1 of 2

হরতনের গোলাম – মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়

হরতনের গোলাম – মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়

তোমরা অনেক আশ্চর্য ঘটনা কানে শুনেছ, কিন্তু আমি চোখে দেখেছি এক অত্যাশ্চর্য অদ্ভুত ঘটনা। তখন আমার বয়স অল্প—বোধ হয় তেরো-চোদ্দ।

বৃন্দাবন, ডাক-নাম বিনু, ছিল আমার সব-চেয়ে ভালবাসার বন্ধু। এক ক্লাসে পড়তুম, দিনরাত একসঙ্গে থাকতুম, সে ছাড়া আর কারো সঙ্গে খেলতে, কথা-কইতে আমার ভাল লাগত না। আমাদের কাছেই ছিল তাদের বাড়ি।

তখন আমরা নতুন তাস খেলতে শিখেছি। বিনু সেবার একদিনের জন্য মামার বাড়ি গিয়ে বিন্তি খেলা শিখে এসেছিল। এসেই সে আমায় ওই খেলা শিখিয়ে দিলে। দুজনেই নতুন খেলিয়ে, কিন্তু বিনু দু-চার বাজি খেলেই পাকা ওস্তাদ হয়ে উঠল। আমি প্রায় প্রতি হাতেই তার কাছে হারতুম। কোথায়ই বা তাকে জিতেছি? স্কুলের লেখা-পড়ার প্রাইজে, খেলাধুলার প্রাইজে সে বরাবরই আমায় হারিয়ে এসেছে; এমন কি নিমন্ত্রণ খেতে বসেও কোনদিন তাকে জিততে পারিনি; সে বরাবর আমার চেয়ে বেশি পেয়েছে। এক-এক সময় সন্দেহ হত আমার মায়ের স্নেহটিও বুঝি সে আমার চেয়ে বেশি করে জিতে নিলে। কিন্তু এতে আমার দুঃখ ছিল না। কারণ তাকে যে আমি সত্যিই ভালবাসতুম।

রোজ সন্ধ্যার পর স্কুলের পড়া শেষ করে, খাওয়া-দাওয়া সেরে নিয়ে আমরা দুই বন্ধুতে আমাদের সদর-বাড়ির পশ্চিম কোণে ভাঙা নহবৎখানার নিচের অন্ধকার ঘরটায় লুকিয়ে বসে তাস খেলতুম। এই ঘরটায় পুরাকালে কে থাকত জানি না; এ বাড়ি যখন জম্‌জমাট ছিল, তখন হয়তো কর্তাদের সানাইওয়ালারা এইখানে বসবাস করত। এখন এখানে দিনে-রাতে কারো পায়ের ধুলো পড়ে না—এক চুপি-চুপি আমাদের ছাড়া। এই ঘরটা আমাদের দুই-বন্ধুর ভারি মনের মত ঘর ছিল—এর মধ্যে বাড়ির ভিতরকার তাড়াহুড়ো এসে পৌঁছতে পারত না; আমরা দুজনে পায়রার খোপের মত একটুখানি জায়গায় বেশ নির্জনে নিশ্চিন্তে মুখোমুখি বসে মনের সুখে অবিরাম গল্‌গল্‌ করতে পারতুম। আমাদের ছুটির দিনগুলো নির্বিঘ্নে নিবিড় আনন্দে কাটত—এই ঘরখানির কোলে মাথা রেখে শুয়ে। বিনু নিজের হাতে ওই ঘরের একটি কোণ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখত। এর কোন আভরণ ছিল না—এর সমস্ত অভাব ও দৈন্যকে আমরা আমাদের অন্তরের আনন্দ দিয়ে ঢেকে রেখেছিলুম। নইলে সেই কঙ্কাল-সার জীর্ণ অন্ধকার কোটরের মধ্যে আমাদের কচি দুটো প্রাণ কিছুতেই তিষ্ঠতে পারত না।

বিনু মামার বাড়ি থেকে এক-জোড়া তাস সংগ্রহ করে এনেছিল, বোধ হয় তার মামাদের আড্ডার পরিত্যক্ত তাস। তাস-জোড়াটা ছিল খুবই পুরোন— ভদ্রসমাজে নিতান্তই অচল। সম্ভবত তাই এত সহজে সে-বেচারা ওস্তাদ খেলোয়াড়দের কড়া হাতের কঠিন চাপড় থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে বিনুর ছোট্ট নরম হাতখানিতে এসে পড়বার সৌভাগ্য পেয়েছিল। বেচারাকে যে অনেক দিন ধরে অনেক চড়-চাপড় সইতে হয়েছে সে তার চেহারা দেখলেই বোঝা যেত। কিন্তু কোন গুরুতর অপরাধে তার কানগুলো যে এমন নির্দয়ভাবে কাটা গিয়েছিল এবং কেনই বা তার বুকের উপর আঁচড় টেনে-টেনে এমন ক্ষত-বিক্ষত করা হয়েছে তা আমরা বুঝতে পারতুম না। এ তার কোন পাপের শাস্তি!—কে জানে!

তার এই জীর্ণশীর্ণ চেহারা দেখে আমাদের কেমন মায়া করত; সেই জন্যে তার উপর জোরজবরদস্তি করতে পারতুম না। একে নিয়ে অতি সন্তর্পণে খেলতুম,অনেককাল আগে এখানে ছিল যেন তাদের কাছে। —আস্তে-আস্তে তুলতুম, আস্তে-আস্তে ফেলতুম, ভাঁজাতুম খুব আল্‌গা হাতে। খেলা শেষ হয়ে গেলে ধীরে-ধীরে গুছিয়ে একখানি রুমাল মুড়ে তুলে রাখতুম—অতি যত্নে। সত্যি বলছি এই তাসকে এত ভালবাসতুম আমরা যে এর বদলে নতুন ঝকঝকে তাস কিনে আনতে আমাদের লোভটুকু পর্যন্ত হয়নি কোনদিন। এই তাসের ছবি দেখে আমার মনে হত—এরা যেন এককালে এই বাড়িরই মানুষ ছিল, এখন তাস হয়ে গেছে। তোমরা হেসো না; এর হরতনের গোলামটিকে আমার মনে হত ঠিক যেন বুড়ো ঠাকুরর্দার দরোয়ান এ! এর ফোঁটা-ওয়ালা তাসগুলোও যেন কেমন-এক-রকমের। এক-একদিন বিনুর সঙ্গে খেলতে-খেলতে প্রদীপের ঝাপসা আলোয় এর আটা-নওলা-দওলার রঙিন ফুটকিগুলোর দিকে চেয়ে-চেয়ে হঠাৎ আমার চোখ কেমন ধাঁধিয়ে যেত—মনে হত আমি যেন তাদের ওই ফুটকিগুলোর ফাটলের মধ্যে দিয়ে কতদূর চলে গেছি—সে যেন কতকালের আগেকার কোনখানে!—যারা অনেককাল আগে এখানে ছিল যেন তাদের কাছে! সেখানে কি দেখতুম, কি শুনতুম মনে নেই কিন্তু সে-সব দেখে-শুনে কেমন তন্ময় হয়ে যেতুম। হঠাৎ বিনুর ডাকে আবার ফিরে আসতুম। সে ধমক দিয়ে বলত, “কি বসে বসে ভাবছিস? খ্যাল না! আমি অমনি তাড়াতাড়ি যা-হোক-একখানা তাস ফেলে দিয়ে খেলায় আবার মন দিতুম। কিন্তু বুকটা কেমন ছম্‌ছম্‌ করতে থাকত। মনে হত এ নিশ্চয় যাদু করা তাস!

বিনুকে একদিন জিজ্ঞাসা করেছিলুম, ,’এই তাস নিয়ে তোর মামার বাড়িতে কারা খেলত রে বিনু?’ বিনু বলেছিল, ‘শুনেছি দাদামশাই খুব পাকা খেলিয়ে ছিলেন আমলের তাস।’ বিনুর দাদামশাইকে আমরা চোখে দেখিনি ; কেউ নাকি তাঁকে তাস-খেলায় হারাতে পারত না। লোকে হিংসে করে বলত, সে তাঁর খেলার গুণ নয়, তাসের গুণ! তিনি তাস গুণ করতে জানতেন। বোধ হয় এ তাঁরই আমলের তাস।’ বিনুর দাদামশাইকে আমরা চোখে দেখিনি; তার মামাদেরই দেখতুম খুব বুড়ো! উঃ, তাহলে না-জানি তিনি কত বুড়ো! এ সেই আদ্যিকালের-বদ্যি-বুড়োর হাতের গুণ করা তাস! এ তাস ছুঁতে বুক ছমছম করত, কিন্তু তবু ভালবাসতুম বিনুর-দেওয়া এই তাস-জোড়াটাকে।

এই তাস নিয়ে বিনু গম্ভীর মুখে রোজ আমার সঙ্গে খেলত। তাকে খেলায় জিততে পারতুম না বলে সে প্রায়ই হাসতে হাসতে বলত, ‘জানিস মল্লি, এ আমার দাদামশাইয়ের গুণ-করা তাস! এ তাস হাতে থাকলে কেউ আমায় জিততে পারবে না। —তুইও না!’

আমাদের আড্ডা ঘরের দেয়ালে গরুর চোখের মত একটা সরু কুলুঙ্গিতে ছোট্ট একটি তেলের প্রদীপ জ্বলত—আমাদের বসবার কোণটুকু আলো-করে; বাকি ঘরটা অন্ধকারের আবছায়ায় পড়ে থাকত—কালো চাদর মুড়ি দিয়ে। খেলা জমে উঠত, সঙ্গে সঙ্গে রাতের অন্ধকারও জমে উঠত। একে-একে বাড়ির প্রদীপ সব নিভে যেত, ঘরের পাশে সরু গলির পথটা ক্রমে নির্জন হয়ে আসত। চৌধুরী-বাড়ির দোতলার জানলা থেকে যে এক-ফালি সরু আলো এসে অন্ধকার গলির উপর পড়ত, ক্রমে সেটুকুও অস্ত যেত; গলির ফাঁকটা ভরাট হয়ে উঠত—জমাট অন্ধকারে। আর সেই কালো পাথরের মত অন্ধকারের উপর দিয়ে মাঝে-মাঝে শুনতুম কে যেন পায়চারি করছে লাঠি-হাতে খড়ম-পায়ে—খট্‌-খটাস্‌! খট্‌-খটাস্। তার পরেই খুব দূর থেকে একটা খেকি কুকুর বুক-ফেটে কারে উঠত—কেঁই-কেঁই! আর অমনি ঝুলের ঝালর ও মাকড়সার জাল-দিয়ে-ঘেরা আমাদের ঠাকুর্দার আমলের পুরোন ঠাকুরদালানের কাল্‌প্যাঁচা ও চামচিকে-বাদুড়গুলো অন্ধকারের মধ্যে কখনো হস্-হস্ কখনো হিস্‌-হিস্‌ শব্দে তাদের বাচ্চাগুলোকে সাবধান করে দিত এবং মাঝে-মাঝে ফট্‌ফট্‌ করে হাততালির আওয়াজে কাকে যেন আমাদের ঘরের দিকে তাড়িয়ে দিত! ওই বুঝি সে এল! এই ভাবতে ভাবতে আমার সর্বাঙ্গ অসাড় হয়ে আসত। হাতের তাস মাটিতে নামত না! বিনু ধমক দিয়ে বলত, ‘কি করছিস্? খ্যাল্‌ না!’ তার এই ধমকানিতে আমার চত্‌কা ভাঙত। আর সঙ্গে-সঙ্গে চারিদিকের ওই বিশ্রী শব্দগুলোও যেন ভয়ে-ভয়ে চুপ করে যেত। তা যদি না হত তাহলে বোধ হয় ঘর থেকে ছুটে আমি বাবার কাছে পালিয়ে যেতুম, কিছুতেই বিনুর সঙ্গে খেলতুম না।

সেদিন খেলা আরম্ভ করতেই হঠাৎ খুব জোরে ঝড়-বৃষ্টি এল। একটা ঝড়ের দমকা আমাদের কোলের তাসগুলোকে উল্টে-পাল্টে ভেস্তে দিয়ে ঘর থেকে খানিকটা ঝুল ও ধুলো উড়িয়ে নিয়ে চলে গেল। বিনু বললে, ‘মল্লি, দরজা-জানলাগুলো বন্ধ করে দে!’ আমি উঠে জানলগুলো বন্ধ করতে লাগলুম। পশ্চিমের জানলাটায় হাত দিতেই কে যেন সজোরে আমার হাতে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে সেক্‌হ্যান্ড করে চলে গেল। আমি তাড়াতাড়ি হাতটা ঘরের ভিতর ঢুকিয়ে নিলুম—কিছু বুঝতে পারলুম না। বুকটা ধুক্‌ধুক্‌ করতে লাগল।

খেলতে বসেই সে বাজি জিতলুম। আশ্চর্য কাণ্ড। যা কখনো হয় নি, তাই হল। বিনুও অবাক। সে একটু বেশি করে মন দিয়ে খেলতে বসল। কিন্তু পরের বাজিও জিততে পারলে না। আমার কেমন সন্দেহ হল—এলোমেলো ঝড় এসে তাসের যাদুটা উড়িয়ে নিয়ে গেল নাকি!

আমি ক্রমাগতই জিততে লাগলুম। কিন্তু আমার কেমন মনে হচ্ছিল এ জেতায় আমার কোন বাহাদুরি নেই; প্রতিবারেই এমন তাস আসছিল যে খেললেই পিঠ পাওয়া যায়; কে যেন ম্যাজিক করে ভাল ভাল তাসগুলো বেছে বেছে আমার হাতে তুলে দিচ্ছে। বিনু বারবার হেরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠল, ‘আজ আমার পড়তা খারাপ পড়ল দেখছি!’ তার এই দীর্ঘশ্বাসটি আমার বুকে গিয়ে বাজল! আমি চঞ্চল হয়ে উঠলুম। আমার মন কেঁদে বলতে লাগল, ‘আমি জিত চাই না, বিনু জিতুক।’ আমি ফন্দি করে বিনুকে জিতিয়ে দেবার জন্যে হাঁকুপাঁকু করতে লাগলুম; কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। আজকের এই ঝড়ে কেমন যেন সব এলোমেলো হয়ে গেছে!

বিনু ফেললে হরতনের বিবি, তাকে সেই পিঠটা দেবার জন্য আমি তাড়াতাড়ি খেললুম গোলাম, কিন্তু পিঠ তোলবার সময় দেখা গেল গোলামটা চেহারা বদলে সাহেব হয়ে গেছে। কাজেই পিঠটা আমাকেই নিতে হল। পরের হাতে আমি খেললুম চিঁড়ের দশ; আমি জানতুম বিনু এ দশ ফোঁটার লোভ কিছুতেই ছাড়তে পারবে না, সে নিশ্চয় গোলাম দিয়ে পিঠটা নেবে; বিনু ফেললেও গোলাম, কিন্তু আমার দশখানা হঠাৎ দু ফোঁটা চুরি করে কেমন করে যে আটা হয়ে গেল আমি কিছুতেই বুঝতে পারলুম না। আমি অবাক; বিনু বাজি হেরে গোঁ হয়ে বসে রইল।

রাগ হলে বিনুর বড় বড় চোখ দুটো আরো বড় হয়ে উঠতে দেখেছি, কিন্তু আজ যেন অস্বাভাবিক রকম বড় হয়েছে বলে মনে হতে লাগল। সে-বারের খেলাতে তার হাতের ফ্রাই ইস্কাবনের দশখানার উপর চিঁড়ের সাতা পাশিয়ে দিতে গিয়ে যখন সেটা রঙের সাতার তুরুপ হয়ে গেল, তখন তার সেই হঠাৎ-বড়-হয়ে-যাওয়া চোখ দুটো কেমন-এক-রকম-ভাবে বিস্ফারিত করে সে আমার দিকে চাইলে যে সে-চাহনিতে আমার সর্বশরীর ঝিম্‌ঝিম্‌ করে এল।

বিনুকে ভয়ে ভয়ে বললুম,—‘ভাই, আর খেলে কাজ নেই। চল যাই।’ বিনু সে কথা কানেই তুললে না।

ক্রমে রাত গভীর হয়ে এল। মনে হল বাড়ির সবাই ঘুমিয়েছে; আমাদের এ ঘরখানারও যেন ঘুম ধরেছে;—এর দরজা-জানলা ইট কাঠ ঘুমে ঢুলছে। প্রদীপের আলোটা থেকে-থেকে কেবল হাই তুলছে। কড়িকাঠের খোপে খোপ চড়াই-পাখিগুলো গল্প শেষ করে শুয়ে পড়েছে। চারিদিক নিস্তব্ধ নিঝুম! হাতের তাসগুলোর দিকে চেয়ে দেখি সাহেব-বিবিদের চেহারা ঘুমে জড়িয়ে আসছে। ক্রমে মনে হল সমস্ত পৃথিবীটাই যেন ঘুমের ঝোঁকে দুলছে—ঝুম্‌ ঝুম্‌ ঝুম্‌ ঝুম্!

হঠাৎ চট্‌কা ভাঙল চৌধুরী-বাড়ির ঘড়ির শব্দে—ঢং! সেই শব্দ অন্ধকারের ঘুম ভাঙতে ভাঙতে অনেক দূর চলে গেল।

ও কি? ও কিসের শব্দ? কড়িকাঠের কাছে ওই কোণের গর্ত থেকে কে অমন বিশ্রী সুরে নিশ্বাস টানছে হুউউউস্‌স্‌স্‌!—হুউউস্‌স্‌! আমি চমকে উঠে বিনুকে জিজ্ঞাসা করলুম, ‘ও কিসের শব্দ ভাই?’

বিনু কথা কইলে না; শুধু তাস থেকে চোখ তুলে কড়িকাঠের দিকে চাইলে, আর আমার মনে হল তার সেই ড্যাবডেবে চাহনিটা চোখ থেকে ঠিকরে বেরিয়ে কড়িকাঠের অন্ধকার কোণে গিয়ে এঁটে রইল—জ্বলজ্বল করে চেয়ে আমার দিকে। বিনুকে আমি কান্নার সুরে বললুম, ‘ভাই, আমার বড় ঘুম পেয়েছে।’

বিনু বললে, ‘আচ্ছা, আর দু-হাত খেল।’ আমি চমকে উঠলুম-—তার গলা শুনে। কি গভীর আওয়াজ! এ তো বিনুর গলা নয়। কে তার গলার ভিতর থেকে কথা কইলে?

কোনরকমে এই দু-হাত খেলা এখন শেষ করতে পারলে বাঁচি! কোনদিকে কান দেবার, কোনদিকে চোখ দেবার আমার আর সাহস হচ্ছিল না। ইচ্ছা হচ্ছিল এই তাস দিয়ে চোখ-কান ঢেকে ফেলি। আমি খুব চোখের কাছে তাস এনে এক-মনে খেলতে লাগলুম।

সে-হাত বিনু খেলেছিল রঙের নওলা। আমার হাতে গোলাম ছিল, কিন্তু পিঠ নেবার ইচ্ছা ছিল না। কি করে লুকোলে বিনু সেটা ধরতে পারবে না ভাবছি, বিনু বলে উঠল সেই রকম বিষম ভারী গলায় ঘর কাঁপিয়ে, ‘গোলামটা আছে তো।’

ভয় হল ধরা পড়ে গেছি। বাঁ-হাতের তাসের সারি থেকে চট করে হরতনের গোলামটা তুলে নিয়ে হরতনের নওলার উপর ফেলতে গিয়ে দেখি—সামনে নওলা নেই; বিনুও নেই। অ্যাঁ!

বুকটা ধ্বক্ করে উঠল।

এ-পাশ্‌ ও-পাশ চেয়ে দেখি শুধু বিনু নয়, একখানি তাসও নেই।

বোঁ করে মাথাটা ঘুরে গেল। চোখে অন্ধকার দেখলুম। গা-হাত-পা ঝিম্-ঝিম্ করতে লাগল। ঘরের চার কোণ থেকে চারটে বিকট হাসি খিল্‌খিল্‌ শব্দে ছুটে বেরিয়ে গেল। আর উপরের নহবৎখানা থেকে ঢাক ঢোল কাঁসি বাঁশি সব এক সঙ্গে বেজে উঠল। আমি কাঁপতে-কাঁপতে মাটিতে শুয়ে পড়লুম। মনে হল আমার হাত-পায়ের সমস্ত খিল যেন আলগা হয়ে গেছে—উঠে-হেঁটে পালাবার আর উপায় নেই।

আমার কান্না আসতে লাগল—বিনু—আমার বিনু কোথায় গেল? উপর থেকে ভাঙা কাঁসিখানা ফাটা আওয়াজে বলতে লাগল, কই না না! কই না না! আমি খুব চেঁচিয়ে ডাকলুম, ‘বিনু! বিনু।’ কিন্তু আমার গলার স্বর মুখ দিয়ে না বেরিয়ে পেটের ভিতর চলে গেল —ঘুরতে-ঘুরতে,গোঁ-গোঁ-শব্দে!

একবার আশা হল বিনু হয়তো বাইরে গেছে—এখনি আসবে। কিন্তু বাঁ-হাত থেকে ডান হাতে তাসটা নিয়েছি মাত্র—এই এতটুকু সময়ের মধ্যে সে এতবড় ঘর পেরিয়ে বাইরে গেল কেমন করে? হয়তো আমি অন্ধকারে দেখতে পাইনি। তাই হবে। এই মনে করে দরজার দিকে এগিয়ে গেলুম, কিন্তু গিয়ে দেখি—একি, যেমন খিল বন্ধ করেছিলুম, ঠিক তেমনই আছে। —তবে সে কেমন করে বাইরে গেল?

হঠাৎ মনে হল বিনু আমাকে ভয় দেখাবার জন্যে এই ঘরের মধ্যে লুকিয়ে নেই তো!

কিন্তু কোথায় লুকোবে? ঘর যে ফাঁকা। আসবাবের মধ্যে মাত্র একটা ভাঙা আলমারি। তার পেছনে বড়জোর আঙুল পাঁচেক জায়গা। তার মধ্যে একটা মানুষ থাকতে পারে না। তবু সেখানটা একবার দেখলুম। ঘরের একোণ ওকোণ এধার ওধার প্রদীপ ধরে দেখলুম তন্ন তন্ন করে। কিন্তু সে কোথাও নেই—কোথাও নেই!

কতক্ষণ পড়ে পড়ে কেঁদেছিলুম জানি না। যখন ঘর থেকে বেরিয়ে এলুম, তখনও কান্নার জলে চোখ আমার ঝাপ্‌সা। রাত তখন নিশুতি। চারিদিক নিঝুম। কেউ কোথাও নেই; কেবল আমাদের তিন মহল প্রকাণ্ড বাড়িখানা দেখলুম ভয়ঙ্কর আতঙ্কে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে; যেন তার সর্বাঙ্গে কাঁটা দিয়ে উঠেছে! চৌধুরীদের চৌতলার চিলের ছাদটা আমাদের দিকে এতখানি গলা বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলে, ‘কি হল রে, কি হল? কোথায় গেল?’ পশ্চিম কোণের ঢ্যাঙা সুপারি গাছটা কিছু না বলে শুধু ডিঙি-মেরে আকাশের দিকে মুখ তুলে ইশারায় দেখিয়ে দিলে—আমাদের বাড়ির ঠিক মাথায় একটা মস্ত-বড় কালো পাখি তাসের মত নানা রঙে চিত্র-বিচিত্র-করা ডানা মেলে মেঘের ধার দিয়ে অন্ধকারে ভেসে চলেছে—কাকে ঠোঁটে নিয়ে! তাই দেখে চারিদিক থেকে চাপা গলায় সবাই বলে উঠল, ‘আ হা হা!’ অমনি আমার বুকের ভিতরটা করে উঠল, ‘আহাহা! বিনুকে ওরা ভেল্‌কি-বাজিতে উড়িয়ে নিয়ে গেল!’

ভাবতে ভাবতে আমার চোখের সামনে থেকে যেন সব একে একে মুছে আসতে লাগল, পায়ের তলা থেকে পৃথিবীটা ধীরে ধীরে সরে যেতে লাগল; আমি যেন একটা অতল অন্ধকারের মধ্যে ডুবতে লাগলুম—পলে-পলে, তালে-তালে!

তার পর মনে পড়ে! অন্ধকারে চেনা-পথ ধরে বাড়ির ভিতরের দিকে যাচ্ছিলুম; হঠাৎ কানে এল তাস পেটার শব্দ—চটাস্‌-চটা্‌স! এত রাত্রে এখানে অন্ধকারে তাস খেলে কে? মুহূর্তের মধ্যে আমার চলা বন্ধ হয়ে গেল; আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে শুনতে লাগলুম।

বারান্দার পশ্চিম কোণে ঘুরঘুট্টে অন্ধকারের মধ্যে আমাদের খাজনা ঘর। দিনের বেলা এর সামনে দিয়ে যেতে আমাদের গা ছমছম করে, সেজন্য এ-দিকটা আমরা কেউ মাড়াতুম না। আমাদের বিশ্বাস যত রাজ্যের ভূতপ্রেত ওইখানে বাসা বেঁধে মনের সুখে ঘরকন্না করছে। আমরা ওই মহলটা তাদের ছেড়ে দিয়েছিলুম। সেখানে কস্মিনকালে সকাল-সন্ধ্যায় আলো-গঙ্গাজল পড়ত না;—ঝাঁটও কেউ দিত না। এই খাজনা-ঘর যে কতকালের তা কেউ জানে না;—বাড়ির মধ্যে সবচেয়ে পুরোন এই জায়গাটা। শোনা যায়, ঠাকুরদাদার যিনি ঠাকুরদাদা ছিলেন, তাঁর আমলে জমিদারির খাজনা এলে এই ঘরে গচ্ছিত রাখা হত—মাটির তলায় একটা চৌখুপির মধ্যে। সরু সুড়ঙ্গের মত এই ঘর; সামনে মোটা-মোটা লোহার গরাদে-দেওয়া খাঁচার মত দরজা—পিতলের শিকল দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো। সামনে দাঁড়ালে একটা স্যাঁৎসেঁতে পচা গন্ধ নাকে আসে, আর চোখে পড়ে কালি-ঝুলি-মাখা একটা অন্ধকারের কুণ্ডলী—দিন-রাত ঘূর্ণির মত ঘুরচে!

এই ঘর কতকাল যে ভোলা হয়নি তার ঠিক নেই। খোলবার দরকার হয়নি। কারণ বহুদিন হল আমাদের সে জমিদারী নেই; তার খাজনাও আর আসে না। ঠাকুরমার মুখে গল্প শুনেছি, আমার ঠাকুরদাদার যিনি ঠাকুরদাদা ছিলেন তাঁর অগাধ টাকা ছিল—একটা রাজা-রাজড়ার তেমন থাকে না। কিন্তু তিনি ভারি কৃপণ ছিলেন। একটি পয়সাও কাউকে প্রাণ থাকতে দিতে পারতেন না—এমন কি নিজের ছেলে-মেয়েকেও নয়। তিনি কেবল টাকার পর টাকার রাশ জমা করে চলতেন। লোকে টাকা খরচ করে নাম কেনে, তিনি টাকা না খরচ করার বাহাদুরিতে লোকের কাছে খেতাব পেয়েছিলেন! টাকার উপর তাঁর এমন মায়া ছিল যে, পাছে মারা যাবার পর তাঁর টাকা খরচ হয়ে যায় এই ভয়ে তিনি তাঁর যথাসর্বস্ব যখের হাতে সমর্পণ করে যান—যার কাছ থেকে একটি কাণা-কড়িও বার হবার যো নেই!

এই যখের কাহিনী একটা মস্ত-বড় গল্প! কেমন করে একটি সুন্দর নয় বছরের ছেলেকে মেঠাই ও খেলনার লোভ দেখিয়ে তার বাপ-মায়ের কাছ থেকে চুরি করে আনা হয়, কেমন করে তাকে লাল চেলি পরিয়ে, কপালে সিঁদুরের ফোঁটা দিয়ে, ওই অন্ধকার খাজনা-ঘরের তলায় বন্ধ চৌখুপির মধ্যে—যেখানে কেবল ঘড়া ঘড়া টাকা সাজানো আছে, আর কিছু নেই, আর কেউ নেই–না বাপ, না মা, না আলো, না বাতাস—সেইখানে একলাটি বসিয়ে রেখে, তার পর ওই চৌখুপিতে ঢোকবার পথটা দশ-মণ পাথর দিয়ে চিরদিনের মত বুজিয়ে দেওয়া হয়, সে কথা শুনতে শুনতে আমার চোখে জল আসত—বুক দুর-দুর করত; আর ঠাকুরদাদার সেই পাষণ্ড ঠাকুর্দার উপর রাগ হত। ঠাকুরমা বলতেন,—‘আহা, ওই সুন্দর নয় বছরের ছেলেটি কত কেঁদেছে, বাবা-বাবা করে বুক-ফেটে কত চেঁচিয়েছে, তেষ্টায় একফোঁটা জলের জন্য ছটফট করেছে, তবু কেউ তাকে ওই চৌখুপির দরজা খুলে দেয়নি।’ শুনে আমার গলা কাঠ হয়ে আসত। তার পর ক্ষিধে-তৃষ্ণায়-ভয়ে কাতরাতে কাতরাতে বেচারা কখন যে হাঁকিয়ে মরে গেছে, সে হয়তো নিজেই বুঝতে পারেনি। এখন সে যখ হয়ে আছে—ওইখানে বসে বসে কেবল টাকার ঘড়া আগলাচ্ছে। কারো সাধ্য নেই যে ওই টাকা সেখান থেকে নিয়ে আসে! আমার ঠাকুরদাদার বাবা নাকি একবার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বেশি দূর যেতে হয়নি; মেজের পাথরে একটি মাত্র শাবলের ঘা দিতেই তিনি গোঁ-গোঁ করতে করতে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। তিন দিন তাঁর কাঁপুনি ছিল; সাত দিন তাঁর মুখে রা ছিল না। কেন যে এমন হল, কেউ জানে না, তিনি নিজেও কিছু বলেননি; কারো সাহসও হয়নি জিজ্ঞাসা করতে। সেই থেকে ওই ঘরের দিকে আর কেউ যায় না।

মনে হল ওই খাজনা-ঘর থেকেই যেন তাস-খেলার শব্দ পেলুম। যদিও ওদিকে যেতে বুক দুরদুর করতে লাগল, কিন্তু বিনুর জন্যে না গিয়ে পারলুম না; যদি সে ওখানে থাকে—যদি সে আমায় দেখতে পেয়ে ছুটে আসে।

বুকটা দু-হাতে চেপে খাজনা-ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালুম। লোহার গরাদে-দেওয়া দরজা দিনের বেলা শিকল-দিয়ে বাঁধা থাকে, কিন্তু এখন দেখলুম খোলা। অন্ধকারে চোখে কিছু দেখা গেল না, কিন্তু কানে শোনা গেল—কারা দুজন যেন দরজার দুইধার থেকে সজোরে ছুটে এসে মাথায়-মাথায় অনবরত ঠোকা-ঠুকি করছে—দুম্‌, দুম্‌, দুম্! আমার কেমন মনে হল যেন এইখানকার এই অগাধ সম্পত্তি এই যখের ধন—কে নেবে তাই নিয়ে দুই ভূতেই লড়াই চলেছে। আমি এক-মনে এদের লড়াইয়ের তাল গুনছি, হঠাৎ বিনুর মত কার গলা পেলুম। সে বলছে, ‘বিবির চেয়ে রঙের গোলাম বড়।’ আর-একজন কে সরু গলায় বলে উঠল, ‘দূর বোকা, কখনো হয়? গোলাম হল সাহেব-বিবির চিরকেলে কেনা গোলাম; হলই না-হয় সে রঙ মেখেছে!’

গোড়ায়-গোড়ায় আমিও একদিন বিনুকে বলেছিলুম, ‘গোলাম কেন বিবির চেয়ে বড় হবে বিনু?’ বিনু বলেছিল, ‘এইরকম যে নিয়ম।’ আজও আবার সেই কথা উঠেছে। এও তাহলে আমাদের মতন নতুন খেলিয়ে দেখছি।

আবার শুনলুম, ‘তুই কিছুই খেলতে পারিস না! মল্লি তোর চেয়ে ঢের ভাল খেলে।’ বিনু আমায় ডাকত মল্লি বলে।

মনে হল, আমার যখন নাম করছে, এ তখন নিশ্চয় বিনু! বিনুর গলায় আমার নাম শুনে ওই ঘরের মধ্যে ছুটে যাবার জন্যে আমার প্রাণটা আকুলি-বিকুলি করতে লাগল, কিন্তু পারলুম না; ভয় হল, পাছে ওই দুটো পাগলা ভূতের মাথা-ঠোকাঠুকির মধ্যে পড়ে থেঁৎলে যাই! আমি চুপ করে সেখানে দাঁড়িয়ে রইলুম।

হঠাৎ অন্য লোকটা চেঁচিয়ে উঠল, ‘অ্যাঁ, হরতনের গোলাম কোথায় গেল? হরতনের গোলাম! ভারি আশ্চর্য!—এই ছিল, এই নেই! চোখের পাতা ফেলতে-না-ফেলতেই উড়ে গেল?’

আমার ভারি হাসি পেল—ওই যাদু-করা তাস এদের সঙ্গেও যাদু খেলছে দেখছি!

বিনু বলে উঠল, ‘হরতনের গোলাম?—সে তো মল্লির হাতে।’

আমি নিজের হাতের দিকে চেয়ে দেখি—সত্যই তো, সেই হরতনের গোলাম, যা দিয়ে বিনুর নওলার পিঠ নিতে গিয়েছিলাম, সেখানা আমার হাতেই রয়েছে তো!

অন্য লোকটা বলে উঠল, ‘কৈ হ্যায়—মল্লিবাবুকো পাকাড় লে আও!’

সেই শুনে আমি তাড়াতাড়ি হরতনের গোলামখানা খাজনা-ঘরের ভিতর ছুঁড়ে দিয়ে এক-ছুটে নিজের শোবার-ঘরে পালিয়ে এলুম।

ঘরে এসেও ভয়ে বুকটা ধকধক করতে লাগল, এই বুঝি সে এসে আমায়ও জাপ্‌টে ধরে নিয়ে যায়! আমি পা থেকে মাথা পর্যন্ত চাদর মুড়ি দিয়ে মড়ার মত পড়ে রইলুম। খানিকক্ষণ কেউ এল না, তারপর কে একজন খসখস শব্দে বারান্দা দিয়ে চলে গেল—বোধ হয় আমার ঘর চিনতে পারলে না। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলুম। নিশ্চিন্ত হয়ে পাশ ফিরতে যাচ্ছি, এমন সময় কে আবার তড়াক করে লাফিয়ে আমার বিছানায় উঠল—আমি ভয়ে কাঠ! যে এল, সে খানিক বিছানার এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে আমার গা শুঁকে শুঁকে বেড়াতে লাগল; তারপর আমার মাথার কাছে এসে মুখ-ঢাকা চাদরখানা ধরে সজোরে টানতে লাগল—মুখ খুলে দেখবে। ওরে বাবারে! আমি প্রাণপণে চাদরখানা আঁকড়ে রইলুম, কিছুতেই মুখ খুলতে দিলুম না। তারপর সে পায়ের দিকে গেল। তার নিশ্বাসের হাওয়ায় আমার পা-দুখানা ঠাণ্ডা হিম হয়ে এল। আমার পা-ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যাবে না তো? ভয়ে পা গুটিয়ে নেবার চেষ্টা করলুম, পারলুম না। খানিকক্ষণ সে চুপ করে রইল, বোধ হয় কি ভাবলে, তারপর আমার পাশে এসে ধুপ করে শুয়ে পড়ল। সর্বনাশ! এখন করি কি! কিন্তু ঠিক সেই সময় আমার পুষি-বেড়ালটা ম্যাঁও-শব্দে ডেকে উঠতেই, সে তড়াক করে বিছানা থেকে লাফিয়ে পালিয়ে গেল।

পুষিকে কাছে পেয়ে আমার ভয় অনেক ভেঙে গেল। তখন আবার বিনুর ভাবনা এল—তাহলে সত্যিই কি বিনুকে ওরা ওইখানেই—ওই চৌখুপির মধ্যে নিয়ে গেল! সেখান থেকে সে পালিয়ে আসবে কি করে? এই সব ভাবছি, হঠাৎ কে কানের কাছে মুখ এনে খুব চুপি চুপি ডাকলে, ‘মল্লি, ভাই মল্লি! বিনুর কাছে যাবে? বিনুর কাছে?’

আমি ধড়মড় করে উঠে বসলুম—বিনুর কাছে যাবার জন্যে বুকটা লাফিয়ে উঠল, কিন্তু ভারি ভয় হতে লাগল— যদি আর ফিরে আসতে না পারি?

সে তখন বললে, ‘ভয় কি! চল না! বিনু তোমার জন্যে বড় কাঁদছে।’

বিনুর কান্নার কথা শুনে আমার বুক ফেটে যেতে লাগল। আমি ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলতে লাগলুম, ‘ওগো, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, বিনুকে এবার ফিরিয়ে এনে দাও—বিনুর জন্যে আমার বড্ড মন কেমন করছে।’

আমার কান্না শুনে সে চুপি চুপি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। যাবার সময় দেখলুম, একটা মস্ত পাগড়িওয়ালা চেহারা—ঠিক যেন হরতনের গোলাম।

এই হরতনের গোলামটিকে তাসের মধ্যে সবচেয়ে আমি বেশি ভালবাসতুম। আমাদের বাড়িতে যে বুড়ো থুরথুরে দরোয়ান ছিল—ঠাকুরদাদার আমলের, তাকে খুব ছেলেবেলায় দেখেছিলুম, অল্প অল্প তার চেহারা মনে পড়ে; কিন্তু বেশ মনে আছে রোজ সকালে সে একটি করে রসমুণ্ডি আমায় খাওয়াত। কি মিষ্টি লাগত সে রসমুণ্ডি! এখনো যেন তার স্বাদ মুখে লেগে আছে। আমার মনে হল, এই হরতনের গোলাম যেন সেই বুড়ো দারোয়ান—এখন তাসের ছবি হয়ে গেছে। সে বোধ হয় আমার কান্না দেখে লাঠি-হাতে বিনুকে খুঁজে আনতে গেল। আবছায়ার মত মনে পড়ে ছেলেবেলায় আমার পুষি-বেড়ালটা হারিয়ে যেতে, আমার কান্না দেখে, সে এমনি করে একদিন তাকে খুঁজে আনতে বেরিয়েছিল।

কতক্ষণ গেল; ঘরের ঘড়িটা টকটক শব্দ করতে করতে কতদূর চলে গেল, মনের মধ্যে কত ভাবনা এল-গেল—তবু বিনু এল না। হায়, সে কি আর আসবে? ওই ভয়ঙ্কর চৌখুপি ঘর—যার সামনে দুটো ভীষণ ভূত মাথা ঠোকাঠুকি করছে অনবরত, সেখান থেকে বিনুকে কে উদ্ধার করে আনবে? ভাবতে-ভাবতে আমার শরীর এলিয়ে আসতে লাগল, চোখের পাতা জড়িয়ে আসতে লাগল, কপালে যেন কে নরম ঠাণ্ডা হাত বুলিয়ে দিলে; আর অমনি একনিমিষে মনে হল, আমি যেন একখানা তাসের উপর শুয়ে কোথায় চলেছি—হাওয়ার সঙ্গে ভেসে ভেসে!

তাসখানা ভাসতে ভাসতে এসে আমায় একটা চারিদিক-আঁটা অন্ধকার ঘরের মধ্যে নামিয়ে দিলে। দেখলুম সেই অন্ধকারে বসে দুজন এক-মনে তাস খেলছে; বিনু আর একটি ছোট ছেলে—সুন্দর দেখতে, থোকা থোকা কোঁকড়া চুল চাঁদের মত কপালের উপর ছড়িয়ে পড়েছে। ঠিক যেন বিনুর ছোট ভাইটি। বিনু তার সঙ্গে খেলতে লাগল, আমার দিকে একবার চেয়েও দেখলে না। আমার ভারি রাগ হল—হিংসেও হল। এরি মধ্যে এর সঙ্গে এত ভাব! আমি মুখ গোঁ করে রইলুম।

ছেলেটি একবার তাস থেকে মুখ তুলে মিষ্টি সুরে জিজ্ঞাসা করলে, ‘এ কে, বিনু?’

বিনু গম্ভীর গলায় বললে, ‘ও মল্লি!’

সে বললে, ‘বেশ হল ; আমরা তিনটি ভাইয়ে কেমন একসঙ্গে এইখানে থাকব!’

আমি রেগে চিৎকার করে উঠলুম, না, না—আমি এখানে কিছুতেই থাকব না!

অমনি হরতনের গোলাম এসে আমায় পিঠে করে তুলে নিলে। বিনু সেটার উপর লাফিয়ে চড়তেই সেখানা ভারী হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। মজা দেখে ছেলেটা খিলখিল করে হেসে উঠল।

বিনু বললে, ‘দাঁড়া, আমরা তিন জনেই একসঙ্গে যাব।’—বলে সে ছেলেটির কানে কানে কি বললে। ছেলেটি বললে, ‘চল, যাই।’ কিন্তু উঠে দাঁড়াতে গিয়েই ধুপ করে পড়ে গেল। দিন-রাত এক জায়গায় বসে থেকে থেকে তার পা অসাড় হয়ে গেছে। বিনু তাকে কোলে করে তুলে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। তাসগুলোকে কি বললেতারা ফরফর করে উড়ে এসে পাখির মত ডানা ছড়িয়ে দাঁড়াল। আমরা উড়তে যাচ্ছি, এমন সময় কড়ি-কাঠ থেকে দুটো কালো চামচিকে এসে তাসগুলোর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারপর দুই দল যা যুদ্ধ। আঁচড়া-আঁচড়ি, কামড়া-কামড়ি! আমি ভয়ে ঠক্‌ঠক করে কাঁপতে লাগলুম। চারিদিক থেকে অন্ধকারগুলো ছুটে এসে আমাদের সামনে তালগোল পাকিয়ে পথ আটকে দাঁড়াল! —যেন আমরা পালাতে না পারি! ছেলেটি কাঁদো কাঁদো হয়ে বললে, ‘বিনু, দেখছিস তো, এরা আমায় যেতে দেবে না! তোরা কেন প্রাণে মরবি? পালা!’

বিনু বললে, ‘না ভাই, তোকে ছেড়ে কিছুতেই যাব না।’ চামচিকে দুটো তাই শুনে ফ্যাঁস করে উঠল। এমন সময় হরতনের গোলামটা ছুটে গিয়ে একটা চামচিকের পেটে সজোরে এক ঘুষি বসিয়ে দিলে; চামচিকেটা তার ধারালো নখ দিয়ে হরতনের গোলামখানাকে আঁকড়ে ধরে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল, আর সেই ফাঁকে অন্য তাসগুলো আমাকে নিয়ে উড়ে পালাল। বিনু আর সেই ছেলেটি দেখলুম সেই ঝটাপটির মধ্যে হিমসিম খাচ্ছে। আমি তাসের উপর থেকে হাত বাড়িয়ে বিনুকে ডাকতে লাগলুম, ‘বিনু, আয় আয়!’ বিনু আমার দিকে ফিরেই চাইলে না ; ছেলেটাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে রইল। আমার কান্না পেতে লাগল! তাসগুলো উড়তে উড়তে এসে আমাকে বিছানায় ফেলেই উড়ে গেল—বোধ হয় বিনুদের উদ্ধার করতে। তার পর কি হল জানি না!

‘মল্লি! মল্লি!’

আমি ধড়মড় করে উঠে বসলুম! ঝড়ের মত ধাক্কা দিয়ে কে ঘরের মধ্যে ঢুকল। সকালের আলোয় ঘরটা আলো হয়ে উঠল। মনে হল যেন একটা প্রকাণ্ড দুঃস্বপ্ন কেটে গেল। আমি ছুটে গিয়ে দুই হাতে বিনুর গলা জড়িয়ে ধরলুম, ‘বিনু, এসেছিস ভাই, এসেছিস?’

সে বললে, ‘আসব না তো কি! তুই স্টুপিড্‌ এত বেলা অবধি ঘুমচ্ছিস কেন?’

আমি বললুম, ‘কখন এলি ভাই!’

সে বললে, ‘অনেকক্ষণ! তোকে ডেকে ডেকে আমার গলা চিরে গেল। তোর আজ হয়েছে কি? চোখ অমন রাঙা কেন?’

আমার ধাঁধা লাগল। বিনু তো সবই জানে, তবে এমন আশ্চর্য হচ্ছে কেন?’

আমি আমতা-আমতা করে বললুম, কাল রাত্রে তুই খেলতে-খেলতে হঠাৎ অমন অন্তর্ধান—’

সে বাধা দিয়ে বললে, ‘আমি কেন অন্তর্ধান হতে যাব? তুই তো খেলা ফেলে চোখ মুছতে মুছতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলি।’

আমার আরও ধাঁধা লাগল। এ কি ঘুমের ঝোঁকে সবই স্বপ্নের মত দেখলুম! কিন্তু এত যে কাণ্ড, সে সবই স্বপ্ন? ইচ্ছা হচ্ছিল আগাগোড়া সব কথা বিনুকে খুলে বলে হেঁয়ালিটা পরিষ্কার করে নিই, কিন্তু পারলুম না। দিনের আলোয় কথাগুলো এমন অদ্ভুত বোধ হতে লাগল যে বলতে লজ্জা হল। আমার ভূতের ভয়ের জন্য বিনু যা আমায় ঠাট্টা করে!

বিনু বললে, ‘কি ভাবছিস? চল বাইরে যাই।’

আমরা দুই বন্ধুতে আমাদের সেই বাইরের ঘরে গিয়ে দেখি—ঘরময় তাস ছড়ানো—সমস্ত দেহ তাদের ক্ষত-বিক্ষত! তাদের বুকের উপর যেন মনের আনন্দে ধারালো নখ দিয়ে কেবল আঁচড়ের পর আঁচড় টেনেছে। বেশ বোঝা গেল রাত্রের মধ্যে খুব একটা মারামারি কাণ্ড হয়ে গেছে। আমি সভয়ে বিনুর দিকে চেয়ে বললুম, ‘বিনু দেখছিস!’

বিনু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললে, ‘আমারই জন্যে তাসগুলো গেল!’

‘আঁ! তোমারই জন্যে? তার মানে?—সেই চৌখুপি ঘর থেকে তোমাকে উদ্ধার করবার জন্যে? তা হলে তো সবই ঠিক!’

কিন্তু বিনুর মুখ দেখে কিছু বুঝতে পারলুম না। একটু ইশারা পাবার আশায় আমি বিনুকে আবার জিজ্ঞাসা করলুম, ‘কি করে এমন হল বিনু!’ বিনু কোনো জবাব দিল না, শুধু আঙুল দিয়ে ভাঙা আলমারিটা দেখিয়ে দিলে।

আমি আলমারি খুলতেই একরাশ আরসোলা ফর্‌ফর্‌ করে ঘরময় ছড়িয়ে পড়ল। তারপর ডানা মেলে উড়ে অন্ধকার কোণের একটা গর্ত দিয়ে কোথায় চলে গেল—বোধ হয় মাটির তলা দিয়ে সেই চৌখুপির মধ্যে। আমি হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলুম।

বিনু বললে, ‘তাসগুলো কুড়ো!’

আমি তাসগুলো কুড়িয়ে, গুছিয়ে দেখি সবই আছে, কেবল একখানা নেই—সেই হরতনের গোলাম!

তবে?

এই তো ঠিক মিলছে! সেই হরতনের গোলাম—যাকে নিয়ে কাল রাত্রের ওই সমস্ত অদ্ভুত ঘটনার উৎপত্তি—সে নেই কেন। সে গেল কোথা?

সে কোথায় আছে, আমি জানি। সে আছে সেইখানে—সেই চারিদিক বন্ধ চৌখুপির মধ্যে, যেখানে সেই নয় বছরের সুন্দর ছেলেটি চিরদিন একা অন্ধকারে বসে আছে।

কালকের সব কাণ্ড বিনু নিশ্চয় ভুলে গেছে; সকালে ঘুম থেকে উঠে তার আর কিছুই মনে নেই। তার যে ঘুম! এমন তো আমারও এক-একদিন হয়। রাতের ঘটনা স্বপ্ন দেখার মত সকালে সব ভুলে যাই। কাল রাত্রে আমি যদি ঘুমিয়ে পড়তুম, তাহলে আমিও হয়তো সব ভুলে যেতুম; আজ সকালে উঠে অবাক হয়ে ভাবতুম—তাই তো, হরতনের গোলাম বেচারা গেল কোথায়?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *