1 of 2

হয়তো বা – বিমল কর

হয়তো বা – বিমল কর

আরও ফার্লংটাক এগিয়ে এসে গাড়িটা থামল। এতক্ষশ চাকা ঘষড়ে যাওয়ার বিশ্রী একটা শব্দ উঠছিল এবং এই ফাঁকা মাঠ, খালবিলে ছড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ছিল। গোটা কুড়ি ওয়াগনের শ’খানেক চাকায় ব্রেকগুলো পুরোপুরি কামড় দেয়নি, একটু একটু করে দাঁত বসাচ্ছিল। শেষ কামড়ের সঙ্গে সঙ্গে সব চুপ। একেবারে নিস্তব্ধ।

সন্তোষ বাইরে দাঁড়িয়েছিল। ব্রেকভ্যানের ফাঁকা বারান্দাটুকুর মধ্যে। এটা আপ ট্রেন। ডান দিকের সিঁড়ির কাছটায় গলা বুক বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা বোঝবার চেষ্টা করছিল সন্তোষ।

হল কি? লাইন ক্লিয়ার নেই, সিগন্যাল পায়নি? মাথার ওপর হাত তুলে যে হ্যাণ্ডেলটা ধরে সন্তোষ এতক্ষণ ঝুলছিল, এবার সেইটে আরও একটু শক্ত মুঠোয় ধরে আধখানা শরীরই গাড়ির বাইরে বের করে দিল।

না, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

চুলোয় যাক। গুডস্ ট্রেনের হালই এই। চলছে তো চলছে, দাঁড়াল তো দাঁড়াল—মাঠ-ঘাট ঠাই-বেঁঠাই বিচার নেই। লাইনে ফেলে রাখল তো রাখলই—সারা রাত জঙ্গলের মধ্যেই ফেলে রাখল।

একটু বিরক্ত হয়েছিল সন্তোষ। কিন্তু এখন যেন অযথা এই বিরক্তি উড়িয়ে দিতে, মনটা হালকা করতে ঠোঁটে একটা শিস তুলে বেশ টেনে টেনে বাজাল।

তারপর দেখতে লাগল। এই সন্ধেতেও চাঁদ উঠে গেছে আকাশে। শুক্লপক্ষের দ্বাদশী, ত্রয়োদশী হবে হয়তো। আকাশটা খুব পরিষ্কার, আলো পড়া কাচের মতন। চাঁদটা উঠেছে যেন মাঠ-ঘাট ঝলমলিয়ে। সামনে মাঠ, উঁচু-নিচু। টুকরো টুকরো ক্ষেত। জল জমা বিল। শালের ছোট ছোট ঝোপ। টেলিগ্রাফের পোস্ট, তার। এমনকি রেল লাইনের পাথরকুচি, ফিশ প্লেট, চকচকে লাইন পর্যন্ত স্পষ্ট দেখাচ্ছিল।

সন্তোষ মুগ্ধ হয়ে দেখছিল। আর ভাবছিল, কী অদ্ভুত জ্যোৎস্না, মার্ভেলাস। একটা ছুঁচ পড়লেও খুঁজে পাওয়া যায়।

ঠোঁটের শিসে এবার একটা গানের কলি বাজাতে লাগল সন্তোষ। মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে।

গুরু-গুরু শব্দটা দূর থেকে কানে আসছিল। ডাউন ট্রেন আসছে একটা। ও, এই জন্যেই লাইনে ঠেলে দিয়েছিল তার গাড়িটা। স্টেশনে লাইন পায়নি। কি ব্যাপার? ডাউন লাইনটায় আবার কোন গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে! লোকালটা নিশ্চয়। ওটাকে আটকে মেলটাকে পাস করিয়ে দিচ্ছে।

সন্তোষ মোটামুটি অনুমান করেছিল আগেই। এখন নিঃসন্দেহ হল, স্টেশনের কাছাকাছি কোন জায়গায় তার গাড়ি আটকে দিয়েছে। খুব সম্ভব ডিস্ট্যান্ট সিগন্যালের একটু আগেই। এ লাইনে গাড়ি নিয়ে তার যাতায়াত খুব অল্প। ভাল করে এখনও সব চিনতে পারেনি।

সার্চ লাইটের আলো পড়ল ছিটকে। পাশের লাইনে, আশেপাশে। শব্দটা খুব জোর। গলা বুকটা একটু ভেতর দিকে টেনে নিল সন্তোষ। আলোটা আরও ছড়িয়ে যেতে যেতে গোল হয়ে এসেছে। আহা, অমন চাঁদের আলোকে শুষে একেবারে শেষ করে দিল।

দেখতে দেখতে গাড়িটা এসে পড়ল। প্রচণ্ড এবং দ্রুত একটা যান্ত্রিক শব্দ। ফিশ প্লেটের জয়েন্টগুলো খটাখট নড়ছে আর কাঁপছে আর শব্দ তুলছে। মনে হচ্ছিল যেন একটা সাঙ্ঘাতিক ঝড় লাইন, বল্টু, পাথর, ফিশ প্লেট সব চিবিয়ে, উড়িয়ে চলে যাচ্ছে।

তুফান মেল। নিশ্চয় তুফান মেল। লেট করেছে। খুব লেট করেছে আজ। যতটা পারে মেকআপ করে নেবার চেষ্টা করছে। স্পীডের ধরাধরি আর মানছে না।

মাধুরীর কথাটা মনে পড়ল। আচমকা। একটু স্পীডের মাথায় ট্রেন চললেই মাধুরীর যেন কি হত! বড় ভয় পেয়ে যেত! মুখ ফ্যাকাশে করে, কিছু একটা আঁকড়ে বসে থাকত।

সার্চ লাইটের আলোটা চোখের সামনে থেকে যখন আলগোছে উঠে দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে আর ইঞ্জিনের কালো মুখটা চোখে পড়ছে সন্তোষের—ঠিক তখন—তখনই মনে হল—!

অল্পক্ষণ আর অন্য কিছু নেই। শুধু খটখট—খটাখট শব্দ, ভীষণ শব্দ—আর আলো অন্ধকার জানলা মুখ—পলকে সব যেন একাকার হয়ে কোথায় মিশে গেল!

ট্রেনটা চলে গেল। দূর থেকে দূরে—আরও দূরে। ঝকঝকে জ্যোৎস্নায় আবার সন্তোষের ব্রেকভ্যানের সামনের লাইন আর পাথরটুকরো—এদিক ওদিক ছড়িয়ে থাকল। ঝিঁঝিঁ ডাকতে লাগল আগের মতন, দু’চারটে জোনাকি উড়তে লাগল।

সন্তোষ কিন্তু তীক্ষ্ণ চোখে বুক ঝুকিয়ে ব্রেকভ্যানের সামনের লাইনটুকু দেখছিল।

হাসল সন্তোষ। শিস দিল। কী আশ্চর্য, মাঝে মাঝে মানুষের মনে এমন সব অদ্ভুত অদ্ভুত কথা আসে—যার কোন মানে হয় না। একেবারে মিনিংলেস।

মেল ট্রেনের ইঞ্জিনটা যখন একেবারে কাছে—হাওয়ার বেগে লাইন কাঁপিয়ে উড়ে যাচ্ছে, তখন সন্তোষের হঠাৎ ওরকম মনে হল কেন?

মনে হল, সন্তোষের পাশ থেকে কেউ যেন এগিয়ে গিয়ে ঝপ করে লাইনের ওপর লাফিয়ে পড়ল। কী আশ্চর্য অনুভূতি। সন্তোষের গালে একটা ঘোমটার ছোঁয়া লাগতে না লাগতেই সব শেষ। আর কিছু নেই।

অজান্তেই একবার গালে হাত বুলিয়েছিল সন্তোষ। কিছু না। কিন্তু ঘোমটার ছোঁয়া লাগল, এ কথাই বা কেন মনে হল?

মনে মনে সন্তোষ যদিও বুঝছিল, ব্যাপারটা অসম্ভব, তবু পলকের জন্যে তার চোখ স্থির, হৃদপিণ্ড স্তব্ধ এবং একটা চমকানোর ভাব হয়েছিল। ট্রেনটা চলে যেতে সামনের লাইনের দিকে যেন কেউ জোর করে চোখটা আটকে রেখেছিল অল্পক্ষণ।

কই, কিছুই তো নয়। ভুল, সব ভুল। চোখের ভুল।

গা ঝেড়ে, হাত দুটো মাথার ওপরকার হ্যাণ্ডেল থেকে তুলে নিয়ে ঘুরে দাঁড়াল সভোষ। ব্রেকভ্যানের দু’হাত বারান্দায় জুতোর গোড়ালি ঠুকে ঠুকে একটু পায়চারি করলে। মাথার ওপরকার সুন্দর চাঁদ দেখল এবং এক টুকরো তুলোট মেঘ।

সিগারেট ধরিয়ে সন্তোষ তার ঘরটার মধ্যে উঁকি দিল। পায়রাখুপরি ঘর। টিমটিম বাতি, লাল-নীল লণ্ঠন, কাচের বাক্স, খাতাপত্র।

খোলা জায়গায় আবার একটু পায়চারি করে, সিঁড়ির কাছটায় বসল সন্তোষ। লাইনের দিকে তাকাল। তারপর হঠাৎ গলা ছেড়ে একটা গমগম সুরের গান গাইতে লাগল।

মেলটা অনেকক্ষণ চলে গেছে—তবু তার গাড়িটাকে আটকে রেখেছে কেন? সন্তোষ চটছিল মনে মনে। অযথা ডিটেন করা এ-এস-এমদের একটা দস্তুর। হয়তো স্টেশনে গিয়ে দেখবে, এ-এস-এম নেই; বাড়িতে বউয়ের হাতে এককাপ চা আর পান খেতে গেছে। কিংবা শালার বেটা পার্শেল লগেজ থেকে কিছু সরিয়ে বাড়িতে রাখতে ছুটেছে।

লাইন স্টাফ হলেই এই হবে। এক নম্বরের ছ্যাঁচড়, বদমাস, চোর। হাতটান থাকবেই।

ঘড়িটা দেখল সন্তোষ। চাঁদের আলোয় কাঁটাগুলো বেশ স্পষ্টই দেখাচ্ছিল। আটটা পাঁচ।

পৌনে ন’টা বেজে গেল, তবুও সন্তোষের গাড়ি লাইন পেল না। বাস্তবিকই এবার চটেছে সন্তোষ। এর মানেটা কি! দেড়শ’ মাইলেরও ওপর তাকে রান করতে হবে, পঁচিশ মাইল আসতে না আসতেই এই কাণ্ড। পাকা দেড়টি ঘন্টা আটকে রাখল। ননসেন্স যত সব!

ভ্যানের মধ্যে থেকে লাল-নীল বাতিটা টেনে দিয়ে টপ করে লাফ দিয়ে মাটিতে নেমে পড়ল সন্তোষ। থাক দাঁড়িয়ে গাড়ি, কোম্পানির মাল, তোমার যা আমারও তাই। এই আমি চললুম। স্ট্রেট স্টেশনে যাব। ব্যাপারটা কি!

হাতের বাতিটা পথ দেখে যাবার জন্যে নয়। যা আলো চাঁদের, তাতে পথ দেখার জন্যে এই লাল লণ্ঠন নেবার দরকার করে না। এটা শুধু গার্ড সাহেবের অস্তিত্ব। অথাৎ ড্রাইভার তুমি রুখে থাক, আমা বিহনে যেতে পারবে না। বলা তো যায় না, যদি এর মধ্যে সিগন্যাল পেয়ে যায় ড্রাইভার।

পাশের লাইনের স্লিপারের ওপর দিয়ে টপকে টপকে সন্তোষ ইঞ্জিনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। বাঁ হাতে বাতিটা ঝুলছে; হাঁটার তালে তালে দুলছে। নিজের ছায়াটা দেখতে পেল সন্তোষ। লাইনের ওপর এবং পাশ দিয়ে মাটি, কাঁকর, ঘাস গড়িয়ে দিব্যি চলেছে।

ইঞ্জিনের কাছাকাছি আসতে স্টিমের শব্দটা শোনা গেল। যেন ব্রয়লারে আগুন ঠেলে ঠেলে কোনরকমে স্টিমটা বাঁচিয়ে রেখেছে ওরা। ড্রাইভারদের দেখতে পেল সন্তোষ। আলোর মধ্যে দাড়িবালা ইব্রাহিমের প্রায় গোটা চেহারাটাই চোখে পড়ল। ফায়ারম্যান বয়লারের ঢাকনাটা খুলে কয়লা ছুঁড়ছে ভেতরে। গনগনে আগুনের আভায় ইব্রাহিম, ফায়ারম্যান—দুজনেই খুব স্পষ্ট।

সন্তোষ হাঁক দিল।

ইব্রাহিম পাদানির কাছে এসে দাঁড়াল। বললে, স্টেশন এখান থেকে অনেকটা দূর বাবু। যাবেন না। বেকার গিয়ে কি লাভ। আমার মালুম, আপ লাইনটা মেরামতি হচ্ছে। ডাইন লাইন দিয়ে গাড়ি পাশ করাবে। লোকালটা আগাড়ি খুলে দিয়ে বাদ আমাদের লাইন দেবে।

অনুমানটা ঠিকই করেছিল ইব্রাহিম। দূরে সিগন্যালের দিকে তাকিয়ে সেটা বোঝা গেল। একটা ডাউন গাড়ি আসার সিগন্যাল পড়েছে।

ইব্রাহিমের সঙ্গে কথা বলে সন্তোষ ফিরব-ফিরব করছে—ডাউন গাড়ির শব্দ পাওয়া গেল দূরে। লোকাল প্যাসেঞ্জারটা আসছে। এটাও আজ লেট।

ফিরতে গিয়েও ফিরল না সন্তোষ। ইঞ্জিনের পাদানি বেয়ে উঠে ইব্রাহিমের পাশে দাঁড়িয়ে থাকল। ট্রেনটা চলে যাক আগে।

ডাউন ট্রেন চলে গেলে সন্তোষ তার ব্রেকভ্যানে ফিরে এল। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে।

এতক্ষণ পরে সিগন্যাল পেয়ে তার গাড়ির ইঞ্জিনটা হুইসল্‌ দিল। স্টিমের ভস্ ভস্ শব্দ ছাড়ল। ব্রেক ছাড়ানো চাকা একবার ঝাঁকুনি দিয়ে সামনে এগোল, আবার পেছনে। সবুজ আলো নেড়েই যাচ্ছিল সন্তোষ গা ঝুঁকিয়ে।

শেষ পর্যন্ত ছাড়ল, মালগাড়িটা ছাড়ল।

বারান্দায় একটু দাঁড়িয়ে থেকে আলোটা রাখতে কেবিনে ঢুকল সন্তোষ। আলোটা রাখতে যাচ্ছে—হঠাৎ চোখে পড়ল। আর চোখে পড়তেই প্রথমটা থমকে গেল। ঘরের মিটমিটে আলোয় জিনিসটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। অথচ সন্তোষ যে ডান হাতে তার গার্ডের বাতিটা ধরে আছে, এ সম্পর্কেও সে নিঃসন্দেহ। কাজেই এটা ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন নয়—অন্যমনস্ক হয়ে হঠাৎ দৃষ্টিভ্রম ঘটেছে, তাও নয়। তবু হাতের বাতির আলোটা ফেলল সন্তোষ।

ভীষণ ভাবে চমকে গেল এবার। চোখের পাতা পড়ল না আর। বিস্ময়টা যেন ক, চোখ, নিশ্বাস-প্রশ্বাস—সমস্ত কিছুকে অদ্ভুত এক মুঠোর মধ্যে চেপে ধরল। সন্তোষ বিমূঢ় এবং বিস্ময়বিহুল হয়ে দেখছিল জিনিসটা।

একজোড়া চটি। লেডিজ স্যাণ্ডেল। সন্তোষের বসবার জায়গাটায় রাখা রয়েছে।

কার স্যাণ্ডেল? কোথা থেকে এল? কেমন করে? সন্তোষ কিছুই বুঝতে পারছিল না।

তার পায়রা-খুপরি কেবিনটা তবু ভাল করে দেখল সন্তোষ। বাইরে বেরিয়ে বারান্দাটুকুও নজর করল। কেউ নেই। কী আশ্চর্য, হ্যাণ্ডেল ধরে পিছনে তাকাল। চাঁদের আলোয় অনেকটাই দেখা যায়। ব্রেকভ্যানটা যেখানে দাঁড়িয়েছিল, সেখান থেকে অন্তত পঞ্চাশ গজ এগিয়ে এসেছে গাড়ি কিছু আর বোঝা যাচ্ছে না।

অদ্ভুত ব্যাপার তো! চটি জোড়া এল কি করে? কে রেখে দিয়ে গেল?

সন্তোষ যখন ব্রেক ছেড়ে চলে গিয়েছিল, নিশ্চয় তখন কেউ রেখে দিয়ে গেছে। কিন্তু এমন জন-মানুষহীন জায়গায় কে আসবে আসতে পারে? বিশেষ করে মেয়েছেলে?

সন্তোষ মনে করে দেখল তার ব্রেক যেখানে দাঁড়িয়েছিল, তার আশেপাশে কোন ঘর-বাড়ি ছিল বলে তার মনে হচ্ছে না। এমনও নয় যে, কোন ছেলেমেয়ের দল বেড়াতে বেড়াতে ওখানে গিয়েছিল। সেরকম কাউকে সন্তোষ দেখেনি, কারও সাড়া পায়নি।

তবে?

তবে কি কেউ আশেপাশে লুকিয়েছিল? কেনই তা থাকবে? থাকলেও চুপিসাড়ে এসে সন্তোষের কেবিনে যাতে চোখে পড়ে, এমন ভাবে পায়ের চটি জোড়া রেখে যাবে কেন? কি উদ্দেশ্যে? কোথায় বা লুকোবে সে?

হঠাৎ মনে হল, এমন নয় তো যে—কোন মেয়ে আত্মহত্যা করতে এসেছিল গাড়ির চাকার তলায়? এই জুতো জোড়া শুধু তার উপস্থিতির প্রমাণ।

সন্তোষের কপালে, গালে, গলায় দরদর করে ঘাম জমতে লাগল। যদি তাই হয়—তবে—তবে?

ভাবতে পারছিল না সন্তোষ। মেল ট্রেনটা যাবার সময় তার মনে হয়েছিল, কে যেন ওর পাশ থেকে লাফিয়ে পড়ল লাইনের ওপর। অবশ্য সত্যিই কেউ আর লাফিয়ে পড়েনি। প্যাসেঞ্জার ট্রেনটা যাবার সময় ব্রেকে ছিল না সন্তোষ—তখন যদি কেউ গলা বাড়িয়ে দিয়ে থাকে—! দিতে পারে, দিলে জানবার উপায় নেই। কিংবা, বলা যায় না, হয়তো—সন্তোষেরই ব্রেকভ্যানের চাকার তলায় গলা বাড়িয়ে দিয়েছে।

সন্তোষের শরীরটা ভীষণভাবে ঘামছিল। সর্বাঙ্গ ঠাণ্ডা, অসাড়। বুকের মধ্যে কেউ যেন পাগল হাতে হাতুড়ি পিটছিল।

এই ভয় পাওয়া, মুষড়ে পড়া ভাবটা কিন্তু আস্তে আস্তে এক সময় অনেকটা কেটে গেল। অত বাড়াবাড়ি রকমের কল্পনা করে লাভ কি? আত্মহত্যা করতেই কেউ এসেছিল, এর কি মানে আছে! হতে পারে, কোন দুজন বেড়াতে এসেছিল। একটি পুরুষ, একটি মেয়ে। মেয়েটির পায়ে হয়তো লাগছিল, ফোস্কা পড়েছিল—চটিটা নতুন, সদ্য নতুন, হয়তো সে আর হাঁটতে পারছিল না—তাই ফেলে দিয়ে গেছে। আর এমনি ফেলে দিয়ে যাওয়ার চেয়ে হয়তো সেই রসিক পুরুষ আর মেয়েটি সন্তোষকে খানিকটা বিহ্বল করার জন্যই এই রসিকতাটুকু করেছে।

সন্তোষ চটি জোড়া ভাল করে দেখতে লাগল। দামী চটি। মোরগের ঝুঁটির মতন লাল ভেলভেটের ফুলও আছে একটা করে।

মাধুরীকে আচমকা আবার মনে পড়ল। লাল জিনিসটা সে একদম পছন্দ করতে পারত না। এমনি একজোড়া চটি ছিল তারও। পরত না, পরতে চাইত না। সন্তোষ বলত, নষ্ট করে লাভ কি, পরে ফেল। দিনে পরতে লজ্জা হয়, রাতে পায়ে দিও। আমার তো ভালই লাগে দেখতে।

‘আহা!’ মাধুরী মুখ ভেংচিয়ে হাসত।

‘ঠাট্টা করছি না। সত্যি বলছি। যা ধবধবে সুন্দর পা তোমার। খুব মানায়।’ সন্তোষ জবাব দিত।

ইঞ্জিনটা বারবার সিটি দিচ্ছিল। সন্তোষের তস্ময়তা এবং ঘোর ভাঙল। একটা বড় স্টেশনের ইয়ার্ডের মধ্যে তার গুডস্ ট্রেনটা ঢুকে পড়েছে। লাইন থেকে আর এক লাইনে সরে যাওয়ার ঘটঘটানি, শান্টিংয়ের ফোঁস ফোঁস, একটা গাড়ি পাশ কাটিয়ে চলে গেল, আলোয় আলোয় একাকার ইয়ার্ড।

সন্তোষ কেবিন ছেড়ে বাইরে এসে দাঁড়াল।

তার গুডস্ ট্রেনটাকে এখানে আটকে থাকতে হবে কিছুক্ষণ। ঘন্টাখানেক কম করেও।

গাড়ি থামলে, খাতাপত্র উঠিয়ে ব্রেক ছেড়ে নেমে আসতে গিয়ে কি যেন ভাবল সন্তোষ। আবার উঠে কেবিনের ভেতর গেল। লেডিজ স্যান্ডেল জোড়া খবরের কাগজটায় মুড়ে নিল। তারপর আস্তে আস্তে নেমে ইয়ার্ড ধরে হনহন করে স্টেশনের দিকে এগিয়ে গেল।

মাসখানেক পরে আবার। তেমনি ফুটফুটে চাঁদের আলো। মালগাড়ি নিয়ে সন্তোষ যাচ্ছে। লাইন ক্লিয়ার না পেয়ে আটকে গেল রাস্তাতেই। তবে রক্ষে এই যে, এবার আর অতটা মাঠজঙ্গলে পড়ে থাকল না। একটা মাঝারি স্টেশনের ওয়াটার রিজার্ভারের কাছেই থেমে গেল।

খানিকটা অপেক্ষা করে সন্তোষ হাঁটতে হাঁটতে স্টেশনের দিকে এগিয়ে গেল। কাছেই ক’টা রেল কোয়ার্টার। সামনে একটা বাঁধানো কিনারা উঁচু কুয়ো। কুয়ো থেকে মাঝে মাঝে জল তোলার শব্দ আসছিল—হুইলের শব্দ। পোর্টারদের কোয়ার্টারের বাইরে লোহার উনুনে আগুন জ্বলছিল। আর রেল কোয়াটারের জানলায় লণ্ঠন।

ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় বেড়াতে বেড়াতে প্ল্যাটফর্ম পর্যন্ত চলে এল সন্তোষ। হুইসলের শব্দটা এবার কানে এল। চোখে পড়ল সামনের সিগন্যালটা। সবুজ হয়ে রয়েছে। একটা গাড়ি আসছে। থামবে না, বরাবর বেরিয়ে যাবে। লাইনে শব্দটা উঠছিল। ছেলেবেলায় এই ভাবে কান পেতে কত শব্দ শুনেছে ওরা। এখন আর কান পেতে শব্দ শুনতে হয় না, এমনিতেই বুঝতে পারে—গাড়িটা আর কতদূর।

সন্তোষ হেঁটে এগিয়ে যাচ্ছিল, থমকে দাঁড়াল। দক্ষিণের রাস্তা দিয়ে একটি মেয়ে খুব স্বচ্ছন্দ গতিতে হেঁটে আসছে। চাঁদের আলোয় তার শরীরটা দেখা যাচ্ছিল, কিন্তু মুখটা অস্পষ্ট, একেবারেই অস্পষ্ট। মাথায় আধখানা ঘোমটা, শাড়ির রংটা চেনা যাচ্ছিল না।

একটা করবী ঝোপের পাশ দিয়ে আসতে আসতে মেয়েটি দাঁড়িয়ে পড়ল। সন্তোষও প্ল্যাটফর্মের শুরুর ঢালুটায় এসে পৌঁছেছে। সামনে থেকে সার্চ লাইটের আলোয় লাইন ভিজিয়ে ট্রেনখানা ছুটে আসছে। তার দুরন্ত শব্দ আর থেমে থেমে হুইস্‌ল্‌।

সন্তোষের পক্ষে এখন আর মেয়েটিকে দেখার উপায় নেই। ও একটু এগিয়ে রয়েছে। পিছু ফিরে চাইলে অবশ্য দেখা যায়।

সন্তোষের ইচ্ছে হচ্ছিল, এখন একবার ফিরে তাকিয়ে দেখে। কিন্তু বাধছিল। সার্চ লাইটের আলোটা ক্রমশই তার আশপাশের জায়গাগুলোকে এত বেশি ঝকঝকে করে তুলছিল—যাতে মনে হল, ফিরে তাকাতে গেলেই মহিলাটি দেখতে পাবে। দেখতে পাবে, সন্তোষ কি ভাবে পিছু ফিরে একটি মহিলাকে দেখছে।

তবু শেষ পর্যন্ত একবার না চেয়ে পারল না সন্তোষ। আলোটা যখন সরে গেছে তার সামনে থেকে—ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল সন্তোষ। মহিলা সেখানেই দাঁড়িয়ে। মাটির দিকে অনেকটা নুয়ে পড়ে কি যেন খুঁজছে। কিছু বোধ হয় পড়ে গেছে রাস্তায়। হয়তো গলার হারটা, কিংবা কানের দুল—অন্য কিছুও হতে পারে।

থরথর করে কাঁপছিল লাইন। ঠকঠক খটখট—দ্রুত দুরন্ত একটা শব্দ জলদ সুরে বেজে যাচ্ছিল। ইঞ্জিনটা কয়েক হাতের মধ্যে এসে পড়েছে। সন্তোষের চারপাশে একটা গরম বাতাস ঢেউয়ের মত ভেঙে পড়ল। ক’টা আগুনের ফুলকি ইঞ্জিনের মুখ থেকে উঠে আকাশে ছিটকে পড়ল।

সন্তোষ লাইনের দিকে তাকাল। ঝড়ের বেগে ইঞ্জিনটা পেরিয়ে যাচ্ছে। হ্যাঁ—যাচ্ছে। কিন্তু হঠাৎ সন্তোষ যেন হাত বাড়িয়ে কিছু ধরতে গেল।

চোখের পলকে আলো অন্ধকার, গরম বাতাস, কয়েকটা মুখ—চোখে ধরল কি ধরল না। উধাও হয়ে গেল।

ট্রেনটা চলে গেল। শব্দটা তখনও বাতাসে থেকে গেল। তারপর আস্তে আস্তে মিলিয়ে আসতে লাগল।

লাইনের দিকে কেমন একটা ভীত, বিহ্বল চোখে তাকিয়ে ছিল সন্তোষ। না, কিছু নেই। ঝকঝকে পরিষ্কার লাইন। পাথরগুলো পর্যন্ত স্পষ্ট। অথচ—!

সন্তোষ পিছু ফিরে তাকাল। আশেপাশে কেউ নেই। সেই মহিলা? না, মহিলাটিকেও আর দেখা যাচ্ছে না। অনেকটা দূরে ঝাঁকড়া মাথা এক গাছের তলা দিয়ে যেন চলে যাচ্ছে মহিলা।

কিন্তু আবার! আবার এমন হল কেন? ট্রেনের ইঞ্জিনটা যখন একেবারে সামনে এসে পড়েছে—সন্তোষের মনে হল, তার পাশ থেকে কেউ যেন লাফিয়ে পড়ল লাইনের ওপর। সন্তোষ তার গায়ের ছোঁয়া—না গায়ের ছোঁয়া ঠিক নয়—কিন্তু শাড়ির ছোঁয়া পেয়েছে। অত আলুথালু ছোঁয়া আর কিসেরই বা হতে পারে।

বুকের মধ্যে অদ্ভুত একটা কাঁপুনি আসছিল আর যাচ্ছিল। সন্তোষ বুঝতে পারছিল না, কেন—কেন এমন হল! একবার নয়—এই নিয়ে দু—দুবার। সবই সেই আগের মতন। অবিকল এক।

কি খেয়াল হল সন্তোষের—হঠাৎ পা চালিয়ে ও এগিয়ে যেতে লাগল করবী ঝোপটার দিকে—মহিলাটি খানিক আগে যেখানে দাঁড়িয়েছিল। যেন সন্তোষ বোঝবার চেষ্টা করছিল, সেটাও চোখের ভুল কি না।

করবী ঝোপের পাশে এসে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাল সন্তোষ। কেউ যে এসেছিল, দাঁড়িয়েছিল বোঝবার কোন উপায় নেই। সেটাই স্বাভাবিক।

কি খুঁজছিল মহিলাটি এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে? লাল মোরপের রাস্তা লাল দোপাটি ফুলের মত পরিচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে। সন্তোষ ভাল করে নজর করে দেখল। কোথাও কিছু পড়ে নেই। একটা সেপটিপিন কিংবা মাথার কাঁটাও নয়।

সন্তোষের গুডস্ ট্রেন সিগন্যাল পেয়ে সিটি দিচ্ছিল। চমকে উঠে সন্তোষ ছুটতে ছুটতে তার ব্রেকের দিকে এগিয়ে চলল।

গাড়িটা ছেড়ে দিয়ে ব্রেকের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকল অনেকক্ষণ সন্তোষ। ভীষণ ক্লান্ত লাগছিল নিজেকে। মনটাও বড় দমে গেছে। তার কি কোন অসুখ-বিসুখ করল নাকি? একটা বিশ্রী, ভীষণ অস্বস্তিকর অনুভূতি বারবার হচ্ছে কেন? কেন এরকম মনে হচ্ছে যে, তার গায়ের পাশ থেকে কেউ লাইনে চলতি গাড়ির সামনে লাফিয়ে পড়ল। কেন?

তেষ্টা পাচ্ছিল সন্তোষের, হাত-পাগুলোও অবশ লাগছিল। বসবার জন্য ল্যাম্পটা উঠিয়ে নিয়ে কেবিনের মধ্যে চলে এল।

বাতিটা রাখতে গিয়ে আবার নিস্পন্দ নিথর হয়ে গেল। ঠিক ওর বদ্বার জায়গাটিতে একটা রুমাল পড়ে আছে।

বেহুঁশের মতন অনেকক্ষণ সেই রুমাল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল সন্তোষ। তারপর যেন ভীষণ একটা জেদ এবং যা হচ্ছে হয়ে যাক, এমন একটা নিস্পৃহ ভঙ্গিতে মালটা তুলে নিল সন্তোষ।

ছোট্ট রুমাল। কিনারাগুলো সবুজ সুতো দিয়ে মোড়া। এক কোণে ইংরিজি বাঁকা অক্ষরে লেখা ‘এল’। গোলাপি লাল সুতোয় অক্ষরটা তুলেছে কেউ।

কি আশ্চর্য, এই রুমাল কোথা থেকে এল? কে ফেলে গেল? কেমন করে এখানে সে এল? কেনই বা এসেছিল?

সন্তোষের মাথা চোখ ভার হয়ে এল। কিন্তু আর সে বুঝতে পারছিল না, ভাবতে পারছিল না। শুধু অক্ষরটা চোখের সামনে একটা মরা প্রজাপতির মতন নিশ্চল হয়ে থাকল।

মাধুরীকে মনে পড়ছিল। মাধুরীর খুব রুমালের শখ ছিল। বড় ভাল ছুঁচের কাজ করত। পাড়াময় লোকের রুমালে নক্সা তুলে বলতো, এত কষ্ট করে সুতোব কাজ করে দিই, কিন্তু এই রুমাল কি কারুর পকেটে থাকে নাকি ভাবো! হরদম হারায়। আমার তো বাপু হাতে রুমাল থাকলেই জানি সেটা যেখানে বসব ফেলে আসব। ঠিক ফেলে আসব।

পা থেকে একটা ঠাণ্ডা বরফের স্রোত যেন সাপের মতন কিলবিল করে গা-মাথা বেড় দিয়ে চলে গেল। সন্তোষ অস্ফুট একটা শব্দ করে সামনের কাঠটা ধরে ফেলল।

করবী গাছের ঝোপের পাশে লাল মোরপের রাস্তা আর সেই মহিলা, ট্রেন, ইঞ্জিনের মুখ থেকে হাওয়ায় উড়ে যাওয়া স্ফুলিঙ্গগুলো সব একাকার হয়ে চোখের সামনে দোল খাচ্ছিল।

কতক্ষণ কে জানে—জংশন স্টেশনে গাড়ি থামতে হুঁশ হল সন্তোষের। আলো, কলরব, মানুষজন দেখে যেন সম্বিৎ ফিরে পেল।

তারপর এক সময় ঘোরটা কাটল। রুমালটা পকেটে পুরে ব্রেক থেকে নেমে গেল তাড়াতাড়ি।

যে ঘটনা দু’বার ঘটে গেছে—তৃতীয়বারও যে সেটা ঘটবে, সন্তোষ যেন সেটা জানত।

জানত বলেই তৃতীয় বারে আর সে অতটা বিস্মিত হল না, বিহ্বল হল না, ভয় পেল না।

সেদিন পূর্ণিমার চাঁদ আকাশে। শালবনের মাথার ওপরে নরম একটি মেঘ ঘুমিয়ে পড়েছিল। বুনো একটা পাখি উড়ে যাচ্ছিল পথ ভুল করে। ডাকছিল ঘুরে ঘুরে। টেলিগ্রাফের পোস্টগুলো নিঃসঙ্গ মাঠে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই ডাক শুনছিল।

সন্তোষের গুডস্ ট্রেন চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল এই মাঠ আর শালবনের পাশে।

থাক দাঁড়িয়ে—সন্তোষের আর যেন ভাবনা নেই। কেবিনের মধ্যে চুপ করে বসে ও অপেক্ষা করছিল। অপেক্ষা করছিল একজনের। হ্যাঁ, সে আসবে। যে এসেছে আগে। এসেছে আর তার লাল ভেলভেটের ফুল বসানো স্যাণ্ডেল ফেলে গেছে—আবার এসেছে আর তার সুন্দর ছোট্ট রুমাল ফেলে গেছে। আবার সে আসবে।

এমন দিনেই সে আসে—আকাশ যখন চাঁদের আলোয় খইয়ের মতন সাদা, হু-হু বাতাস বয়ে যায় মাঠ থেকে মাঠে—নির্জন নিরিবিলি জায়গায় গাড়িটা দাঁড়িয়ে পড়ে।

সন্তোষের আজ আর কোন ভয় নেই, উদ্বেগ নেই, বুক ধুক-ধুক নেই। সে বসেই আছে। আসুক ও। অপেক্ষায় আছে সন্তোষ।

শব্দ হল কি? না, শব্দ নয়—নিজেরই দীর্ঘশ্বাস।

ঘড়িটা দেখল সন্তোষ। আটটা বাজে। কান পেতে থাকল। রেল লাইনের স্লিপার আর পাথরে একটা অস্পষ্ট শব্দ উঠল না!…না।

একটা সিগারেট ধরালো সন্তোষ। গন্ধটা নাকে বেশ লাগছে। বুক ভরে ধোঁয়া টানল ও। ভালই লাগছে।

সিগারেট শেষ। আরো কাটল খানিক সময়। অধীর হয়ে উঠছিল একটু একটু করে সন্তোষ। কেন আসছে না এখনো? সময় কি হয়নি!

ট্রেনের বারান্দা থেকে একটা ছায়া যেন কেবিনের দোরগোড়ায় এসে পড়ল। লাফিয়ে উঠল সন্তোষ। এসেছে—এসে গেছে!

ব্লেকের বারান্দায় বেরিয়ে এল। হ্যাঁ, যা ভেবেছিল সে। এসেছে। শাড়ির রেখায় সুন্দর এক মগ্নতা মেখে। ব্রেকের কিনারা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে চাঁদের আলোয় স্নান-সেরে-ওঠা মাঠ দেখছে।

সন্তোষ প্রথমেই কাছাকাছি গেল না। একটু তফাতেই দাঁড়িয়ে থাকল।

‘এবার কি এনেছ?’ সন্তোষ আচমকা প্রশ্ন করলে।

জবাব নেই। যাকে প্রশ্ন তার গা একটুও নড়ল না। ঘাড় বাঁকাল না সামান্য। যেন এ-প্রশ্ন তাকে নয়।

একটু অপেক্ষা করে আবার শুধোল সন্তোষ, ‘কি এমনই এবার ফেলে যেতে?’

ও-পক্ষ থেকে কোন সাড়াশব্দ নেই। যেন মানুষ নয়, একটা মোমের পুতুল দাঁড়িয়ে আছে।

সন্তোষ একটু হাসল। বলল, ‘আমি জানি, স্যাণ্ডেল আর মালের পর তুমি আর কি ফেলে যেতে পারো—’

একটু বোধ হয় নড়ল সেই আশ্চর্য শাস্ত মূর্তি। ঘাড় বাঁকাল সামান্য। মাথার আলগা ঘোমটাটা খসে গেল। কালো চুলের ছন্দটি চোখে পড়ল। মুখের বাঁকা রেখাটুকু।

সন্তোষ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল। বলল, ‘আমি জানতাম তুমি আসবে। আমি তৈরি ছিলাম। অপেক্ষা করছিলাম।’ একটু থামল, সামান্য এগিয়ে এল: ‘কিন্তু এবারই শেষ। আর তুমি আসবে না। আসতে পারবে না। আমার কাছে তোমার আর কিছু নেই। যেটা শেষ ছিল—গলার সরু হারটা—আমি এনেছি।’ সন্তোষ পকেটের মধ্যে থেকে সরু চিকচিকে হারটা বের করল, হাতের তালুতে রাখল, দেখল ক’পলক, তারপর হঠাৎ চেঁচিয়ে বলল, ‘তোমার গলা টিপে আমি ধরতে যাইনি যে এই হারটা আমার হাতে ছিঁড়ে চলে আসবে। কি করে এসেছিল আমি জানি না।’

পুতুলের মুখ আস্তে আস্তে ঘুরে গেল। ভীত, বিস্ময়-স্তব্ধ, শীর্ণ একটি মুখ। চাঁদের আলোয় তার চোখ, নাক, মুখ, ঠোঁট স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। গলাটা নগ্ন। সোনার একটি বিন্দুও সেখানে চিকচিক করছিল না।

সন্তোষ চমকে উঠল না। যেন নাটকের এই দৃশ্যটা তার পুরো জানা, দেখা।

আরো একটু কাছে এগিয়ে গেল সন্তোষ। খানিকক্ষণ তাকিয়ে তাকিয়ে সেই সাদা নরম ভীত উদ্‌ভ্রান্ত মুখটি দেখলে, সেই মুখের টানা টানা চোখের কোল বেয়ে গড়ানো জল।

খুব আস্তে আস্তে স্পষ্ট করে বলল সন্তোষ, ‘আমি তোমাকে সত্যিই ঠেলে ফেলে দিইনি, মাধুরী। আমি ভাবতেই পারিনি, অমন করে তুমি লাইনের ওপর লাফিয়ে পড়বে। বিশ্বাস করো, আমি হাত দিয়ে তোমায় ধরতে গিয়েছিলাম। তোমার গলার হারটা আমার আঙুলে জড়িয়ে গেল, তুমি লাফিয়ে পড়লে।’

মাধুরী একটু যেন সরে গেল।

সন্তোষকে কথায় পেয়েছে। সে থামবে না। বলল, ‘আমি তোমাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে নতুনদি’র কাছে নিয়ে যাব বলে এই ব্রেকে এনে তুলিনি। এমন বে-আইনী কাজ, সবাইয়ের চোখ বাঁচিয়ে করা যে কী কঠিন। তবু তোমায় আমি এনেছিলাম ব্রেকে। কেউ দেখেনি, জানতে পারেনি। এটা আমার ভাগ্য।’

সন্তোষ থামল। জ্যোৎস্না-আকাশের এক প্রান্ত থেকে একটা অস্পষ্ট হুইস্‌লের শব্দ ভেসে এল। কান পেতে শুনল সন্তোষ।

মাধুরী আরো এক-পা সরে গেছে।

সন্তোষ বলল, ‘তোমার ভয় বাতিকই সমস্ত নষ্টের গোড়া। গার্ডের বউ, স্বামী লাইনে গেলে একা কোয়ার্টারে থাকতে পারবে না। সারারাত ভয়ে মরবে। কেন? কেউ তো অমন করে না। তুমি করতে। অমরকে তুমি ডেকে এনে রাত্রে শুইয়ে রাখতে কোয়ার্টারে। হোক না অমর ভাল ছেলে, কিন্তু সে সুন্দর। সে তোমায় খুব ভালবাসত। তার মুখের বৌদি আর মনের বৌদি যে এক-এ আমি বিশ্বাস করিনি। আমি তোমাদের একসঙ্গে বসে গল্প করতে, চা খেতে, তাস-লুডো খেলতে দেখেছি। আর সেদিন স্টেশন পর্যন্ত এসে ফিরে গিয়ে দেখেছি—তোমরা কি করো। কি করছিলে তোমরা দুজনে অন্ধকারে? তুমি জাপ্টে ছিলে অমরকে। আর অমর বলছিল, ভয় কি, আমি আছি। দাঁড়াও, বাতিটা জ্বালি! তোমার ঘর অন্ধকার হয়েছিল কেন? কেন লন্ঠন নিভে গিয়েছিল?’

দূরাগত হুইস্‌লের শব্দটা ঘনঘন বাজছিল। স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছিল।

মাধুরী ব্রেকের কিনারা ঘেঁষে আরো খানিকটা সরে গিয়েছিল।

‘লজ্জা কি, ভয়ই বা কিসের—আমার লজ্জা নেই, ভয়ও নেই। আমি বলছি আমি তোমায় সন্দেহ করতে শুরু করেছিলাম অনেক আগে থেকেই। সে-সন্দেহ আমার দৃঢ় হল তোমাদের ওভাবে দেখে। …হ্যাঁ, আমি বলছি, তোমাকে আমি নতুনদি’র বাড়ি নিয়ে যাব বলে ব্রেকে এনে তুলেছিলাম। আর খুব লুকিয়ে-চুরিয়ে, সাবধানে। গাড়ি ছেড়ে দেবার পর আমি তোমায় কেবিনের মধ্যে ডেকে নিয়ে গিয়ে বসেছিলাম।

সন্তোষকে থামতে হল। ট্রেনটা কাছে এসে পড়েছে। নিশ্চয় তুফান মেল। আকাশ-বাতাস ফুঁড়ে সিটি দিতে দিতে ঝড়ের বেগে উড়ে যাচ্ছে। লাইন কাঁপছে। পাথরের টুকরোগুলোতে পর্যন্ত শব্দ উঠছে। সার্চ লাইটের আলোটা এইবার এখানে এসে পড়েছে।

সন্তোষ মাধুরীর দিকে চেয়ে এবার গলার পর্দা তুলে বলল, ‘তুমি বসেছিলে। আমি আস্তে আস্তে আসল কথায় এলুম। আমার মনে লুকোচুরি ছিল না। যা আমার মনে হয়েছে—আমি যে তোমায় সন্দেহ করি—আমি স্পষ্টই তা বলেছিলুম। তুমি শুনে চমকে উঠেছিলে, মুখটা সাদা হয়ে গিয়েছিল, ভয় পেয়েছিলে তুমি। তখন একটা গাড়ি আসছিল। আজকেরই মতন। ওই তুফান মেল।’

সন্তোষ একটু থেমে লাইনের দিকে তাকাল। সার্চ লাইটের আলোয় সমস্ত জায়গাটা সাদা হয়ে গেছে। থরথর করে ইস্পাতের পাত দুটো কাঁপছে। ফিশ প্লেট, নাট, পাথরের এক বিচিত্র ঝঙ্কার উঠেছে। যেমন দ্রুত, তেমনি সরব।

লাইনের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে সন্তোষ সেই বিহ্বলবাক মূর্তির দিকে চাইল। বলল, ‘আমি তোমায় কেবিনের বাইরে টেনে আনিনি। তুমি নিজেই এসেছিলে। আর ঈশ্বর জানেন, মেলের ইঞ্জিনটা যখন দৈত্যের মতন আমার ব্রেকের ঠিক সামনে—একেবারে সামনে এসে পড়েছে, তখন তুমি লাইনের ওপর লাফিয়ে পড়লে। আমি ঠেলে দিইনি। বরং তোমায় ধরে ফেলবার চেষ্টাই আমি করেছিলুম। পারিনি। তোমার গলার হারটা শুধু আমার আঙুলে জড়িয়ে গিয়েছিল।

সন্তোষ চুপ করল। তাকাল লাইনের দিকে। একটা পৈশাচিক কালো মূর্তির মতন মেলের ইঞ্জিনটা সামনে এসে গেছে। ভীষণ শব্দ, যেন নরক থেকে একটা ঝড়ের দমকা ছিটকে এসে পড়েছে এখানে।

আচমকা কি যেন দেখে সন্তোষ চিৎকার করে উঠল, ‘তোমায় আমি সন্দেহ করেছিলাম। বুঝলে মাধুরী। সে-সন্দেহ আজও আমার ঘোচেনি। তা বলে তোমায় আমি মারতে চাইনি। চেয়েছিলাম তুমি—তুমি—’

সন্তোষের গলা আর শুনতে পাওয়া যাচ্ছিল না। বিকট শব্দে সব ডুবে যাচ্ছিল। মাধুরী লাফিয়ে পড়ার জন্যে পা-দানির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।

সন্তোষ তার আঁচল ধরতে গেল।

গলায় যতটা জোর আছে, সমস্তটা নিঃশেষ করে সন্তোষ চিৎকার করে বলল, ‘তোমার ফেলে যাওয়া স্যাণ্ডেল, রুমাল—সবই আমি রেল পুলিশের জিম্মায় দিয়েছি। এই হার—তাও ওরা পাবে। আর আমার চিঠিও।’

মাধুরী লাফিয়ে পড়েছিল। সন্তোষ মাধুরীকে দেখতে পাচ্ছিল না। শুধু একটা উত্তপ্ত নিষ্ঠুর কালো কঠিন ছায়া তাকে হাওয়ার বেগে টানছিল।

গাড়ি চলে গেছে। আবার সব নিস্তব্ধ। পূর্ণিমার আলোয় লাইন, মাঠ, পলাশ বন ভিজে ভিজে গলে যাচ্ছে। ক’টা জোনাকি উড়ছে কোথায়, ঝিঁঝিঁ ডাকছে—রাতপাখিটা মাথার ওপর ঘুরে ঘুরে উড়ছে।

সন্তোষের মালগাড়ি লাইন পেয়েছে। ইঞ্জিন থেকে হুইস্‌ল বাজল। থেমে থেমে আবার বাজল।

মালগাড়ির ব্রেক থেকে আজ আর কেউ সবুজ বাতিটা দেখাচ্ছে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *