হলদে গোলাপ – ১৫

১৫

আমি মঞ্জু। নাম শুনেই তো বোঝা যায় আমি হেলাফেলার মেয়ে। এসব দুয়ো-মেয়েদেরই নাম হয় : তপু, খেঁদি, ছায়া, মায়া, মঞ্জু। সুয়ো-মেয়েদের নাম অন্যরকম হয়। ওদের বাবা কত ভেবেচিন্তে, ডিকশনারি ঘেঁটে নাম রাখে। সুয়ো-মেয়েদের নাম হয় প্রিয়ংবদা, নন্দিনী, সেবন্তী, অনুরাধা—এইসব। ওদের সুন্দর-সুন্দর ডাকনামও হয়। টিয়া, মৌ, তোড়া এইসব। আমার একটাই নাম। মঞ্জু। ওটাই ভাল নাম, ওটাই ডাকনাম। ডিকশনারিতেই নেই। এই শব্দটার কোনও মানেই নেই। তার মানে মঞ্জু-র কোনও মানেই হয় না। আমার তো দাদা ছিল। তার মানে বাবা-মা পুত্রসন্তান পেয়ে গিয়েছিল প্রথমেই। আমি তৃতীয় সন্তান। দ্বিতীয় সন্তান ছিল একটি কন্যাসন্তান। এক বছর বয়সে মারা গিয়েছিল। ওই অকালে মরা মেয়েটার জন্য হা-হুতাশ শুনিনি তেমন, যেমন বিলাপ শুনেছি হাম-জ্বরে ছ’মাসে মরে যাওয়া ভাইটার জন্য। আমি আমার মায়ের পেটে, পরপর দু’বার হওয়া, দ্বিতীয় মেয়ে। ওরা নিশ্চয়ই ছেলেই চেয়েছিল। আমিই হয়ে গেলাম। আমি কী করব?

আমার বাবা ছিল কম্পাউন্ডার, যদিও গরিব মানুষরা বাবাকে ‘ডাক্তারবাবু’ বলেই ডাকত। বাবার একটা সাইকেল ছিল। ক্যারিয়ারে ব্যাগটা বসিয়ে সাইকেল চালিয়ে চলে যেত পুরকুরিয়া, হোগালিয়া, খাজাইতলা…। বাবার ব্যাগটায় থাকত কাচের ইঞ্জেকশন সিরিঞ্জ, ডিস্টিল্ড ওয়াটারের অ্যাম্পুল, তুলো-কাঁচি, গজ, ইথার, সাবান আর একটা ছোট মা কালীর ছবি রিকশাওলা, কাঠমিস্ত্রি, ঠিকে ঝি-রা আমাকে ডাকত ডাক্তারবাবুর মেয়ে। বাবার একটা বই ছিল। ‘সচিত্র অ্যালোপ্যাথি শিক্ষা’। ডা. স্বপন পান্ডে প্রণীত। বইটার প্রথম পাতাটা খুললেই একটা কঙ্কালের ছবি। আমি ছোটবেলায় বাবার বই খুলে দেখতাম সেই কঙ্কাল। বাবা বলত, ভাল করে লেখাপড়া কর। ডাক্তার হবি। বই খুলে দেখেছি পরিপাক তন্ত্র, রেচনতন্ত্র, জননতন্ত্রও দেখেছি। রেশন থলির মতো পাকস্থলী, জোড়া ঝুমঝুমির মতো ফুসফুস, কাঠবাদামের মতো কিডনি দেখেছি, জননতন্ত্রের ছবিগুলোও দেখেছি। লেবিয়া মেজোরা, লেবিয়া মাইনোরা, ক্লিটোরিস, সার্ভিক্স…। ওসব শুধু ছবি। পটে লিখা। আমার নিখিল ওতে অন্তরের মিল পায়নি। ওসব বাজে ছবি। খারাপ।

মা তো তা-ই শিখিয়েছে। বলত ওসব হল নোংরা জায়গা। রোজ-রোজ ইজেরটা কেচে দিতে হত। নোংরা জায়গায় হাত দিয়েছিল বলে জুঁইকে ওর মা খুব মেরেছিল। জুঁই আমার বন্ধু ছিল। রান্নাবাটি খেলতাম, পুতুল খেলতাম, পুতুলের বিয়ে দিতাম। একবার বিয়ের পর ও বলল, এবার মজা হবে। একটা কাঠের টুকরোর ওপর লাল শালুর টুকরো বিছিয়ে উঠোন থেকে টগর আর নন্দদুলাল ফুল ছিটিয়ে বলেছিল, এবার ফুলশয্যা হবে। বর-পুতুলটা আমার। এত যত্ন করে পরানো বর-পুতুলটার ধুতি খুলে দিয়েছিল জুঁই। ওর বউ-পুতুলটারও কাপড় খুলে ফেলল জুঁই। তারপর কাঠের টুকরোটার ওপর চিৎ করে শুইয়ে দিয়ে, বর-পুতুলটাকে তার ওপর উপুড় করে শুইয়ে দিয়েছিল। আমি বলেছিলাম এসব কী হচ্ছে, আমি খেলব না। ও বলেছিল ফুলশয্যা-খেলা তো এরকম করেই খেলতে হয়। আমি বলেছিলাম, এটা অসভ্য খেলা। আমি খেলব না।

বড় হয়ে তো আমাকে ফুলশয্যা-খেলা খেলতে হয়েছিল ওর সেই লাল হয়ে থাকা নোংরা জায়গাটায় চুমু খেতে বলেছিল। চুমু তো খেতে হয় আদর করে। আদর করতে গেলেই তো ঠোটটা সরু হয়ে যায়। আদর করেই তো বলি চুনু-মুনু-সুনু। চুনু-মুনু বলার সময় ঠোঁট দু’টো সরু হয়ে যায়। আমার বরটাও প্রথম প্রথম চুনু-মুনু করেই চুমু খেত। আমার ঠোটটা সরু হল না ওই নোংরা জায়গাটা দেখে। প্রথমদিন বর জোর করেনি, তারপর তো জোর করত। আমি একদিন কামড়ে দিয়েছিলাম। তারপর ও আমাকে মেরেছিল। থাপ্পড় মেরেছিল দু’গালে।

ওই যে জুঁইয়ের কথা বললাম, ওর সঙ্গে আড়ি হত, আবার ভাবও হত। জুঁই আমাকে বলত, তোর বাবা তো ডাক্তার, তুইও বেশ ডাক্তার হ। জুঁইদের একটা ঘর ছিল, ওই ঘরে কেউ থাকত না, হাবিজাবি জিনিসপত্র রাখা ছিল। ভাঙা আলনা, ট্রাঙ্ক, ড্রাম, পুরনো বই, এসব। ওই ঘরে নিয়ে গিয়েছিল জুঁই। জুঁই বলেছিল আমার জ্বর হয়েছে, থাম্মেটার দে। মৌরি লজেন্স-এর সরু কাচের নল দিয়ে বলেছিল, এটা বেশ থাম্মেটার, বগলে দে। দিয়েছিলাম। ও বলল, কত জ্বর? আমি বললাম, একশো। জুঁই বলল, তা হলে ইঞ্জেকশন দে। ও একটা ড্রপার নিয়ে এসেছিল। ও বলল, হাতে খুব ব্যথা, কোমরে দে। ও ওর লাল ইজেরটা খুলে ফেলেছিল। আমি ওর কোমরে ড্রপার দিয়ে ইঞ্জেকশন দিলাম, কোমরের তলায় কী সুন্দর গোলাকার জায়গা, যেন শ্বেতপদ্ম। ইঞ্জেকশনের জল পদ্মপাপড়ির গা বেয়ে সরু রেখায় গড়িয়ে পড়ছিল। আমি মুছে দিয়েছিলাম। জুঁই বলেছিল, ভাল করে মুছে দে। ম্যাসেজ করে দে, ইঞ্জেকশন দেওয়ার পর যেরকম করতে হয়, আমি তাই করেছিলাম। ঠিক সেই সময় জুঁইয়ের মা ঢুকেছিল ঘরে। ঢুকেই এরকম ভাবে আমাদের দেখল।

ওর মা চিৎকার করে উঠল। বলল, এসব কী হচ্ছে, অ্যাঁ? জুঁই বলেছিল ডাক্তার-ডাক্তার খেলছি। জুঁইয়ের মা আমাকে বলেছিল, তোর বাপ-মা তোকে এই শিক্ষে দিচ্ছে? যা— বেরো…।

আমার মা-কে নিশ্চয়ই জুঁইয়ের মা এসব বলেছিল। আমার মা আমাকে মেরেছিল। বলেছিল, এসব নোংরা কাজ কখনও করবি না। বলেছিল, ছিঃ, তোর ঘেন্না নেই? যেখান দিয়ে পাইখানা-পেচ্ছাপ বেরয় ওইসব জায়গা ঘাঁটা? এত নোংরা তুই?

আমি তো তখন একদম ছোট। তখনও বাবার ‘সচিত্র অ্যালোপ্যাথি শিক্ষা’ পড়িনি। জরায়ু, ডিম্বাশয়, শুক্রাশয় জানি না। লেবিয়া মেজোরা, লেবিয়া মাইনোরা-ও নয়। পরে যখন বাবার বইয়ের ওইসব ছবি দেখলাম, মনে হয়েছিল, নোংরা ছবি। ফুসফুস হৃৎপিন্ড, ওসব নোংরা নয় পাকস্থলীও নোংরা নয়। কিন্তু পাকস্থলীর শেষ প্রান্ত থেকে আঁকাবাঁকা নল যেখানে শেষ হয়েছে, সেই জায়গাটার নাম পায়ুছিদ্র। হ্যাঁ হ্যাঁ, একটা নোংরা জায়গা। ওখান দিয়ে গু বের হয়।

বাবা মাঝে-মাঝে এসে বলত, আজ ডুস দিয়ে বাহ্যি করিয়ে এলাম। মা বলত, চ্যান করে ঘরে ঢুকবে। আমরা তো বহুদিনের এদেশি। আমরা হলুম নস্কর বংশের। এইসব মুকুন্দপুর বলো, কালিকাপুর বলো, সবই আমাদের বংশের লোকের হাতেই ছিল। আমরা একটু ফকফকে থাকতে ভালবাসি। বাঙালদের মতো নোংরা থাকি না। আমরা কখনও হেগো-কাপড়ে থাকি না। পাইখানা যাওয়ার জন্য আলাদা গামছা থাকে। হয়ে গেলে, ধুয়ে দিতে হয়। বাঙালরা দিব্যি হেগো-কাপড়েই ঘুরে বেড়ায়। ডাবুদারাও বাঙাল। ওরা নাকি অনেকদিন আগে থেকেই এখানে আছে। নস্করদেরই কেউ জমিদারির হিসেবের কাজে ওদের আনিয়েছিল। বলতে গেলে, আমাদের কর্মচারী ওরা। কিন্তু আমাদের চেয়ে ওরাই ভাল আছে। ডাবুদার পিসেমশাইও তো বাঙাল। নোংরা। আমার যার সঙ্গে বিয়ে হল, কার্তিক, ডাকনাম কেতো, সেও বাঙাল। নইলে এত নোংরা হয়? যেখানে-সেখানে মুখ দেয়, আবার মুখ দিতেও বলে, নইলে জোরাজুরি করে। সব বাড়িতেই তো নর্দমা থাকে। নর্দমা দিয়েই তো খারাপ পদার্থগুলো বেরিয়ে যায়। কেউ কি নর্দমায় মুখ দেয়, না কি নর্দমার ধারে বসে ভাত খায়? মা আমাকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার শিক্ষা দিয়েছিল। মা বলত, মেয়েদের শরীরটা খুব নোংরা। দু’বেলা চান করতে হয়। আমি যখন বড় হলাম, মা একদিন বলল—নোংরা জায়গা থেকে যখন নোংরা-রক্ত চুঁইয়ে পড়বে, আমায় বলবি। যখন আমি এইট-এ, তখন একদিন ওরকম হল। মা-কে বললাম। মা তখন শিখিয়েছিল ন্যাকড়া দিয়ে কীভাবে জায়গাটা বেঁধে রাখতে হয়। মা বলল, মাসে-মাসে শরীরের বদরক্ত বেরিয়ে যায়। তখন মেয়েরা অশুচি হয়। রান্নাঘরে যেতে নেই, খাবার জিনিস ধরতে নেই। মা শিখিয়েছিল ওই নোংরা ন্যাকড়া কীভাবে লুকিয়ে-লুকিয়ে জলকাচা করে, কীভাবে লুকিয়ে- লুকিয়ে শুকোতে দিতে হয়। রান্নাঘরের পিছনে কুলঝোপে শুকোতে দিতাম। সবসময় শুকোতে না ভাল করে, ওটাই পরতাম। চুলকোত, কখনও পিঁপড়েও ধরত। কিন্তু চুলকোতে নেই। ওটা খুব অসভ্যতা। সহ্য করতে হয়। সহ্য করা শিখতে হয়। সহ্য করাই মেয়েদের গুণ। আমি তো গুণবতীই ছিলাম।

ঠাকমা বলত, সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে। আমার যখন খারাপ-রক্ত বেরতে শুরু করল, তখন বুঝলাম, আমিও রমণী হয়ে যাচ্ছি। শরীর পাল্টাতে লাগল। মা ঝালর-বসানো ফ্রক নিয়ে এল। ইস্কুলে নাইন থেকে শাড়ি। ব্লাউজের ভিতরে পরার জন্য ছোট-জামা নিয়ে এল মা। ওসব লুকিয়ে রাখতে হত শাড়ির ভাঁজের ভিতরে। মাও তাই করত। কিন্তু বাবার-দাদার জাঙ্গিয়া দিব্যি আলনাতেই থাকত, প্রকাশ্যে, সগর্বে।

ওরা তো গরমকালে খালি গায়ে থাকতে পারে। আমাদের জামা পরে থাকতে হয়। যখন রমণী হয়ে গেলাম, তখন টেপজামা পরেও থাকা যেত না। ওটার ওপর কিছু চাপাতে হত। ঘামাচি বেরত। পিঠে, বুকে এসব জায়গায় ঘামাচি বেরত। দুপুরবেলা মা ঝিনুক দিয়ে গেলে দিত, তারপর হাত বুলিয়ে দিত, তখন মনে হত মায়ের হাতে একটা মলম আছে, সেই মলমটা নাম মমতা। কুয়োর জলে অনেক জোছনা মিশে গেলে ওরকম মলম তৈরি হয়। আমি যেদিন কালসিটে-পড়া পিঠ নিয়ে বাড়ি এসেছিলাম, মা সেদিন যে মলম-মাখা হাত বুলিয়ে দিয়েছিল, সেখানে চোখের জলও ছিল। মা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, নারী জম্মো, নারী জম্মো।

যখন নাইন-এ, বাক্যরচনা করতে দিয়েছিল ‘নরক’। একটা মেয়ে লিখেছিল, নারী নরকের দ্বার। দিদিমণি বলেছিলেন—এটা লিখলে কেন? মেয়েটা বলেছিল বইতেই তো আছে, বলে প্রবাদ-প্রবচন অধ্যায়টা খুলে দেখিয়ে দিয়েছিল। ওখানে লেখাই ছিল ‘নারী নরকের দ্বার’। দিদিমণি আর কিছু বলেনি তখন। আমি তো তা-ই জানতাম। মেয়েরা নোংরা। মেয়েরা নরকের দ্বার। মেয়েরা বোকা, গবেট। ওই দাদুটাই তো প্রথম বলেছিল, তুই প্রাণদায়িনী। তুই দুর্গা। ওই দাদুটা যখন ওর গলার ক্যানসারের টিউমারটা আমার শরীরে স্পর্শ করতে-করতে বলছিল দুর্গে দুর্গে রক্ষণী স্বাহা, তখন ভেবেছিলাম আমাকেই দুর্গা ভেবে ওরকম বলছে। কুমারী পুজো হয়তো…। এখন জানি, সেই দুর্গা অচেনা দুর্গা, আর আমি চেনা ওষুধমাত্র ছিলাম, হিঞ্চে-ছেঁচা রস, পদ্মগুলঞ্চের জল।

আমার মা অনেকবার স্নান করত। ওই অভ্যেসটা আমারও হয়েছিল। ডাক্তার বলেছিল, ওটা বাতিক। মনের ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম পরিমলকে নিয়ে। ও কি যেতে চায়? উপোস করার ভয় দেখিয়ে, মরে যাওয়ার ভয় দেখিয়ে…। আমি বলতে চেয়েছিলাম, দেখুন না ডাক্তারবাবু, ছেলেটা কাজল পরে, পুরনো ‘সানন্দা’ কিনে এনে পড়ে। ভাল করে গুছিয়ে ওসব বলার আগেই ছেলেটা বলে দিয়েছিল, মা বারবার স্নান করে, বারবার বিছানার চাদর ধোয়। ডাক্তারটা আমাকেই জেরা করতে শুরু করল। বলল, এটা বাতিক। সেদিন ডাবুও বলল এটা বাতিক। বলল, এক ধরনের ম্যানিয়া। ও.সি.ডি.ই তো বলল, ওটা নাকি একটা মনের অসুখ। আমার স্বামীও তাই বলত। আমি যখন বলতাম, না, এসব করতে পারব না, ছিঃ, কী বীভৎস রুচি তোমার! তুমি একটা অসুস্থ লোক। ও উল্টে বলত, তুমিই অসুস্থ, তুমি বাতিকগ্রস্ত। বলত, তুই একটা ফালতু, ফালতু মেয়েছেলে। শালা বুড়োমারানি…।

‘বুড়োমারানি’ ওর খুব প্রিয় গালাগাল ছিল। সব বলেছিলাম কিনা, গা ঘেঁষে, একদিন সব বলেছিলাম…। না, সব নয়, শুধু দাদুটার কথাই বলেছিলাম, আর কারও কথা বলিনি।

ও বলেছিল—ওই বুড়ো তোমাকে চোদু পেয়ে জীবন বাঁচানোর ঘ্যাতড়া গেয়েছিল, আসলে ওর বুড়োবয়েসের ঘেয়ো ইঁদুরটা লাফাচ্ছিল। ওসব ব্যাং-ইঁদুর ভুলে যাও, ওসব সবার লাইফেই খুচখাচ হয়। তুমি সিংহ দেখ, সিংহ। কেশর ফোলানো।

বাবার ‘সচিত্র অ্যালোপ্যাথি’ বইতে একপাতা-জোড়া পুংজননতন্ত্রের ছবি আছে। কী নিরীহ দেখতে। গুটিসুটি হাবলু গাবলু, শীত-কাতুরে। কেমন বেচারার মতো ঝুলে থাকা। সামনে করবীফলের মতো দেখতে একটা অংশের নাম মুষ্ক। দু’পাশে যেন দু’টো সরস্বতী পুজোর কুল, ভিতরে আলপনা আঁকা। লেখা শুক্রগ্রন্থি। ওটা যে একেবারে আলাদা রূপ ধারণ করতে পারে, সেটা বুঝেছিলাম হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার পরই। মামাতো দাদাটা। ওর এক বন্ধুকেও নিয়ে এসেছিল সেদিন। বাড়িতে কেউ ছিল না। বলেছিল আয়, একটা জিনিস দেখাব। দেখিয়েছিল। তারপর ওরা জোর করেছিল। আমি চেঁচাইনি, কিন্তু আমার সারা শরীর চিৎকার করেছিল, শব্দ হয়নি। ‘ধর্ষণ” শব্দটার মানে বুঝেছিলাম সেদিন। মূর্ধন্য ষ-র ওপরের রেফ-টা যেন একটা কাঁটা বিষকাঁটা। কিংবা একটা ছুরি। মূর্ধন্য ষ অক্ষরটার ওপর আমূল বসে আছে। মানুষ শব্দটারও শেষ অক্ষর মূর্ধন্য ষ। তো, আমি কী করব? আমার সেদিন ভীষণ খারাপ লেগেছিল। খুব কষ্ট রক্ত। একটা রুমাল চেপে রক্ত মোছার চেষ্টা করেছিল দাদার বন্ধুটা। আমি থুথু ছিটিয়েছিলাম ওর মুখে। সেই রুমাল দিয়ে ও মুখ মুছেছিল। ওর মুখেও রক্ত লেগে গিয়েছিল। ও তখন ‘তবে রে’ বলে আমার ওপর আবার। আমি আমার একটা পায়ের ওপর আর একটা পা তুলে দিয়ে চেপেছিলাম। ওরা পা সরানোর চেষ্টা করছিল। উরুতে নখের দাগ। আফগানিস্তানে বোম পড়ছিল তখন। ওদের ঘরে খুলে-রাখা টিভিতে আগুনে ঝলসে যাওয়ার কথা শুনতে পাচ্ছিলাম। বোমা-গুলি-বারুদ আমার গায়েও লেগেছিল। আমার সারা গা জ্বলছিল। আমি চিৎকার করিনি, কিন্তু শরীরের ভিতর থেকে হাজার হাজার বছর আগেকার দ্রৌপদী চিৎকারের সঙ্গে মিশে থাকা সাইরেন বাজছিল, আমি শুনতে পাচ্ছিলাম। আমার উরু-নাভি-হাঁটু চটচট করছিল। আমার দিকে উঁচিয়েছিল অস্ত্র। পুং-ইন্দ্রিয়। এসব শুরু করার আগে মামাতো দাদাটা বলেছিল : বাঘ দেখবি, বাঘ? বাঘের লকলকে জিভ, থাবা, সব কিছুই তো দেখলাম সেদিন। আরও কী হত কে জানে, যদি না তখন কড়া নড়ে উঠত। পাড়ার কোনও বাড়ির সত্যনারায়ণ পুজো সেরে যদি তখন মামিমা না-এসে পড়ত। আমি তক্ষুনি কলঘরে ঢুকেছিলাম। মগ-মগ জল ঢেলেছিলাম। সাবানে জ্বালা করছিল আমার।

আমার বিয়ে হল। বিয়ে দেওয়া হল। ঘরে যুবতী মেয়েসন্তান, বিয়ে তো দিতেই হবে। ছেলের ব্যবসা। লোহার কারবার। নিজের লেদ মেশিন। স্বামীও তো বলেছিল সিংহ দেখাবে। আমার লোভ হত না কোনও বাঘ-সিংহ দর্শনে। আমি সে-খেলা করতে পারতাম না, যে-খেলা ওরা চায়। ভয়ে।

‘ট্রমা’ শব্দটা আমি খুব জানি। জীবনে কতবার শুনেছি। আমার মধ্যে কি ওটা আছে? ট্রমা শুনলেই কেন ট্রয় নগরীর কথা মনে হয় আমার? সেই কবে পড়েছিলাম স্কুলের ইতিহাস বইতে। ট্রয় নামে কোনও এক নগরী ছিল। এখন নেই। ম্যাপে নেই। কিন্তু আছে। এরা ইতিহাসে থাকে, স্মৃতিতে থাকে। ট্রমা কি ট্রয়ের মতোই? কোনও লুপ্ত ঐশ্বর্যের মতোই কিংবা দুঃস্বপ্নের মতো?

এক্কা দোক্কা তেক্কা…পাঞ্জা-ছক্কা সাগর। সাগর মানে একটা গোল দাগ। সাগরের সীমা। ওর মধ্যেই সেফটিপিন। সাগর থেকে সেফটিপিন কুড়িয়ে নিতাম। ছেলেরা দাঁড়িয়ে দেখত তেক্কা থেকে পাঞ্জায় লাফানো। জুঁইও তো লাফাত —কাঁপত। ঝালর-বসানো ফ্রকের তলায় আমারও কাঁপত। ডাবুদারা দেখত। জুঁইয়ের কানে-কানে বলেছিলাম : দ্যাখ, দেখছে। জুঁই আমার কানে – কানে বলেছিল, দেখার জিনিস দেখছে। ডাবুদা দেখতে ভাল, পড়াশোনায় ভাল, আমার যখন দান পড়ত, দেখে নিতাম ডাবুদা দেখছে তো? আমার কেমন যেন মনে হত জুঁইয়ের যখন দান পড়ত, তখন ডাবুদা বেশি করে দেখছে। জুঁইও কি তাই ভাবত? নইলে একদিন জুঁই হঠাৎ মুখ করল কেন—অ্যাই, তোদের লজ্জা করে না—মেয়েদের খেলা দেখছিস? তবু ওরা আমাদের দেখত। সোজাসুজি না-হলেও হয়তো বারান্দা থেকে, হয়তো জানালার শিকের ওধার থেকে। কখনও শিসের শব্দও ভেসে আসত। শিস নয়, সিটি। এক্কা-দোক্কার সাগরের ওপার থেকে। ওই মহাসিন্ধুর ওপার হতে কী সংগীত ভেসে আসে…। মা বলেছিল—মঞ্জু আর এক্কা-দোক্কা খেলতে হবে না রাস্তায় নেমে…। নস্করবাড়ির মেয়েরা কেন এসব নোংরামোর মধ্যে যাবে।

তবু খেলতাম। রাস্তায় নয়, ছাদে। ওখানে ছেলে-দর্শক ছিল না। দর্শক না-থাকার অভাববোধ তো ছিলই। তবুও একদিন এক্কা-দোক্কা কোর্টের সাগরের ওপর একটা ভাঁজ করা কাগজ পেয়েছিলাম। প্রেরকের নাম ছিল না। কাগজে ছিল, ‘বল তো দেখি আমার ফিতে ইংরিজি কী?”

‘ফিতে’ ইংরেজি কে না জানে, টেপ। আমার ফিতে’ মানে তো ‘মাই টেপ’। ইস কী অসভ্য, বলতে-বলতে হাসিতে গড়িয়ে পড়েছিলাম আমি, জুঁই, আর রানি।

সেই এক্কা-দোক্কা যুগটা কী সুখেরই না ছিল, কী মজার। সেই আলুকাবলি-দিন, সেই বৃষ্টিমাখা-দিন, সেই মহাসিন্ধুর ওপার থেকে শিস ভেসে আসা দিন এখন বিদিশা, মহেঞ্জোদাড়ো কিংবা ট্রয় নগরীতে আছে। সেই আলুকাবলি দিনগুলোর মধ্যেই সেই কণ্ঠী-গলার দাদু বলেছিল, জীবন দে।

‘আল্লা ম্যাঘ দে পানি দে ছায়া দে রে তুই’-এর মতোই। মহাসিন্ধুর ওপার থেকে ভেসে আসা সংগীতের মতোই দাদুটা বলেছিল, বাঁচা। আমি বিহ্বল। আমি নিরুপায়। নিরুপায় ভাবে ব্যবহৃত। ধর্ষণ? আইন অনুযায়ী নয়। ওখানে নাকি ‘পেনিট্রেশন’ শব্দটা আছে। লিঙ্গ প্রবিষ্ট হতে হবে। কিন্তু যে-লিঙ্গ প্রবিষ্ট হওয়ার ক্ষমতা রাখে না? সেটা কি ধর্ষণ নয়?

কিন্তু পেনিট্রেশন তো হয়েছিল। আমার মস্তিষ্কে। আমার চেতনায়। যেটা প্রবিষ্ট হয়েছিল, তার নাম ভয়।

এর ক’দিন পরই তো ডাবুদা। হ্যাঁ, হ্যাঁ ডাবুদা তুই। তোকেই তো বলছি এত কথা। উজাড় করে দিচ্ছি তোকে। তুই বাঘ-সিংহ কিছু দেখাসনি, কিন্তু আমার বিশ্বাস ভেঙেছিলি। এভাবে কাউকে বলতে হয়? মেয়েরা কি মেলার সাজানো বেলুন, বন্দুকের টিপ পরীক্ষা করার?

এর কিছু দিন পরই সেই মামার বাড়ি। বাবার ‘সহজ অ্যালোপাথি শিক্ষা’র পুংজনন ইন্দ্রিয় বই ছেড়ে সাপ হয়ে আমার কাছে আসত। ছোবল মারত। অসহ্য হয়ে উঠেছিল, মাইরি বলছি। ভালবাসতে পারিনি আমার স্বামীকে। একটু ভুল বললাম। ওকে ভালই তো বাসতাম। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতাম, মাথা টিপে দিতাম, ক্যাসেটে কিশোরকুমারের গান চালিয়ে দিতাম। ওর মদের জন্য আলুভাজা, ডালের বড়া ভেজে দিতাম। ওর পিঠে সাবান ঘষে দিতাম। দু’জনে একসঙ্গেও তো সাবান ঘষেছি। আমি ভালবাসতে পারিনি ‘সহজ অ্যালোপাথি শিক্ষা’-র ১৬ নং পৃষ্ঠাকে, বেরিয়ে আসা ওই বিচ্ছিরি প্রাণীটাকে। আমি ওটাকে ঠিক সহ্য করতে পারিনি প্রথমে। অথচ কী আশ্চর্য! আমার ছেলেটার শরীরে ওই পরাক্রান্ত যন্ত্রটাই দেখতে চাই, যাকে আমি ভালবাসিনি। আমি পরিমলের পরি হয়ে থাকাটা চাই না, কিছুতেই চাই না। তবে আমি কী চাই?

আমি কি চাই, ও কাউকে বলুক—

বাঘ দেখবি, বাঘ!

১৬

অনুষ্ঠানটা প্রায় শেষের দিকে। আর অল্প কয়েকটা পর্ব করলেই প্রোজেক্টটা শেষ। এই প্রোজেক্ট একটা অচেনা জগতের দরজা খুলে দিয়েছে। নিষিদ্ধ দরজাও বলা যেতে পারে।

সেদিন অফিসে ঢুকে লিফ্ট-এর দিকে যাওয়ার সময় চেঁচামেচি শুনতে পেল অনিকেত। চামড়া খুলে নেব, একদম চামড়া খুলে নেব…একটা গাট্টাগোট্টা লোক চিৎকার করছে। শোভন পাঠক নামে একজন ডিউটি অফিসার লোকটার সঙ্গে তর্ক করছেন, তর্ক নয়, বলা ভাল সামলানোর চেষ্টা করছেন। বলছেন—আপনার যা বক্তব্য লিখে দিয়ে যান, এটা প্রোটেক্টেড প্লেস, অ্যারেস্ট হয়ে যেতে পারেন। লোকটার এক সঙ্গী বলল অ্যারেস্ট-ই করুন। আইন অমান্য করছি। অন্য লোকটা বলল, লিখিত অভিযোগ তো এনেইছি, কিন্তু এতে কী হবে?

অনিকেত ওই দিকে যাচ্ছিল, কিন্তু শোভন পাঠক হাতের ইশারায় চলে যেতে বলে।

সেদিন মিটিং সরগরম। বিষয়টা ওই অনুষ্ঠান নিয়ে নয়, অন্য একটা অনুষ্ঠান নিয়ে। একটা পাঁচালি-ধর্মী অনুষ্ঠান হয়েছিল, ওটা শোভন পাঠকই প্রযোজনা করেছিলেন। ওঁরই লেখা। বিপদতারিণী দেবী এবং ওলাইচণ্ডী দেবীর কাব্যযুদ্ধ। ওলাইচণ্ডী হচ্ছেন কলেরার দেবী। দাস্ত- বমির ওই অসুখটাকে ওলাউঠা বলা হত। এখন যদিও কলেরা আর কলেরা নামে নেই। কিন্তু দাস্ত-বমিটা রয়েই গিয়েছে। এখন ওই রোগটাকে আন্ত্রিক বলা হয়। ওই পাঁচালিতে বিপদতারিণী দেবী ওলাইচণ্ডীকে হারিয়ে দেওয়ার জন্য ওআরএস-এর বিধান দিচ্ছেন। ‘ওআরএস’ হচ্ছে ‘ওরাল রিহাইড্রেশন সাপ্লিমেন্ট’। বিপদতারিণী দেবী গান গেয়ে ‘ওআরএস’ বোঝাচ্ছেন, এবং মাঝে-মধ্যেই ওলাইচণ্ডীকে গাল পাড়ছেন। ওলাইচণ্ডীও কম ঝগড়ুটে নয়। এইসব ঝগড়ায় মুখপুড়ি, ভাতারখাকি, ভাশুরশুঁকি ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এইসব শব্দ ব্যবহার নিয়ে আপত্তি তুললেন একজন প্রোগ্রাম অফিসার। অন্য একজন বলল, রেডিও- র কী অবনতি!

সত্যিই তো ‘শালা’ শব্দ আছে বলে রন্ধনশালা কেটে রান্নাঘর করতে হত, বালবাচ্চা কেটে বাচ্চাকাচ্চা, সেখানে এসব শব্দ?

একজন বলল, মুখপুড়ি ভাতারখাকি এখন কী এমন দোষ করল? যেসব অনুষ্ঠান হচ্ছে এখন, কোনও নোংরাই তো বাদ দিচ্ছেন না অনিকেতবাবু। একজন বললেন—আমাদের অনুষ্ঠানে ঠাকুর-দেবতা না-টেনে আনাই ভাল। মানুষের তো একটা সেন্টিমেন্ট আছে। হিন্দুধর্মটা সহনশীল বলে এসব চলছে।

অন্য একজন বললেন—গাঁয়ের কৃষ্ণযাত্রা-য় কৃষ্ণকে কত কী বলা হয়।

—শিবযাত্রায় শিব-পার্বতীর কোন্দল শুনেছেন?

—ওসব গেঁয়ো যাত্রায় হয়। তাই বলে রেডিওতে? স্টেশন ডিরেক্টর তেমন কোনও মন্তব্য করছেন না। শুধু বললেন, কোনও কিছুই তো আগের মতো থাকে না, রেডিও-র কী করে সব আগের মতো থাকবে?

একজন পুরনো অফিসার বললেন, আর দেড় বছর আছি। রিটায়ার করে বাঁচব। হোক, যা খুশি হোক। যে যা খুশি, তা-ই করুক। অনিকেতের দিকেই ওঁর চোখ। চামড়া বলে আর কিছু থাকল না। মিটিং শেষে চামড়া উঠিয়ে দেওয়ার কেসটা জানতে নিচে নামল অনিকেত। শোভন পাঠক একটা চিঠি ধরিয়ে দিলেন। ‘সর্বভারতীয় যোগ মহাসঙ্ঘ’ লেখা একটা প্যাড। এরপর ‘তমসো মা জ্যোতির্গময়’।

এরপর—মাননীয় কেন্দ্র অধিকর্তা, বেতার কেন্দ্র হইতে এরূপ অশ্লীল অনুষ্ঠান প্রচার করিতেছেন কেন? লজ্জা করে না? আমাদের যুবসমাজ অধঃপাতে যাইতেছে। কিছুদিন আগে একটি নাটকে অবিবাহিত যুগল ঘরে ঢুকিল। আপনারা খিল বন্ধ করিবার শব্দ শুনাইলেন। তারপর উঃ আঃ ইত্যাদি অশ্লীল শব্দ। বিবাহিত যুগল হইলেও এত আপত্তি ছিল না। আমাদের সভ্যরা বলিতেছিল রবিবার সকালে একটি অতি অসভ্য অনুষ্ঠান চলিতেছে। নিজে কানে শুনিলাম। শুনিয়া নিজের কানকে বিশ্বাস করিতে পারি নাই। আপনারা সমকামী ধরিয়া আনিলেন। ছিঃ। উহারা আবার বড় মুখ করিয়া নিজেদের কীর্তির কথা বলিল। জানি না কী করিয়া এইসব অ্যালাও করেন। অতঃপর পায়ুদেশের বর্ণনা। অবিলম্বে এইসব বন্ধ করুন নচেৎ আমরা সমবেত হইয়া ঘেরাও করিব।

ধন্যবাদ দিলাম না। কেন দিব?

শ্রীকান্ত হালদার।

কপি টু : মাননীয় রাজ্যপাল, পশ্চিমবঙ্গ

মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী শ্রী জ্যোতি বসু।

মাননীয় প্রধান বিচারপতি, কলিকাতা হাই কোর্ট,

চিঠিটা ভাঁজ করে পকেটে ঢোকাতে যাচ্ছিল অনিকেত, শোভন পাঠক বললেন—এটা তুমি

কোথায় ঢোকাচ্ছ।

কেন? পকেটে?

—পকেটে না, ওটা এসডি-র কাছে যাবে। ওঁকেই তো অ্যাড্রেস করা আছে। চিঠিটা ফেরত নেয়।

তোমার এই কেত্তন বন্ধ হচ্ছে কবে।

—হয়ে এল তো।

—যত তাড়াতাড়ি পারো শেষ করো। ঝক্কি তো আমাদেরই পোহাতে হয়…।

সত্যিই, ঝক্কি-ঝামেলা তো ডিউটি রুমকেই পোহাতে হয়। দরজা দিয়ে ঢুকে রিসেপশন, তারপরই ডিউটি রুম। ডিউটি রুম পেরিয়ে স্টুডিও। স্টুডিও-তে কে যাচ্ছে, কে আসছে, ডিউটি অফিসারদের লক্ষ রাখতে হয়, কোন স্টুডিওতে কী রেকর্ডিং হচ্ছে জানতে হয়। এমনকী কোন স্টুডিও থেকে কী সম্প্রচার হচ্ছে, তা-ও। ঘোষক-ঘোষিকারা ডিউটি রুমেই বসেন। বিদ্যুতের গোলযোগে অনুষ্ঠান সম্প্রচার বন্ধ হলে পাবলিকের গালাগালির ফোন এই ডিউটি রুমেই আসে। ‘কী মশাই, আপনারা বললেন ষাট কিলোমিটার বেগে ঝড় আসছে, বজ্রবিদ্যুৎ-সহ বৃষ্টি হবে। দরকারি কাজ ছিল, বেরলাম না, অথচ কি হল না। মিথ্যে কথা কেন বলেন মশাই?’ এটাও ওঁদেরই শুনতে হয়। অনিকেতকেও শুনতে হয়েছে। কারণ বেশ কয়েক বছর ওখানে কাজ করেছে ও। কত কিছু সামলেছে। দিল্লির রিলে চলছিল, ক্রিকেটের ধারাবিবরণী, বৃষ্টির জন্য খেলা বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু অ্যানাউন্সার নেই। অনিকেত-ই ছুটে গিয়ে বলে এসেছিল ‘খেলার জন্য বৃষ্টি বন্ধ।’ তাড়াহুড়োয় এটুকু ভুল হতেই পারে। সামলেছিল তো… কত কিছু সামলেছে। যখন রেডিও-র অ্যানাউন্সাররা দূরদর্শন-এর খবর পড়তেন, তখন ওঁদের মুখ দেখা যেত। ছন্দা সেন, তরুণ চক্রবর্তী, দেবাশিস বসু—এঁদের কী তুমুল জনপ্রিয়তা। টেলিভিশনকে তো পুষ্টি দিয়েছিল রেডিওই, পরে রেডিওকেই অপুষ্টি ধরল। যাই হোক, সেই তুমুল জনপ্রিয়তার সময়, একজন ভদ্রলোক ছন্দা সেন সম্পর্কে প্রবল উৎসাহী ছিলেন। মাঝে-মধ্যে ঠোঙায় করে আপেল-আঙুর নিয়ে আসতেন। বলতেন, কাল টিভিতে দেখলাম ছন্দা সেন বড় রোগা হয়ে গিয়েছে। মুখটাও শুকনো। মেক আপ করে আমার চোখকে কী করে ফাঁকি দেবে ও? ওকে এই ফলগুলো দেবেন।

ওই লোকগুলোকে সামলাতে হত। শুধু গলা শুনেও কেউ-কেউ প্রেমে পড়ে যেত। কানে শুনে প্রেমে পড়ে চোখের দেখা দেখতে আসত। ওদেরও সামলাতে হত। কত যে পাগল ঢুকে পড়ে, কেউ বলে—বলে দিন আমি নোবেল প্রাইজ পেয়েছি। কেউ বলে—আমার দুশ্চরিত্রা বউটাকে আপনাদের কাছে রেখে যেতে চাই। একজন একটা ঘটি নিয়ে এসে বলেছিল, শম্ভু মিত্র কখনও এলে বলতে, যেন কুলকুচি করে এই ঘটিতেই জল ফেলেন। ওঁর কুলকুচি করা জল দিয়ে গার্গল করব আমি…এরকম কত। আজও যোগগুরু শ্রীকান্ত হালদারকে সামলাতে হয়েছে ওঁদের।

পাঠক মশাই বললেন—শুনলে তো—বলেছে চামড়া ছাড়িয়ে নেবে….

—শুনলাম তো।

—তা তুমি চামড়া ছাড়াচ্ছ কবে?

–কীসের চামড়া?

—ইংরেজিতে বলব, নাকি বাংলায়?

—ও, বুঝে গিয়েছি, বুঝে গিয়েছি…বলতে হবে না। তো, কার চামড়া ছাড়াব?

তোমার ছাড়াতে হবে কি হবে না জানি না, তবে চামড়া ছাড়ানোটা বোধহয় হয়নি। করবে না কি একটা?

মন্দ বলেননি কিন্তু শোভনদা। ‘সারকামসিশন’-এর কথা বলতে চেয়েছেন। শুদ্ধ বাংলায় লিঙ্গাগ্রের ত্বকচ্ছেদ। মুসলমানরা যাকে সহজ করে বলে ‘সুন্নত’। লালনের গানে আছে সুন্নত করলে হয় মুসলমান নারী লোকের কী হয় প্রমাণ। কিন্তু সুন্নত মানেই ওই জায়গাটার ত্বকচ্ছেদ নয়। ‘সুন্নত’ হল যা করলে ভাল হয়, রসুল যা করা পছন্দ করতেন। ফর্জ হচ্ছে যা করতেই হয়। নামাজ রোজা জাকাত এসব হল ফর্জ। নামাজের সময় গোসল করতে হয়। গোসলের সময় কুলি করাই ফর্জ, কিন্তু হাতের কনুই পর্যন্ত ধোয়া সুন্নত। কিন্তু লিঙ্গাগ্র ছেদন তো সব মুসলমানকেই বোধহয় করতে হয়। ইহুদিদেরও। কোনও কোনও আদিবাসীদেরও অবশ্যকর্তব্য। এটা নাকি বিজ্ঞানসম্মত। নোংরা জমে না। আর অনেকে বলেন লিঙ্গমুণ্ড উন্মুক্ত থাকায় পোশাকের ঘর্ষণে কিছুটা ট্যান হয়ে যায়, ফলে সঙ্গমকালে অতি-অনুভূতিপ্রবণ থাকে না। আবার কিছু পুরুষের বড় হলেও পুরো খোলে না। বিয়ের পর কাটিয়ে নিতে হয়। ছোটবেলায় কাটিয়ে নিলে সমস্যা থাকে না। কিন্তু কাটানোটাই তো সমস্যা। বেতারে কি বলা যায়, কাটিয়ে নাও হে ভায়েরা? তবে ডাক্তারবাবুরা বলেছেন যখন সারকামসিশ্ব ব্যাপারটা ভালই, এ নিয়ে একদিন করা যেতেই পারে।

ঠিক সেদিনই সুধীর চক্রবর্তীর সঙ্গে দেখা। এখানে সাহিত্য বিভাগ আছে। একসময় এখানে প্রেমেন্দ্র মিত্র কাজ করেছেন, লীলা মজুমদার, কবিতা সিংহ…। অনিকেত সাহিত্যবিভাগে একটু আড্ডা মারতে গিয়েছিল। ওখানে বসেছিলেন সুধীর চক্রবর্তী। ওঁকে ডাকা হয়েছিল কিছু বিষয়ে বলার জন্য। অনিকেতের ধারণায় উনি হলেন একজন সর্বজ্ঞানী লোক। অনিকেত সুন্নত সম্পর্কে কিছু ফান্ডা চায়। সুধীরবাবু বলেন—একজন তরুণ লেখককে আমি জানি, ওর নাম আনসারউদ্দিন, ওকে বলব, ও তোমাকে লিখে জানিয়ে দেবে। আমার চেয়ে ও অনেক ভাল জানে বিষয়টা। তোমার ঠিকানা দাও।

সত্যিই, দিন দশেকের মধ্যেই আনসারউদ্দিনের একটা চিঠি পায় অনিকেত। আনসারউদ্দিন ওঁর অভিজ্ঞতার কথা লিখে জানান। এই লিঙ্গের চর্মচ্ছেদনের প্রচলিত নাম হল খত্না।

আনসার লেখেন : ‘আমার খত্না হয় আট বছর বয়সে। ফাল্গুন মাস। টানের মাস। কাঁচা ঘা এ সময় তাড়াতাড়ি শুকায়। এ কারণে ফাল্গুন মাসেই বেশি খত্না হয়। আল্লার আদেশ হল ফরজ, আর হজরত মহম্মদের নির্দেশ হল সুন্নত। খৎনা হল সুন্নত। খত্নার দিন নিকটজনদের দাওয়াত দেওয়া হয়। ওই আত্মীয়রা কেউ পুলিপিঠা বানিয়ে নিয়ে আসে, কেউ আনে মুরগি। খৎনার শিশুর জন্যও উপহার আনে। বড়লোকের বাড়ির ছেলেদের বড়লোক আত্মীয়রা আনে সোনার আংটি, ছেলের মামা হয়তো ভাগ্নের ‘খৎনা’-য় একটা সাইকেল উপহার দিয়ে দিল। আমি পেয়েছিলাম গোট চারেক গামছা, একটা পেন্টলুন আর দু’টো জামা। কোনও কোনও বাড়ির খত্না-র দিনে মাইক বাজে। মাইকে হিন্দি গান হয়, আবার বড়লোকের বেটি লো হয়। বড়লোকের বাড়ির খৎনায় সারা গ্রামের দাওয়াত হয়। দশ-বারোটা গরু কাটা হয়। বিয়ের উৎসবের মতোই বাজি পোড়ে। আসলে খৎনা আর বিয়ের মধ্যে একটা মিল আছে। দু’টো উৎসবই হল যৌনযাপনের স্বীকৃতি। খৎনা হওয়া মানে তোমার পুংলিঙ্গটি যথাযথ হল।

খৎনার অন্তত একমাস আগে ওস্তাদকে দাওয়াত দিতে হয়। একজন দক্ষ ওস্তাদের ওপর আস্থা রাখে ৩০-৪০টি গ্রাম। প্রতি ফাল্গুন-চৈত্রে একজন ওস্তাদ শ’খানেক লিঙ্গমুগুর চাম কাটেন। গাঁয়ের মানুষ ওস্তাদকে হাজাম বলেও ডাকে। হাজাম মানে নাপিত। আগে হাজামরা ই এই কর্ম করতেন। আমার যিনি খৎনা করেছিলেন ওঁর নাম লোকমান খালিফা। এই খালিফা সাহেব ষাট বছর ধরে আড়াইশো মুসলমান অধ্যুষিত গ্রামের খৎনার কাজ করে গিয়েছেন। জীবনের শেষ পাঁচ বছর অন্ধত্ব নিয়েও নাকি ওই পবিত্র কাজটি সমাধান করেছেন।

একজন দক্ষ খত্নাকার হিসেবে লোকমান খালিফা কিংবদন্তি হয়ে আছেন। তাঁকে দূর গ্রাম থেকে গরুর গাড়ি ভাড়া করে আনতে হত। শিশুর গোপনাঙ্গে হাত দেওয়া মাত্রই তিনি বুঝে যেতেন সেটি খৎনার উপযুক্ত হয়েছে কি না। লিঙ্গমুণ্ডের পূর্ণ বিকাশ না-হলে শলা ঘোরাতেন। শলা ঘোরানো ব্যাপারটা খুব যন্ত্রণাদায়ক। একটি সরু কাঠি চর্মাচ্ছদনীর ভিতরে ঢুকিয়ে এঁটে থাকা চামড়াটা ঢিলে করতে হয়। ওই ওস্তাদ সারা জীবনে কত চামড়া ছাড়িয়েছেন তার হিসেব করা মুশকিল। ছোটবেলায় খৎনার ব্যাপারে আমার ভীষণ ভয় ছিল। পাড়ায় ওস্তাদ বা হাজাম এসেছে শুনলেই পালাতাম। আইরি খেতের জঙ্গলে বসে থাকতাম। একবার পাশের বাড়ির ছেলেটার খত্না দেখেই এই ভয়টা হল। একদিন আমারও খত্নার দিন ঠিক হল। যাতে আমি না-পালাই এজন্য আগের দিন থেকে বাড়িতে বন্দি। আমার কাছে ওটা শাস্ত্রীয় ব্যাপার ছিল না, যেন মনে হত শহিদ হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। খত্নার দিন সকাল থেকে আত্মীয়স্বজনরা আসতে শুরু করেছে। আমাকে নতুন লাল গামছা আর নতুন গেঞ্জি পরানো হল। চোখে কাজল, লোকমান খালিফা ঘরে এলেন। লম্বা সাদা দাড়ি। গা থেকে আতরের গন্ধ আসছে। আমার কেবল মনে হচ্ছিল খালিফা ছুরি দিয়ে যা খুশি করুন, যেন করাত আনার কথা না বলেন। খালিফা সাহেব ন্যাকড়া পুড়িয়ে ছাই করলেন। বাইরে কুল কাঠের আগুন জ্বলছে। ঘরের বারান্দায় বিছানা পাতা। তার ওপর মায়ের হাতে বোনা নকশা করা কাঁথা। শিথানে এবং দু’পাশে দু’টো বালিশ। মেজোমামা আমার দুই হাত দুই ঠ্যাঙের মধ্য দিয়ে গলিয়ে পিছন থেকে সাপটে ধরলেন। লোকমান খালিফা আমার শিথিল অঙ্গটা নাড়াচাড়া করে বলে উঠলেন, এ যে কলার খোসার মতো। এক্ষুনি হয়ে যাবে। বুঝলাম শলা ঘোরানো থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। চোখ বাঁধা হল। কাঁথার ওপরে একটা কলাপাতা। কলাপাতার ওপরে আমার নিম্নদেশ। জিগ্যেস করা হল, কলমা জানো? আমি কাঁপা গলায় বললাম। লা ইলাহা ইলাল্লাহো যোহাম্মদুর রসুল্লাহ…তারপর বাংলায় বল্লাম—হে আল্লা, ব্যাথা দিওনাগো। আল্লা বাংলা ও বোঝেন নিশ্চই। একবার হে মা কালীও বলে ফেল্লাম। কলমা শেষ হতেই শুনি—ওই দ্যাখ তোর মাথার ওপর ফিচিং পাখি। চোখ বন্ধ অবস্থায় আমি মাথার ওপর তাকাই। আর তখনই আমি লিঙ্গে কিছু একটা অনুভব করি। এক মুহূর্তের যন্ত্রণা। আমার যখন চোখ খুলে দেওয়া হল, আমি বিছানায় কলাপাতা সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। যা রক্তপাত কলাপাতার ওপরেই পড়েছে। লক্ষ করি নিম্নাঙ্গে পোড়া ন্যাকড়ার বেষ্টনী। দুই মামা ছোট-ছোট বালির পুঁটলি কুল কাঠের আঁচে গরম করে চারপাশ সেঁক দিচ্ছে। সেদিন কিছুক্ষণ টনটন করেছিল। প্যান্ট পরার সময় প্রথম কয়েকটা দিন কেমন যেন সরসর করত। সাতদিন পর প্যান্ট পরা গেল। তারপরই অনেকটা ঠিকঠাক হয়ে যায়। পুরোপুরি সারতে—মাসখানেক লেগে যায়। ‘

অনেক কিছু জানা গেল। একটা আন্তরিক বর্ণনা দিয়েছে আনসারুদ্দিন। প্রচুর জ্ঞান হচ্ছে অনিকেতের। এইসব জ্ঞানকে কে কি জি কে, মানে ‘জেনারেল নলেজ’ বলা যায়? যদি অ্যাসিস্ট্যান্ট স্টেশন ডাইরেক্টর-এর জন্য ইন্টারভিউ দিতে যায়, ওকে কি কেউ জিগ্যেস করবে খৎনা কী? কোতি কাদের বলে? এসবও জিগ্যেস করবে, না ধান সেদ্ধ করার পাত্রকে কী বলে? জিরেন রস কাকে বলে? এই কাজ করতে এসে জিরেন রস থেকে মদন রস সব জেনে গিয়েছে অনিকেত। বেশ রসালো কাজ। অনিকেত ভাবে, আনসারুদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করে ওদের গ্রামে গিয়ে ‘ও.বি’ করবে। ‘ও.বি’ মানে বাইরে থেকে রেকর্ড করে আনা অনুষ্ঠান

পায়রাডাঙা থেকে ভ্যান রিকশায় মিনিট কুড়ি গিয়ে, তারপর মিনিট পনেরো হেঁটে একটা বাড়িতে পৌঁছনো গেল। টিনের ঘরের সামনে টিনের সাইনবোর্ডে লেখা ওস্তাদ নুর মহম্মদ আব্বাস। আগেই চিঠি লেখা ছিল। অনিকেতের সঙ্গে মনোজ নামে একটি লম্বা রোগামতো ছেলে। আব্বাস সাহেব আশাহত হলেন। হেঁটে-হেঁটে এসেছে রেডিও-র লোক। সঙ্গে একটা ছোট টেপ রেকর্ডার, যে মেশিনে ওরা হরবখত গান শোনে, ওইরকমই একটা মেশিন। উনি ঘরে বসালেন। শরবত হুকুম করলেন। খৎনা সম্পর্কে কিছু জানতে চাওয়া হচ্ছে শুনে উনি বললেন—আমাদের রসুল খৎনা-র সুপারিশ করে গিয়েছেন, সুতরাং এটা করতেই হয়। যেসব বাচ্চার খত্না হওয়ার আগেই ইন্তেকাল হয়েছে, শেষ বিচারের আগে ওদের অবশ্যই খৎনা করতে হবে। নইলে বেহেস্তে যাওয়া যাবে না। আব্বাস সাহেব বললেন—’আমারও নিস্তার নাই রে ভাই, কবর থে উঠে আমরেও ছুরি ধরতি হবে। বেখৎনা বাচ্চাগুলোকে খত্না না করি দিলে তো ওদের গতি হবে নে।’

—কিছু অ্যান্টিসেপটিক দেন?

—ওসব কিছু লাগে না। কলমা পড়ে ফুঁ দিই। খৎনার পর ত্যানাপোড়া ছাই আর গ্যাদা গাছের পাতা থুপে লাগিয়ে দিই। ওতেই ফতে হয়ি যায়।,

—কত মজুরি নেন?

—-ওটা মজুরি না। এই নেক কাজের মজুরি হয়? এটা একটা ইমানদারি। পঁচাত্তর, একশো, দেড়শো—যে যা পারে দেয়। এই টাকা সবাই হাসিমুখে দেয়। যখন ছেলের বে দেবে, বিশহাজার পণ হাঁকবে।

এসব কথাবার্তার মধ্যেখানে অনিকেত জিগ্যেস করে ফেলেছিল—আপনি কি অণ্ডকোষ ও কাটতে পারেন?

‘তওবা’ ‘তওবা’ বলে উঠেছিলেন আব্বাস সাহেব। ওটা কাটার কথা উঠে ক্যান, অ্যাঁ? ওটা কাটতে হয়?

‘সরি’ ‘সরি’ বলে উঠল অনিকেত।

উনি আবার বললেন—নাউজুবিল্লা, নাউজুবিল্লা।

চোখ বড়-বড় করে তাকিয়ে আছেন। এরপর আর খুব একটা কথা এগোয় না। ভেবেছিল বলবে, সামনে কোনও খত্না-র অনুষ্ঠান আছে কি না, তা হলে সেটা রেকর্ড করে রাখবে। ‘সালাম’ জানিয়ে ফিরে আসে অনিকেত। আসলে অনিকেত জেনেছিল লিঙ্গান্তরকামী পুরুষেরা ওদের অণ্ডকোষসহ লিঙ্গচ্ছেদন করে গোপনে। কিন্তু এটা তো অধর্মীয়। একজন ধর্মীয় খৎনাকারীর কাছে এই প্রশ্নটা অন্যায়। অনিকেতের নিজের কাজে নিজের খুব খারাপ লাগল।

অঞ্চলটা মুসলিম প্রধান। একটা মাঠের এক কোণে তাজিয়ার কাঠামো পড়েছিল। একটা পাঁচিলের গায়ে, কোথায় যেন উরস হবে, সেটা সাঁটানো আছে। পায়রাডাঙার কাছে এসে দেখল একটা ডাক্তারখানা। ডা. আজিজুল হক, এফআইসিপি। ‘এফআইসিপি’ কী ব্যাপার কে জানে? ‘পি’-তে প্র্যাকটিশনার হতে পারে। যাবতীয় রোগের চিকিৎসা-সহ সুন্নত করা হয়।

সুন্নত দেখে ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকল অনিকেত। ওটা চেম্বার কাম বাড়ি কাম পোলট্রি। লম্বা বারান্দার এক কোণে খাঁচার ভিতরে মুরগি। আর এক কোণে ক্রস লাগানো দরজা। রেডিওর লোক শুনে দরজা খুলে দিল। তখন খুব পাত্তা পেত রেডিওর লোকরা। —সুন্নতও করেন?

—করি বইকি।

–কী করে করেন?

—আপনি তো হিন্দু…

—হ্যাঁ।

—তবে করালেই বুঝবেন কী করে করি। করাবেন? ডাক্তারটি বেশ রসিক। হাসছেন। বয়েস চল্লিশের মতো। অনিকেতও হে-হে করল।

ডাক্তারটি বলল, আমরা কিন্তু প্রথমেই টেডভ্যাক দিয়ে দিই। হাজামদের মতো নয়। রেকর্ডার অন করে মনোজ।

টেডভ্যাক দিয়ে দেওয়ার পর ইসপিরিট দিয়ে জায়গাটা পরিষ্কার করি। তারপর আয়াত পড়ে যন্তরের সাহায্যে খত্না করি। অ্যান্টিবায়োটিক মলম দিই। অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ খেতে দিই। ব্যান্ডেজ করে দিই। পানি কম খেতে বলি যাতে প্রেসাবের বেগ কম পায়। সাতদিনে আরাম। হাজামের কাছে খত্না করালে একমাস লাগে ঘা শুকোতে। আমি ভাল দাবাই দিয়ে দিই। তবু কিছু লোক আছে এখনও পুরনো কায়দায় সুন্নত করায়।

ব্যস, মেটেরিয়াল পেয়ে গেল অনিকেত। এই রেকর্ডিংটাই সাজিয়ে-গুছিয়ে, কিছুটা ন্যারেশন আর মিউজিক দিয়ে দিলেই তৈরি হয়ে যাবে প্রোগ্রাম।

বন্ধুরা, লিঙ্গমুণ্ডের অগ্রভাগের চামড়া অনেকের এমনিতেই বড় হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে উন্মুক্ত হয়ে যায়, অনেকের হয় না। অনেকের এত সেঁটে থাকে যে প্রয়োজন মতো খোলে না। এই অবস্থাকে বলে ফাইমোসিস। তখন সামান্য শল্য চিকিৎসার সাহায্য নিতে হয়। কিছু-কিছু ধর্মীয় বিধান অনুসারে শিশু বয়েসেই লিঙ্গমুণ্ডের আবরক চামড়া সামান্য কেটে দেওয়া হয়। মুসলিম ধর্মে এর নাম খত্না। সুন্নত-ও বলা হয়। এখন আধুনিক উপায়েও সুন্নত করা যায়…এরপর ইন্টারভিউটা…।

‘বোম্বে দোস্ত’ একটি সমকামীদের পত্রিকা। ওর একটা সংখ্যায় অনিকেত দেখেছিল যারা পায়ুসঙ্গম করে ওদের লিঙ্গ মুক্ষ অনাবৃত হওয়া উচিত। নইলে রক্তপাতের সম্ভাবনা আছে, এবং তাতে এইডস্ এর সম্ভাবনাও বাড়ে। আর সমকামীদের মধ্যে যাঁরা বটম শ্রেণির, মানে অনুপ্রবিষ্ঠ করাতে ভালবাসে, ওরা আচ্ছাদনহীন লিঙ্গ পছন্দ করে। কিন্তু এসব কথা রেডিও-তে নয়। রেডিওতে পায়ুসঙ্গমের বিপদের কথাই বলা হবে। অনিকেতের একবার মনে হল মঞ্জুর ছেলেটাকে এই বিপদের কথাটা জানিয়ে দেয়া উচিত। কিন্তু কী করে জানাবে?

কমল গুপ্ত নামে এক রসিক অ্যানাউন্সার একবার বলেছিল—’ঘর মুখো গাই, আর নাই মুখো মাই’ আটকানো যায় না। পায়ুমুখো লিঙ্গগুলিকে এইড্‌স-এর ভয় দেখিয়ে হয়তো কিছুটা চেষ্টা করা যেতে পারে, কিন্তু যে ছেলেগুলো মনেপ্রাণে মেয়ে, যাদের যোনিছিদ্র নেই, ওদের তো পায়ু আছে শুধু, —ওদের কী হবে?

—কে জানে কী হবে? পরের পর্বটা তৈরি করে শোভন পাঠককে অনিকেত বলে, চামড়া ছাড়িয়ে দিলাম দাদা।

১৭

অনিকেতের বেশ কয়েকটা নতুন নাম হয়েছে। অফিসের সনৎদা ওকে ডাকে ডা. লামা। কখনও ডা. লোধ। শুক্লা কখনও রেগে-টেগে গেলে বলে ‘ভাম’ কোথাকার। কেন ‘ভাম’ বলে কে জানে? জিগ্যেস করা যায়নি। জিগ্যেস করলেও, ঠিকঠাক উত্তর পেত বলে মনে হয় না। “ভাম’ হল এমন একটা প্রাণী, চুপচাপ ছোটখাটো শিকার করে। দেখলে নিরীহ মনে হয়। ‘ভাম’-এর আগে সাধারণত বুড়ো শব্দটা লাগিয়ে ‘বুড়োভাম’ বলারই রেওয়াজ বেশি। শুক্লা ‘বুড়োভাম’ বলছে না। শুধু ‘ভাম’। তবে কি তার ভাম ভীম-জাত? ভীম বোধহয় ভীমরতির সংক্ষিপ্ত রূপ। কিন্তু সনৎদা যে নতুন নামে আজকাল ডাকতে শুরু করেছে, এর ব্যঞ্জনা স্পষ্ট। ডা. লামা এবং ডা. লোধ দু’জনেরই খুব বিজ্ঞাপন বের হয় সেক্সোলজিস্ট হিসেবে। যাবতীয় যৌনরোগ ও যৌন-সমস্যার সমাধান। অনিকেত জিগ্যেস করে, বলুন সনৎদা, আপনার কী সমস্যা? সনদা বলে—আমার সমস্যার তুই কিছু করতে পারবি না। একমাত্র ও-ই যদি সল্ভ করতে পারে। খবরকাগজের সিনেমার পাতার এক হিরোইনের দিকে ওর আঙুল। অন্য এক সহকর্মী ওকে দেখলেই আজকাল বলে হিজুমে’। ছেলেটি কিছুদিন সাঁওতালি বিভাগে কাজ করেছিল, কয়েকটি সাঁওতালি শব্দ শিখেছে। ‘হিজুমে’ একটা সাঁওতালি শব্দ। মানে ‘এদিকে এসো। ‘হিজড়ে’ শব্দটার সঙ্গে ধ্বনিগত মিলের কারণেই ‘হিজুমে’ সম্বোধন। ওর সঙ্গে দেখা হয়েছিল চেতলায়। হিজড়ে পাড়ার কাছে। এদিকে কোথায়? এর উত্তরে অনিকেত বলেছিল—একটু ও-পাড়ায় গিয়েছিলাম।

—ও-পাড়ায় বলতে?

—হিজড়ে পাড়ায়।

ব্যস, হয়ে গেল।

কিছুকাল আগে একটা সিনেমা এসেছিল ‘সড়ক’। এক হিজড়ে চরিত্রে অভিনয় করার জন্য সদাশিব অভ্রপুরকর কিছু একটা পুরস্কারও পেয়েছিলেন। পরিচালক ছিলেন মহেশ ভাট। কিন্তু চরিত্রটা যেন লোক হাসানোর জন্যই তৈরি করা হয়েছিল। দর্শকের কোনও সহানুভূতি তৈরি হয় না ওদের প্রতি।

একদিন শিয়ালদার কাছে রাস্তা পার হতে যাওয়া একটা বাচ্চাকে ছুটে গিয়ে হাত ধরে টেনে আনতে দেখেছিল একটি হিজড়ে-কে। বাচ্চাটার বিপদ হতে পারত। বেশ সাহসিকতার কাজই করেছিল হিজড়েটি। অথচ ‘নপুংসক’ বলে একটি গালাগালি আছে, ভিতু-পুরুষদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। হিজড়েদের অপর নাম নপুংসক। আবার ভিতুদেরও নপুংসক বলা হয়। কিন্তু অনিকেতের ধারণায়, হিজড়েরা ভিতু নয়। ট্রেনে যখন ওরা তোলা আদায় করে, কিংবা যখন ঝগড়াঝাঁটি করে, তখন তো ভিতু বলে মনে হয় না। অনেক হিজড়েই লিঙ্গচ্ছেদ করে। ভিতু লোকরা একটা ইনজেকশন নিতেও ভয় পায়। কিন্তু ভয়কে কতটা জয় করতে পারলে লিঙ্গচ্ছেদনের মতো একটা কাজ করতে পারে ওরা!

হিজড়েরা তো বেশির ভাগেই লিঙ্গান্তরকামী। এই ধরনের কয়েকজনের সঙ্গে তো আগেই কথাবার্তা হয়েছে অনিকেতের। কিন্তু ওরা সবাই লেখাপড়া জানা। কেউ-কেউ ভাল চাকরি- বাকরিও করে। কিন্তু রাস্তায় যারা উগ্র সাজে ঘোরে, হাততালি দেয় একটা অদ্ভুত শব্দে, বাচ্চা নাচায়, ওরা নাকি একসঙ্গে থাকে। মূল সমাজে ওরা পাত্তা পায়নি, প্যাঁক খেয়েছে পাড়ায়, অবজ্ঞা পেয়েছে পরিজনদের কাছে, তারপর হয়তো হিজড়েদের দলে গিয়ে নাম লিখিয়েছে। ওখানে একটা সমাজ পেয়েছে ওরা, বন্ধু পেয়েছে, মনখারাপ দেওয়া-নেওয়া করতে পেরেছে, মনের খুশি লোফালুফি করতে পেরেছে, মানে বন্ধু পেয়েছে, হইচই পেয়েছে, যাকে এককথায় বলা যায় ‘মস্তি’।

একটা সময় অনিকেত শুনত এবং বিশ্বাসও করত যে, হিজড়েরা যখন ‘কার হোলো গো…’ বলতে-বলতে হাততালি মেরে বাড়ি-বাড়ি ঘোরে তখন যদি দেখে কোনও শিশু লিঙ্গহীন, বা উভলিঙ্গ—তখন ওরা বাচ্চাটাকে চেয়ে নেয়, এবং বাচ্চার মা-বাবাও ওদের দিয়ে দেয়। এখন জেনেছে, এটা বাজে কথা। ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলেছিলেন, যতদিন বাঁচি ততদিন শিখি। মাও সে তুং-ও বলেছিলেন, নিরক্ষরদের থেকে জ্ঞান নাও। এই বয়সেও ওকে কত কী জানতে হচ্ছে। জানতে ইচ্ছে করছে যে। রাস্তায় যেসব হিজড়ে ঘুরে বেড়ায়, ওদের কাছে গিয়ে তো জিগ্যেস করা যায় না : হিজড়া, তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ? বললে বলবে, তোমার বাপের পিছন হইতে। ওরা বড্ড খিস্তি দেয়। চেতলা অঞ্চলে ওদের একটা ডেরা আছে। ওদের ডেরার পাশে ঘুরঘুর করেছে, ভিতরে ঢোকার সাহস হচ্ছিল না। মনে সাহস পাম্প করে ঢুকেছিল, হাতে প্যাড আর কলম। দরজা দিয়ে ঢুকে একটা উঠোন, উঠোনের তিনদিকে তিনটে টিনের চালার ঘর। উঠোনে একটা নিমগাছের তলায় খাটিয়া পাতা, খাটিয়ার ওপর লুঙ্গি আর গেঞ্জি-পরা একজন বিড়ি খাচ্ছে। তখন বেলা দশটা মতো। গেঞ্জিটা ছেলেদের গেঞ্জির মতো নয়। ও কোনও কথা না-বলে সুড়সুড় করে ঘরের ভিতরে ঢুকে গেল। ঘর থেকে শাড়ি পরা একজন বেরিয়ে এল, গরমকাল বলেই হয়তো, ব্লাউজ নেই। ঠাকুমা-দিদিমারা যেভাবে শাড়ি পরতেন, সেই স্টাইলে পরা শাড়ি। বয়সটাও পঞ্চাশের ওপর। লম্বা চুল। বারান্দার ওপর থেকেই চেঁচিয়ে উঠল—অ্যাই? কী হল?

—কিছু কথা ছিল।

অনিকেত শুনেছিল ওদের গুরুমা-রাই হচ্ছে ওদের লিডার।

বলল, গুরুমা-র সঙ্গে দেখা করব।

—আমি-ই গুরুমা

প্যাডটা বাঁ হাতে, ডানহাতে কলম। প্যাডের ওপর ১-২-৩-৪ করে প্রশ্ন লেখা—সমাজে নতুন হিজড়েরা কোথা থেকে আসে? হিজড়েরা কি সবাই সমকামী হয়? যেসব হিজড়ের পুরুষাঙ্গ আছে তারা কি উভকামীও হতে পারে কখনও? হিজড়েদের নিয়মকানুন….?

গুরুমা বলল, থানায় নতুন আমদানি? গত মাসেরটা তো দিয়ে দিয়েছি…

না, আমি থানা থেকে না। অনিকেতের নিজের ওপর একটা ইয়ে হল। ওকে পুলিশ ভাবল? ও কি পুলিশদের মতো দেখতে? নিজের আঁতেল-সত্তায় শ্রদ্ধা হারাল।

–থানা থেকে নয়। তবে কোন চুলো থেকে?

—আমি সাংবাদিক।

—সাংবাদিক–তো, সোগামারানির একেনে কী দরকার? কতা? ভাগো, সরে পড়ো…

সরে পড়ে। আর তখনই সেই সহকর্মীর সঙ্গে দেখা, কিছুদিন পর দ্বিতীয়বারের জন্যও। একই জায়গায়, সেই হিজড়ে পাড়ায়। কারণ ও হাল ছাড়েনি। সুমন চট্টোপাধ্যায়ের ক্যাসেটটা ততদিনে বেরিয়ে গিয়েছে, এবং তোলপাড়। তাই হাল ছাড়েনি। জোরে কণ্ঠ ছাড়া ওসব পাড়ায় খুব মুশকিল। এরকম বার দুয়েক দেখা হওয়ার পর থেকেই ‘হিজুমে’ সম্বোধন

চেতলার ওই ঘরটা থেকে বেরিয়ে এসে দেখল, একটা মুদি দোকানে একটা হিজড়ে তেল, ডাল, পেঁয়াজ এসব কিনছে, সবাই যেমন কেনে। ওখানে একটু দাঁড়াল। হিজড়েটা বলে যাচ্ছে—রসুন এক টাকার, চিনি দু’টাকার, চা পাত্তি দু’টাকা, টুপি ছ’টা।

দোকানদার বলল, ভাল জিনিস দেব?

—কোন ভাল জিনিসটা শুনি?

—কোহিনুর ….

—না বাবা, অত ফুটুনির কাজ নেই, নিরোধ দাও…।

কথা বলার ইচ্ছে ছিল, বলতে পারল না। কী স্বাভাবিক ভাবে তেল-মশলার সঙ্গে কন্ডোম কিনে নিয়ে যাচ্ছে। তার মানে, এই মুদি দোকানওলা নিশ্চয়ই জানে যে এরা পিছন-কর্ম করে। হিজড়েটি চলে গেলে অনিকেত দোকানদারটিকে জিগ্যেস করে—এরা সব আপনার খদ্দের?

দোকানদার উত্তর দেয় না। দোকানের তাক সাজাতে ব্যস্ত থাকে। অনিকেত জিগ্যেস করে, এরা এখানে কতজন আছে?

দোকানদার বলে, আপনার কী দরকার? —আমি সাংবাদিক।

—বিশ-পঁচিশজন আছে।

হলদে গোলাপ

‘আমি সাংবাদিক’ না-বললে দোকানদারও ফুটিয়ে দিত। কিন্তু ওরা সাংবাদিক শুনেও ফুটিয়ে দিয়েছিল খিস্তি মেরে।

—ওরা তো বেরিয়ে যায়। কখন বেরয়?

—ন’টা…দশটা…।

—কখন ফেরে?

—আমি কি জিম্মাদরি নিয়েছি নাকি, সব জানতে হবে?

—তা তো ঠিক। বলছি, ওদের গুরুমা-র সঙ্গে একটু কথা বলিয়ে দেবেন?

—না। আমি ওদের ঘরেও যাই না। আপনি আসুন।

অনিকেত চলে যায়। ও ভাবে—রঞ্জন, পবন, অনির্বাণ, বাসব, এদের সঙ্গে তো পরিচয় আছেই, ওদের কাছ থেকে জেনে নেবে। কিন্তু এটাও ঠিক, এখানেও একটা শ্রেণিবৈষম্য আছে। ওরা হল ‘গে’। ওরা অভিজাত। ওরা ইংরেজি বলতে পারে, কেউ-কেউ ভাল চাকরি করে, চাউ-পিৎজা-বার্গার-আইসক্রিম খায়। ওরা কোহিনুর-কে ‘ফুটুনি’ ভাবে না, আরও ভাল কিছু কিনতে পারে। ওদের সঙ্গে এদের অনেক তফাত। ওরা এদের কথা জানে না।

একদিন অনিকেতের মনে পড়ল ওর স্কুলের এক সহপাঠী পুলিশে চাকরি পেয়েছিল। ওকে ‘মুচো’ বলে ডাকা হত। মুচো নামের উৎপত্তি মোচ বা গোঁফ থেকে নয়। ওকে মুরগি চোর বলে ডাকা হত। কেন যে ডাকা হত কে জানে? সংক্ষেপে ‘মুচো’। ও পুলিশে চাকরি পেয়েছিল। মুচো-র ভাল নামটা কিছুতেই মনে পড়ছিল না।

অবশেষে খোঁজখবর করে জানতে পারল, মুচো এখন চেতলা থানারই ওসি। নারায়ণ বিশ্বাস। অফিসের গাড়িটা নিয়ে হাজির হল চেতলা থানায়। গাড়িটা নিল—যাতে ওসি একটু পাত্তা দেয়।

মুচো চিনতে পারল অনিকেতকে।

স্কুল-জীবনের সহপাঠীদের সঙ্গে দেখা হলে স্যরদের কথা ওঠে, দুষ্টুমি, এইসব। এসব কথা ওঠার আগেই অনিকেত বলল, আমায় একটু হেল্প করবি?

—পুলিশের কাছে এসেছিস যখন নিশ্চয়ই কোনও বিপদে পড়েছিস। কী হয়েছে?

অনিকেত বলল—আমাকে একটু হিজড়ে পাড়ায় এন্ট্রি করিয়ে দিবি? তোর এলাকায় তো হিজড়ে পাড়া আছে।

অবাক হয়ে তাকায় মুচো।

অনিকেতের মনে হয় এই মুহূর্তে প্রসঙ্গ উল্লেখ-সহ ব্যাখ্যা করা দরকার, কিংবা সরলার্থ, কিংবা ভাবার্থ। কিন্তু ‘কমন’ না-আসা প্রশ্নের উত্তর-অপারগ বেচারার কলম কামড়ে থাকার মতো মুখ করে বসে থাকে।

—হিজড়ে কী হবে তোর? তুই তো খুব ভাল ছেলে ছিলি রে অনিকেত?

অনিকেতের সঙ্গে মুচোর দেখা বহুদিন পর। কালের ব্যবধানে কার কী হাল হয় কে জানে? ইতিবৃত্ত বলতে গেলে অনেক কথাই বলতে হয়। তবে রেডিওতে চাকরির কারণে ছোট করে বলাটা রপ্ত হয়েছে। কারণ পাঁচ মিনিট, ন’মিনিট, তেরো মিনিট ইত্যাদি সময় অনুসারে ফিড করার ব্যাপারে একটা পারদর্শিতা জন্মেছে। ও চার মিনিটের চাংক-এ ব্যাপারটা বোঝাল। মুচো বলল—হিজড়েদের জীবন যন্তরনা চাই? তুই কি লেখকও হয়েছিস নাকি? এসব কাগজ- রেডিও-টিভিতে যারা করে খায়, ওরা নাকি আবার লেখকও হয়। মুচিপাড়া থানায় যখন ডিউটি ছিল, তখন বেশ কয়েকবার হাড়কাটা রেইড করেছিলাম। প্রায় প্রতিবার দু-এক পিস কবি- সাহিত্যিক পেয়েছিলাম। সবাই বলেছে জীবন যন্তরনা চাই। যন্তর চাই কেউ বলে না—সব বলে যন্তরনা চাই।

তারপর ওর এক রেইড-করা আখ্যান ব্যাখ্যান করে বলতে লাগল।

মুচো একটু বেশি কথা বলে। ওকে পাঁচ মিনিটের চাংক-এ কোনও টক দিলে নির্ঘাত প্রচুর এডিট করতে হবে। তারপর মুচো জিগ্যেস করল, অ্যাকচুয়ালি তুই কী চাস বল তো? তুই কি ডাব্লডেকার?

‘ডাব্লডেকার’ শব্দটার অর্থ ও জানে। গে-দের কোনও এক পত্রিকায় শব্দটা পেয়েছিল। মানে যারা সামনে এবং পেছনে—দু-জায়গাতেই অভ্যস্ত। উভকামী আর কি। জোরে মাথা নাড়ায় অনিকেত। বলল, জাস্ট কিছু ইনফর্মেশন নেব। কিছু প্রশ্ন লেখা আছে। আমি একবার গিয়েছিলাম, ফুটিয়ে দিয়েছে। শুনেছি থানার সঙ্গে ওদের একটা ইয়ে থাকে অনেক সময়। সঙ্গে পুলিশ যদি থাকে, তা হলে হয়তো কিছু বলতে পারে।

মুচো হাসল। বলল, ওক্কে ওক্কে। বুঝেছি। একজন কনস্টেবল ওদিকটা বিট করে, ওকে ফিট করে দিচ্ছি তোর সঙ্গে। চা খা।

ঘরে মুচো ছাড়া আর কেউ ছিল না। ও বলল—ওর সঙ্গে ঘ্যাম নিয়ে থাকবি। বেশি কথা বলবি না। কারণ কী, আমি ওসি, তুই আমার বন্ধু। এসব পয়দা আমি ছুই না। ছুটকো। থ্রি সেভেন্টি সেভেন-এ পয়সা নেই। ওরা যা পারে করুগ গে…।

—মানে?

—মানে, আইপিসি থ্রি সেভেন্টি সেভেন হল একটা কুমিরছানা, যেটা দেখিয়ে দু-চার পয়সা পাওয়া যায়। মানে, এই আইনে উল্টোপাল্টা সেক্স বেআইনি। উল্টোপাল্টা মানে উল্টোদিকে। হিজড়ে-বৃত্তি কিন্তু বেআইনি নয়। এর এগেনস্টে কোনও আইন নেই। ছেলে নাচানো, তালি-মারা, খিস্তি করা—এসব চলতে পারে। কিন্তু পেছনকম্মটির বিরুদ্ধে থ্রি সেভেন্টি সেভেন আছে। হিজড়েদের ঘরে সন্ধের পর রেড করলে ওরকম কেস পাওয়া যায়। এজন্য ওরা ফিটিং করে রাখে। ওখানে অবশ্য কবি-সাহিত্যিক যায় না। তবে আমি বাড়ি দু- তিনটের কথা জানি, আমি কখনও যাইনি।

যে কনস্টেব্লটিকে ফিট করে দেওয়া হল, ওর নামই জিগ্যেস করেনি অনিকেত। ঘ্যাম নিয়েছে। কিন্তু গুরুমা-র নাম জিগ্যেস করল। কমলা। অনিকেত বলেছিল, আরও আগে একদিন এসেছিল, কোনও কথা বলেনি।

কনস্টেবল বলল—ওরা এরকমই করে।

অনিকেত বলল—সেদিন দেখলাম একজন লুঙ্গি পরে খাটিয়ায় বসেছিল। ওরা কি লুঙ্গিও পরে?

—ও বোধহয় মিনসে।

—মিনসে মানে?

—ওদের কাজকম্ম করে, খেটে দেয়। কখন গিয়েছিলেন?

—দুপুর নাগাদ।

—দুপুরে? থালে মিনসেটাই ছিল। ওরা রাতে সবাই থাকে। এখন গুরুমা-কে পাবেন, আর যদি দু-একজন থাকে জ্বরজারি হওয়া…।

গাড়িটা থামল ও-পাড়ায়। সেই মুদি দোকান। বিকেল হয়েছে। মুড়ি-চানাচুর কিনে নিয়ে গেল একটি হিজড়ে।

কনস্টেব্লটি বলল, আসুন। উঠোনের সামনে দাঁড়িয়ে একটা গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, কমলদি আচো…

—ক্যা রে…?

—আমি। থানাবাবু।

—অ। এখন আবার কী হল? ঝলকি তো দিয়েছি।

—ঝলকি নয়, বড়বাবু একজনকে পাঠালেন। সাংবাদিক।

—পাতিয়া? পাতিয়া পাঠাল কেন?

—কথা বলে দ্যাখোই না।

অনিকেতকে হাতছানি দিয়ে ডাকল কনস্টেবল।

অনিকেত সামনে যেতেই সেই গুরুমা বলল, আরে, এ তো আর একদিন এসেছিল।

অনিকেত বলল, সেদিন তো কথা হয়নি।

—বোসো। খাটিয়ার দিকে ইঙ্গিত গুরুমার।

খাটিয়ায় বসল অনিকেত।

গুরুমা, মানে, কমলদি বারান্দায়। কনস্টেব্‌ল দাঁড়িয়ে আছে।

—কী বলবে বলো…হাত নাড়াল গুরুমা।

—আমি কী আর বলব? আপনাদের কথা কিছু বলুন।

—বা-আ-রে…বলুন…। আমার এখন ভড়কানি পায়নি যে ভড়কাব।

কনস্টেব্লটা হাসছে। অনিকেতকে বলল, ভড়কানি মানে পায়খানা করা।

যত্ত সব বিলতিস…মুখটা বিকৃত করল গুরুমা। অনিকেত আন্দাজ করল—বিলতিস মানে বাজে ঝামেলা বা উৎপাত। এরকম কিছু। অনিকেত বলে, আপনাদের সমস্যার কথাটা জানতে এসেছিলাম আর কী।

গুরুমা বলল—মেন সমস্যা তো আমাদের হচ্ছে টুপি। বাচ্চাকাচ্চাই হচ্ছে না। বাচ্চার মশলা রবারের টুপিতে সেদোচ্ছে। বাজার খুব খারাপ। সেকেন্ সমস্যা হল ফ্যালাট বাড়ি। ওকেনে ঢোকা যায় না।

অনিকেত জিগ্যেস করে—আপনার আন্ডারে যারা আছে, ওরা যা রোজগার করে, তা কি সব আপনাকে এনে দেয়?

খেঁকিয়ে উঠল গুরুমা। তোমায় বলব কেন গা?

পুলিশের লোককে বলল—কাটো তো, ঝাকে লিয়েসচো, তাকে লিয়ে কাটো, তোমার এ মাসের ঝলকি হয়ে গেচে, যাও…

‘যেতে পারি, কিন্তু কেন যাব’ মনে এসেছিল একবার। কিন্তু যেতে হয়। যেতে হয়, নইলে খিস্তি শুনতে হয়।

চলে যায়, কিন্তু ভিতরে-ভিতরে একটা আকাঙ্ক্ষা থেকে যায়। একটা গান শুনেছিল বিমান মুখোপাধ্যায়ের কাছে—আমার গোল্লায় গেছে মন, নজরুলগীতি, যদিও পরের লাইনটাই ছিল, আমার রসগোল্লায় গেছে মন।

অনিকেতের গোল্লায়-যাওয়া-মন খুঁজতে লাগল আরও খবরটবর। জানল—ট্যাংরা, টালিগঞ্জ, উল্টোডাঙা, খিদিরপুর এসব অঞ্চলে কিছু হিজড়ে ঠেক আছে। কিন্তু ওর যা অভিজ্ঞতা, একা গেলে কিছু লাভ নেই। আইভি-কে নিয়ে এলে হয়? আইভি কি রাজি হবে?

ইতিমধ্যে বাসবকে খুব ফ্র্যাঙ্কলি জিগ্যেস করেছে হিজড়েদের নিয়ে কোনও কাজ-টাজ হচ্ছে কি না। বাসব কুরিয়ান, প্যাটেল, জিয়া জেফরি—এরকম কয়েকটা নাম বলল। অজয় মজুমদার, নিলয় বসু এরাও নাকি এদের নিয়ে কাজ করছে জানাল, আর সোমনাথ ব্যানার্জির কথাও বলল, ও নাকি বগুলার দিকে কোনও কলেজের পার্টটাইম লেকচারার। আশাপূর্ণা দেবীকে নিয়ে পিএইচডি করছিল। ও নাকি এসব নিয়ে একটু কাজ-টাজ করছে। ক্ষেত্র সমীক্ষার কাজ। ওর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে পারি। ও নৈহাটিতে থাকে।

একটা রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে ওদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল অনিকেতের। মূলমঞ্চ থেকে একটু দূরে, নন্দনের কাছাকাছি ওরা পাঁচ-ছ’জন গুলতানি করছিল। মেয়েদের পোশাকে কেউ ছিল না, কিন্তু কেউ-কেউ কাজল পরা ছিল, ঠোঁটও রাঙানো ছিল। বাসব সোমনাথ ব্যানার্জির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। আরও কয়েব জন ছিল। সনাতন, জয়ন্ত, নয়ন, শুভজিৎ—এরকম সব নাম। বাসব তো ফার্স্টক্লাস পাওয়া, বাংলায়। একটা স্কুলের টিচার। সোমনাথও ব্রিলিয়ান্ট। কিন্তু অন্য যারা আছে, তারা ঠিক সেই পর্যায়ের নয়। কারও বিউটি পার্লার আছে, কাউকে মুদি দোকানে বসতে হয়। আসলে বাপের দোকান, বসতে হয়—মহা জ্বালা। ওরা সবাই রং-তামাশা করছিল। কথা বলার ধরন অনেকটা মেয়েদেরই মতো।

সোমনাথ বাসবকে জিগ্যেস করল, পারিক?

‘পারিক’ মানে জানে অনিকেত। পুরুষ-যৌনসঙ্গী। বাসব বলে—ধুর। অনিকেত ব্যানার্জি। রেডিও শোনো না?

সোমনাথ বলল, আমার বাবা শোনে।

বাসব তখন কিছুটা বলল অনিকেত সম্পর্কে।

সোমনাথ বলল, শুনেছি এরকম কিছু একটা রেডিওতে হয়েছে। খামোকা এসব করতে গেলেন কেন?

অনিকেত বলল, খামোকা বলছেন কেন? এটাও একটা সোশ্যাল ওয়ার্ক।

—কবে কবে হয়?

—শেষ হয়ে গিয়েছে।

—তবে তো ল্যাটা চুকেই গিয়েছে।

—অনিকেত বলল, ল্যাটা চোকেনি। অফিসের অ্যাসাইনমেন্ট-টা শেষ হয়েছে। কিন্তু আমার ব্যাপারটা দ্য এন্ড করতে ইচ্ছে করছে না।

বাসবের কাছে শুনলাম আপনি ইউনাকদের নিয়ে কাজ করছেন। আমাকে একটু সাহায্য করবেন?

—হিজড়ে বললে হয় না? ….ইউনাক….জাঙ্গিয়ার বুকপকেট…।

অনিকেত মাথা চুলকোয়।

—হ্যাঁ, কিছু-কিছু তো করেছি। গিয়েছি ওদের খোল-এ।—সোমনাথ বলে।

—কেন গিয়েছিলেন? অনিকেত জানতে চায়।

—নিজেকে চিনতে। রবীন্দ্রনাথের একটা গানে আছে না—আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না/এই জানারই সঙ্গে সঙ্গে তোমায় চেনা।

অনিকেত দেখল মানুষটা খুব ইন্টারেস্টিং। মুখ-খারাপও করে, আবার সিরিয়াস গানের লাইনও বলে। অন্য ছেলেপুলের ওপর সোমনাথের একটা প্রভাবও আছে মনে হল। লম্বায় ও সবার চেয়ে বড়। ছাতিতেও। যতই মেয়েলিপনা করুক না কেন, বড়সড় চেহারা, মানে, পুরুষালি চেহারার একটা শাসন কিন্তু রয়েই যায়।

সোমনাথ কিন্তু একদিন সত্যিই নিয়ে গেল ঋষি বঙ্কিম রোডের একটা খোল-এ। হিজড়েদের বাসস্থানকে ওরা ‘খোল’ বলে। ওখানে আট-ন’জন থাকে। সোমনাথ ঘরের সামনে গিয়ে হাঁকল, কে আছো গো…। একজন বেরিয়ে এল, বেশ লম্বা। শাড়ি পরা, ওকে দেখে সোমনাথ বলল, আজ ছল্লা গেলে না? ও মুখ বেঁকিয়ে বলল না, গো…। শরীল খারাপ…, মাসিক হয়েছে—বলে শরীর বেঁকিয়ে অদ্ভুত হাসল। আবার বলল, নিরখা ঝরছে বাটুতে।

বোঝাই যাচ্ছে সোমনাথের এখানে যাওয়া-আসা আছে।

সোমনাথ বলল—ওর নাম ফুলঝুরি।

ফুলঝুরি বলল—কে গা? সঙ্গে? কোতি?

সোমনাথ বলল—জানি না। আমার বন্ধু। একটু দেখাতে নিয়ে এলাম। দু’টো কথা বলবে।

–কী কতা বলব? গুরুমার নিষেধ আছে।

সোমনাথ বলল—গুরুমা কোথায়? আমি পটিয়ে নিচ্ছি।

—গঙ্গাচ্যানে গেচে। আজ মঙ্গলচণ্ডী কি না।

–কী রান্না হচ্চে আজ?

—তেতোর ঝোল, ডাল, আলুচোখা—ব্যাস।

—ডাক্তার দেখাচ্ছ?

–কেন?

—ওই বাটলি নিরখার?

বলছে অপরেশন করতে হবে। আঙুর হয়েছে। কী ঝকমারি বলো দিনি…।

—তোমার ছেলে কই?

—ওই তো…। একটা নেড়ি কুকুরকে দেখাল, বারান্দার কোনায় গুটলি মেরে শুয়ে আছে।

—’সড়ক’ সিনেমাটা দেখেছ?

—না।

—’লাওয়ারিস’?

—দেখেচি।

অনিকেত জিগ্যেস করল, তোমরা কি সত্যিই ওরকম সিনেমার মতো নাকি?

ফুলঝুরি কিছুক্ষণ উদাসভাবে চেয়ে রইল। তারপর বলল—আমাদের মজা লাগে। অনিকেত ভাবল ঘনিষ্ঠ হতে পেরেছে বোধহয়।

জিগ্যেস করল—তোমাদের এখানে নতুনরা আসে?

—আসে তো।

—কীভাবে আসে?

সোমনাথ অনিকেতের হাতটা ধরে চেপে দেয়।

সোমনাথ তারপর দু’চার কথার পর বলল—চলুন, উঠি।

অনিকেতের প্রত্যাশা মিটল না।

রাস্তায় সোমনাথের সঙ্গে যাচ্ছে। দু-একজন লোক ওর দিকে কেমনভাবে যেন তাকাচ্ছে। সোমনাথ বলল—ওরা সব কথা বলে না। ‘কী করে নতুনরা আসে?’ বললে উল্টোপাল্টা বলবে।

—ওরা কি জোর করে নিয়ে আসে?

সোমনাথ বলল, একদম নয়। স্বেচ্ছায় চলে আসে। আমিই যদি গরিব ঘরে জন্মাতাম হয়তো আমিই এদের দলে ভিড়তাম…

অনিকেত বলল, কয়েকটা কথার মানে বুঝলাম না…যেমন নিরখা…

—মানে, রক্ত। রক্ত। ফুলঝুরি বলল মাসিক হয়েছে। উইশফুল থিংকিং। আসলে ওর অর্শরোগ আছে। বলছিল না—বাটলি-আঙুর?

অনিকেত জিগ্যেস করল আপনি ওদের সম্পর্কে অনেক কিছুই জানেন। বলবেন আমাকে? সোমনাথ বলল, অনেক কিছুই জানি না।

অনিকেত বলল, সে তো নিউটনও বলতেন উনি ফিজিক্স-এর কিছুই জানেন না।

সোমনাথ বলল—দু’টো এক নয়। নিউটন তো অংকে আর ফর্মুলায় ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন, আর এই জগৎ অংকে ব্যাখ্যা হয় না। ভীষণ আলো-আঁধার আর গলিঘুঁজি। আমিও তো জানার চেষ্টা করছি…। আসলে নিজেকেই জানতে চাইছি…।

আবার একদিন অনিকেত ওখানে গেল। একা। অ্যাডভেঞ্চারে পেয়ে বসেছে। কী আর করবে ওরা? মারবে তো না!

ওখানে হাজির হল ফের। সন্ধ্যাবেলা। গণিকাপল্লির ভিতর দিয়ে রাস্তা। এখানে চেনাশোনা কারও থাকার কথা নয়। কেউ দেখবে না। সব গা-দেখানো হাফড্রেস-এ দাঁড়িয়ে। অনিকেতেরও যে একটু-একটু লিক্‌ ফড়কাচ্ছে না, তা নয়। লিমের কী দোষ? ওই বাড়িতে হাজির হল।

ও ডাকল, ফুলঝুরি দিদি…।

ঘরে মদের আসর বসেছিল হয়তো। ফুলঝুরি দিদি এল। হাতে গেলাস …।

—ক্যা…রে…এ…

—আমি, আমি, সেদিন এসেছিলাম…।

—কী চাই?

—ভাল আছেন?

—কী চাই বল না… —দু’টো কথা ছিল…

–কী কথা…

—আচ্ছা…আপনাদের না কি নমাজ পড়তে হয়…?

—আর কী পোস্নো?

—বাচ্চাদের যদি নুনু না-থাকে ওদের বাপ-মা’রা আপনাদের দিয়ে দেয়?

প্রশ্নটা শুনেই বোধহয় তিন-চারজন বেরিয়ে এল ঘর থেকে।

—বাপমারানির ব্যাটাটা ক্যা রে…একজন জিগ্যেস করল।

ফুলঝুরি বলল, কোতি সোমনাথ নিয়ে এসেছিল একদিন…

একজন বলল—সিআইডি-গিরি করতে এয়েচ? ভাগো, এক্ষুনি ভাগো…।

এরই মধ্যে একজন ওর কাপড়টা তুলে দিল। শেষ অবদি এটাই তো তোদের পুছ—কী থাকে। দ্যাক…!

অনিকেত ওখানে জমাটবাঁধা অন্ধকার ছাড়া আর কিছু দেখতে পায় না।

একজন বয়স্কমতো হিজড়ে বলল—জন্মের সময় তোদের কোল দিইচি। আশীর্বাদ করিচি। এখন আমাদের লিয়ে সিআইডি-গিরি কোরো না। আমাদের বাঁচতে দাও। কেঁদে ফেলে বুড়ি হিজড়ে। হাতের মদের গেলাস কাঁপে।

কান্নাটা সংক্রমিত হয়। কান্না পিছনে ফেলে ফিরে আসে অনিকেত।

১৮

আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম—এই গানটা শুনল স্বপন বসুর গলায়। জিন্স পরে লোকসংগীত গাওয়াটা বোধহয় তিনিই শুরু করলেন। বেশ কিছু গান সংগ্রহ করেছে ও। আমাদের অনেক গান পানাপুকুরের কাদায় ডুবে গিয়েছে, অনেক গান পটাশ-ইউরিয়া- অ্যামোনিয়া মাখা মাটির সঙ্গে ধুয়ে চলে গিয়েছে খালে, বিলে, ড্যামের লকগেট-এ আটকে আছে কিছু গান, কিছু গান কুয়োয় পড়ে আছে। হেমাঙ্গ-খালেদ-কালী দাশগুপ্ত বা অমর পাল- রা কিছু গানকে তুলে শুশ্রূষা দিয়েছেন। কিন্তু আদুড় গায়ের গানের শরীরে নতুন জামা পরিয়ে আলো-মাখা স্টেজে হাজির না-করলে নব্য-মধ্যবিত্ত পাত্তা দেবে না—এটা বুঝেছিলেন স্বপন বসু। ওই গানটা ছিল—

আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম
গ্রামের নও জোয়ান হিন্দু মোসলমান
মিলিয়ে বাঙলা গান আর মুর্শেদি গাইতাম
হিন্দু বাড়িতে যাত্রাগান হইত—
নিমন্ত্রণ দিত, আমরা যাইতাম…

ওই গানটার কথা মনে রেখে অনিসেত মনে মনে একটা গান ভাবে—

আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম
অফিসের পরে
কফি হাউসের ঘরে
টেবিল চাপড়াইয়া উজির মারিতাম।
কিংবা ঘরে আসিয়া
বউ-এর পাশে বসিয়া
মন দিয়া সিরিয়াল দেখিতাম
হায় রে
আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম
গিন্নির সঙ্গে বসিয়া
দু’জনে রসিয়া রসিয়া
পাশের ফ্ল্যাটের বউয়ের নিন্দা করিতাম
দূর হইতে তাহাকেই ঝাড়ি করিতাম
আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম।

আর এখন হয়েছে যত গেরো। মঞ্জু জুটেছে। ছেলের সমস্যা নিয়ে আসছে, নিজেরও সমস্যা নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করছে। আসলে ওর সমস্যার অনেকটাই ওর ছেলেকে জড়িয়ে। নিজের অর্থনৈতিক সমস্যাও আছে কিছুটা। একটা শাড়ি কিনে দিয়েছে একদিন। মঞ্জু আপত্তি করেনি। টাকাপয়সা দিলেও নিয়ে নেবে। এটা বোঝা গিয়েছে, মঞ্জু ফ্রিজিড। কামশীতল। এবং এই শীতলতার জন্য দায়ী ওর কৈশোরকালীন শক। সেই ট্রমাময় দিনগুলোর, ঘটনাগুলোর অভিঘাত। মন এক আজব বস্তু। বস্তুই তো! ম্যাটার? মন কি বস্তুরই কোনও ধর্ম? কে জানে বাবা। এই যে পিটুইটারি, কিং অফ অল এন্ডোক্রাইন গ্ল্যান্ডস, এই পিটুইটারি-ও তো মনচালিত। অ্যাড্রিনালিন বলো, টেস্টাস্টোরেন বলো, ইস্ট্রোজেন বলো, প্রজেস্টেরন বলো—সব কিছুকেই কন্ট্রোল করছে পিটুইটারি। আর যাবতীয় লিবিডো তো হরমোন-তাড়িত। মন বড়, না হরমোন বড়? এ নিয়ে যদি তর্ক হয়, অনিকেত তো মনের দলেই যাবে। শুক্লার যখন হিস্টোরেক্টমি হল, জরায়ু-টরায়ু বাদ গেল, তারপর কতদিন ধরে ওর গ্যাস-অম্বল। কিছুতেই সারে না। ওভারি- টোভারি-র সঙ্গে অ্যাসিডিটি-র কোনও সম্পর্ক নেই, কিন্তু ওটা হল। প্রচুর অ্যান্টাসিড- এজাইম ইত্যাদি খেয়েও যখন কিছু হল না, তখন মনের ডাক্তারের কাছে গেল। উনি কিছু ওষুধ দিলেন, মনের ওষুধ। তাতেই তো কমল। ওই যে ওষুধগুলো দেওয়া হয়েছিল, ওগুলো কতগুলো কেমিক্যাল। কিছু রাসায়নিক মলিকিউল। মানে, বস্তু। বস্তু তো বস্তুর সঙ্গেই ক্রিয়া করবে। মন কি তবে বস্তু? মন কি স্নায়ু, মানে, নিউরন-শৃঙ্খলের মধ্যে বিঁধে থাকা কিছু রাসায়নিক কোড? কে জানে রে বাবা!

মঞ্জুর কথা হচ্ছিল। মঞ্জুর ফ্রিজিডিটি-র কারণেই ওর বর ফুটেছিল। এই সত্যটা মঞ্জুও স্বীকার করে। রাতের পর রাত একটা কাঠ-শরীরের সঙ্গ ভাল লাগেনি ওর। কম্পন কে না চায়? কে না চায় হিল্লোল? সমুদ্রের কাছে ছুটে যাওয়া ঢেউ ভালবেসে। মঞ্জুকে একবার বলেছিল, ছেলেকে ওষুধ না খাইয়ে তুই খা বরং। ওষুধ তোকে লিবিডো দেবে।

লিবিডো কী?—মঞ্জু জিগ্যেস করেছিল।

লিবিডো?—ওটাও খুব কঠিন প্রশ্ন। সাইকোলজি-র বইতে নিশ্চয়ই এর একটা সংজ্ঞা আছে। প্রশ্নপত্রে চার-ছ’নম্বরের শর্ট নোট লিখতে হয় নিশ্চয়ই। সেই সংজ্ঞা অনিকেত জানে না। ও বলেছিল—ওটা হল ইচ্ছে। যে-ইচ্ছে শরীর জাগায়।

—ওটা দিয়ে আমার কী হবে? কী করব আমি লিবিডো দিয়ে?

কথাটা ঠিকই ছিল মঞ্জুর পক্ষে। অনিকেতও কখনও নিজের শরীর জাগানোর ওষুধ-বিষুধ ব্যবহার করেনি। ওরও একই সমস্যা। শুক্লার শরীরেও ঢেউ নেই, হিল্লোল নেই। আগে ছিল, এখন নেই। এর কারণ মন নয়, হরমোন। চিনেবাদামের মতো ছোট-ছোট দুটো ওভারিই তো ইস্ট্রোজেন-প্রজেস্টেরন দেয়।

তাতেই তো রক্তে দোলা লাগে, অঙ্গ লাগি অঙ্গ কাঁদে, কী গুণ করে ওই কেমিক্যাল যে, মদন আগুন জ্বলে, কাঁপে তনুবায়ু কামনায় থরোথরো, ঘাইমৃগী সারারাত ডাকে। শুক্লার ইস্ট্রোজেন নেই, প্রজেস্টেরন নেই। হাঁটুব্যথা আছে। ওর তো কোনও দোষ নেই। নক্ষত্রের দোষ। নক্ষত্র মানে তো কেমিস্ট্রি। অনিকেতু ব্যাপারটা বোঝে। অনিকেতের একটা যৌন- অবদমন আছে। কে জানে—ওই অবদমনের কারণেই এসব বিষয়ে এতটা মন দিচ্ছে কি না। ফ্রয়েড-ট্রয়েড ঘাঁটাঘাঁটি করার এই হল মুশকিল।

সেই কমল গুপ্তর কথা মনে পড়ল। ও খুব বেচারার মতো মুখ করে জিগ্যেস করেছিল— অনিকেতবাবু, আপনার জং না কড়া?

ব্যঞ্জনার্থ বুঝতে কিছুটা সময় লাগলেও, শেষ পর্যন্ত বুঝতে পেরেছিল। বেশি ব্যবহারে কড়া পড়ে। যারা বেশি হাতুড়ি পেটায়, ওদের হাতে কড়া হয়। আর অব্যবহৃত থাকলে মরচে পড়ে যায়। যারা ফাইমোসিস-এর কারণে পুংযন্ত্র পরিষ্কার করতে পারে না, ওদের ভেতরে এক ধরনের আস্তরণ পড়ে। ওটা মরচেই তো, অব্যবহৃত থাকলেও ওরকম হয়। অনিকেত বলেছিল, আমার তো দাদা মরচে। উনি বললেন, অমুকের-অমুকের তো কড়া পড়ে গিয়েছে। কড়া তো চাইলেই পাওয়া যায় না, অর্জন করে নিতে হয়।

‘কড়া’ আর ‘মরচে’ কথায়-কথায় এসে পড়ল, কী করা যাবে। কথা হচ্ছিল গেরো নিয়ে। অর্জন করা গেরো। অর্জিত ঝামেলা।

মঞ্জু একটা গেরো। পবন, বাসব—ওদের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর আর একটা অজানা জগৎকে জানার ইচ্ছেটাও একটা গেরো। কোথায় কীভাবে খত্না হয়, সেটার জন্য গাঁয়ে চলে যাওয়া, কোথায় হিজড়েরা থাকে, ওটা দেখার জন্য ঝামেলা পোহানো, এর কোনও দরকার ছিল? ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’। এখন চিঠি আসছে ‘প্রবর্তক’-এর কাছ থেকে, ‘দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি’-র কাছ থেকে, আজ আইপিসি ৩৭৭ ধারার বিরুদ্ধে কনভেনশন, কাল গে চলচ্চিত্র উৎসব…। আমেরিকা, কানাডা, সুইডেন, ডেনমার্ক এসব দেশের গেরা কী ধরনের ছবি করে, কিংবা ওদের ছবিতে গে-রা কীভাবে এসেছে—এসব নিয়ে ছবি। ‘যাক গে মরুক গে’ করে এড়িয়ে যেতেও পারছে না। আবার সোমনাথ ব্যানার্জি বলছে, আমি ‘অবমানব’ নামে একটা কাগজ করব, আপনাকে লেখা দিতে হবে কিন্তু। অনিকেত বলল, আমি আবার কী লিখব? ও বলল, আপনার অভিজ্ঞতার কথাই লিখবেন। ওখানে কিছু লিখলেই ‘প্রবর্তক’ থেকে বলবে, এ বলবে, সে বলবে। এমনিতেই তো ওর নাম ডা. লোধ হয়েই গিয়েছে! তার ওপর আবার?

ইতিমধ্যে ও খোঁজ পেল বলরামবাটিতে একটা মেলা হয়, ওখানে হিজড়ে সম্প্রদায়ের মানুষরা আসে। মেলাটা নাকি দেখার মতো।

আমাদের মেলাগুলো বড় বিচিত্র। বহু মেলার সঙ্গেই লোককথা জড়ানো, এবং এক-একটা মেলা এক-একরকম। বহু মেলাতেই ঘুরেছে অনিকেত। কখনও কর্মসূত্রে, কখনও নিজের উদ্যোগে। জয়দেবের মেলায় বাউল গান তো হাড়োয়ার মেলায় মোসলমানি জলসা। বিষ্ণুপুরে সাপ খেলা তো পরকুলে টুসুগান। গঙ্গাসাগরের মেলায় তো গোটা ভারতবর্ষ।

অনিকেত বলরামবাটি চলল সকালবেলা। শুক্লা জানে, ন্যানো মেটেরিয়াল নিয়ে সারাদিনের সেমিনার শুনতে যাচ্ছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। হাওড়া-বর্ধমান কর্ড লাইনে বলরামবাটি স্টেশনে নামতে হয়। ওখান থেকে দু’কিলোমিটার দূরে বাসুবাটি নামে গ্রামে আছে একটা পিরের মাজার। ওই পিরের নাম জালালুদ্দিন পির। ভেবেছিল, ট্রেনে অনেক হিজড়ে মানুষের দেখা পাবে। চোখে পড়ল না। হয়তো অন্য কামরায় আছে। চপলকান্তি ভট্টাচার্যর ‘বাংলার মেলা’ বইটায় পড়েছিল অনিকেত—’হিজড়ারা দলবদ্ধ হইয়া মিছিল করিয়া অগ্রসর হয় বাসুবাটির পথে। এই মিছিলের নাম সন্দল। মাজারের নিকটেই হিজড়াগণের জন্য নির্মিত হয় অস্থায়ী তাঁবু। দূরদূরান্ত হইতে আগত হিজড়ারা ওই তাঁবুতেই বিশ্রাম নেয়। উহারা মাজারে চাদর প্রদান করে এবং সমাধিস্থলে গোলাপ জল ছড়াইয়া মাজার প্রদক্ষিণ করে। মেলার এক প্রান্তে হিজড়ারা তাহাদের নিজস্ব সংগীত করিয়া আমোদ প্রমোদ করে। অনেকেই মাজারের সম্মুখে একটি অশ্বত্থ বৃক্ষে ঢিল বন্ধন করে। বিশ্বাস ইহাতে মনস্কামনা সিদ্ধ হয়। সন্ধ্যার পর, কাওয়ালি গানের আসর বসে। গুরু মায়েরা তাহাদের শিষ্যাদের মঙ্গল কামনায় মানৎ করে। মেয়ের মস্তকের ওপর টাকা স্থাপন করিয়া গুরুমা হাত দিয়া সেই মুদ্রা আচ্ছাদিত করিয়া রাখিলে কাওয়ালি দলের কেহ ওই মুদ্রা লইয়া যায়। কাওয়ালি চলাকালীন গুরুমায়েরা খুচরা পয়সা চতুর্দিকে ছড়াইয়া দেন।

এই মেলায় হিজড়া সমাগমের কারণ হিসেবে একটি কাহিনী প্রচলিত আছে। পিরসাহেব আরবের বোখারা হইতে ভারতের বিভিন্ন স্থান পরিক্রমা করিয়া অবশেষে বাসুবাটিতে আসিয়া বসবাস করিতে থাকেন। তিনি বহু অস্পৃশ্য চণ্ডালকে কোলে স্থান দিয়াছিলেন। একাসনে বসিয়া এক অন্ন গ্রহণ করিতেন। অনেক অস্পৃশ্য ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করিয়াছিলেন। অনেক হিজড়াও তাঁহাকে মুর্শেদ বলিয়া গ্রহণ করিয়াছিল। কথিত আছে, একজন পক্ষাঘাতগ্রস্ত হিজড়া পিরের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া দোয়া মাগেন। পির সাহেব মোনাজাত করেন, অতপর সে ধীরে ধীরে সুস্থ হইয়া উঠে। কিন্তু আরও আশ্চর্য কাহিনী হইল এই জনৈক হিজড়া পির সাহেবকে বলেন আমি নিজস্ব সন্তান চাই। আমার গর্ভে যেন সন্তান হয়। পির সাহেব মোনাজাত করেন এবং কিছুদিনের মধ্যেই সেই হিজড়া সন্তানসম্ভবা হয়। এই কথা হিজড়াদের মহল্লায় মহল্লায় প্রচারিত হয়, আর তাহার পর হইতেই প্রতি বৎসর হিজড়া সমাবেশ হয়…

একটি হিজড়ে নিজের গর্ভে সন্তান কামনা করেছিল! সেই হিজড়েটি কি নির্বাণপ্রাপ্ত ছিল? ‘নির্বাণপ্রাপ্ত’ মানে লিঙ্গচ্ছেদ করা। না কি সে লিমদার ছিল? সে কি সন্তান লাভ করেছিল পায়ু-সঙ্গমে? না কি মেরি মাতা যেমন গর্ভ পেয়েছিলেন ঈশ্বরের অনুগ্রহে—সেরকম? মুসলমানি বিশ্বাস আছে, বেহেস্ত থেকে ফেরেস্তা এসে গর্ভিণীর যোনিতে রুহ ফুঁকে দেয়। তাতেই গর্ভের সন্তান প্রাণ পায়। রুহ মানে এক দৈব শক্তি, যাকে আত্মাও বলা যেতে পারে। ‘রুহ আফজা’ নামে একটি হেকিমি শরবত আছে। এর মানে বোধহয় প্রাণের আরাম। আবার ‘প্রাণের আরাম’ কথাটা ব্রাহ্মদের প্রার্থনাস্থলেও লেখা থাকে। সে যাকগে যাক। মানুষ অত কূট কথায় যায় না। পিরের কেরামতিতে হিজড়েরও গর্ভ হয়—এই বিশ্বাসে হিজড়েরা নয় শুধু, হাজার মানুষও আসে।

বলরামবাটি স্টেশনে অনেক লোক নামল। কিন্তু হিজড়ের সংখ্যা তো খুব কম। মাত্র ৮/১০ জনের একটা দল, ব্যস। ব্যাপারটা একটু অদ্ভুতই লাগল। বইয়ের সঙ্গে কিছুই তো মিলছে না, অবশ্য বইটা ৬০/৭০ বছর আগেকার।

একটা ভ্যান রিকশায় মেলাস্থলে গেল। মেলাটার একটা গ্রাম্যচরিত্র আছে। মাটির হাঁড়ি- কলসির সঙ্গে বিক্রি হচ্ছে মাটির কড়াই। দু’পাশে হাতলও আছে, মাটির। মাটির তাওয়া। যারা কিনছে, ওদের ঘরে নিশ্চয়ই অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি আছে, রুটি করার লোহার তাওয়াও কি নেই? আসলে, সহজে কিছুই ছাড়ি না আমরা। অনিকেতের ঘরে তো মিক্সি আছে। আবার শিল-নোড়াও। বাড়িতে যখন ভুট্টাটা ছিল, মানে কুকুরটা, ও শোওয়ার আগে তিনটে পাক দিয়ে শুত। কবে কোন বন্যজীবনে শোওয়ার আগে ঘুরে-ঘুরে হাওয়ার অভিমুখ বুঝে নিত, যাতে শত্রুর ঘ্রাণ ঠিকমতো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হয়, গৃহজীবনেও ওই অভ্যেস ছাড়েনি, ছাড়তে পারেনি। বিক্রি হচ্ছে বাঁশ আর তালপাতা দিয়ে তৈরি লম্ফমান হনুমান, সেই সঙ্গে ব্যাটারিচালিত বাঁদর। বিগত দিন আর বর্তমান কেমন একই সঙ্গে। মাজারের কাছে গেল। বিগত দিনের কবরে কিংবদন্তি। ধূপ-আতর বিক্রি হচ্ছে, আর নানারকম কাপড়ের ফালি। চাদর চড়াচ্ছে মাজারে।

অনিকেতের বাড়ির কাছেই তো খাজাইতলা। ওখানেও তো একজন পির শুয়ে আছেন। সেই পিরের গল্প তো জানে না ও। ভাল করে দেখাই হয়নি। দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া…। ওখানে দেখল, একটা মেলা কমিটির অফিস। অনিকেত জানল— এই মেলা বহুদিন ধরেই হচ্ছে, কিন্তু কতদিন জানে না। ওরা দেখেছে, ওদের বাপ-ঠাকুরদাও এই মেলা দেখেছে। হিজড়েদের প্রসঙ্গ এল। ওদের একজন বলল, আর বলবেন না দাদা, ওরা বড় নুইসেন্স। ওরা মনে করে—এই পিরবাবা ওদের সম্পত্তি। ছোট্ট মাজারটা ঘিরে বসে থাকে। কেউ-কেউ নাটক করে।

—নাটক মানে?

—কান্নাকাটি করে, নানারকম নৌটঙ্কি করে।

—কান্নাকাটি করে? শ্বশুরবাড়ির কষ্ট-পাওয়া বউ যেমন বাপের বাড়ি এসে কান্নাকাটি করে? অনিকেত ভাবল, কিন্তু বলল না।

—তা ছাড়া ওরা বাজে নাচ-টাচ করে। খিস্তি দেয়। গাঁয়ের ভদ্রলোকরা আপত্তি করেছিলেন, ওরা শোনে না, গত বছর মারপিট হয়ে গেল। আমাদের একটা ছেলের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল।—ওদের কারও কিছু হয়নি।

—ওদের ছেড়ে দেবে না কি? ওরাও মারধোর খেয়েছে। একজনের তো দাঁত পড়ে গিয়েছিল।

—এজন্য এ বছর ওরা আসেনি?

—আসবে না মানে? গতকাল ওদের ‘ডেট’ ছিল। গতকাল সব এসেছিল।

—ডেট’ ছিল মানে? ওদের আলাদা ‘ডেট’ থাকে না কি?

—ডেট’ থাকে না, কিন্তু গতবার ঝামেলা হওয়ার পর শান্তিশৃঙ্খলার জন্য পুলিশ ঠিক করে দিল যে, ওদের জন্য একটা দিন আলাদা রাখা হবে। সেদিন শুধু ওরাই আসবে। ওরা আলাদা ভাবে যা খুশি করুক।

—ওরা কী করে জানল যে গতকালই ওদের ‘ডেট’ ছিল?—অনিকেত জিগ্যেস করল।

—আরে ওদের মারাত্মক নেটওয়ার্ক। পুলিশ থেকে দু-চারটে গুরুমাকে আগেই খবর দিয়ে দিয়েছিল, ওরাই সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে।

—তার মানে, গতকালই ওরা সব এসেছিল?

— হ্যাঁ।

অনিকেতের মুখ থেকে বেরিয়ে গেল—ইস্‌স।

—ইস্ কেন? আপনি কি ওদেরই দেখতে এসেছেন নাকি?

অনিকেত ঢোক গিলে বলল – হ্যাঁ।

—কেন?

—আমি সাংবাদিক কিনা…

সাংবাদিক বললে অনেক খুন মাপ হয়ে যায়। ওদের একজন বিগলিত গলায় জিগ্যেস করল, কোন কাগজ?

এটাই মুশকিল। খবরের কাগজ না-হলে সাংবাদিক হয় না।

অনিকেত বলল, রেডিও-র।

একজন বলল, রেডিও-র সাংবাদিক হয় না কি আবার?

অন্য একজন বলল, কেন হবে না? রেডিওতে খবর হয় না বুঝি?

অন্য একজন বলল, কিন্তু রেডিও-র সাংবাদিকের হাতে টেপরেকর্ডার থাকে। খগেন মণ্ডলের শুয়োরের ফার্মে এসেছিল একজন। আমি দেখেছি। টেপরেকর্ডার-টা খগেনদার সামনে ধরে জিগ্যেস করেছিল—এগুলো কি শুয়োরের বাচ্চা? এবার অনিকেতকে জিগ্যেস করল— স্যর, আপনার টেপরেকর্ডার কই?

অনিকেত বলল—না, আমি রেকর্ড করতে আসিনি।

—দেখতে?

–হ্যাঁ।

—অনেকের অনেকরকম কামনা থাকে। একবার এক বাংলা সিনেমার হিরোইন এসেছিল, বোধহয় বোম্বের হিরোইন হওয়ার মনস্কামনা ছিল। আবার অনেক ছুপা কোতি-ও আসে। ‘কোতি’ মানে অনিকেত জানে। তবু জিগ্যেস করল। ‘কোতি’ হল : হিজড়ে হয়নি, কিন্তু হিজড়ে-হিজড়ে ভাব। এসব হল ওদের ভাষা

অনিকেত ‘কোতি’ মানে যেটা জানে, সেটা ঠিক এরকম না হলেও—অনেকটাই তাই। ওরা অনিকেতকে ‘কোতি’ ভাবছে কি না কে জানে?

অনিকেত বলল—আজ তো দেখলাম কয়েকটা হিজড়ে এসেছে।

—ওরা কি মাজারে যেতে পেরেছে? আমাদের ভলেন্টিয়ার-রা আটকে দিয়েছে। আজ ওরা নট অ্যালাউড।

তার মানে, যে-দলটা এসেছিল, ওদের চলে যেতে হয়েছে। ইস, ওদের মেলাটাও ভদ্রলোকরা ছিনতাই করে নিল? ভদ্রলোক না-বলে ‘হেট্রো’ বলাই ভাল–অনিকেতের মনে হয়। হেট্রোসেক্সুয়াল। হেট্রো-রা, মানে সংখ্যাগুরুরা, যা মনে করবে, সেটাই হবে। সেটাই ঠিক।

মেলার এক কোনায় মাদুলি বিক্রি হচ্ছে। স্বপ্নদোষ কমানোর মাদুলি, সর্বরোগহর বড়িও বিক্রি হচ্ছে। একটা টেস্টটিউবে একটু ঘোলা জলীয় পদার্থ। বিক্রেতা চাঁচা গলায় বলছে, ভায়েরা আমার, এই হল ধাত-মেশানো প্রচ্ছাপ। প্রচ্ছাপের সঙ্গে ধাত নির্গত হয়ে এমন ঘোলা দেখাচ্ছে। এবারে লক্ষ করুন, এই আশ্চর্য বড়ি কী করে….

লোকটা টেস্টটিউবে বড়িটা ফেলে দিল, এবং ঘোলা তরলটা স্বচ্ছ ফটফটে হয়ে গেল। মানুষ কিনছে। মেলাতেই এসেছে পেজার কোম্পানি। ওরা বিক্রি করছে না যদিও, পেজারের কার্যকারিতা দেখাচ্ছে। বলছে, লক্ষ করুন…।

মেলাতেই একটি ছেলে অনিকেতের হাত ধরে টানল।

—চিনতে পারছেন?

ছেলেটা প্যান্ট-শার্ট পরা। বছর ২৫-২৬ বয়স হবে মনে হচ্ছে। খুবই সাধারণ দেখতে।

মনে হয় গুটকা জাতীয় কিছু খায়। ফচ করে থুথু ফেলল।

অনিকেত ওকে চেনার চেষ্টা করছিল। মুখটা একটু চেনাই লাগছে। কিন্তু কোথায় দেখেছে, ঠিক বুঝতে পারল না।

ছেলেটা বলল, আমার নাম জয়ন্ত। রবীন্দ্রসদনে দেখা হয়েছিল। সোমনাথদাদের সঙ্গে আড্ডা মারছিলাম, আপনি এসেছিলেন…।

—হ্যাঁ, এবার মনে পড়েছে। অনেকেই ছিল তো…।

—সোমনাথদা আপনার খুব প্রশংসা করছিলেন। আমরা, ‘এলজিবিটি’-রা ওঁকে খুব মানি। এই শব্দবন্ধগুলোর মানে জেনে গিয়েছে অনিকেত। লেসবিয়ান গে বাইসেক্সুয়াল এবং ট্রান্সজেন্ডার।

তুমি একা এসেছ? অনিকেত জিগ্যেস করে। না, আমার একজন ফ্রেন্ড আমার সঙ্গে এসেছে। ‘ফ্রেন্ড’ শব্দটার ঠিক আগে একটা মাইক্রোসেকেন্ডের পজ্ ছিল, মানে অনুচ্চারিত শব্দ। যেন ও বলতে চেয়েছিল, আমার সঙ্গে ‘বয়ফ্রেন্ড’ এসেছে। ছেলেটার কথার মধ্যে একটু মেয়েলিপনা আছে। মানে, পুরুষসমাজ যে বাচনভঙ্গিকে মেয়েলি মনে করে। ‘ফ্রেন্ড’ ছেলেটার সঙ্গে পরিচয়ও করিয়ে দিল। ওর নাম তপন দাস। ডেকরেটরের বিজনেস। ও জয়ন্তর চেয়ে একটু বড়ই হবে বয়সে। অনিকেতের মনে হয়েছিল, ওই তপন বোধহয় জয়ন্তর ‘পারিক’, যাকে প্রেমিক বলা যেতে পারে—তবে যৌনসঙ্গী বলাটাই বোধহয় ভাল।

—আপনি এখানে এসেছেন কেন অনিকেতদা? চাদর লাগাবেন না কি?

অনিকেত বলল—না, আমি আর কী করতে চাদর লাগাব? —বলেই মনে হল, হিজড়ের যদি বাচ্চা হতে পারে, তা হলে জরায়ুহীনার কি সন্তান হতে পারে না? সন্তানের জন্য একটা চাদর চড়িয়ে গেলে হত না? পরক্ষণেই মনটা বলে উঠল, ধুর। কী সব ভাবছি। মনেরও উত্তর মেরু দক্ষিণ মেরু আছে। দুর্বল মুহূর্তে হঠাৎ-হঠাৎ কী যে মনে হয়… অনিকেত আগের প্রশ্নের রেশ ধরে বলল, এমনিই এসেছি। তোমরা?

জয়ন্ত বলল, এলাম যখন আমি একটু পুজো দিয়েই যাব। আফটার অল এলজিবিটি-দের ভগবান। বন্ধুটা অবশ্য পুজো দেবে না।

—কী করো তুমি জয়ন্ত? কাজ-টাজ, না কি…

—আমার একটা বিউটি পার্লার আছে।

—জেন্টস না লেডিজ?

—নাম তো দিয়েছি ‘সাজাব যতনে’। ভেবেছিলাম ইউনিসেক্স করব। ছেলেরাও আসবে, মেয়েরাও আসবে। দু-চার পিস ছেলে আসে, ফেসিয়াল-টেসিয়াল করে, কিন্তু মেয়েরাই আসে মূলত।

—কী করে ওরা?

—কী আবার? সাজুগুজু করে। ফেসিয়াল, পেডিকিওর, ম্যানিকিওর, ফাইলিং এসব। —ফাইলিং-টা কী?

—ম্যানিকিওর-এর একটা পার্ট। মানে হাতের নখ, আঙুল ওগুলো ঠিকঠাক করা হল ম্যানিকিওর, আর নখটাকে শেপ দিয়ে চকচকে করাটা হল ফাইলিং।

—ম্যাসাজও করো?

—ওমা, ফেসিয়ালের বড় পার্টই তো ম্যাসাজ

—সে তো মুখে। ঘাড়ে, হাতে করো না…আমরা যেমন সেলুনে গিয়ে মাঝে-মাঝে….

—হ্যাঁ, করি। আমার দু’জন খদ্দের আছে হোল বডি করায়।

—তোমার কিছু অসুবিধে হয় না মেয়েদের গায়ে এভাবে….

—ধুর, আমার ফড়কায় না।

—ওদের? ওদের অস্বস্তি হয় না? শত হলেও তুমি ব্যাটাছেলে….

—এটা খুব কঠিন প্রশ্ন করেছেন দাদা। ওরা কতটা ব্যাটাছেলে ভাবে কে জানে? কিছুটা তো ভাবে, কেউ-কেউ। আবার ব্লিচ করার সময়, বা অন্যসময়, বউদিরা এমন খুলে দেয়, যেন আমি ওদের ননদ। কনেও সাজাই তো। বিয়ের আগে কনের শুধু মুখে নয়, অনেক অঙ্গে দুধ- মধু-মুলতানি মাটি-শশার রসের প্যাক লাগাই। অনেক কথা আছে, পরে বলব। আসুন না আমাদের বাড়িতে। সোমনাথদার বাড়ির কাছেই তো। ‘লিপিকা’ সিনেমা হল-এর পিছনে…।

জয়ন্তর ‘বয়ফ্রেন্ড’ বিশেষ কথা বলছে না। ও একটু স্মার্ট থাকার চেষ্টা করছে। সিগারেট খাচ্ছে। অনিকেত বুঝল, মানে অভিজ্ঞতায় বুঝতে পারল, যে, জয়ন্ত এবং তপন দু’জনই সমকামী। সমকামীদের আধুনিক টার্মিনোলজি-তে বলা হচ্ছে ‘এমএসএম’ মানে, ‘ম্যান সেক্স উইথ ম্যান’। জয়ন্ত হল ‘বটম এমএসএম’, তপন হল ‘টপ এমএসএম’।

জয়ন্ত বলল—আজকের মেলাটা একদম নিরামিষ। ওরা আসেনি কিনা।

আগে কখনও এসেছে কি না জিগ্যেস করায় জয়ন্ত বলল, বছর তিনেক আগে একবার এসেছিল।

তার মানে ওরাও এই মেলাটাকে নিজেদের মনে করে?

জয়ন্তকে দেখে কিছুই বোঝা যাবে না যে, ওর মধ্যে অন্য কোনও সত্তা গোপনে বাস করছে।

অনিকেত ঘুরছে। একটা নাগরদোলাও আছে। গোল হয়ে ঘোরে না, নিচ থেকে উপরে ওঠে। ওখান থেকে আহ্লাদ-মেশানো হাসির ছররা আসছে। ওখানে দাঁড়িয়ে মানুষের খুশি দেখতে ভাল লাগছিল। ঘুরন্ত চাকাটা থামলে যারা নেমে এল, ওদের কয়েকজনকে দেখে বেশ অবাক হল অনিকেত।

জিন্‌স-গেঞ্জি, জিন্‌স-শার্ট পরা কয়েকটি কমবয়সি ছেলে হইহই করতে-করতে নেমে এল। ওদের চোখে কাজল, কারও ঠোঁটে লিপস্টিক। এক কানে দুল পরাও কয়েকজন। একজনের কানে আলো ঝলকাচ্ছে। হিরে? নাও হতে পারে, হয়তো নকল হিরে।

একজন বলল, উঠতে-উঠতে আকাশে উড়ে যেতে ইচ্ছে করছিল।

একজন বলল, আমারও।

অন্য একজন ওকে বলল, তুই উড়ে যেতেই পারতিস, তুই তো পরি। সেই তো, যাকে এক ঝলক দেখেছিল গঙ্গার ঘাটে। মঞ্জুর ছেলেটা। ছেলেটার বন্ধু বা পরির অরূপও কি আছে? অরূপকে দেখতে পেল না। ওরা মজা করতে-করতে, অন্যদিকে চলে গেল। পরি কি অনিকেতকে দেখতে পেয়েছে? দেখলে কি চিনতে পারবে? মঞ্জুর সঙ্গে পরির চোখাচোখি হয়েছিল। মঞ্জুর পাশে অনিকেতও তো ছিল। পরে মঞ্জুকে জিজ্ঞাসা করেছিল অনিকেত, ওই ব্যাপারটা নিয়ে কোনও কথা হয়েছিল কি না পরির সঙ্গে। মঞ্জু বলেছিল—ডাইরেক্ট কিছু বলেনি, তবে একদিন বলেছিল—তুমি কার সঙ্গে মিশছ না মিশছ, কোথায় যাচ্ছ, কী কোচ্ছো আমি জানতে চাইনি, তুমিও আমার ব্যাপারে ইন্টারফেয়ার কোরো না। আমি বলেছিলাম, যাকে দেখেছিলি ওর সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল, ছোটবেলার বন্ধু। ও থামিয়ে দিয়ে বলেছিল, আমি কি জানতে চেয়েছি মা?

সন্ধে নাগাদ ফিরে এল স্টেশনে। একটা ট্রেন দাঁড়িয়েছিল। মেলা উপলক্ষে স্পেশাল ট্রেন দেওয়া ছিল, ওটা সেরকম। খুব বেশি ভিড় ছিল না। জানলার ধারে একটা জায়গা পেয়ে বসে গেল। একটু পরই এল জয়ন্ত আর তপন। ওরা অনিকেতকে দেখল। হয়তো বা ওরা আলাদাই বসতে চেয়েছিল, কিন্তু অনিকেতকে দেখে ভদ্রতাবশত অনিকেতের পাশেই বসল। অনিকেতের চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা চক্ষুভঙ্গি করল, অনেকটা চোখ মারার মতো। এর গূঢ়ার্থ অনিকেত বুঝল না। জয়ন্তর হাতে একটা ‘সানন্দা’ ছিল। ওটা খুলে ‘মেচেতা হলে কী করবেন’ পড়তে লাগল।

একটু পরই হইহই করতে-করতে ট্রেনে উঠল ওই দলটা, যাদের হাসি আর হল্লা নাগরদোলা থেকে ছিটকে আসছিল। বসেই একজন ব্যাগ থেকে ক্যাডবেরি বের করে সবাইকে ভাগ করে দিল। জয়ন্ত বলল, সব লালুপুসু বাচ্চা।

—মানে?

—মানে, আবার কী? বাপের পয়সায় শখ মেটাচ্ছে। দেখুন হয়তো বাপের এক ছেলে। কিছু বলতে পারছে না। আমার মতো স্ট্রাগল করতে হয় না ওদের।

অনিকেত পরিকেও দেখতে পেল। ফুলপ্যান্ট আর হাওয়াই শার্ট পরে আছে ও। অন্যদের তুলনায় ও একটু ম্রিয়মাণ। জামাটাও সাধারণ, একটু শর্ট ঝুল।

একটি মেয়েকেও দেখতে পেল অনিকেত। জয়ন্তকে জিগ্যেস করল—ওদের দলে মেয়ে কেন? ওদের গার্লফ্রেন্ড?

জয়ন্ত বলল, মেয়ে কী করে বুঝলেন? বুক দেখে? ওটা লিল্কি নয়, ইলু। —ইলু মানে?

—নকল। নকল।

মেয়েটাকে দেখতে থাকে অনিকেত। না কি ছেলেটাকে? চুলটা এমনভাবে ছাঁটা, যে, ওটাকে ছেলেদেরই ছাঁট বলা যায় না। অনেক মেয়েও আজকাল এরকম করে চুল ছাঁটে। কানের ওপরে চুল। কিছু চুল কপালে এসে পড়েছে। গোঁফদাড়ির চিহ্ন নেই। ভ্রু-টা খুব সুন্দর। যেন চোখের ওপর এক-একটা ফার্স্ট ব্র্যাকেট। চোখের পাতার ওপর নীলচে কিছু লাগিয়েছে। আইশ্যাডো, না কি মাসকারা? জিন্স-এর ওপরে গেঞ্জি। গেঞ্জি ঠেলে বেরিয়ে পড়েছে বক্ষ। বলল, আজ কাঁপিয়ে দিয়েছি। সবাই আমার দিকে জুলজুল করে তাকাচ্ছিল।

অন্য একজন বলল, মাজারে ও গোলাপ দেয়নি। গোলাপ কেন কেনেনি জানিস তো, কাঁটার ভয়ে। কাঁটা লেগে গেলে ভুস হয়ে যেত।

উঁচু বুকওলা মেয়েটা হিহি করে হেসে অন্য একজনের গায়ে গড়িয়ে পড়ল।

পরির কানে একটা হেড-ফোন। গান শুনছে। এসব শুনছে না বলে একজন ওর কান থেকে ইয়ার-ফোনটা খুলে নিজের কানে দিল। ও ব্বাবা, রবীন্দ্রসংগীত। খোল তো। এখন মজা কর। পুলু-র ইলুতে ছুঁচ ফুটিয়ে দে।

পুলু বলে মেয়েটা বলল, তোদের কী বলি? জেলাস? কেন এ দু’টোর পিছনে লেগেছিস? তোদের তো সাহস নেই লাগানোর।

অন্য একজন বলল, তোর এগুলো নিয়ে বাড়ি যাওয়ার সাহস আছে?

ও বলল—এখন হয়তো নেই, কিন্তু একদিন পার্মানেন্ট ব্রেস্ট বানিয়ে বাড়িতে ঢুকব। দেখে নিস।

আরও দু-একজন যাত্রী এল। একজন পাকা কলার ফেরিওলা এল। কলা নিয়ে একটু ঠাট্টা- ইয়ার্কি হল। তারপর পুলু বলল, এবার আমি পল্লব হয়ে নিচ্ছি। অনেক হয়েছে। গেঞ্জিটার তলা দিয়ে হাত ঢুকিয়ে এক-এক করে দু’টো জলভরা রবারের বল বার করে আনল। একজন বলল, বল্ হরি, অন্যরা বলল, হরি-ই-ই বল্। ‘বলো হরি’ নয়, বল্ হরি। হরি বল। বল দু’টো নিয়ে লোফালুফি খেলতে লাগল ওরা।

একজন পল্লবকে জিগ্যেস করল—ওটা খুললি না? পল্লব বলল, ওটা ভিতরেই থাক। বাড়ি গিয়ে বের করব।

মনে হয় ব্রা-এর কথা বলছে। ওটার খোপেই তো জল-বেলুনগুলো ছিল।

পল্লব জলের বোতল থেকে জল বের করে মুখটা ধুয়ে নিল। চোখের পাতায় জল দিল। রুমাল দিয়ে মুছে নিল। পুনপল্লব ভব হতে লাগল। এবং তক্ষুনি অন্য একজন হাতের ব্যাগ থেকে ছোট আয়না এবং লিপস্টিক বের করে নিজের ঠোঁটে বোলাতে লাগল।

ভাবটা এই-দ্যাখ, আমি কাউকে কেয়ার করি না।

কত যে অদ্ভুত মানসিকতা…।

অথচ জয়ন্ত, যে ওর পাশে বসে আছে, সে কিন্তু কোনও সাজগোজ করেনি। কত যে ভাঁজ, কত যে রকমফের বোঝা মুশকিল। ওদের মধ্যে কেউ হয়তো মেয়েলি পোশাকেই তুষ্ট, কেউ ট্রান্সজেন্ডার, কেউ-বা এমএসএম বটম, কেউ টপ। টপ মানে সক্রিয়। ওদের মধ্যে বোধহয় কেউ নেই। যদি থাকে তো জয়ন্তর পাশে বসে আছে তপন

ট্রেন ছাড়ল। অনিকেত দেখল জয়ন্ত টুক করে হাতটা কপালে ছোঁয়াল। পিরের উদ্দেশেই হয়তো।

জয়ন্ত অনিকেতের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, ‘আসুন না নৈহাটিতে…’

অনিকেত বলল, আসব।

জয়ন্ত বলল, ফোন নম্বরটা দিন।

অনিকেত ওর কার্ডটা দিল।

অনিকেত খবরের কাগজটা ব্যাগ থেকে বের করল। কাগজ পড়তে লাগল।

জয়ন্তর বয়ফ্রেন্ড ঘুমোচ্ছে।

ট্রেনের শব্দ ছাড়িয়ে ওদের হল্লা শোনা যাচ্ছে।

একটা বাদামওলা এল।

জয়ন্ত বলল—অনিকেতদা, বাদাম খাই। চুপচুপ বসে না-থেকে টুকটাক….

বাদাম নেওয়া হল। দু’জনের থাইয়ের ওপর খবরের কাগজ পেতে। বাজপেয়ীর হাতের ওপর বিটনুন রাখল। সিনেমার পাতাটা অনিকেতের কোলের ওপর। ‘কুছ কুছ হোতা হ্যায়’, “বড়ে মিঞা ছোটে মিঞা’। শাহরুখ-কাজল-রানি মুখার্জির ওপর ছড়িয়ে আছে বাদাম। জয়ন্ত একটা-একটা করে বাদাম তুলে নিচ্ছে। বাদাম নেওয়ার সময় অনিকেতের মনে হল অনিকেতের উরুর ওপর অনাবশ্যক ভাবে বেশি সময় ধরে হাত রাখছে জয়ন্ত। একবার বাদাম তুলে নেওয়ার সময় অনিকেতের উরুসন্ধিতে আঙুল বোলাল। কিছু ধরার চেষ্টা করল, যদিও খবরের কাগজের ওপর থেকেই। অনিকেত আস্তে-আস্তে বলল, কী হচ্ছে জয়ন্ত?

জয়ন্ত অনিকেতের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, কুছ কুছ হোতা হ্যায়।

অনিকেত বলল—ভুল করছ। আমি না।

১৯

জ্যান্ত দেশি পুঁটি পাওয়া গেল বাজারে। জলের রুপোলি শস্য শুধু ইলিশ মাছ কেন? দাম বেশি বলে? পুঁটি-ও তো রুপোলি শস্য। একটা পলিথিনে জল ভরে মাছগুলো এনেছিল। বাড়িতে আনার পরেও কয়েকটা জ্যান্ত ছিল। দেখে, শুক্লার খুশি হওয়ার কথা, কিন্তু ওর মুখে খুশি ভাব দেখা গেল না। শুক্লা জানাল, দুলালের মা আজও আসেনি।

গতকালও কামাই করেছে দুলালের মা। ও খুব একটা কামাই করে না। তার মানে, জ্বরজারি হয়েছে। তার মানে, আরও কামাই করার সম্ভাবনা আছে। শুক্লার মনখারাপ হওয়ারই কথা। পুঁটি মাছগুলো অনিকেতই কাটবে। হাঁটু মুড়ে বসতে শুক্লার বেশ অসুবিধে।

অনিকেত এসব পারে। কী করে যেন শিখে গিয়েছে। মাছের ফিজিওলজি মোটামুটি জানে। ভোলামাছের মাথার দিক ঘেঁষে ইনসিশন দিলে নাড়িভুঁড়িগুলো বেরিয়ে আসে। পুঁটির মাঝামাঝি জায়গায়। মৌরলার তলার দিকে। খেয়াল রাখতে হবে, পিত্ত থলেটা বেরিয়ে গিয়েছে কি না। নইলে তেতো লাগবে।

পুঁটিগুলো মেঝেতে শুইয়ে দিয়ে ছুরি দিয়ে আঁশ ছাড়াচ্ছিল অনিকেত। ছাই হলে সুবিধে হত। এখন ছাই পাবে কোথায়? মাছটা টাটকা ছিল বলে পিছলে যাচ্ছিল। কয়েকটা পুঁটিমাছ তখনও লাফাচ্ছিল। ওদের জ্যান্ত শরীর থেকে আঁশগুলোকে চেঁচে নিচ্ছিল ছুরি। তারপরও জীবন্ত থাকতে পারে মাছটা? তখন পেটের মাঝখানে চিরবে, দু’-আঙুলে চাপ দেবে, আর মাছের শীতল, দীন রক্তসমেত বেরিয়ে আসবে দলা-পাকানো লিভার-গলব্লাডার-ইনটেনস্টাইন- হার্ট-লাং। নিষ্ঠুর মনে হয় না তো…। মমতাময়ী মা-রা তো ক্রোড়ের শিশুকে স্তন্যপান করাতে- করাতে হাসিমুখে মাছ কোটে। আসলে মাছ যে আওয়াজ করতে পারে না, কণ্ঠ ছাড়তে পারে না জোরে। চিৎকার করতে পারে না। তাই নির্জন মাছের ব্যথা এইখানে হয়ে আছে চুপ।

এ সময় এল দুলালের মা। সে কি দাদাবাবু, আপনি মাছ কুটতিছেন? সরো সরো…।

মাছ কুটছিল দুলালের মা, কুটতে কুটতেই বিস্ফোরণের মতো কেঁদে ফেলল। বঁটি উল্টে গেল।

–কী হল, ও দুলালের মা…?

দুলালের মা কান্না থামানোর চেষ্টা করে। অনেকটা বাতাস ভিতরে নিয়ে বলল—দুলালরে ফিরে পালাম।

—তাই না কি? ফিরেছে ও? কাঁদছ কেন তবে? শুক্লা উচ্ছ্বসিত। অনিকেত ভাবল ওটা ওর আনন্দাশ্রু।

দুলালের মা বলল—কিন্তু সেটা আমার দুলাল না, অন্য দুলাল।

—মানে? কী বলছ বুঝতে পারছি না তো…।

—আবার কাঁদতে থাকে দুলালের মা। রক্ত-কাটা পুঁটিমাছের শরীরে নুনমাখা জল পড়ে। জল-মাখা চোখে বলে—কিছু টাকা দাও না দাদাবাবু…। দুলাল হাসপাতালে।

—কেন? কী হয়েছে দুলালের?

—দুলালের পেট কাটি দেচে।

—কে?

–কী করে কব? দুলাল কতা কচ্চে না।

–কোথায় পাওয়া গেল ওকে?

—খাজাই পিরের মাজারে।

—তবে যে বললে ও তোমার দুলাল নয়, অন্য দুলাল?

এই দুলাল বেলাউজ পরা। যখন খপর পেয়ি দেকতি গেলাম, দেখি শাড়িখান দলাপ্যাঁচা পড়ি আচে পাশে। রক্ত। চোকে মাছি। মুখটা দুলালের মতো। সবাই বলল, এটাই দুলাল।

আমুও দেকলাম, কপালে কঞ্চিকাটা দাগ, কানের তলায় জড়ুল। হাঁ করে আছে, ঘুমোলে যেমন পানা হাঁ করি থাকত। অবিকল। মুখটা দেখি মনে হল আমার দুলাল। আগে একবার দুলাল দেখতি গেছিলাম, তার মুখ ছিল না। এই দুলালের মুখ আছে, কিন্তু পুরুষ চিন্ন নাই। ওখেনে মেয়েলোকের মতো। ও কি করে আমার দুলাল হবে? একজন বলল, নিশ্বেস পড়তিচে। পুলিশে খপর গেল। পুলিশ হাসপাতালে নে গেল। আমুও গেলাম।

—কোন হাসপাতাল?

—নীলরতন।

—তারপর?

—হাসপাতালে সেলাই দেছে পেটে। বিকালা জ্ঞান এসিচে। এবার যাব হাসপাতাল।

—ও তো তোমার দুলাল না-ও হতে পারে। হয়তো একইরকম মুখ…এরকম তো হয়…।

–আমার দুলাল না হয় যদি, কারও তো দুলাল …।

এই সরল, নিরীহ বাক্যটা বোমার মতো আছড়ে পড়ল।

—তোমার দুলাল নয় বলছ কেন দুলালের মা? মা কি নিজের ছেলেকে চিনবে না? হয়তো তোমার সঙ্গেই দেখা করতে আসছিল, হয়তো অনেক টাকা রোজগার করেছিল, সেই টাকাই হয়তো ছিনতাই করতে গিয়ে কেউ ওকে মেরেছে। চিন্তা কোরো না, হাসপাতালে আছে যখন, ঠিক ভাল হয়ে যাবে, দেখো, তোমাকে মা বলে ডাকবে। শুক্লা বলল।

শুক্লার শেষ বাক্যটা ভিতর থেকে। ‘একবার মা বলিয়া ডাকো’ শুনতে পেল অনিকেত। যেটা শুক্লার প্রাণের মাঝে লুকিয়ে থাকে।

দুলালের মা বলল, তোমার মুকে ফুল-চন্দন পড়ুক। যেন ভগবান তাই করে। কিন্তু ও যদি দুলাল হবে, তবে দুলালের চিন্ন কই? ওকে তো উদলা দেখেছি, মাটিতে চিৎ হয়ে পড়েছিল। অনিকেত কিছু একটা আশঙ্কা করল, কিছু বলল না। শুক্লা বলল, আজ তো রবিবার, অপিস নেই, দুলালের মায়ের সঙ্গে গেলে ভাল হত না?

অনিকেত তো সেটাই ভাবছিল। শুক্লা আগেই বলে দিল।

এসব হাসপাতাল থেকে তথ্য জোগাড় করা খুব কঠিন ব্যাপার। নার্সের কাছে জানা গেল, এটা পুলিশ কেস। জানা গেল জ্ঞান ফিরেছে। জানা গেল, আজ রবিবার, বড় ডাক্তার আসবেন না। আর একটু পরে হাউস স্টাফ আসবে। একটা কাগজ ধরিয়ে বলল, ওষুধ আনতে হবে। সেই লিস্টে স্যালাইন এবং অ্যান্টিবায়োটিক ছিল। দুলালের মা কাতর গলায় জিগ্যেস করল, বাঁচবে তো দিদিমণি? মোটামতো নার্সটি জবাব দিল, আমি কী করে বলব? আমি কি জ্যোতিষী?

—কার আন্ডারে ভর্তি আছে?

নার্সটি বলল, ডাক্তার পলাশ সেনগুপ্ত। এমনভাবে বলল, যেন একটা বাউন্সার। অনিকেত তো পলাশ সেনগুপ্তকে চেনে। রেডিও-র টকার। সার্জেন। খুব ভাল ডাক্তার।

দুলালের মা মেল সার্জিকাল ওয়ার্ডের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল। নার্স বলল, ভেতরে ঢোকার ধান্দা? এখন নয়। ভিজিটিং আওয়ার শুরু হয়নি। নিচে গিয়ে বসুন।

—হাউস স্টাফ কখন আসবে? অনিকেত জিগ্যেস করে।

কোনও কিছু জিগ্যেস করতেই ভয়-ভয় করে—যেন কিছু গোপন কথা জিগ্যেস করছে।

—ওদের ব্যাপার জানি না। বারোটাতেও আসতে পারে, বেলা একটাতেও আসতে পারে।

—কেস খারাপ হলে?

–কলবুক পাঠাই…।

তা হলে কেসটা খুব খারাপ নয়। একটু আশ্বস্ত হয় অনিকেত।

হাউস স্টাফ কখন এল বুঝব কী করে? অনিকেত জিগ্যেস করে।

—ডাকলেই বুঝবেন। নম্বর ধরে পেশেন্ট পার্টিকে ডাকবে। এখন নিচে গিয়ে বসুন—যান।

নিচে গিয়ে কোথায় আর বসবে? অনেকে মেঝেতে বসে আছে। কুকুর সরিয়ে দুলালের মা বসল। অনিকেত ওষুধপত্র কিনে এনে দিয়ে এল। ঘুরঘুর করছে। পাতালে, হাসপাতালে। একবার দু’টো কচুরি সাঁটিয়ে এল। দুলালের মায়ের জন্যও নিয়ে এল। ‘খাব না, খাব না’ করে খেয়ে নিল।

বেলা একটা নাগাদ ডাকাডাকি শুরু হল। গাইনি এল, ওদিকে নেফ্রোলজি-র ডাক পড়ল। একটা ছেলে এল, ‘সার্জিকাল — সার্জিকাল মেল’ হাঁক পাড়তে পাড়তে। অনিকেত ওর কাছে গেল। ও স্থির নেই। অনিকেতও স্থির নেই। ওর ঠোটের তলাটায় অল্প দাড়ি। ছোট করে। এটা নতুন ফ্যাশন। হাতে মোবাইল ফোন। অনিকেতের নেই। বেশ দামি। ফোন করলে তো বটেই, ফোন এলেও নাকি পয়সা লাগে। ছেলেটা বলছে—মস্তি করো গুরু, কিচ্ছু ভেবো না, আমি তো তোমার সেবার জন্য আছি। না, না, কেউ খসেনি…। কথা বলা শেষ হলে মোবাইলটা কোমরের খাপে গুঁজে বলতে লাগল—এমএস দু’থার্টি-পেশেন্টের পেচ্ছাপ হয়ে গিয়েছে, গায়ে জ্বর আছে; টু-থার্টি এইট কাল ছুটি হয়ে যাবে…। টু ফর্টি ফোর–এক বোতল রক্ত লাগবে, কাল নিয়ে এসে জমা দেবেন। এ প্লাস…

অনিকেত বলল—আমার পেশেন্ট। কী হয়েছে ওর—

—আপনার পেশেন্ট, কী হয়েছে জানেন না?

—না, ঠিক জানি না –

—জেনে আসবেন, টু ফর্টি সিক্স…

ফেঁসে গেল অনিকেত। পরদিন যেতে হল। রক্তদান-ই হবি এমন একজন ছেলে জোগাড় হল বিবেকানন্দ ‘স্পোর্টিং ক্লাবে। রিকুইজিশন নিয়ে ব্লাড ব্যাংক, তারপর নীলরতন। পলাশ সেনগুপ্তকে খুঁজে বের করল। ওঁর ঘরের সামনে ভিড়। ভিড় ঠেলে ঢোকার চেষ্টা করতে জনৈক গ্রুপ ডি বলল, কোথায় যাচ্ছেন? অনিকেত বলল, পলাশবাবু আমার বন্ধু। গ্রুপ ডি বলল, বন্ধুত্ব বাড়িতে। কিন্তু অনিকেত দেখল, মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ-রা অবলীলায় ঢুকে যাচ্ছে।

ভিড় পাতলা হলে দেখা করল। পলাশ সেনগুপ্তকে দুলাল মণ্ডল বলাতে উনিই জিগ্যেস করলেন—ও কে হয় আপনার?

অনিকেত বলল, যা বলার।

—ওর তো টেস্টিকেলস, পেনিস, কিচ্ছু নেই। মনে হয় ক্যাসট্রেটেড। আনসাইনটিফিক্যালি।

—তাই না কি?

–জানতেন না?

–কী করে জানব? বহুদিন নিরুদ্দেশ ছিল। দশ বছর পর ফিরেছে।

—কিন্তু ছুরি মারল কে? ভাগ্য ভাল লিভার-স্প্লিন এসব ঠিক আছে। ইনটেনস্টাইনের এক জায়গায় ফেঁসে গিয়েছিল। ঠিকঠাক করে দিয়েছি। প্রচুর ব্লিডিং হয়েছে। ও কি হিজড়ে খাতায় নাম লিখিয়েছিল?

—আমরা জানি না। ওর লাস্ট দশ বছর আমাদের কাছে ব্ল্যাংক।

পলাশ সেনগুপ্ত বললেন—খোঁজ নেবেন তো…। বেঁচে তো যাবে মনে হয়। তারপর কি ওদের দলেই ভিড়বে নাকি?

এর উত্তর তো অনিকেতের জানা নেই।

কোন কুক্ষণে ‘সন্ধিক্ষণ’ অনুষ্ঠানটা করতে গিয়েছিল। যত অন্তস্থ-য ওর কপালেই জুটছে। অন্তস্থ-য ঔ-কার। পবন রঞ্জন, বাসবদের সে এড়িয়ে চলতেই পারে, কিন্তু মঞ্জু? ওকেও আস্তে- আস্তে ফুটিয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু দুলাল? দুলালকে ফোটানো মানে দুলালের মা-কে ফোটানো সেই কবে থেকে দুলালের মা এ বাড়িতে। সবার জন্য করেছে, অনির বাবা-মায়ের সেবাও। একটা কিছু এধার-ওধার করেনি। যদি আত্মীয় বলে কিছু হয়, দুলালের মা তাই। তা হলে দুলালও। কিন্তু দুলাল কেন হিজড়ে হতে গেল? হিজড়ে হয়ে যাওয়া দুলাল, সমকামী পরি, ফ্রিজিড মঞ্জু। যত সব যৌ জুটেছে। ধুর শালা। এদের এক-এক করে হঠাতে হবে।

শুক্লা বলল—দুধ মন্থন করলে মাখন ওঠে। তুমি নোংরা মন্থন করেছ, নোংরার ক্রিম উঠছে এখন। মাখো।

অনিকেত বলল, এখন তো ওসব করি না। এখন তো প্রতিবন্ধীদের জন্য, বিশেষত ব্লাইন্ডদের জন্য, একটা প্রোজেক্ট শুরু করতে চলেছি। ব্লাইন্ড-রা খুব রেডিও শোনে। ওদের কথা ভেবে স্পেশাল প্রোগ্রাম। পুণ্য হবে।

শুক্লা বলল, আগে পাপের ফলটা ভোগ করে নাও, তারপর তো পুণ্য।

তবু তো শুক্লা মঞ্জুর কথা তেমন কিছু জানে না। ওর ছেলের কথাও নয়।

পরদিন অনিকেত দুলালের মা-কে বলল—আমার পক্ষে তো রোজ-রোজ হাসপাতালে যাওয়া সম্ভব নয়, পাড়ার ছেলেদের ধরো। একা গিয়ে তুমি কিছু বুঝবে না। ওষুধপত্র আনা আছে, ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কথা বলা আছে…। দুলালের মা মাথা নিচু করে বলে, পাড়ার লোকরা হাসাহাসি করছে। ‘দুলালের মা’ বলে যে ডাকত, সে কাল ডাকল…

গলা রুদ্ধ হয়ে এল ওর।

—কী ডাকল?

—ডাকল ‘ও হিজড়ের মা’।

—সে ডাকুক গে। বিপদে-আপদে ওরাই তো …

—তাই বলে বিপদের দিনে টোন-টিটকিরি দেবে?

—দিকগে যাক। প্রথম-প্রথম একটু অমন করবেই তো। আগে ভাল হয়ে ঘরে আসুক, পরে দেখা যাবে কেন ওর এমন হয়েছে।

দুলালের মা বলল—শত্রুতা করে কেউ ওর ওসব কেটে দিয়েছে। ওর মুখপুড়ি বউটারই কাজ। ও-ই লোক দিয়ে অমন করিয়েছে।

মাথা থাবড়াতে থাকে দুলালের মা।

কয়েকটা দিন হাসপাতাল থেকে রেহাই পাওয়া গেল হয়তো। যদি বেঁচে যায়, ব্যাপারটা জানা যাবে। দুলাল প্রথম দিকে কাঁচা-আনাজের ব্যবসা করত। তারপর তো সাইকেল করে আলতা-সিঁদুর-টিপ-নেলপালিশ ফেরি করত। ওর তো ছেলেও হয়েছিল একটা। তারপর নিরুদ্দেশ। ও কি হিজড়ের দলে নাম লেখাল?

শুক্লার সঙ্গে এ নিয়ে কথা হচ্ছিল।

শুক্লা বলল, ওর বউটা সুবিধের নয়। যদি ওর বউটার খোঁজ পাওয়া যায়, তা হলে বোঝা যেত। দুলালের মায়ের কথাটাই হয়তো ঠিক। ও-ই কলকাঠি নেড়েছে।

অনিকেত বলল, তাই বলে এতদিন পরে কেন ওর কলকাঠি কেটে দিতে যাবে?

শুক্লা বলল, কাগজে পড়েছিলাম কোনও বউ তার স্বামীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বঁটি দিয়ে নিজের স্বামীর ওটা কেটে দিয়েছিল।

—তাই বলে এতদিন পরে কেন কাটতে যাবে?

—কে জানে? ভেতরে-ভেতরে রাগ ছিল হয়তো। কিংবা এমনও হতে পারে অনেক আগেই কেটে দিয়েছিল। তারপর লজ্জায় বাড়ি ছেড়েছে। ভেবেছে মুখ দেখাবে কী করে?

—মুখ দেখালে তো কোনও দোষ নেই, ‘মুখ’ মানে কী বলতে চাইছ তুমি?

—হ্যাঁ, ‘মুখ’ মানে বলতে চাইছি ওই জায়গাটাই। তুমি যা ভাবছ। ওটাই তো ছেলেদের “মুখ’। ওটা নিয়েই তো পুরুষমানুষের যত তড়পানি।

—ধুর, ওর বউ ওর কলকাঠি কেটে দিল আর কেউ জানবে না? ওর মা-ও জানবে না? দুলালের মা ঠিকই আমাদের বলত।

শুক্লা একটু চিন্তায় পড়ল। তারপর বলল, এমনও তো হতে পারে, দুলাল সাইকেল করে যে মেয়েদের সাজবার জিনিস ফেরি করত, তখন হয়তো কারও সঙ্গে, লটরপটর হয়েছে। তখনই বউবাচ্চা ছেড়ে ভেগেছে। ব্যাটাছেলেদের কিচ্ছু বিশ্বাস নেই। তারপর ওই নতুন বউ ওর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে একদিন বঁটি দিয়ে কেটে দিয়েছে।

অনিকেত বলল—অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বঁটি দিয়ে কেটে ফেলার থিয়োরিটা ছাড়ো। ওর অত্যাচার করার ইচ্ছে বা ক্ষমতা ছিলই না। বরং তোমার ওই অত্যাচারটা কম হত বলেই ওর বউ পালিয়েছে—যেখানে অত্যাচারটা ভাল পাওয়া যায়। ‘অত্যাচার’ শব্দটা নিয়ে বেশ একটু খেলাধুলো করল অনিকেত। তারপর বলল—আমার কি মনে হয় জানো, ও নিজেই ওসব কেটে ফেলেছে।

শুক্লা বলল, নিজে? নিজে হাতে? তা আবার হয় না কি? অনিকেত বলল—নিজে হাতে নয়, কাউকে দিয়ে। হিজড়েরা তো এটা করেই। আর যারা রি-অ্যাসাইনমেন্ট সার্জারি করে ছেলে থেকে মেয়ে হতে চায়, তারা ভাল সার্জেনকে দিয়ে করিয়ে নেয়। দুলাল তো হিজড়েই হয়েছিল। ওর তো শাড়ি ছিল পরনে।

শুক্লা বলল, তাই যদি হবে—পিরের কাছে এসেছিল কেন? এমনও তো হতে পারে ওকে শাড়িটাড়ি পরিয়ে খুন করার চেষ্টা হয়েছিল যেন লোকে ভাবে ও হিজড়ে। মানে ওকে হিজড়ে সাজানো হয়েছিল।

বাব্বা! শুক্লা তো বেশ পেঁচিয়ে ভাবতে শিখেছে। ফেলুদা পড়ছে কিনা, তবে পিরের দরগায় কেন এসেছিল এটা একটা প্রশ্ন।

বাসুবাটিতে তো হিজড়েরা যায়। ওখানেও পিরের মাজার আছে। খাজা জালালুদ্দিন।

পিররা অনেকেই সুফি। সমাজের এঁটোকাঁটাদের ওঁরা কাছে টানতেন, ইসলামেও দীক্ষা দিতেন। হিজড়েরা হয়তো পিরদের কাছে মানসিক শুশ্রূষা পেত। আজমির শরিফে খাজা মৈনুদ্দিন চিস্তির দরগায় নাকি অনেক হিজড়ে যায়, ওরা খাজাবাবা-কে খুব মানে। ঘুটিয়ারি শরিফেও শ্রাবণ মাসে মেলা বসে। বাংলার মেলা ও পূজাপার্বণ’ নামে একটা সরকারি বই আছে, অশোক মিত্র সম্পাদিত। ওখানেও লেখা আছে—ওই মেলায় আগে হিজড়া সম্প্রদায়ের মানুষের প্রচুর আগমন হত। ইদানীং কমে যাচ্ছে। ওই পিরের নামের আগে খাজা নেই, গাজি আছে। গাজি সৈয়দ মোবারক আলি শাহ সাহেবের মাজার। বীরভূমের পাথরচাপড়ির হজরত মহবুব পিরের মাজারেও হিজড়েরা যায়। এরকম আরও পির আছেন। গরিফা-র চশমাবাবা পির, ঝরিয়া-র কালো পির…। চব্বিশ পরগনা খুঁজে খাজাইতলা-র খাজাই পিরের কথা পেল না। এখানে তো মেলা হয় না, তাই হয়তো উল্লেখ নেই। তা ছাড়া এসব বইতে সব কিছু অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব নয়। আমাদের দেশ বড় বিচিত্ৰ দেশ।

‘খাজা’ কথাটার মানে কী? অনেকের নামের আগে ‘খাজা’ থাকে। কাকে জিগ্যেস করা যায়? সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ-কে ফোন করল অনিকেত। উনি বললেন, ‘খাজা’ শব্দটা ফারসি। এটা একটা সম্মানসূচক বিশেষণ। এর মানে, অনেকটা ‘প্রভু’র কাছাকাছি। যদিও প্রভু হলেন আল্লা, সবাই তাঁর বান্দা। এই শব্দটা শিষ্যরাই প্রয়োগ করে থাকে। শেখ বা সৈয়দদের মতো এটা বংশগত উপাধি নয়।

সিরাজ সাহেব অনিকেতের খুব পরিচিত কেউ নন, কিন্তু খুব ভাল করে কথা বললেন উনি। আসলে অ্যাকাডেমিক কোনও বিষয় পেলে উনি খুব খুশি হন। অনিকেত ওর সমস্যাটার কথা বলল। খাজাইতলা-র কথাও জানাল। সিরাজ সাহেব বললেন—তোমার ওই খাজা কোনও ‘খোজা’ থেকে আসেনি তো? খোঁজ নিয়ে দ্যাখো তো?

কী করে খোঁজ নেব? জিগ্যেস করে অনিকেত।

—দ্যাখো, ঠিকই গল্পকথা ছড়িয়ে থাকবে ওই এলাকায়।

অনিকেত বলল—ওই এলাকায় পুরনো লোকজন তো কমে আসছে। চারদিকে ফ্ল্যাট হচ্ছে, প্লট করে জমি বিক্রি হচ্ছে। নতুন-নতুন মানুষজন আসছে, গল্পকথা কিছু থাকলেও হয়তো হারিয়ে গিয়েছে।

সিরাজ বললেন—তবু দ্যাখো, কাছাকাছি মসজিদের ইমাম যদি কিছু জানেন, আসলে গল্পকথাগুলো কোঁচড়ে ভরে রাখে মহিলারা। আমার মনে হচ্ছে, তোমার খাজাইপির কোনও ‘খাজা’ নন। তা হলে জাঁকজমক বেশি হত। গাছতলায় চুপচাপ পড়ে আছেন যখন, খোজা-ই হবেন তিনি। খোজা পির। খোজাতলা থেকে খাজাইতলা। পুরনো দলিল-টলিল থাকলে হয়তো দেখতে পাবে মৌজার নাম খোজাতলা। না-ও হতে পারে। হয়তো খোজাতলা নামে কোনও মৌজা নেই, লোক-মুখে ওই এলাকার নাম খোজাতলা হয়ে গিয়েছিল, লোক-মুখে অনেক জনবসতির নাম তৈরি হয়, কিন্তু রেকর্ডে থাকে না। আমাদের গোকর্ণের কাছে একজন পিরকে আমি ছোটবেলায় দেখেছি। সেই পির শাড়ি পরতেন। শরিয়তি মুসলমানরা কেউ ওই পিরের ছায়াও মাড়াতেন না। গরিব-গুর্বো-জোলা মুসলমানরা ওঁর কাছে যেত। শূদ্র চণ্ডালরাও যেত। শাড়ি পরলেও উনি মহিলা ছিলেন না। ইসলামে কোনও মহিলা মসজিদের ইমাম হতে পারে না, পির তো দূরের কথা। মহিলারা তো প্রকাশ্যে নামাজ পড়তেও যেতে পারে না, ঈদের নামাজ হলেও নয়। দূর থেকে ওই শাড়ি-পরা পিরকে দেখতাম। মুরিদ, মানে শিষ্যদের সঙ্গে, কথা বলতেন। গলার স্বরটা মনে আছে। একটু কর্কশ ছিল। মেয়েদের মতো নয়; পুরুষদের মতোও নয়। কিন্তু কথার মধ্যে সুর খেলা করত। কী বলতেন আর মনে নেই, তবে হিন্দুদের বলতে শুনেছি, উনি প্রতিমা পির। মুসলমানরা বলত, ফতে পির। ফাতেমা হল পয়গম্বরের মেয়ের নাম। ফাতেমা আবার হাসান-হোসেনের মা-ও হন। আলি-র স্ত্রী। আলি হলেন প্রথম ইমাম। এই ফাতেমা জড় এবং জীবের মধ্যে যে মিস্টিক শক্তি কাজ করে, সে-কথাও বলেছিলেন। সুফিরা ওঁকে খুব মানে। আবার স্তনত্যাগী শিশুকেও বোঝায়। ওই পির নিজেকে নারী ভাবতেন। আল্লাহ যদি পরমপুরুষ হন, নিজেকে নারী ভাবতে পারলে, তাঁর প্রতি আকুতি বাড়ে। বৈষ্ণবদের মধ্যে রাধাভাব সাধনাও তো আছে। কোনও পুরুষ নিজেকে রাধা ভাবতে পারলেই—কৃষ্ণকে প্রাণমন সমর্পণ করে দিতে পারে। আমাদের গোকর্ণের ওই পিরের যে খুব নাম-ডাক ছিল, তেমন নয়। থাকবে কী করে? দেশে গিয়ে কিছুদিন আগে খুঁজতে গিয়েছিলাম। একটা মাজার আছে, অবহেলায়। নাম হয়ে গিয়েছে ফতে পিরের মাজার। ফাতেমাও নয়, প্রতিমাও নয়। ফতে। পুরুষতন্ত্র একেই বলে!

অনিকেত জিগ্যেস করল—ওখানে কি হিজড়েরা আসে?

সিরাজ সাহেব বললেন—সেটা বলতে পারব না। তবে ওঁর শিষ্যদের মধ্যে মেয়েলি-পুরুষ দু-চারজন হয়তো ছিল। আমাদের আলকাপ দলের একটি ছোকরা তো খুব ওঁর কাছে যেত। ছোকরা মানে আলকাপ দলের মেয়েলি-পুরুষ। ছেলে আর মেয়ে, পুরুষ আর নারী, এই সম্পর্কটার মধ্যে কোথায় যে ভেদরেখা কে জানে। শুধু কি লিঙ্গচিহ্ন? জনন-দ্বার? মনে হয় না। আমি একটা পুরুষ-ছোকরায় বড় বিভোর ছিলাম বহুদিন। পারলে আমার ‘মায়ামৃদঙ্গ’ উপন্যাসটা পড়ে নিও।

অনিকেত জিগ্যেস করল—ওই ফাতেমা পির কি খোজা ছিলেন? ক্যাস্ট্রেশন করিয়েছিলেন? হেসে উঠলেন সিরাজ সাহেব। বললেন, সেটা আমি কী করে জানব? আমার জানার কথা নয়। বৈষ্ণবদের যাঁরা রাধাভাবের সাধক, ওঁরা তো ক্যাস্ট্রেশন করান না। পারস্যেই দ্বিতীয় বা তৃতীয় শতাব্দীতে ম্যানিকিজ্ম নামে এক বিশেষ ধর্মমতের উন্মেষ ঘটে। শরীর- পীড়নের মধ্যে দিয়ে ঈশ্বরের সান্নিধ্যের আশায় ওই মতে বিশ্বাসীদের পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলতে হত। আবার খ্রিস্টান ধর্মতত্ত্ববিদ অরিজেন ওই একই সময়ে যৌনতাকে ঈশ্বর-সাধনার পরিপন্থী ভেবে তাঁর পুরুষাঙ্গ ছেদন করেছিলেন—এরপর ওঁর নামে একটা দল গড়ে ওঠে। ভ্যালেসিরাও ভাবতেন, পুরুষাঙ্গ ছেদন করলেই মন যৌনচিন্তা থেকে সরে ঈশ্বরের দিকে যাবে। কিন্তু পুরুষাঙ্গ ছেদন করলেই যৌনতা শেষ হয় না। তা হলে ছিন্নি-হিজড়েদের কোনও যৌনতাই থাকত না। আসলে ব্যাপারটা কী জানো? নারীর মধ্যে প্রকৃতিগত ভাবেই সেবা করার এলিমেন্ট থাকে। ওরাই স্তন্যপান করায় কিনা। স্নেহপ্রবণতা ওদেরই বেশি। হয়তো এর পিছনে কোনও হরমোন কাজ করছে, জানি না, তবে এটা জানি বৈষ্ণবদের মতো সুফিদেরও একটা ‘স্কুল’ নারীভাবে ঈশ্বর-ভজনা করেন।

সিরাজ সাহেব একটু দম নিলেন। ওঁর একটু শ্বাসের কষ্ট হয়। উনি আরও বলতে লাগলেন—পারস্যে একটা সেক্ট আছে, ওঁরাও নিজেদের খোজা বলেন। কিন্তু ক্যাস্ট্রেটেড নন ওঁদের একটা অংশ গুজরাট-মহারাষ্ট্রে বসবাস করেন। পারসিদের মতো ওঁরা পুরোপুরি অগ্নি- উপাসক নন। যেমন আমাদের টাটা, ওয়াদেয়া। ওঁরা দশাবতারে বিশ্বাস করেন, কিন্তু দশম অবতার হলেন আলি। ফাতেমার স্বামী। খুব ইন্টারেস্টিং।

আবার উটকো ঝামেলায় পড়ল অনিকেত। ওই খাজাইপির তবে কি খোজা? কীরকম খোজা? হারেমে যাদের রাখা হত, ওদের খোজা বলা হত। সেই ধারায় ক্যাস্ট্রেটেড বা লিঙ্গচ্ছেদ-করা পুরুষ হলেই খোজা। উনি কি সেই গোকর্ণের ফতে পিরের মতো কেউ ছিলেন, না কি বৈষ্ণব-মনোভাবাপন্ন খোজা সম্প্রদায়ের কেউ।

খাজাইতলায় গেল অনিকেত। গাঁয়ের বসতির বাইরে পিরের সমাধিটা ফেটে গিয়েছে। চুনবালির পলেস্তরা খসে গিয়েছে। একটা পুরনো গাছ। গাছে কিছু ঢিল ঝুলছে।

গাঁয়ে অল্প কিছু মুসলিম আছে। সুতরাং একটা মসজিদ। মসজিদের ইমামের খোঁজ পেল। মুড়ি-ফুলুরি খাচ্ছিলেন। জানালেন, হাটতলায় রেডিও সারাইয়ের দোকান আছে। চলে না। জানালেন, ওই খাজাই পির সম্পর্কে তেমন কিছু জানেন না, ওঁর বাবা হয়তো জানতেন। বাবার ইন্তেকাল হয়েছে গত বছর। বাবার কাছে শুনেছেন নীল চাষের সময়ে এখানে একজন পির থাকতেন। শ্রাবণ মাসে কিছু লোকজন আসত। চাদর চড়াত, এখন কাউকে দেখা যায় না। তবে দু-চারজন টুকটাক আসে। ইমামের বয়স পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে। গোড়ালির একটু ওপরে পাজামা। আর হাওয়াই শার্ট। হাঁক পাড়লেন, কী রে…ইলেকটিরি এল?

উত্তর এল, এখনও লোডশেডিং। অনিকেতকে বলল, এই হল ঝামেলা। গলা চিরে যাবে। মোয়াজ্জেন শ্বশুরবাড়ি গিয়েছে।

পানি খেলো ঢকঢক করে, দেড় লিটারের পেপসির বোতল থেকে। অনিকেত জিগ্যেস করল—এই মাজারে কি হিজড়েদের আসতে দেখেছেন কখনও? ইমাম সাহেব বললেন, মনে তো পড়ে না। বললাম তো ইন্টারেস্ট নেই। তা ছাড়া ওই মাজারটা তো গাঁয়ের বাইরের দিকে, কে আসে না-আসে, নজরে পড়ে না।

অনিকেত বলল—আপনাদের গাঁয়ের দুলালের মা আমাদের বাড়িতেই কাজ করে….

ইমাম সাহেব বললেন, বুঝেছি। আপনাকেও চিনি। ওই পথেই যাতায়াত কিনা। আর হিজড়ের কথা কেন জিগ্যেস করছেন সেটাও অনুমান করতে পারি। দুলাল ওরকম হয়ে গিয়েছে কি না ভাবছেন। আর ও কেন খাজাইপিরের কাছে গেল? ও যদি বেঁচে ফিরে আসে ইনশাল্লা, সব বোঝা যাবে। তবে আমার এক নানা বেঁচে আছে। ওঁর কাছে গেলে জানা যাবে। অবশ্য এখন তো যাওয়া যাবে না, আজানের টাইম…। তারপর লোকজন আসবে। আজ জুম্মাবার কিনা, পানি পড়া দিতে হবে।

—এখনও পানি পড়া নিতে আসে?

—আসবে না কেন? দরুদদোয়ায় কাজ হবে না?

–ক’জন হয়?

—পাঁচ-সাত-দশ…।

.

আজ একটা ছুটির দিন ছিল, ক্ষেত্রসমীক্ষায় চলে গেল। এসব হচ্ছে তারাপদ সাঁতরা-সুধীর চক্রবর্তী-দিব্যজ্যোতি মজুমদারদের কাজ। এসব কম্ম কি ওকে দিয়ে হয়?

দুলালের ছুটি হওয়ার আগের দিন নীলরতন সরকার হাসপাতালে গেল অনিকেত। যেতেই হল, কারণ ডাক্তারবাবু দুলালের মা-কে বলেছেন, তোমার ওই বাবুকে নিয়ে এসো। কথা আছে। ড. পলাশ সেনগুপ্ত বললেন—কোনও ধানাইপানাই না-করেই বললেন—ওর রেকটাম-টা ফানেলের মতো হাঁ করা। বোঝাই যায় পেনিট্রেশন হয়। তা ছাড়া ক্যাস্ট্রেটেড। হিমোগ্লোবিন কম। সন্দেহ হল। ওর ব্লাড এলাইজা টেস্ট করতে পাঠালাম। এইচআইভি পজিটিভ। সম্ভবত এড্‌স-এর ম্যানিফেস্টেশন শুরু হয়ে গিয়েছে। এটা জানানো দরকার ছিল। ওকে সাবধানে রাখতে হবে। আন্ডারস্টুড?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *