হলদে গোলাপ – ২০

২০

অনিকেতদের বাড়ির চিলেকোঠার ঘরটাকে টিবি-ঘর বলা হয়। অনিকেতের দাদুর কোনও জ্ঞাতি-ভাইয়ের টিবি হয়েছিল, উনি ছিলেন ব্যাচেলর, ওঁকে রাখা হয়েছিল। ওই ঘরে, আলাদা করে। অনিকেত দেখেনি। উনি ওই ঘরেই মারা যান। অনিকেতের মনে পড়ে, ওর ছোটবেলাতে ওই ঘরে ঢোকা নিষেধ ছিল। যক্ষ্মা হলে মানুষ ভয় পেত, কারণ খুব খরচ-সাপেক্ষ ছিল চিকিৎসা, তা ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের আগে পর্যন্ত এর কোনও চিকিৎসা ছিল না। এজন্য এর নাম ছিল ‘রাজরোগ’। যক্ষ্মা-র ইংরেজি নাম টিউবারকিউলোসিস। সংক্ষেপে টিবি। ওই শব্দ একটা ভয় বয়ে আনত। টিবি-ঘর যেন ভূতের ঘর। সে-সময় সম্বন্ধ করে বিয়ে দেওয়ার সময় খোঁজ নেওয়া হত পাত্র বা পাত্রীর বংশে কারও ‘রাজরোগ’ আছে কি না।

টিবি নিয়ে এখন কেউ মাথা ঘামায় না আর। ভাল ওষুধ বেরিয়ে গিয়েছে। এখন সেই ভয়টা এসে বাসা বেঁধেছে এড্‌স শব্দটার মধ্যে।

কোত্থেকে যে এল রোগটা, ক’বছর আগেও তো এ নামের কোনও অসুখের নামই শোনা যেত না। যেমন সন্তোষী মা। হঠাৎই এলেন এবং জয় করলেন। শুক্রবার-শুক্রবার শুক্লা টক খায় না, বোঁদে খায়। সন্তোষী মা করে কিনা, আর এসেছে চাউ ও রোল। আশির দশক থেকেই রাস্তায়, অফিসপাড়ায় চাউমিন বিক্রি হতে থাকে। বাঙালির জলখাবারেও ঢুকে যায় চাউ। চাউ এবং সন্তোষী মা-ও বাঙালির ঘরে এই সময়েই ঢোকেন। কীভাবে যে কে ক্লিক করে যায়, বোঝা মুশকিল। পাশের রাজ্য বিহার থেকে সারা উত্তর ভারতেই হনুমান পুজোর রমরমা, কিন্তু বাঙালি হনুমানকে গ্রহণ করল না। বাঙালির ঠাকুরঘরে হনুমানজি ঢুকলেন না। সারা শ্রাবণ মাস জুড়ে মাইক বাজে। বাবা তারকনাথের মাথায় জল ঢালতে যারা যায়, তাদের মনোরঞ্জনের জন্য প্লাস্টিকের ফুল সাজানো বাঁক, বাঁক রাখার স্ট্যান্ড তৈরি হয় পাড়ায়-পাড়ায়। ‘জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব জিন্দাবাদ’—স্লোগানের পাশেই এসব বাঁক রাখা। প্রচুর মানুষ এখন তারক-ভক্ত। ‘জয় বাবা তারকনাথ’ সিনেমার প্রভাবেই কি এই সমারোহ? কে জানে, ‘জয় বাবা হনুমান’ সিনেমা এলে কি বাঙালি হনুমান-ভক্ত হবে? মনে হয় না। বাঙালির রক্তে কি কোনও অ্যান্টি-হনুমান অ্যান্টিজেন আছে?

হিউম্যান ইমিউনো ডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস বা ‘এইচআইভি’ হল একটা ভাইরাসের নাম, যা রক্তের টি সেল-কে কাজ করতে দেয় না। এর ফলে মানুষ রোগ প্রতিরোধ করতে পারে না। সহজেই অন্য রোগের কবলে পড়ে। এই রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতাচ্যুত মানুষরাই হল এড্‌স- এর রুগি। ‘এআইডিএস’ মানে হল ‘অ্যাকোয়ার্ড ইমিউনো ডেফিসিয়েন্সি সিনড্রোম’। অ্যাকোয়ার্ড মানে ‘অর্জন’।

এড্‌স-এর রুগি নিয়ে ভয়টা এখন আমাদের মধ্যে, সেটা টিবি-র ভয়ের চেয়েও বেশি। টিবি-ঘরের মতো হাসপাতালেও এইচআইভি ‘পজিটিভ’-দের জন্য আলাদা ঘর থাকে। ওদের রক্তে খুব ভয়, ওদের শরীর থেকে নিঃসৃত রসে ভয়। চোখের জলেও ভয়?

ডাক্তার পলাশ সেনগুপ্ত বললেন—ওর তো অপারেশন হল, আলাদা যন্ত্রপাতি তো ব্যবহার হয়নি, ওই যন্ত্রপাতি দিয়েই তো অন্য অপারেশন হবে। যদিও স্টেরাইল করা হয়, কিন্তু হাসাপাতালের ব্যাপার…। ওকে আরও ক’টা দিন হাসাপাতালে রাখা উচিত ছিল, কিন্তু এইচআইভি ‘পজিটিভ’ পাওয়া গেল, কোনও রিস্ক নেব না। বাড়ি নিয়ে যান।

‘ও’ মানে দুলাল। দুলালের এইচআইভি ‘পজিটিভ’ পাওয়ায়, দুলাল এখন ‘ও’। নাম-হীন। ও এখন এইচআইভি ‘পজিটিভ’। অনিকেত জিগ্যেস করেছিল—’পজিটিভ’ মানেই কি এড্‌স?

ডাক্তারবাবু বললেন—’পজিটিভ’ মানেই সবার ক্ষেত্রে এড্‌স নয়, এইচআইভি ‘পজিটিভ’ মানে ওর রক্তে ওই মারাত্মক ভাইরাস-টা রয়েছে, মাথা চাড়া দিয়ে উঠলেই শরীরের রোগ প্রতিরোধ শক্তিকে অকেজো করে দেবে। সহজেই ঠান্ডা লাগবে, ডায়রিয়া হবে, ওজন কমতে থাকবে—একবার ঠান্ডা লাগলে, কি নিউমোনিয়া হলে, বাঁচানো শক্ত; আন্ত্রিক হলে কমতে চাইবে না; নানা ধরনের স্কিন ডিজিজ-ও…। তবে আপনার পেশেন্টের মনে হয় এড্‌স হয়েই গিয়েছে। সারা গায়ে তো দেখছি লিম্ফোমা, বাড়ি নিয়ে যান, পরে আউটডোর-এ আসতে বলবেন। এড্‌স এর আলাদা সেকশন আছে। আপনি এত কিছু মাথায় নিচ্ছেন কেন? যথেষ্ট করেছেন। বাড়ির কাজের লোকের ছেলের জন্য কেউ এত করে না।

ঠিকই তো, অনিকেতের কী দায় পড়েছে? দুলালের মা দুলাল পেয়েছে, ব্যস, মিটে গেল।

ট্যাক্সি করে দুলালকে বাড়ি পৌঁছে দিল অনিকেত। ওর বাড়ি পর্যন্ত ট্যাক্সি যায় না। কিছুটা ভ্যান, বাকিটা ধরাধরি করে। পাড়ার কেউ-কেউ ওকে ধরল। যখন জানবে ওর এড্‌স হয়েছে, ওকে ছোঁবে না।

দুলালের মা বলল—আপনার দয়ায় আমার দুলাল ফিরে পালাম দাদাবাবু। দুলালের মা- কে ‘মাসি’ বলে ডাকে অনিকেত। কিন্তু দুলালের মা ওকে বোনপো বলে ডাকে না। ‘দাদাবাবু’- ই বলে।

ট্যাক্সিতে দুলাল কোনও কথা বলছিল না। অনিকেত জিগ্যেস করছিল, এতদিন কোথায় ছিলে দুলাল? দুলাল চুপ। ওর চোখ দিয়ে জল পড়ছিল। শরীর থেকে বেরনো জল। শরীর- নিংড়ানো নুন থাকে ওতে। সঙ্গে কি ভাইরাসও থাকে?

দু-তিনবার জিগ্যেস করে উত্তর পেল না। অনিকেত ভাবল পরে জিগ্যেস করবে। রোগটা তো ‘অ্যাকোয়ার্ড’। কোথা থেকে ‘অর্জন’ করেছে ও? অনিকেত দেখছিল, সারা ট্যাক্সি-যাত্রায় হুলালের মা ওর বাসন-মাজা হাত ঘর-মোছা হাত দুলালের গায়ে-মাথায় বুলিয়ে দিচ্ছিল। মায়া-মমতা বুলিয়ে দিচ্ছিল। না কি ওর ঘর-মোছা হাতে দুলুর শরীরের অসুখ-বিসুখ মুছে নিচ্ছিল? বারবার জিগ্যেস করছিল একই কথা—ভাল ছিলিস তো দুলু? দুলাল ‘হ্যাঁ’-ও বলছিল না, ‘না’- ও বলছিল না।

দুলালের বাড়িতে কোনও টিবি-ঘর নেই। ওদের একটাই তো ঘর, টিনের ছাউনি। ওখানে শুইয়ে দেওয়া হল। দুলালের ছেলে ওর বাবাকে ড্যাবড্যাব করে দেখছিল। এখন ওর বছর বারো বয়স। রোগা-রোগা চেহারা। দেখেই বোঝা যায় ছেলেটার শরীর ভীরুতা-মাখানো। ওর নির্মল চোখের কোণে অক্ষম পিচুটি।

অনিকেত দুলালের মা-কে আলাদা করে ডেকে নিয়ে বলল—এবার আমি যাই। দুলালকে সাবধানে রেখো, যেন কোথাও না কেটে-কুটে যায়। বলেই মনে হল, কেটে গেলে কী করবে। বলল, মাসি, তোমার হাত দু’টো খুলে দেখাও তো!

দু’হাত মেলে দেয় দুলালের মা। হাতের আঙুল ফাটা-ফাটা। দুই আঙুলের সন্ধিস্থলে একটু হাজাও আছে মনে হল। ওকে কী করে বলবে কেটে-কুটে গেলে হাতে গ্লাভস পরে নিও, যাতে ওর রক্ত… ও বলল, তোমায় একটা মলম কিনে দেব। হাজা হয়েছে তো…!

—জল ঘাঁটতে হয় দাদাবাবু, কী করব… কেউ কি শুনবে? এখন তো আরও এক বাড়ি কাজ ধরতে হবে। দুলু তো এখন কুনু কাজ করতে পারবে না।

এসব সমস্যার সমাধান তো অনিকেত করতে পারবে না। বড়জোর শুক্লাকে বলতে পারে, ওর পঞ্চাশ টাকা মাইনে বাড়িয়ে দাও। ব্যস। এর মধ্যে অনিকেত আর নেই। অনেক হয়েছে। দুলালের এই রোগের কথা শুক্লাকে বলেনি এখনও। বলবেও না। এড্‌স রোগীর সঙ্গে করমর্দনে এই রোগ হয় না, এক বিছানায় শুলে কিছু হয় না, এমনকী হাল্কা চুম্বনেও কিছু হয় না—এসব কি শুক্লা মানবে?

ডাক্তাররাই হাসপাতাল থেকে সরিয়ে দিচ্ছে—কাগজে তো বেরচ্ছে।

অনিকেত বলল—এবার যাই মাসি। সাবধানে থেকো। কলেজে এনসিসি করার সময় যেমন অ্যাবাউট টার্ন করত, সেভাবে পিছন ফিরল। অনেক হয়েছে, আর না।

জামাটা ধরে মৃদু টানল দুলালের মা। শকুন্তলার পতিগৃহে যাত্রার সময় বনের হরিণী শকুন্তলার আঁচল টেনেছিল। অনিকেত দাঁড়িয়ে যায়। দুলালের মা হঠাৎ বসে পড়ে, দুই হাতে কুয়োভাদিস-পরা পা চেপে ধরে বলে, দাদাবাবু গো, আপনি ছাড়া কে আছে আমার…।

অনিকেত পা ছাড়ায়

বলে, ছি ছি। তোমাকে মাসি বলি, এটা কী করছ?

দুলালের মা বলে—আমার বড় বিপদ দাদাবাবু। দুলালের আইভি রোগ হয়েচে, এ রোগে কেউ বাঁচে না…

—কে বলল তোমায়?

—নার্স দিদি, আর ছোট ডাক্তার।

অনিকেত বলল, পাড়ার কাউকে বোলো না।

দুলালের মা বলল, আমায় ছেড়ে যাবেন না দাদাবাবু গো…

‘অনেক হয়েছে আর না’ তো মনে-মনে বলেছিল অনিকেত। দুলালের মা শুনল কী করে? অনিকেত বলল, ছেড়ে যাব না মানে? বাড়ি যাব না? আমার ঘর-বাড়ি নেই?

দুলালের মা ওর দু’হাত কচলাচ্ছে। যেন ওর অন্তর-বাসনাকে হাতের তালুতে এনে রস বার করছে। বলল—আপনার ঘরেই থাকুন দাদাবাবু, মনে-মনে আমার ঘরেও…।

.

শুক্লা বলল, অনেক পুণ্য করলে গো…। আমারও পুণ্য হল।

—কেন? তোমার কেন?

পতির পুণ্যে সতীর পুণ্য…!

রবীন্দ্রনাথ-বিদ্যাসাগর-বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণ’র বাণী লেখা পিতৃদত্ত ডায়রিটার প্রভাব? ওসব মনীষী-বাণী উদ্ধৃত করে রচনা লিখতে হয়। ওগুলো বিশ্বাস করে জীবনে ‘লগ ইন’ করে না কি কেউ?

অনিকেত বাজাতে চায়। বলে, কেন? পুণ্য কেন?

জীবে প্রেম করে যেই জন…শুক্লা বলল।

যদি বলা যায় দুলাল এড্‌স রুগি? এড্‌স রুগি প্রেম করে যেই জন…সেইজন সেবিছে ঈশ্বর মেনে নেবে তো শুক্লা?

মাদার টেরিজা গত হয়েছেন। উনি অনেক অসুস্থকে কোল দিয়েছেন, সেবা দিয়েছেন। কুন্ঠরুগিকে সেবা করার মধ্যে মহিমা বেশি। যিশু করেছেন, গান্ধীজিও। মাদার-ও অনেক কুষ্ঠরুগিকে সেবা দিয়েছেন। কুষ্ঠ রোগের মধ্যে বীভৎসতা আছে। পুঁজ-রক্ত আছে। এদের সেবা করার মধ্যে মহিমা প্রকাশ হয়। এড্‌স রুগিদের তো অঙ্গবিকৃতি নেই, রক্তপাত নেই…কোনও গ্ল্যামারও নেই। ধীরে, করুণ সুরে মরে। মাদার যদি বেঁচে থাকতেন, এড্‌স রোগীদের জন্য কিছু করতেন। নিশ্চয় করতেন। নিশ্চয়ই করতেন।

১৯৯৭ সালে মাদার দেহ রেখেছেন। তাতে কী হয়েছে? ‘মিশনারিজ অফ চ্যারিটি’ আছে তো…। ওখানে গিয়ে খোঁজ নিলে হয় না? ওখানেই তো আশ্রয় পেতে পারে দুলাল। এটা তো মাথাতেই আসত না…যদি না শুক্লা ‘পুণ্য’-র কথাটা তুলত।

গ্রামে যদি জেনে যায় দুলালের এই ব্যারাম হয়েছে, দুলালের মা’কে টিউবওয়েলের জল পাম্প করতে দেবে না। পুকুরে স্নান করতেও দেবে না। ১৯৮২ থেকে ১৯৯৬–এই ষোলো বছর মাত্র এই রোগটার বয়েস। আসল বয়স নিশ্চয়ই আরও অনেক বেশি, কিন্তু শোনা যাচ্ছে তো ‘৮২ থেকেই। ভারতে প্রথম এইচআইভি ধরা পড়ে ১৯৮৬ সালে। মাদ্রাজে। ‘ন্যাশনাল এড্‌স কন্ট্রোল প্রোগ্রাম’ চালু হয় ১৯৮৭ সাল থেকে। আর ‘ন্যাশো’; মানে ‘ন্যাশনাল এড্‌স কন্ট্রোল অর্গানাইজেশন’ তৈরি হয় ১৯৯২ থেকে। টাকা-পয়সা আসছে। প্রচারও হচ্ছে খুব। হোর্ডিং, খবর কাগজে বিজ্ঞাপন, বেতার ও দূরদর্শন খুব এড্‌স-এড্‌স করছে। এই শব্দটা এখন জুজু-র মতো। অফিসে কেন্দ্রীয় সরকার থেকে সাহায্য আসে। ওটাও এড্‌স। ওই শব্দটা আজকাল বলা হয় না। বলা হয় গ্র্যান্ট। ডাক্তারবাবুরা রুগিদের কাছ থেকে এরকম প্রশ্নও শুনছেন, কানেও কি এড্‌স হয় নাকি? কেননা, হিয়ারিং এড্‌স বলে একটা জিনিস শুনছি কিনা…। ব্যান্ড এড্‌স-কে ওষুধের দোকানের লোকরা বলে ব্যান্ডেট। আর যাবতীয় ওয়াকিং এড্‌সগুলোকে এককথায় বলা হচ্ছে ‘ওয়াকার’। ইংরিজি খবরের কাগজে অর্থ সাহায্য বোঝাতে এইড্স-এর বদলে লেখা হচ্ছে গ্রান্ট চারিদিকে ভয়। সচেতনতা ছড়ানোটা একটু বেশিই হয়ে গিয়েছিল হয়তো, তাই একটা ভয়ের আবহ তৈরি হয়ে গিয়েছে।

আজও অফিস গেল না অনিকেত। ভাল কাজে একটা সি.এল. দান করল। স্নান করল অনেকটা সময় নিয়ে। সাবানটা বার কয়েক ঘষল সারা শরীরে। তৃতীয়বার সাবান ঘষার সময় নিজেকেই প্রশ্ন করল, এতবার কেন? ও কি কালিমা-মুক্ত হচ্ছে? ও কি জুজু ধুচ্ছে? করমর্দন কিংবা আলিঙ্গনে এড্‌স সংক্রমিত হয় না—এই স্লোগানটাও সাবানের ফেনায় মিশিয়ে নিল।

তারপর শাওয়ার-স্নান।

দুপুরে শুক্লা আর অনিকেত পাশাপাশি শুয়েছিল। ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ছিল। জল পড়ে পাতা নড়ে হচ্ছিল। জলের নাচন পাতায়-পাতায় হচ্ছিল। কপোত-কপোতী উচ্চ বৃক্ষচূড়া থেকে নেমে কোনও নিরাপদ ঘুলঘুলিতে আশ্রয় নিয়েছিল। হঠাৎ এ কী গভীর বাণী এল ঘন মেঘের ওপার হতে।

অনিকেত বলল—আচ্ছা শুক্লা, আমার যদি এড্‌স হয়ে যায়, তুমি কী করবে?

শুক্লা বলল, ধুর, কীসব বাজে কথা একটা সুন্দর দুপুরবেলাটায়…

–ধরো না, যদি হয়….

–কী করে হবে? কার থেকে ঘরে নিয়ে আসবে ওটা?

—না, ধরো নিষ্পাপ ভাবেই যদি হয়, ধরো, রক্ত পরীক্ষা করাতে গেলাম, সেই সুচ বা সিরিঞ্জ থেকে হয়ে গেল।

–কেন? রক্তপরীক্ষা করতে গেলে নতুন সুচ নাও না?

—নিই তো। তবু যদি…

—ধুর, অলুক্ষুনে কীসব বলছ।

—না, এমনি খেলাচ্ছলে বলছি। এই ঝরঝর মুখর বাদর দিনে একটু খেলছি।

—তোমার ও-রোগ হলে তোমার থেকে আমি নিয়ে নেব।

–কী করে নেবে? করমর্দনে এড্‌স হয় না, পাশাপাশি শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লেও এড্‌স হয় না, আলিঙ্গনেও নয়। কেবলমাত্র…

—ওই কেবলমাত্র যেটা, সেভাবেই নেব।

–নেবে? তা হলে ট্রায়াল হয়ে যাক।

বলে তো ফেলল। কিন্তু মনে ভিতর থেকে ‘ট্রায়াল’ নেওয়ার উত্তেজনা আসছে না কেন?

হে কামদেব, অনঙ্গ দাও। অনঙ্গ শরে বিদ্ধ করো আমায়। মাথার ভিতরে লুকিয়ে-থাকা ছোট্ট পিটুইটারি, সক্রিয় হও হে। হে আমার গোনাডোট্রফিন হরমোন, জাগো জাগো…। মনের ভিতর থেকে যেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র-র কণ্ঠে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ অনুষ্ঠানে ‘জাগো জাগো মা’ শুনতে পায়।

বহুদিন কিছু নেই। হয় না এ বিছানায়। ইচ্ছেই হয় না। ওই জন্যই অফিসের আড্ডায় ‘কড়া পড়া’ ও ‘মরচে পড়া’—এইভাবে শ্রেণি-ভাগ করা পুরুষের মধ্যে ও ‘মরচে’ শ্রেণিতে। অব্যবহৃত থেকে মরচে। তাই বলে কি হ্যান্ডবিলের ভাষার ইন্দ্রিয়শৈথিল্য, নাকি? তা ঠিক নয়। সকালবেলায় সূর্য একাই ওঠে না কি? আরও কিছু ওঠে। কিন্তু সকালবেলায় ভৈরব রাগিণী। দু-একবার অ্যাপ্রোচ করেছিল, সাড়া পায়নি, কারণ ওটা পুজোর সময়। ভোরে উঠে স্নান করে একটু পুজোআচ্চা করে শুক্লা। আর রাত্তিরে দেখেছে শুক্লা পুতুল-প্রায়। হাত উঠিয়ে দিলে উঠে যায়, পা ওঠালে পা। পুতুল কোনও শব্দ করে না। কিচ্ছু বলতে পারে না। শুক্লা ‘উঃ লাগছে’, কিংবা ‘ব্যস, হয়েছে?’ এটুকুই বলতে পারে। আইপিসি ৩৭৭ ধারায় বিভিন্ন অপ্রাকৃতিক শারীরিক সংযোগ নিষিদ্ধ করা আছে। পায়ু, জন্তু-জানোয়ার ইত্যাদি। কিন্তু পুতুল-সঙ্গম নিষিদ্ধ নয়। পুতুল বা রোবট বিষয়ে কিছু বলা নেই। সে যাক, পুতুলটা ঠিক হ্যানডল করতে পারে না অনিকেত। সপ্রাণ হলেও। শুক্লার না-হয় পুতুল থাকার শারীরিক কারণ আছে, কিন্তু মঞ্জুর তো মানসিক। শুক্লা যদি বার্বি ডল হয়, মঞ্জু কাঠের পুতুল। অনিকেত নিজে এখনও পরীক্ষা করে দেখেনি ওর পৌত্তলিক ধর্ম, এটা মঞ্জুর নিজস্ব উক্তি। কিন্তু যেদিন মঞ্জু কিছুটা ঘন হয়ে, অনিকেতের হাত ধরে বলেছিল, ‘পারবি, তুই পারবি পুতুলটাকে প্রাণ দিতে?’ অনিকেত একটু ঘাবড়েই গিয়েছিল, রক্তস্রোতের চাঞ্চল্যও টের পেয়েছিল, কথাটার প্রাথমিক শক-এ হাতটা ছেড়ে দিলেও, আফটার শক-এ হাতটা বেশ জেরে চেপে ধরেছিল। মঞ্জুর হাতের পাতা উন্মুক্ত হয়ে গেলে অনিকেতের হাত ওখানে আশ্রয় নিল। একটা হাতের আঙুলের ফাঁকে-ফাঁকে ঢুকেছে আর একটা হাতের আঙুল অনিকেতের মনে হচ্ছিল শুক্লার তুলনায় এই হাত আরও উষ্ণ। আরও কোমল। অনিকেতের চোখের মধ্যে টর্চ জ্বলে উঠেছিল, টর্চ নয়, সার্চলাইট। মঞ্জুর শরীরের ওপর ঘুরছিল। ডুবুরি হয়ে মঞ্জুর শরীরের গভীরে ঢুকে গিয়ে বলে উঠেছিল, পেয়েছি, পেয়েছি। মুক্তো! মুক্তো! কিন্তু মনে-মনে। কোথাও তোমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা। কিন্তু রবীন্দ্রসদনের সিঁড়ির ওপর বসে এর বেশি কিছুই সম্ভব ছিল না। সিঁড়ি ছাড়াও ওই চত্বরে অনেক কুঞ্জ আছে। কিন্তু ওই বয়সে কুঞ্জগমন পোষায় না কি? কিন্তু ‘পারবি পুতুলটাকে প্রাণ দিতে’—এই বাক্যাংশটা আফ্রোডেজিয়াক-এর কাজ করেছিল অনিকেতের শরীরে। ওই শব্দ ক’টিই যেন মদনানন্দ মোদক। রতিকল্প তৈল।

এই এখন, বৃষ্টিদিনে শুক্লা একটা ইঙ্গিত দিয়েছে, বহুদিন পরে, কেন কে জানে? বৃষ্টিই কারণ। ওর আহ্বানে সাড়া দেওয়া উচিত। মঞ্জুর মুখোৎসারিত সেই শব্দ ক’টা গিলে ফেলল অনিকেত। এবং মনে হল, হচ্ছে। ভায়াগ্রা নামে একটা ওষুধের কথা শোনা যাচ্ছে। পৃথিবীর কয়েকটা দেশে চালু হয়ে গিয়েছে। ওই ওষুধটা নাকি শরীরে রক্তপ্রবাহ বাড়িয়ে দেয়, সমস্ত সরু জালিকাগুলো রক্তে টইটম্বুর হয়ে ওঠে। এদেশে এখনও ওষুধটা আসেনি, কিন্তু গল্প এসেছে। মঞ্জুর মুখ থেকে বের হওয়া ওই নিরীহ শব্দ ক’টা কেন ভায়াগ্রা হয়ে ওঠে। মন বড় বিচিত্র বস্তু।

শুক্লা অনিকেতের গায়ে মাথায় হাত বুলোতে লাগল।

বলল, তুমি বেশ ভাল লোক কিন্তু…

—কেন, এতদিন পর এ কথা মনে হচ্ছে কেন?

—বলছি, লোকের জন্য কত করো। দুলালের মা তো একটা ‘মা’, আমি যদিও মা নই, হতে পারিনি, কিন্তু মায়ের মন বুঝি। তুমি সার্ভিসটা না-দিলে দুলাল বেঁচে ফিরত না। বলে— আবার একটু আদর করল। তুমি একটা ভালো ছেলে। ভেরি গুড বয়

অনিকেতের গায়ে উপুড় হল। এরকম তো হয় না, ভেরি আনলাইক্‌লি। অনিকেত তো খালি গায়েই ছিল। এবং বারমুডা। শুক্লা ম্যাক্সিতে। শুক্লা অনিকেতের শিরায়, হাড়-পাঁজরায়, আঙুল ছুঁইয়ে দিচ্ছিল, পিয়ানোর মতো বেজে উঠছিল ও। বর্ষা-সিম্ফনি। হাতটা নাভি ছাড়িয়ে নামছিল। স্পর্শও করেছিল লিঙ্গস্থল। শুক্লা মায়া-আহ্লাদে বলে উঠেছিল, ও-মা? এ কী? কিন্তু হায়, শুক্লা জানে না এই জাগরণ-রহস্য। জাগরণের গুপ্তকথা। সামান্য অপরাধবোধ এল অনিকেতের মনে। এখন বেশি অপরাধবোধ ভাল নয়।

শুক্লা বলল, দুলালটা এটাকেই কেটে ফেলেছিল? অ্যাঁ? কেন গো?

—ওটাই তো…।

‘বিপন্ন বিস্ময়’ কথাটা মনে এলেও বলল না। ‘বিপন্ন বিস্ময়’ শব্দটার সঙ্গে জীবনানন্দ দাশ এমন বিচ্ছিরিভাবে জড়িত যে, জীবনানন্দকে এসবের মধ্যে আনতে চাইল না। অনিকেত বলল, ওটাই তো বিচ্ছিরি বিস্ময়।

শুক্লা বলল, আমার কী মনে হয় জানো, ও কোনও প্রায়শ্চিত্ত করেছে। দুলাল নিশ্চয়ই অন্য কোনও মেয়ের সঙ্গে…. ওর মনে পাপবোধ এসেছিল, ওর বউকে মুখ দেখাতে পারত না লজ্জায়, ওর মনে হয়েছে ওর অপকর্মের জন্য এই জিনিসটাই দায়ী, তাই ওটা কেটে ফেলেছে।

—উঃ, পারা যায় না এসময় এসব কথা। আবার তো আগের অবস্থায় ফিরে যাবে।

কথা বাড়ায় না অনিকেত। কথা কম, কাজ বেশি। অনিকেত খুব অবাক হচ্ছিল। শুক্লাকে এভাবে পায়নি কতকাল। এরূপ দেখেনি কতদিন। শুক্লা নিজেও অনেকটা সক্রিয় ছিল। বেশিটাই। এক যুগ আগে এরকম শীৎকার শব্দ ফেলে এসেছে। কী করে আবার ফিরে এল?

তবে যে বলে হরমোনটাই আসল, যৌনতা কেমিস্ট্রি মাত্র। যে-রাসায়নিক দ্রব্যগুলো মানুষকে লিবিডো-পীড়িত করে, সেগুলো শুক্লার শরীরে নিঃসৃত হয় না। হরমোনের উৎস কাটা গিয়েছে। ওভারি শুধু নয়, সারভিক্‌স-সহ জরায়ু। তা হলে এ তাড়না ও পেল কীভাবে হঠাৎ করে? ও আজ যা-যা করল—মনীষী ডায়রি পড়া, সকালে স্নান করে পুজোয় বসা, এবং উপযুক্ত আধ্যাত্মিক গুরু খুঁজে দীক্ষা-বাসনায় থাকা শুক্লার পক্ষে একটু অস্বাভাবিক। টিভিতে খোলামেলা পোশাক পরা মেয়ে-টেয়ে দেখলে বলে, ইস, দেখা যায় না। ওর মা-বাবা দেখছে না? ওর ছেলেমেয়ে থাকলে দেখছে না? তাই বলে চ্যানেল পাল্টেও দেয় না। বলে, তুমি দ্যাখো। তোমাদের জন্যই তো দেখাচ্ছে। যে-মেয়েটা এখনও কাপড় ছাড়ার সময় অনিকেতকে ঘর থেকে বার করে দেয়, সে আজ অনেকটা যেন সফ্ট পর্ন-এর নায়িকা হয়ে গেল।

অভিনয়?

কেন এই অভিনয়?

অনিকেত জিগ্যেসই করে ফেলল, তোমার আজ কী হয়েছিল শুক্লা? হঠাৎ কোত্থেকে টিন- এজ খাবলে নিলে তুমি এই চল্লিশ প্লাস বয়সে?

শুক্লা বলল, ফট্টি-নট্টি…। বলেই হাসল…হাসতে-হাসতে বলেছে, ‘অলকানন্দা’ কাগজের কভার স্টোরি। ‘অলকানন্দা’ একটা মেয়েদের কাগজ। যুগান্তকারী লেখা থাকে। ছেলেদের জোটানো এবং ফোটানো, ফ্লার্ট-এর এ বি সি ডি—এসব লেখা থাকে।

—তুমি আবার ‘অলকানন্দা’ কেনো না কি? আগে তো দেখিনি?

ও বলল, একটা কিনলাম হঠাৎ

অনিকেত বলল—মধ্যবয়সে স্বামীকে খুশি করার টিপ্‌স আছে নাকি ওটায়?

শুক্লা বলল—অনেকটা ও-ধরনের আছে একটা আর্টিক্‌ল…

—ও, তা হলে ওইসব থিয়োরির প্র্যাকটিকাল ক্লাস করলে বুঝি আজ?

—কেন? ভাল লাগেনি?

—ভাল তো লেগেইছে। কিন্তু তুমি যেসব আওয়াজ-টাওয়াজ করলে, ওগুলোও কি থিয়োরি? ওইভাবেই হোমওয়ার্ক করতে বলেছিল তোমায়? তোমার ওই পনেরো-বিশ মিনিটের অভিনয়টা অসাধারণ হয়েছিল, নিঃসন্দেহে।

শুক্লা বলল—অভিনয় বলছ কেন? ওসব তো আমিই করেছিলাম। অসভ্যের মতো। ভীষণ ইচ্ছে করছিল তোমায় ভালবাসতে। ভীষণ করে?

—কেন?

—বললাম না? দুলালদের জন্য তুমি কত কী করলে। ভাল লোক না-হলে কেউ এরকম

মাথা চুলকোয় অনিকেত। মন? না হরমোন?

বিকেল শেষের বৃষ্টি-ধোয়া আলো শুক্লার মুখে। ওর মুখটা মায়াবী দেখাচ্ছে। লাবণ্যে পূর্ণ দেখাচ্ছে।

অনিকেত সোফায় গা এলিয়ে সিগারেট ধরিয়েছে। তৃপ্ত হলে যা করতে হয়। পা-টা সেন্টার টেবিলের ওপর লম্বা করে তুলে দিয়ে নাচাচ্ছে। এরকম একটা দৃশ্য ওদের মুকুন্দপুরের ঘরে বহুদিন পরে তৈরি হল।

শুক্লা বলল—একটা খুব ভাল স্বপ্ন দেখেছি আজ ভোরে। শেষরাতের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়। চোখে জিজ্ঞাসা নিয়ে স্মিত হাস্যে অনিকেত শুক্লার দিকে তাকায়।

শুক্লা স্বপ্নের কথাটা না-বলে বলে—কালকের কাগজে দেখলাম একটি পুরুষ গর্ভবতী হয়েছে। পড়েছ?

—পড়েছি। ও পুরুষ ছিল না। আসলে নারীই ছিল। x-x ক্রোমোজোম-সম্পন্ন। হয়তো বহিরঙ্গে পুরুষ। ভিতরে-ভিতরে নারী। এজন্যই হয়তো….।

শুক্লা বলল, সব গুলিয়ে দাও তোমরা। অন্তরঙ্গ, বহিরঙ্গ…। ও একটা ব্যাটাছেলে ছিল। ওর নাম অভয়চরণ দাস। কাগজে তাই তো লিখেছে। ওর হঠাৎ পেটটা বড় হয়ে গেল। বাড়ির লোক ভেবেছিল ওটা টিউমার। তারপর ডাক্তারের কাছে গেল। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল পেটে বাচ্চা…

অনিকেত যেটা বলতে পারল না—সেটা হল—ভ্রূণ অবস্থায়, সব ভ্রূণেরই, গোনাডিক এরিয়া প্রথম দিকে একইরকম থাকে। পাঁচ মাসের পর থেকে আস্তে-আস্তে পরিবর্তন হতে থাকে। দু’টো সরষের দানার মতো গ্ল্যান্ড পুরুষ-ভ্রূণদের ক্ষেত্রে বড় হয়ে ধীরে-ধীরে পেটের তলায় ঝুলে যায়। সেটাই অণ্ডকোষ। স্ত্রী-ভ্রূণদের ক্ষেত্রে পেটের ভিতরেই থেকে যায়, পরে ওটা ওভারি-তে রূপান্তরিত হয়। আর একটা ছোট্ট পিণ্ড বেড়ে গিয়ে পুরুষ-লিঙ্গে পরিণত হয়, মেয়েদের ক্ষেত্রে ওটা তেমন বাড়ে না, জনন-অঙ্গের ওপরেই রয়ে যায়। ওটা ক্লিটোরিস। কে পুরুষ হবে, কে নারী হবে সেটা নির্ভর করে ৪৬টা ক্রোমোজোমের মধ্যে যে দু’টো সেক্স – ক্রোমোজোম, তাদের ওপর। xx হলে নারী, xy হলে পুরুষ। কোনও-কোনও পুরুষ-শিশুর ক্ষেত্রে অণ্ডকোষটা পেটের ভিতরেই রয়ে যায়। লিঙ্গটিও অপরিণত হয়। ওরা হিজড়ে নয়। পুরুষ। সার্জিকাল অপারেশনে ঠিক হয়ে যায়। কোনও স্ত্রী-শিশুর ক্ষেত্রে ক্লিটোরিস-টা একটু বড়ই দেখায়। মনে হয় যেন পুরুষ। আসলে সে নারী। অভয়চরণ সেরকমই। তার জনন-ছিদ্র ছিল, শুক্রসংযোগও ঘটেছিল। নইলে…।

এত কিছু বলা মানে, এই রচিত সুন্দর দৃশ্যচিত্রটার ওপর কালি ছিটিয়ে দেওয়া। ও শুধু বলল, কাগজে সবটা কি লেখে? স্বপ্নটার কথা বলো।

শুক্লা বলল—দেখি, বাড়িতে বিদ্যাসাগর এসেছেন। গায়ে উড়নি। ধুতি। হাসছেন। বলছেন, তোমার নাকি কন্যাসন্তান হয়েছে শুনলাম…। আমার বাবাও ছিলেন। বাবা বললেন, বিদ্যাসাগরমশাইকে প্রণাম করো। বাবাও প্রণাম করলেন। বিদ্যাসাগর মশাই মেয়েটার মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলেন। তক্ষুনি এলেন নিবেদিতা। সাদা গাউন পরা। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। বললেন শুক্লা, মেয়েটাকে কিন্তু আমার স্কুলে দিও…।

তা হলে একটু আগে যা কিছু হল তার কারণ একটা স্বপ্ন? এত কিছু করাতে পারে?

হে ফ্রয়েড, ইয়ুং, পাভলভ, উইলহেম জনসন, ডকিন্‌স, তোমরা দেখে নাও—মন- পরিবেশ-হরমোন-জিন শুধু নয়, আরও এক প্যারামিটার আছে, যেটা লিবিডো চালনা করে— যেটা শুক্লা জেনেছে—সেটা স্বপ্ন।

২১

মেট্রো রেল পুরোটাই চালু হয়ে গিয়েছে। প্রথম দিকটা টালিগঞ্জ থেকে এসপ্লানেড, আর ওদিকে দমদম থেকে গিরিশ পার্ক পর্যন্ত চলছিল। মাঝখানের অংশটুকু তৈরি হতে দেরি হয়েছে। চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ-তে কীসব মামলা ছিল। মামলা মিটতে দেরি হয়েছে। ফলে ওই অঞ্চলের কাজটুকুও আটকে ছিল।

কলকাতা খোঁড়াখুঁড়ি করে মাটির তলা থেকে যা-যা পাওয়া গিয়েছে, তাই নিয়ে একটা এগজিবিশন চলছে এশিয়াটিক সোসাইটি-তে। অনিকেত একটু আগে ভাগে অফিস কাটল। মেট্রো স্টেশনগুলো ঝকঝক করে। এই পাতাল-কলকাতার সঙ্গে ওপর-কলকাতাকে মেলানো যায় না। লোকজন নীচে কাগজ ফেলে না, সিগারেট খায় না, থুথু ফেলে না। কেউ পানের পিক ফেললেই অন্য কেউ প্রতিবাদ করে। একই তো লোকজন। ওপরে উঠলেই মানসিকতা পাল্টে যায়। এটাকে কি বলা যায় বাই-আইডেন্টিটি। বাই-পোলারিটি? কে জানে? তা হলে বাইজেনটিয়ানিটি। হঠাৎ বাইজেন্টিয়ান সাম্রাজ্যের কথা উড়ে এল কেন পুরনো কালের স্কুল- বই থেকে? ইতিহাস দেখতে যাওয়া হচ্ছে বলে? নাকি ‘বাই’ শব্দটা নিয়েই একটা বাই হয়েছে আজকাল। বাই-সেক্সুয়াল, বাই-লিঙ্গুয়াল, বাইনারি বন্ডিং…চলমান সিঁড়ি দিয়ে নামছিল অনিকেত। এর নাম এস্কালেটর। বেশ মজা লাগে চড়তে। ফাঁক পেলেই মেট্রো রেল চড়ে অনিকেত। এশিয়াটিক সোসাইটি তো পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে। আকাশবাণী থেকে বাসেই যাওয়া যেত, কিন্তু মেট্রোতেই যেতে ইচ্ছে করল। চার-পাঁচ বছর হয়ে গেল, এখনও বেশ লাগে। ওর বাড়িটা যেখানে, ওখানে মেট্রোয় খুব একটা সুবিধে হয় না। বাসেই যাতায়াত করে। তাই সুযোগ পেলেই মেট্রোয় ওঠা। এসপ্লানেড স্টেশন।

সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামছে অনিকেত, হাই বস… লুক্স নাইস….

আইভি সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠছে। একটা বিন্দুতে ওরা পরস্পরকে অতিক্রম করল, সেই মুহূর্তে টুক করে মাথার টুপিটা উঠিয়ে নিল আইভি। অনিকেত পিছন ফিরে দেখল, টুপিটা আইভি ওর মাথায় পরে নিয়েছে, আইভি ওপরে উঠে যাচ্ছে।

এগুলো ওর বাড়াবাড়ি। ইচ্ছে করে এসব ছেলেমি করে। এই ইয়ার্কিগুলো তো ছেলেদের।

নিচে নেমে গিয়ে আবার ওপরে ওঠার এস্কালেটর দিয়ে উঠতে হচ্ছে। সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে আছে আইভি। মাথায় টুপি।

ছাতার বদলে টুপিই ব্যবহার করে অনিকেত। রোদ্দুর আটকায়, হাল্কা বৃষ্টিতেও কাজ দেয়। টুপি ব্যবহারে প্রথম দিকে একটু জড়তা ছিল, মন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তী এই জড়তাটা কাটিয়ে দিয়েছেন। আইভি বলল—তুমি আমায় টুপি পরাতে পারবে না গুরু, তার আগেই আমি পরে নিলাম। ইস্কুল কেটে কোথায় যাচ্ছ? ইএমএ?

‘ইএমএ’ মানেটা বুঝতে পারল না অনিকেত। ‘এইএমইউ’ জানে। মুখে জিজ্ঞাসা-চিহ্ন এঁকে দাঁড়িয়ে রইল অনিকেত।

—মানে বুঝতে পারলে না? এক্সট্রা ম্যারিটাল অ্যাফেয়ার্স। একদিন খুব গদগদ ভাবে কথা বলছিলে একজন মহিলার সঙ্গে, খুব ঘেঁষটে হাঁটছিলে, আমি যে তোমার সামনে ছিলাম, খেয়ালই করোনি। কিছু মনে কোরো না বস, ইএমএ’ করতে চাইলে আরও ভাল পেতে। ওই ভদ্রমহিলা মোটেই ইমপ্রেসিভ নয়। কোত্থেকে জোটালে?

—ধুস্, ওরকম কিছু নয়। ‘ইএমএ’ আবার কী? সেই ছোটবেলার পাড়ার মেয়ে, অনেকদিন পর দেখা হল…

—আইস্ শা…। তুমি লাজে রাঙা হল কনে বউ গো’ টাইপের হয়ে যাচ্ছ কেন? বলো না বেশ করেছি।

বলছি তো, ওরকম কিছু নয়। কারও সঙ্গে কথা বললেই প্রেম হয় না কি? এখন যে তোমার সঙ্গে কথা বলছি, এটা কি প্রেম?

—যাবাব্বা। প্রেম কোত্থেকে এল? ‘ইএমএ’ মানে কি প্রেম নাকি? আর তুমি আমার সঙ্গে প্রেম করতে চাইলেও, আমি করব না কি? এটা হল বাই-কনসেনচুয়াল। যাক, যা করছ করো, বুক ফুলিয়ে করো। যদিও তোমার বুক ফুলবে না। যাও। ‘ইএমএ’ করতে যাও।

শালা। সব ক’টা মেয়েই জেলাস। আইভি ছেলেমিপনা দেখালে কী হবে, ঠিক ভিতরে- ভিতরে জেলাস। অনিকেত ভাবে। ও যে মঞ্জুর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে না, সেটা প্রমাণ করার জন্যই যেন বলে—একটা এজিবিশন দেখতে যাচ্ছি। কলকাতার গর্ভে পাওয়া পুরাতাত্ত্বিক জিনিসপত্র।

—গর্ভ বললে কেন? অভ্যেস খারাপ হয়ে গিয়েছে, তাই না? আইভি বাঁকা চোখে বলল। চোখের এই ভঙ্গি, যেটাকে ভ্রুভঙ্গি বলে, সেটা মেয়েরাই বেশি করে।

—যাব্বাবা, গর্ভই তো। ভূগর্ভ, সমুদ্রগর্ভ, এগুলো…

—না, বললেই তো হত কলকাতার মাটির তলায় পাওয়া পুরাতাত্ত্বিক না কী বললে, সেই এগজিবিশন, সাধুভাষা বলার কী দরকার ছিল? অসাধু উদ্দেশ্য।

—এর মধ্যে অসাধু উদ্দেশ্য? কী হয়েছে তোমার, অ্যাঁ?

—কী আবার হবে? গর্ভ কথাটা শুনলেই শালা গা ঘিনঘিন করে। জরায়ু-ফরায়ু কী সব বলে না…

কপাল কুঁচকে গেল, ঠোঁটটা বেঁকে গেল আইভি-র, যেন ওর গায়ে বিচ্ছিরি কিছু নোংরা লেগেছে। অনিকেত বলতে যাচ্ছিল : ওসব তো তোমারও আছে, কেন বদার করছ? বলতে গিয়েও বলে না। আইভি-র ব্যাপারটা ও কিছুটা বোঝে। চারপাশেই কত ভুল-করে-পাওয়া লোকজন। যাহা পাই তাহা ভুল করে পাই। ভারতবর্ষে তিরিশ-চল্লিশ লক্ষ ট্রান্সজেন্ডার ঘুরে বেড়াচ্ছে। লিঙ্গান্তরকামী। কোনও তো হিসেব নেই, এসব হল এনজিও-র হিসেব। গত সেনসাসে এদের পুরুষ বলেই হিসেব করা হয়েছিল। যদি তিরিশ লক্ষই হয়, তবে প্রতি হাজারে তিনজন করে লিঙ্গান্তর-কামী রয়েছে। মানে, নিজেদের জেন্ডার আইডেন্টিটি যাদের পছন্দ নয়। এই তিরিশ লক্ষর মধ্যে বারো লক্ষ পেশাগত হিজড়া, মানে হিজড়ে পেশায় নিযুক্ত। ‘কার হল গো’ বলে তালি লাগায়, ট্রেনে যাত্রীদের কাছ থেকে তোলা আদায় করে, কিংবা স্টেশনের লেডিজ টিকিট কাউন্টারে দাঁড়িয়ে থাকে, ওখানে ভিড় কম। পুরুষদের টিকিট কেটে দিয়ে পয়সা নেয়। ‘সর্বভারতীয় হিজড়া কল্যাণ সমিতি’র ১৯৯৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, হিজড়েদের সংখ্যা বারো লক্ষ। এ ছাড়া আছে লোন্ডা-নাসিন, যারা মেয়ে সেজে বিয়েবাড়ি বা অন্যান্য উৎসবে নাচে। আর আছে সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা অজস্র কোতি। আমাদের মধ্যেই কত ‘পরি’ রয়েছে, তাদের সংখ্যা কত কে জানে? যে সব এনজিও এদের নিয়ে কাজ করে, তারা সবাই একইরকম পরিসংখ্যান দেয় না। তবে মোটামুটি ভাবে বলা যায়—বারো থেকে পনেরো লক্ষ পেশাদার হিজড়া ও লন্ডা ছাড়াও পঁচিশ-ত্রিশ লক্ষ ঘরে থাকা লিঙ্গান্তর-কামী রয়েছে।

এরা কিন্তু পুরুষ। জন্মসূত্রে, বা শারীরিক ভাবে পুরুষ, কিন্তু মনে-মনে নারী। পুরুষ-সত্তা পছন্দ করে না। মেয়ে হতে পারলে মানসিক তৃপ্তি পায়।

নারী লিঙ্গান্তর-কামীদের এই হিসেবে ধরা হয়নি। জন্মসূত্রে স্ত্রী-লিঙ্গচিহ্ন পাওয়া যেসব মেয়ে তাদের ওই লিঙ্গ-পরিচয়ে সন্তুষ্ট নয়, তাদের মধ্যে অনেকেই মনে-মনে পুরুষ। বা ভাবে, পুরুষ হতে পারলে ভাল হত। নিজেকে পুরুষ ভেবে নারীর প্রতি আকৃষ্ট হয় তারা। চারপাশের লোক ভাবে, দু’টো মেয়েতে কীসব করছে। ওদেরই লেসবিয়ান বলা হয়। আইভি নিশ্চয়ই তা-ই। আর যত এইসব পাবলিকের সঙ্গেই পরিচয় হয়ে যায় অনিকেতের।

অনিকেত যদি এখন আইভিকে জিগ্যেস করে, আইভি তুমি কি লেসবি?

ও হয়তো উত্তর দেবে—তাতে তোমার কী?

আইভি বলল, এগজিবিশন যাবে বলছ, চলো, আমিও যাই। দেখে আসি। যদি ‘ইএমএ’ করতে যেতে, তা হলে তোমার সঙ্গে যেতাম না।

অনিকেত বলল—ঠিক আছে, চলো, কিন্তু তোমাকে আজ বেশ বিন্দাস লাগছে আইভি। অফিসে সকালবেলা একবার দেখলাম, তারপর কোথায় কেটেছিলে তুমি? আইভি বলল – একটা ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলাম অনিকেতদা, কাউকে বোলো না। একটা সিকিউরিটি অফিসারের চাকরি। এই পুতুপুতু চাকরিটা একদম ভাল লাগছে না। কী আছে এই চাকরিতে? খেলা হলে কমেন্টেটর ফিট করো। একটা লোক রিলে করবে, আর আমি পাশে বসে কমেন্টেটরের তত্ত্বতালাশ করব। পিকে ব্যানার্জি, চুনী গোস্বামীদের তেল মারব। সিএবি কর্তাদের তেল মারব, ক্রিকেট অ্যানালিসিসের জন্য সম্বরণকে ডাকব, কবে কলকাতায় গাভাসকর আসছে, কপিলদেব আসছে, তক্কে তক্কে থাকব। ওদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়ার জন্য ওদের চামচেদের তেল মারব, ধুস। ক্রিকেট একটা ক্রেজ, আর ক্রিকেট একটা খেলা না কি? আমি গুরু ক্যারাটে জানি, তাইকোয়ান্ডো জানি, ভলিবলে স্টেট খেলেছি, এসব কেরানি- মার্কা চাকরি আর পোষাচ্ছে না। সিকিউরিটি অফিসারের কাজটা যদি হয়ে যায়, নিয়ে নেব। ইউনিফর্ম পরে অফিস যাব। একদম প্যান্ট-জ্যাকেট, হয়তো একটা লাইসেন্সড রিভলভার-ও দেবে…। বলো গুরু, কাজটা ভাল না?

অনিকেত বলল, গভর্নমেন্ট-এর চাকরিটা ছেড়ে দেবে? আইভি বলল—ধুর, গরমেন্টের গা…খিস্তি করার জন্য ইনস্টিগেট কোরো না কিন্তু…।

—আচ্ছা ঠিক আছে, আচ্ছা ঠিক আছে…।

এশিয়াটিক সোসাইটি-তে একটা হল-এ এগজিবিশন সাজানো হয়েছে। পুলক নামে একটা ছেলে ওখানকার ফেলোশিপ পাওয়া গবেষক।

ও বলছে, জোব চার্নক কলকাতা এলেন তারপর এখানে বসতি শুরু হল—অনেকে এরকম ভাবেন, এটা ঠিক নয়। বহুদিন আগে থেকেই গঙ্গার ধারে এই অঞ্চলে জনপদ ছিল। কলকাতার কাছেই বেড়াচাঁপা অঞ্চলের চন্দ্রকেতুর গড়ে গুপ্তযুগের প্রত্নসামগ্রী পাওয়া গিয়েছে। সুন্দরবনেও বেশ কিছু পুরাতাত্ত্বিক চিহ্ন পাওয়া গিয়েছে, যা কয়েক হাজার বছরের পুরনো। নবদ্বীপের কাছে বল্লাল ঢিপি এখনও খোঁড়াখুঁড়ি হয়নি। মঙ্গলকোটের কাছে পাণ্ডুরাজার ঢিপির রহস্যও জানি না আমরা। কলকাতার চারপাশে প্রাচীন ইতিহাসের চিহ্ন রয়েছে। এই বিরাট অঞ্চল জুড়ে সভ্যতা ছিল। আলেকজান্ডার উত্তর-পশ্চিম ভারতে হানা দিয়েছিলেন, বেশ কিছু এলাকা দখল করে নিয়েছিলেন, কিন্তু আর এগোননি, কারণ শুনেছিলেন—গঙ্গারিডি নামে একটা খুব শক্তিশালী রাজ্য আছে, ওদের প্রচুর ক্ষমতা। গঙ্গারিডি রাজ্যর মধ্যেই একসময় কলকাতা পড়েছে। তারও আগে, মহাভারতের সময় অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গের কথা আছে। কর্ণ ছিল অঙ্গের রাজা। কলকাতা অঙ্গের মধ্যে থাকলেও, আরও ওপরে বঙ্গ।

‘বঙ্গ’ নামের উৎপত্তি দেখাচ্ছে পুলক একটা চার্টে। দ্রাবিড়-ভাষী জাতি বঙ্গা ছিল এখানে।

অনিকেত বলল—’বোঙ্গা’ থেকে হতে পারে? অস্ট্রিক-রা ‘বোঙ্গা’ বলতে ভূত বোঝায়।

পুলক হাসল। পুলক তো মুরগি পেয়েছে। সারা এগজিবিশন হল-এ আর কোনও লোক নেই। আর অনিকেত এসেছে পুলক বলেছে বলেই।

পুলক ইতিহাস বোঝাচ্ছে।

গুপ্তযুগের পর পাল বংশ, সেন বংশ, এইসব ভ্যারভ্যার করল। মধ্যযুগে হাওড়া-হুগলি- চব্বিশ পরগনা মিলিয়ে ভুরশুট রাজ্য হয়েছিল, তারা খুব বাণিজ্য করত, এসবও বলল। বলল, কলকাতার আশেপাশে পুকুর খুঁড়তে গিয়ে অনেক কিছু পাওয়া গিয়েছে, যেমন গড়িয়ার কাছে মহামায়াতলায়, ধপধপিতে, বারাসতে, ঠাকুরপুকুরে, ওসব বিভিন্ন মিউজিয়মে আছে। এখানে শুধু মেট্রো রেল খোঁড়াখুঁড়ির সময় যা পাওয়া গিয়েছে, এবং পিরিওডিক্যালি সাজানো নেই। পুলক বলছে—এগুলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কয়েন। এগুলো জাহাঙ্গির-এর সময়ের কয়েন। এই যে এই হাড়ের লাঠিটা, এটা নাগপুরি লাঠি। বর্গীরা খুব হানা দিত ১৭১০ থেকে ১৭৫০ পর্যন্ত। ওরাই এনেছিল নিশ্চয়। এই যে, এটা আধা–ফসিল হওয়া হাড়। এক্সপার্টরা বলছে এটা গন্ডারের হাড়। ১৭০০ সালেও নাকি সুন্দরবনে গন্ডার ছিল। ওটা মগদের তামাক খাবার পাইপ। আইভি এর মধ্যে কনুই খোঁচা দিয়েছে। মানে, এবার ফোটো। কনুই খোঁচা দিয়েই বলল, সরি। বোধহয় ভাবল এটা তো মেয়েলি জেস্চার।

—এই দেখুন এটা মিশরের স্বর্ণমুদ্রা। তিন পিস। এটা মিশরের স্কারা মাদুলি।

এ-ধারে দেখুন সব মাটির বাসনের টুকরো। পোড়া মাটির কত পুতুল। এটা বোধহয় সূর্যমূর্তির হাত। ওটা বিষ্ণুমূর্তির পা। কষ্টিপাথরের। এদেশে তো এরকম পাথর নেই, নিশ্চয়ই বাইরের। এটা একটা গোটা বুদ্ধমুর্তি। পাল রাজারা তো বৌদ্ধ ছিল। এটা যক্ষিণী। পোড়ামাটির। এটা দেখুন আজব একটা মূর্তি। পোড়ামাটির। এখনও নষ্ট হয়নি, দেখুন। কে জানে কোত্থেকে কলকাতায় এসেছে এই মূর্তি। মিশর-টিশর হতে পারে, কম্বোজ, মানে কম্বোডিয়াও হতে পারে। মুরগির ওপর বসা দেবীমূর্তি। চারটে হাত। এক হাতে ছোরা। হিন্দু দেবদেবীদের প্যাঁচা, হাঁস, ময়ূর—পাখি হিসেবে এই তিনটেই জানি। মুরগি-বাহন দেখিনি কখনও। রংটা দেখুন লাল। তেল-সিঁদুরের আস্তরণ পড়েছিল। সিঁদুর মানে মার্কিউরিক অক্সাইড কিনা, এর লাল রং বহুদিন থাকে।

খুব মন দিয়ে মূর্তিটা দেখতে থাকে অনিকেত। খুব চেনা লাগছে। চেনা লাগছে কেন? এবার এধারে আসুন। বোধহয় কোনও বাবু-বাড়ি ভেঙে পড়েছিল। কত ঝাড়লণ্ঠনের টুকরো। ওধারে চলুন, নৌকোর ভাঙা অংশ আছে।

অনিকেত একটা ট্রে-র ওপর রাখা অজানা দেবীমূর্তিটা দেখতে থাকে। আইভি বলে, খুব পছন্দ হয়েছে দেখছি…। পুলক বলে, কী দেখছেন ওটা? ভাবখানা এমন : আর্কিওলজি-র আপনি কী বোঝেন—এরকম বিশেষজ্ঞর দৃষ্টিতে দেখছেন যে খামোকা?

–দেখছ, চারটে হাতের একটা হাতে বরাভয় মুদ্রা। দুর্গার যেমন থাকে, অন্নপূর্ণার। লক্ষ্মীরও…।

পুলক বলল—এ আর নতুন কথা কী? চার হাতের সব দেবদেবীরই একটা হাত বরাভয় মুদ্রায় থাকে।

অনিকেত বলল—এই মূর্তি আমার চেনা। আমি এই মূর্তি দেখেছি। এই দেবীর নাম বহুচেরা।

–বহুচেরা? এটা আবার কী দেবী? পুলক জিগ্যেস করে।

অনিকেত বলে—হিজড়েরা এই দেবীর পুজো করত। এখনও করে। তার মানে প্রাচীন কলকাতায় হিজড়েরা ছিল…। অনিকেত বলল, লক্ষ করে দ্যাখো, এটা মাটি-টিপে করা নয়, মানে টেপা-পুতুল নয়। ছাঁচে ঢেলে পোড়ানো হয়েছে। তার মানে একসঙ্গে অনেক পুতুল বা মূর্তি করা হয়েছিল। আর এটা পাথরের মূর্তি নয়। পোড়ামাটির। মানে বাইরে থেকে নিয়ে আসা নয়, এখানেই, এই বাংলায়, হয়তো বা এই কলকাতায়, এগুলো তৈরি হয়েছিল, তার মানে কলকাতায় বহুচেরা দেবী পূজিতা হতেন…।

পুলককে বলল—এই সাবজেক্টটা নিয়ে কাজ করো। পিএইচডি অবধারিত।

পুলক বলল, একটা কাজ তো করছি সেন যুগ নিয়ে…। বল্লাল ঢিপিটা এক্সকাভেট করতে পারলে অনেক সুবিধে হত, কিন্তু তার আগে আপনাকে এক্সকাভেট করতে হয়….কী করে কনফিডেন্টলি বললেন যে এটা ‘বহুচেরা’…। অনিকেত বলতেই পারত, দুলালের কথা। দুলালের ঘরে এরকম একটা ছবি আছে। রোজ পুজো করে দুলাল। দুলাল বলেছে, ইনি মা বহুচেরা। আমাদের কথা শোনেন। কিন্তু বলল না কিছু। বললেই, দলবল নিয়ে হাজির হবে। দুলালরা পড়বে সমস্যায়।

ওখান থেকে বেরিয়ে এল অনিকেত। আইভি বলল, তোমার এই দেবীতে ইন্টারেস্ট হল কেন? নামের মধ্যে ‘চেরা’ শব্দটা আছে বলে?

অনিকেত বলল—তুমি তবে চেরাপুঞ্জি বেড়াতে গিয়েছিলে কেন? ‘চেরা’ শব্দটার জন্য?

আইভি বলল—ধুর, আই হেট দিস চেরা পার্ট অফ মাই অর্গান। তোমাকেই বলা যায়। আমার যদি তোমাদের মতো একটা এক্সটেন্ডেড পার্ট থাকত ওই জায়গাটায়, খুশি হতাম। যখন ফ্রয়েড পড়েছিলাম একটু, দেখেছিলাম উনি বলছেন, মেয়েদের ইনফিরিয়রিটি-র জন্য দায়ী ওই যন্তরটা না-থাকা। ফ্যালিক ইনডেফিসিয়েন্সি। বাচ্চা বয়সে ছেলেমেয়েরা সবাই যখন উদোম, একটা মেয়ে দেখতে পায় একটি অঙ্গ ওর নেই। তাই থেকে একটা হীনম্মন্যতার বোধ মনে গেঁথে যায়। একটা বাচ্চা ছেলে যখন দেখে, ওর শরীরে একস্ট্রা কিছু আছে, তখনি মনে সুপিরিয়রিটি-র ধারণা তৈরি হয়। আর ছেলেরা যখন বড় হয়, ওদের ওই অর্গান-টা যখন এক্সপ্যান্ড করে, তখন তো ভাবে ওটা একটা খাপ-খোলা তলোয়ার। ওয়েপন।

জানো, ছোটবেলায় জয়েন্ট ফ্যামিলিতে ছিলাম। বাড়িতে একজন বহুদিনের পুরনো কর্মচারী গোছের ছিল, ওকে বাঙাল জ্যাঠা বলতাম। ও বাড়ির বাজার করত, ঘরদোর সাফ করাত, বাথরুমগুলো পরিষ্কার করাত, বাড়ির মেয়েদের স্কুলে পৌঁছে দিত…। আমাদের শাসন-টাসন ও করত। আমাদের বাড়িতে একটু বাগানমতো ছিল। ওখানে দু’টো পেয়ারা গাছ ছিল, সফেদা গাছ ছিল, ওখানে লুকোচুরি খেলা হত। পেচ্ছাপ পেলে—ছেলেরা দিব্বি দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে হিসি করে দিত। মেয়েরাও আছে বলে পরোয়া করত না। আর মেয়েদের আবার বাড়ি যেতে হত। একদিন আমার খুব পেয়ে গিয়েছিল।

কড়ে-আঙুলটা একবারের জন্য একটু তুলে দেখাল আইভি। ভাবলাম, বাড়ি যাব না। একটু ঝোপের পিছনে গিয়ে বসে পড়েছিলাম। বাঙাল জ্যাঠা বলে উঠল, হেই, পূর্বদিকে মুখ কইর‍্যা পচ্ছাপ করো ক্যান? পূর্বদিকে আমাগোর কুলদ্যাবতা আছেন না। পূর্ব দিকে সূর্য উঠে…আমি উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিলাম, আমায় বলছেন কেন? ছেলেরাও তো করে। এই দিকে মুখ করেই তো করে।

বাঙাল জেঠু বলেছিল—শুনো মা, ব্যাটাছেলেদের দোষ নেই। অরা পূর্বদিকে মুখ করলেও—এই দিক ওই দিক ঘুরাইতে পারে। তোমরা পারো না মা…।

এই ছোট্ট পাইপটুকুর জন্য তোমাদের যত রং, প্রাইড অ্যান্ড অ্যারোগেন্‌স। গাছে উঠতে দিত না। দাদারা বলত, তুই না মেয়ে, গাছে উঠবি কী? বাঙাল জ্যাঠাও বলত, মেয়ে-মাইনষের গাছে উঠতে লাই। তোমরা ওপরে উঠলে ছেলাগুলো খারাপ চোখে তাকাইবে।

তবু আমি গাছে উঠতাম। আর ছেলেগুলো, মাইরি, কী বলব, আমার জ্ঞাতি দাদা-টাদাগুলো ছাড়াও পাড়ার কয়েকটা ছেলেও খেলতে আসত, ওরা ফ্রকের তলায় তাকাত। কী দেখবি রে শালা? কী আছে। ওখানে তো অন্ধকার। আমি পরোয়া করতাম না। যা দেখবি দ্যাখ।

ছেলেরা সব সময় আপারহ্যান্ড নেয়। ডমিনেট করার চেষ্টা করে। শুধুই কি ওদের একস্ট্রা অর্গানের অহংকার? আমি তো তখন ফ্রয়েড-টয়েড জানতাম না, এখন যা সামান্য জানি, তাতে মনে মনে ভাবি, আ বে ফ্রয়েড সাহেব–মানি না তোমায়, ফোটো। আমিও ভেবেছি ওই চার- পাঁচ ইঞ্চি যন্তরটাই সব না কি? ওটা দেখিয়ে তোমরা রাজ্য জয় করবে, মেয়েদের চমকাবে, বশ করে রাখবে, কেন?

আমরা শালা জন্ম থেকেই বঞ্চিত, বঞ্চিত বাঞ্চোত। কিছু মনে করছ না তো? ভগবান আমায় ওটা দেয়নি। দেয়নি তো দেয়নি। তো? আমি তো কমতি যাব না। চ্যালেঞ্জ করছি তোমায়, ক্যারাটেতে এসো, পাত্তা পাবে না।

আইভি-কে বেশ উত্তেজিত দেখায়। অনিকেত ব্যাপারটা লঘু করার জন্য বলে—ভগবানকে শেষ দিও না। ভগবান তোমাদের যা দিয়েছে ছেলেদের তা দেয়নি। বুকের ওপর কী সুন্দর দু’টো মন্দির…

—ড্যাম। আমার ইচ্ছে করে কেটে ফেলতে। নিমাই হয়ে যেতে। ফালতু ও দু’টো। বদারেশন। কত যে কনুইয়ের গুঁতো খেয়েছি তার ঠিক নেই। ভিড় বাসে উঠলে ব্যাগটা দিয়ে গার্ড করে রাখতে হয়। তা ছাড়া ওটা তো ছোটবেলায় ছিল না। ফ্রয়েড যদি সত্যি হন—তবে তো বলতে হয়, ছোটবেলাতেই মেয়েদের মনে সেন্স অফ ইনফিরিয়রিটি ঢুকে গিয়েছে। ডিউ টু ল্যাক অফ দ্যাট কক। একেবারে সুপার ইগো ছাড়িয়ে ইদ্-এ ঢুকে বসে আছে।

কিন্তু জানো অনিকেতদা, আমি এইসব থিওরি মানি না। অস্বীকার করি। মাই নেম মে বি আইভি। আইভি একটা লতানো গাছ। কিন্তু আমি লতা না, পুতুপুতু না। মেয়েদের শরীর পেয়েছি বটে, কিন্তু মনে-মনে তোমাদের অনেকের চেয়ে বেশি পুরুষ। সেই রোমান পুরুষদের মতো, এক হাতে শিল্ড। সেই শিল্ড আমার বুক ঢাকার জন্য নয়, সোর্ড প্রোটেক্ট করার জন্য…

ফালতু বকছি, না? সেই বহুচেরা দেবী থেকে এত কিছু এল।

কাউকে বোলো না, অ্যাঁ? তোমাকেই বলছি, আমি না আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সেই অভিশপ্ত চেরা জায়গাটায় মাঝে-মাঝে গাজর-টাজর প্লেস করে দেখি কেমন লাগে দেখতে। নট ফর মাস্টারবেশন ম্যান, টাচউড, ওনলি টু ফিল…

ফিল করতে পারছ? কষ্টটা?

২২

দুলালের মা সব সময় মনমরা। সব সময় ওর মুখে কালো মেঘ। অপরাধীর মতো মুখ করে থাকে, সোজা চোখে তাকায় না, ওর পড়শিরা জেনে গিয়েছে দুলালের খারাপ রোগ হয়েছে। ওদের বাড়ির কাছাকাছি একটা ছোট পুকুর আছে, ওখানে দুলালের লুঙ্গি কাচতে গিয়ে বাধা পেয়েছে দুলালের মা। যে বলল—”কার লুঙ্গি দুলালের মা? কোনও দিন আর পুকুরে আসবে না মাসি’–সে দুলালের সঙ্গে ছোটবেলায় একসঙ্গে সাঁতার কেটেছে এই পুকুরে। তুমিও চ্যানে আসবে না মাসি। অসুখ বলে কতা, ছোঁয়াচে।’ তবে কোথায় চ্যান করব? জিগ্যেস করেছিল দুলালের মা। জবাব পেয়েছে, তোলা জলে, নিজের উঠোনে। এটা কি সম্ভব? খুব ভোরবেলা উঠে টিউবওয়েল-এ পাম্প করা জলে স্নান সেরে নেয় দুলালের মা। দুলালের লুঙ্গি-গেঞ্জি ওর নিজের উঠোনেই কাচতে হয়।

মাঝে কয়েকবার দুলালের বাড়ি গিয়েছে অনিকেত। ওর ‘খোল জীবনের’ দশ বছরের টুকটাক টকঝাল টুকরো কাহিনি শুনেছে, এবং আশ্চর্য হয়েছে। কিন্তু আসল কথাগুলো জানা হয়নি, কারণ কথা পাড়া হয়নি। বহুচেরা দেবীর মূর্তিটা ওকে একটা অনুসন্ধিৎসার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। যে ছ’ইঞ্চির টেরাকোটা মূর্তিটা দেখেছে, সেটা কি বহুচেরা দেবীর মূর্তি? দুলালের ওই ছবিটার সঙ্গে মিলিয়ে দেখার ইচ্ছে হল, এবং শুধু এজন্যই ওর বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছে হল।

এসব উটপটাং ইচ্ছের জন্য দায়ী তারাপদ সাঁতরা। তারাপদ সাঁতরার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল পাথরা-য়।

ইয়াসিন পাঠান নামে এক ভদ্রলোক এসেছিলেন আকাশবাণী-তে। ছোটখাটো একজন মানুষ। বললেন, আমাদের গ্রামে অনেক মন্দির আছে, কংসাবতীর ধারে। অর্ধেকের বেশি মন্দির কংসাবতীর গর্ভে চলে গিয়েছে। নদী ভাঙছে, মন্দিরগুলোকে খেয়ে নিচ্ছে। কিছু ব্যবস্থা না- নিলে বাকি মন্দিরগুলোও শেষ হয়ে যাবে। ডিএম সাহেবকে লেখালিখি করে কোনও লাভ হয়নি। যদি রেডিওতে এই বিপদগ্রস্ত মন্দিরগুলোর কথা বলা হয়, মানুষ জানতে পারবে। বড় খবর কাগজের রিপোর্টারদের সঙ্গেও কোনও চেনাজানা নেই, যদি আমরা এই ব্যাপারে কিছু সাহায্য করতে পারি তো খুব ভাল হয়। ইয়াসিন জানালেন—নিজেরা চাঁদা তুলে কিছু বালি বস্তা ফেলে ভাঙন আটকানোর চেষ্টা করছেন, কিন্তু এতে কী হবে?

একজন মুসলমান যুবকের হিন্দু মন্দিরগুলো সংরক্ষণের চেষ্টা একটু আপ্লুত করেছিল। কী করে যেতে হয় জেনে নিয়ে একদিন সকালে চলে গিয়েছিল একাই। খড়গপুর থেকে মেদিনীপুরের দিকে যাওয়ার রাস্তায় আমতলা থেকে মাত্র ৮/১০ কিলোমিটার দূরে গ্রামটা। প্রচুর ভগ্নাবশেষ ছিল, বোঝাই যায় প্রাচীন গ্রাম। গ্রামে ঢুকতেই বুড়ো পিরের মাজার। তারপরই ছোট-ছোট মন্দির। এরপর নদী। নদীর পাড়ে হেলে পড়েছে একটা বেশ বড় মন্দির। যে কোনও সময় কংসাবতীর গর্ভে পড়ে যাবে।

ইয়াসিন পাঠানের সঙ্গে দেখা হল। ইয়াসিনের বাড়িতেই ছিলেন তারাপদ সাঁতরা। মন্দির এবং লোক-সংস্কৃতির গবেষক। নামটা শোনাই ছিল, ইয়াসিন আনুষ্ঠানিক আলাপ করিয়ে দিল। তারাপদ সাঁতরা-র ঝোলা ব্যাগে টেপ। মানে, ফিতে। উনি আর পাঠান ফিতের দু’দিক ধরে মন্দিরগুলোর দৈর্ঘ্য-প্রস্থ মাপছিলেন। তারাপদবাবু মন্দিরের টেরাকোটা প্যানেলের দিকে তাকিয়ে বলছিলেন : এগুলো দশমহাবিদ্যা, এগুলো দশাবতার…। অনেক কিছু বলছিলেন, সব মনে নেই, মনে থাকার কথাও নয়। তবে একটা কথা এখন মনে পড়ে গেল, তখন অতটা গুরুত্ব দেয়নি অনিকেত। তারাপদবাবু বলছিলেন—এই দেখুন, একটা যৌনদৃশ্য, একাধিক মহিলা, আর একজন পুরুষ। সম্ভবত ছোটখাটো হারেম। আর এই ভদ্রলোকটিকে দেখুন, মাথায় ঝুঁটি, উরুসন্ধি দেখে যোনির মতোই লাগছে, কিন্তু বুকটা দেখুন সমান। উচ্চতায় রাজার চেয়ে বড় সম্ভবত খোজা। হারেমে রাজা বা জমিদারের সহকারী হিসেবে কাজ করছে। ও নিজে যৌনক্রীড়া করতে পারে না, কিন্তু ক্রীড়াতে অংশ নেয়।

অনিকেত বলছিল—রেফারি বা লাইন্সম্যান-এর মতো?

তারাপদবাবু বলেছিলেন—না, বল-বয়ের মতো। বল-টল কুড়িয়ে আনে যারা। তারাপদবাবু বলছিলেন—এটা ষোলোশো, সাড়ে ষোলোশোর মন্দির। এ সময়ে এদিককার অন্তঃপুরে খোজা থাকত। মহিষাদলের রাজবাড়ির ব্যাপার এটা নয়। তবে খোজা ছিল। মন্দিরের গায়ে তো সমাজচিত্র-ই ফুটে ওঠে।

তারাপদবাবুকে খুব ভাল লেগেছিল অনিকেতের। উনি বলছিলেন, কতরকমের ঘুঁটে হয় আমাদের দেশে, কতরকমের উনুন হয়, কতরকমের মন্দির হয়, এসব বলছিলেন। ওঁর এদিকে উৎসাহ কী করে হল, তা নিয়ে একটা গল্প-ও বলেছিলেন একটা রাসমন্দিরের চাতালে বসে। তারাপদবাবু কমিউনিস্ট পার্টি করতেন। কোনও একটা কারণে নেতৃত্বের সঙ্গে প্রবল মতভেদ হয়। বাগনানের কাছে একটা পুরনো টেরাকোটা মন্দিরের চাতালে চুপচাপ মনখারাপ করে বসেছিলেন। হঠাৎ একটা টেরাকোটা রিলিফ-এর দিকে নজর যায়। দেখেন এক স্ত্রীলোক একটা লাঠি দিয়ে কোনও পুরুষকে মারছে। দেখে মনে হল, এটা কীরকম ব্যাপার হল? কোনও পুরুষ তার বাড়ির মেয়েছেলেকে মারধর করছে—এটাই তো স্বাভাবিক, এরকমই তো হয়। এখানে মন্দিরের গায়ে উল্টো ছবি কেন? অন্যান্য টেরাকোটা দেখতে থাকেন। দেখলেন মাথায় জটা, মুখে দাড়ি এক পুরুষ এক নারীকে আলিঙ্গন করছেন। জটাওলা লোকটাকে ‘সাধু’-ই তো মনে হচ্ছে। সাধু তো ব্রহ্মচারীই হন। কেন সব উল্টোপাল্টা ছবি? এমন সময় পাজামা-পাঞ্জাবি, চশমা পরা এক সাহেব এলেন। এসে ছবি তুলতে লাগলেন, ডায়রিতে কিছু নোট করতে থাকলেন। তারাপদবাবু ভাবলেন নিশ্চয়ই কোনও গবেষক। ওই রিলিফগুলোকে দেখালেন। ভদ্রলোক খুব মন দিয়ে দেখলেন, ছবিও তুললেন। তারপর বললেন, হ্যাভ ইউ এভার সিন কালীঘাট’স পট?

তারাপদবাবু কালীঘাট জানতেন, কিন্তু কালীঘাটের পট জানতেন না। খেতমজুরদের সমস্যা জানতেন, আলুর বিভিন্ন রোগ জানতেন, ধানগাছের পোকা জানতেন, রূপনারায়ণের জেলেদেরও জানতেন। কিন্তু কালীঘাটের পট জানতেন না। ওই সাহেব বোঝালেন কালীঘাটের পটে নানারকম সামাজিক ব্যঙ্গ থাকে। বড় মানুষের বাড়ির কেচ্ছা, বাবুদের কাজ-কারবার, এসব থাকে। তা ছাড়া অ্যাট দি এজ অফ কলি, মানে কলিকালে, কী হবে এসবও পটুয়ারা আঁকতেন। কলিকালে সব উল্টো হয়ে যাবে, ব্যাটাছেলেরা ঘরে বসে রান্না করবে, মেয়েছেলেরা বাইরে গিয়ে টাকা রোজগার করবে, সবাই মদ খেয়ে মাতলামি করবে—এসব। বউরা বাড়ির কর্তাকে মারবে, এসবও থাকত। এই মন্দিরগুলো হল আর্লি এইটিথ সেঞ্চুরি-র। কালীঘাটের পট-ও ওই সময়ের। মন্দিরের গায়ে এই রিলিফগুলো হল কালীঘাটের পটের ইনফ্লুয়েন্স।

তারাপদবাবু বলছিলেন—আমি তো অবাক! কোথায় কালীঘাটের পট আর কোথায় হাওড়া জেলার গড়াইতলার মন্দির?

সাহেব বললেন—যাঁরা মন্দিরের রিলিফের কাজগুলো করেছিলেন, তাঁরা কালীঘাটে তীর্থ করতে যেতেন। ওখান থেকে পট কিনে আনতেন। আই বিলিভ, দিজ আর ইনফ্লুয়েন্সড বাই কালীঘাট। ওই সাহেবের নাম কী জানেন, ডেভিড ম্যাকাচ্চিয়ন? লোকটি কম বয়সেই মারা গেলেন, কিন্তু আমাকে নেশা ধরিয়ে দিয়ে গেলেন। ভাবলাম, আমার চারপাশে এত, অথচ আমিই জানি না!

তারাপদ সাঁতরার সঙ্গে ওইভাবেই আলাপ হয়েছিল পাথরাতে। এরপরও অল্পবিস্তর যোগাযোগ আছে। শেষ কথা হয়েছিল পিজি হাসপাতালে। কিডনির গন্ডগোলে ভুগছেন। ডাক্তার অভিজিৎ তরফদারকে দেখাতে এসেছিলেন। ওখানে বলেছিলেন—খিদিরপুরে একটা ইন্টারেস্টিং শিবমন্দির দেখলাম, বুঝলেন, মন্দিরের গায়ে পাথরে খোদাই একটা ইনক্রিপশন আছে—’এই নেক মন্দিরে কেহ জুতা পায়ে প্রবেশ করিবেন না, যে প্রবেশ করিবেন, তাহাকে তাল্লাক।’ ভাব দেখেই বুঝতে পারছেন, বেশি পুরনো নয়, শ’দেড়েক বছরের হবে। ভূকৈলেশের জমিদাররা এই মন্দির তৈরি করিয়েছিলেন। কিন্তু মন্দির-ফলকে কেন আরবি শব্দ? ‘নেক’ মানে পবিত্র, আর ‘তাল্লাক’ মানে শুধু ডিভোর্স-ই বোঝায় না, দিব্যি দেওয়া, শপথ বা প্রতিজ্ঞা-ও বোঝায়। কিন্তু কারা লিখেছে শিবমন্দিরে আরবি শব্দ? সিপাহি যুদ্ধের পর অযোধ্যার নবাবরা পালিয়ে এসে আশ্রয় নেন খিদিরপুর-মেটিয়াবুরুজ অঞ্চলে। মুসলমান বসতি শুরু হয়। কোনও মুসলমান কি এই শিবমন্দিরটা দেখভাল করতেন? কে জানে?

এশিয়াটিক সোসাইটি-র এগজিবিশন-টা দেখে পরদিনই তারাপদবাবুকে ফোন করেছিল অনিকেত। জিগ্যেস করেছিল—মুরগি-বাহন কোনও দেবীমূর্তি দেখেছেন? একটু স্তব্ধতার পর তারাপদবাবু উত্তর দিলেন, মোরগ-বাহনা দেবী? মনে পড়ছে না তো…মোরগ গুজরাটের কোথায় যেন দেখেছিলাম। আপনি কোথায় দেখলেন? তারাপদবাবুর গলাটা কেমন যেন ম্রিয়মাণ লাগছিল।

অনিকেত এশিয়াটিক সোসাইটি-র প্রদর্শনীটার কথা বলল। তারাপদবাবু বললেন—শুনেছি তো ওরকম কিছু হচ্ছে। যেতে পারলে ভাল হত। শরীর খারাপ। ছবি দেখাতে পারবেন? অনিকেত বলেছিল, চেষ্টা করব।

পরের রবিবার দুলালদের বাড়ি গেল অনিকেত। সঙ্গে আপেল আর কমলালেবু। শীতকাল। শীতকালে রোদ্দুরটা বেশ কমলা-হলুদ ফোকাস মারে। ফাঁকা মাঠঘাটে যেন মনে হয় আকাশ থেকে ঝুলছে জরির ঝালর। আবার দু-এক টুকরো জমিতে কাটা ধানের গোড়াগুলো নুলো হাত নেড়ে ‘হায় হায়’ করে। দুলালদের বাড়িতে ঢুকতেই একটা লোক বলল—আপেলই খাওয়ান আর নেসপাতিই খাওয়ান—যে-রোগ বাধিয়েছে, তার থেকে ওর নিস্তার নেই। আমাদের মহা ক্যাঁচাল। ওর মা তো আপনাদের বাড়িতে বহুত দিন ধরে কাজ কচ্চে, তা আপনারা ওদের নিয়ে যান না, আপনাদের পাকা বাড়ি, একটা ঘরে দরজা বন্ধ করে রেখে দেবেন। একেনে তো সে- উপায় নেই।

অনিকেত বলার চেষ্টা করে—দুলালের রোগটা তো সেরকম ছোঁয়াচে কিছু না। বলে, ছোঁয়াচে হলে কি আমি আসতাম?

—আপনারা বড়লোক। আপনাদের অনেক পোটেকসন থাকে। ভাল খাওয়াদাওয়া করতে পারেন। আমাদের খাওয়াদাওয়ায় ভিটামিন থাকে না, এজন্য সহজে আমাদের রোগে এটাক মারে।

এ তো দেখি অতি সচেতনতা! অনিকেত বলে, অহেতুক ভয় পাচ্ছেন কেন? ওর নিশ্বাস-প্রশ্বাস বা ওর স্নানের জল থেকে এ রোগ ছড়ায় না।

লোকটা বলল, ওসব বুঝি না, একে এই গাঁয়ে আর বেশিদিন রাখা যাবে না। এদের পরিবারটাই ক্যাচাল। এর বউটা অন্য ব্যাটাছেলের সঙ্গে লটরপটর করত। দুলাল নিজে হিজড়ে হয়ে গেল, এখন এড্‌স বাধিয়েছে। এলাকার বাচ্চারা তো বড় হচ্ছে। যদি জিগ্যেস করে কী হয়েছে লোকটার, তখন তো খারাপ কথাটা উচ্চারণ করতে হবে।

—কোন খারাপ কথাটা?

–কেন? এড্‌স! এটা খারাপ কথা না? তারপর যদি জিগ্যেস করে কী করে ছড়ায়? দেখুন না, রেডিও-তে, টিভিতে অবলীলায় বলে দিচ্ছে যৌনরস। পোস্টারের মধ্যে লিখে দিচ্ছে চুম্বন, আলিঙ্গন—এসব। এই রোগটার জন্য চারদিক অপসংস্কৃতিতে ভরে গেল। সব চক্রান্ত। এই রোগটা নাকি আমেরিকা থেকে বেরিয়েছে!

প্রশ্নটা শুনে অনিকেতের মনে হল লোকটা হয়তো পঞ্চায়েত নেতা। আর ‘চক্রান্ত’ শব্দটা রাজনীতির লোকদের খুব প্রিয় শব্দ। জিগ্যেস করল, রাজনীতি করেন?

লোকটা বলল—উচিত কথা বললেই আপনারা রাজনীতির গন্ধ পান। আমি করি না, আমার ভাইপো এই পঞ্চায়েতের নির্বাচিত প্রতিনিধি। সাতদিন সময় দিচ্ছি, এই জঘন্য লোকটাকে সরিয়ে নেবেন, নইলে….

গলাটা শক্ত করল অনিকেত।

বলল, নইলে?

‘নইলে’ শব্দটা নিজের কাছেই অচেনা লাগল। হুমকির জবাবে হুংকার? ও তো এরকম অকস্মাৎ গলা ওঠাতে পারে না। আজকাল পারছে কী করে? সাহস বেড়েছে। বছর দুই আগে একটা ক্যাসেট বেরিয়েছে ‘তোমাকে চাই’, সুমন চট্টোপাধ্যায়ের ওই ক্যাসেটের একটা গানে একটা কথা আছে—বরং কণ্ঠ ছাড়ো জোরে’। কথাটার সঙ্গে একটা গিটার নির্ঘোষ। অনিকেত আবার বলল–বলুন, নইলে কী করবেন?

লোকটা আর কোনও কথা না-বলে চলে গেল। কে জানে লোকসংগ্রহ করতে গেল কি না—দুলালদের ঘরের সামনেই ঘটনাগুলো ঘটছিল, কিন্তু দুলালের মা ঘর থেকে বের হয়নি। সব সময় নিজেকে আড়াল করেই রাখে। দুলালের ছেলেটা গাঁদা ফুলের মালা গাঁথছে।

মালা কী হবে রে?—অনিকেত জিগ্যেস করে। ছেলেটা হাসে। বলে, পুজোয় দেবে।

—কী পুজো?

—মুরগি সরস্বতী। —ওটা আবার কী?

—বাবা করে।

—আজ ইস্কুল যাসনি?

—রবিবার না?

দুলালের ছেলের নাম মন্টু। ভাল-নামটা জানে না। কখনওই জিগ্যেস করেনি। আজ জিগ্যেস করল। ছেলেটা জবাব দিল না। মাথা নিচু করে রাখল। তোর ইস্কুলের নাম কী?

ছেলেটা জবাব দেয় না।

দুলালের মা বলল—পোসেনজিত।

—বাঃ, খুব ভাল নাম তো। বলছিস না কেন?

ও চুপ থাকে।

দুলালের মা বলল—ওর নাম কইতে ওর লজ্জা করে।

—ওর এই নাম কে রেখেছিল?

—ওর মুখপুড়ি মা। ওকে এই নামে ইস্কুলে দিয়েছে।

অনিকেত বলল, প্রসেনজিৎ তো খুব ভাল নাম। প্রসেনজিৎ মানে কী জানিস?

মন্টু ঘাড় নাড়ায়। মানে জানে।

—বল, কী মানে?

—ঝাড়পিট।

—হাসল অনিকেত। মন্টুও অল্প।

—ঝাড়পিট মানে তো ভাল রে। তুই নাম বলতে লজ্জা পাস কেন?

মাথা নিচু করে মন্টু বলল, ঝাড়পিট পারি না।

চৌকিতে বসে দুলাল মুড়ি খাচ্ছিল। লুঙ্গি পরা। মুখের হনু বেরিয়ে পড়েছে। কোমর থেকে ওপরের অংশ যেন একটু বড়। ইউনাক সম্পর্কে পড়াশোনা করার সময় ‘ইউনাকয়েড গ্রোথ’ নামে একটা অংশ দেখেছিল, সেখানে লেখা ছিল ক্যাস্ট্রেশনের পর অ্যান্ড্রোজেন হরমোনের অভাবে এক ধরনের মেটাবলিক ডিসঅর্ডার হয়, তাতে শরীরের ওপরের দিকটা একটু বেশি বাড়ে। কিন্তু এটা আর্লি-ক্যাস্ট্রেশন-এ হয়। দুলাল তো এসব করেছে বেশি বয়সে। ও যখন বাড়ি ছেড়ে চলে যায়, তখন ওর বয়স ২৭-২৮। হয়তো ওটা ইউনাকয়েড গ্রোথ নয়। না- হজম-হওয়া খাদ্য অনেক সময় উদ্‌গারে জানিয়ে দেয়, না-হজম-হওয়ার বার্তা। না-হজম- হওয়া বিদ্যেও তাই। ফুকো, দেরিদা, ডকিন্স, চমস্কি এসব নাম অনেকের উদ্‌গারে চমকায় এটাও তাই। অনিকেতও এখন কিনসে, ইবিং, সিসজেন্ডার, ভ্যাজিনোপ্লাস্টি, পেগিং এসব শব্দ মাঝে-মাঝে কপচায়। অনেক সময় ঠিকঠাক না বুঝেই।

—কেমন আছ দুলাল?

দুলাল অল্প হাসে।

হাসে না তো, ক্যালায়। দাঁত ক্যালায়।

অনিকেতও ওর ওপর বিরক্ত। একটা জীবন্ত স্যাম্পল পেয়েছে ঠিকই, যাকে নিয়ে উপন্যাস লেখা যায়, যদিও অনিকেত তো উপন্যাস লেখে না, লেখার ইচ্ছে যে নেই তা নয়, কিন্তু এসব ওর কম্ম নয়, সেটা ও ভালই জানে। দুলালের কাছে আসাটা স্রেফ দুলালের মায়ের জন্য। যে- মহিলাটি বহু দিন ধরে সার্ভিস দিয়েছে, তার জন্য। বিপদের দিনে যে পাশে দাঁড়ায়—সেই না আত্মীয়—’সিরাজদৌল্লা’ নাটকের ডায়লগ। কর্তব্যের আহ্বানেই আসা। তবে ‘বাই ওয়ান গেট ওয়ান’-এর মতো কর্তব্যকর্মের সঙ্গে অভিজ্ঞতাটাও পাওয়া যাচ্ছে। নতুন কিছু জানার নেশাটা খুব বড় নেশা। একটা জিনিস বুঝেছে অনিকেত, নলেজ বড় আনন্দদায়ক। বড় সুখ দেয়। যে কোনও ইন্দ্রিয় সুখের স্থায়ীত্ব, মানে ডিউরেশন কম। খাবার সময় জিভের টেস্ট বাডগুলো কতক্ষণের সেনসেশন পায়? সঙ্গমই বা কতক্ষণের? কিন্তু নলেজ বারবার সুখ দেয়। নলেজ নিয়ে জাবর কাটা যায় রিসাইকেল করা যায়।

দুলালের কাছে এর আগে ওদের গুরুমা নিয়ে কিছুটা আলোচনা হয়েছিল। ওদের ডিসিপ্লিন, খাওয়া-দাওয়া, আমোদ—এসব নিয়েও কিছুটা। কিন্তু ওর যৌনজীবন নিয়ে কোনও কথা হয়নি। শুধু একবার জিগ্যেস করেছিল, রোগটা বাধালে কী করে? ও মাথা নিচু করে বসেছিল।

আর, ছুরি খেয়েছিলে কেন’ জিগ্যেস করলে বলেছিল, পুলিশকে কয়েচি, পুলিশ কাউকে কইতে মানা করেচে। দুলালের ঘরের তাকে মুরগি-বাহনা মূর্তি, হাতে ছোরা। বেশ কিছু ছাই পড়ে আছে। ধূপধুনো দেওয়া হয়। ছবিটা কাচ-বাঁধানো। আকারেও বড় নয়। ছবিতে মালা। হ্যাঁ, এই মূর্তিই দেখেছিল এশিয়াটিক সোসাইটি-তে।

—ওটা বহুচেরা দেবী, তাই তো?

দুলাল মাথা নাড়ে।

—কীভাবে পুজো করো?

–যেভাবে পারি। একট মালা, ধুপ…পাঁচালি পড়ি।

—পাঁচালি, পাঁচালি আছে না কি?

—আছে তো। গুরুমা পড়ত, আমরা শুনতাম।

—শুধু বহুচেরা, অন্য পুজো নেই?

—আছে তো, নক্ষী, সরসোতি, দুগ্গা—এনারা তো আচেই। কিন্তু ইনিই আমাদের মেন ঠাকুর।

কী বারে পুজো হত? যেমন বেস্পতিবারে লক্ষ্মী পুজো হয়, তেমন কোনও—

—না দাদা, আমাদের ঠাকুর খুব ভাল ঠাকুর। কোনও নিয়ম-কানুন নেই। যে যেমন পারে। আবার খুব রাগীও। কত ব্যাটাছেলের খসিয়ে দিয়েছেন..লজ্জা-পাওয়া-মুদ্রায় বাঁ হাতটা ঘুরিয়ে মুখ চাপা দিল দুলাল। অনিকেত বুঝে নিল দেবী রেগে গিয়ে কী খসিয়ে দিয়েছেন। অনিকেত জিগ্যেস করল—এই দেবীর উৎপত্তি কীভাবে হল জানো? যেমন মনসার উৎপত্তি শিবের ইয়ে থেকে, দুর্গার সৃষ্টি সমস্ত দেবতার তেজ থেকে ….

দুলাল বলল—স্বর্গের দেবী নয় দাদাগো, ইনি মানুষ। ইনি ছিলেন এক রাজকন্যা।

ভাদুর সঙ্গে মিল পেল যেন। ভাদুরানিও ছিলেন রাজকন্যা।

—কোথাকার রাজকন্যা? অনিকেত জিগ্যেস করে।

দুলাল বলে তা হলে পাঁচালিটা শোনাই। আজ বিকেলের পাঁচালিটা পড়া হয়ে যায় থালে। দেশলাই জ্বেলে ধূপ জ্বালিয়ে ছবিটার সামনে রাখে, তারপর দুলাল চোখ বুজে বলতে থাকে—

চরণরাজার কন্যা আহা মরি মরি
চম্পকবরণ বর্ণ দেখিতে সুন্দরী
মাথা ভরা চুল যেন মেঘের মতন
নিতম্বিনী কন্যা সে যে বিল্বফল স্তন
বাপের বাড়ি থিকে শ্বশুরঘর যায়
এমন সময় ডাকাত দল হানা দিল হায়
ডাকাতের দলপতি বাপিয়া তার নাম
সুন্দরী দেখিয়া তার জাগিয়া যায় কাম
সুন্দরীর সঙ্গে ছিল সাত সহচরী
তাহারাও ভয়ে-ভয়ে ডাকে হরি-হরি।
ডাকাত হাঁকিয়া বলে খুলহ কাপড়
আমরা চাপিব সব তোমার ওপর
ইহা শুনি সুন্দরী তরবারি দিয়া
নিজের দুই স্তন দিলেন কাটিয়া
ইহা দেখি আর যত সহচরী নারী
নিজেদের স্তন দিল কাটি তাড়াতাড়ি।
হাতে ধরা অসি আর রক্তমাখা দেহ
হাঁকিয়া বলিল, আইস, কী করিতে চাহ
তখন পলাইল সব যতেক ডাকাত
সূর্যদেবতা ডুবে ক্রমে আসে রাত
আট দেহ শুয়ে আছে ষোলো খানি স্তন
মাটিতে লুটায়ে আছে ফুলের মতন
ষোলোটি কদম্ব গাছ পরদিন ওঠে
আটখানি পাহাড় সেইখানে ফুটে
বাপিয়া ডাকাইত সহ যতেক পাষণ্ড
পরদিন তাহাদের খসে যায় অণ্ড।
বাপিয়া স্বপ্ন দেখে চতুর্ভুজা নারী
মোরগ বাহনা তিনি, হাতে তরবারি।
বলেন যেখানে আছে আটখানি শিলা
সেখানে দেখিবি তুই আমারই লীলা
বড় পাহাড়ের শিরে মন্দির করিবি
সেখানে স্ত্রীবাস পরে আমারে পূজিবি
আমার এরূপ মূর্তি গড়াইয়া নিবি
জানিবি আমার নাম দেবী বহুচেরা
চরণ রাজার কন্যা রাজ্য সেহরা।

দুলাল চোখ বুজে পাঁচালি পড়ছিল, এবার চোখ খুলল।

অনিকেত জিগ্যেস করল, সেহরা জায়গাটা কোথায়?

দুলাল ওর ডান হাতটা ভোটের ‘হাত চিহ্ন’র মতো সামনে এগিয়ে ধরল। মুখে কথা বলল না। মানে—এখন কথা বোলো না। দুলাল জোরে শ্বাস নিয়ে আবার চোখ বুজল।

অনিকেত দেখল দুলালের মা-ও মেঝেতে বসে আছে, যে-দেবীর নাম জীবনে শোনেনি, তাঁর উদ্দেশে হাত জোড় করা। দুলালের মায়ের ঠোঁট নড়ছে। পুত্র-মঙ্গল প্রার্থনা করেই চলেছে ওই অচেনা দেবীর কাছে।

দুলাল হাতজোড় করে আবার পাঁচালি পড়তে থাকে—

বহুচেরা মাতাজি’র বহুত মহিমা
এনাতে বিরাজ আছে কালী মা দুর্গা মা
অটন্তী নগরে ছিল এক সওদাগর
তেজপাল নাম তার দেখিতে সুন্দর
বঢ়িয়া মকান তার, মনে নাই সুখ
লিকমের দোষে তার মনে বড় দুখ
তিনজন বউ তার দেখিতে চামর
তথাপি বাপ নাহি হয় সওদাগর।
লিকম সাপুটি থাকে না পারে রমণ
বহুচেরা মা-র কাছে করেন গমন
তেজপাল করজোড়ে জানাল আকুতি
দেবী কন তুমি বাছা হয়ে আছ কোতি।
বাহিরে পুরুষ-চিহ্ন অন্তরে জেনানা
যাহা বলি তাহা করো অন্যথা কোরো না।
পুরুষ-চিহ্ন মোরে উৎসর্গ করিও
পুরুষের বাস ছাড়ি স্ত্রীবাস পরিও।
মন্দিরে রহিও তুমি সেবক হইয়া
নিত্য পূজিও মোরে ভকতি করিয়া
নাই মন্ত্র নাই তন্ত্র বাজাইবা ঢোল
‘জয় জয় মাতাজি কি’ এই হল বোল।
পৃথিবীর যত শিশু জানিও তোমার
দিল মাঝে ভালবাসা রাখিও অপার
মাছ মাংস দারু এসব কভু না খাইবে
প্রতি পূর্ণিমাতে সবে ক্ষীর ভোগ দিবে।
একথা শুনিয়া সে ছিব্‌ড়ি হইল
স্ত্রীলোকের বাস পরি মন্দিরে রহিল
একদিন মাতা আসি দেখন স্বপনে
আশা আমি পূর্ণ দেব যাহা আছে মনে।
সওদাগর দেখে এক আসমানি আলো
কী আশ্চর্য সওদাগরের দেহে ঢুকে গেল।
দুই মাস পরে তার অরুচি হইল
তিনমাস পরে মুখে খাট্টা উঠিল
চারমাস পরে বুকে লিলকি দেখা দিল
ছয়মাস পরে পেট ফুলিয়া উঠিল।
শরীরে সুগন্ধ এক ভাসে সাত মাসে
আট মাসে গায়ে যেন চন্দ্র আলো আসে
শিশু নড়াচড়া করে পেটের ভিতর
নয় মাসে সাধ ভক্ষণ করে সওদাগর
সাধ ভক্ষণের দিনে দেবীর সকাশে
সওদাগরের সেই তিন বউ আসে।
কেহ তারে যত্ন করি দেয় আলুভাজা
কেহ দেয় পিঠাপুলি কেহ দেয় গজা
সওদাগর কহে দেখ মাতাজি’র ছল
পুরুষ নারী কিছু নয়, মানুষই আসল।
দশম মাসেতে তার ব্যাটাছেলে হল
ভক্তিপূর্ণ মনে সবে জয় মাতা বলো।

অনিকেত শুনল সবচেয়ে বেশি জোরে দুলালের মা বলে উঠল—জয় মা, মা গো, দুলালকে ভাল করো। অনিকেত মন দিয়ে শুনছিল পাঁচালি। সওদাগরের শেষ অবদি ব্যাটাছেলেই তো হল। কেন? কন্যাসন্তান হলে চলত না? যারা এই পাঁচালিটা বানিয়েছে, ওরাও তো পুরুষতন্ত্রেরই অংশ।

এই পাঁচালিটা কে বানিয়েছে? তোমার গুরুমা? অনিকেত জিগ্যেস করল।

দুলাল আবার ডান হাতটা আগের মতো সামনে স্থাপন করল। মানে, এখন থামো। পাঁচালি শেষ হয়নি –

ভক্তি ভরে যেবা নিত্য বহুচেরা পুজে
অন্য কোন দেবদেবী কভু নাহি খোঁজে।
দেবীর কৃপায় মন সদা মস্তি থাকে
জানিও সেই লোক মার কোলে থাকে।।

এরপর সব পাঁচালিতে যা থাকে, সেই সব। মনোবাঞ্ছা পূরণের কথা। তবে, সব পাঁচালিতেই অর্থ প্রাপ্তির স্বপ্নপূরণ থাকে, এখানে ছিল না, পাঁচালি শেষ হলে ছবিটার দিকে তাকিয়ে দুলাল জোড় হাতে নমস্কার করল। দুলালের মা-ও।

অনিকেত বলল—এই পাঁচালি এই প্রথম শুনলাম।

দুলাল বলল—সবাই জানে না।

আবার জানতে চাইল অনিকেত—পাঁচালিটা কার কাছে শিখেছে ও।

দুলাল বলল, গুরুমায়ের কাছ থেকে। গুরুমা শিখেছিল তার গুরুমা-র কাছে।

অনিকেত জিগ্যেস করল, ‘তোমাদের ওখানে কি ঘটা করে এই দেবীর পুজো হয় কোনও এক বিশেষ দিনে—যেমন কোনও-কোনও এলাকায় কার্তিক পুজো হয়? ‘বেশ্যা’ কথাটা উচ্চারণ করতে ওর কাছে এখনও একটু আটকাল।

দুলাল বলল—মুর্তি গড়ে পুজো হয়নে। মুর্তি শুধু মন্দিরে। আমাদের কাছে শুধু ফটোক।

—মন্দিরটা কোথায়।

—বহুত দূর। গুজরাট। —গুজরাটের কোথায়।

—বেচরাজি না কী যেন বেশ নাম। সুরাট দিয়ে যেতে হয়।

—তুমি গেছ?

—আমার যাওয়া হয়নিকো। গতবার যাব ভাবলাম, আর আমার শরীল খারাপ হয়ে গেল। অনেকে গ্যাচে। যারা গ্যাচে, তাদের কাছে গপপো শুনিচি। খুব ধুম হয়। বহুত দূর দূর থেকে সব লোক আসে। মাদ্রাজি, পাঞ্জাবি, হিন্দু, মোসলমান, পাকিস্তান থেকেও আসে, বোরখা পরা কোতিরাও আসে।

—শুধু হিজড়েরাই যায়?

—সবরকম যায়। মেয়েরাও যায়। পাঁচালিতে পড়লুম না বন্ধ্যা নারী পুত্ৰ পায়?

মনে-মনে একটা দৃশ্য দেখতে পেল অনিকেত। বোরখা থেকে দু’টো হাত বেরিয়ে তালি দিচ্ছে আর কোমর দোলাচ্ছে। মুখ দেখা যাচ্ছে না। হিজড়েদের মধ্যে অবশ্য ততটা হিন্দু- মুসলমান ভেদ নেই, এমনটাই জেনেছে, কিন্তু পাকিস্তান থেকে আসা হিজড়েরা বোরখা পরেই এসেছে নিজেদের ‘নারী’ প্রমাণ করার জন্য। কারণ পুরুষদের বোরখা পরতে হয় না, নারীকেই পরতে হয় যে।

—ওই মন্দিরে পরব কখন হয়? অনিকেত জিগ্যেস করে।

—পরব লাগে দশেরা-র দিনে, চত্তির মাসে, শ্রাবণ মাসের কবে কবে যেন হয়।

বাসুবাটিতেও চৈত্রমাসেই মেলাটা হয়। ওখানেও তো ব্যাটাছেলের গর্ভ হওয়ার কাহিনিটা রয়েছে। ওখানে বহুচেরা-র কোনও চিহ্ন দেখেনি ঠিকই, কিন্তু কলকাতার মাটির তলায় পাওয়া গেল পোড়ামাটির বহুচেরা? কীভাবে? কেন? তাকের সামনে গিয়ে বহুচেরা-র ছবিটাকে দেখতে থাকে অনিকেত। মনে হল, ওই দেবী স্ফীতবক্ষা নন। তরোয়াল দিয়ে বক্ষ কেটে ফেলেছিলেন কিনা। এজন্যই দেবীর হাতে তরোয়ালটাও রয়েছে। কলকাতার মাটির তলায় পাওয়া বহুচেরার মূর্তিটিও কি স্তনহীন ছিল? ঠিক খেয়াল করতে পারছে না এখন। মূর্তিটা সিঁদুর-চর্চিত ছিল। মূর্তিটা যে বহুচেরা-র, এতে সন্দেহ নেই। মুরগি-বাহনা দেবী আর কেউ নেই। মুরগি নয়, মোরগ। মাথায় ঝুঁটি আছে। মুরগির মাথায় ঝুঁটি থাকে না।

কলকাতার কোন অঞ্চলে প্রাচীন কালেও ছিল বৃহন্নলাদের ডেরা? কবে থেকে? সুরাটেও ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কুঠি। সুরাটের কাছাকাছি কোথাও আছে ওই দেবীর মন্দির। ওই মন্দির ঘিরে নিশ্চয়ই গড়ে উঠেছে বৃহন্নলাদের ডেরা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তারা কি ওখান থেকে কিছু বৃহন্নলাকে কলকাতা নিয়ে এসেছিল একসময়? ওদের দিয়ে নাচাত? না কি নারী-অভাবী গোরাগুলো ওদের নিয়েই জ্বালা মেটাত, কারণ বারাঙ্গনা পল্লি তখনও গড়ে ওঠেনি খিদিরপুর বা সোনাগাছিতে। না কি কলকাতার খোজা হয়ে-যাওয়া দাসগুলো একসঙ্গে এই দেবীর পুজো করত। বিনয় ঘোষের একটা বইতে ছিল, সতেরো শতকের মাঝামাঝি থেকে আটের শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এখানেও দাস কেনাবেচা হত। হিকির গেজেটে ‘পাত্র চাই পাত্রী চাই’-এর মতন বিজ্ঞাপন থাকত স্বাস্থ্যবান স্লেভ বিক্রয়ের, বয়স ২৪। ১৭৯২ সালের ‘ক্যালকাটা ক্রনিক্ল’ পত্রিকায় বেরনো একটা সংবাদের কথা লিখেছিলেন—কসাইতলায় এক আস্তাবলে বন্দি কয়েকজন ক্রীতদাসের কথা। ওই ক্রীতদাসদের কাউকে কি খোজা করে দেওয়া হত? কে জানে? আঠেরোর শতক ছিল পাল্কির যুগ। মানুষ বইত মানুষ-ভরা পাল্কি। পাল্কি-বাহকদের খোজা হতে হয় না তো? ষাঁড় নয়, বলদে গাড়ি টানে, লাঙল দেয়। ষাঁড়কে খোজা বানালেই তো বলদ হয়। পাল্কি-বাহকরা কি খোজা হত? আর খোজা হয়ে-যাওয়া মানুষরা তাদের দেবী-ভজনা করত কলকাতার কোথাও?

ধুর! আজগুবি ভাবনা। অ-গবেষক হলে যেমন হয়। পাল্কি-বেহারারা কেন নিজের ইচ্ছেয় খোজা হতে যাবে? ওদের তো সংসার ছিল। পাল্কি-বেয়ারা ক্রীতদাস ছিল না কখনও। বরং একবার পাল্কি-বেয়ারারা স্ট্রাইক করেছিল।

যদি এরকম একটা বানিয়ে লেখা যেত, কলকাতার ক্রীতদাস পাল্কি-বেহারা, ওদের জোর করে খোজা করা হয়েছে, ওরা সুন্দরী বউদের নিয়ে চলেছে কোথাও। এবার খোজা হলে কী হবে, ট্রান্সজেন্ডারদের মতো সেল্ফ-ক্যাসট্রেটেড তো নয়, মনের ভিতরে কামনা। কামনার আগুন। পাল্কি-বেহারারা ওদের নামাল, কিছুই করতে পারল না, শুধু দেখল। দেখতে-দেখতে অর্গাজম হল, সেরিব্রাল অর্গ্যাজম। এসব ইংরেজিতে লিখতে হয়। যেমন অমিতাভ লেখেন- লোককথা জড়িয়ে। ইতিহাসকে বানাতে পারেন তিনি। ‘ক্যালকাটা ক্রোমোজোম’-টা পড়ল সেদিন।

যাকগে যাক। তারাপদবাবুকে বিষয়টা বলবে আরেকবার। এসব ওর বিষয়ও নয়। বহুচেরা নিয়ে অনেকক্ষণ নাড়াচাড়া হয়েছে। এবার থাক। অনিকেত জিগ্যেস করতে যাচ্ছিল, রোগটা বাধালে কী করে দুলাল? কিন্তু ঝট করে এ প্রশ্ন উচিত নয়। ‘আর্ট অফ ইন্টারভিউ’-তে এরকমই বলেছিলেন প্রীতীশ নন্দী।

অনিকেত জিগ্যেস করল—পেট খারাপটা কমেছে দুলাল?

দুলাল ঘাড় কাত করে।

–কী খেয়ে এমন হল?

দুলালের মা বলল, কিচ্ছু খায়নিকো। ওকে পাদলা করে ঝোল-ভাত দি, নাউ দি ঠান্ডা বলে। গ্যাদাল পাতা দি। ওসবই তো খাচ্ছিল…।

—তোমার বউটা তোমার সঙ্গে দেখা করতে এল না, ও কি তোমার খবর জানে?

ওপর-ঠোঁটের ওপর নীচের ঠোঁটটা উঠিয়ে দিয়ে বাঁ হাতের আঙুলগুলো একটু ঘোরাল দুলাল। এই দেহ-ভঙ্গিমার অর্থ, কে জানে?

—ওই পোড়ামুখী খুব খারাপ মেয়েমানুষ। চরিত্তির নেই। সেই যে ছেড়ে গেল, নিজের পেটেরটাকেও একটিবারের জন্য দেখতে এল না।

অনিকেত দেখল সব কথাই ওর মা বলে দিচ্ছে। অনিকেত বলল—ও মাসি, তুমি একটু বাইরে যাও। দুলালের সঙ্গে প্রাইভেট কথা আছে।

ও চলে গেলে অনিকেত জিগ্যেস করল—দুলাল, আনাজের ব্যবসাটা ছেড়ে দিয়েছিলে কেন তুমি?

—পোষাচ্ছিল না।

—কেন?

–বড় খাটালি।

—ওই কাজ ছেড়ে সাইকেলে চড়ে গ্রামে-গ্রামে ঘুরে আলতা সিঁদুর ফিতে সেফটিপিন চুলের কাঁটা বেচতে, ওটা বুঝি খাটনির কাজ নয়?

—ওটাই ভাল লাগত যে।

—কেন ভাল লাগত? অনেক মেয়েদের সঙ্গে আলাপ জমত বলে? অনেক মেয়ে-বউয়ের সঙ্গে ভাব হত বলে?

—মাথাটা একটু নিচু করে দুলাল বলল—সিটা হত, কিন্তু ওদের তো মা-বোনের মতো লাগত।

–নকশা মেরো না দুলাল, মা-বোনের মতো? ওদের দেখে তোমার মনে কোনও কামনা- বাসনা জাগত না?

—মা কালীর দিব্বি, ওরম হত না। ওরা সব সইয়ের মতো ছিল। মাইরি বলছি, আমার আসলে আলতা সিঁদুর কাঁটা ফিতে ঘাঁটতে খুব ভাল লাগত। লাল টিপ, হলদে টিপ, নেলপালিশ, সায়ার দড়ি…

—সায়ার দড়ি খালি? বডিজ রাখতে না। বডিজ? দু’বার মাথা নাড়াল দুলাল।

কল্পনায় দেখতে পায় অনিকেত—কাঁচা রাস্তার ধারে কোনও গ্রামে গিয়ে হাঁস-মুরগি, কাঁঠাল গাছ, পেয়ারা গাছ, ছাগলছানা, নেড়িকুকুর সমন্বিত কোনও উঠোনের ভিতরে সাইকেলের ঘন্টি বাজিয়েছে দুলাল—টিরিং। বউ-ঝি’রা ঘিরে ধরেছে সাইকেল। দুলাল বলছে, অদিদি এই পুঁতির হারটা ন্যাও না, তোমায় খুব মানাবে। অ’বউদি, ছোট জামার কতা বলেছিলে, এই এনেচি গো।

—আমার সাইজ জানো?

—তোমার তো বউদি ভরন্ত শরীল। তো, ভাতার-সোহাগী বউদিমণির জন্য আটতিরিশ তো লাগবেই। আচে…।

অনিকেত বলে—তো দুলাল, বউদি-টউদির সঙ্গে তো খুব রঙ্গরসে দিন কাটাতে। নিজের বউটার কী হত?

দুলাল অনিকেতের দিকে ল্যাবার মতো চেয়ে থাকে।

অনিকেত একটু বে-পরোয়া হয়। বাঁ-হাতের তর্জনীর ওপরে মধ্যমাটা বেঁকিয়ে দু’আঙুলের ফাঁকে একটা গহ্বর তৈরি করে ডান হাতের তর্জনী সেখানে লাগিয়ে বলে, বউয়ের সঙ্গে হত?

দুলাল যেন কোনও অন্যায় করেছে, সেইভাবে বলল, বউ জোর করত। যেটা বলল না, তা হল—’আমি কী করব?’

অনিকেত বলে ফেলল, দাঁড়াত?

দুলাল একটু অবাক চোখে তাকাল অনিকেতের দিকে। এ ধরনের কথা ঠিক যেন আশা করতে পারেনি।

দু’বার মাথা নাড়ল দুলাল।

মানে, দাঁড়াত।

দুলাল বলল, কিন্তু ভাল লাগত না। বউয়ের পেড়াপেড়িতে….

–বেরুত?—অনিকেত জিগ্যেস করল।

–কী, ঝিন্নি?

‘ঝিন্নি’ মানে বুঝতে পারল না অনিকেত। জিগ্যেস করল, ঝিন্নি বলতে কী বলতে চাইছ?

—ধাত। এই শব্দটা বলতে গিয়ে গলা নামাল। যেন অপরাধ। ওর যেন বীর্য নিঃসরণ কোনও অন্যায়।

হ্যাঁ, ওটা বেরত! মাথা নাড়াল দুলাল।

কিসের বইটার কথা মনে পড়ল। আলফ্রেড কিসে। সেক্সুয়াল বিহেভিয়ার ইন হিউম্যান মেল। ১৯৪৮ সালে প্রকাশিত এই মূল বইটা পড়া হয়নি যদিও, কিন্তু বারবার কিসের তত্ত্বের কথা এসেছে যৌনতা-সম্পর্কিত বিভিন্ন লেখায়। উনি পতঙ্গ নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে গল্ ওয়াপ নামে এক ধরনের বোলতা জাতীয় পতঙ্গের ক্ষেত্রে দেখেছিলেন, ওই পতঙ্গগুলোকে নির্দিষ্ট যৌনলিঙ্গে শনাক্ত করা যায় না। ওই জাতের একটি নির্দিষ্ট পতঙ্গকে পুরুষ-পতঙ্গ বলা যায় না, কিংবা স্ত্রী-পতঙ্গও বলা যায় না। একটি পুরুষ-পতঙ্গ দরকার মতো স্ত্রী-পতঙ্গে পরিবর্তিত হতে পারে, আবার স্ত্রী-পতঙ্গও পুরুষে পরিণত হতে পারে। স্ত্রী ও পুরুষ-পতঙ্গের মিলনে যে নিষিক্ত ডিম হয়, তা থেকে স্ত্রী বা পুরুষ-পতঙ্গ জন্মায়, আবার অনিষিক্ত ডিম থেকে লিঙ্গচিহ্ন-হীন পতঙ্গ জন্মায়। মৌমাছিদের ক্ষেত্রেও দেখা গিয়েছে অনিষিক্ত ডিম থেকে কর্মী- মৌমাছি তৈরি হচ্ছে। পিঁপড়েদেরও। ভারত মহাসাগরে এক জাতের মাছ আছে, মালয়ীরা বলে ‘মুপি’, ওরা ছোট-ছোট ঝাঁক বেঁধে চলে। একটা ঝাঁকে ৭০-৮০টা করে মাছ থাকে। একটাই পুরুষ-মাছ, বাকি সব স্ত্রী-মাছ। যদি কোনও বড় মাছ ওই ঝাঁক থেকে পুরুষ-মাছটাকে খেয়ে নেয়, কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই অন্য একটা স্ত্রী-মাছ পুরুষ-মাছে পরিবর্তিত হয়ে যায়। মাছের বাপারটা অবশ্য কিসে দেখেননি, উনি পতঙ্গ নিয়েই কাজ করছিলেন। কিন্তু ওই গল্ ওয়াস্প পোকাগুলোর কাণ্ডকারখানা দেখে কিসের মাথার পোকাও নড়ে উঠল। ওঁর মাথায় প্রশ্ন এল—মানুষের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মধ্যে কি কোনও বর্ডার লাইন আছে? কারা পুরুষ? কারা নারী? কীভাবে নির্ধারিত হবে? লিঙ্গচিহ্নে? ওভারি এবং টেটিকল-এর উপস্থিতি কিংবা অনুপস্থিতিতে, না কি ক্রোমোজোমে? কিসে ১৯৫৬ সালে মারা যান। জেনেটিক্স তখনও এতটা পরিণতি পায়নি। কিন্তু ক্রোমোজম আবিষ্কৃত হয়ে গিয়েছিল। কিসে দেখলেন, পুরুষ লিঙ্গ-চিহ্নধারী অনেকেই নিজেকে নারী ভাবতে ভালবাসে। সংখ্যায় কম হলেও অনেক নারীও পুরুষ ভাবে নিজেকে। কিসে দীর্ঘদিন ধরে নারী-পুরুষের যৌনতার ঝোঁক পর্যবেক্ষণ করলেন। প্রচুর স্যাম্পল নিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত এলেন যে, প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই পুরুষ- সত্তা এবং স্ত্রী-সত্তা আছে। সব পুরুষের কম বেশি সমলিঙ্গের প্রতি যৌন আকর্ষণ আছে। তিনি একটা ‘স্কেল’ করেছিলেন। স্কেলের ‘শূন্য’ মানে সম্পূর্ণ বিষমকামী, ‘ছয়’ মানে সম্পূর্ণ সমকামী। আবার এই অবস্থান সারাজীবনের জন্য নির্দিষ্ট নয়। আজ যে ‘তিন’-এ আছে, কয়েক বছর পর সে ‘পাঁচ’-এ পৌঁছে যেতে পারে। ‘তিন’ মানে উভকামী। হিজড়েদের ভাষায় ‘ডবল ডেকার’। যে ‘দুই’ চিহ্নে, সে প্রধানত বিষমকামী বা হেট্রোসেক্সুয়াল, কিন্তু মাঝে-মধ্যে সমকামিতার দিকে ঝোঁকে। যাকে ‘পাঁচ’ স্কেলে ফেলা যায়, সে সমকামীই, তবে একটু-একটু বিষমকামী। অনেক সমকামীই পরিবারের চাপে বিয়ে করে ঘরে বউ আনে, সন্তানও হয়। ছোটবেলায় দেখা ননী নামে যে লোকটি মহিলাদের সঙ্গে থাকতে ভালবাসত, নাড়ু বানাত, মেয়েলি রসিকতা করত, সে বিবাহিত ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওকে আত্মহত্যা করতে হয়েছিল।

দুলাল কিসের স্কেলে কোথায়? পাঁচ-এ? যখন বিয়ে করেছিল, পুরুষলিঙ্গ-ধারী সবাই যেমন করে, তখন কি পাঁচ-এ ছিল? পরে সেই সংসার অসহ্য বোধ হল? এরপর পালাল দুলাল?

এত কিছু ভেবে ফেলল কয়েক মুহূর্তে। মন তো সবচেয়ে দ্রুতগামী। বকের সঙ্গে ক্যুইজে যুধিষ্ঠির একদম ঠিক জবাব দিয়েছিল। এত সব ভাবতে-ভাবতেই অনিকেত ভাবল—ধুর, ফ্রয়েড বলো, কিসে বলো, সাইমন লিভে বলো, কোনও তত্ত্বেই এসব পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা যায় না। এ এক বিপন্ন বিস্ময়।

দুলাল একটা বিড়ি ধরানোর জন্য উশখুশ করছিল। বলল, একটা খাচ্ছি দাদা।

অনিকেত বলল—ছাড়া যায় না? শরীরটা খারাপ কিনা…

দুলাল বলল, বহুদিনের অব্যেস কিনা…।

অনিকেত বলল—আচ্ছা, একটা কথা বলো তো দুলাল, তোমার বউ তো দেখতে-শুনতে বেশ ভালই ছিল, আদর-টাদর করতে ইচ্ছে করত না?

দুলাল মাথা চুলকাতে লাগল।

অনিকেত প্রশ্নটা করেই ভাবল, কিসে তো কবে মারা গিয়েছেন, অথচ এখনও কত রিসার্চ স্কলার ওঁর আন্ডারে কাজ করে চলেছে, কিসে জানলেন না।

দুলালের দিকে তাকিয়ে থাকে অনিকেত একটা উত্তরের আশায়।

দুলাল বলল—প্রথম ক’দিন মন্দ লাগতনি। সাইকিল নিয়ে নতুন গাঁয়ে যাবার মতন। তারপর হল কী, ওর গতর দেখে, মানে ম্যানা দু’টো দেখে, আমার মনে কীরম ধারা হিংসে হত। ভাবতাম ওরম যদি আমার থাকত। ও আমায় খুব আকার-ইঙ্গিতে বর-বউ খেলার জন্য বলত। খেলতাম, কিন্তু ভাল লাগতনি খুব। কখনও বলতাম গায়ে ব্যথা, কখনও বলতাম মাথা ব্যথা। অকম্যে বলত, মেনিমুখো, নেংটি ইঁদুর এসব বলত। আমি বলতাম আমার দ্বারা হবে না গো, মাপ করো। এরপর ওর গড়ভো হল। গড়ভো হলে ভাইবোন হয়ে থাকতে হয়, তাই ছিলাম। এরপর একদিন ওকে অন্য ব্যাটাছেলের সঙ্গে দেখলাম ঘরে। ও ছিল আমার মহাজন। ওটা দেখে খুব দুঃখু হল। দুঃখু হওয়ার কথা নয়। তবু হল। নিজের বে করা বউ কিনা। জানি, স্বামীর কম্ম-কত্তব্য করিনি, তা বলে অন্য ব্যাটাছেলে ঘরে ঢোকাবে?

জিগেস করলাম, কবে থেকে?

ও বলল, বলবনি। ব্যস, আমিও সুযোগ পেয়ে গেলাম, ওর সঙ্গে আর ভড়কানি করতে হত না।

তুমি তবে উপোস থাকতে দুলাল? কারও সঙ্গে ছিল না কিছু?

মাথা নিচু করে দুলাল। বলে, সব জেনে কী করবেন?

অনিকেত বলে—তুমি চেপে গিয়েই বা কী করবে? আমায় বলো, তোমায় বুঝতে পারব।

—ছিল। একটা চালের আড়তদার। পরে একটা নাপিত। নাপিতের নিজের বউ ছিল না। আমাকে চুল কেটে দিত। তারপর মুখে-গলায় হাত বুলিয়ে দিত। ওই হাতের কথা আমি বুঝে নিয়েছিলাম। ওর সঙ্গে খুব ভাব হয়েছিল। ওর বাড়ি নিয়ে যেত। কিন্তু চালওলাটার বউ একদিন আমায় খুব প্যাদাল।

—ওই চালওলার সঙ্গে তুমি কী করছিলে, যখন ওর বউ দেখল? লজ্জার ভাব করে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল—বলব না যাও। চোখে এমন ভাব করল—মেয়েরা ‘যাও, অসভ্য’ বলার সময় তেমন ভ্রু-ভঙ্গি করে।

—তো, হিজড়েদের দলে ভিড়লে কী করে?

দুলাল অনেকটা শ্বাস নিল, বোধহয় অনেক কথা বলবে ভেবে অনেকটা বাতাস ভরে ছিল বুকে।

দুলাল বলতে লাগল—সাইকিলে যাচ্ছিলাম, এমন সময় একদল হিজড়ের সঙ্গে দেখা। ওরা ছল্লায় যাচ্ছিল। আমায় দেখে তালি দিল। থামতে বলল। আমিও থামলাম। বলল, দেখাও দিকি বাপু কী আছে? আমার কাছে কমা-মালও থাকত।

—কমা-মাল কী জিনিস?

—কমা-মাল হল বোরোনীল, লাকমি, পিয়ার, এইসব। বোরোলিন নামটা একটু পেল্টে বোরোনীল, ল্যাকমে পেল্টে লাকমি, এমনধারা। একইরকম দেকতে। বড়বাজারে পাওয়া যায়, চিংড়িহাটাতেও একজন মহাজন এসব রাখে। ওসব লি আসতাম, দাম কম হত। ওইজন্য কমা- মাল। ওরা কমা-মাল দেকতে চাইল। আমি দ্যাকালাম। ওরা দু-একটা মাল কিনল। আমায় একজন বলল—কী, দেকে মনে হচ্ছে নুনে নুন। কোতি?

—নুনে নুন মানে?

—তখন আমুও মানে জানতাম না। মানে হল…ইয়ে, ব্যাটাছেলে দেখেই যদি কোনও ব্যাটাছেলের…

—বুঝেছি। তুমি কী বললে?

—আমি কিছু বলিনি। ওদের একজন বলল চিপটি চলে? আপনি যেমন আঙুল দিয়ে বাহার করেছিলেন, সেরকম আঙুল দেখাল। বলল, করো? অন্য একজন বলল, বউ আছে? অন্য একজন বলল, ধুরপিট্টি হয়?

আমি দাদা একটু ভ্যাবাচাকা মতন খেয়ে গেলাম। একজন আমার মাথায় হাত বুলোতে- বুলোতে বলল, গাত্তুসোনাটা ঢ্যামা খেয়ে গেছে গো… ও জিগ্যেস করল, তোমার নাম কী গো? নাম বললাম। ও বলল, আমার নাম চাত্তারা। পরে বুঝেছিলাম ওর আসলে চাঁদতারা নাম চাঁদতারা হিজড়েনি। ওরা বলল, কসবায় ওদের একটা আটপুরে আছে, ওখানে যেতে।

—আটপুরে মানে?

—মানে খোল, মানে থাকার জায়গা, কিন্তু টেম্পোরালি। মানে বড় গুরুমা-র এক টোস্কা চেলি ওখানে থাকে, ওর কাছে ওরা ক’দিনের জন্য এসেছে। ওদের আসল খোল পানাগড়। ওরা ছল্লায় যাচ্ছিল, পথে দোকান-টোকান থেকে মাংতি নিচ্ছিল, আমার সঙ্গে সুখ-দুঃখের কথা হতে লাগল। আমি আমার ঘরের কথা ওদের বলে দিলাম। চাত্তারা বলল, তোর চিপটিধারী বউ যদি কোনও আকঘাট মদ্দর সঙ্গে ধুরপিট্টি চায়, তাতে তুই কেন কাঁটা হবি? ওকে ওর মতো চলতে দে, তুই তোর মতো চল। আমাদের সঙ্গে চলে আয়। একই তো কথা, এখনও ঘুরচিস, পরেও ঘুরবি। ঘরে বসে থাকলে চলবে? সবার আগে পেট। পেটের তলা সেকেন্- থার্ড। আমরা কিন্তু মস্তিতে আছি। ছল্লা করি, ছমকাই, ছেমো-ছেনালি করি, বিলকুল ছক্কা লাইফ। এসো একদিন।

—তারপর?

গেলাম ওখানে। কসবায়। ঠিকানা দিয়েছিল। ওরা খুব বন্ধুর মতো ব্যাভার করল।

এরম ব্যাভার তো ঘরে পাই না, পাড়ায় পাই না। সবাই তো দুচ্ছাই করে। একদিন চলে গেলাম। চৈতন্যঠাকুরও তো চলে গিয়েছিলেন মা’কে ছেড়ে, বিষ্ণুপ্রিয়া বউকে ছেড়ে।

হাত জোড় করল দুলাল।

তাকে রাখা বহুচেরা মায়ের দিকেই কিন্তু ওর চোখ।

২৩

এই দুনিয়া ঘোরে বন বন বন বন ছন্দে ছন্দে কত রং বদলায়—রং বদলায়। দুরন্ত ঘূর্ণি। এই লেগেছে পাক…। কথা ও সুর সলিল চৌধুরী, কণ্ঠ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।

৭৮ আরপিএম-এর রেকর্ড আর চালানো যাবে না। পিন নেই। যাঁরা পিন তৈরি করেন, তাঁরা তো শুধু রেডিও-র জন্য পিন তৈরি করবেন না। লং প্লেয়িং ডিস্ক ৪৫ কিংবা ৩৩ আরপিএম- এ চলে। এই পিন এখনও পাওয়া যায়। কতদিন পাওয়া যাবে কে জানে? বহু গান শুধু ৭৮-এ বন্দি, ওসব গান শোনানো যাবে না আর, হারিয়ে যাবে কমলা ঝরিয়া, আব্বাসউদ্দিন, গিরিবালা দাসী, কানন দেবী, বিষ্ণুপদ দাস, কে মল্লিকদের কত গান…। এখন এই গানটা বাজছে। এই দুনিয়া ঘোরে বন বন…

কত রং পাল্টানো। কত কী হচ্ছে। শোনা যাচ্ছে শিগগিরি একটা চাকতি আসবে, পাতলা ধাতুর, ওর নাম নাকি কমপ্যাক্ট ডিস্ক। এক-একটা চাকতিতে এক-দেড় ঘণ্টার রেকর্ডিং ঢুকে যাবে। কম্পিউটার এসে গিয়েছে। মোবাইল ফোনও এসে গিয়েছে। তার লাগছে না, রিসিভার নেই, পকেটে ঢুকে যাচ্ছে আস্ত টেলিফোন, রিলে করার জন্য আর টেলিফোন লাইন বুক করার দরকার নেই।

এই তো সেদিন গ্যালিলিও উপগ্রহটাকে আকাশে ছাড়া হল। বৃহস্পতির উপগ্রহ আবিষ্কার করল গ্যালিলিও। আবার দেখল ওখানে বরফ রয়েছে। ১৯টা দেশ সই করল মানুষের ক্লোনিং বন্ধ করার জন্য। ভেড়ার ক্লোনিং হয়ে গিয়েছে, ক্লোন করা ভেড়া দিব্যি সুস্থ হয়ে বেঁচে আছে। মানুষের এখন যা প্রযুক্তিগত পারদর্শিতা, তাতে হয়তো মানুষকেও ক্লোন করে ফেলতে পারে। কী উপায় হবে তা হলে? মাধুরী দীক্ষিত যদি নিজেকে ক্লোন করেন, এবং ক্লোন করা নতুন মাধুরী যদি অভিনয় না-করে কেবল ক্লোনিং বিজনেস শুরু করে দেন, নিজের কোষ থেকে নতুন-নতুন মানুষ, মানে নতুন-নতুন মাধুরী—কী হবে ভাবুন তো, মাধুরী-বন্যা বয়ে যাবে। এমনিতে তো এখনই স্পার্ম ব্যাংক হয়ে গিয়েছে। কোনও মহিলা যদি মা হতে চান, এ জন্য আর যৌন প্রক্রিয়ার দরকার নেই। প্রক্রিয়া না-বলে ক্রীড়া বলাই ভাল। প্রক্রিয়া তো একটা দরকার। ডিম্বাণুটাকে নিষিক্ত করতে হবে তো। ওটা নারী শরীরের গভীরের ফ্যালোপিয়ান টিউব-এ না-হয়ে টেস্ট টিউবেও হতে পারে। ফার্টিলাইজেশন-এর দোকান, মানে ক্লিনিকে গেলে দোকানদার, মানে ফার্টিলাইজেশন এক্সপার্ট জিগ্যেস করবেন, কী স্পার্ম চাই? বক্সার নেবেন? না কি ওয়েট লিটার? একদম ম্যাসকিউলিন। স্ট্যাটিস্টিসিয়ান আছে, ইকনমিস্ট, ম্যাথমেটিসিয়ান—অঙ্কে এক্কেবারে হদ্দমুদ্দ। আর্টিস্ট পছন্দ করেন? পেন্টার? নাকি পোয়েট? হ্যাঁ, অ্যাক্টরও আছেন। বচ্চন?—না না, কারও নাম বলা যাবে না। যা চান…।

পছন্দ করে স্পার্মটি ডিম্বাণুর সঙ্গে ফার্টিলাইজ্‌ড করিয়ে নিজ-গর্ভে ধারণ করতে পারেন। ঠিক ওই একই জিনিস হবে। ‘দুই মাস পরে কন্যার অরুচি হইল। তিন মাস পরে মুখে টক জল উঠিল। চতুর্থ মাসেতে দেহ কাঞ্চন বরণ। পঞ্চম মাসেতে চেঞ্জ গর্ভের গড়ন…।’ এবার ন’মাসে সাধ খাও, বাপ কে জানো না, ওই ভদ্রলোককে তেল মেরে সন্তুষ্ট করতে হয়নি, জামাইষষ্ঠীতে ‘এই চলো না গো, চলো না গো’ বলে বাপের বাড়ি নিয়ে যেতে হয়নি, পুরো ফ্রিডম। যদি মনে করো নিজের পেটে নেবে না, ফোলা পেটে অফিস যেতে ভাল্লাগে না, ঠিক আছে, সারোগেট মায়ের পেটে ভরে দাও সেই জাইগোট, সেখানেই বড় হবে। যে-সন্তানটা হবে, সেখানে গ্যারান্টেড তেইশটা ক্রোমোজম তোমার। এই দুনিয়া ঘোরে বন বন বন বন ছন্দে ছন্দে কত রং পাল্টায়…।

একজন বিখ্যাত গাইনি, যাঁর ফার্টিলিটি ক্লিনিক আছে, টেস্ট টিউব বেবি-তে সফল, তাঁকে অনিকেত জিগ্যেস করেছিল—কোনও লেসবিয়ান মহিলা মা হতে চেয়েছে?

উনি বলেছিলেন—বিদেশে যখন ছিলেন, একজন লেসবিয়ান এসে স্পার্ম চেয়েছিলেন। বলেছিলেন, ছেলেদের সঙ্গে ওঁর পক্ষে সম্ভব নয়, তাই এখানে এসেছেন। ওঁদের স্পার্ম ব্যাঙ্কে হোমোসেক্সুয়ালদের স্পার্মও ছিল। জিগ্যেস করেছিলেন, ওরকম চলবে কি না…। সেই লেসবিয়ান মহিলা চিৎকার করে বলে উঠেছিলেন, ওনো-ও-ও। হোমোসেক্সুয়াল পুরুষের সন্তান হোমোসেক্সুয়াল হয়, এমন কোনও কথা অবশ্য নেই, এমনকী যমজ দুই ভাইয়ের একজন হোমো হলে অন্যজন না-ও হতে পারে, না-হওয়ার চান্স-ই বেশি, তবু সেই মহিলা চিৎকার করে উঠেছিলেন—নো…। অথচ দেখুন, উনি নিজে লেবি। এদিকে বিজেপি ক্ষমতায় এসেছে। বিজেপি আর তার সঙ্গীসাথীরা ২৫১টা আসন পেয়েছে। কংগ্রেস ১৬৬। বিজেপি ক্ষমতায় এসেই পোখরানে পারমাণবিক বোমা ফাটিয়ে বোমপরীক্ষা করল, আরএসএস-এর সভ্যরা মুম্বই জুড়ে হোর্ডিং আর পোস্টারে চলচ্চিত্র নায়িকাদের বুকে আলকাতরা লেপে দিলেন। কিছুদিন পর চাঘাই-তে পাকিস্তান আরও শক্তিশালী পারমাণবিক বোমা ফাটাল। এবং ধর্মীয় দলের সভ্যরা লাহোর এবং করাচিতে জিন্স পরা মহিলাদের জিন্স-এর ওপর দিয়ে ব্লেড ও খুর চালিয়ে দিল। পোস্টার পড়ল, মহিলার শরীরকে বোরখায় ঢেকে রাখতে হবে। আর বার্লিন-এর আলেকজান্দ্রা প্লাস-এর যে স্পটে হিটলার ৩৬০ জন সমকামীকে একসঙ্গে জড়ো করে গুলি করে মেরেছিলেন, ওখানে সমকামীরা বিরাট সমাবেশ করলেন, থাইল্যান্ড থেকে ‘এলকাজার’ নামে একদল ট্রান্সজেন্ডার নৃত্যশিল্পী আশ্চর্য নৃত্য প্রদর্শন করলেন, এবং সারা পৃথিবীতে সমকামকে বৈধ করার দাবি তুললেন।

এরকম সময়ে স্টেশন ডিরেক্টর অনিকেতকে ডেকে বললেন, ‘বিবিসি’ আপনাকে চেয়েছে।

—মানে?

—’বিবিসি’ সেক্স এডুকেশন নিয়ে একটা ওয়ার্কশপ করবে ব্যাংককে। ইন্ডিয়া থেকেও কয়েকজন যাবে। রেডিও থেকে দু’জন। যেহেতু আপনি এই কাজটা করেছেন, আপনাকে পাঠাব। আপনি রাজি আছেন?

এই পৃথিবী ঘোরে বন বন বন—আর কোথাকার জল কোথায় ছিটকে যায়।

বিদেশ যাচ্ছে অনিকেত, জীবনে প্রথম, সরকারি পয়সায়।

ব্যাংকক এয়ারপোর্ট-এর লাউঞ্জ দেখে তো চোখ ছানাবড়া। বিরাট লাউঞ্জ। কত যে দোকানপাট। কাচের এধার দিয়ে দেখা যায় মাসাজ চলছে। কমবয়সি মেয়েরা মাসাজ করে দিচ্ছে। ম্যাট্রেসের ওপর বিশাল বপু আফ্রিকান কিংবা ছোট আকৃতির চিনেম্যান চিত বা উপুড় প্রচুর এস্কালেটর, চলমান রাস্তা, গাছপালা, কোনটা আসল কোনটা প্লাস্টিকের বোঝা মুশকিল। বাইরে এলে দেখা গেল হাতে ‘বিবিসি’ প্ল্যাকার্ড ধরা যুবতী। ওরাই গাড়ি করে পৌঁছে দিল হোটেলে। ফোয়ারা, সুইমিং পুল, অ্যাকোয়ারিয়াম শোভিত হোটেল।

বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা, সুদান, কেনিয়া, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, তাইওয়ান থেকে প্রতিনিধিরা এসেছে। তিনদিন ধরে ওয়ার্কশপ চলবে। প্রতিনিধিদের সংখ্যা চল্লিশ।

অনিকেতের একবার মনে হল—ওর এইসব কিছুর মূলে তো গ্রামবাংলা থেকে আসা কয়েকটা অসহায় চিঠি, যারা স্বপ্নদোষের ভয়ে গার্ডার আটকে রাখত জননযন্ত্রে, যারা ধর্ষিত হওয়ার জন্য দোষ দিয়েছিল ওদের উন্মুখ স্তনকে, বন্ধ করতে চেয়েছিল উদ্‌গম, যারা অপরাধবোধে জর্জর ছিল বীর্যস্খলনে, ওদের জন্যই তো একটা অনুষ্ঠান রচনা, আর সেই পরিণামেই আজ এখানে আসা, এত ফলের রসভর্তি গ্লাস, এত বাদাম, এত রং, এত ধুম। বেড়াচাঁপা, মহিষাদল, বলুহাটি, কদম্বগাছির ছেলে-মেয়েগুলো তো জানতেও পারল না। ওই অনুষ্ঠানটা করে ওদের কতটা কী হয়েছে কে জানে? অনিকেতের তো এই সব হচ্ছে।

প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটারের নাম সুসানা রস। সঙ্গে আছেন হ্যাজেল স্লেভিন, পারভেজ আলম, ক্লাইভ হলওয়ে, হরিণী সিং। এঁরা রিসোর্স পার্সন। প্রথমে একটা করে ফর্ম ধরিয়ে দেওয়া হল। এটা যেন একটা অ্যাডমিশন টেস্টের মতো। জানতে চাওয়া হচ্ছে, এঁদের মধ্যে কাদের-কাদের যৌনক্ষমতা থাকা উচিত?

ওই তালিকায়—গে, লেসবিয়ান, যাজক, মেনোপজ হয়ে যাওয়া নারী, সত্তরোর্ধ্ব পুরুষ, টিনএজার, মানসিক প্রতিবন্ধী মানুষ, শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষ…ইত্যাদি। সবার শেষে পিডোফিল।

অন্যরা সব ঠিকই আছে। যাজকও। কিন্তু পিডোফিল, মানে শিশুদের ওপর যাদের যৌন আসক্তি, ওদের নিয়েই তো সমস্যা। সবার ক্ষেত্রে ‘ইয়েস’ করে পিডোফিলদের পাশে ‘নো’ লিখে দিল অনিকেত।

হোয়াই নো? অনিকেতকে জিগ্যেস করা হল। অনিকেতকেও একটু মাথা চুলকোতে হল। বলল, ম্যাডাম, কাগজে প্রায়ই পড়ি সাত বছর, পাঁচ বছর এমনকী তিন বছরের গার্ল চাইল্ডকে ধর্ষণ করা হয়েছে, বয় চাইল্ডরাও বাদ যায় না। আমার ছোটবেলার কথা মনে পড়ে। আমার মতো অনেকেরই এরকম অভিজ্ঞতা আছে। বাসে যখন দাঁড়িয়ে যেতাম, আমার পিছনে কোন বয়স্ক লোক দাঁড়িয়ে যেত, প্রেশার দিত। আনক্যানি ফিলিং হত। বড় হয়ে এদেরও হোমোসেক্সুয়াল ভাবতাম। এখন বুঝি ওরা পিডোফিল।

ম্যাডাম মুচকি-মুচকি হাসছেন। বলছেন—দেন ইউ থিংক দ্যাট পিডোফাইল্স আর টু বি ক্যাট্রেটেড?

আবার মাথা চুলকোচ্ছে। ও ওদের খোজা করে দেওয়ার কথা বলতে চায়নি তো…।

ম্যাডাম এবার একজন শ্রীলঙ্কানকে নিয়ে পড়লেন—যিনি ‘প্রিস্ট’-—যিনি ‘প্রিস্ট’-দের পাশে ‘নো’ লিখেছিলেন।

মজাই লাগছে।

বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত এসব চলল। তারপর ছুটি। ঘোরো ইচ্ছেমতো। পুরো ব্যাংকক ট্রিপ-টা মনে-মনে সাম-আপ করছিল অনিকেত—হোটেলে শুয়ে। যেন কাউকে বলছিল। একদম প্রথম দিনে কী এলাহি ব্রেকফাস্ট জানো, ফ্যানা ভাতও ছিল, দলাপাকানো, পিন্ডির মতো দেখতে ভাতের মণ্ড। পোকাও ছিল, হ্যাঁ গো, পোকা। ফ্রাই করা। কী পোকা জানি না। শুক্লাকে বলল। এরপর হিউম্যান সেক্সুয়ালিটি, মিথ অ্যান্ড মিসকনসেপশন। গোটা তিরিশেক প্রশ্ন। ফল্স বা ট্র লিখে জমা দিতে হবে। এর ওপর পরে আলোচনা হবে।

আ গার্ল মাস্ট হ্যাভ এ হাইমেন টু বি আ ভার্জিন। কী, তুমি কী মনে করো? সতীচ্ছদ ফাটা থাকা মানেই সে কুমারী নয়?

সে কী, অনিকেত তো মঞ্জুকেই জিগ্যেস করছে।

মঞ্জু বলছে, ফল্স। সাইকেল চালালে কিংবা খেলাধুলো করলেও ছিঁড়ে যেতে পারে।

—মেনোপজ ইজ দ্য এন্ড অফ উয়োমেন্‌স সেক্সুয়াল লাইফ?

মঞ্জু ঠোঁট উল্টে দিল। জানি না। এর আগেও তো এন্ড হতে পারে…।

অনিকেত মঞ্জুর থুতনি নাড়িয়ে দিল। বলল, ন্যাকা? এন্ড? দেখবি?

হোটেলের বিছানাটা বেশ বড়। পর্দা ঝুলছে লম্বা। মঞ্জুকে শুইয়ে দিল অনিকেত। মেন আর মোর সেক্সুয়াল দ্যান উয়োমেন…ফল্স না টু?

—জানি না, যা…।

—সাইজ অফ পেনিস হ্যাজ এ লিট্ল রোল টু প্লে ইন দি সেক্সুয়াল অ্যাক্ট? কী? ফলস না ট্রু?

—একটা থাপ্পড় মারব, বদমাশ কোথাকার, এটা কপট রাগ, বুঝতেই পারছে অনিকেত। শোন না, ভ্যাজাইনাল আর ক্লিটোরাল—দু’রকম অর্গ্যাজ্‌জ্ম হয়, সেটা জানিস? মঞ্জু বলল— অ্যাঁ?

ও জানে না। ও কি অর্গ্যাজ্‌জ্ম জানে? জেনেছে কোনওদিন?

শূন্য-বিছানাকে জিগ্যেস করে অনিকেত। শোনো, এ এক অদ্ভুত ওয়ার্কশপ। আইভি-কে বলল অনিকেত। এরকমও ওয়ার্কশপ যে হয়….

ম্যাডাম বলল—ওয়েল, লেট আস বি ফ্রি অ্যান্ড ফ্র্যাংক। সমস্ত ইন্‌হিবিশন কাটাতে হবে। বলল—উয়োমেন্স রিপ্রোডাক্‌টিভ অর্গ্যান-কে কী বলে? –সে অ্যাজ মেনি ওয়ার্ডস অ্যাজ ইউ ক্যান। সবাইকে বলতে হবে। প্রথমে তামিলনাড়ু থেকে আসা ছেলেটিকে জিগ্যেস করল— ছেলেটি ‘পুসি’, ‘কান্ট’–এসব বলল, কিন্তু ওদের তামিল ভাষায় কী বলে বলতে পারল না, মানে উচ্চারণ করতে পারল না। ও বলল, আমি বরং লিখে দিচ্ছি। ও লিখে দিল, ম্যাডাম পড়ল, পেনুরুপ্‌পু। তোমাকে যদি জিগ্যেস করত, বলতে পারতে তুমি আইভি, বাংলাটা?

—হ্যাঁ-হ্যাঁ। কী আছে? শুনবে?

—ইট্‌স ওকে, ওকে।

—এরপর কী হল? মেল রিপ্রোডাকটিভ অর্গ্যান জানতে চাইল না?

—চাইল তো? বলে দিলাম। একদম চন্দ্রবিন্দু দিয়ে। মাস্টারবেশন-কে কী কী বলে জানতে চাইলেন, সেক্স ওয়ার্কার-দের কী কী বলে, মেনসট্রুয়েশন-কে কী বলে, বিভিন্ন ভাষায়—এসব আবার অনেকে নোট করল। বাধ্য ছাত্র।

—তুমিও?

—হ্যাঁ। আমিও।

—গুড। তারপর কী হল!

তারপর অ্যাপ্রোচ, এইম, টার্গেট এইসব নিয়ে লেকচার। একই মেসেজ বিভিন্নভাবে বলতে হয়….এইসব….

—রাখো তো মেসেজ, মাসাজ করালে না?

–বলব, বলব। একটা ইন্টারেস্টিং গল্প শুনবে আইভি, গল্প নয়, সত্যি কথা। কেনিয়া থেকে যে-মেয়েটা এসেছিল ওর নাম আরিদা মুসু। মুসলিম। আরিদা বোধহয় ফারিদা থেকে এসেছে। ওদের ডায়লেক্টে ‘ফ’ ধ্বনি ‘অ’ হয়ে যায় আমাদের দেশের কোথাও কোথাও যেমন রাম আম হয়। বলছিল ওদের দেশে মেয়েদেরও ক্যাস্ট্রেশন হয়। ‘ক্যাসট্রেশন’ তো নয়, সারকামসিশন মেয়েদেরও কেটে দেয়।

—ওদের আবার কী কাটবে? ভগবানই তো কেটেকুটে সাইজ করে দিয়েছে!

—না, মেয়েটা বলছিল—ওদের দেশে কিছু ট্রাইবালদের মধ্যে আর মুসলিমদের মধ্যে এই নিয়মটা আছে। ক্লিটোরিস-টা খুঁচিয়ে উপড়ে ফেলে দেয়। সুদানের মেয়েটাও একই কথা বলল, জানো। পাঁচ-ছ’বছরের মেয়েদের এই খতনাটা হয়। আগে জানতাম শুধু মুসলিম আর ইহুদি ছেলেদের খতনা হয়। ওখানে শুনলাম মেয়েদেরও করে। শুধু ক্লিট নয়, লেবিয়া মাইনোরা-ও ছেঁটে দেয়। ওদের অনুভূতি কমিয়ে দেওয়া হয়। মেয়েদের সতীত্ব গ্যারান্টেড করার জন্য এরকম করা হয়।

—এতে কী করে গ্যারেন্টেড থাকবে?

—এই জায়গাগুলো, যেখানে নার্ভ নেটওয়ার্কটা বেশ ঘন, এগুলো খুবলে নিলে মেয়েদের যৌন-অনুভূতি কমে যাবে, সেনসেশন কমে যাবে। আরিদা বলছিল ওর নিজেরও ছোটবেলায় সারকামসিশন হয়েছিল। ওর তখন পাঁচ বছর বয়স। কিছু লোকজনকে নেমন্তন্ন করা হয়েছিল। ওরা কেউ চকোলেট এনেছিল উপহার হিসেবে, কেউ পুঁতির মালা। একজন মহিলা এটা করেছিল। ভীষণ ব্যথা পেয়েছিল, ভীষণ কষ্ট, ভীষণ জোরে চিৎকার করেছিল, চিৎকারটা করতে দেয়, মুখে নেকড়া গুঁজে দেয় না। চিৎকার মানে হল কাজটা ঠিকঠাক হচ্ছে। কিন্তু তখন খুব জোরে ঢোল বাজে, এক ধরনের ফাঁপা কাঠের বাঁশি বাজে, সেই বাঁশিতে সুর নেই, শুধু শব্দ। আর্তনাদ চাপা দেওয়ার শব্দ।

আরিদা একটা এনজিও-তে কাজ করে। কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস নিয়ে পড়েছে। ও বলছিল—আসলে ওইসব অঞ্চলের গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে গন্ডগোল লেগে থাকত, পুরুষরা যুদ্ধে যেত, শিকারেও যেত, তাই মেয়েদের যৌনতাকে পঙ্গু করে দেওয়া হত। যৌন-কর্মটা যেন শুধু পুরুষদের। পুরুষরা এসে…আইভি বলল—একটা গর্ত পেলেই হল, না?

—ওরকমই ব্যাপার। মেয়েদের অনুভূতি রইল কি না-রইল…বাইরেটা তো কেটেছে শুধু। ভেতরে তো জরায়ু আছে। সন্তান তো হবে। ছেলেদের খতনা করা হয় যেন ছেলেরা আরও বেশি করে যৌন-সুখ পায়, আর মেয়েদের খতনা করা হয় যেন ওরা যৌন-সুখ না পায়। ওটা কম হলে সতী থাকবে। শুধু আফ্রিকান দেশগুলো নয়, অনেক আরব দেশেও এই প্রথা আছে। আরিদা বলছিল যখন ক্লিটোরাল অর্গ্যাজমের কথা বলো, আমি হাঁ করে থাকি। আমি কিছু বুঝতে পারি না। যখন ফিমেল গোনাড্স-এর ছবি দেখি, ওখানে ক্লিট দেখি, নিজেদের সঙ্গে মেলাতে পারি না। আমাদের ট্রাইবে ওটা নেই। সংবেদনের মূল কেন্দ্রটাই উপড়ে দেয় আমাদের….

আরিদা যখন এসব ‘শেয়ার’ করছিল তখন ম্যাডাম সুসানা বলছিল আমাদের দেশেও চেটিটি বেল্ট ছিল। ক্রুসেডের সময় পুরুষরা ওদের বউদের তালা বন্ধ করে যেত। একটা বেল্ট এমন বুদ্ধি করে তৈরি করা, যাতে মেয়েরা ‘পি’ করতে পারবে, ন্যাপকিনও প্লেস করতে পারবে, কিন্তু কোনওরকম পেনিট্রেশন সম্ভব হবে না। চাবিটা তো সঙ্গে করে নিয়ে যেত। যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে বেল্ট খুলত।

—যদি এমন হত, যুদ্ধেই মারাই গেল, তা হলে কী হত? তা হলে কী করে খোলা হত ওই চেটিটি বেল্ট? শ্রীলঙ্কার মেয়েটি জিগ্যেস করল।

কী আশ্চর্য, ওই প্রশ্নের পর একটা সমবেত হাসি হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু কেউ হাসল না। সুসানা বলল, যদি মেয়েটির আবার বিয়ে হত, তা হলে হয়তো ওর নতুন স্বামী বেল্টটা খোলার ব্যবস্থা করত।

—আর যদি মেয়েটা আর বিয়ে না করতে চাইত?

এই প্রশ্নের উত্তর দিল না কেউ। সারা জীবন একটা চেটিটি বেল্ট কোমরে ধারণ করে থাকতে হত। কে জানে, ১৪০০-১৫০০ সালের ইয়োরোপ জানে, সুসানা জানে না।

ইন্দোনেশিয়া থেকে আসা ছেলেটির নাম সারমুদা। আসলে সমুদ্র। সমুদ্রই সারমুদা হয়, যেমন সুকর্ন হয় সোয়েকর্ন। ও বলল—আমাদের দেশে দাঙ্গা হলেই মেয়েদের ওরকম একটা জিনিস পরে থাকতে হয়। প্রাণে মেরে দেবে, মরুক, কিন্তু রেপ করতে পারবে না।

ম্যাডাম রস এই বিষয়ের ওপর একটা ডকুমেন্টারি দেখিয়েছিলেন। মেয়েদের খতনা বিষয়ক। টিউনিশিয়ায় তোলা। তলায় সাবটাইটেল। একটি ৫/৬ বছরের মেয়ে, কোঁকড়া চুল, দোলনায় দুলছে। ওকে ঘরে ডেকে আনা হল। গলায় পরিয়ে দেওয়া হল মালা। হাতে তুলে দিল কিছু খাবার। একজন মহিলা এসেছেন। উনি বললেন এটা খুব পবিত্র কাজ। এই কাজ করে ওর খুব পুণ্য হচ্ছে। ব্যাগ থেকে বার করলেন দু’টো ছুরি, একটা কাঁচি, আর একটা ব্লেড মহিলা বলছেন—মেয়েরা খুব সেক্সি হয়। মেয়েদের সতীত্ব রাখতে গেলে এই কাজ করাটা জরুরি। উনি হাসছেন। মেয়েটিকে স্নান করানো হল। ছুরি, কাঁচিগুলো গরম জলে ফোটানো হল। তারপর মেয়েটিকে শোয়ানো হল বিছানায়। একজন গাঁওবুড়ো মোষের শিং-এর ভেঁপু বাজাচ্ছে। ড্রাম বাজছে। মেয়েটির দু’টো হাত বেঁধে দেওয়া হল দু’টো কাঠের সঙ্গে। দু’টো পা ফাঁক করে পা দু’টোও বাঁধা হল। মহিলার হাতের মুঠোয় একটা ছুরি। বেগুনের ভিতরের পোকা খুবলে ফেলার মতো ছুরির ডগা দিয়ে একটা ছোট মাংসপুঞ্জকে খুবলানো হতে লাগল, ছুরির ডগা রক্তে লাল। মেয়েটির চিৎকার শোনা যাচ্ছে বাজনা উপচিয়ে। কাঁচি দিয়ে আবার কিছুটা কাটা হল। ওটা লেবিয়া মাইনোরা। রক্ত। বাজনা। দ্রিমদ্রিম। পোঁপোর পোঁ। এবার সেলাই। সেলাইটা এমন যে মাসান্তিক স্রাবরক্ত চুঁইয়ে পড়বে ঠিক। যখন বিয়ে হবে, মেয়েটার, সমর্থ লিঙ্গের চাপে সেলাই ছিঁড়ে যাবে, আবার রক্তপাত হবে নব-রক্তপাত, সেই রক্ত শুষে নেবে কাপড়, ওই রক্তমাখা কাপড়খানা হল পবিত্র সতীত্ব-চিহ্ন। বিয়ের পর তিনরাত পাত্র থাকে পাত্রীর বাড়ি। তারপর পাত্র নিয়ে যায় পাত্রীকে। সেই শুভ শোভাযাত্রায় সবার সামনে একটা লাঠির মাথায় উড়তে থাকে রক্তমাখা ন্যাকড়া, গর্বচিহ্ন। উড়তে থাকে সতীগৰ্ব।

আধুনিক সময়ের এরকম নববিবাহিত বরযাত্রা দেখানো হল, একটা গাড়ির সামনে উড়ছে একটা লাল পতাকা।

এটা এখন রিচুয়াল, বুঝলে আইভি, আমার মনে হয় ওদের দেশের দশকর্মা ভাণ্ডারে বিয়ের দ্রব্যসামগ্রীর লিস্টিতে এরকম সতী-চিহ্নের লাল কাপড়ও পাওয়া যায়। বিয়ের পর এটা দরকার। লিস্টিতে থাকে। যারা ফাটিয়ে রক্ত বের করে না, ওদেরও একটা লাল কাপড় লাগে। নিয়ম। প্রথা। তাই না? কোথায় আইভি, ও কখন ফুটে গিয়েছে। এইসব ফুটোস্কোপের গল্পে ও বোর হয়ে চলে গিয়েছে।

হোটেলে শুয়ে আছে অনিকেত। একা ঘরে। বাইরে আলোয় সাজানো ব্যাংকক। বিরাট- বিরাট বাড়ি, হোটেল, ফোয়ারা নাচে। চকচকে রাস্তায় পিছলে যায় দামি গাড়ি, গিজগিজ করছে ট্যুরিস্ট। সারা শহর জুড়ে মাসাজ ক্লিনিক, শহরে বেশ কয়েকটা এলাকায় গণিকালয়। সেই প্রথম দিনেই তো এয়ারপোর্টে দেখেছিল বিমান ধরার ফাঁকে কেউ কাচের ঘরে শুয়ে আছে। তার গায়ে চড়ে মাসাজ করছে কন্যাসমা। ব্যাংকক থেকে সোজা হাইওয়ে চলে গিয়েছে পাটায়া। সমুদ্রের ধারে পর-পর নারী-বিপণি। গো গো বার, সওনা বাথ, হাইড অ্যান্ড সিক, ইরোটিক শো…।

ও কমলদা, মানে কমল গুপ্তকেই বলে অনিকেত। জানেন, কী বলব, একটা রিভলভিং প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েরা, শরীরে দু’ফালি কাপড়, ওদের গলায় ঝোলানো নম্বর। প্ল্যাটফর্মটা ঘুরে যাচ্ছে আস্তে-আস্তে। আপনি মেয়ে পছন্দ করে কাউন্টারে গিয়ে ওই নম্বরটা বলুন শুধু, একটা লোক চলে আসবে আপনার সঙ্গে, আপনার মাথায় একটা ছোট্ট ছাতা ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে, সিল্কের ছাতা, ছাতার ওপরে ওই নম্বরটা লেখা, ওই নম্বরটা দেখে ঘুরন্ত প্ল্যাটফর্ম থেকে লাফিয়ে নেমে এসে আপনাকে জড়িয়ে ধরে হামি খাবে। এবার আপনি ওকে নিয়ে চলে যেতে পারেন সমুদ্রের ধারে। মেয়েগুলোর বয়স পনেরো থেকে কুড়ির মধ্যে।

কমল গুপ্ত বলল—ইস রে, একদম আমার মেয়ের বয়সি। ধ্যার…।

সাত লক্ষ মেয়ে এই কাজ করছে সারা থাইল্যান্ডে। কেউ বলে ন’লক্ষ। দশ লক্ষও হতে পারে। তাদের মধ্যে ত্রিশ শতাংশের বয়স ১৮-র কম। ব্যাংকক-এ প্রতি আড়াই মিনিটে একটা করে প্লেন এসে, পর্যটক বমি করে দিচ্ছে। যত পর্যটক আসছে তার দশ শতাংশ আসছে শুধুই যৌনতার জন্য, তিরিশ শতাংশ শুধু যৌনতার জন্য না এলেও কিছু-না-কিছু টাকা সেক্স ট্যুরিজ্‌জ্ম-কে দেয়। সাত বা আট লক্ষ নারীদেহ বিক্রয়কারিণীর সঙ্গে আছে কুড়ি-পঁচিশ হাজার পুরুষ। পুরুষদের কি দেহ-বিক্রয়কারিণী বলা যায়? বেশ্যাদের ‘যৌনকর্মী’ বলতে চায় না অনিকেত, কথাটা ক্রমশ চালু হচ্ছে। কর্ম বা কাজ হল সেটাই, যার সঙ্গে উৎপাদন যুক্ত। কাজের একটা লক্ষ্য থাকে। দেহ বিক্রির মধ্যে কি ওসব আছে? উৎপাদন নেই, ধ্বংস আছে। দেহ পসারিণীরা বলেন, আজ এতজনকে বসালাম। বলেন না—আজ এতজনের সঙ্গে কাজ করলাম। কোনও নারীই ভালবাসাহীন চিত হওয়ার মধ্যে, যান্ত্রিক পা ফাঁক করার মধ্যে আনন্দ পেতে পারেন না। অনিকেত তাই ‘যৌনকর্মী’ শব্দটাকে না-ব্যবহার করারই চেষ্টা করে। কিন্তু পুরুষদের বেলায় কী বলবে? পুরুষদের বারবণিতা, বারবধূ, রূপজীবিনী, এসব তো বলা যায় না। কী বলবে? দেহ-বিক্রয়কারী? এটাও মানায় না। মহা ফ্যাচাং। ‘যৌনকর্মী’ বলাটাই সোজা। এরা সবাই মিলে, সব যৌনকর্মী মিলে তাঁদের স্বদেশকে প্রতিদিন আশি-লক্ষ ডলার উপহার দিচ্ছেন। তাঁদের আকর্ষণে হোটেলগুলো রোজগার করছে, রোজগার করছে স্পিডবোট, প্যারাসুটওলা, মদের দোকান, অটো রিকশা, ট্যাক্সি, কন্ডোমের দোকান, ওষুধের দোকান, লুব্রিক্যান্ট জেলি, যৌনরোগের চিকিৎসক, এড্‌স-এর মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি এবং মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। সারা ব্যাংকক, পাটায়া, ফুকেট-এ আলো ঝলকায় থাই-বালিকাদের যৌবনের বিনিময়ে। ওই যে একটা ফোয়ারা নাচছে, ওর জন্য হয়তো লেগেছে সাড়ে দশ হাজার জোড়া স্তন, হোটেলের লাউঞ্জের ঝুলন্ত দ্যুতিময় ঝাড়বাতিটার জন্য তিরিশ হাজার অনিচ্ছুক চুম্বন, আর সারা শহরের রাস্তার পাশের ফুটন্ত ফুলগুলোর জন্য? পাটায়া কিংবা ব্যাংকক-ফুকেট হাইওয়েগুলোর জন্য?

ওয়াকার স্ট্রিট দিয়ে হেঁটেছিল একদিন। নানারকম বিপণি। পেঁপে-আনারস-আঙুরের পাশের দোকানেই বিক্রি হচ্ছে রবারের পুংলিঙ্গ। ডিলডো। টুলে বসে আছে পেশিবহুল চেহারার পুরুষ। ওদের খদ্দের হল নারী। শুনুন না কমলদা, ও, না, আপনি তো চলে গিয়েছেন, তা হলে দেবাশিস, তুই শোন—তুই রিলে করে যা—পাটায়ার রাস্তা থেকে সরাসরি বলছেন দেবাশিস বসু—যে-গলায় রবীন্দ্রনাথের কৃষিচিন্তা কিংবা আধ্যাত্মিক ভারতের মানববাদ বলিস—সেই গলায় বলে যা–কালো গেঞ্জি পরে খদ্দেরের আশায় বসে আছে কয়েকটা জিগোলো। দু’জন মোটা মতন…না বল— স্থূলকায়া মধ্যবয়সি শ্বেতাঙ্গিনী মহিলা এলেন। একজন ছেলেটির মাথায় টুসকি মারল, ‘টুসকি’ বলবি না কী বলবি তুই ভেবে নে। ছেলেটি বলল, ওয়েলকাম ম্যাম। ওরা ভিতরে চলে গেল। পাশে গো-গো শো। এরপরই ফানি কানি শো। চল্লিশ ভাট টিকিট। ঢুকে গেলাম। একটা কিশোরী মেয়ে একটা ইজি-চেয়ারে শুয়ে আছে। গায়ে বসন নেই, শুধু পায়ে কালো জুতো। ইজি-চেয়ারের দুই হাতলে দুই পা। দুই পায়ের মাঝখানে কিছু হাতড়াচ্ছে একটি লোক। ভিতরে কিছু পেল। বের করে আনছে। বের করে আনছে ব্লেডের মালা। সারি-সারি ব্লেড। ব্লেডের গায়ে রক্ত। আলো পড়ছে রক্ত-মাখানো ব্লেডে। মিউজিক। দেবাশিস—তুই মুখ বিকৃত করলি? তোর তো মেয়ে নেই, তবুও।

তা হলে শুক্লা, তুমিই শোনো। কত ফল। কী টাটকা! নানারকমের ফল। ছোট ছোট কাঁঠাল, ওরা বলে কুরিয়েন। বাক্সভর্তি স্ট্রবেরি। থোকা থোকা আঙুর। বেদানা, নিটোল কমলালেবু, আপেল। অনেক আপেল।

আপেলে কামড় বসাব? প্ররোচনা দিচ্ছে ইভ।

২৪

গত সত্তরের দশকে থাইল্যান্ডের কোনও রাজা নাকি বলেছিলেন, আমাদের দেশের কী সুন্দর প্রকৃতি! কত ফুল, কত ফল। তিনটে এস। সি, সান অ্যান্ড স্যান্ড। আমি আর একটা এস জুড়ে দিতে চাই। ‘সাশে’। ‘সাশে’ হল সুগন্ধে ভরপুর নরম পুঁটুলি। আমাদের মেয়েরা। আমাদের মেয়েরাও তো দেশের কাজে লাগতেই পারে।

মেয়েরা কাজে লেগেছে। দেশের কাজে। সেক্স-ট্যুরিজমের অন্তর্গত মানুষগুলো বলে থাকে ‘আমরা সার্ভিস সেক্টরে কাজ করি।’

আর এই ‘সার্ভিস সেক্টর’-এ কাজ করা নব্বই শতাংশ মেয়েদের বয়স ১৫ থেকে ৩০-এর মধ্যে।

হোটেলের রিসেপশনিস্টকে জিগ্যেস করেছিল অনিকেত। একটা প্রশ্নের উত্তর পাচ্ছি না, তোমাদের সার্ভিস সেক্টরে যারা কাজ করে, তারা তো সবাই কমবয়সি। বয়স বেড়ে গেলে ওরা কোথায় যায়?

—সো মেনি প্লেসেস, লাইক মি। মেয়েটার মুখে মোহিনী হাসি।

–কত বছর সার্ভিস সেক্টরে কাজ করেছিলে?

—ফিপতিন ইয়ারস।

—তোমার স্পেশালিটি কী ছিল?

—এসস্পিসিয়ালিতি? হি-হি। আই স্তারটেড অ্যাজ গো-গো ড্যান্সার অ্যাট দ্য এজ অফ ফোরতিন। আই ওয়াজ দেন লাইক দিস। আঙুলগুলো সাজিয়ে যে-মুদ্রা তৈরি করল, ছোট কোনও ফল বোঝাতে এরকম মুদ্রা ব্যবহার করা হয়।

—দেন সামডেজ প্যারাসেলিং পার্টনার

সমুদ্রের ধারে প্যারাসুটের মতো ওড়ার ব্যবস্থা আছে। সাধারণত একজনই ওড়ে। কখনও দু’জন। কোনও পুরুষ-ট্যুরিস্ট একটি সঙ্গিনী ভাড়া নিতেই পারে। দু’জনে একসঙ্গে ওড়ে, সঙ্গিনীকে তখন থ্রিলড হতে হয়, ভয় পেতে হয়, সঙ্গীটিকে জড়িয়ে ধরতে হয়।

—দেন অ্যাট মাসাজ পার্লার। এই ব্যাপারে আর কিছু জিগ্যেস করেনি অনিকেত। হতে পারে কোনও ইরোটিক পার্লারে ওর স্পেশালাইজেশন ছিল সাকিং। হতেও পারে।

—ফাইনালি হিয়ার। নাও আই অ্যাম থার্টি ফোর। অ্যাম আই নট স্তিল লুকিং গুড? হি-হি।

–খুব সুন্দরী লাগছে। খুব। ম্যাডাম আর ইউ ম্যারেড দেন?

—ইয়েস। আই অ্যাম। গট টু দটাস। হি-হি।

—ওরাও কি একদিন সার্ভিস সেক্টরে…

গম্ভীর হয়ে গেল মুখটা। হঠাৎ মেঘ। নো-নো-নো। দে আর নট লাইক মি। নাও আই হ্যাভ মানি টু গেট দেম এডুকেশন। মাই ফাদার ওয়াজ আ পুয়োর ম্যান ইউ নো, ফার্মার অফ কুলিয়ং ডিস্ট্রিক্ট। ইট ইজ ইন নর্থ পার্ট। দিস পার্ট ইজ পুয়োর এরিয়া। অ্যান্ড গার্লস অফ দোজ এরিয়া আর কামিং দাউন টু দিস সিতিজ। হোয়াট টু ডু ম্যান? আই ওয়াজ দ্য এলডেস্ট…

একটা ব্যাপার বোঝা গেল, এখানে সামাজিক ভাবে যৌন-ব্যবসা নিয়ে খুব একটা ‘ট্যাবু’ নেই। এখানে মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার অবশেষ কিছুটা রয়ে গিয়েছে। সংসারের প্রতি মেয়েরা দায়িত্বশীল। সর্বত্রই মেয়েদের কাজ করতে দেখা যায়। এদেশের যৌন-ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত মেয়েদের বিয়ে-টিয়ে নিয়ে খুব একটা অসুবিধা হয় না। ৮-১০-১২ বছর এই কাজ করে, টাকা- পয়সা জমায় ওরা। যৌবন-বেচা পয়সায় সংসারের জন্য আমেরিকান কোম্পানির ফ্রিজ, জাপানি কোম্পানির টিভি, ডাচ কোম্পানির ফ্রিজ, কোরিয়ান কোম্পানির ওয়াশিং মেশিন কেনা হয়। অসুবিধা হয় যদি আগে সন্তান হয়ে যায়। রাষ্ট্র সেই সন্তানের কোনও দায়িত্ব নেয় না। তবে সন্তান হয় না বললেই চলে—বিশেষ কোনও কারণ ছাড়া।

আশির দশকে থাইল্যান্ডের একজন মন্ত্রীকে ‘মি. কন্ডোম’ নামে ডাকা হত। ওঁর আসল নাম মিকেল বীরবৈদ্য। উনি ছিলেন এড্‌স অ্যান্ড ট্যুরিজম মিনিস্টার। লক্ষ্য করার বিষয়, এড্‌স-এর সঙ্গে ট্যুরিজম-কে ক্লাব করে দেওয়া হয়েছে। উনি খুব করিৎকর্মা মন্ত্রী ছিলেন। ওঁর চেষ্টাতেই কন্ডোম আবশ্যিক হয়ে গিয়েছে। ওঁর চেষ্টাতেই কন্ডোম কেনার মেশিন বসেছে রাস্তায়। পয়সা দিলেই বেরিয়ে আসবে। এড্‌স অনেকটাই বাগে আনা গিয়েছে। অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তানও। সেক্স- পুলিশ রয়েছে বিশেষ এলাকায়। ওরা ডলার খরচ করতে আসা সেক্স-ট্যুরিস্টদের সাহায্য করে। অথচ থাইল্যান্ডে বেশ্যাবৃত্তি আইনসম্মত নয়। অথচ রাষ্ট্রীয় মদতেই চলে এই ব্যবসা। আমেরিকাতেও বেশ্যাবৃত্তি নিষিদ্ধ। কিন্তু ওখানেও তো চলছে। ইউরোপের অনেক দেশেই নিষিদ্ধ। আরব দেশগুলোতে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। পাকিস্তানেও। কিছু ইসলামিক দেশে ‘জেনা’-র শাস্তি খুব বেশি। ‘জেনা’ মানে যে কোনও বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক। ‘জেনা’-র শাস্তি চাবুক, কারাবাস থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পাথর ছুড়ে মারা’ অবধি হতে পারে। এবং ‘জেনা’-তে মেয়েরাই দোষী সাব্যস্ত হয়। পুরুষরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রেহাই পেয়ে যায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার আগে পর্যন্ত ওদেশে এবং অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে বেশ্যাবৃত্তি নিষিদ্ধ ছিল। সমাজতন্ত্রের পতনের পর বছরে দশ লক্ষ নারী রাশিয়া, বেলারুশ, ইউক্রেন, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, রোমানিয়া, আলবেনিয়া থেকে পশ্চিম ইউরোপ, কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, জাপানে পাড়ি দিচ্ছে। হয়তো থাইল্যান্ডেও রয়েছে ওরা কেউ-কেউ। আগে এক ধরনের নিরাপত্তা ছিল, চাকরি না-পেলে বেকার-ভাতা ছিল, অসুস্থ হলে চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগ ছিল, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর ব্যবস্থা ছিল। এখন শুধু ক্ষুধা আছে। এই ক্ষুধা যৌন-ক্ষুধা নয়। পেটের খিদে। সন্তানের মুখে খাদ্য তুলে দেওয়ার মানবিক তাড়না। আর ওদের যা জীবনযাপন, তাতে শাকভাত, হাঁড়িয়ায় চলে না। শীতের দেশ। শরীর গরম রাখার জন্য একটু ভারী পোশাক-পরিচ্ছদ চাই, একটু মাখন চাই, মাংস চাই। স্নান কম করা হয় বলে পারফিউম চাই। তাই পথে নামা।

আমাদের দেশে বেশ্যাবৃত্তি বেআইনিও নয়, আইন-সম্মতও নয়। একটা অস্পষ্ট আইন আছে : পিটা। প্রিভেনশন অফ ইমমরাল ট্রাফিকিং অ্যাক্ট। এই আইনে রাস্তায় বা উন্মুক্ত জায়গায় দাঁড়িয়ে খরিদ্দার ধরা বেআইনি। কিন্তু ঘরের ভিতরে টাকা পয়সার বিনিময়ে কেউ দেহ বিক্রি করলে আইনের কিছু বলার নেই। দেহ বিক্রির জন্য কাউকে ‘প্রোভোক’ করা বেআইনি। দেহ-ব্যবসা করার জন্য কাউকে প্ররোচিত করাও বেআইনি।

অথচ নিত্যনতুন মেয়েরা আসছে এ লাইনে। পুলিশ মর্জিমতো পিটা’ আইনের ভয় দেখিয়ে মাঝেমধ্যে তোলা আদায় করে। মাঝে-মধ্যে ‘রেড’ হয় এবং অসৎ উদ্দেশ্যে আনা নাবালিকা উদ্ধার হয়ে হোম-এ যায়। দেহ বিক্রিকে আইনের স্বীকৃতি দেওয়ার কথা বলছে অনেকেই।

সেদিন, ১৯৯৭-এর নভেম্বরে, সল্টলেকে যৌনকর্মীদের জাতীয় সম্মেলন করল দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি’। সারা ভারতবর্ষ, এমনকী ভারতের বাইরে থেকেও, ‘যৌনকর্মী’-রা এল। ‘যৌনকর্মী’ নাম-টাও বোধহয় ওরাই চালু করেছিল। ‘বেশ্যা’ শব্দটা তো সংস্কৃত ‘বিশ’ থেকে আসা। যার অর্থ জনসাধারণ। জনসাধারণের ভোগ্যা। পরে ‘গণিকা’ শব্দটি এল। যারা কুল ত্যাগ করে এসব পাড়ায় গিয়েছে, ওরা নিশ্চয়ই ‘কুলটা’। আর ‘কুলটা’ যদি হয়, ‘পতিতা’-ও বটে। ‘ঝি’ যদিও ‘দুহিতা’ শব্দ থেকে আসা, মানে মেয়ে, কিন্তু খারাপ শোনায় বলে ‘কাজের মেয়ে বলতে থাকলাম ভদ্দরলোকরা। তেমনই ‘গণিকা’ বা ‘বেশ্যা’-দের জন্য একটা নতুন শব্দ দরকার হয়ে পড়ল। তাই ‘যৌনকর্মী’ শব্দটির আবিষ্কার। এই শব্দটা যেন ওদের জীবিকাটাকে আরও বেশি করে চিনিয়ে দিচ্ছে। একজন ‘যৌনকর্মী’-ই বলেছিল—নতুন নাম বেরিয়েছে যৌনকর্মী। এটা বেশি লজ্জার। বেশ্যার চেয়েও খারাপ। যৌনটা তো লুকিয়ে রাখি। (ও যৌন এবং যোনি এক করে দিয়েছে) কাপড়ের তলায় থাকে। ওটা নিয়ে বড়াই করে বলার কী আছে?

আসলে গণিকা ও বারবণিতা-র মতো যৌনকর্মী শব্দটাও একটা জীবিকাকে বর্ণনা করেছে। ভাবা হয়েছিল, বেশ্যা বা বারবণিতা-র পরিবর্তে ‘যৌনকর্মী’ বললে ওই বৃত্তিজীবী মেয়েদের নামের সঙ্গে যুক্ত কলঙ্ক-জ্বালায় কিছুটা ক্রিম ঘষে দেওয়া হবে। আর কর্মী কথাটা জুড়ে রাখলে ‘শ্রমিক’ মর্যাদার জন্য দবি তোলা যাবে। ‘সেক্স ওয়ার্কার’ শব্দের এই অনুবাদের সময় মনে হয়নি, এই নতুন নাম আসলে শিকল পরানোর ছল।

তো, যৌনকর্মীদের সম্মেলনে দাবি তোলা হল যৌনকর্ম একটা কাজ, এই কাজের আইনি স্বীকৃতি চাই। যৌনকর্মীদের শ্রমিকের অধিকার দিতে হবে। শ্রমিকের স্বীকৃতি মানে? ঘোষণা করতে হবে, ওরাও শ্রমিক। তা হলে কী হবে? বোনাস পাবে? ১ মে-তে ছুটি পাবে? ট্রেড ইউনিয়ন করতে পারবে? ট্রেড লাইসেন্স-ও। বাঃ? কোম্পানিগুলোর নাম কী হবে? শান্তি সার্ভিস, প্লেজার সেন্টার, অর্গ্যাজম পয়েন্ট? না কি আয়া সাপ্লাই সেন্টারের মতো সোজাসুজি? ওরা শ্রমিক, সুতরাং শ্রমিক সাপ্লাইয়ের জন্যও এজেন্সি চাই। ধরা যাক, নব্য উদ্যোগপতি ব্যাংক লোন নিতে এসেছেন।

—কোম্পানির নাম?

—সেক্স ওয়ার্কার এক্সপোর্টার সাপ্লায়ার অ্যান্ড স্টকিস্ট।

–বাঃ ব্যালান্স শিট তো ভালই। খুব ভাল প্রফিট। টাকাটা নিয়ে কী করবেন?

—এসি বসাব, আর রাশিয়া থেকে কিছু এস ডব্লিউ আনাব।

.

নামটা পাল্টালেই হয়? অনিকেত এই মাঝরাত্তিরে বিড়বিড় করে। ঘুম আসছে না।

অকটারলনি মনুমেন্টের নাম পাল্টে, মাথা লাল রং করে, ‘শহিদ মিনার’ নাম রাখলেও— লোকে ওটাকে মনুমেন্ট-ই বলে। কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন রাখলেই কি ওর লোচন পদ্মের মতো হয়?

আইনের স্বীকৃতি না-থাকলে—একটা অপরাধ-বোধ থেকে যায়। বেশ্যাবৃত্তি উঠিয়ে দেওয়া যাবে না, জোর করে ওঠানো উচিতও নয়। যারা এই কাজ করে, তারা নিজের ইচ্ছেয় করে না। তাদের বাধ্য-হয়ে-গ্রহণ করা চোখের জল জড়ানো বৃত্তিটিকে মহান বললে মনুষ্যত্বের অপমান করা হয় না? তা হলে পুরুষ দেহজীবীরা? ওরাও কি চোখের জল ফেলতে-ফেলতে এই পেশায় আসে? এখানেই একটা প্রশ্ন-চিহ্ন নাচে। যাদের আমরা পুরুষদেহজীবী বলছি, আসলে তো তারাও নারী। জিগোলোদের কথা আলাদা। ওরাও যৌনতা বিক্রি করে। বিক্রি করে নিজেদের লিঙ্গপ্রহার। ওদের খদ্দের নারী। কিন্তু অন্যান্য পুরুষ যারা, তারা তো আপাত-পুরুষ, মনে-মনে নারী। নিজেদের নারীই ভাবে। নারীর যোনি আছে, ওদের নেই, ওদের ওটা নেই বলে ওদের কষ্ট। কিন্তু ওদের পায়ু আছে। ‘হায়’ শব্দটা কোত্থেকে টুকরো কাগজের মতো উড়তে-উড়তে কাঁপতে কাঁপতে জুড়ে গেল ‘পায়ু আছে’র পর। তাই ওটাই ব্যবহার করে। এভাবেই ওরা যৌনতা পেতে চায়।

নারী-বেশ্যরা যান্ত্রিক সঙ্গমের মধ্যে, একাধিক পুরুষের ক্লেদ-রসের মধ্যে আনন্দ পেতে পারে না, তারা পয়সা-দেওয়া পুরুষটিকে দেহ বিছিয়ে দেয়, কিন্তু মন থেকে এই বৃত্তিটি গ্রহণ করে না।

যে সামান্য কয়েকটি দেশে যৌনব্যবসা আইনি, ওখানে যৌনকর্মীরা খুব সুখে আছে—এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। সুইডেন, নরওয়ে, ডেনমার্ক ওইসব দেশের জীবনযাত্রার মান এমনিতেই ভাল, ওদের দেহ-পসারিনীরাও স্বভাবতই ভাল আয় করে। কিন্তু সুখ? ওটা দু’অক্ষরের রহস্যময় তান্ত্রিক শব্দ। ‘সুখ’ নামের শুকপাখিটাকে নিয়ে কত দার্শনিক বার্তা, কত গান-কবিতা, তবে লরির পেছনে যেটা লেখা থাকে, তার চেয়ে বড় কথা বুদ্ধ-প্লেটো-সক্রেটিস- যুধিষ্ঠিররা বলতে পারেন না : ‘সুখ স্বপনে শান্তি শ্মশানে।’

ছেলেটা বলেছিল ওর মায়ের নাম শান্তি। বলেছিল তেহট্ট বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে ভালুকবাটি বললেই ভ্যানগাড়ি নিয়ে যাবে। ওর মা-কে ওর দু’টো ছবি আর একটা সাদা পাথরের থালা পৌঁছে দিতে পারবে কি না। অনিকেত রাজি হয়নি। সম্ভব হবে না। ছেলেটার নাম চন্দন। এখানে সবাই চ্যাংডেন বলে ডাকে।

একটা শো দেখতে গিয়েছিল অনিকেত। ওখানে অনেকগুলো ইভেন্ট ছিল। যেমন নগ্ন নারীর স্কিপিং লাফানো, নর-নারীর কুস্তিযুদ্ধ এইসব ছিল। এরপর একটা বামন এল। ডোয়ার্ফ। পৃথুল। থপথপ করতে-করতে বামনটা এল, মাথায় মুকুট। জরির পোশাক, বুকে ক্লিপ দিয়ে আঁটা নানা অভিজ্ঞান। গলায় মেডেল। বামনটা কোনও কথা বলে না। ক্যাটওয়াক করে। পিছনে কমেন্ট্রিতে বলে, হি ইজ অ্যান ইনদিয়ান গাই, নেম ইজ চ্যাংদেন। হি ইজ উইনার অফ সো মেনি সেক্স কনতেস্ত। হি ইজ এশিয়ান চ্যাম্পিয়ন অফ কক্ অলিম্পিয়াদ। ছেলেটা ‘বাও’ করে। দর্শকদের সামনে মাথা ঝোঁকায়। তারপর একে-একে পোশাকগুলো খুলতে থাকে। যখন সম্পূর্ণ নিরাবরণ হয়, তখন দেখা যায় ওর লিঙ্গটা হাঁটু ছাড়িয়েছে। এমনিতে ওর উচ্চতা তিন ফুটেরও কম, কিন্তু লিঙ্গটি প্রায় একফুট। চ্যাংদেন লিঙ্গটিকে বাজনার তালে-তালে নাচাতে থাকে। এরপর তিন-চারটি যুবতী আসে স্টেজে। ওই লিঙ্গ দর্শনে উত্তেজিত হয়। ঝপাঝপ পোশাক খুলতে থাকে। এবার চ্যাংদেনের লিঙ্গ-প্রতিক্রিয়া হয়। লিঙ্গগাত্রে আলো পড়ে। ঝিন ঝিনা ঝিকা। ঝিকা ঝিকা ঝিন। যুবতী-হাতগুলো এগিয়ে আসে। সবাই লিঙ্গটি ধরতে চায়, চ্যাংদেন-কে কোলে তুলে নিতে চায় কেউ, কেউ ছিনিয়ে নেয়। লিঙ্গটি নিয়ে টানাটানি শুরু হয়। অকস্মাৎ ওটি খুলে আসে, দীর্ঘ, অথচ ফাঁপা। কৃত্রিম। চন্দনের উরুসন্ধিতে, হয়তো বা দুর্বল লিঙ্গটির ওপর ওই তেজি পিভিসি লিঙ্গ পরানো ছিল। একটি যুবতীর মুষ্ঠিতে ওই বিচ্ছিন্ন পিভিসি, আর চন্দন দু’হাতের চেটো চোখের সামনে রেখে ভ্যাঁ করে কেঁদে দেয়। আর তখন স্যাক্সোফোনের আর্তনাদ ছাপিয়ে হইহই, সিটি, তালি, হাসি।

অনিকেতের খুব কৌতূহল হয়েছিল। পরে, চেষ্টা করে ছেলেটার সঙ্গে দেখা করেছিল। তখনই জানল ছেলেটার নাম চন্দন। বাঙালী সার্কাসে জোকারি করত। সেই সার্কাস দল খেলা দেখাতে গিয়েছিল বাংলাদেশে। ওখান থেকেই ওকে তুলে নেয় এই কোম্পানি। বহুদিন দেশে যায় না। ওদের গ্রামের এক মাস্টারমশাইয়ের নামে মাঝে-মধ্যে টাকা পাঠায়। ওর মা কেমন আছে জানে না। যদি দেশে যেতে পারে, ওর মা-কে একটা মোবাইল কিনে দেবে। তখন মায়ের সঙ্গে কথা বলতে পারবে।

ছেলেটা বলছিল, ভাল নেই ও। এত খেতে হয় যে ভাল লাগে না। গাদা-গাদা আলু, মাখন, চিজ, জেলি, ওকে মোটা থাকতে হবে। বেঁটে তো ভগবানই করে দিয়েছে, সেই সঙ্গে মোটা, থলথলে, ভুঁড়িওয়ালা থাকতে হবে, নইলে মানুষ হাসবে না।

অনিকেত চন্দনকে জিগ্যেস করেছিল—তুমি ওই রবার-দণ্ডটা নিয়ে এত কায়দা কী করে করো? মেয়েগুলো আসার পরই কী করে ওটা বেড়ে যায়? কী করে ঝুলন্ত অবস্থা থেকে ওপরে উঠে যায়? ছেলেটা বলেছিল—সুতো স্যর, কালো সুতো। হাতে থাকে, টানতে হয়। কায়দা আছে, তবে না লোক হাসবে, আমার মায়ের মুখের হাসি দেখতে চাই স্যর, ম্যানেজারের ফোন নম্বরটা নিয়ে যান স্যর, মায়ের মুখের একটা হাসি-হাসি ছবি পাঠাতে পারবেন স্যর?

এত ঝামেলা ও নেয়নি। একেই হাজার ঝামেলা। ও বলেছিল, সরি চন্দন, আমার সময় হবে না ভাই। চলে এসেছিল। পালিয়ে এসেছিল। অনিকেত ভাবে এসব অভিজ্ঞতা রগরগে ভাবে লিখে, ‘রাতপরিদের দেশে’ কিংবা ‘হরেক মজার রাত’ জাতীয় নামে ছাপতে পারলে কেমন হয়? প্রকাশক পেতেও অসুবিধে হবে না হয়তো। বিক্রিও হবে। কিন্তু …এই আর্ত শব্দমালা কি রগরগে করে লেখা যায়? যোনি-গহ্বর থেকে বেরিয়ে আসা রক্তমাখা ব্লেডেও কি সুড়সুড়ি থাকে? ওটা সত্যিকারের রক্ত নয় নিশ্চয়ই, রক্তরঙে রঞ্জিত। ও কিছু না। কিন্তু রগরগে হবে? এই ঘটনাটাও কি রাখা যায়? ইরোটিক শো দেখতে এসেছিল যে বোরখাপরা মহিলাটি, সে বমি করছিল একটা লেহন-দৃশ্যে, মুখের কালো ঢাকনা সরিয়ে, ওটাও কি লেখা যায়? রগরগে হবে?

নাথিং ইজ অ্যাবনরমাল ইন সেক্স। তোমার কাছে কোনও-কোনও অ্যাক্ট আন- ডিজায়ারেল হতে পারে, বাট ইউ ক্যান্ট সে অ্যাবনরমাল। একজন রিসোর্স পার্সন বলেছিলেন ওই ওয়ার্কশপ-এ। হেট্রো, বাই অর হোমো-সেক্সুয়ালিটি, নাথিং ইজ অ্যাবনরমাল। নো অ্যাক্ট ইজ অ্যাবনরমাল—তাই বলছেন? পিডোফাইলরা-ও তা হলে ঠিক আছে? যারা শিশুদের ধর্ষণ করে?

—ও ইয়েস। একজন পিডোফাইলের ‘পয়েন্ট অফ ভিউ’ থেকে ও এটাকে অ্যাবনরমালিটি মনে করছে না কিন্তু, সোসাইটি মনে করছে এটা ঠিক নয়।

—কেন? একজন পিডোফাইল তো জানে ওর এই ধরনের কাজটা সমাজ অনুমোদন করে না। ও জানে শিশুটির সম্মতি নিয়ে ও এসব করছে না। তা ছাড়া শিশুর সম্মতি কথাটা ভো্। ১৮ বছর বয়সের আগে নিজস্ব সম্মতি দেওয়ার অধিকার তৈরি হয় না। অনিকেত নিজের যুক্তি রাখে।

—আমরা বলছি না পিডোফিলিক অ্যাক্ট ভাল।

—তা হলে যারা স্যাডিস্ট, যারা যৌনসঙ্গীকে উৎপীড়ন না-করতে পারলে তৃপ্তি পায় না, ওরাও নরমাল?

রিসোর্স পার্সন মাথা চুলকে বলেছিলেন—অ্যাবনরমাল বলি কী করে, যখন বহু মানুষ এভাবেই তৃপ্তি পায়। যারা ম্যাসোসিস্ট, একটু মারধোর না-খেলে তৃপ্তি পায় না, ওরা যদি স্যাডিস্ট-এর সঙ্গে কাল করে, ঠিক আছে। বোথ আর হ্যাপি…

রিসোর্স পার্সন এবার বললেন—অফ কোর্স, মানুষের মধ্যে কিছু-কিছু আনকমন বিহেভিয়ার থাকেই টুওয়ার্ডস সেক্স, যেমন—কিছু স্কোপোফিলিক আছে, যারা শুধু দেখতেই বেশি ভালবাসে, জেরাটোফিলিক আছে, যাদের বৃদ্ধ বা বৃদ্ধায় মতি, এমনকী নেক্রোফিলিক-ও কেউ-কেউ থাকতে পারে, যাদের মৃত মানুষের সঙ্গে…এরা যৌনসঙ্গীর কাছ থেকে কোনও সাড়া পেতে চায় না, মনে করে যৌনসঙ্গী তার সম্পূর্ণ করায়ত্ত। যৌনসঙ্গী যদি পুতুলের মতো, মড়ার মতো থাকে—তাতেই ওরা সন্তুষ্ট…।

বাকিটা শুনতে পারছিল না। কান ভোঁ-ভোঁ করছিল। অনিকেত কি তবে নেক্রোফিলিক? পুতুলের সঙ্গে?…তা কেন হবে? ওটা তো বাধ্যবাধকতা। তবে তা হলে এরকম কেউ-কেউ আছে, যারা পুতুলই চায় পুরো অধিকার করবে বলে?

ওরা বেশ কিছু প্রোগ্রাম দেখিয়েছিল—যা নাকি কিশোর-কিশোরীদের জন্য তৈরি। ওরা চাইছে, ওদের দেখানো মডেলেই এইসব দেশগুলোতে যৌনশিক্ষা হোক। অনিকেত বুঝল ফোর্ড ফাউন্ডেশন প্রচুর টাকা ঢালছে যৌনশিক্ষার ব্যাপারে। যৌনশিক্ষার নামে বিভিন্নভাবে ফোর্ড ফাউন্ডেশনের কাছ থেকে টাকা আদায় সম্ভব। ‘বিবিসি’ ওদের হয়েই কাজ করছে এবং উৎসাহ দিচ্ছে। অনিকেতের মনে হল, প্রকৃতপক্ষে ফোর্ড ফাউন্ডেশন যেটা চাইছে সেটা যৌনশিক্ষা নয়, বরং যৌনকার্যের প্রসার।

বিবিসি প্রশ্ন করেছিল অনিকেতকে—কেন তুমি তোমার প্রোগ্রামে সেক্সুয়াল অ্যাক্ট রাখোনি? কন্ডোম রাখোনি? ‘জি’ পয়েন্ট রাখোনি, কন্ট্রাসেপশন রাখোনি….?

অনিকেত বলার চেষ্টা করেছিল—আমরা তো কিশোর-কিশোরীদের যৌনকর্ম শেখানোর জন্য অনুষ্ঠানটা করিনি, বরং ভুল ধারণাগুলো ভেঙে একটা সুস্থ মন, সেক্সুয়াল এথিক্‌স…

—এথিক্‌স ইন সেক্স? হেসে উঠেছিল ব্রিটেন-কাম্পুচিয়া-ফিলিপিন্‌স-থাইল্যান্ড। একজন বললেন, এখানেও আল্টাচেবিলিটি?

অনিকেতের মনে হচ্ছিল—একটা বাজার খোলার চেষ্টা চলছে যেন। ভারতের জীবনযাত্রায় যৌন বিধিনিষেধ থাকার জন্য যৌন-পণ্যসামগ্রীর বিক্রি খুব একটা বেশি নয়। ভাইব্রেটর, ক্লিটোরিস-উত্তেজক টুনা, প্রেশার রিং, ডিল্ডো—এসবের বাজার নেই। ওরা চাইছে বাজার বাড়ুক। যৌনতা বাড়ুক। বিশ্বায়নের সঙ্গে সেক্সায়ন হোক। যৌনতা অবাধ হলে তবেই তো অবাধ যৌনতার কুফলের কথা বলে কন্ডোমের বিক্রি বাড়ানো যায়। এই রবার বিদেশ থেকে আসে। নিয়ন্ত্রণ করে কয়েকটি দেশ। যৌনরোগের ওষুধ, এড্‌স-এর ওষুধ—সবই তো ওদের নিয়ন্ত্রণে।

ওরা বলল মি. অনিকেত, আপনার ওই প্রোগ্রাম অর্থোডক্স প্রোগ্রাম। সেফ পিরিয়ড-এর কথাই বলেননি, এটার ডিফেন্সে কোনও কথাই হতে পারে না।

অনিকেত চুপ করে শুনে গেল। বুঝল, সেক্সুয়াল ‘এথিক্‌স’ শব্দটা থাইল্যান্ড-কাম্পুচিয়া- ফিলিপিন্‌স-এ প্রায় ন্যাপকিন হয়ে গিয়েছে।

এদেশেও তো কিশোর-কিশোরীদের পত্রিকায় কভার স্টোরি হচ্ছে ‘পটাও এবং ফোটাও’। ফিরে গেলে স্টেশন ডিরেক্টর জিগ্যেস করবেন, কেমন হল?

কী বলবে অনিকেত? বলবে—আমরা ব্যর্থ স্যর, আমরা ওই প্রোগ্রামটা করে অ্যাফ্রোডিজিয়াক ক্রিম-জেলি-টুনা-ডিল্ডোর বিক্রিটা বাড়াতে পারিনি। আমরা ব্যর্থ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *