হরু হরকরার একগুঁয়েমি

হরু হরকরার একগুঁয়েমি

কলকাতায় গেঁড়িদির বিয়ে হল। তার নিমন্ত্রণ-পত্র বিয়ের সাত সপ্তাহ পরেও যখন বোলপুরের ভুবনডাঙায় বড়দাদুর কাছে পৌঁছল না, তিনি চটে কাঁই। নাকি লোকের অভাবে বাইরের চিঠি সব ডাকে দেওয়া হয়েছিল। বড়দাদু তাতে আরো চটে গেলেন, “ডাকে চিঠি! বলি, ডাকের চিঠি, কারো কাছে কখনো সঠিক পৌঁছয় যে বলছিস ডাকে দিয়েছিলি?”

গেঁড়িদিদির বাবা অম্বিকাজ্যাঠা হলেন গিয়ে মেজদাদুর ছেলে। অবিশ্যি ছেলে ঠিক নয়, বেশ বুড়ো। বড্ড ভালমানুষ। বাড়িসুদ্ধু সক্কলের জন্যে নতুন কাপড়, কাঁচাগোল্লা, কালাকান্দ, ল্যাংড়া আম সঙ্গে নিয়ে, কী ব্যাপার দেখতে এসেছিলেন। কেউ গেল না কেন বিয়েতে? সবাই খুশি হল, এক বড়দাদু ছাড়া।

বড়দাদু আবার বললেন, “চিঠি পাইনি, যাইনি, ব্যাস!” অবিশ্যি চিঠি পেলেও যেতেন না। দোতলা থেকে নামতেই পারেন না, ৮৮ বছর বয়স। রান্নাঘরের ছাদে পাইচারি করে করে বনপথের মতো দুটা চওড়া লাইন ক্ষয়ে ফেলেছেন। অম্বিকাজ্যাঠা কিছু বলছেন না দেখে বড়দাদু ইজিচেয়ারের হাতল চাপড়ে আরো বললেন, “হয় রেলের ডাকের থলিতে অন্য জিনিস আসে, বুঝলি? নয়তো পাঠাসনি। তা না হলে দেরি করে হলেও, এর মধ্যে এসে পৌঁছত। আসলে রেলের ডাকে চিঠিপত্র আসে না আজকাল। আর শুধু আজকাল কেন, আগেও অনেক সময় আসত না। আমার দাদামশায়ের মরার আগে রেজিস্টার ডাকে পাঠানো হীরেগুলো মা’র কাছে এসে পৌঁছল না কেন? তার রসিদও ছিল। দাদামশায়ের ছেঁড়া গীতায় গোঁজা। তা সেটিকে বড়মামা সর্দারি করে চিতেয় তুলে দেছলেন! ব্যস হয়ে গেল! সে তো আমার জন্যেই পাঠানো হয়েছিল। আমিই মায়ের একমাত্র সন্তান। যদিও তখনও জন্মাইনি, তবু তাতে আমার উত্তরাধিকারের দাবি তো আর উপে যায় না?—”

হেনাতেনা কত কী বলতে লাগলেন বড়দাদু। জোড়া-শিং গুবরেকে চান করাতে করাতে আধখানা কান দিয়ে সব শুনছিল বড়দাদুর একমাত্র সন্তানের একমাত্র সন্তান উট্‌কো। গুবরেটা যেমনি বদ তেমনি নোংরা, কিছুতেই চান করবে না। ঠ্যাং-এ সুতো বাঁধা সত্ত্বেও ইদিক-উদিক পালাবার চেষ্টা করে। সমস্তক্ষণ কড়া নজর রাখতে হয়। তাই গোড়ার দিকটা তত শোনা হয়নি। কিন্তু হিরের কথা কানে যেতেই কান খাড়া। দু-শিং বদ গুবরেটা সেই সুযোগে দরজার পরদা বেয়ে প্রায় ছাদ অবধি উঠতেই সুতোয় টান পড়ল। থপ করে মাটিতে পড়ে উল্টো হয়ে শূন্যে ঠ্যাং ছুঁড়তে লাগল। তা জোড়া শিং ভাঙুক আর না-ই ভাঙুক, উট্‌কোর খেয়াল নেই।

কাঁথা সেলাই করতে করতে বড়ঠাকুমা বললেন, “তা বললে তো চলবে না। মাসে মাসে আমি আমকপালিতে বাপের বাড়ি চিঠি পাঠাই, পরের মাসে তার ঠিক ঠিক জবাবও পাই। আমার বাপু কোনো অসুবিধা হয় না।”

শুনে অম্বিকাজ্যাঠা পর্যন্ত অবাক! “সে কী! রেলের ডাকে চিঠি যায়, উত্তর আসে?”

বড়ঠাকুমা কাঁথা থেকে চোখ না তুলেই বললেন, “অতশত জানিনে, বাপ। উট্‌কো চিঠি ফেলে, উত্তর আসে। তাই না রে উট্‌কো?”

গুবরেকে সোজা করতে করতে উট্‌কো বলল, “হুঁ।” জ্যাঠা বললেন, “ডাকঘরের বাইরের ডোরাকাটা বাক্সে ফেলিস আর ডাকঘরের পেছনের খুদে জানলা দিয়ে উত্তর আনিস?”

গুবরেকে বড় জালের বাক্সে ভরতে ভরতে উট্‌কো বলল, “ঠিক তা নয় অবিশ্যি।” “তবে? তবে?” “ডাকে দিলে যদি না যায়, তা হলে ঠামু আমাকে ঘুড়ির পয়সা, গুলির পয়সা দেবে না। তা—” উট্‌কো থামতেই সবাই ওকে ছেঁকে ধরল, “তাই কী বল, আহা থামলি কেন? তোর যদি কোনো প্রাইভেট বন্দোবস্ত থাকে তো বল, আমরাও তার পৃষ্ঠপোষকতা করব—।”

উট্‌কো উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “বন্দোবস্ত ঠিক নয়। হয়েছে কী, হরু হরকরা যার-তার চিঠি বিলোবার ভার নেয় না।”

বড়দাদু ভারি বিরক্ত, “বিলোবার ভার আবার কী? ডাকের থলিতে রেলে করে যায় না?”

“না। তাহলে হয়তো পৌঁছবে না।”

অম্বিকাজ্যাঠা খবরের কাগজে বানিয়ে বানিয়ে গল্প লেখেন। তিনি বললেন, “তবে কি চিঠি হাতে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যায়। বুড়ো নিশ্চয়? খোঁড়াও হয়তো?”

উট্‌কো বড়দের সঙ্গে পারতপক্ষে কথা বলত না। সে খালি বলল, “হুঁ।” বলে দরজার দিকে পা বাড়াল। ঠামু বললেন, “সেইখানে দুটো পোস্টকাট রেখেছি, তাকে দিয়ে দিস।” সঙ্গে সঙ্গে উট্‌কো হাওয়া।

বড়দাদু তো হাঁ! বুলিপিসি বললেন, “আমিও তা হলে দুটো চিঠি দেব।” এমনিতে তো অর্ধেক পৌঁছয় না। অম্বিকাজ্যাঠা বললেন, “তোরা কি খেপেছিস? হরকরারা আর আছে নাকি? রেলের পত্তনের সঙ্গে সঙ্গে ও-সব উঠে গেছে। চার ঘণ্টায় রেল যায়, হরকরাদের লাগত পাঁচদিন, তা জানিস?”

পিসি বললেন, “তবু তো পৌঁছয় শুনছি। একটা পরীক্ষা হয়েই যাক না।”

ততক্ষণে বিকেলের জলখাবারের সময় হয়ে গেছিল। চিড়েভাজা, ডালমুট, কুচো নিমকি মাখা, জ্যাঠার আনা সন্দেশ। বলা বাহুল্য উট্‌কো এ ব্যাপারে খুব উৎসাহী। সঙ্গে আবার পাশের বাড়ির লংকাকে জুটিয়ে এনেছে। দুজনারি বারো বছর বয়স, ভয়ানক ভাব।

জলখাবারের পর ঘুড়ি নিয়ে উট্‌কো আর লংকা যেই বেরোতে যাবে, বুলিপিসি দুটো কলকাতার চিঠি দিয়ে বললেন, “হরকরাকে দিস। দাঁড়া, ওই টিকিটেই চলবে তো? নাকি বুড়োকে বাড়তি পয়সা দিতে হবে।” উট্‌কো বলল, “না। বাড়তি পয়সাকড়ি কিছু নেয় না হরু হরকরা। সে বলে— “আমরা সরকারের লোক। সরকার যা দেন সেই যথেষ্ট। চিঠি বিলি আমাদের ডিউটি, ওতে টিকিট থাকলেই হল। আজকাল ছাপ-টাপও কেউ দেখে না।” এ-সব কথা অবিশ্যি বলেনি উট্‌কো।

বাড়ি থেকে বেরোবার সময় ঘুড়ি লাটাই সিঁড়ির নিচে রেখে গেছিল। লংকা বলেছিল, “এগুলো দিয়ে কী হবে? আমিও হরু হরকরার কাছে যাই চল৷”

পেছন থেকে বড়দাদুর খাসবেয়ারা সীতেশ এক গাল হাসতে হাসতে ডেকে বলল, “বড়বাবু বলছিলেন, হরকরাকে জিজ্ঞেস করিস হীরেগুলোর কী করল? রেজিষ্ট্রি করা প্যাকেট তো হারাবার কথা নয়।”

ভারি রাগ হল উট্‌কোর। বেশ, তাই জিজ্ঞেস করবে। হরু হরকরা চোর নয়। কী ভালো ভালো গল্প বলে মহারানীর বিষয়ে। ইন্দিরা গান্ধীই বলতে চায় বোধ হয়, তা ঐরকম বলে। দেশের সকলের জন্য কত ভাবেন। ডাক টিকিটের দাম কত কমিয়ে দেছেন। অথচ বড়দাদুদের কথায় উল্টো মনে হয়। কী বাজে বকে বুড়োরা, মানে হরু হরকরা ছাড়া। আর ঠামু ছাড়া। উট্‌কো যা বলে ঠামু সব বিশ্বাস করে।

লংকা বলল, “ও কী! ওই বাঁশতলায় যাচ্ছিস ঠিক সন্ধ্যার আগে? জায়গাটা খারাপ। উট্‌কো চটে গেল, “ধেৎ! আমি তো প্রায়ই যাই। বাঁশতলার চায়ের দোকানে হরু হরকরা আমার জন্য অপেক্ষা করে। ওকে আমি দুটো করে গোলাপী বিড়ি দিই, সীতেশদার ঘর থেকে নিয়ে। না বলে নিই। নইলে দেবে না।”

লংকা বলল, “তোদের চিঠিপত্র নিরাপদে পৌঁছে দেয় আর তুই মোটে দুটো বিড়ি দিস? ছিঃ!” তার বেশি দেয়ই বা কী করে? হরু বলে— যাবার পথে একটা, ফেরার পথে একটা। তার বেশির কী দরকার যে নেব? কিচ্ছু জমাতে হয় না বুঝলি বাপ্‌, সব ছেড়েছুড়ে যেতে হয়। আমাকে দেখতে পাচ্ছিস তো!’

আশু পণ্ডিতের চায়ের দোকান। পণ্ডিত ওর পদবী। তবে সমসকিতও নাকি জানে। গুড় দিয়ে আর শুকনো শালপাতা দিয়ে কী ভালো চা বানায়। হরু খাইয়েছে। আশুর চিঠি পৌঁছে দেয়, আশু ওকে আর ওর বন্ধু যদি কেউ সঙ্গে থাকে, সবাইকে বিনি পয়সায় চা খাওয়ায়। পয়সাকড়ির ধার ধারে না এরা।

হরু হরকরা বোধহয় একটু ব্যস্ত হচ্ছিল, “এত দেরি করলে চলে, বাপ্‌? চাঁদ ডোবার আগে সিকি পথ কাবার করতে হয়।” উট্‌কো বলল, “তা দেরি হবে না, হরুদা? যেখানে যাবে চা খাবে, একটু বসবে, “তামাক খাবে, বিড়ি খাবে, শালপাতার চা খাবে, গাল-গল্প করবে, চিঠি দেবে, চিঠি নেবে— দেরি তো হবেই।”

ভাঁড়ে করে চা দিতে দিতে আশু পণ্ডিত বলল, “তা হরুদা একটু না বসলে আমরা কী করে রাজ্যের খবরাখবর পাব? কলকাতার পোস্টকাট হরুদা পড়ে শোনাবে বলে আমরা সারা হপ্তা পথ চেয়ে থাকি, কী বল ভাইসব?”

চায়ের দোকানে মশার জ্বালায় চাদর-মোড়া অন্য লোকও ছিল, ওরা এতক্ষণ খেয়াল করেনি। তারা বলল, “লিশ্চয় লিশ্চয়।” সীতেশদাদা বলে যে, বেশি ‘লস্যি লিলে সব ল হয়ে যায়।’

উট্‌কো বলল, “ঠামুর পোস্টকাটও পড়ে শোনাও নাকি?” হরু ভারি বিরক্ত, “এত দেরি করে এলে তা কী করে শোনাব? দুঃখ কর না, ভাইসব, আসছে হপ্তায় হবে। এখন রওনা না দিলেই নয়।” উট্‌কো আর লংকা ওর সঙ্গে চলল।

রোগা শুঁটকো মানুষটা, রোদে জলে চিঠি বিলি করে খেজুরের মতো গায়ের রং, পালকের মতো হালকা শরীর, বাতাসের মুখে ছুটে চলে। তা ওরা ওর সঙ্গে পারবে কেন? গোলাপি বিড়ি দুটো নিয়ে সে পা বাড়াতেই, উট্‌কো বলল, একটু সাহায্যের দরকার ছিল।’

ততক্ষণে বাঁশবাগান ছাড়িয়ে ঘোষদের আমবাগানে পৌঁছেছে ওরা। ঝড়ে একটা আমগাছ পড়ে গেছিল। টপ করে হরু তার ওপর বসে পড়ে বলল, “বল।” লংকা চাঁদের আলোয় ওকে ভালো করে দেখতে লাগল। বাঁশবনটা কেমন ধোঁয়া-ধোঁয়া, চেহারাটা ভালো করে মালুম দিচ্ছিল না। এখন দেখল কালচে মতো ইজের কুত্তা পরা, হাতে একটা তেলচুকচুকে বাঁশের লাঠি, কাঁধে ঝোলানো থলি। লংকা বলল, “লাঠিতে ঘণ্টি বাঁধা থাকে, ছবিতে দেখেছি।” হরু কাষ্ঠ হাসল। “সে আমি খুলে রেখেছি। এইসব বনে বাঘ নেই কিন্তু ডাকাতদের জানান দেবার কী দরকার? কই বাপ, বললে না কী সাহায্য?”

উট্‌কো হরুর গা ঘেঁষে বসে বলল, “তোমার গায়ে ধূপধুনোর গন্ধ পাই, হরুদা। দাদু আজ যা-তা বলেছে।”

“কী যা-তা— বলবি তো?”

“নাকি রেজিস্টার ডাকে পাঠানো এক প্যাকেট হীরে হারিয়েছে। ডাকের সবাই নাকি চোর!”

চাঁদের আলোয় হরুর মুখ গম্ভীর হল, “কে পাঠিয়েছিল? কাকে পাঠিয়েছিল? কোথা থেকে কোথায় পাঠিয়েছিল? কবে পাঠিয়েছিল?”

“দাদুর দাদামশাই মরার আগে তাঁর একমাত্র সন্তান দাদুর মা-কে পাঠিয়েছিল। আমাদের এই ভুবনডাঙার বাড়িতে, কলকাতা থেকে পাঠিয়েছিল। কবে তা জানি না। দাদু তখন জন্মায়নি।”

শুনে লংকার কী হাসি। কিন্তু হরু বেজায় রেগে গেল, “তার মানে আমাদের এই লাইনে রেজিস্টার প্যাকেট হারিয়েছিল? ডাকগাড়িতে আসছিল, না কি হরকরা আনছিল? আগে হরকরা আনত, পরে ঘোড়ার ডাক হলে, যদ্দূর গাড়ির রাস্তা, তার পর থেকে হরকরায় আনত। আমি বলছি কারো কোনও হীরের প্যাকেট হারাতে পারে না। রসিদ আছে?”

নাকি দাদামশাই মলে মামা সরদারি করে তাঁর সঙ্গে তাঁর ছেঁড়া গীতা পুড়িয়ে ছিলেন। তার মধ্যে রসিদ ছিল। মোট কথা আজ পর্যন্ত হীরে পৌঁছয়নি। নির্ঘাৎ চুরি গেছে, দাদু বলে।” হরু চিড়বিড়িয়ে উঠল, “নিশ্চয় ঠিকানা ভুল ছিল।” দাদু বলে তা হলে মরা চিঠির দপ্তর থেকে, যে পাঠিয়েছিল তার কাছে ফেরত যেত।”

হরু বলল, “হুঁঃ! তুমি তো সব জান! আমরা অত সহজে ছাড়ি না, বুঝলে? বছরের পর বছর ঠিক মালিককে খুঁজে বেড়াই। আমার কাছেই একাট আলাদা পুঁটলি আছে, এদিককার যত সব পথ-হারা চিঠি, পার্সেলের। তাদের ঠিকানা পাওয়া যায় না। এই দেখ—!”

কাঁধের ঝুলি নামিয়ে হরু বলল, “একবার অজয় নদীর বানের জলে ডাকের থলি পড়েছিল। বহু চিঠি প্যাকিটের নাম ঠিকানা ধুয়ে গেছিল। কিন্তু হারায়নি। চুরিও যায়নি। বুঝলে বাপ্‌? আমি পিরতিজ্ঞে করেছি সবগুলো বিলি না করে ছুটি নেব না, হ্যাঁ। এ লাইনে চোরটোর নেই!”

ঝুলির মধ্যে খুদে একটি বাক্স। সেটি গামছার ওপর উপুড় করে ফেলতেই দশ-বারোটা ছোট বড় খাম প্যাকেট ছড়িয়ে পড়ল। হরু বলল “কী নাম ছিল মায়ের সেটা তো জান?” বগলাদেবী। “বরের কী নাম?” “বর কেন আসবে, হরুদা, দাদুর মা’র তো বিয়ে হয়ে গেছিল।” আহা, কর্তার কী নাম ছিল? “ও তাই বল। ভজহরি শর্মা।”

চাঁদের আলোয় ঘাঁটাঘাঁটি করে খুদে একটা নোংরা ন্যাকড়ায় সেলাই করা, গালা লাগানো প্যাকেট উট্‌কোর হাতে দিয়ে হরু বলল, “এই নাও বগলাদেবী। আর কিছু পড়া যাচ্ছে না। ভুল হয়। তাই বলে চোর বলো না।” এই বলে হাউহাউ করে হরু হরকরা কেঁদে ফেলল। উট্‌কো অপ্রস্তুতের এক শেষ! “ও হরুদা, আমি কখনো তোমাকে চোর ভাবতে পারি? ওরাও কেউ তোমাকে চোর বলেনি। যাবে একদিন আমাদের বাড়িতে? খালি বলছিল ডাকে সব চুরি যায়!”

শুনে হরু ফিক করে হেসে ফেলে বলল, “তা যাব না। কিন্তু এই আমি তোকে বলে দিলাম, এই যে রং-ওঠা, নাম-ঠিকানা-ধোয়া, ভুল-নাম-লেখা তেরোটা চিঠি বাকি রইল, এর পেরতেকটির মালিক খুঁজে বের করে তবে আমি ছাড়ব। তাপ্পর ছুটি নেব। বয়স হয়েছে, আর পারিনে। তোরা তখন অন্য লোক দিয়ে চিঠি পাঠাস। প্যাকিটটা বড়দাদুকে দিস, ওনার মায়ের জিনিস। ঠিকানা নেই, তাই সেকাল থেকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি! আবার বলে কি না ডাকে জিনিস চুরি যায়! ছিঃ!”

এই বলে হরুদা উঠে পড়ল। উট্‌কো বলল, “ও হরুদা, ও-সব একশো বছর আগেকার চিঠিপত্র, ওর মালিক তুমি এখন কোথায় খুঁজে পাবে? ওগুলো মরা চিঠির আপিসে জমা দিয়ে দাও। এখন যেন কী নতুন নাম হয়েছে জ্যাঠা বলছিল।

গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে তেরচা হয়ে একটা চাঁদের কিরণ উট্‌কোর হাতে ধরা প্যাকেটের ওপর পড়ল, একটু ফেটে গেছে, মনে হল ভেতরে কী চকচক করছে। উট্‌কো বলল, “ও হরুদা— ওদের কোথায় খুঁজবে?”

হরু হরকরা বলল, “কেন সেকালে!” এই বলে ওদের চোখের সামনে সেই চাঁদের কিরণটাতে টপ করে উঠে পড়ে, কিরণ বেয়ে হাঁটতে হাঁটতে ওদের চোখের বাইরে চলে গেল। উট্‌কো আর লংকা সেখানে আর এক মুহূর্তও দাড়াল না।

বাড়ি পৌঁছে হাঁপাতে হাঁপাতে বড়দাদুকে প্যাকেটটা দেবামাত্র তিনি সেটা কেটে খুলে হাতে একটা হীরের সীতাহার তুলে ধরে হাঁ করে চেয়ে রইলেন।

তারপর কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, “এ যে দিদিমার সেই সীতাহার, মা’র কাছে কতবার শুনেছি। এই জলে-ধোয়া পুরনো ধুরধুরে প্যাকেট তুই কোথায় পেলি?” উট্‌কো হাঁউমাউ করে এমনি কাঁদতে লাগল যে দুঃখের চোটে জাল কেটে বেরিয়ে এসে গুবরে ওর মুখে মাথায় দুটো শিং-ই বুলিয়ে দিতে লাগল।

লংকা সব বলল। “তা বড়রা কি সহজে কিছু বিশ্বাস করে। ঠিক হল কাউকে কিছু বলা হবে না। কাল সন্ধ্যায় নিজেরা গিয়ে হরু-হরকরাকে ধন্যবাদ আর কিছু বকশিশ দিয়ে আসবে। এমন বিশ্বাসী লোক আজকাল দেখা যায় না।

কোথায় হরু হরকরাকে পাবে যে ধন্যবাদ দেবে। পরদিন সন্ধ্যায় লংকার আর উট্‌কোর সঙ্গে অম্বিকাজ্যাঠা, কলকাতা থেকে ফোন করে ডেকে আনা উট্‌কোর বাবা, পাশের বাড়ির লংকার বাবা, ব্যোমকেশ কাকা, সীতেশদা গেল। বাবা আর জ্যাঠা ছাড়া সবাই শুনল বাঁশবনে মোটা মোটা খরগোশ শিকার করতে যাওয়া হচ্ছে। লাঠি, গুলতি, এয়ার-গান, এইসব সঙ্গে গেল।

কোথায় কী! লংকা আর উট্‌কো সেই বাঁশবাগানটাকে খুঁজেই পেল না, তা আশু পণ্ডিতের শালপাতার চায়ের দোকান আর হরু-হরকরা! ওদের খোঁজাখুঁজি দেখে নবু মণ্ডলের কী হাসি! সে বলল, “ছিল বটে বাঁশবন একশো বছর আগে। কোনকালে সব বেচেবুচে সাফ! খরগোশ চাও তো ইলেমবাজার ছাড়িয়ে শালবনে খোঁজ। বাস যায়।” সব শুনে দাদু একেবারে থ! উট্‌কো আর লংকা গাঁজাখুরি গল্প বলতে ওস্তাদ, কিন্তু হিরেগুলো তো আর গাঁজাখুরি নয়। উট্‌কোকে বলেওছিল হরুদা, কারো কাছে এসব কথা পেরকাশ করলে এমনই হবে।

আর কখনো ওরা সেই বাঁশবন খুঁজে পায়নি। চিঠিপত্র আজকাল পাঁচ দিনে, রেলের ডাকেই যায়। নয়তো স্বপনকাকা হাতে করে পৌঁছে দিয়ে আসে।

________

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *