হরিনাথ ও হরিমতী
এক ভদ্রলোক প্রায় প্রতিদিনই অফিস থেকে সরাসরি বাড়ি না ফিরে এদিক ওদিকে অফিসের তাসের আড্ডায়, গলির মোড়ের চায়ের দোকানে, বেপাড়ার ক্লাবে অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা দিয়ে তারপর আসতেন। এই খারাপ অভ্যেসটা তার রক্তের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল এবং কোনওদিনই সন্ধ্যেবেলায় তাকে বাড়িতে পাওয়া যেত না। তাঁর বাড়ি ফিরতে রাত দশটা সাড়ে দশটা হয়ে যেত।
গল্পের খাতিরে ভদ্রলোকের একটা নাম দিতে হবে। ধরে নেওয়া যাক, ভদ্রলোকের নাম হরিনাথবাবু।
হরিনাথবাবুর এই নৈশ আড্ডার ব্যাপারটা আর দশজন সাধারণ ঘরণীর মতোই হরিনাথবাবুর স্ত্রী শ্ৰীমতী হরিমতী দেবীর মোটেই পছন্দের নয়। রাত জেগে তিরিশ বছর ধরে স্বামীর ভাত বেড়ে অপেক্ষা করতে করতে তিনি অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিলেন। তবু কিঞ্চিৎ চেঁচামিচি করে তিনি স্বামীকে ছেড়ে দিতেন। অবশেষে বোধহয় হাল ছেড়েই দিয়েছিলেন। খুব প্রয়োজন না হলে গালাগাল করেই ছেড়ে দিতেন। কিন্তু ধৈর্যের সীমা অতিক্রম করল একদিন রাতে। হিসেব মতো তখন রাত নয়, রাতগত দিন প্রায় সাড়ে বারোটা-একটা হবে।
হরিনাথবাবু আজ কোথায় গিয়েছিলেন কে জানে? অধিকাংশ দিন সাদাসিধে ভাবেই বাড়ি ফেরেন, আজ একটু নেশা করে বাড়ি এসেছেন। মুখে ম-ম করছে আরকের গন্ধ। চোখ ঠিক জবাফুলের মতো না হলেও বেশ লাল, তা ছাড়া পা টলছে, ঠোঁটে গুনগুনানি গান।
এতক্ষণ দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে ছিলেন হরিমতী দেবী। বিছানায় জেগে বসে ঢুলছিলেন খাটের বাজু ধরে আর মাঝেমধ্যে ভাবছিলেন পাড়া-প্রতিবেশীকে জানাবেন কি না। একই মেয়ে। তারও বিয়ে হয়ে গেছে, নিজের বাড়িতে তো আর কেউ নেই।
কিন্তু পাড়া-প্রতিবেশীকে, খবর দিলে এখন কী কেলেঙ্কারিই না হত।
এই মধ্যরাত পেরিয়ে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় টালমাটাল স্বামীকে দেখে হরিমতী দেবীর মাথায় রক্ত উঠে গেল। জীবনে কখনও যা করেননি আজ এই প্রৌঢ় বয়সে তাই করলেন। ছুটে রান্নাঘরে গিয়ে নারকেল কাঠির মুড়ো বঁটাটা এনে মনের দুঃখে স্বামীকে দু ঘা কষালেন তিনি।
নিগৃহীত হতেই কিঞ্চিৎ সম্বিত ফিরে এল হরিনাথবাবুর। তিনি দুহাত দিয়ে জাপটে গৃহিণীর হাত থেকে বঁটাটা কেড়ে নিয়ে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললেন, ওগো তুমি আমাকে বিনা কারণে আঁটা দিয়ে মারছ। আমার কথাটা আগে শোনো।
ঝাটা মারার পরিশ্রমে হাঁফাতে হাঁফাতে হরিমতী দেবী বললেন, কী কথা?
হরিনাথবাবু বললেন, তুমি যা ভাবছ তা নয়। আমি কোনও খারাপ কাজ করিনি। খারাপ জায়গায় যাইনি। আমি হাসপাতালে এক মরণাপন্ন বন্ধুর শয্যার পাশে বসেছিলাম।
এই কথা শুনে হরিমতী দেবী আরও খেপে গেলেন। চিৎকার করে বললেন, তাই যদি হবে তোমার চোখ তবে এত লাল কেন?
হরিনাথবাবু করুণ কণ্ঠে বললেন, ওগো, তুমি মোটেই বুঝতে পারছ না। আমি এত রাত পর্যন্ত জেগে রয়েছি আমার চোখ লাল হবে না? তোমার চোখও তো দেখি লাল হয়েছে।
সত্যি তাঁর নিজের চোখ লাল হয়েছে কিনা এবং যদি লাল হয়েই থাকে তবে তার কতটা ক্রোধে ও উত্তেজনায় এবং কতটাই বা রাত্রি জাগরণে সে প্রশ্নের মধ্যে প্রবেশ না করে কোনও জটিলতা সৃষ্টি না করে হরিমতী দেবী এবার জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাকে এরকম এলোমেলো দেখাচ্ছে কেন? তোমার পা টলছে কেন?
নিষ্ঠুরা স্ত্রীর এ হেন কঠিন প্রশ্ন শুনে এবার কপালে করাঘাত করলেন হরিনাথবাবু। ইতিমধ্যে তার নেশা প্রায় সম্পূর্ণ অন্তর্হিত হয়েছে। বেশ গোলাপি একটা নেশা হয়েছিল, সেটা কেটে যাওয়ায় কঠোর বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একটু খারাপই লাগছিল এখন হরিনাথবাবুর।
তাঁর বারবার ইচ্ছে হচ্ছিল বউকে তেড়ে যান, পরিষ্কার বলে দেন, নেশা করে এসেছি, বেশ করেছি, তার তোর কীরে মাগী। বেশি গোলমাল করবি তো এরপরে আর আসবই না।হরিমতাঁকে চুলের মুটি ধরে গোটা কয়েক থাপ্পড় ভাল করে তার গালে কষিয়ে কিছুক্ষণ আগের বঁটা প্রহারের উপযুক্ত প্রতিশোধ নেওয়ার একটা অদম্য ইচ্ছা হরিনাথের মনের গোপনে উঁকি দিচ্ছিল।
কিন্তু হরিনাথের এরকম সাহস নেই। তাঁর তিরিশ বছরের দীর্ঘ বিবাহিত জীবনে এ ধরনের সাহস প্রদর্শনের কোনও চেষ্টাই কখনওই তিনি করেননি। আজও হরিনাথবাবু সেরকম কোনও চেষ্টার ধারকাছ দিয়ে গেলেন না।
বরং কপালে করাঘাত করে বললেন, কী বললে, গিন্নি? আমাকে এরকম এলোমেলো দেখাচ্ছে কেন, আমার পা টলছে কেন?
অতঃপর একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে হরিনাথবাবু বললেন, তুমি বুঝতে পারছ না। রাত কাবার হতে চলেছে, আর সেই দুপুর থেকে কিছু খাইনি। চোদ্দো ঘণ্টা পেটে একটা দানা পড়েনি। আমার পা টলবে না তো কার পা টলবে গিন্নি? আমাকে এলোমেলো দেখাবে না তো কাকে এলোমেলো দেখাবে গিন্নি? তুমি কি ভাবো আমি মানুষ নই?
হরিনাথবাবু এরপর একটু দম নিয়ে আর একটি উদগত দীর্ঘনিশ্বাস চাপা দিয়ে প্রায় বিলাসের সুরে বললেন, আমার কি রক্ত-মাংসের শরীর নয়?
কিন্তু ভবি এত সহজে ভুলবার নয়।
শ্রীযুক্তা হরিমতীদেবী এ জীবনে শ্রীযুক্ত হরিনাথবাবুর এতাদৃশ অভিনয় বহুবার দেখেছেন। তিনি এত সহজে ছেড়ে দেবার পাত্রী নন। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তারপর বার দুয়েক নাক কুঁচকে হরিনাথবাবুর দেহনিঃসৃত কটু গন্ধ শুকে হরিমতী বললেন, কিন্তু তোমার মুখ দিয়ে তোমার সারা শরীর দিয়ে এত খারাপ গন্ধ বেরচ্ছে কেন?
এরপরে আর সহ্য করতে পারলেন না শ্রীযুক্ত হরিনাথবাবু। এ বয়সে ডুকরে কেঁদে ওঠা অস্বাভাবিক ব্যাপার, তা না করলেও বুক চাপড়ালেন হরিনাথবাবু, তারপর বললেন, হরিমতী, তুমি কিছু বুঝতে পারছ না। বারো ঘণ্টা হাসপাতালে ছিলাম। আমার গায়ে, মুখে, জামায় জুতোয় এসব হাসপাতালের গন্ধ।
অতঃপর আজকের দাম্পত্য মামলায় জয়ী হলেন হরিনাথবাবু।
কিঞ্চিৎ অনুতপ্তা, (ঝাটামারা, কটুক্তি ইত্যাদির জন্যে), হরিমতীদেবী উনুনে ভাত-টাত গরম করে হরিনাথবাবুকে খাওয়াতে বসলেন।
ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে চালকুমড়োর চচ্চড়ি চিবোচ্ছিলেন হরিনাথবাবু, আরেক হাতা গরম ভাত ঢেলে দিতে দিতে হরিমতীদেবী বললেন, তোমার যে বন্ধুকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলে আমি কি তাকে চিনি? কি নাম তার?
পরিতৃপ্তভাবে ইলিশ মাছের একটা কানকো চিবোতে চিবোতে হরিনাথবাবু বললেন, দেখো গিন্নি, ওর শরীরটা এতই খারাপ, ও এতই অসুস্থ যে ওকে আর জিজ্ঞেস করে উঠতে পারিনি ওর নামটা কী?
হরিনাথবাবুর ভাগ্য ভাল। ঠিক এই মুহূর্তে লোডশেডিং হয়ে গেল। অন্ধকারে উঠোন থেকে হরিমতীদেবী হরিনাথবাবুর ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া বঁটাটা কুড়িয়ে আনতে গিয়ে চৌকাঠে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলেন।
নিশ্চিন্ত চিত্তে অন্ধকারে ইলিশ মাছের কাটা চিবোতে লাগলেন হরিনাথবাবু।