হয়তো – প্রেমেন্দ্র মিত্র

হয়তো – প্রেমেন্দ্র মিত্র

গভীর দুর্যোগের রাত্রি⋯

ভীত শহর যেন এই অন্ধকার ঝড়ের রাত্রে নিরাপদ আশ্রয়ে নিজেকে সঙ্কুচিত করিয়া গোপন রাখিতে চায়।

নির্জন পথের যেখানে যেখানে গ্যাসের আলো পড়িয়াছে, সেখানে মাটি আর চোখে পড়ে না—শুধু বৃষ্টিধারাহত জল চিক্‌চিক্‌ করিতেছে দেখা যায়। পথের ধারের গাছগুলি ঝড়ের তাড়নায় অসহায় বন্দীর মত মাটির শৃঙ্খল ছিঁড়িবার জন্য যেন উন্মত্ত হইয়া উঠিয়াছে।

এমনি রাত্রিতে আকাশের উৎপীড়নে বিপর্যস্ত পৃথিবীকে হঠাৎ বড় অসহায় বলিয়া মনে হয়। অকস্মাৎ যেন এই ক্ষুদ্র গ্রহটির দুর্বল কয়েকটি প্রাণীর ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে গভীর হতাশায় মন আচ্ছন্ন হইয়া যায়।

পথের ধারে গ্যাসের আলোগুলি কেমন নিষ্প্রভ হইয়া গেছে—সমস্ত মানব-জাতির আশার সঙ্গে, কেন জানি না, তাহার একটি উপমা বারবার মনে আসিতে চায়।

বাস হইতে নামিয়া নির্জন কর্দমাক্ত পথ দিয়া, বৃষ্টির ঝাপটা হইতে দেহকে বাঁচাইবার নিষ্ফল চেষ্টা করিতে করিতে এমনি সব চিন্তা লইয়া বাড়ি ফিরিতেছিলাম। কিন্তু মানব-জাতির ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে অস্পষ্ট হতছ্ছাড়া আরেকটি ভয় মনের গোপনে ছিল—সে-আশঙ্কা ব্যক্তিগত ও তাহার হেতু অত্যন্ত স্পষ্ট।

পথ অনেকখানি ; মাঝে একটা নূতন অর্ধসমাপ্ত সেতু পার হইতে হইবে। সেতুটি এখনও চলাচলের উপযুক্ত হইয়া ওঠে নাই। চলিবার রাস্তা সঙ্কীর্ণ। ধারের রেলিং দেওয়া হয় নাই। সাধারণ অবস্থাতেই এক-একটি কাঠের তক্তার উপর সন্তর্পণে পা রাখিয়া চলিতে হয়—এই দুর্যোগের রাত্রে সে-সেতু পার হইতে বিশেষ বিপদের সম্ভাবনা। মনে মনে সেই বিপদের সম্মুখীন হইবার জন্যই সাহস সঞ্চয়ের চেষ্টা করিতেছিলাম।

পোলের নিকট আসিয়া কিন্তু অনেকটা আশ্বস্ত হইলাম। সারাদিনের ভিতর পোলটির নির্মাণকার্য বেশ অগ্রসর হইয়া গিয়াছে। ধারে রেলিং দেওয়া হয় নাই কিন্তু কাঠের তক্তার ফাঁক দিয়া গলিয়া পড়িবার ভয় আর নাই—কাঠগুলি মজবুত করিয়া ইতিমধ্যে জোড়া হইয়াছে।

চেন দিয়া ঝোলানো পোলটি ঝড়ের বেগে দুলিতেছিল। ভয় যে একটু না হইতেছিল এমন নয় কিন্তু শেষ পর্যন্ত মরিয়া হইয়া তাহার উপর পা বাড়াইয়া দিলাম। পোল পার না হইলে এই ঝড়বৃষ্টি মাথায় করিয়া আরও এক মাইল পথ ঘুরিয়া যাইতে হয়।

পা দিয়াই বুঝিলাম ঝড়ের সহিত যুঝিয়া এই দোদুল্যমান পোল পার হওয়া সহজ কথা নয়। শুধু সাহস নয়, শক্তিরও প্রয়োজন। ঝড়ের বেগ খোলা নদীর উপর এমন প্রচণ্ড হইয়া উঠিয়াছে যে প্রতি মুহূর্তেই একেবারে নিচে গিয়া পড়িবার সম্ভাবনা।

লোকজন কেহ কোথাও নাই। এই জনহীন সেতুর উপর অহঙ্কার বিসর্জন দিয়া হামাগুড়ি দিয়া গেলেই বা ক্ষতি কি—চিন্তা করিতে করিতে কিছুদূর অগ্রসর হইয়াছি এমন সময়—

থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িলাম। পোলের এপার হইতে একটি টিমটিমে কেরোসিনের বাতি প্রাণপণ চেষ্টা করিয়া ওপারের অন্ধকারকে একটু তরল করিতে পারিয়াছে মাত্র।

সেই তরল অন্ধকারে দুইটি অস্পষ্ট মূর্তি চোখে পড়িল। তাহারা ওধার হইতে পোল পার হইবার জন্য চেষ্টা করিতেছে। তাহাদের একটি মূর্তি নারীর।

এই অন্ধকার দুর্যোগের রাত্রে দুইটি নরনারী কি এমন প্রয়োজনে এই বিপদসঙ্কুল সেতুপথ পার হইতে আসিয়াছে, এ-কথা ভাবিয়া সেদিন থমকিয়া দাঁড়াই নাই।

এ দুর্যোগের রাতে এরূপ ব্যাপার যতই কৌতূহলজনক হোক না কেন, বিস্ময়কর নয়।

কিন্তু ওপারের তরল অন্ধকারে দুইটি নাতিস্পষ্ট নরনারী-মূর্তির যে-আচরণ চোখে পড়িল তাহা সত্যই অসাধারণ।

মেয়েটি আসিতে চায় না। শুধু পোল পার হইবার ভয়ে, না আর কোন গভীর আশঙ্কায় জানি না, সমস্ত শক্তি দিয়া প্রাণপণে পুরুষটির আকর্ষণ সে যেন প্রতিরোধ করিতে চাহিতেছিল। ঝড়ের শব্দের ভিতর দিয়া তাহাদের যে কয়েকটি কথা শুনিতে পাইতেছিলাম তাহাতে পুরুষটি তাহাকে আশ্বাস দিতে চাহিতেছে বলিয়াই মনে হইল।

ঝড়ের সহিত যুঝিয়া তখন সেতুর মাঝামাঝি আসিয়া পৌঁছিয়াছি। দেখিলাম, শেষ পর্যন্ত মেয়েটি অত্যন্ত যেন অনিচ্ছার সহিত রাজী হইয়াছে। পুরুষটি তাহার হাত ধরিয়া ওদিক হইতে পোলের উপর অগ্রসর হইতে লাগিল।

আরও খানিকটা অগ্রসর হইয়া তাহাদের মুখোমুখি হইলাম। পুরুষ ও মেয়েটি উভয়েই সর্বাঙ্গে তিনপুরু কাপড় মুড়ি দিয়া আছে। কিন্তু সেই কাপড়ের জঙ্গলের ভিতরেই কেরোসিন তেলের বাতির অস্পষ্ট আলোকে মেয়েটির মুখটি চকিতে দেখিয়া আর একবার চমকিয়া উঠিলাম।

শীর্ণ রুগণ্‌ মুখে, দুইটি দীর্ঘায়ত চোখ—সে-চোখে অসহায় আতঙ্কের যে-ছবি প্রত্যক্ষ করিলাম তাহা মানুষের চোখে সম্ভব বলিয়া ভাবি নাই। কৌতূহল বাড়িয়াই যাইতেছিল। কিন্তু উপায় কি !

পোল প্রায় পার হইয়া আসিয়াছি। এমন সময় পিছনে অমানুষিক চিৎকার শুনিয়া চমকিয়া ফিরিয়া দাঁড়াইলাম।

সর্বনাশ!

আমার চোখের উপর অসহায় চিৎকার করিয়া মেয়েটি পোলের ধার হইতে টাল সামলাইতে না পারিয়া নিচে পড়িয়া গেল। যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি সেখানে ছুটিয়া গেলাম। পুরুষটি বোধ হয় আতঙ্কে হতবুদ্ধি হইয়া গিয়াছিল। যেভাবে সে কাঠের মত আড়ষ্ট হইয়া দাঁড়াইয়া আছে, তাহাতে তাহার নিকট কোন সাহায্য পাইবার আশা নাই বুঝিলাম।

কিন্তু অন্ধকারে এই ঝড়ের ভিতর গভীর নদী হইতে মেয়েটিকে উদ্ধার করিবার জন্য আমিই বা কি করিতে পারি।

এতক্ষণে স্রোতের টানে সে কোথায় তলাইয়া গিয়াছে, কে জানে! সাঁতার জানিলেও এই রাত্রে তাহাকে নদী হইতে উদ্ধার করা একরকম অসম্ভব!—সাঁতারও জানি না।

হঠাৎ বহু নিম্ন হইতে অস্পষ্ট কাতর আহ্বান শুনিয়া চমকিয়া উঠিলাম। পর মুহূর্তেই তাহার শাড়ির প্রান্তটুকু চোখে পড়িল।

পড়িবার সময় তাহার শাড়ির একটি অংশ কেমন করিয়া লোহার একটি বলটুতে আটকাইয়া গিয়াছে—মেয়েটি জলে পড়ে নাই। কাপড়ের সহিত জড়াইয়া নিম্নমুখ হইয়া অন্ধকার নদীর উপর ঝুলিতেছে।

ঠেলা দিয়া অপরিচিত লোকটির আচ্ছন্ন ভাব দূর করিবার চেষ্টা করিয়া বলিলাম, ‘শিগ্‌গির এসে ধরুন, এখনও হয়তো টেনে তুলতে পারি।’ লোকটি যন্ত্রচালিতের মত আসিয়া আমার আদেশ পালন করিল।

মেয়েটি সেদিন নিশ্চিত মৃত্যু হইতে শেষ পর্যন্ত রক্ষা পাইয়াছিল। কৃতজ্ঞতা বিনিময়ের তখন সময় ছিল না, পরিচয় জিজ্ঞাসারও নয়—নইলে অনেক কথাই হয়তো শুনিতে পারিতাম।

সাবধানে তাহাদের পার করিয়া দিয়া আবার সেই পোলের উপর দিয়া সভয়ে পার হইবার সময় যে কয়টি কথা শুনিতে পাইয়াছিলাম তাহাই আমার মনে চিরন্তন সন্দেহ ও বিস্ময় জাগাইয়া রাখিয়াছে।

মেয়েটি পুরুষের সহিত চলিয়া যাইতে যাইতে বলিতেছিল, ‘কি আশ্চর্য দেখ, পড়ে যাবার সময় আমার যেন মনে হল তুমি আমায় ঠেলে দিলে। পা ফসকে তো পড়িনি, আমার যেন ঠিক মনে হল তুমি ঠেলে দিলে⋯’

তাহাদের কথা ক্রমশ অস্পষ্ট হইয়া আসিতেছিল। লোকটির হাসি শুনিতে পাইলাম। সে যেন বলিতেছিল…

‘পাগল! কি যে বল ; আমি ঠেলে দেব তোমায়…’

সে-ঘটনাটি ভুলিতে পারি নাই। সময়ে অসময়ে সেই বিপদসঙ্কুল সেতুর উপর অস্পষ্টভাবে দেখা মূর্তি দুইটি সম্বন্ধে নানা সন্দেহ, নানা প্রশ্ন মনে জাগে। তাহারা সেই ঝড়ের রাত্রে কেন কোথা হইতে সে-পোল পার হইতে আসিয়াছিল, মেয়েটি কেমন করিয়া পড়িয়া গিয়াছিল, রক্ষা পাইয়া অমন কথাই বা সে বলিল কেন এবং তাহার পর তাহারা কোথায় যে গেল তাহার কিছুই জানি না। তবু তাহাদের সম্বন্ধে অস্পষ্টভাবে নানা কথা মন রচনা করে।

সেই অসাধারণ ঘটনা ও সেই অস্পষ্ট দেখা দুইটি মূর্তিকে কেন্দ্র করিয়া একটি কাহিনী মনের ভিতর আপনা হইতেই গড়িয়া ওঠে।

প্রকাণ্ড সাতমহলা দালান।

কিন্তু এখন আর তাহার কিছুই অবশিষ্ট নাই। চারিধারে শুধু ভাঙা নোনা-ধরা ইট-কাঠের স্তূপ। বাহির হইতে দেখিলে ভুতুড়ে পোড়ো বাড়ি বলিয়া মনে হয়। এই জরাজীর্ণ বাড়িটির কোন গোপন কক্ষে এখনো তাহার মুমূর্ষ প্রাণ ধুকধুক করিতেছে এ-কথা সহজে বিশ্বাস করিতে প্রবৃত্তি হয় না। দিনের বেলায় সে-প্রাণের কোন লক্ষণই দেখা যায় না। দেউড়ির সিংদরজা ভেদ করিয়া যে অশ্বথ্থগাছটি শাখায় প্রশাখায় বিপুল হইয়া বাড়িয়া উঠিয়াছে তাহার পত্রচ্ছায়ায় বসিয়া ঘুঘু ডাকে। কাঠবেড়ালির দল নির্ভয়ে ভূতপূর্ব বারবাড়ির ধ্বংসাবশেষের উপর দিয়া পরম্পরকে তাড়া করিয়া ফেরে।

এই ধ্বংসাবশেষের অন্তরালে কোথায় মানুষের জীবনের ধারা বহিয়া চলিয়াছে তাহার সন্ধান পাওয়া সহজ নয়।

রাত্রে কিন্তু বহু দূর হইতে দেখা যায় ধ্বংস্তূপের মাঝখানে কোথা হইতে ক্ষীণ আলোকের রেখা আসিতেছে। এ-বাড়ির ইতিহাস যাহাদের জানা নাই, বিদেশী সেসব পথিক ভয়ও যে পায় না এমন নয়।

গাঁটছড়া বাঁধা হইয়া এই ধ্বংসাবশেষের পাশে একদিন লাবণ্য পালকি হইতে নামিয়াছিল। বাপের বাড়ি হইতে যে-ঝি সঙ্গে আসিয়াছিল সে তো মাটিতে পা দিয়াই ঝঙ্কার দিয়া বলিয়াছিল, ‘কেমনতর বেআক্কিলে বেহারা গা! এই বাড়িটার সামনে নামালে-বরকনের অকল্যাণ হবে না!’

যে-পুরোহিত বরপক্ষের হইয়া বিবাহ দিতে গিয়াছিলেন পথে তাঁহার সহিত পরিচারিকার কয়েকবার বাক্‌যুদ্ধ হইয়া গিয়াছে। তাঁহার দিক দিয়া বিশেষ সুবিধা করিতে না পারিলেও, সম্বোধনের দূরত্বটা ঘুচিয়া গিয়াছিল।

তিনি দাঁত খিঁচাইয়া জবাব দিলেন, ‘মর মাগী, ভুতুড়ে বাড়ি হতে যাবে কেন? নিয়োগীদের সাতপুরুষের কোটা—এ-তল্লাটে জানে না এমন লোক নাই। ওর কাছে হল ভুতুড়ে বাড়ি !’

ঝি কপালে চোখ তুলিয়া সবিস্ময়ে বলিয়াছিল, ‘ওমা, এরা বলে কি গো! এই পোড়াবাড়িতে মানুষ থাকে!’ তাহার পর কন্যার পিতার উদ্দেশেই বোধ হয় কঠোর মন্তব্য করিয়া বলিয়াছিল, ‘মিন্‌সে পয়সা খরচের ভয়ে করলে কি গো! মেয়েটাকে সাপে কামড়ে মেরে ফেলতে এই জঙ্গলে পাঠালে!’

অবগুণ্ঠিত লাবণ্য তখন স্বামীর সহিত গাঁটছড়া-বাঁধা হইয়া পালকি হইতে নামিয়াছে।

পুরোহিত ঝিয়ের সহিত বাক্যব্যয় নিস্ফল মনে করিয়াই বোধ হয় পথ দেখাইয়া আগে চলিতে শুরু করিয়াছেন।

পথ দেখানোটা কথার কথা নয়, একান্ত প্রয়োজন। ভাঙা ইট-কাঠের স্তুপের উপর দিয়া, হাঁটুভর জঙ্গলের ভিতর দিয়া সুড়ঙ্গের মত অন্ধকারে বহুদিনের সঞ্চিত শেওলার ভ্যাপসা গন্ধভারাক্রান্ত পথ দিয়া পদে-পদে হোঁচট খাইতে খাইতে লাবণ্য তাহার স্বামীর পিছু পিছু চলিতেছিল। পিছনে ঝি বাধ্য হইয়া তাহাদের অনুসরণ করিতে করিতে আপন মনেই গজগজ করিতেছিল, ‘সাত জন্মে এমন বিয়ের কথা কোথাও শুনিনি মা। বিয়ে করতে এল, তার বর-যাত্তর নাই, বরকর্তা নাই। ট্যাং ট্যাং করে এক মড়িপোড়া পুরুত এল বরকে নিয়ে ; আর খোঁজ নিলে না, শুধুলে না, মেয়েটাকে হাত-পা বেঁধে ধরে দিলে গা! আর এরা কোথাকার আকখুটে গো! জ্ঞাতগোত্তর নেই, পাড়াপড়শী নেই, বিয়ে করে এল তা বরকনেকে বরণ করতে এল না কেউ! শ্যাল-কুকুরের বিয়েতেও যে এর চেয়ে নেমকানুন আছে…’

লাবণ্য এত কথা শুনিতে বোধ হয় পায় নাই। আচ্ছন্নের মত ভীত অসহায়ভাবে চলিতে চলিতে শুধু তাহার মনে হইতেছিল, কেহ যদি শুধু হাতটা বাড়াইয়া একবারটি তাহাকে ধরে তাহা হইলে সে বাঁচিয়া যায়।

কিন্তু কেহ হাত বাড়াইল না।

গজগজ করিতে করিতে একসময়ে ঝি ঝঙ্কার দিয়া উঠিল, ‘বলি, ও মুখপোড়া বামুন, কোন চুলোয় নিয়ে চলেছ শুনি?’

ব্রাহ্মণ এইবার উত্তর দিলেন, ‘তোকে গোর দিতে রে মাগী!’

উত্তরে ঝি যাহা বলিতে শুরু করিল, তাহাতে আর যাহাই হোক লাবণ্যের প্রথম স্বামীগৃহে পদার্পণের পুণ্যক্ষণ মধুর হইয়া উঠিল না।

ঝিয়ের আস্ফালন কতক্ষণ চলিত বলা যায় না। সহসা অন্ধকার পথ কাহার সুমধুর কলহাস্যে মুখরিত হইয়া উঠিল।

ঝি চমকিয়া চুপ করিল। লাবণ্য ঘোমটা ঈষৎ ফাঁক করিয়া এই সুমধুর হাস্যের উৎস ঠাওর করিয়া দেখিবার চেষ্টা করিল।

যে হাসিয়াছিল তাহারই অপরূপ কণ্ঠ শোনা গেল, ‘দাদা যে চুপিচুপি বউ এনে ফেলেছে গো!’

অন্ধকার পথ তখন শেষ হইয়াছে। সামনেই নাতিবৃহৎ অঙ্গন এবং সেই অঙ্গনের চারিধার ঘিরিয়া ঘরের সারি।

আলোতে আসিয়া দাঁড়াইতে শাঁখ বাজানো থামাইয়া যে-মেয়েটি আসিয়া লাবণ্যের মুখের ঘোমটা সরাইয়া আর একবার মধুর হাস্যে সমস্ত বাড়ি মুখর করিয়া তুলিল, তাহার মুখের দিকে একটি নিমেষের জন্য চাহিয়া চোখ নামাইয়া লাবণ্যের বিস্ময়ের আর অবধি রহিল না।

নারীর দেহে এত রূপ সম্ভব, লাবণ্যের কখনও জানিবার সুযোগ হয় নাই।

মেয়েটি হাসিয়া বলিল, ‘ওমা কেমন বউ গো, প্রণাম করে না কেন! প্রণাম করতে জানো না?’

কাহাকে প্রণাম করিতে হইবে কিছুই বুঝিতে না পারিয়া লাবণ্য হেঁট হইয়া মেয়েটিকে প্রণাম করিতে যাইতেছিল। মেয়েটি খিলখিল করিয়া হাসিয়া সরিয়া গিয়া বলিল, ‘আমাকে নয় গো, আমাকে নয়, পিসিমাকে দেখতে পাচ্ছ না?’

লাবণ্য দেখিল। দেখিয়া বুঝি অজ্ঞাতে একটু শিহরিয়া উঠিল।

শকুনির মত শীর্ণ বীভৎস মুখের কানা একটি চোখের ভয়ঙ্কর দৃষ্টি দিয়া মূর্তিমতী জরা যেন তাহাকে বিদ্ধ করিতেছে।

লাবণ্যের সংসার শুরু হইল।

ঝি দুই দিন থাকিবার পর ভুতুড়ে বাড়ি সম্বন্ধে নানারূপ অসংলগ্ন মন্তব্য করিয়া চলিয়া গিয়াছে। চারিটি মাত্র প্রাণী এই বিশাল ভগ্ন প্রাসাদের অভ্যন্তরে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ তিনটি ঘরে বাস করে। উপরে নিচে চারিধারে শুধু আগাছার জঙ্গল ও অব্যবহার্য পরিত্যক্ত ঘরের সারি। তাহার কোনটির কড়ি-কাঠ ঝুলিয়া ছাদ পড়ো-পড়ো হইয়াছে। কোনটির দেওয়াল ধসিয়া পড়িয়াছে। মাকড়সা, চামচিকা ও ইঁদুর তাহাদের সবগুলিকেই দখল করিয়া আছে।

পোড়ো বাড়ির ঘরগুলির মত বাড়ির বাসিন্দাগুলিও রহস্যময়। পিসীমা বলিয়া প্রথম দিন যাঁহাকে প্রণাম করিতে হইয়াছিল, তাঁহার দেখাই বড় মিলে না। অন্ধকার একটি কোণের ঘরে সারাদিন তিনি খুটখাট করিয়া কি যে করেন কিছুই জানিবার উপায় নাই। সে-ঘরে কাহাকেও প্রবেশ করিতে দিতে যে তিনি চাহেন না, এ-কথা বুঝিতে ‘লাবণ্যের বিশেষ বিলম্ব হয় নাই। দৈবাৎ কখনও সামনাসামনি পড়িয়া গিয়া চোখাচোখি হইয়া গেলে তিনি এমনভাবে তাহার দিকে তাকান যে, অকারণে লাবণ্যের বুকের ভিতর পর্যন্ত হিম হইয়া যায়।

স্বামীকেও সে বুঝিতে পারে না। সারাদিন কাজ-কর্ম লইয়া একরকম সে ভুলিয়া থাকে। রাত্রে কিন্তু শয়নঘরে ঢুকিতে তাহার কেমন যেন ভয় করে।

ঘরটি প্রকাণ্ড। কড়িকাঠ যেখানে যেখানে দুর্বল, সেখানে বাঁশের ঠেকো দিয়া তাহাকে জোর দিবার চেষ্টা করা হইয়াছে বলিয়া বড় অদ্ভুত দেখায়। দুইধারে দুইটি জানালা। একটি খুলিলে সম্মুখের প্রকাণ্ড বাঁশবাগান ও পুকুর চোখে পড়ে। আরেকটি বন্ধই থাকে। একদিন খুলিতে গিয়া ভয়ে আর লাবণ্য সে-চেষ্টা করে নাই। সে-জানালার পাশেই অব্যবহার্য একটি অন্ধকার ঘর ভাঙা কাঠ-কাঠরা জঞ্জালে বোঝাই হইয়া আছে। জানালা খুলিবা মাত্র ঝটপট কিসের একটা শব্দ শুনিয়া সভয়ে আবার লাবণ্য বন্ধ করিয়া দিয়াছিল। হয়তো চামচিকাই হইবে, কিন্তু লাবণ্যের ভয় যায় নাই।

লাবণ্য ঘরে ঢুকিয়া হয়তো দেখে স্বামী আগে হইতেই বিছানায় বসিয়া আছে। তাহার দিকে ভ্রূক্ষেপও নাই। সঙ্কুচিতভাবে সে খানিকক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকে, তাহার পর ধীরে ধীরে হয়তো বিছানার এক পাশে বসে। স্বামী তবুও ফিরিয়া চাহে না; নিজের চিন্তাতেই তন্ময় হইয়া থাকে।

তাহার পর হঠাৎ একসময়ে স্বামী তাহাকে জড়াইয়া ধরিয়া আদরে চুম্বনে একেবারে অভিভূত করিয়া দেয়। স্বামীর কঠিন বাহুবন্ধনের ভিতর নিশ্চিন্ত আরামে আত্মসমর্পণ করিতে গিয়া কিন্তু লাবণ্য সম্পূর্ণ সফল হয় না—তাহার মনের কোথায় যেন একটি বাধা থাকিয়া যায়।

সস্নেহে তাহাকে কাছে বসাইয়া বাম বাহু দিয়া তাহার কণ্ঠ জড়াইয়া ধরিয়া স্বামী জিজ্ঞাসা করে, তোমার এখানে কষ্ট হচ্ছে না তো লাবণ্য?’

লাবণ্য ঘাড় নাড়িয়া জানায়, ‘না, তাহার কষ্ট হইতেছে না।’

‘আমাকে তোমার পছন্দ হয়েছে তো?’

অত্যন্ত সাধারণ স্বামী-স্ত্রীর প্রশ্নোত্তর। সলজ্জভাবে ‘হুঁ বলিয়া লাবণ্য স্বামীর বুকে মুখ লুকাইয়া ফেলে।

কিন্তু এই সাধারণ কথাবার্তা হঠাৎ অসাধারণ রূপ গ্রহণ করে। স্বামী সজোরে তাহার মুখটা তুলিয়া ধরিয়া হঠাৎ উগ্র কণ্ঠে বলে, ‘অত্যন্ত সহজে হুঁ বলে ফেললে, কেমন? পছন্দ হওয়াটা তোমাদের কাছে এমনি সহজ ব্যাপার!’

লাবণ্য কিছু বুঝিতে না পারিয়া সবিস্ময়ে চাহিয়া থাকে। স্বামীর গলা আরও চড়িয়া যায়—

উত্তেজিতভাবে বলিতে থাকে, ‘একবার জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে নিলেই পছন্দ হয়ে গেল। এই তো পছন্দের দাম? কেমন, না?’

লাবণ্য চুপ করিয়া থাকে।

স্বামী বিছানা হইতে উঠিয়া পড়িয়া ক্ষিপ্তের মত জিজ্ঞাসা করে, ‘বল, চুপ করে আছ কেন? উত্তর দিতে পার না?’

এ-কথার উত্তরে কি বলিতে হইবে কিছু বুঝিতে না পারিয়া লাবণ্য চুপ করিয়া থাকে। স্বামী অশান্তভাবে ঘরের ভিতর পায়চারি করিয়া বেড়ায়। কিন্তু স্বামীর উত্তেজনা যেমন বেগে আসে তেমন তাড়াতাড়ি শান্ত হইয়া যায়। শান্তভাবে আবার তাহার কাছে আসিয়া বসিয়া বলে, ‘রাগ করলে লাবণ্য?’

লাবণ্য ধরা-গলায় বলে, ‘না, তুমি অমন করছিলে কেন?’

‘ও কিছু নয়, তোমার সঙ্গে একটু ঠাট্টা করলাম। তুমি আমায় সারাজীবন সত্যি ভালবাসবে তো? বাসবে?’

লাবণ্যের মুখে হাসি দেখা দেয়। আরেকবার স্বামীর বুকে মাথা রাখিয়া সে ধীরে ধীরে অর্ধস্ফুট স্বরে বলে, ‘তুমি বুঝি বাসবে না?’

কিন্তু স্বামীর ঠাট্টার সমাপ্তি ওইখানেই নয়। অর্ধেক রাত্রে হঠাৎ ঘুম ভাঙিয়া হয়তো লাবণ্য দেখে, ঘরের দেওয়ালে টাঙানো বাতিটি উজ্জ্বলভাবে জ্বলিতেছে এবং স্বামী বিছানায় উঠিয়া বসিয়া তাহার মুখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকাইয়া আছে।

সে-দৃষ্টিতে অনুরাগের কোমলতা নাই—সে-দৃষ্টি তীব্র, তীক্ষ!

লাবণ্য চোখ খুলিয়া চাহিতেই স্বামী যেন অপ্রস্তুত হইয়া চোখ ফিরাইয়া লইয়া সরিয়া বসে।

লাবণ্য জিজ্ঞাসা করে, ‘অমন করে উঠে বসেছিলে কেন গো?’

‘নাঃ, কিছু না—তুমি ঘুমের মধ্যে কি যেন বলছিলে শুনছিলাম!’

‘কি বলছিলাম?’

‘না, না, বলনি কিছু। যদি কিছু বল তাই শুনছিলাম।’ —বলিয়া কথাটাকে উড়াইয়া দিয়া স্বামী তাহার উঠিয়া পড়ে।

আর একদিন ভোরের বেলা ঘুম হইতে উঠিয়া লাবণ্য অবাক হইয়া গেল। ঘরের ভিতর তখনও অন্ধকার। দেওয়ালের আলো তেলের অভাবে বোধ হয় নিবিয়া গিয়াছে। কিন্তু সকাল হইতেও আর দেরি নাই। পূর্বদিকের জানালা দিয়ে বাঁশবাগানের মাথায় আকাশের রং ঈষৎ লাল হইয়া উঠিতেছে দেখা যায়। বিছানা হইতে উঠিতে গিয়া হঠাৎ বাধা পাইয়া লাবণ্য দেখিল, তাহার অঞ্চলপ্রান্ত নিজের কাপড়ের খুঁটের সহিত স্বামী শক্ত করিয়া বাঁধিয়া রাখিয়াছে। স্বামীর এই রসিকতায় মনে মনে হাসিয়া ধীরে ধীরে সে গেরো খুলিয়া লইতেছিল এমন সময়ে কাপড়ে সামান্য টান লাগায় স্বামী জাগিয়া উঠিল।

কিন্তু জাগিয়া উঠিয়া সে এমন কাণ্ড যে করিয়া বসিবে এ কথা লাবণ্য কল্পনাও করিতে পারে নাই। সবলে তাহার হাত চাপিয়া ধরিয়া স্বামী তীক্ষ কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, ‘কোথায়? কোথায় যাচ্ছ এত রাত্রে? কোথায়?’

স্বামীর ঘুমের ঘোর এখনও কাটে নাই মনে করিয়া লাবণ্য হাসিয়া বলিল, ‘স্বপ্ন দেখছ নাকি! আমি গো আমি! হাত ছাড়ো, লাগছে!’

স্বামী কিন্তু উচ্চতর কণ্ঠে বলিল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুমি, তুমি ; তোমায় চিনি! কোথায় যাচ্ছ বল শিগগির ; নইলে খুন করে ফেলব।’

এবার লাবণ্য একটু বিরক্ত হইল—বলিল, ‘খুন করবার আগে ভাল করে একটু চোখ দুটো রগড়ে দেখ! ভোর হয়েছে, উঠতে হবে না?’

পূর্বের জানালা দিয়া আকাশের রক্ত আভা তখন ঘরের ভিতর পর্যন্ত ঈষৎ রাঙাইয়া দিয়াছে। সেইদিকে চাহিয়া হাত ছাড়িয়া দিয়া স্বামী খানিক চুপ করিয়া রহিল। তাহার পর হঠাৎ হো হো করিয়া হাসিয়া বলিল, ‘চোর বলে আরেকটু হলে তোমায় খুন করতে যাচ্ছিলুম আর কি! ভারি বিশ্রী স্বপ্ন দেখছিলুম।’

হয়তো কথাটা সত্য। কিন্তু লাবণ্যের মনে কেমন একটি সন্দেহ জাগিতে থাকে। কাপড়ে গিঁট দেওয়ার রসিকতাটা কেমন যেন বিসদৃশ ঠেকে।

স্বামীকে সে বুঝিতে পারে না বটে কিন্তু এ-বাড়ির সুন্দরী মেয়েটিকে তাহার আরও দুর্ঙ্গেয় বলিয়া মনে হয়। বয়সে সে তাহার চেয়ে কিছু বড়ই হইবে—নাম মাধুরী। সে যে এ-বাড়ির কে, এই পরিবারটির সহিত তাহার সম্বন্ধ যে কি, তাহা জানিবার উপায় নাই। তাহার স্বামীকে সে দাদা বলিয়া সম্বোধন করে—সুতরাং ভগিনীস্থানীয়া কেহ হইবে। কিন্তু আপনার ভগিনী যে নয়, এ-বিষয়ে শুধু চেহারা দেখিয়া নয়, তাহার আচরণ দেখিয়াও নিঃসন্দেহ হওয়া যায়।

মাধুরীর বিবাহ হইয়াছে কিনা বলা অসম্ভব। সে চওড়াপাড় শাড়ি পরে, সর্বাঙ্গে তাহার বহুমূল্য অলংকার সারাক্ষণ ঝলমল করে, পায়ে আলতা পরিয়া বিফলের মত অধর দুটি তাম্বুলে রঞ্জিত করিয়া সারাদিন সে পটের ছবিটি সাজিয়া থাকে। অথচ তাহার মাথায় সিঁদুর নাই এবং বিবাহের বয়স অনেকদিন পার হইয়াছে বলিয়াই মনে হয়।

তাহার গতিবিধিও রহস্যময়। সারাদিন সে যে কোথায় থাকে কোনও সন্ধান পাওয়া যায় না। হঠাৎ কখন কোথা হইতে আসিয়া লাবণ্যের গলা জড়াইয়া ধরিয়া চুমা খাইয়া হয়তো বলে, ‘তোকে বড়ো ভালবেসে ফেলেছি ভাই ; চ, তোকে নিয়ে কোথাও পালাই।’

অর্থহীন অসংলগ্ন কথা ; তবু লাবণ্যকে হাসিয়া জবাব দিতে হয়, ‘কোথায় পালাব?’

‘কেন, দিল্লী লাহোর! তুই সাজবি বর, আমি হব তোর কনে। তুই মালকোঁচা মেরে কাপড় পড়বি আর ছোট-বড় চুল ছেঁটে পাঞ্জাবি চড়িয়ে উড়নি উড়িয়ে বেরুবি আর আমি তোর পাশে ঘোমটা দিয়ে থাকব। রোজগার করে খাওয়াতে পারবি তো?’

লাবণ্য বলে, ‘কেন, তুমিই বর হও না!’

‘দূর, তাহলে মানাবে কেন? আমার এ-রূপ কি কোঁচা চাদরে ঢাকা যাবে রে হতভাগী!’ বলিয়া হাসিয়া আবার মাধুরী উধাও হইয়া যায় এবং খানিক বাদেই হয়তো আবার ফিরিয়া আসিয়া রন্ধনরতা লাবণ্যের কড়ায় এক খামচা নুন টপ্‌ করিয়া ফেলিয়া দিয়া বলে, ‘বাপের বাড়ি খালি গিলতে শিখেছিলি বুঝি? রাঁধতেও শিখিসনি ছাই!’

লাবণ্য শশব্যস্ত হইয়া বলে, ‘ও কি করলে ঠাকুরঝি! নুন যে দিয়েছি একবার!’

‘বেশ তো, খেতে গিয়ে দাদার মুখ পুড়ে যাবে, আর তুই গাল খাবি।’ বলিয়া মাধুরী হাসিতে থাকে। সে-হাসি দেখিলে সব অপরাধ, সব অন্যায় মার্জনা করা যায়।

কড়াটা নামাইয়া ফেলিয়া লাবণ্য হাসিয়া বলে, ‘তুমি ভারি দুষ্টু।’

‘আর তুই লক্ষ্মীর প্যাঁচাটি! বলিয়া রাগ দেখাইয়া মাধুরী চলিয়া যায়! লাবণ্য হাসিতে থাকে।

মাধুরীর হালচাল এমনি লাবণ্য তাহাকে না ভালবাসিয়া থাকিতে পারে নাই। এই ভয়ঙ্কর বাড়িটির ভিতর লাবণ্যের শঙ্কিত সন্ত্রস্ত মন শুধু এই মেয়েটির কাছে আসিয়াই যেন হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচে। প্রথম দিন হইতেই তাহার অদ্ভুত আচরণের পরিচয় সে পাইয়াছে। তবু মুগ্ধ হইয়াছে।

ফুলশয্যার রাত্রে আয়োজন অনুষ্ঠান কিছুই তাহাদের হয় নাই। বাপের বাড়ির ঝি তখন উপস্থিত। ইহাদের কাণ্ডকারখানা সম্বন্ধে নানা কঠোর মন্তব্য উচ্চস্বরে অনেকক্ষণ ধরিয়া করিয়াও কোন ফল না হওয়ায় অবশেষে ঝি নিজেই তাহাকে সারা বিকাল সাজাইয়া গোছাইয়া শয়নঘরে ঠেলিয়া পাঠাইয়া দিয়াছিল।

নির্জন ঘর। জড়সড় হইয়া একা সে-ঘরে বসিয়া থাকার জন্য লজ্জা ও ভয়ের তাহার আর সীমা ছিল না। মাধুরী সকালে একবার তাকে দেখা দিয়াই সেই যে অন্তর্ধান হইয়াছিল, সারাদিন তাহার আর দেখা মিলে নাই। স্বামীও কোথায় বাহির হইয়া গিয়াছেন। কখন ফিরিবেন কে জানে? কত রাত তাহাকে এমন নিঃসঙ্গভাবে নির্জন ঘরে কাটাইতে হইবে, ঝি-এর কাছে পুনর্বার ফিরিয়া যাওয়া উচিত কিনা—ভাবিতে ভাবিতে লাবণ্য হঠাৎ চোখে হাত চাপা পড়ায় চমকিয়া উঠিল। প্রথমে মনে হইয়াছিল, স্বামীই বুঝি আসিয়াছেন কিন্তু পরক্ষণেই বুঝিতে পারিল এমন কোমল অঙ্গুলি পুরুষের হইতে পারে না। সঙ্গে সঙ্গে হাসি শুনিয়া তাহার সন্দেহ সহজেই দূর হইয়া গেল।

মাধুরী খিলখিল করিয়া হাসিয়া তাহার চোখ ছাড়াইয়া দিয়া সামনে আসিয়া হাত মুখ নাড়িয়া চোখের অপরূপ ভঙ্গি করিয়া বলিল, ‘মেয়ের কি আস্পর্ধা, উনি ভেবেছেন ওঁর বর বুঝি এসে চোখ টিপেছে! বরের দায় পড়েছে!’

পরিচয় তখনও গভীর হয় নাই, তবু লাবণ্য না বলিয়া থাকিতে পারে নাই, ‘যাঃ, আমি বুঝি তাই ভেবেছি!’

‘তবে কি ভেবেছ শুনি? ও-পাড়ার বেন্দা বোষ্টম এসে চোখ টিপেছে!’

‘যাঃ’ বলিয়া চোখ তুলিয়া মাধুরীর দিকে চাহিয়াই লাবণ্য একেবারে অবাক হইয়া গিয়াছিল।

সর্বাঙ্গ পুষ্পাভরণে অলঙ্কৃত করিয়া মাধুরী সাক্ষাৎ বনদেবীর মতই সাজিয়া আসিয়াছে। সে-রূপ দেখিয়া চোখ ফেরানো দুষ্কর। এত ফুলই বা সে কোথা হইতে সংগ্রহ করিল কে জানে?

‘অমন করে অবাক হয়ে দেখছিস কি বল দেখি?’ বলিয়া লাবণ্যের পাশে বসিয়া পড়িয়া মাধুরী আবার বলিল, ‘এখন বল দেখি, তোর ফুলশয্যা না আমার?’

অদ্ভুত কথা! তবু লাবণ্য হাসিয়া বলিয়াছিল, ‘তোমারই তো দেখছি!’

‘শেষ পর্যন্ত দেখতে পারবি তো?’ বলিয়া সহসা কলহাস্যে সমস্ত ঘর মুখরিত করিয়া মাধুরী জোর করিয়া লাবণ্যকে ঠেলিতে ঠেলিতে আবার বলিয়াছিল, ‘তবে বেরো ঘর থেকে! দেখি তোর বুকের জোর।’

লাবণ্য হাসিতেছিল। ঠেলা দিতে দিতে সত্য সত্যই তাহাকে দরজার কাছ পর্যন্ত সরাইয়া লইয়া গিয়া হঠাৎ মাধুরী থামিয়া বলছিল, ‘এই যে মহিদা! আর বুঝি তর সইল না? এই নাও বাপু, তোমার বউ এখনও পর্যন্ত আস্তই আছে। আরেকটু হলেই ঠেলে ঘরের বার করে দিয়েছিলাম আর কি!’

মহিম দরজায় দাঁড়াইয়া ছিল। মুখ তাহার অত্যন্ত গম্ভীর। মাধুরীর রসিকতা তাহাকে স্পর্শই করে নাই যেন!

স্বামীর সামনে পড়িয়া গিয়া লাবণ্য একেবারে লজ্জায় জড়সড় হইয়া ‘ন যযৌ ন তস্থৌ অবস্থায় দাঁড়াইয়া পড়িয়াছিল। মাধুরী তাহাকে হিড়হিড় করিয়া টানিয়া একেবারে বিছানার উপর ফেলিয়া দিয়া বলিল, ‘নে, তাড়াতাড়ি দখল কর ভাই ; আমি যাই। মানুষের মন তো, মতিভ্রম হতে কতক্ষণ।’

মহিমের দিকে হাসিয়া একবার চাহিয়া মাধুরী বাহির হইয়া গিয়াছিল, কিন্তু কিছুক্ষণ বাদেই ফিরিয়া আসিয়া দরজা হইতে একটা পুঁটুলি ঘরের ভিতর ফেলিয়া দিয়া বলিয়াছিল, ‘তোমার বউ-এর ফুলের গহনা নাও, মহিদা, তাড়াতাড়িতে দিতে ভুলে গিয়েছিলাম।’

মহিম গম্ভীর মুখে পুঁটুলিটি তুলিয়া লইয়া বিছানার উপর নামাইয়া খুলিয়া ফেলিতেই কিন্তু দেখা গিয়াছিল তাড়াতাড়ি খুলিবার দরুন বা পুঁটুলি করিয়া বাঁধিবার জন্য যে-কারণেই হোক ফুলগুলি সমস্তই চটকানো।

মধুরীর সব আচরণের অর্থ বোঝা যাক বা না যাক লাবণ্য সেইদিনই তাহাকে ভালবাসিয়া ফেলিয়াছিল।

রহস্যপুরীর মাঝখানে এমনি করিয়া দ্বিধায় দ্বন্দ্বে ভয়ে আনন্দে লাবণ্যের দিন একরকম কাটিয়া যাইতেছিল। বিমাতা-শাসিত বাপের বাড়িতে সুখের সহিত পরিচয় তাহার বড় বেশি হয় নাই, সুতরাং এখানকার দুঃখে অভাবে বড় বেশি বিচলিত হইবার তাহার কথা নয়। এ-বাড়ির রহস্য এবং ভীতিও ক্রমশ তাহার গা-সওয়া হইয়া আসিতেছিল। বাপের বাড়ি হইতে কালেভদ্রে কেহ খোঁজ লইতে আসে—সেখানে যাইবার কিন্তু তাহার আর উপায় নাই সে বোঝে। বুঝি তাহার ইচ্ছাও নাই। এখানেও কোনরকমে জীবনের দিনগুলি কাটাইয়া দিবার সাহস ও সহিষ্ণুতা সে অনেকটা সঞ্চয় করিয়া ফেলিয়াছিল। কিন্তু তাহা হইবার নয়—

সকালবেলা। দূরে কোথায় যাইতে হইবে, তাই তাড়াতাড়ি সেদিন মহিম খাওয়া সারিয়া লইয়াছে। পান দিবার জন্য লাবণ্য ঘরে ঢুকিয়াছিল। মহিম তাহাকে বুকের কাছে টানিয়া লইয়া বলিল, ‘আমি কিন্তু আজ যদি না আসতে পারি, তোমার একলা রাত্রে শুতে ভয় করবে না তো লাবণ্য?’

ভয় তাহার করে—করিবেই, কিন্তু স্বামীকে সে-কথা বলিয়া উদ্বিগ্ন করা উচিত হইবে কিনা বুঝিতে না পারিয়া সে চুপ করিয়া রহিল।

মহিম আবার জিজ্ঞাসা করিল, ‘কি গো, বল না, ভয় করবে?’

একটু ইতস্তত করিয়া লাবণ্য বলিল, ‘না, ভয় আর কি?’

‘না, ভয় আর কি? ভয় তোমার হবে কেন? একলা শুতেই তুমি চাও, একলাই ভালবাস, কেমন?’

সে-স্বরে ব্যঙ্গের আভাস পাইয়া বিস্মিত হইয়া মুখ তুলিয়া লাবণ্য দেখিল, স্বামীর মুখ অস্বাভাবিকরকম কঠিন হইয়া উঠিয়াছে। স্বামীর অদ্ভুত আচরণের সহিত তাহার এতদিনে ভাল করিয়াই পরিচয় হইয়াছে। একটু ক্ষুণ্ণ-স্বরে বলিল, ‘ভয় পাব না বললেও দোষ হয় নাকি? জানি না বাপু!’

‘না, দোষ আর কি!’ —বলিয়া মহিম সে-কথা চাপা দিল।

কিন্তু কিয়ৎক্ষণ পরেই তাহাকে ডাকিয়া বলিল, ‘যাবার আগে তোমাকে একটা জিনিস দেখিয়ে যেতে চাই! দেখবে?’

‘কি জিনিস?’

‘এস আমার সঙ্গে।’

স্বামীর এই ছেলেমানুষিতে সায় দিবে কিনা লাবণ্য বিচার করিতেছিল কিন্তু মহিম তাহাকে সে-অবসর দিল না। হাত ধরিয়া একপ্রকার জোর করিয়া টানিয়াই তাহাকে যেখানে আনিয়া দাঁড় করাইল, সেটি পরিত্যক্ত একদিকের মহলের পুরাতন অব্যবহার্য একটি ঘর।

মরচে-পড়া তালা খুলিয়া লাবণ্যকে ভিতরে ঢুকাইয়া তাহার হাতে একটি দেশলাই দিয়া মহিম বলিল, ‘আচ্ছা, এই দেশলাইটা জ্বালো দেখি।’

লাবণ্য দেশলাই জ্বালাইতেছিল, হঠাৎ পিছনে দরজা বন্ধের শব্দ শুনিয়া সবিস্ময়ে তাকাইয়া দেখিল, স্বামী বাহিরে গিয়া দরজা ভেজাইয়া দিয়াছেন। শুধু তাই নয়, দরজায় শিকলি তোলার শব্দও পাওয়া গেল।

এ আবার কিরকম ঠাট্টা! লাবণ্য বলিল, ‘ও কি করছ? ভাঁড়ার এলো রেখে এসেছি। এখন আমার রঙ্গ করবার সময় নেই। খোল তাড়াতাড়ি।’

কিন্তু দরজার ওদিক হইতে কোনও সাড়াশব্দ শোনা গেল না।

লাবণ্য আবার বলিল, ‘এখন কি ছেলেমানুষির সময়। তোমার এঁটো থালা-বাটি সব পড়ে আছে পিসীমা, ঠাকুরঝি কেউ খায়নি—খোল।’

কিন্তু তথাপি কেহ উত্তর দিল না।

এবার লাবণ্যের ভয় হইল। অন্ধকার ঘরের ভিতর কিছুই দেখা যায় না—শুধু এখানে-ওখানে নানাপ্রকার শব্দ হইতে থাকে।

লাবণ্য দরজায় সবেগে করাঘাত করিয়া নববধূর পক্ষে অশোভন উচ্চ কাতর কণ্ঠে ডাকিল, ‘ওগো, কেন এমন করছ? খুলে দাও, আমার ভয় করছে।’

কোথাও কাহারও সাড়াশব্দ নাই। স্বামীকে সে একটু চিনিতে শিখিয়াছে! —মনে হইল যদি সে দরজায় তালা দিয়া একেবারে চলিয়াই গিয়া থাকে। যদি এ ক্ষণিকের পরিহাস না হয়?

ভাবিতেই তাহার সর্বাঙ্গে কাঁটা দিয়া উঠিল। এখান হইতে চিৎকার করিয়া গলা চিরিয়া ফেলিলেও কেহ যে শুনিতে পাইবে না এ-কথা সে ভাল করিয়াই বোঝে। এই অন্ধকার নির্জন পরিত্যক্ত ঘরে তাহাকে সারা দিন রাত্রি কতক্ষণ যে কাটাইতে হইবে কে জানে! আশঙ্কায় উদ্বেগে কাঁদিয়া ফেলিয়া আর একবার স্বামীকে মিনতি করিয়া কাতর স্বরে সে বলিল, ‘ওগো, তোমার পায়ে পড়ি, খুলে দাও, কেন আমায় এমন করে কষ্ট দিচ্ছ?’

সে-মিনতি কেহ শুনিল না। শুনিবার কেহ ছিল বলিয়াও মনে হয় না।

কতক্ষণ এইভাবে যে তাহার কাটিয়াছে সে জানে না। ভয়ের চরম অবস্থা পার হইয়া অবসাদে তাহার সমস্ত দেহমন তখন প্রায় নিস্পন্দ হইয়া আসিয়াছে। লাবণ্যের মনে হইল, কে যেন দরজার পাশ দিয়া চলিয়া যাইতেছে। প্রাণপণে চেষ্টা করিয়া সে ডাকিল, ‘কে?’

বাহিরের পদশব্দ থামিল।

লাবণ্য অস্ফুট কণ্ঠে আর এর বলিল, ‘আমায় খুলে দাও না গো!’

পরমুহূর্তেই সুমধুর হাস্যধ্বনি শোনা গেল, ‘ওমা, তুই এখানে!’

তাহার পর শিকলি খুলিয়া ঘরে ঢুকিয়া মাধুরী বলিল, ‘আর আমি এই ভেবে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে আছি যে তুই পালিয়ে গেছিস! দেখ দেখি তোর অন্যায়! এমন করে মানুষকে হতাশ করে?’

তাহার কথায় বুঝি মড়ার মুখেও হাসি ফোটে। ম্লান হাসিয়া লাবণ্য বলিল, ‘যমের বাড়ি ছাড়া পালাব কোথায় ঠাকুরঝি!’

যেন সাগ্রহে তাহার মুখের কাছে মুখ আনিয়া মাধুরী বলিল, ‘দূর, যমের বাড়ি যাবি কেন? পৃথিবীতে আর জায়গা নেই। পালাবি বলে, সব বন্দোবস্ত করে দিই তাহলে? বাড়ির মাছিটি পর্যন্ত টের পাবে না।’

তাহার কথার ধরনে এত দুঃখেও লাবণ্যের মুখে আবার হাসি দেখা দিল। খানিক চুপ করিয়া থাকিয়া হঠাৎ জিজ্ঞাসা করিয়া বসিল, ‘কিন্তু ও কেন অমন করে ঠাকুরঝি, বলতে পার? কি আমার অপরাধ?’

‘তোর অপরাধ নয়? মরতে কেন এ-বাড়িতে তুই এসে জুটেছিস? পালাতে বললাম, তা কথাটা যেন গায়েই মাখলি না—তোর অপরাধ নয়?’ কিন্তু খানিক বাদেই গম্ভীর হইয়া বলিল, ‘এ-বাড়ির এমন দশা কেন জানিস?’

লাবণ্য তাহার গলার স্বরে বিস্মিত হইয়া উৎসুকভাবে জিজ্ঞাসা করিল, ‘কেন?’

মাধুরীর উত্তেজিত কণ্ঠ শোনা গেল, ‘মেয়েমানুষের শাপে ; হাজার হাজার মেয়েমানুষের শাপে এ-বাড়ির প্রত্যেকটি ঘরের ভিৎ পর্যন্ত ঝাঁজরা হয়ে গেছে। সাতপুরুষ ধরে এরা মেয়েমানুষের এমন অপমান লাঞ্ছনা নেই, যা করেনি। তাদের সে-অভিশাপ যাবে কোথায়! যা নিয়ে একদিন ছিনিমিনি খেলেছে তারই জন্য দুর্ভাবনা আজ তোর বরের বুক কুরে-কুরে খাচ্ছে! ও যে সেই বংশের শেষ বাতি!’

কথা কহিতে কহিতে তাহারা তখন অঙ্গনের আলোকে নামিয়া আসিয়াছে। সে-আলোয় মাধুরীর মুখের চেহারা দেখিয়া লাবণ্যের বিস্ময়ের আর সীমা রহিল না। অমানুষিক রাগে ও ঘৃণায় তাহার সেই পরম সুন্দর মুখ বীভৎস হইয়া উঠিয়াছে।

মাধুরীর সব কথা ভাল করিয়া লাবণ্য সেদিন বুঝিতে পারে নাই। কিন্তু তাহার মনের কোণে একটি অহেতুক আতঙ্কের সঞ্চার হইয়াছিল। সে-আতঙ্ক স্বামীর আচরণে ক্রমশ বাড়িয়াই চলিল।

স্বামীকে এখন প্রায়ই দূরে যাইতে হয়। ছুতা করিয়া নয়, সোজাসুজি সবলেই মহিম তাহাকে ঘরের ভিতর পুরিয়া চাবি বন্ধ করিয়া দিয়া যায়। স্বামী চলিয়া যাইবার পর মাধুরী আসিয়া তাহাকে মুক্ত করিয়া দেয়, এইটুকুই যা সান্ত্বনা। আবার স্বামী আসিবার পূর্বে মাধুরী তাহাকে ঘরের ভিতর পুরিয়া দরজা বন্ধ করিয়া রাখে।

কিন্তু একদিন এ-কৌশল ফাঁস হইয়া গেল।

মহিম তাহাকে বন্দী করিয়া চলিয়া গিয়াছিল। মাধুরী আসিয়া দরজা খুলিয়া বলিল, ‘মজা দেখবি তো আয়—’

‘কি মজা?’

‘পিসীমার ঘরে কি আছে দেখবি? পিসীমা আজ ভুলে ঘরে তালা না দিয়েই কোথায় বেরিয়েছে।’

সভয়ে লাবণ্য বলিল, ‘না, না, দরকার নেই, পিসীমা এসে পড়বে।’

কিন্তু মাধুরী ছাড়িবার পাত্রী নয়, বলিল, ‘এলেই বা ; মেরে তো আর ফেলতে পারবে না দু-দুটো জোয়ান মেয়েকে!’

লাবণ্য তবুও আপত্তি করিতেছিল, মাধুরী তাহাকে একরকম জোর করিয়াই টানিয়া লইয়া গেল।

পিসীমা ঠিক তালা দিতে ভোলেন নাই তবে দৈবাৎ চাবি ঠিক লাগে নাই, তালা আলগাই আছে। মাধুরী দরজা খুলিয়া লাবণ্যকে টানিয়া লইয়া ঘরে প্রবেশ করিল।

ঘর অন্ধকার। সে-অন্ধকারে চোখ অভ্যস্ত হইয়া যাওয়ার পর দেখা গেল, সঙ্কীর্ণ ঘরে কোথাও আর স্থান নাই, ছোট বড় বাক্স-পেঁটরা, সিন্দুক, বাসন-কোসন, কাপড়-চোপড়ে ছাদ পর্যন্ত বোঝাই হইয়া আছে।

লাবণ্য ভয়ে ভয়ে বলিল, ‘দেখা তো হল, চল, এবার যাই।’

মাধুরী বলিল, ‘দূর, এখনো কিছুই দেখিসনি।’ তাহার পর ঝট করিয়া একটা বাক্সের তালা খুলিয়া সে প্রথমেই যে-জিনিসটি বাহির করিয়া আনিল, অন্ধকারেও তাহার স্বরূপ বুঝিয়া লাবণ্য চমকাইয়া উঠিল। —সে-কালের জড়োয়া গহনা। লাবণ্যের মনে হইল, অন্ধকারে তাহার মূল্যবান পাথরগুলি হিংস্র সরীসৃপের চোখের মতই যেন তাহার দিকে ক্রূর দৃষ্টিতে চাহিয়া আছে। লাবণ্যের বুকের ভিতরটা অকারণ ভয়ে শুকাইয়া আসিতেছিল। বলিল, ‘চল, চল, ঠাকুরঝি, আমার ভাল লাগছে না।’

‘তুই তো আচ্ছা ভয়-কাতুরে!’ মাধুরী সশব্দে সমস্ত বাক্সটা মেঝের উপর উজাড় করিয়া ফেলিয়া বলিল, ‘নে, বেছে নে। বুড়ীর ঘরে এমন জিনিস জমা হয়ে থেকে কোনও লাভ আছে কি?’

‘না, না, ঠাকুরঝি চল।’ কিন্তু মাধুরীর চোখ দুইটাও তখন কিসের উন্মত্ততায় জ্বলিতেছে। বাক্সের পর বাক্স, পাত্রের পর পাত্র সে মেঝের উপর উপুড় করিয়া ফেলিতেছিল। কঠিন স্বরে বলিল, ‘না, দেখি আগে সব।’

গহনা, টাকা, মোহর, মণিরত্ন—এই প্রাচীন লুপ্তপ্রায় পরিবারের সমস্ত সম্পদ বৃদ্ধা বুঝি তাহার ঘরে সঞ্চিত করিয়া রাখিয়াছ। সেই সম্পদ আগলাইয়া ডাইনীর মত সে দিনরাত্রি বসিয়া থাকে—অন্ধকারে তাহাদের দিকে চাহিয়া থাকিতে থাকিতে প্রাণহীন প্রস্তরের অস্বাভাবিক জ্যোতির প্রখরতা তাহার চোখেও যেন ফুটিয়া উঠিয়াছে।

সহসা লাবণ্য ‘মাগো’ বলিয়া অস্ফুট চিৎকার করিয়া উঠিল। মাধুরী চোখ তুলিয়া দেখিল, বৃদ্ধা দরজায় দাঁড়াইয়া হিংস্র শ্বাপদের মত তাহাদের দিকে চাহিয়া আছে। সে শুধু এক মুহূর্তের জন্য—পরক্ষণেই শোনা গেল বৃদ্ধা সশব্দে দরজা বন্ধ করিয়া বাহির হইতে শিকল তুলিয়া দিতেছে। সঙ্গে সঙ্গে মাধুরীর কলহাস্যে ঘর মুখরিত হইয়া উঠিল।

লাবণ্য কাতর কণ্ঠে বলিল, ‘কি হবে ঠাকুরঝি!’

‘হবে কি আবার, গয়না পরি আয়—!’ বলিয়া মাধুরী একছড়া মুক্তার হার লাবণ্যের গায়ের উপর ছুঁড়িয়া দিল।

সারাদিন বন্দী থাকিবার পর সন্ধ্যায় মহিম পিসীমার সহিত আসিয়া দরজা খুলিল। ইতিমধ্যে কি তাহাদের কথাবার্তা হইয়াছিল বলা যায় না কিন্তু মহিম এ-ব্যাপারের উল্লেখ পর্যন্ত করিল না। এক-গা গহনা পরিয়া পিসীমার দিকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি হানিয়া মহিমের দিকে ফিরিয়া ব্যঙ্গের হাসি হাসিয়া মাধুরী বাহির হইয়া গেল। পিসীমা বা মহিম তাহাকে কেহ কোন বাধা পর্যন্ত দিল না।

নীরবে রাত্রি কাটিল।

সকাল হইতে দুপুর পর্যন্ত কোন কথাই হইল না। বিকালে হঠাৎ মহিম আসিয়া বলিল, ‘চল, যেতে হবে।’

লাবণ্য সবিস্ময়ে স্বামীর মুখের দিকে চাহিল, কিছু বুঝিতে পারিল না।

মহিম আবার বলিল, ‘ওঠো, যেতে হবে!’

‘কোথায়?’

‘জানি না।’ মহিম আলনা হইতে একটা চাদর লইয়া তাহার গায়ের উপর ছুঁড়িয়া দিয়া বলিল, ‘আর কিছু নিতে হবে না, ওঠো!’

তাহার গলার স্বরে ভয় পাইয়া লাবণ্য উঠিয়া দাঁড়াইল। কাতর কণ্ঠে একবার শুধু প্রশ্ন করিল, ‘কোথায় যাবে?’

মহিম উত্তর দিল না। তাহার একটি হাত শক্ত করিয়া ধরিয়া ধীরে ধীরে অগ্রসর হইল।

আবার সেই অন্ধকার সুড়ঙ্গের মত পথ, আবার সেই হাঁটুভর জঙ্গল, ইট-কাঠের স্তূপ পার হইয়া লাবণ্য স্বামীর সহিত বাহির হইয়া আসিল। পিছনে বাড়ির আঙ্গিনায় সর্বাঙ্গ অলঙ্কারে ভূষিত করিয়া সুন্দরী মাধুরী তাহাদের যাত্রাপথের দিকে সকৌতুক দৃষ্টিতে চাহিয়াছিল, এইটুকু শুধু সে দেখিয়া আসিয়াছে। এ-বাড়িতে প্রথম প্রবেশের সময় যে-কলহাস্য তাহাকে অভ্যর্থনা করিয়াছিল, সেই কলহাস্যই বিদায়ের বেলায় তাহার কর্ণে ঝঙ্কৃত হইতে লাগিল।

ট্রেনে সারা পথ কোন কথা হয় নাই। শহরে আসিয়া যখন পৌঁছিল তখন রাত্রি হইয়াছে। তাহার উপর দারুণ দুর্যোগ! সারা শহরের উপর ঝড় ও বৃষ্টির উচ্ছৃঙ্খল মাতামাতি চলিয়াছে।

একটা গাড়ি ভাড়া করিয়া মহিম লাবণ্যকে লইয়া উঠিয়া বসিল। গাড়োয়ান জিজ্ঞাসা করিল, ‘কোথায় যেতে হবে হুজুর?’

‘যেখানে খুশি।’

গাড়োয়ান এমন কথা হয়তো আগেও শুনিয়াছে। সে দ্বিরুক্তি না করিয়াই গাড়ি হাঁকাইয়া দিল।

গাড়ি কিছুক্ষণ চলিবার পর মহিম প্রথম কথা বলিল এবং কথা বলিল যেন একেবারে নতুন মানুষ হইয়া।

বলিল, ‘তোমায় অনেক কষ্ট দিয়েছি লাবণ্য ; এতদিনের ব্যবহারে আমায় মনে মনে তুমি ঘৃণা করতে শুরু করেছ কিনা তাও জানি না; কিন্তু একটি কথা বুঝে আজ আমায় ক্ষমা করতে অনুরোধ করছি লাবণ্য। ও-বাড়ির হাওয়া পর্যন্ত বিষাক্ত—এইটুকু জেনে তুমি আমায় মার্জনা করতে পারবে না কি কখনো?’

অন্ধকারে ডান হাতটি বাড়াইয়া স্বামীর হাতটি খুঁজিয়া লাবণ্য এই স্নেহস্বরে অভিভূত হইয়া গিয়া বলিল, ‘কেন তুমি এসব কথা বলছ, বল দেখি। মনে আমার কিছু থাকলে তোমার সঙ্গে এমন করে আসতে পারতাম কি?’

মহিম গাঢ় স্বরে ডাকিল, ‘লাবণ্য!’

লাবণ্য স্বামীর বুকে মাথা রাখিয়া বলিল, ‘কি?’

‘আবার আমরা সহজ মানুষের মত সংসার আরম্ভ করতে পারি না কি লাবণ্য? সাতপুরুষের পাপ দেহ থেকে ধুয়ে ফেলে আবার নতুন জন্ম পাওয়া যায় না কি? যেখানে কেউ আমাদের জানে না এমন জায়গায়, একেবারে নতুন করে জীবন আরম্ভ করলে আবার আমি সহজ হতে পারব না কি?’

‘কেন পারবে না?’

‘তুমি জানো না লাবণ্য, কত বাধা, রক্তের ভেতর কত বিষ জমে আছে। কিন্তু এ-বিষ থেকে আমি মুক্ত হবই, শুধু যদি তোমার ভালবাসা পাই।‘

‘তোমায় আমি ভালবাসি না?’

‘বাসো, বাসো জানি, কিন্তু অসুস্থ মনে অকারণ সন্দেহ জাগে। সে-সন্দেহে মিছে পুড়ে মরি, তোমাকেও পোড়াই। তুমি শুনে হাসবে লাবণ্য কিন্তু তুমি ও-কথাটি প্রতিদিন আমাকে বলে স্মরণ করিয়ে দিলে আমি যেন জোর পাই।’

গাড়োয়ান ঝড়বৃষ্টির মধ্যে উদ্দেশ্যবিহীনভাবে ঘুরিয়া ঘুরিয়া হয়রান হইয়া একসময়ে বলিল, ‘সারা রাত ধরে তো ঘুরতে পারি না বাবু।’

‘আচ্ছা থাক।’ বলিয়া সেই ঝড়বৃষ্টির মধ্যে অপরিচিত স্থানেই মহিম হঠাৎ লাবণ্যের হাত ধরিয়া নামিয়া পড়িল।

গাড়োয়ান ভাড়া বুঝিয়া পাইয়া অবাক হইয়া কি ভাবিতে ভাবিতে চলিয়া গেল সেই জানে।

মহিম বলিল, ‘ভয় করছে না তো লাবণ্য?’

চাদরটা ভাল করিয়া মুড়ি দিয়া স্বামীর বুকের কাছে ঘেঁষিয়া দাঁড়াইয়া লাবণ্য বলিল—‘না, কিন্তু কোথায় যাবে?’

‘চল না যেদিকে খুশি। ঝড়বৃষ্টি থামলে যেখানে গিয়ে উঠব সেইখানে ভাবব আমাদের নবজন্ম হল।’

লাবণ্য কথা কহিল না। স্বামীর হাত ধরিয়া নীরবে চলিতে শুরু করিল।

উদ্দেশ্যহীন চলা। কোন সময়ে তাহারা ছোট্ট নদীটির ধারে আসিয়া পৌঁছিয়াছে জানিতেও পারে নাই। মহিম বলিল, ‘চল, ওই পোল পার হয়ে যাব!’

এবার লাবণ্য একটু ইতস্তত করিল। বলিল, ‘কিন্তু ও-পোল ভাঙা কিনা কে জানে, যদি পড়ে যাও!’

‘তুমিও আমার সঙ্গে পড়বে। পারবে না পড়তে?’

আবার তাহার চোখের সেই অদ্ভুত দৃষ্টি দেখিয়া লাবণ্য চমকিয়া উঠিল। গাড়ির নিরাপদ আশ্রয়ে লাবণ্যকে বুকের কাছে ধরিয়া যে-স্বপ্ন সে দেখিয়াছিল, এতখানি পথ হাঁটিতে হাঁটিতে তাহা মহিমের মন হইতে কখন লুপ্ত হইয়া গিয়াছে! কি বিশ্বাস নারীকে করা যায়? কি তাহার প্রেমের মূল্য ? আজ যে ভালবাসিয়াছে কাল বিশ্বাসঘাতকতা করিতে তাহার কতক্ষণ! তাহার চেয়ে এই মধুরতম মুহূর্তটিকেই চিরন্তন করিয়া রাখিয়া নিশ্চিন্ত হওয়া যায় না কি? এই সন্দেহের দোলা হইতে চিরদিনের মত রক্ষা পাইয়া তাহার ক্লান্ত মন যে তাহা হইলে পরম বিশ্রাম লাভ করিতে পারে। ভালবাসা, জীবনে যদি আপনাকে অপমানই করে তখন তাহাকে মৃত্যুর মধ্যে অমর করিয়া রাখিলে ক্ষতি কি?

লাবণ্যের হাত ধরিয়া দোদুল্যমান সেতুর উপর দিয়া লইয়া যাইতে যাইতে অকস্মাৎ মহিম তাহাকে ঠেলিয়া দেয…

তাহার পরের কথা বলিয়াছি। আমার কাহিনী ওইখানেই আসিয়া থামিয়াছে। পোল পার হইয়া মহিম লাবণ্যকে লইয়া কোথায় গিয়াছে আমি জানি না। আমার কল্পনার অন্ধকারে তাহারা বিলীন হইয়া গিয়াছে।

কে জানে, মাধুরী হয়তো সেই জনহীন ধ্বংসাবশিষ্ট প্রাসাদের কক্ষে কক্ষে এখনো প্রেতিনীর মত ঘুরিয়া বেড়ায়। হয়তো আর কোথাও জীবনের সেতু হইতে মহিম লাবণ্যকে কবে ঠেলিয়া দিয়াছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *