হযরত ইয়াকূব (আ)
জন্ম ও বংশপরিচয়
হযরত ইয়াকুব (আ) আনু. ১৮৩৬ খৃ. পূ. সালে কান্আন (বর্তমান ফিলিস্তীন)-এ জন্মগ্রহণ করেন (বাইবেল ডিকশনারী, পৃ. ২৩)। তাঁহার সময়কাল সাধারণ হিসাব অনুসারে খৃ. পূ. ১৮শ শতক (Colliers Encyclopedia, ১৩ খ., পৃ. ৪২৭) এবং তাফসীরে মাজেদীর বর্ণনামতে খ্র. পূ. ২০০০ সাল হইতে ১৮৫৩ খৃ. পূ. (১খ., পৃ. ২৪৬, টীকা ৪৭৫, ই. ফা.-র বাংলা সং)। তিনি ছিলেন হযরত ইসহাক (আ)-এর পুত্র এবং হযরত ইবরাহীম (আ)-এর পৌত্র। এই বংশলতিকা কুরআন মজীদ কর্তৃক স্বীকৃত। মহান আল্লাহ বলেন :
“আমি ইবরাহীমকে দান করিয়াছিলাম ইসহাক এবং অতিরিক্ত পৌত্ররূপে ইয়াকূব” (দ্র. ২১ : ৭২)।
হাদীস শরীফে ইহার প্রমাণ বিদ্যমান। রাসূলুল্লাহ (স) এক ব্যক্তির জিজ্ঞাসার উত্তরে বলেন :
“সর্বাধিক সম্মানিত ব্যক্তি হইলেন আল্লাহর নবী ইউসুফ, তিনি ছিলেন আল্লাহর নবী (ইয়াকূব)-এর পুত্র, ইয়াকূব (আ) ছিলেন আল্লাহর নবী (ইসহাক)-এর পুত্র” (বুখারী, ১খ., পৃ. ৪৭৮, কিতাবুল আম্বিয়া, বাব ১৫; মুসলিম, ফাদাইল, বাংলা অনু., ৭খ., পৃ. ৩৬৮)।
বুখারীর অন্যত্র হাদীছটি এভাবে বর্ণিত হইয়াছে :
“ইবন উমার (রা) হইতে বর্ণিত। নবী (স) বলেন : মর্যাদাবান ব্যক্তি, মর্যাদাবান ব্যক্তির পুত্র, মর্যাদাবান ব্যক্তির পুত্র, মর্যাদাবান ব্যক্তির পুত্র ইউসুফ ইব্ন ইয়াকূব ইবন ইসহাক ইব্ন ইবরাহীম আলায়হিমুস সালাম (আম্বিয়া, বাব ১৯, নং ৩১৩২, ৩, পৃ. ৩৭২; আরও দ্র. তাফসীর সূরা ১২, নং ৪৩২৭, ৪খ., পৃ. ৪৩০)।
তাহার মাতার নাম রিকা (রিকা)। তিনি ছিলেন পিতা-মাতার জমজ সন্তান। বাইবেলের ব্যাখ্যা অনুসারে ইয়াকূব (পাদগ্ৰাহী) শব্দটি হিব্রু বিশেষ্যপদ ‘আকিব (পায়ের গোছা) হইতে গৃহীত। কারণ তিনি তাঁহার মাতার গর্ভ হইতে তাঁহার জমজ ভ্রাতা এসূ-এর পাদমূল ধরিয়া ভূমিষ্ঠ হন (দ্র. বাইবেলের আদিপুস্তক, ২৫ ও ২৬)। আরবী ভাষায়ও উক্ত শব্দের অর্থ পায়ের গোছা ও পশ্চাদবর্তী (দ্র. অভিধান)।
হযরত ইয়াকূব (আ) ও তাঁহার পিতা হযরত ইসহাক (আ) ছিলেন হযরত ইবরাহীম (আ) ও তাঁহার স্ত্রী সারার জন্য আল্লাহ তাআলার দানস্বরূপ । এই প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন :
“আর আমি তাহাকে দান করিয়াছিলাম ইসহাক ও ইয়াকূব, ইহাদের প্রত্যেককে আমি সৎপথে পরিচালিত করিয়াছিলাম” (৬ ও ৮৪; আরও দ্র. ২১ : ৭২; ২৯ ও ২৭; ১১ : ৭১)।
কতক তাফসীরকারের মতে হযরত ইয়াকূব (আ) তাঁহার দাদা হযরত ইবরাহীম (আ)-এর জীবদ্দশায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহারা সূরা বাকারার ১৩২ নম্বর আয়াতে উদ্ধৃত ইয়াকূব শব্দটিকে মাফউল (কর্মকারক)-এর পরিবর্তে ফাইল (কর্তৃকারক) হিসাবে পাঠ করেন। আয়াতটি নিম্নরূপঃ
“এবং ইবরাহীম ও ইয়াকূব এই সম্বন্ধে তাহাদের পুত্রগণকে ওসিয়ত করিয়াছিলেন” (২৪ ১৩২)।
ইহা হইল আয়াতের সর্বজনগ্রাহ্য অর্থ। কিন্তু ইয়াকূবকে মাফউল সাব্যস্ত করিলে আয়াতের অর্থ হয় : “এবং ইবরাহীম এই সম্বন্ধে তাহার পুত্রগণকে ও ইয়াকূবকে ওসিয়াত করিয়াছিলেন। তাফসীরে ইব্ন কাছীর-এ এই মতকে অগ্রাধিকার প্রদান করা হইয়াছে এবং ইহার সমর্থনে ইব্ন কাছীর ১১৪ ৭১; ২৯ : ২৭ ও ২১ : ৭২ আয়াতত্রয় পেশ করিয়াছেন। উক্ত আয়াতসমূহে আল্লাহ তাআলা ইবরাহীম (আ)-কে দান করিয়াছেন বলা হইয়াছে। আর দান তো জীবদ্দশায়ই হইয়া থাকে (বিস্তারিত দ্র. তাফসীরে ইবন কাছীর, বাংলা অনু., ১খ., পৃ. ৫৭৩; বিদায়া, ১খ., পৃ. ১৯৫)।
বাইবেল ও বাইবেল ভিত্তিক রচনাবলীর বর্ণনা অনুসারে হযরত ইসহাক (আ) এসূকে অধিক স্নেহ করিতেন এবং স্ত্রী রিক্কা অপর পুত্র ইয়াকূবকে অধিক স্নেহ করিতেন। এক পর্যায়ে রেষারেষির সৃষ্টি হইলে মাতা তাহাকে নিজ ভ্রাতা লাভান-এর নিকট হাররান বা পাদ্দান আরাম (বর্তমান উত্তর মেসোপটামিয়া)-এ পাঠাইয়া দেন (বাইবেলের আদিপুস্তক, ২৭ : ৪১-৬) তথায় তিনি মামার মেষপাল চরাইতেন। ইহার দ্বারা মহানবী (স)-এর একটি বাণী স্বতঃসিদ্ধ প্রমাণিত হয়। তিনি বলেন : “এমন কোন নবী নাই যিনি মেষপাল চরান নাই”। সেখানে তিনি এক পর্যায়ে দুই সহোদর মামাতো বোনকে বিবাহ করেন এবং পরবর্তী কালে দুই স্ত্রী ও তাহাদের দুই দাসীকে লইয়া কাননে প্রত্যাবর্তন করেন। তৎকালীন শরীআতে দুই সহোদরাকে একইসঙ্গে বিবাহ করা বৈধ ছিল। এজন্যই আল্লাহ তাআলা বলিয়াছেনঃ
“এবং আরও এই যে, দুই ভগিনীকে একত্রে বিবাহ করা, পূর্বে যাহা হইয়াছে তো হইয়াছে” (৪ : ২৩; আল-কামিল, ১খ., পৃ. ৯৬)।
মামার বাড়িতে যাওয়ার পথে তিনি এক স্থানে যাত্রাবিরতি করিলেন এবং রাত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্বপ্ন দেখিতে পাইলেন যে, আল্লাহ তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “আমি সদাপ্রভু, তোমার পূর্বপুরুষ ইবরাহীম ও ইসহাকের প্রতিপালক প্রভু। তুমি যে ভূমিতে শুইয়া আছ, ইহা আমি তোমাকে ও তোমার বংশধরগণকে দান করিব ….” (দ্র. বাইবেলের আদিপুস্তক, ২৮ : ১০-২২)।
ইব্ন কুতায়বা আদ-দীনাওয়ারীর মতে স্বপ্নের বিষয়বস্তু এই যে, মহামহিম আল্লাহ তাঁহার নিকট ওহী পাঠাইলেন যে, “আমিই আল্লাহ, আমি ব্যতীত কোনও ইলাহ নাই, তোমার ইলাহ এবং তোমার পূর্বপুরুষগণের ইলাহ। আমি তোমাকে এই পবিত্র ভূমির উত্তরাধিকারী বানাইলাম এবং তোমার পরে তোমার বংশধরগণকেও। আমি তোমাকে ও তাহাদেরকে প্রাচুর্য দান করিলাম, তোমাদের মধ্যে কিতাব, হিকমাত ও নবওয়াত দান করিলাম। আমি এই স্থানে পৌঁছা পর্যন্ত তোমার সঙ্গে আছি এবং আমি তোমার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করিলাম। তুমি ইহাতে একটি ঘর বানাও যাহাতে তুমি ও তোমার বংশধরগণ আমার ইবাদত করিবে। ইহাই বায়তুল মাকদিস” (আল-মাআরিফ, পৃ. ২৩)।
কুরআন মজীদে হযরত ইয়াকুব (আ)
কুরআন মজীদে নামসহ খোলবার হযরত ইয়াকূব (আ)-এর প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হইয়াছে এবং সর্বনামরূপে আরও কয়েক স্থানে তাহার প্রসঙ্গ আসিয়াছে। যেমন ২ : ১৩২, ১৩৩, ১৩৬, ১৪০; ৩ : ৮৪; ৪ : ১৬৩; ৬ ও ৮৪; ১১ ও ৭১; ১২ : ৬, ৩৮, ৬৮; ১৯ ও ৬, ৪৯; ২১ : ৭২; ২৯ : ২৭; ১৮: ৪৫। এইসব স্থানে হযরত ইয়াকূব (আ) সম্পর্কে যে তথ্যাবলী উক্ত আছে তাহা মূল পাঠসহ নিবন্ধের সংশ্লিষ্ট স্থানসমূহে উদ্ধৃত হইয়াছে।
ইয়াকুব (আ)-এর বৈবাহিক জীবন ও সন্তান-সন্তুতি
ইয়াকূব (আ) মাতুলালয়ে পৌঁছিয়া তাহার গবাদিপশু লালন-পালনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মামার দুই কন্যা ছিল, বড়জনের নাম লিয়া এবং ছোটজনের নাম রাহীল। সাত বৎসর পর ইয়াকূব (আ) মামার ছোট কন্যা রাহীলকে বিবাহ করিতে আগ্রহ প্রকাশ করিলেন। কিন্তু মামা তাঁহার সহিত জ্যেষ্ঠা কন্যা লিয়ার বিবাহ দিলেন। কারণ জ্যেষ্ঠা কন্যাকে অবিবাহিত রাখিয়া কনিষ্ঠা কন্যার বিবাহদান তাহাদের রীতিবিরুদ্ধ ছিল (বিদায়া, ১খ., পৃ. ১৯৫)। অবশ্য পরে আরো সাত বৎসর (বিদায়া, ১খ., পৃ. ১৯৫; বাইবেলের আদিপুস্তক, ২৯ ও ২৭) মামার পশুপাল চরাইবার পর তিনি তাহার কাঙ্খিত মামাত ভগিনী রাহীলকেও বিবাহ করিতে সক্ষম হইলেন। তৎকালে একত্রে দুই বোনকে বিবাহ করা বৈধ ছিল। তাহার কন্যা লিয়ার সহিত জুলফা (সিল্পা) ও রাহীলের সহিত বিলহা নাম্বী দুইটি দাসীও দান করেন। পরে দুই স্ত্রী স্ব স্ব দাসীকেও ইয়াকূব (আ)-এর সহিত বিবাহ দেন (বিদায়া, ১খ., পৃ. ১৯৫)।
আল্লাহ্ তাআলা এই চারজন স্ত্রীর গর্ভে ইয়াকূব (আ)-কে দ্বাদশ পুত্র ও এক কন্যা সন্তান দান করেন। প্রথম স্ত্রী লিয়ার গর্ভে রূবিল (রূবেন=পুত্রকে দেখ), শামউন (শিমিয়ন=শ্রবণ), লাবী (লেবী=আসক্ত), ইয়াহূ (যিহূদা=স্তব), ঈসাখর, অপর বর্ণনায় ইব্নসাখর (ইযাখর=বেতন) ও যাঈন (সবুলুন= বসবাস) নামে পাঁচ পুত্র সন্তান এবং রাহীলের গর্ভে হযরত ইউসুফ (যোশেফ= বৃদ্ধি) ও বিনয়ামীন (বিন্যামিন=দক্ষিণ হস্তের পুত্র), তৃতীয় স্ত্রী এবং রাহীলের দাসী বিলহার গর্ভে দান (বিচার) ও নাফতালী (মল্লযুদ্ধ), চতুর্থ স্ত্রী এবং লিয়ার দাসী যুলফার গর্বে জাদ, অপর বর্ণনায় হায় (গাদ=সৌভাগ্য) ও আশীর (ধন্য) জন্মগ্রহণ করে (বিদায়া, ১খ., পৃ. ১৯৭; আরও দ্র. পৃ. ১৯৫; আল-কামিল, ১খ, পৃ. ৯৫-৬; তাফসীরে তাবারী, বাংলা অনু., ২খ, পৃ. ৩৬৭-৮; বাইবেলের আদিপুস্তক, ২৯ ও ৩২-৩৫; ৩০ : ১-২৪; ৩৫ : ১৮ ও ২৩-২৬)। বিনয়ামীন ব্যতীত ইয়াকূব (আ)-এর সকল সন্তান তাঁহার মাতুলালয় হাররানে (তাবারীর মতে বাবিলে) জন্মগ্রহণ করেন।
ইয়াকূব (আ)-এর উসীলায় আল্লাহ্ তাআলা তাঁহার মামার সম্পদে, বিশেষত গবাদিপশুতে প্রচুর বরকত ও প্রাচুর্য দান করেন। তিনি মোট বিশ বৎসর মাতুলালয়ে অবস্থান করেন (বিদায়া, ১খ., পৃ. ১৯৫)। পরে আল্লাহ তাআলা ওহীর মাধ্যমে ইয়াকূব (আ)-কে তাঁহার পিতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তনের নির্দেশ দান করেন এবং তাঁহাকে সহায়তা দানের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন (বিদায়া, ১খ., পৃ. ১৯৫)। তদনুযায়ী তিনি সপরিবারে প্রচুর সম্পদসহ পিতৃভূমি হেব্রনে ফিরিয়া আসেন। আসার পথে রাহীল “আফরাছ” (ইফরাত বা বেথেলহাম) নামক স্থানে বিনয়ামীনকে প্রসব করার পরপরই ইনতিকাল করেন। ইয়াকূব (আ) তাহাকে এখানেই দাফন করেন এবং তাহার কবরের উপর একটি প্রস্তর স্তম্ভ স্থাপন করেন (বিদায়া, ১খ., পৃ. ১৯৭; বাইবেলের আদিপুস্তক, ৩৫ ও ১৬-২০)।
ইব্ন কাছীর (র) আহলে কিতাবের বরাতে উল্লেখ করেন যে, কানআনে বসবাসকালে ইয়াকূব (আ)-এর একমাত্র কন্যা দীনাকে এতদঞ্চলের রাজপুত্র শিখীম অপহরণ করে। শিখীমের পিতা জামূর (হমোর) তাহার পুত্রের সহিত এই কন্যাকে বিবাহ দেওয়ার প্রস্তাব করিলে ইয়াকূব (আ)-এর পুত্রগণ বলিলেন যে, তাহারা খাতনাহীনদের সহিত আত্মীয়তা করেন না। যদি তাহারা সকলে খাতনা করিতে সম্মত হয় তবে উক্ত প্রস্তাব গ্রহণ করা যাইতে পারে । তাহারা খাতনা করিবার তৃতীয় দিনে অসুস্থ হইয়া পড়িল। এই সুযোগে ইয়াকূব (আ)-এর পুত্রগণ রাজ-পরিবারে আক্রমণ চালাইয়া শিখীম ও তাহার পিতাসহ বহু লোককে হত্যা করেন। এই আক্রমণে রাজবংশের শক্তি খর্ব হইয়া যায় (দ্র. আদিপুস্তক ৩৪ : ১-৩১)। বাইবেলে বর্ণিত এই ঘটনাটি নবী পরিবারের মর্যাদার পরিপন্থী বিধায় গ্রহণযোগ্য নহে।
কুরআন মজীদ হইতেও ইয়াকূব (আ)-এর বারজন পুত্র থাকার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ইউসুফ (আ) তাঁহার পিতার নিকট তাঁহার স্বপ্নের কথা এইভাবে ব্যক্ত করেন :
“হে আমার পিতা! নিশ্চয় আমি দেখিয়াছি একাদশ নক্ষত্র, সূর্য ও চন্দ্রকে, আমি এইগুলিকে আমার প্রতি সিজদাবনত অবস্থায় দেখিয়াছি” (১২ ও ৪)।
ইব্ন আব্বাস (রা)-র মতে একাদশ নক্ষত্র অর্থ ইউসুফ (আ)-এর একাদশ ভ্রাতা এবং সূর্য ও চন্দ্র অর্থ তাঁহার পিতা-মাতা (তাফসীরে ইব্ন আব্বাস, পৃ. ১৯৩; তাফসীরে উছমানী, সৌদী সং, পৃ. ৩১২, টীকা ২; মাআরেফুল কোরআন, সংক্ষিপ্ত সৌদী সং, পৃ. ৬৫১, কলাম ২; তাফহীমুল কুরআন, সূরা ইউসুফ, ৪ নং টীকা)। ইবন আব্বাস (রা)-র মতে ইউসুফ (আ)-এর স্বপ্ন দর্শনকালে তাঁহার হযরত ইয়াকূব (আ) মাতা রাহীল জীবিত ছিলেন (তাফসীরে ইব্ন আব্বাস, পৃ. ১৯৩)। তাফসীরে কুরতুবীতে বলা হইয়াছে যে, তখন তাঁহার মাতা জীবিত ছিলেন না, তাঁহার সত্যতা লিয়া জীবিত ছিলেন। শেষোক্ত মত সত্য হইলে ইয়াকূব (আ) সপরিবারে মিসর গমনকালেও লিয়া জীবিত ছিলেন। কারণ ইউসুফ (আ)-এর রাজ-দরবারে তাহাদের উপস্থিতি প্রসঙ্গে কুরআন মজীদে বলা হইয়াছে :
“এবং ইউসুফ তাহার মাতা-পিতাকে উচ্চাসনে বসাইল এবং তাহারা সকলে তাহার সম্মানে সিজদায় লুটাইয়া পড়িল” (১২ : ১০০)।
বাইবেল হইতে জানা যায় যে, লিয়া ইয়াকূব (আ)-এর জীবদ্দশায় মারা যান (আদিপুস্তক, ৪৯ : ৩১)। তাঁহার অপর স্ত্রীদ্বয় কখন মৃত্যুবরণ করেন সেই সম্পর্কে কিছু জানা যায় না।
হযরত ইয়াকূব (আ) পুত্রগণের মধ্যে বৃদ্ধ বয়সের পুত্র ইউসুফ (আ)-কে সর্বাধিক স্নেহ করিতেন। স্বপ্নের বিবরণ শুনিয়াই তিনি তাঁহাকে নিজ ভ্রাতাদের নিকট তাহা গোপন রাখার উপদেশ দেন, যাহাতে তাহারা তাহার ক্ষতিসাধন করিতে না পারে (দ্র. ১২ : ৫)। ১২ : ৬ হইতে ১৮ আয়াত পর্যন্ত তাহার বিরুদ্ধে সৎ ভ্রাতাদের ষড়যন্ত্র ও তাহা বাস্তবায়নের ঘটনা উল্লিখিত হইয়াছে। সর্বাধিক প্রিয় সন্তানকে হারাইয়া হযরত ইয়াকূব (আ) পুত্রশোকে এক পর্যায়ে দৃষ্টিশক্তি হারাইয়া ফেলেন এবং পরবর্তী কালে ইউসুফ (আ)-এর জামা তাঁহার মুখমণ্ডলে স্পর্শ করাইলে তিনি পুনরায় দৃষ্টিশক্তি লাভ করেন (দ্র. ১২ : ৮৪ ও ৯৬)। এক সময়ে কানআনে দুর্ভিক্ষের প্রাদুর্ভাব হইলে ইয়াকূব (আ) তাঁহার দশ পুত্রকে খাদ্যশস্য সংগ্রহের জন্য মিসরে প্রেরণ করেন। ইউসুফ (আ) তাহাদেরকে দেখিয়া চিনিয়া ফেলেন কিন্তু নিজের পরিচয় গোপন রাখেন, অবশ্য তাহারা তাহাকে চিনিতে পারে নাই (দ্র. ১২ ও ৫৮)। তিনি তাহাদেরকে পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য দান করেন, গোপনে তাহাদের ক্রয়মূল্য ফেরত দেন এবং তাহারা পুনর্বার আসিলে তাহাদের কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে সঙ্গে করিয়া আনিবার জন্য জোর তাগিদ দেন (দ্র. ১২ : ৫৯-৬২)। তাহাদের কনিষ্ঠ ভ্রাতা এবং ইউসুফ (আ)-এর সহোদর বিয়ামীনই ছিলেন তখন ইয়াকূব (আ)-এর সর্বাধিক স্নেহের পাত্র। মিসর হইতে ফিরিয়া আসিয়া তাহারা পিতাকে মিসরের শাসনকর্তার অনুরোধ সম্পর্কে অবহিত করিল এবং বিয়ামীনকে তাহাদের সঙ্গী করা হইলে তাহার নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতিও প্রদান করিল (১২ : ৬৩)। ইয়াকূব (আ) বিদায়কালে বলিলেন :
“আল্লাহই রক্ষণাবেক্ষণে শ্রেষ্ঠ এবং তিনি সর্বশ্রেষ্ট দয়ালু” (১২ ও ৬৪)।
দ্বিতীয়বার তাহারা মিসর পৌঁছিলে ইউসুফ (আ) তাঁহার সহোদরকে সুকৌশলে নিজের কাছে রাখিয়া দেন এবং নিজের পরিচয় সহোদরের নিকট ব্যক্ত করেন (দ্র. ১২ : ৬৯-৭৯)। বিয়ামীন মিসর হইতে প্রত্যাবর্তন না করায় ইয়াকূব (আ) আল্লাহর তরফ হইতে ইঙ্গিত পাইলেন যে, তাঁহার স্নেহের ধন ইউসুফ (আ) এখনো জীবিত আছেন। তিনি পুত্রদের সহিত সাক্ষাতের জন্য ব্যাকুল হইয়া উঠিলেন। এইজন্য তাহার অপর পুত্রগণ তাঁহার প্রতি অনুযোগ (দ্র. ১২ : ৮৬) করিলে তিনি বলেন :
“আমি আমার অসহনীয় বেদনা এবং আমার দুঃখ শুধু আল্লাহর নিকট নিবেদন করিতেছি। আমি আল্লাহর নিকট হইতে জানি যাহা তোমরা জান না” (১২ : ৮৬)। তৃতীয়বার তাহারা মিসর পৌঁছিলে ইউসুফ (আ) তাহাদের সামনে নিজের পরিচয় ব্যক্ত করেন, তাহাদের পূর্বের কৃতকর্মের কথা স্মরণ করাইয়া দেন এবং তাহাদের জন্য ক্ষমা ঘোষণা করেন এবং তাহাদের সকলকে সপরিবারে মিসরে চলিয়া আসিতে বলেন (দ্র. ১২ : ৮৬-৯৩)।
তখন তিনি স্পষ্টভাবে ইউসুফ (আ)-এর নাম উচ্চারণ পূর্বক তাহাদেরকে পুনরায় মিসরে যাইতে বলেন। তাহারা ইউসুফ (আ)-এর দরবারে উপস্থিত হইয়া অনুনয়-বিনয় করিয়া তাহাদের জন্য রসদ সরবরাহের আবেদন জানায়। তিনি তাহাদের সঙ্গে পিতার জন্য নিজের জামা প্রেরণ করেন (দ্র, ১২ : ৯৩)। চতুর্থবারের সফরে হযরত ইয়াকূব (আ) সপরিবারে মিসর গমন করেন। তাহারা শহরদ্বারে পৌঁছিলে ইউসুফ (আ) পিতা-মাতাকে আলিঙ্গনের মাধ্যমে অভ্যর্থনা জানাইয়া নির্ভয়ে ও নিরাপদে রাজধানীতে প্রবেশ করিতে বলেন। রাজ-দরবারে তিনি পিতা-মাতাকে তাঁহার পাশে বসান এবং দশ ভ্রাতা তাঁহাকে রাজকীয় সম্মান প্রদর্শন পূর্বক সিজদা করে (দ্র, ১২ : ৯৯-১০০)। তখন ইউসুফ (আ) বলেন :
“হে আমার পিতা! ইহাই আমার পূর্বেকার স্বপ্নের ব্যাখ্যা, আমার প্রতিপালক উহাকে সত্যে পরিণত করিয়াছেন” (১২৪ ১০০) দ্বাদশ পুত্র হইতে দ্বাদশ গোত্র
হযরত ইয়াকূব (আ)-এর দ্বাদশ পুত্র হইতে আল্লাহ তাআলা দ্বাদশ গোত্রের উম্মেষ ঘটান। এই সম্পর্কে কুরআন মজীদে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত বিদ্যমান ও
“আমি তাহাদেরকে দ্বাদশ গোত্রে বিভক্ত করিয়াছি” (৭ : ১৬০; আরও দ্র. ৫ : ১২; এবং ২ : ৬০)।
পুত্রগণের মধ্যে হযরত ইউসুফ (আ)-এর নবুওয়াত সম্পর্কে কুরআন মজীদে সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে, কিন্তু তাঁহার অবশিষ্ট ভ্রাতাগণ নবী ছিলেন কি না সেই বিষয়ে কোন উল্লেখ নাই। অধিকাংশ তাফসীরকারের মতে তাহারা নবী ছিলেন না (বিদায়া, ১খ, পৃ. ১৯৮)। অবশ্য কতক তাফসীরকার নিম্নোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় তাহারাও নবী ছিলেন বলিয়া মত প্রকাশ করিয়াছেন :
“এবং যাহা নাযিল হইয়াছে ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব ও তাহার বংশধরগণের উপর” (২৪ ১৩৬)।
“বল, আমরা ঈমান আনিয়াছি আল্লাহতে এবং আমাদের প্রতি যাহা অবতীর্ণ হইয়াছে এবং ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব ও তাহার বংশধরগণের প্রতি যাহা অবতীর্ণ হইয়াছে …….” (৩ : ৮৪)।
“এবং আমি ওহী প্রেরণ করিয়াছি ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব ও তাহার বংশধরগণের প্রতি” (৪ : ১৬৩)।
উক্ত আয়াতসমূহে উদ্ধৃত আসবাত শব্দটির (এ.ব. সিবৃত) অর্থ বংশধরও হইতে পারে এবং ইয়াকূব (আ)-এর বারজন পুত্রও হইতে পারে। ইব্ন আব্বাস (রা) ও ইবন জারীর তাবারী (র)-এর মতে আসবাত হইল ইয়াকূব (আ)-এর পুত্রগণ (তাফসীরে ইব্ন আব্বাস, ৩ ও ৮৪, পৃ. ৫১; তাফসীরে তাবারী, বাংলা অনু., ২খ, পৃ. ৩৬৭)। তাবারী আরও বলেন, আসবাত দ্বারা হযরত ইয়াকূব (আ)-এর সন্তানদের মধ্যে যাহারা নবী ছিলেন তাহাদেরকে বুঝায় (পৃ. ৩৬৬)।
ইব্ন কাছীর (র) বলেন, “আসবাত শব্দটি তাহাদের নবুওয়াত লাভের শক্তিশালী দলীল হইতে পারে না। কেননা আসবাত অর্থ শুউব বানী ইসরাঈল (ইসরাঈল-সন্তানগণের গোত্রসমূহ)। তাহাদের কাহারও প্রতি ওহী নাযিল হওয়ার কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না, যেভাবে ইউসুফ (আ) সম্পর্কে পাওয়া যায় (বিদায়া, ১খ., পৃ. ১৯৮-৯)।
সূরা ইউসুফের ঘটনাবলী হইতেও এই শেষোক্ত মতের সমর্থন পাওয়া যায়। পার্থিব স্বার্থকে কেন্দ্র করিয়া নবী-রাসূলগণের পরস্পরের মধ্যে কখনও সংঘাত বাঁধিবার কোন নযির ইসলামী ইতিহাসে বিদ্যমান নাই। অথচ ইউসুফ (আ)-এর সৎ ভ্রাতাগণ তারুণ্যে ও যৌবনে তাঁহাকে কঠিন বিপদে নিক্ষেপ করিয়া সন্ধ্যায় পিতার নিকট উপস্থিত হইয়া বানোয়াট বিবৃতি প্রদান করেন (দ্র. ১২ ৪ ৮-১৮)। প্রাপ্ত বয়সে মিসরে ইউসুফ (আ)-এর দরবারে উপস্থিত হইয়া তাহার ও তাঁহার ভ্রাতা বিয়ামীনের প্রতি চৌর্যবৃত্তির মিথ্যা অপবাদ আরোপ করেন (দ্র, ১২ : ৭৭) এবং ইউসুফ (আ)-এর সাক্ষাত পরিচয় পাওয়ার পর তাহারা মিসর হইতে পিতার নিকট কানআনে ফিরিয়া আসিলে তিনি তাহাদেরকে ইউসুফ (আ)-এর ঘ্রাণ পাইতেছেন বলিয়া জানাইলে তাহারা সত্য ঘটনাকে অস্বীকার করিবার সঙ্গে সঙ্গে পিতাকে বিভ্রান্ত বলিয়া আখ্যায়িত করেন (দ্র. ১২ : ৮৮-৯৫)। অথচ নবী-রাসূলগণ শিশুকাল হইতেই সরল-সহজ ও সৎ মানুষ হিসাবে বাড়িয়া উঠেন (এই সম্পর্কে তাফসীরে উসমানী, সৌদী সং, পৃ. ৩১২, টীকা ৩ দ্র.)। অবশ্য তাঁহার সৎ ভ্রাতাগণ আল্লাহর নিকট তওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া অনুতপ্ত হইলেন এবং পিতা ও ইউসুফ (আ)-ও তাহাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন (দ্র. ১২৪ ৯২ ও ৯৭-৮)।
হযরত ইয়াকূব (আ)-এর নবুওয়াত লাভ
ইয়াকূব (আ) ছিলেন আল্লাহ তাআলার একজন সম্মানিত মহান পয়গাম্বর, তিনি বিশেভভাবে কাআনবাসীদের মধ্যে আল্লাহর দীন প্রচারের জন্য প্রেরিত হইয়াছিলেন এবং এখানেই তিনি জীবনের অধিকাংশ কাল দীন ইসলামের প্রচার করেন (কাসাসুল কুরআন, উর্দু, ১খ., পৃ. ২৭৯)। মহান আল্লাহ তাঁহার নবুওয়াত সম্পর্কে বলেন
“এবং আমি তাহাকে দান করিলাম ইসহাক ও ইয়াকূব এবং প্রত্যেককে নবী করিলাম” (১৯ ও ৪৯)।
“আমি ওহী পাঠাইয়াছি ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব ও তাহার বংশধরগণের নিকট “ (৪ : ১৬৩)।
“বল, আমরা ঈমান আনিয়াছি আল্লাহ্তে এবং আমাদের প্রতি যাহা নাযিল হইয়াছে এবং ইবরাহীম, ইসমাঈল ইসহাক ও ইয়াকূব এবং তাহার বংশধরগণের প্রতি যাহা নাযিল হইয়াছে” (৩ : ৮৪; আরও দ্র. ২৪ ১৩৬ ও ২১ : ৭২)।
নবী-রাসূলগণের প্রধান দায়িত্ব হইল মানবজাতির নিকট আল্লাহর বাণী পৌঁছাইয়া দেওয়া, তাহা বুঝাইয়া দেওয়া এবং বাস্তবক্ষেত্রে তাহা কিভাবে কার্যকর করিতে হইবে তাহা দেখাইয়া দেওয়া। হযরত ইয়াকূব (আ) নবী হিসাবে নিশ্চয় এসব দায়িত্ব পালন করিয়াছেন, কিন্তু তিনি কিভাবে তাঁহার এলাকাবাসীর মধ্যে দীনের দাওয়াত পেশ করিয়াছেন এবং তাহা কতদূর ফলপ্রসূ হইয়াছে, ইতিহাসের গ্রন্থাবলীতে ইহার কোন বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় না। তবে এতখানি জানা যায় যে, তাহার এলাকায় তখনও পৌত্তলিক কাআন বংশীয়রা রাজত্ব করিত। তিনি সপরিবারে তাঁহার মাতুলালয় হইতে কাআনে ফিরিয়া আসিবার পর তাহার কন্যাকে কাআন বংশীয় এক রাজপুত্র অপহরণ করিয়াছিল। পরবর্তীতে ইয়াকূব (আ)-এর সন্তানগণের হাতে উক্ত রাজবংশের পতন ঘটে (দ্র. আদিপুস্তক, ৩৪ : ১-৩১)। এই ঘটনার পর হইতে অত্র এলাকায় ইয়াকূব (আ)-এর দাওয়াতের বরকতে পৌত্তলিকতার অবসান ঘটিতে থাকে এবং জনগণ দীন ইসলাম গ্রহণ করিতে থাকে। এক পর্যায়ে এই এলাকা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে পরিণত হয়। অতঃপর হযরত ইয়াকূব (আ) এখানে আল্লাহর ঘর বায়তুল মাকদিস নির্মাণ করেন। বর্তমান কালে ইহা ইয়াহুদী-খৃস্টান-মুসলিম এই তিন জাতির পবিত্র স্থানরূপে স্বীকৃত।
ইহা ব্যতীত নিবন্ধের বিভিন্ন স্থানে তাঁহার নবুওয়াতের বিষয় সংক্রান্ত আয়াতসমূহ উদ্ধৃত হইয়াছে। হযরত ইয়াকূব (আ)-এর নবী জীবনের অধিকাংশ বিবরণ সূরা ইউসুফ-এ হযরত ইউসুফ (আ)-এর সহিত সংশ্লিষ্ট।
হযরত ইয়াকূব (আ)-এর মিসর গমন ও অন্তিম জীবন
হযরত ইয়াকূব (আ) তাঁহার মাতৃভূমি মেসোপটামিয়া হইতে সপরিবারে প্রত্যাবর্তনের পর জন্মভূমি কাআনেই (ফিলিস্তীন) বসবাস করিতে থাকেন। জীবনের শেষ পর্যায়ে খৃ. পূ. ১৭০৬ অব্দে
হযরত ইয়াকূব (আ)
(বাইবেল ডিকশনারী, পৃ. ২৩), পুত্ৰ ইউসুফ (আ)-এর আবেদনক্রমে ৭০ সদস্যবিশিষ্ট (Americana, ১৫/৬৫) পরিবার-পরিজনসহ তিনি মিসরে গমন করেন (আহলে কিতাব মতে), মিতে ৭৩, অপর মতে ৮৩, আরেক মতে ৩৯০ জন (বিদায়া, ১খ., পৃ. ২১৮)। ৮০ বৎসর পর, হাসান বসরীর (র) মতে ৮৩ বৎসর, কাতাদার (র) মতে ৩৫ বৎসর, ইবন ইসহাকের (র) মতে ১৮ বৎসর এবং আহলে কিতাবমতে ৪০ বৎসর পর পিতা-পুত্রের পুনর্মিলন হয় (বিদায়া, ১খ., পৃ. ২১৭)।
ইব্ন ইসহাক আহলে কিতাবের বরাতে বলেন, হযরত ইয়াকূব (আ) মিসরে আগমনের পর এখানে ১৭ বৎসর জীবিত ছিলেন (বিদায়া, ১খ., পৃ. ২২০; আদিপুস্তক, ৪৭ : ২৮)। কিন্তু Colliers Enyclopedia-তে সাত বৎসর উল্লেখ করা হইয়াছে (১৩ ব., পৃ. ৪২৭)। এই সময়কালে পিতা-পুত্র মিসরে ব্যাপক ভিত্তিতে ইসলাম প্রচার করেন। ফলে গরিষ্ঠ সখ্যক মিসরবাসী দীনে হানীকের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেন। বস্তুত নবী-রাসূলগণের প্রধান কাজই হইল মানবজাতির নিকট আল্লাহর দীনের দাওয়াত পৌঁছানো। তাই তাঁহারা সর্বাবস্থায় দীনের দাওয়াত দিয়াছেন, এমনকি হ্যরত ইউসুফ (আ) সম্পর্কে তো কুরআন মজীদেই বর্ণিত হইয়াছে যে, তিনি অত্যন্ত প্রজ্ঞার সহিত যুক্তি সহকারে জেলখানায় বন্দী অবস্থায়ও তাঁহার সহ-কয়েদীদের মধ্যে দীনের প্রচারকার্য অব্যাহত রাখেন (দ্র. ১২ ও ৩৭-৪০)।
ইব্ন কাছীর (র) বলেন, আহলে কিতাবমতে মিসরে গমনকালে তাঁর বয়স হইয়াছিল ১৩০ বৎসর (বিদায়া, ১খ., পৃ. ২২০), কিন্তু তিনি তাঁহার বয়স মোট ১৪০ বৎসর উল্লেখ করিয়াছেন (পৃ. ২২০)। অথচ বাইবেলে তাহার মোট বয়স ১৪৭ বৎসর বর্ণিত হইয়াছে (আদিপুস্তক, ৪৭ : ২৮; Colliers Ency., ১৩ খ, পৃ. ৪২৭; Americana, ১৫খ, পৃ. ৬৫৫; Ency. Relig., ৭, পৃ. ৫০৩)। মৃত্যুর পূর্বে তিনি ইউসুফ (আ)-কে ওসিয়াত করিয়া যান যে, তাঁহার লাশ যেন তাঁহার পিতৃপুরুষ ইসহাক ও ইবরাহীম (আ)-এর কবরস্থানে দাফন করা হয় এবং তাহার ওসিয়াত প্রতিপালিত হয় (বিদায়া, ১খ., পৃ. ২২০; আদিপুস্তক, ৪৯ ও ৩০-৩৩; আরও দ্র. Colliers Ency., ১৩খ, পৃ. ৪২৭; Ency. Relig., ৭খ., পৃ. ৫০৪; Americana, ১৫খ, পৃ. ৬৫৫)। ইউসুফ (আ)-ই তাঁহার পিতার লাশ কানআনে বহন করিয়া আনেন এবং হেবরনে (বর্তমান আল-খলীল) দাফন করেন (বিদীয়া, ১খ., পৃ. ২২০)। মিসরবাসী তাঁহার জন্য ৭০ দিন শোক পালন করে (ঐ, পৃ. ২২০; আদিপুস্তক, ৫০ ও ৩)।
অন্তিম উপদেশ
হযরত ইয়াকূব (আ) যখন বুঝিতে পারিলেন যে, তাঁহার অন্তিম মুহূর্ত নিকটবর্তী, তিনি তাঁহার সন্তানদেরকে ডাকিয়া সেই উপদেশ দান করিলেন যাহা তাঁহার পিতামহ হযরত ইবরাহীম (আ) তাঁহার পুত্রগণকে দান করিয়াছিলেন। তাঁহার উপদেশ এই ছিল যে, “আল্লাহ এক, তাঁহার কোনও শরীক নাই”। এই মূল ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত দীন ইসলামকে আমৃত্য আকড়াইয়া ধরিতে হইবে। কুরআন মজীদে বিষয়টি এইভাবে উল্লিখিত হইয়াছে :
“এবং ইবরাহীম ও ইয়াকূব এই সম্বন্ধে তাহাদের পুত্রগণকে নির্দেশ দিয়া বলিয়াছিল, হে পুত্রগণ! আল্লাহই তোমাদের জন্য এই দীনকে মনোনীত করিয়াছেন। অতএব তোমরা আমৃত্য মুসলমান থাকিবে। ইয়াকূবের নিকট যখন মৃত্যু আসিল তখন তোমরা কি উপস্থিত ছিলে? সে যখন তাহার পুত্রগণকে জিজ্ঞাসা করিল, আমার পরে তোমরা কিসের ইবাদত করিবে, তখন তাহারা বলিল, আমরা আপনার ইলাহ্-এর এবং আপনার পিতৃপুরুষ ইবরাহীম, ইসমাঈল ও ইসহাকের ইলাহ-এর ইবাদত করিব। তিনিই একমাত্র ইলাহ এবং আমরা তাঁহার নিকট আত্মসমর্পণকারী” (২: ১৩২-৩)।
রাসূলুল্লাহ (স) যখন মদীনা ও তৎপার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহে “আল্লাহ্ এক এবং তাঁহার কোনও শরীক নাই”, এই দাওয়াত দিতেছিলেন এবং বলিতেছিলেন, ইহাই ইবরাহীম (আ)-এর একনিষ্ঠ ধর্ম (দীনে হানীফ), তখন ইয়াহুদী ও খৃস্টানরা দাবি করিল যে, তাহারাই তো ইবরাহীম (আ)-এর ধর্মের অনুসারী। শুধু তাহাই নহে, ইয়াহুদী-খৃস্টানরা তো মুসলমানদেরকে লূতন ধর্ম ত্যাগ করিয়া তাহাদের নিজ নিজ ধর্মের অনুসরণ করিতে বলিতে লাগিল এবং ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব (আ) ও তাঁহার বংশধরগণ ইয়াহুদী-খৃস্টান ছিল বলিয়া দাবি করে। মহান আল্লাহর ভাষায়:
“তোমরা কি বল, ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব ও তাহার বংশধরগণ ইয়াহূদী কিংবা খৃস্টান ছিল? তুমি বল, তোমরা কি বেশি জান, না আল্লাহ” (২: ১৪০)?
পূর্বোক্ত আয়াত নাযিল পূর্বক ইয়াহুদী-খৃস্টানদের উপরিউক্ত দাবি প্রত্যাখ্যান করিয়া আসল সত্য তুলিয়া ধরা হইয়াছে। আয়াতে প্রদত্ত প্রশ্নাকারে প্রতিবাদের তাৎপর্য অনুধাবন করার জন্য দুইটি বিষয় বিবেচনায় রাখিতে হইবে। (এক) ইয়াহুদী ও খৃস্টান ধর্মের বর্তমান যে কাঠামো তাহা পরবর্তী কালের সৃষ্টি। ইয়াহুদী ধর্মের নামকরণ, উহার ধর্মীয় বিশেষত্ব, অনুষ্ঠানমালা ও নিয়ম-কানুন খৃস্টপূর্ব ৩য়-৪র্থ শতাব্দীতে রূপ লাভ করিয়াছে। অনুরূপভাবে যেসব ধারণা-বিশ্বাস ও বিশেষ ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির সমষ্টিকে খৃস্টবাদ বলা হয় তাহা হযরত ঈসা (আ)-এর বহু পরবর্তী কালে উদ্ভাবিত হইয়াছে। সুতরাং ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকূব ও তাঁহার বংশধরের ইয়াহুদী বা খৃস্টান হওয়ার দাবি অসার কল্পনামাত্র । (দুই) স্বয়ং ইয়াহুদী-খৃস্টানদের নিজস্ব ধর্মীয় গ্রন্থাবলী হইতেও এই কথা প্রমাণিত হইয়াছে যে, হযরত ইবরাহীম (আ)-সহ উক্ত নবীগণ এক আল্লাহ ব্যতীত অপর কিছুর ইবাদত, উপাসনা, আনুগত্যে বিশ্বাসী ছিলেন না এবং আল্লাহ তাআলার সাথে কাহাকেও অংশীদার করিতেন না। অতএব এই কথা সুস্পষ্ট যে, ইয়াহুদীবাদ ও খৃস্টবাদ উভয়ই পূর্বোক্ত নবীগণের আচরিত চিরসত্য পথ হইতে বিচ্যুত হইয়া গিয়াছে (তাফহীমুল কুরআন, সূরা বাকারার ১৩৫ নং আয়াতের ১৩৫ নং টীকা)।
বাইবেলে হযরত ইয়াকূব (আ)-এর মৃত্যুকালীন অবস্থা বিস্তারিতভাবে বর্ণিত থাকিলেও তাহাতে কুরআন মজীদে উক্ত এই মূল্যবান অন্তিম উপদেশের কোনও উল্লেখ নাই। অবশ্য ইয়াহূদীদের তালমূদ গ্রন্থে যে দীর্ঘ উপদেশমালা বর্ণিত আছে, কুরআনের উপদেশের সহিত উহার যথেষ্ট সামঞ্জস্য রহিয়াছে। তাহাতে হযরত ইয়াকূব (আ)-এর এই কথাগুলি পাওয়া যায়? “তোমরা সদাপ্রভু আল্লাহর ইবাদত করিতে থাকিবে। তিনি তোমাদেরকে সকল বিপদ হইতে রক্ষা করিবেন, যেমন করিয়াছেন তোমাদের পূর্বপুরুষদেরকে। নিজ সন্তানদেরকে সদাপ্রভুকে ভালোবাসিতে এবং তাঁহার নির্দেশ মান্য করিয়া চলিতে শিক্ষা দিবে, যাহাতে তাহাদের জীবনের অবকাশ দীর্ঘতর হয়। কেননা যাহারা সত্যের সহিত সকল কাজ সম্পন্ন করে এবং সত্যের পথে ঠিকভাবে চলে, আল্লাহ তাহাদের রক্ষণাবেক্ষণ করেন”। উত্তরে সেই সন্তানগণ বলিল, “আপনি যেই উপদেশ দিলেন তাহা আমরা মান্য করিব, আল্লাহ আমাদের সহায় হউন।” তখন ইয়াকূব (আ) বলিলেন, “তোমরা যদি সদাপ্রভুর সহজ সরল পথ হইতে ডানে-বায়ে ভ্রষ্ট হইয়া না যাও, তবে আল্লাহ নিশ্চয়ই তোমাদের সহায় হইবেন” (তাফহীমুল কুরআন, ২৪ ১৩৩ আয়াতের ১৩৩ নং টীকা)।
বায়তুল মাকদিস নির্মাণ।
আল্লামা ইব্ন কাছীর (র) তাঁহার তাফসীর গ্রন্থে পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবের বরাতে লিখিয়াছেন যে, হযরত ইয়াকূব (আ) সর্বপ্রথম বায়তুল মাকদিস নির্মাণ করেন (তাফসীর ইব্ন কাছীর, বাংলা অনু., ১৩, পৃ. ৫৭৩)। বাইবেলের আদিপুস্তকে উল্লিখিত আছে : “পরে যাকোব প্রত্যুষে উঠিয়া বালিশের নিমিত্ত যে প্রস্তর রাখিয়াছিলেন, তাহা লইয়া স্তম্ভরূপে স্থাপন করিয়া তাহার উপর তৈল ঢালিয়া দিলেন। আর সেই স্থানের নাম বৈথেল (বায়ত ঈল=আল্লাহর ঘর) রাখিলেন—– এবং এই যে প্রস্তর আমি স্তম্ভরূপে স্থাপন করিয়াছি, ইহা আল্লাহর ঘর হইবে” (২৮ : ১৮-২২)।
অতএব হযরত ইয়াকূব (আ)-ই বায়তুল মাকদিস-এর প্রথম নির্মাতা, অতঃপর হযরত সুলায়মান (আ) ইহা পুননির্মাণ করেন (বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ১খ., পৃ. ১৯৪ ও ১৯৬; আল-মাআরিফ, পৃ. ২৩)।
হযরত আবু যার আল-গিফারী (রা) বলেন, আমি বলিলাম,
“হে আল্লাহর রাসূল! পৃথিবীতে সর্বপ্রথম কোন মসজিদ নির্মিত হয়? তিনি বলেন : মসজিদুল হারাম। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, অতঃপর কোনটি? তিনি বলেন : মসজিদুল আকসা (বায়তুল মাকদিস)। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, এই মসজিদ নির্মাণের মধ্যকার (কালের) ব্যবধান কত ছিল? তিনি বলেন : চল্লিশ বৎসর” (বুখারী, আম্বিয়া, বাব ১০, নং ৩১১৬; বাব ৪০, নং ৩১৭৩; মুসলিম, মাসাজিদ, নং ১০৪২-৩; নাসাঈ, মাসাজিদ, বাব আয়ু মাসজিদ উদিআ আওয়ালান; ইবন মাজা, মাসাজিদ, বাব ৭, নং ৭৫৩)।
বাইবেলের বিবরণ ও উক্ত হাদীছের বিষয়বস্তু হইতে প্রমাণিত হয় যে, হযরত ইবরাহীম (আ) কর্তৃক কাবা ঘর নির্মিত হওয়ার চল্লিশ বৎসর পর তাঁহার পৌত্র হযরত ইয়াকূব (আ) বায়তুল মাকদিস নির্মাণ করেন। উক্ত হাদীছের ভিত্তিতে ইবন হিব্বান মত প্রকাশ করেন যে, হযরত ইবরাহীম (আ) ও হযরত সুলায়মান (আ)-এর যুগের মধ্যে মাত্র চল্লিশ বৎসরের ব্যবধান ছিল। তিনি ধারণা করেন যে, হযরত সুলায়মান (আ)-ই বায়তুল মাকদিসের নির্মাতা। তাঁহার এই ধারণা যথার্থ নহে। বস্তুত হযরত সুলায়মান (আ)-এর যুগ ও হযরত ইবরাহীম (আ)-এর যুগের মধ্যে পার্থক্য হাজার বৎসরের অধিক। সুলায়মান (আ) উহা পুনর্নির্মাণ করিয়াছিলেন মাত্র (তাফসীর ইবন কাছীর, বাংলা অনু, ১খ, পৃ. ৫৭৪)।
উটের গোশত ভক্ষণ সংক্রান্ত বিবরণ
হযরত ইয়াকূব (আ) রুচিগত কারণে অথবা অজ্ঞাত কোন ব্যাধির কারণে কোনও কোনও ভাষ্যকার ও ঐতিহাসিক সাইটিকা নামক বাতরোগের কথাও বলিয়াছেন) উটের গোশত ভক্ষণ করিতেন না এবং উহার দুধ পান করিতেন না। তিনি ইহা ব্যক্তিগতভাবে নিজের জন্য নিষিদ্ধ করিয়া লইয়াছিলেন। পরবর্তী পর্যায়ে ইসরাঈলীরা উটের গোশত ও দুগ্ধ নিজেদের জন্য নিষিদ্ধ করিয়া লয়। বিষয়টি সম্পর্কে কুরআন মজীদে এইভাবে ইঙ্গিত করা হইয়াছে :
“তাওরাত নাযিল হওয়ার পূর্বে ইসরাঈল নিজের জন্য যাহা হারাম করিয়াছিল তাহা ব্যতীত বন্দু ইসরাঈলের জন্য যাবতীয় খাদ্যই হালাল ছিল। তুমি বল, তোমরা সত্যবাদী হইয়া থাকিলে তাওরাত আন এবং তাহা পাঠ কর। ইহার পরও যাহারা আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা রচনা করে তাহারাই যালিম। তুমি বল, আল্লাহ সত্য বলিয়াছেন। সুতরাং তোমরা একনিষ্ঠ হইয়া ইবরাহীমের ধর্মাদর্শ অনুসরণ কর এবং সে মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নহে” (৩ : ৯৩-৯৫)।
দীন ইসলামের মূল ভিত্তি যেসব জিনিসের উপর স্থাপিত, সেই বিবেচনায় পূর্ববর্তী নবীগণের শিক্ষা ও মহানবী (স)-এর শিক্ষার মধ্যে নীতিগতভাবে কোন পার্থক্য নাই। কুরআন মজীদ ও মহানবী (স)-এর আদর্শ ও শিক্ষ সম্পর্কে ইয়াহূদী আলিমগণ যখন নীতিগত কোনও আপত্তি উত্থাপনের সুযোগ পাইল না, তখন তাহারা কতিপয় শরীআতী আইব্নগত আপত্তি উত্থাপন করিতে থাকে। এই প্রসঙ্গে তাহারা প্রশ্ন তুলিল যে, এমন অনেক জিনিসকে হযরত মুহাম্মাদ (স) হালাল ঘোষণা করিয়াছেন, যাহা পূর্বকালের নবীগণের শরীআতে সম্পূর্ণ হারাম ছিল, ইহা কিরূপে সম্ভব হইল :এখানে সেই প্রশ্নের উত্তর দিয়া বলা হইয়াছে যে, আহারের জন্য ইসলামী শরীআতে যে সমস্ত জিনিস হালাল তাহা বনূ ইসরাঈলের জন্যও হালাল ছিল। অবশ্য কোনও জিনিস এমনও ছিল যাহা তাওরাত কিতাব নাযিল হওয়ার পূর্বে বনূ ইসরাঈল স্ব-উদ্যোগে নিজেদের জন্য হারাম ঘোষণা করিয়াছিল। আল্লাহ তাআলা রাসূলুল্লাহ (স)-কে এই প্রসঙ্গে ইহা বলিতে নির্দেশ দিলেন : “তোমরা তাওরাত আন এবং উহা পাঠ কর” (৩ : ৯৩)। কিন্তু তাহারা সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করিতে দুঃসাহস দেখায় নাই। মূলত উটের গোশত ও দুধ তাওরাতে ইয়াহুদীদের জন্য হারাম ঘোষণা করা হয় নাই, হইয়া থাকিলে প্রসঙ্গক্রমে কুরআন মজীদের এই স্থানে তাহার উল্লেখ থাকিত। খাদ্যের মধ্যে কোন্ কোন্ বস্তু তাহাদের জন্য হারাম ছিল কুরআন মজীদে তাহার উল্লেখ আছে এবং তাহাও তাহাদের অবাধ্যাচরণের কারণে শাস্তিস্বরূপ হারাম করা হইয়াছিল। যেমন :
“উত্তম জিনিসসমূহ যাহা ইয়াহুদীদের জন্য হালাল ছিল, তাহাদের সীমালঙ্নের কারণে আমি তাহা তাহাদের জন্য হারাম করিয়াছি, আল্লাহর পথে অনেক লোককে বাধা প্রদানের জন্য, তাহাদের সূদ গ্রহণের জন্য, যাহা তাহাদের জন্য নিষিদ্ধ করা হইয়াছিল এবং অন্যায়ভাবে জনগণের ধন-সম্পদ গ্রাস করার জন্য” (৪ : ১৬০-১৬১)।
“আমি ইয়াহূদীদের জন্য নখরযুক্ত সমস্ত পশু হারাম করিয়াছিলাম এবং গরু ও ছাগলের চর্বিও তাহাদের জন্য হারাম করিয়াছিলাম, তবে এইগুলির পৃষ্ঠের অথবা অন্ত্রের কিংবা অস্থিসংলগ্ন চর্বি ব্যতীত, তাহাদের অবাধ্যতার দরুন তাহাদেরকে এই প্রতিফল দিয়াছিলাম। নিশ্চয় আমি সত্যবাদী” (৬ : ১৪৬)।
উক্ত আয়াতসমূহ হইতে পরিষ্কার প্রতিভাত হয় যে, ইয়াহুদীদের অবাধ্যতার শাস্তিস্বরূপ আল্লাহ তাআলা তাহাদের জন্য এই বিধান দেন। অনন্তর তাহাদের জন্য উটের গোশত ও দুধ হারাম করা হইলে তাহা অবশ্যই উক্ত আয়াতসমূহে উদ্ধৃত হইত। তাহা ছাড়া তাওরাতে উক্ত বিধান বিদ্যমান থাকিলে ৩ : ৯৩ আয়াতের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করিয়া তাহারা মহানবী (স)-এর সামনে তাওরাত কিতাব আনিয়া হাযির করিয়া দেখাইয়া দিত, কিন্তু তাহারা তাহা করিতে অপারগ ছিল। বাইবেলে যে উট ও খরগোশের গোশত হারাম (বাইবেলের লেবীয় পুস্তক, ১১ ও ৪-৬; দ্বিতীয় বিবরণ, ১৪ : ৭) লিপিবদ্ধ রহিয়াছে তাহা পরবর্তী কালের সংযোজন হইতে পারে (তাফহীমুল কুরআন, ৩ : ৯৩-৯৫ আয়াতের ৭৬, ৭৭ ও ৭৮ নং টীকা এবং ৬ ও ১৪৬ নং আয়াতের ১২২ নং টীকা; শায়খুল হিন্দের তরজমায় শাববীর আহমাদ উছমানীর টীকাভাষ্য, ৩ ও ৯৩ আয়াতের ২ ও ৩ নং টীকা, পৃ. ৭৯; ৬ : ১৪৬ আয়াত সংশ্লিষ্ট ২ নং টীকা, পৃ. ১৯৬)।
ইয়াহুদীদের দ্বিতীয় আপত্তি এই ছিল যে, তোমরা মুসলমানগণ বায়তুল মাকদিসকে ত্যাগ করিয়া কাবা ঘরকে কেন কিবলা বানাইয়াছ, অথচ পূর্বকালের নবী-রাসূলগণের কিবলা তো ছিল এই বায়তুল মাকদিস? তাহা হইলে তোমরা কিভাবে মিল্লাতে ইবরাহীমীর অনুসারী হওয়ার দাবি করিতে পার? ইহার উত্তর সূরা আল-বাকারায় (২ : ১৪২-৪৫) দেওয়া ছাড়াও উহার উত্তরে নিম্নোক্ত আয়াত (৩ : ৯৬) অবতীর্ণ হইয়াছে :
“নিশ্চয় মানবজাতির জন্য সর্বপ্রথম যে ঘর প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল তাহা তো বাক্কায় (মক্কায়), উহা বরকতময় ও বিশ্বজগতের দিশারী। উহাতে বহু সুস্পষ্ট নিদর্শন আছে। যেমন মাকামে ইবরাহীম।”
অতএব কাবা ঘর তো হযরত মূসা (আ)-এর আট-নয় শত বৎসর পূর্বে তোমাদের ইসরাঈলীদের প্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ গোষ্ঠীপতি হযরত ইবরাহীম (আ) নির্মাণ করিয়াছেন এবং ইহাকে কিবলা বানাইয়াছেন। সুতরাং কাবা ঘরের সর্বাগ্রগণ্যতা সম্পর্কে কোন প্রশ্নই উঠিতে পারে না। অথচ বায়তুল মাকদিস পূর্ণাঙ্গ ইবাদতখানা হিসাবে নির্মিত হইয়াছে হযরত মূসা (আ)-এর চার শত বৎসর পর (তাফহীমুল কুরআন, ৩ ও ৯৬ আয়াত সংশ্লিষ্ট ৭৯ নং টীকা অবলম্বনে)।
ইয়াকূব (আ)–এর চারিত্রিক গুণাবলী
নবী-রাসূলগণ হইলেন মানবজাতির মধ্যে আদর্শ মানব। সরাসরি আল্লাহর তত্ত্বাবধানে তাঁহাদের জীবন সৌন্দর্য প্রস্ফুটিত হয়। সততা, নিষ্ঠা, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, ধৈর্য, সৎকর্মশীলতা, তাওয়াক্কুল সার্বিক দিক হইতে তাঁহারা মানবজাতির অনুসরণীয় আদর্শ। নবী হিসাবে হযরত ইয়াকূব (আ)-এর মধ্যে এইসব বৈশিষ্ট্য পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান ছিল। বাইবেল যেখানে নবী-রাসূলগণের মহত গুণাবলীর যৎসামান্য বর্ণনা করার পাশাপাশি তাঁহাদের উপর এমন কালিমা লেপন করিয়াছে যে, তাঁহাদের মহৎ গুণাবলী ম্লান হইয়া গিহয়াছে, কুরআন মজীদ সেখানে তাঁহাদের মহৎ গুণাবলী তুলিয়া ধরার সঙ্গে সঙ্গে তাঁহাদের প্রতি আরোপিত অপবাদসমূহ জোরালোভাবে প্রত্যাখ্যান করিয়াছে। কুরআন মজীদ হযরত ইসহাক (আ) ও ইয়াকূব (আ)-সহ বেশ কয়েকজন নবীর উল্লেখ পূর্বক বলিয়াছে: “ইহাদের প্রত্যেককে আমি সৎপথে পরিচালিত করিয়াছি” (৬ : ৮৪), “ইহাদের প্রত্যেকেই সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত” (৬ : ৮৫), “ইহাদের প্রত্যেককে আমি বিশ্ববাসীর উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করিয়াছি” (৬ : ৮৬)।
“আমি তাহাদেরকে মনোনীত করিয়াছিলাম এবং সরল পথে পরিচালিত করিয়াছিলাম” (৬ : ৮৭)।
“আমি তাহাদেরকে কিতাব, হিকমাত ও নবুওয়াত দান করিয়াছি” (৬৪ ৮৯)।
“ইহাদেরকেই আল্লাহ সৎপথে পরিচালিত করিয়াছেন। সুতরাং তুমি (মুহাম্মাদ) তাহাদের পথের অনুসরণ কর” (৬ ও ৯০)।
ইয়াকূব (আ)-এর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ সাক্ষ্য দেন : “এবং সে অবশ্যই জ্ঞানী ছিল, কারণ আমি তাহাকে জ্ঞান শিক্ষা দিয়াছিলাম” (১২ : ৬৮)।
তাঁহার ধৈর্য সম্পর্কে দুই স্থানে বলা হইয়াছে : ১৪ ‘পূর্ণ ধৈর্যই শ্রেয় (১২৪ ১৮ ও ৮৩)।
অর্থাৎ প্রাণপ্রিয় পুত্র ইউসুফ (আ)-এর নিখোঁজ সংবাদ শ্রবণ করিয়া এবং মিসর সম্রাটের হাতে সর্বকনিষ্ঠ পুত্র বিনয়ামীন চুরির দায়ে গ্রেপ্তার হওয়ার সংবাদ শুনিয়া হযরত ইয়াকূব (আ) এই কথা বলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে আরো বলেন :
“তোমরা যাহা বলিতেছ সেই বিষয়ে একমাত্র আল্লাহ আমার সাহায্যস্থল” (১২ : ১৮)। আল্লাহর কাছেই তিনি সাহায্যপ্রার্থী হইলেন। মহানবী (স) ইহাই আমাদেরকে শিক্ষা দিয়াছেন?
“তোমার সাহায্য চাওয়ার প্রয়োজন হইলে আল্লাহর নিকটই সাহায্য প্রার্থনা কর” (তিরমিযী, বাংলা অনু, ৪খ, পৃ. ৩১৩, বাব ৫৯, নং ২৪৫৬, কিয়ামত অধ্যায়)।
হযরত ইউসুফ (আ)-এর অনুরোধে ইউসুফ (আ)-এর সহোদর বিনয়ামীনকে ইয়াকূব-পুত্রগণ তাহাদের সঙ্গে মিসরে লইয়া যাইতে চাহিলে তাহাদের পক্ষ হইতে পিতাকে বিনয়ামীনের পূর্ণ নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় (১২ ও ৬৩)। তখন তিনি নবীসুলভ কণ্ঠে বলিয়া উঠেন ও
“আল্লাহ-ই সর্বোত্তম নিরাপত্তাবিধায়ক এবং তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু” (১২ : ৬৪)।
পুত্রের নিরাপত্তার জন্য পার্থিব নিয়ম অনুযায়ী অন্যান্য পুত্রগণের নিকট হইতে প্রতিশ্রুতি গ্রহণের এবং তাহাদের মিসরে প্রবেশের প্রয়োজনীয় পরার্মশ প্রদানের (১২ ৬৬-৭) পর আল্লাহর মহা ক্ষমতার ও ভরসাস্থল হওয়ার কথা স্মরণ করাইয়া দিয়া তিনি বলিলেন :
“আল্লাহর বিধানের বিরুদ্ধে আমি তোমাদের জন্য কিছু করিতে অক্ষম। বিধান আল্লাহরই। আমি তাঁহারই উপর ভরসা করি এবং যাহারা ভরসা করিতে চাহে তাহারা যেন আল্লাহর উপরই ভরসা করে” (১২ : ৬৭)।
ইউসুফ (আ)-এর নিখোঁজ হওয়ার দীর্ঘ বিচ্ছেদ বেদনায় হযরত ইয়াকূব (আ)-এর হূদয় ছিল দুঃখ ভারাক্রান্ত। তাঁহার জন্য সৃষ্টিগত স্বভাবসুলভ শোকে তাঁহার দৃষ্টিশক্তিও লোপ পাইয়াছিল (১২৪ ৮৪)। তাঁহার দশ পুত্র এই অবস্থা দেখিয়া বলিল, ইউসুফের জন্য এইভাবে সদাসর্বদা মনস্তাপ করিতে থাকিলে হয় আপনার স্বাস্থ্যহানি ঘটিবে অথবা আপনি মারা যাইবেন। ইয়াকূব (আ) উত্তরে বলেন :
“সে বলিল, আমি আমার অসহনীয় বেদনা ও দুঃখ কেবল আল্লাহর নিকট নিবেদন করিতেছি এবং আমি আল্লাহর নিকট হইতে জ্ঞাত আছি যাহা তোমরা জ্ঞাত নও” (১২ ৮৬)।
হযরত ইয়াকূব (আ)-এর এইরূপ অসহনীয় অবস্থায় আল্লাহ তাআলা তাঁহাকে ওহীর মাধ্যমে শেষ পর্যায়ে জানাইয়া দিলেন যে, ইউসুফ (আ) জীবিত আছেন এবং মহাসম্মানে ও প্রতিপত্তির সহিত মিসরে শাসনকার্য করিতেছেন। উক্ত আয়াতের শেষাংশে সেই জ্ঞানের কথাই বলা হইয়াছে। বাইবেলীয় পণ্ডিতগণের মতে পিতা-পুত্রের বিচ্ছেদকাল ছিল বাইশ বৎসর (খ্র. পূ. ১৭২৮-১৭০৬ সাল; বাইবেল ডিকশনারী, পৃ. ২৩) এবং কোনও কোনও তাফসীরকারের মতে চল্লিশ বৎসর (বিস্তারিত দ্র. ইউসুফ শীর্ষক নিবন্ধ)। দুঃখ ও মনস্তাপ সত্ত্বেও তিনি ধৈর্য ধারণ করিলেন এবং সন্তানদেরকে আশার বাণী শুনাইলেন:
“হে আমার পুত্রগণ! তোমরা যাও, ইউসুফ ও তাহার সহোদরের অনুসন্ধান কর এবং আল্লাহর দয়া হইতে তোমরা নিরাশ হইও না। কারণ আল্লাহর দয়া হইতে কেবল কাফেররাই নিরাশ হয়” (১২ : ৮৭)।
সংবাদবাহক আসিয়া যখন ইউসুফ (আ)-এর খবর জানাইল এবং ইউসুফ (আ)-এর জামা তাঁহার চক্ষুদ্বয়ে রাখিতেই তিনি দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়া পাইলেন, তখন দশ পুত্র আসিয়া পিতার নিকট ক্ষমাপ্রার্থী হইল । তিনি বলিলেন :
“আমি আমার প্রতিপালকের নিকট তোমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করিব। তিনি তো পরম ক্ষমাশীল, পরম দয়াময়” (১২ : ৯৮)।
নবী-রাসূলগণ হইলেন ক্ষমা ও অনুগ্রহের মূর্ত প্রতীক। তাঁহারা আল্লাহর বিধানের সীমালংঘনের অপরাধ ব্যতীত ব্যক্তিগত কারণে কখনও প্রতিশোধ গ্রহণ করেন না, বরং অপরাধীর জন্য ক্ষমা প্রার্থনাই করেন। রাসূলুল্লাহ (স) সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, তিনি কখনও ব্যক্তিগত কারণে কাহারও উপর প্রতিশোধ গ্রহণ করেন নাই।
“রাসূলল্লাহ (স) ব্যক্তিগত কারণে কখনও প্রতিশোধ গ্রহণ করেন নাই, তবে আল্লাহর নিষিদ্ধ বিষয়ের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করিলে শাস্তি দান করিতেন” (বুখারী, বাংলা অনু., মানাকিব, বাব ২৪, নং ৩২৯৬, ৩খ., পৃ. ৪৬৩; আদাব, বাব ৮০, নং ৫৬৮৬, ৫খ, পৃ. ৪৯৩; হুদূদ, বাব ১০, নং ৬৩১৭, ৬খ, পৃ. ১৭৬; মুসলিম, বাংলা অনু, ফাদাইল, বাব ৩৩৪, নং ৫৮৩৮, ৭খ, পৃ. ৩৩০; নং ৫৮৪২, পৃ. ৩৩১, বাব ৩৩৫; আবু দাউদ; আদাব, বাব ৪, আল-আফবু; মুওয়াত্তা ইমাম মালিক, কিতাবুল জামে, বাব হুসনিল খুলুক)।
হযরত ইবরাহীম (আ)-এর ত্যাগ-তিতীক্ষা, হিজরত, কঠিন পরীক্ষায় সাফল্য লাভ ইত্যাদি কারণে আল্লাহ তাআলা তাঁহার সহিত তাঁহার পুত্রগণ ও পৌত্র ইয়াকূব (আ)-কে উচ্চ মর্যাদা দান করেন এবং অনুগ্রহ ধন্য করেন :
“এবং আমি তাহাদেরকে দান করিলাম আমার অনুগ্রহ এবং তাহাদের সুনাম-সুখ্যাতি সমুচ্চ করিলাম” (১৯৪ ৫০)।
মাওলানা শাববীর আহমাদ উছমানী (র) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখিয়াছেন, আল্লাহ তাআলা তাঁহার বিশেষ অনুগ্রহের এক বিরাট অংশ তাঁহাদের দান করিয়াছেন এবং পৃথিবীতে তাঁহাদের স্মরণ অব্যাহত রাখিয়াছেন। ফলে সকল ধর্মের অনুসারীরা তাঁহাদের প্রতি ভক্তিশ্রদ্ধা প্রকাশ করে, তাহাদের গুণগান করে। হযরত মুহাম্মাদ (স)-এর উম্মত স্থায়ীভাবে তাহাদের নামাযে দুরূদ শরীফের মাধ্যমে তাহাদেরকে প্রতিনিয়ত স্মরণ করেন। বস্তুত ইহা ছিল হযরত ইবরাহীম (আ)-এর সেই দোআ কবুল হওয়ার ফল :
“আমাকে তুমি পরবর্তীদের মধ্যে যশস্বী কর” (২৬ : ৮৪; শায়খুল হিন্দের তরজমা, উক্ত আয়াতের ২নং টীকা, পৃ. ৪১২, সৌদী সংস্করণ)।
আল্লাহ তাআলা ইয়াকূব (আ)-কে তাঁহার পিতা ও প্রপিতার সঙ্গে নানামুখী অনুগ্রহে ধন্য করিয়াছেন। তিনি তাঁহাদেরকে সৎকর্মপরায়ণ, মানবজাতির নেতা, পথপ্রদর্শক ও ইবাদতপ্রিয় বান্দা হিসাবে উল্লেখ করিয়াছেন :
“এবং আমি ইবরাহীমকে দান করিয়াছিলাম ইসহাক এবং পৌত্ররূপে ইয়াকূব; আর প্রত্যেককেই করিয়াছিলাম সৎকর্মপরায়ণ। আমি তাহাদেরকে করিয়াছিলাম নেতা। তাহারা আমার নির্দেশ অনুসারে মানুষকে পথপ্রদর্শন করিত। আমি তাহাদের নিকট ওহী প্রেরণ করিয়াছিলাম সৎকর্ম করিতে, নামায কায়েম করিতে এবং যাকাত প্রদান করিতে। তাহারা আমারই ইবাদতকারী ছিল” (২১৪ ৭২-৩)।
প্রপিতামহ, পিতামহ ও পুত্রের প্রতি আল্লাহ তাআলার আরো কতক অনুগ্রহের বর্ণনা এভাবে প্রদত্ত হইয়াছে :
“স্মরণ কর আমার বান্দা ইবরাহীম, ইসহাক ও ইয়াকূবের কথা, তাহারা ছিল শক্তিশালী ও সূক্ষ্মদর্শী। আমি তাহাদেরকে অধিকারী করিয়াছিলাম এক বিশেষ গুণের, তাহা ছিল পরকালের স্মরণ। অবশ্যই তাহারা ছিল আমার মনোনীত উত্তম বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত” (৩৮ : ৪৫-৭)।
“শক্তিশালী ও সূক্ষ্মদশী” বলার তাৎপর্য এই যে, পিতা-পুত্র-পৌত্র তিন পয়গাম্বর বড়ই সৎকর্মশীল ছিলেন। আল্লাহর আনুগত্যে অবিচল থাকা এবং বিপদ-মুসীবতে দৃঢ়পদ থাকার বিরাট শক্তি তাঁহাদেরকে দান করা হইয়াছিল। আল্লাহর দীন প্রচারে তাঁহারা প্রাণপণ চেষ্টা করিয়াছেন । তাঁহাদের অন্তর-দৃষ্টি ও বিবেক-বুদ্ধি ছিল অত্যন্ত প্রখর। তাই তাঁহারা ছিলেন সত্যদর্শী। “পরকালের স্মরণ” বলিতে তাঁহারা নিজেরাও আখিরাতের জিন্দেগীর কথা স্মরণ করিতেন এবং অন্যদেরকেও স্মরণ করাইয়া দিতেন। তাঁহাদের মধ্যে পার্থিব মোহ ও লোভ-লালসার নাম-গন্ধও ছিল না । তাঁহাদের সব চিন্তা-ভাবনা ও চেষ্টা-সাধনা ছিল আখিরাতমুখী (তাফহীমুল কুরআন, সূরা সাদ-এর ৪৮-৪৯ নং টীকা অবলম্বনে; আল-জামি লি-আহকামিল কুরআন, ১৫ খ., পৃ. ২১৭-১৮; তাফসীরে কবীর, ২৬ খ., পৃ. ২১৬-১৭; তাফসীরে তাবারী, ১০ম বালাম, ২৩ খ, পৃ. ১০৯-১০; তাফসীরে ইবন কাছীর (সংক্ষিপ্ত), ৩খ, পৃ. ২০৬-এর সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যার বিস্তারিত রূপ)।
বনী ইসরাঈলের পরিচয়
হযরত ইয়াকূব (আ)-এর বংশধরগণ বনূ ইসরাঈল নামে পরিচিত। হযরত ইয়াকূব (আ)-এর অপর নাম ইসরাঈল। ইসর অর্থ বান্দা এবং [ ] অর্থ আল্লাহ, অতএব ‘ইসরাঈল’ শব্দের অর্থ “আল্লাহর বান্দা” (তাফসীরে তাবারী, বাংলা অনু, ১খ, পৃ. ৩৭০; তাফসীর ইবন কাছীর, বাংলা অনু., ১খ, পৃ. ৩০১; মাআরিফুল কুরআন, সংক্ষিপ্ত সং, পৃ. ৩৪; শায়খুল হিন্দের তরজমা, উছমানীর টীকাভাষ্য, টীকা নং ৫, পৃ. ৯; তাফহীমুল কুরআন, ২ ও ৪০ আয়াতের ৫৬ নং টীকা)।
কুরআন মজীদের এক আয়াতে বলা হইয়াছে, “তাহারা ছিল আমারই ইবাদতকারী” (২১ : ৭৩), এই কারণেও তাঁহার উক্ত নামকরণ হইতে পারে। ইবনুল আছীর বলিয়াছেন, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা কর্তৃক নিহত হওয়ার ভয়ে তিনি রাত্রে বাড়ি হইতে পলায়ন করিয়া মামার বাড়ি যান। পথিমধ্যে তিনি রাত্রে ভ্রমণ করিতেন এবং দিনের বেলা নিরাপদ স্থানে বিশ্রাম করিতেন। এই রাত্রি ভ্রমণের জন্য তাঁহার উক্ত নামকরণ হয় (আল-কামিল, ১খ, পৃ. ৯৬)। কুরআন মজীদে ইদাফাত ছাড়া একবার মাত্র এই নামের উল্লেখ আছে (দ্র. ৩ : ৯৩)। ইবন আব্বাস (রা) বলেন, ইসরাঈল অর্থ আল্লাহর বান্দা (তাবারী, ১খ, পৃ. ৩৭০)। একটি হাদীছ হইতেও ইহার সমর্থন পাওয়া যায়। একদল ইয়াহূদী নবী করীম (স)-এর নিকট উপস্থিত হইলে তিনি তাহাদেরকে জিজ্ঞাসা করেন : ইয়াকূব (আ)-ই যে ইসরাঈল তাহা কি তোমরা জান? তাহারা বলিল, আল্লাহর শপথ! আমরা তাহা জানি। নবী (স) বলেন, হে আল্লাহ! আপনি সাক্ষী থাকুন (আবু দাউদ তায়ালিসীর বরাতে তাফসীর ইব্ন কাছীর, বাংলা অনু, ১খ., পৃ. ৩০১)। আল্লামা ইবন কাছীর বলেন, একদা মানুষের বেশে একজন ফেরেশতা হযরত ইয়াকূব (আ)-এর নিকট উপস্থিত হইয়া তাঁহার সহিত মল্লযুদ্ধে লিপ্ত হন। ফেরেশতা পরাজিত হইয়া জিজ্ঞাসা করেন, আপনার নাম কি? তিনি বলেন, ইয়াকূব । ফেরেশতা বলেন, এখন হইতে আপনার নাম “ইসরাঈল”। ইয়াকূব (আ) তাঁহার পরিচয় জিজ্ঞাসা করিলে তিনি অদৃশ্য হইয়া যান। তখন তিনি বুঝিতে পারেন যে, ইনি আল্লাহর ফেরেশতা (বিদায়া, ১খ., পৃ. ১৯৬)। ইহা বাইবেলের বিকৃত ঘটনার মার্জিত রূপ বলিয়া মনে হয়। কারণ বাইবেলের হাস্যাস্পদ বিবরণ অনুযায়ী ইসরাঈল অর্থ “আল্লাহর সহিত যুদ্ধকারী” এবং তাহাতে অনুরূপ একটি ঘটনা বর্ণিত আছে (দ্র. আদিপুস্তক, ৩২ : ২৪-৩০)। অতএব ‘বনূ ইসরাঈল’ অর্থ ইয়াকূব (আ)-এর বংশধর।
কুরআন মজীদে ১৬টি সূরায় মোট ৪০ বার ‘বনী ইসরাঈল’ যৌগিক শব্দটি উল্লিখিত হইয়াছে। চার স্থানে ইয়া বানী ইসরাঈল (হে বনূ ইসরাঈল) বলিয়া সম্বোধন করা হইয়াছে এবং একটি সূরার নামকরণ করা হইয়াছে ‘সূরা বনী ইসরাঈল। হযরত ইয়াকুব (আ)-এর বারো পুত্র হইতে উদ্ভূত বারোটি গোত্রের সমষ্টিই একসঙ্গে বনূ ইসরাঈল নামে অভিহিত। কুরআন মজীদে যত গোত্র ও সম্প্রদায়ের প্রসঙ্গে আলোচনা আসিয়াছে, তম্মধ্যে বনূ ইসরাঈলের আলোচনা সর্বাধিক। অবশ্য এইসব আলোচনায় তাহাদের ধারাবাহিক ইতিহাস বিকৃত করা হয় নাই, বরং আল্লাহ তাআলা তাহাদেরকে যেসব অবিস্মরণীয় সুযোগ-সুবিধা দান করিয়াছেন, তাহাদের আল্লাহর দীনের ধারক-বাহক ও প্রচারক হিসাবে যে দায়িত্ব প্রদান করিয়াছেন, সেই দায়িত্ব পালনে তাহারা যে অনীহার পরিচয় দিয়াছে, আল্লাহর বিধান বেপরোয়াভাবে লংঘন করিয়াছে, এমনকি নবী-রাসূলগণকে হত্যা পর্যন্ত করিয়াছে, এক পর্যায়ে শিরকে লিপ্ত হইয়াছে, এইসব বিষয়ের আলোচনা আসিয়াছে। তাহাদেরকে এই কথা বুঝানো হইয়াছে যে, মুহাম্মাদ (স) যে দীনসহ প্রেরিত হইয়াছেন তাহা পূর্বকালের নবীগণেরই দীন। অতএব তাহাদেরই সর্বাগ্রে এই দীন গ্রহণ করা উচিৎ।
ইয়াকুব (আ)-এর দ্বাদশ পুত্র হইতে উদ্ভূত দ্বাদশ গোষ্ঠী হইল : রূবেন, শিমিয়ন, লেবী, যিহূদা, দাম, নপ্তালী, গাদ, আশোর, ইযাখর, সম্পূন, ইউসুফ (যোসেফ) ও বিন্যামিন-এর বংশধর। হযরত মূসা (আ)-এর যুগে তাঁহার নেতৃত্বে বনী ইসরাঈলের মিসর ত্যাগ করিয়া সিনাই উপদ্বীপে পৌঁছার পর তাহাদের আদমশুমারি করা হয়। ইহাতে লেবীর বংশের জনগোষ্ঠী ব্যতীত তাহাদের জনসংখ্যা দাঁড়ায় ৬,০৩,৫৫০ জন যুদ্ধে গমনযোগ্য পুরুষ; নারী ও শিশুদের সংখ্যা নির্ণয় করা হয় নাই (দ্র, বাইবেলের গণনাপুস্তক, ১ : ১-৪৬)। উল্লেখ্য যে, কুরআন মজীদে নাম উল্লেখ ছাড়া এই বারো গোত্রের উল্লেখ আছে (দ্র. ৫ : ১২; ২ : ৬০)। কুরআন মজীদে তাহারা সমষ্টিগতভাবে “ইয়াহূদ” নামেও উল্লিখিত হইয়াছে (দ্র. ২ : ১১৩; ১২০; ৩ : ৬৭; ৫ : ১৮, ৫১, ৬৪, ৮২; ৯৪ ৩০)। এই বনী ইসরাঈল ইয়াহদী বা Jews নামে পরিচিত।
হযরত ইবরাহীম (আ)-এর মিসরীয় স্ত্রী হাজার (a) (বাইবেলে হাগার)-এর গর্ভে জন্মগ্রহণকারী হযরত ইসমাঈল (আ)-এর বংশধারা বনূ ইসমাঈল নামে পরিচিত এবং তাঁহাদের অধিবাস ছিল আরব উপদ্বীপে। তাঁহার ইরাকী স্ত্রী সারার (বাইবেলে সারি) গর্ভজাত হযরত ইসহাক (আ)-এর বংশধারা পুত্র ইয়াকূব (আ)-এর মাধ্যমে বন্ ইসরাঈল নামে পরিচিত এবং তাঁহাদের অধিবাস ছিল সিরিয়ায় (শাম)। প্রাচীন ভূগোলে ফিলিস্তীন নামে স্বতন্ত্র কোন দেশের অস্তিত্ব ছিল না। ঐ নামের বর্তমান ভূখণ্ড ছিল সিরিয়ার অংশ। হযরত ইবরাহীম (আ) নিজ জন্মভূমি (উর/মেসোপটামিয়া) হইতে সস্ত্রীক মিসর গমন করেন এবং তথা হইতে সিরিয়ায় পৌঁছিয়া বর্তমান ইসরাঈলের ব্রেনে (বর্তমান নাম আল-খলীল) বসতি স্থাপন করেন এবং এখানেই তাঁহার পুত্র ইসমাঈল ও ইসহাক জন্মগ্রহণ করেন। জ্যেষ্ঠ পুত্র ইসমাঈল (আ) আরব উপদ্বীপে বসতি স্থাপন করেন। অন্যদিকে দ্বিতীয় পুত্র ইসহাক (আ) সিরিয়ায় থাকিয়া যান (বিস্তারিত দ্র. ইবরাহীম নিবন্ধে)। তাঁহার পুত্র ইয়াকূব (আ)-এর বংশধর বনী ইসরাঈলই ইতিহাসে সর্বাধিক প্রসিদ্ধি লাভ করে। এই গোষ্ঠীকে আল্লাহ তাআলা তাঁহার দীনের প্রচার এবং সে দীন অনুযায়ী সমাজ ব্যবস্থার পুনর্গঠন করার জন্য মনোনীত করেন। মহান আল্লাহ এই বংশে চার হাজার নবী-রাসূল প্রেরণ করেন। মহানবী (স) বলেন :
“আল্লাহ তাআলা আশি হাজার নবী প্রেরণ করেন, তম্মধ্যে চার হাজার নবী প্রেরণ করেন বনী ইসরাঈলে” (কানযুল উম্মাল, ১১খ., পৃ. ৪৮২, নং ৩২২৭৮; আরও দ্র. নং ৩২২৮০, পৃ. ৪৮৩)। মশহুর রিওয়ায়াতে নবীদের (আ) সংখ্যা ১ লাখ ২৪ হাজার (ইবন কাছীর, তাফসীর, ১খ., ৪৬৫)।
কুরআন মজীদে সর্বপ্রথম (বিন্যাসক্রম অনুসারে) সূরা আল-বাকারায় ইহাদেরকে সম্বোধন করিয়া বলা হয় :
“হে নবী ইসরাঈল! তোমরা আমার সেই অনুগ্রহকে স্মরণ কর যদ্দ্বারা আমি তোমাদেরকে অনুগৃহীত করিয়াছি এবং আমার সঙ্গে তোমাদের অঙ্গীকার পূর্ণ কর, আমিও তোমাদের সঙ্গে আমার অঙ্গীকার পূর্ণ করিব। আর তোমরা শুধু আমাকেই ভয় কর। আমি যাহা নাযিল করিয়াছি তোমরা তাহাতে ঈমান আন। ইহা তোমাদের নিকট যাহা আছে তাহার প্রত্যয়নকারী। আর তোমরা উহার প্রথম প্রত্যাখ্যানকারী হইও না এবং আমার আয়াতসমূহের বিনিময়ে তুচ্ছ মূল্য গ্রহণ করিও না। তোমরা শুধু আমাকেই ভয় কর” (২ : ৪০-৪১)।
উক্ত আয়াত হইতে শুরু করিয়া সূরা বাকরার বিস্তারিত অংশ জুড়িয়া বনী ইসরাঈলের ইতিহাসের খণ্ডচিত্র, তাহাদেরকে আল্লাহ প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধা, তাহাদের অবাধ্যাচারিতা এবং সর্বশেষে মহানবী (স)-এর নবুওয়াত প্রত্যাখ্যান করার বিষয় আলোচিত হইয়াছে। প্রথমেই তাহাদেরকে আল্লাহ প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধার কথা স্মরণ করিতে আহবান জানানো হইয়াছে। তাহাদের প্রতি আল্লাহ তাআলার নিয়ামতসমূহ হইল, তাহাদেরকে মানবজাতির নেতৃত্বদানের পদে সমাসীন করা হইয়াছিল এবং একইসঙ্গে নবুওয়াত ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব দান করা হইয়াছিল। ২ : ৪৭ আয়াতে সেদিকেই ইঙ্গিত করা হইয়াছে । “তোমাদেরকে বিশ্বের সকলের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করিয়াছিলাম” (আরও দ্র. ২ : ১২২)।
ইহার পর তাহাদেরকে আল্লাহর সহিত কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করার আহ্বান জানানো হইয়াছে। তাফসীরকারগণ বলেন যে, তাহাদের নিকট হইতে আল্লাহ প্রদত্ত শরীআত অনুসরণের অঙ্গীকার গ্রহণ করা হইয়াছিল এবং বিনিময়ে তাহাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতের সাফল্য দানের জন্য আল্লাহ ওয়াদা করেন (যেমন ২ : ৬৩ ও ৯৩; ৪ : ১৫৪ ও ৫ : ৭ আয়াত)। মুফাসসিরগণ আরও বলেন যে, তাহাদের নিকট হইতে সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (স)-এর নবুওয়াত স্বীকার করিয়া তাহার অনুসরণ করার অঙ্গীকার গ্রহণ করা হয়। এই মত অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত। কারণ পরের আয়াতেই (২ : ৪১) তাহাদেরকে রাসূলুল্লাহ (স)-এর শরীআত মান্য করার এবং তাহা প্রত্যাখ্যান না করার নির্দেশ প্রদান করা হইয়াছে। বাইবেল হইতেও ইহার সমর্থন পাওয়া যায়। হযরত মূসা (আ) তাঁহার জাতিকে সম্বোধন করিয়া প্রদত্ত ভাষণে বলেন : “প্রভু, তোমার সদাপ্রভু তোমার মধ্য হইতে, তোমার ভ্রাতৃগণের মধ্য হইতে, তোমার জন্য আমার সদৃশ একজন নবী উৎপন্ন করিবেন। তোমরা তাঁহার কথায় কর্ণপাত করিও ….. তখন সদাপ্রভু আমাকে কহিলেন, তাহারা ভালোই বলিয়াছে। আমি তাহাদের জন্য তাহাদের ভ্রাতৃগণের মধ্য হইতে তোমার সদৃশ একজন উৎপন্ন করিব এবং তাঁহার মুখে আমার বাক্য দিব। আর আমি তাহাকে যাহা আজ্ঞা করিব, তাহা তিনি তাহাদেরকে বলিবেন। আর আমার নামে তিনি যে সকল বাক্য বলিবেন, তাহাতে যে কেহ কর্ণপাত না করিবে, তাহার কাছে আমি পরিশোধ লইব” (বাইবেলের দ্বিতীয় বিবরণ, ১৮ : ১৫-১৯)।
হযরত ঈসা (আ)-এর ভাষায় বাইবেলের লূতন নিয়মের বহু স্থানে মহানবী (স)-এর আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী বিদ্যমান আছে। তিনি তাঁহার অনুসারীদেরকে বলেন, “যাহাকে আমি পিতার নিকট হইতে তোমাদের নিকট পাঠাইয়া দিব। সত্যের সেই আত্মা, যিনি পিতার নিকট হইতে বাহির হইয়া আসেন, যখন সেই সহায় আসিবেন, তিনিই আমার বিষয়ে সাক্ষ্য দিবেন” (বাইবেলের যোহন, ১৫ : ২৬)।
“তথাপি আমি তোমাদেরকে সত্য বলিতেছি, আমার যাওয়া তোমাদের পক্ষে ভাল। কারণ আমি গেলে সেই সহায় তোমাদের নিকট আসিবেন না। কিন্তু আমি যদি যাই, তবে তোমাদের নিকট তাহাকে পাঠাইয়া দিব” (যোহন ১৬ : ৭; আরও দ্র. ১৪ : ১৬-১৭; ২৫-২৬; ১৬ : ১২-১৫)। কুরআনের ভাষায় হযরত ঈসা (আ) বনী ইসরাঈলকে এইভাবে সম্বোধন করিয়াছেন ।
“মরিয়ম-তনয় ঈসা যখন বলিল, হে বনী ইসরাঈল! আমি তোমাদের নিকট আল্লাহর রাসূল, আমার পূর্ব হইতে তোমাদের নিকট যে তাওরাত রহিয়াছে আমি তাহার সমর্থক এবং আমার পরে আহমাদ নামে যে রাসূল আসিবে আমি তাঁহার সুসংবাদ বহনকারী। পরে সে যখন স্পষ্ট নির্দশনসমূহসহ তাহাদের নিকট লইয়া আসিল তখন তাহারা বলিতে লাগিল, ইহা তো এক স্পষ্ট জাদু” (৬১৪ ৬)।
মহানবী (স)-এর একটি নাম ‘আহমাদ, হাদীছেও তাহা উদ্ধৃত হইয়াছে (দ্র. বুখারী, বাংলা অনু., মানাকিব, বাব ১৮, নং ৩২৬৮, ৩খ., পৃ. ৪৫৫; তাফসীর সূরা ৬১, নং ৪৫২৮, ৪খ, পৃ. ৫৬৮; মুসলিম, বাংলা অনু., ফাদাঈল, বাব ৩৪৩, নং ৫৮৯৪, ৫৮৯৫, ৫৮৯৭, ৭খ., পৃ. ৩৪৬; তিরমিযী, বাংলা অনু., আদাব, বাব ৬৭, নং ২৭৭৭, ৫খ., পৃ. ৮১; মুওয়াত্তা, জামে, বাব আসমাউন নবী (স); দারিমী, রিকাক, বাব ৫৯, নং ২৭৭৫, ২খ., ৪০৯)। উল্লেখ্য যে, মদীনায় রাসূলুল্লাহ (স) সবচেয়ে মারাত্মক বিরোধিতার সম্মুখীন হইয়াছিলেন ইয়াহুদীদের পক্ষ হইতে। হযরত মূসা (আ) আল্লাহর নির্দেশে তুর পাহাড়ে গেলে পেছনে তাঁহার উম্মাত গো-বৎস পূজায় লিপ্ত হয়। তিনি তুর হইতে ফিরিয়া আসিয়া তাহাদের প্রতি রহমাত বর্ষণের জন্য যে দোআ করেন (৭ : ১৪২-১৫৬), উহার জওয়াবে আল্লাহ তাআলা বলেন : “আমার শাস্তি যাহাকে ইচ্ছা দিয়া থাকি এবং আমার দয়া-তাহা তো প্রতিটি বস্তুতে ব্যাপ্ত। সুতরাং আমি উহা তাহাদের জন্য নির্ধারণ করিব যাহারা তাকওয়া অবলম্বন করিবে, যাকাত দিবে এবং আমার আয়াতসমূহে ঈমান আনিবে । যাহারা অনুসরণ করিবে বার্তাবাহক উম্মী নবীর, যাহার উল্লেখ তাহাদের নিকট রক্ষিত তাওরাত ও ইনজীলে লিপিবদ্ধ পায়, যে তাহাদেরকে সৎ কাজের নির্দেশ দেয় এবং অসৎ কাজে বাধা দেয়, যে তাহাদের জন্য পবিত্র বস্তু হালাল করে এবং অপবিত্র বস্তু হারাম করে, যে তাহাদেরকে তাহাদের গুরুভার ও শৃংখল হইতে মুক্ত করে, যাহা তাহাদের উপর ছিল। অতএব যাহারা তাহার উপর ঈমান আনে, তাহাকে সম্মান করে, তাহাকে সাহায্য করে এবং যে নূর তাহার সহিত নাযিল হইয়াছে উহার অনুসরণ করে তাহারাই সফলকাম” (৭ : ১৫৬-৭)।
অতএব তাওরাত ও ইনজীলে হযরত মুহাম্মাদ (স)-এর প্রতি বনী ইসরাঈলের ঈমান আনয়নের এই যে আহবান কুরআন মজীদে বিবৃত হইয়াছে, তাহার ইঙ্গিত বর্তমান বাইবেলেও বিদ্যমান আছে। (যাহার কয়েকটি বরাত ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হইয়াছে এবং আরও দেখা যাইতে পারে নিম্নোক্ত স্থান ও যোহন, ১ : ১৯-২৩)।
বনী ইসরাঈলের নিকট হইতে সর্বশ্রেষ্ঠ, সর্বপ্রধান ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ যে অঙ্গীকার আল্লাহ তাআলা গ্রহণ করিয়াছিলেন তাহা ছিল, তাহারা কেবল এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর ইবাদত করিবে, তাঁহার সহিত কোন কিছুকে অংশীদার বানাইবে না এবং ইহার সহিত আরও কতিপয় সঙ্কর্মের অঙ্গীকার। মহান আল্লাহ বলেন :
‘স্মরণ কর, যখন ইসরাঈল-সন্তানদের অঙ্গীকার নিয়াছিলাম যে, তোমরা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাহারও ইবাদত করিবে না, মাতা-পিতা, আত্মীয়-স্বজন, পিতৃহীন ও দরিদ্রদের প্রতি সদয় ব্যবহার করিবে এবং মানুষের সহিত সদালাপ করিবে, সালাত কায়েম করিবে ও যাকাত দিবে, কিন্তু স্বল্প সংখ্যক লোক ব্যতীত তোমরা বিরুদ্ধভাবাপন্ন হইয়া মুখ ফিরাইয়া লইয়াছিলে” (২ ৪ ৮৩)।
তাওহীদের প্রতিষ্ঠা ও শিরক-এর মূলোচ্ছেদ সম্পর্কে বর্তমান বাইবেলেও অত্যন্ত জোরালো নির্দেশ বিদ্যমান। “আমার সাক্ষাতে (বা ব্যতিরেকে) তোমার অন্য কোন মাবুদ না থাকুক। তুমি নিজের জন্য খোদিত প্রতিমা নির্মাণ করিও না, উপরিস্থিত আকাশে, নীচস্থ পৃথিবীতে এবং পৃথিবীর নিম্নে পানিতে যাহা যাহা আছে তাহাদের কোন মূর্তি নির্মাণ করিও না। তুমি তাহাদের সামনে সিজদা করিও না এবং তাহাদের ইবাদত করিও না। কেননা আমি আল্লাহ তোমার সদাপ্রভু নিজ গৌরব রক্ষণে উদ্যোগী” (বাইবেলের যাত্রাপুস্তক ২০ : ৩-৫; বাইবেলের দ্বিতীয় বিবরণ, ৫ ও ৭-৯)।
“হে ইসরাঈল শুন! খোদাওয়া আমাদের সদাপ্রভু, একই সদাপ্রভু। আর তুমি তোমার সমস্ত হূদয়, তোমার সমস্ত প্রাণ এবং তোমার সমস্ত শক্তি দ্বারা আপন প্রভু, সদাপ্রভুর প্রেম করিবে” (দ্বিতীয় বিবরণ, ৬ : ৪-৬)।
“তুমি আপন প্রভু সদাপ্রভুকেই ভয় করিবে, তাঁহারই সেবা করিবে এবং তাহারই নাম লইয়া দিব্য করিবে। তোমরা অন্য দেবগণের চারদিকের জাতিদের দেবগণের অনুগামী হইও না। কেননা তোমার মধ্যবর্তী তোমার খোদা সদাপ্রভু স্বগৌরব রক্ষণে উদ্যোগী প্রভু। সাবধান পাছে তোমার রব সদাপ্রভুর ক্রোধ তোমার প্রতিকূলে প্রজ্জ্বলিত হয়, আর তিনি ভূমণ্ডল হইতে তোমাকে উচ্ছিন্ন করেন” (দ্বিতীয় বিবরণ, ৬ : ১৩-১৫)।
ইয়াহুদী বিশ্বকোষে (Jewish Encyclopedia) লিখিত আছে, বনী ইসরাঈলের উপর আরোপিত বিশেষ দায়িত্ব এই ছিল যে, তাহারা আল্লাহর একত্ববাদের দাওয়াত দিতে থাকিবে এবং সূর্যপূজা, চন্দ্রপূজা ও তারকাপূজার বিরুদ্ধে জিহাদ করিতে থাকিবে (উক্ত বিশ্বকোষ, ৬খ., পৃ. ১১-এর বরাতে তাফসীরে মাজেদী, বাংলা অনু, ১খ., পৃ. ৯৪, টীকা নং ১৬২)। বনী ইসরাঈলের একমাত্র দায়িত্ব ছিল পৃথিবীতে আল্লাহর সাক্ষীরূপে বসবাস করা (পূ. এ., ৬খ, পৃ. ২; মাজেদী, ঐ; আরও দ্র. বাইবেলের যিশাইয়, ৪৩ ও ১০ ও ১১)। তৌহীদপন্থী জাতি মাত্রই পৃথিবীতে আল্লাহর সাক্ষীস্বরূপ। মহান আল্লাহ মুসলমানদেরকে লক্ষ্য করিয়া বলেন :
“এভাবে আমি তোমাদেরকে এক মধপন্থী জাতিরূপে প্রতিষ্ঠা করিয়াছি, যাহাতে তোমরা মানবজাতির জন্য (আল্লাহর) সাক্ষীস্বরূপ হও এবং রাসূল তোমাদের জন্য সাক্ষীস্বরূপ হয়” (২ : ১৪৩; আরও দ্র. ৪ : ১৩৫; ৫৪ ৮ এবং ২২৪ ৭৮)। মহানবী (স) মুসলমানদেরকে সম্বোধন করিয়া বলেন :
“তোমরা পৃথিবীতে আল্লাহর সাক্ষীস্বরূপ” (বুখারী, জানাইয, বাবঃ মৃত ব্যক্তির প্রশংসা করা, নং ১২৭৬, ১খ., পৃ. ১৮৩; শাহাদাত, বার ৬, নং ২৪৫০, ২খ, মুসলিম, জানাইয, নং ২০৬৭, ৩খ., পৃ. ৩২৯-৩০; তিরমিযী, জানাইয, বাব ৬২, নং ৯৯৬, ২খ, পৃ. ২৫৪-৫; নাসাঈ, জানাইয, বাবঃ মৃতের প্রশংসা, ১ ও ২ নং হাদীস; ইবন মাজা, জানাইয, বাব ২০, নং ১৪৯১-২; যুহদ, ‘বাব ২৫, নং ৪২২১)।
একই বিশ্বকোষে আরও বলা হইয়াছে, “আল্লাহর ইবাদতকারী তৌহীদপন্থী সম্প্রদায় হিসাবে বনী ইসরাঈল ছিল মুশরিক সম্প্রদায়সমূহের তুলনায় শ্রেষ্ঠতর” (ঐ বিশ্বকোষ, ৬খ., পৃ. ১১; মাজেদী, ১খ, পৃ. ৯৪)। “রাজনৈতিক জাতিপুঞ্জের মধ্যে সর্বপ্রথম হিব্রুভাষীরাই তাহাদের নবীগণের শিক্ষার মাধ্যমে তৌহীদের (আল্লাহর এককত্ব) শিক্ষায় উপনীত হইয়াছিল (হিব্রু বিশ্বকোষ, ৮খ., পৃ. ৬৫৯-এর বরাতে তাফসীরে মাজেদী, পূ. স্থা.)।
খৃস্টান ঐতিহাসিকগণও উপরিউক্ত ঐতিহাসিক সত্যের পুনরুল্লেখ করিয়াছেন। The Historians History of the world গ্রন্থে বলা হইয়াছে :
বনী ইসরাঈল সম্প্রদায়ের মাঝেই তাওহীদের ভিত্তি স্থাপিত হইয়াছিল (২খ, পৃ. ৩)। খৃস্টীয় বা ইসলামী যাহাই হউক, মানবসভ্যতার বর্তমান সব কয়টি আধ্যাত্মিক পরিমণ্ডলের সুগভীরে এই তৌহীদেরই প্রতিধ্বনি শ্রুত হয়, যাহার আহবান ব্যাপকভাবে জানাইয়াছিল সর্বপ্রথম ইসরাঈলী সম্প্রদায়” (ঐ গ্রন্থ, ২খ., পৃ. ২)। কিন্তু তৌহীদের ধারক ও বাহক এই ইসরাঈলীরা ইয়াহুদী ও খৃস্টান দুই সম্প্রদায়ে বিভক্ত হইয়া আজ প্রকাশ্য শিরকে লিপ্ত হইয়া রহিয়াছে। এমনকি খৃস্টান সম্প্রদায় তাহাদের উপাসনালয়ে মরিয়ম (আ) ও ঈসা (আ)-এর কল্পিত মূর্তি পর্যন্ত স্থাপন করিয়াছে। মহান আল্লাহ বলেন :
“ইয়াহূদীরা বলে, উমায়র আল্লাহর পুত্র এবং খৃস্টানরা বলে, মসীহ আল্লাহর পুত্র। ইহা তাহাদের মনগড়া কথা। পূর্বে যাহারা কুফরী করিয়াছিল ইহারা তাহাদের মত কথা বলে। আল্লাহ ইহাদেরকে ধ্বংস করুন। কোন্ দিকে ইহাদেরকে ফিরাইয়া দেওয়া হইয়াছে। ইহারা আল্লাহ ব্যতীত ইহাদের পণ্ডিতগণকে (রিব্বী) ও সংসার বিরাগীদেরকে (পাদ্রী) ইহাদের প্রভুরূপে গ্রহণ করিয়াছে এবং মরিয়ম-পুত্র মসীহকেও। অথচ তাহারা এক ইলাহ-এর ইবাদত করিবার জন্য আদিষ্ট হইয়াছিল। তিনি ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ নাই। তাহারা যাহাকে শরীক করে তাহা হইতে তিনি অতীব পবিত্র” (৯ : ৩০-৩১)।
“যাহারা বলে, আল্লাহ্ই মরিয়ম-তনয় মসীহ্, তাহারা অবশ্যই কুফরী করিয়াছে। অথচ মসীহ বলিয়াছিল, হে বনী ইসরাঈল! আমার প্রভু ও তোমাদের প্রভু আল্লাহর ইবাদত কর। কেহ আল্লাহর সহিত শরীক করিলে আল্লাহ তাহার জন্য অবশ্যই জান্নাত হারাম করিবেন এবং তাহার আবাস জাহান্নাম। যালেমদের জন্য কোন সাহায্যকারী নাই। যাহারা বলে, আল্লাহ তো তিনের মধ্যে একজন, তাহারা অবশ্যই কুফরী করিয়াছে। যদিও এক ইলাহ ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ নাই” (৫ : ৭২-৭৩)।
আল্লাহূকে এক ও অদ্বিতীয় ইলাহ মানিয়া লইয়া একনিষ্ঠভাবে তাঁহার ইবাদত করার সঙ্গে সঙ্গে বনী ইসরাঈলকে সালাত কায়েম, যাকাতদান ইত্যাদিরও নির্দেশ প্রদান করা হয়। তাহাদেরকে সত্যকে মিথ্যার সহিত এবং জ্ঞাতসারে সত্যকে গোপন করিতে নিষেধ করা হয় এবং তুচ্ছ পার্থিব স্বার্থে আল্লাহর কিতাবকে বিক্রয় (বিকৃত) করিতে নিষেধ করা হয় (দ্র. ২ : ৪১-৪২)। বাইবেলেও অনুরূপ নির্দেশ বিদ্যমান আছে । “তোমার পিতাকে ও তোমার মাতাকে সমাদর করিও” (যাত্রাপুস্তক, ২০১২; দ্বিতীয় বিবরণ, ৫ : ১৬)। “আপনার দরিদ্র ভ্রাতার প্রতি আপন হস্ত (দান) রুদ্ধ করিও না, কিন্তু বরং) তাহার প্রতি মুক্ত হস্ত হইয়া তাহার অভাবজনিত প্রয়োজনানুসারে তাহাকে অবশ্য ঋণ দিও” (দ্বিতীয় বিবরণ ১৫ : ৮-৯)। “এবং বিদেশী, পিতৃহীন ও বিধবা তোমার নগরদ্বারের মধ্যবর্তী এই সকল লোক আসিয়া ভোজন করিয়া তৃপ্ত হইবে” (ঐ, ১৪ : ২৯)। “তুমি আপন দেশে তোমার ভ্রাতার প্রতি, তোমার দুঃখী ও দীনহীনের প্রতি তোমার হাত অবশ্য খুলিয়া রাখিবে” (ঐ, ১৫ : ১১)। আল্লাহর কিতাবকে বিকৃত না করার নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও তাহারা উহার বিকৃতি সাধণ করে। “তাহারা কুৎসিৎ লাভের অনুরোধে অনুপযুক্ত শিক্ষা দিয়া ঘরকে ঘর বরবাদ করিয়া ফেলে (বাইবেলের লূতন নিয়মাধীন তীত, ১৪১১)।
বনী ইসরাঈলের নিকট হইতে এই মর্মেও অঙ্গীকার গ্রহণ করা হইয়াছিল যে, তাহারা পরস্পরকে হত্যা করিবে না, আপনজনদেরকে স্বদেশভূমি হইতে বিতাড়ন করিবে না (দ্র. ২৪ ৮৪)। কিন্তু তাহারা এই নির্দেশ লংঘন করিয়া পরস্পরকে হত্যা করে, স্বদেশ হইতে উচ্ছেদ করে এবং মুক্তিপণ আদায় করে (দ্র. ২ : ৮৫)। রক্তপাতের এই নিষেধাজ্ঞা বর্তমান বাইবেলেও একাধিক স্থানে পরিদৃষ্ট হয়ঃ “তুমি নরহত্যা করিও না” (যাত্রাপুস্তক, ২০ : ১৩)। “তোমার প্রতিপালক সদাপ্রভু অধিকারার্থে তোমাকে যে দেশ দিতেছেন, তোমার সেই দেশের মধ্যে নির্দোষ রক্তপাত না হয়, আর তোমার উপরে রক্তপাতের অপরাধ না বর্তে” (দ্বিতীয় বিবরণ, ১৯ : ১০)। “নরহত্যা করিও না। ব্যভিচার করিও না। চুরি করিও না। তোমার প্রতিবাসীর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দিও না। তোমার প্রতিবাসীর গৃহে লোভ করিও না, প্রতিবাসীর স্ত্রীতে কিংবা তাহার দাসে কি দাসীতে কিংবা তাহার গরুতে কি গর্দভে, প্রতিবাসীর কোনও বস্তুতেই লোভ করিও না” (যাত্রাপুস্তক ২০ : ১৩-১৭; দ্বিতীয় বিবরণ ৫ ১৭-২১)।
ইসরাঈলীরা বাইবেলের এই নিষেধাজ্ঞা লংঘন করিয়া শুধু সাধারণ মানুষকেই হত্যা করে নাই, বরং তাহারা আল্লাহর নবীগণকেও পর্যন্ত হত্যা করিয়াছে। মহান আল্লাহ্ বলেন :
“যখনই কোন রাসূল তোমাদের নিকট তোমাদের অমনঃলূত কিছুসহ আসিয়াছে তখনই তোমরা অহংকার করিয়াছ এবং কতককে প্রত্যাখ্যান করিয়াছ ও কতককে হত্যা করিয়াছ” (২ : ৮৭; আরও দ্র. ২ : ৬১, ৯১; ৩ : ২১; ১১২; ৪ : ১৫৫; ৫: ৭০)।
রাসূলুল্লাহ (স) তাঁহার উপর নাযিলকৃত বিষয়ের উপর ঈমান আনার জন্য ইসরাঈলীদেরকে আহবান করিলে তাহারা উত্তরে বলে যে, তাহাদের উপর যাহা নাযিল হইয়াছে তাহাতে তাহারা ঈমান আনিয়াছে। তাহাদের এই ঈমানকে চ্যালেঞ্জ করিয়া নবী (স) জিজ্ঞাসা করেন, তাহা হইলে তোমরা অতীতে আল্লাহর নবীগণকে কেন হত্যা করিয়াছিলে (দ্র. ২ : ৯১)? আবার কখনও তাহারা বলিত, “আল্লাহ আমাদেরকে আদেশ দিয়াছেন যে, আমরা যেন কোন রাসূলের প্রতি ঈমান না আনি, যতক্ষণ পর্যন্ত সে আমাদের নিকট এমন কুরবানী উপস্থিত না করিবে যাহা আগুনে গ্রাস করিবে” (৩ : ১৮৩)। আল্লাহ তাআলা মহানবী (স)-কে তাহাদের এই দাবিকে প্রত্যাখান করিয়া বলিতে বলেন, “আমার পূর্বে তো অনেক রাসূল স্পষ্ট নিদর্শনসমূহসহ এবং তোমরা যাহা বলিতেছ তাহাসহ তোমাদের নিকট আসিয়াছিল। যদি তোমরা সত্যবাদী হও তবে কেন তাহাদেরকে হত্যা করিয়াছিলে” (৩ : ১৮৩)? শুধু তাহাই নহে, তাহারা তো নির্ভীকভাবে তাহাদের বংশেরই নবী হযরত ঈসা (আ)-কে হত্যা করার প্রকাশ্য দাবি করিয়াছে (যদিও তাহারা তাঁহাকে হত্যা করিতে পারে নাই); “আমরা আল্লাহর রাসূল মরিয়ম-পুত্র ঈসা মসীহকে হত্যা করিয়াছি”, (৪ ও ১৫৭)। বাইবেলের একাধিক স্থানে নবী হত্যার উল্লেখ রহিয়াছে। “কিন্তু তাহারা সদপ্রভুর রাসূলগণকে উপহাস করিত, তাঁহার বাক্য তুচ্ছ করিত এবং তাহার নবীগণকে বিদ্রূপ করিত। তন্নিমিত্ত শেষে আপন প্রজাদের বিরুদ্ধে সদাপ্রভুর ক্রোধ উথিত হইল। অবশেষে আর প্রতিকারের উপায় রহিল না (বাইবেলের ২ বংশাবলী, ৩৬ : ১৬)। “তোমাদেরই খড়গ বিনাশক সিংহের ন্যায় তোমাদের ভাববাদীগণকে গ্রাস করিয়াছে” (বাইবেলের যিরমিয় ২ ও ৩০)। “হে ইয়াকূবের কুল, হে ইসরাঈল কুলের সমুদয় গোষ্ঠী! সদাপ্রভুর বাক্য শোন। সদাপ্রভু এই কথা বলেন, তোমাদের পিতৃপুরুষেরা আর কি অন্যায় দেখিয়াছে যে, তাহারা আমা হইতে দূরে গিয়াছে, অসারতার অনুগামী হইয়া অসার হইয়াছে” (ঐ, ২ : ৪)?–তথাপি তাহারা অবাধ্য হইয়া তোমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহাচরণ করিল, তোমার ব্যবস্থা পশ্চাত দিকে ফেলিল এবং তোমার যে ভাববাদীগণ তোমার প্রতি তাহাদেরকে ফিরাইবার জন্য তাহাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতেন তাহাদেরকে বধ করিল এবং মহা অসন্তোষকর কর্ম করিল” (বাইবেলের নহিমিয়, ৯ ও ২৬)।
বাইবেলের খৃস্টান ধর্মীয় অংশেও অনুরূপ সাক্ষ্য বিদ্যমান : “হে শক্ত গ্রীবেরা এবং হূদয়ে ও কর্মে অচ্ছিন্নত্বকেরা …. তোমাদের পিতৃপুরুষেরা কোন্ ভাববাদীকে তাড়না না করিয়াছে? তাহারা তাহাগিকেই বধ করিয়াছে” (বাইবেলের প্রেরিতদের কার্য, ৭ : ৫১-৫২)। “ইহাতে তোমরা তোমাদের বিষয়ে এই সাক্ষ্য দিতেছ যে, যাহারা ভাববাদীগণকে বধ করিয়াছিল, তোমরা তাহাদেরই সন্তান।… হা যেরুসালেম যেরুসালেম! তুমি ভাববাদীগণকে বধ করিয়া থাক ও তোমার নিকটে যাহারা প্রেরিত হয় তাহাদিগকে পাথর মারিয়া থাক” (বাইবেলের মথি, ২৩ : ৩১-৩৭; আরও দ্র. ল্ক, ১৩ ও ৩৪)। ইয়াহূদী রাজা হেরোধ এক নর্তকীর আবদার রক্ষা করিতে হযরত ইয়াহইয়া (আ)-কে হত্যা করায় (তু. মথি, ১৪ : ১-১২; মার্ক, ৬ : ১৪-২৯; লূক, ৯ ও ৭-৯)। ইউশা, ইয়ারমিয়া ও যাকারিয়া (আ)-কেও তাহারা হত্যা করে। অবশ্য ইহার প্রতিশোধও তাহাদের উপর নামিয়া আসে। তাহারা নবীদেরকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও পরিহাস করিত। তাঁহাদের বাক্যকে তুচ্ছ ও বিদ্রূপ করিত। ফলে শেষ পর্যন্ত তাহাদের বিরুদ্ধে সদাপ্রভুর ক্রোধ উথিত হইল। তিনি কালদীয়দের রাজাকে তাহাদের বিরুদ্ধে পাঠাইলেন এবং তাহারা তাহাদের যুবকদিগকে তাহাদের উপসনালয়ে খড়গ দ্বারা হত্যা করে এবং যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ, জরাজীর্ণ সকলের প্রতি নির্দয় ব্যবহার করে। সে তাহাদের জনপদ ও উপাসনালয় লুণ্ঠন করিল এবং উপাসনালয়ে অগ্নিসংযোগ করিল (তু. ২ বংশাবলী, ৩৬ : ১৫-২১)। বনী ইসরাঈলের জন্য প্রেরিত হযরত ঈসা (আ) এবং সমগ্র মানবজাতির জন্য প্রেরিত সর্বশেষ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মাদ (স)-এর নবুওয়াতকে প্রত্যাখ্যান করিয়া তাহারা কিয়ামত পর্যন্ত অভিশপ্ত জাতিতে পরিণত হইয়াছে এবং অভিশাপের অসহনীয় বোঝা তাহারা আজও বহন করিয়া চলিয়াছে। তাহাদের উপর অভিশাপ বর্ষণ করিয়াছেন হযরত দাউদ (আ) এবং হযরত ঈসা (আ)।
“বনী ইসরাঈলের মধ্যে যাহারা কুফরী করিয়াছিল তাহারা দাউদ ও মরিয়ম-পুত্র ঈসা কর্তৃক অভিশপ্ত হইয়াছিল। কারণ তাহারা ছিল অবাধ্য ও সীমালংঘনকারী। তাহারা যেসব গর্হিত কাজ করিত তাহা হইতে তাহারা একে অপরকে বারণ করিত না। তাহারা যাহা করিত তাহা কতই না নিকৃষ্ট” (৫ : ৭৮-৭৯)।
দাউদ (আ)-এর অভিশাপ যাবুর ৭৮ : ২১-২৩-এ এবং ঈসা (আ)-এর অভিশাপ মথি, ২৩ ও ৩১-৩২-এ পরোক্ষভাবে উল্লিখিত আছে। কুরআন মজীদে মোট নয়বার ইহাদের প্রতি অভিশাপ বর্ষণ (লানত) উল্লিখিত হইয়াছে (দ্র. ২৪ ৮৮, ৮৯; ৪ : ৪৬, ৪৭, ৫২; ৫ : ১৩, ৬০ ও ৬৪)।
“আল্লাহর প্রতিশ্রুতি ও মানুষের প্রতিশ্রুতির বাহিরে যেখানেই তাহাদেরকে পাওয়া গিয়াছে সেখানেই তাহারা লাঞ্ছিত হইয়াছে। তাহারা আল্লাহর ক্রোধের পাত্র হইয়াছে এবং হীনতাগ্রস্ত হইয়াছে। ইহা এইহেতু যে, তাহারা আল্লাহর আয়াতসমূহ প্রত্যাখ্যান করিত এবং অন্যায়ভাবে নবীগণকে হত্যা করিত। ইহা এইজন্য যে, তাহারা অবাধ্য হইয়াছিল এবং সীমালংঘন করিত” (৩ : ১১২)।
বনী ইসরাঈল প্রসঙ্গে আরও দ্র. নিবন্ধ হযরত মূসা (আ), হযরত দাউদ (আ), হযরত ঈসা (আ), হযরত মুহাম্মাদ (স)। মোটকথা নবী-রাসূলগণের অবমাননা এবং তাহাদেরকে হত্যা করার অভিযোগ কুরআন মজীদই সর্বপ্রথম ইয়াহুদীদের প্রতি আরোপ করে নাই, বরং তাহাদের নিজস্ব কিতাবই তাহাদের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম উক্ত অভিযোগ উত্থাপন করিয়াছে। কুরআন কেবল উহার পুনরুক্তি করিয়াছে এবং উহার সত্যতা সমর্থন করিয়াছে।
ইসরাঈলীদের, বিশেষত তাহাদের আলিম সম্প্রদায়ের আরেকটি মারাত্মক অপকর্ম এই যে, তাহারা তাহাদের নবীগণের উপর নাযিলকৃত আসমানী কিতাবসমূহের বিকৃতি সাধন (তাহ্রীফ) করিয়াছে শব্দগতভাবে, অর্থগতভাবে, মূল শব্দ অপসারণ করিয়া অথবা তদস্থলে নূতন শব্দ প্রবিষ্ট করাইয়া বা আসল তথ্য গোপন করিয়া তাহাদেরকে নির্দেশ প্রদান করা হইয়াছিল যে, তাহারা যেন তুচ্ছ পার্থিব স্বার্থে আল্লাহর কিতাব বিক্রয়ের ব্যবসায় না করে (২৪ ৪১), সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশ্রিত না করে এবং জ্ঞাতসারে সত্যকে গোপন না করে (২৪ ৪২)। কিন্তু তাহারা তাওরাত ও ইনজীলের সম্ভাব্য সকল প্রকার তাহরীফ সাধন করিতে কখনও কুণ্ঠিত হয় নাই।
“অথচ তাহাদের একদল আল্লাহর বাণী শ্রবণ করে, অতঃপর তাহারা উহা হূদয়ঙ্গম করার পরও সজ্ঞানে উহার বিকৃতি সাধন করে” (২৪ ৭৫)।
“ইয়াহুদীদের মধ্যে কতক লোক কথাগুলি স্থানচ্যুত করিয়া বিকৃত করে” (৪ : ৪৬; আরও দ্র. ৫ : ১৩ ও ৪১)।
বনী ইসরাঈলের বিরুদ্ধে আসমানী কিতাব বিকৃতির অভিযোগ শুধু কুরআনই উত্থাপন করে নাই, বাইবেলেও এই অভিযোগ করা হইয়াছেঃ “কারণ অনেক অদম্য লোক অসার বাক্যবাদী ও বুদ্ধিভ্রামক লোক আছে, বিশেষত ত্বকছেদীদের মধ্যে আছে…. তাহারা কুৎসিত লাভের অনুরোধে অনুপযুক্ত শিক্ষা দিয়া কখন কখন একেবারে ঘর উল্টাইয়া ফেলে” (তীত, ১ : ১০-১১)। তাহারা এতটা দুঃসাহস দেখাইয়াছে যে, নিজেদের পক্ষ হইতে মনগড়া কিছু রচনা করিয়া তাহা আল্লাহর কিতাবের অংশ বলিয়া চালাইয়া দিয়াছে।
“অতএব দুর্ভোগ তাহাদের জন্য যাহারা নিজ হাতে কিতাব রচনা করে এবং তুচ্ছ মূল্য প্রাপ্তির জন্য বলে, ইহা আল্লাহর নিকট হইতে। তাহাদের হাত যাহা রচনা করিয়াছে তাহার জন্য রহিয়াছে তাহাদের ধ্বংস এবং তাহারা যাহা উপার্জন করে তাহার জন্যও তাহাদের ধ্বংস অনিবার্য” (২৪ ৭৯)।
বনী ইসরাঈলের এই বেপরোয়াভাবে মারাত্মক অপরাধ কর্মে লিপ্ত হওয়ার পশ্চাতে রহিয়াছে। তাহাদের একটি ভ্রান্ত ধর্মবিশ্বাস। তাহারা মনে করে যে, তাহারা যাহাই করুক না কেন, সেজন্য তাহাদেরকে দোযখবাসী হইতে হইবে না, তাহাদের মহান পূর্বপুরুষ হযরত ইবরাহীম (আ) দোযখের দরজায় দণ্ডায়মান থাকিবেন এবং তিনি তাহাদেরকে তথা হইতে উদ্ধার করিয়া জান্নাতে পৌঁছাইয়া দিবেন। তাহা ছাড়া তাহারা দোযখের দরজায় পৌঁছিয়া নিজেদের অপরাধ কর্মের স্বীকারোক্তি করার সঙ্গে সঙ্গে তাহাদের অপরাধ ক্ষমা করা হইবে। কারণ তাহারা আল্লাহর প্রিয়পাত্র এবং তাঁহার সন্তান (দ্র. ৫ : ১৮)। যদিও বা তাহারা দোযখে প্রবেশ করে তবে সামান্য কয়েক দিনের জন্য (দ্র. ২ : ৮০)। ইয়াহুদী বিশ্বকোষে তাহাদের বিশ্বাস এইভাবে তুলিয়া ধরা হইয়াছে ও দোযখের আগুন ইয়াহুদী জাতির পাপীদিগকে স্পর্শও করিবে না। কেননা তাহারা জাহান্নামের দরজায় পৌঁছা মাত্রই নিজেদের পাপের স্বীকারোক্তি করিবে এবং প্রভুর নিকট ফিরিয়া আসিবে” (৫খ,, পৃ. ৫৮৩)। ইয়াহূদীদের তালমুদ গ্রন্থের নির্বাচিত সংকলন Every mans Library Series-এ লিপিবদ্ধ আছে : কিয়ামতের দিন ইবরাহীম (আ) দোযখের দরজায় উপস্থিত থাকিবেন এবং কোনও খাতনাকৃত ইয়াহূদীকে তাহাতে পতিত হইতে দিবেন না” (পৃ. ৪০৪)। “দোযখের আগুন ইয়াহদী পাপীদের উপর কোনও ক্ষমতা রাখে না” (পৃ. ৪০৫; তিনটি উদ্ধৃতিই তাফসীরে মাজেদী, বাংলা অনু., ১খ., পৃ. ১৪৬-৭ হইতে গৃহীত)। মহান আল্লাহ্ তাহাদেরকে সতর্ক করিয়া বলেন :
“হাঁ, যাহারা পাপকার্য করে এবং যাহাদের পাপরাশি তাহাদেরকে বেষ্টন করিয়াছে তাহারা দোযখবাসী, যেখানে তাহারা স্থায়ী হইবে” (২ : ৮১; আরও দ্র. ২ : ৮৬ ও ৯০)।
এবং সেই দিনকে ভয় কর যেদিন কেহ কাহারও কোনও উপকারে আসিবে না, কাহারও নিকট হইতে কোনও বিনিময় গ্রহণযোগ্য হইবে না, কোনও সুপারিশ কাহারও পক্ষে লাভজনক হইবে না এবং তাহারা সাহায্যপ্রাপ্তও হইবে না” (২ : ১২৩; আরও দ্র. ২৪ ৪৮)।
যেহেতু বনী ইসরাঈল (ইয়াহূদী ও খৃস্টান উভয় ধর্মাবলম্বী) চূড়ান্তভাবে আল্লাহর কিতাবের নির্দেশ ত্যাগ করিয়া পথভ্রষ্ট হইয়া গিয়াছে এবং সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (স)-এর নবুওয়াত এবং তাঁহার উপর নাযিলকৃত কিতাবকে প্রত্যাখ্যান করিয়া তাহারা হেদায়াত লাভের সর্বশেষ সুযোগও হারাইয়াছে, সেহেতু আল্লাহ তাআলা এই অভিশপ্ত সম্প্রদায়ের অনুসরণ করিতে মুসলমানদেরকে কঠোর ভাষায় নিষেধ করিয়াছেন। মহান আল্লাহ বলেন :
“হে মুমিনগণ! তোমারা ইয়াহুদী ও খৃস্টানদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করিও না । তাহারা পরস্পরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে কেহ তাহাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করিলে সে তাহাদেরই অন্তর্ভুক্ত হইবে। নিশ্চয় আল্লাহ যালেম সম্প্রদায়কে সৎপথে পরিচালিত করেন না” (৫ : ৫১)।
“হে মুমিনগণ! তোমাদের পূর্বে যাহাদেরকে কিতাব দেওয়া হইয়াছিল তাহাদের মধ্যে যাহারা তোমাদের দ্বীনকে উপহাস ও ক্রীড়ার বস্তুরূপে গ্রহণ করে তাহাদেরকে ও কাফেরদেরকে তোমরা বন্ধুরূপে গ্রহণ করিও না। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যদি তোমরা মুমিন হইয়া থাক” (৫ : ৫৭)।
“হে মুমিনগণ! যাহাদেরকে কিতাব দেওয়া হইয়াছে, তোমরা যদি তাহাদের দলবিশেষের আনুগত্য কর, তবে তাহারা তোমাদেরকে ঈমান আনার পর আবার কাফির বানাইয়া ছাড়িবে। কিরূপে তোমরা সত্য প্রত্যাখ্যান করিতে পার যখন আল্লাহর আয়াতসমূহ তোমাদের নিকট পঠিত হয় এবং তোমাদের মধ্যে তাঁহার রাসূল রহিয়াছে : কেহ আল্লাহকে দৃঢ়ভাবে অবলম্বন করিলে সে অবশই সরল পথে পরিচালিত হইবে” (৩ : ১০০-১০১)।
গ্রন্থপঞ্জী : আল-কুরআন ও তাফসীরঃ (১) আল-কুরআনুল করীম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৯শ মুদ্রণ ১৪১৭/১৯৯৭, আয়াতসমূহের তরজমার জন্য; (২) আবদুল মাজেদ দরিয়াবাদী, তাফসীরে মাজেদী, বাংলা অনু., ১খ, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ সংস্করণ, প্রকাশকাল ১৪১৫/১৯৯৪; (৩) তাফসীরে উছমানী, সৌদী সংস্করণ, শায়খুল হিন্দের অনুবাদ এবং শাব্বীর আহমাদ উছমানীর টীকাভাষ্য; (৪) মুফতী মুহাম্মাদ শফী, মাআরেফুল কোরআন, সৌদি সংস্করণ; (৫) আবুল আলা মওদূদী, তাফহীমুল কুরআন, সংশ্লিষ্ট আয়াতের তাফসীর; (৬) ইব্ন কাছীর, তাফসীর, বাংলা অনু, ১খ; (৭) আমীন আহসান ইসলাহী, তাদাববুরে কুরআন, তাজ কোম্পানি, দিল্লী, ১ম সং ১৯৮৯, ১খ।
ইতিহাস ও ইসলামী সাহিত্য : (১) ইবন কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, দারুল ফিকার আল-আরাবী, বৈরূত তা. বি., ১খ.; (২) আবদুল ওয়াহহাব নাজ্জার, কাসাসুল আম্বিয়া, দারুল ফিকার, বৈরূত তা, বি; (৩) ইবন কুতায়বা আদ-দীনাওয়ারী, আল-মাআরিফ, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়া, ১ম সং, বৈরূত ১৪০৭/১৯৮৭; (৪) হিফজুর রহমান, কাসাসুল কুরআন (উর্দু), ৪র্থ সং, দিল্লী ১৪০০/১৯৮০, ১খ., পৃ. ২৭৭-৭৯; (৫) গোলাম নবী অনূদিত আনওয়ারে আম্বিয়া, ৫ম সং, লাহোর তা, বি, পৃ. ৭০-৭৩; (৬) কাদী যায়নুল আবিদীন, কাসাসুল কুরআন, ১ম সং, দেওবন্দ ১৯৯৪; (৭) ইবনুল আছীর, আল-কামিল, ১ম সং, বৈরূত ১৪০৭/১৯৮৭, ১খ, পৃ. ৯৫-৯৬; (৮) সহীহ আল-বুখারী, আরবী-বাংলা, আধুনিক প্রকাশনী, ঢাকা, ৬ খণ্ডে সমাপ্ত; (৯) সহীহ মুসলিম, আরবী-বাংলা, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ, ৮ খণ্ডে সমাপ্ত; (১০) জামে আত-তিরমিযী, আরবী-বাংলা, বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, ৬ খণ্ডে সমাপ্ত; (১১) আবু দাউদ, আরবী সংস্করণ; (১২) নাসাঈ, আরবী; (১৩) ইবন মাজা, ফুআদ আবদুল বাকী সম্পাদিত, আরবী, বৈরূত, ২ খণ্ডে; (১৪) সুনানুদ দারিমী, আরবী, ফাওয়ায আহমাদ প্রমুখ সম্পাদিত, কাদীমী কুতুবখানা, করাচী, ২ খণ্ড, (১৫) মুওয়াত্তা ইমাম মালিক, আরবী সংস্করণ; (১৬) ইবন মানজুর, লিসানুল আরাব, বৈরূত সং, ৪খ, পৃ. ৩০৩০, কালাম ২ ও ৩।
পাশ্চাত্য উৎস : (১) বাইবেল, সংশ্লিষ্ট অধ্যায়, যাহা নিবন্ধ গর্ভে উদ্ধৃত হইয়াছে; বাংলা, আরবী ও উর্দু তিন ভাষার বাইবেলের সমন্বয়ে বক্তব্য নকল করা হইয়াছে; (২) বাইবেল ডিকশনারী, ইংরেজি বাইবেলের কেমব্রিজ সংস্করণের পরিশিষ্ট আকারে মুদ্রিত; (৩) Colliers Encyclopedia, ১৩ খ, নিউইয়র্ক; (8) Americana, ১৫খ, পৃ. ৬৫৫, ৫৩৮; (৫) The Encyclopedia of Religion, ম্যাকমিলান কোম্পানি, নিউ ইয়ার্ক; (৬) The Historians History of the world, logos press, New Delhi, Repr. 1987, vol. 2, P 2-3; (7) Encyclopaedia Britannica, 1962, Xll, P. 856-7.