হরিহরাত্মা – শিশির বিশ্বাস

হরিহরাত্মা – শিশির বিশ্বাস

মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য ভুটভুটি ধরা গেল না। হরিশঙ্কর যখন ঘাটে পৌঁছোলেন, শেষ ভুটভুটি তখন এগিয়ে গেছে অনেকটাই। রাতে খড়গলির ঘাট থেকে জিরাট যাওয়ার এটাই শেষ ভুটভুটি। অথচ রাত এমন কিছু বেশি নয়। সবে আটটা। তার উপর আজ সপ্তমী পুজো। বছর কয়েক আগেও এই দিনে রাতভর ভুটভুটি চলত। এই বাইচচর থেকে দল বেঁধে মানুষ পুজো দেখতে যেত ওপারের জিরাটে। জিরাট থেকেও অনেকে আসত বাইচচরের পুজোয়। তখন গোটা পাঁচেক পুজো হত এদিকেও। গ্রাম হলেও বাইচচর তখন হেলাফেলার নয়। মস্ত গ্রাম। হাজার কয়েক মানুষের বাস। তিনটে স্কুল। বিডিও, পঞ্চায়েত আর ইরিগেশন অফিস। গমগম করত। নদীর ভাঙনে মাত্র বছর পনেরোর মধ্যে সব শেষ। বাড়ি, জমি হারিয়ে অনেকেই গ্রাম ছেড়ে গেছে। যারা আছে, তারা দিন গুনছে, যদি কোনও দিন মা গঙ্গা ফের মুখ তুলে তাকান, সেই আশায়। এই খড়গলির ঘাটের কাছেও আগে বড়ো একটা পুজো হত। এই সপ্তমীর রাতে তখন মানুষের ঢল। মেলা, দোকানপাট, নাগরদোলা, চরকিপাক আর নৌকো বাইচ। সন্ধের পরেও আলোর রোশনাই, মানুষের মেলা। আর আজ নিশুতি থমথমে রাত। ঘাটের পাশে ছোটো এক দোকান, মহামায়া স্টোর্স। একসময় বেশ বড়ো ছিল এই দোকান। পাওয়া যেত সবকিছু। এখন টিমটিম করে টিকে আছে। শেষ ভুটভুটি ছেড়ে যেতে ঝাঁপ ফেলার তোড়জোড় করছিল বছর পনেরো বয়সের একটি ছেলে। হরিশঙ্করকে দেখে ভুরু কুঁচকে বলল, ‘জ্যাঠামশাই যে! এই রাতে!’

‘হ্যাঁ রে ভাই। জিরাট যাব।’

‘কিন্তু ভুটভুটি যে ছেড়ে গেল জ্যাঠামশাই।’

‘সে তো দেখছি। দেখি এগিয়ে, কোনো জেলে নৌকো পেয়ে যাব ঠিক।’

ছেলেটার নাম কিশোর। বিলক্ষণ চেনে গ্রামের এই প্রবীণ মানুষটিকে। বলল, ‘এই রাতে একা নৌকোর খোঁজে যাবেন! চলেন আমিও সঙ্গে যাই।’

‘না রে বাপু, সামনেই পরীক্ষা তোর। বাড়ি যা এবার। সময় নষ্ট করিসনে।’ প্রায় হাঁ-হাঁ করে উঠলেন হরিশঙ্কর। বড়ো ভালো ছেলে এই কিশোর। বাড়িতে বাবা অসুস্থ। মা-ছেলে মিলে এই দোকানের উপর নির্ভর করে কোনওমতে টেনে চলেছে সংসার। সেই সাথে পড়াশোনাও। এবার উচ্চমাধ্যমিক দেবে। হয়তো সেই সকালের পর পেটেও কিছু পড়েনি ছেলেটার। শহর কলকাতার ছেলেরা ভাবতেও পারবে না এসব।

মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে কিশোর আর কথা বাড়ল না। কী ভেবে দোকানের এক কোনা থেকে হাত দুয়েক লম্বা মোটা একটা লাঠি এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এটা রাখেন জ্যাঠামশাই।’

হরিশঙ্কর এবার আর আপত্তি করলেন না। বরং খুশিই হলেন। রিটায়ার করেছেন আজ প্রায় দশ বছর। সত্তরের কোঠায় বয়স হলেও দেখে বোঝার উপায় নেই। মনের জোরও অসাধারণ। এই শেষের ব্যাপারটা অবশ্য হরিশঙ্করের আজন্ম। খুব গরিব ঘরের মানুষ ছিলেন। এই কিশোর ছেলেটার মতোই মানুষ হয়েছিলেন খুব কষ্টের মধ্যে। তারপর স্ত্রী যখন মারা যায়, দুই ছেলে তখন একেবারেই নাবালক। কলকাতায় ভাড়া বাড়িতে থাকেন। দেখাশোনার কেউ নেই। বলা যায়, দুই ছেলের কথা ভেবেই ফিরে এসেছিলেন বাইচচরের এই গ্রামে বাড়িতে। কষ্ট হলেও এই বাইচচর থেকেই কলকাতায় অফিস করেছেন। ফিরতে অনেক রাত হয়ে যেত। তবে তাতে ছেলেদের সমস্যা হয়নি। বাড়িতে কাজের মানুষ ছিল। আর ছিল হরনাথ। বড়ো ভালো মানুষ ছিলেন ওই হরনাথ। ছেলেবেলার বন্ধু। একই ক্লাসে পড়তেন। কেউ সামান্য টিফিন আনলেও দুজন ভাগ করে খেতেন। সবাই বলত হরিহরাত্মা।

পড়া শেষ করে হরনাথ গ্রামের স্কুলেই মাস্টারি শুরু করেছিলেন। বিয়ে-থা করেননি। দুই ছেলেকেই তিনি সঁপে দিয়েছিলেন তাঁর হাতে। হরনাথ বিমুখ করেননি। হরিশঙ্করের দুই ছেলেই এখন সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার। বিদেশে বড়ো চাকরি করে। বাবাকেও নিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু রাজি করাতে পারেনি। বরং রাতদুপুরে ছেলেরা যখন ফোনে বাবার খবর নিত, সামান্য বিরক্তই হতেন কখনও। আসলে দুই ছেলে বিদেশে চলে যাবার পরেও হরনাথের সাহচর্যে হরিশঙ্কর কখনও একাকিত্ব বোধ করেননি। দুই বন্ধু তখনও সেই আগের মতো। সেই হরিহরাত্মা। কিন্তু হঠাৎই শেষ হয়ে গেল সব। মর্মান্তিক এক ঘটনায় হঠাৎই মারা গেলেন হরনাথ। হরিশঙ্করের দুঃখ এই কারণে আরও যে, সেই সময় তিনি দেশেও ছিলেন না। সেবার বড়ো ছেলে শিবশঙ্কর একরকম জোর করেই বাবাকে নিয়ে গিয়েছিল সঙ্গে। তিন কয়েক ঘুরে আসবেন। বলা হয়েছিল হরনাথকেও। কিন্তু রাজি করানো যায়নি। হরিশঙ্করের এখন মনে হয়, ছেলের কথায় রাজি না-হলে হরনাথ এভাবে হয়তো চলে যেত না।

কথাটা ভুল নয় খুব। ছেলেদের কাছে মাস খানেক ছিলেন হরিশঙ্কর। তার মধ্যেই ঘটে গিয়েছিল মর্মান্তিক ব্যাপারটা। বন্ধু চলে যাবার পরে সময় কাটাতে হরনাথ সন্ধের দিকে নবসাক্ষরদের এক স্কুলে পড়াতে যেতেন। মাইল পাঁচেক পথ। গঙ্গার পাড় ধরে সাইকেলে যাওয়া-আসা করতেন। সেদিনও গিয়েছিলেন। রাতে ফেরার সময় অন্ধকারে বুঝতে পারেননি, খানিক আগে কখন পাড় ভেঙে সেই পথ হারিয়ে গেছে নদীতে। বেশ জোরেই আসছিলেন। সাইকেল নিয়ে যদি জলে গিয়ে পড়তেন, বেঁচে যেতেন হয়তো। কিন্তু শূন্যে ছিটকে উঠে মাথা ঠুকে গিয়েছিল সামনে ভাঙন-কূলের শক্ত মাটিতে। ঘাড় ভেঙে তৎক্ষণাৎ মৃত্যু।

হরনাথের ওই হঠাৎ মৃত্যুর পরে বড্ড একা হয়ে গিয়েছেন হরিশঙ্কর। নইলে আজ এভাবে একা পথে বেরোতে হয় না। কবিগানের টানে এভাবে কতদিন রাতবিরেতে দুজন পাড়ি জমিয়েছে গ্রামের পথে। দিব্যি গল্পে মজে কোথা দিয়ে পেরিয়ে গেছে সময়। আসলে সেই ছেলেবেলা থেকে দুজনেরই কবিগানের দিকে টান। কোথাও কবিগানের আসর বসেছে। খবর পেলেই ছুটতেন। হরনাথ তো এসব নিয়ে খানিকটা ভাবনাচিন্তাও করতেন। আসরে দুই কবিয়ালের চাপানউতোর সামান্য খুঁত হলেই বন্ধুকে বলতেন, ‘এটা ঠিক হল না রে হরি।’

তবে ‘তরজা’ বা ‘খেউড়’ নয়, ওদের পছন্দ ছিল ‘মালসী’ আর ‘সখীসংবাদ’। সিনেমা, টিভির জাঁতাকলে পড়ে বাংলার এসব ক্লাসিক জিনিস আজ হারিয়েই গেছে প্রায়। তেমন উঁচু দরের কবিয়ালও আর নেই। তবু এই গ্রামের দিকে এখনও টিমটিম করে টিকে আছে কোনো মতে। তাই কোথাও কবিগান হচ্ছে খবর পেলে দুই বন্ধু যত দূরেই হোক ছুটতেন। অন্যথা হয়নি আজও।

তবে জিরাটের ওদিকে আজ যে কবিগানের আসর, তা আগে থেকে জানতে পারেননি হরিশঙ্কর। আসলে হরনাথের মৃত্যু বড়ো একটা ধাক্কা দিয়ে গেছে তাঁকে। বাড়ি থেকে আজকাল তেমন আর বের হন না। তবু আজ সপ্তমী বলেই সন্ধের পর পঞ্চায়েত মাঠের দিকে গিয়েছিলেন। ওখানে এখনও ছোটো করে পুজো হয় একটা। খবরটা সেখানেই পেয়েছিলেন। আর তারপর দেরি করেননি এক মুহূর্ত।

খবরটা যার কাছ থেকে পেয়েছিলেন, সেই নন্দ পাল অবশ্য বারণই করেছিলেন, ‘এই রাতে একা আর নাই বা গেলেন হরিশঙ্করদা। দিনকাল ভালো নয়।’

কিন্তু বলা বাহুল্য হরিশঙ্কর তাতে কান দেননি। তবে ঘাটে যে ভুটভুটি পাবেন না, সেটা ভাবেননি। তবে মনস্থির করতেও সময় লাগেনি। যদিও বেশ জানেন, এই রাতে কোনও মাঝি নৌকো পাবেন কিনা, বা পেলেও রাজি করাতে পারবেন কিনা। তবে সেসব নয়। হরিশঙ্করের মাথায় তখন পাক খাচ্ছিল হরনাথের কথা। আসলে কবিগানের সঙ্গে হরনাথের স্মৃতি যে জড়িয়ে আছে ভীষণ ভাবে। মানুষটার মৃত্যুর পর এই প্রথম চলেছেন কবিগানের আসরে। ভাবতে-ভাবতে কিশোরের দেওয়া সেই লাঠি হাতে নদীর পাড় ধরে দ্রুত পথ চলছিলেন হরিশঙ্কর। পথের ধারে বেগুন খেত। লকলক করে বেড়ে ওঠা গাছে চমৎকার বেগুন ধরেছে। কিন্তু ভাঙনে খেতের অনেকটাই ইতিমধ্যে তলিয়ে গেছে নদীতে। নতুন পথ এখন খেতের ভিতর দিয়ে। পায়ে-পায়ে মুড়িয়ে গেছে অনেক গাছ। এদিকে বেশিরভাগ জমিতেই তাই চাষবাস বন্ধ। ফাঁকা জমিতে কাশফুলের ঝাড় দোল খাচ্ছে বাতাসে। ছলাৎ ছলাৎ শব্দে ঢেউ আছড়ে পড়ছে পাড়ে। ভাঙা ঢেউয়ে চাঁদের ঝিকিমিকি। কিন্তু যতদূর চোখ যায় কোনও নৌকোর দেখা পেলেন না।

কাশফুলের ফাঁকা জমিটা পার হয়ে পোড়ো এক আম-লিচুর বাগান। কতক গাছ ভেঙে নদীগর্ভে চলে গেছে, কতক হেলে পড়ে দিন গুনছে। সেই বাগানের কাছে এসে হঠাৎ তাঁর নজরে পড়ল, ভাঙা পাড়ের নীচে ছোটো এক নৌকো। শুধু তাই নয়, অদূরে বাগানে এক গাছের তলায় দুটো মানুষ। ওকে দেখেই ঝট করে সেঁধিয়ে গেল ঝোপের অন্ধকারে। তবে ব্যাপারটাকে পাত্তা না-দিয়ে হরিশঙ্কর এগিয়ে যাচ্ছিলেন নৌকোর দিকে। হঠাৎ অন্ধকার ফুঁড়ে সেই লোক দুটো বের হয়ে এল। কর্কশ গলায় বলল, ‘এই বুডঢা ভাগ।’

এই গ্রামেই জন্ম হরিশঙ্করের। অপরিচিত কেউও কোনোদিন এভাবে তার সঙ্গে কথা বলেনি। আজও এই অঞ্চলে যথেষ্টই সম্মান তাঁর। তবু ব্যাপারটা গায় না-মেখে এগিয়ে চললেন। আর তখনই গাছপালার ফাঁকে আবছা আলোয় নজরে পড়ল ব্যাপারটা। বাগানে মালিদের জন্য একসময় ছোটো একটা ঘর ছিল। এখন পরিত্যক্ত। জনা কয়েক মানুষ ধরাধরি করে সেই ঘরের ভিতর থেকে মুখবন্ধ বড়ো একটা ভারী বস্তা নিয়ে চলেছে নৌকার দিকে।

ব্যাপার দেখে হরিশঙ্করের বুঝতে বাকি রইল না, লোকগুলো সাধারণ নয়। এভাবে এগিয়ে যাওয়া ঠিক হয়নি একেবারেই। মুহূর্তে পিছন ফিরতে যাবেন, লোক দুটো ছুটে এল ওর দিকে। একজনের হাতে বড়ো একটা ভোজালি। কেউ কর্কশ গলায় চেঁচিয়ে উঠল, ‘মার ডালো বুডঢাকো।’

যৌবনে একবার তাড়া করে ডাকাত ধরেছিলেন হরিশঙ্কর। এত সহজে হার মানার পাত্র নন। ভোজালি হাতে লোকটা ততক্ষণে এগিয়ে এসেছে আরও । হাতের লাঠিটা ধরাই ছিল। মুহূর্তে সেটা চালিয়ে দিলেন তার মাথা লক্ষ করে। আর্ত চিৎকার করে লোকটা মুহূর্তে মাটিতে পড়েই স্থির হয়ে গেল। এমনটা হবে ভাবতেও পারেনি তার সঙ্গী। তবে এসব অভ্যাস আছে তার। হতবুদ্ধি ভাবটা কাটিয়ে উঠতে তাই সময় লাগল না। মুহূর্তে কোমরে সার্টের তলায় হাত ঢুকিয়ে বের করে আনল একটা দেশি পিস্তল। লোকটার সঙ্গে আগ্নেয়াস্ত্র থাকতে পারে, ভাবেননি হরিশঙ্কর। তবু সামলে উঠে ফের হাতের লাঠি চালালেন। ওদিক থেকে আগ্নেয়াস্ত্রটাও গর্জে উঠল সেই মুহূর্তে। এক ঝলকা আগুন আর কান ফাটানো শব্দ।

জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন হরিশঙ্কর। তবে সেটা বোধ হয় মুহূর্তের জন্য। চোখ মেলেই বুঝলেন, পড়ে আছেন মাটিতে। পাশে একটা মানুষ। বয়স প্রায় তারই কাছাকাছি। তবে অন্ধকারে মুখটা দেখতে পেলেন না। মুহূর্তে ধড়মড়িয়ে উঠে বসে চারপাশে তাকালেন। সেই লোক দুটোকে দেখতে পেলেন না কোথাও। মাটিতে চাপ-চাপ রক্তের দাগ শুধু। হাঁ করে তাকিয়ে আছেন। পাশের লোকটা বলল, ‘শাবাশ মশাই! লাঠির দুই ঘায় ষণ্ডা দুটোকে শেষ করে দিলেন! এলেম আছে বটে!’

‘কিন্তু, কিন্তু কোথায় তারা? এর মধ্যেই সরে পড়ল’ অবাক হয়ে হরিশঙ্কর বললেন।

‘কী দরকার মশাই অত খোঁজে। তার চেয়ে চলুন দেখি সরে পড়ি। এরপর থানা-পুলিশ হবে। মেলা ঝামেলা।’

যুক্তি মন্দ নয়। এই বয়সে এসব হ্যাপায় না-থাকাই ভালো। চটপট উঠে পড়লেন তিনি। পাশে লোকটা বলল, ‘চলুন বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসি।’

শরীরটা ফের ঝরঝরে হয়ে উঠেছে। তবু লোকটার কথা ফেলতে পারলেন না। যা কাণ্ড হল। এরপর আর ঝুঁকি না-নেওয়াই ভালো। বললেন, ‘তাই চলুন, কিন্তু আপনাকে যে ঠিক চিনতে পারলাম না। এদিকে নতুন বুঝি?’

কিন্তু লোকটা সেই কথার জবাব না-দিয়ে দ্রুত পথ চলতে লাগল। তাল দিতে না-পেরে একটু পিছিয়ে পড়েছিল হরিশঙ্কর। হঠাৎ এক ব্যাপার ঘটল। নদীর পাড় ধরে সরু পায়ে চলা পথ। সামনের মানুষটা দ্রুত এগিয়ে চলেছেন। আবছা চাঁদের আলোয় হরিশঙ্করের নজরে পড়ল সামনে মানুষটা যেখান দিয়ে চলেছেন, সেখানে বড়ো একটা ফাটল। সাবধান করতে যাবেন, ফাটলটা আরও হাঁ হয়ে গেল। দুলে উঠল মাটি। বিশাল চাঙড়টা ভেঙে পড়বে এক্ষুনি। ছুটে গিয়ে হরিশঙ্কর যখন তাঁকে টেনে আনলেন, তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বিশাল চাঙড়টা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল নদীতে।

‘ধন্যবাদ মশাই।’ হাঁপাতে হাঁপাতে লোকটা বলল, ‘এই নিয়ে আর একবার প্রাণ পেলাম।’ কিন্তু সেই কথা কানেই গেল না হরিশঙ্করের। ততক্ষণে মানুষটার মুখের দিকে নজর পড়েছে। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বললেন, ‘আরে হরনাথ তুই! এ-এখানে কী করে এলি!’

‘কেন আসতে নেই বুঝি!’ ম্লান হাসল ওপক্ষ। ‘আসলে ব্যাপার কী জানিস, সবাই ভুল খবর দিয়েছিল তোকে, আমি মরিনি রে। দেখতেই পাচ্ছিস, বেঁচেই আছি দিব্যি। অবশ্য আজ এইভাবে তুই না-বাঁচালে অন্য রকম হয়ে যেত।’

‘কিন্তু, কিন্তু সবাই এমন মিথ্যে রটাল কেন?’ ভরু কুঁচকে উঠল হরিশঙ্করের।

‘সে অনেক কথা। পরে শুনিস। তার আগে বল, এই রাতে একা ওদিকে যাচ্ছিলি কোথায়।’

‘আর বলিস কেন। তুই নেই, তাই একাই বের হয়েছিলাম কবিগান শুনতে। তা হল আর?’ খুশিতে দু-চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল হরিশঙ্করের।

‘কবিগান!’ আনন্দে দু-চোখ নেচে উঠল হরনাথেরও। ‘কোথায় রে?’

‘জিরাটের ওদিকে। ষষ্ঠীতলার—।’

‘তাহলে চল যাই।’ হরিশঙ্করের কথা কেড়ে নিয়ে হরনাথ বললেন, ‘কতদিন যে দুজন একসাথে কবিগান দেখিনি।’

‘কিন্তু যাবি কী করে? শেষ ভুটভুটি চলে গেছে। এতক্ষণ খুঁজে একটা নৌকোও তো পেলাম না।’

‘কী দরকার নৌকোর।’ হরিশঙ্করের কথা প্রায় তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিলেন হরনাথ, ‘চল হেঁটেই পার হয়ে যাই।’

বলতে-বলতে বন্ধুর হাত ধরে হরনাথ নেমে পড়লেন জলে। হরিশঙ্কর অবাক হয়ে দেখলেন, কারও গোড়ালি ডুবল না। দিব্যি হেঁটে চলেছেন জলের উপর দিয়ে। সেই কতদিন আগের মতো খুশিতে গল্প করতে-করতে দুই বন্ধু চলতে লাগলেন ষষ্ঠীতলার মাঠে কবিগানের আসরের দিকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *