হরর ক্লাব
হরর ক্লাবের সদস্য হওয়ার একটাই শর্ত-সদস্যকে ভূতের বলতে হবে। এই শর্ত দেয়ার পরে দেখা গেল-ভূতের গল্প জানা বা বলতে পারা লোকের অভাব নেই। তবে টিভি, ডিশ আর ইন্টারনেটের বদৌলতে মানুষের সময়ের বড়ই অভাব। ক্লাবের সদস্য শুরুতে যতজন ছিল, এখন একুনে দাঁড়িয়েছে এগারোজন। তারমধ্যে প্রতিদিন হাজিরা দেয়ার মত পাঁচজনই নিয়মিত আসে। হরর ক্লাবের সদস্যরা মিলে একটা পোডড়াবাড়ির বেসমেন্টে ক্লাবের পরিবেশ তৈরি করে নিয়েছে। পোডড়াবাড়ির ইলেকট্রিসিটির লাইন কাটা, সেটা আর সংস্কারের চেষ্টা কেউ করেনি। মোমের আলোয় গল্পের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হয়। অতিরিক্ত কল্পনাবিলাসী ক্লাবের প্রধান উদ্যোক্তা রিটায়ার্ড অফিসার আজমল সাহেব পরিবেশটাকে আরও গাঢ় করতে বিদেশিদের অনুকরণে ফায়ারপ্লেসের ব্যবস্থা করেছেন। মোমের আলোও দূরীভূত হয়েছে। ফায়ারপ্লেসের আগুনের পাশে বসে ওরা চারজন গল্পখখার অপেক্ষা করছে। পাঁচ নম্বর সদস্যের অপেক্ষা। ওরা। জানে, ঝড়, বৃষ্টি, বাদল, বন্যা, ভূমিকম্প যা-ই হোক না কেন। বিমল হালদার আসবেই। একটা ভুতের গল্প না শুনলে বা বললে ওর রাতে ঘুম হয় না। আজ অবশ্য ঝড়, বৃষ্টি, বাদলা কিছুই নেই, শুধু আলকাতরার মত কালো অন্ধকার রাত।
শওকত সাহেব বললেন, নেন, আলতাফ ভাই, একটা কিছু শুরু করেন, রাত বাড়ছে। আজ আর মনে হয় বিমলদা আসবে না।
মুরুব্বি গোছের আলতাফ হোসেন ফায়ারপ্লেসের আগুনের পাশে বসেছিলেন। তিনি ঝিমধরা আগুনটাকে উস্কে দিয়ে বললেন, শীতের রাতে ফায়ারপ্লেসের আগুনের উষ্ণতা কেমন দেখেছেন? গা যেন পুড়ে যায়।
আজমল সাহেব হেসে বললেন, আপনি আগুনের পাশে বসেছেন বলে অমন মনে হচ্ছে, আমার কিন্তু ঠিকই ঠাণ্ডা লাগছে।
শওকত সাহেব একটু সঙ্কুচিত হয়ে বসে বললেন, তাহলে এদিকে সরে এসে বিমলবাবুর জায়গাটাতে বসুন। কি হে, আলতাফ ভাই, ফাঁকি মারতে চাইছেন নাকি? নেন শুরু করুন, আজ আপনার পালা। তবে বিমলবাবু এলে। তাকেই ধরিয়ে দিতাম। ক্লাবের নিয়মানুসারে আমাদের লেট ফি হচ্ছে, গল্প বলাটা লেটকামারের দিকে চলে যাবে।
আলতাফ হোসেন ফায়ারপ্লেস থেকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, আসলে এটা ঠিক গল্প না। অভিজ্ঞতাই বলতে পারেন, তবে আমার না। আমার এক দাদুর। দাদুর মুখেই শুনেছিলাম। সেভাবেই বলছিঃ তখন শরষ্কাল, অপূর্ব হাওয়া। সবাই সন্ধের দিকে নদীর ধারে বেড়াতে যায়। নদীর দুতীর কাশফলে সাদা হয়ে আছে। হাওয়ায় কাশফুল এদিক-ওদিক দুলছে। দাদু দেখলেন, সেই কাশের সাথে আরও একটা সাদা কী যেন দুলছে! সাদা শাড়ির মত…
ঠিক সেই সময়ে দরজায় কাঁচকাঁচ আওয়াজ হলো। হরর ছবির দৃশ্যের মত। শব্দে সবাই চমকে তাকালেন। ফায়ারপ্লেসের আগুন কমে এসেছে। সেই আলোয় সবাই তাকিয়ে আলতাফ সাহেবের বলা গল্পের সাদা শাড়ির মত কিছু একটা দেখতে পেলেন। সাদা শাড়িটা যেন হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে এগিয়ে আসছে। কিন্তু স্বল্প আলোয় তাঁরা শাড়ি আর তার মালিককে চিনতে পারলেন। বিমলবাবু সাদা ফতুয়া আর ধুতি পরে এসেছেন। এই আধুনিক যুগেও ধুতি খড়মের প্রচলন রেখেছেন। আর খড়মের খটখট শব্দেই তারা মুখ না দেখেও বলতে পারেন বিমলবাবু এসেছেন।
আলতাফ হোসেন গল্পের হাত থেকে বাঁচার জন্য গলা চড়ালেন, বিমলদা, নিয়মানুযায়ী আজকের গল্পটা আপনারই পাওনা। আপনি সবার শেষে এসেছেন।
এ বিমলবাবু সোজা গিয়ে ফায়ারপ্লেসের সামনে বসলেন। ফায়ারপ্লেসের দিকে মুখ করে বললেন, ভূতের জন্যই আসতে দেরি হয়ে গেল।
মানে? সবাই সমস্বরে জিজ্ঞেস করলেন।
বিমলবাবু তার উত্তর না দিয়ে কানে গোঁজা পাতার-বিড়ি বের করলেন। তারপর ফায়ারপ্লেসের ভেতর থেকে জ্বলন্ত কাঠ নিয়ে বিড়ি ধরালেন। বিড়িতে টান দিয়ে শান্তভাবে বললেন, আসার পথে একটা ভূতের সাথে দেখা হয়ে গেল।
ভূতের সাথে দেখা? কোথায়! কীভাবে? আজমল সাহেব জানতে চাইলেন।
এই তো, এখানে আসার পথে। নতুন শ্মশানঘাটের সামনে। দেখলাম জটলা। শ্মশানে দাউদাউ আগুন জ্বলছে। বুঝতে পারলাম কেউ মারা গেছে। একপাশে দাঁড়িয়ে পড়লাম হিন্দু মানুষ। শ্মশান যেন কোন এক আকর্ষণে টানে। যখন চলে আসার জন্য পা বাড়িয়েছি, তখনই তাকে দেখলাম। আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাটা যে ভূত তা বুঝতে পারিনি। তবে পাগল ঠাউরেছিলাম। পাগল না হলে কেউ পুরোপুরি দিগম্বর হয়ে ওভাবে শ্মশানের দিকে তাকিয়ে থাকে।
শওকত হোসেন বললেন, তাই বলুন, ভূত না পাগল! ভূত আবার কেউ দেখে নাকি?
তো প্রথমে পাগলই ভেবেছিলাম। কিন্তু ব্যাটা যখন বিড়ি ধরানোর জন্য ওখান থেকেই দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে শ্মশানের আগুনে বিড়ি ধরাল, তখন আমার ভুল ভাঙল।
আপনি ঠিক দেখেছিলেন? আলতাফ সাহেব জানতে চাইলেন।
এক্কেবারে হানড্রেড পার্সেন্ট ঠিক। কারণ তারপরই আমি তাকে ধরে ফেললাম।
ভূত ধরেছিলেন! সত্যি?
হ্যাঁ। তিন সত্যি। ভাবলাম, জীবনে তো কত ভূতের গল্প করলাম। সেই ভূতই যখন জলজ্যান্ত দেখা দিয়েছে, তখন একে ধরেই ফেলি না কেন?
সবাই একসাথে বলে উঠলেন, ভূত ধরা কি অতই সোজা। তা সেই ভূত এখন কোথায়! কোথায় ধরে রেখেছেন?
আরে আগে ভূত ধরার কাণ্ডটাই শোনেন না।
আজমল সাহেব বললেন, সবাই চুপ করে বিমলবাবুর ভূত ধরার গল্পটা শোনেন। ভূত যখন ধরা আছে, তখন সেটা আমরা স্বচক্ষেই দেখতে পাব, কী বলেন, বিমলবাবু? ভূতটাকে কোথায় আটকে রেখেছেন? গাছের সাথে? আজমল সাহেবের কন্ঠে শ্লেষ ও বিদ্রুপের মিশেল।
বিমলবাবু কোনওদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে ফায়ারপ্লেসের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আলো নিভুনিভু হয়ে আসছে। কিন্তু কেউ সেটা বাড়ানোর চিন্তা করছে না। স্বল্প আলোয় বিমলবাবুর মুখ ভালভাবে দেখা যাচ্ছে না। তিনি শান্ত স্বরে বলতে লাগলেন, ভূত বুঝতে পেরে আমি ভাব জমানোর চেষ্টা করলাম। কানে গোঁজা বিড়ি বের করে ভূতের দিকে তাকিয়ে বললাম, দাদা, একটু আগুন হবে?
ভূত ভালমানুষের মত বলে উঠল, কেন দাদা, মুখাগ্নি করবেন?
মুখাগ্নি হিন্দুশাস্ত্রের মরণের পরের বিষয় হলেও বিড়িতে আগুনকে আমরা শয়তানি করে মুখাগ্নিই বলি। কাজেই আমি বিড়ি ধরা মুখটা এগিয়ে দিলাম। আর সেই ভূতটা করল কী, তার মুখটাই এগিয়ে দিল। তবে আমার মত করে না। ঘাড় থেকে ভেঙে মুখমণ্ডল হাতের তালুতে নিয়ে স্বাভাবিকভাবে আমার সামনে বাড়িয়ে দিল। আমি ভেতরে ভেতরে ভয়ে কুঁকড়ে গেলেও, এরকমভাবে বিড়ি ধরালাম যেন ওরকম কন্ধকাটার বাড়িয়ে দেয়া মাথার মুখ থেকে আমি নিয়মিত বিড়ি ধরিয়ে থাকি।
তারপর কী হলো? ভূতটাকে ধরলেন কীভাবে? কাটা মাথা পাকড়ে?
উঁহু। ভূতের সাথে ভাব-ভালবাসা করে। ভূতেরাও ভালবাসায় পটে যায়। ভূতের বিড়ি শেষ হয়ে এসেছে দেখে, আমার কাছ থেকে একটা বিড়ি অফার করলাম। ভূতটা স্বচ্ছন্দে হাত বাড়িয়ে নিল। তারপর মানুষের গলায় বলল, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজের চিতা জ্বলতে দেখতে দেখতে বিড়িতে সুখটান দেয়ার মত সুখ আর কয়জনের হয়।
আমিও রসিকতা করে বললাম, সবার হয় না, বাপু, আপনার মত দুচারজনের হয়। মরার পরে তো আর সবাই আপনার মত পুণ্যে ভূত হতে পারে না।
ভূতটা হাসল, তা বেড়ে বলেছিস রে, বাছা। কী নাম তোর? তোর সাথে আমার মিলবে খুব। চলে আয় না আমার সাথে, কেউ দেখতেও পাবে না। ধোঁয়ার মধ্যে ওই চিতায় গিয়ে উঠে পড়, তারপর সটান আমার কাছে চলে আয়,
দুজনে মিলে একই বিড়িতে সুখটান দেব।
এখন যেতে পারব না, বাপু। আমার যে একটু কাজ আছে।
মরার চেয়ে কী এমন জরুরি কাজ পড়েছে তোর, বাছা? আমার যদি ক্ষমতা থাকত, তা হলে গলা টিপে মেরে তোর মত বন্ধুকে আমার সঙ্গী করে ফেলতাম। কিন্তু ভূতেরা কাউকে মারতে পারে না, বড়জোর ভয় দেখাতে পারে। তা তুই যে ভয় খাওয়ার লোক নস, সে তো নিজ চোখেই দেখলাম, বাছা। হাতটা বিশ হাত লম্বা করে শ্মশান থেকে আগুন আনলাম। মাথা খুলে দেখালাম, তবু তুই ভয় পেলি না!
মানুষ আর ভূতেরও তো বন্ধুত্ব হতে পারে, বাপু। আমি যখন মরতে পারছি না, তখন আপনি তো আমার সাথ ধরতে পারেন?
মন্দ বলিসনি, বাছা। তা কোথায় যেন চলেছিস তুই?
হরর ক্লাবে। ভূতের গল্পের আড্ডাখানায়। সেখানে সবাই হয় ভূতের গল্প শোনে, না হয় বলে।
কিন্তু কেউ তো আর সরাসরি ভূত দেখতে পায় না, ভূতের মুখ থেকে গল্প শুনতেও পায় না।
না, তা পায় না।
তা হলে আজ আমাকে তোর সাথে করে ওখানে নিয়ে চল। এতদিন শুধু ভূতের গল্প শুনেছে, আজ সত্যিকারের ভূত। দেখুক। ভূতের মুখে গল্প শুনুক।
আপনি যাবেন আমার সাথে?
তুই নিয়ে গেলে যাব। নিয়ে না গেলেও অদৃশ্য হয়ে তোর পিছু নিয়ে চলে আসতে পারি। নিজের চিতা পোড়ানো তো দেখলাম, এখানে আর দাঁড়িয়ে থেকে লাভ কী? তার চেয়ে তোর সাথে গিয়ে যদি একটু মানুষের সঙ্গ পাই। বেঁচে থাকতে মানুষের একটু সঙ্গ পাওয়ার জন্য খুব হাঁসফাঁস করতাম। তা এই অথর্ব বুড়োর সাথে কে বসে আর বকবক করবে, কার এত সময় আছে? কার এত ঠেকা পড়েছে?
না-না, অদৃশ্য হয়ে যেতে হবে না। আমিই সাথে নিয়ে যাচ্ছি।
তা, তোর ওখানকার অন্যান্য সদস্যরা তোর মতই তো?
মানে? আমার মতই মানুষ কি না? হ্যাঁ, মানুষই। নাকি আপনি তাদের ভূত ভেবেছিলেন?
উঁহু, তা নয়। আমি বোঝাতে চেয়েছি তারাও তোর মত সাহসী মানুষ কি না? ভূতের গল্প বলা ও শোনা এক জিনিস আর সরাসরি ভূত দেখা অন্য জিনিস। বয়স্ক মানুষ হলে ভয়ে গোঁ-গোঁ করে অজ্ঞান হয়ে পড়তে পারে। শেষে যমে-মানুষে আর ভূতে মিলে টানাটানি শুরু হবে। তার চেয়ে না হয় তোর সাথে অদৃশ্য হয়ে…
তা মন্দ বলেননি, ওখানে সবাই আমার মত ঠিক সাহসী নয়। সুদখোর আজমইল্যা তো টাকার গরমে অজ্ঞান হয়ে থাকে। টাকার গরমেই পোড়োবাড়ি কিনে ভূতের। আড্ডাখানা বসিয়েছে। আর বুড়োভাম আলতাফ খুড়ো তো নিজেকে সর্বজ্ঞানী ভাবে, ওদিকে ওর আত্মীয়স্বজনরা যে সব ফাঁকা করে দিচ্ছে সে খেয়াল বুড়োভামের নেই। শওকত। চোরা নিজেরে সাহসের ডিপো ভাবলেও ওটা এক্কেবারে ভিতুর ডিম। আপনাকে দেখে এক্কেবারে কাপড় খারাপ করে ফেলবে।
আজমল সাহেব, আলতাফ সাহেব আর শওকত হোসেন তিনজনই সমস্বরে বলে উঠলেন, এসব কী বলছেন, বিমলবাবু? আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল? ভূতের চক্করে পড়ে? আমাদের সম্বন্ধে কী সব আজেবাজে কথা বলছেন!
সর্বকনিষ্ঠ ও সবচেয়ে চুপচাপ সদস্য জসিম মণ্ডল বলল, বিমলদা, ফায়ারপ্লেসের আগুনটা একটু উস্কে দেন না, কেমন
অন্ধকার হয়ে এসেছে।
বিমলবাবু শান্ত মুখে বললেন, ফায়ারপ্লেসের ভেতরে তেমন কিছু নেই, উস্কে দিলেও লাভ হবে না। নতুন কাঠ দিতে হবে। শওকত চোরারে কাঠ চুরি করে আনতে বলো।
শওকত হোসেন ক্ষুব্ধ স্বরে বললেন, ভাল হচ্ছে না কিন্তু, বিমলদা। বয়োজ্যেষ্ঠ বলে আপনাকে কিন্তু যথেষ্ট সম্মান করি, তাই বলে মুখে যা আসে আবোলতাবোল বলে যাবেন! শওকত হোসেন রেগেমেগে উঠে দাঁড়ালেন।
শওকত হোসেনের দেখাদেখি আলতাফ সাহেব ও আজমল সাহেবও উঠে দাঁড়ালেন। ক্ষুব্ধ ভঙ্গিতে এগিয়ে এলেন বিমলবাবুর দিকে। ইচ্ছে-কলার ধরে দুটো ঝাঁকুনি দিয়ে এসব কথার ব্যাখ্যা চাইবেন।
ফায়ারপ্লেসের কাছটাতে অন্ধকার। আগুন প্রায় নিভু নিভু। কাঠপোড়া কয়লার নিচে গনগনে লালচে আভা দেখা যাচ্ছে।
জসিম মণ্ডল উঠে দাঁড়িয়ে বলল, কাঠ আনা নিয়ে ঝগড়া করে লাভ নেই, শওকত ভাই। আমিই কাঠ নিয়ে আসছি।
বিমলবাবু শান্ত স্বরে বললেন, আপনাদের কাউকেই উঠতে হবে না, জায়গায় বসুন। কাঠের ব্যবস্থা আমিই করছি।
শওকত হোসেন খেপে গেছেন। তিনি চিবিয়ে-চিবিয়ে বললেন, তোর কাঠের খ্যাতা পুড়ি আমি। তুই আমারে চোর বলেছিস, বিমল। তোরে আজকে ওই ফায়ারপ্লেসের আগুনে পোড়াব। হিন্দু মানুষ, পুড়েই তো তোদের শান্তি, কাঠকয়লা পোড়া হয়ে ভূত হয়ে যাবি তুই।
তার আর দরকার হবে না, শওকত চোরা। তোদের সুবিধা করে দিচ্ছি।
শওকত হোসেন বিমলবাবুর কথা ধরতে পারলেন না। গলার টুঁটি টিপে ধরার জন্য এক লাফে ফায়ারপ্লেসের কাছে বিমলবাবুর মুখোমুখি হলেন।
তারপর অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখলেন…
ফায়ারপ্লেসের আগুন বেড়ে যাচ্ছে! নতুন কাঠ দিলে যেমন উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে ওঠে, তেমনটি। আর সেই আগুন বেড়ে ওঠার কারণ বিমলবাবু তার ডান হাতের কনুই পর্যন্ত ফায়ারপ্লেসের জ্বলন্ত কাঠকয়লার মধ্যে ঢুকিয়ে রেখেছেন।
আগুনে পোড়াতে এসে বিমলবাবুর হাত আগুনের মধ্যে দেখে আঁতকে উঠলেন শওকত হোসেন। বিমলবাবুর হাতটা ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে বললেন, এ কী পাগলামি করছেন, বিমলবাবু? এমন কাজ কেউ করে?
হাতটা টেনে বের করে হতভম্ব হয়ে গেলেন শওকত হোসেন। হাতের আঙুল থেকে কনুই পর্যন্ত দাউ দাউ করে জ্বলছে। ততক্ষণে বাকি তিনজনেও কাছে এসে পড়েছে।
হাতের দাউদাউ আগুনে সবাই বিমলবাবুর মুখ দেখতে পেল এবার। সে মুখ যে বিমলবাবুর, তা কেউ বলতে পারবে না। আগুনে পুড়ে ঝলসানো, বিকৃত, বীভৎস একটা মুখের আদল…।
ভয় পেলে যে মানুষের অবস্থা কেমনতরো হয়, তা এই বয়স্ক মানুষগুলোকে দেখলে বোঝা যেত। তারা সবকিছু ফেলে ভেঙেচুরে এমনভাবে দৌড় শুরু করলেন, যেন অলিম্পিকের প্রবীণ সোনাজয়ী দল।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছুটতে ছুটতে তারা শোনের কাছে এসে পড়লেন। বাড়ির পথেই শুশানটা পড়ে। শ্মশানে তখন মড়া পোড়ানোর দল শেষ ছাইটুকু রেখে চলে আসার তোড়জোড় করছে।
ওরকম হন্তদন্ত হয়ে তিনচারজন বয়স্ক মানুষকে ছুটে আসতে দেখে তারা অবাক হলো। একজন প্রবীণ মানুষ প্রায় পথ আগলেই জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে, আজমল ভাই, অমন করে দৌড়াচ্ছেন কেন?
আজমল হোসেন হাঁপাতে হাঁপাতে কোনওমতে বললেন, বিমলবাবু…
প্রবীণ বুঝদারের মত মাথা নেড়ে বললেন, হু, বিমলবাবু আজ সন্ধেয় মারা গেছেন। তার খবর আপনারা এখন পেয়েছেন? তাই এভাবে ছুটতে ছুটতে আসছেন?
প্রবীণের কথাতে ওরা থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল। কোনওমতে ঢোক গিলে তো-তো করে বলতে পারল, বিমলবাবু মারা গেছেন!
হু। আজ সন্ধেয়, ছাদের কার্নিশ থেকে পড়ে। থেঁতলে বীভৎস চেহারা হয়ে গিয়েছিল। এই তো, আমরা বিমলের মড়া পুড়িয়ে চান করতে যাচ্ছি। তা যান না শ্মশানের কাছে। বন্ধুকে শেষ দেখাটা দেখে আসেন। এখন অবশ্য একমুঠো ছাই ছাড়া কিছুই দেখতে পাবেন না। সবাই ছাই হয়ে যায়…ছাই…
প্রিন্স আশরাফ