হরবোলা মানিক
নিতান্তই গরীব পরিবারের একটা ছোট ছেলে। প্রচন্ড ডানপিটে। তার দুরন্তপনায় পাড়া পড়শীরা অতিষ্ঠ। গ্রামের কোন্ বাগানে আম, জাম, কাঁঠাল, জামরুল পেকেছে সব তার নখদর্পণে। খেতে কোথায় শশা, ছোলা, মটরশুঁটির গাছে ফল পুষ্ট হয়েছে তা ওর নজর এডায় না। কাঠবেড়ালির মত তড়তড়িয়ে সে বড়সড় গাছে উঠে পড়তে পারে। সুযোগবুঝে সেই সব ফল পেড়ে আনতে তার জুড়ি মেলা ভার। পুকুরের একবুক জলে নেমে পানিফল তুলে আনতে সে ওস্তাদ। ভরা বর্ষায় বন্ধুদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সাঁতরে এপার ওপার করে। চুরি করা ফল সে কখনও একা খায় না। বন্ধুদেরও ভাগ দেয়। তাই বন্ধুদের ও চোখের মণি। আশ্চর্যভাবে পশুপাখিদের ডাক নকল করতে পারে। কাকভোরে উঠে মুরগী ও অন্যান্য পাখপাখালিদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ডাকতে ও অভ্যস্ত। তাই তাদের সঙ্গেও তার সখ্যতা জমে উঠেছে। কিন্তু কাকেদের কর্কশডাক তার না পসন্দ। তাছাড়া বাচ্চা হবার সময় একবার একটা কাক ওর মাথায় খুব জোরে ঠুকরে দিয়েছিল বলে সে ওদের সঙ্গ এড়িয়ে চলে।
ছেলেটার নাম মানিক। সবাই ওকে হরবোলা মানিক বলে ডাকে। বাবা পরেশ দিন মজুর। সাকিন দক্ষিণ চব্বিশপরগণার কুমীরমারী। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান, তাদের যক্ষের ধন।
প্রতিবেশীরা তার উপর বিরক্ত হলেও সন্তানের মত স্নেহ করে। আর করবেই বা না কেন? পাড়ায় কাকে সাপে কেটেছে মানিক ছুটে যায় ওঝা, গুনিন ডাকতে। আসন্ন প্রসবা কার ব্যাথা উঠেছে সে ছুটল ডাক্তার, বদ্যি, ধাইমাকে খুঁজতে। প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র কিনতে দোকানে যাবে কে? – না মানিক।
দুরন্ত হলেও তার মনটা খুব নরম। কোন্ মুরগীকে কুকুরে কামড়েছে তাকে সেবা যত্ন করে ভালো করে তোলা, ঝড়ে বাসা ভেঙে চড়াই, শালিখের ছানা পড়ে গেলে তাদের তুলে এনে সযত্নে এমনভাবে রেখে দেওয়া যাতে তাদের মায়েদের নজর এড়িয়ে না যায়।
মানিকের সব ভাল কিন্তু লেখাপড়ায় একেবারে মন নেই। পড়তে বসলে হাই ওঠে, ঘুম পায়। পাঠশালার বদলে তেঁতুলতলায় গিয়ে ঢিল মেরে পাকা তেঁতুল পেড়ে আনতে ওর ভালো লাগে। বকুনি খাবার ভয়ে সেগুলো মাচায় লুকিয়ে রাখে। সময়মত মাকে বের করে দেয় আচার বানানোর জন্য। কখনও বা খেত থেকে কচি শশা, গাছশুদ্ধ ছোলা, মটরশুঁটি চুরি করে গাছের ছায়ায় বসে খায়।
মানিকের উপস্থিত বুদ্ধি খুব। ভয়ডর কাকে বলে ওর জানা নেই। একবার পানিফল তুলতে যাবার সময় একটা দাঁড়াশ সাপ ওর পায়ে ছোবল দিয়েছিল। একটুও ঘাবড়ে না গিয়ে নিজের পরণের গেঞ্জি ছিঁড়ে বাঁধন দিয়ে একাএকাই ছুটে গিয়েছিল গুনিনের কাছে। মন্ত্রপূত থালা চালিয়ে গুনিন সাপের বিষ বের করে দিলে মানিক সে যাত্রায় প্রাণে বেঁচে যায়।
এই রকম ডাকাবুকো মানিক কীভাবে কুঁজোমানিকে পরিণত হল সেই করুণ কাহিনী তোমাদের বলি শোন।
সেদিন ছিল আষাঢ মাসের পূর্ণিমা। পাড়ায় বোস কাকীমার বাড়িতে আসান পূজো। কেউ কোন বিপদে পড়ে যদি আ্সান দেবীর মানত করে সুফল পায় তবে নিষ্ঠাভরে তার পূজো করে। এই পূজোয় কোন পুরোহিতের প্রয়োজন হয় না। যে পূজো দিচ্ছে তার সঙ্গে আরও সাতজন এয়োস্ত্রী লাগে। সবাই স্নান করে, শুদ্ধ বস্ত্র পরে, নিরম্বু উপবাসে থেকে ভক্তিসহকারে দেবীর আরাধনা করে। তারপর পাঁচালি পাঠ শেষ হলে শান্তিজল নিয়ে প্রসাদ খেয়ে যে যার বাড়ি ফিরে যায়। মানিকের মা গিয়েছিল এই উৎসবে যোগ দিতে। বাবাও বাড়িতে ছিল না।
খানিকক্ষণ আগে প্রচন্ড ঝড়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শিলাবৃষ্টি হয়ে গেছে। এখন আকাশ নির্মল। সামনের বটগাছটার ঝুরি ধরে মানিক মহানন্দে দোল খাচ্ছিল। আচমকাই কীভাবে যেন ও হাত ফসকে ছিটকে পড়ল অনেকটা দূরে। ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে ও অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। একজন গ্রামবাসীর নজরে পড়ায় সেই পাঁজাকোলা করে তাকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনে। জলের ঝাপটা দিলে তার জ্ঞান ফেরে। তার মাকে ও আরও চারপাঁচজন পড়শীকে খবর পাঠানো হয়। হাতুড়ে বদ্যি এসে তার চিকিৎসা শুরু করে। শিরদাঁড়ায় চোট লেগেছিল। চিকিৎসা করে প্রাণ ফিরে পেলেও মেরুদণ্ডটা আস্তে আস্তে বেঁকে যেতে থাকে। তখন অনেকেই বলেছিল শহরে নিয়ে গিয়ে বড় ডাক্তার দেখিয়ে সুস্থ করে আনতে। কিন্তু অত খরচের ঝুঁকি নেবার ক্ষমতা পরেশের ছিল না। তাই প্রথম প্রথম টান ধরলেও এখন ও কুঁজো হয়ে হাঁটতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। তবে আগের মত আর দৌড়ঝাঁপ করতে পারে না। মা সাধ্যমত সেবাযত্ন করে ওকে সুস্থ করে তুললেও মানিক সারাদিন মনমরা হয়ে ঘরে বসে থাকে। প্রথম প্রথম গাছের ফল পাকলে প্রতিবেশীরা আমটা, কলাটা দিয়ে যেত। বন্ধুরাও আসত ওকে সঙ্গ দিতে। কিন্তু এখন সব বন্ধ।
মন খুব খারাপ করলে ও দাওয়ায় গিয়ে বসে। শালিখ, ময়না, কাকাতুয়া, কোকিল, হাঁস মুরগীদের ডাক ডেকে ওদের সঙ্গে ভাব জমায়। আর কী আশ্চর্য, ওর ডাক শুনে শালিখ, পায়রা, হাঁস মুরগীরা ওদের মাটির নিকোনো উঠানে এসে জড়ো হয়। অব্যক্ত ভাষায় নানান সুরে গান জুড়ে দেয়। ঘুরে ঘুরে শরীরে হিন্দোল তুলে যেন নৃত্য পরিবেশন করে ওদের বন্ধুদের তাক্ লাগিয়ে দিতে চায়। টিয়া, ময়না, কাকাতুয়ারা সামনের গাছগুলোতে বসে দোল খেতে খেতে যেন বলে, “ছোট্ট বন্ধু, দেখ আমরাও তোমার মত দুলতে পারি। এখন পারছ না তো কী হয়েছে? আমাদের দেখেই আনন্দ পাবার চেষ্টা কর”। আর কোকিল গাছের আড়ালে থেকে কুহুতানে তার মনপ্রাণকে ভরিয়ে দেয়। মানিক তার শারীরিক যন্ত্রণা, মানসিক কষ্ট সব ভুলে যায়।
দিনতো আর কারোর জন্য অপেক্ষা করেনা। নদীর স্রোতের মতই আপন খেয়ালে সে বয়ে চলে। এভাবেই দিন, মাস, বছর গড়িয়ে যায়। মানিকেরও বয়স বাড়ে। সে এখন পনেরো বছরের কিশোর।
এ বছর বৈশাখজ্যৈষ্ঠ মাসে লাগামছাড়া গরম পড়েছে। সূর্যের প্রচন্ড উত্তাপে চারদিক ফুটিফাটা। আকাশে একফোঁটা মেঘের চিহ্নমাত্র নেই। গাছপালা, শাকসব্জী সব শুকিয়ে যাচ্ছে। আষাঢ পড়তে চলল অথচ বৃষ্টির কোন নামগন্ধ নেই। বাড়ির মেয়ে বউরা যদি প্রায় শুকিয়ে যাওয়া খাল, বিল, নালা থেকে গেঁড়ি, গুগলি কিম্বা বরাতজোরে দু’একটা শোল, মাগুর ধরতে পারে তবেই তা হাটে বিক্রি করে যা পায় তাই দিয়ে চাল কিনে আনে। আগের বছরেও এ সময় কলমী, থানকুনি, কচুরডাঁটা, কচুরলতি পাওয়া যেত। কিন্তু এবছর ওরও বড় আকাল।
মানিক দাওয়ায় বসে বসে ভাবে প্রকৃতির কী নিষ্ঠুর খেলা। তার রহস্য বোঝার ক্ষমতা মানিক কেন অনেক তাবড় তাবড় বিজ্ঞানীরও নেই। দু’বছর আগেই তো, এমন অঝোর ধারায় বৃষ্টি হয়েছিল যে খাল, বিল, নদীনালা ছাপিয়ে গ্রামে জল ঢুকে সব মাটির বাড়ি ধুয়ে মুছে সাফ করে দিয়েছিল। সেই বিধ্বংসী আয়লায় কত মানুষ, কত গরু ছাগল যে ভেসে গিয়েছিল তার আর ঠিকঠিকানা ছিল না। ওদের সঙ্গে গ্রামের অনেকেরই ঠাঁই হয়েছিল স্থানীয় স্কুলগুলোতে। শরনার্থী শিবিরে হা পিত্যেস করে বসে থাকতে হত কতক্ষণে রিলিফপার্টির লোকেরা এসে খিচুড়ি দিয়ে যাবে। তারপর আয়লার দাপট কমে গিয়ে ধীরে ধীরে যখন সকলে ঘরে ফিরল তখন চারদিক শূন্য, নোনামাটি চারদিকের মাঠ, ঘাট গ্রাস করে নিয়েছে। ঘর বলতে কিছুই অবশিষ্ট নেই। শুধু বাঁশের কাঠামোটাই পড়ে রয়েছে। কূযোর লবনাক্ত জল মুখে দেওয়া যায়না। খেতে ফসল ফলে না। তখন বাবা, কাকারা সব ঠিক করেছিল তামিলনাড়ু চলে যাবে। ওখানে গেঞ্জির কলে কিম্বা প্লাস্টিক কারখানায় কাজ নিয়ে অভাব দূর করবে। কিন্তু রাহাখরচ জোগাড় করতে না পারায় ওদের আর যাওয়া হয়নি।
আর এবার-প্রচণ্ড খরা। চাষবাস তো দূরঅস্ত্। খাবার জোগাড় করতেই বাবার প্রাণান্তকর অবস্থা। বৃষ্টির আশায় আরও অনেকের সঙ্গে বাবাও গিয়েছিল মাটিতে লাঙল দিয়ে পাথরের মত শক্ত মাটিকে আবাদযোগ্য করে রাখতে যাতে বর্ষায় জল পড়লেই বীজবপন করতে পারা যায়। আগের দিনের বাসি ভাত, নুন লংকা মেখে বাবা, মা আর সেও খেয়ে নিয়ে বাবা মাঠে আর মা চলে গিয়েছিল জঙ্গলে কাঠকুটো, শাকপাতা সংগ্রহের আশায়।
দিনটা ছিল শনিবার। আজ গরমের দাপট খুব। আগুনের হল্কার মত বাতাস বইছে। “লু”-এর সেই উত্তাপ মানিক ঘরে বসেও টের পাচ্ছে। দরদর করে ঘেমে নেয়ে যাচ্ছে। হাতপাখার হাওয়া শরীরকে শীতল করতে পারছেনা। মানিক তার বাবামায়ের জন্য চিন্তায় পাগল হয়ে উঠল। ভাবল বেরিয়ে পড়ে দেখে আসে বাবাকে। কিন্তু মায়ের সাবধানবাণী, “ঘর খোলা রেখে কোথাও যাবিনা”, মনে পড়তেই নিজেকে সংবরণ করল। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল। সন্ধ্যা নাগাদ মা ঘরে ফিরল। কিন্তু বাবা কোথায়? সে তো এখনও ফিরছে না। সারাদিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত, শ্রান্ত মা ছুটে গেল বাবার সন্ধানে। খানিকটা এগিয়ে যেতেই খবর পেল বাবা অসুস্থ হয়ে মাঠে পড়েছিল বলে তাকে পাশের গাঁয়ের দাতব্য চিকিৎসালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। একরাশ চিন্তা আর উদ্বেগ নিয়ে ঘরে ফিরল মা। কাঠকুটো জ্বালিয়ে ভাত চাপাল। উৎকন্ঠা চাপতে না পেরে বারবার বাইরে যেতে লাগল। রাত প্রায় দশটা। গাঁয়ের লোকেরা বাবাকে নিয়ে বাড়ি ফিরল। তাদের টুকরো টুকরো কথায় মানিক জানতে পারল যে তার বাবা সানস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে তাদের ছেড়ে অনেক দূরে ঐ আকাশে তারা হয়ে গেছে। আর কোন দিন সে তার বাবাকে ছুঁতে পারবে না, তার কাছে গল্প শোনার আবদার জানাতে পারবে না। মনে হতেই চিৎকার করে কেঁদে উঠল সে।
প্রথম দু’এক মাস মানিক আর ওর মা খুব ভেঙে পড়েছিল, নাওয়া খাওয়া প্রায় ভুলতে বসেছিল। কিন্তু সময়ই মানুষের সমস্ত ক্ষতে মলম লাগিয়ে দেয়। তার উপর পেটের জ্বালা বড় বালাই। তাই ধীরে ধীরে ওরাও সব কিছু সয়ে নিয়েছিল। মা আগের মতই আবার রসদসংগ্রহে বেরিয়ে পড়ে। তবে মানিক আর এখন দাওয়ায় বসে সাতপাঁচ ভাবে না। বাবা তো নেই, তাই ওর কিছু করা দরকার এই কর্ত্তব্যবোধে সে উঠোনের চারপাশে শাকসবজীর গাছ লাগায়। নিয়মিত জল দেয়, পরিচর্যা করে। মা ওর উৎসাহ দেখে খুব খুশী হয়।
এভাবে সুখে দুখে আরও দুটো বছর কেটে গেল। মানিক এখন কুড়ি বছরের তরতাজা যুবক। ওর মা, মানিকের হাতে লাগানো ফসল হাটে বিক্রি করে চাল, ডাল, তেল, নুন কিনে আনে। দু’জনের পরিশ্রমের ফসল হিসাবে ওদের হাতে এখন কিছু বাড়তি টাকা থাকে যা দিয়ে ওরা জামাকাপড় ও অন্যান্য টুকিটাকি জিনিস কিনতে পারে। কিন্তু বিধাতা বোধহয় মানিকের সুখ বেশিদিন সহ্য করতে পারলেন না। তাই একদিন হাট থেকে ফেরার পথে কালবৈশাখীর কবলে পড়ল ওর মা। প্রচন্ড ঝড় তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ব্জ্র, বিদ্যুৎ, বৃষ্টি। মায়ের আর বাড়ি ফেরা হল না। বাজ পড়ে পথেই পড়ে মরে গেল। মা হারা মানিক অকূলপাথারে পড়ল। বাবা, মা-দু’জনেরই অপঘাতে মৃত্যু। পাড়া প্রতিবেশী প্রত্যেকেই বলতে লাগল ওর মত অপয়া ছেলে ওরা আগে কখনও দেখেনি। দু’দিন বাদে মাকে দাহ করে ঘরে ফিরতেই হারু জ্যাঠা সাক্ষাৎ যমদূতের মত এসে হাঁক পেড়ে বলল, “তোদের ভিটের জমিটা আমার। তোর বাবাকে দয়া করে থাকতে দিয়েছিলাম। এক সপ্তাহের মধ্যেই ভিটে মাটি ছেড়ে চলে যাবি। তোর ওই অলুক্ষণে মুখ যেন আর কখনও না দেখি”। জ্যাঠার পায়ে পড়ে ও অনেক অনুনয় বিনয় করল। কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা।
মা, বাবাহীন পর্ণকুটীর মানিকের কাছে অসহনীয় হয়ে উঠল। সে মনে মনে ভাবল ভিটে মাটি ছেড়ে অনেক দূরে যে দিকে দু’চোখ যায় চলেই যাবে। তাই একদিন খুব ভোরভোর উঠে নিজের প্রয়োজন মত কতকগুলো জিনিস একটা পোঁটলায় বেঁধে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল সে। সারাদিন ক্লান্ত পায়ে হেঁটে ও যখন নদীর তীরে পৌঁছাল তখন সূর্য পাটে গেছে। অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। চারদিক নিস্তব্ধ। শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে আর দূরে কিছু জোনাকির আলো মিট্মিট্ করে জ্বলছে। মানিকের বুক ভয়ে দুরু দুরু করে উঠল। বাবামায়ের শোকে ওর মন উথালপাতাল হয়ে উঠল। এখন ও কী করবে বুঝতে না পেরে নীরবে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর চোখে অন্ধকার সয়ে এলে ও একটা পরিত্যক্ত ভাঙাচোরা নৌকা দেখতে পেল। আসলে ওটা কোন এক জনের ডিঙিনৌকো। সেই রাতটা ওখানেই কাটাবে বলে সে মনস্থ করল।
পরদিন খুব ভোরে পাখিদের কলতানে মানিকের ঘুম ভেঙে গেল। আশ্চর্য হয়ে দেখল যে হাঁটতে হাঁটতে সে মোল্লাখালি পৌঁছে গেছে। আরে, এটা তো সেই ঝিলা নদী। ও শুনেছিল নদীর কাছেই আর বি সির জঙ্গল। সেখানে বিষাক্ত সব সাপখোপ, বাঘ, ভালুকের বাস। কিন্তু আর তো ভয় পেলে চলবে না। বাঘের পেটে কিম্বা সাপের ছোবলে না মরা অবধি ওকে এখানেই থাকতে হবে। তাই সাহস সঞ্চয় করে নদীতে স্নান সেরে কাঠপাতা পুড়িয়ে সঙ্গে আনা চাল, ডাল ফুটিয়ে রান্না সারল। চারদিকে জানা অজানা অনেক পাখিকে দেখে ওর মন আনন্দে ভরে গেল। হরবোলা মানিকের সঙ্গে কয়েকদিনের মধ্যে ওদের খুব ভাব জমে গেল। বনমোরগ, কাঠবেড়ালি, বুনোকুকুর, বাঁদর, হনুমান, এমনকী সজারুর সাথেও সে মিতালী পাতিয়ে ফেলল। তারা ওকে অভয় দিয়ে যেন বলত, “ভয় পেও না বন্ধু, বিপদে আপদে আমরা সবাই তোমার পাশে আছি”।
এভাবেই বেশ কয়েক মাস কেটে গেল। মানিক অনেকদিন কোন মানুষের মুখ দেখেনি, কথা বলেনি তাই ভেতরে ভেতরে খুব মুষড়ে পড়েছিল। মানুষের সঙ্গ পাবার জন্য ও উতলা হয়ে উঠেছিল। আজ হঠাৎ সন্ধ্যা নাগাদ একটা মাছধরা ডিঙিকে ঘাটে ভিড়তে দেখে ও খুশী হয়ে উঠল। আনন্দে চিৎকার করে বলে উঠল, “ডিঙিতে কে আছ ভাই, একবার দেখা দাও”। ডিঙিটা ঘাটে নোঙর করে একজন মাঝবয়সী জেলে এগিয়ে এল। দু’জনে পরস্পরের পরিচয় পর্ব সারা করল, একসঙ্গে খেল, রাত কাটাল, পরদিন সকালে বিদায় নেবার আগে সে জানাল, “এখানের জঙ্গলে বাঘ থাকে। যে কোন সময়ে জল খেতে ঘাটে আসতে পারে। সুযোগ বুঝে ঘাড় মটকে নিয়ে গভীর জঙ্গলে মিলিয়ে যেতে পারে। সাবধানে থেকো। তুমি যেটায় আস্তানা গড়েছ ওই নৌকার জেলে মাঝির সেই দশাই হয়েছিল। তার দেহটা খুঁজে পাওয়া যায়নি”।
মাঝি চলে যাবার পরে মানিক মনে মনে ভাবল, “বেঁচে থেকেই বা কী লাভ? আমার তো আপন বলতে কেউই নেই যে আমার জন্য দু’ফোটা চোখের জল ফেলবে”। কিন্তু সত্যি সত্যি মরতে ভয় কে না পায়? তাই মানিকের খুব ভয় ভয় করতে লাগল। খালি মনে হতে লাগল রাতের বেলায় চুপি চুপি বাঘ এসে ওকে টেনে নিয়ে গেলে ও তো টেরই পাবে না। আতঙ্কে দিনে রাতে ওর ঘুম বন্ধ হয়ে গেল।
কিছুদিনের মধ্যেই ওর আশঙ্কা সত্যি হল। বুনো মোরগ আর কুকুরের লাগাতার ডাকে আকৃষ্ট হয়ে ও তাকিয়ে দেখল একটা চিতা পাড়ে দাঁড়িয়ে ওকে লক্ষ্য করছে। আর তাই ওর বন্ধুরা ওকে সতর্ক করে দিচ্ছে। একটা গাছে বাঁদরগুলো অহেতুক এডাল থেকে ওডালে ঝুলতে ঝুলতে ওকে যেন বলছে, “পালাও বন্ধু, সামনে বিপদ, সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত তোমার শিয়রে”। এখন কী করা উচিত ভাবতে ভাবতেই মানিক দেখল, দু’তিনটে কুকুর বাঘটার পেছনে ফেউ লাগার মত লেগেছে আর তার সেই সজারু বন্ধুটা কোথা থেকে যেন উদয় হয়ে বড় বড় কাঁটা বের করে বাঘটাকে ভয় দেখাচ্ছে। আর কী আশ্চর্য! বাঘটা কাঁটার ভয়ে
সেখান থেকে দে দৌড় লাগিয়েছে। মানিক এতক্ষণ মনে মনে ভগবানকে ডাকছিল। এখন বিপদ মুক্ত হয়ে সে তার বন্ধুদের ধন্যবাদ জানাল, বন্ধুরা প্রত্যুত্তরে জানাল, “বিপদে সাহায্য না করতে পারলে আর বন্ধু হল কী করে”?
মানিকের এখানে থাকা প্রায় ছয় সাত মাস হয়ে গেল। প্রথম প্রথম ভয় লাগলেও এখন ও সাহসী হয়ে উঠেছে। বনের সব পাখপাখালি ওর বন্ধু। ওরাই ওকে পাহারা দেয়। ও নিশ্চিন্তে ঘুমোয়। সকাল হলে নিত্যনৈমিত্তিক কাজে লেগে যায়। নদীতে মাছ ধরে। যত্ন করে রান্না করে বন্ধুদের খাওয়ায়। সকলে মিলে মিশে সুন্দর সময় কাটায়। মানিকের মনে হয় লোকালয়ে থাকার চেয়ে এখানে থাকা অনেক নিরাপদ। আর যাই হোক বনের পশু পাখিরা মানুষের মত অত হিংসাপরায়ণ, ঈর্ষাকাতর হয় না। বিপদে আপদে ওরা ওকে রক্ষা করে। আদর করে ঘিরে থাকে। মানুষের মতো গৃহছাড়া করে দেয় না।
আনমনে বসে বসে সে এইসব কথাই ভাবছিল। এমন সময় বুনো কুকুরটা কোথা থেকে সেখানে এসে হাজির। আরে! ওর পেছনে পেছনে তো সব বন্ধুরাই এসেছে দেখছি। কী ব্যাপার, ওদের ভাষায় হরবোলা মানিক জানতে চাইল। কোন উত্তর না দিয়ে কুকুর বন্ধু ওর জামা ধরে টানাটানি করতে লাগল। অন্যান্য পাখপাখালিরা যেন নিজের নিজের ভাষায় বলল, “আমরা তোমার ক্ষতি চাই না, যেখানে নিয়ে যাচ্ছি আমাদের অনুসরণ করে লক্ষ্মীছেলের মত সেখানে চল। ভাগ্য ফিরে যেতে পারে”। বন্ধুদের কথায় বিশ্বাসে ভর করে সে অন্ধের মত তাদের সঙ্গে চলতে লাগল। ওদের কথামত গভীর জঙ্গল ছেড়ে ওরা পৌঁছাল অপেক্ষাকৃত কম ঘন একটা জায়গায়। অবাক হয়ে কালীর আরাধনায় মগ্ন একজন জটাজুটধারী তান্ত্রিক সাধককে সে দেখতে পেল। কোন কথা না বলে, হাতজোড় করে, চোখ বুঁজে একমনে ও ঠাকুরকে ডাকতে লাগল। ধ্যানভঙ্গ হলে চোখ খুলে মানিককে দেখতে পেয়ে সেই সাধক বললেন, “এতবড় জঙ্গল পেরিয়ে এখানে এলি কীভাবে? কী উদ্দেশ্যেই বা আমার কাছে এসেছিস? তোর মনোবাসনা আমায় জানা, দেখি তোর জন্য কী করতে পারি”? মানিক নিজের জন্য কিছুই না চেয়ে বন্ধুদের ভাল রাখার কথা বলল। এবার তার বন্ধুরা তাদের বিচিত্র ভাষায়, হাবেভাবে, ইশারায় মানিকের কুঁজটা ভাল করে দেবার আরজি জানাল। ও যেন সুখে শান্তিতে থাকতে পারে সেই কামনাও করল। অপেক্ষা করতে জানিয়ে সাধক আবার ধ্যানে বসলেন। ধ্যান ভাঙলে তিনি মানিককে নদী থেকে স্নান সেরে আসতে বললেন। ফিরে এলে তিনি তাঁর মন্ত্রপূত জল মানিকের পিঠ থেকে কোমর পর্যন্ত বুলিয়ে দিলেন। বললেন, “ফিরে যা, ভাল হয়ে যাবি। সুখে থাকতে হলে পরিশ্রম করতে হয়। পরিশ্রম কর, অবশ্যই সুফল পাবি। মনে রাখিস, পৃথিবীতে অলস লোকেদের কোন স্থান নেই”। এই বলে তিনি আবার ধ্যানমগ্ন হলেন। সঙ্গীদের সঙ্গে মানিক আবার সেই ভাঙা নৌকায় ফিরে এল। পিঠে হাত দিয়ে অনুভব করল তার কুঁজটা কোথায় যেন মিলিয়ে গেছে। নিজেকে খুব হালকা বোধ করলও। সাধকের প্রতি শ্রদ্ধায় আর বন্ধুদের প্রতি কৃতজ্ঞতায় তার আনত দু’চোখ বেয়ে অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ল।