হরবাবুর অভিজ্ঞতা

হরবাবুর অভিজ্ঞতা

নিশুত রাতে হরবাবু নির্জন অন্ধকার মেঠো পথ ধরে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছেন। বৃষ্টি বাদলার দিন। পথ জলকাদায় দুর্গম। তার ওপর আকাশে প্রচণ্ড মেঘ করে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। হরবাবুর টর্চ আর ছাতা আছে বটে, কিন্তু তাতে বিশেষ সুবিধে হচ্ছে না। টর্চের আলো নিবুনিবু হয়ে আসছে আর হাওয়ায় ছাতা উল্টে যাওয়ার ভয়। বর্ষা বাদলায় সাপখোপের ভয়ও বড় কম নয়। গর্তটর্ত বুজে যাওয়ায় তারা আশ্রয়ের সন্ধানে ডাঙাজমির খোঁজে পথে ঘাটে উঠে আসে।

হরবাবুর অবশ্যই এই নিশুতরাতে পৌঁছোনোর কথা নয়। কিন্তু ট্রেনটা এমন লেট করল যে হরিণডাঙা স্টেশনে নামলেনই তো রাত সাড়ে দশটায়। গরুর গাড়ির খোঁজ করে দেখলেন সব ভোঁ ভোঁ, এমনকী তাঁর শ্বশুরবাড়ির গাঁ গোবিন্দুপুরে যাওয়ার সঙ্গী সাথীও কেউ জুটলো না। গোবিন্দপুর না হোক দুই তিন মাইল রাস্তা। হরবাবুর ভয় ভয় করছিল। কিন্তু উপায়ও নেই। তাঁর শালার বিয়ে। হরবাবুর স্ত্রী চার পাঁচদিন আগেই ছেলেমেয়ে নিয়ে চলে এসেছেন। হরবাবুর জন্যে তাঁরা সব পথ চেয়ে থাকবে।

সামনেই তুলসীপোতার জঙ্গল। একটু ভয়ের জায়গা, আধমাইলটাক খুবই নির্জন রাস্তা। আশে পাশে বসতি নেই। হরবাবু কালী—দুর্গা স্মরণ করতে করতে যাচ্ছেন। বুকটা একটু কাঁপছেও। এই বিজ্ঞানের অগ্রগতির যুগেও পৃথিবীটা যে কেন এত পেছিয়ে আছে, তা তিনি বুঝতে পারেন না।

ফিরিঙ্গির হাট ছাড়িয়ে ডাইনে মোড় নিতে হবে। কিন্তু এত জম্পেশ অন্ধকারে কিছুই ঠাহর হচ্ছে না, টর্চবাতির আলো চার পাঁচ হাতের বেশি যাচ্ছেও না। বড়ই বিপদ।

হরবাবুর মুখ থেকে বেরিয়ে গেল, — ওঃ, আজ বেঘোরে প্রাণটা না যায়। ডান দিকে তুলসীপোতার রাস্তার মুখটা খুঁজে পেয়েও দমে গেলেন হরবাবু। এতক্ষণ যাইহোক শক্ত জমির ওপর হাঁটছিলেন। এবার একেবারে থকথকে কাদা।

—হরি হে, এই রাস্তায় মানুষ যেতে পারে? পৃথিবীটা আর বাসযোগ্য নেই।

হরবাবু আপনমনে কথাটা বলে ফেলতেই পিছন থেকে কে যেন বলে উঠল, —তা যা বলেছেন।

হরবাবু এমন আঁতকে উঠলেন যে আর একটু হলেই তাঁর হার্ট ফেল হত। পিছনে তাকিয়ে দেখেন একটা রোগা আর লম্বাপানা লোক। হরবাবুর সঙ্গে শালার বউয়ের জন্য গড়ানো একছড়া হার আছে। কিছু পয়সাও। লোকটা ডাকাত নাকি? হরবাবু কাঁপা গলায় বললেন, আপনি কে?

—চিনবেন না। এদিক পানেই যাচ্ছিলাম।

—অ। তা ভালো।

—আপনি কোথায় যাচ্ছেন? গোবিন্দপুর নাকি?

হরবাবু কাঁপা গলায় বললেন, —হ্যাঁ, সেখানেই যাওয়ার কথা।

লোকটা একটু হাসল, — যেতে পারবেন কি? এখন তো এই কাদা দেখছেন, গোড়ালি অবধি। এরপর হাঁটু অবধি গেঁথে যাবে।

—তাহলে উপায়? আমার যে না গেলেই নয়।

লোকটা একটু হেসে বলে, — উপায় কাল সকাল অবধি বসে থাকা। তারপর ভোরবেলা ফিরিঙ্গির হাট থেকে গরুর গাড়ি ধরে শিয়াখালি আর চটের হাট হয়ে গোবিন্দপুর যাওয়া। তাতে অবশ্য রাস্তাটা বেশি পড়বে। প্রায় সাত আট মাইল। কিন্তু বর্ষাকালে তুলসীপোতা দিয়ে যাতায়াত নেই।

—রাত এখানে কাটাব? থাকব কোথায়?

—তার আর ভাবনা কী? একটু এগোলে ওই জঙ্গলের মধ্যে আমার দিব্যি ঘর আছে। আরামে থাকবেন।

হরবাবু খুব দোটানায় পড়লেন বটে, কিন্তু কী আর করেন। লোকটা যদি তাঁর সব কেড়েকুড়েও নেয় তাহলে কিছু করার নেই বটে। কিন্তু গোবিন্দপুর যে পৌঁছানো যাবে না তা বুঝতে পারছেন।

আমার পিছু পিছু আসুন। —বলে লোকটা একটু এগিয়ে গেল।

হরবাবু খুব ভয়ে ভয়ে সংকোচের সঙ্গে তার পিছু পিছু যেতে যেতে বললেন,—তা আপনার বাড়ি বুঝি ফিরিঙ্গি হাটেই?

—তা বলতে পারেন। যখন যেখানে ডিউটি পড়ে সেখানেই যেতে হয়। আমার কাছে সব জায়গাই সমান। তবে আপনার এই পৃথিবীটা যে বাসযোগ্য নয় তা খুব ঠিক কথা। এখানে হরকিত, গুবজোর, সেরোঈ কিছুই পাওয়া যায় না। বড্ড অসুবিধে।

লোকটা পাগল নাকি? হরবাবু অবাক হয়ে বললেন, —কী পাওয়া যায় না বললেন?

বলে লাভ কী? আপনি পারবেন জোগাড় করে দিতে? ওসব হচ্ছে খুব ভালো ভালো সবজি।

জন্মে যে নামও শুনিনি। এসব কি বিলেতে হয়?

না মশায় না। বিলেতের বাজারও চষে ফেলেছি।

খুবই আশ্চর্য হয়ে হরবাবু বললেন, —বিলেতেও গেছেন বুঝি?

—কোথায় যাইনি মশায়! ছোট গ্রহ, এমুড়ো ওমুড়ো টইল দিতে কতক্ষণই বা লাগে।

হরবাবু হতভম্ব হয়ে গেলেন। এই দুর্যোগের রাতে শেষে কি পাগলের পাল্লায় পড়লেন?

লোকটা হাঁটতে হাঁটতে বলল, —নিতান্তই পেটের দায়ে পড়ে থাকা মশাই। নইলে এই অখাদ্য জায়গায় কেউ থাকে? এখানে ফোরঙ্গলিথুয়াম হয় না, কাঙারাঙা নেই, ফেজুয়া নেই —এ জায়গায় থাকা যায়?

হরবাবু গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, —এগুলো কি সবজি?

—আরে না। আপনাকে এসব বুঝিয়েই বা লাভ কী? আপনি এসব কখনও দেখেননি জানেনও না। ফোরঙ্গলিথুয়াম একটা ভারি আমোদ প্রমোদের ব্যাপার। কাঙারাঙা হল খেলা। ফেজুয়া হল —নাঃ, এটা বুঝবেন না।

হরবাবু মাথা নেড়ে বললেন, —আজ্ঞে না। আমার মাথায় ঠিক সেঁধোচ্ছে না। তা মশাইয়ের দেশ কি আফ্রিকা?

—হাসালেন মশাই। আফ্রিকা হলে চিন্তা কি ছিল! এ হল জরিভেলি লোকের ব্যাপার।

—জরিভেলি?

—শুধু জরিভেলি নয়, জরিভেলি লোক। এই আপনাদের মোটে নয়টি গ্রহ নয়, আমাদের ফুন্দকনীকে ঘিরে পাঁচ হাজার গ্রহ ঘুরপাক খাচ্ছে। সবকটা নিয়ে জরিভেলি লোক। এলাহি কাণ্ড।

হরবাবু মূর্ছা গেলেন না। কারণ লোকটা পাগল। আবোল তাবোল বকছে।

কিন্তু কয়েক কদম যেতে না যেতেই হরবাবু যে জিনিসটা দেখতে পেলেন তাতে তাঁর চোখ ছানাবড়া। জঙ্গলের মধ্যে ছোটখাটো একটা বাড়ির মতো একখানা মহাকাশযান। আলো টালো জ্বলছে। ভারি ঝলমল করছে জিনিসটা।

—আসুন, ভিতরে আসুন। আমি একা মানুষ, আপনার আপ্যায়নের ত্রুটি ঘটবে।

ভিতরে ঢুকে হরবাবু যা দেখলেন, তাতে তাঁর মূর্ছা যাওয়ারই জোগাড়। হাজার কলকব্জা, হাজার কিম্ভূত সব জিনিস। কোথাও আলো জ্বলছে নিবছে, কোথাও হুস করে শব্দ হল, কোথাও পিঁ পিঁ করে যেন বেজে গেল, কোথাও একটা যন্ত্র থেকে একটা গলার স্বর অচেনা ভাষায় নাগাড়ে কী যেন বলে চলেছে— লং পজং ঢাকাকাল লং পজং পাকালাব….

হরবাবুর মাথা ঘুরছিল। তিনি উবু হয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন।

লোকটা তাড়াতাড়ি কোথা থেকে এক গেলাস কালোমতো কী একটা জিনিস এনে তাঁর হাতে দিয়ে বলল,—খেয়ে ফেলুন।

হরবাবু বুক ঠুকে খেয়ে ফেললেন। একবারই তো মরবেন। তবে স্বাদটা ভারি অদ্ভুত। ভিতরটা যেন আরামে ভরে গেল।

—এসব কী হচ্ছে মশাই বলুন তো?

লম্বা লোকটা ব্যাজার মুখে বলল, —কী আর হবে? আমার এখানে পোস্টিং হয়েছে। পাক্কা তিনটি মাস— আপনাদের হিসেবে— এইখানেই পড়ে থাকতে হবে।

—কীসের পোস্টিং?

—আর বলবেন না মশাই। এতদিন জরিভেলির বাইরে আমরা কোথাও যেতাম না। এখন হুকুম হয়েছে, কাছে পিঠে যে—কটা লোক আছে সেগুলো সম্পর্কে সব তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। সোজা কাজ নাকি মশাই? যেখানে পোস্টিং হবে, সেখানকার ভাষা শেখো রে, সেখানকার আদব কায়দা রপ্ত করো রে, সেখানকার অখাদ্য খেয়ে পেট ভরাও রে। নাঃ, চাকরিটা আর পোষাচ্ছে না।

হরবাবু একটু একটু বুঝতে পারছেন, লোকটা গুল মারছে না। তিনি উঠে একটা চেয়ারগোছের জিনিসে বসে পড়ে বললেন, — আপনাদের জরিভেলি কতদূর?

—বেশি নয়। আপনাদের হিসেবে মাত্র একশো তেত্রিশ আলোকবর্ষ দূরে।

—অ্যাঁ?

হ্যাঁ, তা আর বেশি কী? আমার এই গাড়িতে ঘণ্টা খানেক লাগে।

—অ্যাঁ।

—হ্যাঁ।

হরবাবু খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে বললেন, —তাহলে আর আমার শ্বশুরবাড়ি গোবিন্দপুর এমনকী দূর?

—কিছু না, কিছু না।

হরবাবু মহাকাশযান থেকে লাফ দিয়ে নেমে পড়ি—কি—মরি করে ছুটতে লাগলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *