হর্ষবর্ধনের সূর্য-দর্শন – শিবরাম চক্রবর্তী
সূর্যদর্শন না-বলে সূর্যগ্রাস বললেই ঠিক হয় বোধ হয়।
রাহুর পরে এক মহাবীরই যা সূর্যদেবকে বগলদাবাই করেছিলেন, কিন্তু যত বড়ো বীরবাহুই হন না, হর্ষবর্ধনকে হনুমানের পর্যায়ে কখনো ভাবাই যায় না।
তাই তিনি যখন এসে পাড়লেন, ‘সূয্যি মামাকে দেখে নেব এইবার’, তখন বলতে কি, আমি হাঁ হয়ে গেছলাম।
আমার হাঁ-কারের কোনো জবাব না-দিয়েই তিনি দ্বিতীয় হেঁয়ালি পাড়লেন, ‘সুন্দরবনের বাঘ শিকার তো হয়েছে, চলুন এবার পাহাড়ে বাঘটাকে দেখে আসা যাক।’
যতদুর আমার জানা, না-বলে আমি পারলাম না, বাঘরা পাহাড়ে বড়ো একটা থাকে না। বনে-জঙ্গলেই তাদের দেখা মেলে। হাতিরাই থাকে পাহাড়ে। পাহাড়দের হাতিমার্কা চেহারা—দেখেছেন তো!
কে বলেছে আপনাকে? তিনি প্রতিবাদ করলেন আমার কথার, টাইগার হিল তাহলে বলেছে কেন? নাম শোনেননি টাইগার হিলের?
শুনব না কেন? তবে সে হিলে, যতদূর জানি, কোনো টাইগার থাকে না। বাবুরা বেড়াতে যান।
সুয্যিঠাকুর সেই পাহাড়ে ওঠেন রোজ সকালে। সে নাকি অপূর্ব দৃশ্য!
তাই দেখতেই তো যায় মানুষ।
আমরাও যাব। আমি, আপনি আর গোবরা। এই তিনজন।
বিকেলের দিকে পৌঁছোলাম দার্জিলিঙে। টাইগার পাহাড়ের কাছাকাছি এক হোটেলে ওঠা গেল।
খাওয়া-থাকার বন্দোবস্ত করে হোটেলের মালিককে অনুরোধ করলাম—দয়া করে আমাদের কাল খুব ভোরের আগে জাগিয়ে দেবেন…
কেন বলুন তো?
আমরা এক-একটি ঘুমের ওস্তাদ কিনা, তাই বলছিলাম…
ঘুম পাহাড়ও বলতে পারেন আমাদের। বললেন হর্ষবর্ধন—যে ঘুম পাহাড় খানিক আগেই পেরিয়ে এসেছি আমরা। তাই আমাদের বলতে পারেন। আমাদের এই পাহাড়ে ঘুম সহজে ভাঙবার নয় মশাই।
নিজগুণে আমরা ঘুম থেকে উঠতে পারব না, গোবরাও যোগ দিল আমাদের কথায়—তাই আপনাকে এই অনুরোধ করছি…
কারণটা কি জানতে পারি?
কারণ। আমরা কলকাতা থেকে এসেছি, অ্যাদ্দূরে এসেছি কেবল সূর্যোদয় দেখবার জন্য।
সূর্যোদয় দেখবার জন্য? কেন, কলকাতায় কি তা দেখা যায় না? সেখানে কি সূর্য ওঠে না নাকি?
উঠবে না কেন, কিন্তু দর্শন মেলে না। চার ধারেই এমন উঁচু উঁচু সব বাড়িঘর যে, সুয্যি ঠাকুরের ওঠা-নামার খবর টের পাবার জো নেই।
তা ছাড়া, তালগাছও তো নেইকো কলকাতায়, থাকলে না-হয় তার মাথায় উঠে দেখা যেত… গোবরা এই তালে একটা কথা বলল বটে তালেবরের মতন!
তাল গাছ না-থাক, তেতালাবাড়ি আছে তো? তার ছাদে উঠে কি দেখা যেত না? বলতে চান ম্যানেজার।
থাকবে না কেন তেতালাবাড়ি। তেতাল, চৌতাল, ঝাঁপতাল সবরকমের বাড়িই আছে। বলে হর্ষবর্ধন তাঁর উল্লিখিত শেষের বাড়ির বিশদ বর্ণনা দেন, ঝাঁপতাল বাড়ি মানে যেসব সাত-দশতলা বাড়ির থেকে ঝাঁপ দিয়ে মরবার তালে ওঠে মানুষ, তেমন তেমন বাড়িও আছে বইকি! কিন্তু থাকলে কী হবে, তাদের ছাদে উঠেও বোধ হয় দেখা যাবে না সূর্যোদয়। দূরের উঁচু উঁচু বাড়ির আড়ালেই ঢাকা থাকবে পুব আকাশ।
এক হয়, যদি মনুমেন্টের মাথায় উঠে দেখা যায় …আমি জানাই।
তা সেই মনুমেন্টের মাথায় উঠতে হলে পুরো একটা দিন লাগবে মশাই আমার এই দেহ নিয়ে… দেহটা দেখেছেন?
হর্ষবর্ধনের সকাতর আবেদনে হোটেলের মালিক তাঁর দেহটি অবলোকন করেন। তারপরে সায় দেন—তা বটে।
তবেই দেখুন, এজন্মে আমার সূর্যোদয়ই দেখা হচ্ছে না তাহলে—এই মানবদেহ ধারণ বৃথাই হল…
তাই আমাদের একান্ত অনুরোধ…
এখানে নাকি অবাধে সূর্যোদয় দেখা যায়, আর তা নাকি একটা দেখবার জিনিস সত্যিই…
সেই কারণেই আপনাকে বলছিলাম…
আমাদের যুগপৎ প্রতিবেদন,—দয়া করে আমাদের ভোর হবার আগেই ঘুম থেকে তুলে দেবেন। এমনকি, দরকার হলে জোর করেও।
কোনো দরকার হবে না। তিনি জানান, রোজ ভোর হবার আগে এমন সোরগোল বাঁধে এখানে যে তার চোটে আপনা থেকেই ঘুম ভেঙে যাবে আপনাদের।
সোরগোলটা বাঁধে কেন?
কেন আবার? ওই সূর্যোদয় দেখবার জন্যেই। যে কারণে যেই আসুক না, হাওয়া খেতে কী বেড়াতে কী কোনো ব্যাবসার খাতিরে, ওই সূর্যোদয়টি সবারই দেখা চাই। হাজার বার দেখেও আশ মেটে না কারো। একটা বাতিকের মতোই বলতে পারেন।
আমরাও এখানে চেঞ্জে আসিনি, বেড়াতে কি হাওয়া খেতেও নয়—এসেছি ঠিক ওই কারণেই…।
তাই রোজ ভোর হবার আগেই হোটেলের বোর্ডাররা সব গোল পাকায়, এমন হাঁকডাক ছাড়ে যে, আমরা, মানে, এই হোটেলের কর্মচারীরা, যারা অনেক রাতে কাজকর্ম সেরে ঘুমোতে যায় আর অত ভোরে উঠতে চায় না, সূর্য ভাঙিয়ে আমাদের ব্যাবসা হলেও সূর্য দেখার একটুও গরজ নেই যাদের, একদম সেজন্য ব্যতিব্যস্ত নয়, তাদেরও বাধ্য হয়ে উঠে পড়তে হয় ওই হাঁকডাকের দাপটে। কাজেই আপনাদের কোনো ভাবনা নেই, কিচ্ছু করতে হবে না আমাদের। কোনো বোর্ডারকে আমরা ডিসটার্ব করতে চাইনে, কারো বিশ্রামে ব্যাঘাত ঘটানো আমাদের নিয়ম নয়… তার দরকারও হবে না, সাতসকালের সেই গোলমালে আপনাদের ঘুম যতই নিটোল হোক না কেন, না-ভাঙলেই আমি অবাক হব।
অতঃপর নিশ্চিন্ত হয়ে হোটেলের ঘরে আমাদের মালপত্র রেখে বিকেলের জলযোগ পর্ব চা-টা সেরে বেড়াতে বেরুলাম আমরা।
তখন অবশ্যি সূর্যোদয় দেখার সময় ছিল না, কিন্তু তা ছাড়াও দেখবার মতো আরো নানান প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মজুদ ছিল তো! সেইসব অপূর্ব নৈসর্গিক দৃশ্য দেখতেই আমরা বেরুলাম।
সন্ধে হয় হয়। এ ধারের পাহাড়ে পথঘাট একটু ফাঁকা ফাঁকাই এখন। একটা ভুটিয়ার ছেলে একপাল ভেড়া চরিয়ে বাড়ি ফিরছে গান গাইতে গাইতে।
শুনে হর্ষবর্ধন আহা-উহু করতে লাগলেন।
আহা আহা! কী মিষ্টি! কী মধুর…
কেমন মূর্ছনা! যোগ দিল গোবরা। শুনে প্রায় মূর্ছিত হয় আর কী!
একেই বলে ভাটিয়ালি গান, বুঝেছিস গোবরা? কান ভরে শুনে নে, প্রাণ ভরে শোন।
ভাটিয়ালি গান বোধ হয় এ নয়, মৃদু প্রতিবাদ আমার—সে গান গায় পুব বাংলার মাঝিরা, নদীর বুকে নৌকার ওপর বৈঠা নিয়ে বসে। ভাটির টানে গাওয়া হয় বলেই বলা হয় ভাটিয়ালি।
তাহলে এটা কাওয়ালি হবে। সমঝদারের মতন কন হর্ষবর্ধন।
তাই বা কি করে হয়? গোরু চরাতে চরাতে গাইলে তাই হত বটে, কিন্তু cow তো নয়, ওতো চরাচ্ছে ভেড়া।
কাওয়ালিও নয়? হর্ষবর্ধন যেন ক্ষুণ্ণ হন।
রাখালি গান বলতে পারো দাদা! ভাই বাতলায়, ভেড়া চরালেও রাখালই তো বলা যায় ছোঁড়াটাকে।
লোকসংগীতের বাচ্চা বলতে পারেন। আমিও সংগীতের গবেষণায় কারো চাইতে কম যাই না, এই বেড়ালই যেমন বনে গেলে বনবেড়াল হয়। তেমনি এই বালকই বড়ো হয়ে একদিন কেষ্ট-বিষ্টু একটা লোক হবে। অন্তত ওর গোঁফ বেরুবে তখন এই গানকে অক্লেশে লোকসংগীত বলা যাবে। এখন নেহাত বালকসংগীত।
ভেড়ার পাল নিয়ে গান গাইতে গাইতে ছেলেটা কাছিয়ে এলে হর্ষবর্ধন নিজের পকেট হাতড়াতে লাগলেন—ওকে কিছু বকশিশ দেওয়া যাক। ওমা! আমার মানিব্যাগটা তো হোটেলের ঘরে ফেলে এসেছি দেখছি। আপনার কাছে কিছু আছে? নাকি, আপনিও ফেলে এসেছেন হোটেলে?
পাগল! আমি প্রাণ হাতছাড়া করতে পারি, কিন্তু পয়সা নয়। আমার যৎসামান্য যা কিছু আমার সঙ্গেই থাকে—আমার পকেটই আমার রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। তবে কিনা…
বলতে গিয়েও বাধে আমার। চক্রবর্তীরা যে কঞ্জুস হয়, সে-কথা মুখ ফুটে বলি কী করে? নিজগুণ কি গণনা করবার?
তাহলে ওকে কিছু দিন মশাই। একটা টাকা অন্তত।
—দিলাম।
টাকাটা পেয়ে তো ছেলেটা দস্তুরমতন হতবাক। পয়সার জন্যে নয়, প্রাণের তাগাদায় অকারণ পুলকেই গাইছিল সে। তাহলেও খুশি হয়ে, আমাদের সেলাম বাজিয়ে নিজের সাঙ্গোপাঙ্গদের নিয়ে সে চলে গেল।
খানিক বাদে সেই পথে আবার এক রাখাল বালকের আবির্ভাব! সেই ভেড়ার পাল নিয়ে সেই রকম সুর ভাঁজতে ভাঁজতে… তাকেও এক টাকা দিতে হয়।
খানিক বাদে আবার আরেক! পঞ্চম স্বরে গলা চড়িয়ে ভেড়া চরিয়ে ফিরছে ওই পথেই।
তার স্বরাঘাতের হাত থেকে রেহাই পেতে, অর্ধচন্দ্র দেওয়ার মতোই, একটা আধুলি দিয়ে তাকে বিদায় করা হল।
তারপর আরো আরো মেষপালকের গাইয়ে বালকের পাল আসতে লাগল পরম্পরায়… ওই পথেই! আর আমিও তাদের বিদায় দিতে লেগেছি। তিনটেকে আধুলি, চারটেকে চার আনা করে, বাকিগুলোকে পুঁজি হালকা হওয়ার হেতু বাধ্য হয়েই দশ নয়া পাঁচ নয়া করে দিয়ে তাদের গন্তব্য পথে পাচার করে দিতে হল।
সেই একটা ছেলেই ঘুরে ঘুরে আসছে না তো দাদা? গোবরা সন্দেহ করে শেষটায়—পয়সা নেবার ফিকিরে?
সেই ছেলেই নাকি মশাই? দাদা শুধান আমায়।
কী করে বলব? একটা ভুটিয়ার থেকে আরেকটা ভুটিয়াকে আলাদা করে চেনা আমার পক্ষে শক্ত। এক ভেড়ার পালকে আরেক পালের থেকে পৃথক করাও কঠিন। আমার কাছে সব ভেড়াই একরকম। এক চেহারা।
বলেন কী? হর্ষবর্ধন তাজ্জব হন।
—হ্যাঁ, সব এক ভ্যারাইটি। যেমন এক চেহারা তেমনি এক রকমের স্বরলহরী—কী ভেড়ার আর কী ভুটিয়ার!
আসুন তো, এই পাশের টিলাটার ওপর উঠে দেখা যাক ছেলেটা যায় কোথায়!
ছেলেটা যেতেই আমরা টিলাটার ওপরে উঠলাম।
ঠিক তাই। ছেলেটা এই টিলাটার বেড় মেরেই ফের আসছে বটে ঘুরে… গলা ছেড়ে দিয়ে সুরের সপ্তমে।
কিন্তু এবার আর সে আমাদের দেখা পেল না।
না-পেয়ে, টিলাটাকে আর চক্কর না-মেরে তার নিজের পথ ধরল সে। তার চক্রান্তের থেকে মুক্তি পেলাম আমরাও।
কিন্তু ছেলেটা আমাকে কপর্দকশূন্য করে দিয়ে গেল। আরেকটু হলে তার গানের দাপটে আমার কানের সব ক-টা পর্দাই সে ফাটিয়ে দিয়ে যেত। তাহলেও, কানের সাত পর্দার বেশ কয়েকটাই সে ঘায়েল করে গেছে, শেষ পর্দাটাই বেঁচে গেছে কোনো রকমে। আমার মতো আমার কানকেও কপর্দকশূন্য করে গেছে।
তাহলেও কোনো গতিকে কানে কানে বেঁচে গেলাম এ যাত্রায়।
প্রাকৃতিক মাধুরীর প্রচুর ভূরিভোজের পর বহুত হন্টন করে হোটেলে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেল।
তখন ঘুমে আমাদের চোখ ঢুলঢুলু, পা টলছে। কোনো রকমে কিছু নাকে-মুখে গুঁজেই আমাদের ঢালাও বিছানায় গিয়ে আমরা গড়িয়ে পড়লাম।
গোবরাভায়া, দরজা-জানালা খড়খড়ি ভালো করে এঁটে দাও সব। নইলে কোনো ফাঁক পেলে কখন এসে বৃষ্টি নামবে, তার কোনো ঠিক নেই। বললাম আমি গোবর্ধনকে।
এটা তো বর্ষাকাল নয় মশাই।
দার্জিলিংয়ের মেজাজ তুমি জানো না ভাই। এখানে আর কোনো ঋতু নেই, গ্রীষ্ম নেই, বসন্ত নেই, শরৎ নেই, হেমন্ত নেই, খালি দুটো ঋতুই আছে কেবল। শীতটা লাগাও, আর বর্ষণ যখন-তখন।
তার মানে?
চারধারেই হালকা মেঘ ঘুরছে-ফিরছে নজরে না-ঠাওর হলেও। মেঘলোকের উচ্চতাতেই দার্জিলিং তো! জানালা খড়খড়ির ফাঁক পেলেই ঘরের ভেতর সেই মেঘ এসে বৃষ্টি নামিয়ে সব ভাসিয়ে দিয়ে চলে যাবে।
বলেন কী?
তাই বলছি। আমি বললাম,—কিন্তু আর বলতে পারছি না। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম…
ঘুমোচ্ছেন তো! কিন্তু চোখ-কান খোলা রেখে ঘুমোবেন। হাঁকলেন হর্ষবর্ধন।
তেমন করে কি ঘুমোনো যায় নাকি? আমি না-বলে পারি না—চোখ তো বুজতে হবে অন্তত।
কিন্তু কান খাড়া রাখুন। কান খোলা রেখে সজাগ হয়ে ঘুমোন। একটু সোরগোল কানে এলেই বুঝবেন ভোর হয়েছে। জাগিয়ে দেবেন আমাদের।
দেখা যাবে। বলে আমি পাশ ফিরে শুই। কান দিয়ে কতদূর কতটা দেখতে পারব, তেমন কোনো ভরসা না-করেই।
এক ঘুমের পর কেমন যেন একটা আওয়াজে আমার কান খাড়া হয়। আমি উঠে বসি বিছানায়। পাশে ঠেলা দিই গোবরাকে—গোবরাভায়া, একটা আওয়াজ পাচ্ছ না?
কীসের আওয়াজ?
পাখোয়াজ বাজছে যেন। কেউ যেন ভৈরোঁর রাগিণী সাধছে মনে হচ্ছে। ভৈরোঁ হল গে ভোরবেলার রাগিণী। ভোরবেলায় গায়।
পাখোয়াজ বাজছে? গোবরাও কান তুলে শোনবার চেষ্টা পায়।
হর্ষবর্ধনও সাড়া দেন ঘুম থেকে উঠে—কী হয়েছে? ভোর হয়েছে নাকি?
খানিক আগে কীরকম যেন একটা সোরগোল শুনছিলাম।—আমি বললাম।
ভোর হয়েছে বুঝি?
ভাবছিলুম তাই। কিন্তু আর সেই হাঁকডাকটা শোনা যাচ্ছে না।
শুনবেন কী করে? বলল গোবরা—দাদা জেগে উঠলেন যে! দাদাই তো নাক ডাকাচ্ছিলেন এতক্ষণ।
কক্ষনো না। বললেই হল। কখনো আমার নাক ডাকে না, ডাকলে আমি শুনতে পেতুম না নাকি? ঘুম ভেঙে যেত না আমার?
তুমি যে বদ্ধকালা। শুনবে কী করে? নইলে কানের অত কাছাকাছি নাক! আর ওই ডাকাতপড়া হাঁক তোমার কানে যেত না?
তুই একটা বদ্ধপাগল! তোর সঙ্গে কথা কয়ে আমি বাজে সময় নষ্ট করতে চাইনে। বলে দাদা পাশ ফিরলেন—আবার তাঁর হাঁকডাক শুরু হল।
এরপর, অনেকক্ষণ পরেই বোধহয়, হর্ষবর্ধনই জাগালেন আমাদের—কোনো সোরগোল শুনছেন?
কই না তো। আমি বলি—বিলকুল চুপচাপ।
এতক্ষণেও ভোর হয়নি! বলেন কি! জানালা খুলে দেখা যাক তো … তিনি বিছানা ছেড়ে উঠে জানালাটা খুললেন—’ওমা!’ এই যে বেশ ফরসা হয়ে এসেছে … উঠুন! উঠে পড়ুন চটপট।
আমরা ধড়মড় করে উঠে পড়লাম।
জামাকাপড় পরে না! সাজগোজ করার সময় নেই—তা ছাড়া দেখতেই যাচ্ছেন, কাউকে দেখাতে যাচ্ছেন না। নিন, কম্বলটা গায়ে জড়িয়ে নিন। দেরি করলে সূর্যোদয়টা ফসকে যাবে।
তিনজনেই শশব্যস্ত হয়ে আপাদমস্তক কম্বল জড়িয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
টাইগার হিলের উঁচু টিলাটা কাছেই। হন্তদন্ত হয়ে তিনজনায় গিয়ে খাড়া হলাম তার ওপর।
বিস্তর লোক গিজগিজ করছে সেখানে। নিঃসন্দেহ, সূর্যোদয় দেখতে এসেছে সবাই।
মশাই! সুয্যি উঠতে দেরি কত? হর্ষবর্ধন একজনকে শুধালেন।
সুয্যি উঠতে? ভদ্রলোক একটু মুচকি হেসে ওঁর কথার জবাব দিলেন।
বেশি দেরি নেই আর। আমি বললাম,—আকাশ বেশ পরিষ্কার। দিগবিদিক উদ্ভাসিত… উঠল বলে মনে হয়।
কিন্তু সূর্য আর ওঠে না। হর্ষবর্ধন বাধ্য হয়ে আরেকজনকে শুধান,—সুয্যি উঠচে না কেন মশাই?
এখন সূর্য উঠবে কী? ভদ্রলোক অবাক হয়ে তাকান তার দিকে।
মানে, বলছিলাম কী, সূর্য তো ওঠা উচিত ছিল এতক্ষণ। পুবের আকাশ বেশ পরিষ্কার। সূর্যের আলো ছড়াচ্ছে চারদিকে—অথচ সূর্যের পাত্তা নেই!
সূর্য কি উঠবে না নাকি আজ? আমার অনুযোগ।
ওই মেঘটার আড়ালে ঢাকা পড়েছে সূর্য, তাই দেখতে পাচ্ছেন না। তিনি জানালেন—মেঘটা সরে গেলেই…
বলতে বলতে মেঘ সরে গেল, প্রকাশ পেলেন সূর্যদেব?
ও বাবা! অনেকখানি উঠে পড়েছেন দেখছি। বেলা হয়ে গেছে বেশ। আপশোশ করলেন হর্ষবর্ধন—সূর্যোদয়টা হাতছাড়া হয়ে গেল দেখছি আজ।
ওমা! একী! হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি—নেমে যাচ্ছে যেন। নামছে কেন সুয্যিটা? নীচের দিকে নেমে যাচ্ছে যে! এ কী ব্যাপার?
এরকমটা তো কখনো হয় না! আমিও বিস্মিত হই—সূর্যের এমন বেচাল ব্যাপার তো দেখা যায় না কখনো।
হ্যাঁ মশাই, এরকমটা হয় নাকি এখানে মাঝে মাঝে? একটু না-উঠেই নামতে থাকেন আবার—পথ ভুল হয় সূর্যদেবের?
তার মানে?
তার মানে, আমরা সূর্যোদয় দেখতে এসেছি কিনা, উদীয়মান সূর্য দেখতে না-পাই, উদিত সূর্য দেখেও তেমন বিশেষ দুঃখিত হইনি—কিন্তু একী! উঠতে-না-উঠতেই নামতে লাগলো যে!
আপনার জন্যে কি পশ্চিম দিকে উঠবে নাকি সূর্য? অস্ত যাবার সময় সূর্যোদয় দেখতে এসেছেন! ঝাঁঝালো গলা শোনা যায় ভদ্রলোকের—
কোথাকার পাগল সব! আরেক জন উতোর গান তাঁর কথার।