হরিপদ কেরানির কাঁটা

হরিপদ কেরানির কাঁটা – নারায়ণ সান্যাল

রচনাকাল : সেপ্টেম্বর 2000

প্রথম প্রকাশ : জানুয়ারি 2001

প্রচ্ছদশিল্পী : গৌতম রায়

উৎসর্গ : গৌতম রায়

.

গোপালপুর-অন-সী।

উড়িষ্যার গঞ্জাম জেলায় বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে গড়ে উঠেছে এই মনোরম সাগরবেলা। এককালে এই সমুদ্রতীর বিদেশী পর্যটকদের কাছে খুব প্রিয় ছিল। সারা শীতকাল ‘গোপালপুর-অন-সী’ থাকত জমজমাট। পুরীর ভিড় নেই, পুরীসমুদ্রের সেই কাকে-খাই কাকে-খাই প্রচণ্ড ঢেউও নেই।

বেলাভূমির প্রায় দক্ষিণপ্রান্তে, মুষ্টিমেয় হোটেলের ঘেঁষাঘেঁষি জটলা থেকে যেন একটু স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে দুর্গের মতো মাথা খাড়া করে দাঁড়িয়ে আছে একটি বিলাতী-কেতার হোটেল—’দ্য নূক’। হোটেল-মালিক—না মালিক নয়, মালকিন, মিসেস নোয়ামি ক্রোম। প্ৰায় আশি ছুঁই ছুঁই বিধবা। ওঁর স্বামী ছিলেন দক্ষিণ-পূর্ব রেলের এক জাঁদরেল অফিসার। বিশাল প্রাসাদটি বানিয়েছিলেন অবসর নেবার আগেই, কিন্তু ভোগ করে যেতে পারেননি। বাড়ি শেষ করতে করতেই ওপার থেকে ডাক এসে গিয়েছিল প্রৌঢ় মানুষটির। নিঃসন্তানা নোয়ামি হোটেলটার শেষ রূপারোপ করেছিলেন। লিজাকে ম্যানেজার বানিয়ে এই পান্থাবাসটি চালু রেখেছেন। লিজা ওঁর স্বর্গগতা ভগিনীর নাতনী। কনফার্মড স্পিনস্টার।

সমুদ্রমুখী দ্বিতল বাড়ি। প্রতিটি ঘর থেকেই জানলা দিয়ে সাগরসৈকতের দৃশ্য নজরে পড়ে। হোটেলের সামনে, ক্যানিউটের আদেশ লঙ্ঘন করে অথচ অমাবস্যার ভরা-কোটালের লক্ষ্মণের দেওয়া গণ্ডীর সীমারেখা স্বীকার করে সমুদ্রের জল যতদূর আসে তার থেকে প্রায় বিশ-মিটার ভিতরে সারি-সারি অনেকগুলি বিরাটাকার রঙিন ছাতা খাটানো। সেগুলির কাছাকাছি ইতস্তত ছড়ানো কিছু আরামদায়ক প্লাস্টিকের চেয়ার। সবই সমুদ্রমুখী এবং খালি। যেগুলি ভর্তি তাতে যাঁরা বসে আছেন তার অধিকাংশই আমাদের পরিচিত। সপরিবারে বাসু- সাহেব আর ব্রজদুলালবাবু।

ব্রজবাবুকে মনে আছে তো? ড্রেস-রিহার্সালের কাঁটার? তাঁরই ব্যবস্থাপনায় ও আগ্রহে এবার পুরীর বদলে এই গোপালপুরে অভিযান। ব্রজদুলাল অকৃতদার, একা মানুষ। অগাধ সম্পত্তি। গতবছর অল্পসময়ের ব্যবধানে তাঁর তিন-তিনটি ঘনিষ্ঠ বঙ্কুর অপমৃত্যু ঘটেছে। বিল শবরিয়া আর ডাক্তার ঘোষাল মারা গিয়েছিলেন বিষপ্রয়োগে আর একজন নিকটবঙ্কু ফাঁসিকাঠে ঝুলে। সেসব কথা বিস্তারিত বলা হয়েছে ‘ড্রেস রিহার্সালের কাঁটায়। ব্রজদুলাল তারপর তাঁর শ্যামবাজারের থিয়েটার হাউসটি বিক্রয় করে দিয়েছিলেন। মেলাঙ্কোলিয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। ডাক্তারে হাওয়া বদলের কথা বলেছিলেন। ওঁর নিজস্ব একটা ফাঁকা বাড়ি পড়ে আছে পুরীতে, কিন্তু সেটা যেন অভিশপ্ত। স্মৃতিবিজড়িত, ক্ষুধিত পাষাণ। তাঁর প্রকাণ্ড গাড়িটা নিয়ে তাই চলে এসেছেন এই গোপালপুর-অন-সীতে। সপরিবারে বাসু-সাহেবকেও পাকড়াও করে নিয়ে এসেছেন দিন-দশেক ছুটি কাটিয়ে যেতে। হোটেলের রিজার্ভেশান থেকে গাড়ি চালিয়ে পৌঁছে দেওয়া সব কিছু করেছে ওঁর একান্ত সচিব অশোক। সে নিজে অবশ্য ফিরে গেছে। ওই প্রকাণ্ড গাড়িতে সড়কপথে আসায় রানী দেবীর হুইল-চেয়ারটা আনতে কোনও অসুবিধা হয়নি।

সকালবেলা প্রাতরাশ সমাধা করে ওঁরা সার বেঁধে বসেছেন সমুদ্রের কিনারে। রানী দেবীর হাতে কী একটা মাসিক পত্রিকা। কিন্তু এক পাতাও পড়া হয়নি। একে সামুদ্রিক ঝোড়ো হাওয়া, তায় প্রতিনিয়তই কানে ভেসে আসছে আশপাশের কথাবার্তা। পত্রিকাটা মুড়ে রেখে পার্শ্ববর্তিনী সুদীপাকে বললেন, গোপালপুর কিন্তু পুরীর তুলনায় অনেক শান্ত।

চল্লিশ ছুঁই-ছুঁই অনূঢ়া সুদীপা বলে, সমুদ্রের শান্ত রূপটা ভালই লাগে। এখানে সাহস করে স্নান করা যায়। পুরীর ঢেউগুলো সবাই যেন দারা সিং। সুযোগ পেলেই ঠ্যাং ধরে পটকে দেবে। কপাল কেটে যায়, হাঁটু ছড়ে যায়। পুরীর সমুদ্রকে খুরে খুরে পেন্নাম। আমি তো বাপু পুরী গেলে ভুলেও জলে নামি না। এখানে দিব্যি রোজ স্নান করছি।

পায়েল, সুদীপার বান্ধবী—ওরা একই স্কুলে পড়ায়, কলকাতায়,—গ্রীষ্মের ছুটি হওয়ায় একটা ড-বেড রুম বুক করে একসঙ্গে আছে—বললে, সমুদ্র নিয়ে আমার কোনো কম্‌প্লেন নেই; কিন্তু এতটা নির্জনতা যেন বরদাস্ত হয় না। বুকের ভিতরটা কেমন যেন খালি খালি লাগে।

প্রৌঢ় কর্নেল সমাদ্দার বসেছিলেন অদূরে। এদিকে ফিরে বললেন, বটেই তো। সুটকেস ভর্তি যেসব জমকালো শাড়িগুলো এনেছেন তা পরে সী-বীচে পায়চারি করা বেহুদ্দো। দেখবে কে? দেখনেবালা কই?

সবাই হেসে ওঠে। সুদীপা জানে আত্মরক্ষার শ্রেষ্ঠ পন্থা এসব ক্ষেত্রে : প্রতি-আক্রমণ। বান্ধবীকে সাহায্য করতে তাই বলে, কেন? দেখবেন তো আপনি। একমাত্র আপনিই তো জানেন, লক্ষ্য করে দেখে রেখেছেন : কোন মহিলা একই শাড়ি পরে দু’বেলা বেড়াতে বেরিয়েছেন, কার শাড়ির সঙ্গে ব্লাউজ ঠিক ম্যাচ করেনি। তাই তো অতবড় একটা বাইনোকুলার নিয়ে এসেছেন কলকাতা থেকে

কর্নেল একটু ঘাবড়ে যান। বলেন, না, না। এটি আমার নিত্য সহচর। সার্ভিস যুগের বাইনো।

—আই নো।—প্রতি-আক্রমণ চালিয়ে যায় সুদীপা। এককালে ওইটার সাহায্যে শত্রুদের গোপন অবস্থান খুঁজতেন, এখন অবসর নেবার পর সুন্দরীদের গোপন অবস্থানের সন্ধান করেন। বিশেষ করে বহুদূরে যারা সমুদ্রে স্নানরতা।

রানী দেবী ঝগড়া-কাজিয়া থামিয়ে দেবার চেষ্টা করেন : তোমরা অহেতুক ওঁর লেগপুলিং করছ, সুদীপা আর পায়েল। আর আপনিও বুকে হাত দিয়ে বলুন তো কর্নেল সাহেব, এতটা নির্জনতা কী আপনারই ভাল লাগে? তাছাড়া ত্রিসীমানায় কোনো শপিং সেন্টার পর্যন্ত নেই যে, দু’দণ্ড সময় কাটাতে পারে মেয়েরা।

কথাটা লুফে নেয় অর্পিতা : বলুন তো মাসিমা। বেড়াতে এসে যদি শপিংই না করলাম তাহলে…

কৌশিক চট্জলদি পাদপূরণ করে, ‘ডেংচি-বিবি’ বন্ধ কী করে?

—’ডেংচি-বিবি’ মানে?

কৌশিক শাংকর-ভাষ্য দাখিলের সময় পায় না। কারণ সেই মুহূর্তেই সামুদ্রিক বাতাসে মিশ্রিত হলো ফরাসি সেন্টের একটি উগ্র সৌগন্ধ। সকলেই হোটেলের প্রবেশদ্বারের দিকে তাকালেন—মানে তাকাতে বাধ্য হলেন। সদর-দরজা পেরিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসছেন একজোড়া কপোত-কপোতী। কর্তার ঊর্ধ্বাঙ্গে প্রকাণ্ড একটা তোয়ালে, কাঁধে ব্যাগ, নিম্নাঙ্গে নীলরঙের সুইমিং-ট্রাংক। বলিষ্ঠ লোমশ জানুদ্বয়ের আ-প্রাইভেট-পার্টস্ অনাবৃত। কপোতীর পোশাক আরও বিচিত্র। তোয়ালের বালাই নেই। স্রেফ রানী কালার ‘বিকিনি’। শ্যামলা গায়ের রঙ, কিন্তু দেহ-সৌষ্ঠব অনিন্দ্য। এই জাতীয় কোনো নায়িকাকে দেখেই বোধহয় কালিদাস তাঁর সেই দিলতোড় ‘তন্বী-শ্যামা’ শ্লোকটা রচনা করেছিলেন। কারণ ‘বিকিনি’ পরিধান করায় দেখা যাচ্ছে এঁরও নামিতা নিম্ননাভি’; ইনিও ‘শ্রোণীভারাদলসগমনা’ এবং বরাঙ্গের ‘ভ্যাংদ্বয়’ স্তোকনম্রা। না হবে কেন? বয়স তো বহুদিন দেড়কুড়ি অতিক্রম করেছে।

কৌশিক ঊর্ধ্বমুখে একটি দার্শনিক স্বগতোক্তি ছেড়ে দেয় : সম্ভবত এঁরা দুজন সূর্যের এই তৃতীয় গ্রহেরই বাসিন্দা, ই. টি. নন।

অর্পিতা ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞাসা করে, ই. টি মানে?

—একস্ট্রা টেরিস্ট্রিয়াল জীব। ওই যাঁরা মাঝে-মধ্যে ফ্লাইং ডিকে চেপে খেয়ালবশে আমাদের সঙ্গে মূলাকাৎ মানসে পৃথিবীতে আসেন।

কর্নেল সাহেব বলেন, ওঁরা কাল একটু বেশি রাত্রে এসেছেন। আমি লাউঞ্জে বসে তখন একাই থার্ড পেগ্‌ ড্রাই-মার্টিনীটা শেষ করছি। ভদ্রমহিলাটিকে চেনা-চেনা মনে হলো; কিন্তু ঠিক—

পায়েল নিরীহের মতো প্রশ্ন করে, ভদ্রমহিলা কি তখনো ওই ‘বিকিনিটা’ পরেই ছিলেন? সুজাতা বলে, স্টপ্ য়োর কন্টিনিউয়াস্ লেগপুলিং, পায়েল। আপনারা কি এই নবাগত দম্পতিকে সত্যিই চিনতে পারেননি?

সুদীপা বলে, আমি পেরেছি। এঁরা চিনতে পারছেন না ওঁর গাত্রবর্ণের জন্য। মেকআপ- ম্যানের সেই দুধে-আলতা রঙের প্রলেপটা তো এখন নেই। উনি হচ্ছেন, টলিউডের মোস্ট ফেমাস নায়িকা—পর পর তিনটি বক্স-অফিস বিদীর্ণ করা নবাগতা আর্টিস্ট : অনামিকা সেন।

–‘সেন’? না ‘ঘোষাল’? জানতে চায় পায়েল।

সুদীপা বলে, আমি ওঁর ‘ম্যারিটাল-হিস্ট্রি’ নিয়ে গবেষণা করিনি। এটুকু শুনেছি যে, বেশ কয়েকবার উনি বিবাহ করেছেন, কিন্তু প্রথম অভিনয় কালে যে উপাধিটা ছিল— ‘সেন’—সেটি পরিবর্তন করেননি।

একটু দম নিয়ে সুদীপা আবার বললে, এটি ওঁর চতুর্থ স্বামী : সোমেশ্বর ঘোষাল। ওদের বিয়ে হয়েছে মাস-তিনেক। এটা ওদের ‘হনিমুন ট্রিপ’ নয়, সে বখেড়া মিটেছিল কাঠমণ্ডুতে।

সুজাতা বলে, ওরে বাবা। তুমি ওদের বিষয়ে এত নাড়ির খবর পেলে কোত্থেকে?

পায়েল সমাধান দাখিল করে, সুদীপা স্কুলে বাঙলা পড়ায়, আবার ফ্রি-লান্স জার্নালিজ্‌ম্‌ও করে। একাধিক সিনেমা পত্রিকায় লেখে।

অর্পিতা জানতে চায়, ওই মিস্টার সোমেশ্বর ঘোষাল কী করেন?

—বর্তমানে ধর্মপত্নীর খিদ্‌মগিরি। এককালে ভাল ফুটবলার ছিলেন। সিনিয়ার ডিভিশন টিমে ফরোয়ার্ডে খেলতেন।

অর্পিতা আবার জানতে চায়, কোন টিমে?

—এক-এক সিজনে এক-এক টিমে। কেন আপনি জানেন না, ফুটবল মরসুমের আগেই নামকরা ফুটবলাররা কোরাসে সেই বিখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীতটা গাইতে থাকেন: ‘কে নিবি গো কিনে আমায়, কে নিবি গো কিনে?”

ইতিমধ্যে হোটেল থেকে কিছুটা দূরে ‘খিদ্‌মদ্‌গার’ তার তোয়ালেটা বিছিয়ে দিয়েছে। অনামিকা তার সর্বাঙ্গে ইতালিয়ান অলিভ-অয়েল বার্তোল্লি মর্দন করতে শুরু করেছে।

এতক্ষণে এসে উপস্থিত হলো সমরেশ পালিত। সেও সুইমিং ট্রাংক পরে এসেছে। সবাইকে সম্বোধন করে বলে, গুড মর্নিং এভরিবডি। আপনারা এখনো কেউ জলে নামেননি দেখছি। এরপর বালি যে তেতে উঠবে।

কর্নেল বলেন, আমরা তৈরি হয়ে নিতাম; কিন্তু ইতিমধ্যে একটি বাধার সৃষ্টি হয়েছে। কেউ স্থানত্যাগ করতে চাইছেন না।

সমরেশ একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়ে। স্ত্রী অর্পিতার দিকে ফিরে বলে, তুমি চট্‌ করে পোশাক-টোশাক বদলে এস। আমরা এখনই জলে নামব।—তারপর কর্নেলের দিকে ফিরে বলে, হ্যাঁ, কী-একটা বাধার কথা বলছিলেন যেন আপনি। কোনও হাঙর-টাঙর কি পথ ভুলে এ-পাড়ায় এসে পড়েছে?

অর্পিতা স্নানের পোশাক পরতে চলে গেল সমরেশের হাত থেকে চাবিটা নিয়ে। কর্নেল বললেন, আপনি বুলস-আই হিট করেছেন মিস্টার পালিত। হাঙর। না, হাঙর নয় : কিলার হোয়েল। ওই যাকে বলে : ‘অর্কা’, অর্থাৎ জ’স ছবির নামভূমিকায় যিনি অভিনয় করেছিলেন।

সমরেশ বসেছিল কপোত-কপোতীর দিকে পিছন ফিরে। অভিনব দৃশ্যটা এখনো তার নজরে পড়েনি। বলে, হেঁয়ালিটা একটু ভেঙে বলবেন, কর্নেল সাব?

কর্নেল একটি ফৌজি লব্‌জ্‌ ঝাড়লেন, সোলজার। ‘বাউট টার্ন।

সমরেশ বুঝল। একশ আশি ডিগ্রি ঘুরে বসল। তারপর সে যেন স্থানকালপাত্র ভুলে গেল। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। ভাল করে দেখে নিয়ে আবার বসে পড়ল। অসঙ্কোচে টেনে নিল কর্নেল সাহেবের হাত থেকে তাঁর 8”x4” বাইনোকুলারটা। অসঙ্কোচেই চোখে লাগাল। যেন বজ্রাহত হয়ে গেছে সে।

ইতিমধ্যে তৈলমর্দনান্তে বাংলা ফিল্‌ম্ তথা সিরিয়ালের দিতোড় নায়িকা উবুড় হয়ে শুয়েছেন তোয়ালের উপর। সানট্যান্ড হবার বাসনা তাঁর। অগত্যা ছুটি পেয়ে ওঁর খিদ্‌মদ্‌গার এদিকে পায়ে-পায়ে এগিয়ে আসে। তোয়ালেটা গাত্রচ্যুত হওয়ায় তার লোমশ দেহের নব্বই শতাংশই নগ্ন। যুক্তকরে সকলকে সমবেত নমস্কার করে বলে, গুড মর্নিং এভরিবডি। লেডিজ অ্যান্ড জেন্টেলমেন। আমরা দুজন কাল রাত্রে এসেছি। উঠেছি বাইশ নম্বর ঘরে। থাকব দিনসাতেক। আপনাদের কারও সাথে আমাদের আলাপ নেই। সেই কাজটা সারতেই উঠে এলাম। সর্বাগ্রে নিজের পরিচয়টা দিই। পিতৃদত্ত নাম : সোমেশ্বর ঘোষাল। এককালে ছিলাম : ফুটবলার। সিনিয়ার ডিভিশনে রাইট-ঈন খেলতাম। এক শ্যালিকাপুত্র স্টপারের লেঙ্গিতে ডান ‘ফিমার বোনটা’ বল-সকেট জয়েন্ট থেকে বেরিয়ে আসে। আমরা, হ্যাঁ পেনাল্টি পেয়েছিলাম। জিতেও ছিলাম। কিন্তু আমি আর ফুটবল ময়দানে ফিরে আসতে পারিনি।

কর্নেল বললেন, হাউ স্যাড।

—ইয়েস্ স্যার। ইটস্ দ্য ‘স্যাডেস্ট অফ অল’ ফাউস্‌ ইন মাই ফুটবলার্স কেরিয়ার। বর্তমানে আমি আমার ওই বেটার সেভেন-এইটথ্রু-এর খিদমদারি করে গ্রাসাচ্ছাদন করি।

সমরেশ জানতে চায়, ‘বেটার সেভেন-এইটথ্’ মানে?

সোমেশ্বর বললে, আপনি বিবাহিত কিনা জানি না। হলে নিশ্চয়ই অস্থিতে-অস্থিতে অবগত আছেন : ‘বেটার হাফ’ কাকে বলে। বিবাহের সময় আমার উনি ছিলেন ‘বেটার থ্রিফোর্থ’। আমার পরিচয় ছিল অনামিকা সেনের ফুটবলার হাজবেন্ড। ল্যাংড়া হয়ে যাবার পর আমি হয়ে গেছি ‘ওয়ার্স-ওয়ান-এইট্‌থ্’। উনি ন্যাচারালি ‘বেটার সেভেন-এইট্‌থ্’। সে যাক্, আপনাদের পরিচয়গুলি সংগ্রহ করি—সাতদিন একত্রে থাকতে হবে যখন

কর্নেল আগ্ বাড়িয়ে বলেন, সবার আগে আপনি বসুন। আমি হলাম ইন্ডিয়ান আর্মির অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল বিল্বমঙ্গল সমাদ্দার। একাই আছি একতলার 2/1-এ। ইনি স্বনামধন্য পি. কে. বাসু বার-অ্যাট-ল। মিসেস বাসু। এঁরা দুজন—পায়েল আর সুদীপা একই স্কুলে পড়ান। আছেন দোতলায়। এঁদের পাশের ঘরেই মিস্টার কৌশিক আর সুজাতা মিত্র। ওদের সঙ্গে একটি ক্যিউট বাচ্চা…কী যেন নাম?

সুজাতা পাদপূরণ করে : মিঠু।

—হ্যাঁ মিঠু। আর ইনি ব্রজদুলালবাবু। এসেছেন একাই। এছাড়া আছে আর একটি কাল—সমরেশ আর… ওই তো, নাম করতে করতেই এসে পড়েছেন ওঁর বেটার হাফ

সুইমিং কস্টুমের উপর একটা হাউসকোট চাপিয়ে ঠিক সেই মুহূর্তেই ভিতর থেকে এগিয়ে এল অর্পিতা।

সোমেশ্বর পর্যায়ক্রমে নমস্কার করে যাচ্ছিল। অর্পিতাকেও করল। অর্পিতা গায়ে তোয়ালে জড়িয়ে একটা চেয়ারে বসল। সোমেশ্বর বললে, দেখুন, আমি শ্রুতিধর নই। এতগুলি নাম ঠিক ঠিক মনে রাখতে পারব না। আপনাকে আমি কর্নেল-সাহেব, আর ওঁকে ব্যারিস্টার-সাহেব বলে ডাকব। ইনি ন্যাচারালি বাসু-মাসিমা। তাহলে তিনটি নাম মনে রাখার দরকার হবে না….

ঠিক সেই সময়ে তিন-চার মিটার দূরত্বে বালুশয্যালীনা অনামিকা মিহি গলায় হাঁকাড় পাড়ে, ডার্লিং। একটু শুনে যাও প্লিজ…

সোমেশ্বর রওনা দেবার আগে বাসু-সাহেবের দিকে ফিরে বললে : আদালতের ‘সমন’, স্যার। আগে সেটা সেরে আসি। নাহলেই আদালত অবমাননা

ব্রজদুলাল বলেন, ছোকরা খুব ফূর্তিবাজ। মুখে-চোখে কথা। তাই না বাসু-সাহেব?

—অন্তত সেই রকম একটা ‘ইমেজ’ তৈরি করার চেষ্টা করছে।–বাসু-সাহেবের মন্তব্য।

দূর থেকে দেখা গেল—অনামিকা ফ্লাস্কটা খুলতে পারছে না। সোমেশ্বর সেটা খুলে ওকে কিছু কফি ঢেলে দিয়ে আবার ফ্লাস্কটা বন্ধ করে দিল। ওরা নিম্নস্বরে কী যেন আলাপচারী করল। তারপর সোমেশ্বর এদিকে এগিয়ে আসতে থাকে। অনামিকা উঠে বসে। সমুদ্রের দিকে মুখ করে কফি পান করতে থাকে। এখন তার প্রোফাইল দেখা যাচ্ছে। সমরেশ নির্লজ্জের মতো আবার তুলে নিল কর্নেল সাহেবের চেয়ার থেকে তাঁর দূরবীনটা।

সোমেশ্বরের সেটা নজরে পড়ল। ঘাড় ঘুরিয়ে বাইনোকুলারের লক্ষ্যমুখটাও লক্ষ্য করল। অনামিকা এতক্ষণে সামনে ফিরেছে। তারিয়ে তারিয়ে কফি পান করছে। সোমেশ্বর রসিকতা করে সমরেশের কাঁধে একটা হাত রাখল। সমরেশ চমকে বাইনোটা নামিয়ে নিতেই সোমেশ্বর বলে, আপনি যা ভাবছেন তা নয়, ওটা স্নাইপ নয়, স্যান্ডপাইপার। স্নাইপ সুস্বাদু, কিন্তু স্যান্ড- পাইপারের মাংস অখাদ্য।

সমরেশ রীতিমতো অপ্রস্তুত হয়ে বলে, স্যান্ডপাইপারই হবে বোধহয়।

বাইনোটা ফেরত দেয়। সকলেই পরস্পরের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসে। সোমেশ্বর বলে, এতক্ষণে সবার গলাই নিশ্চয় শুকিয়ে কাঠ হয়ে উঠেছে। আমাকে এক-রাউন্ড ড্রিংস- পরিবেশনের অনুমতি দিন। বলুন কে কী নেবেন? কর্নেল সাহেব?

—বীয়র। যদি মাছরাঙা পাওয়া যায়। না হলে ব্ল্যাক লেবেল।

বাসু-সাহেব এত সকালে কিছু নিতে রাজি হলেন না। মিসেস্ বাসু—কোক; ব্রজদুলাল ও বীয়র; কৌশিক চাইল ভদ্‌কা উইথ ক্যানাডা-ড্রাই।

সোমেশ্বর দুই দিদিমণির দিকে ফিরে বলল, আপনারা দুজন?

দুই বান্ধবীর চোখাচোখি হলো। সুদীপা বলল, যা হোক দুটো সফট্ ড্রিংস। .

সোমেশ্বর বলে, ‘জিন-অ্যান্ড-লাইম’ও কিন্তু লেডিজ ড্রিংক। এক পেগে কিছু নেশা হবে না। আর এখানে ছাত্রীরা তো কেউ নেই। অসুবিধাটা কোথায়?

পায়েল স্বীকার করল, আমি জীবনে কখনো খাইনি কিন্তু।

সোমেশ্বর বলে, তবে জন্মের শোধ এখানেই পরীক্ষাটা করে ফেলুন। আই স্ট্যান্ড গ্যারান্টি। এক পেগে কোনও নেশা হবে না। হয় না।

সমরেশ বলল, আমারও তাহলে ওই ‘জিন-অ্যান্ড-লাইম’।

সোমেশ্বর অর্পিতার দিকে ফিরে বলল, আপনি কি নেবেন, মিসেস্ পালিত?

—আমি একটা সফ্ট নেব : কোক্‌।

কৌশিক উঠে দাঁড়ায়। বলে, আপনি নিজ স্বীকৃতিমতে শ্রুতিধর নন। সব গুলিয়ে ফেলবেন। চলুন, আমিও যাই আপনার সঙ্গে।

ওরা দুজনে সবে ‘বার’-এর দিকে গেছে এমন সময় সামুদ্রিক হাওয়ায় ভেসে এল একটা সকাতর আহ্বান : ডার্লিং। কৌটোটা খুলতে পারছি না।

বলে, অনামিকা এদিকে ফিরল। ভিড়ের মধ্যে সোমেশ্বরকে চিহ্নিত করতে চাইল। চোখ থেকে সানগ্লাসটা খুলে। এতক্ষণে বোঝা গেল, কালিদাসের সেই দিলতোড় শ্লোকের ওই বিশেষণটাও মিলে যাচ্ছে : ‘চকিতহরিণীপ্রেক্ষণা’–তা হোক না বয়স, হিসাব মতো দেড়কুড়ি।

সমরেশ আবার শরাহত। সম্মোহিতের মতো সে উঠে দাঁড়াল। অনামিকা তার দিকে তাকিয়ে ভুবনজয়ী একটুকরো হাসি ছুঁড়ে দিল। তারপর কিশোরী মেয়ের মতো আদুরে গলায় বললে : এই ক্রিমের কৌটোটা। কিছুতেই খুলতে পারছি না।

সমরেশ হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে গেল সেদিকে। বসে পড়ল ওর বিছানো তোয়ালের পাশে, বালিতেই। এদিকে কর্নেল-সাহেব ততক্ষণে বাইনোর ফোকাসিংটা রি-অ্যাডজাস্ট করে রানিং কমেন্ট্রি শুরু করেছেন : ক্রিমের কৌটোটা সত্যিই আটকে গেছিল কিনা খোদায় মালুম। এখন সেটা খোলা গেছে। কিন্তু মনে হচ্ছে শুধু টিনের কৌটো নয়, আরও কিছু উন্মোচনের আগ্রহ নিয়ে উনি ও-পাড়ায় গেছেন। দুজনে সে বিষয়ে আলাপচারী হচ্ছে…

রানী বলেন, আপনি থামুন তো কর্নেল-সাহেব। আমরা ওই দৃশ্য দেখতে এখানে এসে বসিনি।

—আই নো, আই নো। কিন্তু বাইনোতে তো সী-গাল, স্নাইপ, স্যান্ডপাইপার কিচ্ছুটি দেখতে পাচ্ছি না—শুধু একজোড়া চখা-চখী।

অর্পিতার আর সহ্য হয় না। চিৎকার করে ওঠে, সমর। বেলা বেড়ে যাচ্ছে। চল এবার জলে নামি।

অতদূর থেকে সমরেশ জবাব দিল, তুমি নাম, আমি এখনি আসছি।

কর্নেল রানিং কমেন্ট্রি চালিয়েই যাচ্ছেন : এই ক্রিমটা বোধহয় পিঠে মাখতে হয়। নিজে নিজে মাখা যায় না। তাই একটা হেল্পিং হ্যান্ড…

কথাটা অসমাপ্ত রইল। কারণ সেই সময়েই একটি বার-অ্যাটেন্ডেন্ট-এর হাতে ট্রেতে সুরাপাত্র সাজিয়ে ফিরে এল ওরা দুজন। পরিবেশন শুরু হয়ে গেল। কিন্তু ‘চিয়ার্স’ বলে কেউ চুমুক দিল না। সোমেশ্বরের প্রতিক্রিয়ার জন্য সবাই রুদ্ধশ্বাসে প্রতীক্ষা করছে। সোমেশ্বর তাকিয়ে দেখল। অনামিকা উবুড় হয়ে পড়ে আছে। আর তার পিঠে সমরেশ ওই ক্রিমটা মালিশ করে দিচ্ছে। সোমেশ্বর নির্বিকার। কোনও ভাবান্তর হলো না তার। কর্নেল-সাহেব তাকে বললেন, আপনার বেটার সেভেন-এইট্‌থ্ আপনাকে একটু আগে খুঁজছিলেন।

‘চিয়ার্স’। বলে সোমেশ্বর তার হুইস্কিসোডায় একটা চুমুক দিল। হ্যাঁ, এত সকালেও সে হুইস্কি পানে অভ্যস্ত। বললে, বুঝেছি। ওই ক্রিমটা ওর পিঠে মাখিয়ে দেবার জন্য। এ আমার নিত্যকর্মপদ্ধতির অন্তর্ভুক্ত। তা নতুন খিদ্‌মদ্‌গার তো ও আজ পেয়েই গেছে। আমার ছুটি। অর্পিতা গট্-গট্ করে সমুদ্রের দিকে এগিয়ে গেল। হাঁটুজলে নেমে আবার একটা হাঁকাড় দিল : সমর। আমি জলে নামলাম কিন্তু…

—ও. কে। আয়াম কামিং ইন আ মিনিট, ডার্লিং।

.

প্রায় ঘণ্টাখানেক পরের কথা। ইতিমধ্যে স্নানার্থীরা একে একে স্নান সেরে ভিতরে গেছেন। কৌশিক-সুজাতা, পায়েল-সুদীপা, কর্নেল সমাদ্দার প্রভৃতি। বাসু সমুদ্রস্নান খুব উপভোগ করতেন, করেনও; কিন্তু গতবছর পুরীতে পরপর দু’দিন সমুদ্রস্নান করে সর্দিজ্বরে পড়েছিলেন। এবার তাই রানীর নির্দেশে তাঁর সাগরজলে নামা মানা। ব্রজদুলাল সমুদ্রস্নান পছন্দ করেন না। তাঁর আর্থারাইটিস্ আছে। সারা বছর তিনি গরমজলে স্নান করেন। অর্পিতা প্রায় আধঘণ্টা জলে ছিল। বেশ ভালই সাঁতার জানে সে। তটরেখা ছেড়ে মানুষভর-জল এলাকায় অনেকটা সাঁতরে ফিরল। মাঝে একবার ডাঙায় উঠে হাঁক পেড়েছিল তার কর্তার উদ্দেশে : কী? তুমি আজ নাইবে। না—না?

সমরেশ রীতিমতো ভদ্রলোক। তার কথার নড়চড় হয়নি—এই এলাম বলে। জাস্ট আ মিনিট।

অর্পিতা রীতিমতো আহত হয়ে পায়ে পায়ে উঠে এল। ওঁদের সামনে দিয়ে মাথা নিচু করে হোটেলের দিকে চলে গেল। ভিজা বেদিং-কস্টিউমের উপর একটা হাউসকোট চাপিয়ে। কেউ তাকে কিছু বলল না। সেও কোনও কথা বলল না। চরম অপমানিতা মনে হলো তাকে।

ছাতার তলা ছেড়ে ইতিমধ্যে বাসু সস্ত্রীক উঠে এসেছেন হোটেলের পোর্চ-এ। পোচটা প্রকাণ্ড—ওভাল শেপ্‌ড্। অনেকগুলি কংক্রিটের বেঞ্চি। মাঝখানে খান-কতক বেতের টেব্‌ল আর পোর্টেব্‌ বেতের চেয়ার। তার একটি দখল করে হুইস্কি-সোডা, স্ন্যাকস্ আর বরফ নিয়ে; জমিয়ে বসেছিল সোমেশ্বর। একাই।

অর্পিতা যখন পোর্চের সামনে দিয়ে নতমস্তকে ভিতরে যাচ্ছে, তখন হঠাৎ উঠে দাঁড়াল সোমেশ্বর। একটু এগিয়ে এসে ডাকল, মিসেস পালিত।

থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে অর্পিতা। গ্লাসটা টেবিলে নামিয়ে রেখে এগিয়ে এল সোমেশ্বর : আপনাকে একটা কথা বলব, মিসেস্ পালিত?

কুঞ্চিত-ভ্রূ অর্পিতা বলল, না। দেখছেন না আমার সর্বাঙ্গ ভিজে। এই কি কথা বলার সময়?

—ও আয়াম সরি। এক্সট্রিমলি সরি—

অর্পিতা তোয়ালে দিয়ে সর্বাঙ্গ ঢেকে ভিতরে চলে যায়। সোমেশ্বর গ্লাসটা উঠিয়ে নিয়ে এদিকে এগিয়ে আসে। বসে ছিলেন শুধু বাসু-সাহেব আর রানীদেবী। আর রানীর কোলে ঘুমন্ত মিঠু। কৌশিক-সুজাতা জামা-কাপড় বদলাতে গেছে।

বাসু-সাহেব যে টেবিলে বসেছিলেন তার কাছেই ছিল আরও কিছু ফাঁকা বেতের চেয়ার। সোমেশ্বর বাসু-সাহেবকে বলে, একটু বসতে পারি, স্যার?

বাসু সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বসেছিলেন। ঘাড় না ঘুরিয়েই বললেন, বস। কিন্তু তুমি স্নানে যাবে না?

—যাব বলেই তো সকাল থেকে তৈরি হয়ে আছি; কিন্তু ক্লিয়ারেন্স পাচ্ছি কই? সিগ্‌নাল যে এখনো আপ।

বাসু-নীরব রইলেন। রানী অহেতুক মিঠুর পিঠে থাবড়া দিতে শুরু করলেন। সোমেশ্বর বলে, একটা কথা বলতে পারি ব্যারিস্টার-স্যার?

বাসু বিরক্ত হয়ে বলেন, পার। কিন্তু অতি সংক্ষেপে।

—এটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না, স্যার?

—অফকোর্স। লাঞ্চের আগে তিন-পেগ হুইস্কি তো বাড়াবাড়ি বটেই। কী গিলছ ওটা? রয়্যাল স্ট্যাগ?

সোমেশ্বর হাতের গ্লাসটা দেখিয়ে বলে, আমি স্যার এটার কথা বলছি না। বলছি ওই লোচ্চাটার কথা।

বাঁ হাতটা বাড়িয়ে সে নির্জন সমুদ্রবেলায় কপোত-কপোতীকে দেখিয়ে দিল। সমুদ্রসৈকত সম্পূর্ণ নির্জন। শুধু ওই একটা ছাতার তলায় দুজনে ক্রমাগত বক্তকম্ করে চলেছে।

সোমেশ্বর যোগ করে, পালিতটা কি এর আগে জ্যান্ত কোনও সুন্দরী মেয়েছেলে দেখেনি?

বাসু জানতে চান, পালিত? কোন পালিত?

—ওই যে সমরেশ পালিত। শালা নাকি কিনু গোয়ালার গলিতে মাঝরাতে কর্নেট বাজায়।

–কী করে জানলে? কে বলেছে?

–কে বলেছে মনে নেই। ওই ইয়ে আরকি….পাঁচজন বলে।

—ও তাই বুঝি?

বাসু উঠে পড়েন। হুইল-চেয়ারটা ঠেলতে ঠেলতে। এ মদ্যপের মাতলামি থেকে পালাবার একমাত্র পথ : স্থানত্যাগ করা।

একটু পরেই ওঁদের ডাকতে এল কৌশিক-সুজাতা। ডাইনিং হলে গিয়ে দেখেন কর্নেল, ব্রজদুলাল, সুদীপা আর পায়েল বসেছে একটা টেবিলে। বিপরীত টেবিলে গিয়ে বসলেন ওঁরা চারজন। লক্ষ্য হলো—ডাইনিং হলের দূরতম প্রান্তে একা বসে মধ্যাহ্ন আহার সারছিল অর্পিতা। হঠাৎ সে উঠে ওয়াশ-বেসিনের দিকে এগিয়ে গেল। মনে হলো আহার অসমাপ্ত রেখেই।

সুজাতা মেনু-কার্ড দেখে লাঞ্চের অর্ডার দিল। রানী জানতে চান, ফুটকির খাওয়া হয়েছে? সুজাতা ঘাড় নেড়ে জানায়, ফুটকির মধ্যাহ্ন আহার সমাপ্ত। ফুটকি হচ্ছে বিশের দিদি। এখন সে মিঠুর দেখভাল করে। বিশে কলকাতায়। একা কুম্ভ নকলবুঁদির গড় রক্ষা করছে। কৌশিক বলে, মামু আজ সকালে এক্কেবারে চুপচাপ ছিলেন। একটা কথাও বলেননি। একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলেন সমুদ্রের দিকে। কী দেখছিলেন, মামু, অমন করে?

—নিম্নচাপ। বহু বহু দূরে সমুদ্রের মাঝখানে একটা নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়েছে। সাইক্লোন অনিবার্য। পৌঁছতে দিন দুই-তিন লাগবে মনে হচ্ছে।

—নিম্নচাপ? মানে ঝড়ের লক্ষণ? সাইক্লোন?

—তাই তো আশঙ্কা করছি। ঝড়টা কোন দিক থেকে আসছে, কোন ঘরটা ভাঙবে তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। একটা অসঙ্গতি মিটলেই সেটা বোঝা যাবে।

—অসঙ্গতি! কিসের অসঙ্গতি?—জানতে চান রানী।

—আজ সকালে অনেকে অনেক কথা বলেছে; কিন্তু তার মধ্যে একটা ভুল আছে। ভ্রান্তি। মিথ্যা কি না জানি না…কিন্তু একটা অনিবার্য অ্যাপারেন্ট-কন্ট্রাডিকশন। যা হয় না তাই…কিন্তু কে বলল? কখন বলল?

–কী জাতের কন্ট্রাডিক্‌শন?

—ধর, কেউ যদি বলে, ‘ক্যালেন্ডারে দেখলাম : এ বছর গুড ফ্রাইডের ছুটিটা রোব্বারে পড়ে নষ্ট হয়েছে’—এইরকম আপাত-অসঙ্গতি।

—আই সী। কিন্তু কে বলল? কখন বলল?

—দ্যা দ্য মিলিয়ন-ডলার কোশ্চেন। কে বলল? এবং কখন বলল? মেমারির পাতা উল্টে দেখ—কী অসঙ্গতি। আগে থেকে সেটা চিহ্নিত করতে পারলে ঝড়ের সময় কাজে দেবে।

সুজাতা বললে, আমার কানে একটা অসঙ্গতি লেগেছে। সোমেশ্বরবাবু বললেন বিয়ের সময় ওঁর বউ ছিল ‘বেটার থ্রিফোর্থ’; কিন্তু ওঁর হাঁটু ভাঙার পর বউ হয়ে গেল বেটার সেভেন-এইট্‌থ্’, তাই না? কিন্তু ওদের বিয়ে তো হয়েছে মাত্র তিন মাস। হাঁটুটা কি তার আগে ভাঙেনি?

বাসু বলেন, এটা একটা অসঙ্গতি বটে। কিন্তু ভগ্নাংশগুলো তো কথার কথা। আমি যে ভ্রান্তিটার কথা বলছি তা আরও বড় জাতের। ডেলিবারেট গ্রস বেইট টু এন্টাইস্ আদার্স। মাছের টোপ। কী সেটা?

.

এখানে সূর্যের আলোর তেজ এখন কমে যায় পৌঁনে ছয়টায়। ওঁরা সদলবলে বেরিয়ে পড়েন সান্ধ্যভ্রমণে। আজ কিন্তু হোটেল-পোর্চেই ওঁদের সবার জন্য অপেক্ষা করছিল একটা বিস্ময়। বাসু-সাহেবের ভাষায় : যা হবার নয় তাই।

পোর্চে সোমেশ্বর আর সমরেশ মুখোমুখি বসে দাবা খেলছে। দর্শকের আসনে বসে আছে অর্পিতা। দুই দাবাড়ু চোখ তুলে চাইল না পর্যন্ত। সুদীপা সোমেশ্বরের দিকে ফিরে বলে, অনামিকা কি ঘরে?

সোমেশ্বরের কানে প্রশ্নটা ঢোকে না। তার আগেই সমরেশের ঘোড়া আড়াই পা এগিয়ে এসেছে। অর্পিতা নিঃশব্দে তার তর্জনী তুলে দেখাল। দূরে-বহুদূরে একটি ছাতার তলায়—এবার ছাতাটি পশ্চিম দিকে হেলেছে—অনামিকা একটি পত্রিকা পড়ছে একমনে। তার পরনে একটা চাঁপা রঙের কাঞ্জিভরম, ম্যাচিং ব্লাউস ও হাইহিল।

ওঁরা পোর্চ ছেড়ে বালুবেলায় নেমে এলেন। কর্নেল আর বাসু-সাহেব পদচারণা শুরু করলেন পশ্চিমমুখো। মেয়েরা পুবদিকে। কৌশিক রইল রানীদেবীর কাছে। ব্রজদুলালও হাঁটতে নারাজ। কৌশিক বলল, বুঝলেন, মামিমা, প্রথমে মনে হয়েছিল জ্যামিতিক ফিগারটা চতুষ্কোণ। পরে বোঝা গেল অর্পিতা নন্‌এন্টিটি—ওই যাকে বলে, এলেবেলে। সুতরাং জিওমেট্রিক ফিগারটা হয়ে গেল সমকোণী ত্রিভুজ। শীর্ষবিন্দুতে অনামিকা—আর অতিভুজের দুই প্রান্তে দুই যুযুধান ষণ্ড—সেই ইটার্নাল ট্রায়েঙ্গেল। এবেলা দেখছি, তাও ঠিক নয়। প্রবলেমটা অধিবৃত্তের। ইলিস্-এর দুটি ফোসাই—দুই নাভি এখন কাছাকাছি এসে গেছে। মিলে গেলেই অধিবৃত্তটা বৃত্তে পরিণত হবে। বর্তমানে ওই অধিবৃত্তপথে ‘নামিতা নিম্ন নাভি অতিদূর দিয়ে নাভিদ্বয়কে পরিক্রমা করছেন।

ব্রজদুলাল বিরক্ত হয়ে বলেন, সাদা বাঙলায় কথা বলতে কি ভুলে গেছ কৌশিক?

কৌশিক বললে, সাদা বাঙলায় : ওদের দুজনের লড়াই-কাজিয়া মিটে গেছে। আর ভয়ের কিছু নেই।

—তুমি তো তাই বলছ, কিন্তু বাসু-সাহেব তখন কি যেন নিম্নচাপের কথা বলছিলেন। একটা নাকি সাইক্লোন হতে পারে।

কৌশিক প্রত্যুত্তর করার সময় পেল না। লক্ষ্য হলো, ওরা তিনজনে পোর্চ থেকে এদিকেই এগিয়ে আসছে। দাবা খেলায় সোমেশ্বর হেরে গেছে। সমরেশ বললে, একটা কথা বলতে এলাম। আমরা কাল খুব সকালে চিল্কা যাব ভাবছি। আপনারা কে-কে পার্টিসিপেট করবেন?

রানী বললেন, ওঁরা সবাই ফিরে আসুন তখন কথা হবে।

সান্ধ্য ভ্রমণান্তে সবাই যখন একত্র হলেন—অনামিকা বাদে, সে ঘরে চলে গেল—তখন প্রস্তাবটা আবার পেশ করল সমরেশ। চিল্কা ওখান থেকে তিন-চার ঘণ্টার মোটরপথ। ওদের পরিকল্পনা প্যাকেট-ব্রেকফাস্ট নিয়ে খুব ভোরে রওনা দেওয়া। লেটেস্ট ছয়টা। তাহলে চিল্কায় গিয়ে রম্ভায় লাঞ্চ সারা যাবে। আবার চারটে নাগাদ রওনা দিলে রাত আটটায় ফিরে এসে এখানে ডিনার করা যাবে। যাত্রীসংখ্যা বুঝে ওরা স্থির করবে কী গাড়ি নেওয়া হবে।

দেখা গেল, বিশেষ কেউই উৎসাহিত হলেন না। অধিকাংশেরই চিল্কা দেখা। সুদীপা আর পায়েল সুজাতাকে জনান্তিকে বললে, ওই দেমাকির সঙ্গে কে যাবে? আজ সারাদিনে এসে আলাপ করবার সময় হলো না তার।

অগত্যা ওরা একটা টাটা সুমো বুক করল। চারজন আরামসে যাবে। অনামিকা, সোমেশ্বর আর পালিত দম্পতি।

.

পরদিন নিত্যকর্মপদ্ধতি অনুসারে সূর্যোদয়ের অনেক আগেই বের হয়েছিলেন বাসু-সাহেব সমুদ্রসৈকতে অনেকটা হেঁটে যখন ফিরে এলেন, ততক্ষণে সূর্যোদয় হয়ে গেছে। তবে মেঘের আড়ালে। হঠাৎ নজর হলো, নির্জন পোর্চে একা বসে আছে অর্পিতা। রুমাল দিয়ে চশমার কাচটা মুচছে। বাসু-সাহেবকে দেখে তড়িঘড়ি চশমাটা নাকে চড়াল। ওর চোখ দুটো লাল। বাসু অবাক হয়ে বলেন, এ কি। তোমরা যাওনি?

ধরা গলায় অর্পিতা বলল, আমি যাইনি। ওরা গেছে।

—তুমি গেলে না কেন?

—ভোর রাত থেকে লুজ-মোশান হচ্ছে। পেটটা আপসেট করেছে।

—স্যাড কেস। তা ওরা তিনজন একদিন জার্নিটা পোস্টপোন্ড করলেই পারত। কাল যেত। ‘চিল্কা তো পালিয়ে যাচ্ছে না।

নতনেত্রে অর্পিতা বলল, ওরা তিনজন নয়, দুজন।

—মানে?

—মিস্টার ব্যানার্জি, আই মীন মিস্টার ঘোষালও যাননি। কাল রাত্রে অত্যধিক ড্রিংক করেছিলেন। এখনো খোঁয়াড় ভাঙেনি।

—আই সী।

বাসু বসলেন সামনের একখানা চেয়ার দখল করে। বেড-টির আগে সচরাচর উনি ধূমপান করেন না। আজ কিন্তু প্রয়োজন হলো। পকেট থেকে পাইপ আর পাউচ বার করতে থাকেন।

—আমি…আমি কী করব বলুন মেসোমশাই? আপনি কী অ্যাডভাইজ দেন? এখন আমার কী করা উচিত?

—বলছি। তার আগে আমাকে কিছু ‘ডাটা’ দাও দেখি। সমরেশ লোকটা কি বরাবরই এই জাতের? কতদিন বিয়ে হয়েছে তোমাদের? পরস্ত্রীকাতরতা কি ওর স্বভাবজাত?

—পরশ্রীকাতরতা?

—না, আমি ‘পরস্ত্রীকাতরতা’র কথা বলেছি। অপরের সুন্দরী স্ত্রী দেখলেই কি ওর মাথা ঘুরে যায়?

—তা কিছুটা যায়। দু’বছর বিবাহিত জীবনে এটা অনেকবারই লক্ষ্য করেছি। তবে এমন মাত্রাতিরিক্তভাবে নয়। সেটা এই প্রথম। এবারই।

—আই সী। দ্বিতীয়ত গান-বাজনার শখটা কার? তোমার না সমরেশের?

–কী আশ্চর্য। আপনি কেমন করে জানলেন?

—অর্পিতা, তুমি আমার পরামর্শ চেয়েছ। গ্র্যাটিস। পরামর্শ আমি দেব। কিন্তু কোনও প্রতিপ্রশ্ন কর না। যা জিজ্ঞেস করছি জবাব দাও।

—গান-বাজনার শখ দুজনেরই। সেই সূত্রেই আমাদের প্রথম আলাপ। ও সেতার বাজায়। আর আমি আধুনিক সঙ্গীত গাই। অবশ্য একটা স্কুলে গানও শেখাই। আর ও চাকরি করে এগ্রিকালচারাল এঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে।

—ও এগ্রিকালচারাল এঞ্জিনিয়ার?

—না, না। ও ওখানকার এল. ডি. ক্লার্ক।

—বুঝলাম। তোমরা থাক কোথায়?

—খেলাবাবু লেনে। কেন?

‘কেন’ প্রশ্নটাকে আমল না দিয়ে বাসু বলেন, তোমাদের বাড়ির সামনেই বাঁ দিকে একটা

আঁস্তাকুড় আছে, নয়?

অর্পিতা অবাক হয়ে বলে, আছে। আপনি কেমন করে জানলেন? তবে বাঁ দিকে নয়, বাড়ি থেকে বেরিয়েই ডান দিকে….

—না, আমি বাড়িতে ঢুকবার মুখে বাঁ হাতি একটা আঁস্তাকুড় আছে কি না জানতে চাইছিলাম।

—হ্যাঁ, ঢোকার মুখে ওটা বাঁ-দিকেই পড়ে।

—জ্যৈষ্ঠ মাসে, মানে এখন, তাতে কাঁঠালের ভূতি পড়ে? মাঝে মাঝে মরা-বিড়ালের ছানা?

অর্পিতা জবাব দেয় না। তার মুখটা হাঁ হয়ে যায়।

বাসু-সাহেব বললেন; প্রশ্নের ধরনটা তোমার বোধগম্য হচ্ছে না, তাই না? সুদীপাকে জিজ্ঞেস কর, সে বুঝিয়ে দেবে। ও একটা স্কুলে বাঙলা পড়ায়। যাক সে কথা, তুমি পরামর্শ চাইছিলে; তাই না? আমার পরামর্শ : ওরা দুজন চিল্কা থেকে ফিরে আসার আগেই তুমি সুটকেস গুছিয়ে নিয়ে তোমার খেলাৎবাবু লেনের বাসায় ফিরে যাও। চাবিটা আমাকে দিয়ে যেও। চেক-আউট করার দরকার নেই।

অর্পিতা স্তম্ভিত হয়ে যায়। বলে, ওকে ওই ডাইনীটার কব্জায় ছেড়ে দিয়ে?

—এজ্যাক্টলি। ও স্বভাব-ব্যভিচারিণী। তিন-বার বিয়ে করেছে। পুরুষমানুষ আর গল্দা চিংড়ির মুণ্ডু ও সমান তৃপ্তির সঙ্গে চিবিয়ে খেতে ভালবাসে। তা হোক, সে বিবাহিতা। তোমার কর্তাকে সে বিয়ে করতে পারবে না। কর্তাও তোমাকে ত্যাগ করতে পারবে না। তোমার পক্ষে এখন সেরা চাল ‘কুইন পন’-কে দু’ঘর সামনে এগিয়ে দেওয়া। লিভ দ্য হোটেল অ্যাট ওয়ান্স। লেট দ্য কিং ফলো দ্য কুইন

—কিন্তু…

ডান হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বাসু বলেন : নো মোর ‘কিন্তু’ প্লিজ। আমার ‘রায়’ দেওয়া হয়ে গেছে। অ্যাপিল করতে চাও তাহলে হায়ার কোর্টে যেতে হবে তোমাকে—ঈশ্বরের দরবারে। ‘তর্জনীটা আকাশপানে তুলে দিলেন।

চট করে উঠে দাঁড়ান। ভিতর থেকে তখন ব্রজদুলাল, কর্নেল আর সুদীপা, পায়েল বার হয়ে আসছে। অর্পিতা চটজলদি চোখটা মুছে নেয়।

সকলেই অবাক হলো। অর্পিতার দুঃখের কথা শুনে।

পায়েল সুদীপার কানে কানে জনান্তিকে বলে, শুনেছিস্? ঘোষাল-মাতালটা যায়নি। আকণ্ঠ মদ গিলে ফ্ল্যাট হয়ে নিজের ঘরে পড়ে আছে। তার সুন্দরী বউটাকে নিয়ে কে কী করছে মাতালটার ভ্রূক্ষেপই নেই। ছি-ছি-ছি…

সুদীপা হ্রস্ব-ইকারের বদলে তিনটি য-ফলার মাধ্যমে তার ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ করল : ছ্যা- ছ্যা-হ্যা। লোকটা বনমানুষ। সারা গায়ে কী লোম দেখেছিলি? ওয়াক্।

ব্রজদুলাল অর্পিতাকে বললেন, ওষুধ-টষুধ কিছু খেয়েছ? খাওনি? বস এখানে। আমার কাছে ডায়াজিন ট্যাবলেট আছে, নিয়ে আসছি।

তিনি নিজের ঘরে গিয়ে ওষুধটা নিয়ে এলেন, বললেন, এখনই একটা ট্যাবলেট জল দিয়ে খেয়ে ফেল। আর এই অ্যাটিভান ট্যাবলেটটাও। ব্রেকফাস্টে কিছু খেও না, একটু লেবুর জল খেতে পার। যাও, ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নাও। টেনে ঘুম দাও একটা।

অর্পিতা টেবিল থেকে ঘরের চাবিটা উঠিয়ে নিয়ে নিঃশব্দে চলে গেল।

ব্রেকফাস্টের পর আজ অধিকাংশই ছাতার তলায় বসেননি। পোর্চে বসেছে ব্রিজের আসর। মুশকিল হলো ‘ফোর্থ-হ্যান্ড’ নিয়ে। কর্নেল, পায়েল আর কৌশিক। আর কারও উৎসাহ নেই। অনেকে জানেনই না খেলাটা। অনামিকাদের ঘরে একবার ওরা ঢুঁ মেরেছিল। সুবিধা হয়নি। ‘বিরক্ত করবেন না’ বোর্ড টাঙিয়ে অঘোরে ঘুমাচ্ছে পাঁড় মাতালটা। অবশেষে রানী দেবীই বসলেন কৌশিকের পার্টনার হয়ে। বহুদিন পর তাস ছুঁলেন তিনি। প্রথম মিঠু হারিয়ে যাওয়ার পর এই প্রথম।

প্রাক-লাঞ্চ পর্যায়ে যথারীতি এক রাউন্ড ‘অ্যাপিটাইজার’ এল—বীয়র, জিন অথবা ভদ্‌কা মেয়েদের সফ্ট ড্রিংক। আজ এটা ব্রজদুলালের সৌজন্যে। দু-বোতল বীয়র আর গ্লাস একটি ট্রেতে সাজিয়ে—আর ওই সঙ্গে এক প্লেট চিকেন-টিকিয়া নিয়ে হোটেল-বয়ের সাহায্যে ব্রজদুলাল এগিয়ে এলেন একটা ছাতার তলায়। যেখানে একমনে একটি ইংরেজি বই পড়ছিলেন বাসু-সাহেব। ব্রজদুলাল বললেন, আসুন স্যার, একটু বীয়র ‘ইচ্ছে করুন’। বলুন, বঙ্গোপসাগরের নিম্নচাপটার কী অবস্থা?

বাসু বইটা মুড়ে রেখে সাবধানে বোতল থেকে মাছরাঙা-বীয়র ঢালতে ঢালতে বললেন, সাইক্লোনটা এসে পড়ল বলে।

—সেটাকে ঠেকানো যায় না?

—কোনটাকে? ঝড়টাকে? তাই কি সম্ভব? প্রাকৃতিক বিধান। সাবধানতা যেটুকু নেওয়া যায়, নিয়েছি। অর্পিতাকে যথাকর্তব্য পরামর্শও দিয়েছি। এখন দেখা যাক, সে আমার কথা শোনে কি না—

–কী পরামর্শ দিয়েছেন তাকে?

—অবিলম্বে ‘দ্য নূক’ ত্যাগ করে নিঃশব্দে কলকাতায় ফিরে যেতে।

—আপনি তাকে তাই বলেছেন? দ্যাট সপ্স্ দ্য প্রবলেম? –

–কী প্রবলেম?

—শুনুন তবে :

ঘণ্টাখানেক আগে, মানে সাড়ে দশটা নাগাদ, ব্রজদুলাল ইউরিনালে যাবেন বলে নিজের ঘরে গিয়েছিলেন। কিন্তু কিছুতেই চাবি দিয়ে নিজের ঘরের দরজাটা খুলতে পারলেন না। অগত্যা রিসেপশান কাউন্টারের শরণাপন্ন হতে হলো। তখন জানতে পারলেন, তাঁর হাতের চাবিটা মিস্টার অ্যান্ড মিসেস্ পালিতদের ঘরের। অর্থাৎ অর্পিতা পোর্চে যখন ট্যাবলেটের সঙ্গে ঘরের চাবিটা তুলে নিয়েছিল—ঘণ্টা-চারেক আগে, তখন ভুল করে ব্রজদুলালের চাবিটা নিয়ে যায়। যাহোক ম্যানেজমেন্ট ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে ওঁর ঘরটা খুলে দেয়। ব্রজদুলাল অর্পিতাকে ডিসটার্ব করতে চাননি। কিন্তু ম্যানেজমেন্ট শোনেনি। ডুপলিকেট চাবি দিয়ে পালিতদের ঘরটা খোলা হয়, ব্রজবাবুর ঘরের দ্বিতীয় চাবির সন্ধানে। কিন্তু তাজ্জব কাণ্ড। সেঘরে অর্পিতা নেই। দীর্ঘ জবানবন্দির উপসংহারে উনি বললেন, আমার মনে হয়, সে আপনার পরামর্শটা শুনেছে। নিঃশব্দেই নিজের সুটকেসটা তুলে নিয়ে কলকাতায় ফিরে গেছে।

বাসু বীয়রে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে পাইপটা ধরালেন। ঘট-ঘট করে মাথা নাড়তে শুরু করলেন।

ব্রজদুলাল বলেন, কী না? ঘাড়-নাড়া বুড়ো বনে গেলেন কেন?

—গুড ফ্রাইডের ছুটিটা রোব্বারে পড়ে নষ্ট হতে পারে না। দ্যাটস্ অ্যাবসার্ড।

—তার মানে?

—সংক্ষেপে বলিতে গেলে : হিংটিংছট।

—আপনার মশাই সব সময়েই হেঁয়ালি।

লাঞ্চ-টেবিলে আর এক বিস্ময়। পায়েল-সুদীপাদের টেবিলে অর্পিতাও আহারে বসেছে। ব্রজদুলাল গুটি গুটি তার কাছে এগিয়ে এসে বলেন, এখন শরীর ঠিক হয়ে গেছে?

অর্পিতা ঘাড় নেড়ে জানায় সে সম্পূর্ণ সুস্থ।

—আমার ঘরের চাবিটা তোমার ব্যাগে।

—আজ্ঞে না। ভুলটা বুঝতে পেরেই আমি সেটা কাউন্টারে জমা দিয়ে দিয়েছি। আমার নিজের ঘরটা ওরা প্রথমে খুলে দিয়েছিল ডুলিকেট চাবি দিয়ে। পরে আপনি জমা দেওয়ায় আমার ঘরের চাবিটাও পেয়ে গেছি।

—আর পেট কামড়াচ্ছে না তো? ঘুমটা হয়েছিল?

—আজ্ঞে না, পেট কামড়ানি একেবারে সেরে গেছে। ঘণ্টাচারেক টানা ঘুমিয়ে শরীরটাও ঝরঝরে লাগছে।

—ভেরি গুড। লাঞ্চেও বুঝে শুনে খেও বাপু। দই খেতে পার। টক দই। ভাজাভুজি বেশি নিও না।

ওঁরা পাঁচজনে এক টেবিলে বসলেন। তখনি নজরে পড়ল ঘরের শেষপ্রান্তে একা-একা বসে খাচ্ছে সোমেশ্বর। চোখাচোখি হতেই হাত তুলে বলল, গুড-ডে।

সুজাতা চাপা গলায় বলে, কিসের গুড-ডে? সকালে খোঁয়াড় ভেঙে উঠেই তো দেখলি বাপু, খাঁচা খালি। পাখি ফুরুৎ। এটা তোর গুড-ডে?

রানী বলেন, আহ্। চুপ কর। শুনতে পাবে।

সুজাতা নিচু গলায় আরও বলে, কী করে চুপ করি মাসিমা? দেখুন কী তৃপ্তি করে মুরগির ঠ্যাঙ চিবাচ্ছে। ঠিক যে ভঙ্গিতে রম্ভাতে ওর বউ সমরেশবাবুর মুণ্ডুটা চিবাচ্ছে।

এবার ধমক দেয় কৌশিক : তোমার হলো কী সুজাতা? খেতে এসেছ, খেয়ে যাও। কে- কার মুণ্ডু চিবাচ্ছে তা তোমাকে দেখতে হবে না।

ব্রজবাবু পাদপূরণ করেন, যতক্ষণ না সেই বিকিনি-মাঈ বিকিকিনির হাটে তোমার কর্তাটিকে কিনে তার মুণ্ডুটা চিবাতে শুরু করেন।

এ পাড়ায় একটা চাপা হাসির রোল ওঠে।

.

আহারাদির পর যে যার ঘরে দ্বিপ্রাহরিক ‘বেড়াল ঘুম’ দিতে এগিয়ে চললেন। রানী দেবীর হুইল-চেয়ারটা ঠেলতে ঠেলতে নিজের ঘরের সামনে এসে বাসু দেখেন সোমেশ্বর করিডরে দাঁড়িয়ে সিগ্রেট টানছে।

—কী ব্যাপার? তুমি এখানে? আমার প্রতীক্ষায় নাকি?

—ইয়েস স্যার। যদি অনুমতি দেন পাঁচ মিনিট ডিসটার্ব করব।

—হ্যাঁ, কিন্তু ঘড়ি ধরে ঠিক পাঁচ-মিনিট। না হলে আমার ভাতঘুম ছুটে যাবে।

—আপনি মিলিয়ে নেবেন স্যার, চার-মিনিট উনষাট সেকেন্ড এসিড্ করবে না। ঘরে এসে রানী নিজের খাটে উঠে বসলেন। শুলেন না। বাসু পাইপ ধরিয়ে নিজের বিছানায় গিয়ে বসলেন। সোমেশ্বর চেইন-স্মোকারের কায়দায় স্টাম্প থেকে একটা নতুন সিগ্রেট ধরাল। চেয়ারে বসল। হিপ-পকেট থেকে মানিব্যাগটা বার করে বললে, আমি আপনাকে প্রফেশনালি কনসাল্ট করতে চাই। কী অ্যাডভান্স দেব স্যার?

—সংক্ষেপে কেসটা আগে শুনি। গ্রহণযোগ্য মনে করলে ‘রিটেইনার’ নেব বৈকি। তবে প্রথমেই বলে রাখি বাপু, ডিভোর্সের মামলা আমি নিই না।

সোমেশ্বর আকাশ থেকে পড়ল। বলে, যা ব্বাবা! ডিভোর্স। কী বলছেন স্যার? কাঁটা সিরিজের আঠারোখানা কেচ্ছা আমার মুখস্থ। আপনি আপনার একনিষ্ঠ পাঠককে চেনেন না, কিন্তু আপনাকে কি আমার চিনতে বাকি?’ এই দেখুন স্যার, আপনি অহেতুক বাইশ সেকেন্ড নষ্ট করে দিলেন। শুনুন :

—আমার আশঙ্কা : আমি বেমক্কা খুন হয়ে যেতে পারি। আমার স্ত্রীর স্বভাবই হচ্ছে নিত্যনতুন শাড়ি-ব্লাউজ, নিত্যনতুন পুরুষমানুষ। কী করব? এটা ওর রক্তে। আমি মেনে নিয়েছি। কিন্তু আমার অবস্থাটা দেখুন। লেখাপড়া অল্প শিখেছি। চাকরি জুটেছিল ফুটবলার হিসাবে। ঠ্যাঙ ভেঙে আমি অথৈ জলে। একবার বাইসিক্ল কিকে গোল্ডেন গোল করে ফাইনাল জিতেছিলাম। কাগজে ছবি পর্যন্ত বের হয়েছিল। অবশ্য আমার নয় বাইচুঙের। বাইসির কিকে কেউ গোল করলেই সব খবরের কাগজে বাইচুঙের সেই অনবদ্য ছবিখানি ছাপা হয়। তলায় ক্যাপশানে অবশ্য নতুন গোলদাতার নামটা ছাপা হয়। ফটোতে অ্যাকশন আছে, বাইচুঙের মুখখানা দেখা যায় না। তাতেই এই সুবিধে। ঘটনাচক্রে বিদ্যেধরী মাঠে ছিলেন। তখন তিনি শেষ স্বামীর বন্ধন থেকে সদ্যমুক্ত। প্রেমে পড়লেন আমার। অর্থাৎ তিনিও বাইসি কিকে উল্টে গেলেন। যেচে আলাপ করলেন। রেজিস্ট্রি বিয়ে করলেন। ঠিক তার পরেই আমি হাঁটু ভাঙলাম। আর্থিক সঙ্গতির দিক থেকে এখন আমি ওঁর নিরুপায় পরগাছা। বডি গার্ড-কাম ড্রাইভার-কাম হ্যান্ডিম্যান-কাম বেড-পার্টনার। অবিশ্যি সপ্তাহে আমার সে সৌভাগ্য জোটে গড়ে দু’দিন। বাকি পাঁচ দিন তিনি বিকল্প ব্যবস্থা করেন। এতে ওঁর স্বভাবব্যাভিচারী চরিত্রটা তৃপ্ত হয়, বেশ কিছু অর্থাগমও হয়। আমার আপত্তি তো নেই, আগ্রহ আছে।…মাসিমা কিছু মনে করছেন না তো?

রানী বলেন, না, না, এসব কেসে আমি অভ্যস্ত। বলে যাও তুমি।

—হঠাৎ এ হারামজাদা ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খেতে চায়। আমার স্ত্রীকে বলেছে, বেশ কিছু ‘অ্যালিমনি’ দিয়ে ওই সোমেশ্বরটাকে বিদায় কর। আমিও আমার স্কুল-মিস্ট্রেস স্ত্রীকে ডিভোর্স দেব। আর তারপর রূপকথার রাজপুত্তুর রাজকন্যার মতো আমরা দুজন সুখে থাকব ‘এভার আফটারওয়ার্ডস্’। আমি, স্যার, রাজি হইনি, হবোও না। যে হাঁস নিত্যি সোনার ডিম পাড়ে, তাকে কি কেউ ‘অ্যালিমনি’ নিয়ে বেচে দেয়। ফলে ওরা ডেস্পারেট। আমার লাইফের উপর অ্যাটেম্‌ হতে পারে। তিনকূলে আমার কেউ নেই। কিন্তু আমি চাই অপঘাতে আমার মৃত্যু হলে আপনি তদন্ত করে দেখবেন।

—হ্যাভ য়ু ফিনিশড?

–ইয়েস স্যার। এবার আপনার মতামত শুনতে চাই।

—তুমি যা বললে আমি শুনে গেলাম। কেস নিই আর না নিই এটা আপাতত কনফিডেনশিয়াল। এখন আমার ঘুমের সময়। ভেবেচিন্তে তোমাকে পরে জানাব।

—থ্যাঙ্কু, স্যার।

হঠাৎ কোথাও কিছু নেই নিচু হয়ে পদধূলি নিয়ে দ্রুত প্রস্থান করল সোমেশ্বর ইয়েল লকওয়ালা দরজাটা টেনে দিয়ে।

.

রাত আটটা। কৃষ্ণা ত্রয়োদশীর রাত্রি। কিন্তু নির্মেঘ আকাশে একটিও তারা দেখা যাচ্ছে না। হোটেলের সম্মুখস্থ মার্কারি-ভেপার ল্যাম্পের দৌরাত্ম্যে। ওঁরা সবাই বসেছিলেন হোটেলের সামনে পোর্চ-এ। কেউ কেউ সামনের বালুবেলায় ছাতার নিচে। হঠাৎ দুম করে লোড-শেডিং হয়ে গেল। তৎক্ষণাৎ লাফিয়ে উঠলেন বাসু-সাহেব। তুলে নিলেন এক হাতে ছোট টর্চটা, অন্য হাতে কর্নেলের বাইনো। পড়ি-তো-মরি ছুটলেন নির্জন সৈকতে।

—কী হলো?—বলে পিছন-পিছন ছুটে এল কৌশিক।

—লুক অ্যাট দ্যাট সিলেস্টিয়াল কাপ, ওভারটার্নড অন দ্য ফেস অব দ্য সী।

আমাদের দৃষ্টিতে ওরা হঠাৎ-ফুটে-ওঠা এক ঝাঁক অচেনা তারা। আর ওঁর কাছে সবাই হারানো বান্ধবী। নাগরিক আলোর রোশনাইয়ে ওরা ছিল বোরখাঢাকা। সূর্য এখন বৃষ রাশিতে। ওই তো পশ্চিম দিগ্বলয়ে সিংহ রাশির মঘা—রেগুলাস। উত্তরাকাশে ডেনেব, অভিজিৎ; দক্ষিণাকাশে বৃশ্চিক রাশি জ্বলজ্বল করছে—তার মধ্যমণিকা অ্যান্টারিস : জ্যেষ্ঠা। বু নক্ষত্রমণ্ডলী, দু’হাত বাড়িয়ে প্রতীক্ষমানা : স্বাতী।

পর পর দুটি ঘটনায় তন্ময়তা কেটে গেল বাসু-সাহেবের। প্রথমত, লোড-শেডিং শেষ হলো। বাতি জ্বলে উঠল। দ্বিতীয়ত, একটা টাটাসুমো গাড়ি এসে দাঁড়াল পোর্চের কাছে।

গাড়ি থেকে নেমে এল ওরা দুজন। মালপত্র কিছু নেই। দুজনেরই কাঁধে দুটি হাতব্যাগ। অনামিকার পরনে এখন নীলরঙের একটা জর্জেট বেনারসী, ম্যাচিং ব্লাউজ আর নীল হাইহিল, নীল হাতবটুয়া। গেইনস্বরো ওকে দেখলে ব্লু-বয়ের পরিপূরক একটি ‘ব্লু-গ্যের্ল’-এর ছবি আঁকতেন হয়তো; আর পঞ্চতন্ত্রের লেখক দেখলে লিখতেন ‘সা নীলীবর্ণা সঞ্জাত’।

হাতবটুয়া খুলে ড্রাইভারকে টাকা মিটিয়ে দিল অনামিকা। তারপর চোখ তুলেই দেখতে পেল সামনে দাঁড়িয়ে আছে সোমেশ্বর। আদুরে গলায় সে বলতে গেল, ওহ্। হাউ য়ু মিস্ড ইট ডার্লিং। চিল্কা ইজ…

কথাটা তার শেষ হলো না সোমেশ্বরের চোখে চোখ পড়ায়। সোমেশ্বরের দক্ষিণ-তর্জনীতে একটি চাবি দোদুল্যমান। ঠাণ্ডা গলায় সে বললে, ন্যাকামি যথেষ্ট হয়েছে। এবার ঘরে যাও জামা-কাপড় ছাড়গে।

অনামিকা কী একটা কথা বলতে গেল প্রত্যুত্তরে। তারপর লগুড়াহত কুক্কুরীর মতো মাথা নিচু করে স্থানত্যাগ করল। সোমেশ্বর এগিয়ে এল এক-পা। সমরেশের কাঁধের উপর রাখল একটা বাঘের থাবা। তারপর মিহি গলায় বললে, তারপর মিস্টার শুয়োরের বাচ্চা। আপনি কী স্থির করলেন? নিজে থেকেই নামবেন, নাকি আমাকেই সেটা করতে হবে?

সমরেশ নিশ্চয় গিট্-কনশাস। আমতা-আমতা করে বলে, এসব আপনি কী বলছেন, মিস্টার ঘোষাল? কোথা থেকে নামব?

—আমার বিবাহিতা স্ত্রীর স্কন্ধ থেকে। নিজেই নামবেন, না আমি ঘাড় ধরে নামাবো?

—আমি…আমি…আমার কী দোষ? আপনি মদের খোঁয়াড়ে উঠতে পারলেন না, আমার স্ত্রী অসুস্থা হয়ে পড়লেন …

—তাহলে আপনি গোটা ট্রিপটা ক্যানসেল করলেন না কেন? আমরা কাল যেতাম, অথবা পরশু?

—বাঃ। অনেক টাকা যে অগ্রিম দেওয়া ছিল—

—সেটা তো দিয়েছিলেন আমার স্ত্রী, আপনি নয়।

—কারেক্ট। তাহলে প্রশ্নটা আপনার স্ত্রীকেই করবেন। আমাকে কেন?

—আপনাকে শুধু সাবধান করে দিতে চাই; পরস্ত্রীর সঙ্গে কিছু ফূর্তিফার্তা করতে চান করুন—যদি আপনার স্ত্রীর আপত্তি না থাকে। কিন্তু মনে রাখবেন, আমার বিবাহবিচ্ছেদ- বিশারদা স্ত্রী এবার তাঁর সাতপাকে বাঁধা বাঁধনটা ছিঁড়তে পারবেন না। আপনি যদি কোনও প্রফেশনাল কিলারকে এনগেজ করেন তাহলে তাকে কাইন্ডলি জানিয়ে দেবেন যে, তার টার্গেটের হিপ্-পকেটে সব সময় একটা লোডেড যন্ত্র থাকে। সেটা হিসাব করে যেন সে ‘ফি’- টা স্থির করে।

হিপ্‌-পকেট থেকে একটা ছোট্ট কোল্ট পিস্তল বার করে সে শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে ফের লুফে নিল।

সমুদ্রগর্জনে সব কথা হয়তো শোনা যাচ্ছিল না, কিন্তু অধিকাংশই শ্রুতিগোচর হচ্ছিল একসার দর্শকবৃন্দের শ্রুতিতে।

এবার সেদিকে ফিরে সমরেশ বললে, আপনারা দেখুন, উনি রিভলভার দেখিয়ে আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন।

হঠাৎ লাফিয়ে উঠলেন কর্নেল সমাদ্দার। এক-পা এগিয়ে এসে বলে ওঠেন, ইয়েস। য়ু কান্ট ডু দ্যাট। দ্যাটস্ আ ক্রিমিন্যাল অফেন্স।

সোমেশ্বর বললে, থানা তো কাছেই। একটা এফ্. আই. আর দাখিল করে আসুন না স্যার। স্বয়ং ব্যারিস্টার সাহেবই তো সাক্ষী আছেন।

পিস্তলটা হিপ-পকেটে ভরে সে ফিরে চলল নিজের ঘরে।

.

রাত্রে ডিনার টেবিলে সবার খেয়াল হলো চারজন বোর্ডার অনুপস্থিত। দু’জোড়া কর্তা- গিন্নি। তারা বোধকরি একটু আড়ালে থাকতে চায়। অন্তত একটা রাত। তাই দূরভাষণে অর্ডার দিয়ে নৈশাহার নিজেদের ঘরে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করেছে।

.

পরদিন অতি প্রত্যূষ। হোটেলের প্রধান ফটক তখনো তালাবন্ধ। বাসুকে দেখে সিকিউরিটির লোকটা ঘুম-জড়ানো চোখে সোফা থেকে উঠে দাঁড়াল। প্রশ্ন করে, সাম্রাইজ দেখবেন, স্যার? লেকিন অখনো বিশ-বাইশ মিনিট দের আছে।

বাসু বললেন, তা হোক। গেটটা খুলে দাও তুমি। সকালের ‘ওজোন’ নেব একটু লাংসে।

লোকটা কিছুই বুঝল না। অবাক হয়ে তাকাল। বাসু-সাহেব একহারা মানুষ। তিনি কেন ‘ওজন’ নিয়ে ব্যস্ত হচ্ছেন? যা হোক সে খুলে দিল দরজা।

বাইরে আসতেই ঠাণ্ডা বাতাসের একটা ঝাপটা লাগল মুখে। সেটা উপভোগ করলেন। মার্কারি-ভেপার ল্যাম্পটা নেভানো তাই আবার এক আকাশ তারা। তবে যারা ছিল সন্ধ্যার সাক্ষী তারা অস্তমিত। উঠে এসেছে নতুন তারার একঝাঁক প্রজাপতি। সামনের পিচ-ঢালা রাস্তায় নেমে পড়লেন। শেষরাতের হিমেল আর্দ্র বাতাসটা উপভোগ করতে করতে হনহনিয়ে এগিয়ে চললেন। সূর্যোদয় আজও দেখা যাবে না। পুব-আকাশে মেঘ আছে। হঠাৎ আধো- আলো, আধো-অন্ধকারে বাসু-সাহেবের নজর হলো হোটেল থেকে চাদর মুড়ি দেওয়া কে একজন এগিয়ে আসছে। খর্বকায় ব্যক্তি; বোধহয় আলখাল্লা জাতীয় কিছু পরা। আরও একটু কাছে আসতে বাসু বুঝতে পারেন : ওটা আলখাল্লা নয়, গাঢ় রঙের নাইটি। আর সেই সঙ্গে চিনেও ফেললেন ওকে : অর্পিতা পালিত।

একটি ছাতার তলায় শিশির-ভেজা চেয়ারেই বসে পড়লেন উনি। অর্পিতা এগিয়ে এসে নীরবে বসল তাঁরে পাশের চেয়ারে। দুজনেই প্রথমে নীরব। শেষে বাসু বলেন, কিছু বলবে আমাকে?

—সেই জন্যেই তো ছুটে এলাম। আমি জানি, আপনি খুব ভোরে বেড়াতে আসেন।

—বল?

—এখন আমি কী করব স্যার?

–ব্যাক টু স্কোয়ার ওয়ান? এ প্রশ্নের জবাব তো কালই দিয়েছি। তুমি শুনলে না। আজও ওই একই পরামর্শ দেব। আমার আশঙ্কা এবারেও তুমি শুনবে না।

—কিন্তু কী করে যাব? ও যে কিছুতেই রাজি হচ্ছে না।

—বুঝলাম। আমার কতকগুলি প্রশ্নের জবাব দাও তো অর্পিতা। কাল সকালে তুমি ভুল করে ব্রজবাবুর চাবিটা নিয়ে চলে গেলে। তারপর কী হলো? কী করলে তুমি?

—ডায়াজিন ট্যাবলেটটা খেলাম। ঘুমের ওষুধটাও খেলাম। তারপর শুয়ে পড়লাম। পাক্কা চার ঘণ্টা টানা ঘুমিয়েছি।

—না। তা তুমি ঘুমাওনি। সাড়ে দশটা নাগাদ হোটেল ম্যানেজমেন্ট থেকে ওরা ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে তোমার ঘরটা খুলেছিল। তখন তো তুমি ঘরে ছিলে না?

—সাড়ে দশটার সময়? ও হ্যাঁ, একবার বার হয়েছিলাম বটে। কলকাতায় একটা এস. টি. ডি. করতে।

—কাকে? তার নাম্বারটা কত?

—কী আশ্চর্য। আপনি বিশ্বাস করছেন না? নম্বর কি আমার মুখস্থ? সে তো আমার ডায়েরিতে লেখা আছে। ঘরে চলুন, দেখে বলছি।

—তার আগে বল, তুমি নিজের ঘরে ঢুকলে কী করে? তোমার হাতে তো ব্রজবাবুর ঘরের চাবি। তাহলে তুমি কেমন করে চাবি খুলে ঘরে ঢুকলে? ওষুধগুলো খেলে? সাড়ে দশটা নাগাদ ডায়েরিটা হাতে নিয়ে এস. টি. ডি. করতে বেরিয়ে গেলে?

–বাঃ। ওরা…মানে, রিসেপশান থেকেই তো ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে আমার ঘরটা আমাকে খুলে দিল।

—সেটা তো বেলা এগারোটা দশে। রিসেপশানের কাউন্টারে যে মেয়েটি বসে তার স্টেটমেন্ট অনুসারে।

হঠাৎ যেন একটা নতুন কথা মনে পড়ে গেল অর্পিতার। বললে, ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে। আপনাদের ওখান থেকে বেরিয়ে এসে আমি ঘরে আদৌ ঢুকিনি। ওষুধটাও তখন খাইনি। একটা রিক্শা ধরে চলে গিয়েছিলাম এস. টি. ডি. বুথে।

—কিন্তু তোমার ডায়েরি তো ঘরে। আর নম্বর তো তোমার মুখস্থ নেই।

—কী আশ্চর্য। আপনি এভাবে জেরা করছেন কেন? আমি অহেতুক মিথ্যা বলতে যাব কেন বলুন? কাল ডায়েরিটা ছিল আমার ভ্যানিটি ব্যাগে। তাই কোনও অসুবিধা হয়নি।

—বুঝলাম। তা তুমি আমার কাছে ছুটে এসেছ কেন?

—ওই তো। একই কথা জিজ্ঞেস করতে। আমি এখন কী করব?

বাসু বললেন, ওই তো, একই জবাব দেব আমি। রিপিট দ্য মিক্সচার। এক্ষুণি হোটেল ছেড়ে খেলাৎবাবু লেনের বাসায় ফিরে যাও। তোমার কর্তা সঙ্গে গেল কি না ফিরেও তাকিয়ে দেখ না।

—কিন্তু …

—কালই বলেছি : কিন্তুর শেষ নেই। আমার রায় আমি দিয়েছি। নিজের অন্তরকে জিজ্ঞেস কর অর্পিতা—এ-কথা কেন আমি বলেছি। তারপর আমার কথায় নয়—বিবেকের নির্দেশে পথ চল।

হন্‌হন্ করে এগিয়ে গেলেন বাসু সাহেব।

.

ব্রেকফাস্ট সেরে আবার সবাই সমবেত হয়েছেন সমুদ্রসৈকতে। তবে আবার সবাই অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন দাবার ছকটা পেতে ওরা দুজন আপনমনে খেলছে। কী বিচিত্র মনুষ্যচরিত্র। কাল রাত্রে যারা লড়াই-কাজিয়ার চূড়ান্ত করেছে তারা আজ এ-ভাবে দাবা খেলে কী করে?

প্রশ্নটা বান্ধবীকে জিজ্ঞেস করল পায়েল, ওদের কি হায়া-কায়া, লজ্জা-শরম কিচ্ছুটি নেই?

সুদীপা প্রতিপ্রশ্ন করে, তুই বনফুলের ‘দ্বৈরথ’ পড়েছিস?

–না। একথা কেন?

—পড়া থাকলে বুঝতে পারতিস।

হঠাৎ কর্নেল সাহেব বলে ওঠেন, আজ ড্রিংসটা স্ট্যান্ড করব আমি। তবে আমি বুড়ো মানুষ। কৌশিক, তুমি জেনে নাও কে কী খাবে? এন্তাজাম কর।

সমরেশ বলে, আমিও আপনার সঙ্গে যাচ্ছি, কৌশিকবাবু।

সোমেশ্বর বলে, বাঃ। খেলাটা—?

–ও। আপনার বুঝি নজরে পড়েনি? এই ঘোড়ার কিস্তিতেই তো আপনি মাৎ। আবার চালটা ভুল দিয়েছিলেন আপনি।

সোমেশ্বর হতাশ। বলে, হেত্তেরি। পরপর দু’বার মাত হয়ে গেলাম।

ইতিমধ্যে কৌশিক সংগ্রহ করে জেনে নিয়েছে কে কী নেবে। সকলেই নিজ-নিজ পছন্দ মতো ড্রিংস নিয়েছেন। দিদিমণিদ্বয় আজ ‘ভদ্‌কা’ পরখ করতে রাজি হয়েছেন। তবে এক-এক পেগ মাত্র। বাসু, কর্নেল আর ব্রজবাবু নিয়েছেন মাছরাঙা। পার্থক্যের মধ্যে সোমেশ্বর আজ আর হুইস্কি নেইনি। নিয়েছে জিন-উইথ্-ফ্রেশ লাইম।

আজ আরও একটা ব্যতিক্রম হলো। ঘিয়ে রঙের একটি বালুচরী পরে হঠাৎ ভিতর দিক থেকে বার হয়ে এল অনামিকা। অমিট্রায়ের ভাষায়—এ তো আগমন নয়, আবির্ভাব।’

যুক্তকর বুকের সামনে তুলে অনামিকা বললে, আপনাদের কারও সঙ্গে আমার আলাপ হয়নি। দোষটা আমারই। সেই ত্রুটি সংশোধন করতে এলাম। সকলের সঙ্গে পরিচিত হতে। কী জানেন, আমি লোকটা স্বভাবতই আত্মকেন্দ্রিক। ইনট্রোভার্ট। লোকজনের সঙ্গে সহজে মিশতে পারি না।

সুদীপা এ সুযোগ ছাড়ল না। বলে, তাই বুঝি? অর্পিতাপতির সঙ্গে আপনার দ্রুত গড়ে- ওঠা বঙ্কুত্বে আমরা সেটা ঠিক বুঝে উঠতে পারি নি।

অনামিকা অবাক হয়ে বলে, ‘অর্পিতাপতি।’ তার মানে?

—অর্পিতার পতি। আমি ষষ্ঠী তৎপুরুষে বলেছি। অর্থাৎ সমরেশবাবু

অনামিকা বুঝতে পারে এরা ওর ‘লেগ্ পুলিং’ করছে। সোমেশ্বরের কথামতো এ ধাষ্টামো না করলেই ভাল হতো। কিন্তু এখন আর পিছানো চলে না। সুদীপার দিকে ফিরে বলে, আয়াম সরি, অর্পিতাদি। অনেক আগেই আমার উচিত ছিল আপনার সঙ্গে আলাপ করা। সমরেশ আপনার কথা তো সব সময়ে বলে।

সুদীপা প্রতিনমস্কার করে বলে, আমার নাম সুদীপা বাগচি।

অনামিকা বিহ্বল হয়ে ইতিউতি চাইতে থাকে। করুণা হয় রানী দেবীর। অর্পিতার পিঠে একটি হাত রেখে বলেন, এর নাম অর্পিতা। ভারি ভাল মেয়ে

দুজনেই দুজনকে হাত তুলে শুধু নমস্কার করে। কারও কণ্ঠে কথা ফোটে না। ধপ করে বসে পড়ে অনামিকা। সোমেশ্বরের দিকে ফিরে বলে, আমাকেও একটা ড্রিংস্ দিতে বল : জিন-উইথ-ফ্রেশ লাইম।

মিনিট খানেক আগে সোমেশ্বরের হাতে সমরেশ ধরিয়ে দিয়েছে একটা গ্লাস। সেটা থেকে পান শুরু করেনি সোমেশ্বর। খেলাচ্ছলে শুধু গ্লাসটা অন্যমনস্কভাবে নেড়েই চলেছে। যেন লেবুর সরবতে চিনি মেশাচ্ছে। আসলে সে ভদ্রতা করে গ্লাসটা হাতে ধরে অপেক্ষা করছিল। সবাই একসঙ্গে ‘চিয়ার্স’ বলে পান শুরু করবে বলে। এখন গ্লাসটা তার স্ত্রীর দিকে বাড়িয়ে ধরে বলে, তুমি এটা নিতে পার, আমি এঁটো করিনি।

পায়েল বললে, এঁটো করলেই বা ক্ষতি কী? কর্তার উচ্ছিষ্ট তো গিন্নিরা খেয়ে থাকেন।

সোমেশ্বর বললে, কী করে জানলেন? আপনি তো বিয়ে করেননি।

পায়েল কী জবাব দেবে ভেবে পায় না। সুজাতা তার সাহায্যে এগিয়ে আসে। বলে, বাসি বিয়ের দিন কর্তার পাতাতেই তো নববধূকে খেতে হয়, এ তো সবাই জানে।

রানী দেবী সচরাচর এসব তর্কাতর্কিতে থাকেন না। আজ আগ বাড়িয়ে বললেন, মনুসংহিতার গৃহ্যসূত্রে বলা হয়েছে “ভুক্তেবাচ্ছিষ্টংবর্ধ্বে দদাৎ।”

পানীয় গ্লাসটা তখনো সোমেশ্বরের হাতে ধরা। যেন এ বিতর্ক শেষ না হওয়া পর্যন্ত গ্লাসটা সে হস্তান্তর করবে না। বলে, তার মানে?

রানী ব্যাখ্যা দেন, গৃহ্যসূত্রাকার শিষ্যকে বলছেন, ‘বাপুহে। আহারান্তে যা খেতে পারলে না সেই ভুক্তাবশিষ্ট-সমেত এঁটো পাতাখানা স্ত্রীকে ধরে দেবে।’

সুদীপা বাঙলায় এম. এ.। সে আর নিশ্চুপ বসে থাকতে পারল না। বলে ওঠে, ওসব হচ্ছে ‘উইমেন্‌স্‌ লিব’-এর আগের জমানার কথা, মাসিমা। এখন কর্তারাও হামেহাল গিন্নির এঁটো খেয়ে থাকেন।

সোমেশ্বর একই প্রশ্ন করে, আপনিই বা কী করে জানলেন? আপনারও তো ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নেই, মিস্ বাগ্‌চি।

সুদীপা চটজলদি জবাব দেয়, ওটা আপত্তিকর হলে বাঙলা সাহিত্যে বঙ্কিম থেকে রবীন্দ্রনাথে আমরা ‘মুখচুম্বন’ শব্দটা পেতাম না। সেই আনন্দঘন মুহূর্তে কে কার উচ্ছিষ্ট পান করে? বলুন? আমার না থাক আপনার তো সে অভিজ্ঞতা আছে।

রানী ছদ্মভর্ৎসনা করে ওঠেন, মেয়েটার মুখের কোনও আড় নেই।

সোমেশ্বর যেন পরাজয় মেনে নিয়ে এতক্ষণে গ্লাসটা অনামিকাকে হস্তান্তরিত করে। ইতিমধ্যে সমরেশ আর একটি জিন-উইথ-লাইম সোমেশ্বরের টেবিলে নামিয়ে রেখেছে। বস্তুত সকলের হাতেই পানপাত্র পৌঁছেছে। ‘চিয়ার্স’ বলে সবাই একসঙ্গে পান শুরু করে। ব্যতিক্রম শুধু অনামিকা। তার গলাটা এতক্ষণে শুকিয়ে কাঠ। মদ্যপানে সে অভ্যস্তও। ঢক্-ঢক্ করে প্রায় গোটা গ্লাসটা শেষ করে ঠক করে টেবিলে নামিয়ে রাখে।

রানী দেবী অনামিকাকে বলতে গেলেন, তোমাদের চিল্কা ভ্ৰমণটা…

কথাটা তাঁর শেষ হলো না। ওঁর মনে হলো, অনামিকা কেমন যেন করছে। তার ঠোঁট দুটো নীল হয়ে গেছে। বুকের বাঁ-দিকটা খামচে ধরে সে যেন নেতিয়ে পড়ছে।

সুজাতা চিৎকার করে উঠল, কী? কী হয়েছে অনামিকা? তুমি ওরকম করছ কেন?

সবার দৃষ্টি ঘুরে গেল অনামিকার দিকে। অনামিকা ততক্ষণে প্রায় শুয়ে পড়েছে। ঠোঁট দুটো অল্প ফাঁক হয়ে গেছে। মুখটা নীল। শিবনেত্ৰপ্ৰায়।

সোমেশ্বর তার উপর ঝুঁকে পড়ে বলল, কী কষ্ট হচ্ছে অনু?

—বুঝতে পারছি না…বুকে অসহ্য যন্ত্রণা…ওই ড্রিংকস্টাতেই…

—এই ‘জিনটার’ কথা বলছ?

বহু কষ্টে মাথা নাড়িয়ে অনামিকা জানাল : হ্যাঁ, তাই।

—কিন্তু ওটা তো…ওটা তো আমার হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল সমরেশ। ইয়েস। ইট ওয়াজ মাই গ্লাস। গুড গড!

হঠাৎ লাফিয়ে উঠল সে। সমরেশের কলারটা চেপে ধরে বলে, য়ু, সান অফ আ বিচ্। বল্…বল্…আমার গ্লাসে কী মিশিয়েছিলি?

কৌশিক লাফিয়ে পড়ে বাধা দেয়। বলে, কী হচ্ছে এসব? সরে আসুন আপনি — অনামিকাকে নিশ্বাস নিতে দিন…

কিন্তু নিশ্বাসের জন্য বাতাসের আর প্রয়োজন ছিল না অনামিকার। তার ভবযন্ত্রণার অবসান হয়েছে।

কর্নেল চিৎকার করে উঠলেন : ডাক্তার। এক্ষুণি একজন ডাক্তার।

বাসু ভিড় ঠেলে এগিয়ে এলেন। অনামিকার কব্জি, বাহুমূল এবং চিবুকের নিচে হাত দিয়ে পরীক্ষা করলেন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, সরি। শী হ্যাজ এক্সপায়ার্ড।

.

ঘণ্টা দুয়েক পরের কথা। হোটেলের হাউস ডক্টর এসে সরকারীভাবে অনামিকাকে মৃত ঘোষণা করে গেছেন। থানা থেকে দুজন অফিসার এসেছিলেন। তাঁরাও মৃতদেহ পরীক্ষা করলেন। ফটো নিলেন। মৃতদেহকে মর্গে পাঠাবার ব্যবস্থা করলেন।

একে-একে সকলেরই জবানবন্দি নেওয়া হলো। হ্যাঁ, এটা ফ্যাক্ট যে, সমরেশ একটা ট্রে- তে পাঁচ-সাতটি পানীয় সাজিয়ে নিজহাতে ‘বার’ থেকে লাউঞ্জ পার হয়ে পোর্টিকোর জমায়েতে নিয়ে এসেছিল। সোমেশ্বর ট্রে থেকে যে-কোনও একটি গ্লাস তুলে নেয়নি, বরং সমরেশই ওই বিশেষ গ্লাসটি তার হাতে ধরিয়ে দেয়। ‘বার’ থেকে লাউঞ্জ পার হয়ে বাইরে আসতে যে দেড়-দু’মিনিট সময় লাগে, সে সময় সমরেশ একাই ছিল। কৌশিক তখন বার- কাউন্টারে। ফলে এইটুকু সময়ের মধ্যে সমরেশের পক্ষে কোনও নির্দিষ্ট গ্লাসে এক পুরিয়া বিষ মিশিয়ে দেওয়া অসম্ভব কোনও কাজ নয়। তবে, কেউ তাকে এ কাজ করতে দেখেনি এটাও সবাই দেখেছে যে, সমরেশ যে গ্লাসটা সোমেশ্বরের হাতে দিয়েছিল, সেটাই সোমেশ্বর তার স্ত্রীকে দেয় এবং অনামিকা সে গ্লাস থেকে পানীয়টা অতি দ্রুত খেয়ে ফেলে।

থানা-অফিসার প্রতিটি ঘর সার্চ করেছেন। একটি বিচিত্র বস্তু তিনি আবিষ্কার করেছেন। সমরেশদের ঘর থেকে। সমরেশেরই সুটকেসের একটা সিক্রেট পকেট থেকে। এক ‘ফায়াল’ ওষুধ—ডিজিটালিস গ্রুপের ঔষধ। নাম : স্টেফেথিন। ঔষধ বটে, তবে তীব্র বিষও অ্যাকিউট হার্ট পেশেন্টদের চিকিৎসায় তার অত্যন্ত সীমিত ব্যবহার। সাধারণ মানুষের ব্যাগে সেটা থাকার কথা নয়। নির্মাণকারীর মুদ্রিত তথ্যে জানা যাচ্ছে : ওটা একশ গ্রামের প্যাক। তার আধাআধি ফাঁকা। জানা গেল, বিশ গ্রামই ‘ফেটাল ডোজ’—অর্থাৎ বিশ গ্রামই মৃত্যুবাহী বিষ। সমরেশের বক্তব্য : সে ওটার কথা কিছুই জানে না। সে ওটা কেনেনি, দেখেনি, তার সুটকেসে রাখেনি। তার তালাবন্ধ ঘরে অন্য কেউ ওই সিক্রেট ড্রয়ারে ওটা রেখে গেছে এটা পুলিশ বিশ্বাস করেনি। ফলে সমরেশকে পুলিশে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেছে।

প্রায় উন্মাদিনীর মতো কাঁদতে কাঁদতে অর্পিতা ছুটে এসেছিল বাসু-সাহেবের ঘরে: আপনি ওকে বাঁচান, মেসোমশাই। ও একাজ করেনি। করতেই পারে না।—হাঁটু গেড়ে বসে জড়িয়ে ধরে ওঁর পা দুটো।

বাসু বলেন, উঠে বস, অর্পিতা, পাগলামি কর না। আমি কথা দিচ্ছি সমরেশের জন্য আমি যথাসাধ্য করব।

—আপনাকে কত ‘রিটেইনার’ দেব, মেসোমশাই?

—এখন নয়। আগে হাজতে গিয়ে ওর সঙ্গে কথা বলি। সে নিজমুখে আমাকে বলুক যে, সে এ কাজ করেনি।

অর্পিতা ছিলে-খোলা ধনুকের মতো সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ায়। বলে, তার মানে? আপনার মনে কি বিন্দুমাত্র সন্দেহ আছে যে, সমর এ কাজ করেও থাকতে পারে?

—না নেই। আমার বিশ্বাস : ও নির্দোষ। কিন্তু এটাই আমার কাজের ধারা। তুমি যাও, অর্পিতা। নিজের ঘরে বিশ্রাম নাও গে যাও। আমাকে একটু নিরিবিলি চিন্তা করতে দাও।

লাঞ্চে অধিকাংশই কোনওরকমে পিত্তিরক্ষা করে গেলেন। সকলের সব অনুরোধ উপেক্ষা করে অর্পিতা অনশনে রইল। ঘরে ‘ডোন্ট ডিস্টার্ব’ বোর্ড টাঙিয়ে ভিতর থেকে ছিটকিনি দিল।

সোমেশ্বরও লাঞ্চে গেল না। একটা জনি-ওয়াকারের বোতল আর তিন-চারটি সোডা ‘বার’কাউন্টার থেকে নিয়ে অর্গলবদ্ধ ঘরে নিজেকে স্বেচ্ছাবন্দী করল।

কৌশিক বাসুকে বলল, চলুন মামু, যাহোক মুখে দেওয়া যাক।

বাসু বললেন, তোমরা তিনজনে কিছু খেয়ে এস। আমার জন্য এক প্লেট স্ন্যাপ্স্ ঘরে পাঠিয়ে দাও।

—তুমি কি দিনের বেলা ওই সিভ্যাস রিগ্যাল-এর বোতলটা বার করতে চাও নাকি?—রানীর সশঙ্ক জিজ্ঞাসা।

বাসু বিনীতভাবে বললেন, প্লিজ রানু। ইটস আ ডে-অব্ একসেপশন।

.

বিকেল চারটে নাগাদ ওঁর ঘরের টেলিফোনটা বেজে উঠল। দুজনের কারও ঘুম হয়নি। বাসু-সাহেব ফোনটা তুলে আত্মপরিচয় দিতেই ও প্রান্ত থেকে রিসেপশনিস্ট জানাল যে, গঞ্জাম থেকে এস. পি. মিস্টার এম. এম. পানীগ্রাহী এসেছেন, বাই রোড। নিহত ব্যক্তিটি পশ্চিমবঙ্গের একজন সেলিব্রেটি শুনে, এবং মৃত্যুটা রহস্যময়, একথা জানতে পেরে। হোটেলে এসে তিনি জানতে পেরেছেন বোর্ডারদের মধ্যে ক্যালকাটা-বারের অতি বিখ্যাত ক্রিমিনাল-সাইড ব্যারিস্টার পি. কে বাসুও আছেন। তাই তিনি বাসু-সাহেবকে সেলাম দিয়েছেন। তিনি যদি কাইন্ডলি …

.

সন্ধ্যা পাঁচটা। দীর্ঘ এক ঘণ্টা একটি রুদ্ধদ্বার কক্ষে ওঁরা তিনজন কীসব পরামর্শ করলেন। লোকাল থানা-অফিসার মিস্টার বিনায়ক পাণ্ডে, এস. পি. পানীগ্রাহী আর বাসু-সাহেব। ম্যারাথন-ডিস্কাশন এক সময় শেষ হলো।

ওঁরা তিনজনে বার হয়ে এলেন। এস. পি. দৃঢ়ভাবে বাসু-সাহেবের করমর্দন করে বললেন, অশেষ ধন্যবাদ। ঘটনাচক্রে আপনি উপস্থিত না থাকলে হয়তো ভুল পথে কেসটা পরিচালিত হতো।

ওঁরা চলে গেলেন। ইন্টারোগেশনের জন্য অপির্তা আর সোমেশ্বরকে থানায় নিয়ে গেলেন। আগেও ওদের দুজনের জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই দীর্ঘ আলোচনার সময় এমন কিছু তথ্য জানা গেছে যে, এস. পি. মনে করছেন ওঁদের দুজনকে থানায় নিয়ে গিয়ে আরও নিবিড়ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা দরকার।

বাসু নিজের ঘরে গিয়ে দেখলেন সেটা তালাবন্ধ। সব ঘরই তাই। বুঝলেন, সব আবাসিকই সমবেত হয়েছেন বাইরের পোর্চে। অগত্যা সেদিকেই এগিয়ে গেলেন তিনি। হ্যাঁ, যা আশা করেছিলেন : আজ আর ছাতার তলায় কেউ যায়নি। পোর্চেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসেছে। আজ আর ‘অ্যাপিটাইজার’-এর কথা কারও মনে পড়েনি। তাস-দাবার আসরও বসেনি। ছোট ছোট গ্রুপে নিচু গলায় সারাদিনের অদ্ভুত ঘটনাগুলির রোমন্থন হচ্ছে। ওই সঙ্গে মানব-চরিত্রের বৈচিত্র্য, অর্পিতার দুর্ভাগ্য, সমরেশের নজিরবিহীন ব্যভিচার আর অনামিকার …

না থাক, আহা, মেয়েটা তো প্রাণ দিয়ে প্রায়শ্চিত্তই করে গেল।

বাসু-সাহেবকে দেখে ঝিমিয়ে পড়া জটলাটা উৎসাহিত হয়ে ওঠে। বাসু দ্রুত চোখ বুলিয়ে দেখে নিলেন প্রতিদিনের আড্ডাধারীদের মধ্যে চারজন মাত্র অনুপস্থিত: সোমেশ্বর, অর্পিতা, সমরেশ আর অনামিকা।

ব্রজদুলাল বললেন, আপনার সেই ভবিষ্যদ্বাণীটা দারুণভাবে ফলে গেল : সাইক্লোন একটা আসছে। কার ঘর ভাঙবে তা এখনই বোঝা যাচ্ছে না।

বাসু বললেন, সবটা প্রথমেই বোঝা যায় না। তাহলে তো দুর্ঘটনাটা এড়ানোই যেত।

কর্নেল বলেন, শুনলাম অর্পিতা আপনাকে সমরেশের তরফে লিগাল কাউন্সেলার হিসেবে রিটেইন করতে চেয়েছিল। আপনিই নাকি রাজি হননি।

বাসু গ্রীবা সঞ্চালনে স্বীকার করলেন।

কর্নেল সখেদে বললেন, কি করেই বা করবেন? সমরেশ যে অপরাধী এটা তো পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। সোমেশ্বর পাঁচ-দশ লাখ টাকা পেলেও অনামিকাকে ডিভোর্স দিত না। তাই তাকে দুনিয়া থেকে…

বাসু বাধা দিয়ে বললেন, সমরেশের জামিনের ব্যবস্থা হচ্ছে। কাল সকালেই সে ছাড়া পেয়ে যাবে—

কর্নেল পুনরায় বলেন, সাময়িকভাবে জামিনে ছাড়া পেলেও শেষ পর্যন্ত ওকে শাস্তি পেতেই হবে। কঠিন শাস্তি। ইটস এ ক্লিয়ার কেস অব মার্ডার।

—মানছি। খুনই। কিন্তু খুনটা করল কে?

—অভিয়ালি সমরেশ। আবার কে?

বাসু বলেন, একটা কথা আমাকে বুঝিয়ে বলুন তো, কর্নেল সমাদ্দার। আপনাদের সকলের মতে—পুলিশের মতেও—সমরেশ বিষটা মিশিয়েছিল। ধরিয়ে দিয়েছিল সোমেশ্বরের হাতে। কারণ সোমেশ্বর মারা গেলে সে অর্পিতাকে ডিভোর্স করে ওই অত্যন্ত ধনী, সুন্দরী, গ্ল্যামারাস মেয়েটিকে বিয়ে করতে পারে। এই তো? তাহলে সে যখন স্বচক্ষে দেখল যে, সোমেশ্বর সেই বিষমিশ্রিত পানীয়টা অনামিকার হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে, তখন সে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাধা দিল না কেন?—ওতে একটা মাছি পড়েছে’ এই অজুহাতে?

কেউ কোনও জবাব দিলেন না।

বাসু বলে চলেন, এ প্রশ্নের জবাব নেই। পানীগ্রাহীও খুঁজে পাননি। সেকেন্ডলি—ওই বিষের ফায়াল থেকে পঞ্চাশ গ্রাম বার করে নিয়ে কোন্ মূর্খ সেটা নিজের সুটকেসের সিক্রেট ড্রয়ারে লুকিয়ে রাখবে? এটা বিশ্বাসযোগ্য?

ব্রজদুলাল বলেন, কিন্তু সেখানেই তো ওটা পাওয়া গেছে। ওর তালাবন্ধ ঘরে, ওর তালাবন্ধ স্যুটকেসের সিক্রেট পকেটে কে সেটা লুকিয়ে রাখতে পারে বলুন? সে ছাড়া?

—আরও একজনের পক্ষে তা সম্ভব ছিল। ঘরের চাবি যার হেপাজতে হামেহাল আসে, সুটকেসের চাবিটাও এবং স্বামীর সুটকেসে সিক্রেট পকেট কোথায় আছে, তা একজনের পক্ষেই জানা সম্ভব।

কর্নেল বলেন, অর্পিতা? বাঃ। তার কী স্বার্থ?

কৌশিক বলে, আমারও একবার তাই মনে হয়েছিল। এটা একটা সুপরিকল্পিত জয়েন্ট অ্যাডভেঞ্চার। দুজনের মিলিত প্রচেষ্টায়। এটা ধরে নিলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। প্রথমত, অনামিকা বিষমিশ্রিত পানীয়টা পান করছে স্বচক্ষে দেখেও কেন সমরেশ ঝাঁপিয়ে পড়ে বাধা দেয়নি। দ্বিতীয়ত, সোমেশ্বর পানীয়টা হাত বাড়িয়ে নিয়েও কেন চুমুক দেয়নি? নানান কথাবার্তায় সে দেরি করাচ্ছিল আর ক্রমাগত—হ্যাঁ, আমি লক্ষ্য করে দেখেছি… ক্ৰমাগত হাতের গ্লাসটা নাড়াচ্ছিল। যেমন করে আমরা লেবুর সরবতে চিনি মিশিয়ে নাড়তে থাকি। তৃতীয়ত, কেন হত্যাকারী অতবড় কনক্লুসিভ এভিডেন্সটা নিজের হেপাজতে লুকিয়ে রাখবে? বঙ্গোপসাগরে ছুঁড়ে ফেলে দেবে না? মানে পঞ্চাশ গ্রামের পুরিয়াটা বানানোর পর। ফোৰ্থলি, কী ভাবে ওটা ওর সুটকেসের সিক্রেট ড্রয়ারে স্থানলাভ করল? আমার শুধু একটা প্রশ্নের সমাধান হচ্ছিল না, কেন? হোয়াই? কী জন্যে? দুজনে জয়েন্টলি এ দুঃসাহসিক কাজটা কেন করবে? স্বার্থটা কার?

বাসু বললেন, পার্টনার-ইন-ক্রাইম দুজনেরই স্বার্থ এতে জড়িত। সোমেশ্বর তার ব্যভিচারিণী স্ত্রীকে বরদাস্ত করে শুধু টাকার জন্য। বউটা মরে গেলে সেই একমাত্র ওয়ারিশ। কিন্তু স্ত্রীর অপঘাত মৃত্যু হলে পুলিস তাকেই সন্দেহ করবে—যেহেতু সেই একমাত্র ওয়ারিশ। তাই দুর্ঘটনাটা সর্বসমক্ষে হতে হবে। ওদিকে অর্পিতাও তার ব্যভিচারী স্বামীকে নিয়ে বীতশ্রদ্ধ, বিরক্ত। অপরের সুন্দরী স্ত্রী দেখলেই সমরেশের মাথা ঘুরে যায়। নির্লজ্জ ব্যবহার করতে থাকে। সুতরাং অনামিকা-হত্যার অপরাধটা যদি ওই সমরেশের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া যায় তাহলে ওদের কাউকেই আর কষ্ট করে ডিভোর্স নিতে হবে না। অনামিকার বিপুল সম্পত্তির অধিকারী হয়ে যাবে ওরা—সোমেশ্বর আর অর্পিতা। অনামিকা মৃত, সমরেশ ফাঁসিতে ঝুলেছে।

পায়েল বলল, কিন্তু এ ষড়যন্ত্রটা ওরা করল কবে, কখন?

—গোপালপুর-অন-সি আসার অনেক আগে। কলকাতায়।

সুদীপা বলে, আপনার কি ধারণা ওরা আগে থেকেই পরস্পরকে চিনত?

–ধারণা নয় সুদীপা। আমি প্রমাণ দেব। সমরেশ কখনো অনামিকাকে দেখেনি! অনামিকাও দেখেনি অর্পিতাকে। তাদের ব্যবহারে এটা স্পষ্ট বোঝা যায়। অনামিকাকে প্রথম দেখে সমরেশের মাথা ঘুরে যায়। আবার অনামিকা প্রথম দর্শনে অর্পিতাকে চিনতে পারেনি। সুদীপাকে ভেবেছিল সমরেশের স্ত্রী। অথচ অর্পিতা আর সোমেশ্বর পরস্পরকে চিনত গোপালপুর-অন-সীতে আসার আগেই।

কর্নেল বলেন, সেটা কী করে বুঝলেন? কোনও প্রমাণ পেয়েছেন?

—একেবারে সেই প্রথম দিনের ঘটনাগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ভেবে দেখুন। সোমেশ্বর এগিয়ে এসে আমাদের সকলের সঙ্গে আলাপ করল। বলল, সে শ্রুতিধর নয়, নামগুলো তার সব মনে থাকবে না। স্মরণ করে দেখুন, সে সময় সমরেশ উপস্থিত ছিল কিন্তু অর্পিতা তার জামা-কাপড় সুইমিং কস্টম আনতে ঘরে গেছিল। সোমেশ্বর একে একে সকলের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। কর্নেল আগবাড়িয়ে পরিচয়গুলি করিয়ে দিচ্ছেন। সেই খণ্ডমুহূর্তটাকে স্মৃতির মণিকোঠা থেকে ফিরিয়ে আনুন। কর্নেল বললেন, কৌশিক-সুজাতার সঙ্গে আছে একটি ক্যিউট বাচ্চা। কী নাম যেন? সুজাতা বলেছিল, মিঠু। কর্নেল ‘ক্যিউটা’ তুলে নিয়ে বলেন, “হ্যাঁ মিঠু। আর ইনি ব্রজদুলালবাবু। এসেছেন একাই। এছাড়া আছে আর একটি কাপল, সমরেশ আর…ওই তো, নাম করতে করতেই এসে পড়েছেন ওঁর বেটার হাফ।…” মনে করে দেখুন, কর্নেল সমরেশের কী উপাধি তা বলেননি। এরপর অনেকে অনেক কথা বলেছে। সোমেশ্বর সবাইকে এক-কোর্স করে ড্রিংক অফার করল। সুদীপা আর পায়লকে পীড়াপীড়ি করে জিন নিতে বাধ্য করল। তারপর সে অর্পিতার দিকে ফিরে জানতে চাইল, সে কী নেবে? কিন্তু ঠিক কী ভাষায়? কী বলেছিল সে… বলুন? এনিবডি—

সকলেই মাথা নিচু করে ভাবছে। তিন দিন আগে একটি খণ্ডমুহূর্তের কথা মনে করে বলা প্রায় অসম্ভব। রানী ইতস্তত করে বললেন, আমার যতদূর মনে পড়ে : সোমেশ্বর অর্পিতার দিকে ফিরে বলেছিল, আপনি কী নেবেন, মিসেস্ পালিত?

লাফিয়ে ওঠেন বাসু : একজ্যাক্টলি। হান্ড্রেড-পার্সেন্ট কারেক্ট। নাউ আসার দ্যাট মিলিয়ান ডলার কোশ্চেন : সোমেশ্বর কেমন করে জানল সমরেশের বেটার হাফ: ‘পালিত’? বোস নয়, ঘোষ নয়, চ্যাটার্জি নয়, পতিতুণ্ড নয়? পালিত? পূর্বপরিচিতি ছাড়া এটা হয় না, হতে পারে না।

ব্রজদুলাল বললেন, কারেক্ট। ওদের নিশ্চয় পূর্বপরিচয় ছিল।

বাসু বলেন, আর সেটা গোপন করার চেষ্টাও প্রকট। আমার মনে আছে, অর্পিতা আমার কাছে একবার সোমেশ্বরের প্রসঙ্গে ‘মিস্টার ব্যানার্জি’ বলে পরক্ষণেই সংশোধন করে নিয়ে বলেছিল ‘মিস্টার ঘোষাল’।

সকলে চুপ করে ভাবছে, কোথাও কোনও অসঙ্গতি আছে কি না।

বাসু আবার বলেন, অনামিকা আর সমরেশ যেদিন চিল্কা যায় সেদিন এই দুজন ষড়যন্ত্রকারী সম্পূর্ণ বহাল তবিয়তে ছিল। সোমেশ্বর আদৌ মদ্যপানে বেহুঁশ হয়নি, আর অর্পিতারও পেট কামড়ানো শুরু হয়নি। ওরা দুজন কায়দা করে বোকা দুটোকে চিল্কা পাঠিয়ে দিয়েছিল। আমি জানি না—আন্দাজ করছি—অর্পিতা আর সোমেশ্বর হয়তো তাদের প্রাকবিবাহ জীবনের প্রেমিক-প্রেমিকা। ব্রজদুলালবাবুর ওষুধ অর্পিতা আদৌ খাইনি। সে সোজা চলে গিয়েছিল সোমেশ্বরের ঘরে। নটা থেকে বারোটা সোমেশ্বরের বাহুবন্ধে সে জানতই না যে, তার হেপাজতে যে চাবিটা আছে তা ব্ৰজদুলালবাবুর ঘরের। মামলা যখন আদালতে উঠবে তখন এসব এভিডেন্স খুঁটিয়ে দেখা হবে। কোন দোকান থেকে সে কলকাতায় এস. টি. ডি করে। কত নম্বরে? কার সঙ্গে কথা বলে? পেটের ব্যথা সত্ত্বেও কেন সে টেলিফোন করতে যায়? কী জরুরি প্রয়োজন ছিল?

কর্নেল বলেন, দুর্ঘটনাটা এড়ানো যেত না?

বাসু বলেন, কী করে যাবে, বলুন? ওরা যে কীভাবে খুনের পরিকল্পনাটা ফেঁদেছে তা তো জানি না। আমি ক্রিমিনালদের জোড়টা ভাঙতে চেয়েছিলাম। অর্পিতা কলকাতা চলে গেলে সোমেশ্বর ঘাবড়ে যেত। একা হাতে অগ্রসর হতে সাহস পেত না। আর হয়তো সমরেশও ঘাবড়ে গিয়ে কলকাতা ছুটতো। কিন্তু অর্পিতা কিছুতেই স্থানত্যাগে রাজি হলো না। ফাঁসির দড়ি যেন ওকে টানছিল। ‘নিয়তি’ ছাড়া একে আর কী বলবেন বলুন?

সকলেই নতমস্তকে এই নতুন সমাধানটার কথা ভাবছে। বাসু-সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। বলেন, আর নয়, আপনারা সবাই গোপালপুর-অন-সীতে এসেছিলেন কেন? মৃত্যুরহস্যের কিনারা করতে নয়। সমুদ্রের ধারে বেড়াতে। সূর্যাস্ত হতে আরও পাঁচ-সাত মিনিট। আজ পশ্চিমাকাশে মেঘও নেই। সুতরাং : আউট য়ু গো, নেচার লাভার্স। সুদীপা-পায়েল তোমরা একদিকে যাও। এই ফুট্‌কিটাকেও নিয়ে যাও সঙ্গে করে। মিঠু রানীর কাছে থাকবে। কৌশিক। সুজাতা। তোমরা যাও ওদিক পানে।

ওরা একে একে রওনা হয়ে পড়ে। কর্নেল সাহেবও লম্বা লম্বা পা ফেলে মার্চের ভঙ্গিতে এগিয়ে যান। ব্রজদুলাল বলেন, মিসেস্ রানী বাসুর মেমারি তো অসাধারণ। ঠিক বলে দিয়েছেন।

বাসু স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বললেন, ও শুধু আমার সহধর্মিণীই নয়, শী ইজ মাই উইন্‌সাম ম্যারো।

ব্রজদুলাল হালে পানি পান না। ওয়ার্ডসওয়ার্থ ওঁর পড়া নেই। তিনি বিজ্ঞের হাসি হাসেন। কী করবেন? পণ্ডিত ব্যক্তির সঙ্গে বঙ্কুত্ব করলে এমন বিড়ম্বনা মাঝে মাঝে সইতেই হয়। রানী বৃদ্ধ বয়সেও রাঙিয়ে ওঠেন।

ব্রজদুলাল নতুন প্রসঙ্গের অবতারণা করেন : আপনার কী মনে হয়? সমরেশ আবার বিয়েথা করে সংসার পাতবে?

বাসু বলেন, জানি না। কেমন করে জানব?

রানী আগাড়িয়ে বলেন, আমার বিশ্বাস সে আর ঘর-সংসার করতে চাইবে না। কাল সকালেই সে হয়তো ছাড়া পাবে। আমার ধারণা : জামিন নয়, পার্মানেন্টলি। ওঁরা চার্জ ফ্রেম করবেন অর্পিতা আর সোমেশ্বরের বিরুদ্ধে। কিন্তু হোটেলে ফিরে এসে সমরেশ বেচারি কারও দিকে চোখ তুলে চাইতে পারবে না।

বাসু বলেন, অর্পিতা জনে জনে তার ব্যভিচারী স্বামীর কেচ্ছার কথা বলে বেড়াতো। চোখের জলে, কিন্তু রসিয়ে রসিয়ে। অথচ ভেবে দেখ : শিল্পীরা কখনো-সখনো অমন হয়ে থাকেন। পল গোগ্যা থেকে পাবলো পিকাসো কি তাঁদের প্রথমা পত্নীর প্রতি একনিষ্ঠ থাকতে পেরেছিলেন?

ব্রজদুলাল বলেন, রাইট। আই পিটি হিম্।

নো, স্যার।—প্রতিবাদ করে ওঠেন বাসু। সে শিল্পী, আপনার করুণার পাত্র নয়। স্বীকার করি : ও হরিপদ কেরানির চেয়েও বড় জাতের দুর্ভাগা :

ঘরেতে এসেছিল সে
কুচক্রী খুনীর বেশে
পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর।

—তাহলে তো সে করুণারই পাত্র?—আবার বলেন ব্রজদুলাল।

—আজ্ঞে না। সমরেশ মাথা নিচু করে ফিরে যাবে তার খেলাৎবাবু লেনের বাসায়। প্রতিবেশীরা জানতে চাইবে, অর্পিতা কোথায়? ও জবাব দিতে পারবে না। কিন্তু মাঝরাতে ও উঠে যাবে ছাদে। মাদুর বিছিয়ে বসবে। তার সেতারে মুর্ছিত হবে সিন্ধু-বারোয়ার তান। সেই সুরের সপ্তমস্বর্গে মিলে-মিশে একাকার হয়ে যাবে, সমরেশ পালিত, হরিপদ কেরানি আর আকবর বাদশা।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *