হর্ষবর্ধনের কাব্যচর্চা
বাড়ির দরজায় কে যে এক-পাল ছাগল বেঁধে গেছল, তাদের চাঁ-ভা পাড়াটা মাত। হর্ষবর্ধন তখন থেকে উঠে-পড়ে লেগেছেন, কিন্তু মনই মেলাতে পারছেন না, তা কবিতা মেলাবেন কী!
দূর ছাই! বিরক্ত হয়ে বলেছেন হর্ষবর্ধন, পাঁঠার সঙ্গে খালি পেটের মিল হতে পারে কবিতার মিল হয় না। পাঠারা অপাঠ্য। •
আজই একটু আগে গোবরার হাতে তিনি মোটা খাতাটা দেখেছিলেন। চামড়ায় বাঁধানো চকচকে-অবিকল বইয়ের মতো। কৌতূহল প্রকাশ করায় গোবরা জানিয়েছিলো–এটা আমাদের কবিতার খাতা, আমরা কবিতা লিখবো। পরে ছাপা হয়ে বই আকারে বেরুবে! আমাদের কবিতার বই।
আমরা মানে? আমরা কারা? ভাইয়ের কথায় দাদা একটু ঘাবড়েই গেছেন।
আমরা অর্থাৎ তুমি আর আমি। আবার কে? গোবরা ব্যক্ত করেছে।
আমি! আমি লিখবো কবিতা! কেন, কি দুঃখে? হর্ষবর্ধন আকাশ থেকে পড়েছেন : আমাদের কাঠের কারবার বেঁচে থাকতে। কবিতা লিখতে যাবো কিসের দুঃখে?
চিরটা কাল তো আকাট হয়েই কাটালে। কেন, কবি হওয়াটা কি খারাপ?
ধুত্তোর কবি! কী পাপ করেছি যে আমায় কবিতা লিখতে হবে! হর্ষবর্ধনের কভি নেহি মেজাজ।
কেন, পাপ কিসের! গোবরা জবাব দিয়েছে, কবিতা লেখা কি পাপ? ব্যাস-বাল্মীকি, কালিদাস-কৃত্তিবাস, ওমর-ওমর বলতে বলতে গোবরার কোথায় যেন আটকে যায়।
দূর বোকা! ওমর নয়, অমর। জানি কবিতা লিখে এঁরা সবাই অমর। জানা আছে। হর্ষবর্ধন ভাইকে জানাতে দ্বিধা করেন না।
অমর নয়, ওমর। আরেকজন নামজাদা কবিতার নামের সঙ্গে আরো দু-দুটো খাবার জিনিস জড়ানো কিনা। খাবাগুলো আমার মনে আসছে না ছাই!
ওমরত্ব ছাড়াও দুরকমের খাবার? ভাল খাবার? ঠিক কাব্যরস না হলেও হর্ষবর্ধনের জিভে এক রকমের রস জমে।
মনে পড়েছে। খই আর আম। ওমর খৈআম। হ্যাঁ, তুমি কি বলতে চাও ব্যাস, বাল্মীকি, কালিদাস, কৃত্তিবাস আর আমাদের ওই ওমর খৈআম–এঁরা সবাই কবিতা লিখে পাপ করে গেছেন?
ওমর খৈআম আমি পড়িনি। তবে খই আমরে মতো মতো ভাল হবে কি না বলতে পারবো না। হর্ষবর্ধন আসল প্রশ্নের পাশ কাটিয়ে যান।
আমি পড়েছি। দই-চিঁড়ের চেয়েও ভাল। গোবরা নিজের অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করে, ঢের উপাদেয়।
তা ভাল হতে পারে। কিন্তু কবিতা লেখা ভারি শক্ত! মেলাতে হয়। কবিতা মেলাতেই অনেকের প্রাণ যায়। ওমরের কথা জানি না, আর সবাই মরো–মরো।
কিছু শক্ত না। তুমি এই ভূমিকাটা পড়ে দেখো। জনৈক আন্ত লেখকের লেখা। লোকটাকে হয়তো কবিও বলা যায়। যা রীতিমত টাকা দিয়ে লেখাতে হয়েছে নগদ এক-কুড়ি টাকা। বইটা লেখবার আগেই বইয়ের ভূমিকাটি লিখিয়ে লাখলাম। কাজ এগিয়ে রইল।
মোটা খাতাটার গোড়াতেই একটা গোটা প্রবন্ধ কোন এক আস্ত লেখকের লেখা ছোট্ট এক ভূমিকা-ভূমিকাটার মাথায় বিশদ করে জানানো কবিতা লেখা মোটেই কঠিন না। হর্ষবর্ধন ভূমিকার মাথাটা পড়েন, কিন্তু মোটেই তার ভেতরে মাথা গলান না। এমনিতেই তিনি মাথা নাড়েন : না, শক্ত না! খুব শক্ত। এ কি বাপু কাঠ যে হাটে গেলেই মিলে যায়? এ হলো কবিতা। মেলা দেখি কবিতার সঙ্গে? খবিতা, গবিতা, ওবিতা, চবিতা, ছবিতা, ভবিতা, জবিতা-মায় ইস্তক হবিতা পর্যন্ত কিছু মেলে না। কবিতা লেখা কি সহজ রে বাপ! বললেই হলো আর কি!
এই আস্ত লেখকটা তাহলে আস্ত গুল ঝেড়েছে, এই তুমি বলতে চাও তো?
আলবৎ! কবিতা মেলাতে হয় নইলেনই কবিতাই হয় না। আর মেলানো ভারি শক্ত। দু রকমের মেলা আছে, রথের মেলা আর কবিতার মেলা কিন্তু দুটো মেলা একেবারে আলাদা রকমের। রথের মেলা ঠিক সময়ে আপনিই মেলে, কিন্তু কবিতা মেলায় কার সাধ্যি! তোর লেখক গুল না ঝাড়তে পারে, কিন্তু ভুল করে দুটো মেলায় গুলিয়ে ফেলেছে বলে বোধ হচ্ছে।
জানি, জানি। গোবরা ঘাড় নাড়ে : মিলও তোমার দুরকমের। কবিতার মিল, আবার কাপড়ের মিল। কিন্তু মিল ছাড়াও যেমন কাপড় হতে পারে–ধরো যেন তাঁতের কাপড়, তেমনি তোমার মিলেও কবিতা বানানো যায়। পড়ে দেখ না ভূমিকাটা।
আচ্ছা, যা তুই! ঘণ্টাখানেক পরে আসিস। আমি তোকে এমন একটা লম্বা কবিতা বানিয়ে দেবো যে তোর তাক লেগে যাবে। পারিস তো কোন কাগজে কিছু টাকা দিয়ে তোর নাম ছাপিয়ে দিস। তোর নামে উইল করে দিলাম।
এই বলে শ্রীমান ভ্রাতৃত্বকে ভাগিয়ে দিয়ে আমাদের কবিতার খাতা নামক মরোক্কো চামড়ার বাঁধাই মোটা খাতাটাকে নিয়ে তিনি পড়েছেন। লাইন দুয়েকের কবিতা দেখতে না দেখতেই তার এসে গেছে পলায়মান তাদের ধরে-পাকড়ে খাতার পাতায় তিনি পেড়ে ফেলেছেন। লাইন দুটি এই :
মুখখানা থ্যাবড়া।
নাম তার গোবরা।।
কিন্তু এই দু-ছত্রের পরে আর একছত্রও তাঁর নিজের কিংবা কমলের মাথায় আসছে না। বাড়ির তলায় ছাগলদের সমবেত ঐকতান সেই ছাগলাদ্য সঙ্গীত সুরধুনী ভেদ করে কাব্য সরস্বতীর সাধ্য কি যে তাঁর খাতার দিকে পা বাড়ায়! অগত্যা, বিতাড়িত হয়ে তিনি ভূমিকাটা নিয়ে পড়েছেন তার মধ্যে যদি গোবরা-কথিত কবিতা লেখার সত্যি কোন সহজ উপায় থাকে।
ভূমিকাটার আরম্ভ এই :
তোমাদের নিশ্চয় কবিতা লিখতে ইচ্ছে করে। কিন্তু তোমরা হয়তো ভেবেছো, ওটা শক্ত কাজ। কিন্তু মোটেই তা নয়। কবিতা লেখার মতো সহজ কিছুই নেই। নাটক গল্প প্রবন্ধ–এ-সব খুব কষ্ট করে লিখতে হয়, কিন্তু কষ্ট করে একটি জিনিস লেখা যায় না, তা হচ্ছে কবিতা। খুব সহজে ও আসবে, নয়তো কিছুতেই ও আসবে না। সহজ না হলে কবিতাই হলো না।
এই অবধি পড়ে হর্ষবর্ধন আপন মনে বলতে থাকেন : আর, আমিও তো ঠিক সেই কথাই বলছি। কষ্ট করে কখনোই কবিতা লেখা যায় না। আর দেখো তো এই গোবরার কাণ্ড! আমার ঘাড়ে ইয়া মোটা একটা জাবদা খাতা চাপিয়ে গেছে –আমি অনর্থক কষ্ট করে মরছি। যতো সব অনাসৃষ্টি দেখো না!
হর্ষবর্ধন আবার ভূমিকার মধ্যে আরেকটু অগ্রসর হন–
নির্মল জলে যেমন আকাশের ছায়া পড়ে, তেমনি মানুষের মনে কবিতার মায়া লাগে। মনের সেই আকাশকে রঙে রেখায় ধরে রাখলেই হয় ছবি, আর কথায় বাঁধলে হয় কবিতা। তোমাদের মনে যন যে ভাব জাগে তাকে যদি ভাষায় জাহির করতে পারো তাই কবিতা–যেটা যতো ভাল প্রকাশ হবে, কবিতাও হবে ততো চমৎকার।
অতঃপর হর্ষবর্ধন নিজের মনের মধ্যে হাতড়াতে শুরু করেন। কিন্তু সমস্তই তার শূন্য বলে মনে হতে থাকে। অবশেষে তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলেন তাহলে আর আমি কি করে কবি হবো!
ভূমিকায় আরো ছিল?
শরীরের যেমন ব্যায়াম দরকার, যেমন বই পড়া আবশ্যক, তেমনি প্রয়োজন কবিতা লেখার। বই পড়লে চিন্তা করলে হয় মস্তিষ্কের ব্যয়াম, কবিতাচর্চায় মনের ভাবের। ভাণ্ডার যত পূর্ণ হবে, মন হয়ে ততই বড়ো–ততই অগাধ। ভাব এলেই লিখে ফেল। তাহলে, সেই প্রয়াসের দ্বারাই ঘুরে ফিরে সেই ভাব তোমার চেতনা বা অবচেতনার মধ্যে গিয়ে জমা হয়ে থাকলো। ভাবনা হচ্ছে, মৌমাছির মত যদি উড়ে যেতে দিলে তো খানিক গুনগুন করেই ও চলে গেলো আর কখনো ফিরে
আসতেও পারে। কিন্তু কথার রূপগুণের মধ্যে–ভাষার মৌচাকে যদি ওকে ধরতে পারো তাহলে মধু না দিয়ে ও যাবে না। সেই মধুই হলো আসল। এবং তোমার সেই মনের মধু পাঠকের মনকেও মধুময় করতে পারে তখনই তোমার কবিতা হয়ে ওঠে মধুর। তখনই তার সার্থকতা।
কবিতার আসল কথা হচ্ছে তা কবিতা হওয়া চাই। ছন্দ, মিল ইত্যাদি না হলেও তার চলে। ছন্দ যদি আপনিই এসে যায়, মিল যদি অমনি পাও, বহুৎ আচ্ছা, কিন্তু ও না হলেও কবিতার কোন হানি হয় না। আকাশের সঙ্গে বাতাস বেশ মিল খায়, আকাশের সঙ্গে পৃথিবীর কোথাও মিল নেই। অথচ আকাশ আর পৃথিবী মিলে চমৎকার একটা কবিতা।
ভূমিকাটা, দু-একটা উদাহরণের পরে এইভাবে শেষ। পরিশেষে পৌঁছে হর্ষবর্ধন মুখ বাঁকান : জানি, জানি। এ সবই আমার জানা। তুমি আর নতুন কথা আমাকে কি শেখাবে বাপু! তোমার চেয়ে ঢের ভাল ভূমিকা আমি লিখে দিতে পারি। আরে বাপু কে না জানে শ্রীবৎস লিখলেই বীভৎস দিয়ে মেলাতে হয়। কার খোকা আনলেই অমনি ছারপোকাকে আমদানি করতে হবে। গাড়ি ভাড়া করলে ভারি তাড়া না হয়ে আর যায় না! সবাই জানে, তুমি আর বেশি কি বলবে! কিন্তু একপাল ছাগল আর তাদের কান ফাটানো চ্যাঁ–ভ্যাঁর সঙ্গে যদি মেলাতে পারতে তাহলে জানতুম যে হ্যাঁ–তুমি একজন আস্ত জাত কবি। এমন কি তোমাকে আমি কবি অমর মুড়ি-কাঁঠাল বলে মানতেও রাজি ছিলাম।
গোবরা এসে এতক্ষণ পরে উঁকি মারে–কি দাদা? কদুর? বেরুল তোমার কবিতা?
হয়েছে, খানিকটা হয়েছে। দু-ছত্তর তোর বইয়ের ওপর গজিয়েছে, আর দু-ছত্তর আমার মাথায় গজগজ করছে, এখনো খাতায় ছাড়িনি!
দেখি তোমার কবিতা? গোবরা দাদার কাব্য–গঞ্জনা শুনতে উৎসুক হয়।
কিন্তু খাতার দু-লাইন–মুখখানা থ্যবড়া, নাম তার গোবরা দেখেই নিজের মুখের সঙ্গে সে মিলিয়ে দেখে কি না বলা যায় না–গোবরার মুখ কবিতার আরেকটা মিল হয়ে ওঠে–একেবারে গোমড়া হয়ে ওঠে।
আরে এখনি অবাক হচ্ছিস! আরো দু-লাইন আছে–বলছি শোন! হর্ষবর্ধন বাকি পংক্তি গুলোকেও নিজের দন্তপংক্তির সঙ্গে প্রকাশ করে দেন–বাকিটাও শোন তবে–শুনলে খুশিই হবি–
তলায় এক পাল ছাগল!
আর ওপরে এক পাগলা।
এই চার লাইনেই আমার অমরত্বলাভ। আজকের মতো এই যথেষ্ট। কেমন হয়েছে কবিতাটা? এমন কৈআমের সমকক্ষ হয়তো হইনি, কিন্তু ওমর মুড়কিজাম কি বলা যায় না আমায়?