হলদে গোলাপ – ১০

১০

পবন ধল একটা দারুণ কথা বলেছিল। গোলাপের রং তো আমরা গোলাপি-ই বুঝি। পিংক কিন্তু গোলাপ যদি সাদা কিংবা হলুদ হয়, তবে কি সেটা গোলাপ নয়? আমরাও পুরোপুরি মানুষ। মানুষের সমস্ত ধর্ম আমাদের মধ্যে আছে। আমাদের মধ্যে শিল্পীসত্তা আছে, পরের জন্য দুঃখবোধ আছে, সমাজ সচেতনতা আছে, আবার হিংসা-পরশ্রীকাতরতাও আছে। শুধু ব্যক্তিগত যৌনতার ক্ষেত্রে আমরা আলাদা।

সেদিন পবন ধলের সঙ্গে এসেছিল অনির্বাণ, রঞ্জন, আর বাসব। প্রথম আলাপের দিন বাসব ছিল না। বাসব ভাল কথা বলতে পারে বলে ওরা বাসবকে নিয়ে এসেছে। বাংলায় এমএ ফার্স্ট ক্লাস, একটা স্কুলে চাকরি করে। নেট, স্লেট এসব পরীক্ষা দেবে।

বাসব বলল, ছোটবেলা থেকেই ওর মনে হয়েছে ও ছেলে না-হয়ে মেয়ে হলেই ভাল হত। মনের মধ্যে একটা নারী ঢুকেছিল ছোটবেলা থেকেই। সব পুরুষের মধ্যেই কিছু-না-কিছু নারীত্ব আছে, আবার সব নারীর মধ্যে কিছু-না-কিছু পুরুষ-ভাব। পুরাণে অর্ধনারীশ্বরের কথা আছে। বৈষ্ণব শাস্ত্রেও আছে রাধাভাব-এ কৃষ্ণসাধনার কথা। অনেক বৈষ্ণব নিজেকে রাধা ভেবেছেন মনে-মনে। কিন্তু অর্ধনারীদের সামাজিক স্বীকৃতি নেই। বরং অবজ্ঞা। এই সামাজিক অবজ্ঞার কারণেই, এইসব অনেক পুরুষের ঠাঁই হয় হিজড়ে-সমাজে। হিজড়েরা শারীরিকভাবে স্বাভাবিক পুরুষ, কিন্তু মনের গভীরে নারী। স্বাভাবিক নারীর মতো এরাও চায় প্রেমিক, স্বামী, সন্তান। কিন্তু শরীরটা যে পুরুষের, সন্তানধারণ তো করতে পারে না। অথচ ইচ্ছেটা সরাতেও পারে না। যতটা পারে, নারী হতে চায়। পুরুষের সঙ্গ ভালবাসে। এটা সম্পূর্ণ মনের ব্যাপার। আমাদের দেশেই হিজড়ে সমাজের একটা আলাদা অস্তিত্ব আছে। ইউরোপের মতো উন্নত দেশগুলোতে মেয়েভাবাপন্ন পুরুষদের আলাদা গোপন সমাজ গড়তে হয় না। ওরা সংসারেই থাকে, সমাজেই থাকে। অন্য পাঁচজনের মতোই চাকরি-বাকরি, ব্যবসা করে। সামাজিক অবজ্ঞার কারণেই কিছু মানুষ হিজড়ে সমাজে গিয়ে আশ্রয় খোঁজে। ওখানে ওরা সমাজ পায়, বন্ধু পায়, এবং রোজগারপাতিও হয়।—খুব ভাল বলেছিল বাসব। অনির্বাণ আর রঞ্জনও বলল ওদের শৈশব আর কৈশোরের কথা। স্কুলে পড়ার সময় ওদের কোনও সহপাঠীকে ভাল লাগার অভিজ্ঞতা, পুরুষের প্রতি আকর্ষণের কথা। উপসংহারে অনিকেত বলেছিল, আমরা চারজন সমকামী-র বক্তব্য শুনলাম। ওঁদের নিজেদের অভিজ্ঞতা এবং অনুভূতির কথা শুনলাম। ওঁরা সবাই বুদ্ধিমান, সামাজিক মানুষ। অত্যন্ত ব্যক্তিগত কিছু পছন্দ-অপছন্দ সেটা ওঁদের নিজস্ব আমরা যেন ওঁদের ‘লেডিস’ বলে, ‘বউদি’ বলে অবজ্ঞা না-করি!

ওদের বেশ ভালই লাগল অনিকেতের। বেশ স্পষ্টবাদী, গুছিয়ে কথা বলতে পারে। বাসব তো বেশ রসিক ছেলে। প্রচুর পড়াশোনা। ওরা ‘প্রবর্তক’ নামে যে-পত্রিকা বার করে, সেই পত্রিকার কয়েকটা কপি দিল। ওরা যে-সংগঠনটা করে, তার নাম ‘কাউন্সেল ক্লাব’। তাদের উদ্দেশ্য ইত্যাদি নিয়ে একটা লিফলেট-ও দিল ওরা।

কাউন্সেল ক্লাব

প্রযত্নে রঞ্জন, পোস্ট ব্যাগ নং ৭৯৪

কলকাতা ৭০০০১৭, ভারত

সব গোলাপই গোলাপ

কিন্তু সব গোলাপ যে লাল নয়!

প্রিয় বন্ধু,

কাউন্সেল ক্লাবের তরফ থেকে জানাই হৃদয়ের উষ্ণ ভালবাসা এবং অভিনন্দন।

কাউন্সেল ক্লাব সবরকম মানুষের সহযোগিতায় গড়ে ওঠা সমকামী নারী-পুরুষের একটি সমর্থক গোষ্ঠী। ১৯৯৩ সাল থেকে শুরু করে আগামী ১৫-ই আগস্ট আমরা পা দেব তিন এর বছরে!

আমাদের সদস্যরা সমাজের সকল স্তরের প্রতিনিধি। বয়ঃসীমা ১৮ থেকে ৬০। আমাদের কর্মক্ষেত্র মূলত কলকাতা এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলি হলেও সমগ্র ভারতবর্ষ এমনকী বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তেও আমাদের সদস্য ছড়িয়ে আছেন। একইভাবে সদস্য হওয়ার সুযোগ আমরা কেবলমাত্র সমকামী নারী-পুরুষ বা উভকামী মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখিনি যৌনতার পরিচয় নির্বিশেষে সকল মানুষকেই আমাদের সংস্থায় শামিল হওয়ার জন্যই মুক্ত আহ্বান। সেই সঙ্গে যাঁরা সমলিঙ্গধারী ব্যক্তির প্রতি আকর্ষণ বোধ করেও নিজের যৌনতাকে কোনও বিশেষ শব্দ দিয়ে প্রকাশ করেন না, তাঁরাও স্বাগতম।

এইসঙ্গে আরও জানাচ্ছে, ওরা প্রত্যেক রবিবার আড্ডার ব্যবস্থা করে, শরীর সম্পর্কে পরামর্শ দেয়, আইনের সাহায্য দেয় ৩৭৭ ধারার বিরুদ্ধে জনমত গঠন করে ইত্যাদি। ওদের পত্রিকা ‘প্রবর্তক’-ও পড়ল অনিকেত। অনেক কিছুই নতুন করে জানতে লাগল, বুঝতে লাগল। মানুষের মন কী জটিল, কতরকমের ভাঁজ, কতরকমের প্যাঁচ। আলো-অন্ধকার। ‘প্রবর্তক’ পত্রিকায় প্রশ্নের উত্তর আছে, যৌনস্বাস্থ্য-সম্পর্কিত টিপ্‌স আছে, সমকামীদের মনের কথাও আছে, ওদের লেখা কবিতা-গল্প ইত্যাদিও আছে। বেশির ভাগ লেখাপত্তর ইংরেজিতেই, তবে বাংলা-হিন্দিতেও আছে। বন্ধুত্বের আবেদনও রয়েছে বেশ কিছু পৃষ্ঠা জুড়ে। একজন ছত্রিশ বছরের যুবক, বুকে লোম নেই, প্যাসিভ কোনও মাসকুলার পুরুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব চাইছে। একজন বত্রিশ বছরের অ্যাক্টিভ পুরুষ, গান-বাজনা ভালবাসে, কুড়ি থেকে চল্লিশ বছর বয়সি গান বাজনা ভালবাসে এমন পুরুষ খুঁজছে। টকেটিভ, হিউমারাস, লাড্স কুকিং অ্যান্ড হাউসহোল্ড ওয়ার্ক-এ দক্ষ সুইট গে, সিক্‌স ক্লোজ ইনটিমেসি উইথ প্লেজেন্ট লুকিং গে…। এরকম সব। লক্ষ করার বিষয়টা হল : ছেলেটি জানাচ্ছে ঘরোয়া কাজ এবং রান্না করতে ভালবাসে।

খুব ছোটবেলা থেকে সবার মতো অনিকেতও জেনে এসেছে কিছু কাজ আছে ছেলেদের। কিছু কাজ আছে, যা শুধু মেয়েদের জন্যই। রান্না করা, ঘর ঝাঁট দেওয়া, বাসন মাজা, সেলাই করা মেয়েদের কাজ। নাচ তো বটেই, গানও। যেসব ছেলে নাচ-টাচ করে, ওদের মনে করা হয় ওরা ঠিকমতো ছেলে নয়। কোনও বাড়ির পুরুষরা স্ত্রী-র সাহায্যের জন্য মাছ বা তরকারি কুটে দিতে দেখলে অন্য মহিলারাই বলে, ওই লোকরা ব্যাটাছেলেই নয়। স্ত্রী-র কাজ স্বামীর জাঙিয়া কেচে দেওয়া। কোনও পুরুষ স্ত্রী-র ব্রা কেচে দিলে ছ্যা ছ্যা হবে যদি লোকে জানে।

সেই কবে, কোন আদিম যুগে, জঙ্গলচারী পুরুষরা শিকারে যেত। মেয়েরা কৃষিকাজ করত। এখন সমাজ পাল্টেছে। গাঁ-গ্রামে মেয়েরা লাঙল চালায় না ঠিকই, কিন্তু চাষের অন্য কাজ করে, ছেলেরাও করে। মেয়েরা এখনও পেটো বানায় না, সেটা ওদের করতে দেওয়া হয় না বলে। কিন্তু ঠিকই পারবে ওরা। মাওবাদী স্কোয়াডগুলোতে তো মেয়েরা বন্দুক চালাচ্ছে, গ্রেনেড অপারেশন করছে। শহরে ছেলেমেয়েদের মধ্যে কাজের তফাত সামান্যই। কিন্তু তবু কিছু কাজ রয়ে গিয়েছে ছেলেদের জন্য নির্দিষ্ট, মেয়েদের জন্য নির্দিষ্ট। ছেলেরা যে রান্না-বান্না করতে পারে না তা তো নয়, হোটেলের বড়-বড় শেফ তো ব্যাটাছেলেই। কিন্তু ঘরে কেউ-কেউ শখে খাসির মাংসটা কিংবা চিংড়ির মালাইকারিটা করে থাকলে তা নিয়ে আলাদা গর্ব হয়।

যে-সব ছেলে মেয়েলি ধরনের, তারা লিঙ্গ-চিহ্নে পুংলিঙ্গ-ধারী। কিন্তু মনে-মনে অনেকটাই নারী। সমাজ যেটাকে মেয়েদের কাজ বলে থাকে, সেইসব কাজ করতে ভালবাসে। ভাবভঙ্গি ও অনেকটাই মেয়েদের মতো। মানে, মেয়েদের মতো ভাবভঙ্গি করতে ভালবাসে। কখনও কখনও একটু বেশি মাত্রাতেই করে। মেয়েরাও হয়তো ততটা হাত নাড়িয়ে কথা বলে না— ওরা যতটা করে। ভাষাটাও মেয়েদের মতোই করার চেষ্টা করে।

মেয়েদের ভাষা বলে কিছু আছে না কি? আছে তো। ভাষা না-বলে উপভাষা বলা ভাল। কে জানে, উপভাষাও ঠিক কি না। ভাষাবিদরা বলতে পারবেন। সুকুমার সেনের একটা গবেষণা ছিল মেয়েদের মুখের ভাষা নিয়ে। উনি লিখেছিলেন—নেবু, নুচি, নাউ—এই প্রবণতা ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের মধ্যে বেশি। শর্মিলা বসুও পরবর্তীকালে গবেষণা করেছিলেন এ নিয়ে। কিছু-কিছু মেয়েলি উচ্চারণের বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছিলেন। যেমন শব্দের দ্বিত্ব উচ্চারণ। ছোট্ট, বড্ড, কত্তো…এরকম। ‘তুমি কত্তো ভাল ছেলে…।’ ‘আমার বড্ড ইচ্ছে করছে…। ľ বোধহয় আবেগ একটু বেশি প্রকাশ পায় এরকম উচ্চারণে। কোনও ছেলে যদি বলে, ‘আমি কখনও করিনি’, মেয়েরা বলবে, ‘আমি কক্ষনও করিনি’। মেয়েদের মৌখিক বাক্যগঠনে একটা গল্প বলার ভঙ্গি থাকে। ‘আমি না, ওখানে না, গিয়ে দেখলাম কী, ওদের বাড়িতে, বাপরে বাপ সে কী কাণ্ড…’ আবার ‘যাঃ’ (সঙ্গে একটু হাত নাড়ানো, মেয়েরা ডান হাতটা নাড়ালেও মেয়েলি-ছেলেরা বাঁ হাতটা বেশি), ‘ইশ’ শব্দটাও মেয়েরা বেশি ব্যবহার করে। ইঃ’, ‘উফ্’ এসব শব্দ, ‘মাইরি’, ‘মা কালীর দিব্যি’, ‘সোয়্যার’—এ ধরনের শপথ মেয়েদের বাক্যেই বেশি। তারপর ‘অসভ্য’ শব্দটা—নানা ব্যঞ্জনায় ব্যবহার করে মেয়েরা। ‘যাঃ, অসভ্য’ একটা অন্য অর্থ প্রকাশ করে। ছেলেরা সাধারণত ‘যাঃ অসভ্য’ বলে না। পাজি, দুষ্টু, বাঃ, ভাল হবে না কিন্তু, আড়ি হয়ে যাবে কিন্তু—এ ধরনের কথা মেয়েরাই বলে। ‘গো’ শব্দের প্রয়োগ মেয়েরাই বেশি করে। গ্রামে লো, ওলো এখনও কিছুটা চলে। মেয়েদের হাসিটারও একটা অন্য ভঙ্গি আছে। সাহিত্যে মেয়েদের হাসিকে ‘হিহি’ বা খিলখিল’ শব্দে লেখা হয়। হা-হা, হো-হো ছেলেদের হাসিতেই প্রযোজ্য। অট্টহাস্য তো মেয়েদের মুখে একেবারেই মানায় না, অশোক বনের চেড়িরা হয়তো অট্টহাস্য হেসে থাকতে পারে। মেয়েদের খিস্তিও একটু আলাদা হয়। গ্রাম্য-মেয়েদের গালাগালিতে পোড়ারমুখি ভাতারখেকো, পোঁদমুখো, ফ্যাদামুখো, মা-মেগো এসব থাকলেও গুরুতর খারাপ কথা থাকে না। ঘ্যাম, বিলা, কিচাইন, থোবড়, মাল—এসব শব্দ ছেলেরাই বেশি ব্যবহার করে। তবে শহুরে মেয়েরাও ব্যবহার করছে আজকাল। শহরে বলতে গেলে, মেয়েদের ভাষা আর ততটা আলাদা থাকছে না। তফাত কমে আসছে। কিন্তু এখনও আমরা মেয়েলি ভাষা বলে একটা ভাষাভঙ্গিকে চিহ্নিত করতে পারি।

‘কাউন্সেল’ ক্লাবের পত্রিকা ‘প্রবর্তক’-টা দেখছিল অনিকেত। ওইসব বন্ধু খোঁজার আবেদনগুলোর কথা তো বলাই হল। কিছু নিবন্ধ আছে সেফ সেক্স নিয়ে। পায়ুদ্বারের পেশি- সংস্থান কেমন, কী কী সাবধানতা নিলে পায়ুতে ক্ষত হবে না বা রক্তপাত হবে না—এসব বলা আছে। যোনির সঙ্গে পায়ুর পেশিসজ্জার তফাত আছে। যোনি বাইরে থেকে ভিতরের দিকে চাপ গ্রহণ করতে পারে, কিন্তু পায়ু সেটা পারে না। মল নির্গমনের কারণেই পায়ুর পেশিসজ্জা। ভিতর থেকে কিছু সহজে বেরিয়ে আসতে পারে, কিন্তু বাইরে থেকে কিছু প্রবেশ করাতে গেলে মাংসপেশির বিরুদ্ধে যেতে হয়। এজন্য ওরা কিছু প্রক্রিয়ার কথা লিখেছে। অ্যাবোনাইট-এর মসৃণ লিঙ্গসদৃশ জিনিস জেলি দিয়ে ভিতরে ঢুকিয়ে রাখতে উপদেশ দিয়েছে। লিঙ্গগ্রহণের সময় কে-ওয়াই জেলি ব্যবহার করতে উপদেশ দেওয়া হচ্ছে। কন্ডোম ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে এইচআইভি প্রতিরোধের জন্য। চুম্বন এবং মুখমেহনের নানা কায়দা শেখানো হচ্ছে বিভিন্ন নিবন্ধে। ৩৭৭ ধারা রদের জন্য কোথায় কী আন্দোলন হচ্ছে তার খবরাখবর রয়েছে। ‘আত্মকথা’ বলারও একটা বিভাগ আছে। ওখানে গে এবং লেসবিয়ান-রা নিজেদের অনুভূতির কথা বলছে। পড়ছে আর অবাক হচ্ছে অনিকেত, এই জগৎ সম্পর্কে আগে তেমন কোনও ধারণাই ছিল না। একজন পুরুষ ভালবেসে অন্য পুরুষের লিঙ্গগ্রহণ করে তার পায়ুদেশে।

একটা ধারণা ছিল অনিকেতের যে, কোনও-কোনও পুরুষ প্রবল কামোত্তেজনায় যোনির অভাবেই পায়ুমেহন করে। প্রথম কৈশোরে ছেলেরা পরস্পরের লিঙ্গ ঘাঁটাঘাঁটি করে, এরটা ও দ্যাখে, ওরটা এ ধরে। অনিকেতের কৈশোরেও এরকম ঘটেছে। কেউ কেউ হাতে ধরে পরস্পরের লিঙ্গ হস্তমৈথুন করে দিয়েছে, এরকমও ঘটে। জেলের কয়েদিরা সমলিঙ্গে যৌন কার্যকলাপ করে বিপরীত লিঙ্গের অভাবেই তো। পুলিশ ব্যারাক বা মিলিটারি ছাউনিতেও এসব হয়।

একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে অনিকেতের। ও তখন অন্য একটা চাকরি করত। ভূমি রাজস্ব দপ্তরে। বোলপুরের আগের স্টেশন ভেদিয়া-তে পোস্টিং। বাইশ তেইশ বছর মাত্র বয়েস তখন। বন্ধুবান্ধবদের অনেকেই বেড়াতে যেত ওখানে। ভেদিয়া থেকে বোলপুর, রামপুরহাট, তারপর রামপুরহাট থেকে বাসে চেপে ম্যাসেঞ্জোর গিয়েছে কয়েকবার। একবার এক বন্ধু এল, ওর নাম অরূপ। একটু কবিতা লেখার বাতিক ছিল অরূপের। অরূপ বলল ম্যাসেঞ্জোর যাবে। রাতের রামপুরহাট প্যাসেঞ্জার রাত বারোটা নাগাদ ভেদিয়া-তে আসে। সাড়ে তিনটে নাগাদ রামপুরহাট পৌঁছয়। ওখান থেকে ফার্স্ট বাসে চেপে ম্যাসেঞ্জোর যাওয়ার প্ল্যান। টিকিট কাটা হয়নি ট্রেনের। রাতের ট্রেনে চাপা হল। রামপুরহাট পৌঁছল। দেখা গেল, বেরনোর পথে চেকার দাঁড়িয়ে আছে। অরূপ বলল, ও শালা কতক্ষণ থাকবে ঠিক নেই। একটা ডাউন ট্রেনও আসবে। রেলিং ডিঙিয়ে বাইরে চল। অনিকেত বলেছিল দূরে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করা যাক, কিংবা প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে লাইন দিয়ে কিছুক্ষণ চলে গেলে ঠিকই বেরনোর রাস্তা পাওয়া যাবে। অরূপ বলল, এত ঝামেলার দরকার কী। রেলিং ডিঙোলেই তো হয়। রেল প্ল্যাটফর্মে যেরকম লোহার রেলিং থাকে, সেই রেলিং টপকে বাইরে লাফ দিল অরূপ। তারপরই কুকুরের ঘেউঘেউ। অনেকগুলো কুকুর একসঙ্গে তুমুল চেঁচিয়ে উঠল। তারপর দু-তিনটে কণ্ঠস্বর শোনা গেল কৌন হ্যায়? কৌন হ্যায়?. একটা কণ্ঠস্বর শোনা গেল, পাকড়ো, উসকো পাকড়ো…। তারপর সামান্য শোরগোল। অরূপের কোনও কণ্ঠ শোনা গেল না।

অনিকেত কিছুক্ষণ পর স্টেশন ফাঁকা হলে বাইরে বেরিয়ে যায়। রাত। স্টেশনের বাইরে রাস্তায় একটা চায়ের দোকানের রোয়াকে বসে। চিন্তা হচ্ছিল। অরূপের কী হল? ও ধরা পড়ে গিয়েছে বোঝাই যাচ্ছিল। ওকে নিয়ে কী করবে? অনিকেত ভাবল, আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে, তারপর খোঁজখবর করবে। আরও মিনিট কুড়ি পরে অরূপ এল। বলল শালা, কেলো হয়ে গিয়েছে। যেখানে লাফিয়ে পড়েছিলাম, ওখানে ছিল আরপিএফ ক্যাম্প। কুত্তাগুলো শালা চিল্লামিল্লি শুরু করে দিল, তারপর নাইট পাহারাদার ধরল। বুঝলাম কেস খেয়ে গিয়েছি। কিছু করার নেই। সব স্বীকার করলাম। বললাম, টিকেট নেহি কিয়া, গলতি হো গিয়া, মাফি মাংতা হুঁ। ওরা তখন ওদের ব্যারাকে নিয়ে গেল। একটা ঘরে ঢোকাল। বলল, প্যান্ট খোল। আমি বললাম ক্যায়া করেগা আপ? একটা পুলিশ বলল গাড় মারেগা। সত্যি-সত্যি একটা লোক ওর জিনিসটা বার করল। আমি তো দেখে ভয় পেয়ে গেলাম। পায়ে পড়তে যাচ্ছি, তখন বলছে— যা বলি শোন, নইলে কয়েদ হয়ে যাবে। কী করব, প্যান্টটা খুলতে হল। আমি হাতজোড় করে বললাম, ভাইসাব, শুধু ঠেকাকে রাখো, ঠেলো মাত। বললাম, কথা কি শোনে? শুধু ঠেকিয়ে রাখলে ওদের হবে? যা-তা কাণ্ড। ওদের ওখানে মুখ-ফুক দিতে হল একটু, কাছে একটা টিউবওয়েল ছিল। অরূপ বলল, একটু পাম্প কর তো, ভাল করে মুখটা ধুই।

এরপর অনিকেতদের বন্ধুমহলে ওই লাইনটা প্রবাদবাক্য হয়ে গিয়েছিল—ঠেকাকে রাখো, ঠেলো মাত। কোনও বিপদ-আপদে পড়লে বলা হত লাইনটা

পুলিশ ব্যারাকে এসব হতে পারে। কিন্তু এরা এর জন্য কত সাধ্যসাধনা করছে! কত কষ্ট! অ্যাবোনাইট রড গুহ্যদেশে ঢুকিয়ে ওরা পথ প্রশস্ত করছে। জেলি নিচ্ছে। ‘প্রবর্তক’-এ একটা প্রবন্ধ ছিল সাজগোজ বিষয়ে। ত্বকের প্রসাধন, ত্বকের যত্ন, ফেস প্যাক ইত্যাদির ব্যবহার বিষয়ে। মেয়েদের কাগজে যেমন থাকে। রান্নার টিপ্‌সও ছিল। পুডিং এবং জেলি তৈরি করা। যেহেতু এটা অভিজাত গে’দের কাগজ, তাই পুডিং তৈরির প্রণালী লিখেছে।

ছোটবেলায় অনিকেতের বাবার মামারবাড়িতে দুর্গাপুজো হত। বিরাটিতে। ঠাকুরমার সঙ্গে বেশ কয়েকবার বিরাটিতে ওই পুজোবাড়িতে গিয়ে কয়েকদিন করে থাকত। পরে, বড়বেলাতেও ওই পুজোবাড়িতে যেত। গত আট-দশ বছর ধরে ওই পুজো বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ওখানেই বলি দেখেছে অনিকেত। ষষ্ঠীর দিনে বোধন দেখেছে, নাড়ু বানানো দেখেছে, তিলতক্তি বানানো দেখেছে।

,

পুজোর দুই-তিনদিন আগে থেকেই নাড়ু বানানো শুরু হত। বাড়ির দিদিমারা, ঠাকুরমারা, পিসিমারা সবাই মিলে নারকোল কোরাত, গুড়-চিনি দিয়ে জ্বাল দিত, নাড়ু পাকাত, সন্দেশের ছাঁচে ফেলে নারকোলের সন্দেশ তৈরি করত। কী সুন্দর-সুন্দর ছাঁচ ছিল। পাথরের, কাঠের…। ওই মেয়েদের মধ্যে একজন পুরুষ ছিল। ওর নাম ছিল ননী। অনিকেতের ছোটবেলার ঠাকুরমা- দিদিমারা তখনও ততটা বুড়ি নয়। ষাটের কমই হবে বোধহয়। ওরা নিজেদের মধ্যে অশ্লীল রসিকতা করত। আর ননী মাঝে-মাঝে জিভ বের করে বলত অ্যামা…লাজ…। মানে এ-মা, কী লজ্জা! ননী মাঝে-মধ্যে মুখ বেঁকিয়ে বলত ঢ-অ-ঙ। ঠাকুমা-দিদিমা-পিসিমাদের পান সেজে দিত, হাসার সময় ধুতির খুঁটটা মুখে চাপা দিত। মেয়েরা তো মুখে আঁচল চাপা দেয়। ননী আঁচল কোথায় পাবে? ঠাকুমা-দিদিমারা মাঝে-মধ্যেই যা-তা রসিকতা করত। হয়তো খুন্তিটা পাওয়া যাচ্ছে না, একজন জিগ্যেসা করল—খুন্তিটা কোথায় রাখলা গো দিদি? দিদি বলল- কোথায় রাখমু, আছেই কোথাও। আমি তো এত বড় খন্তিটা হোনা-র ভিতরে রাখি নাই…’হোনা’ মানে হল সোনা। যৌন অঙ্গকে ওরা আদর করে, কিংবা সাংকেতিকে সোনা বলত। এরকম অনেক বদ রসিকতা হত অনিকেতের সামনেই, ওরা জানত, এই বাচ্চাটা কিচ্ছু বুঝতে পারছে না। নারকোলের মোদক বানানোর জন্য গুড়-নারকোলের পাকের পর মণ্ডটা প্রথমে লম্বা করে নিতে হত, পরে মন্দিরের মত আকৃতি দেওয়া হত। যখন লম্বা করা হত, কেউ বলত, তোর কত্তার মতন এত লম্বা করছস ক্যান! অন্য কেউ বলত, ইশ, সাহস কত! আমার কত্তার কত বড় তুই জানলি কী করে? ননী তখন মুখ ঝামটা দিয়ে বলে উঠত, ছিছিছি, ঠাকুরের পস্সাদ নিয়া কী আকথা কুকথা কইতেছ তোমরা…। থামাও। লাজ-লাজ। ওরা ননীর সামনে ওইসব মেয়েলি কথা বলতে সংকোচ করত না। ননীকে সবসময়ে রান্নাঘরে কিংবা মহিলাদের আড্ডাতেই দেখত অনিকেত। মনে আছে, একবার ননী বলছে, কন দেখি দিদি, এই শোলকের মানে কী? চিৎ কইর‍্যা ফ্যালাইলাম, মাইগ্য নাইড়া করলাম, কামকাজ হইয়া গেলে ধুইয়া-মুইছ্যা রাখলাম…। ঠাকুমা বলতেন—কী আবার, শিল। বাটনা বাটন। অনিকেতদের আদি বাড়ি পূর্ববঙ্গে হলেও ওর ঠাকুর্দা দেশভাগের আগেই চলে এসে এই মুকুন্দপুরে বাড়ি করেছিলেন। মুকুন্দপুরে কোনও বাঙাল ছিল না আগে। ওই অঞ্চলে ওরাই প্রথম বাঙাল।

অনিকেত স্মৃতি হাতড়ায়

ও যখন আরও বড় হল, ওইসব গল্পগুজবের মানেগুলো বুঝতে শিখল।

ওইসব মেয়েলি গল্প-গুজবের কিছু স্মৃতি এখনও মনে আছে ওর।

আর একটা গল্প মাঝে-মাঝেই মনে পড়ে। একজন জিগ্যেস করল—তোর বড় পোলা জলধররে তুই কত বচ্ছর বয়সে বিয়াইছিলি?

উত্তরটা পূর্ববঙ্গীয় উপভাষায় লিখতে গেলে সবাই বুঝতে পারবেন না। ব্যাপারটা এরকম—

উত্তরদাত্রী বলেছিলেন—আমার বিয়েটা তো হয়ে গিয়েছিল আমার নয় বছর বয়সে। বিয়ে ব্যাপারটা কী, কিছুই বুঝতাম না। শাড়ি পরে, ঘোমটা দিয়ে থাকতে হত। এগারো বছর বয়স থেকে স্বামীর সঙ্গে শোয়া। বারো বছরে রজঃস্বলা হলেও সঙ্গম ব্যাপারটা কী তখনও বুঝতেন না। ‘কত্তা মইধ্যে-মইধ্যে বেড়াইয়া ধইরা হোয়াগ (সোহাগ) করলে ভালই লাগত’ একদিন উনি দেখলেন, কাজের ছেলেটি গরু বাঁধতে গিয়েছে মাঠে। গরুর খুঁটা গাড়ছে নিচু হয়ে। ওখানে একটা গাছের আড়ালে শুয়েছিল কাজের মেয়ে সুরবালা। দূর থেকে দেখেছিলেন, ছেলেটি শুয়ে থাকা মেয়েটির গায়ে কী যেন করছে। আমি কত্তারে জিগাইলাম সুরবালার প্যাটের কাছে বাগাল ক্যান খুঁটা পুঁতে? কত্তা কইলেন তুমি দেখছ বুঝি খুঁটা গাড়ন? তবে দ্যাখবা কেমনে খুঁটা গাড়ে? আমিও খুঁটা গাড়ুম। হেই রাইতে কত্তা খুঁটা গাড়লো। আর হেই হইল জলধর। জলধর হচ্ছে বড় কাকুর নাম। বাবার মামাতো ভাই।

একবার মনে পড়ে, কী একটা সন্দেশের ছাঁচ পাওয়া যাচ্ছিল না। ননীকে জিগ্যেস করেছিল কোথায় রাখছস তুই? ননী বলেছিল, হ, আমি হোনায় থুইছি। ওরা তখন হাসাহাসি করেছিল। ওরে ননীরে, মাইয়াগিরি করতে গিয়া তুই ভুইলা যাস ক্যান তোর হোনার ভিতরে কিছু লুকাইয়া থোওন যায় না। তোর তো ক্যালা গা। মানে—ননী যখন বলেছিল আমি কি আমার যৌনাঙ্গের ভিতরে ঢুকিয়ে রেখেছি নাকি? অন্য মহিলা বলেছিল, বেচারা ননী, মেয়েলিপনা করতে গিয়ে ভুলে যাস কেন তোর যৌনাঙ্গের ভিতরে কিছু লুকিয়ে রাখা যায় না। তোর তো কলার মতো বার করা…।

কথাটা শুনে, ননী দুঃখ পেয়েছিল। কাপড়ের খুঁট দিয়ে চোখ মুছেছিল ননী। কেন কলার মতো লিঙ্গের জন্য দুঃখ পেয়েছিল ননী—অনিকেত বোঝেনি। এখন যেন কিছুটা বুঝতে পারছে। এখন বুঝতে পারছে ‘প্রবর্তক’ পত্রিকা-র রান্নাবান্নার টিপ্‌স আর সাজগোজ, ঘরকন্নার কথা কেন? ননীর কথা মনে হচ্ছে।

ননীর নাকি বিয়েও হয়েছিল। ননীর নাকি সন্তানও আছে। ননী ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গিয়েছিল। কেউ কেউ বলে, ও ইচ্ছে করেই ট্রেনের তলায় শরীর উৎসর্গ করেছিল।

‘প্রবর্তক’-টা পড়তে গিয়েই তো ননীর কথা মনে পড়ল অনিকেতের। প্রবর্তক-এর একটা কবিতার ওপর চোখ আটকে গেল—

স্বীকারোক্তি

বয়স তখন তোরোর শেষে
প্রথমবার একা
বাড়ির বাইরে পা বাড়ালেম
মামার বাড়ি—জোকা।
গোসাঁইবাবুর অনুশীলন
মামা বাড়ির পাশেই
মামা ছেলে, জোকার ‘দাদা’
ব্যায়াম শিখত ওতেই।
জোকার দাদা জোকার দাদা
হাসির খুড়োর কল
বিকেল হতেই বললে আমায়
আমার সাথে চল।
ছুটি চেয়ে গুরুর কাছে

বললে চড়া সুরে
চলছে কেমন অনুশীলন
দেখাব ঘুরে ঘুরে।
দেখতে পাবি জিমনাস্টিক
কঠিন ভারোত্তোলন
প্যারালাল বার ফ্রি হ্যান্ড আর
যোগের প্রশিক্ষণ।
দেখছি আমি নয়নজোড়া
সুঠাম সারি সারি
অর্ধনগ্ন পুরুষ দেহ
তুলছে ওজন ভারী
মিষ্টিমুখ আর মাচো দেহের
ভাঁজ খাওয়ানো ছাঁচে-
চলছে আসন সময় ধরে
ওস্তাদদের কাছে
দেখছি আমি সম্মুখেতে
নগ্ন পেশি যত
উঠছে ফেঁপে উঠছে ফুলে
কষছে দেহ যত।
পেশির জোরে ঊর্ধ্বটানে
পেশির জোরেই মা‍
বক্ষ পেশির ঘেমো ছাতি
দেখেই আমি কাত
পেশির খেলায় জোয়ার-ভাটা
পেশির বৃন্দাবন
নগ্নপেশির নগ্নটানে
মন যে উচাটন।
দীপ্ত আমার সুপ্ত শিখা
হৃদয় গভীর মাঝে
কারাগৃহের ক্ষুব্ধ অসি
ঝনঝনিয়ে বাজে
হচ্ছে কী যে মনের মাঝে
বলব কী তা আজ
বলতে গেলেই আসবে তেড়ে
পড়বে মাথায় বাজ।
আমার আশা আমার ভাষা
জানি শুধু আমি
জানি না তো জানেন কিনা
স্বয়ং অন্তর্যামী।
মা বোঝে না, কেউ বোঝে না
কোথায় আমার আমি।
ব্যাঙ্গ করে বলতে পারো
তুইতো সমকামী।

— পরী।

১১

অফিসে একদিন বেলা বারোটা নাগাদ একটা টেলিফোন পেল অনিকেত।

নমস্কার স্যর, আপনাদের ‘সন্ধিক্ষণ’ অনুষ্ঠানটা শুনছি। সমকামীদের নিয়ে দু’দিন অনুষ্ঠান হল। আমি একজন অভিভাবক। ছেলেকে নিয়ে ভুগছি। খুব সমস্যায় আছি। চিঠিতে কাজ হবে না, আমি আপনাদের সঙ্গে দেখা করে আমার সমস্যার কথা বলতে চাই। প্লিজ আমাদের বাঁচান।—মহিলা-কণ্ঠ। কাতর গলা। গলার স্বরে অসহায়তা মেশানো।

অনিকেত বলল—আমি কী সাজেশন দেব আপনাকে? আমি তো বিশেষজ্ঞ নই, আপনি বরং বিশেষজ্ঞদের কাছে যান।

উনি বললেন, প্লিজ ফেরাবেন না। আপনাদের অনুষ্ঠান শুনেছি বলেই বলছি। খুব দরদি অনুষ্ঠান। অনেকটা মানসিক বল পাই। আগে ছেলেটার ওই সমস্যার জন্য সবাই মিলে সুইসাইড করার কথাও ভেবেছি। অনুষ্ঠানটা শুনে মনে হল, আমাদের মতো অনেকেরই হয়। সত্যিই তো গোলাপ যে হলুদও হয় সেটা ক্রমশ বুঝতে পারছি। ওকে সারানোর চেষ্টা করেছি। মনে হচ্ছে ও আর সারবে না। এখন কী করে ছেলেটা সুখে থাকতে পারে, মা হিসেবে তো আমাকে সেটাই ভাবতে হবে, তাই না? আপনাদের অনুষ্ঠানটা শুনে সেটাই মনে হল আমার। আমাকে একটু সময় দিন। আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে পারলে আর একটু মানসিক বল পাব। অনিকেত বলল, ঠিক আছে। আগামীকাল একজন সাইকোলজিস্ট-ও আসবেন। কালই চলে আসুন। রিসেপশনে এসে বলবেন বিজ্ঞান বিভাগে যাব।

পরদিন একজন মহিলা এলেন। মাঝবয়সি। চেনা-চেনা মুখ। বললেন, কাল ফোন করেছিলাম। অনিকেত বলল, বসুন। উল্টো দিকের চেয়ারে বসলেন উনি। আরে, মঞ্জু না? মঞ্জুই তো? ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে অনিকেত।

অনিকেত খুব আস্তে করে জিগ্যেস করে——মঞ্জু না? ও তখন অনিকেতের মুখের দিকে তাকায়। ও বলে, বাগবাজার?

অনিকেত মাথা নাড়ে।

ডাবুদা?

অনিকেত ঘাড় নাড়ে

কত চেঞ্জ… কিন্তু তোর ভাল নাম অনিকেত বন্দ্যোপাধ্যায় কী করে জানব? তোকে তো ডাবু বলেই জানতাম…। এ মা, তোকে ‘তুই’ বলে ফেললাম…।

—তাতে কী হয়েছে, আমাকে তো ‘তুই’ করেই বলতিস।

ও মাথা নাড়ে। বলে, কতদিন পরে…।

অনিকেত কি বলে ফেলবে, তোর কাছ থেকে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ পাইনি মঞ্জু, সেই কলঘরের ঘটনাটা আমাকে বহুদিন বিঁধেছে, কিন্তু আমি কিছু বলতে পারিনি। চোখে একটা ক্ষমা চাওয়ার অনুনয় নিয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে অনিকেত। মঞ্জু বলে, এভাবে আবার দেখা হবে ভাবতেও পারিনি।

মঞ্জুর মাথার চুল অনেক পাতলা হয়ে গিয়েছে। ওর ঘন চুলের কথা মনে পড়ল, সেই বিনুনি, বিনুনির মধ্যে লাল বা বেগুনি ফিতের ফুল। ওর চোখের তলায় এখন একটু কালচে দাগ। মুখে বিষণ্ণতার মেঘ। ওর কপাল এবং সিঁথি লক্ষ করে, বিয়ের চিহ্ন খোঁজে। একটু লাল দাগ দেখতে পায়। হাতে শাঁখা-টাখা নেই। আজকালকার মেয়েরা অবশ্য এসব পরে-টরে না। মঞ্জু কি আজকালকার মেয়ে? ও তো প্রায় অনিকেতেরই বয়সি। দু-তিন বছরের তফাত মানে সমবয়সিই। অনিকেত তাই ডাবুদা। শাঁখা-সিঁদুর তো অনিকেতের বউ পরে। কিন্তু ওর সহকর্মী মহিলাদের মধ্যে প্রায় কেউ-ই পরে না। প্রথমেই জিগ্যেস করা যায় না, বিয়ে করেছিস কি না, কিংবা ঘর-সংসারের খবর কী? সেফ প্রশ্ন হল, বল, তোর খবর বল?

তার আগেই মঞ্জু জিগ্যেস করল, বল কেমন আছিস?

অনিকেত ঘাড় নাড়ে। বলে, তুই?

মঞ্জু মাথা নিচু করে। বলে, ভাল নেই তো বুঝতেই পারছিস। একটা কারণ তো ফোনে বলেছিলাম। তখন তো জানতাম না ফোনটা তুই ধরেছিস…। গলা শুনে তো বোঝা যায় না।

যদি জানতিস আমি, তা হলে কি ফোনটা করতিস? বোধহয় করতিস না।

মঞ্জু বলল, কে জানে? একটা জড়তা তো আছেই।

—সেটা তো আমারও। আমি ভুল করেছিলাম। কম বয়সে এমন ভুল অনেকেই করে। এই অনুষ্ঠানটা করতে গিয়ে আরও বেশি করে বুঝতে পারছি।

—কম বয়সে কেন, বেশি বয়সেও মানুষ ভুল করে। ভুলের আবার বয়স হয় না কি?

এরপর কিছুক্ষণ সব চুপচাপ। কেউ কোনও কথা বলতে পারে না। কিন্তু মনে হচ্ছিল, অনেক কথা জমে আছে। এই ঘরে লোকজন আসে, ‘ভিজিটর আসে, সহকর্মীরাও। মঞ্জুকে নিয়ে স্টুডিওতে যায় অনিকেত।

মঞ্জু বলে, আকাশবাণী-র ভিতরে কখনও আসিনি। বাইরে থেকেই দেখেছি। এখানেই অনুরোধের আসর হত?

—এখনও তো হয়।

—জানি। কিন্তু শ্যামল মিত্র, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়—ওঁরা তো আর নেই। জপমালা ঘোষ, উৎপলা সেন, সতীনাথ…তুই হেমন্তকে দেখেছিস?

—দেখেছি।

—অনেকদিন ধরে এখানে কাজ করিস?

— হ্যাঁ।

—নাটক কোথায় হয়?

—চল, দেখাব। সেই ঝোলানো মাইক্রোফোন, যার সামনে দাঁড়াতেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, বসন্ত চৌধুরী, শম্ভু মিত্র, নির্মলকুমার, মঞ্জু দে, তৃপ্তি মিত্র, কেয়া চক্রবর্তী, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, শুক্লা বন্দ্যোপাধ্যায়, শোভনলাল মুখোপাধ্যায় …

মঞ্জু বলল, এখন শুক্রবারের নাটকটা শোনা হয় না আর। কিন্তু রোববার দুপুরের নাটকটা মাঝে-মাঝে শোনা হয়। রেডিও শোনার অভ্যেসটা রয়েই গিয়েছে। নইলে ‘সন্ধিক্ষণ’-টা শোনা হত না। আর তোর সঙ্গেও দেখা হত না।

ড্রামা স্টুডিওটা ফাঁকা ছিল। ওখানেই ওরা বসল। মেঝেতে কার্পেট পাতা আছে।

–বল, তোর সমস্যা বল। জানি না আমাদের দিয়ে তোর কিছু লাভ হবে কি না।

মঞ্জু বলল, তোর হাতে কতটা সময় আছে?

—কিছু অসুবিধে নেই।

মঞ্জু বলল—যে-কারণে এসেছি, সেটা নিশ্চয়ই বলব। তার আগে একটা ব্যাপার বলে দিই। সেই ছোটবেলার কথা। যেটা কখনও বলা হয়নি। সেই যে দাদুর সঙ্গে আমাকে দেখেছিলি …।

নাটকের ফ্ল্যাশব্যাক-এর একটা মিউজিক যেন বেজে ওঠে—টিরি টিরি টিরিং।

দাদুর ক্যানসার হয়েছিল। মঞ্জু মাথা নিচু করে।

দাদু বলেছিল, আরও ক’টা বছর আমি বাঁচতে চাই মঞ্জু। তুই আমাকে বাঁচাতে পারিস। শুধু তুই।

আমি বলেছিলাম—আমি? আমি কী করে তোমার অসুখ ভাল করব?

দাদু বলেছিল, আমি তো পুজোআচ্চা করি, শাস্ত্র পড়েছি। শাস্ত্রে একটা কথা লেখা আছে, বেদ-পুরাণেও আছে। আগেকার দিনে এভাবে অনেকে ভাল হয়েছে।

—কীভাবে?

দাদু বলল, বলছি। কিন্তু তোর-আমার মধ্যেই ব্যাপারটা রাখিস। তোকে মিনতি করছি মঞ্জু। দাদু হাতজোড় করল। দাদুর চোখে জল।

আমি বললাম, আমি কী করতে পারি বলো…

দাদু বলল, যেটা বলব, শুনে হয়তো আমাকে খারাপ ভাববি। হয়তো রাজি হবি না। কথা দে, তুই আমার এই অনুরোধটা রাখবি।

কী করতে হবে আমাকে কিছুই বুঝতে পারলাম না। দাদুর চোখের জল দেখে বলে দিলাম—আচ্ছা, রাখব…।

দাদু আমার মাথায় হাত রাখল। বলল, আশীর্বাদ করি সুখে থাক। রাজরানি হ। পুজোআচ্চা করি, ভগবানের নাম করি, ঠাকুর-দেবতা নিয়ে থাকি। যদি আশীর্বাদের কিছু শক্তি থাকে, সেটা ফলবে।

আমি বলি, বলো এবার…।

দাদু বলল, শাস্ত্রে আছে ষোড়শী বালিকা জরা নাশ করতে পারে। রোগ-ব্যাধি মুক্ত করতে পারে। ষোড়শী বালিকার অনেক ক্ষমতা…। তুই যদি তোর শরীরটা দিস আমাকে…। শাস্ত্রে আছে ষোড়শী রমণ সর্বব্যাধিহর। আরও কী সব শ্লোক বলল।

আমি ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম। বুক ধুকধুক করতে লাগল। আমি জোরে-জোরে মাথা নাড়ি।

দাদু আবার দু’হাত জোড় করে। আমার পা চেপে ধরে।

আমি বলি, কী হচ্ছে দাদু? এ কী করছ! দাদু বলে, বাঁচব মঞ্জু, বাঁচব। আমাকে বাঁচা। রমণ তো হবে না। তুই শুধু বিবস্ত্র হবি। আমি তোর শরীর স্পর্শ করব। আমার সর্ব অঙ্গ দিয়ে তোর শরীর স্পর্শ করব। ষোড়শীর স্পর্শেই রোগ সারবে। শাস্ত্রের বচন মিথ্যা নয়। কেউ জানবে না। শুধু তুই আর আমি। একদিন সুযোগ বুঝে তোকে ডাকব। এটা গোপন ক্রিয়া। কিন্তু অব্যর্থ। আমি যদি ক’টা দিন বাঁচি, সেটা তোর জন্যই বাঁচব রে মঞ্জু। তোর প্রতি কৃতার্থ থাকব। কৃতজ্ঞ থাকব। সারা জীবন আশীর্বাদ করে যাব। একদিন তো মরবই। মরার পরও, আমার আত্মা সর্বদা তোর মঙ্গল চাইবে। তোর কাছে ভিক্ষা চাই রে মঞ্জু। ভিক্ষা চাই। তুই ফেরাস না।

একটা অদ্ভুত প্যাথোজ মিউজিক ড্রামা স্টুডিও-র দেওয়াল থেকে বাজতে থাকে। অনিকেতের সারা শরীর রিনরিন করতে থাকে। ও কীরকম হাওয়ায় ভাসতে থাকে।

—তারপর তুই আমাকে দেখে ফেলেছিলি দাদুর সঙ্গে, ওইভাবে। খুব খারাপ ভেবেছিলি আমাকে…!

অনিকেত বলে, আর ওই জন্যই তো…। আমি ভেবেছিলাম যে মেয়েটা একটা ক্যানসারের বুড়ো রুগিকে…তাকে…।

—যে এমন করতে পারে, সে খুব অ্যাভেলেবল। খুব চিপ। এইসব ভেবেছিলি। ভাবতেই পারিস। তোর দোষ কী? কিন্তু আমি সেদিন তোর সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করেছিলাম। যা- তা করেছিলাম। মনে হয়েছিল, ভেবেছে কী সবাই? একটা বুড়ো একরকম ভাবে বলল, তারপর একটা ইয়ং ছেলে…।

—ঠিকই তো। তোর কী দোষ? তুই ঠিকই করেছিলি। তোর ওই কথা আর তুই যা করেছিলি—তাতে আমার উপকারই হয়েছিল। মেয়েদের শ্রদ্ধা করতে শিখেছিলাম। তুই আমাকে সংযত হতে সাহায্য করেছিলি… অনিকেত বলে।

মঞ্জু বলল, সেই মুহূর্তে খুব রাগ হয়েছিল। তোর ওপর ব্যক্তিগত রাগ নয়। হয়তো আমার নিজের ওপরই। নিজের শরীরের ওপর।

মঞ্জু একটু নিশ্চুপ থাকে। ড্রামা স্টুডিও-র দেওয়াল থেকে যেন ছুটে আসে মেহের আলি- র চিৎকার। তফাত যাও…তফাত যাও…সব ঝুট হ্যায়…। দেয়াল থেকে একটা কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, আমার সাজানো বাগান শুকিয়ে গেল। সেই হাহাকার। জাহানারা-র সেই সংলাপ— চমৎকার। আবার বলি চমৎকার…।

অনিকেত বলে, তোর কী মনে হয় মঞ্জু এখন? জীবনের অনেকটা পথ পার হয়ে এসেছি আমরা। তোর কি মনে হয়, তোর দাদু, মানে আমার সেই বড় পিসেমশাই, তোকে ভোগ করার জন্য ওসব বাহানা করছিল? নকশা করছিল?

মাথা নাড়ে মঞ্জু। বোধহয় তা নয়। দাদুর ওই বিশ্বাসটা জেনুইন ছিল। আমাকে ছোঁওয়ার আগে চোখ বুজে কিছু প্রার্থনা করছিল। আমার গা ছুঁয়ে নিজের মাথায় হাত রেখেছিল। আমার বুক ছুঁয়ে নিজের সারা গায়ে বোলাচ্ছিল। গলার ওই জায়গাটায় বেশি করে, যেখানটা ফুলে ছিল। কীরকম পুজো করার মতো করছিল।

অনিকেত বলে, এত কথাই যখন বললি, তখন আমার জিগ্যেস করতে হেজিটেশন নেই, ওঁর কি ইয়ে-টা, মানে পুরুষাঙ্গটা, ‘হার্ড’ হয়েছিল? মঞ্জু বলে, আমি ওদিকে তাকাইনি, তবে আমার ওখানে টাচ করিয়েছিল। ‘হার্ড’ ছিল না মনে হয়। অতটা মনে নেই। কয়েক মিনিটের মধ্যেই তো তুই জানালা খুললি …।

ওই ব্যাপারটা কি কাউকে বলেছিলি? অনিকেত জিগ্যেস করে।

—না।

—তোর মা-কে?

—না।

—আর, আমার ব্যাপারটা?

–না।

তোর মা-কেও বলিসনি?

–না।

—তা হলে তোর মা আমার দিকে অমন করে তাকাতেন কেন?

–তোর মনের ভুল। তোর নিজের অপরাধবোধ।

—কিচ্ছু বলিসনি মা-কে?

—বোধহয় একবার একটু বলেছিলাম ডাবু ছেলেটা সুবিধের নয়।

—ওটাই যথেষ্ট, তোর মা যা বোঝার বুঝে নিয়েছিলেন।

—হয়তো।

—তোর মা জিগ্যেস করেননি, …এরকম বলছিস কেন?

—না।

—কিন্তু পরেও কি আমাকে ঘেন্না করতিস মঞ্জু?

–বললাম তো, তোকে ঘেন্না না। নিজের শরীরের ওপর। কেন এরকম হল? ছোট ছিলাম, বেশ ছিলাম, এরকম মনে হত।

—তা হলে আমাকে দেখলে মুখ ঘুরিয়ে নিতিস কেন? থুতু ফেলতিস…

—থুতু?

—হ্যাঁ তো…।

—মনে পড়ছে না। ছাড় ডাবু ওসব। অনেকের জীবনেই অনেক কিছু ঘটে। কত সব বিচিত্র অভিজ্ঞতা।

—তোর আর রাগ নেই তো?

—বলছি তো না।

—হাল্কা হলাম রে মঞ্জু। ওটা একটা ট্রমার মতো ছিল। কত সব ভুলভাল ধারণা মানুষের। বড় পিসেমশাইয়ের বিশ্বাসটা হয়তো খুব জেনুইন ছিল, হয়তো বাঁচার প্রবল আর্তিতেই ওসব করতে চেয়েছিল…।

অনিকেত কিছু বইপত্র জোগাড় করেছিল মনের বিচিত্র ভাঁজ, আলো-অন্ধকার বোঝার জন্য। যৌনতা-সম্পর্কিত কিছু বইও। একটা বইয়ের একটা শ্লোক মনে পড়ল। বইটা বাড়ি গিয়ে খুঁজে পেয়েছিল। একটা চটি বই। বইটির নাম ‘রতিমঞ্জরী।’ মহাকবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র বংশীয় মহামহাধ্যাপক পণ্ডিত উদয়চন্দ্র ন্যায়ভূষণের প্রপৌত্র পণ্ডিত পঞ্চানন রায় কাব্যতীর্থ কর্তৃক সংকলিত—পতিগণের শক্তিস্বরূপা অভিন্নহৃদয়া অর্ধাঙ্গিনী নারীকুলের করকমলে উৎসর্গীকৃত। দু’শোটার মতো সংস্কৃত শ্লোক আছে। নারী কয় প্রকার, কাদের কেমন গুণ ইত্যাদি প্রসঙ্গে বলতে-বলতে কোন নারীগমনে কী ফল হয়, তাও আছে। কয়েকটা শ্লোক এখানে বলা যেতে পারে, যা থেকে বড় পিসেমশাই ও মঞ্জুর ব্যাপারটা বোঝা যায়।

আষোড়শী ভবেদ্বালা তরুণী ত্রিংশতীমতা
পঞ্চপঞ্চাশতি প্রৌঢ়া ভবেৎ বৃদ্ধা ততঃ পরম

ফলমূলাদিভবালা তরুণী রতিযোগতঃ
প্রেমদানাদিভিঃ প্রৌঢ়া বৃদ্ধা চ দৃঢ় তাড়না

বালাতু প্রাণদা প্ৰোত্তা তরুণী প্রাণহারিণী
প্রৌঢ়া করোতি বৃদ্ধত্বং বৃদ্ধা মরণমাদিশেৎ

মানেটা দাঁড়াচ্ছে এরকম : নায়িকা চাররকম। বালা, তরুণী, প্রৌঢ়া ও বৃদ্ধা। ষোলো বছর বয়স পর্যন্ত নারীরা ‘বালা’। ষোলো থেকে তিরিশ বছর পর্যন্ত তরুণী, তিরিশ থেকে পঞ্চাশ বছরের নারীরা প্রৌঢ়া, এরপর বৃদ্ধা। ফলমূল দিয়ে বালাকে, রতি দ্বারা তরুণীকে, প্রেমবচনে প্রৌঢ়াকে এবং তাড়না দ্বারা বৃদ্ধাকে বশ করতে হয়।

বালা নারী মাত্রই ‘প্রাণদা’। তরুণী ‘আয়ুহারিণী’। প্রৌঢ়ার সঙ্গে রমণ আরও বৃদ্ধ করে। বৃদ্ধা- রমণ মৃত্যু ডেকে আনে।

কোনও মুসলিম কিতাবেও পড়া গেছে বালিকা-রমণে আয়ু বাড়ে। বলবৃদ্ধি হয়।

বালা তু প্রাণদা প্রোক্তা। বড় পিসেমশাই এটা বিশ্বাস করতেন। আরও কেউ-কেউ বলেছিল হয়তো। মঞ্জু তো তখন বালা। বালা’কে ফলমূল দিয়ে বশীভূত করতে হয়। এখন কেউ চকোলেট, লজেন্স দিয়ে কিংবা স্যান্ডউইচ-বার্গার দিয়েও চেষ্টা করে হয়তো, কিন্তু পিসেমশাই তো হাতজোড় করে কাতর কণ্ঠে ওর কাছ থেকে প্রাণ চেয়েছিল।

অনিকেত বলল, ওইসব ভুলভালগুলো..। কী বলবে ঠিক বুঝে উঠতে পারল না। থেমে গেল। আবার শ্বাস নিল অনিকেত।

বলল—বল, তোর আসল কথা বল। কেন এসেছিস? এতক্ষণ যা সব কথা হল, তা তো এক্সট্রা।

মঞ্জুও দীর্ঘশ্বাস নিল, যেন অনেক কথা বলবে। কিন্তু কিছু না-বলে দীর্ঘশ্বাস-ই শুধু। স্টুডিও-র মাইক্রোফোন অন থাকলে ঝড় আর দুর্যোগের সাউন্ড-এফেক্ট হত।

দু-চার সেকেন্ড নিস্তব্ধ থেকে মঞ্জু বলল, তুমি ভাল আছ ডাবুদা?

—ওই আর কী।

—বিয়ে? নিশ্চয়ই করেছ…

—তুই কিন্তু আমাকে ‘তুই’ করেই বলতিস…

—ও, হ্যাঁ, হ্যাঁ…বিয়ে করেছিস? না, না, ‘তুই’ করে পারব না।

—হ্যাঁ, করেছি।

–বউ নিশ্চয়ই খুব সুন্দরী…

—ওই আর কী।

—ছেলে-মেয়ে?

—না।

—কেন রে, হয়নি?

—না।

—ও!

ছেলেদের বিয়ের চিহ্ন থাকে না। মেয়েদের থাকে। অনিকেত মঞ্জুর মাথায় কোনও লুকনো সিঁদুর দেখতে পেল না। হাতেও কিছু নেই। বাঁ হাতে শুধু একটা ঘড়ি। অনিকেত জিগ্যেস করল, তুই বিয়ে করিসনি?

—করিনি। হয়েছিল। টেকেনি।

—ও। বাচ্চা?

—একটা। ছেলে।

—কার কাছে থাকে?

—আমার কাছেই।

–কত বড় হল?

–ষোলো। সেই ষোলো। সর্বনাশা ষোলো।

সুকান্ত ভট্টাচার্য আঠেরো বছর বয়সের কথা লিখেছিলেন। অনিকেত দ্যাখে ষোলো বছর বয়সটাও কম কিছু নয়।

মঞ্জু বলতে থাকে—আমি আর ও থাকি একটা বাড়িতে ভাড়ায়। ওর যখন আট বছর বয়স, তখন ওর বাবা চলে গেল। মানে, আমায় ছেড়ে গেল।

—ডিভোর্স হয়েছে?

–না। কোর্টে যাওয়া হয়নি।

—ও টাকা-পয়সা দেয়?

—না। দেয় না। কী করে দেবে? অন্য মহিলার সঙ্গে থাকে, সংসার আছে।

—–বাঃ, ছেড়ে চলে গেল, খোরপোশ দেবে না? ছেলেটা তো ওর।

—বলেছিলাম, বলল, পারবে না।

—কোর্টে গেলে পেয়ে যেতিস…

–কে যাবে? আমার তো কেউ নেই…

–কেন, মহিলা সমিতি-টমিতি কত আছে…

—জানি না রে…।

—তোর চলছে কী করে?

—আমি একটা ছোটখাটো চাকরি করি। তাতে যা হোক করে ডাল-ভাত হয়ে যায়।

—কোথায় থাকিস মঞ্জু?

—পানবাজার। এন্টালির কাছে।

—তোর বর কী করে?

—বিজনেস। লেদের কারখানা। এখন বিজনেস-টা তেমন চলে না শুনেছি।

–যোগাযোগ আছে?

—একটু-একটু।

—তার মানে সম্পর্কটা ধুয়ে-মুছে যায়নি। তাই না? কিছু বলে না মঞ্জু।

—বরের প্রতি তোর এখনও একটা সফট কর্নার আছে, তাই না?

—কী করে বুঝলে?

—ওই যে, বলছিলি—কী করে টাকা দেবে, ওর সংসার আছে… বিজনেসটাও ভাল চলছে না…।

—আমার কথা ছাড়। আমার ছেলেটাকে বাঁচা। ও ছাড়া আমার কেউ নেই। খুব সমস্যায় পড়েছি ছেলেটাকে নিয়ে।

–কী সমস্যা?

–তোরা যা নিয়ে আলোচনা করছিলি। রেডিও-টা শোনার অভ্যেস ছিল ছোটবেলা থেকে একটা রোববার সকালে শুনলাম, এরপর থেকে পরপর কয়েকটা রোববার-ই শুনলাম। তোরা বলছিল, হোমোসেক্সুয়ালিটি কোনও রোগ নয়, অথচ আমরা জানি এটা একটা অসুখ। আমার ছেলেটা…।

১২

মঞ্জু বলেছিল, ওর ছেলেটা সমকামী। কথাটা বলার সময় যেন ও লজ্জায় মরে যাচ্ছিল। বলছিল, আমার স্বামীটা ছেড়ে চলে গেল, ছেলেটাই ভরসা, কিন্তু ও এরকম উচ্ছন্নে গেল…।

—উচ্ছন্নে গেল বলছিস কেন মঞ্জু? লেখাপড়ায় কেমন ও?

—ছোটবেলায় তো বেশ ভাল ছিল। এখনও খুব খারাপ না। কিন্তু বিগড়ে গেল।

—বিগড়ে গেল মানে?

—অংক-টংক একদম করে না। করতেই চায় না। গান শোনে, গানের সঙ্গে-সঙ্গে নাচে। টেপ চালিয়ে।

—তাতে কী হল? একে কি বিগড়ে যাওয়া বলে নাকি?

—স্কুলেও যেতে চায় না। কবিতা-টবিতা লেখে।

—আবার কী আজেবাজে বকছিস! কবিতা লেখা কি খারাপ নাকি?

—না, কবিতা লেখা খারাপ সেটা বলছি না, কিন্তু স্কুলের সিলেবাসে তো কবিতা ছাড়াও আরও সাবজেক্ট আছে। ওসব পড়ে না। সিক্স-সেভেন থেকেই ও কেমন একটা হয়ে গিয়েছে। মেয়েদের মতো সাজগোজ করে। তারপর আরও সব বিচ্ছিরি কাণ্ডকারখানা। আমার লাইফ-টা হেল করে দিল। ছোটবেলায় ও কী সুন্দর ছিল, কী ভাল মেমোরি ছিল। যা পড়ত, একবার – দু’বার পড়লেই মুখস্থ হয়ে যেত। ওকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখতাম…। সব স্বপ্ন শেষ করে দিয়েছে পরিমল। আসলে পাপের শাস্তি বোধহয়

—কী পাপ করলি আবার?

—ওই যে ছোটবেলায়—তোর পিসেমশাইয়ের সঙ্গে…। কিন্তু আমি কী করতাম? একটা অসুস্থ মানুষ বলেছিল বাঁচতে চায়…।

—ওটা ভুলতে পারলি না?

—ভুলে তো গিয়েছিলাম, কিন্তু ছেলেটা ওরকম হয়ে গেল বলেই মাঝে-মাঝে মনে হয় রোগ নয়…। সত্যি বল তো, তুই নিজেও কি বিশ্বাস করিস এটা কোনও রোগ নয়?

—আমিও আগে ভাবতাম, এটা একটা রোগ। এখন বুঝেছি।

—এটা নর্মাল ব্যাপার?

—সবাই তো বলছে। বিশেষজ্ঞরা…।

—তা হলে আমার ছেলেটা নর্মাল?

—তাই তো।

—তা হলে ও যে মেয়েদের মতো সাজে, চুপিচুপি মেয়েদের পোশাক পরে, আমি যখন বাড়ি থাকি না, আমার শাড়ি পরে…এসব পাল্টাবে না?

—তুই চেষ্টা করেছিলি?

—করেছিলাম। বলে-কয়ে, বুঝিয়ে…। বলেছিলাম, তুই ব্যাটাছেলে, পুরুষমানুষ, কেন মেয়েদের মতো হাবভাব করিস? ও বলেছিল আমি যদি মেয়ে হতাম, তা হলেই ভাল হত। আমি বলেছিলাম, বোকার মতো কথা বলছিস কেন? মেয়ে হওয়া কি ভাল? আমি কি মেয়ে হয়ে ভাল আছি? তুই ছেলে, ছেলেদের মতো হ। খেলবি, মারপিট করবি, দৌড়বি। তুই কেন এরকম মিনমিনে স্বভাবের হচ্ছিস? হাত-মুখ বেঁকিয়ে কথা বলছিস, ছিঃ!

—ওর কত বছর বয়স থেকে এসব লক্ষ করলি?

–বাচ্চা বয়সে তো সবাই একরকমই থাকে। স্কুলে যেত, গান শুনতে ভালবাসত, গান গাইতেও ভালবাসত। খুব সুইট ছিল। আদুরে। ওর বাবার সঙ্গে আমার যখন ঝগড়া হত, ওর মনে সেটার এফেক্ট পড়ত। ও বলেছিল, বাবাটা একদম ভাল না। তুমি ভাল। আমি মনে-মনে খুশি হতাম। ওর যখন পাঁচ বছর বয়স, তখন থেকেই ওর বাবা অন্য এক মহিলার সঙ্গে ইনভল্ভড হয়ে পড়েছিল। ওর আট বছর বয়সের সময়, ওর বাবা আমাদের ছেড়ে চলে যায়। তখন থেকেই বাবার প্রতি ওর একটা বিতৃষ্ণা জন্মে যায়। পুরুষদের ঘৃণা করতে গিয়ে ও নিজেকেও ঘৃণা করতে শুরু করে। নিজেকে পুরুষ ভেবে লজ্জা পেতে শুরু করে।

—এই রাবিশ ব্যাখ্যা তোকে কে দিয়েছে? তুই কি নিজে-নিজেই এইভাবে ভেবেছিস?

—আমাকে একজন সাইকোলজিস্ট বলেছিল।

—সাইকোলজিস্ট দেখিয়েছিলি বুঝি?

—দেখিয়েছি তো।

–কবে?

—কিছুদিন আগে। মাস দু’য়েক।

–কী বলেছিলেন উনি?

–বলেছিলেন কাউন্সেলিং করাতে হবে। কুড়ি-টার মতো সিটিং দরকার হবে। পার সিটিং দু’শো টাকা। তার মানে কুড়িটার জন্য চার হাজার টাকা। এই টাকাটা আমি খরচা করতে হয়তো পারতাম, কিন্তু পরিমল রাজি হল না। ও কিছুতেই গেল না। পরিমল আমার ছেলের নাম

—জানি তো…। বলে যা।

—একদম লেখাপড়া করতে চায় না। পড়াশোনায় মন নেই। স্কুলেই যেতে চায় না। স্কুলে যেতে ওর ভাল লাগে না। ওকে স্কুলের ছেলেরা টিটকিরি দেয়। টিচাররাও ব্যঙ্গ করে। কোনও- কোনও টিচার ওকে ‘পরি ম্যাডাম’ বলে।

—ও কি তাতে দুঃখ পায়?

—এটা একটা প্রশ্ন হল? দুঃখ পাবে না?

—কেন দুঃখ পাবে? ওর তো এতে ভাল লাগার কথা। তুই তো বললি ও মেয়ে হতে চায়। নিজেকে মেয়ে বলে ভাবতে ভালবাসে। তাই যদি হয়, তা হলে যখন কেউ ওকে পরি বলে ডাকে, মানে ওর মেয়েলিত্ব-কে স্বীকৃতি দেয়, তখন তো ওর আনন্দ হওয়ারই কথা।

মঞ্জু একটু মাথা চুলকোয়। কিছুক্ষণ চুপ। বলল, এতটা জটিল করে ভাবতে পারি না রে। আসলে, বলার মধ্যেই তো ব্যঙ্গ আছে। বিদ্রূপ আছে। হ্যাটা আছে। অপমান আছে। এই অপমানটা প্রতিদিন ওকে কষ্ট দিচ্ছে। ওইজন্যই ও স্কুলে যেতে পারছে না। স্কুলে যেতে চায় না বলে আমিও ওকে মেরেছিলাম। তারপর একদিন ও ব্লেড দিয়ে ওর হাতের শিরা কেটে দিয়েছিল। আমি তখন কাজে গিয়েছিলাম। বাড়ি ফিরে দেখি ওর হাত রক্তে ভেসে যাচ্ছে। ভাল করে কাটেনি বলে বেঁচে গিয়েছিল। এখনও হাতে সেলাইয়ের দাগটা আছে। ওটা দেখে আমার বুক টনটন করে ওঠে এখন। ভয় হয়। এরপর থেকে ওকে কিচ্ছু বলি না আর। কয়েকদিন কাজে যাইনি। কিন্তু কাজ কী করে কামাই করব? কাজ না-করলে খাব কী? ওকে বললাম, বাবু, তোর যা ভাল লাগে তাই কর, তোকে আমি আর কিচ্ছু বলব না। বকব না। কিন্তু পড়াশোনা কর। স্কুলে না-যাস লেখাপড়াটা ঠিক করে কর। পরীক্ষাটা দে। ও কিন্তু পড়াশোনায় বেশ ভাল। বিশেষ করে বাংলায়। ক্লাস এইট-এ যখন পড়ত, ইস্কুলের ম্যাগাজিনে কবিতা বেরিয়েছিল।

ওর বাবা যখন ছেড়ে-ছুড়ে চলে গেল, তখন ভেবেছিলাম ছেলেকে যে করে হোক মানুষ করব। যে করে হোক, ছেলেকে ভাল করে লেখাপড়া করাব। ছেলেটা তো ইন্টেলিজেন্ট-ই ছিল…।

অনিকেত বলে, ইন্টেলিজেন্ট ছিল বলছিস কেন, এখনও ইন্টেলিজেন্ট। ওর প্রতিভার বিকাশ হতে দে, ও ঠিক বড় হবে।

—কী করে বড় হবে ও? ও তো যা-তা শুরু করে দিয়েছে। জঘন্য ব্যাপার-স্যাপার শুরু করেছে।

— যেমন?

—চব্বিশ-পঁচিশ বছরের একটা ছেলেকে ঘরে নিয়ে আসছে, স্কুলে না-গিয়ে এসব করছে। বিছানায় একটা ব্যাটাছেলের সঙ্গে…।

—ও যদি ব্যাটাছেলেকে ঘরে না-ঢুকিয়ে কোনও মেয়েকে নিয়ে আসত, তা হলে কি মেনে নিতিস?

—সেটাও হয়তো মেনে নিতাম না, তবু ভাবতাম এটা তো বয়সের ধর্ম। অ্যাবনর্মাল কিছু নয়। কিন্তু ব্যাটাছেলের সঙ্গে জামাকাপড় খুলে জড়াজড়ি করাটা তো অ্যাবনর্মাল। কী করে সহ্য করব? আমার নিজেরই সুইসাইড করতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু আমি যদি ওসব করি, ছেলেটা তো ভেসে যাবে। শুনেছি হিজড়েরা এই ছেলেদের টোপ দেখিয়ে নিজেদের দলে ভিড়িয়ে নেয়। এটা কি সত্যি?

অনিকেত বলে, জানি না। তবে জেনেছি হিজড়েরা প্রায় সবাই পুরুষমানুষ। আগে আমার ধারণা ছিল, হিজড়েরা উভলিঙ্গ। মানে, ওদের জন্মগত ত্রুটি থাকে। ওদের পেনিস আর ভ্যাজাইনা দু’টোই থাকে, কিন্তু অপরিণত। এরকম বাচ্চাকে ওদের বাবা-মা-ই হিজড়েদের দিয়ে দেয়, এইভাবে হিজড়েদের দল তৈরি হয়। ভুল জানতাম। পরে শুনলাম, জেনেটিক ত্রুটির কারণে হিজড়ে হয়। এটাও ভুল জানতাম।

মঞ্জু বলল, আমার খুব ভয় হয়। সবসময় একটা ভয়। ছেলেটা হিজড়ে-টিজড়ে হয়ে যাবে না তো? ওকে অনেকে হিজড়ে বলে। পাড়ার অনেকে। কেউ যদি আমার বাড়ি খুঁজতে-চুঁজতে আসে, বলে, ওই বাড়িটা তো, একজন ভদ্রমহিলা থাকেন, ওঁর একটা হিজড়ে মতন ছেলে আছে? এগুলো সর্বক্ষণ আমাকে কুরে কুরে খায়। একদম বাঁচতে ইচ্ছে করে না। আমি এখানে এসেছি যদি একটা পথ তোরা দেখাতে পারিস…।

অনিকেত বলল, এবার আমাদের এখান থেকে উঠতে হবে। চয়ন বসু-র আসার কথা। উনি একজন সাইকোলজিস্ট। তোর সঙ্গে কথা বলিয়ে দিচ্ছি।

ড্রামা স্টুডিও থেকে নিজের ঘরে গেল অনিকেত। গিয়ে দেখল চয়ন বসু বসে আছেন অনেকক্ষণ? অনিকেত জিগ্যেস করে।

—না, পাঁচ মিনিট।

—হাতে সময় আছে আজ?

—আছে।

—তা হলে এই ভদ্রমহিলাকে একটু সময় দিন। তারপর কাজের কথা বলব।

চয়ন বসু-কে আসতে বলেছিল অনিকেত সমকামীদের মানসিক সংকট নিয়ে একটা আলোচনা করার জন্য। এঁকে নতুন করে প্যানেল-এ নেওয়া হয়েছে।

অনিকেত চয়নবাবুকে মঞ্জুর ছেলের সমস্যাটার কথা বলে। চয়ন বসু বলেন—অত চিন্তা করছেন কেন ম্যাডাম? ব্যাপারটা নিয়ে এত ভাববেন না। ও একজন পরিপূর্ণ মানুষ। মানুষের সমস্ত গুণ ওর মধ্যে আছে, ওগুলো বিকশিত হতে দিন। কতটা ছেলের মতো ব্যবহার, কতটা মেয়ের মতো—এসব কোনও ব্যাপারই নয়। এগুলো আমরাই তৈরি করেছি। মেয়েরা তো এখন শার্ট-প্যান্ট পরছে, এটা কুড়ি বছর আগেও আমাদের চোখে খারাপ লাগত। কিন্তু মেয়েদের শার্ট-প্যান্ট পরা না-পরা নিয়ে আপনার কোনও মাথাব্যথা আছে?

মঞ্জু বলে, না।

এখন তো অনেক মেয়ে বাড়িতে বারমুডা-গেঞ্জি পরেও সংসার সামলাচ্ছে। গেঞ্জি উঠিয়ে বাচ্চাকে ব্রেস্ট ফিড করাচ্ছে।

–হুঁ।

—তা হলে, কোনও ছেলে যদি শাড়ি-টাড়ি পরে, আপত্তি কীসের?

মঞ্জু বলল—একটা কথা বলব ডাক্তারবাবু? মেয়েরা শাড়ির বদলে সালোয়ার-কামিজ পরে কেন? চলাফেরায় সুবিধার জন্য। শার্ট-প্যান্ট পরে কমফর্ট-এর জন্য। কিন্তু ছেলেরা কেন শাড়ি পরতে যাবে?

চয়ন বসু বললেন——আমি ছেলেদের শাড়ি পরার পক্ষে ওকালতি করছি না মোটেই। সত্যি তো, ছেলেরা কেন শাড়ি পরতে যাবে? কিন্তু মেয়েরাই বা কেন কষ্ট করে নাক ফুঁড়তে যাবে? কান ফুঁড়তে যাবে? সাজবে বলে, তাই তো? দেখতে ভাল লাগবে, তাই। যদি কোনও ছেলে নিজে মনে করে লিপস্টিক লাগিয়ে ঠোঁটটা লাল হলে ওকে দেখতে ভাল লাগবে, কিংবা কাজল পরলে দেখতে ভাল লাগবে, তা নিয়ে আমরা কেন এত হাসাহাসি করি? প্যান্ট পরলে একটা মেয়ে সমাজের চোখে হয়ে যায় স্মার্ট, আর কাজল পরলে একটা ছেলে হয়ে যায় হিজড়ে এই মনোভাবটা, এই দৃষ্টিভঙ্গিটা পাল্টে ফেললেই মনে অশান্তি থাকবে না। জানি, বহুদিন ধরে একটা সোশাল ভ্যালু তৈরি হয়। ওগুলো আমাদের মনের গভীরে গেঁথে থাকে। আর ওইসব ভ্যালুজ সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে পাল্টায়। অনেকের বাড়িতেই তো ঠাকুর-দেবতা আছে। দেবতাদের গায়ে গয়না নেই? কৃষ্ণের কানে দুল, গলায় মালা, হাতে বালা, মাথায় মুকুট। রাধারও তাই। সব রাজা গয়নাগাটি পরতেন। এতে তো কোনও নিন্দে ছিল না। ইউরোপে আগেকার দিনে ছেলেরাও ফ্রক পরত। কোনও-কোনও ছেলে হয়তো ধর্মীয় কারণে নয়, অন্য কোনও ভাল- লাগা থেকে মেয়েদের পোশাক-টোশাক পরে। মানে, যাকে আমরা মেয়েদের পোশাক বলে ভাবি আর কী। এ নিয়ে অতটা দুশ্চিন্তা না-করলেও চলবে। ওকে নর্মাল বলে ভাবুন না, ওর যা প্রতিভা আছে, বিকশিত হতে দিন। ক্রমাগত যদি ওকে বকাবকি করা হয়, ওর কিন্তু প্রতিভার স্ফুরণ হবে না। পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক উদাহরণ আছে, যারা বিরাট প্রতিভাবান, কিন্তু মেয়েলি স্বভাবের, মানে যাকে আমরা মেয়েলি স্বভাব বলি আর কী!

মঞ্জু বলল—ও তো শুধু মেয়েদের পোশাকেই আটকে নেই, সত্যি কথাই বলছি, ডাক্তারদের কাছে কিছু গোপন করা উচিত নয়। ও তো ঘরে ব্যাটাছেলেদেরও ডেকে আনছে। ও তো সমকামী…। চিকিৎসা নেই?

চয়ন বসু একটু শ্বাস নিলেন। বললেন, একটা কথা বলি ম্যাডাম? আগে ভাবা হত চিকিৎসা হয়। ভাবা হত, সমকাম একটা রোগ। এখন ঠিক সেভাবে ভাবা হয় না। নিঃসন্দেহে এরা অন্যরকম। এরকম না হলেই ভাল হত। কিন্তু কী করা যাবে? সব সমকামীরা মেয়েদের পোশাক পরতে ভালবাসে এমন নয়, কিন্তু যারা মেয়েদের মতো পোশাক আর সাজসজ্জা করে, তারা সাধারণত সমকামী-ই হয়। আবার যারা মেয়েদের সাজসজ্জা করতে ভালবাসে, ওদের বলে ট্রান্সভেস টাইট। তারা ওখানেই সীমাবদ্ধ না-থেকে অনেকে পুরো নারী হতে চায়। এদের বলে রূপান্তরকামী বা ট্রান্সজেন্ডার। কাউন্সেলিং করে অনেক সময় এটা আটকানো যায়। আপনার ছেলের সঙ্গে আমি না-হয় কথা বলে নেব…।

মঞ্জু বলল—এত সব মানসিক রোগের চিকিৎসা আছে, পাগলও ভাল হয়ে যায়—আর এটা ভাল হয় না?

চয়ন বসু বললেন—সেই এক কথাই আমি কিছুতেই আপনাকে বোঝাতে পারলাম না। রোগ-রোগ-রোগ করেই গেলেন। আগে রোগ মনে করে এদের ওপর কম অত্যাচার হয়েছে? শক থেরাপি করা হত।

—মানে?

—মানে, ইলেকট্রিক শক দেওয়া হত। হাল্কা শক যদিও। প্রতিটা শক-এ কুঁকড়ে যেত ছেলেটা। ভাবখানা এই—আর করবি? তা হলে শক দেব। পাগলের চিকিৎসাতেও শক দেওয়া হত আগে খুব। এখন কমে গিয়েছে। ভাবনাটা কী ছিল জানেন? একটা স্টাডি-তে দেখা গিয়েছিল যারা পাগল, ওদের মৃগী বা এপিলেপসি হয় না। সুতরাং যারা পাগলামি করে, ওদের যদি আর্টিফিসিয়ালি কিছুক্ষণের জন্য এপিলেপটিক করা যায়, মানে মৃগীরোগীতে রূপান্তরিত করা যায়, তা হলে পাগলামি সেরে যাবে। এইভাবেই ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল। সমকামীদেরও পাগল ভেবেই শক ট্রিটমেন্ট করা হত। কোথাও-কোথাও সমকামীদের পুরুষত্বহীন করে দেওয়া হত। থিয়োরি-টা হচ্ছে সমস্তরকম যৌন অনুভূতিকে নষ্ট করে দেওয়া, ধ্বংস করে দেওয়া। ভাবখানা এরকম—মেয়েদের সঙ্গে না মিশে ছেলেতে ছেলেতে এসব করছিস, দ্যাখ, তোর যৌন অনুভূতিই নষ্ট করে দিচ্ছি। এতে উল্টো ফলই হল। পুরুষের যে হরমোন টেস্টোস্টেরন, সেটার সাপ্লাই বন্ধ হয়ে গেলে মেয়েলিত্বই বেশি ফুটে উঠবে। আমেরিকার এক ডাক্তার সমকামিতার কারণ হিসেবে মস্তিষ্কের একটা বিশেষ জায়গা নির্দিষ্ট করলেন। সার্জারি করে সমকামিতার চিকিৎসার তত্ত্ব দিলেন। কেউ-কেউ করালেন, কাজ হল না। ঘুমের ওষুধ খাইয়ে আচ্ছন্ন করে রাখার পক্ষপাতীও কেউ। ঘুমোক, ঘুমিয়ে পড়ে থাকলে তো লিপস্টিক দিতে পারবে না, ন্যাকা ন্যাকা কথাও বলতে পারবে না। ন্যাকা ন্যাকা কথা মানে মেয়েলি কথা আর কী। লিপস্টিক লাগানোর চেয়ে ঘুমিয়ে থাকা ভাল। এটাই হল ফান্ডা

মঞ্জুর বোধহয় চয়নবাবুর কথা খুব একটা ভাল লাগছিল না। মঞ্জু বারবার ভ্রু কোঁচকাচ্ছিল।

চয়ন বসু-র বয়স চল্লিশের মতো। মাথায় পনিটেল বাঁধা, গায়ে চকরাবকরা জামা।

চয়ন মঞ্জুকে দেখিয়ে অনিকেতকে বলল—ইনি কি আপনার খুব পরিচিত?

অনিকেত বলল, ছোটবেলার বান্ধবী।

—তা হলে ওঁকে সব বলা যায়। আপনি আমার চেয়ে বয়সে বড়, কিন্তু বন্ধুর মতোই তো।

অনিকেত বলল, বন্ধুর মতোই কেন? বন্ধুই তো।

চয়ন বলল—তা হলে আমারও বন্ধুর মতোই। মঞ্জুকে বলল, জানেন কি ম্যাডাম, হোমো- সেক্সুয়ালদের ওই রোগ; মানে আপনার মতো যারা এটাকে রোগ ভাবছেন, সেটা সারানোর জন্য ওদের প্রচুর টর্চার করা হয়েছে? ফ্রান্সের একদল ডাক্তারের দেখাদেখি ইউরোপের কিছু ডাক্তার ওদের হরমোন ইনজেকশন দিয়ে বিভিন্ন মেয়ের সঙ্গে সঙ্গম করিয়েছে। বারবার। ভেবেছে, বারবার ওটা করিয়ে মেয়েদের দিকে আকর্ষণ ফিরিয়ে আনবে। ভাবুন তো, মন বলেও তো একটা কথা আছে। মন বড়, না হরমোন বড়? মন-ই বড়। মনই তো হরমোন-কে নিয়ন্ত্ৰণ করে। মনের অলিগলিতে ঢোকার সাধ্য কারও নেই।

—আপনার তো মন নিয়েই কারবার। আপনিও মনের খবর জানেন না?

চয়ন বলল—একটা গান আছে না ম্যাডাম, ‘কোথাও আমার মনের খবর পাইলাম না… ব্যাপারটা তাই। সাইকোলজি পড়ে কতটাই বা জেনেছি?

মঞ্জু বলল, তা হলে আপনি কী করে বলছেন আমার ছেলে নর্মাল?

—ওই তো, আমার যেটুকু জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, তা দিয়েই বলছি। যুক্তি দিয়েই তো বলছি। অ্যাবনর্মাল ভেবে যা-যা চিকিৎসা করা হয়েছে, খুব একটা কাজ দেয়নি, সেটাই বলেছি। এমনি- এমনি যদি বিহেভিয়ার চেঞ্জ হয়, তো হল; কিংবা কিছুটা বুঝিয়ে। ওষুধপত্র দিয়ে, ইনজেকশন দিয়ে, শক দিয়ে—কিছু হয় না।

—তা হলে আধ্যাত্মিক লাইন-এ কিছু কাজ হয়? মঞ্জু কীরকম বেচারি-বেচারি মুখ করে জিগ্যেস করে।

—আধ্যাত্মিক মানে? তান্ত্রিকের কাছে নিয়ে যাবেন না কি?

—না, কবচ-মাদুলি তো করেছি। ও পরে না। বলছিলাম, যদি দীক্ষা-টিক্ষা দিয়ে দিই…।

চয়ন বেশ জোরে হেসে উঠল। অনিকেত হাসল না। হাসলে মঞ্জু ব্যথা পাবে। মঞ্জুর জন্য কেমন সহানুভূতি হচ্ছে ওর। চয়ন বলল—ম্যাডাম, অনেক সাধুটাধু আছেন, যাঁরা সমকামী। তবে ওটা অন্য ব্যাপার। ওঁরা ব্রহ্মচারী। ওঁরা না-পাওয়া থেকে করেন। ওঁরা ট্রান্সজেন্ডার নন। মানে, ওঁরা নারীসঙ্গ পান না বলে পুরুষের সঙ্গে মাঝেমধ্যে যৌনকর্ম করার চেষ্টা করেন। জেলখানার কয়েদিরাও করে। ওদের এই প্রসঙ্গে আনছি না। আপনার ছেলেটা, যা বুঝলাম, মনে-মনে মেয়ে, তাই বাইরেও মেয়ে হতে চাইছে, ছেলেদের সঙ্গ চাইছে। এ নিয়ে কেন এত চিন্তা-ভাবনা করছেন। দিনকাল পাল্টেছে। ভাল করে লেখাপড়া করুক, জীবনে প্রতিষ্ঠিত হোক, বলছেন তো গান-বাজনাটা ভাল করে। ওদিকেই যাক না। বলছেন বাংলায় ভাল…

—কিন্তু ওকে যে সবাই টিটকিরি দেয়, স্কুলে টিচাররাও …

চয়ন বলল, এটার বিরুদ্ধেই তো লড়াই। স্কুলে যেতেই হবে ওকে। স্কুলে যাওয়ার সময় সাজগোজ করে ও?

—না। কিন্তু ওর ব্যাগে আয়না আর লিপস্টিক পেয়ে ওর টিচাররা ওকে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল।

চয়ন একটু গম্ভীর হয়ে যায়।

মঞ্জু বলল, জ্যোতিষীর কাছে গিয়েছিলাম একবার ওর জন্মছক নিয়ে। জ্যোতিষী বলল, ওর শুক্র ডাউন, বৃহস্পতি খারাপ, মঙ্গল বক্রী আরও কী সব। একটা যজ্ঞ করতে বলেছিল, আর একটা কবচ দিয়েছিল। যজ্ঞটা করাইনি, অনেক খরচ। মাদুলি দিয়েছিলাম, পরেনি। বলেছিল তাড়াতাড়ি বিয়েটা দিয়ে দিতে, বিয়ের পর নাকি ঠিক হয়ে যাবে। যদি জন্মের সময়ের দোষে, মানে গ্রহের দোষেই এরকম হয়, তা হলে তো ও কোনও দিনই ঠিক হবে না….

অনিকেত বলল—রেডিও-র প্রোগ্রাম-টা শুনেই তো ছুটে এলি এখানে—তাই তো? ওখানে যেকটা ছেলে ছিল—ওরা কি সবাই একই সময়ে জন্মেছিল? কেন এইসব ভাবছিস? ওই ছেলেগুলো তো সবাই যে যার মতো কাজ করছে। একজন মানুষ কী পোশাক পরছে, কেমন করে কথা বলছে, কার সঙ্গে মিশছে, এসব না-ভেবে দ্যাখ মানুষটা ভালমানুষ হতে পারছে কি না। একটা মানুষের পিছনে যদি ল্যাজও হয়, কিন্তু সেইসঙ্গে যদি সে ভালমানুষ হয়, অন্যের ক্ষতি না-করে, সমাজকে কিছু দেয়, তখন ল্যাজ থাকা না-থাকাটা কোনও ম্যাটার করে না। মঞ্জু কয়েক মুহূর্ত চুপ থাকে। তারপর চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে খুব আস্তে-আস্তে বলে—শোন না, আমি না, ওর জাঙ্গিয়াটা চেক করি, চুপি-চুপি। দেখি, মাঝেমধ্যে নোংরাও হয়, মানে ওর আছে, হয়, মানে ও নপুংসক নয়। তা হলে কেন…

অনিকেত এবার একটু অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে। বলে—উঃ। সেই ভ্যাজর ভ্যাজর। নপুংসক বলে কিছু নেই। হিজড়েদেরও ওটা থাকে—যদি না কেটে ফ্যালে। মঞ্জু দু’হাতে চোখ ঢাকে। বলে, তবে কি আমার ছেলেটা হিজড়ে? হিজড়ে?—অ্যাঁ?—উঃ, পরিমল…!

১৩

আমি পরি। স্কুলের নাম পরিমল। হোক গে। আমার পরি নামটাই ভাল লাগে। ছোটবেলাতে তো সবাই পরি নামেই ডাকত। কোনও ছেলে পরি হয় না। সব পরি মেয়ে। জলপরি, ফুলপরি, মেঘপরি…। পরিরা নাচ জানে। গানও জানে। পরিরা উড়তে পারে। ফুলবাগানে নেমে যায়, বনে-জঙ্গলে, ঝরনার ধারে নেমে যায়। ডানা মেলে জোছনা রাত্তিরে চাঁদের আলো সারা গায়ে মেখে ওড়ে। মানুষ তো আর পরি হয় না কখনও, আমিও হতে পারব না। কিন্তু পরিদের কথা ভাবতে খুব ভাল লাগে। খুব যখন ছোট ছিলাম, দিদা পরিদের গল্প বলত। সেই থেকে স্বপ্নে আমি পরি হয়ে উড়ি। পরিদের মতো রত্নহার পরি, ফুলের গয়না পরি, ফুলবাগানে নাচি।

নাচতেও ভাল লাগে খুব। তাসাপার্টির নাচ নয়, ধুমধাড়াক্কা বিসর্জনের নাচও নয়। নাচ কি শুধু লাফানো-ঝাঁপানো নাকি? সুরে-সুরে শরীরটাকে মিশিয়ে দেওয়া। মেয়েরা নাচে। ছেলেদের নাচতে নেই। পাড়ায় যখন রবীন্দ্রজয়ন্তী হত, তখন আলোদি বলত, কে কী করবে বলো। আমি বলেছিলাম, আমি নাচব। আমি বাড়িতে একা একা নাচ প্র্যাকটিস করতাম। ‘পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে আয়রে চলে আয় আয় আয়’, গানটার নাচ আমার খুব ভাল লাগে। ওই যে ‘আয় আয় আয়’ বলে হাতছানি দিয়ে ডাকা, ওটা দারুণ। ‘ডালা যে তোর ভরেছে আজ পাকা ফসলে’— গানে শরীর যেভাবে কথা বলে, ওটা যেন ডালাটা ভরে ওঠা নয়। শরীরটা ভরে ওঠা। মেয়েরা যখন ডালা ভরে ওঠার কথা বলে, তখন কী সুন্দর মানিয়ে যায়, কারণ মেয়েরা বড় হলে যে ওদের শরীরটা ভরে ওঠে। কী সুন্দর হয়ে যায় বুক দু’টো। আমার কেবল মনে হত, এখনও হয়, যেন জোড়া ফুল। আমার বুকটা যদি ওরকম ভরাট আর ভরন্ত হয়ে যেত, তা হলে কত ভাল হত। ওরকম ফুলের মতো বুকের মাঝখানে বোঁটাটা। গলায় হার পরলে, দুই বুকের মাঝখানে হারের লকেটটা ঝুলবে। যেখানে দু’টো স্তন তাদের আলাদা-আলাদা রূপ পেয়েছে, সেই জায়গাটাকে ক্লিভেজ বলে। নামটাও সুন্দর, দেখতেও সুন্দর। আমার চোখেই এত সুন্দর লাগে, তবে তো ছেলেদের চোখে আরও সুন্দর লাগবে। সুন্দরী মেয়েদের দেখলে আমার কেমন যেন একটা হিংসে হয়। মাইরি বলছি। মান্না দে-র ওই গানটা মনে পড়ে। ও কেন এত সুন্দরী হল…।’ আমি কেন হলাম না?

খুব ছোট ছিলাম যখন, দিদা কত গল্প বলত। পরিদের, রাজা-রানিদের, রাজকন্যা- রাজপুত্তুরদের। আমার হাতে ঢাল-তরোয়াল নিয়ে রাজপুত্তুর হয়ে যুদ্ধ করতে ইচ্ছে করত না একদম। বরং রাজকন্যা হয়ে, হাতে মালা নিয়ে, স্বয়ংবর সভায় রাজপুত্র বরণ করতে ইচ্ছে করত। কাজল-পরা চোখে বেশ লজ্জা-লজ্জা ভাব। রাজপুত্তুরের দিকে একটু করে তাকাচ্ছি, আবার একটু করে চোখ নামিয়ে নিচ্ছি। সখিরা সব দেখছে। রাজপুত্তুরদের জিম-করা বডি। না না, জিম নয়, তির-ধনুক ছুড়ত, মুগুর ভাঁজত, তাতেও তো মাস্‌ল ভাল হয়। ছেলেদের মাস্‌লওলা বডি দেখতে দারুণ লাগে। আমার বাবার চেহারাটা একদম বাজে ছিল। কাঁধটা চওড়া ছিল না। বুকে কোনও খাঁজ নেই, অল্প কয়েকগাছি লোম, তার মধ্যে আবার ভুঁড়ি। একদম বাজে দেখতে লাগত। তার চেয়ে ভাল লাগত—বরুণকাকুকে। আমরা একবার পুরী গিয়েছিলাম। আমি তখন অনেক ছোট। আমি, বাবা, মা, বরুণকাকু, কাকিমা। সমুদ্রে স্নান করতে নেমেছিলাম। বাবার হাত ধরে স্নান করছিলাম। সমুদ্রের ঢেউ এলে লাফাতাম। বেশ মজা লাগত। বাবা একবার আমার হাত ছেড়ে কাকিমার হাত ধরল। তখন একটা ঢেউ আমাকে ধাক্কা দিল। আমি পড়ে গেলাম। ঢেউটা টেনে নিয়ে গেল, বালিতে আছাড় দিতে লাগল। দু’হাত তুলে বাবাকে ডাকতে চেষ্টা করলাম, নুনজল পেটে ঢুকে গেল। কোথায় যেন তলিয়ে যাচ্ছি। মনে হচ্ছিল, মরে যাব। তখন কে একজন আমাকে টেনে তুলল। সে আমাকে জড়িয়ে ধরল বুকে। সে একজন নুলিয়া। তার কালো শরীরে লেপ্টে রইলাম। যেন জীবনের সঙ্গে লেপ্টে রইলাম। নুলিয়াটা আমাকে পাড়ে এনে দিল। ততক্ষণে আমার মা আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আমি নুলিয়াকাকুকে ছাড়তে চাইছিলাম না। তার শক্ত, কালো শরীরে সেঁটে থাকতে ইচ্ছে করছিল। সেই থেকে কালো শরীরের মধ্যে যেন জীবন পাই। মনে হয়, শক্তপোক্ত শরীরের মধ্যেই জীবন থাকে। শক্তি থাকে। যাকে বলে—পৌরুষ। মেয়েদের থলোথলো নরম শরীর দেখতে ভাল, কিন্তু ওই শরীরে লেপ্টে থাকতে ইচ্ছে করে না। মনে হয়, আমি যেন কোনও শক্ত শরীরে সমর্পণ করি।

খুব ছোট ছিলাম যখন, দিদিমা-র রূপকথার গল্পে আশ্চর্য পুকুরের গল্প শুনতাম। ওই পুকুরে ঠিকমতো মন্ত্র পড়ে স্নান করলে কুরূপা-রা রূপসী হয়ে যায়। আমি স্বপ্নে কতদিন স্নান করেছি, স্নান করে পাল্টে গিয়েছি। আমার নুনুটা খসে গিয়েছে। বুকে গোল-গোল পেয়ারার মতো দু’টো ফল হয়েছে। আর পুকুরের পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকত রাজপুত্র। সে আমাকে ঘোড়ায় চড়িয়ে নিয়ে যেত। রাজপুরীর ভিতরে আমাকে সোনার পালঙ্কে শুইয়ে দিয়ে রত্নহার পরিয়ে দিত, আর খুব আদর করত। অত ছোটবেলায় কি কেউ সেক্স-টেক্স বোঝে? আমিও বুঝতাম না। তবু সেই স্বপ্নের আদর আমার খুব ভাল লাগত। তারপর পুরী থেকে বাড়ি ফিরে, সেই রূপকথার পুকুরের স্বপ্ন দেখেছি আরও বহুবার। পুকুরে ডুব দিতে গিয়ে ডুবে যাচ্ছি। আর আমাকে উদ্ধার করছে নুলিয়াপুরুষ। সেই নুলিয়াপুরুষ। আমি মেয়ে হয়ে গিয়েছি। নুলিয়াদের বস্তিতে গিয়ে আমি মাছ রান্না করছি। মশলা বাটছি। একটা বাচ্চা কাঁদছে, ওকে আমি মাই খাওয়াচ্ছি। আমি পা ছড়িয়ে বসে আছি বাইরে, আর নুলিয়াপুরুষটি আমার মাথার উকুন বেছে দিচ্ছে পিছনে বসে। ও আমার পিছনে, সমুদ্দুরের হাওয়ায় সমুদ্দুরের গন্ধ, তার মধ্যে মিশেছে শুকনো মাছের গন্ধ, তার মধ্যে ওই নুলিয়াপুরুষের ঘামের গন্ধ। সব কিছু মিলে জীবনের গন্ধ। জীবনটা বড় ছেনাল মাইরি, আমি প্যাঁচড়া জীবন ছ্যাঁচড়া জীবনের কথা বলছি না, জীবন ধাড়া, ধন ধরে দাঁড়া—সে জীবন নয়, আমি এই জন্ম-এক্কাদোক্কা-ভেলপুরি-ফুচকা জীবনের কথা বলছি, এই ধুরানি-মারানি-বিলুয়া-বাট্টু ইলাবিলা জীবনের কথা বলছি, ওয়ান প্লাস ওয়ান জীবন মানে ম্যাদামারা জীবন, প্লাস কলকলানো জীবন মিলে যা হয়, সেই জীবনের কথা বলছি, মানে বলতে চাইছি, ওই যে একটা গান আছে না, ওরে জীবন রে…তুই ছাইড়া গেলে আমি সোহাগ করমু কারে…। জীবনকে বলি আয়, আয়, আয়রে, পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে আয় রে চলে আয় আয় আয়—ডাকি আঙুলের ইশারায়। কিন্তু জীবন আসে না, লুকোচুরি খ্যালে। কখনও আসে, টুকি দিয়ে চলে যায়। টু-উ-উ-কি, টু-উ-উ-কি, মানে সে আছে, কোথাও আছে, আশেপাশেই আছে, ওকে খুঁজে বার করতে হবে। খুঁজতে গিয়েই তো ঝামেলা। ভূপেন হাজারিকা-র ওই গানটার কথা মনে পড়ে মাঝে-মাঝে, হাসি নিয়ে আয় রে বাঁশি নিয়ে আয়…জীবন খুঁজি আয়। কোথায় খুঁজব মাইরি? ল-সা-গু গসা-গু-র ভিতরে কি জীবন থাকে? সুদ কষার ভিতরে, ঐকিক নিয়মের মধ্যে কি জীবন থাকে? জীবনটা কি তৈলাক্ত বাঁশ? যেখানে মিনিটে সাত ইঞ্চি উঠলে পরের মিনিটে পাঁচ ইঞ্চি পড়ে যেতে হয়? কে জানে শালা যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের মানুষের সঙ্গে তার হয়নাকো দেখা…। জীবনানন্দের বই কিনে এনেছিলাম বলে মা খুব বকেছিল। বলেছিল, কেন এসব বই আনিস, এই পয়সা দিয়ে একের ভিতর তিন আনতে পারিস না? ব্যাকরণ, ভাব সম্প্রসারণ ও প্রবন্ধ রচনা। ইজি লেটার রাইটিং আনতে পারিস না। মা তো ওরকমই বলে। সব সময় মায়ের কথা শুনতে ভাল লাগে না। শুনিও না। মায়ের পয়সা চুরি করি। বেশ করি। জীবনানন্দ-র ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ কিনেছিলাম। কবিতাগুলো বুঝি না। কিন্তু কতগুলো কথা পড়ে কীরকম গা শিরশির করে। আরও এক বিপন্ন বিস্ময় আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করে’—এই লাইনটা পড়ে অনেকক্ষণ চুপ করে বসেছিলাম। পড়েছিলাম—

চোখে তার
যেন শত শতাব্দীর নীল অন্ধকার
স্তন তার
করুণ শঙ্খের মতো দুধে আর্দ্র
কবেকার শঙ্খিনীমালার;

নিজেকে কেন যেন শঙ্খিনীমালা মনে হয়েছিল। করুণ শঙ্খের মতো স্তন যদিও আমার নেই। যেটুকু আছে, সেটা ভিখিরির হাতের মতো করুণ। কিন্তু শঙ্খিনীমালা বা শঙ্খমালার চোখে তো গত শতাব্দীর নীল অন্ধকার। জীবন খুঁজতে গিয়ে খোঁড়ানো লোকের চোখের হতাশার অন্ধকার। নিজের কাছেও বাতেলার মতো লাগছে। এই বয়সে গত শতাব্দীর নীল অন্ধকার? সবে তো ষোলো বছর প্লাস। একটা কবিতা লিখেছিলাম :

নাকের নীচে গোঁফের চিহ্ন
জানিয়ে দিচ্ছে অপরাহু
কম্ম সারো তাড়াতাড়ি
বুকের মধ্যে সকালসন্ধে ঢাকের বাড়ি।

গোঁফ-দাড়ি ওঠা মানেই তো পুরো পুরুষ হয়ে গেলাম। ব্যাটাছেলে হয়ে গেলাম। আমি ব্যাটাছেলে। ব্যাটাছেলেদের যা-যা করা উচিত বলে মনে করে আমার মা, স্যরেরা, ব্যাটাছেলে- বন্ধুরা, তাই যদি না-করি—তা হলে আমি ভেড়ুয়া, আমি যাচ্ছেতাই। কিন্তু গোঁফ-দাড়ি ঠেকাব কী করে, ওটা তো হবেই। জীবনবিজ্ঞান বইয়ে পড়েছি পুরুষ-ময়ূরের পেখম হয়। পুরুষ- মুরগিদের ঝুঁটি হয়। আমারও গোঁফ হল নাকের তলায়। এখানে-ওখানে চুল গজাল, যেখানে আগে ছিল না। একদিন আয়নায় দেখলাম নিজেকে, সব খুলে, পুরোপুরি। আয়নায় যেন অন্য কেউ। আমি নই। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। ওই লোকটাকে বেশ ভাল লাগল আমার। শুধু নাকের তলায় গোঁফের চিহ্ন-ই নয়, পেটের তলাতেও। উঠছিল বুঝেছিলাম, জানি ওঠে, দেখেওছিলাম অন্য পুরুষের। কিন্তু আমারও?—না, আমি না, আমি না, আয়নার ওপাশে যে সে অন্য কেউ। পেটের তলায় ঝুলে পড়া অঙ্গটা ক্রমশ আকৃতি পাল্টাতে থাকল। রং-ও পাল্টাল। বেদনার গাঢ় রসে লাল হল, বেদানা নয়, বেদনা, বেদনা। অঙ্গটা উঁচিয়ে রইল আমার দিকে, আঙুল উঁচিয়ে যেমন অপরাধীকে দেখায় পুলিশ, সেরকম ভাবেই। আমি আয়নায় ওর মুখ চেপে ধরলাম, আড়াল করলাম, ও তখন অন্য কেউ। একটা পুরুষ। একটা লিকম্দার। আর আমি পরি। আমার ওকে খুব ভাল লাগতে লাগল। আমি ওর দিকে এগিয়ে গেলাম, জড়িয়ে ধরতে যাব, আয়নায় লেগে গেল। আমার সঙ্গে ওর লেগে গেল। তখন বুঝলাম। সত্য মিথ্যাবাস্তব-মায়া, কায়া-ছায়া কোথাও কেমন একাকার হয়ে যায়। আমি আমার জেগে যাওয়া লিঙ্গটাকে লুকোবার চেষ্টা করলাম। দুই উরুর খাঁজে ঢুকিয়ে দিলাম। এইতো, মেয়েদের মত ওইতো কৃষ্ণত্রিভুজ। ছিঃ, মা ঢুকেছে ঘরে। কেন যে ঘরের দরজাটা বন্ধ করিনি? তক্ষুনি আবার সোজা দাঁড়ালাম, তখনো ওটা উত্থিত।

ঘরে ঢুকে এই দৃশ্য দেখল মা। ঢুকেই বেরিয়ে গেল। আমি ধড়াচুড়ো পরে নিলাম। ব্যাটাছেলের পোশাক। সালোয়ার-কামিজ পরে তো আর রাস্তায় বেরতে পারি না। কিন্তু আয়নার ভিতরে যাকে দেখলাম—যে মায়া ব্যাটাছেলেটার জন্য আমার মধ্যে ঝুমঝুমি বাজানো, সেও কি আমি? ছিঃ!

মা কিন্তু কোনও রাগ দেখাল না সেদিন, মা বোধহয় আমার ব্যাটাছেলের লক্ষণ দেখে খুশি হয়েছিল মনে-মনে। ঘরের বাইরে থেকে বলেছিল, কী রে, হয়েছে? যেন আমি বাথরুমে আছি। মা ঘরে ঢুকেছিল, যেন একটু-একটু হাসি লেগেছিল মুখে, মেঘের শরীরে যেমন চাঁদের আলো লেগে থাকে চাঁদ-ভাসা রাতে, মায়ের মুখে যেন একটু-একটু লজ্জাও লেগেছিল। মিষ্টি লজ্জা। মা কি একটু আঁচল চাপা দিয়েছিল মুখে? আঁচল কী করে হবে? মা তো সেদিন সালোয়ার- কামিজ পরেছিল। হয়তো একটু ওড়না চাপা দিয়েছিল মুখে। ওড়নাকে আঁচলই বলতে ইচ্ছে করে আমার। বুকের কাপড় হাওয়ায় উড়াইয়া লইয়া যায়—কী সুন্দর যে গানটা। রবীন্দ্রনাথ কেন মুখের আঁচলখানি করলেন? ঝড়ে যায় উড়ে যায় গো আমার মুখের আঁচলখানি ধরা থাকে না হায় গো, তারে রাখতে নারি টানি/আমার রইল না লাজ লজ্জা/আমার ঘুচলো গো সাজ সজ্জা…। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, ওটা বুকের আঁচল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ লিখলেন মুখের আঁচল। শুনে মনে হয়েছিল ভুল গাইছে, বাড়িতে তো ‘গীতবিতান’ আছে, খুলে দেখেছিলাম ওটা মুখের আঁচল’-ই লেখা আছে। কে জানে, লিখতে গিয়ে কলমের মনে হয়েছিল কিনা মুখ বুকের চেয়ে ভাল…।

মায়ের ‘গীতবিতান’-টা এখন এমনি-এমনি। হারমোনিয়াম-টাও এমনি-এমনি। আগে মা গান গাইত। আমি মায়ের পাশে চুপটি করে বসে গান শুনতাম। আমি মায়ের গানের সঙ্গে নাকি তাল দিতাম। মা আমাকে সা রে গা মা শিখিয়েছিল। হারমোনিয়াম বাজানো শিখিয়েছিল। এখন হারমোনিয়ামের বেলোটা ফুটো। মা কেটে ফুটো করে দিয়েছে। আমি গান গাইতাম বলে, মানে, বেশি গাইতাম বলে, না কি গান ভালবাসি বলে মা বলেছিল, গান গাইতে হবে না মেয়েদের মতো। আমি বলেছিলাম হেমন্ত মুখার্জি, কিশোরকুমার—এঁরা কি সব মেয়ে? ভূপেন হাজারিকা কি মেয়ে? মা বলেছিল হেমন্ত-মান্না-কিশোরদের সঙ্গে তুই নিজের তুলনা করছিস? ওঁরা কি তোর মতো হাত ঘুরিয়ে কথা বলেন নাকি? আমি বলেছিলাম, বেশ করব গান গাইব, বলে হারমোনিয়ামটা বাজাতে শুরু করেছিলাম। মা বলেছিল, ও বাব্বা, মেয়েলিপনা করলে কী হবে, জেদ দেখাচ্ছে, জেদ, দেখাচ্ছি তোর গান করা, বলেই একটা বঁটি নিয়ে এল রান্নাঘর থেকে। ভাবলাম, বঁটিটা দিয়ে আমাকেই মারবে বোধহয়, মারো, মারো, এমনি করেই আমায় মারো। কিন্তু হারমনিয়ামের বেলো-টার ওপর কোপ বসিয়ে দিল। এখন হারমনিয়ামটার বেলো টিপলে দীর্ঘশ্বাসের মতো বাতাস বেরয়, শুয়ে-থাকা রুগ্ণ ভিখিরির মতো কীরকম কাতর শব্দ, অসহায় ফ্যাসফ্যাসে আর্তনাদ করে। হারমোনিয়ামের কোনও দোষ ছিল না তো, যত দোষ—সে তো আমার। আমার তো অনেক দোষ। আমি কেন ক্রিকেট খেলতে যাই না? পাড়ায় তো ক্রিকেট খেলা হয়। যেতাম, ছোটবেলায় তো যেতাম। যখন ফিল্ডিং করার সময়—আমার পায়ের ফাঁক দিয়ে বল গলে যেত, ওরা বলত তোর ক্রিকেট খেলা হবে না, রান্নাবাটি খ্যালো গে, যাও। বলত, এক্কাদোক্কা খ্যালো গে যাও। রান্নাবাটি কার সঙ্গে খেলব? আমার কি বোন আছে? মামাতো বোন আছে, মামার বাড়িতে তো যাই মাঝে-মাঝে, মামাতো বোন দু’টো রান্নাবাটি খ্যালে না, ওদের বাড়িতে একটা কাজের বউ আছে, ওর মেয়ের নাম ফুলি। ফুলি রান্নাবাটি খেলত, একা-একা। বালি দিয়ে ভাত করত, আমাকে দিত, বলত গরম, ফুঁ দিয়ে খাও। তাই করতাম। পেঁপের কালো-কালো বিচি দিয়ে ডালনা করে দিত। মিছিমিছি খেতাম। একদিন ফুলিকে বললাম, ফুলি, আজ আমি রান্না করি, তুই খা, কেমন? আমি ডাল বসালাম। গুঁড়ো মাটির ডাল। অদৃশ্য কাউকে বললাম—কী যে ডাল আনো, সেদ্ধ হয় না, একটু দেখেশুনে না আনলে কি হয়? ওপাশ থেকে অদৃশ্যকণ্ঠে শুনতে পেলাম, তুমি পারো না? তুমি আনো গে যাও…। সবই তো পারো। এরকম কত-কত কথা বলি। ইশ, লজ্জা করে না, স্নান করার সময় লুকিয়ে দেখছ?…স্নান করার সময় অদৃশ্য কাউকে বলি। তুমি রোজ-রোজ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকো কেন? স্কুলে যাওয়ার পথে অদৃশ্য কাউকে বলি, না, দরজা খুলব না—যাও…। অভিমান করে অদৃশ্য কাউকে বলি। সাবানকেও তো বলি, গলে যা, মিশে যা আমার সারা গায়ে…। আমার গায়ের গন্ধ হয়ে তুই মিশে যা, সাবান সোনা…। সাবান কী লিঙ্গ গো? ক্লীবলিঙ্গ? উ- হু…। পুংলিঙ্গ, পুংলিঙ্গ।

সেভেন-এইট’এ হিন্দি ছিল স্কুলে। হিন্দির লিঙ্গ-টিঙ্গগুলো ভারি ইয়ে…। দোয়াত পুংলিঙ্গ, কলম স্ত্রীলিঙ্গ। তালা স্ত্রীলিঙ্গ, চাবি পুংলিঙ্গ। যা কিছু গ্রহণ করে, সব স্ত্রীলিঙ্গ। বোতাম যদি পুংলিঙ্গ হয়, বোতামের ঘর স্ত্রীলিঙ্গ। পরিমল তো পুংলিঙ্গ। পরি কী লিঙ্গ তবে? পরি আর পরিমল নিয়েই তো আমি। আমি কী লিঙ্গ? আমাকে তো পাড়ার অনেকে কী সব বলে। হিজড়েও বলে। হিজড়েদের ভালকথায় ‘ক্লীব’ বলে। আমি কি ক্লীব লিঙ্গ? এসব কথা ব্যাকরণে থাকে না।

আমাকে কেউ ভালবাসে না। মা-ও না, বাবাও না। বাবাকে কতদিন দেখিনি। সেই লাস্ট দেখেছিলাম চার বছর আগে। আমার ব্রেন ম্যালেরিয়া হয়েছিল। বাবাকে দেখেছিলাম হাসপাতালে। কীরকম আবছায়ার মধ্যে, কীরকম যেন বরিক পাউডার মাখা কুয়াশার মধ্যে বাবার গলার স্বর শুনেছিলাম : এবার আমায় রেহাই দাও। বাবা বোধহয় মাকেই বলেছিল কথাটা। আমার শরীরে তখন নুনজল ঢুকছিল, নুনজল। আর দেখিনি বাবাকে। ছোট্টবেলায় বাবার ঘাড়ে চড়ে ঠাকুর দেখতে যেতাম। দুগ্গাঠাকুর। বাবা বেলুন কিনে দিত। বাবা আমায় মিলিটারি জামা কিনে দিয়েছিল আর একটু বড় হলে। একটা বন্দুকও দিয়েছিল। বন্দুক নয়, মেশিনগান। ওটা টিপলেই টরটর টরটর করে শব্দ হত, আর লাল রঙের আলো জ্বলত। বিল্টুর সঙ্গে ওটা আমি এক্সচেঞ্জ করে নিয়েছিলাম। বিল্টু আমাদের পাড়ার ছেলে। বিল্টুর মা ওর মায়ের সঙ্গে আমাদের বাড়ি আসত। বিল্টু একটা ডিম-পাড়া মুরগি নিয়ে এসেছিল। একটু চেপে দিলেই ডানা দু’টো উঠে যেত, আর একটা ডিম পেড়ে দিত। খুব মজার। আমি বিল্টুকে বলেছিলাম আমার বন্দুক তুই নে, আর তোর মুরগিটা আমায় দে। বিল্টু রাজি হয়েছিল।

বাবা খুব বকেছিল, মা-কেও। বলেছিল, বন্দুকটার কত দাম, আর মুরগিটা তো সস্তা। ওরা আমার ছেলেকে মুরগি করে চলে গেল, ছিঃ, বুদ্ধু, বোকা। শুধু ‘বোকা’ বলেনি, ওর সঙ্গে আরও দু’টো অক্ষর। বাবা খুব মুখখিস্তি করত। মা-কে। আমাকেও। তখন তো খিস্তিগুলোর মানে বুঝতাম না; আর কোন কথাটা খিস্তি নয়, কোন কথাটা খিস্তি—সেটাও বুঝতাম না। মা যখন বাবাকে ‘মাতাল’ বলত, বুঝতাম ওটা খারাপ কথা। কিন্তু গানের মধ্যে যখন থাকে ‘বসন্তের এই মাতাল সমীরণে’, তখন তো ‘মাতাল’ শব্দটাকে খিস্তি মনে হয় না। বাবা বলত মা-কে, আমি আর পারব না, যাও মারিয়ে রোজগার করোগে। মা তখন বলতো ঘেন্না করে তোমায়। অথচ শুকনো পাতা মাড়িয়ে যাওয়া কী সুন্দর লাগে। ও, মাড়ানো তো ড-য় শূন্য ড়। হ্যাঁ, মারানো মানে আমি পরে বুঝেছি। মা-বাবার মধ্যে ঝগড়া হত খুব। মা বলত, তাই বলে তুমি ঘরের বউ ছেড়ে অন্য মেয়েছেলের সঙ্গে যা-তা করবে? বাবা বলত, বেশ করব। শীত লাগলে কেউ বরফ ঘষে না গায়ে, আগুনের পাশে যায়। মা বলত, ওই আগুন তোমাকে পুড়িয়ে বেগুনপোড়া করে দিয়েছে, বেগুনপোড়া কোথাকার…। তার মানে ‘বেগুনপোড়া’ একটা খিস্তি। বাবা বলেছিল, ঠিক আছে, ঠিক আছে, জানা আছে সব…বুড়োমারানি কোথাকার। ‘বুড়োমারানি’ তার মানে একটা খিস্তি। মা বলেছিল—আমি তোমাকে সব কথা বলেছিলাম, সব উজাড় করে বলেছিলাম বলে, বিশ্বাস করেছিলাম বলে—একথা বলতে পারছ। তুমি সেই বিশ্বাসের মর্যাদা রাখোনি। তুমি নিজে গোপন কারবার চালিয়ে গিয়েছ। বাবা তখন খিস্তি দিয়েছিল। আমি অনেক খিস্তি জানি এখন, মাঝে-মাঝে বলি, না-বললে আমার এখনকার বন্ধুরা রাগ করে। কিন্তু ছোটবেলায় খিস্তিগুলো তো বাবার কাছ থেকেই শিখেছি। মদের গন্ধটা, সেটাও তো বাবার কাছেই। এইভাবেই ষোলো বছর বয়স হয়ে গেল আমার। বাপ নেই, মা আছে হাফ। স্কুলে প্যাঁক, কোনও ঝিনচ্যাক নেই কোথাও, তবুও শালা মশাগুলো সঙ্ঘারামে জেগে থাকে জীবনের স্রোত ভালবেসে। সঙ্ঘারাম ব্যাপারটা কী? ইতিহাসে কোথাও যেন কথাটা ছিল। যে কোনও সময়ে মশাকে কেউ চেপ্টে মেরে দিতে পারে, তবু মশা জেগে থাকে। আমিও মশার মতো

পরীক্ষাটা তো দিতে হবে। পরীক্ষা এসে গেল। পাসটা করে যাব ঠিকই, ফেল করা খুব শক্ত। সায়েন্স নিয়ে হার্গিস পড়ব না। মা এখন আর কিছু বলবে না। হাল ছেড়ে দিয়েছে।

আমায় নিয়ে মায়ের বড় জ্বালা। কতবার ভেবেছি বাবলু-পিন্টুদের মতো, শেখর- অরিন্দমদের মতো হব। মায়ের ইচ্ছে আর আমার ইচ্ছে মেলাতে পারি না। জ্যোতিষীর কাছে নিয়ে গিয়েছে মা, সাইকোলজিস্ট-এর কাছেও। মামাতো ভাইরাও কত কী বলেছে। একটা বাজে বই পড়তে দিয়েছিল শেখরদা। জিম-এ নিয়ে গিয়েছিল। বডি বিল্ডিং দেখাচ্ছিল, বলেছিল তুইও এরকম কর। ব্যাটাছেলে হ। ফোর প্যাক, সিক্স প্যাক…। ওদের দেখে আমার ভাল লেগেছিল। কিন্তু ওই সব ফোর প্যাক, সিক্স প্যাকের চেয়ে আমার শরীরে দু’টো আপেল কামনা করেছিলাম আমি। জিমে-দেখা ছেলেদের নিয়ে একটা পদ্যও লিখেছিলাম। ভাল হয়নি জানি, ‘প্রবর্তক’-এ পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। ওরা ওরকমই চায়। ওরা ছেপেছিল। বইটা লুকিয়ে রেখেছিলাম। মা একদিন দেখেছিল, পাতাগুলো ছিঁড়ে ফেলেছিল। আবার আর একটা পাঠিয়েছিলাম, সেদিন ছাপা হল। কবিতাটার নাম ‘ইচ্ছে’। ওটা পদ্য নয়, কবিতা। পদ্য আর কবিতার তফাত কী জিগ্যেস করলে কিন্তু গুছিয়ে বলতে পারব না আমি।

লিখেছিলাম—

এখন যদিও পচা ভাদর
জড়িয়েছি তবু কালচে চাদর
আড়াল করেছি, আড়াল করেছি ইচ্ছে
অসহায় তাপে ঘামছি যদিও
শুকিয়ে যাচ্ছে বহতা নদীও
প্রাণটা তবুও প্রাণের আরাম নিচ্ছে…।

আরও ছ’লাইন আছে। অরূপ বলেছিল, ভাল হয়েছে, খুব ভাল হয়েছে।

অরূপকে এখন আর অরূপদা বলি না। ওকে নাম ধরে ডাকি। ও আমাকে ‘তুই’ ডাকে, আমি ওকে ‘তুমি’। ও আমাকে আদর করে, আমিও ওকে চুমি। আমি লিখেছিলাম ‘অরূপ দাদা অরূপ দাদা তোমার বাড়ি যাব, অরূপ দাদা অরূপ দাদা তোমায় চুমু খাব’, যেন একটা সারপ্রাইজ, খামে ভরে দিয়েছিলাম। লাস্টে লিখেছিলাম, কেমন হবে আমিও যদি খারাপ ছেলে হই? কিন্তু কয়েকবার ভেবে ‘ছেলে’ কেটে মেয়ে-ই করে দিলাম। অরূপদা বলেছিল, হেব্বি হয়েছে, আমাকে একটা ভাল জিনিস কিনে দিয়েছিল। লোম তোলার লোশন। অরূপদা-ই তো আমাকে ‘প্রবর্তক’ পত্রিকা এনে দিল। ওখানে লেখা পাঠালাম, ছাপা হয়ে গেল। অরূপদা বলেছে আবার পাঠিয়ে দে। ওটা তো সমকামীদের কাগজ। আমিও তাই, তাই ওরা সব ওই ধরনের লেখাই ছাপে। আমি কেন ওখানেই লেখা পাঠাব শুধু? আর ওই লেখাই বা লিখতে যাব কেন শুধু? সবরকম লিখব। আমার মায়ের কষ্টের কথা লিখব। আমায় নিয়েই মায়ের কষ্টটা যদিও বেশি—সেটাই লিখব। আকাশ ভরা সূর্য তারার কথা, উল্টো হয়ে পড়ে থাকা শিউলি ফুলের ব্যথা, শানবাঁধানো ফুটপাথের কাঠখোট্টা গাছ কচিপাতায় পাঁজর ফাটিয়ে হাসে—বাসগুলো সব গাড়লের মতো কাশে—সবই তো লিখতে মন চায়। শুকনো ঘাস, ভিজিয়ে দিচ্ছে আষাঢ় মাস; এক মা-পাখি, ঘর বাঁধার খড় খোঁজে একাকী; একটা লোক, চেটেপুটে খায় সকল শোক; রাস্তার জমা জলে, কবিতা থাকে কৌতূহলে। লিখব। লিখব ওগো অরূপ সোনার ছেলে, কবিতা লিখব তোমায় পেলে…।

১৪

ওদের লজ্জাই করছিল গঙ্গার ধারে এভাবে হাঁটতে। একটা নৌকোওলা চোখ মেরে ডাকল ‘আইয়ে-আইয়ে’। অন্য একটা লোক অনিকেতের কানের কাছে ফিসফিস করে বলল- ‘নৌকো নিন না, পরদা ফেলা যায়…।’ অনিকেত বুঝতে পারছিল না ওরা কী করে বুঝতে পারছে মঞ্জু পরস্ত্রী। নিজের বউ সঙ্গে করে যারা একটু হাওয়া খেতে আসে, ওদের নিশ্চয়ই এরকম ফিসফিস করে কেউ বলে না—পরদা ফেলা যায়…। তা হলে? ওদের কি কোনও অতিরিক্ত ইন্দ্রিয় আছে? না কি এই বয়সের দম্পতিরা এখন আর গঙ্গার ধারে আসে না, এলে বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে আসে, কিংবা দল বেঁধে। ফুচকা খায়, আইসক্রিম খায়, ভেলপুরি খায় সূর্যাস্ত দ্যাখে। এখন শীতকাল। অনেক গাছের পাতা ঝরে গিয়েছে। গঙ্গার জল লাল, কারণ সূর্য নেমে এসেছে ওপারের চিমনি-টিমনিগুলোর কাছে। মিহি কুয়াশার আস্তরণ পড়েছে জলের ওপর। শরীর খুব খারাপ, পাতলা হাগচি…। আমারও খুব অম্বল’…কারা বলছে? খড় বেরিয়ে যাওয়া দু’টো শেতলা মূর্তির পাশে দাঁড়ানো তিনটি নারী সুখ-দুঃখের কথা বলছে। তিন দেবীয়া। ওরা ভাড়া খাটে। এখান থেকে ওদের তোলা যায়। তুলে, নৌকোয় নিয়ে যাওয়া যায়। মঞ্জুকে কি ওরা এরকম ভাবল নাকি? হঠাৎ দাঁড়িয়ে যায় অনিকেত। মঞ্জুর মুখের দিকে তাকায়।

মঞ্জু হালকা মতো হেসেই, হাসিটা ফিরিয়ে নেয়। বলে, কী দেখছিস ডাবুদা?

অনিকেত কি বলতে পারে ও দেখছিল—মঞ্জুকে বাজারের মেয়েদের মতো দেখায় কি না। বলা যায়?

অনিকেত বলছিল…তোকে…।

আ-হ্-হা…। মঞ্জু বলল। ‘আ’ বলার মধ্যে কিছুটা আহ্লাদ মিশল।

এরকম হয় না। মঞ্জুকে যেটুকু দেখেছে অনিকেত, উচ্ছ্বাসহীন, ছায়া-লেপ্টে-থাকা অন্ধকার একটা মুখ। মুখের মধ্যে কোনও জোয়ার-ভাঁটা খেলে না, শুধু শীত। বসন্ত নেই।

মঞ্জু অনিকেতের হাতে ছোট্ট একটা চিমটি কেটে বলল : ঢ-অ-ং।

একটা হাসির হুল্লোড় শুনল। ওই তিন নারীর নিশ্চয়ই। নিশ্চয়ই ওদের দেখে নয়, অন্য কারণ।

মঞ্জু বলল, ঝালমুড়ি খাওয়াবি, ঝালমুড়ি?

ঝালমুড়ি আবার খাওয়ানো কী? এ তো ছোটবেলার কথা। আলুকাবলি খাওয়া, ঘুগনি খাওয়া না মাইরি…। এখন কেউ কাউকে ‘খাওয়ানো’ বলতে স্কচ, বিয়ার, বড়জোর বিরিয়ানি খাওয়ানোর জন্য অনুরোধ করতে পারে। চা-রোল-ঘুগনি ইত্যাদির ক্ষেত্রে বলা হয়—চল একটু চা খাই, বা ঘুগনি খাই। কে খাওয়াবে, মানে কে পয়সা দেবে ওটা ধর্তব্যের মধ্যেই আসে না। ঝালমুড়িওলা টিনের কৌটোয় মুড়ির সঙ্গে বাদাম, পিঁয়াজ, মশলাপাতি মিশিয়ে জিগ্যেস করল, লংকা?

—মঞ্জু বলল, দাও, বেশি করে। শশা দিও না।

ঝালমুড়িওলা টিনের কৌটোয় চামচ দিয়ে মুড়ির সঙ্গে মশলাপাতি জড়িয়ে নিচ্ছিল, ঠনঠনাঠন শব্দে বেজে উঠছিল পুরনো দিন, ছেলেবেলা। নাগরদোলা, নস্কর মাঠের মেলা, চোর-চোর খেলা, ওরা ঝালমুড়ি খেতে-খেতে হাঁটছিল। মঞ্জুর মুখে লালচে আভা। সূর্যাস্তের রং, না কি লংকার কারণে? অনিকেত বলল—চ’ কোথাও বসি।

ঠিকঠাক বসার জায়গা পাচ্ছিল না। কংক্রিটের বেঞ্চিগুলোয় কমবয়সি ছেলেমেয়েরা জড়াজড়ি করে বসে আছে। এক জায়গায় দেখল একজোড়া বুড়োবুড়ি বসে আছে। ওরা চাদরে-মাফলারে জড়ানো। পাশে কিছুটা জায়গা আছে। ওখানেই ওরা বসে পড়ল। ওরাও তো প্রৌঢ়-প্রৌঢ়া। অনিকেত তেতাল্লিশ, মঞ্জু চল্লিশ-একচল্লিশ মতো হবেই। শাস্ত্রবচন অনুসারে, ষোলো থেকে তিরিশ পর্যন্ত মেয়েরা তরুণী। তিরিশ থেকে পঞ্চাশ প্রৌঢ়া। অনিকেত কি তেতাল্লিশেই প্রৌঢ়? কোনও বাস ওকে ধাক্কা দিলে কি লেখা হবে, পথ দুর্ঘটনায় প্রৌঢ়ের মৃত্যু?

ভদ্রমহিলা খবরের কাগজ পড়ে ভদ্রলোককে শোনাচ্ছেন। ভদ্রলোকটির চোখে মোটা কাচের চশমা। ভদ্রমহিলা বললেন, ডায়না বলেছে—একসঙ্গে থাকা অসম্ভব। ডিভোর্সের জন্য অ্যাপ্লাই করেছে। বুঝলে? ভদ্রলোক কানের ছিপিটা চেপে ধরে বললেন, আবার বলো। ভদ্রমহিলা আবার বললেন একই কথা। ভদ্রলোক হাসলেন। বললেন, আমাদের ক’বছর হল গো। তিপ্পান্ন। তিপ্পান্ন বছর একসঙ্গে…।

ভদ্রমহিলা মাফলারটা জড়িয়ে দিলেন ভদ্রলোকের গলায়। খবরকাগজ দেখে বললেন- বৃহস্পতি গ্রহের চারদিকে ঘুরছে গ্যালিলিও। গ্যালিলিও কী গো?

—গ্যালিলিও জানো না। একজন সে-যুগের সাইনটিস্ট। বলেছিলেন সূর্য স্থির, পৃথিবীই পাক খাচ্ছে।

—তো গ্যালিলিও কী করে ঘুরবে?

—ওটা বোধহয় স্যাটেলাইট। নাম রেখেছে ‘গ্যালিলিও’। ভদ্রমহিলা খবর কাগজ থেকে এবার পড়লেন—দিল্লিতে সমকামীদের মিছিলে লাঠিচার্জ। আহত কুড়ি।

ভদ্রলোক বললেন—বেশ হয়েছে।

ভদ্রমহিলা বললেন—সমকামী কী গো?

ভদ্রলোক বললেন—ওরা বাজে লোক।

মঞ্জু অনিকেতকে বলল, চল উঠি। অনিকেতের সম্মতির অপেক্ষা না-করেই উঠে দাঁড়াল এগিয়ে চলল। মঞ্জুর পিছন-পিছন অনিকেতও। মঞ্জু কীরকম থপথপ পায়ে হাঁটছে। চটিতে অভিমান।

অনিকেত একটু এগিয়ে গিয়ে মঞ্জুর কাঁধে হাত দেয়, বলে, কী হচ্ছে মঞ্জু, দাঁড়া…। মঞ্জু দাঁড়ায়, দাঁড়িয়ে অনিকেতের হাত চেপে ধরে। তক্ষুনি একটা লোক অনিকেতের কাছে ফিসফিসায়—লৌকা লিবেন স্যর…। অনিকেত হাত ছেড়ে দেয়। তিন দেবীয়াঁ হেসে ওঠে। স্টিমার ভোঁ মারে।

মঞ্জু বলল, চ’ গঙ্গার ধার ছেড়ে চলে যাই। অনিকেত বলল, গঙ্গা কী দোষ করল? মঞ্জু বলল, বাজে জায়গা। একটা গাছে এঁটে রয়েছে, ‘গঙ্গা দূষণ রোধ করুন’। অনিকেত বলল, কোথায় যাবি তা হলে? মঞ্জু বলল, জানি না। অনিকেত বলল, সব জায়গাই এরকম। এখানে তবু একটা খোলা পরিবেশ আছে। মঞ্জু বলল, কোথায় খোলা? অনিকেত গঙ্গার বিশাল বিস্তার, আর আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখতে চাইল কোথায় খোলা?

অনিকেত অনেকদিন পর আজ গঙ্গার ধারে এল। বহুদিন পর। হাওড়া স্টেশন থেকে গঙ্গা পারাপার-কে গঙ্গায় আসা বলে না। চুল্লিতে বাবার দেহ ঢুকিয়ে দিয়ে উদ্‌ভ্রান্তভাবে গঙ্গার ধারে ঘোরাটাকেও বলে না। শেষ কবে বেড়াতে এসেছিল? কোনও এক ধর্মঘটের দিন। শত ধর্মঘট হলেও, রেডিও খোলা থাকে। আগের দিন রাতে থাকতে হয়। পরদিন সারাদিন ডিউটি। অনেকেই থাকে। বেশ হইহল্লা হয়। অনিকেত স্ট্রাইক-ডিউটি নিত শুধু মজার জন্য। মেয়েদের ওই ডিউটি করতে হত না। ছন্দা সেন-রা বলত, তোদের কী মজা রে, আমাদের দেয় না কেন মাইরি? আইভি একদিন গিয়ে স্টেশন ডিরেক্টরের সঙ্গে দেখা করে বলেছিল, আমরা কি বানের জলে ভেসে এসেছি না কি স্যর? আমরা কেন স্ট্রাইক ডিউটি করতে পারব না? স্টেশন ডিরেক্টর বোধহয় একটু ভ্যাবাচাকা খেয়ে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, হোয়াট? হোয়াট? আইভি বোঝানোর চেষ্টা করছিল, স্ট্রাইক ডিউটি করার মজা থেকে মেয়েরা কেন বঞ্চিত হবে? এসডি নিরাপত্তার প্রশ্ন তুলেছিলেন। আইভি বলেছিল—আরে স্যর, আমার সিকিউরিটি আমি পুষি। আমায় কে কী করবে? (বলতে চেয়েছিল—কোন শালা কী করবে, আমি কি এমনি এমনি বড় হয়েছি নাকি, মায়ের দুধ খেয়েছি স্যর) বেশি এগোলে মুশকিল (এইসা দেব না…); তা ছাড়া স্যর, মেয়েদের সিকিউরিটি-র প্রশ্ন তুলে আমাদের পুরুষ-কলিগদের অপমান করছেন— যেন স্যর ওরা সবসময় রেপ করার ফন্দিফিকির খোঁজে, এটা খুব বাজে অ্যাটিটিউড স্যর…। এস ডি নাকি বলেছিলেন, লেডিজ আর নট অ্যালাউড টু’…আইভি বলে উঠেছিল, ‘আমি তো লেডি নাও হতে পারি স্যর … ‘

বড় অফিসার এবার আরও বেশি রিখটার স্কেলে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আইভি-র মুখের দিকে…মুখ নয়, বুকের দিকে ক্লিনিকাল দৃষ্টি দিয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছিলেন—তখন আইভি আবার বলেছিল–ঠিক আছে, আমি লেডি, কিন্তু ‘লেডিজ আর নট অ্যালাউড টু স্টে অ্যাট নাইট’ বললেই হল? পুরনো লোকদের কাছে শুনেছি সুপ্রীতি ঘোষ, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায় আরও অনেকেই ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ লাইভ করার যুগে রাত্তিরে এসে থাকতেন, ভোরবেলা গঙ্গাস্নান করে, গরদ পরে মহালয়ার ভোরে গান গাইতে বসতেন….

শেষ অবধি পারমিশন আদায় করেছিল আইভি, তবে সঙ্গে আরও একটি মেয়েকে জোটাতে হয়েছিল। অর্চনা সেন, ক্যাজুয়াল নিউজ রিডার।

অনেকে মিলে গঙ্গার ধারে বেড়াতে এসেছিল ওরা। চাক্কা বন্ধ হলেও জলের প্রবাহ বন্ধ থাকে না। বয়েই চলে। হাওয়াদেরও বন্ধ নেই। বয়েই চলে। সেদিন অনিকেতের ঠোটের থেকে সিগারেট কেড়ে নিয়ে টেনেছিল আইভি। একটু-একটু কেশেছিল। গঙ্গার ধারে দাঁড়ানো একটা নৌকো থেকে কয়েকটা কিশোর জলে লাফ দিয়ে পড়ছিল। আইভি হাততালি দিয়ে বলছিল, ভেরি গুড, ভেরি গুড। আইভি বলছিল, হাফপ্যান্ট আছে কারও কাছে, হাফপ্যান্ট?

হাফপ্যান্ট কী হবে?

—একটু নেমে পড়তাম মাইরি। জামা-টামা খুলে। আজ স্ট্রাইক বলে ভিড় নেই, ঝামেলা হত না।

হাফপ্যান্ট কারও কাছে ছিল না। থাকার কথাও নয়। আর থাকলেও কি সত্যি-সত্যি হাফপ্যান্ট পরে জামা খুলে জলে ঝাঁপ দিত না কি? ওগুলো উইশফুল থিংকিং। আইভি সেদিন গঙ্গায় ঝাঁপ দিতে পারেনি বটে, কিন্তু ব্যালেন্স-এর খেলা দেখিয়েছিল। চক্ররেলের লাইনের ওপর দিয়ে হেঁটেছিল। চেঁচিয়ে বলেছিল—এই যে ব্যাটাছেলেগুলো—হাঁটো দেখি, এরকম লাইনের ওপর দিয়ে আমার মতো…। কোনও ব্যাটাছেলে লাইনের ওপর ব্যালেন্সের খেলা দেখানোর জন্য এগিয়ে যায়নি সেদিন, বরং একবার যখন আইভি পড়ে গেল, ব্যাটাছেলেগুলো হাততালি দিয়ে উঠেছিল। সেই দলে অনিকেতও ছিল।

হাততালির শব্দ শুনল অনিকেত। এই তালির শব্দ অন্যরকম। ঘাড় ফিরিয়ে দেখল, কয়েকজন হিজড়ে। কোমর বেঁকিয়ে হেলতে-দুলতে হাঁটছে। একটা ফুচকাওলাকে ঘিরে ধরল ওরা। একজন হাতের পাতায় কিছুটা নাচের মুদ্রা করে বলল—’অ্যাই ফুচকাওলা, ভাল ফুচকা আছে?’

একজন বলল, ডাঁশা হবে তো?

একজন বলল, তোমার ফুচকাগুলো বড্ড ছোট। নারকোল কুলের সাইজ। পেয়ারা সাইজের ফুচকা করতে পারো না?

অন্য একজন বলল, পেয়ারা সাইজ খাবে, তোর মুখের গর্তে ঢুকবে। অন্য একজন বলল দাও, বেশি করে ঝালটাল দিয়ে দাও। আমাদের আশালতা আবার পোয়াতি হয়েছে। তখন খিকখিক করে যে হেসে উঠল, সে-ই বোধহয় আশালতা। বলে উঠল, ঠিক বলেচিস লো… পাঁচ মাস চলছে কিনা….মুকে বড্ড অরুচি।

আবার খিলখিল। হাসির শব্দ, জলস্রোতে। অনিকেত বোঝে, ওদের উইশফুল থিংকিং। ওই হাসির শব্দের মধ্যেই মঞ্জু আবার বলে, উঃ, চল, জায়গাটা ছেড়ে চল এক্ষুনি। কোথাও একটু ভাল জায়গা নেই কলকাতা শহরে…। ওরা সামনের দিকে এগিয়ে চলে। চক্ররেলের ইডেন গার্ডেন স্টেশন। রেলের মাইকে ঘোষণা শোনে, দমদম যাওয়ার চক্ররেল আসছে। অনিকেত বলে, কোনওদিন সারকুলার ট্রেনে চড়েছিস? মঞ্জু মাথা নাড়ায়। বলে চল, উঠি। বাগবাজারে নেমে যাব, ওখান থেকে তুই এন্টালি চলে যাবি। গঙ্গার ধার দিয়ে ট্রেনটা যায়। খুব ভাল জার্নি

মঞ্জু আজ ফোন করেই এসেছিল। বলেছিল, একটু সময় দিবি। খুব দরকার আছে। দরকারি কথাটা এখনও বলা হয়ে ওঠেনি। মঞ্জুর মালিকের মা মারা গিয়েছেন বলে আজ ওদের অফিস বন্ধ। অফিস কি বলা যায়? দু’টো মাত্র ঘর। সামনের ঘরে তিনজন, পিছনের ঘরে মালিক, মালিকের মেয়ে। মালিকের নাম বলরাম চ্যাটার্জি, কোম্পানির নাম চ্যাটার্জি স্পেশাল। এটা একটা ভ্রমণ সংস্থা। কনডাকটেড ট্যুর করায়। মঞ্জু বলেছে, মঞ্জুর বসার সিটের পিছনে একটা বিরাট বড় ভারতবর্ষের ম্যাপ আছে। মঞ্জু হলুদ গোলাপি সবুজ প্রদেশগুলোর ভিতরে মনে-মনে ঘুরে বেড়ায়। ও আঙুল দিয়ে জব্বলপুর খাজুরাহো অজন্তা ইলোরা কোনারক দেখিয়ে দিতে পারে, কিন্তু ওসব জায়গায় কোনও দিন যায়নি। বাগবাজারে নামল। অন্নপূর্ণার ঘাট। মা সারদা একসময় এই ঘাটে স্নান করতে আসতেন। গিরিশ ঘোষ হয়তো এই ঘাট থেকে ইলিশ মাছ দড়ি ঝুলিয়ে নিয়ে যেতেন। গিরিশ ঘোষের বাড়িতে ইশি মাছ রান্না হলে হয়তো নিবেদিতার বাড়িতে সেই গন্ধ যেত। এখানেই হয়তো পক্ষীর দলের গাঁজার আসর বসত কোনও একসময়। গোকুল মিত্তির কি হাতে ছড়ি নিয়ে সান্ধ্যভ্রমণ করতেন, পাত্রমিত্র নিয়ে? এখানে গঙ্গাটা বেশ চওড়া। একটা বাঁক নিয়েছে। বাঁকের ধারে বাজার বসত, বাঁক-বাজার থেকেই হয়তো বাগবাজার। জায়গাটা অনিকেতের চেনা। ওর পিসির বাড়ি তো এখানেই ছিল। ছোটবেলায় এসেছে কত। ফেরিঘাটের পাশে কতগুলো কংক্রিটের চেয়ার। ওখানে বৃদ্ধরা বসে আছে। বৃদ্ধা তেমন নেই। কাছেই একটা মন্দির। মন্দিরের ভিতরে অনেকে বসে আছে। ওখানে অনেক বৃদ্ধা আছে। কীর্তন হচ্ছে। একটা চোঙার মুখ বাইরের দিকে। বিরহে ব্যাকুল রাধা খাওয়া-দাওয়া ত্যাগ করেছেন। নিদ্রা নেই, চোখের তলায় কালি পড়েছে—এইসব বলছেন কথক। কথক বলছেন—রাতে ঘুম হচ্ছে না আমাদের রাধারানির। মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছেন। হয়তো প্রেশার কমে গিয়েছে, লো-প্রেশার হয়ে গিয়েছে। কেবল কৃষ্ণনাম করে যাচ্ছেন। বলছেন—বুঝি না কেমনে বা হয়ে যায় ভোর, এ ভরা বাদর মাহ ভাদর, শূন্য মন্দির মোর…। গাইছেন, খোল- করতাল মৃদঙ্গ-পাখোয়াজ বেজে উঠছে। একটা বেঞ্চি পাওয়া গেল। পাশে দুই বৃদ্ধ।

—রাত্তিরে ক’বার ওঠো?

—দু-তিনবার। কোনও দিন চারবারও। শীতকালে বড় কষ্ট।

—আমার দু’বার উঠলেই চলে। তোমার অ্যাটাচ্‌ড বাথরুম?

—না ভাই ঘোষাল। ছেলে-ছেলেবউ অ্যাটাচ্‌ড বাথের ঘরে থাকে।

—আমাদের তো পুরনো আমলের বাড়ি। অ্যাটাচ্‌ড বাথের গপ্পো নেই। ছেলেদের ফ্ল্যাটে অবিশ্যি ওসব আছে, তা থাক। আমি একটা গামলায় সেরে ফেলি। তুমিও তাই করো।

—ভালই বলেছ। কত টাইম লাগে তোমার ঘোষাল?

—একদম ফোর্স নেই। কখনও ফোঁটা-ফোঁটা করে পড়ে।

—বুজিচি। প্রস্টেট-টা দেখাও, বুঝলে….

—দেখিয়েছি তো। আলট্রাসোনোগ্রাফি করাতে হল। বলছে তো অপারেশনটা করিয়ে নাও। -হোমিওপ্যাথি করিয়েচো? আমি তো হোমিওপ্যাথি করচি। বরদা বড়ুয়া। ফড়েপুকুরে বসে। বুঝলে ভাই, পুরুষ মানুষের প্রস্টেটটা খুব জটিল যন্তর…।

এইসব কথাবার্তার মধ্যে মঞ্জু আর অনিকেত। অনিকেত বলল, এবার তোর দরকারি কথাটা বলে ফ্যাল।

—আচ্ছা, আমার ছেলেটারও কি বড় হলে প্রস্টেটের সমস্যা হবে?

—যাবাব্বা, এই প্রশ্নটা করার জন্য এত দূর এলি?

—না, ওরা বলছিল তো, তাই মনে এল। আমার ছেলেটাও তো ব্যাটাছেলে, আর প্রস্টেটটা তো ব্যাটাছেলেদেরই থাকে….

মঞ্জু খুব আস্তে করে বলে, অনিকেতের কানের কাছে মুখ নিয়ে। অনিকেত ওর কানে গরম বাতাসের স্পর্শ পায়, দুশ্চিন্তা-মাখা।

—তোর ছেলের যদি ব্যাটাছেলেদের অসুখ হয়, তুই খুশি হবি? রেপ করা তো ব্যাটাছেলেদেরই অসুখ। অবশ্য মেয়েরাও করতে পারে, পুরুষের অসম্মতিতে; জোর করে,

কিন্তু আইনে ওটা রেপ নয়। ছেলেরাই আইনত রেপ করে। যদি তোর ছেলে…

—ধুর। আমার ছেলের সে মু – নেই। বলতে গেলে, ওই তো রেড হয়।

—মানে? কী বলতে চাস তুই মঞ্জু?

মঞ্জু বলে, ওর জাঙ্গিয়ায় আমি রক্তের দাগ দেখেছি। জাঙ্গিয়াটার পিছন দিকে। কেঁদে ফ্যালে মঞ্জু। আঁচল দিয়ে জল মোছে।

অনিকেত বলে, ওকে কি কেউ জোর করে?

মাথা নাড়ে মঞ্জু।

—নিজের ইচ্ছেয়?

মঞ্জু স্থির।

—তা হলে রেপ বলছিস কেন?

–না হোক রেপ। কিন্তু এটা কি ঠিক করছে? তুই বল, এটা কি ঠিক করছে ও?

এবার অনিকেত স্থির। মাথা কোনও দিকেই নাড়াতে পারে না।

কয়েক মুহূর্ত পর অনিকেত বলে—যদি তোর ছেলে না-হয়ে ও তোর মেয়ে-সন্তান হত, তখন যদি ও কোনও ছেলেকে বাড়িতে ডেকে আনত, তা হলে কী করতিস?

—কী আবার করতাম? স্বাভাবিক, বয়েস হলে তো…

–এরপর যদি তোর মেয়ের প্যান্টিতে কিছু চিহ্ন দেখতিস ….

—হ্যাঁ, বলতাম সাবধান হতে…।

—তা তোর ছেলেকে সেটাই বল…।

—কী আশ্চর্য রে বাবা, একটা জলজ্যান্ত ব্যাটাছেলে, ওকে কেউ ক্ষত-বিক্ষত করে দিয়ে যাবে, আর আমি বলব সাবধানে কর…। তোকেও বুঝতে পারছি না ডাবুদা, তুইও কি ‘হোমো’ হয়ে গিয়েছিস? আগে তো ছিলিস না। ‘হোমো’ হলে সেই ছোটবেলায় আমাকে ওই অ্যাপ্রোচটা করতিস না।

—যা বাব্বা। তোর এসব মনে হচ্ছে কেন? আমি কেন ওসব হতে যাব। মঞ্জুর হাত ধরল। বলেই মনে হল, ও যেন রক্ষণাত্মক খেলছে। প্রমাণ করতে চাইছে ও ‘হোমো’ নয়।

—তা হলে ‘হোমো’-দের হয়ে সাফাই গাইছিস কেন?

—সাফাই গাইছি না তো, …বলেই অনিকেত ভাষ্য-পরিবর্তন করল। বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, সাফাই গাইছি। হলদে গোলাপও তো গোলাপ। তোর পরি-র সবই ঠিক, শুধু সেক্সুয়াল চয়েস- এর ব্যাপারে একটু আলাদা, তাতে…

মঞ্জু অনিকেতের কথাটা থামিয়ে দিয়ে বলে, পরি নয়, পরি নয়, পরিমল।

—ও ঠিক আছে। অনিকেত ব্যাপারটা লঘু করার চেষ্টা করে।

পাশে বসা একজন বৃদ্ধ বলল, এবার ওঠা যাক ঘোষাল। ঠান্ডা লাগছে বড়। আজকালকার উলে তেমন গরম হয় না।

—এই শীতের মধ্যে ওরা কেমন দিব্বি খালি গায়ে ঘুরে বেড়ায় দেখেচ?

—ওরা মানে কারা?

—ওই নাচের মেয়েগুলো…টিভিতে…

—ওটা দ্যাখো না কি?

–ছেলে আমার ঘরে একটা ঢুকিয়ে দিয়ে গিয়েচে। নাড়াতে নাড়াতে ওটাও দেখি।

–কী নাড়াতে নাড়াতে?

—চ্যানেল। চ্যানেল নাড়াতে নাড়াতে। পুঁচকে মতো বোতাম আচে না? ওটা টিপলে চ্যানেল চেঞ্জ হয় তো। তিন-চারটে চ্যানেল আসে। সব জায়গায় দেকেচো, কী অশ্লীল নাচ?

—তোমার তো দেকচি এখনও খুব রস…

—যজ্ঞিবাড়ি দেকেচো—ছোটবেলায়? কাঠের উনুনে খিচুড়ি-লাবড়া রান্না হত। চ্যালাকাঠ ঢুকিয়ে দেওয়া হত। কাঠ পুড়তে পুড়তে যখন প্রায় শেষ হয়ে যায়, তখন কাঠের পোঁয়া দিয়ে বিজবিজ করে রস বেরোয়, দেকেচো? আমাদের হচ্ছে সেই রস।

—যাও, তুমি ওসব দেকোগে যাও। আমি ভাই সাতটা পঁইত্রিশের নিউজ শুনব রেডিওতে। সকালে শুনেছি পুরুলিয়ার কাছে ঝালদায় আকাশ থেকে বন্দুক পড়েছে, মেশিনগান, গোলাগুলি, একেবারে অস্তর-বৃষ্টি। কী হল শুনি গে। টিভি-র চেয়ে রেডিওটাই ভাল লাগে আমার। বিছানায় শুয়ে পাশে নিয়ে…

—হ্যাঁ, কী আর করবে ভায়া, রেডিওকেই পাশে শোয়াও এখন, হ্যা-হ্যা-হ্যা।

ওরা গাত্রোত্থান করে। অনিকেত রেডিওপ্রেমী লোকটাকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে থাকে। ওর অন্নদাতা। মঞ্জু অনিকেতের ঘাড়টা ঘুরিয়ে দেয়। বলে, ওই বুড়োকে দেখতে হবে না, আমায় দ্যাখ।

বাব্বা, মঞ্জু এতটাই পাল্টে গেল নাকি এর মধ্যেই। ওকে যেটুকু দেখেছে, বেদনাতুর মনে হয়েছে, ডিপ্রেসিভ, ঝরে পড়া ভোরের শিউলি যেমন। ওকে কখনও এতটা অ্যাগ্রেসিভ দেখেনি অনিকেত। অবশ্য ক’দিনই বা দেখেছে?

মঞ্জু বলে, ওই বুড়োগুলো ছিল বলে ঠিক করে কথাগুলো বলতে পারছিলাম না। এবার শোন। আমাকে বাঁচা। কী আশ্চর্য তখনই কথক ঠাকুর চিৎকার করলেন—আমায় বাঁচা, বাঁচা সখি, কৃষ্ণ-বিরহে প্রাণ যায়। না যদি বাঁচি, পুনরায় কীভাবে কৃষ্ণ-অঙ্গ দর্শন পাব?

ওই কথকতার মধ্যেও ওদের কথা ভেসেই থাকছে, জলপ্রবাহে যেমন নৌকা। মঞ্জু বলল, শোন। শুনতে খারাপ লাগবে হয়তো, আমার এই দুর্গতির জন্য তুইও দায়ী।

—আমি?

করতাল বেজে উঠল ঝনঝন। ঢোল বেজে উঠল ড্রিমড্রিম।

—আমি কী করলাম? আমি কেন দায়ী হতে যাব?

—তুই একা নয়। তুইও। আরও অনেকের সঙ্গে তুইও।

—মানে?

—সেই যে দাদু, যে জামাপ্যান্ট খুলিয়েছিল, বলেছিল বাঁচা, তোর সংস্পর্শ আমার অসুখ সারাবে…

—জানি তো, ওসব কথা তো হয়ে গিয়েছে। ওটা তো একটা কুসংস্কারের বশে, একটা উদ্ভট থিয়োরি-কে বিশ্বাস করে….

—হ্যাঁ, আমি তো বাঁচাতে চেয়েছিলাম বুড়োটাকে, ওই অসুস্থ বুড়োটা তো আমার কাছে হাতজোড় করে ভিক্ষে চেয়েছিল, জীবন ভিক্ষে। আমি সব খুলেছিলাম। বলেছিল, তোর হাত দিয়ে এখানটা স্পর্শ কর। মানে ওর গলার ফুলো জায়গাটা, যেখানে টিউমার, ক্যান্সারের টিউমার, আমি ছুঁয়েছিলাম। বাঁ হাতে। তারপর মনে হল বাঁ হাত অপবিত্র, বাঁ হাতে কাজ হবে না, তারপর ডান হাতে, তারপর দু’হাত দিয়ে ওই বিষফল। দাদু তারপর বলেছিল, তোর বুকটা আমার অসুখে ছুঁইয়ে দে সোনা। আমি ভয় পেয়েছিলাম। একবার মনে হল, যদি আমার বুকেও ওই অসুখটা হয়ে যায়? আমি মাথা নাড়িয়েছিলাম। ওই দাদুটা, মানে তোর পিসেমশাই, তখন আমাকে শুইয়ে দিয়ে দুর্গে দুর্গে রক্ষণীস্বাহা করতে-করতে ওর গলার বিষফল আমার বুকে ছুঁইয়ে দিল। তারপর দু’হাত দিয়ে…। নখ বসে গেল, উঃ। তারপর তো তুই দেখলি। এরপর বমি হল আমার। ঘেন্নার, কাউকে কিছু বলতে পারলাম না। তুই আমাকে দেখিয়ে-দেখিয়ে আমার সামনে থুতু ফেলতিস। কিন্তু, তুই, তুই কেন এলি? তুই কেন শরীর চাইলি আমার? তোর পরই শেষ নয়। আমার একটা মামাতো দাদা। ও বিয়ে করা লোক, তবুও। যেন জোর করে। মামার বাড়িটা বড়লোক। আমাদের অনেক হেল্প করত। আমার বাবা তো কম্পাউন্ডার। গরিব। মামাতো দাদাকে কিছু বলতে পারিনি। পরে আর একদিন। জোর করে। আমার খুব কষ্ট হয়েছিল। তবু ওকে আঁচড়ে দিইনি, কামড়ে দিইনি। কিন্তু এরপর থেকে পুরুষমানুষ দেখলেই কেমন ভয় করত। শুধু পুরুষমানুষ নয়, শশা, গাজর এসবও খুব খারাপ লাগত। আজও শশা খাই না। গাজর খাই না। শিবরাত্তির করতাম। ওটাও ছেড়ে দিলাম। মা বলেছিল শিবরাত্তির করবি না? কুমারী মেয়েদের করতে হয়। বলেছিলাম করব না, বিয়ে না হলে, হবে না।

কিন্তু বিয়ে হল। মামাবাড়ি থেকেই সম্বন্ধ করে বিয়ে হল। সেই মামাতো দাদা ভাল হার দিল। পিঁড়িতে উঠিয়ে সাতপাক ঘোরাল। ছেলের লেদের ব্যবসা। ভাল ইনকাম। সোনারপুরে জমি কেনা আছে, বাড়ি করবে। আমার বরের গলায় সোনার হার, মাথায় কোঁকড়া চুল, গায়ে মেশিনের গন্ধ। মেশিনের গন্ধ তো আমার ভালই লাগত। কিন্তু দু’হাতে চোখ ঢেকেছিলাম যখন ও ধুতিটা খুলল ফুলশয্যার দিন। মাথা নাড়িয়ে বলে উঠেছিলাম, না, না, একদম না। পুরীতে নিয়ে গেল ক’দিন পর। মনে হল নিষেধ করা ঠিক হবে না। ও করত, কিন্তু কাঠকে। একটা নিষ্প্রাণ ন্যাকড়াকে। সন্তান হল। হয়ে গেল। কিন্তু কেন বেশিদিন একটা কাঠের পুতুলকে সহ্য করবে? ওর কোনও দোষ নেই। আমাকে কাঠ করে দেওয়ার জন্য যারা দায়ী, তুইও তাদের মধ্যে একজন। ওদের সামনে এসে একটা রেকাবি নিয়ে দাঁড়াল একজন মহিলা। রেকাবিতে নকুলদানা। বলল, জয় রাধে। গলা শুনেই মুখের দিকে তাকাল অনিকেত। ব্যাটাছেলের মতোই তো মুখটা। গলার স্বরও তো ব্যাটাছেলেদের মতোই, রেকাবিটা নাড়িয়ে আবার বলে উঠল, জয় রাধে।

আর তখনই ঘাটের সিঁড়ি থেকে উঠে এল দু’জন। এতক্ষণ গঙ্গার দিকে মুখ ছিল ওদের, তাই বোঝা যায়নি। ওদের হাতে হাত। ওরা পরিমল এবং অরূপ।

মঞ্জুর সঙ্গে চোখাচোখি হল পরিমলের, হ্যালোজেন-জোছনার জন্ডিস হলুদে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *