হরি পণ্ডিত – লীলা মজুমদার

হরি পণ্ডিত – লীলা মজুমদার

পুজোর ছুটিতে পশ্চিমে—যাকগে জায়গাটার নাম করলাম না—দাদুর বাড়ি গিয়ে ভজু লক্ষ্য করল যে পাশের বাড়িটা এবাড়ি থেকে দেখা যায় না। সেখানে হরি পণ্ডিত থাকেন, দাদুর সঙ্গে নাকি ছোটোবেলায় দারুণ ডাংগুলি খেলতেন, দাদুর প্রাণের বন্ধু। তারপর অনেক বছর ছাড়াছাড়ির পর বুড়ো বয়সে আবার পাশাপাশি থাকতে এসেছেন।

হরি পণ্ডিত রোজ-রোজ যখন তখন দাদুর কাছে টাকাকড়ি চান। দাদুও যা পারেন দেন। কেউ কিছু বললে বলেন, ‘আহা! ও তো আর নিজের খাওয়া পরার জন্য নেয় না—সে তো আমি এমনিতেই দিয়ে থাকি—এ টাকা দিয়ে ও এক অভাবনীয় গবেষণার কাজ করছে।’

ভজু বলল, ‘কি অভাবনীয় গবেষণা দাদু? মরা মানুষ জ্যান্ত করবার গবেষণা?’

দাদু শিউরে উঠলেন, ‘আরে না না, তার চেয়েও ঢের গুরুতর ব্যাপার। ঠিক অর্ধেক কাজ হয়েছে, বাকি অর্ধেক না হলে কাউকে কিছু বলা যায় না। বললে সর্বনাশ হবে!’

এ-কথা শুনে সবাই হাসতে লাগল। দাদু একটু চটে গেলেন। বললেন, ‘তা তোরা হাসতে পারিস। কিন্তু অদ্ভুত মাথা ওর। পৃথিবীতে হেন জায়গা নেই যেখানে গিয়ে ও গবেষণা না করেছে, খেতাব মেডেল পুরস্কার না পেয়েছে। সে-সব বুঝবার মতো বিদ্যেবুদ্ধি তোদের থাকলে তবে তো। এখনো যেটা নিয়ে কামড়ে পড়ে আছে সেটা শেষ করতে পারলে পৃথিবীতে যুগান্তর ঘটিয়ে দেবে। তোদের নিউক্লিয়ার বোমা-ফোমা নস্যাৎ হয়ে যাবে। অথচ সম্পূর্ণ অহিংস। এতটুকু চিহ্ন কেউ খুঁজে পাবে না। দুঃখের বিষয়, টাকার অভাবে কাজটা শেষ করতে পারছে না।’

এই বলে দাদু এমনি জোরে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন যে টেবিলের ওপর রাখা 2-3 দিনের খবরের কাগজ ফড়ফড় করে উঠল।

ভজুর মামাতো ভাই পল্টু বলল, ‘তাহলে এখন এ-কথা কেন?’ দাদুর কি দুঃখ, ‘আরে’ তাই তো বলছি। গবেষণা গবেষণা করে খেপে গেল। চাকরিবাকরি করল না, বিয়ে-থাও করল না। পূর্ব বাংলায় জমিদারি ছিল। সেখান থেকে টাকা আসত। নিজে না খেয়ে না পরে, সব টাকা ঢালত গবেষণায়!’

‘গবেষকরা তো সরকারের কাছ থেকে পায়। উনি নেন না কেন?’

‘নিত রে নিত। তাতে কোনো লজ্জা নেই। কিন্তু বছরের পর বছর কাজ করে যাচ্ছে, কোনো ফল দেখাচ্ছে না, কাউকে কিছু ভেঙেও বলছে না—দিয়েছে সরকার সব সাহায্য বন্ধ করে!’

এই বলে দাদু এতক্ষণ চুপ করে থাকলেন যে এরা বিরক্ত হয়ে উঠল, ‘বল না তারপর কী হল? গবেষণাটা কী অন্তত সেটুকু বল।’

দাদু উঠে পড়ে চ্যাঁচাতে লাগলেন, ‘ও সাধুচরণ, ও নটবর, পণ্ডিতমশায়ের বিকেলের দুধ-সন্দেশ দিয়ে এলি না!’ বলে পিট্টান।

দেখে দেখে গা জ্বলে। আধ ময়লা, ছেঁড়ামতো জামা-কাপড় গায়ে ; এ-বাড়ি থেকে চার বেলা খাবার না গেলে উপোস, সে নাকি আবার পৃথিবীতে যুগান্তর ঘটাবে! থেকে থেকে উঁচুনীচু দু-সারি দাঁত বের করে বলে ‘ও লাটু, তোর কাছে বড্ড ঋণী হয়ে যাচ্ছি যে রে। তা ভাবিসনে, সব শোধ কবে দেব ; তার চেয়েও ঢের বেশি দেব। আমার গবেষণার ফল-পাকড় তোর এই নাতি দুটোকে দিয়ে যাব—’

সঙ্গে সঙ্গে ভজু পল্টু পণ্ডিতমশায়ের কাঁধে ঝুলে পড়ল, ‘বলুন, পণ্ডিতমশাই, কীসের গবেষণা। আমরা রোমাঞ্চ-সিরিজ পড়ি কী না, এ-সব ব্যাপার বড্ড ভালো লাগে। যতটুকু করেছেন, ততটুকুই বলুন।’

পণ্ডিতমশাই ঘাড় ঝাঁকি দিয়ে ওদের ঝেড়ে ফেলে দিয়ে বললেন, ‘আঃ, ঝামেলা করো না। সবটা বলতে পারলে যুগ-পরিবর্তন। অর্ধেকটা বললে সর্বনাশ!—ও লাটু আমার ফতুয়াটা পাচ্ছিনে। কী জানি হয়তো—’ এই বলে জিব কেটে তাড়াতাড়ি চলে গেলেন। ধাপ্পা দেবার আর লোক পেলেন না?

কিন্তু দাদু কিচ্ছু শোনেন না। উলটে বলেন, ‘বড়োলোকের ছেলে, দুর্দিনে পড়েছে, তোরাও যদি ওকে টিটকিরি দিস, আমার কিছু বলবার থাকে না।’ মনে হল বেশ দুঃখিত হয়েছেন।

ওরা একদিন সকালে গিয়ে পণ্ডিতমশায়ের বাড়ি দেখে সেটি স্রেফ একটি ধবংষস্তিূপ। পল্টু বলল, ‘ঘাঁটলে ওর মধ্যে থেকে অশোকের শিলালিপি বেরিয়ে পড়াও বিচিত্র নয়।’ গবেষণা হয় গোয়াল-ঘরে। সেটি আষ্টে-পৃষ্টে বন্ধ, দরজা-জানলা লোহার তৈরি—নিশ্চয় দাদুর খরচায়—ভেতর থেকে কোনো সাড়া-শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। তবু কেমন মনে হচ্ছিল থেকে থেকে মাটিটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। চারপাশের গাছপালাও কেমন শুকনোপানা।

তবু পল্টু বলল, ‘বুড়ো হয়ে গাছ মরেছে। গত পঞ্চাশ বছর তো কেউ জল কিংবা সার দেয়নি।’ মোট কথা পাখিও চোখে পড়ল না। ওরা বাড়ি ফিরে এসে দাদুকে সে-কথা বলতেই তিনি বললেন, ‘হুঁম। ওখানে যেতে মানা করিনি? একেবারেই নিরাপদ নয়। তখন তোদের মা-বাবাদের কী বলব বল দিকিনি!’

ওরা তো হাঁ! ওই শুটকো খেমো লোকটা বেড়াল দেখলে মুচ্ছো যায়—ওর বাড়িতে যাওয়া নিরাপদ নয়! দাদু বলে কী! তবে মাটিটা কাঁপছিল সত্যি, হয়তো ডাইনামো চালাচ্ছেন পণ্ডিত। যা ক্যাবলা দেখতে, ফেটেফুটে যাওয়া বিচিত্র নয়! খুব হাসাহাসি করল ওরা পণ্ডিতকে নিয়ে।

এরপর পর-পর কতকগুলি এমন ব্যাপার ঘটল যে কিছুদিন পণ্ডিতমশায়ের কথা ওদের মনেই হল না। প্রথম দিন আদালত থেকে ক-জন লোক এসে দাদুকে কী সব বলে গেল। শুনে দাদু শুয়ে পড়লেন, খেলেন-দেলেন না, কথাও বললেন না। সন্ধেবেলা জলখাবার খেতে পণ্ডিতমশাই এসে ব্যাপার দেখে বললেন, নিশ্চয় সেই জামিনের ব্যাপার! বলিনি আত্মীয়াই হক আর যে-ই হক, লাখ টাকার জামিন কক্ষনো হয়ো না। লাখ টাকা দিতে হলে ঘটিবাটি বেচতে হবে! তা সে তো শুনলে না!’

ভজু পল্টু তো অবাক। বেশ বলেছেন পণ্ডিত! নিজে এদিকে দাদুর মাথায় হাত বুলিয়ে কম সুবিধে করে নিচ্ছেন না। পণ্ডিতমশাই বলে চললেন, ‘আরও হাজার পঞ্চাশেক হলেই আমার এটাও কমপ্লিট হয়। তখন আর দেখতে হবে না। তোর সব দুশ্চিন্তা দূর করে দেব।’

দাদু এতক্ষণে কথা বললেন, ‘আর ততদিন?’ ভজু পল্টু এক সঙ্গে বলল, ‘কেন আমরা আছি, দাদু!’ দাদু একটু হাসলেন। হঠাৎ পণ্ডিত বললেন, ‘ভালো কথা। তোর আবার ভাবনা কীসের? সেই কিপ্টে মামাতো দাদা না তোকে তার যথাসর্বস্ব লিখে দিয়ে গেছেন! রেডিয়োতে বলল তিনি সগগে গেছেন।’

পণ্ডিতমশাই জল খাবার খেয়ে হাসতে হাসতে বিদায় নিলে ভজু পল্টু বলল, ‘সত্যি, দাদ? তোমার মামাতো ভাই তোমাকে সব দিয়ে গেছেন?

দাদু বললেন, ‘তার নিজের এক দুর্দান্ত ভাই আছে। জেলে জেলে জীবন কাটায়। চোর, ঠক, ঠ্যাঙাতে—’ এই অবধি বলতে না বলতে বাইরে থেকে তিনটে বিশ্রী চেহারার লোক ঢুকল। প্রত্যেকের হাতে ছোরা। দাদু আশ্চর্য হয়ে বললেন, ‘এ কি, মোহন! তুমি কবে ছাড়া পেলে?’

সবচেয়ে বিশ্রী যার চেহারা, সে কাষ্ঠ হেসে বলল, ‘না, পেলে তোমার বোধ হয় সুবিধে হত? এখন ভালোয় ভালোয় সেই তিনজনের সই দেওয়া কাঁচা দানপত্রটি বের করে দাও দিকিনি, নইলে নাতিদের জন্য শোক করতে হবে।’

সঙ্গী দুটি দরজাটা বন্ধ করে তাতে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল। বিশ্রী লোকটা তাদের সামনে দাঁড়িয়ে হাত পেতে বলল, ‘কই, দাও দিকিনি, আমি ধৈর্যের জন্য বিখ্যাত নই।’

দাদু ভজু পল্টুকে বললেন, ‘নড়িস নে।’ তারপর দেরাজ খুলে দলিল খুঁজতে লাগলেন। মোহন লোকটার তেড়িবেড়ি বেশি, ‘ন্যাকামো হচ্ছে নাকি? দাও শীগগির—’ তারপরেই মনে হল পেছনের জানলার দিক থেকে এক ঝলক আলো দেখা গেল। চোখ ঘষে ভজু পল্টু দেখল সেই তিনটে লোক অদৃশ্য হয়ে গেছে।

সঙ্গে সঙ্গে দাদু লাফিয়ে উঠলেন, ‘হরি! হরি! এ কী কাণ্ড করলে!’ বলে ছুটে বেরিয়ে এলেন। চারদিক অন্ধকার, চুপচাপ, কেউ কোথাও নেই!

দাদু হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। ডাক্তার, হাসপাতাল, ওষুধপত্র করে বাকি রাতটা কাটল। সেই লোকগুলির কথা কাউকে বলা হল না।

সকালে দাদুকে অনেকটা সুস্থ দেখে, ওরা কৌতূহল রাখতে না পেরে সটাং হরি পণ্ডিতের বাড়ি গিয়ে হাজির হল।

সব শান্ত, চুপচাপ, দু-একটা পাখি ওড়া-উড়ি করছে আর গোয়ালঘরের জায়গাটা একটা ফাঁকা শূন্য মাঠ। হরি পণ্ডিতকেও কোথাও দেখতে পেল না। ওঁরা ভাঙাচোরা বাড়িতে কেউ কোনো দিন ছিল বলে মনে হল না।

সুস্থ হয়ে বাড়ি এসে দাদু ওদের বললেন, ‘যা হবার তা হয়ে গেছে। এই নিয়ে তোরা আর কাউকে কিছু বলিস নে। হরির গবেষণা এতটা এগিয়ে ছিল যে আলোর রশ্মি দিয়ে সব কিছুকে অণুতে পরিণত করে দিতে পারত। আবার পড়ে দেবার কাজটি শেষ হয়নি। আর হবেও না।

ভজু পল্টু ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘কিন্তু উনি গেলেন কোথায়? কত খুঁজলাম, পেলাম না।’ দাদু একটা বড়ো খাম খুলতে খুলতে বললেন, ‘গেছে মহাশূন্যে। গবেষণার শেষে আঁক মিলছিল না।’ এই তো গেল ব্যাপার। বাকি শুধু রইল দাদুর সম্পত্তি পাওয়ার সুখবর। তার অর্ধেক দিয়ে হরি পণ্ডিতের পোড়া বাড়ির জায়গায় একটা বিজ্ঞান কেন্দ্র করে দিয়েছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *