১
বালককালে আমার সাহস যে কত ছিল তার দুটি দৃষ্টান্ত মনে পড়ছে। মানিকতলায় রাজেন্দ্রলাল মিত্রের ঘরে আমার যাওয়া-আসা ছিল, আর তার চেয়ে স্পর্ধা প্রকাশ করেছি পটলডাঙায় বঙ্কিমচন্দ্রের সামনে যখন-তখন হঠাৎ আবির্ভূত হয়ে।
একটা কথা মনে রাখা চাই তখন যাঁরা নামজাদা ছিলেন তাঁদের কাজের জায়গা বা আরামের ঘর এখনকার মতো সকলের পক্ষেই এত সুগম ছিল না। তখন সাহিত্যে যাঁদের প্রভাব ছিল বেশি তাঁদের সংখ্যা ছিল কম, তাঁদের আমরা সমীহ ক’রে চলতুম। তখনকার গণ্য লোকেরা সকলেই রাশভারি ছিলেন ব’লে আমার মনে পড়ে। সেকালে সমাজে একটা ব্যবহারবিধি ছিল, তাই পরস্পরের মর্যাদা লঙ্ঘন সহজ ছিল না।
রাজেন্দ্রলালের প্রতি আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা ছিল, গাম্ভীর্য ও বিনয়ে মিশ্রিত তাঁর সহজ আভিজাত্যে আমি মুগ্ধ ছিলুম। তাঁর কাছে নিজের জোরে আমি প্রশ্রয় দাবি করি নি তিনি স্নেহ করে আমাকে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন। কথাপ্রসঙ্গে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীমশায়ের কথা সব প্রথমে আমি তাঁরই কাছে শুনেছিলাম। অনুভব করেছিলেম শাস্ত্রীমশায়ের প্রতি তাঁর বিশেষ শ্রদ্ধা ছিল। সে সময়ে এশিয়াটিক সোসাইটির কাজে তাঁর সঙ্গে অনেক সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত কাজ করতেন। তাঁদের মধ্যে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীমহাশয়কে তিনি যে বিশেষভাবে আদর করেছিলেন পরেও তার প্রমাণ দেখেছি।
এই প্রসঙ্গে রাজেন্দ্রলালের কথা আমাকে বলতে হল তার কারণ এই যে শাস্ত্রীমশায় দীর্ঘকাল যে রাস্তা ধরে কাজ করেছেন সে রাস্তা আমার পক্ষে দুর্গম। সেইজন্যে তাঁকে প্রথম চিনেছি রাজেন্দ্রলালের প্রশংসাবাক্য থেকে আমার পক্ষে সেই যথেষ্ট।
তার পরে তাঁর সঙ্গে আমার যে পরিচয় সে বাংলা ভাষার আসরে। সংস্কৃত ভাষার সঙ্গে বাংলার মতো ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ থাক্ তবু বাংলার স্বাতন্ত্র্য যে সংস্কৃত ব্যাকরণের তলায় চাপা পড়বার নয়, আমি জানি এ মতটি শাস্ত্রীমহাশয়ের। এ কথা শুনতে যত সহজ আসলে তা নয়। ভাষায় বাইরের দিক থেকে চোখে পড়ে শব্দের উপাদান। বলা বাহুল্য বাংলা ভাষার বেশিরভাগ শব্দই সংস্কৃত থেকে পাওয়া। এই শব্দের কোনোটাকে বলি তৎসম, কোনোটাকে তদ্ভব।
ছাপার অক্ষরে বাংলা পড়ে পড়ে একটা কথা ভুলেছি যে, সংস্কৃতের তৎসম শব্দ বাংলায় প্রায় নেই বললেই হয়। “অক্ষর’ তৎসম বলে গণ্য করি ছাপার বইয়ে; অন্য ব্যবহারে নয়। রোমান অক্ষরে “অক্ষর’ শব্দের সংস্কৃত চেহারা তযড়বতক্ষত বাংলায় ষযযবতক্ষ। মরাঠি সংস্কৃত শব্দ প্রায় সংস্কৃতেরই মতো, বাংলায় তা নয়। বাংলার নিজের উচ্চারণের ছাঁদ আছে, তার সমস্ত আমদানি শব্দ সেই ছাঁদে সে আপন করে নিয়েছে।
তেমনি তার কাঠামোটাও তার নিজের। এই কাঠামোতেই ভাষার জাত চেনা যায়। এমন উর্দু আছে যার মুখোশটা পারসিক কিন্তু ওর কাঠামোটা বিচার করে দেখলেই বোঝা যায় উর্দু ভারতীয় ভাষা। তেমনি বাংলার স্বকীয় কাঠামোটাকে কী বলব? তাকে গৌড়ীয় বলা যাক।
কিন্তু ভাষার বিচারের মধ্যে এসে পড়ে আভিজাত্যের অভিমান, সেটা স্বাজাত্যের দরদকে ছাড়িয়ে যেতে চায়। অব্রাহ্মণ যদি পৈতে নেবার দিকে অত্যন্ত জেদ করতে থাকে তবে বোঝা যায় যে, নিজের জাতের ‘পরে তার নিজের মনেই সম্মানের অভাব আছে। বাংলা ভাষাকে প্রায় সংস্কৃত ব’লে চালালে তার গলায় পৈতে চড়ানো হয়। দেশজ বলে কারো কারো মনে বাংলার ‘পরে যে অবমাননা আছে সেটাকে সংস্কৃত ব্যাকরণের নামাবলী দিয়ে ঢেকে দেবার চেষ্টা অনেকদিন আমাদের মনে আছে। বালক বয়সে যে ব্যাকরণ পড়েছিলুম তাতে সংস্কৃত ব্যাকরণের পরিভাষা দিয়ে বাংলা ভাষাকে শোধন করবার প্রবল ইচ্ছা দেখা গেছে; অর্থাৎ এই কথা রটিয়ে দেবার চেষ্টা, যে, ভাষাটা পতিত যদি বা হয় তবু পতিত ব্রাহ্মণ, অতএব পতিতের লক্ষণগুলো যতটা পারা যায়, চোখের আড়ালে রাখা কর্তব্য। অন্তত পুঁথিপত্রের চালচলনে বাংলা দেশে “মস্ত ভিড়’কে কোথাও যেন কবুল করা না হয় স্বাগত বলে যেন এগিয়ে নিয়ে আসা হয় “মহতী জনতা’কে।
এমনি করে সংস্কৃতভাষা অনেককাল ধরে অপ্রতিহত প্রভাবে বাংলা ভাষাকে অপত্য নির্বিশেষে শাসন করবার কাজে লেগেছিলেন। সেই যুগে নর্মাল স্কুলে কোনোমতে ছাত্রবৃত্তি ক্লাসের এক ক্লাস নীচে পর্যন্ত আমার উন্নতি হয়েছিল। বংশে ধনমর্যাদা না থাকলে তাও বোধহয় ঘটত না। তখন যে ভাষাকে সাধুভাষা বলা হত অর্থাৎ যে ভাষা ভুল করে আমাদের মাতৃভাষার পাড়ায় পা দিলে গঙ্গাস্নান না করে ঘরে ঢুকতেন না তাঁর সাধনার জন্যে লোহারাম শিরোরত্নের ব্যাকরণ এবং আদ্যানাথ পণ্ডিতমশায়ের “সমাসদর্পণ’ আমাদের অবলম্বন ছিল। আজকের দিনে শুনে সকলের আশ্চর্য লাগবে যে, দ্বিগু সমাস কাকে বলে সুকুমারমতি বালকের তাও জানা ছিল। তখনকার কালের পাঠ্যগ্রন্থের ভূমিকা দেখলেই জানা যাবে সেকালে বালকমাত্রই সুকুমারমতি ছিল।
ভাষা সম্বন্ধে আর্যপদবীর প্রতি লুব্ধ মানুষ আজও অনেক আছেন, শুদ্ধির দিকে তাঁদের প্রখর দৃষ্টি– তাই কান সোনা পান চুনের উপরে তাঁরা বহু যত্নে মূর্ধন্য ণ-য়ের ছিটে দিচ্ছেন তার অপভ্রংশতার পাপ যথাসাধ্য পালন করবার জন্যে। এমন-কি, ফার্সি “দরুন’ শব্দের প্রতিও পতিতপাবনের করুণা দেখি। গবর্নমেন্টে-র উপর ণত্ব বিধানের জোরে তাঁরা ভগবান পাণিনির আশীর্বাদ টেনে এনেছেন। এঁদের “পরনে’ “নরুণ-পেড়ে’ ধুতি। ভাইপো “হরেনে’র নামটাকে কোন্ ন-এর উপর শূলে চড়াবেন তা নিয়ে দো-মনা আছেন। কানে কুণ্ডলের সোনার বেলায় তাঁরা আর্য কিন্তু কানে মন্ত্র শোনার সময় তাঁরা অন্যমনস্ক। কানপুরে মূর্ধন্য ণ চড়েছে তাও চোখে পড়ল– অথচ কানাই পাহারা এড়িয়ে গেছে। মহামারী যেমন অনেকগুলোকে মারে অথচ তারই মধ্যে দুটো-একটা রক্ষা পায়, তেমনি হঠাৎ অল্পদিনের বাংলায় মূর্ধন্য ণ অনেকখানি সংক্রামক হয়ে উঠেছে। যাঁরা সংস্কৃতভাষায় নতুন গ্র্যাজুয়েট এটার উদ্ভব তাঁদেরই থেকে, কিন্তু এর ছোঁয়াচ লাগল ছাপাখানার কম্পোজিটরকেও। দেশে শিশুদের ‘পরে দয়া নেই তাই বানানে অনাবশ্যক জটিলতা বেড়ে চলেছে অথচ তাতে সংস্কৃতভাষার নিয়মও পীড়িত বাংলার তো কথাই নেই।
প্রাচীন ভারতে প্রাকৃত ভাষার ব্যাকরণ লেখা হয়েছিল। যাঁরা লিখেছিলেন তাঁরা আমাদের চেয়ে সংস্কৃত ভাষা কম জানতেন না। তবু তাঁরা প্রাকৃতকে নিঃসংকোচে প্রাকৃত বলেই মেনে নিয়েছিলেন, লজ্জিত হয়ে থেকে থেকে তার উপরে সংস্কৃত ভাষার পলস্তারা লাগান নি। যে দেশ পাণিনির সেই দেশেই তাঁদের জন্য, ভাষা সম্বন্ধে তাঁদের মোহমুক্ত স্পষ্টদৃষ্টি ছিল। তাঁরা প্রমাণ করতে চান নি যে ইরাবতী চন্দ্রভাগা শতদ্রু গঙ্গা যমুনা ব্রহ্মপুত্র সমস্তই হিমালেয়ের মাথার উপরে জমাট-করা বিশুদ্ধ বরফেরই পিণ্ড। যাঁরা যথার্থ পণ্ডিত তাঁরা অনেক সংবাদ রাখেন বলেই যে মান পাবার যোগ্য তা নয় তাঁদের স্পষ্ট দৃষ্টি।
যে-কোনো বিষয় শাস্ত্রীমশায় হাতে নিয়েছেন তাকে সুস্পষ্ট করে দেখেছেন ও সুস্পষ্ট করে দেখিয়েছেন। বিদ্যার সংগ্রহ ব্যাপার অধ্যবসায়ের দ্বারা হয় কিন্তু তাকে নিজের ও অন্যের মনে সহজ করে তোলা ধীশক্তির কাজ। এই জিনিসটি অত্যন্ত বিরল। তবু, জ্ঞানের বিষয় প্রভূত পরিমাণে সংগ্রহ করার যে পাণ্ডিত্য তার জন্যেও দৃঢ় নিষ্ঠার প্রয়োজন; আমাদের আধুনিক শিক্ষাবিধির গুণে তার চর্চাও প্রায় দেখি নে। ধ্বনি প্রবল করবার একরকম যন্ত্র আজকাল বেরিয়েছে তাতে স্বাভাবিক গলার জোর না থাকলেও আওয়াজে সভা ভরিয়ে দেওয়া যায়। সেই রকম উপায়েই অল্প জানাকে তুমুল করে ঘোষণা করা এখন সহজ হয়েছে। তাই বিদ্যার সাধনা হাল্কা হয়ে উঠল, বুদ্ধির তপস্যাও ক্ষীণবল। যাকে বলে মনীষা, মনের যেটা চরিত্রবল সেইটের অভাব ঘটেছে।
তাই আজ এই দৈন্যের দিনে মহামহোপাধ্যায় শাস্ত্রীমশায় যে সঙ্গিবিরল সার্থকতার শিখরে আজও বিরাজ করছেন তারই অভিমুখে সসম্মানে আমি আমার প্রণাম নিবেদন করি।
[১৩৩৮]