হলদে গোলাপ – ২৫

২৫

অফিসে গিয়েই শুনল অনিকেতের ট্রান্সফার অর্ডার এসেছে। এটা রুটিন। কলকাতায় পাঁচ বছর কাটিয়ে দিয়েছে, সুতরাং এবার বাইরে যেতে হবে। গ্যাংটকে পোস্টিং এসেছে।

ডিরেক্টরের ঘরে গেল।

–কেমন ঘুরলেন? কেমন হল?

যা বলবে ভেবেছিল, বলা গেল না। অনেক কথা বলতে হয়, মানে গল্প করতে হয়, ডিরেক্টরের সঙ্গে একজন প্রোগ্রাম এজিকিউটিভের গল্প করার সম্পর্ক নয়। ‘সম্পর্ক’ ভাল থাকলেও নয়। অনিকেত বলল—ভালই, আমরা যে সিনসিস নিয়ে গিয়েছিলাম, সেটা শুনে ‘বিবিসি’ বলল ‘অর্থোডক্স প্রোগ্রাম’।

—যাকগে। খাওয়াদাওয়া ঠিকঠাক ছিল?

—ওসব ঠিক ছিল। তবে আমার ট্রান্সফারটা…। আমি তো একটা সিরিয়াল শুরু করেছি, প্রতিবন্ধীদের নিয়ে, লাস্ট এপিসোডে একজন ব্লাইন্ড হকারকে এনেছিলাম, যে বৈঠকখানা থেকে ধূপকাঠি কিনে ট্রেনে বিক্রি করে। ও বঙ্গবাসী কলেজের গন্ধ পায়, গন্ধে-গন্ধে মশলাপট্টি পার হয়ে ধূপকাঠির বাজারে আসে, তারপর শিয়ালদা। ও বলেছে, সাউথ স্টেশনেরও আলাদা গন্ধ আছে। ও বোঝে। খুব একটা ইন্টারেস্টিং জায়গায় পৌঁছছে সিরিয়ালটা। এরপর…

—সে আপনাকে ভাবতে হবে না। আপনি চলে গেলেও সিরিয়াল বন্ধ হবে না।

—কিন্তু আমি যে খুব ঝামেলায়…

—ওসব বলে লাভ নেই। ট্রান্সফার তো আপনার নতুন হচ্ছে না, আপনি জানেন, যেতে হবেই। আমাকেও ট্রান্সফারে যেতে হবে সামনের বছরই। আপনি যদি একটা অ্যাপ্লিকেশন করেন, কিছুটা সময় চান, আমি দিল্লিতে পাঠিয়ে দিতে পারি।

অনিকেত বলল—তা হলে স্যর, একটু ভাল করে লিখে দেবেন, আর গ্যাংটক নয়, কাছাকাছি কোথাও দিন, গ্যাংটক থেকে কলকাতা আসা তো খুব মুশকিল…

‘স্যর’ বলে ফেলল। অন্য সময় তো সুমিতদাই বলে।

—আপনার কলকাতা আসার কী দরকার? মিসেস-কে নিয়ে চলে যান। আপনি তো ঝাড়া হাত-পা। আপনার কীসের অসুবিধে?

‘ঝাড় হাত-পা’ কথাটা শুনতে খুব নিরীহ, আসলে ওর ব্যথার জায়গাটাতেই তো সুচ ফোটানো ‘ঝাড়া হাত-পা’ মানে তুমি তো নিঃসন্তান। ছেলে-মেয়ের এডুকেশনের ঝামেলা নেই…

—না স্যর, অসুবিধে আছে।

—কী অসুবিধে বলুন?

অনিকেত চুপ করে থাকে।

সত্যিই তো ওর কী অসুবিধে? এর আগের বার তো কটক আর রাঁচিতে ট্রান্সফার হয়েছিল, শুক্লা সঙ্গে গিয়েছিল। এবারও বললে চলে যাবে। বদলি মানে অন্য পরিবেশ, অন্য আবহাওয়া, একটু অন্যরকম খাওয়াদাওয়া। শুক্লার তো ভালই লাগে।

তা হলে বদলির কথা শুনে অনিকেতের মনখারাপ হয়ে গেল কেন? কেন কাছাকাছি কোনও স্টেশন চাইছে?

দুলালের জন্য? ওর একটা খারাপ রোগ হয়েছে, ব্যাপারটা দেখভাল করছে। একটা দায়িত্ব রয়ে গিয়েছে…।

শালা, নক্‌শা দিচ্ছো? দুলাল? অনিকেতের ভিতর থেকেই কেউ বলে উঠল।

—না না শুধু দুলাল নয়, এই যে একটা অচেনা জগতের দরজা খুলে কিছুটা এগিয়েছে, আরও ঢুকতে চেষ্টা করছে, এ সময়ে ট্রান্সফার মানে তো ছেঁচড়ে টেনে নিয়ে আসা…। এই যে পরিমল বা পরি, ওকে তো একটু এক্সকাভেট করতে হবে।

এই যে বাবা, পথে এসো। পরি? না পরির মা? কাকে এক্সকাভেট করতে চাও তুমি? মনে হচ্ছে শিবরাম চক্রবর্তীর গল্পের ওই লেডিজ ব্যাগ। বড় ব্যাগের মধ্যে একটা মেজো ব্যাগ, মেজো ব্যাগের মধ্যে একটা সেজো ব্যাগ, সেজো ব্যাগের মধ্যে একটা ছোট ব্যাগ, ওখানে টাকা-পয়সা। মানে আসল জিনিস।

কী বলা যায়? কেন কাছাকাছি পোস্টিং? ইউরেকা।

অনিকেত বলল—শুক্লার খুব হাঁপানি হচ্ছে আজকাল। ঠান্ডা জায়গা একদম সইবে না। সেবার দার্জিলিঙে খুব ঝামেলায় পড়েছিলাম।

ডিরেক্টর বললেন—তা হলে শিলিগুড়ি চলে যান। ওখানে ঠান্ডা নেই।

অনিকেত বলল—চাইবাসা-টা দেখুন না। ওখানে যদি খালি থাকে …।

—চাইবাসা কেন চাইছেন?

কেন চাইবাসার কথা মনে এল? শক্তি-সন্দীপনের স্মৃতি জড়িয়ে আছে বলে? রোরো নামের নদীটার জন্য? না কি সাত ঘণ্টার পথ বলে?

অনিকেত বলে ফেলল—ট্রাইবাল এরিয়া কিনা? একটু নতুন অভিজ্ঞতা হতেই পারে।

বস বললেন, অ্যাপ্লিকেশন-টা দিন, আমি দেখছি।

অনিকেত বুঝে গেল হাতে বড়জোর তিন মাস সময়। এর মধ্যে কত কাজ। কম্পিউটারটা জানে না, গাড়ি চালানোটা জানে না। চাইবাসা চলে গেলে কয়েক বছরের জন্য গ্যারেজ। কম্পিউটারটা শিখতে হবে। আর একটা কাজও তো আছে। সেটা শুধু ওর মনের ছোট ব্যাগটার মধ্যে রাখা আছে। ঠান্ডা মঞ্জুর শরীরে আগুন জ্বালানো। মঞ্জুই তো বলেছিল, তুই পারবি? অনিকেত তখন কথা বলেনি। কথা না-বলা মানে। নৈঃশব্দ্য। নৈঃশব্দ্যের ভিতরে অনেক কথা পোরা থাকে।

টেবিলে গেল। এখন প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ। প্রতিবন্ধী বলা হয় না। ফিজিকালি চ্যালেঞ্জ। একটা চিঠি পেল। একজন স্পাইনাল কর্ড ভাঙা লোক চিঠি লিখেছেন—গাড়ি দুর্ঘটনায় আমার মেরুদণ্ড ভাঙিয়া গিয়াছে। আমার নিম্নাঙ্গ সম্পূর্ণ অবশ। আমি হুইল-চেয়ারে চলাফেরা করি। ঘরে বসে টিউশনি করি ও পাঠ্যবই রচনা করি। আমি ক্যাথিটারের সাহায্যে প্রস্রাব করি। আমি কীভাবে আরও ভাল করে জীবন কাটাতে পারব?

পড়েই অনিকেতের চোখের সামনে কয়েকটা ছবি ভেসে এল। ধিক অনিকেত! ওই মেরুদণ্ড-প্রতিবন্ধী মানুষটির নিরাবরণা স্ত্রী দাঁড়িয়ে আছে লোকটার সামনে। লোকটির নিম্নাঙ্গ যেহেতু অবশ, কার্য-ক্ষমতাহীন, লোকটি তার হাত মুখ জিভ ইত্যাদির সাহায্যে চেষ্টা করে চলেছে। কিছুক্ষণ পর ওর স্ত্রী এক গ্লাস জল আর একটা পিকদানি ওর সামনে ধরে। লোকটা কুলকুচি করে পিকদানিতে ফ্যালে।

দ্যাখে, লোকটি ফোন করছে—ডাক্তারবাবু, ও ডাক্তারবাবু, আমার স্পাইন ভাঙা। আমার স্পাইনের এগারো নম্বর হাড় ভেঙে গেছে। এর তলা থেকে সব অকেজো। আমার বয়স বত্রিশ ডাক্তারবাবু, স্কুটার চালিয়ে বউয়ের জন্য আইসক্রিম নিয়ে আসছিলাম, জোরে চালাচ্ছিলাম যেন না গলে যায়। অ্যাক্সিডেন্ট হল। জননেন্দ্রিয়ে কোনও প্রাণ নেই। শুধু ঝুলে থাকে। কিন্তু টেস্টিস তো আছে। ওখানেই নাকি স্পার্ম থাকে। ডাক্তারবাবু, সন্তান চাইছে আমার স্ত্রী। এ কী মুশকিল বলুন, সন্তান পেতে গেলে জন্মদাতার লিঙ্গ দৃঢ় হতেই হবে? কেন? আমার তো রয়েছে, চেরাপুঞ্জি থেকে এক কণা মেঘ গোবি-সাহারার বুকে নয়, আমার শরীর থেকে এক কণা স্পার্ম নিয়ে অন্যভাবে কিছু করা যায় না ডাক্তারবাবু?

আইভি-কে ফোন করতে ইচ্ছে হল। আইভি মোবাইল ফোন নিয়েছে। ও এখন একটা সংস্থার সিকিউরিটি অফিসার। ও খুশি। ও একদিন ফোন করে বলেছিল–হেব্বি লাগছে কাজটা। খাওয়াব। ইউনিফর্ম পরে অফিস যাচ্ছি। অনিকেত বলেছিল, ছেলেদের পোশাক পরতে ভাল লাগবেই তো। ও বলেছিল, প্যান্ট-শার্ট কি ছেলেদের বাপের নাকি? অনিকেত বলেছিল, হ্যাঁ, বাপেরই তো। আইভি বলল, তবে আমিও শালা ছেলে। শার্ট পরলে বুকের ফুলো-টুলোগুলো বোঝা যায় না। অনিকেতের মোবাইল নেই। একটা নিতে হবে। ধুস, এখন নিয়ে কী হবে? চলেই তো যাচ্ছে। আগে ল্যান্ড-ফোন থেকে মোবাইলে ফোন করা যেত না, এখন যায়। ফোন করল। বলল, আইভি, আমার ট্রান্সফার অর্ডার এসে গিয়েছে। বাইরে যেতে হবে।

আইভি কোথায় আহা-উহু করবে, উল্টে বলল, ফ্যান্টাস্টিক! কোথায়? যোধপুর যাও, কিংবা পোর্টব্লেয়ার। দারুণ হবে। আমি যাব। সবাই বলে যাব, কেউ যায় না। বলা যায় না, আইভি হাজিরও হয়ে যেতে পারে।

অনিকেতের ভিতরে-ভিতরে একটা প্রশ্ন ছিল, হঠাৎই উগরে দিল। জিগ্যেস করে ফেলল—আইভি, তুমি কি লেবি?

হা-হা করে হেসে উঠল আইভি। হাসি থামতে বলল—একটা ছাপ্পা না-মারলে তোমাদের চলছে না, না? শিডিউল কাস্ট, ওবিসি, হোমো, হেট্রো, লেবিয়ান…ছাপ্পা মারার খুব দরকার, না? এটুকু বলতে পারি—কোনও ব্যাটাছেলের পুতুপুতু বউ হয়ে জীবন কাটাতে পারব না আমি, ব্যস। হঠাৎ আজকে এ প্রশ্ন কেন অনিকেতদা?

অনিকেত বলল, হঠাৎ নয়, অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম, আজ জিগ্যেস করে ফেললাম।

আইভি বলল, বেশ করেছ। কিন্তু উত্তরটা পেলে না বলে ঠিক মতো তোমার মেন্টাল অর্গ্যাজম হল না, তাই না? আমার কোনও মেয়ে-বন্ধু আছে কি না, তার সঙ্গে আমার কেমন গোপন কাজকর্ম হয়, এসব জানতে খুব ইচ্ছে করছিল, তাই না?

অনিকেত জবাব খুঁজে পায় না। ভিতরে-ভিতরে আমতা-আমতা করে। ওকে অস্বস্তি থেকে রেহাই দিল আইভি। বলল, আমার মনটা আজ হেবি বিন্দাস। একজনকে খুব ক্যালালাম। অফিসে ঢুকে সে তড়পাচ্ছিল। ঘাড় ধরে বার করে দিলাম। তোমাদের অফিসের কাজটা খুব নিরামিষ ছিল।

সেদিনই অফিস ছুটির পর একটা কম্পিউটার শেখার স্কুলে চলে গেল অনিকেত। ‘বেসিক শিখবে। প্রথম দিনেই ক্লাস। কাকে বলে র‍্যাম, ফাইল কী, ফাইল জমা করার ফোল্ডার, কী করে সেভ করতে হয়, এসব বলল। হাতের মুঠোতে যখন মাউস, মনে হচ্ছিল ওর হাতের মুঠোয় একটা অন্য বিশ্ব। তির-চিহ্নটাকে বাগে আনতে পারছিল না। বারবার পিছলে যাচ্ছিল। তির-চিহ্নটা একটা ফোল্ডারের গায়ে যদি ঠিকমতো লাগে, তারপর ক্লিক করলেই খুলে যায় ভিতরে পুরে রাখা তথ্য। মনে হচ্ছিল কত ফাইল ওর সামনে। ঠিকমতো ক্লিক করে খুলে নেওয়া যেত। মঞ্জু একটা ফাইল, আইভি একটা ফাইল, পরি একটা ফাইল, দুলাল একটা ফাইল…। পাটায়া-য় দেখে আসা চন্দন ও একটা এটি ফাইল। ওখানে কয়েক এমবি তথ্য ভরতে হবে। ওকে নিয়ে একটা গল্প লিখলে হয় না? চেষ্টা করবে না কি?

শুক্লাকে ট্রান্সফারের খবরটা দিল। শুনে শুক্লার প্রতিক্রিয়া—’বাড়িতে ভাল তালা নেই।’

—মানে?

—তালা লাগাতে হবে না? কেউ থাকব না, একটা তালার চাবি হারিয়ে ফেলেছিলে, তালাওলাকে দিয়ে ডুপ্লিকেট বানাতে হল। ওটা বাতিল করে দেব। বাকিগুলো পুরনো। কয়েকটা ভাল দেখে তালা কিনে এনো।

দ্বিতীয় প্রশ্ন—কোথায় হল? ভাল জায়গা নাও। যেমন গ্যাংটক, আলমোড়া, ডালহৌসি…।

অনিকেত চুপ। ওর তো গ্যাংটক-ই হয়েছিল, ও ওটাকে পাল্টানোর চেষ্টা করছে। শুক্লাকে বলল না কিছু।

—আবার ট্রান্সফারে যেতে হবে, তোমার কষ্ট হচ্ছে না? মনখারাপ হচ্ছে না শুক্লা?

শুক্লা বলল, কার জন্য মনখারাপ হবে? তোমার সঙ্গেই তো যাচ্ছি। গোপালও যাবে। ওকে তো নিয়েই যাব। রুমকি, মেজবউ, রামপ্রসাদ—ওরাও তো থাকবে। না কি ওদের পাব না ওখানে? গোপাল হল নাড়ুগোপাল, পেতলের। বাকিরা টিভি সিরিয়ালের চরিত্র। কলকাতারই মূলত। প্রাইভেট চ্যানেল তখন শুধু একটা-দু’টো।

অনিকেত বলল, ব্যস?

শুক্লা ঘাড়টায় মৃদু ঝাঁকুনি দিল। চুলগুলো নড়ে উঠল। এখনও এসব করলে ওকে বেশ লাগে। বলল, হ্যাঁ, ব্যসই তো। আমার কীসের বন্ধন? ছেলে-মেয়ের স্কুল, কলেজ, মাস্টার ওসব ঝামেলা সবার থাকে, আমার তো নেই। আর এখানে আমার কোনও এক্সট্রা-ম্যারিটাল সম্পর্কও নেই যে আঠা থাকবে। আমার কাছে কলকাতাও যা, ধাপধাড়া গোবিন্দপুরও তাই—।

তারাপদ সাঁতরার কাছে শুনেছিল—গোবিন্দপুর গ্রামটা ছিল শুঁড়ার কাছে। বেলেঘাটার শুঁড়া। গঙ্গা থেকে বিদ্যাধরী পর্যন্ত দু’টো সংযোগস্থল ছিল তখন। পূর্ববঙ্গের সঙ্গে বাণিজ্য করার জন্য গঙ্গা থেকে বাণিজ্য-নৌকোগুলো বিদ্যাধরী-তে যেত। গোবিন্দপুর গ্রামটা ছিল খালের ধারে। ওখানে বাণিজ্য-তরীগুলোর থেকে মাশুল আদায় করা হত। মাশুলকে স্থানীয় ভাষায় বলা হত ‘ধাপ’। সেই ‘ধাপ’ ধরা হত। কোথায়-কোথায় যে ইতিহাস ঘাপটি মেরে বসে থাকে নিজেরাই জানি না। ইতিহাস কথায়-কথায় থাকে। ক’দিন আগে মঞ্জুকে নিয়ে একটু ডায়মন্ডহারবার গিয়েছিল অনিকেত। সব কথা তো বলা হয়নি, বলা যায়ও না। মাঝে-মাঝেওরা বেরয় টুকটাকে। তবে আগুন জ্বালানোর কাজটা হয়ে ওঠেনি।

তো, ওখানেই কোনও যাত্রী গল্প করতে-করতে অন্য একজনকে বলল—আরে, কথায় আছে না, জয়নগরের মোয়া, সাদুমের পোঁয়া।

সাদুম?

লোকটাকে একবার জিগ্যেস করল—যেটা বললেন ওটার মানে কী দাদা?

লোকটা হাসল। পাশের লোকটাও। বলল, এসব আমাদের ঘরের কথা। দেখে মনে হয় দু’টো লোকই ছোটখাটো কাজ করে।

—মানেটা কী?

–বলা যাবেনি। সবার সামনে বলা যায়? মঞ্জুর দিকে চোখটা ঘুরিয়ে নিল।

অনিকেতের ইচ্ছে হল—লোকটাকে আলাদা ডেকে নিয়ে জিগ্যেস করে। কিন্তু যেহেতু এই প্রবাদটা মানুষের পিছন-দিক সম্পর্কিত, তাই খুব বেশি উৎসাহ দেখাল না তখন।

একটু পরে লোকটা বিড়ি খেতে দরজার ধারে গেল। অনিকেতও গেল। বেশি উৎসাহ দেখালে ওরা ভাবতেই পারে অন্য কিছু, ভাবুক গে।

জিগ্যেস করল—’সাদুম’ নামে সত্যি-সত্যি কোনও লোক আছে না কি?

লোকটা বলল, সাদুম কোনও লোক নয়। একটা গাঁয়ের নাম।

–গ্রাম? ওই গ্রাম নিয়ে একটা প্রবাদ তৈরি হয়ে গিয়েছে!

লোকটা মাথা নেড়ে বলল, হুঁ। ও-গাঁয়ের লোকেদের খুব বদনাম।

অনিকেত জিগ্যেস করল, গ্রামটা কোথায়?

লোকটার চোখে কারুকার্য তৈরি হয়। ভ্রু উঁচিয়ে অনিকেতের দিকে তাকায়। অনিকেত পড়তে পারে—কেন? ও গাঁয়ে যাবা না কি?

অনিকেত জিগ্যেস করল, ওই গাঁয়ের এরকম বদনামের পিছনে কোনও গল্প-কথা আছে? লোকটা কী বুঝল কে জানে? বলল, গপ্পো-কথা নয়। এখনও ও-গাঁয়ের সঙ্গে কেউ বিয়ে শাদির কাজ করতে চায় না।

—গাঁ-টা কোথায়?

লোকটা এবার সত্যিই জিগ্যেস করে, কেন, যাবেন না কি?

অনিকেত বলে, হ্যাঁ, পারলে যাব, একটু দেখে আসতাম। এরপর কৈফিয়ত দেওয়ার মতো বলে—আমি সাংবাদিক কিনা….

সাংবাদিক? তাই বলি, আপনাদের সঙ্গে তো মন্ত্রীমণ্ডলীর দেখাশোনা হয়, একটু বলে দেবেন ছ্যার—আমাদের দিকে পানিতে খুব আচ্ছেনিক, এই দেখুন নখের রং কালো, হাতের চামড়া কেমন হয়ে গিয়েছে, বারুইপুর ব্লক, আমাদের গাঁয়ের নাম গোমতা, আশপাশের নদাখালি, গজুলা—এসব অঞ্চলেও এমনধারা

অনিকেত বলল—সে নাহয় হবে…বলেই চুপ করে গেল।

ওর মনে হল কোনটা বেশি ইম্পর্ট্যান্ট?—সাদুমের পোঁয়ার তত্ত্বতালাশ না জলের আর্সেনিক? ‘সে না হয় হবে, আগে সাদুমের কথা বলো’—এই কথাটাই বলতে যাচ্ছিল, বলতে পারল না। মিথ্যে কথা বলল। বলল, লিখে দেব।

কোন কাগজ ছ্যার?

বানিয়ে একটা বড় কাগজের নাম বলে দিল। তারপর জিগ্যেস করল, সাদুম কোথায়?

লোকটা বলল—ওই তো বাশুলডাঙা থেকে যেতে হয়। ডায়মন্ডহারবারের দু’স্টেশন আগে। গঙ্গার ধারে। এমনিই একটা বদনাম রয়ে গিয়েছে—ও কিছু নয়।

অনিকেত সেদিন মনে-মনে ভেবেছিল—একদিন আসবে। বাশুলডাঙা স্টেশনে নেমে ভ্যান-রিকশা করে যাবে ওই গ্রামে। যাওয়া আর হয়নি। গিয়ে কী দেখত? কয়েকটা চায়ের দোকান, উঠোনে ছাগল নাচছে, হাঁস প্যাকপ্যাক করছে পুকুরে, কুঁজো ইমাম সাহেব লুঙ্গি- গেঞ্জিতে, দাড়িতে হাত বুলোচ্ছে। ইমাম সাহেবকে যদি জিগ্যেস করত—জয়নগরের মোয়ার মতো তোমাদের গ্রামের পোঁয়া প্রসিদ্ধ হল কেন? কী বলত কে জানে?

তখনই মনে এসেছিল গ্রামটার নাম ‘সাদুম’ কেন? কথাটা ‘সাদোমি’ থেকে আসেনি তো? ‘সাদোমি’ আরবি শব্দ হলেও এখন ইংরেজিতেও চলে এসেছে—–সোডোমি। হোমো- সেক্সুয়ালিটি বোঝায়। আরবের দেশগুলোতে সাদোমি-র শাস্তি কোথাও চাবুক মারা, কোথাও পাথর ছুড়তে-ছুড়তে মেরে ফেলা। ‘সাদোম’ ছিল আরবের একটা জনপদ। কোনও ভ্ৰাম্যমাণ বেদুইন জাতি ওই জনপদের বহু মহিলাকে লুঠ করে নিয়ে গিয়েছিল। ওখানে তাই নারীর অভাব ঘটেছিল। তখন পুরুষরা পুরুষদের সঙ্গে যৌন-কাজে রত হত।

এটা আল্লাহ্তালার অভিপ্রায় নয়। ফলে তিনি ‘সাদোম’-এর মানুষদের ওপর ভীষণ রেগে গেলেন। তাঁর গজবে আসমান থেকে পাথরবৃষ্টি হল। সাদোম শহরের মানুষরা মারা গেল। সাদোম ধ্বংস হয়ে গেল।

সাদোম-এর নাম থেকেই পুরুষের সমলিঙ্গের যৌনতাকেই ‘সাদোমি’ বলা হয়।

কোথায় আরব, আর কোথায় ডায়মন্ডহারবার। এই ডায়মন্ডহারবারের কাছে কোনও গ্রামের নাম সাদোম। ‘সাদোম’নয় ঠিক—সাদুম। এই অঞ্চলে মুসলমানের সংখ্যা বেশি। লোকটা তো আর্সেনিক বলেছিল জলে নয়, পানিতে। যে-গ্রামটার নাম সাদুম, আগে কি অন্য কোনও নাম ছিল? নদীর পাড়ের এই গ্রামটাতে কি ফিরিঙ্গি হানা হত? পর্তুগিজ দস্যুদের? কিংবা মগ হানা? কখনও কি ওই গ্রামের যুবতী মেয়েদের লুঠ করে নিয়ে যায় ওরা? তারপর কি ওরা সমলিঙ্গে যৌনতা করত? গ্রামটার নাম পাল্টে গেল, সাদোম হয়ে গেল? আর জন্ম নিল ওই প্রবাদবাক্যের?

এসবই কল্পনা। ওই যে মাটির তলায় পাওয়া বহুচেরা মায়ের মূর্তি—এরও তো ইতিহাস আছে। যদি কল্পনা করা যেত, সায়েন্স ফিকশন তো হয়। ফিশনাল হিস্ট্রি হয় না?

এত কথা উঠে এল সেই ধাপধাড়া গোবিন্দপুর প্রসঙ্গে।

বেচারা শুক্লা। ওর কোনও সাধ-আহ্লাদ নেই। দামি শাড়িও কেনে না, লিপস্টিকও লাগা না ঠোঁটে। বাচ্চা-কাচ্চা হয়নি বলে বক্ষসৌন্দর্য এখনও বেশ ভাল। কিন্তু এরকম হলে কী হয়? ও যাবে স্বামীসেবা করতে। স্বামীর খাওয়াদাওয়ার দিকে নজর রাখতে। জামা-গেঞ্জি-জাঙিয়া কেচে দেবে বলে।

শুক্লা বলল—তুমি যখন বাইরে ছিলে, দুলালের মা দু’দিন আসেনি। আজ সকালে এসেছিল। বলল, দুলালের খুব পেচ্ছাপের কষ্ট হচ্ছে।

–হোক গে।

বলল বটে, কিন্তু পরদিনই গেল দুলালের বাড়ি।

দেখল দুলাল চিত হয়ে শুয়ে আছে, লুঙ্গি খোলা, আর ওর দুই পায়ের ফাঁকে একটা শীর্ণ, দীন ভিখিরির মতো সরু নুনু। নুনু নয়, একটা সরু পাইপ। রবারের। একটা রবারের পাইপ ওর মূত্রছিদ্রের থেকে ইঞ্চিদুয়েক বেরিয়ে আছে। ওর লিঙ্গ, অণ্ডকোষ কিছু নেই। জমাট অন্ধকারে কিছু খাংলা চুল, আর লজ্জানত একটু পাইপ। আসলে ক্যাথিটার। দুলাল চোখ বুজে শুয়ে আছে। ওর মা বলল, পেটের ভিতরে সুপুরি ফুলেছে বলে পেচ্ছাব আটকে গিয়েছে। ডাক্তার এসে পাইপ লাগিয়ে দিয়েছে। আমাকে দেখিয়েও গিয়েছে। আমি মা হয়ে এখন ওর এসব জায়গায় হাত লাগাই। কিছুই তো নেই। আমার আর লজ্জা কী! লজ্জা হলেও-বা কী করব? আর কে আছে?

অনিকেত বুঝল—ওর প্রস্টেটে কিছু হয়েছে। দুলালেল দেহের বাইরে-ঝোলা পুরুষ অঙ্গগুলিকে ছাঁটা হয়েছে। কিন্তু পেটের ভিতরেও তো পুরুষ-অঙ্গ আছে—প্রস্টেট। ওটা তো থেকেই গিয়েছে। এখন শেষকালে ওটাতেই গন্ডগোল হল?

—একটু ওধার মুখে করে থাকো দাদাবাবু—দুলালের মা বলল।

দুলালের মা একটা কন্ডোম বার করেছে। মোড়কটা খুলবে। অনিকেত অন্যদিকে মুখ করে রইল। ওই রবারের পাইপটা কন্ডোমে ঢোকাবে। এরপর গার্ডার দিয়ে টাইট করবে। ফোঁটা-ফোঁটা পেচ্ছাপ কন্ডোমে জড়ো হবে। কন্ডোমটা ফুলে গেলে আবার নতুন একটা।

কেই বা করাবে? আয়া রাখার টাকা নেই। তা ছাড়া আয়ারা করবেই বা কেন? এড্‌ড্স না?

দুলালের মায়ের ক্যাথিটারে লজ্জা নেই, লজ্জাটা কন্ডোমে।

দুলালের মা বলল, হয়ে গিয়েছে।

অনিকেত দুলালের মা-কে দেখল। চোখে কোনও কাপড় বাঁধা নেই, তবু মনে হয় ও গান্ধারী।

দেখল দুলালের দু’পায়ের ফাঁকে লজ্জায় গুটিয়ে রয়েছে একটা ফ্যাকাশে কন্ডোম।

এই ক্যাথিটার কে পরিয়ে দিয়েছে? অনিকেত জিগ্যেস করল।

দুলালের মা উনুনের মুখের মতো মুখ করে তাকিয়ে রইল।

—ক্যাথিটার’ মানে হল রবারের পাইপ। ওটা কে পরাল?

—ডাগ্‌দার বাবু। গজা ডাগ্‌দার। একশো নিল।

এই অঞ্চলে গজা ডাক্তারের নাম-যশ আছে। পাস করা ডাক্তার নন, বিপদে-আপদে উনিই ভরসা। নিশ্চয়ই গজেন্দ্র কিংবা গজানন টাইপের কোনও নাম আছে।

—আর কী বলল ডাক্তার?

দুলালের মা বলল, আলাসোনা করতে হবে।

বোধহয় আলট্রাসোনোগ্রাফ বোঝাতে চাইছে।

—লিখে দিয়েছে কিছু?

একটা কাগজ দেখাল। ডা. জি সি মণ্ডল। এমডি (এএম) তিনটে চেম্বার। মোবাইল ফোন নম্বরও আছে।

অনিকেতের এখনও নিজস্ব মোবাইল ফোন নেই।

—আর কী বলল ডাক্তার? দুলালকেই জিগ্যেস করল অনিকেত।

দুলাল লজ্জা-লজ্জা মুখ করে বলল—পটেস ফুলেছে বলল। বলার সময় একটা হাত দিয়ে একবার লজ্জাস্থান ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা করল, যদিও একটা চাদরে ঢাকাই আছে। ঢাকার তলায় কেটে ফেলা লিঙ্গস্থানের মূত্রছিদ্রটা থেকে একটা সরু পাইপ বেরিয়েছে, কন্ডোমের সঙ্গে বেঁধে দেওয়া, ওখানে জমা হচ্ছে পেচ্ছাপ, ভর্তি হয়ে গেলে দুলালের মা পাল্টে দেয়। এটা নিশ্চয়ই গরিবি ব্যবস্থা। ডা. মণ্ডলের ‘এএম’ ব্যবস্থা।

ডা. মণ্ডলের নামের পাশে ‘এমডি’ লেখা ছিল, তারপর ব্র্যাকেটে ‘এএম’। মানে ‘অল্টারনেটিভ মেডিসিন’।

১৯৮৭-৮৮ থেকে অনেক অল্টারনেটিভ মেডিকেল কলেজ তৈরি হয়েছে। কোনও কোনও কলেজের ক্লাস হয় মনসামন্দিরে, কোথাও-কোথাও ক্লাস হত সন্ধের পর কোনও প্রাইমারি স্কুলের বারান্দায়। ইস্টার্ন জোনাল ইউনিভার্সিটি অফ অল্টারনেটিভ মেডিসিন’-এর অ্যাডমিশন সেন্টার-টা বারাসত রেল প্ল্যাটফর্ম-এর একটা হকার ইউনিয়নের ঘরে। ‘সাউথ বেঙ্গল মেডিকেল কলেজ অফ অল্টারনেটিভ মেডিসিন’-এর কর্পোরেট অফিসটা রয়েছে আমতলা বাজারের বকুল গাছের তলায় নকুলের চায়ের দোকানে। ওসব শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপক ছিলেন অভিজ্ঞ হাতুড়েরা। তাঁরা পেট খারাপ হলে থানকুনি পাতার রসে এন্ট্রোকুইনল-এর গুঁড়ো মিশিয়ে খাওয়ানোর বুদ্ধি দেন। ডায়াবেটিস সন্দেহ হলে গরিব মানুষকে প্যাথোলজি টেস্ট করতে পরামর্শ দেওয়ার আগে রোগীর প্রস্রাবে শুকনো ইটের টুকরো ভিজিয়ে বাইরে রেখে লক্ষ করেন পিঁপড়ে ধরে কি না। ইঞ্জেকশন দেওয়া, সেলাই, ব্যান্ডেজ এসব অবশ্য ভালই শেখানো হয়। ‘ঋতুবন্ধে পাঁচ মিনিটে আরোগ্য’—বিজ্ঞাপন দেয় যেসব নার্সিংহোম, সেখান থেকে অ্যাবোরশন মাস্টারদের ধরে আনা হয়। ওঁরা ওঁদের অভিজ্ঞতার ঝুলি উজাড় করে পড়ান। দাই-রা গাইনোকোলজি-র কিছু-কিছু ক্লাস যত্ন-সহকারে নিয়ে থাকেন, সঙ্গে কিছু অ্যাডিশনাল সাইকো-টেকনিক। যেমন কোনও মেয়ে গর্ভ-যন্ত্রণায় খুব চেঁচাচ্ছে। থামানোর উপায় হল—’এখন চ্যাঁচাচ্ছ কেন? করার সময় মনে ছিল না?’ ধমকে বলতে হবে, এবং বলার সময় ‘করা’ ব্যাপারটাকে আঙুলের মুদ্রায় দেখিয়ে দিতে হবে। তা হলেই ওরা চিৎকার থামিয়ে দেয়। এরকম নানা ধরনের টিপ্‌স ওঁরা দিয়ে থাকেন।

আমাদের দেশ-গাঁয়ের হাসপাতালে পাস করা ডাক্তাররা যেতে চান না। এঁরাই যা হোক করে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাটা টিকিয়ে রেখেছেন। কিন্তু খাজাইতলা তো এমন কিছু দূর নয়। ইস্টার্ন বাইপাস থেকে ছ’সাত কিলোমিটার মাত্র দূর। বিরাট-বিরাট বেসরকারি হাসপাতাল তৈরি হয়েছে। ক্যাপসুল লিফ্‌ট-এ চড়ে মানুষজন ওসব হাসপাতালের ওপরে উঠে যায়, ওসব হাসপাতালের সামনে হলঘর থাকে, ওখানের মেঝে চকচকায়। দুলালের ‘আলাসোনা’-টা ওরকম কোনও বড় জায়গায় গিয়ে করতে হবে। দেখতে হবে ‘পটেস’ কতটা ফুলেছে।

‘পটেস’ মানে হল প্রস্টেট। প্রস্টেট গ্ল্যান্ড। এটা নিতান্তই পুরুষের সম্পত্তি। মেয়েদের থাকে না। মুত্রথলি, মানে ব্লাডারের একটু তলায়, নারকোল কুল আকৃতির এই গ্ল্যান্ডটা গোপনে থাকে। বাইরে থেকে এই পুং-যৌনাঙ্গ দেখা যায় না। যারা ‘ছিবড়ি’ হয়, মানে ক্যাস্ট্রেশন করে, তারা দৃশ্যমান পুরুষ-যৌনাঙ্গই কেটে ফেলে। প্রস্টেট-টা রয়ে যায় ভিতরে। থেকে গিয়ে ভালই হয়, ক্ষতি করে না কোনও। প্রস্টেট-এর অনেক কাজ। শুক্র তৈরির কারখানা হল অণ্ডকোষ। ওখান থেকে শারীরিক বৈশিষ্ট্য বহন করার দায়িত্ব-সম্পন্ন জিনগুলো থাকছে ২৩টা ক্রোমোজোম-এ। শুক্রকীট ওই ২৩টা ক্রোমোজোম বহন করে। প্রস্টেট-এর মধ্যে তৈরি হয় শুক্রকীট-কে আশ্ৰয় দেওয়ার প্রশ্রয়-তরল। সামান্য ক্ষারীয়। এই প্রস্টেট তৈরি করে পিচ্ছিল তরল, যা কামভাবাচ্ছন্ন পুরুষের শিশ্ন ভেজায়। ক্যাচড়া বইয়ে যার নাম ‘মদন জল’। যারা ‘ছিবড়ি’ হয়, যাদের দু’পায়ের ফাঁকে কিছু মায়াময় অন্ধকার শুধু, অন্ধকারের আহ্লাদ মাখিয়ে রাখে ত্রিকোণ ভূমিতে, ওখানে কর্তিত পুংলিঙ্গের স্মৃতিচিহ্নের মতো ছিদ্রমাত্র—সেই ছিদ্র দিয়েই তো প্রস্রাব আসে।

‘ছিবড়ি’-মানুষেরা নারীর মতো বসে-বসে প্রস্রাব-কর্ম করতে পারে বলে মনে-মনে পুলকিত থাকে। আর ওই মায়াবী স্মৃতির মতো ছিদ্রটিও কখনও-কখনও সিক্ত হয়ে ওঠে কামনায়, যৌন- ইচ্ছায়। প্রস্টেট-ই তো পাঠায় সেই কামনার গূঢ় রস।

এই ছোট যন্ত্রটার আরও কত কাজ। প্রস্টাগ্লান্ডিন নামে একটা হরমোন তৈরি করে। তা ছাড়া এটা একটা অদ্ভুত ভাল্‌ব। মূত্রথলি থেকে মূত্রনালী প্রস্টেটের ভিতর দিয়েই আসে, তারপরে পেচ্ছাপের পাইপে যায়, পুরুষের ক্ষেত্রে এটা একইসঙ্গে জনন নল এবং মূত্র নল। দু’টো শুক্র থলি থেকেও দু’টো শুক্রনালী প্রস্টেট-এ এসেই থামে। তারপর প্রস্টেট-ই তো নিজের ছোট্ট শরীরে চাপ দিয়ে বীর্যক্ষেপণ করায়। প্রস্রাব এবং বীর্যক্ষেপণ দু’টো ব্যাপারই চালিত করে প্রস্টেট। মেয়েদের এই ঝামেলা নেই, কারণ ওদের মূত্রছিদ্র আলাদা।

প্রস্টেট নানা কারণে বড় হয়। কর্মক্ষমতা কমতে থাকলে বেড়ে যায়। ক্যানসার হলে হয়, অন্য সংক্রমণেও হয়। প্রস্টেট-এ ক্যানসার হলে অনেক ক্ষেত্রে অণ্ডকোষ বাদ দেওয়া হয়। দেখা গিয়েছে অণ্ডকোষ যাদের নেই, তাদের প্রস্টেটে ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। এসব অনিকেত জেনেছে এধার-ওধার পড়াশোনা করে।

তবে আর একটা চমকপ্রদ জিনিস জেনেছিল পবন, রঞ্জন এসব শিক্ষিত ‘গে’র সঙ্গে কথা বলে, এবং ‘গে’-দের পত্রিকা পড়ে। সেটা হল Male G Point। ‘G’ পয়েন্ট-টা নাকি সুখের উৎস। যেসব ‘গে’ বটম, যারা পায়ুমেহন করিয়ে সুখ পায়, তাদের সুখের অনেকটাই দেয় ‘জি পয়েন্ট। পায়ুনালীর ভিতরের দেয়ালের ওধারে যেখানে প্রস্টেট গ্ল্যান্ড লেগেছে, সেখানে যদি ঘর্ষণ হয়, তখন নাকি প্রস্টেট-এ একটা জাগরণ হয়, একটা কম্পন হয়, ‘গে’-দের কেউ-কেউ এই অনুভূতিকে বলে ‘মিস্ট’। মানে মিস্টিক অর্গ্যাজ্‌জ্ম। কী করে পায়ুনালীর দেওয়ালের ওধারে প্রস্টেট-এর স্পর্শস্থল বোঝা যাবে, ওসব বইতে ছবি দিয়ে বর্ণনা করা আছে। ডাক্তারবাবুরাও তো প্রস্টেট বড় হয়েছে কি না বোঝেন পায়ুছিদ্রের ভিতরে আঙুল চালিয়েই।

অনিকেতের ওপরই দুলালের ‘আলাসোনা’ করার দায়িত্ব। ও না নিয়ে গেলে কে নিয়ে যাবে? দুলালের ওপর রাগ হয়। যত্তসব ঝামেলা পাকাচ্ছে। তার আগে গজা ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলা দরকার।

গজা ডাক্তারের টিনের চালার চেম্বারে টিনের সাইনবোর্ডে রেড ক্রস, লেখা ডা. জি সি মণ্ডল এমডি, এএম। জটিল রোগ ও গুপ্ত রোগের চিকিৎসা করা হয়, আয়া সরবরাহ করা হয়, ঋতুবন্ধের সমাধান করা হয়। চেম্বারের সামনে কয়েকটা সাইকেল ও ভ্যান, এবং একটা লাল ক্রস লাগানো মোটরসাইকেল। বোঝাই যাচ্ছে ওটা ডাক্তারবাবুর গাড়ি। কচুঝোপের পাশে একটা মাছি-ভনভন প্লাস্টিকের বালতি। ভিতরে দু’টো বেঞ্চি পাতা। ওখানে চার-পাঁচজন রোগী বসে আছে। সামনে বাঁশের বেড়ার পার্টিশন, দরজা নেই, পরদা। পরদা সরিয়ে ভিতরে ঢুকল অনিকেত। একটা রোগীর পেটে হাত দিয়ে টিপছেন গজা ডাক্তার, লাগছে?

—খুব লাগছে।

–লাগবেই তো। পেটের পাঁচ-নম্বর ট্যাঙ্কি তো জ্যাম। ক’দিন হাগো না?

—চার-পাঁচদিন।

—মাল খাও?

—আজ্ঞে।

—কতটা?

—বেশি না, এক পাঁইট।

–কী চাট খাও?

—এই দু’টি ছোলা, বেগুনি, ফুলুরি—

—ওসব চলবে না। পাকা বেল দিয়ে খাবে।

–বেল দিয়ে?

—খুব ভাল। খারাপ লাগবে না। ঢ্যাঁড়শ সেদ্ধ খাও। জল বেশি করে খাও। সকালে হাগতে বসার আগে আঙুলে করে পোঁয়ার ভিতরে নারকেল তেল দিয়ে দ্যাখো, যদি না হয়, পোঁয়ায় গ্লিসারিনের স্টিক ঢোকাতে হবে। বলি কত—বাংলা না-খেয়ে মাঝে-মধ্যে রাম খা। বাংলা মাল গু শুকিয়ে দেয়।

অনিকেতের দিকে তাকিয়ে গজা ডাক্তার কপাল কুঁচকে জিগ্যেস করলেন, কী চাই? ওকে দেখে সম্ভাব্য পেশেন্ট মনে হল না ডাক্তারবাবুর।

অনিকেত বলল—ওঁকে দেখে নিন, পরে আসছি। ডাক্তার বললেন—দেখা হয়ে গিয়েছে। আপনার কী চাই?

ডাক্তারের পিছনের দেওয়ালে একটা মা কালীর ছবি। ছবিতে মালা। একটা চামড়া-খোলা মানব শরীর। শরীরে ভিতরের যন্ত্রপাতি দেখা যাচ্ছে, সেই ছবিতেও মালা। এক বৃদ্ধের ছবি। ওঁর বাবা, না শিক্ষাগুরু, না কি দীক্ষাগুরু বোঝা যাচ্ছে না। সেই ছবিতেও মালা। আর একটা পোস্টার, ‘আজ নগদ, কাল ধার। ধারের পায়ে নমস্কার।’ ওটায় মালা পরানো নেই।

অনিকেত বলল—খাজাইতলায় দুলাল নামে এক পেশেন্ট-কে দেখেছিলেন? ওকে ক্যাথিটার পরিয়ে দিয়েছেন, বলেছেন আল্‌ট্রাসোনোগ্রাফ করতে হবে, আমি ওখান থেকেই আসছি। দুলালের মা আমাদের বাড়িতে কাজ করে।

ডাক্তারবাবু রোগী দেখার টুল দেখিয়ে বললেন, বসুন, বসুন স্যর, এখানে বসুন। আপনি তো দেখছি মহাপুরুষ লোক মশাই।

ডাক্তারের পরনে নীল ফুল প্যান্ট, লাল ফুল শার্ট, গলায় মাফ্লার এবং স্টেথো।

উনি বলতে থাকলেন—আমি তো আল্‌ট্রাসোনো করতে লিখে এসেছি, জানি ওসব করা হবে না, মুত্রকৃচ্ছ হয়ে মরবে। তা, আপনি ওর তত্ত্বতালাশ করছেন না কি?

—ওই একটু। কী হয়েছে?

—হয়েছে তো অনেক কিছুই। প্রস্রাব বন্ধ। ওই যন্তরটা তো কেটে ফেলেছে, জানেন নিশ্চয়ই। ওই গর্তের ভিতরে কিছু মাংস গজালো কি না, কে জানে। আঙুল তো ওখানে ঠিক ঢোকে না, ব্যাটাছেলেদের ওই ছ্যাঁদাটা সরু কিনা, তবে ক্যাথিটার ঢোকানোর সময় বাধো বাধো লাগছিল। এছাড়া সুপুরিটাও দেখলাম। মানে, প্রস্টেটের কথা বলছি। ওর বডিতে সুপুরির সাইজ বোঝাটা খুব সুবিধে। পেছনটা তো একেবারে হাঁ করা। নিশ্চয়ই বোঝেন কেন এমন হয়েছে। ওখানে আঙুল ঢুকিয়ে ‘প্যালপিটিশন’ করেই বুঝে গেলাম।

‘প্যালপিটিশন’ করলেন? অনিকেত অবাক হয়ে জিগ্যেস করে।

—না, মানে প্যালপেট, প্যালপেট। আঙুল চালিয়ে বুঝে গেলাম সুপুরি ফুলেছে। কেন বড় হয়েছে, কী বৃত্তান্ত—ওসব তো দেখতে গেলে খরচা আছে। আর কোন দিক সামলাবেন ওর? ওর সব ট্যাঙ্কিতেই গোলমাল। সাত জায়গায় ফুটো, তালি মারবেন ক’টা? মোক্ষম রোগটা তো বাঁধিয়ে এসেছে। ও গাঁয়ে তো আমার পেশেন্ট আছে, সব জানি। আমি বলেই ও-বাড়ি গিয়েছি। পাস করা ডাক্তার হলে যেত? তা ছাড়া নোপেনিস পেশেন্ট দেখিনি কিনা, তিরিশ বছর ডাক্তারি করছি…, কত কেস আসে, নোপেনিস কেস পাইনি।

—নোপেনিস মানে? কোন অসুখ?

—অসুখ বললে অসুখ, না বললে নয়…

–বুঝলাম না ডাক্তারবাবু।

—বুঝলেন না? নো-পেনিস, মানে ‘ধন’ কেটে ফেলা পেশেন্ট আর কী…। ডোন্ট মাইন্ড

—তি-রিশ বছর ডাক্তারি করছেন। যেটা পাস করেছেন, ‘এমডি’, ওরকম এমডি তো বেশিদিন বেরয়নি…

–ধুর! নিকুচি করেছে এমডি। ওসব পড়ে কি ডাক্তারি শেখা যায় নাকি? যাদব ডাক্তারের কম্পাউন্ডারি করেছি দশ বছর। হাতটা মাথায় ঠেকালেন, ছবিটার দিকে তাকালেন।

উনি তা হলে শিক্ষাগুরু। বোঝা গেল।

—উনি নিজে হাতে ধরে ইনঞ্জেকশন দেওয়া শিখিয়েছেন, প্রেশার মাপা, পেট-খসানো, ডুস দেওয়া, স্যালাইন চালানো—সব শিখিয়েছেন। পেট টিপে আমি বুঝতে পারি রোগীর কত নম্বর ট্যাঙ্কিতে ব্যাগড়বাই। যাকগে যাক, নিজের কথা কইব না। সবাই জানে গজা ডাক্তার কেমন ডাক্তার। তবে আপনার পেশেন্টের হ্যাপা আছে। গায়ে চাক-চাক দাগ, সারা শরীরে মটর ফুলেছে। মানে, লিম্ফ গ্ল্যান্ডগুলোর কথা বলছি। ওর পেছনে টাকা ঢেলে কোনও লাভ নেই।

গজা ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে অনিকেত ফাঁপরে পড়ল। ওর কী করা উচিত? যাকগে, মরুকগে, বলে হাত ধুয়ে নেবে? না কি কোনও বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে?

আকাশবাণী-তে কাজের সূত্রে বেশ কিছু ডাক্তারের সঙ্গে পরিচয় আছে অনিকেতের। ওঁরা স্বাস্থ্য-টাস্থ্য নিয়ে প্রোগ্রাম করেন। কেউ-কেউ আবার জনহিতকর কাজের সঙ্গে যুক্ত, কেউ- কেউ জনস্বাস্থ্য আন্দোলন করেন। এরকম একজন ডাক্তার—সমীর প্রধান। সমীর প্রধানের ভিতরে একটা গবেষক মনও রয়েছে। মূলত মেডিসিনের ডাক্তার, গবেষণাপত্রও নাকি লেখেন। সমীরবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করল অনিকেত। সব জানাল। সমীরবাবু বললেন—হাসপাতালে নিয়ে আসুন।

ট্যাক্সিতে দুলালের সঙ্গে দুলালের মা-ও ছিল। এই সুযোগে দুলালকে অনিকেত জিগ্যেস করল—তুমি মাজারে এসেছিলে কেন? বলবে বলেছিলে, কিন্তু বলোনি।

—পুলিশকে বলেছি।

—পুলিশকে বললে কী হবে? আমি জানতে চাইছি; আমাকে বলো। আমাকে বলছ না কেন?

—আপনার শুনে কী হবে?

—তোমার মা-কে বলেছ?

দুলালের মা বলল—আমাকেও কয়নি কো, শুধোলে গুম মেরে থাকে।

অনিকেত বলল—তোমাকে ঘটনাটা বলতেই হবে। তোমার জন্য এত করছি দেখছ না?

এসব তো জানা দরকার আমার।

দুলাল বলল—বউটা একবারের জন্যও এল না…।

অনিকেত বলল—বউ আসবে কেন? ওর সঙ্গে কি যোগাযোগ আছে নাকি? ও কি জানে তোমার কী হয়েছে? দুলাল মাথা নাড়ে।

—তুমি কি তোমার বউয়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলে?

দুলাল মাথা নাড়ে।

—তবে?

আমি গুরুমার কাছে শুনেছিলাম, খাজাইবাবা খুব জাগ্রত। বললে কথা শোনে। আমাদের গুরুমা একসময় এদিকে বাঁধাই খাটতে আসত। তাই শুনে বাবাকে মনস্কামনা জানাতে এসেছিলাম। ভেবেছিলাম এরপর বাড়ি যাব। বাড়িতেই থাকব। বউটাকে খবর দেব, যদি আসে। কিছু ‘ঝলকি’ নিয়ে এসেছিলাম, ভেবেছিলাম দিয়ে দেব।

‘ঝলকি’ মানে পয়সা-কড়ি, তাই তো? বউটাকে কী করে খবর দেবে? তুমি তো জানো না বললে ও কোথায় আছে।

—সন্তোষ জানে। সন্তোষ তো আসত। আমি তো ভাল পারতাম না, সন্তোষ ধুরে যেত। আমি কিছু বলতাম না। সন্তোষ আমার মহাজন। বলেছিলাম না?

—সন্তোষ কোথায় আছে?

ঠোঁট উল্টে দিল দুলাল।

—তা হলে যে বললে সন্তোষের খোঁজ করবে?

—সেটা খোঁজ-খবর নিয়ে জানা যেত।

মা বলেছিল, তুই চলে যাওয়ার পর সন্তোষ তো আসতই, সে বাদে আরও দু-তিনজন আসত। বেশি আসত একটা কেলে মতো। ওদের নাম জানি না।

দুলাল বলল, সন্তোষকে জিগ্যেস করলে সব জানা যেত।

অনিকেত প্রায় বলতে যাচ্ছিল—’তা হলে সন্তোষকে খুঁজে বার করি, ওর ডেরা কোথায়? কোথায় থাকে বলো’—বলবে নিজের মনের ভেবে ‘প্লে’-টা টিপেই আচমকা ‘স্টপ’ বোতাম টিপে দিল। আবার কেন ঝামেলায় জড়াতে যাচ্ছে? অনেক হয়েছে, আর না। এরপর রি- ওয়াইন্ড-টা টিপে বলল—মাজারে তোমাকে ছুরি মেরেছিল কেন?

দুলাল বলল—সঙ্গে টাকা ছিল কিনা। শায়ায় ক’টা পকট বানিয়ে রেখেছিলাম কিছু টাকা, বেলাউজের ভিতরে রেখেছিলাম কিছু। ওরা বলল, মালকড়ি দিয়ে দে। আমি বললাম কেন দেব, তিল-তিল করে জমিয়েছি। ওরা বলল—পালিয়ে এসেচিস, গুরুমা-র টাকা-পয়সা ঝেঁপেছিস—দিয়ে দে। আমুও দেব না, ওরা দু’জন ছিল, তখন কাড়াকাড়ি হচ্ছিল, হঠাৎ ছুরি মেরে দিল পেটে, আমার শায়াটা টেনে খুলে নিল। শায়ায় অনেকগুলো পকট ছিল। দশ-বিশ- পঞ্চাশ-একশো—টাকার নোট। পাঁচশোর কাগজ বেশি ছিল না। ওইজন্য বান্ডিল মোটা হয়ে গিয়েছিল। তাই জন্য ভাগ-ভাগ করে রেখেছিলাম। বিশ হাজারের ওপর। তিল-তিল করে জমিয়েছিলাম। সব ‘ঝিটে’ নিল।

—কখন নিল টাকাগুলো?

—তখন রাত হয়েছে, বেশি না, সাড়ে সাতটার মতো হবে। দুপুরের দিকে খোল থেকে বেরিয়েছিলাম কিনা…।

—যারা টাকাটা কেড়ে নিয়েছে ওদের চিনতে পেরেছিলে?

—ঠিক চিনতে পারিনি। পুলিশও বহুত শুধিয়েছিল, মিথ্যে বলব কেন?

—আন্দাজ করতে পারো দুলাল? সন্দেহ হয় না কাউকে?

—সন্দেহ একটু যাকে হয়, সে আমার ‘পারিক’। সেই আমাকে এড্‌স রোগটা দান করেছে মনে হয়।

দুলাল ট্যাক্সির মাঝখানে বসেছিল। একদিকে অনিকেত, অন্যদিকে ওর মা। দুই পাশে দুই কলাগাছ, মধ্যিখানে মহারাজ।

দুলাল অনিকেতের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, ওর বাটু-চিপটি সব চলত। বউ আছে ওর।

অনিকেত বলল, তুমি কি কেবল ওকেই বাড়ু দিতে নাকি?

–শেষের দিকে ওকেই একা। বেশি ধুরপট্টি করতাম না। ওরও আমার অসুখ হয়েছে বোধহয়। খুব শরীল খারাপ যাচ্চে।

—সেটা তো তোমার থেকেও ওর হতে পারে। অনিকেত বলল।

—কে জানে? লোকটা তো এক লম্বরের ধুরবাজ ছিল, যেখানে খুশি ঝিন্নি ঝরাত। ওর তো খুব জ্বরজারি, পেটখারাপ হত।

—তোমার যে এই রোগ হয়েছে বুঝলে কী করে?

—এটা তো আপনারা বললেন। এখানে আসার পর।

–তোমার ওখানে শরীর খারাপ লাগত না?

—খুব। গায়ে মটরদানা বেরল। তারপর জ্বর। সবসময় ভোঁ-ভোঁ করত। তখন মনে হল, আর বাঁচব না। ভাবলাম, এখানে না-মরে দেশে গিয়েই মরি। বউ না পাই, মা আছে, ছেলেটা আছে। ছেলেটা আমার না সন্তোষের কে জানে, সন্তোষেরই হবে হয়তো, হোক গে। নিজের ভাবলেই নিজের।

মনের কথা যদুকে বলেছিলাম। যদু আমার ‘পারিক’। লছমন যাদব। ওকে যদু বলে ডাকতাম। আর কাউকে বলিনি।

—ওকে কি বলেছিলে কবে তুমি খোল ছাড়ছ?

—না, যদুই বলেছিল এদিককার লীলা খতম করে ঘর ওয়াপস চল যাও। যদুই বলেছিল, ওই দিনটা শুভদিন। কী একটা ভাল তিথি আছে।

অনিকেত বলল, বুঝেছি। ও-ই তা হলে লোক পাঠিয়ে তোমার টাকা কেড়ে নিয়েছে। ওরা তোমাকে ‘ফলো’ করেছিল। দুলাল চুপ করে থাকে।

অনিকেত জিগ্যেস করল—পুলিশকে বলোনি যদুর কথা? পুলিশ তোমাকে জিগ্যেস করেনি কাউকে সন্দেহ করো কি না।

দুলাল মাথা নাড়ে। বলে, পুলিশকে বলেছি কিছু জানি না।

—কেন, পুলিশকে তোমার সন্দেহের কথা বললে না কেন?

–বললে কি টাকা ক’টা ফিরত পেতাম?

মাথা নাড়ে দুলাল।

বলে—বে-ফালতু গুরুমাকে হেনস্তা করত পুলিশ। যদুকে পেত না খুঁজে। আমিই কখুনো ওর বাড়ি যাইনি। যদি পেত হেনস্তা করত, ওর থেকেও টাকা খেত, আমার টাকা আমি হার্গিস পেতাম না। পুলিশদের জানা আছে। আমাদের খোলে এসে মাসে-মাসে ঝলকি নিয়ে যেত। আমাদের গুরুমা আবার গাঁজাও রাখত কি না।

—গাঁজা? ওইসব ব্যবসাও করে না কি?

—গুরুমা করত। যদুই তো গুরুমার কাছে এস্টক রাখত। গব্বর, লালু, গুপে, ওরা মাঝে- মাঝে এসে নিয়ে যেত। দু’কিলো চার কিলো সবসময় থাকত। পুলিশ প্রথমে কিছু বুঝতে পারেনিকো, পরে যখন বুঝল, তখন ঝলকি দিতে শুরু করল। যদুর সঙ্গে ওখানেই তো পরিচয় আমার। শেষ লাইনটার উচ্চারণ যেন ‘শরম রাঙ্গা’ টাইপের। যেন ওই বৈশাখে দেখা হল দু’জনায়। গান্ডু একটা…। অনিকেতও রেগে যায় দুলালের ওপর। যত্তসব ঝামেলা বাধিয়েছে।

কিন্তু এবার একটু খটকা লাগল। যদু, মানে লছমন যাদব যদি গাঁজার কারবারই করবে, তবে—মাত্র দশ-বিশ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেবে? দুলাল কি সত্যি কথা বলছে?

অনিকেত জিগ্যেস করল কথাটা।

দুলাল বলল—না গো, যদু টাকা লেয়নি।

কী বলা যায় দুলালকে? কোন খিস্তি ঠিক? অনিকেত কপাল কুঁচকে ওর দিকে তাকায়। একটু জোর গলায় বলে—এই, ঠিক করে বলো, নকশা মারছ? এই বললে যদু নিয়েছে, এখন বলছ যদু লেয়নি কো? কী পেয়েছ আমাকে? অ্যাঁ?

দুলালের মা অনিকেতের হাঁটুতে হাত রেখে বলল—ওকে বোকোনি দাদাবাবু। রোগ- ব্যাধিতে কাতর, ওর কি মাথার ঠিক আছে?

অনিকেত বলল, তোমরাই তো আমার মাথা খারাপ করে দিচ্ছ। যদুকে সন্দেহ করছ, অথচ পুলিশকে বলছ না।

দুলাল বলল, আমি তো বলিনি দাদাবাবু যদুকে সন্দেহ করছি, খালি বলেছি যদু জানে আমি কবে পাইল্যে আসব। যদু হয়তো নেশার ঘোরে কাউকে বলেছিল, সে তার স্যাঙাৎ নে এসে টাকাগুলো ঝিরিয়ে নিয়েছে।

–একবার বললে ‘ঝিরিয়ে’ নিয়েছে, একবার বললে ‘ঝিঁটে’ নিয়েছে। ‘ঝিরিয়ে’ নেওয়া মানে তো টুপি-টাপা পরিয়ে ম্যানেজ করে নেওয়া। আর ‘ঝিঁটে’ নেওয়া মানে জোর করে ছিনিয়ে নেওয়া। আমি তো এটাই জানি। ঠিক বলেছি?

মাথা নাড়ে দুলাল।

—এবার বলো ‘ঝিরিয়ে’ নিয়েছে, না ‘ঝিঁটে’ নিয়েছে?

দুলাল বলল—বললুম তো শায়া-সুদ্ধু খুলে নিয়েছে। জোর করে।

—ওদের চিনতে পেরেছিলে?

—না।

অনিকেত চুপ করে। দুলাল বলল—আপনি যত জিগ্যেস করলেন, পুলিশ তার কিছুই শুধোয়নি।

—পুলিশ কী শুধিয়েছিল তবে?

—কী হয়েছিল, কখুন হয়েছিল এসব জিগ্যেস করেছিল, বলেছিল থানায় যেতে। থানায় যেতে একজন বলেছিল, তুই হিজড়ে? হিজড়েদের ওই জায়গাটা কেমন হয় দেখিনি কখনও, দেখা। দেখিয়েছিলাম। জিগ্যেস করেছিল জন্ম থেকেই এরকম? আমি বলেছিলাম, হ্যাঁ। বলল, বসে মুতিস? বললাম, আজ্ঞে। ব্যস।

—আর কিছু জিগ্যেস করেনি?

—জিগ্যেস করছিল পাতার কাজ করি কি না। ওটা নিয়েই ভ্যানতাড়া করছিল।

—’পাতা’ মানে গুঁড়োর কথা বলছ তো? হেরোইন?

— হ্যাঁ।

—তা ‘পাতা’-র কথা তোমায় জিগ্যেস করছিল কেন পুলিশ? তোমার সঙ্গে কি ওসব ছিল?

জিভ কাটল দুলাল।—ও-জিনিস কখনও করিনি। শুনেছি আসানসোলের খোলে দু’জন পাতা খেয়ে মরেছে। আমি ও-লাইনে নেই। মায়ের দিব্বি। আমার শরীল খারাপ করছিল, মা স্বপ্ন দিল, ফিরে যা। মাজারে এসে বসলাম। তখনই তো দু’জন এসে গেল।

—চেঁচাওনি?

দুলাল একটু থতমত খেল যেন। বলল, একজন তো আমার মুখে শাড়ির আঁচল গুঁজে দিয়েছিল। এখন আর কথা বলতে পারছিনি। টায়ার লাগছে।

ব্যাপারটা পরিষ্কার হল না অনিকেতের কাছে। কিছু একটা গেরো আছে।

থাকগে। ওসব ব্যোমকেশ-ফেলুদাদের কাজ। মরুকগে।

যত তাড়াতাড়ি মরে, ততই মঙ্গল।

মেডিকেল কলেজের ভিতরে গিয়ে ট্যাক্সি থেকে নামতেই তিন-চারজন লোক মন্দিরের পান্ডাদের মতো ঘিরে ধরল। দুলাল আর দুলালের মা-কে দেখে ‘মুরগি পাওয়া গেল’ ভেবে আশান্বিত হয়েছিল ওরা, ‘কোন ডিপারমেন কোন ডিপারমেন’ বলে এগিয়েও এসেছিল, কিন্তু অনিকেতকে দেখে ওদের মনে হয়—–সুবিধে হবে না। —ওরা দালাল।

ডা. সমীর প্রধানকে খুঁজে বের করা গেল। মাঝবয়সি। বললেন—কিছু খাবার-দাবার নিয়ে আসতে। একটু দেরি হবে, আজই অনেকটা কাজ হয়ে যাবে। ডাক্তারবাবুর নিজের একটা ঘর আছে। ওই ঘরটা খুলে দিলেন। দুলালের লুঙ্গি পরা ছিল। দুলালকে লুঙ্গির ওপর দিয়ে ওই ক্যাথিটার এবং রবারের পাত্রখানি ধরে রাখতে হয়েছিল। ডাক্তারবাবু টয়লেটটা দেখিয়ে দিলেন। পাত্রটি ভরে গিয়েছিল। নবপাত্র লাগানো হল।

সমীরবাবু বললেন, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন, রাউন্ড মেরে আসছি। তখন এগারোটা মতো বাজে। একটা নাগাদ চলে এলেন সমীরবাবু। সঙ্গে একজন কাগজ-কুড়ুনি টাইপের লোক। লুঙ্গি, নোংরা গেঞ্জি, দুর্গন্ধ। সমীরবাবু বললেন, ও পেটব্যথার সিম্পটম নিয়ে আমাদের কাছে এসেছিল। দেখলাম, গলব্লাডার-এ স্টোন আছে। অথচ আশ্চর্যটা কী জানেন, ওর অ্যাসিডিটি নেই, বমি হয় না। ও তো যা-তা খায়। পাউরুটি দিয়ে ঠান্ডা আলুর চপ খায়। রাস্তায় পড়ে থাকা খাবারও খেয়ে নেয়। আই-কিউ খুব কম। কিন্তু আশ্চর্য, ওর পেটখারাপও হয় না। ওর ফিসিজ-এর কোয়ালিটি অবাক করার মতো। ওকে কমোডে হাগিয়ে দেখেছি। ভাসছিল। ওয়ান্ডারফুলি ফর্মড। গোল্ডেন ইয়েলোইশ কালার। কী করে হয়? ওর ডাইজেটিভ সিস্টেমটা নিয়ে আমার খুব কিউরিওসিটি। আজ ওর স্টমাক থেকে কিছুটা স্যাম্পল নেব।

কিছু কাজ-খ্যাপা লোক এখনও রয়ে গিয়েছে বলে দুনিয়াটা চলছে—অনিকেত ভাবে। এবার তোমার পেশেন্ট-টাকে দেখি?

ঘরের ভিতরে একটা ছোট ঘর ছিল। ওখানে নিয়ে গেলেন। হাতে গ্লাস পরে নিলেন।

মিনিট দশেক পরে ফিরে এসে বললেন—ওর পেচ্ছাপের অসুবিধেটার কারণ প্রস্টেট নয়। ওর ইউরেথ্রায় স্টেনোসিস হয়েছে। যেহেতু লিঙ্গটাকে চেঁচে ফেলেছে, কোনও ক্রুড উপায়ে, প্রস্রাব বের হওয়ার পথটা সরু হয়ে গিয়েছে, এবং ওই পথের টিস্যু কুঁচকে গিয়েছে। প্রস্টেট- টাও বড়। কিন্তু খুব বড় নয়। আল্‌ট্রাসোনোগ্রাফ করলে বোঝা যাবে।

–কবে আসতে হবে? অনিকেত জিগ্যেস করে।

—আজই করিয়ে দিচ্ছি। এই দু’টোকেই নিয়ে যাব। টেকনিশিয়ান আমাকে খুব ‘ইয়ে’ করে। ওর কাজের ফাঁকে টুক করে ম্যানেজ করিয়ে নেব।

সমীরবাবু ফিরে এলেন। অনিকেতকে আলাদা করে ডেকে বললেন, কেস ভাল নয়। প্রস্টেট-টা নডিউলার মনে হচ্ছে। প্রস্টেটে ক্যানসার হলে টেস্টিক্ল বাদ দেওয়া হয়। কিন্তু টেস্টিকল্‌স না-থাকলে প্রস্টেট ক্যানসার হয় কি না এ নিয়ে ধোঁয়াশা আছে। কারণ এরকম স্যাম্পল পাওয়াই যায় না, যারা ক্যাস্ট্রেটেড, অ্যান্ড সাফার্ড ফ্রম প্রস্টেট ক্যানসার আফটারওয়ার্ডস। একটা হালকা মতবাদ আছে—অণ্ডকোষ না-থাকলে প্রস্টেট ক্যানসার হয় না। কিন্তু সেকেন্ডারি ইনফেকশন থামাবে কে? আমার মনে হল, ওর প্রস্টেটে যদি ক্যানসার- ই হয়ে থাকে, এটা সেকেন্ডারি নয় তো? ডিওডেনাম-এর মধ্যে মনে হল একটা লাম্প আছে। হতে পারে ওটা ক্যান্সারাস। হতে পারে ওটা প্রাইমারি, প্রস্টেট মেটাস্টেসিস। আবার নাও হতে পারে। হয়তো ওই ল্যাম্প-টা এমনি, বিনাইন। বা ওটা অন্য কিছু। আরও পরীক্ষা করলে বোঝা যাবে।

অনিকেত যেন হাতে চাঁদ পেল। বলল—তা হলে ডাক্তারবাবু, ওকে ভর্তি করে নিন না। সমীরবাবু বললেন, তাই তো ভাবছি। কিন্তু চাইলে কালই তো ভর্তি করতে পারি না…। আউটডোর-এ এসে দেখাতে হবে। ডেট নিতে হবে, তা ছাড়া ওর আবার এড্‌স। আলাদা ব্যবস্থা। কতগুলো টেস্ট বাইরে থেকে করিয়ে আনুন, আগামী সপ্তাহে বুধ-শুক্র আমার আউটডোর।

—ওর পায়খানা ঠিকমতো হয়?

দুলালের মা বলল, না ডাক্তারবাবু।

—পায়খানায় রক্ত দেখেছেন?

দুলাল বলল, জানি না তো, খেয়াল করিনি।

—খিদে?

—মোটে না।

সমীরবাবু বললেন-–কেসটাতে আমার উৎসাহ আছে। নিয়ে আসুন। এই ধরনের মানুষ নিয়ে খুব একটা কাজও হয়নি আমাদের দেশে। বহুদিন আগে, ১৯৭৪-৭৫ সালে, এই মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল ডা. জে বি মুখার্জি কিছু হিজড়েদের নিয়ে কাজ করেছিলেন। উনি ওঁদের কেস হিস্ট্রি রেকর্ড করেছিলেন, নানারকম প্যাথোলজিকাল টেস্ট করেছিলেন। তখন তো জেনেটিক্স-এর তেমন উন্নতি হয়নি, সুতরাং প্যাথোলজি-র ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হত, স্পেশালি ব্লাড। উনি ওদের গোনাড্স এর ছবিও তুলেছিলেন। ওই ৪০/৫০টা স্যাম্পেলের মধ্যে ক্যাস্ট্রেটেড, নন-ক্যাস্ট্রেটেড সবই ছিল। মেডিকেল কলেজে যে কোনও রোগ নিয়ে কোনও হিজড়ে এলেই ওদের পরীক্ষা করতেন। ওই সব রিপোর্ট ছিল মেডিকেল কলেজের সম্পত্তি। উনি রিটায়ার করার পর ওইসব রেকর্ড অযত্নে নষ্ট হয়ে যায়। হারিয়েই যায়। তবে, কিছুদিন পর আমেরিকায় একটা ফরেন্সিক সায়েন্স কংগ্রেসে ডা. মুখার্জি একটা পেপার পড়েছিলেন। ওটার একটা কপি আমি পেয়েছি। যতদুর মনে পড়ে ডা. মুখার্জির পেপারে ছিল, এদের প্রস্টেট ছোটই হয়। একটা ভারি আশ্চর্য কথা লিখেছিলেন উনি। রেক্টামের ভিতরে আঙুল চালিয়ে বা অন্য কিছু দিয়ে প্রস্টেটকে উত্তেজিত করলে, কিছুক্ষণ পরে চেঁচে ফেলা পুংলিঙ্গের গোড়ার ছিদ্র দিয়ে সামান্য তরল কিছু বেরিয়ে আসে। ওটা প্রস্টেটের সিক্রিশন। শুক্রহীন বীর্য। ওরা যখন পায়ুমেহন করায়, ঠিকমতো হলে—এই তরল বেরিয়ে আসাটাই ওদের অর্গ্যাজ্‌জ্ম। ড্রাই-অর্গ্যাজ্‌জ্মও হয়। অনিকেতের ভয় হয়। সমীর প্রধানকে বলে, ওকে নিয়ে এসব এক্সপেরিমেন্ট করবেন না কি?

ডা. সমীর প্রধান বলেন—ও কি এই স্টেজে আছে নাকি? ওর প্রস্টেট কেন বড় হল এটা বুঝতে হবে। তবে ওর কষ্ট হবে না। চিকিৎসাও যা হওয়ার হবে।

দুলালের মা-কে বললেন—চিন্তা করবেন না, আমরা আছি তো।

২৬

মাছওলা বলেছিল, একদম সুইমিং পুল-এর গ্র্যাজুয়েট মাছ। জ্যান্ত চারাপোনার ঝোল, কিন্তু ঝোলটা তেতো।

এত তেতো কেন? ভেড়ি-দূষণ? মাছের শরীরেও তিক্ত রাসায়নিক ঢুকে আছে? শুক্লাকে বলল অনিকেত। শুক্লা ঝোলে ডুবে-থাকা মাছ হাতায় তুলে দেখল। বলল, দুলালের মা-কে দিয়ে আর চলবে না। অন্য লোক দেখতে হবে। মাছের আঁশ ছাড়িয়েছে, অথচ পেট কাটেনি। পিত্তি রয়ে গিয়েছে। মাছের পিত্তি ঝোলে মিশে গিয়েছে।

মাছ কাটিয়েই আনে। কিন্তু আজকাল এলাকায় লোক বেড়ে গিয়েছে। মাছ কাটাতে দেরি হয়। বাড়িতে দুলালের মা আসে, তাই ভিড় হলে কাটিয়ে আনে না। দু’দিন আগে জামা কেচেছিল, জামার পকেটে টাকা ছিল। শুক্লাও দেখেনি, দুলালের মা-ও না। দুলালের মা-কে বলাই ছিল কাচাকুচি করার আগে পকেট-টকেট ভাল করে দেখে নেবে। ভুলে গিয়েছে। কিছু বললে বলে, কী করব, মন ভাল নেই।

ওকে দিয়ে আর চলবে না, অনিকেত বলে, অন্য লোক দেখে নাও। এমনিতেও ওকে ছাড়াতে হত। ট্রান্সফারের অর্ডার ঝুলছে। ট্রান্সফার হলেই চলে যেতে হবে। তখন তো বলতেই হবে, দুলালের মা, কাজ দেখে নাও। ক’টা দিন আগে বলে দেওয়া—এই যা।

শুক্লা বলে, সে নাহয় বলে দেব ওকে, কিন্তু দুলালের মা বলছিল দুলালের নামে পুরীতে জগন্নাথের পুজো করিয়ে দিতে। আমাদের পান্ডাকে চিঠি লিখতে পারবে একটা?

অনিকেত বলল, টাকাটা তুমিই দেবে, তাই তো?

শুক্লা বলল, আমি আর কোত্থেকে দেব? তুমিই তো দেবে। দুলালের চিকিৎসার টাকা দিচ্ছ না?

অনিকেত বলল—তা তো দিতেই হচ্ছে। উপায় কী? তবে পান্ডাকে যে টাকা পাঠাব, তা দিয়ে ওষুধ কিনলে কাজ হত। কাজ হত বলছি কেন? কোনও কাজই হত না। কোনও কাজই হবে না। দুলালের বাঁচার কোনও চান্স আছে নাকি? জগন্নাথদেব-এর সাধ্যি নেই।

শুক্লা বলল, জগন্নাথদেব অনেক অলৌকিক কিছু ঘটাতে পারেন।

অনিকেত বলল, তা হলে তো হাসপাতালের দরকার হত না। ডাক্তারের দরকার হত না। এর বেশি আর কথা বাড়াল না।

অফিসে একটি প্রতিবন্ধী দম্পতির ইন্টারভিউ নেওয়ার ছিল। ওঁরা ঠিক সময়ে এসে পড়েছেন। পুরুষটি অস্থি-প্রতিবন্ধী। আরও ঠিক করে বলতে গেলেন মেরুদণ্ড-ভাঙা। আগেও এরকম একজন মানুষকে পেয়েছিল। এঁর হাত চলে, মাথা চলে, পা চলে না। শুধু পা কেন, কোমরের তলা থেকে কিছুই চলে না। ইনি চিত্রশিল্পী। ওঁর স্ত্রী-ও চিত্রশিল্পী। কিন্তু কথা বলতে পারেন না, কানে শোনেন না। ডেফ অ্যান্ড ডাম্ব।

—আপনারা সুখী দম্পতি?

পুরুষটি বললেন, খুব। আমরা একসঙ্গে ছবি আঁকি, একে অপরকে ‘শেয়ার’ করি। আলোচনা করি…।

—আলোচনা? কী করে? উনি তো কথা বলতে পারেন না।

–কথা দিয়েই শুধু কথা বলা যায় নাকি? ওর তো সারা শরীর কথা বলে, আমারও।

—সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ-টা শিখে নিয়েছেন বুঝি? ওই যে আঙুল দিয়ে কী যেন বলে?

—এমভিএসএল ও জানে। আমি জানি না। আমার সঙ্গে ওর কমিউনিকেশন-এ অসুবিধে হয় না। কমিউনিকেশন-টা একটা আশ্চর্য ব্যাপার। আমাদের ছেলেটা কথা বলতে পারে। ওর বয়স এখন চার। ও জানে, ওর মা শোনে না। কিন্তু মা-ছেলের কোনও অসুবিধে হয় না। ওরা তো সর্বক্ষণ কথা বলে।

তা হলে একটা গল্প বলি। অ্যাক্সিডেন্ট-টার আগে আমি বনগাঁ-র একটা স্কুলে যেতাম আঁকা শেখাতে। ফেরার সময় দেখতাম একজন প্রৌঢ় লোক বনগাঁ থেকে উঠতেন। আর একজন প্রৌঢ়া উঠতেন গোবরডাঙা থেকে। ওঁরা চেষ্টা করতেন মুখোমুখি বসতে। ভদ্রমহিলা সারাক্ষণ উল বুনতেন কিংবা সুচ-সুতোয় এয়ডারি করতেন। ভদ্রলোক বই পড়তেন। দু’জনের মধ্যে কোনও কথা হত না। ভদ্রলোক মধ্যমগ্রামে নেমে যেতেন। যাওয়ার সময় মহিলাকে বলতেন, উঠি, কাল আবার কথা হবে। মহিলাটিও বলতেন—হ্যাঁ, কথা হবে। অথচ কোনও কথা-ই হত না।

অনিকেত জিগ্যেস করল—আপনার অ্যাক্সিডেন্ট-টা হয়েছিল কত বছর আগে?

—তা এক যুগ হয়ে গেল। বারো বছর

—ও, তা হলে যে বলছেন আপনাদের সন্তানের বয়স চার বছর…। অ্যাক্সিডেন্ট-এর পর আপনার তো…

ভদ্রলোক হেসে উঠলেন, মোক্ষম প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তর অনেকবারই দিতে হয়েছে। অ্যাক্সিডেন্ট-এর পর আমার নিম্নাঙ্গে সাড় নেই। সেক্সুয়াল অর্গ্যান ইন-অ্যাক্‌টিভ। তাতেও ভালবাসা কমেনি। সত্যি বলতে কী, ভিতরে, সারা শরীরে, কখনও কখনও শিহরনও হয়, যাকে অর্গ্যাজম-ও বলা যায়। আসলে ভালবাসায় জোর থাকলে সব হয়। ও! আসল প্রশ্নটার উত্তরটাই তো দেওয়া হয়নি। সন্তানের জন্য আমার এক বন্ধুকে অনুরোধ করেছিলাম। আমাদের ক-ফ্রেন্ড। ও দয়া করে কাজটা করে দিল। সবাইকে বলি না। কাউকে বলি অলৌকিক ভাবে গর্ভ হয়েছিল বনানীর। মেরি মায়ের যেমন। লোকে বিশ্বাস করে না। এমনকী খ্রিস্টানরাও নয়। আমি তো নিজেই খ্রিস্টান পরিবারের। আত্মীয়স্বজনরা আছে। আবার কাউকে বলি—আমার

কখনও কখনও কাজ করে…।

কতগুলো পেন্টিং-এর ছবি তুলে এনেছিল ওরা। অনিকেত ছবিগুলো দেখছিল।

বনানীর ছবিগুলো খুব রঙিন। চড়া রঙের। সুররিয়ালিস্টিক ধরনের। একটা মানুষ হাত উঁচিয়ে রয়েছে। বিরাট হাঁ, জিভ কাটা। ছবিটার ক্যাপশন : আ পলিটিকাল ম্যান। পাঁচটা খাটিয়া এমনভাবে সাজানো যেন ফুলের পাঁচটা পাঁপড়ি। প্রত্যেক খাটিয়াতে একটা করে মৃতদেহ। ছবিটার নাম ‘পিস’। কিন্তু ভদ্রলোকের ছবি একটু অন্যরকম। মা কালীর লোলজিহ্বায় একটা প্রজাপতি। বেশ কিছু জগন্নাথদেবেরও ছবি। নানা ভাবে, নানা রঙে।

—এত জগন্নাথ এঁকেছেন যে…

—জগন্নাথ আমার খুব ফেভারিট।

ওঁর স্ত্রী মুচকি হাসছেন। এসব কথাবার্তা ওঁর শোনার কথা নয়। কিন্তু কী করে যেন বুঝলেন জগন্নাথ প্রসঙ্গ এসেছে। উনি চোখ গোল-গোল করে তাকালেন।

জগন্নাথের চোখও গোল। বড় বড়।

শিল্পী বলতে থাকেন—জগন্নাথ কেন এত ফেভারিট জানেন? উনি বিশ্বস্রষ্টা, তাই তো ভাবা হয়, জগতের নাথ, অথচ দেখুন, উনি আমার মতো। ওঁর পা নেই। আমার তো তবু হুইল চেয়ার আছে, ওঁর তো তা-ও নেই। উনি স্থাণু। অনড়। মানে, চিরকালীন। চোখে বিশাল দু’টি লেন্স। সব দেখছেন, উপভোগ করছেন। নিজের তৈরি করা মহাবিশ্ব-টাকে এন্জয় করছেন। রগড়ও দেখছেন। দেখুন না, মুখে মৃদু হাসি। মোনালিসা-র হাসির চেয়েও বেশি ব্যঞ্জনাময় ছোটখাটো স্বার্থ নিয়ে মানুষের এসব কাজ-কারবার দেখে বিদ্রুপের, কিংবা তাচ্ছিল্যের, নাকি ক্ষমা-ঘেন্নার হাসি হাসছেন। হাত দু’টো সো-কলড্ কমপ্লিট নয়। কিন্তু দেখুন দু’টো সমান্তরাল রেখা। ছোটবেলায় জ্যামিতি-তে পড়েছিলাম সমান্তরাল সরলরেখা অসীমে গিয়ে মেশে। আমরা তো অসীম বুঝি না, আহ্বান বুঝি। দুই হাত বাড়িয়ে ধরেছেন। ওঁর তো তলা-ই নেই, অথচ সৃষ্টি করে চলেছেন। পেটের তলা নিয়ে পৃথিবী জুড়ে কী ঝামেলা রে বাবা…।

দুলাল, দুলালের জন্য জগন্নাথের কাছে টাকা পাঠানোর কথা বলেছিল শুক্লা…।

এ সময় শুক্লার ফোন এল। তখন বেলা একটা।

—খুব খারাপ কাণ্ড হয়েছে, জানো, দুলাল ওর গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। দুলালের মা-ও দুলালকে বাঁচাতে গিয়ে পুড়ে গিয়েছে। ওদের দু’জনকেই হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছে।

দুলালের ছেলে হাঁপাতে-হাঁপাতে এসে বলে গেল। নীলরতন-এ আছে। দুলাল বোধহয় বাঁচবে না।

—আপদ যাবে।

—কিন্তু দুলালের মা-ও নাকি খুব পুড়েছে। কিছু পয়সা-কড়ি নিয়ে হাসপাতালে যেতে পারবে?

—পয়সার মেশিন আছে নাকি এখানে? তা ছাড়া আমি তো কাজ করছি।

–কেন, তোমাদের অফিসে নাকি কো-অপারেটিভ আছে, সময়-অসময়ে টাকা পাওয়া যায়, তুমিই তো বলেছিলে?

—হ্যাঁ। দেখছি।

ইন্টারভিউ-টা তাড়াতাড়ি শেষ করে কো-অপারেটিভ থেকে কিছু টাকা তুলে বেরিয়ে পড়ল অনিকেত। দুলাল যাই হোক, বিবেচক লোক। ডা. সমীর প্রধান আরও অনেক টেস্ট-এর কথা বলেছিলেন। যদি ক্যানসার ধরা পড়ে, তা হলে কেমো না অপারেশন, না দু’টোই, এসব পরে ঠিক করবেন অনকোলজিস্ট। অনিকেত আর কোনও ঝামেলা নেয়নি। দুলালের মা-কে বলেছে, ঘরেই রাখো, খাওয়াও-দাওয়াও। সমীর প্রধান-কে দেখিয়েছে দিন দশেক তো হল।

হাসপাতালে মন্টুর সঙ্গে দেখা হল। ও পানের পিকমাখা সিঁড়িতে বসে উদাস তাকিয়ে আছে।

—কী রে, কী হয়েছে?

মন্টু বলল, বাবা ঘর বন্ধ করে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়েছিল। তারপর নিজেই দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছিল। তখন ঠাকমাও পুড়ে গেল।

—কটার সময়?

—দশটা।

—তুই কী করছিলি?

—আমি তো নাইতে গেসলাম পুকুরে। ইস্কুল ছিল কি না…।

—তারপর?

বাড়ি ফিরে দেখি লোকজন, ভিড়। আমাদের সবাইকে গাল দিচ্ছিল, আর দু’জনের গায়ে জল ঢালছিল, নারকোল তেল মাখিয়ে দিচ্ছিল। আমি তখন ছুটে গেলাম জেঠিমার কাছে।

—খেয়েছিস কিছু?

—জেঠি রুটি-বোঁদে দিয়েছিল।

—আর কেউ এখানে আছে তোদের পাড়ার?

মাথা নাড়ল মন্টু।

ওরা বেঁচে আছে না কি মারা গিয়েছে? মন্টুকে কী করে জিগ্যেস করা যায়? অনিকেত জিগ্যেস করল, কেমন আছে জানিস?

ঠোঁট উল্টে দিল মন্টু।

—সিট নম্বর জানিস?

— উঁহু।

মন্টুর ঘাড় নাড়া, ঠোঁট উল্টে দেওয়া, এসব যেন একটু অন্যরকম লাগল। ঘাড় নাড়াটার মধ্যে একটু বেশি ঝাঁকুনি ছিল। কানে ঝোলানো দুল থাকলে বেশিক্ষণ ধরে নড়ত। এই মন্টুর মধ্যেও কি তবে দুলালের একটু প্রপার্টি আছে? তবে কি যৌন-বিশেষত্ব বংশানুক্রমিক? এই মেয়েলিপনা-টাও বংশানুক্রনিক? অবশ্য মেয়েলিপনা ব্যাপারটাই তো পুরুষের কনসেপশন-এ হচ্ছে। একটু বেশি হাত নাড়া, মুখ নাড়া, একটু হেলে-দুলে হাঁটা, একটু ন্যাকামি করা…এসব মেয়েলি লক্ষণ। তা হলে মহাশ্বেতা দেবীর ক্ষেত্রে কী হবে? উনি তো মহিলা। উনি হেলে- দুলেও হাঁটেন না, হাতও নাড়েন না কথা বলার সময়, ভ্রু-ভঙ্গিও করেন না। তা হলে? সুকুমারী ভট্টাচার্য থেকে সুদেষ্ণা চক্রবর্তী কারও মধ্যেই তো তথাকথিত ‘মেয়েলিপনা’ নেই। তাই বলে কি ওঁরা সব পুরুষ নাকি? যাকগে—এখন মৃত্যুমুখে পড়ে আছে দু’জন মানুষ। এখন এসব তত্ত্ব থাক। আর ওই মেয়েলিপনা বংশানুক্রমে অর্জিত কি না, এসব প্রশ্নর সময় এটা নয়। আর মন্টু আদৌ দুলালের ঔরসজাত কি না, এখানেও একটা বড় প্রশ্নচিহ্ন আছে। অনিকেত-কে তা হলে এমার্জেন্সি-তে যেতে হবে। ওখানে খোঁজ করতে হবে।

এ সময় একটা লোক এল। পা-জামা আর ফুলশার্ট পরা। মন্টুকে বলল, খাবি কিছু। অনিকেতের দিকে তাকিয়ে বলল, ওঃ, আপনি এসে গিয়েছেন। আমি হলাম দুলালের ছোটবেলার বন্ধু। ওর গাঁয়ের ছেলে। কিছুদিন ওর সঙ্গে আনাজের কারবারও করেছি। আপনি আমায় চিনবেন না। আমি আপনাকে চিনি। আপনার দয়ার শরীর।

ওরা কেমন আছে এখন?

—দু’জনই বেঁচে আছে এখনও।

—হয়েছিল কী? অনিকেত জিগ্যেস করে।

—আগুন লাগিয়ে নিজের জীবনটা পুইড়ে দিতে গিয়েছিল আর কী। আমি তখন গরুর জাবনা দিচ্ছিলাম, তরুণ সংঘ কেলাবের চানু আর গুরুপদ আমাকে ডেকে বলল, চলো, তোমার বাল্যবন্ধু গায়ে আগুন দেছে। ছুটে গেলাম। কাকে সামলাব। ঘরের বিছানাতেও আগুন ধরেছে। সব জল ঢালছে। জল তো টিউকলে। পাম্প করে জল তুলতে হয়। আগে ঘরটা সামলাব, না মানুষ সামলাব। দুলালের গায়ে আর ওর মায়ের গায়ে জল ঢেলেছে, ওদের গা থেকে ধুমা উঠছে, বিছানার চাদর জ্বলছে। যা হোক আগুন নিভানো হল। মুকুন্দপুরে অ্যাম্বুলেন্স আছে, ওদের বাড়ি পর্যন্ত আসার পথ নেই। ভ্যানে চাপিয়ে গারুলগাছার মোড়ে এসে অ্যাম্বুলেন্স-এ চাপালাম। পাঁচ-ছ’জন সঙ্গে ছিল। আমুও অ্যাম্বুলেন্স-এ ছিলাম। ওদের গা থেকে কেরোসিনের গন্ধ ছাড়ছিল। দুলালের মা কেবল হরি হরি বলছিল, বলতে কি পারে, ঠোঁট নড়ছিল শুধু। দুলালের মুখে রা ছিল না। ওদের দু’জনারই মুখ পোড়েনি। কিন্তু দুলালের তো মুখ আগেই পুড়েছিল, নতুন করে আর পুড়বে কী?

অনিকেত জিগ্যেস করল, আপনার নাম কী?

—আমার নাম বদু। বদু মণ্ডল। পুরো নাম বদরুদ্দিন মণ্ডল।

—আপনি কি এখনও আনাজের ব্যবসা করেন?

—আনাজের ফড়েগিরি করি না আর। বাড়িতে দুধেল গাই রেখেছি, সঙ্গে পোল্‌টিরি। আর আনাজের সঙ্গে কানেকশন-টা আছে বলে হাসপাতালগুলোকে আনাজ সাপ্লাই করি। অনেকগুলো হাসপাতাল হয়েছে কি না। ওপরওলার দয়ায় ভালই আছি। ছেলে ক্লাস টেন-এ পড়ে। তিনরকমের মাস্টার রেখে দিয়েছি। আনাজের ব্যবসায় একটু খাটালি আছে, কিন্তু লাভও আছে। দুলাল-টা ছেড়ে দিল, বে-ফালতু কাজে নামল। সেই একই তো খাটালি। সাইকেলে- সাইকেলে টিপ, ফিতে, বুক-বাঁধা এসব বিক্রি করত। আমি নিষেধ করেছিলাম, শোনেনি। ওর একটু গড়বড় ছিল। সবই জানেন, আমি আর নতুন কী বলব, আমি অনেক বলেছিলাম। জানেন তো, ইসলামে এটাকে বলে ‘সাদোমি’। আরবের সাদোম আর ঘমোরা শহরের মানুষের এসব দুষ্কর্ম ছিল বলে ওপরওলা আকাশ থেকে আগুন আর পাথর ছুড়ে শাস্তি দিয়েছিলেন। দুলালকেও শাস্তি দিলেন। হিন্দু-মুসলমান-শিখ-ইশাই—সবার তো ওপরওলা একজনই। শাস্তির জন্য কেয়ামত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় না। আগেই হয়ে যায়। কী বলেন স্যর? অনিকেত মাথা নাড়ায়।

উনি বলে চলেছেন—ও যখন ফিরে এল, পাড়ার লোকজন বলেছিল গাঁয়ে থাকতে দেবে না। আমি যা হোক করে ম্যানেজ করলাম। ছোটবেলায় একসঙ্গে খেলেছি, সাঁতরে শাপলা তুলেছি…।

জানেন স্যর, তখুনি দেখতাম, চ্যান করে ঘর যাওয়ার সময় গামছাটা গায়ে জড়িয়ে নেয়, আমাদের মেয়েছেলেরা যেমন করে। আমরা তো কাঁধে ফেলে দি, নইলে কোমরে জড়াই— তাই না স্যর?

–হুঁ।

—জানেন, যখন হাসপাতালে নিলাম, পুরো জ্ঞান ছিল ওর। যখন নাম জিগ্যেস করল, আমরা বললাম দুলাল মিরধা, ও বলছে দুলালী।

—ওর মায়ের-ও কি জ্ঞান ছিল?

—ওর মায়ের তেমন জ্ঞান ছিল না। হাত নাড়াচ্ছিল, মুখ দিয়ে আওয়াজও বেরুচ্ছিল। কিন্তু .কথা কইছিল না। যা হোক, ভর্তি তো হল। স্যালাইন, ওষুধ, ইনজেক্‌শন সব আমি কিনে দিলাম। দু’হাজার বেরিয়ে গেল। এই কথা বলে বদু অনিকেতের দিকে তাকাল। চোখে একটা প্রত্যাশা। ও অপেক্ষা করছে, অনিকেত কখন বলবে টাকাটা আমি দিয়ে দেব।

কিন্তু অনিকেত কিছু বলল না। অনিকেত বলল—এখন ওরা কেমন আছে জানা যায় না?

বদু বলল—থাকতে তো বলেছে। খবর হলে জানাবে। নইলে আর একঘণ্টা পর যেতে দেবে। ঘড়ি দেখল বদু।

উল্টো দিকে একটা ছোট দোকান ছিল। ওখানে জল, কোল্ড ড্রিংক এবং আইসক্রিম বিক্রি হচ্ছিল। অনিকেত একটা কোন্ এনে মন্টুকে দিল।

মন্টু কোনের ওপরে উঁচিয়ে থাকা স্ট্রবেরি-লাল গোলাকার অংশটা জিভ দিয়ে চাটছিল।

বদু ওকে নিরীক্ষণ করছিল। বদু বলল, একটা কথা বলব স্যর, যদি আইস্কিরিম খাওয়ান ওকে, কাপ দেবেন। কোন্ দেবেন না, কাঠিওলা গোল জিনিসও দেবেন না। দেখুন না, কেমন চুষছে। ওর বাপের তো স্বভাব ভাল ছিল না, ওর সাবধান থাকা ভাল।

অনিকেত ইঙ্গিতটা বুঝল। এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করল না। পাত্তা দিল না। অনিকেত বদুকে জিগ্যেস করল—ও যখন ঘর ছেড়ে চলে গেল, আপনি কি জানতেন ও কোথায় গিয়েছে?

—না-না-না। কোনও লিংকিং ছিল না। ও যখন আনাজের কারবার ছেড়ে ওসব ধরল, তখন থেকেই ওর সঙ্গে কাট-আপ হয়ে গিয়েছিল। তা ছাড়া এক নাপিতের সঙ্গে গুনাহ করত। তবু আমি এসেছি, ওর পিছনে খরচা করলাম। সারাটা দিন দিলাম। আর তো কেউ থাকল না। সবাই বলল, তোর ছোটবেলার দোস্ত তুই থাক। ও তো অনেকেরই ছোটবেলার বন্ধু ছিল।

মন্টু খুব তৃপ্তি করে আইসক্রিমটা খাচ্ছিল। অনিকেত মন্টুকে জিগ্যেস করল—হ্যাঁ রে, সকালবেলায় তোর ঠাকমার সঙ্গে তোর বাবার কোনও ঝগড়াঝাঁটি হয়েছিল না কি?

মন্টু বলল, না। বাবা সকালবেলায় খুব চেঁচাচ্ছিল। বারবার ঠাকুরের ছবিটাকে পেন্নাম করছিল। বাবার একটা ঠাকুর আছে না? ওটাতে। বলছিল, জয় মা। এতদিনে কথা শুনলে। আর চিৎকার করে, হাততালি দিচ্ছিল। ঠকঠক করে। আর ঠাম্মা বলছিল, এত রক্ত পড়ছে, ডাক্তারকে খবর দি? বাবা বলছিল আর দরকার নেই।

—রক্ত পড়ছিল? অনিকেত জিগ্যেস করে—কোত্থেকে রক্ত পড়ছিল?

—ওই বাবার যেখানে নল ঢোকানো থাকে, সেখান দিয়ে। নল খুলে ন্যাকড়া চাপা দিয়েছিল।

—তারপর?

—তারপর তো নাইতে গেলাম…।

অনিকেত বুঝল, প্রস্টেট থেকেই ওই রক্তক্ষরণ। প্রস্টেটে ঠিক কী হয়েছে ওর জানা নেই। ওটা ইনফেক্‌শন, না ক্যানসার, না মেটাস্টেসিস জানা নেই। রক্তক্ষরণটা ওখান থেকেই হচ্ছিল নিশ্চয়।

একটু পরে ওদের দেখতে গেল। প্রথমে দুলালকে। ওর নাকে অক্সিজেন, হাতে স্যালাইন। ওর শরীরে নুনজল ঢুকছে। গায়ে সবুজ চাদর। যেটুকু হাত বেরিয়ে আছে কালচে। গলার কাছটায় ব্যান্ডেজ করা। ওকে এমার্জেন্সি-তেই ফেলে রেখেছে।

একজন গ্রুপ ডি-কে জিগ্যেস করল অনিকেত। ও বলল, কেস খারাপ আছে। আর যা জিগ্যেস করার সন্ধেবেলা ডাক্তারবাবুকে করবেন। ও জিগ্যেস করল—ওর কি মাথার ছিট ছিল?

অনিকেত বলল, না তো?

—তবে যে উল্টোপাল্টা বলছিল-

–কী বলছিল?

—বলছিল আমার মাসিক হয়েছে…।

কিছু ডাক্তার ছুটোছুটি করছিল। একজন নার্সও ছিল। নার্সকে জিগ্যেস করাতে উনি কিছু না–বলে একটা টেবিল দেখিয়ে দিলেন। বদু বলল, ওদের কাছে রেকর্ড আছে।

অনিকেত জিগ্যেস করল—ওকে এখানে ফেলে রাখা হল কেন?

উত্তর এল, সিট নেই। একটা ফিমেল ওয়ার্ড-এ সিট খালি হল। পদ্মবালাকে ট্রান্সফার করা হয়েছে। ওর মা। ফিমেল দু’শো এক। আর এর তো ঝামেলা কেস। কোন ওয়ার্ডে যাবে? মেল না ফিমেল। পেশেন্ট পার্টি বলল দুলালচন্দ্র মিরধা, আর পেশেন্ট নিজে বলল, দুলালী। তখন পেশেন্ট পার্টিরা বলল, ও হিজড়ে। কোন ওয়ার্ডে দেব? একজন সিনিয়র বলল, হিজড়ে হলে ফিমেল ওয়ার্ডেই যায়। এর তো সব পুড়ে গুড়। কিছুই বোঝা যায় না। এখানেই রাখা আছে।

—এখানেই থাকবে না কি তবে?

—ওসব ডাক্তারবাবুকে জিগ্যেস করবেন।

দুলালের মা-কে দেখতে গেল ওরা। দুলালের মা ফিমেল সার্জিকাল ওয়ার্ডের বারান্দায়। মুখে অক্সিজেন, হাতে স্যালাইনের নল। নার্স বলল, জ্ঞান নেই।

অনিকেত জিগ্যেস করল, বাঁচবে?

নার্স বললেন, আমি কি ভগবান? কী করে জানব?

দুলালের ছেলেটা ওর বাবাকে দেখে কেঁদে ওঠেনি। কিন্তু ওর ঠাকুমাকে দেখে কেঁদে উঠল। বলল, অ-ঠাকুমা, কেন তুমি লোকটাকে নেবাতে গেলে…। এখন আমার কী হবে…কেঁদে উঠল।

অনিকেত বলল, হাসপাতালে কাঁদতে নেই। ওরা নেমে এল। ডাক্তারবাবুর জন্য অপেক্ষা। টুকরো ঘটনা আর মন্তব্যগুলোকে মেলাতে লাগল অনিকেত।

দুলালের প্রস্টেটের সংক্রমণটা বেড়ে রক্তক্ষরণ হয়, ওর লুপ্ত যৌনাঙ্গের ভিতরে, গোপনে- থাকা মূত্রছিদ্র দিয়ে বেরিয়ে আসে রক্ত। যেন এই রক্তস্রাবের জন্যই অপেক্ষা ছিল ওর। দুলাল ভাবল, ওর নারী হওয়া হয়ে গিয়েছে এতদিনে। জীবন পূর্ণ। এবার আগুন জ্বালো।

শুক্লারও এরকম হয়েছিল। ওর যখন হিস্টোরেক্টমি করার কথা হল, গাইনি বললেন— এছাড়া অন্য উপায় নেই, শুক্লা বলেছিল, তা হলে আর পিরিয়ড হবে না? উনি বলেছিলেন, না।

শুক্লা কেঁদে ফেলেছিল।

হাসপাতাল-এ থেকে ফিরেই আলমারি খুলে যে দু’-চারটে স্যানিটারি ন্যাপকিন ছিল, ওগুলোকে তীব্র আক্রোশে খামচে আলমারি থেকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল। সব জঞ্জাল। জঞ্জাল। আবর্জনা। আলমারির নিচের তাকেও বোধহয় ছিল দু’-একটা। নিচু হতে গিয়ে তলপেটে কিছু হয়েছিল হয়তো। ওর ভেজা অনুভব হয়েছিল। জায়গাটা স্পর্শ করেছিল। হাতে রক্ত লেগেছিল। কোনও কারণে রক্ত ছুঁয়েছিল ওর যোনিদেশ। শুক্লা স্বগতোক্তি করেছিল— তবে? বললেই হবে শেষ?

ও ভাল করেই জানত, ওটা ঋতুরক্ত নয়। তবু আহ্লাদ পেয়েছিল। অনিকেতকে বলেছিল, সরে যাও। শুক্লা ওখানে ন্যাপকিন ধরেছিল মমতায়…

একটু পরেই ডাক্তার এল। ডাক্তার মানে হাউস স্টাফ।

—বার্ন কেসের পেশেন্ট পার্টি কে আছে…?

অনিকেত এগিয়ে এল।

—দুলালী মিরধা…

—এই তো।

—একটু আগে এক্সপায়ার করেছে। কিছুই করার ছিল না। এইট্টি পার্সেন্ট বার্ন। কিডনির কোনও ফাংশন ছিল না। লিভার এরিয়া বিচ্ছিরিভাবে পুড়ে গিয়েছিল। হার্টফেল করল।

ডেডবডি পরে পাবেন। পুলিশ কেস হবে। পোস্টমর্টেম হবে। ঝামেলা আছে। এমনিতেই তো পুলিশ কেস আছে একটা। অনিকেত মনে-মনে বলে।

আপনার কে হয়?—ডাক্তারবাবু জিগ্যেস করল।

—কেউ হয় না, মানে, চেনা, ওর মা আমার বাড়িতে কাজ করে।

—ওর মা-ও তো পুড়েছে?

—হ্যাঁ। কেমন আছে?

—জানি না। ফিমেল ওয়ার্ড বলবে। কিন্তু ওর ডেথ সার্টিফিকেট-টা লিখতে হবে তো। ওরা বলছিল নাম নিয়ে কনফিউশন আছে। দুলাল লেখা ছিল, পরে ‘আই’ লাগিয়ে দুলালী করা হয়েছে। শুনলাম, ও নাকি হিজড়ে। গোনাস দেখে তো কিছু বোঝার উপায় নেই, এমন বিচ্ছিরি ভাবে পুড়েছে…। রেকর্ডে কী লিখব? আর ডেথ সার্টিফিকেট-এ? মেল না কি ফিমেল?

—ফিমেল লিখুন ডাক্তারবাবু, ফিমেল। ও আসলে ফিমেলই ছিল।

–বলছেন? ও-কে…।

ওই ইংরেজি ‘ও-কে’ কথাটার সময় যেন পুষ্প-বৃষ্টি হল। রূপকথার রাজপুত্র-র মুখ থেকে মণিমুক্তো ঝরে। দু’টো মুক্তো ঝরল যেন।

জীবনে যা চেয়েছিলি, মরার পরে পেয়ে গেলি দুলাল। না, দুলাল না, দুলালী। ঋতু- কাঙালিনী।

২৭

দুলাল এক্সপায়ার্ড। না, মরেছে। এরা এক্সপায়ার করে না, মরে। একটা চ্যাপ্টার শেষ হল। বাঁচা গেল।

কিন্তু দুলালের মা বেঁচে আছে এখনও। রয়েছে দুলালের সো-কল্ড ছেলে মন্টু।

সকাল থেকে তিনবার ফোন এল বাড়িতে। গভর্নমেন্ট রেশন দোকানগুলোতে ঠিকমতো চাল দিতে পারে না—দেশের কোনায় কোনায় টেলিফোন বুথ করে দিয়েছে।

—স্যর, আপনাকে একটু আসতে হবে স্যর, মর্গ থেকে ঝামেলা করছে। দিচ্ছে না।

এরা মরলে মড়া, বড়জোর লাশ। অনিকেত মরলে বডি। খবর কাগজের সাংবাদিকরাও ‘লাশ’-ই লিখবে, অনিকেতরা মারা গেলে ‘মৃতদেহ’।

অনিকেত-টনিকেতরা মারা যায়, প্রয়াত হয়, দেহত্যাগ করে, এরা স্রেফ মরে।

—কেন, বড়ি ছাড়ছে না কেন?

—স্যর, বলছে হাসপাতালের কাগজে দুলালী লেখা আছে, ফিমেল, অথচ এটা ফিমেল বড়ি নয়, ভোটার কার্ড নিয়ে এসো। ভোটার কার্ড পাওয়া যায়নি।

—তো আমি গিয়ে কী করব?

—স্যর, ও শালারা পয়সা খাওয়ার মতলব করছে, আপনি গিয়ে দাঁড়ালে ওরা এত পাঁয়তাড়া করতে পারবে না।

—বাড়িতে ভোটার কার্ড ছাড়া অন্য কোনও কাগজ নেই? রেশন কার্ড?

—ওখানে তো দুলাল-ই লেখা আছে।

—ও, আচ্ছা!

অনিকেত চুপ করে থাকে।

অনিকেত ভাবে, যদি ও না-যায়, আবার ফোন আসবে। অনিকেতকেই গার্জেন ভেবে নিয়েছে ওরা।

শুক্লা বলল—যাও, ব্যাপারটা মিটিয়ে দাও। এটাই তো শেষ, আর তো যেতে হবে না। অনিকেত ভাবেও যদি ওর ডেরায় মরে যেত, তা হলেই তো ঝামেলা চুকে যেত। এসে ছুরি খেল, রোগ বাধাল, অনিকেতকে ব্যতিব্যস্ত করল।

শুক্লা বলল—দুলালের মা যদি বেঁচেও যায়, কাজে আসতে পারবে না। একটা লোক দেখতে হবে তো।

অনিকেত বলল, ওটা তোমার ডিপার্টমেন্ট।

শুক্লা বলল—পচার মা, খুদির মা-দের বলে লাভ হচ্ছে না কিছু। গত কয়েকদিন ধরে চেষ্টা তো চালাচ্ছি। সব বাড়িতেই তো কাজের লোক চাই, কেবল তো বাড়ি উঠছে। দেখো, কিছুদিন পর খাজাইতলা, নুড়া—এইসব গ্রামেও ফ্ল্যাটবাড়ি উঠবে। লোকগুলো কোথায় চলে যায় কে জানে? এখন এজেন্সি হয়েছে। ওরা কাজের লোক সাপ্লাই করে। ওখানে বলো।

অনিকেত বলে, আমরা তো চলেই যাচ্ছি। রিভাইড ট্রান্সফার অর্ডার-টা চলে এলেই তো চলে যাব…।

—সে কবে আসবে ঠিক আছে? আমি তো হাঁটু মুড়তে পারি না। ঘরদোর মোছা হচ্ছে না।

অনিকেত বলে, আচ্ছা, ঠিক আছে, দেখছি। তা হলে মর্গেই যাই, তুমি যখন বলছ।

বেশ ভাল হয়েছিল ফুলকপিটা। সবুজ কড়াইশুঁটিগুলো বড় মনোহর। কইমাছও আছে। ফুলকপি-কইমাছের কম্বিনেশনটা দারুণ হয়। কইমাছ আর ফুলকপির গন্ধ মিশে এক আশ্চর্য রসায়ন তৈরি করে। ট্যাংরা মাছের সঙ্গে পিঁয়াজকলি-ও। মেটে আলুর সঙ্গে মুলো। লাউয়ের সঙ্গে ছোট চিংড়ি।

কইমাছে কীরকম পচা গন্ধ পেল অনিকেত। মুখ থেকে বার করে ফেলে দিল। আবার একটু খুঁটে নিল। পচা গন্ধই তো!

মুখ বিকৃত করল অনিকেত।

শুক্লা বলল, কী হল?

অনিকেত বলল—বুঝতে পারছি না। মাছওলা কি মাছ পাল্টে দিল? আমি তো জ্যান্ত মাছ- ই এনেছিলাম। পচা গন্ধ লাগছে কেন?

শুক্লা বলল—তা কী করে হয়? তিনটে মাছই তো কাঁপছিল। কইমাছের প্রাণ সহজে যায় না। আমি একটু দেখি তো?

শখ করে খুব দাম দিয়ে বড়-বড় কইমাছ কিনেছিল। তিনটে মাছেই আড়াইশো।

শুক্লা অনিকেতের পাত থেকে সামান্য দ্বিধামাখা আঙুলে মাছ খুঁটে নিয়ে মুখে দিল।

—কী যা-তা বলো, কোথায় পচা? খুব স্বাদের মাছ। শুক্লা বলল।

আবার মুখে দিল অনিকেত। পচা গন্ধ। মর্গের গন্ধ।

অদ্ভুত ব্যাপার। অনিকেত ভাবে, এটা কীরকম ভৌতিক ব্যাপার। অনিকেত কিছুক্ষণ চুপ থাকে।

ফোন এসেছে।

শুক্লা ফোন ধরতে যায়।

অনিকেত নিষেধ করে। বলে, ও শালারা জ্বালিয়ে খাবে।

শুক্লা ফোন ধরে।

অনিকেত শোনে—হ্যাঁ হ্যাঁ, যাবে যাবে, এই তো খেতে বসেছে। একটু কিছু মুখে দিয়েই চলে যাবে। টাকাপয়সা? কত? অনিকেত খাওয়ার টেবিল ছেড়ে উঠে, শুক্লার কাছ থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে রেখে দেয়।

বলে, একদম পেয়ে বসেছে। সব সময় আমরা কেন? ওর আত্মীয়স্বজন নেই? ভাই-বোন নেই?

গজগজ করতে করতে হাত ধুয়ে নেয় অনিকেত। শখের ফুলকপি দিয়ে কই-টা খাওয়া হল না।

শুক্লা বলল, তোমার কী হয়েছে বলো তো? এরকম তো করো না। মাছটা খামোকা খেলে না। সত্যিই কি পচা গন্ধ পেয়েছিলে?

অনিকেত বলে, আমি মিথ্যে-মিথ্যে বলতে যাব কেন? এত শখ করে আনলাম…।

শুক্লা বলল—ওটাই হল কারণ। শখ করে আনাটা। সবার মনের ভিতরে আর একটা ‘মন’ থাকে। সেই মনটা নিশ্চয়ই বাইরের মন-কে বলছে—তোমার এত পরিচিত দু’-দুটো মানুষ যখন মরছে, তখন এত শখ হয় কী করে? ফুলকপি, এত দাম দিয়ে কইমাছ, কড়াইশুঁটি—তার ওপর আবার নলেন গুড় এনেছ…। তোমার ভিতরের মন বাইরের মনটাকে বলছে—পচে গিয়েছ। এছাড়া তো অন্য কোনও কারণ দেখছি না। আমি তো নিজে খেয়ে দেখলাম, মাছটা বেশ ভাল।

যাকগে, ও নিয়ে আর বেশি ভেবে লাভ নেই।

যেখানে যাওয়ার কথা, গেল। একবার ট্যাক্সিও নিতে হল। কীভাবে টাকাপয়সা খরচ হয়ে যাচ্ছে ফালতু-ফালতু। ধর্মে যদি খুব বিশ্বাস থাকত, তা হলে ভাবা যেত এটা এক ধরনের ইনভেস্টমেন্ট। ওর জীবন-খাতায় পুণ্য ক্রেডিট হচ্ছে। পরলোকে গিয়ে সুখে থাকবে। যদি মুসলমান হত—অনন্ত বসন্তের জান্নাৎ বা বেহেশ্ত পেয়ে যেত। ওখানে গেলে সব পুরুষই তেত্রিশ বছর বয়সের হয়ে যায়, মেয়েরা ষোড়শী। সব গাছ ফলে পূর্ণ। ফল খাওয়ার ইচ্ছে হলেই গাছের ডালটা নেমে যাবে, তুমি শুধু হাত বাড়িয়ে খেয়ে নাও। বেহেতিদের সেবার জন্য কানে দুল-পরা কিশোররা সবসময় নিয়োজিত থাকবে। তারা বারবার পানপাত্র পূর্ণ করে দেবে। কিন্তু ওই শরাব খেয়ে কেউ মাতাল হবে না। ওই কিশোর বালকরা বেহতিদের সবরকম সেবা করবে…। এদেরইকি ওমর খৈয়াম ‘সাকী’ বলেছে? কে জানে রে বাবা। কিন্তু এই সার্ভিসটায় পুণ্য ক্রেডিট হবে তো? সন্দেহ হওয়ার কারণ, ও যার জন্য সময় এবং অর্থ ব্যয় করছে সে তো ঠিক পুরুষ নয়। ও যা করেছে—তা গুনাহ্ করেছে। অন্যায় করেছে। বেশির ভাগ ধর্মই দুলালদের যৌন-জীবন সমর্থন করে না। মৃত্যুর পর দুলাল দোজখে যাবে, কিংবা নরকে। দু’টোই এক জায়গা অবশ্য। এই পাপাচারী পাষণ্ডকে মদত করলে পুণ্য হবে, না কি পাপ বাড়বে? এর ফয়সালা কে দেবে? ভাটপাড়ার কোনও ব্রাহ্মণ মনু-বৃহস্পতি-পরাশর থেকে কোনও উদ্ধৃতি দিতে পারবে না, কিন্তু বলে দেবে অধর্ম। ক্যাথলিক, ইহুদি এবং মুসলিম মতে তো দুলালের জীবনের ষোলো আনাই মাটি। কিন্তু হতে পারে, সবার মনের ভিতরে আর একটা মন আছে, যার কথা শুক্লা বলছিল, সেখানে একজন ধর্মগুরু বিরাজ করেন। তাকে ঠিকমতো দেখা যায় না, বোঝাও যায় না। যার কেরদানি বা ক্যারিশ্মা-য় টাটকা কইমাছ পচা মনে হয়; মনের ভিতরে মন, তার ভিতরে আর একটা মন, ওটা বোধহয় মনকোঠা। ওখানে কিছু একটা হয়। কী জানি কী হয়? এন্ডোক্রিন দিয়েও ব্যাখ্যা হয় না। ফ্রয়েড-পাভলভ-ইয়ুংও বোধহয় এসবের উত্তর জানেন না।

অকুস্থলে পৌঁছল অনিকেত। ওখানে বদু আছে, আর দুলালের কীরকম যেন জ্ঞাতিভাই রয়েছে। দুলালের ছেলে মন্টুও আছে। ওকেই তো মুখাগ্নি করতে হবে।

ছোট্ট একটা ঘরে একজন মাঝবয়সি লোক বসে ছিল। ওর আঙুলে রঙিন পাথরের আংটি, ডানহাতের কনুইয়ের মধ্যে দু’টো বড় সাইজের মাদুলি এবং একটা শেকড় বাঁধা। লাশ নিয়ে কারবার, তাই বোধহয় ভূত-প্রেতের হাত থেকে বাঁচার জন্য এসব সাবধানতা। বদু বলল, লাশ দিচ্ছে না স্যর।

অনিকেত গলার পর্দাটা এমন জায়গায় নিয়ে গিয়ে কথা শুরু করল, যেন অনুরোধ-উপরোধ না-হয়ে বাক্য-ডেলিভারিটা হুকুমায়িত হয়।

—কী হল? ব্যাপারটা কী? বড়ি ছাড়ছেন না কেন?

—কী করে ছাড়ব? কার বডি কাকে দিয়ে দেব? ও দুলাল না দুলালী, ওটার ফয়সালা তো আগে করতে হবে, না কি?

—কেন? ডেথ সার্টিফিকেট-এ তো দুলালী লেখা আছে।

—ডেথ সার্টিফিকেট-টা ওরই তার কী প্রমাণ? কেউ যদি রামের ডেথ সার্টিফিকেট নিয়ে এসে শ্যামের বডি চায়, দিয়ে দেব না কি? এটা তো পুলিশ কেস। পুলিশের কাগজে লেখা আছে দুলাল। রেশন কার্ডে দুলাল। ডেথ সার্টিফিকেটে দুলালের পর একটা ‘আই’ যোগ করে দিয়েছে। সব একইরকম না হলে কী করে বড়ি ছাড়ব? আগে কাগজপত্র ঠিকঠাক করে আনুন। লোকটা গলা চড়িয়ে বলল।

—দিন, ফোনটা দিন তো, পুলিশ কমিশনারকে একটা ফোন করি।

অনিকেত পুলিশ কমিশনারকে চেনে না। ফোন নম্বরও জানে না। একটু চমকে দেওয়ার জন্য কায়দা করেছিল।

লোকটা বলল, পুলিশ কমিশনার কেন, মুখ্যমন্ত্রী বললেও কাজ হবে না। আমি চাই পেপার লোকটা কলম খুলে অন্য কীসব কাগজপত্র দেখতে লাগল।

একটা ডোম এল। অনিকেতকে হাতছানি দিয়ে বাইরে ডাকল।

বলল, শোনেন স্যর, সাহেব খুব কড়া। আমি বলে-কয়ে দেখি। আমাকে বকশিস দেবেন।

—কত?

—দু’হাজার

—দু’হাজার কেন?

—এমনি লাশটা টেবিল থেকে খাটিয়ায় সরাতেই তো পাঁচশো নিই। এটা তো গড়বড় কেস। কেসটা তো হিজড়ে কেস। হিজড়ে-মড়া আমি ছুঁই না। অন্যকে দিয়ে করাব। সে আরও নিচু ডোম। লোকটার মুখ থেকে চুল্লুর গন্ধ বেরচ্ছিল।

—এক হাজার নাও, এক হাজার।

—না। তা হলে হল না।

এবার গলা পরিবর্তন করে অনিকেত। বাবু, এই গরিবকে ভিক্ষে দিন’ বলার সময় গলার পর্দা যেখানে থাকে, সেখানে রেখে বলল, ছেড়ে দাও না বডিটা, ওর কেউ নেই। আমাকেই সব দিতে হবে।

—আপনি তো ভদ্দরলোক, ওর সঙ্গে কী?

—কিচ্ছু না, ওর মা আমার বাড়ি কাজ করত। —তা হলে তিন থাপ্পড়।

থাপ্পড় শুনে ঘাবড়ে গেল অনিকেত।

হাতের পাঁচটা আঙুল এক করে ঠাকুর-দেবতার বরাভয় মুদ্রা, কিংবা কংগ্রেসে ভোটের হাত-চিহ্নর মতো হাতটা সামনে ধরে।

–এক হাতের পাঁচ আঙুল। মানে পাঁচশো। তিন থাপ্পড় মানে তবে দেড় হাজার?

অনিকেত জিজ্ঞাসা করল, দেড়?

লোকটা ঘাড় নাড়ল।

রফা হল।

একটা নীল পলিথিনে মোড়ানো দেহ। তলার দিকে একটু ছেঁড়া, ওখান থেকে পায়ের আঙুল বেরিয়ে আছে। পায়ের আঙুলে একটা রিং। গয়না?

—ইচ্ছে হলে মুখ খুলে দেখে নিতে পারেন মাল ঠিক আছে কি না। ডোম বলল। বাবুর সঙ্গে কোনও কথা হল না। উনি কর্মে নিমগ্ন।

এবার একটা মৃতদেহ এবং চারজন জীবন্ত। অনিকেত, মন্টু, বদু এবং দুলালের কোন জ্ঞাতি। দুলালের জ্ঞাতিভাই বলল—শত হলেও নিজের লোক। যোগাযোগ ছিল না। তবে আমার ঘরের কেউ মরলে ওদের নেড়া হতে হয়, ওদের কেউ মরলে আমাদের। আমার বাপ যখন মরল, দুলাল তো তখন নিরুদ্দেশ। নেড়া হয়নি। কিন্তু দুলাল মরেছে, আমি নেড়া হব। ঘাটের কাজও করব।

অনিকেত জিজ্ঞাসা করল, ও কীরকম ভাই হত আপনার?

ও বলল, আমার ঠাকুর্দা আর দুলালের ঠাকুর্দা ছিল দু’ভাই।

—আপনার নাম?

—পঞ্চানন মিরধা।

—কোথায় থাকেন?

—কাছেই তো থাকি।

অনিকেত বলল—এবার তা হলে সৎকারের কাজ করুন। আপনার জ্ঞাতিভাই যখন, আপনিই যা হোক করুন। আমার আর কোনও কাজ নেই।

কোথায় পোড়ানো হবে? পঞ্চানন মৃধা মাথা চুলকাল। বলল, আমরা তো আমাদের লোকজন মরলে মুড়াগাছার শ্মশানেই পোড়াই। ওখানে হিজড়ে পোড়ালে পঞ্চায়েত থেকে আবার আপত্তি করবে কি না কে জানে? মহা গেরো হল। নিমতলা নিয়ে গেলে হয় না?

অনিকেত বলল—আপত্তি হবে কেন?

পঞ্চানন বলল—আমাকে কিন্তু আগেই দেবু মণ্ডল বলে দিয়েছিল ওকে গাঁয়ে এনো না। শ্মশান অপবিত্তর কোরো না।

—দেবু মণ্ডল কে?

—আমাদের প্রধান। আমরা আট-দশ গাঁয়ের লোক মুড়াগাছার সোঁতার ধারে শ্মশানেই তো পোড়াই। ওখানে আজ অবধি হিজড়ে পোড়েনি। কে জানে, ওরা যদি ঝামেলা করে, শহরের ভিতরে কেউ কারও খোঁজ রাখে না। আর খরচার কথা যদি ধরেন—মেটাডোরে এই শ্যালদা থেকে মুড়াগাছায় মড়া নিতে যা খরচ, তার চেয়ে কমে নিমতলায় হয়ে যাবে। বদু, মানে বদরুদ্দিন বলল—শুনেছি হিজড়েরা নাকি কবর দেয়?

অনিকেত বলল, আর হিজড়ে-হিজড়ে করছ কেন? দুলাল তো ওই জীবন শেষ করে তোমাদের কাছেই চলে এসেছিল।

পঞ্চানন মন্টুকে জিজ্ঞাসা করল, হ্যাঁ রে, তোর বাপ কিছু বলেছিল তোকে, মরলে কী করতে হবে না হবে?

মন্টু ঘাড় নাড়ে।

পঞ্চানন বলল—বডি-টা যদি না নিতাম, তা হলে সরকার থেকেই যা করার করে দিত। একবার ভেবেওছিলাম বডিটা লোবনি। আমার পরিবার বলল, না, মরার পরে সৎকার না-হলে ও ভূত হয়ে ঘুরে বেড়াবে, সে কি ঠিক হবে? হিজড়ে-ভূত ভাল নয়কো…।

পঞ্চানন বলতে থাকে, খুড়িমাও বোধহয় বাঁচবে না। যদি একসঙ্গে মিটে যেত, একই দিনে কাজটা করে ফেলতুম। মরলে আবার নতুন করে ঝামেলা।

মর্গের সামনেই ম্যাটাডোর দাঁড়িয়ে থাকে। ওখানে খাটিয়াও রাখা থাকে। অনিকেত চলে যাবে ভেবেও যেতে পারল না। ও সামনে, ড্রাইভারের পাশে বসল।

শীতকালের এই কয়েকটা মাত্র দিন কলকাতা শহর বড় সুন্দর হয়ে ওঠে। আকাশ থেকে নেমে আসে জরির ঝালর। বাহারি পোশাক গায়ে মানুষরা। রাস্তা জুড়ে কেমন যেন উৎসব- উৎসব ভাব।

এরই মধ্যে একটা প্রায়-অঙ্গার মৃতদেহকে নিয়ে চলেছে অনিকেত। ম্যাটাডোরের ড্রাইভার ক্যাসেট চালিয়েছে, ‘ও কেন এত সুন্দরী হল।’ ওরই মধ্যে ড্রাইভারটা বলল—স্যর, হিজড়ে- মড়া? বয়স তিরিশের মতো। চিমসে।

অনিকেত চমকে উঠল।

—আপনি কী করে জানলেন?

—আমায় কেউ আপনি বলে না। ‘তুই’, ‘তুমি’ এসব।

—আচ্ছা, ঠিক আছে। কে বলেছে?

—ডোম।

—কী বলেছে?

–বলেছিল মড়াটা হিজড়ে। বেশি চাইবি।

—বেশি চেয়েছিলে?

—না, স্যর। যা ভাড়া তা-ই চেয়েছি। অন্যরা হলে বলত মেটাডোরে হিজড়ে ওঠাই না, ওঠালে গাড়ি খারাপ হয়…এসব।

—বেশি চাইলে না কেন?

–বেশি চাইলাম না, সত্যি কথা বলছি, আপনাকে দেখে।

বারো বছর এ লাইনে আছি, দু’বার হিজড়ে-কেস পেয়েছিলাম। একটা ছিল সুইসাইড কেস, রেলে গলা দিয়েছিল, বডি নিয়ে শ্মশানে যাইনি, টিটাগড়ে, ওদের ঠেক-এ। হিজড়েরা দল বেঁধে নিতে এসেছিল। মেটাডোরে লাশ ওঠানোর পর ওরা তালি বাজাচ্ছিল। আর একটাও, স্যর, রেল কেস। সুইসাইড নয়, পড়ে গিয়েছিল। ওরা কিন্তু বলছিল, পড়ে যায়নি, ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল কোনও পাবলিক। ওরা তো ট্রেনে উঠে পাবলিকের কাছে টাকাপয়সা চায়, বিচ্ছিরি রং-ঢং করে, ওইসব নিয়েই হয়তো কিচাইন হয়েছিল। ওদের দলের একজনকে কোনও ভদ্দরলোক ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল। জিজ্ঞাসা করেছিলাম, বাকি যারা ছিল ওরা পুলিশে ভায়রি করেনি? শুনলাম, পুলিশ ডায়রি নেয়নি। পুলিশ বলেছে, কে ধাক্কা মেরেছে তার নাম বলো, ঠিকানা বলো। ওরা কী করে জানবে, যে ধাক্কা দিয়েছে তার বিত্তান্ত? পুলিশ ওদের ফুটিয়ে দিয়েছিল স্যর। সেবারও ছ’সাত জনকে নিয়ে শ্মশানে যাইনি, ওদের ঠেক-এ গিয়েছিলাম। ওটা ছিল টিকিয়াপাড়ায়।

—ওদের থেকে বেশি টাকা নিয়েছিলে?

—তা স্যর বেশিই চেয়েছিলাম। ওরা তো দরাদরি করে, কিন্তু যখন বলি হিজড়ে-বডি ওঠাই না, তখন ওরা কিছু বলতে পারে না। লাস্ট কেস-টাতে স্যর, একজন বলেছিল, আমাদের বডি তুললে কি অপবিত্র হবে? তবে আমরা শুধরানি করে দেব। মুতে দেব। আরও সব কাঁচা খিস্তি স্যর। আমিও তুলব না। পরে সেল হয়ে যায়। কিছু বেশি তো নেবই।

ওরা স্যর শ্মশানে না-নিয়ে নিজেদের ঠেক-এ নিয়ে যায়। শুনেছি ওদের কীসব আচার- টাচার আছে। আলাদা মন্তর আছে। একজন বলেছিল—ওদের নাকি কবর হয়। যে-বাড়িতে থাকে ওখানেই পুঁতে দেয়। এটা কি ঠিক?

অনিকেত বলে, জানি না।

অনিকেত নিলয় চৌধুরী আর মলয় মজুমদারের বইটা পড়েছিল। ওখানে লেখা আছে গভীর রাতে ওরা শ্মশানে যায়। কোথাও আবার মৃত শরীরে লাঠির বাড়ি মারা হয়, ওঁরা লিখেছিলেন—আগ্রার কাছে কোথাও হিজড়েদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় উপস্থিত ছিলেন তাঁরা, মৃতদেহকে স্নান করানো হয়, তারপর শবযাত্রা। শবযাত্রায় কোনও হিজড়ে যায়নি। কিছু পড়শি, মৃতের দুই পালিত পুত্র আর ওদের খোল-এ যাতায়াত করা লোকজন। একসময় একজন হিজড়েকে জিজ্ঞাসা করা হল, মৃতদেহের সঙ্গে আপনারা গেলেন না কেন? জবাব এল, হামে ঔরতে। ইস লিয়ে মৌত কা সাথ যানা গুনাহ্ হ্যায়। শবদেহ নিয়ে শ্মশানে বা গোরস্থানে মেয়েরা যায় না।

কেউ-কেউ ভাবে হিজড়েদের নাকি পোড়ানোই হয় না। ওদের ভাগাড়ে ফেলে আসা হয়। এরকম নানারকম গুজব, সত্যি-মিথ্যে কাহিনি আছে। মৃত্যু-পরবর্তী আচারটা স্থান ভেদে বিভিন্ন রকম হয়। দুলাল যদি এখানে না পালিয়ে আসত, ওর সেই পানাগড়ের খোলেই মারা যেত, তা হলে কী হত কে জানে?

ড্রাইভার জিজ্ঞাসা করল—যে মারা গেছে ও কি সত্যিই হিজড়ে?

—হিজড়ে বলতে কী বোঝো তুমি?

—আমি স্যর এইটুকুই জানি, ওরা ছেলেও না মেয়েও না। ইস্কুলে ব্যাকরণ বইতে পড়তাম না স্যর, পুংলিঙ্গ, স্ত্রীলিঙ্গ আর ক্লীবলিঙ্গ…। পরীক্ষায় লিঙ্গ পরিবর্তন আসত। পুংলিঙ্গ থেকে স্ত্রীলিঙ্গ করো, আবার স্ত্রীলিঙ্গ থেকে পুংলিঙ্গ করো। চাকর-চাকরানি, গয়লা-গয়লানি, কিন্তু ক্লীবলিঙ্গের কোনও লিঙ্গ পরিবর্তন হত না। এরা হল সেই ক্লীবলিঙ্গ। ঠিক বলেছি স্যর?

—না, ঠিক বলোনি।

—কেন স্যর?

ক্যাসেটে তখন, “তবে কেন পায় না বিচার নিহত গোলাপ’ হচ্ছে।

—সে অনেক কথা। এখন থাক।

—ঠিক আছে স্যর। কিন্তু ডোমটা যা বলেছিল, সেটা কি সত্যি? যার বডি যাচ্ছে সে হিজড়ে…

—হ্যাঁ। কিন্তু সে ক্লীবলিঙ্গ নয়, পুরুষ হয়েই জন্মেছিল। পরে হিজড়েদের দলে চলে গিয়েছিল।

—অ, আপনার কেউ হয়!

—ভাই।

—ভাই? না ভাইয়ের মতন!

—না, ভাই। দূর সম্পর্কে।

—তা হলে ভদ্দরলোকদের ঘরেও হিজড়ে হতে পারে? যাব্বাবা। আগে ভাবতাম ছোটলোকদের ঘরেই হিজড়ে জন্মায়।

—কেন এরকম ভাবতে?

—সেটা বলতে পারব না স্যর। ভাবতাম, যারা আগের জন্মে ব্যভিচার করে, মা-বোন মানে না, ওরাই পরের জন্মে হিজড়ে হয়ে জন্মায়।

—তো, ব্যভিচার কি ভদ্দরলোকরা করে না নাকি?

—করে, বেশি করে করে।

—তবে? ভদ্দরলোকের ঘরে হিজড়ে জন্মায় না বলছ কেন?

—কে জানে স্যর কেন বললাম?

এবার কিছুক্ষণ চুপচাপ

ড্রাইভার বলল—আর একটা কথা জিগ্যেস করব সার? এই ডেডবডি-টার আপনি ছাড়া আর নিজের লোক কে আছে?

—কেন, ওর ছেলে আছে তো?

—ছেলে? নিজের?

— হ্যাঁ।

—যাব্বাবা সব গুলিয়ে যাচ্ছে স্যর। ও হিজড়েদের দলে ভিড়ল বড়বেলায়? ছেলে হওয়ার পর?

—হ্যাঁ।

—আরও গুলিয়ে যাচ্ছে স্যর। আগে ভাবতাম যারা ক্লীবলিঙ্গ হয়ে জন্মায়, যাদের এটা- ওটা কিছুই নেই, শুধু একটা ছ্যাঁদা, পেচ্ছাব করার—বাপ-মায়েরা সেই বাচ্চাটাকে হিজড়েদের দিয়ে দেয়। নইলে হিজড়েরা যখন বাচ্চা নাচাতে আসে, ওরকম দেখলে নিয়ে যায়। আবার এটাও শুনেছি, কোনও বাপ-মা যদি মায়া করে বাচ্চা লুকিয়ে রাখে, হিজড়েরা যে তালি দেয়, সেই তালির শব্দ শুনে বাচ্চারা ঘর ছেড়ে চলে যায়…। এগুলো সব বাজে কথা?

–বাজে কথাই তো।

শ্মশানে এসে থামে। নিমতলা।

লাইনে বেশি ছিল না। দু’টো মাত্র। ইলেকট্রিক চুল্লিতে চল্লিশ মিনিট করে ধরলে দেড় ঘণ্টার মতো অপেক্ষা করতে হবে। অফিশিয়াল কাজকর্ম অনিকেতকেই করতে হল। ফর্ম ফিল- আপ, ডেথ সার্টিফিকেট জমা দেওয়া ইত্যাদি।

বামুন চলে এল। ওর পুঁটলিতে সবই থাকে। মূল্য ধরে দিলেই হয়। বামুন বলল, মোড়া কেন? পঞ্চানন বলল, পুড়ে যাওয়া কেস কিনা….।

—ও অপঘাত মৃত্যু। প্রায়শ্চিত্তির আছে।

—করে দিন…।

—প্লাস্টিক খুলতে হবে তো…।

প্লাস্টিক খুলল পঞ্চানন আর বদরুদ্দিন মিলে। কোনও মুসলমান হিন্দু-মড়া স্পর্শ করছে বলে পঞ্চানন আপত্তি করল না।

খুলতেই আঁতকে উঠল সবাই। সমস্ত দেহটা বীভৎস দেখাচ্ছে। মুখটা পোড়েনি।

নাম কী? বামুন জিগ্যেস করে।

দুলালী মৃধা। অনিকেত বলে।

দুলালী? বামুন ঠাকুর দেহটা নিরীক্ষণ করতে থাকে। আর একবার প্রশ্ন করে, দুলালী অনিকেত মাথা নাড়ায়। পঞ্চানন বা বদু কিছু বলে না।

গঙ্গাজলে স্নান করাতে হয়। এখানে স্নান করানো যাবে না, ছিটা দাও। বিসলারি-র সাদা বোতলটা ঝোলা থেকে বার করে।

—মুখাগ্নি করবে কে?

মন্টুকে দেখায় ওরা।

মন্টু এতক্ষণে কাঁদে।

—জল ছিটাও। বলো অপহতা সুরারক্ষাংসি বেদীসদঃ।

যা বলল তা-ই বলল মন্টু।

চাল, কলা, তিল এসব দিয়ে মণ্ড পাকানো হল। বামুন বলল, তোমার মায়ের মুখে ছোঁয়াও।

—গোত্র কী?

পঞ্চানন বলল, কচ্ছপ।

—কচ্ছপ হয় না, কাশ্যপ।

–বলো—কাশ্যপ গোত্রং প্রেতং দুলালী দেব্যাঃ এতত্তে তিলতন্ডুলোদকং তৃপ্যস্য। এসব কাজ-কর্মের পর পাঠকাঠিতে আগুন ধরানো হল।

বদু হঠাৎ একটু দূরে গিয়ে আকাশের দিকে তাকাল। দুহাত সামনের দিকে বাড়ানো। দোয়া চাওয়ার সময় যেমন করে। বামুনঠাকুর জ্বলন্ত পাটকাঠি মন্টুর হাতে দিয়ে বলল মুখে ছোঁয়াও। ঠিক তক্ষুনি মন্টু ভীষণ জোরে ‘মা, মা–মাগো’ বলে কেঁদে উঠল।

মন্টু বলতে লাগল, বাবা গো, কতবার বলেছিলে ‘মা’ ডাক খোকা, আমাকে ‘মা’ ডাক। আমি ডাকিনি। ‘মা’ ডাকিনি। এখন তোমায় ‘মা’ ডাকছি, তুমি তো শুনতে পাচ্ছ না….

বামুন বললেন—শোক পরে। পড়ো—ওঁ দেবা দেবাশ্চাগ্নি মুখাঃ সর্বে হুতাশনং গৃহীত্বা এবং দহন্তু…

দহনের জন্য প্রার্থনা মন্ত্ৰ।

মন্টু নিজস্ব দহনে কেঁদে যায়।

মৃত্যুর আগে লিঙ্গ-ছিদ্রপথে ছদ্ম-ঋতুরক্ত দেখেছিল ও। এবার মাতৃডাক-ও পেল।

শুনল না দুলালী।

২৮

শুক্লা বলল, কেক এনো।

বড়দিন কিনা, কেক খেতে হয়। রথের দিনের পাঁপড়ের মতোই বাঙালি যিশুর জন্মদিনে কেক খায়। হিন্দু-বাঙালিরা ঈদে একটু ফিরনি খেতে পারত, না হলে পায়েস। কই, খায় না তো? ঈদের আগে রাজাবাজার-মল্লিকবাজার-খিদিরপুরে রকমারি সেমুই বিক্রি হয়। অনিকেত তো কখনও কেনেনি।

যিশুর হ্যাপি বার্থডে। বাড়িতে কেক কাটা হল। অনিকেত কিছুটা খেল। বিকেলে শুক্লার পোষা কাক দু’টো আসে না। ওরা সকাল ৮টা নাগাদ একবার আসে, বেলা দেড়টা নাগাদ আর একবার। ব্রেকফাস্ট আর লাঞ্চ। এই যে শুক্লা কেকের ভিতর থেকে কিশমিশ দু’টো খুঁটে বের করে ট্রে-র এক কোনায় রাখল, নিশ্চয়ই হাঁদা-ভোঁদার জন্য। কাক দু’টোর মধ্যে একটা বেশি চালাক, খাবারটা ঠুকরে নিয়ে আগেভাগে পালায়। ও হল ভোঁদা। অন্যটা হাঁদা। যখন ওরা চুপচাপ থাকে, শুক্লা হাঁদা-ভোঁদা’কে আলাদা ভাবে চেনে। অনিকেত চেনে না। হারু আর নাড়ুকেও শুক্লা চেনে আলাদা-আলাদা ভাবে। হারু আর নাড়ু, দু’টোই রাস্তার কুকুর। ওদের নেড়ি বলা হয়—কেন কে জানে? দু’জনই ধূসর, কিন্তু একজন, নাড়ু, প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, আত্মসম্মানী। রুটি ছুড়ে দিলে খায় না। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে রেখে দিতে হয়। চোখের ভাষায় বোঝাতে হয় ‘ইহা তোমারই জন্য’, কিংবা রুটিটা হাতে ধরে ‘নাড়ু নাড়ু’ বলে ডাকতে হয়, নাডুবাবু হাত থেকে রুটিটা কামড়ে নিয়ে চলে যায়। কিন্তু হারুর কোনও আত্মসম্মান নেই ছুড়ে দিলেও লেজ নাড়তে নাড়তে খেয়ে নেয়। অথচ নাড়ু-হারু একই প্রজাতির কুকুর, একই পরিবেশে বড় হয়েছে। অথচ দু’জনের দু’রকমের ব্যক্তিত্ব। এর কী ব্যাখ্যা কে জানে?

দু’টুকরো কেক শুক্লা আলাদা করে রাখল কাগজে মুড়িয়ে—নিশ্চয়ই নাড়ু-হারুর জন্য। ঠিক এই সময় মন্টুর কথা মনে হল অনিকেতের। ও কী করছে একা-একা? বেচারা একেবারেই অনাথ হয়ে গেল। দুলাল মারা যাওয়ার পর, তিনদিনের দিন, দুলালের মা মারা যায়। পঞ্চাননই সৎকারের ব্যবস্থা করেছে নিজের মতো করে। অনিকেতের বাড়িতে ফোন করেছিল মন্টু। শুক্লা তখন অনিকেতকে অফিসে খবর দিয়েছিল। অনিকেত একটু অনুনয়ের সুরেই বলেছিল, ওখানে আর যেতে পারব না। যেন, দুলালের মা শুক্লার বাপের বাড়ির দিকের কেউ। শুক্লা বলেছিল— না না, আর কত করবে? তবে দুলালের মা-ও তো আমাদের জন্য অনেক কিছু করেছে… সেই কতদিন… এতদিন লোক কারও বাড়িতেই থাকে না। “ঠিকই তো, ঠিকই তো’ বলে ফোন কেটে দিয়েছিল অনিকেত।

ওই যে পঞ্চানন, দুলালের মায়ের কাছে ওর নাম কখনও শোনা যায়নি। ও এখন উদয় হয়েছে। ভালই হয়েছে, নইলে সব ধকল অনিকেতকেই সামলাতে হত। দুলালের মা-কে শেষ দেখাটা হল না। পোড়ামুখ কী আর দেখবে, অবশ্য দুলালের মা পুড়ে যাওয়ার আগেই বলত—দ্যাকো দিকি, কীরকম মুখটা পোড়ালাম। দুলালের কারণেই নিজেকে ‘পোড়ামুখী’ ভাবত দুলালের মা।

পঞ্চানন কি মন্টুকে নিজের কাছে রাখবে? পঞ্চাননের স্ত্রী-পুত্র-পরিবার সম্পর্কে খোঁজ নেওয়া হয়নি। তবে এইটুকু জানে যে, পঞ্চানন মাছের কারবার করে। কলকাতা শহরের এই পূর্বপ্রান্তে অনেক বিল, বাঁওর, ভেড়ি ছিল। বিদ্যাধরী নদী স্রোত পাল্টেছে বারবার, আর অবশেষ রেখে গিয়েছে। ওসব মরা খাতে জল থাকত, আর থাকত মাছ। জল ছিল সামান্য লবণাক্ত। এই জলে পাবদা, পার্শে, ভোলা এসব ভাল হয়। কয়েক হাতের চিংড়িও। ১২/১৪ বছর আগেও প্রচুর মাছ উঠত স্থানীয় বাজারে। এখন কমে গিয়েছে। মন্টুকে কি মাছের কারবারে খাটাবে পঞ্চানন?

যা-খুশি করুক গে।

দুলালের মা মারা গিয়েছে দু’দিন হল। একদিন যাওয়া উচিত হয়তো, কিন্তু ঠিক তার আগেই ওরা চলে আসবে। পয়সাকড়ি নেবে না?

শুক্লা বলল- -দু’পিস কেক ওই মন্টুটার জন্য রেখে দিলাম। কেকটা তো ভালই এনেছিলে। মন্টু ঠিক চলে আসবে।

আমিও তো মন্টুর কথাই ভাবছিলাম—অনিকেত বলে।

ঠিক এ সময় কলিংবেল বাজে। অনিকেত খুলে দ্যাখে ধড়াচুড়ো পরে মন্টু। ওরা দু’জনই একসঙ্গে বলে ওঠে—তোর কথাই হচ্ছিল, অনেক দিন বাঁচবি।’

‘অনেক দিন বাঁচবি’ বলেই অনিকেতের মনে হল—এই সব সংস্কার-কুসংস্কারে ওর বিশ্বাস নেই, যার নাম করা হচ্ছে, সে যদি চলে আসে তক্ষুনি, তবে তার পরমায়ু বাড়ে, এটা একটা লোকবিশ্বাস। অনিকেত এটা বিশ্বাস না-করেও বলে ফেলল। আসলে রক্তে থাকে।

মন্টু একাই এসেছে। একটা ধুতি পরেছে, গায়ে চাদর, গলায় ঝুলছে একটা মাছ ধরার জালের লোহা। ছেলেটার সারা মুখে মেঘ। হাতে একটা ছোট ঝোলা। ঝোলার ভিতর থেকে বের করল একটা ছোট রুমাল, আর ভাঁজ করা কাগজ। আগে কাগজটা তুলে দেয় মন্টু।

শ্ৰীশ্ৰী দুর্গা,

আমার কখন কী হয় ঠিক নাই। আমার নাতি ছাড়া কেহ নাই, আর আছো তোমরা। এই আমার বিবাহের রূপার কানফুল, সোনার নাকফুল, রূপার হার, আর কর্তার দেওয়া সোনার কানফুল। বহু কষ্টেও বেচিনি। বউদি গো, সব তোমায় দিলাম। যদি পারো নাতিটারে দেখো, ভগবান মঙ্গল করুন।

তলায় কোনও সই নেই।

মন্টু বলল, ঠাকমা আমাকে দিয়ে এটা লিখিয়ে রেখেছিল।

কবে লিখিয়েছিল? শুক্লা জিজ্ঞাসা করে।

—দুবছর আগে। আমি আর ঠাকমা ছাড়া আর কেউ জানে না।

এবার পুঁটুলিটা দিল। পুঁটুলিটা মানে, একটা সাদা রুমাল, গিঁট খুললে কুণ্ডলী-পাকানো সম্পত্তি।

সম্পত্তি সমর্পণ করল মন্টু। আর স্বাক্ষরহীন উইল।

শুক্লা চোখের জল মুছল।

—তুই এখন কোথায় আছিস?

—বাড়িতে।

–তোর বাড়িতে, না তোর জ্ঞাতির বাড়িতে?

—আমার বাড়িতে।

—ভয় করে না?

মাথা নাড়ে মন্টু।

বলে, ঠাকমার সঙ্গে শুতাম। সেই বিছানায় শুই না। নিচে মাদুরে শুই। বাপ আসে, পায়ে আলতা। বলে ‘মা ডাক, মা ডাক।’

–তোর জ্ঞাতির বাড়িতে গিয়ে থাকিস না কেন? সে তো তোর কাকা হয়।

—ওরা লোক ভাল না।

—থাকতে বলেনি?

মাথা নাড়ে মন্টু। বলেছিল।

মন্টু বলে, আগে তো এ বাড়ি আসত না, ছোটবেলা থেকে দেখিনি। এখন আসছে-যাচ্ছে। একদিন বলল, ‘তোদের জন্য অনেক টাকাপয়সা খরচ হচ্ছে আমার, তোর ঘরে কী আছে দেখি…’ বলে ঘরের সব কিছু উল্টেপাল্টে দেখতে লাগল। ঠাকমা কোথায় টাকা রাখত আমাকে জিজ্ঞাসা করল। আমি বললাম, জানি না। ও বলল, জানিস না? তুই তো খুব স্যায়না। কিন্তু পেয়ে গেল। একটা কৌটোর মধ্যে রাখত। কুলুঙ্গির সব কৌটো খুলে দেখছিল সেই কাকু একটার মধ্যে পেয়ে গেল। কত ছিল জানি না। কৌটোসুদ্ধু নিয়ে গেল। আমার সামনে গোনেনিকো। গুনলে তো জেনে ফেলব কত আছে। তবে আমি জানি, ওর মধ্যে অনেক ক’টা একশো টাকার নোটও ছিল। কত দিন ধরে জমিয়েছে, তাই না?

একনাগাড়ে অনেকগুলো বাক্য বলল মন্টু। এত কথা একসঙ্গে এর আগে শোনেনি অনিকেত। অনিকেত লক্ষ করল, মন্টুর স্বরক্ষেপণের মধ্যেও একটা সুর আছে, ওর হল রেডিও-র কান, ওই কানে ধরা পড়ল—

তবে কি এই মন্টুও ওই টাইপের নাকি? সেরেছে। আগেও লক্ষ করেছিল ব্যাপারটা। তবে যে ধারণা করা হয়েছিল মন্টু দুলালের ঔরসজাত নয়, দুলালেরও এই বিশ্বাস ছিল। তবে কি ওই ধারণা ভুল? মন্টু দুলালেরই ছেলে বলে দুলালের ওইসব গুণ পেয়েছে? কিন্তু একটা তত্ত্ব আছে, সমকামিতা বংশগত নয়। জিনের প্রভাব নেই। আবার অন্য একটা তত্ত্বও আছে, সমকামিতা জিন-প্রভাবিত। পৃথিবীব্যাপী গবেষণা চলছে সে-জিন খুঁজে বের করার। একসঙ্গে একগুচ্ছ প্রশ্ন। ‘মহাভারত’ সিরিয়ালে কর্ণ যেমন ডজনখানেক তির একসঙ্গে ছুড়ে দিত, সেরকম ভাবে প্রশ্ন চিহ্নগুলো ধেয়ে এল।

শুক্লা আশ্চর্য হয়ে বলল, সে কী রে, তুই কিছু বললি না?

মন্টু ঘাড় নাড়ল।

—কী বলব আমি? ওরা তো নিয়ে গেল।

—আশপাশের বাড়ির কাউকে কিছু বললি না তুই? চ্যাঁচালি না?

—কী করব বলুন? আমাদের তো কেউ দেখতে পারে না, বাবার জন্য।

শুক্লা বলল, এই যে তোর অশৌচ চলছে, তোর কাকু তোকে বলেনি ওর বাড়ি গিয়ে খেতে?

–বলেচে। ওখানে মালসা পোড়াচ্চি। একবেলা খাই।

—যাক। ওদের বাড়িতেই খাচ্ছিস তবে।

—হ্যাঁ।

—ওরা আর কী বলেছে?

—কাকি বলেছে, কাকুর সঙ্গে কাজে লেগে যা। এই বাড়িতেই থাকবি, খাবি।

–তো বলেছে যখন সেরকমটা করছিস না কেন?

মন্টু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, ওখানেই থাকতে হবে। আমার তো আর কোনও উপায় নেই, আমার তো কেউ নেই। মন্টুর গালে জল।

অনিকেত বলল, কেক-টা ওকে দিয়ে দাও না।

শুক্লা বলল, আজ বড়দিন কিনা, কেক ছিল। খাবি? না, থাক। তুই তো হবিষ্যি করছিস। কেকে ডিম থাকে।

মন্টু বলল, কেক খেলে কি পাপ হয়?

কেউ কোনও উত্তর দিল না।

—হবিষ্যি করতে হয় কেন?

কেউ উত্তর দিল না ফের।

—বাবার আত্মা আর ঠাকমার আত্মা এক জায়গায়, তা-ই না? ওরা তো একসঙ্গেই বেশ আছে। আমি পড়ে আছি। আত্মারা কি কথা বলতে পারে?

আবার। নৈঃশব্দ্য।

শুক্লা জিগ্যেস করল, তুই কি স্কুলে পড়িস মন্টু…

—পড়ি।

—কোন ক্লাস?

—সিক্স কেলাস।

নাতির বই-খাতা কেনার জন্য টাকা নিয়ে যেত দুলালের মা। কোন ক্লাসে পড়ে ঠিকঠাক জানত না।

শুক্লা ধূসর রুমালটা মুঠোর মধ্যে ধরে বলল – তোর ঠাকুমা এটা আমার জন্য কোথায় রেখেছিল রে মন্টু, যেটা ওরা খুঁজে পায়নি?

—ঠাকমা এটা আমাকে দেখিয়ে রেখে দিয়েছিল একটা কাঠের ইঁদুর-মারা কলের ভিতর। ওটা তক্তাপোশের তলায় রাখা ছিল। ঠাকমা বলেছিল, চোর এলেও কিছু টের পাবে না।

মন্টু হাসল।

এই প্রথম মন্টুর হাসিমুখ দেখল অনিকেত।

শুক্লা দু’টো কলা ছাড়া কোনও ফল পেল না। অনিকেত ফল খেতে ভালবাসে না, ও ফল আনে না। শুক্লা অপছন্দ করে না যদিও, অনিকেত খায় না বলে, ওরও খাওয়া হয় না। কিন্তু শুক্লার ঠাকুরের জন্য একটু-আধটু ফল আনতে হয়। এটা হয়তো সেই দেবভোগ্য কলাই হবে।

একশোটা টাকা হাতে দিল শুক্লা। মন্টু হাত পেতে নিল।

বলল, মাঝে-মাঝে আসিস, আর একা থাকিস না। ওদের বাড়িতেই থাকবি। ও বাড়িতে আর কে কে আছে?

—কাকা, কাকি, ওদের দুই ছেলে, এক মেয়ে।

—ছেলেরা কত বড়?

—আমার চেয়ে সবাই বড়।

—তোর সঙ্গে ভাল করে কথা বলে?

মন্টু চুপ করে থাকে।

শুক্লা মন্টুর মাথায় হাত স্পর্শ করে একবার

দু’দিনে আলাদা ভাবে পারলৌকিক কাজকর্ম হল। দুলালের কাজ আগে হল, ওর মায়ের কাজ পরে। গঙ্গার ধারে কাজ সারা হয়েছিল। দুলালের কাজের দিন কেউ যায়নি, তবে দুলালের মায়ের কাজের দিন শুক্লা যেতে চাইল বলে, অনিকেত নিয়ে গেল। বাগবাজারের ঘাটে। ন্যাড়া- মাথা মন্টুকে দেখল। পঞ্চাননও ন্যাড়া-মাথা হয়েছে। একটা ওড়িয়াদের হোটেলে পাঁচ বামুনকে খাওয়ানো হল। যে-বামুন কাজটা করিয়েছিল, সে, ওর ছেলে, আর এক বামুনকে গাঁ থেকে ধরে এনেছিল। দু’জন বামুন কম পড়েছিল। একজন ঘাট থেকে ম্যানেজ হয়ে গেল, আর অনিকেত পঞ্চম ব্রাহ্মণ।

শালপাতার থালায় ভাত, ডাল, ছ্যাঁচড়া পড়ল। আমিষ না নিরামিষ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে ঘাটে ম্যানেজ-করা বামুন বলল, বাঙালির কাজে মাছ চলে। খরচা কমানোর জন্যই অনিকেত জোর গলায় বলল—না, নিরামিষ। বিধবার শ্রাদ্ধে আমিষ হয় না কি?

সেই বামুন বলে উঠল— ইলিশ খলিসাশ্চৈব রোহিত মুদ্‌রস্তথা এবং শফরিশ্চৈব পঞ্চমসা নিরামিষাঃ’। মানে ইলিশ, খলসে, রুই, মাগুর, পুঁটি—পাঁচ মাছ নিরামিষ। এরা বেশ ভাল কাতলার ঝোল করে।

অনিকেত বললনা, ওসব বললে হয় না। নিরামিষই হবে।

সে আবার বলল, কিন্তু ছ্যাঁচড়ায় যে মাছের কাঁটা দেওয়া ছিল… —ছ্যাঁচড়া ফেলে দিন।

ধোকার ডালনা ছিল। শেষ পাতে দই। মিষ্টি দই, পাশের দোকান থেকে আনিয়ে নেওয়া হল।

শুক্লা বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। ও তো মহিলা। ব্রাহ্মণী হতে পারে, কিন্তু ব্রাহ্মণ নয়। এই পঙ্ক্তিতে বসতে পরে না।

শুক্লা বলল—ব্রাহ্মণ-ভোজনের টাকাটা দিয়ে দাও।

কিন্তু পঞ্চানন বলল, তা কি হয় নাকি?

—আপনি তো নিজেই বামুন। দয়া করে ভোজন করেছেন। আপনি কী করে টাকা দেবেন? ধৰ্ম্ম মানতে হয়।

উল্টে দশটা টাকা পেল অনিকেত। ভোজন-দক্ষিণা।

বলল, আশীব্বাদ করুন যেন খুড়িমার সদগতি হয়।

শ্রাদ্ধে বদরুকে দেখল না। কিন্তু হাসপাতালে বদরু প্রায়ই আসত। হয়তো মুসলমান বলেই বলেনি।

সপ্তাহ দুয়েক পরে একদিন ইস্টার্ন বাইপাসের বাস স্টপে বদরু এগিয়ে এল অনিকেতের কাছে।

—চিনতে পারছেন স্যর?

—চিনব না? বদরুদ্দিন সাহেব। কেমন আছেন?

—ওপরওলা যেমন রেখেছেন। ভাল আছেন স্যর? কলকেতা যাচ্ছেন?

— হ্যাঁ।

এসব অঞ্চলে রাসবিহারী, ধর্মতলা, শিয়ালদা, এই জায়গাগুলোকে ‘কলকেতা’-ই বলা হয়। অনিকেত বলল, হ্যাঁ। অফিস যাব। আপনি কোথায়?

—আমার একটা বুন আছে পল্লব পাগলাগারদে। বেয়লা।

—বুঝেছি। পাৰ্লভ মেন্টাল হোম, কতদিন আছে?

—তা আছে দু’বছর। ওর জন্য বাড়ির গাছের গন্ধলেবু নিয়ে যাচ্ছি। গন্ধ শুঁকে ঠিক বুঝতে পারে বাড়ির গাছের

—ওর কী হত?

—ও স্যর, কালী হয়ে যেত। মুসলমান ঘরের মেয়ে। কালী হওয়া ভাল দেখায়? সমাজ নেবে কেন? জিভ বের করে দিত। জামাকাপড় খুলে ফেলার চেষ্টা করত। আমরা হাত বেঁধে দিতাম। ও তখন বলত, আমি কালী, মুণ্ডমালাধারী—আরও কী সব মন্তর-টন্তর বলত। টিভি- তে খুব বামাখ্যাপা সিরিয়াল দেখত, ওখান থেকে শিখেছে। ঝাড়ফুঁক করা হল। লাভ হল না। কালী তো আপনাদের খুব কড়া দেবতা, এমনি ঝাড়ফুঁকে যাবে? বলুন স্যর, হ্যাঁ কি না…।

–হুঁ।

—তারপর কালীর ভর বেড়ে গেল। হিন্দুরা কয়েকজন এসে প্রণামী দিতে লাগত, প্রণাম করত, কিন্তু শান্ত হয়ে গেলে সব ভুলে যেত। তারপর আস্তে-আস্তে কেমনপানা হতে লাগল, খায় না, কারও সঙ্গে কথা কয় না, শুধু ভর হলে কথা কয়। আমি দুটো নার্সিংহোমে সবজি সাপ্লাই করি। ওখানে এক ডাক্তারকে ব্যাপারটা বললাম। সে বলল, এটা একটা মনের রোগ। কী একটা নাম বলল। সে-ই ওই জায়গাটার সন্ধান দিল। গরমেন্টের। বেশি খরচ নেই। মাসে একদিন যাই। ওখানে টাকাপয়সা যা লাগে দিয়ে আসি। এখন অনেক ভাল আছে। ভর হওয়া বন্ধ হয়েছে। ছেড়ে দেবে কিছুদিন পর। আপনার বাড়িটা আমি চিনি। সামনে দিয়ে সাইকেলে যাতায়াত করি। রাস্তার মোড় থেকে অটো এখন শুকুরপুর পর্যন্ত যায়। তার আগেই মুকুন্দপুরে নেমে যাই, সাইকেল রাখা থাকে। সাইকেলে বাকি রাস্তাটুকু চলে যাই।

পরের রবিবার বদরু এল অনিকেতের বাড়িতে। বলল, একটু কথা আছে স্যর।

—কী কথা?

ব্যবসার জন্য টাকাপয়সা ধার চাইবে না কি?

বাইরের ঘরে বসাল। বলল, কী কথা?

—মন্টু এসেছিল এর মধ্যে?

—না তো।

—ওর জ্ঞাতির মতলব ভাল নয়। ওর ধান্দা দুলালের ভিটেটা দখল নেওয়ার। দুলালদের সেরকম দলিল-পর্চা নেই। সেই জমিদারের সময়কার খাইখালাসি বন্দোবস্ত। দুলালের বাপ- ঠাকুর্দা ভোগ করত।

—খাইখালাসি মানে?

—মানে হল জমিদাররা নাপিত, কুমোর, জেলে—এদের একটু জমি দিতেন, খাজনা দিতে হত না, তার বদলে নাপিতরা জমিদার বাড়ির সবার খেরি করে দিত, জেলেরা পুকুরে জাল দিয়ে মাছ ধরে দিত, এরকম আর কী।

—তারপর?

—ওরা বলছে, মন্টু দুলালের ছেলে নয়। দুলালের বউয়ের চরিত্র খারাপ ছিল, তায় দুলাল পারত না, মন্টু হালাল বাচ্চা নয়। যাকে বলে অবৈধ। ওর ভিটে ওরা নেবে। এরকম বলে বেড়াচ্ছে, আর মন্টুকে ওরা খুব খাটাচ্ছে।

—গাঁয়ের আর সব কী বলছে?

—কে আবার কী বলবে, সবাই যারটা নিয়ে আছে। পঞ্চাননের সঙ্গে পঞ্চায়েতের মাথাদের দহরম-মহরম।

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে অনিকেত। তারপর বলে, আপনার কাছে এটা ভাল মনে হচ্ছে না। আপনি কেন প্রতিবাদ করছেন না?

—গাঁয়ের পলিটিক্সটা আপনি বোঝেন না স্যর। আমি তো অন্য লোক। অন্য মহল্লায় থাকি। অন্য ধর্মের লোক। আমার নাক গলানো ওরা ভালভাবে নেবে না। দুলাল আমার ছোট বয়সের দোস্ত। একসঙ্গে খেলা করতাম…

অনিকেত আবার চুপচাপ থাকে। মনে-মনে বলে, ছোট বয়সের দোস্ত, খেলা করতাম, কী ‘খেলা’ করতে সোনা?

বলা যায় না দুলালের সঙ্গে বদরু হয়তো ধরাধরি খেলা করত। পুরনো যৌনতার স্মৃতি ভোলা যায় না।

—তা এক্ষেত্রে আমি কী করব?

—সে আমি কী করে বলব? যা হয় করুন। যা ভাল বোঝেন। যদি পারেন, পঞ্চাননের সঙ্গে কথা কইতে পারেন।

অনিকেত জিগ্যেস করে—একটা কথা জিগ্যেস করি। মন্টু কি সত্যিই দুলালের ছেলে? আপনার কী মনে হয়?

মাথাটা একবার চুলকে নিয়ে বলল, হতেও পারে। দুলালের বাপ হতে না-পারার কোনও কারণ ছিল না। এটুকু জানি।

তার মানে, বদরু ওর বাল্য-কৈশোরে দুলালের লিঙ্গটিঙ্গ দেখেছে। ‘বাপ হতে না-পারার কোনও কারণ ছিল না’—এই সেনটেন্স-টাকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করা যায়।

কিন্তু দুলালের বাবা হওয়ার চেয়ে মা হওয়ার ইচ্ছেটাই বেশি ছিল। এটা পরে বোঝা গিয়েছে। বদরুকে এসব বলল না অনিকেত।

অনিকেত বলল, দেখি কী করা যায়।

শুক্লা ওপরে তখনও ঠাকুরঘরে। ওকে বলল না কিছু। কাজের লোক পাওয়া গিয়েছে। কমবয়সি মেয়ে। নামের বাহার আছে। মণিকুন্তলা। ‘মণি’ বলে ডাকা হয়। সালোয়ার-কামিজ পরেও মাঝেমাঝে কাজে আসে। শাড়িও পরে। স্বামী কী করে জিগ্যেস করাতে বলেছিল, কাপ্‌পেন্টার।

ছুতোর নয়। কার্পেন্টার। দুলালের মা-কে যা দিত এই মেয়েটাকে ওর ডবলেরও বেশি দিতে হচ্ছে। তবে দুলালের মা প্রায়ই বাড়ি থেকে এটা-সেটা পেত। শুক্লা কয়েকবার বলেছিল, খাজাইতলায় গিয়ে একবার ওদের খোঁজখবর নিয়ে আসতে। অনিকেত যায়নি। এসব শুনলে আবার ঝামেলা পাকাবে।

ইতিমধ্যে মঞ্জুর সঙ্গে টুকটাক দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে। একদিন সিনেমা দেখেছে। গায়ে গা, হাতে হাত। এখানে-সেখানে ঘুরেছে হাত। সিনেমা-ফেরত আইসক্রিম খেতে-খেতে মঞ্জু বলেছিল, আমি একটা ‘জোক’ শুনেছি। অফিসে। নিজের বউ হল চকলেট। যখন খুশি খেতে হয়। পরের বউ হল, আইসক্রিম। ফেলে রাখতে নেই। গলে যায়।

সে সন্ধ্যায় পরস্ত্রীর স্পর্শ-মাখা ফুরফুরে শরীরে বাড়ি ফিরে অনিকেত শুনল, বিকেলে মন্টু এসেছিল। শুক্লার মুখের দিকে এতক্ষণ তাকায়নি। এবার তাকাল।

থমথমে মুখ।

তার মানে ঝামেলা পাকিয়েছে কিছু। অনিকেত জুতোটা খুলল। জামাটা আলনায় রাখল। তোয়ালেটা কাঁধে চাপিয়ে গিজার অন করল।

—মন্টু এসেছিল।

এবার কথাটা একটু ছুড়ে দিল। বোধহয় আগের বারে প্রতিক্রিয়া না-পেয়ে

—কী বলল মন্টু?

—ও এ ক’দিনেই রোগা হয়ে গিয়েছে। স্কুলে যেতে পারছে না। ওর খুব শরীর খারাপ হয়েছিল। ভীষণ বমি-পায়খানা হয়েছিল। গজা ডাক্তার ওকে চেম্বারের বেঞ্চিতে শুইয়ে রেখে দু’বোতল স্যালাইন দিয়েছে। মন্টু বলছে, আগের দিন রাতে ওর খাবারে কোনও খারাপ গন্ধ পেয়েছিল। ডাল দিয়ে ভাত মাখার পরই গন্ধটা পেয়েছিল। ওটা কলাইয়ের ডাল ছিল। এই ডালের রং কালো হয়। দেখে কিছু বোঝা যায় না। ও খাওয়ার সময় বলেছিল, গন্ধ লাগছে। ওর কাকা বলেছিল, পুরনো ডালের গন্ধ। খেয়ে নে। কিছুক্ষণ পরই পেটে মোচড়। বমি। সারা রাত বমি করেছে। অনেকবার পায়খানা। শেষের দিকে পায়খানায় যেতে পারেনি। ঘরেই। বমির আওয়াজ পেয়ে কেউ নাকি আসেনি। সকালে ওর কাকা ডাক্তার-বদ্যি না-ডেকেই কাজে চলে যায়। ওর কাকার ছেলে এসব দেখে গজা ডাক্তারকে ডেকে আনে।

গজা ডাক্তার যখন ঘরে ঢুকেছিল, ওর হুঁশ ছিল না। পরে, যখন স্যালাইন চলছিল, তখন গজা ডাক্তার বলেছিল—রাতে যে-খাবার খেয়েছিলি, তাতে খারাপ গন্ধ ছিল? ও বলেছিল, হ্যাঁ। খারাপ গন্ধ ছিল। তারপর একটা প্যাকেট ছিঁড়ে, হাতে নিয়ে নাকের সামনে ধরে জিগ্যেস করেছিল এরকম? মন্টু বলেছিল—হ্যাঁ, ওরকম। গজা ডাক্তার বলেছিল—এই প্যাকেটে আছে ইঁদুর মারা বিষ। ভুল করে ডালে মেখে নিসনি তো?

ও কেন মাখতে যাবে? সেটাই বলল। ডাক্তার নাকি বলেছিল, ঘরে বমি পড়ে ছিল, ওর মধ্যে এই গন্ধটা পেয়েছিল।

শুক্লা এরপর একটা বড় শ্বাস নিয়ে বলল—বুঝলে, গজা ডাক্তার খুব ভাল ডাক্তার। গাঁ- ঘরে ইঁদুর মারার বিষ খেয়ে মরে তো অনেকে, এজন্য গন্ধটা চেনে। নিশ্চয়ই ডালের মধ্যে ওরা বিষ মিশিয়ে দিয়েছিল। ওকে ওরা মেরেই ফেলবে। বারবার চেষ্টা করে যাবে। ভিটেবাড়িটা বাগাবার তাল। ওকে কি ওখানে রেখে দেওয়া যায়? দুলালের মা আমাদের চিঠি দিয়ে বলে গিয়েছিল নাতিটাকে দেখতে।

শুক্লার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে অনিকেত বলল—দুলালের মা তো এর আগেও একবার ওকে এখানে গছাতে চেষ্টা করেছিল—যখন দুলালের বউ কেটে পড়ল।

শুক্লা বলল—হ্যাঁ, বলেছিল। তখন তো রাখিনি। কিন্তু এ অবস্থায় ওকে ওখানে রাখা যায়? ঠিক মেরে ফেলবে। গজা ডাক্তার ওকে বলেছে সাবধানে থাকিস বাপ

অনিকেত বলে—মানে? তুমি বলতে চাও ওই ছেলেটা এখন এখানে থাকবে?

—থাকুক না। স্কুলে ভর্তি করে দেব।

—মানে? আমার রিভাইড ট্রান্সফার অর্ডার এল বলে। আমরা তো চলেই যাব।

–তুমি যেও। পারবে না? ভালই হবে তোমার। স্বাধীন। যা খুশি করতে পারবে বেশ…

২৯

যে কোনও ব্যাপার নিয়ে কিছুদিন ঘাঁটাঘাঁটি করলে বিষয়টার ওপর একটা ধারণা জন্ম নেয়। গজা ডাক্তার যেমন হাগুর রং দেখেই বুঝতে পারেন কত নম্বর ট্যাংকিতে গন্ডগোল। অফিসের সমরেশ ঘোষ যেমন কোনও রেকর্ডিং-এ ভয়েস শুনেই বুঝতে পারেন লোকটার নস্যি নেওয়া অভ্যেস আছে কি না, কিংবা পান খাওয়ার নেশা আছে কি না। তেমনই কারও কথা শুনেই অনিকেত বুঝতে পারে তার মধ্যে ‘গে’-ভাব আছে কি না। তবে কিসের তত্ত্ব অনুযায়ী, সবার মধ্যেই অল্পবিস্তর ‘গে’-ভাব আছে। কিসে-র স্কেলে যারা ‘শূন্যে’ থাকে, তারা পরিপূর্ণ বিষমকামী। মানে একেবারেই সমকামী নয়। কিন্‌সে-স্কেলের এক, দেড়, দুইয়ে অনেকেই থাকে। তিন হলে উভকামী, ছয় হলে পরিপূর্ণ সমকামী।

সমকামী হলেই কথাবার্তার ধরন-ধারন, হাঁটাচলা এবং হাত-মুখের ভঙ্গি মেয়েলি হয় না। সমকামীদের মধ্যে যারা মনে-মনে নিজেদের মেয়ে ভাবে, কিংবা মেয়ে হলে ভাল হত এমনটা ভাবে, তাদের কথাবার্তার ধরন-ই মেয়েলি হয়ে থাকে সাধারণত। এরা সাধারণত যৌন- অভ্যাসে ‘বম গে’ হয়ে থাকে। তবে এমন ‘বম গে’র দেখা পবন-রঞ্জনদের ঠেক-এ অনিকেত পেয়েছে, যার মোটা গোঁফ আছে, এবং কথাবার্তায় কিছুই বোঝার উপায় নেই। ব গে’-রা কমবেশি নিজেদের নারী ভাবে, ফলত পুরুষের দিকেই আকৃষ্ট হয়। এরা পুংলিঙ্গ গ্রহণ করার চেষ্টাও করে, কিন্তু নিজের লিঙ্গ কোথাও জমা দেয় না। বরং নিজের ঝুলন্ত অঙ্গটা নিয়ে মনোকষ্টেই থাকে। যারা টপ গে, কিসের স্কেলে ওরা আড়াই থেকে সাড়ে চারে থাকে। ওদের দেখে, কথা বলে, কিছু বোঝা যায় না। আর কিসের স্কেল তো থার্মোমিটারের মতো কিছু নয় যে, কারও শরীরের কোনও ছ্যাঁদার মধ্যে ঢুকিয়ে দিলে বলে দেবে ওর কত পয়েন্ট। মানুষ বড় বিচিত্র ‘চিজ’। আজ যে তিন-এ আছে কাল সে পাঁচ-এও যেতে পারে। তখন তার বাভঙ্গিমা পাল্টে যাবে না মোটেই। আর এই শূন্য থেকে ছয় পর্যন্ত কিসের ইউনিট তো অনেকটাই আন্দাজি ব্যাপার। ‘টপ’, ‘বটম’ ছাড়াও কেউ-কেউ দু’টোই। একইসঙ্গে।

এসব চিন্তাভাবনা মন্টুকে কেন্দ্র করেই। অনিকেত মন্টুর কথাবার্তার ধরন এবং হস্তবিন্যাসে কিছু একটা আঁচ করেছে। ওর এখন ১১/১২ বছর বয়স। বয়ঃসন্ধির কাছাকাছি। যদি এই বৈশিষ্ট্য ওর মধ্যে থেকে থাকে, পরে ওটা প্রকট হতে পারে। তবে ওর ধারণা ভুল-ও হতে পারে। অনিকেত কয়েকজন নামকরা বুদ্ধিজীবীকে দেখেছে, যারা বড় কমনীয় কথাবার্তা বলে, নরম করে কথা বলে। মন্টুর ওই কথাবার্তার ধরন অন্য কোনও কারণেও হতে পারে না— এমন কথা নয়। এক ধরনের বিপন্নতা-বোধ বা অসহায়তা থেকেও হতে পারে।

আসলে অনিকেত নতুন কোনও ঝামেলা নিতে চাইছে না। ও অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি ফেরে। দোকান থেকে এক বাক্স প্যাড়া নেয়।

শুক্লাকে বলে, তোমার গোপালের জন্য প্যাঁড়া।

—ওবাব্বা! হঠাৎ?

—তুমি তো গোপালকে গুজিয়া খাওয়াও। আজ প্যাঁড়া নিয়ে এলাম।

—কখনও তো আনো না, তোমার কি প্যাড়া খাবার ইচ্ছে হল নাকি?

—না, আমার জন্য নয়, গোপালের জন্য। গোপাল তো আমাদের একজন ফ্যামিলি মেম্বার। রোজ গুজিয়া খেতে ভাল লাগে নাকি?

—বাঃ ভালই তো। বোঝা যাচ্ছে বয়স হচ্ছে।

–বয়সের সঙ্গে এর আবার কী সম্পর্ক?

—পুরুষের বয়স হওয়ার লক্ষণ কী জানো? গলার চামড়া ঝুলে যাওয়া নয়, বলিরেখা নয়, দাঁত পড়া নয়, যখন বউকে ভালবাসতে শুরু করে, বুঝতে হবে বয়স হচ্ছে।

—বাঃ, এটা তো একটা জোক। তোমায় কে বলল?

—সিরিয়াল। মনোজ মিত্রের ডায়লগ।

—তা বেশ। তা হলে বয়স হচ্ছে। বয়স তো হচ্ছেই। আর বয়স হচ্ছে বলেই অভিজ্ঞতা বাড়ছে, প্রজ্ঞাও বাড়ছে। আমার প্রজ্ঞা বলছে, মন্টুকে এ বাড়িতে রাখাটা ঠিক হবে না। সমস্যা হবে। ওর সঙ্গে কথাবার্তা বলে কিছু আঁচ করতে পেরেছ?

—কী আবার আঁচ করব? হতভাগা ছেলে। মায়ের আদর পেল না, বাপের আদর পেল না, এখন ওর জীবন-সংশয়।

—ওর কথার স্টাইলটা একটু মেয়েলি না?

—মেয়েলি? আমি তো কিছু বুঝিনি….

—তুমি না- বুঝলে কী হবে, আমার কান এড়ায়নি।

—তো, মেয়েলি তো কী হয়েছে? এজন্য ওকে বাতিল করবে?

—ও যদি দুলালের মতো হয়ে যায়?

—তা কেন হবে? ওকে স্কুলে পড়াব।

—স্কুলে যদি ওকে অন্য ছেলে টিটকিরি দেয়, হেনস্থা করে, তারপর যদি স্কুল ছেড়ে দেয়…

—এ তো দেখছি, মাসির যদি গোঁফ গজায় তবে ওকে কী বলে ডাকব সেই অবস্থা। ও দুলালের মতো হয়ে যাবে কে বলল তোমায়? তুমি কি জ্যোতিষী? তুমি তো আবার জ্যোতিষে বিশ্বাস করো না।

অনিকেত একটা তর্ক থামিয়ে দেওয়ার জন্য গলাটা একটু উঁচিয়ে ‘ভেটো’ প্রয়োগ করে আমার এতে মত নেই।

—ও, তোমার মতটাই চাপিয়ে দিতে চাও। এদিকে বাইরে মেয়েদের স্বাধীনতার কথা বলে বেড়াও। মেয়েদের মতামতের গুরুত্ব নিয়ে সমীক্ষা লেখো। একবার বলেছিলে না—পৃথিবীর বড়-বড় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত মহিলারাই নিয়েছে—’অন এয়ার’ বলেছিলে। আসলে আমি তো চাকরিবাকরি করি না, তোমার রোজগারে খাই, তাই আমার মতামতের কোনও মুল্য নেই

—হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট দেন?

—বুঝেছি। ঘরোয়া-বউয়ের সঙ্গে হঠাৎ-হঠাৎ ইংরেজিতে কথা বলে ওঠা—এগুলো হল পুরুষ-লক্ষণ। বস্তির পুরুষ হলে এখন আমার গালে একটা চড় মারতে। যেহেতু ইয়ে, পরিশীলিত, তাই ইংরেজি।

এবার পরিবেশটা একটু লঘু করার চেষ্টা করে অনিকেত। বলে, বাব্বা, এত নারীবাদী কথাবার্তা কোত্থেকে শিখলে? কৃষ্ণা বসুর মতো কথা বলছ যে।

—নারীবাদী-টারিবাদী বুঝি না বাবা। আমি সাধারণ মানুষ। তোমাদের মতন আঁতেল প্রকৃতির নই। এটুকু বুঝি, মানুষের সঙ্গে বিট্রে করা ঠিক নয়। আমার শাশুড়ি-মায়ের আমল থেকে দুলালের মা এ বাড়িতে কাজ করে। শ্বশুরমশাইয়ের জন্য আলাদা আয়া রাখতে হয়নি। ওর জীবনের শ্রেষ্ঠ স্মৃতি, ওর বিয়ের গয়না, আমাকে দিয়ে গিয়েছে। ঘরের কোনও জিনিস এদিক-ওদিক করেনি। নাতি-অন্ত প্রাণ। ওর নাতি মন্টু। মন্টুর কেউ নেই। শুধু আমরা আছি। আমরা যদি ওকে দেখি, ভগবান আমাদের দেখবেন।

—তার মানে তুমি ওকে বাড়িতে রাখবে, ছেলের মতো করে মানুষ করবে?

—ছেলের মতো করে করতে পারব কি না জানি না। ওকে তো ছোটবেলা থেকে পাইনি। একদম শিশু অবস্থায় পেলে মা-ছেলের সম্পর্ক তৈরি হয়। এখন তো সেটা সম্ভব নয়। ওকে আমি রাখব। মানে, বাঁচাব। ছেলের মতোও নয়, চাকরের মতোও নয়। হাটবাজার করবে, পড়াশোনা করবে। যতটা পারি আমি পড়াব, মাস্টারও রেখে দেব। চাকরিবাকরি করে ও যদি আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে তো রাখবে, নইলে রাখবে না। ফলের আশা করতে নেই। কর্ম করে যেতে হবে।

শুক্লার বাবার দেওয়া ডায়েরিটাই যত নষ্টের গোড়া।

অনিকেত বলে, তুমি তা হলে চাইবাসা যাচ্ছ না? আমি ওখানে রান্না করে খাব?

—এর আগেও তো একা-একা থেকেছ তুমি। তুমি তো বলেছ একা থাকতে তোমার ভালই লাগে।

—কিন্তু খরচের কথাটা ভেবে দেখেছ? দু’টো আলাদা এস্টাব্লিশমেন্ট। ওখানেও আমাকে চাল-ডাল-তরকারি কিনতে হবে, এখানেও। তারপর যাতায়াতের খরচ আছে।

শুক্লা একটু মাথা চুলকে নিল। বলল, খরচ এমন কিছু বেশি হবে না। আমি কি বেশি-বেশি শাড়ি কিনি, না কি গয়না কিনি? বড় রেস্তোরাঁয় গিয়ে খাওয়ার বায়নাও করি না। তোমার অনেক খরচই বাঁচিয়ে দিয়েছি আমি। ছেলেমেয়েদের জন্যও খরচ করতে হয়নি। প্রতি বছর ট্যাক্স বাঁচানোর জন্য এনএসসি করছ, ওগুলো আবার রিনিউ। বাড়ি করারও খরচ নেই। রিটায়ার করে পেনশন পাবে। রিটায়ার করার সময় টাকাপয়সা পাবে। যদি ক’টা বছর খরচ একটু বাড়ে, তাতে আমাদের কোনও ক্ষতি হবে না।

অনিকেত আর যদি খুব জোর দিয়ে বলে যে মন্টু-ফন্টুকে রাখা চলবে না, শুক্লা হয়তো জোরজবদস্তি করবে না, জিনিসপত্র ভাঙচুরও করবে না, কিন্তু গুম হয়ে থাকবে। খাবে না। কথা বলবে না।

অনিকেত একটা নতুন বুদ্ধি করে। ভাবে, শুক্লাকে যদি একবার ওখানে নিয়ে যাওয়া যায়, তবে ওখানকার পাহাড়-জঙ্গল, বোরো নদী, ফ্রেশ হাওয়া পেয়ে ওখানেই থেকে যেতে চাইবে। তখন মন্টুর ব্যাপারটা সেকেন্ডারি হয়ে যাবে।

অনিকেত বলল, শোনো, ট্রান্সফার অর্ডার হাতে পেয়ে গিয়েছি। দশ দিনের মধ্যেই জয়েন করতে হবে। আমি জয়েন করি, তুমি সঙ্গে চলো, আমার সংসারটা গুছিয়ে দাও। তারপর চলে আসবে। একসঙ্গেই ফিরব দিন সাতেক পর। তারপর না-হয় তোমার কথামতো মন্টুর একটা ব্যবস্থা করব। কিন্তু সেটা তো এপ্রিলের আগে হচ্ছে না, কারণ স্কুলের ক্লাস এপ্রিল থেকে

শুক্লা বলে, ওসব ওজর টিকবে না। ও এখন যে স্কুলে পড়ে সেটা এখান থেকেও যাওয়া যায়। ওকে একটা সাইকেল কিনে দেব।

—দুলালকেও তো সাইকেল কিনে দেওয়া হয়েছিল। ওর আনাজের ব্যবসায় সুবিধের কথা ভেবে। কিন্তু কী হল শেষ অবদি? সাইকেল সাজিয়ে গাঁয়ে-গাঁয়ে টিপ-পাউডার-ফিতে- নেলপালিশ-ব্রেসিয়ার বিক্রি করতে লাগল।

—সাইকেল কিনে দিলে মন্টুও যে স্কুলে না-গিয়ে নেলপালিশ বেচবে এটা তোমায় কে বলল?

—না, সে কথা নয়। বলছি, মানুষের ভাল ভেবে কিছু করি, কিন্তু অনেক সময় বিফলে যায়।

—জানি, তবে এর উত্তরে যেটা বলা যায়, তা হলে তো কোনও কাজই করা উচিত নয়। আমি সে-কথা বলছি না। …

অনিকেত বেশ বুঝতে পারছে ও আমতা-আমতা করছে, এবং এটাও বুঝতে পারছে, মন্টুকে ঘরে ঢুকতে দিতে ওর আপত্তি মন্টুর ‘পেডিগ্রি’ নেই বলে। কিন্তু বলতে পারছে না। ও ব্যাপারটা আর কচলাতে চায় না।

.

অল্প কিছু মালপত্র নিয়ে রওনা হয়। ঝাড়খণ্ডের দাবিতে আন্দোলন চলছে। হয়তো কিছুদিনের মধ্যেই ঝাড়খণ্ড নামে আলাদা রাজ্য হয়ে যাবে। প্রায়ই হরতাল, স্ট্রাইক হচ্ছে।

২০০০ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। এখন চাইবাসার আবহাওয়া খুব ভাল।

ঝাড়গ্রামের ওপর দিয়ে ট্রেনটা গেল। শুনেছিল, সোমনাথ এখানেই কোনও কলেজে চাকরি পেয়েছে। সোমনাথ নিজেকে একটা নতুন নাম দিয়েছে। সোমনাথের সঙ্গে অনেক দিন কথা হয়নি। শেষ যেবার দেখা হয়েছিল, তখন ও নতুন চাকরিটার কথা বলেছিল। সেদিন সালোয়ার- কামিজ পরনে ছিল ওর। ও বলেছিল, কলেজে গিয়ে ছাত্রদের বলব ‘ম্যাডাম’ ডাকতে, আর আমি ওখানে ‘লেডিজ টয়লেট’ ব্যবহার করব। আমাকে পুরুষসমাজ ওটা ব্যবহার করতে দেবে না জানি, কিন্তু ওটা আমার চ্যালেঞ্জ।

ঝাড়গ্রামের লাল মাটি আঁকড়ে-থাকা শাল-পিয়ালের বন যখন ট্রেনের জানালার পাশ দিয়ে সরে-সরে যাচ্ছিল, তখন অনিকেত বলল—জানো, এখানেই কোথাও সোমনাথ থাকে।

—কে সোমনাথ?

—ওই তো, ওর কথা বলেছিলাম তো, ছেলে থেকে মেয়ে হচ্ছে। ওর নাম এখন ‘মানবী’।

-–ঝাড়গ্রাম এজন্য বিখ্যাত? কোথায় আমি ভাবছি এই বনের ভিতর দিয়েই কোন রাস্তায় চিলকিগড় কিংবা ঝাড়গ্রামের রাজবাড়ি… কখনও যাওয়া হয়নি।

একটু পর ঘাটশিলা। অনিকেত বলল—এই যে ঘাটশিলা। এখানেই বিভূতিভূষণের বাড়ি। এখানেই সুবর্ণরেখা। শুক্লা ব্যাপারটা বুঝে মুচকি হাসল। বেশ লাগছে ওকে।

জামশেদপুর নেমে, হোটেলে খেয়ে নিয়ে একটা গাড়ি ভাড়া করল। বিল করলে সবই পাওয়া যাবে। ট্রান্সফারের জন্য কিছু টাকাপয়সা পাওয়া যায়। তা দিয়ে ওখান থেকেই একটা চৌকি, তোশক, বালিশ—এসব কিনে নেবে। বাসনপত্র কিছু সঙ্গে নিয়েছে। কিছু নিয়ে নেবে। রান্নার জন্য ওখান থেকে ছোট সিলিন্ডার আর একটা বার্নার কিনে নেবে।

কোনও দিন ঘাটশিলা আসিনি। স্কুলের বন্ধুরা অনেকেই ঘাটশিলা বেড়াতে আসত, ছবি দেখাত। খুব সুন্দর। শুক্লা বলল।

—এই তো এলে। চাইবাসাও সুন্দর। কাছেই তো চক্রধরপুর। ওটাও সুন্দর। রাঁচি যাওয়া যায় পাহাড়ি পথে। ওই পথটাও সুন্দর। শুনেছি ওই পথে হিরনি নামে একটা ঝরনা আছে। ওই ঝরনাটাও সুন্দর। সব জায়গায় যাব। চার বছর তো থাকতে হবে এখানে। কিন্তু একা-একা যাব না।

শুক্লা কিছু বলল না। চাদরটা জড়িয়ে তন্ময় হয়ে বাইরে প্রকৃতি দেখছে। শহর শেষ হয়ে গিয়েছে। ঢেউ খেলানো মাঠ, মাঠ পাহারা দিচ্ছে ছোট-ছোট পাহাড়, দূরে আকাশ যেখানে মাটিতে মিশেছে, সেখানে পাহাড়ের পাড়। কিছু কিছু গাছের পাতা খসে গিয়েছে। পত্রহীন ডালপালাগুলো আকাশে মেলে ধরে আছে নাচের মুদ্রায় যেন এক-একটা ইকেবানা। কিছু-কিছু গাছের পাতা হলুদ হয়েছে। কিছু গাছ আবার সবুজ। মাঠে কোনও ধান নেই, কাটা ধানের গোড়াগুলো রয়ে গিয়েছে বলে কোনও-কোনও মাঠ হলুদ ব্রাশের মতো দেখতে লাগছে। কোথাও বিরাট পাথর ফাটিয়ে মাথা উঁচিয়েছে নাম-না-জানা গাছ। বেলা একটা মতো। তবুও কোথাও-কোথাও দুধের সরের মতো কুয়াশা লেগে আছে মাঠে। পাথর-বিছানো নদী। নদীর ওপর পুল। পুলের ওপর দাঁড়িয়ে আছে এক উদাস যুবক। এইসব দৃশ্যে মগ্ন হয়ে আছে শুক্লা। সেই কবে বিয়ে হয়েছে। বিয়ের পর তেমন বেড়ানো হল কই? বার তিনেক পুরী, বাবা-মা- শুক্লা সবাই ছিল দু’বার, একা শুক্লা একবার। আর যেখানে ট্রান্সফার হয়েছে এর আগে, সেখানে গিয়েছে। ওর একবার দিল্লিতে একটা দিন সাতেকের ট্রেনিং হয়েছিল, ওখানে অনিকেত নিয়ে গিয়েছিল শুক্লাকে। খুব একটা বেড়ানো হয়নি শুক্লার

মঞ্জুরও কি হয়েছে? ও তো আরও কোথাও যায়নি। অথচ একটা ভ্রমণ-সংস্থায় চাকরি করে। ভাইজাগ-আরাকু ভ্যালি-হায়দরাবাদ বুকিং করে, সিমলা-কুলু-মানালি-অমৃতসর বুকিং করে। অ্যালবামের ছবি দেখায়।

শুক্লা পাশে বসে আছে, অথচ মঞ্জুর কথা মনে হতেই মন থেকে মঞ্জুকে ছুড়ে ফেলে দিল বাইরে।

শুক্লা বলল, দ্যাখো দ্যাখো, হায় হায় করছে।

—কে?

—ওই গাছগুলো। দু’হাত আকাশে তুলে—যে-বৃক্ষশাখা সমারোহকে ‘ইকেবানা’ মনে হয়েছিল অনিকেতের, সেগুলোকে ‘হায় হায়’ মনে হল শুক্লার?

—আর ওই নদীটাকে কী মনে হচ্ছে? ওই দূরের নদীটা?

শুক্লা বলল, বিধবার দুঃখের মতন।

.

বাগান-ঘেরা রেডিও স্টেশন। বেশ বড় এলাকা। গাছপালা-ঘেরা। পাশেই সার্কিট হাউস, এসপি-র বাংলো, ডিএম সাহেবের বাংলো, জেলা জজের বাংলো। রেডিও-র কোয়ার্টার-টাও কাছেই। কোয়ার্টারের পিছনে একটা ছোট পাহাড়। পাহাড়ের গায়ে কয়েকটা তালগাছ। কয়েকটা ভেড়া চরছে, আর একদিকে একটা বড় জলাশয়। কয়েকটা বক মাছের আশায় এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে। সব নিয়ে ভারি সুন্দর পরিবেশ। মনেই হয় ‘চেঞ্জে এসেছি”।

—কী? কেমন?

শুক্লা বলল, বেশ ভাল।

অফিসের লোক এসে কোয়ার্টার খুলে দিল।

বড়-বড় দু’টো ঘর। একটা লিভিং-ডাইনিং। দু’টো বাথরুম। একটা ব্যালকনি। ব্যালকনিটা জলাশয়ের দিকে।

ফ্যান চালিয়ে শতরঞ্চি বিছিয়ে একটু বিশ্রাম। শুক্লা বলল, কীরকম যাযাবর যাযাবর লাগছে। খুব ভাল লাগছে। খুব মজা লাগছে। অনিকেতকে জড়িয়ে ধরে একবার।

অনিকেত বলল, বিকেলে আমরা একটু কেনাকাটা করতে বেরব। এখন একটু বিশ্রাম করো। আমি একটু অফিস থেকে আসি।

অনিকেতের এখন একটাই কাজ। জায়গাটার প্রেমে ফেলে দিতে হবে শুক্লাকে। যেন এখান থেকে ফিরে যেতে না-চায়। কিংবা ফিরে গেলেও, আবার ফিরে আসে যেন।

মন্টু-ফন্টুকে নিয়ে আর ঝামেলায় পড়তে চায় না ও।

অফিসে গিয়ে জেনে নিল কাছাকাছি কী-কী সুন্দর স্পট আছে। নোট করে নিল। অফিসের তো গাড়ি আছেই। গাড়ি করে জায়গাগুলো শুক্লাকে দেখাবে অনিকেত।

ড্রাইভারের নাম বড়কা মুন্ডা। অনিকেতের কোয়ার্টারে এল। জিগ্যেস করল সই-সাবুদ কিছু লাগবে কি না।

মানে, ট্রান্সফারে এলে মালপত্র ওঠানো-নামানোর জন্য কুলি-খরচ পাওয়া যায়। লরিতে মাল এলে ট্রান্সপোর্টের বিল জমা দিলে খরচটা পাওয়া যায়। জামশেদপুর থেকে এখানে আসার গাড়ি ভাড়াও। কিন্তু বিল দিতে হবে। এক আজব নিয়ম করে রেখেছে। কোনও ট্যাক্সি ড্রাইভার কি প্যাড আর কলম নিয়ে ঘোরে? আর দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে লিখে দেয়, আমার গাড়ির নম্বর এত, অমুক জায়গা থেকে অমুক পর্যন্ত যাওয়ার জন্য তমুকের কাছ থেকে এত টাকা বুঝিয়া পাইলাম। অথচ এই কাগজটা না-দিলে হকের টাকাটা পাওয়া যাবে না। সব জায়গায় অফিস- গাড়ির ড্রাইভার-রাই এই কাগজগুলো জোগাড় করে দেয়। সই-সাবুদও করিয়ে দেয়।

অনিকেত বলল—হ্যাঁ, ও সব তো লাগবে।

—তব আপ্‌কা ঘর কা পতা লিখ দিজিয়ে।

একটা কাগজে ঠিকানাটা লিখে দিল। কোনও ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি থেকে পাকা রসিদ নিয়ে আসবে। ওদের কিছু পার্সেন্টেজ দিতে হয়।

জীবনের প্রথম চাকরিতে একটু অসুবিধে হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একটা চাকরিতে গিয়েছিল গ্রামে। তখনও অফিসের ফার্নিচার, চেয়ার, টেবিল—এক জায়গায় জড়ো করে রাখা। ওগুলো স্টাফরাই ধরাধরি করে সাজিয়ে দিল। তারপর বড়বাবু কতগুলো কাগজ নিয়ে এসে বলেছিল, দু’টো কাগজে টিপসই মেরে দিন স্যর, আমরা তো অনেকগুলোয় করেছি।

–কেন? টিপসই করতে যাব কেন?

—বাঃ এই মালপত্রগুলো লোডিং, আনলোডিং করতে হয়নি? লেবার পেমেন্ট, অ্যারেঞ্জমেন্ট, সুইপিং—এসবের জন্য পেমেন্ট করতে হয়েছে, তার ভাউচার।

—এসব তো নিজেরাই করে নেওয়া হয়েছে। ঘর তো যার ঘর সে ঝাড়ু দিয়ে নিচ্ছি। আমার ঘর তো আমিই ঝাড়ু দিই।

—যাব্বাবা! তাই বলে পেমেন্ট ছেড়ে দেবেন? আপনি তাড়াতাড়ি কাজটা শিখে নিন। পরীক্ষা দিয়ে ঢুকেছেন, অথচ কাজটা শেখেননি। স্যর, বলতে বাধ্য হচ্ছি। মাল এল, লোডিং- আনলোডিং হল না? ক্যাজুয়াল সুইপারের প্রভিশন আছে, দেখেননি? পেমেন্ট ভাউচার দেখিয়ে বিল করতে হবে না?

বিল হয়েছিল। ওই সব ফল্স বিলে সইও করেছিল অনিকেত।

এখন কাজ শিখে গিয়েছে।

শুক্লা জিগ্যেস করল, কীসের সই-সাবুদ?

এসব শুক্লাকে ব্যাখ্যা করার কোনও দরকার নেই। ও হয়তো ‘অনেস্টি’ মারাবে, ওর পিতৃদত্ত ডায়েরি থেকে ‘কোটেশন’ ঝাড়বে।

তবে এটাও ঠিক, অনিকেত শুধু হকের পাওনাটুকুই নেয়। ওটা পেতে গেলে যদি এইসব গ্যাড়াকল নিয়ম গভর্নমেন্টই করে দেয়, ও কী করবে? প্রাইভেট কোম্পানিতে থোক একটা টাকা দিয়ে দেয়, কোনও কাগজপত্র চায় না।

বিকেলে গাড়ি নিয়ে বেরনো। রেডিমেড খাট দেখে এল। একটু বড়ই নিল—যেন দু’জন শোওয়া যায়। তোশক-টোশক কিনে নিয়ে এল। সেদিন হাট-বার ছিল। হাটে সারি-সারি হাঁড়ি মেয়েরা হাঁড়িয়া বিক্রি করছে। পাশে কেউ কাঁচা ছোলা, আদা-পেঁয়াজ। গোটা-গোটা কাঁচালঙ্কা। অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি থেকে টিনের বাটিতে হাঁড়িয়া তুলে দিচ্ছে মেয়েরা। ক্রেতারা বেশির ভাগই পুরুষ। মেয়েরাও আছে। হাঁড়িয়া-অঞ্চল ছাড়ালে শাক, সবজি। ওজনের বালাই নেই। সব ভাগা দেওয়া। কোনও ভাগা দু’টাকা, কোনও ভাগা পাঁচ টাকা। ভাগায় কাঁচালঙ্কা, টমেটো, শিম সবই আছে। পিঁপড়ের ডিমও ভাগা করে বিক্রি হয়। দাম একটু বেশি। পাঁচ টাকা ভাগা। পিঁপড়ের ডিমের সঙ্গে রসুন-কাঁচালঙ্কা মিশিয়ে বেটে চাটনি খায়। এটা খুব সুস্বাদু এবং ডেলিকেসি। মাঝে-মধ্যে খবর কাগজে দেখা যায়—নেতারা বলছেন জঙ্গলের মানুষরা কত গরিব! পিঁপড়ের ডিম খেয়ে ওরা বেঁচে থাকে। যেন পিঁপড়ের ডিম খুব সহজলভ্য। বাঁশের ধামা, চুবড়ি, কুলো এসব নিয়ে বসেছে বেশ কিছু মেয়ে। শুক্লা অনেকক্ষণ ধরে ঝুড়ি দ্যাখে। একটা মেয়ে বলে, দিয়েন গুপো! বা ওরকম কিছু। মুন্ডারি, না হো, না সাঁওতালি—কী ভাষা কে জানে? শুক্লার বুঝতে অসুবিধা হল না, ও কী বলতে চাইছে। শুক্লা বাংলায় বলল, দাম কত? একটা মেয়ে শুক্লার কথা বুঝে নিয়ে হাতের পাঁচটা আঙুল দেখাল। পাঁচ টাকা দিয়ে একটা ঝুড়ি কিনল ও। ওরা কী সুন্দর হাসল। কেন হাসল কে জানে? শহরের মেয়েরা এরকম হাসে না। ওরা কিন্তু কেউ সুন্দরী নয়, যৌবনবতীও নয়। পঁচিশ-তিরিশ বছর বয়সেই অনেকের বুক শিথিল হয়ে গিয়েছে—বাইরে থেকেই বোঝা যায়। পুষ্টির অভাবই হয়তো এর কারণ। কিন্তু কিছু সিনেমা এবং কিছু গল্প-উপন্যাস আমাদের এমন একটা ধারণা দিয়েছে যে, আদিবাসী মেয়ে মাত্রই একেকটা যৌবনকুম্ভ।

একটা গাছের ডাল রঙিন হয়ে আছে। গাছের ডালে ঝুলছে রঙিন-রঙিন ব্রা। সাদা, কালো, গোলাপি। কী গাছ অনিকেত জানে না। গাছের পাতা নেই। এই শীতে পড়ে গিয়েছে। কিন্তু গাছের ডাল সেজে উঠেছে রঙিন হয়ে। গাছের তলায় ভিড় জমিয়েছে বেশ কয়েকজন যুবতী, কিশোরী। তখন অধিকাংশ মেয়েই ব্লাউজ পরে। ব্রা সবাই পরে না। যে ব্রা বিক্রি করছে, তাকে দেখেই অনিকেতের মনে হল, মৌগা। স্ত্রী-বেশধারী পুরুষ। শাড়ি পরে রয়েছে বটে, কিন্তু হাতে-মুখে ওর পুরুষ-চিহ্ন প্রকট। ঠোঁটে হাল্কা লিপস্টিক দিয়েছে, চোখে কাজল। কিন্তু দাড়ি কামানোর একটা হাল্কা কালচে-সবুজ দাগ রয়ে গিয়েছে মুখে। একটা চ্যাপ্টা কাঠের তক্তায় পাশাপাশি দু’টো নারকোলের মালা আটকে রেখেছে। ও দেখিয়ে দিচ্ছে, কী করে ব্রেসিয়ার পরতে হয়। ওটাই হচ্ছে ওর ম্যানিকুইনের বাস্ট। ওটাই মডেল। সেট করা আঁটা নারকোলের মালার ওপর যখন ব্রেসিয়ার পরিয়ে দিয়ে কাঠের পিছনে হুক লাগানো শেখাচ্ছে, মেয়েরা হাসছে, আবার লজ্জা-লজ্জা মুখ করে ‘লে’-ও নিচ্ছে। লোকটা যদি পুরুষ হত, অন্তত পুরুষ পোশাক-পরা লোক হত, মেয়েরা হয়তো কিনত না। লজ্জা পেত। মৌগার কাছে ততটা লজ্জা নেই। মেয়েরাও জানে, ও প্রকৃত-মেয়ে নয়। কিন্তু মৌগা কিনা, প্রকৃত-পুরুষও তা হলে নয়। সুতরাং লজ্জা নেই। মেয়েদের বুকের দিকে তাকিয়ে সাইজ ঠিক করে দিচ্ছে। বলছে, যদি অসুবিধে হয় নিয়ে এলে পাল্টে দেবে।

শুক্লা বলল, এটা তোমার খুব ভাল লেগেছে নিশ্চয়ই। খোরাক পেলে।

অনিকেত বলল, তা আর বলতে…

হাট থেকে বেরিয়ে ড্রাইভার নিয়ে গেল লুপুংঘুটু নামে একটা জায়গায়। ওখানে মাটি ফুঁড়ে জল ওঠে। সেই জল ছোটধারায় বয়ে গিয়ে বোরো নদীতে পড়ে। কাছেই বোরো নদী। খরস্রোতা। জলে-পাথরে সব সময় কথাবার্তা।

লুপুংঘুটু গাছে ছাওয়া। মাঝখানে বুট-বুট করে জল উঠছে। ওখানে অনেক বউ-ঝি কমবয়সি মেয়েরাও। সূর্য পশ্চিমে হেলেছে। কুয়াশা শুরু হয়ে গিয়েছে। ড্রাইভার বলল ‘হো’- দের বিয়ে। জল ভরতে এসেছে। একটা মেয়েকে দেখাল। ওর মুখে হলুদের দাগ। বলল, ওরই বিয়ে। বিয়ে হবে কাল।

দু-একজনের গায়ে সোয়েটার আছে। দু-একজনের গায়ে চাদর। কেউ-কেউ বিছানার চাদর জড়িয়ে এসেছে এই পার্বণে। একটা ঘটে জল তুলল। তারপর ঘট-টাকে ঘিরে মেয়েরা বসল। উলু দিল। তারপর ওরা গান করতে থাকল। শুক্লা ওখানে দাঁড়িয়ে ছিল। ওরা শুক্লাকে হাতছানি দিয়ে ডাকল। শুক্লা ওদের কাছে গেল। সধবা এয়ো। শুক্লারও কপালে সিঁদুর।

বাঙালির সিঁদুর কি এই অঞ্চল থেকেই এসেছে? এখানকার মাটির রং লাল। লাল মাটি দিয়ে ঘর রাঙায়। হয়তো লাল মাটির টিপও পরত।

অনিকেত একটু দূরে দাঁড়িয়ে সিগারেট খায়। আদিগন্ত শোভা দ্যাখে। সেই ভিস্যুয়ালে মিশেছে মায়াবী অডিও। অদ্ভুত সুরেলা গান। মানে বোঝে না। সুর শোনে।

সন্ধে হয়। ওরা সুর সঙ্গে নিয়ে গাঁয়ের পথে যায়। ড্রাইভার হর্ন দেয়। শুক্লা গাড়িতে আসে। গাড়ির কাচ ওঠানো। কোয়ার্টারে ফিরছে। শুক্লা জড়োসড়ো। অনিকেতের গা ঘেঁষে বসে।

অনিকেত বলে, তোমার চাদরটা কী হল? শুক্লা বলে না কিছু।

—আরে চাদরটা, নতুন চাদরটা কই? দু’হাজার টাকা দিয়ে কিনে দিয়েছি। ফেলে এসেছ? শুক্লা বলল, ফেলে আসিনি, দিয়ে দিয়েছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *