে যায়। আর যেখানে আনন্দের জন্য সবাই জড়ো হয়, সেখানে ওরা শুভ।

অনিকেত বলে, তা হলে ওরা বিয়ে বাড়িতে শুভ, পরদিন সকালে নববধূর পক্ষে ওদের দেখা অশুভ, এটা কেমন হল? এখানে কী তত্ত্ব দেবেন?

জাহানাবাদি বলল—এগুলো চলে আসছে যুগ-যুগ ধরে। সকালবেলায় কুকুর, শকুন, হিজড়া, বিধবা অশুভ। প্যাঁচা শুভ, কিন্তু একাদশীতে অশুভ। ওসব যে, নিয়ম হয়েছে, এর একটা স্ট্যাটিস্টিকাল বেস আছে। অনেকদিন ধরে আমাদের পূর্বপুরুষরা দেখেছেন, হিসেব রেখেছেন, তারপর অঙ্ক কষেছেন। যদি দেখা যায়, একশোজন লোক সকালবেলায় যাত্রা করার সময় হিজড়া দেখল এবং তাদের মধ্যে বিশজন বিপদে পড়ল, আর ২৫ জন লোক সধবা সতী নারী দেখে যাত্রা করে সাকসেসফুল হল, তা হলে কী সিদ্ধান্ত হয়? শুনিয়ে জি, সনাতন ভারত মে ইসটাটিসকিস্ কা চর্চা বহোত হোতা থা। আপ, বেঙ্গলি লোগ মানতা নেহি। খনা দেবী তো আপই কা থী না?

যাককে যাক, এরা কিন্তু নাচে ভাল। আমার ছেলের শ্বশুরবাড়ি হল আমার বাড়ি থেকে এগারো কিলোমিটার দূর। এগারোজন লঅন্ডা এই এগারো কিলোমিটার রাস্তা নাচতে-নাচতে গিয়েছে। বরাতি-রা গাড়িতে। গাড়ি ওদের পিছন পিছন। লঅন্ডাদের সঙ্গে ব্যান্ডপার্টি। ওরা আংরেজি গানা, ফিল্‌ম গানা বাজায়, লঅভা-রা নাচে। ওই এগারোজনের মধ্যে ছিল দু’জন চমচম।

‘চমচম’ মানে জিগ্যেস করায় অনিকেত জানতে পারল, যারা একটু বেশি মেয়েলি, এবং স্বাস্থ্য ভাল। লন্ডাদের বেশির ভাগই নিচু জাতের, তাই রং কালো। ভাল খাওয়া-দাওয়া করতে পারে না। রোগা। তাই চমচমদের কদর বেশি। বরাতিরা নেশা করে থাকে। এদের সঙ্গে নাচে। দু-একটা চমচমকে জড়িয়েও ধরে। খামচেও দেয়। এগারো কিলোমিটার নাচতে-নাচতে একজন মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়েছিল। দুবলা কিনা, তাই। মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়া ঘর্মাক্ত মানুষটাকে চোখের সামনে যেন দেখতে পায় অনিকেত। দুলালের মুখটা ওর দেহে বসানো। দুলাল ‘চমচম’ নয়। ও হয়তো রসহীন কটকটি। দু-একটা চমচমের খাবলানো শরীরও ভেসে ওঠে। ওগুলো ধর্ষণ নয়। শ্লীলতাহানি নয়। ৩৭৬ ধারায় শুধু নারীই ধর্ষিতা হতে পারে। এরা পারে না। অনেকটা-মহুয়া-নেওয়া জাহানাবাদিজি বলে যাচ্ছে চমচমিয়া-বরাতি বৃত্তান্ত।

দুলালের কথা মনে হয় ফের। দুলালের ছোটবেলাটা ও জানে না। শেষ-জীবনটা তো জানে। ওকে তো দেখেছে। ওর জীবনটা নিয়ে একটা উপন্যাস লিখলে কেমন হয়? দুলালের কাছ থেকে তো অনেকটাই শুনেছে ও। চাঁদতারা হিজড়ানির কথা শুনেছে, দুলালের প্রেমিক লছমন যাদব…। জাহানাবাদি-র কাছ থেকেও কিছু ইনপুট পাওয়া যাবে। এছাড়া সোমনাথ তো এদের নিয়ে কাজ করেছে, ওর সঙ্গেও দেখা হয় মাঝে-মাঝে। জানা যেতে পারে অনেক কিছু। এখনই শুরু করা উচিত, নইলে পরে মনে থাকবে না। হয়তো সাহিত্য টাহিত্য কিছু হবে না, না লিখলে বাংলা সাহিত্যের কোনও ক্ষতি বৃদ্ধি হবে না। তবু লিখতে ইচ্ছে করছে। উপন্যাস না লিখে নিবন্ধ গোছেরও কিছু লেখা যেতো হয়তো, কিন্তু ওতে কল্পনার কোনও সুযোগ নেই। চোখের সামনে দেখা দুলাল কি গায়ক হতে পারে না? কবিতা সিংহের পৌরুষ উপন্যাসের সখী সোনার চাইতে দুলালের নায়ক হবার গুণ কম কীসে?

কোথা থেকে শুরু করবে?

ছোটবেলাটা থাক।

কাঁচা আনাজের ব্যবসাটা ছেড়ে দিয়ে ফিতে-নেলপালিশ-কুমকুম, শায়ার দড়ির ফেরি করার কাজ থেকে শুরু করলে হয়। এই ইচ্ছেটা ক্রমশ দানা বাঁধতে থাকে, এবং সিদ্ধান্তই নিয়ে ফেলে যে দুলালকে নিয়ে লিখে ফেলবে কিছু একটা।

পরের সপ্তাহে বাড়িতে দু’দিন থেকে ফিরছে। রিজার্ভ করা নেই। সোমনাথকে খুঁজছে, ওর সঙ্গে কথা আছে। ‘অবমানব’-এর পরের সংখ্যাটা যদি বেরিয়ে থাকে, নিয়ে নেবে। লেখার কিছু টিপ্‌সও চাইবে। ওকে পেয়ে গেল। অনিকেত দেখল, সোমনাথ জানালার ধারে একটা সিটে বসে মন দিয়ে একটা বই পড়ছে। অনিকেত উল্টোদিকে বসল। বইটার মলাট দেখল ‘প্রাচীন ভারত, সমাজ ও সাহিত্য’। এখন কথা বলবে না। পড়ুক। ঠিকই দেখতে পাবে। পড়ছে বলে মুখটা বইয়ে ঢাকা। প্লাটফর্মের ছাউনি ছিটকে একটা ঝলকা রোদ্দুর ওর ঝোলা দুলে। মেয়েদের মুখে এক ধরনের আভা হয়। আভা, না বিভা? ছ’টা ফুচকা খাবার পর রুমালে হাত মুছলে মুখে একটা খুশির ছটা, ওটা একরকম বিভা, আবার ওরা প্রগাঢ় পাঠিকা হলে মুখটা অন্যরকম।

সোমনাথ ওর এমফিল-এ যে-গবেষণাটা করেছে, সেটার বিষয় আশাপূর্ণা দেবীর উপন্যাসে নারীর ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য। চেপে রাখা মেয়েদের জেগে ওঠা, ফুঁড়ে ওঠা। এই ধরনের বিষয় সাধারণত মেয়েরাই বেছে নেয়। ট্রেনটা ছাড়ার পর ও দেখতে পেল। এতক্ষণ মুখ ঢেকেছিল কঠিন বইয়ে। বেশ দেখাচ্ছে ওকে। ক্রমশ নারী হয়ে উঠছে ও। কথাবার্তা বলার সময় মহিলাদের মুখের দিকে, শরীরের দিকে বেশিক্ষণ না-তাকানোটাই শালীনতা। মাঝে-মাঝেই অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিতে হয়। কিন্তু ছেলেদের সঙ্গে কথা বলার সময় এটা হয় না। অনিকেত যখন সোমনাথের সঙ্গে কথা বলছিল, তখন কখনও জানালার বাইরের গাছ, মাঠ, ঝুপড়ি, কখনও ট্রেনের গায়ে লেখা ধূমপান নিষেধ দেখছিল। যদিও ও এখনও সোমনাথ-ই।

—নামটা পাল্টাবেন না আপনি? অনিকেত ঝপ করে প্রশ্নটা ছুড়ে দিল।

—ও মা! আমাকে আবার ‘আপনি’ কবে থেকে।

আসলে অনিকেত একটু নার্ভাসই হয়ে গিয়েছিল। হয়তো কোনও অপরাধ বোধ থেকে বক যখন যুধিষ্ঠিরের ক্যুইজ মাস্টার হয়ে প্রশ্ন করছিল, তখন একটা প্রশ্ন ছিল—ব্রহ্মাণ্ডের সবচেয়ে দ্রুতগামী কী? যুধিষ্ঠির সহি জবাব দিয়েছিল—মন। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই মন যে কোথায়-কোথায় যায়? সোমনাথের সুন্দর ভ্রু দেখে মনে হল, ওটা কি প্লাক করা? ও কি পার্লারে যায়? পরমুহূর্তেই আফ্রোদিতি। তারপরই রাজা ভঙ্গাসন। রাজা ভঙ্গাসন তো সরোবরে ডুব দিয়েই পুরুষ থেকে নারী হয়ে গিয়েছিল মুহূর্ত মধ্যেই। কিন্তু এই যে ক্রমান্বয়, এই যে ক্রমশ, এই যে হয়ে ওঠা…। যারা সিলিকোন স্তন ইমপ্লান্ট করে, ওটা তো সত্যিকারের স্তন নয়, ওটার ক্ষেত্রেও কি ওদের সেই ব্রীড়া-ব্রীড়া ভাব থাকে?

—হ্যাঁ। নামটা পাল্টে মানবী করব। প্রচুর ঝামেলা। কোর্টে যেতে হবে, ভোটার কার্ড পাল্টাতে হবে, কিন্তু হায়ার সেকেন্ডারির সার্টিফিকেট…।

—সুকুমারী ভট্টাচার্যের বইটা পড়া হচ্ছিল খুব মন দিয়ে?

—হ্যাঁ। দেখছিলাম। অনেকে বলেন না প্রাচীন ভারতে নারীর স্থান খুব উঁচুতে ছিল, খুব মান-সম্মান পেত মেয়েরা, সুকুমারী ভট্টাচার্য পড়লে বোঝা যায়, ওগুলো কতটা ফাঁপা কথা ফোলানো কথা। এই তো, এই জায়গাটা পড়ছিলাম, চাণক্য থেকে কোট করেছেন—আত্মানং সততং রক্ষেৎ। দারৈরপি ধনৈরপি। নিজেকে সবসময় রক্ষা করবে। প্রয়োজন হলে ধন কিংবা স্ত্রী’র বিনিময়ে। ঘুষ দিয়ে যদি কাজ সিদ্ধ না-হয়, স্ত্রী-কে দিয়ে দাও। পান্ডাবরাও দিয়েছিল। এদেশে ধর্ষণ হবে না তো কী হবে? যজ্ঞের প্রসঙ্গে বলা হয়েছিল, যজ্ঞ শেষে যজ্ঞীয় হবি-কে লাঠি দিয়ে মেরে যজ্ঞের অবশিষ্ট আগুন নেভাতে হবে। অগ্নি পত্নীবৎ। বলা হচ্ছে লাঠি দিয়ে নারীকে মেরে দুর্বল করা উচিত, যজ্ঞশেষের আগুনকেও। সন্তানসম্ভবা নারীর একটা অনুষ্ঠান করতে হত, পুংসবন। দেখবেন, পঞ্জিকায় আছে দশবিধ সংস্কারের তালিকায়, পুংসবন। চূড়াকরণ, উপনয়ন, বিবাহ, গর্ভাধান, তারপর পুংসবন। যার উদ্দেশ্য হল গর্ভের ভ্রুণটি যাতে পুরুষ হয়। অথচ দেখুন…।

‘অথচ দেখুন’-এর পর অসম্পূর্ণ বাক্যে কী বলতে চাইছিল মানবী, কিংবা আধা-মানবী? — অথচ দেখুন কী বিপন্ন বিস্ময়, যে নক্ষত্র—নক্ষত্রের দোষ অথবা জিনের, আমাকে অন্যরকম করে দিল। সকল লোকের মাঝে বসে আমার নিজের মুদ্রাদোষে আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুরু ধাঁধা? আমার পথেই শুধু বাঁধা? –না, সোমনাথ আর কিছু বললনা।

একটা দীর্ঘশ্বাস মতো পড়ল সোমনাথের শরীর থেকে। ট্রেনের জানলা দিয়ে আসা ধানখেতের হাওয়ায় মিশে গেল।

ও বলল—অথচ দেখুন—আমার মা পরপর কন্যাসন্তানের জন্ম দিল। বউ হিসেবে ফেল। আত্মীয়রা দুয়ো দিচ্ছে। তারপর আমি জন্মালাম। আমার কাকিমা-জেঠিমারা আমার লিঙ্গ- পরিচয়ের জায়গাটা ঠিকঠাক করে দেখে নিয়েছিলেন—আমার মা পরিবারকে আবার ঠকালেন কি না। রেজাল্টে কোনও ভুল নেই তো?

বাবা শুনেছিলেন। বাবার মনে হয়েছিল যেন লটারির টিকিট জিতেছেন। শুনেছিলাম, বাবা একটা ইলিশ মাছ কিনে মামাবাড়ি গিয়েছিলেন পুত্রর মুর্খদর্শন করতে। বাঙাল বাড়িতে ইলিশ মাছ হল শুভ। বাবা বাঙাল, মা ঘটি ছিলেন। আমার আগে মা কয়েকটি কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন বলে বাঙাল বাড়ি ভাবত এটা ঘটিদের ‘দোষ’।

কিন্তু অনিকেতদা, আমি তো অন্যরকম হয়ে গেলাম। বাড়ির চাতালে কলকে ফুল তুলতে আসা রিফিউজি বীরুদার বুড়ি মা আমার কথা শুনে বলত, ‘পোলা কেমন কথা কয়, এক্কারে মুগ্ধা মুগ্ধা’ আমাদের পরিবারের ঠিকে-ঝি সেও বলত, ব্যাটাছেলে মাগিদের মতো করলে গা জ্বলে।

আমি, মাগিদের মতো কী করতাম? দু’টো কাঁটা আর উলের বল নিয়ে বোনার চেষ্টা করতাম। পুতুলদের জামা পরাতাম। আমার বাবা-কাকারা ফুটবল হাতে ধরিয়ে বলত, যাও মাঠে। যেতামও। ছেলেগুলো আমায় চাটি মারত, ঠোকরাত। তাই যেতে চাইতাম না মাঠে। মাঠে না-গেলে গুরুজনরাও মারত। বাড়িতে বলত, এটা ঘটি-রক্তের প্রভাব। বাঙালরা নাকি খুব সাহসী হয়। চেঁচিয়ে কথা বলে। ঝগড়া-মারপিট করে। ঘটিরা মেনিমুখো। আরে বাবা নেতাজি, ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী এঁরা সবাই তো ঘটি। ঘটিদের মধ্যে একটা চালু কথা আছে : মেয়ে ন্যাংড়া’। ‘কুমড়ো কাটা বড়ঠাকুর’—কথাটাও ঘটিদের মধ্যে। মেয়েদের নাকি কুমড়ো কাটতে নেই। ওইসব করার জন্য একটা ভাসুর ঠাকুর থাকত। গেরস্থালি কাজ করত। ওসব ঘটিদের সংসারে হত। সুতরাং বাঙাল বাড়ির বিশ্বাস আমার ওই স্বভাব মায়ের দিক থেকেই এসেছে, সুতরাং মা’কে গঞ্জনাও সইতে হত।

কিশোর হলাম। বড় তো হতেই হয় সবাইকে। রোগ গেল না। সাইকায়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যওয়া হল। উনি ফ্যামিলি হিস্ট্রি নিলেন। তারপরই যখন অসুখের রুট পেয়ে গিয়েছেন ভেবে ‘ইউরেকা’ করে উঠলেন—বাড়িতে এতগুলো দিদি, হবেই তো। দিদিদের সাজগোজ করতে দেখে-

আমি বলেছিলাম, আপনি ভুল করছেন ডাক্তারবাবু। আমার দিদিরা কোনও দিন এতটুকু সাজে না। বিনুনি করা কি সাজা? একটু পাউডার মাখতেও দেখিনি। ওরা সারাদিন জল তোলে, ঘর ঝাঁটায়, চাল বাছে, আটা মাখে, সময় পেলে পড়ে, আর অনেকগুলো বোন হওয়ার বিড়ম্বনায় গুটিয়ে থাকে। ওদের জীবন আমি চাইনি। আমার জীবনে ওদের জীবনের ছাপ পড়েনি। ওরা সাজে না, আমি সাজি। প্রকৃতি সাজাতে ভালবাসে। গাছকে ফুল দিয়ে সাজায়, প্রজাপতির ডানাকে রঙে সাজায়, আমিও আমাকে সাজাই।

অনিকেত এর মধ্যে একটা প্রশ্ন জুড়ে দেয় দুম করে,

—আচ্ছা, যখন একসঙ্গে মা ভাইবোনদের খেতে দিত, তখন কি আলাদা কিছু খাতির পেতে, মনে করতে পারো?

সোমনাথ হাসলেন। বেশ কিন্তু দেখতে লাগল। হাসিতে সামান্য বিদ্রূপ ছিল যদিও। সেই বিদ্রূপ স্বাভাবিক মানুষদের উদ্দেশেই নিবেদিত।

ও বলল, খুব খাতির। ব্যাটাছেলে কিনা, আমার পাতে বড় মাছের টুকরো, একসঙ্গে খেতে বসেছি, মা খাওয়াচ্ছেন, থালায় আধলা ডিম। আমার মুখে যখন ভাত ঢুকছে, ডিমের কুসুম মেশানো, আর বোনদের মুখে মিছিমিছি ডিম। বোনেরা বুঝেও কিছু বলছে না। যখন মেয়ে- ন্যাংড়া বা বড়ঠাকুর টাইপ হয়ে গেলাম, তখন দুচ্ছাই হয়ে গেলাম।

—কিন্তু আমি নিজেকে দুচ্ছাই মনে করতে রাজি নই অনিকেতদা। ও থামল।

অনিকেত এখন কোনও কথা বলতে পারছে না। ওর সম্পর্কে কথাও জিগ্যেস করতে পারছে না, যা ও শুধু নিজেই জানে। ওর শরীর সম্পর্কিত। ওর যৌনতা সম্পর্কও। সোমনাথের কমনীয়তার মধ্যেও লুকিয়ে থাকা প্রতিজ্ঞার ছটা দেখতে পেল।

অনিকেত জিগ্যেস করল—পিএইচডি-টা কত দূর?

ও বলল কাজ শুরু করে দিয়েছি তো। নবনীতাদি-র আশীর্বাদ আছে। আনন্দবাজার-এ তৃতীয় সত্তা চিহ্ন নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলাম, নবনীতাদি ওটা দেখে বলেছিলেন এই বিষয়টা নিয়ে আরও কাজ করো। আশাপূর্ণার থিসিস-এর গাইড ছিলেন নবনীতা দেব সেন আর শর্মিলা বসুদত্ত। শর্মিলাদি আর নেই। নবনীতাদি উসকে গেলেন—বললেন, এটা নিয়ে কাজ করো। কিন্তু গাইড পাচ্ছিলাম না। একজনের কাছে গেলাম, তিনি বড় অধ্যাপক। উনি বিষয়টা দেখেই নাক কুঁচকোলেন। আমি প্রথমে নাম দিয়েছিলাম ‘বাংলা সাহিত্যে বৃহন্নলা’। উনি বললেন ‘বৃহন্নলা’ শব্দটার গা থেকে দুর্গন্ধ বেরুচ্ছে যে। উনি রাজি হলেন না। আমি দেখেছিলাম—তারাশংকর ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’য় নসুবালা সৃষ্টি করেছিলেন, সমরেশ বসুর ‘বান্দা’, সিরাজের ‘মায়ামৃদঙ্গ’, কবিতা সিংহের ‘পৌরুষ’, নারায়ণ সান্যালের ‘রূপমঞ্জরী’, কমল চক্রবর্তীর ‘ব্রহ্মভার্গব পুরাণ’। মানব চক্রবর্তীর ‘সন্তাপ’ এসব নিয়ে লিখব। এসব উপন্যাসের চরিত্রগুলো ঘেঁটে দেখব। গাইড পেলাম না। রবীন্দ্রনাথ ব্যানার্জির কাছে যাব। শুনেছি ওঁর শুচিবায়ু নেই। ‘বৃহন্নলা’ শব্দটার বদলে তৃতীয় সত্তা-চিহ্ন রাখতে বলেছেন আমার অন্য একজন স্যর বিমল মুখার্জি। দেখি কী হয়।

একটু থেমে বলল—কেন যে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়—এত সব লিঙ্গ-চিহ্নে ভাগ করে যাই? কোনও মানুষের এই অংশটা এইটুকু এক্সটেন্ডেড, ওইটুকু কভার্ড, এটা বেরনো, ওটা লুকোনো এইটুকু বর্তুলাকার, ওইটুকু দণ্ডাকার—এমনি করে চতুর্থ-পঞ্চম এরকম লিঙ্গচিহ্নও হতে পারে।

কিন্তু ‘সোল’ তো একটাই, বলুন…।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *